আকাশ-ঘাঁটি • লীলা মজুমদার
বড়কাকা বিলেতে অ্যামেরিকায় অনেক বছর ছিলেন। কি করতেন কেউ সঠিক জানত না, তবে মাঝে মধ্যে দেশে ফিরে যে-ভাবে দু-হাতে টাকা খরচ করতেন, তাতে মনে হত কোনো লাভজনক ব্যাপারে জড়িত ছিলেন। বেশি দিন থাকতেন না, ভারত সরকারের নানান সেরেস্তায়, পরীক্ষাগারে, পারমাণবিক কেন্দ্র ইত্যাদিতে যে-ভাবে অবাধ যাতায়াত করতেন তাতেই বোঝা যেত তাঁর কাজে সরকারী সমর্থন আছে। সকলকে বলতেন সাংবাদিকের কাজ করেন, সরকারী সংবাদ সরবরাহের কোনো গুরুত্বপূর্ণ গোপন বিভাগের সদস্য। আত্মীয়-স্বজনরা এ-কথা বিশ্বাস করত না। ছোটবেলা থেকে যে এমন কৃতী-বিজ্ঞানের ছাত্র এবং উপরন্তু পাঁচটা বানান ভুল না করে যে কি ইংরিজিতে, কি বাংলাতে এক পাতা চিঠি লিখতে পারে না, সে হবে সাংবাদিক, এটা কি একটা বিশ্বাসযোগ্য কথা হল? প্রসঙ্গটা বড়কাকার কানে যেতে উনি বললেন, “কে বলেছে সাংবাদিকরা বানান করতে জানে? বানান ঠিক করে যারা দেয় ছাপার কলে কালি লাগানোর কাজ করে, তারা। আর কারো ওপর নির্ভর করা যায় না।” শুনে সবাই থ।
গত বছর অনেক দিন দেশে থেকে গেলেন, চোখে-মুখে কেমন একটা উদ্বিগ্ন ভাব-ও দেখা গেল। যারা ওঁর কাছ থেকে সব চাইতে বেশি টাকা ধার করেছিল, তারা বলাবলি করতে লাগল, “টাকা বেচে, গাঁজা চালায়, বেনামায় বড় বড় ব্যবসা করছে, এখন মিসার ভয়ে চোখে-মুখে পথ দেখতে পাচ্ছে না। যারা সাফল্যলাভ করে তাদের সম্বন্ধে লোকে যেমন বলে থাকে।
শেষটা হল, ঘোতন একদিন চেপে ধরল। বড়কাকা তাদের কখনো কানাকড়িও দেন নি। দুজনে দুটি মাস্তান। স্কুল ফাইনেল-ও পাস করেনি। বাড়ির লোকে ওদের দেখলে নাক সিঁটকায়, সদাই এর বাড়ি ওর বাড়ি খাবার তালে থাকে, তারা পঞ্চাশ-ষাটটা করে পয়সা দিয়ে বিদায় করে দেয়। বলে, এ বেলা হাঁড়ি চড়েনি, বড় খারাপ দিন যাচ্ছে। তবু এই তাগড়াই চেহারা দুজনার, কালীঘাটের আখড়ায় কুস্তি করে, বুক-ডন দেয় একনাগাড়ে পঞ্চাশটা, পিটোনো শরীরে নুড়ির মতো শক্ত গোল মাংসপেশী। বড়কাকা তাদের সঙ্গে কথাটথা কইতেন না, ওরাও ওঁকে এড়িয়ে চলত। তবে মনে ভয়-ডর ছিল না, কলেরার সেবা করত, বে-ওয়ারিশ মড়া পোড়াত, শ্মশান ঘাটের সিঁড়িতে বসে ভাঁড়ে করে চা খেত। গালগল্প করত।
বড়কাকার শুকনো মুখ দেখে একদিন কাছে গিয়ে হুলো বলে বসল, “অমন শুকনো মুখ দেখলে পিত্তি জ্বলে যায়। যার পকেট ভরা পয়সা তার মুখ শুকনো কেন? কিছু কাজ থাকে তো বলুন।”
বড়কাকা ভুরু কুঁচকে ওদের অখাদ্য চেহারার দিকে তাকালেন। আধময়লা নস্যির রঙের আঁটো পেন্টেলুন আর লাল নীল বকড়া-বকড়া শার্ট, পায়ে নোংরা কোলাপুরী চটি। ঘাড় অবধি লম্বা ঝাঁকড়া চুল, অনেক দিন চানটান করেনি।
আশ্চর্যের বিষয়, বড়কাকা আগে কথা বললেন, “তোমরা বড় বাড়ির ছোট মামার নাতি না?” “আজ্ঞে হ্যাঁ, বড়কাকা।” বড়কাকা বললেন, “স্নান কর না কেন? নোংরা লোককে কাজ দিলে আমার অখ্যাতি হবে।” ওরা বলল, “আর কাপড়-চোপড়ও নেই, স্যার, তাই স্নান করার অসুবিধা আছে।”
বড়কাকা ওদের বিষয়ে নানান কথা শুনেছিলেন। বেশির ভাগই নিন্দা। বললেন, “ভয়-টয় পাওনা তো?” হুলো উৎসাহের সঙ্গে বলল, “না স্যার, অব্যর্থ গুলতি যার, তার আবার ভয় কিসের?” “এই ধর পৃথিবীর স্বাভাবিক নিয়মের বাইরের জিনিসকে ভয় কর না তো?” এবার ওরা একটু ঘাবড়ে গেল। এ-ওর মুখের দিকে চাইল। ঘোতন বলল, “ভ-ভূতের কথা বলছেন? তাহলে কিন্তু ওর মধ্যে আমরা নেই, এই পষ্ট কথা বলে দিলাম।” বড়কাকা আকাশ থেকে পড়লেন, “বল কি! তোমাদের মতো আধুনিক ছোকরা, যারা মা বাপকে পর্যন্ত স্বীকার কর না, তোমরাও ও-সব মান?” ঘোতন একটু উষ্মার সঙ্গে বলল, “কালীবাড়ীর উত্তরে বড় বাঁশঝাড়ে একা রাত কাটাতে আপনি রাজি আছেন?” কাষ্ঠ হেসে বড়কাকা বললেন, “না রাজি নই। তবে সে অন্য কারণে। আত্মহত্যা আমার উদ্দেশ্য নয়। সে থাক গে, আমি যেখানকার কথা বলছি, সেখানে ও-সব ভয় নেই। ছিলই না কিছু কোথাও কোনোকালে, তা ভূতে ভর করবে কিসে? বিশ্বাস কর, বুধ-গ্রহের কাছাকাছি গিয়ে দেখেছি, কোথাও ভূতের পায়ের কড়ে আঙুল রাখার জায়গা নেই। সব শূন্য খাঁ-খাঁ করছে।”
ওরা এ-ওর মুখের দিকে তাকাল, গলা খাঁকরাল, মুখে কিছু বলল না, চলেও গেল না। বড়কাকা ইদিক-উদিক চেয়ে, গলা খাটো করে বললেন, “আসলে আমার বেশ কিছু দিনের মতো গা-ঢাকা দেওয়া দরকার। কোথায় পালাব, ভেবে পাচ্ছি না।” আড়চোখে তাকিয়ে দেখেন ওদের চারটে কানই খাড়া। “ইয়ে, একটা জায়গা আছে বটে, তবে সেখানে একা যাওয়া যায় না।” ওর চুলবুল করে উঠল, “আবুধাবি বড়কাকা? নৌকো আনতে হবে? এতক্ষণ বলেন নি কেন?”
কথা হচ্ছিল আদিগঙ্গার ধারে, ইঁটের গাদার পাশে। বড়কাকা ফোঁশ করে নিশ্বাস ছেড়ে, ইঁটের ওপর বসে পড়লেন। সেগুলো যে বিশ্রীভাবে নড়বড় করতে লাগল, তাও খেয়াল করলেন না। হুলো, ঘোতন দুজন দুটি ইঁট পেতে ওঁর পায়ের কাছে, গঙ্গার দিকে পিঠ করে বসে পড়ল। বড়কাকা সোজা ওদের মুখের দিকে চেয়ে বললেন, “কারো কাছে প্রকাশ করিসনে, কিন্তু শুনে রাখ, আমি সাংবাদিক-টাংবাদিক নই, আমি মহাকাশচারী!” শুনে ওরা এমনি চমকে গেল যে শূন্যে দু হাত লাফিয়ে উঠে, নামবার সময় হুলোর ইঁটে ঘোতন, ঘোতনের ইঁটে হুলো পড়ল, অথচ কেউ টের পেল না, বড়কাকা ও না। তিনজনারই গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল।
হুলো রোজ আধ পো করে কাঁচা ছাগলের দুধ খেত, কিনে নয়, তার পয়সা পাবে কোথায়? ঠাকুরবাড়ির পুরুতমশায়ের ছাগলটাকে লুকিয়ে দুইত—তাই ওর উপস্থিত বুদ্ধি ছিল সব চাইতে বেশি। সেই আগে কথা বলল, “ক্-ক্-ক্-ইয়ে-ব্-ব্-ব্-?” বড়কাকা বললেন, “ঠিক তাই। বিস্ময়কর বটে। অবিশ্বাস্যও বলতে পার। একেবারে লোমহর্ষক ব্যাপার। সব কথা বলছি, মন দিয়ে শোন। মধ্য ইউরোপের একটা রাজ্যে আমার কর্মস্থল। সেখানে পাহাড়ের অগম্য উঁচু চুড়োয় আমরা সাফল্যের সঙ্গে—” ঘোতন আর নিজেকে চাপতে না পেরে বলল, “রকেট বানান বুঝি?”
