Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সুবর্ণলতা – আশাপূর্ণা দেবী

    আশাপূর্ণা দেবী এক পাতা গল্প627 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ২.১৪ গিরি তাঁতিনী এসেছে

    গিরি তাঁতিনী এসেছে তাঁতের শাড়ির বোঁচকা নিয়ে। ভালো ভালো সিমলে ফরাসডাঙার শাড়ি নিয়ে গোরস্তর বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ানো কাজ গিরির। উত্তর কলকাতা থেকে মধ্য কলকাতা পর্যন্ত সর্বত্র তার অবাধ গতি। সকলের অন্তঃপুরের খবর তার জানা।

    দর্জিপাড়ার অনেক বাড়িতেই তার যাতায়াত। মুক্তকেশীর সংসারেও শাড়ি যুগিয়ে এসেছে বরাবর-বিয়েথাওয়ায়, পূজোয়। গিরি যে বাজারের থেকে দাম বেশি নেয় সে কথা সকলের জানা, মুক্তকেশী তো মুখের উপরেই বলেন, গলায় ছুরি দিচ্ছিস যে গিরি? কাপড়খানা বড্ড পছন্দ হয়েছে বুঝেই বুঝি মোচড় দিচ্ছিস! তবু সেই বেশি দামেই নেনও। কারণ আরও এক কারণে সর্বত্রই গিরির প্রশ্ৰয় আছে।

    আর একটা ব্যবসা আছে গিরির।

    সেটা হচ্ছে ঘটকীগিরি!

    কাপড় যোগানোর সূত্রে গিরি বহু সংসারের নাড়ীনক্ষত্রের খবর রাখে বলেই কাজটা তার পক্ষে সহজ।

    তবে ইদানীং যেন সে ব্যবসায় কিছু কিঞ্চিৎ টিমে পড়েছে।

    ঘটকী দিয়ে বিয়ের সম্বন্ধ করতে কেউ আর তেমন গা করে না। সবাই স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে, নিজেরাই চেনাজানার ধরে কিংবা কাজকর্মের বাড়িতে দেখাশোনার সুযোগ ধরে বিয়ের সম্বন্ধ গড়ে ফেলে, কারণ রা নাকি মিছে কথা কয়।

    শোনো কথা!

    মিছে কথা। নইলে বিয়ে হয়?

    হয়কে নয়, নয়কে হয়, রাতকে দিন, দিনকে রাত, কানাকে পদ্মলোচন, আদ্যোভক্ষ্যকে শাঁসালো, আর আবলুশ কাঠকে চাপাফুল বলতে না পারলে আবার ঘটকালির মাহাত্ম্য কি?

    কথায় বলে লাখ কথা নইলে বিয়ে হয় না। তা সেই লাখ কথায় দশ-বিশ হাজার অন্তত মিছে কথা থাকবে না? যা সত্যি তাই যদি বলে, তা হলে ঘটক বিদায়টা কি মুখ দেখে দেবে লোকে? কিন্তু লোক যেন আর বুঝছে না। সে কথা! কাজেই গিরির দ্বিতীয় ব্যবসা কিছু টিমে!

    চিমে পড়েছে, তবু শাড়ির বস্তা নামিয়ে পা ছড়িয়ে বসে দোক্তার কৌটো খুলতে খুলতে গিরি বলে, সেজবৌদিদি ছেলের বিয়ে দেবে না নাকি গো? তোমার বড় খোকার বয়েসে যে সেজবাবু দু ছেলের বাপ হয়েছিল গো!

    নামে নামে মিল আছে বলে গিরিবালার সঙ্গে গিরি তাঁতিনীর যেন রঙ্গরস বেশি।

    তাছাড়া ইচ্ছেমত দু-পাঁচখানা শাড়ি কিনে ফেলার ক্ষমতা গিরিবালার যেমন আছে, ছোটবৌ বিন্দুর তেমন নেই, তাই গিরিবালার ঘরের সামনেই তাঁতিনী গিরির পা ছড়িয়ে বসার জায়গা।

