প্রথম ম্যমী • মাণিক্য বন্দ্যোপাধ্যায়
ধূসর অতীতের এক স্নিগ্ধ রৌদ্র-সুষমায়িত প্রভাতে এক সুদর্শন যুবা পুরুষ সবুজ পাহাড়ের কঠিন গা বেয়ে ক্ষিপ্রবেগে উঠছিল। চারিদিকে কঠিনতম শিলারাশি—গাঢ় সবুজ আর ফিকে হলুদ বৃক্ষরাজিতে বনতল উজ্জ্বল। যুবকের মস্তকের আকার স্থানীয় মানুষের মতো লম্বাটে নয়—গোল। সুকুমার মুখমণ্ডল চওড়া—শরীরের বাঁধুনি অতি সমৰ্থ—তবুও যুবার কমনীয় কান্তি দেখে তাকে শিকারী বা বনচারী মনে না হয়ে শিল্পী বলে ভ্রম হয়। ওর হাতে চকচকে পাথরের দীর্ঘ একটা কৃষ্ণ ভল্ল। ঘনকৃষ্ণ কেশদাম মাঝে মাঝে পাহাড়ের নাতিদীর্ঘ গাছের লতাপাতায় জড়িয়ে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছিল। চোখের পরিষ্কার দৃষ্টি সদা জাগ্রত হলেও অপরূপ এক মমতা মাখানো। যুবক তার স্বহস্ত নির্মিত বিচিত্র এক বন্য লতাজাত জালিকার সাহায্যে কয়েকটি নিরীহ প্রাণী শিকার করল। অসীম স্নেহে সে প্রাণী ক’টিকে বুকে জড়িয়ে নোমের দিকে ফিরল। নোমে (বা গ্রামে) বৃদ্ধা মা, ভগিনী তার অপেক্ষায় আছে।
এরপর যুবক অসিরাকে যেতে হবে নোমের পশ্চিমদিকের জলায়। এখনও সেখানে বীজ বপনের কাজ পূর্ণ হয় নি—অথচ শূকরগুলো জমি খুঁড়ে সব পোকা খেয়ে ফেলেছে। অসিরা আকাশের দিকে চাইল—সমস্ত আকাশটা ঘন কালো হয়ে উঠেছে। দেবতা রে বিদায় নিয়েছেন—দেশের কোন্ স্থানে কোন অমঙ্গলকার্য অনুষ্ঠিত হচ্ছে হয়ত। তাই দেবতা রে এদেশ ত্যাগ করেছেন। মা আর নোমের বৃদ্ধদের এই কথায় অসিরা মনে মনে হাসে। ঐ কালো কালো মেঘগুলো ভয়ানক দেখতে হলেও ওরাই যে তাদের বন্ধু—তা তারা বুঝতে চাইবেন না।
অসিরা তাড়াতাড়ি বাড়ী ফিরে এল। ভগিনী ইমানি ছুটে এল। ওর হাতে একতাল থকথকে মাটি। ও জানে অসিরা এখন ঐ মাটি দিয়ে অদ্ভুত সব মূর্তি তৈরি করবে। অসিরাকে ইমানির বিচিত্র লাগে। ও যুদ্ধে যেতে চায় না—শিকারে গিয়ে জন্তুগুলোর গায়ে বর্শা মারবে না—শত্রুকে ও প্রাণ দান করবে—আশ্চর্য পাথরের গায়ে দাগ কাটে… আর কি মজা… ঐ সব আঁচড় মিলে মিলে এক-একটা প্রাণী… মানুষ তৈরি হয়ে যায়! গাছ কেটে এনে ও রোদে শোকায়… তারপর ঐ কাঠের ওপর দাগ কাটে। বনে বনে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায় কিসের লোভে লোভে কে জানে।
অসিরার হাতে মাটির তাল দিয়ে ইমানি বলল— ‘সিরা, গ্রামণী আজও এসে বলে গেছেন যে তুমি যেন নীল পাহাড়ের ওপারে আর কোনোদিন না যাও। কারণ, সেখানে দেবতা ভর করেছেন বিশাল এক পক্ষীর ওপর। কোনো ‘কেম’-বাসী সেখানে গেলে তিনি রাগ করবেন… তাতে আমাদের শস্যক্ষেত্রের ওপর আর জলদান করবেন না। চারিদিকে নাকি অনাচার শুরু হয়েছে, তাই জল-দেবতা শ্যামল শস্যক্ষেত্রের ওপর থেকে ধীরে ধীরে কেশদেশ ছাড়িয়ে উত্তর-পূর্ব কোণে চলে যাচ্ছেন।’
আসিরা মাটি রেখে ইমানির কাছে এল। বলল—‘মানি, তুমি ওই গ্রামণী বা থৎ-পুত্রের কথা বিশ্বাস কোরো না। থৎ-পুত্র কিছু জানে না… মিছিমিছি গ্রামের পুরোহিত হয়ে বসে বসে শস্যে ভাগ বসাচ্ছে।’
ইমানি ক্ষিপ্রবেগে অসিরার মুখে হাত চাপা দিল—‘কেউ শুনলে বিপদ হবে! একি অসম্ভব কথাবার্তা!’
.