বড়কাকা কাষ্ঠ হাসলেন, “রকেট? রকেটকে আমরা খেলনা বলি। আমাদের বিশেষত্ব হচ্ছে আকাশ-ঘাঁটি! আকাশ-ঘাঁটি কি বুঝলি তো? যাকে বলে স্পেস্-স্টেশন। সাধারণ স্পেস্ স্টেশন নয়, সে তো আমেরিকা, ফ্রান্স ও রাশিয়া, যে-যা খুশি বানাতে পারে। আমাদেরগুলো একেবারে স্বয়ংক্রিয়।”
বলতে বলতে উত্তেজনার চোটে উঠে দাঁড়ালেন বড়কাকা, “সে তোরা ভাবতে পারি না। সব আপনা থেকে হয়, জল তৈরি হয়। কেন, তাতে অবিশ্বাসের কি আছে? এই পৃথিবীটাতে তো আর অন্য জায়গা থেকে জল আসে না, লক্ষ লক্ষ বছর ধরে মেঘ উঠছে, বিষ্টি হচ্ছে, মাটিতে জল শুষে নিচ্ছে, আবার ঝরণা হয়ে বেরুচ্ছে, নদী হয়ে ছুটছে—কই তোরা তো কেউ আশ্চর্য হচ্ছিস না? আকাশ ঘাঁটিতেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঐ সব হয়। গাছপালা গজায়, বাড়ে, ফুলফল ধরে, শুকোয়, মরে, পাখি ওড়ে, হরিণ চরে, গোবরটোবর রি-সাইকেল্ হয়। আকাশ-ঘাঁটির জন্তু-জানোয়ার যেমন বাড়তে থাকতে, আকাশ-ঘাঁটিও মাপে বড় হতে থাকে।”
হুলো বলল, “ধেৎ?”
বড়কাকা বললেন, “বিশ্বাস না করলে কি করতে পারি? শূন্যটাকে কি তোরা একেবারে শূন্য ভাবিস? মোটেই তা নয়। কোটি কোটি বছর ধরে ধ্বংস হয়ে যাওয়া গ্রহ-নক্ষত্রের অতি মিহি গুঁড়ো ধুলোর মতো ভেসে যাচ্ছে। মহাকাশ থেকে সেগুলোকে সংগ্রহ করে আকাশ-ঘাটি ক্রমে মাপে বড় হতে থাকে। আমি পাঁচ বছর আগে শেষ যা দেখেছিলাম, তারপর নিশ্চয়ই এত বেড়ে গেছে যে চেনা দায় হবে। আর সব চাইতে ভালো কথা, গা-ঢাকা দেবার এমন জায়গা আর নেই। পাখিরা, হরিণরা সত্য হলেও, মানুষরা সবাই স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র চালিত এবং খুব ট্যাঁকসই ফোম-রবারে তৈরি। সব কথা বোঝে কিন্তু কোনো কথা নিজের থেকে বলে না, প্রশ্ন করলে ইঙ্গিতে উত্তর দেয়। সেখানে আমরা একেবারে নিরাপদ। আমার নিজস্ব একটা ছোট বাড়িও আছে, একটা স্বয়ংক্রিয় চাকর রাখা যাবে—।”
হুলো, ঘোতন অবিশ্যি এ সমস্তর একটি কথাও বিশ্বাস করেনি। খালি জিজ্ঞাসা করেছিল, “আমাদের কি দেবেন?”
‘কি দেব? চিরকালের মতো তোদের সব অভাব ঘুচিয়ে দেব। আবার যখন ফিরে আসবি—।”
ওরা বাধা দিয়ে বলল, “ফিরে এলে আমাদের চলবে না। আজ রাতে পুরুতঠাকুরকে পেটাবার পর এ জায়গাটা আমাদের পক্ষে বড় বেশি গরম হয়ে উঠবে।—কিন্তু ঘাঁটিটা কাদের, আমাদের থানার কারো নয় আশা করি। শেষটা আমাদের ধরিয়ে দেবেন না তো?”
বড়কাকা হতাশ হলেন। “বলছি মধ্য ইয়োরোপে অগম্য এক পাহাড়ে তৈরি হয়েছে।”
“আপনি করেছেন? কে টাকা দিল?”
“আহা, তোদের তো বড় বেশি সন্দেহ বাতিক দেখছি!” ওরা বলল, “যারা প্রাণ হাতে নিয়ে ঘোরে, তাদের সন্দেহ বাতিক থাকবে না তো কি থাকবে?” “বেশ। শোন তবে। করিগা আর বিনো নামে দুই সায়েব ওটাকে বানায়।”
“কে টাকা দিল?”
“কি জ্বালা! কেউ দেয়নি। ওদের ছিল। ওরা ওটাকে বানিয়ে মহাকাশে ছেড়ে দিয়েছিল পাঁচ বছর আগে। সেই ইস্তক ঘুরছে তো ঘুরছেই আর যতই ঘুরছে ততই শক্তি জমছে, স্বয়ংক্রিয়ের উন্নতি হচ্ছে। বলছি কি তোদের, অমন আরামের গা ঢাকা দেবার জায়গা কোথায় পাবি?”
হুলো বলল, “মালিকরা যদি গিয়ে হাজির হয়?” হাসলেন বড় কাকা, “আরে কাগজে পড়িসনি, বড় বেশি বিজ্ঞান করতে গিয়ে তারা আইফেল টাওয়ারের চুড়ো থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছিল।” আর একটিমাত্র প্রশ্ন করেছিল হুলো, “তাহলে আপনি কি করতেন?” বড় কাকা অবাক, “কেন, স্ক্রুপ আঁটতে হত না, এখানে-ওখানে রিভেট করতে হত না? একটা স্ক্রুপ ঢিলা থাকলেই তো হয়ে গেল! আমার কাজ বৈজ্ঞানিকদের কাজের চাইতে কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তাছাড়া ওঁরা দুজনেই সমান ভুলো। এই ফরমূলা তৈরি করছেন তো এই ভুলছেন, এই জটিল সমস্যার উত্তর খুঁজে বের করছেন তো এই সেটাকে ভুলে যাচ্ছেন। আমাকে সব মনে করে রাখতে হত। লিখে রাখবার হুকুম ছিল না, পাছে শত্রুদের হাতে পড়ে। জানিস তো সব বিজ্ঞানীদের শত্রু হল বাকি সব বিজ্ঞানীরা। ওঁরা কাউকে বিশ্বাস করতেন না, পাহাড়ের চূড়ায় আমরা তিনটি প্রাণী আর আমাদের তৈরি গুটি পনেরো স্বয়ংক্রিয় ফোমরবারের রোবো ছাড়া জনমনিষ্যি ছিল না। এরি মধ্যে দুই সন্দেহবাতিক পণ্ডিত আইফেল টাওয়ারে চড়ে কি বাহাদুরি করতে গিয়ে নিখোঁজ নি-পাত্তা হয়ে গেলেন! আমাকে পর্যন্ত কিছু বলে গেলেন না আর নিজেরাও নিশ্চয় ভুলে মেরে বসে আছেন। তাই পাহাড়ের চুড়োর নিরাপদ আস্তানায় ফিরতে পারছেন না। সে দিক দিয়ে বলতে গেলে আমিই ওঁদের একমাত্র ওয়ারিশ বলতে পারিস।”
হুলো, ঘোতন বলল, “এ্যাঁ, একেবারে একা একা পাহাড়ের মাথায়!” “হ্যাঁ, তাই! মানে প্রায় তাই। যাক, সে আর জানতে চাসনি, এখন যাবি কি না বল?”