    বিন্দু যে এক-আধখানা নেয় না তা নয়, তবে সেও তো সেই বাকিতে।

    গিরিবালার অনেকটাই নগদ।

    অতএব গিরি তাঁতিনীর রসের কথা এখানেই ঢেউ তোলে বেশি।

    সেজবাবুর অতীত ইতিহাস তোলার সঙ্গে এমন একটি মুখভঙ্গ করে গিরি, যা নাকি নিতান্তই অর্থবহ।

    গিরিবালাও তেমনি একটি অর্থবহ কটাক্ষ করে বলে, ওতে তো আর পয়সা লাগে না লো, হলেই হলো। একালে দিনকাল খারাপ, বৌ এসে কি খাবে সেটা আগে চিন্তা করতে হবে।

    তা হবে বৈকি! গিরি একটিপ দোক্তা মুখে ফেলে বলে, বৌয়ের শাউড়ী যখন সব্বস্ব গ্রাস করে রেখেছে! তা তুমি বুঝি মেজবৌদিদির পাঠশালে পড়েছ? তিনিও তো ওই কথা বলে বলে এই অবধি ছেলে দুটোর বে তুলে রেখেছিল। কী সুমতি হলো, জোড়া বেটার বে দিল।

    গিরিবালা সহাস্যে বলে, ঘটকী বিদেয় মোটা পেয়েছে তো?

    তাই সেও সহাস্যে বলে, তা হক কথা বলবো বাপু, মেজগিনীর হাতখানি দরাজ আছে।

    গিরিবালা সহসা প্ৰসঙ্গ পরিবর্তন করে বলে ওঠে, তা বোঁচকার গিট খোলো! দেখি কি এনেছ! নতুন ধরনের কিছু আছে?

    গিরি কবে নতুন ছাড়া পুরনো মাল এনে ঢুকেছে গো— বলে সগৰ্ব ভঙ্গীতে বোঁচকা খোলে গিরি।

    মুক্তকেশীর আমলে মোটা তাতের শাড়ির চাহিদাই বেশি ছিল, এখন সিমলে শান্তিপুরে ফরাসডাঙ্গার চাহিদা।

    কিন্তু মুক্তকেশী?

    তিনি গত হয়েছেন? তাই তার আমলও বিগত?

    না, দেহগত হিসাবে গত হননি। অবশ্য মুক্তকেশী, তবে তাঁর আমলটা যে একেবারই গত হয়েছে, তাতে সন্দেহ নাস্তি।

    গিরি ঢুকেই একবার চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করেছিল, বুড়ী কোথায়?

    বোঁচকার গিঁট খোলে গিরি, কিন্তু আবরণ উন্মোচন সহজে করে না। তাতে সস্তা হয়ে যেতে হয়।

    হাই তুলে বলে, এক ঘটি জল খাওয়াও দিকি আগে। রোদে এসে শরীর জ্বলে যাচ্ছে।

    গিরিবালা তাড়াতাড়ি উঠে দালানের কুজো থেকে এক ঘটি জল গড়িয়ে দেয়।

    গিরি এক নিঃশ্বাসে জলটা খেয়ে আঁচল দিয়ে বাতাস খেতে খেতে বলে, বড়মানুষ হয়ে সেজবৌদিদি কেপ্পন হয়ে গেছে। আমাকে জল দিয়ে পান দিতে হয় তা আর মনে নেই!

    গিরিবালা তাড়াতাড়ি মেয়েকে ডেকে পানের আদেশ দেয়, গিরি ধীরে সুস্থে বোঁচকা খোলে।

    নয়নমনোহর শাড়ির গোছা-কলকাঁপাড়, তাবিজপাড়, রেলপাড়, এলোকেশী পাড়, সিথেয় সিঁদুরপাড়, পতিসোহাগপাড়, বসন্তবাহারপাড়। সাদা ছাড়া রঙিনের দিকেও আছে—কালাপানি, বৌপাগলা, ধূপছায়া, ময়ূরকষ্ঠী। শুধু লাল আর কালো সূতোর টানাপোড়েনেই নানান বর্ণের বাহার।

    দাম বেশি দিয়েও এসব শাড়ি নিতে হয়। দোকান থেকে কেনা মানেই তো পুরুষের পছন্দর ওপর নির্ভর, আর সে পছন্দ যে কেমন তা তো মেয়েমানুষেরা হাড়ে হাড়ে জানে। তার ওপর ফেরাঘোরার কথা বললেই মারমুখী হয়ে ওঠেন। বাবুরা। তা ছাড়া গিরি বাকিতে দেয় বলে লুকিয়েও কেনা যায় এক-আধখানা। এসব কি কম সুবিধে? পরমুখাপেক্ষী জাতের জ্বালা যে কত দিকে!