অসিরা তীক্ষ্ণ পাথরের টুকরোটি তুলে নিয়ে পরম যত্নে মাটির মূর্তিটির গা থেকে অনাবশ্যক অংশ চেঁচে ফেলছিল। মূর্তিটি ক্রমশই ইমানির নিজেরই রূপ পাচ্ছিল দেখে ইমানি চরম বিস্ময়ে আনন্দে ছুটে গিয়ে বৃদ্ধা মাকে খবর দিল। বৃদ্ধা মা ছেলেমেয়েদের এই সব অ-কাজ বেশী পছন্দ করেন না। তিনি তাঁর প্রিয় বানর আর কাঠের বর্শাটি নিয়ে চললেন শ্যামল জলাভূমি সাহারার বন-তলে। ফল সংগ্রহ না করলে কি খাবে তারা। অসিরা তো দিন-রাত ঐ সব আঁকা, দাগ কাটা নিয়েই ব্যস্ত। ওর শরীরে শক্তি সঞ্চার আবশ্যক। গ্রামের শক্তিমান পুরুষ এখন কেউ প্রেতরাজ্যে দেবতার কাছে যাবে… সুতরাং অপেক্ষা করতে হবে। তার একমাত্র ছেলে ও… ওকে শক্তিমান করে তুলতেই হবে।
ইমানি জোর করে ধরে নিয়ে এল অসিরাকে… শ্যামল শস্যক্ষেত্রে। শস্য এখনও পাকে নি। অদূরে তালকুঞ্জ। শস্য যাতে নির্বিঘ্নে পাকতে পারে তার জন্য দেবতার কাছে প্রার্থনা করতে হবে। তার ওপর, এখন নাকি, শ্যামল জলাভূমি সাহারার ওপর দেবতা অসিরিসের ক্রোধ হয়েছে। তিনি বর্ষাদেবতাকে ক্রমশঃ উত্তরপূর্বের অসভ্য মানুষদের জমির দিকে চালনা করছেন।
অসিরা শস্যের গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলল—‘জানো মানি… আমাদের পিতা, পিতামহ এই দেশের মানুষ নন। আমরা এখানে আগন্তুক; দেখো না এরা আমাদেরকে একটু ভিন্ন চোখে দেখে! আমাদের দেশে নাকি এই চায়ের ব্যবস্থা ছিল অন্যরকম। আমরা দেবতা আসিরিসের করুণার জন্য হাত গুটিয়ে বসে থাকতাম না; আমরা আমাদের নেমুনা ও শ্রোবতি নদী থেকে জল আনতাম নদীর গা কেটে খাল করে। এদের দেবতা অসিরিসের গা থেকে নাকি প্রথম যবের চারা বেরিয়েছিল; যত সব মিথ্যা কথা। মহান অসিরিসই প্রথম শস্য উৎপাদন শিক্ষা দিয়েছিলেন… তাই এরকম কাহিনী চলে আসছে।’ ইমানি পরম বিস্ময়ে অনিরার কথা শুনতে লাগল… এ সব আবোল তাবোল কি বকছে অসিরা! ওর ওপর কি মৃত আত্মার ভর হয়েছে। মাঝে মাঝে ও আপন মনে মাঠের দিকে চেয়ে পাহাড়ের দিকে চেয়ে কি সব বিড়বিড় করে… ও বোধহয় মৃত আম্মার সঙ্গে কথা বলে! নইলে এই ধরনের বিচিত্র তথ্য… আশ্চর্যজনক কাজকর্মের নির্দেশ পায় কোত্থেকে?
ইমানি অসিরার হাত চেপে ধরল। বলল—‘চল, মাঠের কাজ শেষ হয়েছে; এবার ‘নোমে’ যাই।’ গ্রামণী বুড়ো নিষেধ করেছে ওই নীল পাহাড়ের ওপর উঠতে। অসিরা কিশোরী ইমানিকে এক লহমায় বাহুদ্বয়ের ওপর তুলে বলল—‘আমি ওসব বাজে কথা মানি না, আমি নীল পাহাড়ে গেলে যে দেবতা রাগ করবে, সে দেবতাকে আমার পূজা বা ভয় করার দরকার নেই। চল… তোমাকে আজ একটা বিচিত্র জিনিস দেখাব, যা আমি এখনও কাউকে বলি নি। জিনিসটা যদি পাই, তবে আর কয়েকদিনের মধ্যেই একটা শক্তিশালী ভল্ল তৈরি করতে পারব। সে অস্ত্র দিয়ে দস্যু যাযাবরদের খুন করব।’
ইমানি প্রথমে ভীত হয়ে নামতে চাইল; তারপরে রোমাঞ্চের আনন্দে পুলকিত হয়ে বলল—‘আমার ভয় করছে সিরা। যদি ঈগল দেবতা রাগ করে?’
ক্ষিপ্রবেগে অসিরা আর ইমানি পাহাড়ে উঠতে লাগল। ইমানির শুভ্র কপালে আঁকা ছিল দেবতা ‘রে’-র চিত্র। ফলের রেণু দিয়ে সারা কিশোরী তনুটি সুষমায়িত; বাহুমূলে বন্য লতার রঙীন রস দিয়ে উল্কি করা ছিল নানারকম। পাহাড়ে উঠতে উঠতে সে সব সজ্জা নষ্ট হল—তবুও কিশোরী ইমানির প্রচণ্ড উৎসাহ। আর অসিরার মন তখন পাথরের কোণে কোণে… রুক্ষ শক্ত মাটির ফাটলের মধ্যে। দুর্গম স্থানেই নাকি রত্নের সন্ধান মেলে। অসিরার গলায় ছিল অস্থিনির্মিত সুন্দর অলংকার; হাড়ের মালা ছিটকে পড়ল পাথরের আঘাতে। ইমানি কুড়োতে লাগল ছিন্ন মালা। অসিরা তখন পাহাড়ের আলগলি খুঁজছে। ছুটে গেল এক সময়; ও পেয়েছে সেই বিচিত্র বস্তুটি। ছোট ছোট আকারে মাটির খণ্ড, পাথরের খণ্ডের সঙ্গে যুক্ত আছে। অসিরা গুহার অন্ধকারে লুক্কায়িত বস্তুখণ্ডটি নিয়ে এল ইমানির কাছে।—‘এই দেখ, মানি, এই দেখ—এর নাম কি জানি না… কিন্তু এই জিনিসের সঙ্গে পাথর মিশিয়ে যদি অস্ত্র তৈরি করি… তা হবে সবচেয়ে তীক্ষ্ণ আর দৃঢ়। তা দিয়ে জংলী রাক্ষসদের হত্যা করতে পারব অনায়াসে।’
পঞ্চদশী ইমানি বিমুগ্ধ বিস্ময়ে অবাক-চাওয়া চেয়ে রইল জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার দুর্বোধ্য চোখের দিকে।
গ্রামের প্রবীণগণ মন দিয়ে শুনল অসিরার কথা। কি বলছে ছেলেটা… পাথরের চেয়ে কঠিন অস্ত্র? আরও মজবুত? আরও তীক্ষ্ণ? সে জিনিস কি? কোথায় পেল ও? নীল পাহাড়ে? ‘সর্বনাশ’-গ্রামণী ভীতিবিহ্বল হয়ে দু’লে উঠল প্রচণ্ড বেগে—কড়ির মালা কেঁপে উঠল গলায়।
— ‘কি বললে? নীল পাহাড়ে? সেখানে তুমি গিয়েছিলে?’ দু’তিনজন বুড়ি ফিসফিস করে বলল—‘ওর চোখ মুখ কেমন কেমন লাগছে। দেখছ না! ও প্রেতাত্মাদের সঙ্গে আহার বিহার শুরু করেছে। সেই জন্য দেখছ না ও ইমানিকে বিয়ে করতে চায় না। বলে, বোনকে কেন বিয়ে করব? আরে, এমন ‘অমঙ্গুলে’ কথাও কেউ শুনেছে আমাদের এই শ্যামল ‘পৃথিবী’তে! বোনকে বিয়ে করবে না তো আর কাকে করবে?’