“কিসে করে যাওয়া হবে তাহলে?”
“কেন, এ দেশেই একটা আধা-সরকারী প্রতিষ্ঠান আছে, তারা সরকারী সাহায্যে স্বয়ংক্রিয় রকেট বানাবার চেষ্টা করছে। আমিও তাদের পার্ট-টাইম গবেষক। একটা নতুন ধরনের রকেট দিয়ে স্পেস-স্টেশনের সার্ভিসিং করা চলবে কিনা পরখ করতে হবে। তা কেউ যেতে চায় না। শেষটা আমি স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে যাব বলেছি, যন্ত্রপাতি খরচপত্র ওরা দেবে, আমার নিজের দুজন সহকর্মী নিয়ে যাব, তাদের মাইনে বাবদ তিন হাজার টাকা দেবে—কি বলছিস?” হুলো বলল, “আগাম দিলে ভালো হয়, এখানে কিছু দেটেনা করে ফেলেছি।” বড় কাকা ভ্রূকুটি করে তাকিয়ে, তারপর মুচকি হেসে বললেন, “তাই দেব। তবে সবটা দেব না। একেকজনকে পাঁচশো দিলে চলবে না? ধর যদি পরে ফিরেই এলি, শেষটা তখন—”। ওরা দুজন বড়কাকার মঙ্ক-শু’র নাকে কপাল ঠেকিয়ে গড় করে বলল, “খুব খুব চলবে। অত টাকা চোখেও দেখিনি কখনো!”
বড়কাকা মনিব্যাগ থেকে কয়েকটা নোট বের করে ওদের হাত দিয়ে বললেন, “বুড়োকে আস্তে পেটাস, মরেটরে গেলে ফ্যাসাদে পড়বি। যাবার আগে অশুভ কাজ করিসনি। এই দিয়ে দুটো করে প্যান্ট শার্ট, ১ জোড়া ক্যাম্বিশের জুতো, মোজা, গেঞ্জি কিনিস আর রাতে ভালো করে খাস।”।
বড়কাকা সকলকে বলে কয়ে, যা টাকাকড়ি দেবার দিয়ে, মাঝারি সুটকেসাটি হাতে করে শনিবার সন্ধ্যার দিকে রওনা হয়ে গেছিলেন। হুলো ঘোতনের অন্তর্ধানের ব্যাপার কেউ লক্ষ্যই করেনি। কোথায় কোন্ বদমাইসি করতে গেছে দুই বাউণ্ডুলে তাই নিয়ে কার-ই বা মাথা-ব্যথা! হুলোর বাপ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বরং বললেন, “হয় চাকরি নয় ফাটক। যাই হোক, অনেকটা নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।” তাঁর বড় দিদি ঘোতনের মা শুধু বললেন, “ওনার মনিব্যাগটা ফাঁক করে দিয়ে গেল না কেন তাই ভাবছি।” পরে অবিশ্যি পুরুত ঠাকুরকে ঠেঙানোর কথা রাষ্ট্র হলে সবাই ব্যাপারটা বুঝতে পারল। আসল কারণ কেউ সন্দেহও করল না।
সত্যি কথা বলতে কি নতুন কাপড় চোপড় পরে, চুল ছেঁটে, স্নান করে, দাড়ি কামিয়ে, হাতে নতুন পিজবোর্ডের সুটকেস নিয়ে ওদের চেনে কার সাধ্য। একটু গোলমাল বেধেছিল। ওরা কিছুতেই ওদের পোষা একজোড়া শিং-ওয়ালা গুবরে পোকাকে রেখে যেতে রাজি হল না। “ও বাবা! ওরা হল গিয়ে আমাদের ম্যাস্কট্। ভোমরার পেটে যেমন দত্যিদের প্রাণ থাকত, অনেকটা তাই। ওদের ফেলে গেলে ওদের কেউ মাড়িয়ে দেবে, কিম্বা শিং ভাঙবে, কিম্বা সাংঘাতিক কিছু হবে! ওরা না গেলে, এই আমরাও রইলাম। ওঠ ঘোতন।”
বড়কাকা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, “কি জ্বালা, নেব না বলেছি নাকি? তবে পকেট থেকে যেন বেরটের করিস নে। এক দিক দিয়ে ভালোই হল, ওখানে একটা নতুন জীব দেখা যাবে।”
কিভাবে গোপন ঘাঁটিতে পৌঁছল, সেখানে একটু যেন আলগোছে ওদের ব্যাগট্যাগ দেখিয়ে, ছোট্ট একটা পলকা রকেটে চেপে, তিনজনে কিভাবে রওনা হয়ে গেল, নিরাপত্তার প্রয়োজনে সে-বিষয়ে কিছু না বলাই ভালো। শুধু এইটুকু বললেই যথেষ্ট যে কত ছোট একটা থলির মধ্যে স্বয়ংক্রিয় রকেটটাকে ভাঁজ করে ভরে ফেলা যায়, দেখে ওরা একেবারে হাঁ। স্বয়ংক্রিয় চালকটি একটা টেলিফোনের মতো ছোট একটা সুইচ টিপলে পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ওরা একটা ছোট সরকারি স্পেস স্টেশনে নেমে তার সার্ভিসিং করবে। পৃথিবী থেকে সমস্ত যাত্রাপথ কনট্রোল করা হবে। সেখানকার কাজ শেষ হলে, সুইচ টিপে পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে। কনট্রোল সেন্টারের লোকরা ভাববে যান্ত্রিক গোলযোগ হয়েছে, “বাগচি ঠিক করে নেবে’খন, স্পেস স্টেশনে প্রাণধারণের ব্যবস্থা আছে। ওদের জন্য কেউ মাথা ঘামাবে না। ওরা সেই সুযোগে আকাশ-ঘাঁটিতে পৌঁছে যাবে। সেখানে কি আরাম, কি নিরাপদ, কোনো শা—।” এই অবধি বলে বড়কাকা থেমে গেছিলেন। তবে বাকিটা ওরা বুঝে নিয়েছিল। এবং সম্পূর্ণ সমর্থন করেছিল। সাত বছরের অবিরাম মাস্তানির ফল থেকে এমন সহজ উপায়ে যে ওরা নিষ্কৃতি পেয়ে যাবে, এ ওদের স্বপ্নের বাইরে ছিল। তথাকথিত স্যাঙাৎরাও খোঁজ করবে না। তারা জানে পুরুৎ ঠেঙ্গিয়ে বাছাধনরা হিমালয়ের বুকে নিখোঁজ হয়েছে। ওদের নামে থানায় খাতা খোলা হয়েছিল, কিছুদিন বাদে সে খাতাও নিশ্চয় বন্ধ করা হবে। ভেবেও এত আনন্দ হচ্ছিল যে পকেটে হাত ঢুকিয়ে গুবরের গায়ে হাত না বুলিয়ে পারল না। গুবরেরাও খুনি কুট কুট করে মোক্ষম কামড় দিল। রকেটের নাম ভেজালি! ভালো নাম না? হুলোর দেওয়া নাম। বড়কাকা বলতেন আর-এস থ্রি। তবে জিনিসটা বড়ই পলকা, ওটা যে মহাকাশ পেরিয়ে তিনজনকে নিরাপদে যথাস্থানে নিয়ে যাবে সহজে বিশ্বাস হচ্ছিল না। তবে নাকি পোড়েও না, টোল-ও খায় না, বেজায় শক্ত, অথচ কাগজের চাইতে হাল্কা, আকাশে উড়লে দূরবীণ লাগিয়েও কারো ঠাওর হওয়া শক্ত। সরকারি স্টেশনে ছোট একটা যন্ত্র লাগিয়ে নিয়ে আকাশ-ঘাঁটি পর্যন্ত বড়কাকাই রকেট চালিয়ে নিতে পারবেন। ওঁর কারখানায়, একরকম ওঁর হাতেই তৈরি।
তাজা বাতাসের স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা থাকলেও শুধু বড়ি খেতে খেতে যাওয়া। বড়িগুলোর একেকরকম স্বাদ, পেট-ও ভরে; কিন্তু ওকে কি কেউ খাওয়া বলে? দাঁতের ফাঁকে পর্যন্ত কিছু লেগে থাকে না। আর বাইরে কি অন্ধকার! তবে পরদা টেনে টেলিভিশনে আশ্চর্য সব ছবি দেখাতে দেখাতে নিয়ে চললেন বড়কাকা। তাছাড়া বুধ শুক্রের মতো দূরে তো আর নয়, দেখতে দেখতে পৌঁছেও গেল ওরা। নামল যখন ওরা তখন ঘুমিয়ে ছিল, এতটুকু ঝাঁকি দিল না, কিছু না। জেগে দেখে মনে হল বুঝি বিশাল একটা কিছুর ছাদে চেপে রয়েছে ওরা। আর রকেটের নিচে চোরা দরজা খুলে, সিঁড়ি দিয়ে সুটকেস হাতে বড় কাকা নেমে যাচ্ছেন। ওরাও নিজেদের বাক্স নিয়ে নেমে পড়ল। এই স্পেস্-স্টেশনও নাকি বড়কাকা দের তৈরি।
ছাদের ওপর উকুনের মতো আটকে রইল রকেট, ওরা নেমে গেল। বড়কাকা বললেন, “এখানে কোনো লোকজন থাকে না। যন্ত্রপাতি, সাজসরঞ্জাম, প্রচুর খাবার দাবার, জল তৈরির বন্দোবস্ত মজুত থাকে, ওষুধপত্র থাকে। মহাকাশে কেউ বিপদে পড়লে, এখানে এসে সাহায্য পেতে পারে, ক্লান্ত নভোচারীরা বিশ্রাম করতে পারে। আমরাও এখানে আট দিন থাকব, সমস্ত যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করব, রাঁধব-বাড়ব, খাব-শোব, একটু হাঁটা-চলা করব।” হুলো খুশি হয়ে বলল, “হ্যাঁ, গত দুদিন উকি-বুকির যে কি অমানুষিক কষ্টে কেটেছে, সে আর কি বলব! বেচারিরা একটু চলে ফিরে বেড়াতে পারবে!” এই বলে পকেট থেকে পেয়ারের গুবরে দুটোকে ওরা বের করল। দেখে বড়কাকার চক্ষু স্থির!