    তা গিরি এসব খুব বোঝে, তাই জায়গা বুঝে মোচড় দেয়, জায়গা বুঝে উদারতা দেখায়।

    ও খদ্দেরের কাছে অনায়াসে বলে, ও কাপড়ের দাম তোমায় দিতে হবে না দিদিমণি, আমি তোমায় এমনি দিলাম। বলে, বৌদিদির ফরসা রঙে জেল্লা যা খুলবে, এ কাপড় তোমায় একখানা না পরাতে পেলে আমার জেবনই মিথ্যে। দামের কথা ভেবো না বৌদিদি, তোমার শাউড়ীকে বোলো, গিরি আমায় আমনি দিয়ে গেছে।… এইভাবেই গছায় সে।

    গিরিবালা প্ৰসন্নমুখে বলে, কাপড় তো বেশ এনেছো, এখন দয়া করো দিকি?

    দর! তোমার সঙ্গে আবার দরাদরি কিগো, সেজবৌদিদি, আজ নতুন হলে নাকি?

    না না ঠাকুরঝি, তুমি আমায় একটু আশ্বাস দাও। পছন্দ করতে ভরসা পাই।

    শোনো কথা! তোমার আবার নির্ভরসা! গিরি অবহেলায় বলে, বড়মানুষের গিন্নী, ট্যাকার গোছা ফেলো, কাপড়ের গোছা পছন্দ করো! সাতহাতি আট-হাতি সব রকমই আছে, খুকীদের জন্যে নাও দিকি দু-পাঁচখানা। কই গো খুকীরা—

    গিরিবালা তথাপি কাপড় নাড়তে নাড়তে দাম জিজ্ঞেস করে, এবং জবাব পাবার পর অপ্ৰসন্ন গলায় বলে, দেবো না তাই বল! দেবার ইচ্ছে থাকলে এমন দর হাকতে না! বলি ও বাড়ির তিনতিনটে বিয়েতে তো বিস্তর লাভ করেছ। সে হল বড়মানুষের ব্যাপার, এই গরিবের সঙ্গে একটু দয়াধর্ম করে কাজ করো না!

    গিরি দরাজ গলায় বলে, তা মিথ্যে বলবো না, অনেক কাপড়-চোপড় নিয়েছে মেজবৌদিদি, তবে মানুষটার প্রাণে যেন সুখ নেই!

    গিরিবালা ভিতরের কথার আশায় গলা নামিয়ে চুপিচুপি বলে, ওমা র্যার এত সুখ সম্পত্তি, তার আবার সুখের অভাব!

    গিরি বলে, তা একো একো মানুষের অকারণ দুঃখ ডেকে আনা রোগ যে। মেজবৌদিদির তো সে রোগ আছেই। তাছাড়া মনে হলো বৌরা সুবিধের হয়নি—

    গিরিবালা যেন জানে না, কথা সৃষ্টি করার এই লীলাই গিরি তাঁতিনীর পদ্ধতি, অথবা কারো ঘরে বৌ সুবিধের না হওয়াটা যেন অসম্ভব ঘটনা, তাই যেন আকাশ থেকে পড়লো।

    ওমা সে কি কথা! তবে যে শুনলাম খুব ভালো বৌ হয়েছে!

    ওগো দেখতেই ভালো। ওপর ভালো, ভেতরে কালো। তা নইলে ঘরুনী গিন্নী দস্যি মাগী এক্ষুনি বৌদের হাতে সংসার ছেড়ে দেয়া!

    ওমা বল কি? তাই বুঝি?

    তাই তো— গিরি দুই হাত উল্টে বলে, তবে আর বলছি কি! মাগী নাকি এখন রাতদিন খাতা-কলম নিয়ে সেরেস্তার মতন নেখা নিখছে।

    তা এসব কথা বললে কে তোমাকে?

