মাইক্রোমেগসের পৃথিবী যাত্রা • শান্তি ঠাকুর
সিরিয়াস (লুব্ধক) নক্ষত্রপুঞ্জের একটি গ্রহের সুস্থ সবল এক যুবক। কিছুদিন আগে যখন সে উইঢিবির মতো আমাদের এই ছোট্ট পৃথিবীতে এসেছিল হঠাৎ তার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গেল। নাম ছিল তাঁর মাইক্রোমেগস। মাথায় প্রায় সোয়া লক্ষ ফুট উঁচু হবে। চলবার সময় পা পড়ত চব্বিশ মাইল অন্তর। পেটের ঘেরটা অর্থাৎ চওড়া পঞ্চাশ হাজার ফুট! নাকটা লম্বা ছিল দু হাজার তিনশ তেত্রিশ ফুট।
ছেলেটি বেশ সুশিক্ষিত এবং স্বভাবও মার্জিত! বয়স মাত্র দুশ পঞ্চাশ বছর। এরই মধ্যে নিজের গ্রহের সব চাইতে নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়ের সে ছাত্র। অঙ্ক শাস্ত্রের রেখা গণিতে আগেই অনার্স পেয়েছে।
চারশ পঞ্চাশ বছরে যেদিন পা দিল সেদিনও তার কৈশোরই বলতে হবে। তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন এই ছোট ছেলেটি কিন্তু এরই মধ্যেই ছোট ছোট প্রায় অদৃশ্য জীবাণুগুলিকে কেটে ছিঁড়ে পরীক্ষা করে এক তুমুল কাণ্ড ঘটিয়ে দিল। জীবাণুগুলির ব্যাস হবে হয়ত একশ ফুটের মতো। সাধারণ অণুবীক্ষণ যন্ত্রে তো এগুলি দেখতেই পাওয়া যায় না।
এইসব জীবাণু নিয়ে গবেষণা করতে করতে কিছু প্রবন্ধও সে লিখে ফেলল। এই প্রবন্ধই হল কাল। রাজ্যের সরকারী কর্তৃপক্ষ দেখলো মাইক্রোমেগস বহু অনৈতিক, অধার্মিক এবং অ-শাস্ত্রীয় কথা প্রবন্ধে লিখেছে। গোঁড়া ধার্মিকদের আঘাত করা হয়েছে। যেমন বলা যেতে পারে সে লিখেছে সিরিয়াস নক্ষত্রপুঞ্জের গ্রহগুলির ডাঁশ এবং শামুকের শারীরিক গঠন তত্ত্বের কোন বিশেষ প্রভেদ নেই।
সরকারের অন্যায় হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে মাইক্রোমেগস প্রতিবাদ জানাল। মামলা চলল প্রায় দুশ কুড়ি বছর। শেষ পর্যন্ত গোঁড়া ধার্মিকদেরই জয় হল। বিচারকদের সরকারের বিরুদ্ধে রায় দেবার সাহস হল না। তারা বইটি না পড়েই তীব্র নিন্দা করে মাইক্রোমেগসকে আটশ বছরের নিবার্সন দণ্ড দিয়ে রাজ্য ত্যাগ করতে বললেন।
মাইক্রোমেগস সরকারের নামে এক ব্যঙ্গ সঙ্গীত রচনা করে সোজা গ্রহ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ল। গ্রহ নক্ষত্রগুলির মাধ্যাকর্ষণ এবং অন্যান্য আকর্ষণ বিকর্ষণের নিয়ম সম্বন্ধে তার খুব ভাল জ্ঞান ছিল। এমন কি সে এও জানত যে কেমন করে সূর্যের রশ্মির সাহায্যে অথবা ধূমকেতুর উপর চেপে জলের মধ্যে মাছের মতো হাওয়াতে কেমন করে চলতে হয়। সুতরাং গ্রহ যাত্রায় তার কোন বাধাই হল না।
কয়েক বছর চলতে চলতে একদিন সে শনিগ্রহে পৌঁছে গেল। নিজের গ্রহের তুলনায় শনিগ্রহ তার কাছে অত্যন্ত ছোট মনে হল। ওখানকার ক্ষুদ্র প্রাণীগুলিকে দেখে পোকার মতো মনে হতে লাগল! ওদের দেখে সে হেসেই বাঁচে না। শনিগ্রহের বাসিন্দারা গড়ে ছ’হাজার ফুটের বেশী উঁচু হবে না। মাইক্রোমেগস বেশ বুদ্ধিমান ছিল। সুতরাং সে জানত যে শারীরিক আকারে ছোট হলেই প্রাণীকে তুচ্ছ মনে করাটা মোটেই সুবুদ্ধির কাজ হবে না। প্রথমে মেলামেশার একটু কষ্ট হল। ক্রমে সকলের সঙ্গেই বেশ ভাব জমে গেল। দেখল শনিগ্রহের জীবেরাও বেশ বুদ্ধিমান। শনি গ্রহের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালকের সঙ্গে বন্ধুত্ব খুবই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল। নিজে ভদ্রলোক কোন গবেষণা করেন নি। তবে তিনি অপরের দুর্বোধ্য গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত অতি সহজেই মাইক্রোমেগসকে বুঝিয়ে দিতে লাগলেন।
মাইক্রোমেগস জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা! তোমাদের গ্রহের লোকেরা কটা ইন্দ্রিয় দিয়ে রূপ-রস উপভোগ করে আর জ্ঞান অর্জনই বা করে কটা দিয়ে?”