“ওরে, ছাড়িস নে, ছাড়িস নে, সর্বনাশ করবে। হাঁটাতে হলে পায়ে দড়ি বেঁধে হাঁটা। দাঁড়া, আমি দিচ্ছি।” বড়কাকা নাইলনের সুতো আর কাঁচি দিলেন, স্বচ্ছ দেয়ালের একটা খোপ থেকে বের করে। ওদের বিস্ময় দেখে একটু খুশি না হয়েও পারলেন না। বললেন, “দেখছিস তো, সাধারণ জীবন-যাত্রার সব ব্যবস্থাই এখানে আছে, মায় গা-বমির ওষুধ পর্যন্ত, কারণ সবাই এসে প্রথমেই বেজায় সাঁটায়।”
চ্যাপ্টা গোল মতো জিনিসটা, হাল্কা পাৎলা কোনো জিনিসের তৈরি। মস্ত একটা গোল হল-ঘরের মতো। তাতে খোপ খোপ ভাগ করা, কোথাও যন্ত্রপাতি, কোথাও দূরবীক্ষণের মতো কি-সব, কোথাও বড় বড় ড্রাম, কোথাও ছোট ছোট শিশি বোতল, সব যথাস্থানে বসানো, নড়বার চড়বার জো নেই! হল-ঘরের মধ্যিখানে মোটা একটা লম্বা মতো ছাদ অবধি উঠে গেছে। তারি ভিতর সিঁড়ি, তার দুদিকে দুটো লক্ গেট। মুখ্যু ছেলে ওরা, এর বেশি কিছু বুঝল না। বড়কাকা বললো নাকি সারাক্ষণ স্পেস-স্টেশন লাট্টুর মতো পাক খায় আর শক্তি সঞ্চয় করে, পাক না খেলে উল্টেও যেতে পারত। ভিতরে এক রকম মাধ্যাকর্ষণ আপনা থেকে তৈরি হচ্ছে। তাই ওরা সাধারণ পোশাকে চলছে ফিরছে। সূর্য শক্তিতে সব কাজ হচ্ছে। তাজা বাতাস তৈরির স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা আছে।
দেখে দেখে ওরা তাজ্জব বনে গেল। ওদের যথেষ্ট কাজ দিলেন বড়কাকা, সাফসুফ, তেল লাগানো, আর সব চাইতে বড় কাজ রাঁধা বাড়া, তাতে ওদের কোনোই আপত্তি ছিল না, ছোট ছোট টিনে করে মালমশলা এনেছিলেন বড়কাকা, তারি এটা ওটা মিলিয়ে সে কি ভোজ! শুধু ভাতটাই মামুলী নিয়মে রান্না হত। গুবরেরা মনের সুখে দাপদাপি করে বেড়াত, পায়ে সুতো বেঁধে। বড়কাকা থেকে থেকে বলতেন, “খবরদার, এক কণা গুবরের গোবর দেখি তো ওদের ঠ্যাং ধরে বাইরে ফেলে দেব। সব জড়ো করে ঐ টিনে রাখবি। মেশিন দিয়ে ঐ থেকে দুধটুধ তৈরি হবে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে।”
.
দুই
পরে হুলো ঘোতন বুঝেছিল যে এতদিন থাকার একমাত্র কারণ ওদের একটু তালিম দিয়ে নেওয়া হলে ওখানকার কাজ দুদিনেই হয়ে যেত। এই কদিন পৃথিবীর সঙ্গে যোগ ছিল, কথাবার্তা চলত, রিপোর্ট দেওয়া হত, টিভি দেখা যেত। আট দিনের দিন বড়কাকা সুইচ তুলে সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন করে দিলেন। ওদের দুজনার যা ভয়! “সত্যি বলছি, বড়কাকা যে-দিন পাকুর দল এক-নলা দিয়ে আমাদের নৌকোর পাছু ধরেছিল, সেদিনে এত ভয় পাইনি।” “ভয়টা কিসের শুনি?” “বাঃ ভয় পাব না? ওরা তিন পুরুষ ধরে নৌকো নিয়ে আবু ধাবির ওদিকে কার সঙ্গে কারবার করে এসেছে। ওদের পূর্বপুরুষরা ওয়ারেন হেস্টিংসের রসদ জোগাত। এখন যখন কেউ বলে যে তখন নাকি বিলেত থেকে আসতে এক বছর সময়
লাগত, পাকুরা হাসে।”
বড়কাকা গলা খাঁকরে বললেন, “তোদের সঙ্গে খুব ভাব বুঝি?” ওরা শুনে হাঁ! “ভাব! তা এক দিক দিয়ে বলতে পারেন ভাব। তিনশো বছর ধরে বদলা নিয়ে নিয়ে, কেমন একটা নিজের লোকের মতো হয়ে গেছে ওরা।”
বড়কাকা চটে গেলেন, কি যে বলিস বদলা নিয়ে নিয়ে! আমাদের গুষ্টির কজনকে—মানে, বদলা নিয়েছে?” “আহা, আপনাদের নেবে কেন? দলের ব্যাপার এটা?” “হুঁ, এখন বুঝতে পারছি, কেন তোদের আকাশ-ঘাঁটিতে যাওয়ার এত তাড়া। ভালোই হল, দুটো পারমানেন্ট লোক পাওয়া গেল। এই বড়ি দুটো খেয়ে ফেল, মাথা ঘুরবে না।”
ততক্ষণে স্পেস-টেশনে তালাচাবি দিয়ে ওরা রকেটে চড়ে রওনা দিয়েছিল। চারিদিক থেকে অন্ধকার যেন পাক খেয়ে এদের গিলে ফেলতে এল, রকেটের আলো-ও কিরকম ঘুরতে লাগল। ব্যস, আর কিছু মনে নেই। ঘুম যখন ভাঙল, ‘ভোজালি’ কখন আকাশ-ঘাঁটির পেটের তলার ফটক দিয়ে ঢুকে, আস্তাবলই হক, কি গ্যারাজই হক, কি গোয়ালঘরই হক, সেইখানে নিরাপদে আশ্রয় পেয়েছে। আট জন স্বয়ংক্রিয় কর্মী, তার সার্ভিসিং-এ লেগে। বড়কাকা নেমে গেছেন।
টুপ করে আচ্ছন্ন ভাবটা কেটে গেল। তবে কি ওরা মরে গিয়ে স্বর্গে চলে এসেছে? স্বর্গেই বা আসবে কেন? এই নাকি আকাশ ঘাঁটি। কই এর যে কোনো ঘেরাটোপ দেওয়া নেই? সময়টা বোধ হয় সকাল, মাথার ওপর ডোমের মতো কৃত্রিম ছাদের বদলে কোমল নীল আকাশ, পুব দিকে সূর্য উঠেছে, চার দিকে গাছপালা, বাড়িঘর, হরিণ চরছে, কুকুর ডাকছে, ঝাঁকে ঝাঁকে সবুজ লাল নীল তোতা পাখি উড়ছে। ওরা ভোজালি থেকে বেরিয়ে এসে, আস্তাবলের বাইরে দাঁড়াল।
দলে দলে ফোম রবারের যন্ত্র-মানুষ কাজে ব্যস্ত, কারো মুখে কথা নেই। ওদের তো কথা বলবার জন্য তৈরি করা হয়নি। তবে কাজের কথা নাকি সব বোঝে। একজন যন্ত্র-মানুষের বুকে পিঠে দশ নং লেখা, ওদের বোধহয় নামটাম নেই। হুলো তার সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “স্যার কোথায়?” সে আঙুল তুলে দূরে দেখিয়ে দিয়ে, আবার ঘাসজমি থেকে আগাছা তুলে একটা টুকরিতে রাখতে লাগল। আশ্চর্য বটে, চেহারা দেখে কে বলবে মানুষ নয়! অবিশ্যি মানুষরা এত কাজও করে না, এত চুপ করে থাকে না।
সেদিকে তাকাতেই মনে হল একটা ফিল্মের শহরে এসেছে। কি সুন্দর ছোট বড় বাড়ি, তকতকে পথঘাট, তাতে এক কণা ধূলো নেই, এই দেশটার কোথাও ধুলো নেই। দেশই তো, ছোট বেলায় স্বপ্নে দেখা একটা দেশের মতো। এখানে ধুলো উড়লেই যন্ত্র-মানুষরা নিশ্চয় সেগুলো সংগ্রহ করে কাজে লাগায়। যন্ত্ররা কথা না বললেও, নানা রকম ভালো শব্দ, ঘাস-ছাঁটার কলের শব্দ, কানে এল। জল ঝরার শব্দ, গাছের পাতায় বাতাস বওয়ার শব্দ, জন্তু জানোয়ারের ডাক আর মনে হল কোথাও রেডিও চলছে। সামনের একট। ছোট বাড়ি থেকে বড়কাকা বেরিয়ে এলেন, মুখে তাঁর দুশ্চিন্তার ছাপ।
“কি হল বড়কাকা? যন্ত্ররা বুঝি জিনিসপত্রের যত্ন করে নি?”
“নাঃ—বরং বড় বেশি যত্ন করেছে। যে-সব কাজ শেখানো হয়নি, তাও করে রেখেছে। ভাড়ার ঘরের তাক দেখছি জ্যাম, জেলি, আচার, বিস্কুটে ঠাসা। আর—আর লোকজনও যেন একটু বেশি বেশি মনে হচ্ছে।”
হুলে বলল, “ভালোই তো। আরো ভালো কাজ হবে। আকাশ ঘাঁটি মাপে বড় হয় বললেন, আর তার বাসিন্দারা সংখ্যায় বাড়তে পারে না? ফলপাকুড় খাবার লোক নেই, তাই জ্যাম জেলি করে রেখেছে, ভালোই করেছে।”
“কিন্তু শিখল কোথায়?”
“নিজেরাই বের করে করেছে। মানুষরা প্রথম যেমন করে শিখেছিল। এখন গুবরেদের ছাড়ি?”
যতই দিন যেতে লাগল ওদের ওপর উল্টো রকম ফল হতে লাগল। হুলো ঘেতনকে পায় কে! যদি স্বর্গ না হয় তো স্বর্গ কাকে বলে ওরা ভেবে পেত না। অবিশ্যি ওদের কতটুকুই বা বিদ্যেবুদ্ধি, তাই দিয়ে বুঝত-ই বা কি? তবে বড়কাকার কথা আলাদা এবং তাঁর ওপরেই উল্টো ফল দেখা দিতে লাগল। ক্রমে আরো বেশি গম্ভীর আর খিটখিটে হয়ে যেতে লাগলেন। ওদের সঙ্গে না নিয়ে বেরোতেন না। তাতে ওদের কোনোই আপত্তি ছিল না। মুখ্য মানুষ, একজন কেউ এখানকার তাজ্জব ব্যাপার বুঝিয়ে না দিলে তো অর্ধেকের বেশি অজানাই থেকে যাবে।
বড়কাকা বললেন, “এখানকার সব কিছু প্রাকৃতিক জগতের মতো করে তৈরি করা হয়েছে, তবে বলা বাহুল্য তার চাইতে ঢের ভালো করে। আসল জিনিস কি আর কখনো নকলের মতো ভালো হয়? এখানে ঝড়, বন্যা, অগ্নিকাণ্ড, কিছুর স্কোপ রাখা হয়নি, বুঝলি। অথচ নিয়মিত ছয়টা ঋতু আসে যায়, আগুন লাগার জন্য দাহ্য পদার্থ চাই, সে-সব কিছু নেই। কাপড় চোপড়, পরদা, বিছানা, ফোম রবারের নকল মানুষ সব, অগ্নি-নিবারক জিনিস দিয়ে তৈরি। পোড়াতে হলে শুধু এক ঐ রান্না বান্না পোড়ানো যায়। তাও দেখেছিস তো, স্টোভের মধ্যে বিশেষ নিরাপদ গ্যাস, আর স্টোভের পাশে যে নীল রঙের নল আছে, সেটা খুলে দিলেই কিছুতে আগুন ধরে গেলেও তখনি নিবে যাবে। আর সব চাইতে ভালো কথা হল যে এখানে কোনো বিপদের সম্ভাবনা নেই। হিংস্র জানোয়ার নেই, মানুষগুলো ফোমরবারে তৈরি, কলে চলে, কথা বলে না—তা অশান্তির সৃষ্টি করবেটা কে? কোনো ঝগড়া-ঝাঁটি নেই, দলাদলি নেই, কড়া কথা নেই—ওকি?”
ওরা দুজনও কান খাড়া করল, দূরে একটা হল্লা মতো শোনা গেল কি? না, নিশ্চয় মনের ভুল। বড়কাকা আশ্বস্ত হয়ে বলে চললেন, “চোর-ছ্যাঁচড় নেই, বদমাইস-বাটপাড় নেই, ঠ্যাঙাড়ে, গুণ্ডা, চোরাকারবারি নেই—ওরা উৎসাহিত হয়ে বলল, “পুলিস, জেলখানা নেই, সব কলে হয়, আইন আদালতের দরকারই নেই। কিন্তু কল বিগড়ে গেলে কি হয়, স্যার?”
বড়কাকা বিরক্ত হয়ে বললেন, “কি আবার হবে? স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভুল শুধরে নেওয়া হয়, একি মানুষ পেয়েছিস যে ভাঙবে চুরবে, বিকল হয়ে পড়ে থাকবে? বলিনি তোদের এককণা জিনিস এখানে পড়ে থাকার উপায় নেই, সঙ্গে সঙ্গে সংগ্রহ করে, ভোল বদলে কাজে লাগানো হয়। একটা আলপিন কোথাও পড়ে থাকতে দেখবি না।”
বলতে বলতে ওরা দু সারি ছবির মতো সুন্দর বাড়ির মধ্যিখানের তকতকে বাঁধানো পথ দিয়ে একটা ছোট পাহাড়ের কাছে পৌঁছল। পাহাড় না বলে তাকে একটা বড় ঢিপিও বলা চলে। তার গা বেয়ে এঁকে-বেঁকে লাল রঙের একটা রাস্তা উঠে গেছে, তার দুই পাশে গাছে গাছে ফুল ফুটেছে।
বড়কাকা বললেন, “গাছপালা সব সত্যিকার। এমনভাবে পরিকল্পনা করে লাগানো হয়েছে যে বারো মাস কোনো না কোনো গাছে ফুল দেখা যাবে। নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া করা হয়েছে, বেশি গরমও পড়ে না, আবার বেশি শীতও হয় না। ওদের মনের মধ্যে বহুদিন আগে পড়া ভূগোলের বইয়ের পাঠগুলো নাড়া দিতে লাগল।
বড়কাকার পাহাড় চড়তে গিয়ে হাঁপ ধরে যাচ্ছিল। এরা ফুর্তির চোটে এক দৌড়ে একেবারে চুড়োয় পৌঁছে থ’! চারদিক থেকে কেমন যেন হাসিগল্প থেমে গেল, গাছপালা সরসর করে উঠল, কারা যেন সরে পড়ল, কি যেন চলে গেল। ওরা জানত সব মনের ভুল, কেউ কোথাও নেই, চারদিক খাঁ খাঁ করছে, এখানে কেউ হাসে না, কাঁদে না, ভুল করে না, করলে আপনা থেকে শুধরে নেয়, কিছু পড়ে থাকে না, কোনো জিনিস নষ্ট হয় না। কিন্তু তাই যদি হবে, তাহলে পাহাড়ের চুড়োতে মেয়েদের চুলের ক্লিপ পড়ে আছে কেন? অবাক হয়ে এ ওর মুখের দিকে তাকাল, সঙ্গে সঙ্গে একটা চাকাওয়ালা চোঙামতো যন্ত্র নিয়ে ডি ২০ আর ডি ২১ নম্বরের দুটি কলের মানুষ এসে হস করে শুকনো ফুল, খসা পাতার সঙ্গে ক্লিপটাকে উড়িয়ে সাফ করে তুলে নিয়ে, মেশিনটাকে ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে গেল। এমন সময় বড়কাকা হাঁপাতে হাঁপাতে দেখা দিলেন। পাহাড়চুড়োয় সবুজ বেঞ্চি পাতা ছিল, তাতে বসে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যেত। বড়কাকা ধপাস করে তার একটাতে বসে পড়লেন। ওঁর দম ফিরে এলে ওরা জিজ্ঞেস করেছিল, “কার জন্য এমন এলাহি ব্যবস্থা করেছেন বলুন? আমাদের কালীঘাটের গলিতে, এক ফালি জায়গা পেলে লোকে বর্তে যায় আর এখানে এত জায়গা, কিন্তু কলের মানুষ ছাড়া জামনিষ্যি নেই! এসব তবে কার জন্য করেছেন আপনারা?”
হুলো বড়কাকার পাশে বসে ঢোক গিলে বলল, “আমার ছোট বোন ফুলিটা দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে, একটু রোদে পা মেলে বসতে পায় না!” এই প্রথম বাড়ির কথা বলল ওদের মধ্যে কেউ। বড়কাকা একটু ঘাবড়ে গেলেন। যে বড় বেশি ব্যস্ত হয়ে বলতে লাগলেন, “আরে সেইজন্যেই তো আকাশ-ঘাঁটি তৈরি করা। পৃথিবীতে আর লোক ধরছে না, মিনিটে মিনিটে বাড়ছে। এই রকম কয়েক লাখ আকাশ-ঘাঁটি করে আকাশে ছেড়ে দিলেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।” তারপর কাষ্ঠ হেসে বললেন, “তাহলে অবিশ্যি আকাশ-ঘাঁটি আর আকাশ-ঘাঁটি থাকবে না, হয়ে যাবে কালীঘাট রোড।”
এই বলে কেমন উদ্বিগ্ন হয়ে চারদিকে চেয়ে বলতে লাগলেন, “এখানেও একটু বেশি বেশি লোক দেখছি যেন। জায়গাটা পশ্চিমবাংলার অর্ধেকও হবে না, এখানে মাত্র এক হাজার কর্মী পুতুল রেখে যাওয়া হয়েছিল। মেশিন দিয়ে কাজ করবার পক্ষে সেই যথেষ্ট। অথচ দেখ, সারি সারি বাড়িতে লোক কত! এত বাড়িও তো মনে পড়ছে না।”
বাস্তবিকই চারদিকে চেয়ে ওদের মন ভালো হয়ে গেল, কত লোক তার হিসাব নেই। হতে পারে কলের মানুষ, কিন্তু দেখতে তো ঠিক মানুষেরি মতো। কথা বলে না, কিন্তু একেকটার মুখ একেক রকমের, আর—আর যাবার সময় কি ডি ২১ নম্বর হুলোর দিকে চোখ মটকেছিল?
বড়কাকা দিনে দিনে আরো বেশি গুম মেরে যেতে লাগলেন। বয়সটা এতকাল বাদে যেন বোঝা যেতে লাগল। আকাশ-ঘাঁটির কতকগুলো শক্তিকেন্দ্র ছিল, সেগুলো পরিদর্শন করলেন। খুদে বাড়ির পিছনে খুদে গ্যারেজ, স্কুটার, সূর্যশক্তিতে চলে। কলের মানুষরা তার দেখাশুনা করে, তাদের যত্নে যন্ত্রটিকে মনে হচ্ছিল যে নতুন। নইলে পাঁচ বছরে স্কুটার অকেজো হয়ে যাবার কথা। প্রথমদিনই সন্ধ্যার সময় দুজন কলের মানুষ এইচ ৭ আর এইচ ৮, স্কুটার চালিয়ে এনে গ্যারাজে তুলে দিয়ে গেছিল। তাতে করে ওরা ইন্সপেকশনে বেরুল। একটাতে বড়কাকা উঠলো, অন্যটাতে ওদের দুজনকে উঠতে বললেন। তাই কখনো হয়? ছোটি স্কুটার, কিন্তু কালীঘাটের মাস্তানদের শরীর তো আর ছোট নয়। কলের মানুষরা কেমন করে কি বুঝল বোঝা গেল না, একজন ছুটে গিয়ে পাশের বাড়ির গ্যারাজ থেকে আরেকটা স্কুটার এনে দিল। কলের পুতুলের দক্ষতা দেখে, হুলো ঘোতন প্রশংসা না করে পারল না। বড়কাকা কাষ্ঠ হেসে বললেন, “ওদের কোনো বাহাদুরি নেই, যেটুকু ক্ষমতা ওদের মধ্যে ভরে দেওয়া হয়েছে, তার বেশি কিছু করা ওদের পক্ষে অসম্ভব। তবু আমি নিজেও আশ্চর্য না হয়ে পারছি না।”
শক্তিকেন্দ্রগুলো চমৎকার কাজ করছিল, দেখে কে বলবে পাঁচ বছর মানুষের হাত পড়েনি, কলের পুতুলের সাহায্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সব চলেছে। যতই দেখে, হুলো ঘোতন এতই খুশি হয় আর বড়কাকার মুখ ততই গম্ভীর হয়। মনে হচ্ছিল, খুঁৎ পেলেই যেন খুশি হতেন।
আশ্চর্যভাবে তৈরি ঐ আকাশ-ঘাঁটি, যেন ছোটখাটো একটা পৃথিবীর মডেল, তেমনি আকৃতি, সেই একই নিয়মে চলে। ব্যাপারটা বুঝিয়েও বললেন বড়কাকা, “পৃথিবীর কোটি কোটি বছর ধরে পরীক্ষিত নিয়মগুলোকেই ঝেড়েঝুড়ে কাজে লাগানো হয়েছে। বাজে জিনিস সব বাদ। অত রকম গাছ-গাছড়া, জন্তুজানোয়ার, পোকামাকড় দিয়ে কার কি উপকার হবে বল? একটাও পোকা আনা হয়নি—বাদে তোদের গুবরে ওয়ান, গুবরে টু। মোটকথা যেসব জিনিস কাজেও লাগে না, দেখতেও ভালো না, সে-সব কিছু পাবি না এখানে। ট্যাপারি তৈরি না হলে কার কি ক্ষতি হত বল? ট্যাপারি নেই এখানে।” বাড়ি ফিরে এসে হুলো এক বোতল ট্যাপারির জ্যাম টেবিলে এনে রাখল। তাই দেখে বড়কাকার মুখ এমন সাদা হয়ে গেল যে ওরা না হেসে পারল না। বড়কাকা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, “আকাট মুখ্যু তোরা তাই হাসছিস। ট্যাপারির বিচি যদি ভুলক্রমে চলে এসেও থাকে, কলের মানুষরা জ্যামের প্রণালী জানল কি করে? আমরা যা নিজেরাই জানি না, তা ওদের শেখাব কি করে?”
হুলে বলল, “হয়তো একটা রান্নার বইয়ের ছেঁড়া পাতা কলের পুতুলের মধ্যে ঢুকে গেছিল।” বড়কাকা ধমক দিয়ে উঠলেন “যা বুঝিস না, তাই নিয়ে কথা বলি না। এখানে কোনো শত্রুপক্ষ ঢুকেছে। খবরদার ঐ জ্যাম মুখে দিবি না!”
ঘোতন অবাক হয়ে বলল, “ওমা! আমরা তো টিফিন খেয়ে খেয়ে একটা বোতল ফুরিয়েই ফেলেছি। খাসা জিনিস।” বড়কাকার শরীর খারাপ লাগতে লাগল, উনি শয্যা নিলেন, রাতে খেলেন না।
পরদিন আলমারি খুলে গোছা গোছা বই নামিয়ে, পেনসিল নিয়ে বসে পড়ে, ওদের বললেন, “আমি আজ খিদের বড়ি খেয়ে থাকব। তোদের যা ইচ্ছা খাস, আর সঙ্গে কিছু নিয়ে ঐ পুব দিকটা পরিদর্শন করে আয়, ওটা দেখা বাকি রয়ে গেছে। আমি পায়ে জোর পাচ্ছি না।”
শুনে ওরা মহা খুশি, “স্কুটার নেব, বড়কাকা? তাহলে অনেকটা ঘুরে আসতে পারব।” বড়কাকা মুখ তুলে বললেন, “যা খুশি নিস, তবে সন্ধ্যার আগে ফিরিস। আমার কিরকম-ইয়ে-নার্ভাস লাগছে।”
ওরা তাঁকে সাহস দিয়ে বেরিয়ে পড়ল। পৃথিবীর ছোট মডেল। টপ করে এক বার পাক খেয়ে আসে, যেমন ছোট দিন, তেমনি ছোট রাত। তবু নাকি যন্ত্রের সাহায্যে পাকের গতি কমিয়ে রাখা হয়েছে। ওরা মনের আনন্দে গান জুড়ে সোজা পুব দিকে চলল। মনে হল গাছপালা, ফুলের ঝোপ, পাখি, হরিণ ফূর্তির চোটে লাফাতে শুরু করেছে। কোথা থেকে দলে দলে প্রজাপতি উড়ে এল। তাহলে শুঁয়োপোকাও নিশ্চয় আছে। তারাই হয় তো গাছের পাতা খেয়ে শেষ করে দেয় বলে পাঁচ বছরেও আকাশ-ঘাঁটি জঙ্গলে ভরে যায় নি। বেজায় হাসি পেল দুজনার, প্রাণ খুলে হা-হা হো-হো করে খানিকটা হেসেও নিল। অবাক হয়ে চেয়ে দেখল দূরের গাছতলায় কলের মানুষের দল কাজ ফেলে হেসে গড়াচ্ছে। এবার ওরা এমনি চমকে গেল যে সঙ্গে সঙ্গে হাসিও থেমে গেল। অমনি কলের মানুষরাও যে-যার উঠে পড়ে কাজে লেগে গেল, যেন কিছুই হয় নি।
নাকি সবটাই চোখের ভুল। কাজের মানুষ দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে গেছে, এখন কুঁড়ে মানুষ, আমুদে মানুষ দেখবার স্বাদ হয়েছে। কালীঘাটে বুড়ো-ঠাকুরদার আমলের এঁদো পুকুরে মাছ কত। সেখানে একটা কামরাঙা গাছের তলায় ভাঙ্গা ঘাটের সিঁড়ি আছে, তাতে বসে ছিপ হাতে ওরা কত দুপুরই কাটিয়েছে। ভারি মিষ্টি কামরাঙ্গা, খেলে নাকি জ্বর আসে। কই ভুলো ঘোতনের তো কখনো জ্বর আসেনি। মুদির দোকান থেকে এক পলা তেল চেয়ে এনে, রোগী বোনটাকে দিয়ে কাঠের জ্বালে ভাজিয়ে খেয়েছে। যেন অমৃত।
অন্যমনস্ক হয়ে ওরা আরো কতদূরে চলে এসেছিল নিজেদের খেয়াল নেই। সামনে একটা মস্ত পাঁচতলা বাড়ি, নিচের দিকে নিরেট দেয়াল। হয় তো কোনো গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি আছে। ওপরে ঘুলঘুলির মতো ছোট দেখতে জানলা! হয় তো ততটা ছোট নয়, নিচে থেকে দেখতে ঐ রকম লাগছে। চারদিকে খাঁ-খাঁ করছে ঘাসজমি। এখানে কোনো যন্ত্র-মানুষও দেখা যাচ্ছিল না। ওরা স্কুটার থেকে নেমে পায়ে হেঁটে ঘুরতে ঘুরতে, খিলান দেওয়া বন্ধ ফটকের সামনে পৌঁছল। অমনি ঠক করে কি একটা ছোট জিনিস ওদের পায়ের কাছে পড়ল। তুলে দেখে চামড়ার স্পষ্ট ছাপ লাগানো একটা টিসো কোম্পানির হাতঘড়ি। অতখানি নিচে পড়েও ভাঙেনি।
তাই দেখে হুলোর হাত-পা ঠাণ্ডা। দু পা পিছু হটে ওপরে তাকিয়ে মনে হল অনেক উঁচুতে, খুদে ঘুলঘুলিতে খুদে রুমাল উড়ছে। তখন হুলো ঘোতনকে পায় কে? বিপদ দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়া ওদের অভ্যাস, বুকে ওদের ভয়-ডয় ছিল না, এক ভূতের ভয় ছাড়া। এখানে মানুষই নেই, তাহলে ভূত আসবে কোত্থেকে? মানুষ মলে তবে না ভূত তৈরি হবে! মানুষ যাতে না মরে, সেইটেই আগে দেখা দরকার।
ফটকে বাইরে থেকে খিল দেওয়া। খিল তুলে ঠেলা দিতেই নিঃশব্দে দরজা খুলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল চারদিকে গুণ গুণ করে মেশিন চলতে শুরু করল। হুলো প্রথমটা চমকে উঠেছিল, তারপর বুঝল দরজা খোলার চাপে এর কিছু যোগ আছে। সামনে মস্ত হল-ঘরের এক পাশে পাক দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে, অন্য দিকে নিঃশব্দে একটা স্বয়ংক্রিয় লিফট নেমে এল।
ওরা তাতে না উঠে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে গেল। চেনা বামুনই ভালো। উঠছে তো উঠছেই। থেকে থেকে একটা করে দরজা। ওরা সোজা পাঁচ তলায় উঠে থামল। বুকে হাতুড়ি পিটছিল, হাঁপে না ভয়ে তা টের পাওয়া যাচ্ছিল না। হাঁপেই হবে, কালীঘাটের মাস্তানের আবার ভয় কিসের। দরজা ঠেলে দেখে ছোট হল-ঘর, মাথার ওপর আলো জ্বলছে, চারদিকে চারটি দরজা। সব দরজায় বাইরে থেকে খিল দেওয়া। সব খুলে ফেলে দিল ওরা, ভিতর থেকে বেরিয়ে এল দুই সায়েব, দুই মেম আর গোটা পাঁচ ছয় ছেলেপুলে। যেমন যেমন ঘটেছিল এ গল্পে তার তেমনি বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে। মেম দুটো ওদের গলা জড়িয়ে গালে চুমোটুমো খেয়ে একাকার। কিন্তু কিচির মিচির করে কি যে বলছিল বোঝে কার সাধ্যি।
সায়েবরাও কত জিজ্ঞাসা করল, তার মধ্যে শুধু ‘বাগ্চি’ কথাটাই বোঝা গেল। বড়কাকার নাম বাগ্চি। হুলো ঘোতন যে একেবারে ইংরিজি জানত না তাতো নয়, তবে এরা বোধ হয় ফরাসী ভাষায় বলছিল, খুব চন্দ্রবিন্দু লাগাচ্ছিল। কিন্তু ওদের সারা গায়ে ভারি চমৎকার একটা মানুষ-মানুষ ঘেমো গন্ধ। শুঁকলে প্রাণ জুড়ায়। শেষটা ভুলো সাহস করে বলল, “বাগ্চি কাম্।” শুনে ওরা আহ্লাদে আটখানা।
দেখতে দেখতে সবাই মিলে হুড়মুড় করে নিচে এল। কোথা থেকে কয়েকটা স্কুটার বেরুল। কেউ কারো কথা বোঝে না, কাজেই সময় নষ্ট করে কি লাভ? দল বেঁধে ওরা বড়কাকার বাড়িতে ফিরে এল। পাঁচতলা বাড়ি যেমন ছিল তেমনি পড়ে রইল, শুধু সদরের ফটক বন্ধ করতেই আলো নিবে গেল, মেশিন বন্ধ হল। ওদের সাড়া পেয়ে পড়িমরি করে বড়কাকা ছুটে বেরিয়ে এলেন। তাঁকে দেখে সায়েব দুটো—তা যার খুশি অবিশ্বাস করতে পারে—ছুটে গিয়ে দুই গালে চুমো খেয়ে ফেলল। হুলো এমনি চমকে গেল যে মুখ থেকে ইংরিজিতে বেরিয়ে এল, “মাই গড!” তার পরের ব্যাপার আরো আশ্চর্যের। দলে দলে দলে দঙ্গলে দঙ্গলে কলের মানুষরা ওদের ঘিরে দাঁড়াল, তাদের নানা রঙের সাজ দেখে এক ঝাঁক রঙ্গীন প্রজাপতির কথা মনে হয়। মাথার ওপর থেকে একটা গুণ গুণ শব্দ শোনা গেল; প্রায় সেই স্পেস্-স্টেশনের মতো চেহারার, কিন্তু অনেক ছোট কতকগুলো রূপোলী চ্যাপ্টা আকাশযান কে জানে কোথা থেকে দেখা দিল আর কলের মানুষরা হো-হো করে হাসতে হাসতে, হাত নেড়ে গুডবাই জানিয়ে প্রজাপতির মতো ডানা মেলে উড়ে গেল। নীল আকাশ রঙের কুচিতে ছেয়ে গেল, আকাশ-ঘাঁটির যেখানে যত কলের মানুষ ছিল সবাই বোধ হয় বিদায় নিল। আকাশযানের নিচে দরজা খুলল, ওরা ঢুকে যেতেই, আকাশযানও উড়ে গেল।