    কে আর! মেজদাদাবাবুই রাস্তায় এল সঙ্গে সঙ্গে, নানান দুঃখের গাথা গাইল। বৌরা শ্বশুর বলে তেমন মান্যিমান করছে না, শাউড়ীকে দেখে না, আরো একটা মেয়ে ডাগর হয়ে উঠলো, এই সব!

    কথা ক্রমশই গম্ভীর হয়ে আসে, গিরিবালা ইত্যবসরে খান্নতিনেক শাড়ি পছন্দ করে ফেলে এবং বাকির প্রশ্নও ওঠে না। তবে ও বাড়ির মেজবৌদিদির কাছেও যে ধারে কারবার করতে হয় না, সেই হুলটুকু ফুটিয়ে বোঁচকা গোটায় গিরি।

    এই সময় ঘর থেকে মুক্তকেশীর ভাঙা-ভাঙা কণ্ঠস্বর শোনা যায়, গিরি এসেছিস নাকি? অ গিরি!… সেই থেকে গলা পাচ্ছি মনে হচ্ছে, এদিকপানে উঁকিও দিচ্ছিস না দেখছি!

    ওই হলো জ্বালা–গিরি খাদের গলায় বিরক্তিটা প্ৰকাশ করে গলা তোলে, এই যাই গো খুড়ি, এখানে সেজবৌদিদি কাপড় কিনলো পাঁচখানা, তাই—

    পাঁচখানা! পাঁচখানা কাপড় কিনলো। সেজবৌমা! তা কিনবে বৈকি! সোয়ামীর পয়সা হয়েছে—

    মরণ বুড়ী! বলে গিরি ও-ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, আর তৎক্ষণাৎ তার কাংস্যকণ্ঠ ধ্বনিত হয়, কী সববোনাশ, এ কী হাল হয়েছে তোমার খুড়ি! ঐ্যা, এ যে মড়িপোড়ার ঘাটে যাবার চ্যাহারা! বলি কবরেজ বদ্যি দেখাচ্ছে বেটা বেটার বৌ?

    এই।

    এই হচ্ছে গিরির নিজস্ব ভঙ্গী। আর তাই সবাই গিরিকে ভয় করে।

    গিরি যে অন্তঃপুরের বার্তা রাখে। তার বাড়া ভয়ঙ্কর আর কি আছে?

    মুক্তকেশীর ছেলে, ছেলের বৌরা যে দেখছে না, এখন রটিয়ে বেড়াবে না। সে? তাই গিরিবালাও তাড়াতাড়ি শাশুড়ীর ঘরে এসে ঢোকে।

    মুক্তকেশী নীচু গলায় কিছু একটা বলছিলেন, বৌকে ঢুকতে দেখে বেজার মুখে চুপ করেন। শুধু চোখের ইশারায় কি যেন বুঝিয়ে বিদায় সম্ভাষণ করেন।

     

    তা গিরি তাঁতিনী ইশারার মান রাখে।

    পরদিনই এ বাড়িতে এসে হাজির হয়।

    এবং সাড়ম্বরে ঘোষণা করে, কাপড় গছাতে আসিনি গো মেজবৌদিদি, এসেছি। একটা বাত্রা নিয়ে।

    সুবৰ্ণলতা বেরিয়ে আসে, প্রশ্ন করে না, শুধু সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায়।

    গিরি বলে ওঠে, বলি বুড়ী শাউড়ীর খবর নাওনী কতদিন?

    সুবৰ্ণ অবাক গলায় বলে, কেন? ইনি তো মাঝে মাঝেই-

    হ্যাঁ, তা শুনলাম। গিরি টিপে টিপে বলে, মেজদাদাবাবু পেরায় পেরায় যায়! তবে বেটা ছেলের চোখ কি তেমন টের পায়! বুড়ীর তো দেখলাম শেষ অবস্থা।

    তার মানে?

    মানে আর কি, রক্ত অতিসার। গিরি যেন যুদ্ধজয়ের ভঙ্গী নেয়, ও আর বেশিদিন নয়। আর মরতে তো একদিন হবে গো! চেরকাল কি থাকবে? বয়সের তো গাছ-পাথর নেই, কোন না চার কুড়ি পেরিয়েছে। তা আমায় মিনুতি করে বললে, মেজবৌমাকে একবার আসতে বলিস গিরি, আর আসবার সময় নুকিয়ে পাকা দেখে দুটো কাশীর প্যােয়রা আনতে বলিস।

    পেয়ারা! সুবর্ণ বলে, রক্ত-অতিসার বললে না?