“কর্ম ইন্দ্রিয় এবং জ্ঞান ইন্দ্রিয় মিলিয়ে বাহাত্তরটি ইন্দ্রিয় দিয়ে আমরা কাজ করি।”
শনিগ্রহের শিক্ষালয়ের পরিচালক বলে চলল, “এই সীমিত সংখ্যা ইন্দ্রিয়ের বিষয়ে আমরা বহুদিন ধরে অভিযোগ করে আসছি। কারণ আমাদের কল্পনা শক্তি আমাদের সাধারণ প্রয়োজনের সীমারেখাকে অতিক্ৰম করে চিরদিনই বেড়ে চলেছে। অতএব মাত্র এই বাহাত্তরটি ইন্দ্রিয়ের দ্বারা আমাদের পঞ্চ চন্দ্র যুক্ত গ্রহের চারপাশের আলোক রাশিকে ভেদ করে যাওয়া সম্ভব নয়। এই ক্ষুদ্রসীমায় আবদ্ধ থাকতে চাই না। আরও মজার কথা হল এই যে এই বাহাত্তরটি ইন্দ্রিয়ের দ্বারা কাজ করতে করতেও মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা নিষ্কর্মা হয়ে যাচ্ছি।”
একথা শুনে মাইক্রোমেগস শনিগ্রহবাসীকে বলল, “আমার পূর্ণ বিশ্বাস যে তোমরা অন্ততঃ কিছু না কিছু করছই। আমরা সিরিয়াসবাসীরা প্রায় এক হাজার ইন্দ্রিয়ের দ্বারা রূপ রস ইত্যাদি অনুভব করি। তবুও আমরা মনে মনে অতৃপ্ত। আমাদের মনে হয় এই বিরাট বিশ্বে হয়ত ভ্রমণ করে আমি নিজেও দেখেছি যে আমাদের তুলনায় উন্নত এবং নিম্নতর অনেক প্রাণী রয়েছে, সর্বত্র দেখলাম বুদ্ধিজীবী প্রাণী মাত্রেই নিজের প্রয়োজনের বাইরে আকাঙ্ক্ষাকে বাঁচিয়ে নিয়ে চলেছে। আমার মনে হয় শিগগিরই হয়ত এমন একটা গ্রহে পৌঁছে যাব সেখানে দেখব লোকের কোন অভাবই নেই।”
দুই বন্ধুতে বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলল! সিরিয়াসবাসী শনিগ্রহবাসীকে জিজ্ঞেস করল, “ভাই শনিগ্রহের লোকেরা কতদিন বাঁচে?”