বিনো আর করিগা মুখ হাঁ করে তাকিয়ে রইল। তাদের স্ত্রীপুত্রকন্যারা মহানন্দে চারদিকে ছুটে বেড়াতে লাগল, যেন কিছুই হয়নি। বড়কাকা হাত পা এলিয়ে পড়ে যাবার যোগাড় করছেন দেখে, হুলো ঘোতন একসঙ্গে বলে উঠল, “কি এমন হয়েছে যে মুচ্ছো যাবার চেষ্টা করছেন?” বড়কাকা এমনি রেগে গেলেন যে মুচ্ছোটুচ্ছো একেবারে সেরে গেল। তেরিয়া হয়ে বললেন, “এত বড় জায়গাটার কাজকর্ম কে করবে শুনি? রোবোগুলো তো সব জ্যান্ত হয়ে উড়ে গেল।” বলে কেমন হিস্টিরিয়া রুগীর মতো ফ্যাকফ্যাক করে হাসতে লাগলেন। তাই শুনে বিনো করিগাও হাঁটু চাপড়ে মাটিতে বসে পড়ে হেসে গড়াগড়ি দিতে লাগল। চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল।
হুলো ঘোতন কোনো কথা না বলে কলের মানুষরা ঘাস জমিতে যে নাইলনের নল দিয়ে জল দিত, সেটি তুলে নিল। তাই দেখেই বড়কাকার হিস্টিরিয়াও সেরে গেল। হুলো বলল, “আমাদের বাড়ির লোকদের যদি এখানে এনে দেন, আপনাদের কলের পুতুল ফিরিয়ে তার চেষ্টা করি।” বড়কাকা বললেন, “এক্ষুণি, এক্ষুণি! আরে এখানে বাছাই করা লোক বসিয়ে পৃথিবীর জনসংখ্যা কমানোই তো আমাদের উদ্দেশ্য। তবে বিশ্বাসী লোক বারোমাস এখানে থাকতে চায় না। তাই তোদের ভুলিয়ে ভালিয়ে আনতে হল। তোদের মতো সাহসী লোক কোথায় পাব বল্? তাছাড়া শুনেছি মাস্তানদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলে তাদের মতো বিশ্বাসী বন্ধু এবং কর্মী আর পাওয়া যায় না।”
হুলো ঘোতন হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলল, “এখানে একটা ছোট নদী দেখেছি, তাতে চিংড়ি মাছ ইত্যাদি ছাড়া যাবে না?” বড়কাকা বললেন, “খুব যাবে। চারাটারা সব এনে দেব। এবার বল্ কলের মানুষরা কোথায়?”
ঘোতন হেসে বলল, “প্রত্যেক রাস্তার দশ নম্বর বাড়িতে গোটা কুড়িক্ এলিয়ে
পড়ে আছে, ওরা বোধ হয় তাদের চাবি খুলে নিয়েছে।” বড়কাকা “বলিস কি!” বলে তিন হাত লাফিয়ে উঠলেন। সায়েব দুটো হোয়াট্? হোয়াট্? করতে করতে ছুটে এল।
দেখা গেল বাস্তবিকই তাই। হুলো ঘোতনের অভ্যাস চারদিকে নজর রাখা, এখানে ওখানে উঁকি মেরে ঐ ব্যাপারটি তারা আবিষ্কার করেছিল। তবে ওরা ভেবেছিল পুতুলগুলো হয়তো সম্পূর্ণ নয়, আরো কিছু করলে তবে চালু হবে। বড়কাকা আর দুই সায়েবের সঙ্গে এর পরের ক’দিন কলের মানুষদের আবার চলৎশক্তি ফিরিয়ে আনতেই কেটে গেল। জনা পঞ্চাশ চালু হলে, তাদের সাহায্যে কাজ আরো সহজ হল।
তারপর এক দিন সন্ধ্যাবেলায় বিনোর বাড়ির বাগানে বসে কথা হচ্ছিল, বড়কাকা দোভাষীর কাজ করছিলেন। মেমরা থেকে থেকে কফি আর ভালো ভালো খাবার জিনিস এনে দিচ্ছিল। হুলো বলল, “সব বুঝেছি, কিন্তু ঐ যারা উড়ে চলে গেল, তারা কে?”
করিগাকে এ কথা অনুবাদ করে বলাতে হাত পা নেড়ে সে যা বলল, তার বাংলা করলে সংক্ষেপে দাঁড়ায়, এই ধরনের কিছু “আমাদের সৌরমণ্ডল আছে, আকাশের দিকে খালি চোখে দেখলেও সেটা বোঝা যায়। যত তারা দপ্দপ্ করে জ্বলে, প্রত্যেকের চারদিকে অনেকগুলি করে গ্রহ ঘোরে। তাদের মধ্যে অন্ততঃ দুটি একটির প্রাকৃতিক পরিবেশ আমাদের পৃথিবীর মতোই। সেখানেও নিশ্চয় বুদ্ধিমান জীব আছে, হয়তো মানুষের চাইতেও তারা বেশি জ্ঞানী। আমাদের মনে হয় তাদের একদল এখানে এসে গত পাঁচ বছরে একাধিক বার ছুটি কাটিয়ে গেছে। এখানকার হালচাল শিখে নেবার পর আমাদের রোবোদের উপস্থিতিতে ওদের হয়তো অসুবিধা হত। রোবোদের মাথায় সব কিছু রেকর্ড হয়ে যায়, ওদের সব কথা জানাবার ইচ্ছা না-ও থাকতে পারে, তাই খুব দক্ষভাবে রোবোদের অচল করে, নিজেরা রোবো সেজে ছিল। যখন কেউ থাকত না, তখন হয়তো রোবো সাজ পরত না। যেমন বাগচির সঙ্গে কথা ছিল। মাস দুই হল আমরা এসেছি। প্রথমটা খেয়াল করিনি, গুছিয়ে বসতেই ব্যস্ত ছিলাম। তারপর ছেলেমেয়েরা কেবলি বলতে শুরু করল একই নম্বরের একাধিক রোবো আছে। তাতো থাকবার কথা নয়। তারা কাজও করে ঢের বেশি। যে বিদ্যা পুরে দিয়েছিলাম, তার বেশি তো জানবার কথা নয়। আমাদের গিন্নিরা জ্যাম জেলি বানিয়েছিল, কিন্তু বাগচির বাড়িতে সে সব এল কোত্থেকে? যেই না মনে সন্দেহ হওয়া, সঙ্গে সঙ্গে ওরাও টের পেয়ে গেল। সকালে ঘুম ভেঙে দেখি ঐ বাড়ির পাঁচতলায় আমরা বন্দী। কিন্তু কি ভালো খাবার দিয়ে যেত একটা সত্যিকার রোবো সে আর কি বলব!
আজ আমরা ছাড়া পেয়েছি দেখে পালিয়েছে সব।”
ঘোতন বলল, “কিম্বা হয়তো ওদের ছুটিও ফুরিয়েছে, তাই আকাশযান ওদের নিতে এসেছিল। কোথা থেকে কে জানে!” এসব ঘটনার পর আরো বছর দুই কেটে গেছে। হুলো ঘোতন আকাশ-ঘাঁটির স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছে। রোগা বোনটা আজকাল নেচে বেড়ায়। বড়কাকা ত ওখানেই থাকেন, মাঝে মাঝে পৃথিবী থেকে ঘুরে আসেন, দরকারি জিনিস সওদা করে আনেন। সেই দেখে ওখানে ঐ জিনিস তৈরি হয়। এখন সেখানে অনেক বাসিন্দা। সব নিয়ে হাজার খানেক হবে। তাদের মধ্যে হুলো ঘোতনের মনের মতো দুটি মেয়েও আছে। এ গল্পের শেষটা ভালো।
এই রকম আরো হাজার হাজার পৃথিবী তৈরি করা হবে। তাদের যে কোনোটি থেকে পরিষ্কার রাতে আকাশের দিকে তাকালে, স্থির নীল রঙের একটি ছোট গ্রহ দেখা যাবে। সেই আমাদের এই পৃথিবী।
.
প্রথম প্রকাশ: ফ্যানট্যাসটিক, সেপ্টেম্বর, ১৯৭৬