    আরে বাবা, হলো তো বয়েই গেল। বলি খাওয়ায় সাবধান করে শাউড়ীকে আরো বাঁচিয়ে রাখতে সাধা! না। তাই পারবে? মহাপ্ৰাণীর খেতে ইচ্ছে হয়েছে, দেওয়াই দরকার। বাঁচবার হলে ওতেই বেঁচে থাকবে।

    সুবৰ্ণ অবাক হয়ে তাকায়।

    সুবৰ্ণ ভাবে, এরা কত সহজে সমস্যার সমাধান করে ফেলতে সক্ষম! রাখে কেষ্ট আর মারে কেষ্টর তথ্যে এরাই প্রকৃত বিশ্বাসী।

    সুবৰ্ণর ভাবার অবসরে গিরি। আর একবার বলে, তা প্যায়রা নে যাও আর না যাও, যেও একবার! বুড়ী মেজবৌমা মেজবৌমা করে হামলাচ্ছে!

    যাবো, কালই যাবো!

    গিরি হৃষ্টচিত্তে বলে, অবিশ্যি আজই একটা কিছু ঘটে যাবে তা বলছি না। তবে এ যাত্রা যে আর উঠবে না বুড়ী, তা মালুম হচ্ছে।

    গিরি চলে যায়, সুবর্ণ কেমন অপরাধীর মত বসে থাকে। বাস্তবিক, বড় অন্যায় হয়ে গেছে। বহুদিন যাওয়া হয়নি বটে। সেই কতদিন যেন আগে নিজেই এসেছিলেন মুক্তকেশী, সেই শেষ দেখা।

    মেজবৌমাকে দেখতে চেয়েছেন মুক্তকেশী আর সে খবর জানিয়েছেন। জগতে কত অদ্ভুত ঘটনাই ঘটে!

    মুক্তকেশী সুবৰ্ণলতার প্রতিপক্ষ।

    মুক্তকেশী সুবৰ্ণলতাকে বহুবিধ যন্ত্রণার স্বাদ যুগিয়ে এসেছেন চিরদিন, তবু মুক্তকেশী সুবৰ্ণকে দেখতে চেয়েছেন শুনে যেন মনটা বিষণ্ণ বেদনাবিধুর হয়ে উঠলো।

    হয়তো ব্যাপারটা হাস্যকর, তবু নির্ভেজাল। শক্ৰ যদি শক্তিমান হয়, তার জন্যেও বুঝি মনের কোনোখানে একটা বড় ঠাঁই থাকে। রাবণের মৃত্যুকালে রামের মনস্তত্ত্ব এ সাক্ষ্য দেয়।

     

    বহুকাল হলো এ বাড়িতে আসে নি। সুবর্ণ।

    আগে মাঝে মাঝে ভাসুরবি-দ্যাওরঝিদের বিয়ে উপলক্ষে আসা হতো, ইদানীং যেন বিয়ের হুল্লোড়টাও কমে গেছে। তাই আর হয় না।

    কিন্তু এসে যে মুক্তগেশীকে সত্যিই একেবারে মৃত্যুশয্যায় দেখতে হবে একথা কে ভেবেছিল? সংবাদদাত্রী তো আশ্বাস দিয়েছিলো-আজি-কালই আর কিছু হচ্ছে না!

    কিন্তু হঠাৎ গতরাত্রেই নাকি অকস্মাৎ কেমন বিকল হয়ে গেছেন মুক্তকেশী। মুখ দিয়ে ফেনা কাটছিল, গো গো শব্দ শুনে মল্লিকা তাড়াতাড়ি সবাইকে ডেকেছে। রাত্রে তার হেফাজতেই তো থাকেন মুক্তকেশী।

    ডাক শুনে সবাই এসেছে, ছেলেরা শত-সহস্রাবার মা মা ডাক দিয়েছে, মুক্তকেশী শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছেন, সাড়া দিতে পারেননি। সকাল হয়েছে, দুপুর গড়ালো,একই অবস্থা। কবরেজ এসে দরাজ গলায় সুবোধকে বলে গেছেন, আর কি, এবার কোমরে গামছা বাঁধুন।

    সুবৰ্ণ এসব জানতো না, সুবর্ণ এমনিই এসেছিল।

    গাড়ি থেকে নেমে গলিটুকু হেঁটে আসতেই হাঁপাচ্ছিল সুবর্ণ। এসে বসতেই বিরাজ চোখ বড় বড় করে বলে উঠলো, ওমা এ কী, তোমার এমন চেহারা হয়েছে কেন মেজবৌ?