সকলেই রায় দিল… অসিরা পক্ষীদেবতার বাসস্থানে গিয়ে কি এক বস্তু কুড়িয়ে পেয়েছে, তা নাকি অশুভ; কারণ, এরই পর থেকে তাদের শ্যামল সাহারার নদী নালা তৃণক্ষেত্র শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে। ওকে নোম থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হোক—একেই ওরা বিদেশী, তায় আবার তাদের দেবতাকে জ্বালাতন করেছে; সুতরাং ওকে তাদের ‘সা-পুট’ থেকেও নির্বাসন দেওয়া দরকার। ও ভিন্ন জেলায় চলে যাক।
অসিরার বৃদ্ধা মা ছুটে এল। চিৎকার করে বলল—‘না, না… নোমর্ক, না গ্রামণীও ভাল হয়ে যাবে… আমি ওকে ভাল করে দেব।’
জনতার মধ্য থেকে সহসা দুটি নারীকণ্ঠ বলে উঠল—‘আমি ওকে বিয়ে করব। সুতরাং ও এখন থেকে আমার।..পবিত্র উর্বরা ভূমির মালিক। ওকে নির্বাসন দেওয়া চলবে না!’
—‘কে তুমি সামনে এস!’ গ্রামণী গম্ভীর গলায় আদেশ দিল।
নেমুনা ভীড় ঠেলে অসিরার পাশে এসে দাঁড়াল। নেমুনা নদীর মতোই নেমুনা মেয়ের রূপ। অসিরা মুগ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে রইল… কপালে দেবতার মঙ্গল-টিকা আঁকা। গণ্ডে ফুলের ছাপ… রেণুরাশি ছড়িয়ে পড়েছে বুকের ওপর।
নেমুনার শরীরটি পরম শক্তিশালিনী… ও অনায়াসে একটি পুরুষকে কাঁধে ফেলে ছুটতে পারবে। আসিরার বিমুগ্ধ দৃষ্টি লক্ষ্য করে নেমুনা ওর হাত ধরল। বলল— ‘জানো, অসিরা থাৎ দেবতার আশীষ-ধন্য পুরুষ। তোমরা ওকে চিনতে পারো নি। ও এমন এক বস্তু পেয়েছে যা দিয়ে আমাদের সমস্ত অস্ত্র তৈরি হবে… আর সে অস্ত্র হবে ‘মরণ-হাতিয়ার’।’
অসিরার মা বুড়ী বলে উঠল, ‘গ্রামের সেনা-সর্দার পর্ষুদা প্রেতলোকে যাবে কয়েকদিনের মধ্যেই। ওর নাকি মাথায় আঘাত লেগেছে শিকারে গিয়ে। অসিরাকে
ওর শক্তি দিয়ে দেব… দেখবে অসিরাই হবে সেনা-সর্দার।’
গ্রামণী বুড়োর মেয়ে নেমুনা, সে এসে হাত ধরেছে অসিরার। ওদের বিয়ে হবে… তাহলে তো আর ওকে নির্বাসন দেওয়া যায় না। বরং, ওর আবিষ্কৃত বস্তুটা দেখা যাক! কিন্তু শ্যামল শস্যভূমি দিনে দিনে শুকিয়ে যাচ্ছে কেন? পুরোহিত বলেছে… তাদের পাপে। নিশ্চয়ই রে দেবতা এবং অসিরিস দেবতার অপমান… অসম্মান হয়েছে। তাদের পুজো দরকার বিরাট করে। তার জন্য চাই উৎকৃষ্ট মধুরস, নধরকান্তি মাংসল জন্তু, ভাল শস্য। আর ঈগল দেবতাও নাকি ক্রোধান্বিত হয়েছেন। কী সর্বনাশা তার রূপ… কী ভয়ঙ্কর শক্তি! তাঁকেও সন্তুষ্ট করতে হবে। পাতালের দেবতা ফণাধারীও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। মাটির নীচে চারিদিকে তার অগ্নিফণা বিস্তারিত করছেন—তিনি গর্জন করে পূজা চেয়েছেন।
অসিরা দু’হাত সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলল—‘আমায় তোমরা বিশ্বাস কর। থৎ দেবতা আমায় আশীর্বাদ করে বলেছেন… পুরোহিতের সব কথা মিথ্যা। সে শুধু সম্পদ পাবার জন্য এসব বানিয়ে বানিয়ে বলেছেন।’ —নেমুনার বড় ভাই চিৎকার করে উঠল—‘শ্যামল জলাভূমি শুকিয়ে যাচ্ছে… তা কি মিথ্যা? অনন্ত ফণাধারী মহাদেবতা পাতালে গর্জন করছেন, তা কি মিথ্যা? নীল পাহাড়ের বাজপক্ষীদেবতা মাঝে মাঝে আমাদের নোমে নেমে এসে শিশু, ছোট ছোট জন্তু নিয়ে যান… তাও কি মিথ্যা?’
অসিরা লাফ দিয়ে উঠল—‘না, তা মিথ্যা নয়। সবই সত্যি। এর জন্য আমরা দায়ী নই। শ্যামল শস্যভূমি শুকিয়ে যাবেই, আমরা রোধ করতে পারব না। কারণ উত্তর-পূর্ব পৃথিবীর জংলীদের দেশে শুরু হয়েছে সাংঘাতিক অপ্রতিরোধ্য এক মহাকর্ষণ-যজ্ঞ; সেই যজ্ঞের দারুণ অগ্নি-আকর্ষণে ছুটে যাচ্ছে শ্যামল শস্যভূমির বাতাস। সেই নিদারুণ শীতের রাজ্য নাকি ক্রমে ক্রমে মনোরম বসন্ত-ধামে পরিণত হচ্ছে; শীতের রাজ্যের পাশ দিয়ে যাতায়াতকারী কুম্ভকার ও বণিকদের কাছ থেকে সংবাদ পেলাম। আমরা এতদিন যে পাপ করেছি—তার শাস্তি এমনি ভাবে কঠিন পথে পেতে হবে।’ অসিরার মারাত্মক কথায় শিউরে উঠল সকলে।
—‘আর, বাজপক্ষী-দেবতা—দেবতা নন। তিনি একটি অতিকায় পক্ষীবিশেষ। এবং ঐ পক্ষীর গুহাতেই আছে দামী কয়েকটি বস্তু—যার গন্ধ পাই আমি সেখানে গেলে; তার লোভে আমি প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে ছুটে যাই। মানুষ যখন প্রাণের চেয়েও অন্য কোন বস্তুকে ভালবাসে, তখন সেই বস্তু নিশ্চয়ই জগতের পক্ষে পরম মঙ্গলকারী। ঐ বাজপক্ষীকে ধ্বংস করে ঐ রত্ন আনব।’ নোমের তরুণ-তরুণীরা পর্যন্ত হিস হিস করে উঠল—সর্বনাশ; অসিরা কি মানুষ? ও যে শয়তানের অনুচর; প্রেত-দেবতার সহকারী; নইলে পক্ষীদেবতাকে মারতে চায়? সাহস যখন অপরিণামদর্শী, তখন পতন অনিবার্য। অসিরার জীবন ফুরিয়ে এসেছে। ওকে ‘রে’ দেবতা প্রেতলোকে নিমন্ত্রণ করেছে।
অসিরা আবার বলে উঠল নেমুনার ঘন কালো চোখের দিকে চেয়ে—‘পাতালের অনন্ত ভয়ঙ্কর ফণাধারী দেবতা রেগে যান নি মোটেই! তিনি দেবতাও নন। আমাদের এই মাটির নীচে আছে আগুনময় বস্তু-রাশি। নীল পাহাড়ের এক গভীর গুহা আমায় এই জ্ঞান দিয়েছে। মাটির তলাকার এই আগুন মাঝে মাঝে ওপরে উঠতে চায় বলেই মনে হয় ফণাধারী দেবতা গর্জনা করছেন—আর তখনই শুরু হয় উত্তাল আলোড়ন।’
নেমুনার দাদা এবং আরও কয়েকজন চিৎকার করে উঠল, ‘অসিরা পাগল হয়ে গেছে। ওকে নির্বাসন দেওয়া হোক।’ নেমুনা আবার দৃপ্তভঙ্গিতে এগিয়ে এসে মাঝখানে দাঁড়াল—‘না। ওর প্রাণ আমার প্রাণের সমান; ওর নির্বাসনের অর্থ আমারও নির্বাসন; আমার নির্বাসনের সঙ্গে সঙ্গে—জানবে—নোমের সব মেয়েই নির্বাসনে যাবে। তাছাড়া চারিদিকে দস্যুরা ওৎ পেতে আছে। এ সময় আমরা কি ও রকম ঝগড়া করব! তার চেয়ে অসিরা কি বলছে ভাল করে দেখে আসি চল; কি ওর বস্তু—পরীক্ষায় দোষ কি?’
—‘ঠিক। তাই ঠিক—চল, চল,’… বসে সবাই উঠে দাঁড়াল। গ্রামণী এবং বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা বলল—‘যত দিন যাচ্ছে, ছেলেমেয়েরা কেমন হয়ে উঠছে। আশ্চর্য ব্যাপার সব!’
অসিরা নেমুনার হাত শক্ত করে ধরল—পাহাড়ী পথ বড় বন্ধুর। আশেপাশে বিরাট বিরাট গাছ—হলুদ, গাঢ় সবুজ আর কালো পাতা। ছোট ছোট জন্তু-জানোয়ারগুলো ছুটোছুটি করছে। অসিরার অনাবৃত বক্ষোদেশে ‘রে’ দেবতার করুণা প্রবল বেগে নেমে আসছে, কটিতে বাঁধা ওর আবিষ্কৃত কৃষ্ণ-ধাতুর নির্মিত হাতিয়ার, হাতে দীর্ঘ এক ভল্ল। তীক্ষ্ণ নাকটি সদা জাগ্রত, কখন সেই অদ্ভুত পাথরের গন্ধ ভেসে আসবে। এই বিচিত্র ধরনের পাথরের চুর্ণ বাজপক্ষীর গুহায় ছড়িয়ে আছে। গুহার মধ্যে ভেতরের দিকে আরও তীব্র গন্ধ। মনে হয় পাহাড়ের ঐ অংশে ঐ বস্তুটি আরও আছে। ইতিমধ্যে গ্রামে এবং ‘সা-পুটে অসিরার আবিষ্কৃত কৃষ্ণ-ধাতু এবং নরম শ্বেত-ধাতু নিয়ে হৈ চৈ পড়ে গেছে; সকলে ছুটছে মাটি খুঁড়তে, পাহাড় পর্বত গুহা চষে ফেলছে ঐ ধাতুর জন্য। কী ভয়ানক শক্ত আর তীক্ষ্ণ হয়েছে ঐ সব নূতন অস্ত্রগুলো। শুধু তাই নয়, সা-পুটের তরুণ-তরুণীরা সব অসিরাকে মনে মনে পুজো করছে, কারণ ঐ শ্বেত-ধাতু দিয়ে কি অপূর্ব মনোহরণ অলংকার হচ্ছে, যদিও শ্বেত-ধাতু ঠিক শ্বেত ধাতু নয়, অনেকটা পোড়া মাটির রঙের মতো, ঠিক গায়ের রঙে মিশে যায়, তবুও কি সুন্দর সুন্দর সব আভরণ তৈরি করছে শিল্পীরা। সারা দেশ জুড়ে অসিরার নাম—ও নাকি সব দেবতাদের আশীষ লাভ করেছে; ও থৎ দেবতার পুত্র। কিন্তু প্রাচী-প্রচীনাগণ অসিরার এই সব যুক্তি তর্ক বা নূতন মত মেনে নিতে পারে নি। গ্রামণী বুড়ো মুস্কিলে পড়েছে, কারণ, নেমুনা অসিরার স্ত্রী হয়েছে; অসিরার মতো নেমুনাও ভাই-বোনের বিবাহ পছন্দ করে না।
পাহাড়ে উঠতে উঠতে অসিরা বলল— ‘নেমু, সেদিন যদি তুমি আমায় স্বীকৃতি না জানাতে, তবে বোধ হয় এতদিনে আমাকে এই নীল পাহাড়েই ভীষণ বাজপাখীর কবলে পড়তে হত।’ অসিবার কথায় নেমুনা হেসে উঠল—‘ও, তবে যে বড় বীরত্ব দেখাচ্ছিলে… আমি পাখীটাকে হত্যা করব!’—অসিরা নেমুনাকে আরও শক্ত হাতে ধরে বলল—‘এই হাতে অলংকার গড়ি আর চিত্র আঁকি বলে কি জোর নেই ভেবেছে? আজই দেখবে তার পরিচয়! পাখীটার আসবার সময় হয়েছে, আমিও প্রস্তুত।’
নেমুনা হঠাৎ অসিরার হাত ছাড়িয়ে সামনে ছুটে গেল,—বলল, ‘আমিই কি ভীতু নাকি! আমিও তোমার পক্ষীদেবতাকে ভয় করি না! আমিও গ্রামণী বুড়োর মেয়ে।’—অনিরা হেসে বলল—‘উঁহু। তোমার এ সব কাজ নয়। তোমার কাজ মাটির পাত্র তৈরি করা, কাঠ দিয়ে ফল সংগ্রহ করা, আমি যা শিকার করে আনব—তা সিদ্ধ করে আমায় খেতে দেওয়া, আর এই নরম হাত দুটি দিয়ে আমাকে আদর করা।’
নেমুনা মাথা দুলিয়ে রমণীয় ভঙ্গিতে তনুশরীরটি অসিরার বুকের ওপর এলিয়ে দিয়ে বলল—‘ইস, আমায় ভারী বয়ে গেছে তোমায় আদর করতে।’
নেমুনার কথা শেষ হতে না হতেই হঠাৎ দুরে—নীল পাহাড়ের চুড়ায় ওপার থেকে ভেসে এল অসিরার পরিচিত এক গর্জন। নেমুনা চমকে উঠে অসিরাকে জড়িয়ে ধরল স্বাভাবিক ভয়ে। অসিরা চাপা স্বরে বলল—‘আমার পিছনে এসে দাঁড়াও! বাজটাকে আমরা এখনই আক্রমণ করবো না। ওর গুহায় আগে যাক—সেখানেই ওকে ধ্বংস করব।’
ওরা দেখল বাজটা চক্রাকারে ওদেরই মাথার ওপর ঘুরছে। সর্বনাশ! তবে কি বাজটা আক্রমণ করবে? নেমুনা কম্পিত বুকে অসিরার গা ঘেঁষে রইল। কৃষ্ণ-ধাতুর বল্লমটা জোর করে ধরল অসিরা। নেমুনাকে সমুখে ঠেলে দিয়ে বলল—‘তাহলে ওই বাজপক্ষীর ধ্বংসকার্য এখনই শেষ করব। তুমি ওর দৃষ্টিপথের মধ্যে গিয়ে দাড়াও। ভয় পেয়ো না—আমার এই বল্লম ভীষণ মারণ অস্ত্র।’
নেমুনা হেসে বলল—‘তোমার স্ত্রী হয়ে ভয় পেলে চলবে কেন? তবে দেখো—বল্লম যেন না ব্যর্থ হয়!’
চারিদিকের গাছপালার পাতার সির সির শব্দ ছাপিয়ে ভয়ঙ্কর বিরাট বাজটার ডাক শোনা যাচ্ছিল। বোধ হয় ক্ষুধার্ত। অসিরা ফাঁকা জায়গা বেছে নিয়ে দাঁড়াল। ওই দেখা যাচ্ছে বাজটার গুহা। এখানকার সম্পদ তাকে পেতেই হবে!
নেমুনা ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে খোলা জায়গাটুকুতে দাঁড়াল। বাজটার চেহারা দেখে ভয়ে ওর রক্ত হিম হয়ে এল—ইস! কী বিকট দর্শন! পায়ের নখগুলো যেন প্রেতদেবতার ডাণ্ডা! কর্কশ ঠোঁটটা ঝুলে পড়েছে অনেকখানি—স্বয়ং রে দেবতা যেন বিকৃত ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন।
বাজটাও ধীরে ধীরে পাখা নেড়ে নেমে এল নেমুনার শরীরের তাজা মাংসের লোভে। ওর মাথার একহাত ওপরে থাকতেই শিকারী অসিরার অব্যর্থ ভল্ল সাহারার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের বেগে ধেয়ে এল। নেমুনা ছুটে চলে এল অসিরার কাছে—ওরা দেখল অদ্ভুত রকম তীক্ষ্ণ ঐ বল্লমের অগ্ৰদেশ বিকট বাজটার পেটের এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে। প্রচণ্ড মরণ-চিৎকার করে বাজটা মাটিতে পড়ে গেল। বিশাল ডানা দুটোর আন্দোলনে আশেপাশের ছোট ছোট শিশুগাছ লুটিয়ে পড়ল। পাথরের খণ্ড ছিটকে পড়ল নীচে। শিউরে উঠে অসিরাকে বলল—‘চল, বাড়ী চল; এ দেখতে ভাল লাগছে না।’ —অসিরা পরম স্নেহে নেমুনার পিঠে হাত রেখে বলল—‘ওটাকে গুহার মধ্যে রেখে দিই, নইলে জন্তু জানোয়ার শেষ করে ফেলবে। এটার শক্ত হাড় আর দাঁতগুলো দরকার; অনেক কাজ হবে। তাছাড়া এটার হৃৎপিণ্ডও নাকি আমাদের বৈদ্য-বুড়োর কাজে লাগে।’
ওরা ধরাধরি করে রক্তাক্ত বাজটার মরা দেহটাকে টেনে টেনে নিয়ে এল গুহার মধ্যে। গুহার মুখে পাথর চাপা দিয়ে চলে এল; সন্ধ্যার অন্ধকারে নেমে এসেছিল পাহাড়ে পাহাড়ে।
ওরা নেমে এসে পৌঁছতেই শুনল সেনা-সর্দার মারা গেছেন। তাঁকে মাটির নীচে শুইয়ে দিতে হবে। ইঁট পোড়ানো শুরু হয়ে গেছে। অসিরার মা ছুটে এল ঘরে। অসিরাকে সেনা-সর্দারের শক্তি লাভ করাতে হবে। অসিরা মাকে কাছে টেনে এনে আনন্দিতস্বরে সব ঘটনা বলল। বুড়ী ভয়ে বিস্ময়ে আড়ষ্ট হয়ে এল শুনতে শুনতে। সর্বনাশ! হতভাগাটা পক্ষী-দেবতাকে বধ করেছে। একি সর্বনাশা কাজ—গাঁয়ের লোকে শুনলে যে ক্ষেপে যাবে!
নেমুনা হেসে বলল— ‘কিন্তু মা, ও কি সত্যিকারের দেবতা? ও যে আমাদের নোমের কত শিশু হত্যা করেছে—আমাদের পরম উপকারী ছাগল জন্তুগুলোকে খেয়ে ফেলেছে, তার প্রতিশোধ নেওয়া হল, এ তো ভালোই হল। আমাদের অনিষ্টকারী বৈরীর বিনাশ করল। অসিরা।’
বুড়ী নেমুনার চোখে চোখ রেখে রাগতস্বরে বলল—‘ওর সঙ্গে মিশে মিশে তুইও
হতভাগী হয়ে উঠেছিস। যাক্, কাউকে বলিস না এসব। এখন চল—সেনা-সর্দারের প্রেত-কর্ম বাকী আছে—এখনই শুরু হবে।’
নোমের শেষ প্রান্তে পাহাড়ের শুরু। চারিদিকে ছোট বড় নানা আকারের পাথরখণ্ড ছড়িয়ে আছে। গাঢ় সবুজ আর হলুদ লতাপাতা গাছে জায়গাটা বর্ণময়। এরই মধ্যে মাটি খুঁড়ে সেনাসর্দারের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। আনা হয়েছে শস্যভাণ্ড, মধু, সেনাসর্দারের প্রিয় অস্ত্র। বিরাট গর্তের চারপাশে একে একে সাজানো হল সব। মাঝখানে সর্দারকে রাখা হবে। ওর আত্মা এখানেই থাকবে। মানুষের আত্মা তার সঙ্গে সঙ্গেই থাকে; কোথাও যায় না! অনন্তকাল ধরে সর্দার সূক্ষ্মদেহে এখানে বাস করবে। তাই তার জন্য চাই খাবার। উপযুক্ত আশ্রয়, বস্ত্র—সব কিছুই প্রয়োজন। পৃথিবীর জীবন তো ক্ষণস্থায়ী, আজ আছে কাল নেই—কিন্তু প্রেতরাজ্যের জীবন যে সীমাহীন—সেখানে মহাকালের কোনো ছেদ নেই। সেখানে মানুষ অজেয়-অমর। অসিরা সর্দারের মুখ দেখতে পাচ্ছিল পাশের আগুনের আভায়। সর্দারের আত্মার কি কোন কষ্ট হচ্ছে? ওঁর প্রেত কি মৃত শরীরটার দিকে চেয়ে ভাবছে না—‘এই দেহ যে একদিন গলে পচে যাবে। মাটির কীট এসে কুরে কুরে খেয়ে ফেলবে; তখন আমি কোথায় থাকব?’
অসিরা গম্ভীর হয়ে উঠল একথা চিন্তা করে। সর্দারের দেহটা পচে গিয়ে একদিন শেষ হয়ে যাবে। তখন তাঁর সমস্ত জীবনে যে অসীম যন্ত্রণার সৃষ্টি হবে। তবে? এর কি কোন প্রতিকার নেই! ওঁর ‘কা’ কি ধ্বংস হয়ে যাবে?
পুরোহিতের সঙ্গে সকলে মিলে প্রার্থনা-চিৎকার শুরু করল—‘হে প্রেত-দেবতা, তুমি সর্দারকে নিজের অধীনে যত্নে রাখো, আমরা তোমার নিত্য পুজো দেব। হে রে-দেব, সর্দারের “কা”… আত্মা যেন তোমার দয়া থেকে বঞ্চিত না হয়! তোমার জয় হোক!’
মশাল জ্বালানো হল অনেকগুলো। গ্রামণী বুড়ো তীক্ষ্ণ পাথরের ছুরিটি নিয়ে উঠে দাঁড়াল। ধীরে ধীরে এগিয়ে এল সর্দারের মৃতদেহের দিকে। কয়েকজন উঠে চিৎকার করে প্রার্থনা মন্ত্র পাঠ করছিল। গ্রামণী বুড়ো ছুরি দিয়ে সর্দারের মৃতদেহ কাটতে শুরু করল! অসিরা আবার চমকে উঠল! সদরের দেহটা এভাবে নষ্ট করে দিলে ওর ‘কা’ কোথায় থাকবে! সেকি ‘রে’ দেবতার সঙ্গে আকাশে ভ্রমণ করবে? নাকি পক্ষী হয়ে পৃথিবী পরিশ্রম করবে? দেহটাকে নষ্ট না করে কী উপায় নেই?
গ্রামণী বুড়ো সর্দারের দেহ-মাংস এগিয়ে দিল অসিরার দিকে। বলল—‘একটুখানি খেয়ে নাও। প্রার্থনা করি, সর্দারের শক্তির মতো তোমার শক্তি হোক। সর্দারের বীর্যের মতো তোমার তেজশালী বীর্য হোক! সর্দারের বিরাট আত্মা তোমার ‘কা’-তে অবস্থিত হোক।’
অসিরা এবং আরও কয়েকজন যুবক সর্দারের মাংস ভক্ষণ করল গভীর শ্রদ্ধাভরে। তারপর পোড়া মাটির চৌকোনা খণ্ড ইঁট দিয়ে সুন্দর একটি সমাধি-চৈত্য তৈরি করল অসিরা। মাটি, পাথরের লতাপাতা দিয়ে অলংকরণ অসিরার চেয়ে সুন্দরভাবে আর কে পারবে? আসিরা কাজের মধ্যে ডুবে গেল; কিন্তু বিচিত্র এক চিন্তা তার সমগ্র মন-ধ্যান আচ্ছন্ন করে রইল। মানুষের ‘কা’ বা ছায়ারূপ মৃত্যুর পর যাতে দেহ-আশ্রয় করে সুখে শান্তিতে বাস করতে পারে, তার ব্যবস্থা কি করে করা যায়? কি তার উপায়?
রাত গভীরতর হল। মানুষের মন ভীতিতে ছেয়ে গেল; দেবতা। সিরিস এবং ‘রে’ সারারাত অন্ধকার দানবের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন; দানব যুদ্ধে হেরে যাবে—রোজই পরাজিত হয়; আগামী প্রভাতে সূর্যদেব আবার উঠবেন দিক-দিগন্ত আলোকিত করে। রাত্রির সঙ্গে সঙ্গে অসিরার চিন্তাও গভীর হল।
সবে ভোর হয়েছে। শ্যামল জলাভূমির পার দিয়ে দেবতা উঠছেন। দানবের সঙ্গে যুদ্ধে রক্তাক্ত সূর্যদেবতা মানুষকে প্রাণ দান করতে এগিয়ে আসছেন। মহান তিনি! ধন্য তিনি!
নোমের শিশু আর বৃদ্ধ-বৃদ্ধাগণ এখনও শয্যায়। গৃহপালিত জন্তু প্রাণীগুলো বাইরে এসে তৃণের সন্ধানে ব্যস্ত। গাঢ় সবুজ আর হলুদ রঙের পাতার ওপর সূর্য-কিরণ ঝলমল করছে। প্রাণের অফুরন্ত বন্যায় কীটপতঙ্গ ইতস্ততঃ ছুটোছুটি করছে।
হঠাৎ দূরের পাহাড়ের অন্তরালে দেখা গেল—কালো কালো কতকগুলো বিন্দু নোমের দিকে এগিয়ে আসছে। গ্রাম-প্রহরী তখনও গভীর ঘুমে মগ্ন—স্বপ্ন দেখছিল, ওর বিচারের দিন উপস্থিত; দেবতাগণ তাকে ক্ষমা করছেন না—হঠাৎ চমক ভাঙতে না ভাঙতেই চির-অন্ধকারের রাজ্যে চলে গেল তার চেতনা। ঐ কালো কালো বিন্দুগুলো পার্শ্ববর্তী অরণ্যের যাযাবর হিংস্র পাহাড় শত্রুর দল। তাদের সর্দারের হাতের তীক্ষ্ণ অস্ত্রের আঘাতে গ্রাম-প্রহরীর ছিন্নমুণ্ড মাটিতে ছিটকে পড়ল! শত্রুদল নিঃশব্দে এসে পড়ল। ঝাঁপিয়ে পড়ল অসিরা-নেমুনাদের ছোট্ট সুন্দর গ্রামটির ওপর।
সা-পুট রক্ষককে সংবাদ দেবার সুযোগ পাওয়া গেল না। রাজাদেবতার নির্বাচিত জেলা-রক্ষককে সময়মতো সংবাদ দিলে সে। এসে পড়ল মুহূর্ত-মধ্যেই। কিন্তু, শত্রু-বাহিনী যে এত ভোরে—এই ভাবে লুক্কায়িত আক্রমণ করবে, তা ওরা স্বপ্নেও ভাবে নি।
ইমানি তড়িৎগতিতে অসিরার ঘরে ধাক্কা দিল। তাদের ঘরের বাইরেই দস্যুসর্দার দাঁড়িয়ে। ভীমদর্শন পাষণ্ড এসে ইমানিকে টেনে নিল—পার্শ্ববর্তী সেনানীকে বলল, বাঃ খাসা চেহারা; নিয়ে চল। প্রাণে মারবে না—আগামী গ্রীষ্মে একে ছাগ-দেবতার কাছে বলি দেওয়া যাবে।
অসিরা যখন বাইরে এল, তখন চারিদিকে আগুন জ্বলে উঠেছে। অন্ধকারের দানবরা ঘরের চালে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। বিহ্বল অসিরা চেতনা পেয়ে নিয়ে এল তার তীক্ষ্ণতম মারণাস্ত্র। শত্রুসৈন্য কয়েকটা লুটিয়ে পড়ল। কিন্তু, সে একা—সম্মুখে শত শত পিশাচ। নেমুনাও ধেয়ে এল। ভোরের রোদ পড়ে নেমুনার সৌন্দর্য ঝলসে উঠল। সর্দারের লোভ শতগুণ বেড়ে উঠল। শস্যভাণ্ডার, খাদ্যভাণ্ডার আর গৃহপালিত পশুর দল লুণ্ঠিত হয়েছে। এখন, কয়েকটি সুন্দরী নারীরত্ন সংগ্রহ করলেই এই বিরাট অভিযান সার্থক হবে। ঐ তো একটি সুন্দরী—আহা, যৌবন যেন ফেটে পড়ছে। একে আমাদের যণ্ড-দেবতার ভোগে দিতেই হবে। অথবা, দেবতা অসিরিসের নৈবেদ্যে।
আসিরা রক্তক্ষরণে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল; সংজ্ঞা হারাবার শেষ মুহূর্তে দেখল হতভাগী ইমানি সর্দারের বাহু বন্ধনের কর্কশতায় জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েছে; আর তার বীর্যময়ী স্ত্রী নেমুনা পাষণ্ড সর্দারের দিকে ধেয়ে চলেছে কৃষ্ণ ধাতু নির্মিত বিশালাকার অস্ত্র নিয়ে! মোহন ভীষণ রূপ ওর।
…বহুক্ষণ পর তার জ্ঞান এল। শরীর অবশ। চোখ মেলে দেখল নেমুনা পাশেই পড়ে আছে। আবার গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হল সে। যাক—পাষণ্ড সর্দার নেমুনাকে নিয়ে যেতে পারে নি!… পরদিন নোমের জীবিতদের চেষ্টায় অসিরার যখন জ্ঞান হল তখন দ্বি-প্রহর। নেমুনা অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণে প্রেতলোকে চলে গেছে। দেবতা ‘রে’ ওকে করুণা করে কোলে তুলে নিয়েছেন। ওর মহান আত্মা সূর্যলোকের পথে যাত্রা করেছে।
…না—না, এ হতে পারে না—’ প্রচণ্ড ব্যথায় চিৎকার করে ফেটে পড়ল অসিরা… ‘নেমুনা এখানেই আছে, ও আমার; ও আমার কাছেই থাকবে—ও মরে নি—মরে নি…!’
অসিরার হাহাকারে সান্ত্বনা দেবার কেউ ছিল না—গ্রামের প্রায় সকলেই মৃত; যারা আছে তারা উদভ্রান্ত, বিপর্যস্ত। এ আঘাত তাদের অকল্পনীয়। যুদ্ধ এর আগেও হয়েছে, যুদ্ধ লেগেই আছে; কিন্তু এই সর্বধ্বংসী পরিণাম অচিন্তনীয়।
অসিরা বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল নেমুনার দিকে। ও মরে নি, তেমনি সুন্দর আছে ও। সমস্ত শরীরে রক্ত। তা সত্ত্বেও তার নেমুনার রূপ জ্বলছে। চোখ দুটি বোজা। চকচকে ঠোঁট দুটো তেমনি রক্তিম। কিন্তু ও কথা বলছে না কেন?… কেন!!
অসিরা স্তব্ধ হয়ে গেল এরপর। একি হল? নেমুনা নেই! নেমুনার প্রাণ নেই!
উদ্ভ্রান্তের মতো সে হাঁটতে লাগল নীল পাহাড়ের দিকে। এখানে কত ঘুরেছে তারা; নেমুনার পায়ের ছাপ এখনও লেগে আছে পাথরে পাথরে। অসিরা পায়ে পায়ে এগিয়ে এল বাজ পক্ষীর গুহার সামনে। হঠাৎ চেতনা পেয়ে যেন ঘুম থেকে উঠল সে—একি! ভয়ানক বাজপাখীটা ওৎ পেতে আছে—এখনও মরে নি! সর্বনাশ। আজ যেন সে সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছে—ভয়ে ছিটকে এল সে। …কই—? আসছে না তো যমদূতটা! আসিরা আবার এগিয়ে গেল—ওহো—পাখীটাকে তো সে আর নেমুনা মিলে মেরেছে! হায়! নেমুনা আজ কোথায়? অসিরা বিস্মিত হয়ে দেখল পাখীটার সারা গায়ে গুহার পাথরের ধূসর চূর্ণ লেগে আছে; সেই মনোরম বিচিত্র পরিচিত গন্ধটা নাকে এল তার। আশ্চর্য! পাখীটা সামান্যও বিকৃত হয় নি। পচে নি এতদিনেও! অদ্ভুত ব্যাপার তো! একি ‘রে’ দেবতার আশীর্বাদে? কিন্তু গুহায় তো অন্ধকার। তবে? তবে কি এই অপরূপ পাথরের গুঁড়োর শক্তি! এই বস্তুর তেজেই কি প্রাণীটার শরীরের মাংস পচে নি? অসিরা উন্মাদের মতো পাথরের নীচেকার সেই বিচিত্র চূর্ণ হাতে মাখিয়ে নিল। হ্যাঁ—তাই। এই পদার্থ-ই পাখীটার শরীরকে পচন থেকে বাঁচিয়েছে। তারপর বিদ্যুত চমকের মতো বিচিত্র সেই চিন্তা অসিরার মনের কালো মেঘ উড়িয়ে দিল—তাহলে সে এই পদার্থ দিয়ে নেমুনাকে-ই বা কেন বাঁচিয়ে রাখতে পারবে না! নিশ্চয়ই পরবে। পারতে হবে। নেমুনা তার মরে নি; দেবতা রে-র কাছে যাবার দিন এখনও আসে নি তার।
নোমে ছুটে এল অসিরা। রাজা-দেবতার লোকজন এসে সকলকে নিয়ে গেছে। আবার তারা সংসার গড়বে; পরিবার গড়বে; নোম গড়বে। আর, দানবদের ধ্বংস করবে।
অসিরার কথা শুনে সকলে আনন্দে বিস্ময়ে উদ্বেল হয়ে উঠল। মানুষ মরলেও তাকে অবিকৃত রাখা যাবে? সেকি!! অসিরার আবিষ্কৃত কৃষ্ণ-ধাতুর বিষয় শুনে রাজাদেবতা পরম আনন্দিত হয়ে ঐ ধাতুর সন্ধানের আদেশ দিলেন। রাজাদেবতার আদেশের অর্থ স্বয়ং ‘রে’ দেবের আদেশ, কারণ রাজা ‘রে’ দেবের সন্তান। সারা কেমদেশে চাঞ্চল্যের বন্যা এল—মহান অসিরা আবিষ্কার করেছে কৃষ্ণ-ধাতু, শ্বেত ধাতু আর বিচিত্র এক পদ্ধতি, যার দ্বারা মরা মানুষকে বিকৃত রাখা যায়। অসিরা তৈরি করেছে ওযুধ, যার প্রলেপ লাগিয়ে মৃতদেহ জীবন্ত রাখা যায়—ধন্য হল তারা! আত্মীয়দের মৃতদেহ এতদিন কষ্ট পাচ্ছিল। ‘কা’-আত্মা যন্ত্রণায় ছটফট করছিল—এবার থেকে মৃতের জন্য তৈরি করতে হবে বিরাট বাসগৃহ; যাতে ‘কা’র-র সামান্য অসুবিধা না হয়। শরীর রইবে অবিকৃত। অসিরার বিরাট আবিষ্কার যুগান্তর এনেছে—নূতন জীবন এনেছে! ধন্য অসিরা!
.
অসিরা নেমুনার অবিকৃত সুন্দর ম্যমীর সামনে বসে ভাবছি—-কে বলেছে নেমুনা প্রেতলোকে গেছে? এই তো ঠিক তেমনি সুন্দর আছে সে! যেমনি চক্চকে দুটি কোমল ঠোঁট, শুধু চোখ দুটি বোজা… নতুবা, স্নিগ্ধ শরীরটি ঠিক আগের মতোই পেলব—রক্তিম গণ্ডদেশ… কমনীয় বাহুলতা…
.
প্রথম প্রকাশ: আশ্চর্য!, জুন, ১৯৬৬