“আমাদের গড় আয়ু খুবই কম,” দীর্ঘশ্বাস পেলে শনিগ্রহবাসী উত্তর দিল।
সিরিয়াসবাসী সমবেদনা জানিয়ে বলল, “আমাদেরও ঠিক একই অবস্থা! মৃত্যুর বিরুদ্ধে অভিযোগ আমরা প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছি। বোধ হয় প্রকৃতির এই নিয়ম সর্বব্যাপী।”
শনিগ্রহবাসী বলল, “বড়ই পরিতাপের বিষয় আমাদের গ্রহের অতি সামান্য সংখ্যক লোকই পাঁচশ সূর্য পরিক্রমণের বেশী বাঁচে। (পৃথিবীর বছর হিসাবে এটা পনের হাজার) এই সামান্য জীবনে কি করা যায়? কোন কিছু শিখতে আরম্ভ করবার সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু এসে হাজির। জীবনের কোন সুখই আর ভোগ করা হয় না।” মাইক্রোমেগস মুচকি হেসে বলল, “তুমি বৈজ্ঞানিক না হয়ে দার্শনিক হলে বুঝতে যে তোমাদের তুলনায় প্রায় সাতশ গুণ বছর বেশী বেঁচেও আমাদের ঐ একই দশা। আমি এমন গ্রহে ঘুরেছি যেখানে হাজার গুণ বেশী বছর বেঁচেও তারা আজও মৃত্যুকে জয় করবার চেষ্টায় আছে। অবশ্য আবার এমনলোকও দেখেছি যারা সামান্য জীবন কালেই নিজের কর্তব্য করে বিনা অভিযোগ মৃত্যুকে বরণ করে। সমগ্র বিশ্বের বাইরের পরিস্থিতি যদিও আলাদা তবু মূলে সবই এক সূত্রে গাঁথা। বিভিন্ন গ্রহে পদার্থের গুণ, মাত্রা এবং সংখ্যায় যথেষ্ট প্রভেদ হবেই। আচ্ছা তোমাদের শনিগ্রহে বাস্তব দৃষ্টিতে পদার্থের প্রধান গুণ কত ছিল?”
“আমাদের এখানে পদার্থের বিস্তার, গতি, মাধ্যাকর্ষণ, বিভাজন, ভর ইত্যাদি নানা গুণের সংখ্যা প্রায় তিনশ হবে,” শনিগ্রহবাসী উত্তর দিল।
“এই সংখ্যা খুবই অল্প। অবশ্য তোমাদের গ্রহের সীমাই বা কতটুকু। গ্রহের তুলনায় প্রাণীদের আকারও ছোট। ইন্দ্রিয়ের অনুভূতির সংখ্যাও কম। আচ্ছা তোমাদের চোখে সূর্যের রং কি?”
“একটু হলদে মিশ্রিত সাদা রং। বিশ্লেষণ করলে ওতে আমরা সাতটি রং পাই।”
“আমরা কিন্তু সূর্যকে দেখি লালচে মতো। সিরিয়াসবাসী সূর্যের একটি কিরণকে বিশ্লেষণ করলে ওতে একত্রিশটি মূল রং-এর সন্ধান পায়। আমি যতগুলি জ্যোতিষ্ক দেখেছি তার একটা আর একটার সঙ্গে মোটেই মেলে না। প্রত্যেকের রং আলাদা।” বিজ্ঞান বিষয়ে অনেকক্ষণ আলোচনা হবার পর ঠিক হল ওরা দুজনেই একসঙ্গে বৈজ্ঞানিক তথ্য সন্ধানের জন্য গ্রহ ভ্রমণে বেরুবে। অঙ্ক শাস্ত্রের মাপজোকের যন্ত্র, দূরবীণ আরও অনেক ছোটখাট জিনিসপত্র নিয়ে তৈরি হল। হঠাৎ শনিগ্রহবাসীর স্ত্রী কেমন করে খবর পেয়ে হাজির। মহিলা দেখতে বেশি বড় নয় মাত্র তেত্রিশ ফুট উঁচু। কিন্তু চেহারায় তার এমন একটা মাধুর্য রয়েছে যাতে দৈহিক খর্বতা অনায়াসেই ঢাকা পড়ে যায়। খবর পেয়ে স্বামীর উপর চটে লাল। বলতে লাগল, “এ কেমন কথা! দেড় হাজার বছর তোমার সঙ্গে পরিচয়ের পর মাত্র দুশ বছর হল আমাদের বিয়ে হয়েছে। মধু যামিনী শেষ হবার আগেই তুমি চললে ঐ দৈত্যটাব সঙ্গে। শনিগ্রহবাসী কেউ আজ পর্যন্ত নিজের স্ত্রীকে ছেড়ে কোথাও যায় নি। আমি বুঝতে পেরেছি তুমি ঐ দৈত্য-দেশে গিয়ে কোন দৈত্যের মেয়েকে আবার বিয়ে করবে।”
বেচারা শনিগ্রহবাসী অপ্রস্তুত। বহু কষ্টে স্ত্রীকে বুঝিয়ে শান্ত করে কোন রকমে শেষ পর্যন্ত অনুমতি পেল। তারপর দুজনে রওনা হল বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি সঙ্গে করে। শনিগ্রহ একটি বলয়ে ঘেরা। শনি থেকে ওরা লাফিয়ে পড়ল ঐ বলয়ে। বলয় থেকে প্রথম চাঁদে—তারপর দ্বিতীয় চাঁদে এমনি করে চলল তাদের যাত্রা। ভাগ্য ভাল ছিল রাস্তায় পেয়ে গেল এক ধূমকেতুকে। অমনি লাফিয়ে চেপে বসল তার ঘাড়ে। কয়েক কোটি মাইল চলবার পর হাজির হল বৃহস্পতি গ্রহে। সেখানে বছর কয়েক কাটিয়ে অনেক কিছু খোঁজ খবর নিয়ে এবার এল মঙ্গলগ্রহে। এ গ্রহটি মোটেই ওদের ভাল লাগল না। এত সঙ্কীর্ণ জায়গায় যেন দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। কাজেই তাড়াতাড়ি এখান থেকে পালিয়ে গেল। পথ চলতে চলতে ওরা অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। বিশ্রাম করবার মতো একটু জায়গাও দেখতে পেল না। মনে মনে ভাবল মঙ্গলগ্রহে একটু কষ্ট করে কিছুক্ষণ থেকে বিশ্রাম করে এলেই হত।
শেষ পর্যন্ত ছোট একখণ্ড ভূমি ওদের চোখে পড়ল! এই ভূমিখণ্ডই হল আমাদের পৃথিবী। ওরা যদি একান্ত ক্লান্ত না হত তবে কিছুতেই আমাদের এখানে নামবার কথা ওদের মনেই হত না। হয়ত আরও দূরে কোথাও চলে যেত। যাক শেষ পর্যন্ত ধূমকেতুর লেজ থেকে লাফিয়ে পড়ল ধ্রুবতারার কাছে—অরোরা বোরি এলিস নামে জ্যোতি মালার উপর। এই বিচিত্র যানে আরোহণ করে ১৯৩৭ সালের ৫ই জুলাই এরা এসে হাজির হল বাল্টিক সাগরের ধারে।
পৃথিবীতে নেমে ওরা দুজন খানিকক্ষণ আরাম করল। তারপর এই অতি ক্ষুদ্র গ্রহটির উত্তর প্রান্ত থেকে দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত বাচ্চাদের মতো কৌতূহল নিয়ে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় ঘুরে বেড়িয়ে নিল। মাইক্রোমেগস প্রতি পদক্ষেপে প্রায় তিরিশ হাজার ফুট যাচ্ছিল। বেচারা শনিগ্রহবাসী কোন রকমে দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ওর সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছিল।
মাইক্রোমেগস পায়ে হেঁটেই সমুদ্র পার হচ্ছিল। বর্ষার জলে খেতখামার ভেসে গেলে লোকে যেভাবে পথ চলে এ কতকটা সে রকম। সমুদ্রের জল কোন রকমে ওর গোড়ালি অবধি উঠেছিল। শনিগ্রহ বাসীর অবশ্য হাঁটু পর্যন্ত কাপড় তুলতে হয়েছিল, সুতরাং তার কষ্ট একটু বেশীই হয়েছে।
মাত্র ছ ঘণ্টায় ওরা দুটো গোলার্ধই ঘুরে নিল। চলতে চলতে লক্ষ্য করে পৃথিবীর বুকে হামা দিয়ে চলে মানব নামে একটি অতি সূক্ষ্ম প্রাণীর সন্ধান পেল। যাদের বিনা অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে দেখতে পাওয়াই ভার। শনিগ্রহবাসীর কিন্তু ধারণা হল, এই গ্রহে কোন প্রাণীই নেই।।
মাইক্রোমেগস বোঝাল, “এত তাড়াতাড়ি কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ নয়। বহু ছোট ছোট তারা আছে যাদের তুমি খালি চোখে দেখতে পাও না। কিন্তু আমি তাদের অনায়াসেই দেখতে পাই। বল, তুমি দেখতে পাও না বলে তাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করবে?”
“আমি শুধু চোখে নয়, হাত দিয়েও অনুভব করবার চেষ্টা করেছি।”
“তোমার স্পর্শশক্তি তো ক্ষীণ হতে পারে?”
“যাই হোক এই গ্রহটা আমার কাছে এক মজার গ্রহ মনে হয়। রেখার মতো নদীগুলির ধারা একবার দেখ। একটার গতিপথও সোজা নয়। আর এই পুকুরগুলি দেখ (সমুদ্র দেখিয়ে বলছে) এগুলি না গোল না চৌকো। যেন একটা ডিম। অদ্ভুত এর চেহারাটা। আর এই কাঁকর পাথরগুলি দেখ, (পাহাড় দেখিয়ে বলছে) কি বিশ্রী! এর উপর দিয়ে চলতে গিয়ে আমার পা তলটা একদম ছড়ে গিয়েছে। কোন বুদ্ধিমান প্রাণীর এ গ্রহে থাকা সম্ভব নয়।”
“এই বিশ্ব নানা বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। তুমি এই গ্রহকে বৃহস্পতি এবং শনির সঙ্গে তুলনা করছ বলে এটা তোমার কাছে এত খারাপ মনে হচ্ছে।”
দুজনে বেশ কিছুক্ষণ তকাতর্কি করেই চলেছে। হঠাৎ মাইক্রোমেগসের গলার হীরার হারটি গেল ছিঁড়ে। এই হীরার মধ্যে সবচেয়ে বড় হীরাটির ওজন ছিল প্রায় পাঁচমণ। শনিগ্রহবাসীর হঠাৎ খেয়াল হল, আচ্ছা এই এক টুকরা হীরা দিয়ে তো দূরবীণের কাজ বেশ চলতে পারে। প্রায় একশ ফুট ব্যাসের একটি হীরার টুকরা তুলে নিয়ে নিজে চোখে লাগাল। মাইক্রোমেগসও ব্যাপারটা বুঝে নিল। সেও প্রায় পাঁচশ হাজার ফুট ব্যাসের এক টুকরা হীরা তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে আরম্ভ করল।
শনিগ্রহবাসী বাল্টিক সাগরের দুটি ঢেউয়ের মাঝে কি একটা ক্ষুদ্র জীব দেখতে পেল। আসলে ওটা ছিল তিমি মাছ। অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে সে ওটিকে তুলে নিয়ে বুড়ো আঙ্গুলের নখের ওপর রেখে সিরিয়াসবাসীকে দেখাল। মাইক্রোমেগস এই সূক্ষ্ম জীবটিকে দেখে হেসেই খুন।
এই সূক্ষুদ্র প্রাণীর ভিতর কল্পনাশক্তি এবং স্বাধীন চিন্তা থাকা সম্ভব কিনা,
এই নিয়ে দুজনে বেশ কথা কাটাকাটি হতে লাগল। যাই হক, তারা শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে এল যে, এই ক্ষুদ্র গ্রহের সমস্ত প্রাণীকেই নখের ওপর রাখা যেতে পারে। এবং এই জীবদের মন এবং বুদ্ধি বলে কোন জিনিসই থাকা সম্ভব নয়।
মাইক্রোমেগস দূরবীণের সাহায্যে হঠাৎ তিমির মতো আরও কি একটা প্রাণীকে জলের উপর সাঁতার দিতে দেখতে পেল। ওটা ছিল একটি জাহাজ। কিছুসংখ্যক বৈজ্ঞানিক উত্তর মেরুতে পর্যবেক্ষণ করে বিফল হয়ে ফিরছিলেন। হাত বাড়িয়ে তুলে নিয়ে মাইক্রোমেগস জাহাজটাকেও নিজের নখের উপর বসিয়ে নিল। শনিগ্রহবাসী বলল, “এটা আগের জীব থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।”
মাইক্রোমেগস খুব ভাল করে নিরীক্ষণ করবার জন্য এবারে ওটাকে হাতের তেলোতে নিয়ে দেখতে লাগলো। এদিকে জাহাজের আরোহীরা ভাবল, জাহাজটা হঠাৎ তুফানে ঠেলে এনে এক পাথরে ধাক্কা দিয়েছে। নাবিকের দল মদের পিপেতে বসে মাইক্রোমেগসের হাতের উপরেই ঘুরতে আরম্ভ করল। মাইক্রোমেগসের মনে হতে লাগল অদৃশ্য কোন বস্তু যেন তার হাতের উপর দিয়ে চলে তাকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। যারা নেমেছিল, অণুবীক্ষণে মাইক্রোমেগস তাদের দেখতেই পাচ্ছিল না। অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে দেখবার পর অস্পষ্টরূপে কিছু কিছু দেখতে পেয়ে দু’বন্ধুর আশ্চর্যের সীমা রইলো না।
তারা দেখল, একেবারে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কিছু জীব নীচে নেমে কি যেন নীচে নামাচ্ছে আর উপরে তুলছে। শনিগ্রহবাসী এক দৃষ্টিতে দেখে সহসা উৎসাহিত হয়ে বলে উঠল, “এই তুচ্ছ জীবাণুর দল খুব সম্ভব প্রার্থনা করবার জন্য বসে বা দাঁড়িয়ে আছে।”
মাইক্রোমেগসও একজন নিপুণ বৈজ্ঞানিক। কথার সত্যতা পরীক্ষা করতে তারও দেরী হল না। সে বুঝতে পারল এই প্রাণীরা নিজেদের মধ্যে কি যেন বলাবলি করছে।
“এত ক্ষুদ্র জীব কি করে কথা বলতে পারে,” শনিগ্রহবাসী অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল। “কোন বিষয়ে কথা বলতে হলে অন্ততঃ কিছুটা বিচারবুদ্ধির জন্য প্রয়োজন আছে। বিচারবুদ্ধির জন্য প্রয়োজন মস্তিষ্কের। পরিপুষ্ট মস্তিষ্কের জন্য আবার আত্মার অস্তিত্ব চাই। এত ক্ষুদ্র জীবের আত্মা থাকা মোটেই সম্ভব নয়।”
“কেন? এই মাত্র তুমি বলেছিলে যে ও প্রার্থনার মতো হাবভাব করছে। বিচারশক্তি না থাকলে প্রার্থনার ইচ্ছা কি করে সম্ভব হয়?”
“প্রথমে কিছু বলা ঠিক নয়। আগে ভালভাবে এদের নিয়ে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা হওয়া প্রয়োজন।”
“ঠিক কথা,” এই বলে মাইক্রোমেগস নিজের নখ কেটে একটা ভেঁপুর মতো
মুড়ে নিয়ে গোটা জাহাজটাকে এতে ঘিরে নিয়ে ভেঁপুর চোখ দিকটা কানে লাগিয়ে নিল। এবারে জাহাজের যাত্রীদের ক্ষীণ আওয়াজ বেশ কিছুটা স্পষ্টভাবে শোনা যেতে লাগল। দুজনেই বুঝতে পারল এ প্রাণীরা বুদ্ধিমান প্রাণীদের মতো নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। ওরা দুজনেই এদের সঙ্গে কথা বলবার জন্য অত্যন্ত উৎসুক হয়ে উঠল।
মাইক্রোমেগস কিন্তু ভালভাবেই জানত যে এরা দুজন ওদের কিছু বললে সেই শব্দ ওদের কানে বজ্রপাতের মতো বিকট এবং অসহ্য মনে হবে। সুতরাং দাঁত খুঁটবার দুটো খড়কে দাঁতে চেপে ধরে গলার স্বরকে খুব নিচু করে মাইক্রোমেগস ধীরে ধীরে বলতে আরম্ভ করল—“ওহে অদৃশ্য জীবাণুবৃন্দ, সৃষ্টি কর্তার সৃষ্টির এই অপূর্ব লীলা দেখে আমি মুগ্ধ। তোমাদের মতো সূক্ষ্ম জীবকেও তিনি কি অদ্ভুত কৌশলে সৃষ্টি করেছেন?”
হাতের উপরের জীবেরা এই অদৃশ্য আকাশবাণী শুনে কেউ কেউ তো ভূত তাড়াবার মন্ত্র জপ করে বসল। ওদের এই ভয়চকিত অবস্থা দেখে শনিগ্রহবাসীর খুব দয়া হল। মাইক্রোমেগস অপেক্ষা আরও আস্তে আস্তে সে মনুষ্যরূপী ঐ জীবদের জিজ্ঞেস করতে লাগল, “তোমরা কে-কেমন করে, কিজন্য এবং কোথেকে এই পৃথিবীতে হাজির হলে?” এ ছাড়া আরও বহু প্রশ্ন তাদের জিজ্ঞেস করল, “তোমরা তোমাদের বর্তমান অবস্থিতিতে সন্তুষ্ট কিনা—তোমাদের আত্মা আছে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি।”
এরই মধ্যে এক অঙ্কশাস্ত্রবিদ হঠাৎ বলে উঠলো, “হে অজ্ঞাতনামা মহাপ্রাণী! তুমি অহঙ্কারে ডগমগ হয়ে যে ঘুরছ, তোমার উচ্চতা যদিও পাঁচ হাজার ফুট তবুও…”
শনিগ্রহবাসী কথা শুনে তো থ! নিজের বন্ধুকে লক্ষ্য করে বলল, “আশ্চর্য! এই ক্ষুদ্র জীব এত অল্প সময়ে আমার উচ্চতা সঠিকভাবে কি করে মাপল? নিশ্চয়ই এরা জ্যামিতিতে বিশেষজ্ঞ। এতটুকু অণুতে এত বুদ্ধি! সত্যিই সৃষ্টির রহস্য বিচিত্র!”
“আমি শুধু তোমার উচ্চতা কেন, তোমার বন্ধুর উচ্চতাও এক্ষুণি বলে দিতে পারি।” মুহূর্তের মধ্যে কয়েকজন গণিতজ্ঞ মিলে মাইক্রোমেগসের সামনে লম্বা একটা গাছের মতো কি দাঁড় করিয়ে ত্রিকোণমিতির সাহায্যে মেপে বলল—“এক লক্ষ কুড়ি হাজার ফুট।”
মাইক্রোমেগসের আশ্চর্যের সীমা রইল না। অজ্ঞাতসারে তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল, “হায় ভগবান, এত তুচ্ছ জীবকে তুমি এত বুদ্ধি দিয়েছ? তোমার অসাধ্য কিছুই নেই। কোনদিন হয়ত দেখব তুমি অণু থেকে আবার অণুতর কোন বস্তু সৃষ্টি করে বসেছ। আমি আমার যাত্রাপথে এমনি জীব দেখেছি যার এক ফুট বিস্তার এই পৃথিবীতে সঙ্কুলান হবে না। আবার আমার এ বিশ্বাসও আছে যে এই অদৃশ্য জীবাণু হতে ছোট কোন জীবও হয়ত তোমার সৃষ্টিতে আছে যারা বুদ্ধিবৃত্তিতে মহানতমের অপেক্ষাও অনেক বড়।”
জাহাজের এক দার্শনিক মাইক্রোমেগসকে বলে বসল, “মনুষ্য হতে সূক্ষ্ম বুদ্ধিমান জাবও বর্তমান আছে।”
মাইক্রোমোগস আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বলল, “হে বুদ্ধিমান অণুদল। ভগবান নিশ্চয়ই তোমাদের সব চাইতে বেশী সুখী করে সৃষ্টি করেছেন। কারণ আনন্দময় আত্মা ছাড়া তোমাদের মধ্যে আর কিছু রাখেন নি। তোমাদের মতো ক্ষুদ্র প্রাণীর মধ্যে অন্য পদার্থ আর কোথায় থাকবে? এই ক্ষুদ্র গ্রহের ক্ষুদ্র প্রাণী তোমরা বিশ্বের সমগ্র আনন্দে পরিপূর্ণ।”
জাহাজের দার্শনিক অনেকেই দুঃখের সহিত মাথা নাড়ছিল। এক স্পষ্টভাষী দার্শনিক কিন্তু বলে উঠল, “সমাজে নগণ্য কয়েকজন লোক ছাড়া সকলেই প্রায় ধূর্ত, মূর্খ এবং লম্পটের দল। দুষ্টতার মূল যদি ভৌতিক কারণ হয়, তবে আমাদের মধ্যেও প্রচুর ভৌতিক পদার্থ বর্তমান। আর দুঃখের উৎপত্তি যদি জ্ঞান থেকে হয়, তবে সে জ্ঞানের অভাবও আমাদের নেই। আপনারা জেনে রাখুন, এই যে সময়ে আমরা আপনাদের সঙ্গে কথা বলছি ঠিক এই সময়েই টুপীধারী এক লক্ষ প্রাণী, পাগড়ীধারী এক লক্ষ ভাইকে হত্যা করবার জন্য ব্যস্ত। এই হত্যাকাণ্ড সংস্কৃতির নামে সেই আদিমকাল থেকে চলে আসছে।”
মাইক্রোমেগস জিজ্ঞেস করে জানতে পারল যে গোড়ালি অপেক্ষা ছোট্ট একটা জায়গা প্যালেস্টাইনে এই ধ্বংসকার্য চলছে।
“কি দুঃখের কথা!” মাইক্রোমেগল বলল—“ইচ্ছে করে একবার পায়ে চেপে ঐ অশান্তি সৃষ্টিকারীর দলকে শেষ করে দিই।”
দার্শনিক প্রবর বললেন “ব্যস্ত হবেন না, ওরা নিজেরাই কাটাকাটি করে মরবে। ওদের নিজেদের হাতেই ওদের মৃত্যুবাণ রয়েছে। তাছাড়া এই সৈন্যদের মেরে লাভ নেই তো, যারা ওদের পরিচালনা করে সেই কর্তাব্যক্তিদেরই মারতে হলে মারা উচিত।”
“আমি তো দেখেছি তোমাদের পৃথিবীর লোক আমাদের অপেক্ষা অনেক বেশী বুদ্ধিমান,” মাইক্রোমেগস বলল। “তোমার পেশা কি বল ত?”
“আমরা মক্ষিকা অস্থি সম্বন্ধী মনোবিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ।” দার্শনিক বললেন। “আমরা রেখা-গণিতের সূক্ষ্ম বিচার করতে পারি। দুতিন বিষয়ে একমত হলেও প্রায় হাজার বিষয়ে আমাদের মতে মিল নেই—এসব নিয়ে তর্কও করি প্রচুর।”
এরপর মাইক্রোমেগস জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে কিছু প্রশ্ন করল। ওদের ভিতর যে বৈজ্ঞানিক ছিল, মুহূর্তের মধ্যে উত্তর দিয়ে দিল। দর্শন বিষয়ের প্রশ্নের উত্তর বিভিন্ন দার্শনিক বিভিন্ন ভাবে দিয়ে দিল।
সর্বশেষে এক দার্শনিক সাহস করে বলেই ফেলল—“ভগবান মঙ্গলময়—সব কিছুই মঙ্গলের জন্য সৃষ্টি করেছেন। তোমাদের মতো দৈত্যাকার প্রাণী, গ্রহ, নক্ষত্র এবং এ সবের গতিবিধি ভগবান মানুষের উপযোগ এবং উপভোগের জন্য সৃষ্টি করেছেন।”
এক ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্র এই জীবাণুর এত দম্ভ দেখে মাইক্রোমেগস এবং শনিগ্রহবাসী উভয়েই হো হো করে হেসে উঠল। এই হাসির শব্দ যেন প্রলয়ের ঘোর ভয়াল শব্দের মতো বৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিকদের কানে গিয়ে লাগল। শব্দ শুনে ওদের কান ভোঁ ভোঁ করতে লাগল। জাহাজটা ধাক্কা লেগে মাইক্রোমেগসের নখের উপর থেকে একেবারে শনিগ্রহবাসীর পকেটে গিয়ে পড়ল।
শনিগ্রহবাসী ধীরে ধীরে পকেট থেকে জাহাজটা বের করতেই মাইক্রোমেগস নিজের একখানা দর্শনের বই ঐ ক্ষুদে পণ্ডিতদের উপহার দিয়ে জাহাজটা আবার জলে ভাসিয়ে দিল।
জাহাজের বৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিক দল প্যারিসে পৌঁছে ওখানকার বিজ্ঞান পরিষদের হাতে বইখানা জমা দিল। পরিষদ অধিকর্তা বই খুলে দেখলেন কোথাও কিছু লেখা নেই। একেবারে আনকোরা সাদা বই।
অধিকর্তা অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বললেন “এ রকম একটা কিছু হবে আমি আগেই সন্দেহ করেছিলাম।”
.
প্রথম প্রকাশ: আশ্চর্য!, জানুয়ারি, ১৯৬৪
মূল রচনা: ভলটেয়র