    সুবৰ্ণলতার হাঁপ ছেড়ে ওর কথার উত্তর না দিয়ে প্রশ্ন করলো, মা কেমন আছেন?

    আর থাকাথাকি–, বিরাজ আবার কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলে, কবরেজ তো বলে গেল রাত কাটে কিনা!

    তা আমাদের ওখানে তো একটা খবরও—

    হঠাৎ গলাটা বুজে এল সুবর্ণর।

    চুপ করে গেল।

    ঘরে যারা ছিল তারা কি একবার ভাবল না, মাছের মায়ের পুত্ৰশোক! অথবা মাছ মরেছে বেড়াল কাঁদে–

    তা ভাবলে অসঙ্গতও হবে না।

    তবে মুখে কেউ কিছু বলে না।

    বিরাজই আবার বলে, দিত খবর, আমায় তো দিয়েছে! কিন্তু মার না হয় যাবার বয়েস, চার ছু কাঁধে চড়ে চলে যাবেন, বলি তোমারও যে যাবার দাখিল চেহারা! অসুখ-বিসুখ কিছু হয়েছে নাকি?

    না, অসুখ আর কি!

    বলে সুবর্ণ এগিয়ে যায় মুক্তকেশীর দিকে। খুব ধীরে বলে, মা আমায় ডেকেছিলেন?

    মুক্তকেশীর চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো।

    এই সময় হেমাঙ্গিনী এসে ঢুকলেন। থারথার করতে করতে, চীৎকার করে বলে উঠলেন, মুক্ত চললি? আমায় ফেলে রেখে চলে যাবি?

    মুক্তকেশী ফ্যালফেলিয়ে তাকালেন।

    হেমাঙ্গিনীর কান্নায় উপস্থিত সকলেরও যেন কান্না উথলে এল।

    এসময় শ্যামাসুন্দরীও এলেন একটি পিতলের ঘটি হাতে। খুব কাছে এসে বললেন, চন্নামেত্তর খাও ঠাকুরঝি। মা কালীর চন্নামেত্তর।

    বোঝা গেল সবাইকে খবর দেওয়া হয়েছে, শুধু প্ৰবোধচন্দ্ৰ বাদে।

    সুবৰ্ণলতা নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে।

    বোধ করি মনকে মানাতে চেষ্টা করে, এ অবহেলা তার প্রাপ্য পাওনা।

    মুক্তকেশীর ভিতরের জ্ঞান লুপ্ত হয়নি। চোখের ইশারায় বোঝালেন বুঝতে পেরেছেন, হাঁ। করবার চেষ্টা করলেন, পারলেন না।

    সুবৰ্ণ আর একবার কাছে ঝুঁকে বললো, মা, আমায় কেন ডেকেছিলেন?

    মুক্তকেশীর চোখ দিয়ে আবার দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। চেয়ে রইলেন সুবৰ্ণলতার মুখের দিকে। তারপর আস্তে আস্তে ডান হাতটা তুললেন, সুবৰ্ণলতার মাথা অবধি উঠল না হাতটা, স্থলিত হয়ে পড়ে গেল তারই কোলের ওপর..চোখটা বুজে গেল।

    ঊনআশী বছরের তীক্ষ্ম তীব্ৰ খোলা চোখ দুটো চিরদিনের জন্যে ছুটি পেলো।

    কিন্তুষ্টুটকুৰা অগ্নি কোন কথা জানিয়ে গেল তারা?

    আশীর্বাদ! ক্ষমা প্রার্থনা!

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Article১০টি কিশোর উপন্যাস – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article বকুলকথা – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    আশাপূর্ণা দেবী

    বিবাগী পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    কুমিরের হাঁ – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ঠিকানা – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ততোধিক – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ১. খবরটা এনেছিল মাধব

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }