বাতিক • অমিত চক্রবর্তী
দেওয়াল-ঘড়িতে স্প্রিং-এর কড়কড় আওয়াজ হতেই বিশ্বপতি কলমটাকে টেবিলের খাঁজে শুইয়ে মনে মনে ঘণ্টার আওয়াজ গুণতে শুরু করলেন। পরপর সাতবার আওয়াজ হতেই ঘড়ির দিকে তাকালেন এবং দেখে নিশ্চিত হলেন যে তাঁর হিসেবে কোন ভুলচুক হয়নি। এখন সন্ধ্যে ঠিক সাতটা; আটটা কিংবা সন্ধ্যে ছ’টা নয়। মাথার ওপর দুহাত তুলে আড়মোড়া ভাঙলেন বিশ্বপতি, এটা তাঁর বহুদিনের অভ্যেস। তারপর টেবিলের ড্রয়ারে চাবি দিলেন এবং পরপর দু’বার কলিং বেলটা টিপলেন। ফাঁকা অফিসে বৈদ্যুতিক ঘন্টার আওয়াজে বিশ্বপতির শরীরের ভেতরটা যেন ঝন্ঝন্ করে উঠলো। রোজই এমনটা হয় এবং শরীরের ভেতরে এই ঝন্ঝনানি স্নায়ুগুলোকে কেমন টান্টান্ করে দেয়। হয়তো এই জন্যেই প্রত্যেকদিন সন্ধ্যে সাতটায় পরপর দু’বার কলিংবেলটা টিপে থাকেন বিশ্বপতি।
অফিসের বেয়ারা-কাম-দারোয়ান রঘু ঘরে ঢুকে জানালাগুলো বন্ধ করে, একটা একটা করে আলোপাখার সুইচগুলো নেভায়। বিশ্বপতিও সেই ফাঁকে চেয়ারে ঝোলানো তোয়ালেটা দিয়ে মুখ মুছে অফিসের ব্যাগটা নিয়ে অফিসের বাইরে সিঁড়ির কাছটায় এসে দাঁড়ান। অফিস বলতে পেল্লায় এক হলঘর, তার এক কোণে গুটি তিনেক কেবিন যার সবচেয়ে ছোটটা পড়েছে বিশ্বপতির বরাদ্দে। রঘুও বাইরে বেরিয়ে আসে এবং সদর দরজায় তালা লাগাতে শুরু করে। সব কটা তালায় চাবি পড়তেই বিশ্বপতি সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করেন এবং ঠিক এগারোটা ধাপ নিচে নামার পরেই ঘুরে দাঁড়ান। তারপর আবার হন্হন্ করে সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে উঠে দরজার তালাগুলো টেনে দেখেন, সেগুলো ঠিকমতো লাগানো হয়েছে কিনা। এটাও বিশ্বপতির বহুদিনের অভ্যেস।
কিছুদিন হল, লালবাজার থানার মেন গেটের ঠিক উল্টো ফুটপাথে রেলিং-এর ধারে এক শনিঠাকুরের আবির্ভাব হয়েছে। কাচের বাক্সের ভেতর থাকেন তিনি। পুণ্যার্থীরা যাতে পয়সা-কড়ি দিতে পারে সেজন্য শনিঠাকুরের মাথার কাছে কাচের বাক্সের ওপর চৌকানো গর্ত কাটা; ভেতরে টাকা-কড়ি কেমন জমা হল বাইরে থেকে তা জানার ভারি সুন্দর ব্যবস্থা। প্রতিদিনের মতো আজও শনির মূর্তির সামনে দাঁড়ালেন বিশ্বপতি। ঘড়ির দিকে না তাকিয়েও তিনি বলে দিতে পারেন এখনকার সময়টা। সাতটা সতেরো। ডালহৌসি থেকে মিনিবাস যদি সাড়ে সাতটার মধ্যে ছাড়ে, তবে বাড়ী পৌঁছতে পৌঁছতে পৌনে ন’টা। বিশ্বপতি হাঁটার গতি বাড়ালেন।
বিপত্তিটা বাঁধলো জগুবাবুর বাজারের ঠিক মুখটায়। বিকট আওয়াজ করে দক্ষিণগামী মিনিবাসের সামনের বাঁদিকের চাকাটা ফাটলো। অ্যাদ্দিন ধরে যাতায়াত করছেন, বিশ্বপতির মনে পড়ে না। আগে কখনো চাকা পাল্টানোর জন্যে বাস থেকে নেমে দাঁড়াতে হয়েছে কিনা। আজকের ব্যাপারটাই কেমন গোলমেলে; বাসটা ছাড়তে অহেতুক দেরী করলে। অন্যদিন মিনিবাসে দাঁড়াতে হলেও পার্ক স্ট্রীটের আগেই বসার সীট পেয়ে যান। আজ আশপাশের কোন যাত্রীরই ওঠার লক্ষণ দেখা যায়নি। তার ওপর কণ্ডাকটারের কাছ থেকে টিকিট কাটতে গিয়ে মানি ব্যাগের ভেতর কুড়ি টাকার একটা নোটের মাঝ বরাবর সেলোফেনের তাপ্পি ধরা পড়েছে এবং এক উটকো সহযাত্রীর কল্যাণে দুশো তিরিশ টাকা দামের নতুন জুতো কাদায় ছয়লাপ হয়েছে। সেগুলো তবু সহ্য করা যায়, কিন্তু বাড়ি ফেরার পথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে মিনিবাসের টায়ার-পাল্টানো দেখার মতো বিড়ম্বনা আর সয় না। বিশ্বপতি ঘড়ি দেখেন। নয় নয় করেও প্রায় মিনিট পঁচিশেক সময় নষ্ট হল আজ। রাত নটার খবরটা আজ আর শোনা হবে না। বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে আসে ওঁর।
বাসস্ট্যাণ্ড থেকে হেঁটে বাড়ি পৌছতে সময় লাগে মিনিট সাতেক। গোটা রাস্তাটা অন্ধকার লোডশেডিং চলছে। বাড়ি পৌঁছে দরজায় টোকা দেবার সময় বাঁ-হাতের কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখলেন। আবছা আলোয় মনে হল ঘড়ির ছোট কাঁটাটা দশটা দশের কাছাকাছি এসেছে। স্ত্রী সুরমা দরজা খুলতেই বললেন, না দেখে দরজা খোল কেন? কে কড়া নাড়ছে দরজার ভেতর থেকে সেটা জানতে চাওয়া যায় না? কোনদিন একটা কাণ্ড হবে।
সুরমা কোন জবাব না দিয়ে দরজার পাশে সরে দাঁড়ালেন। একান্ত নিরুপায় না হলে কোন ব্যাপারেই বাগবিতণ্ডার মধ্যে যান না তিনি। তাছাড়া বিশ্বপতিকে তো আর নতুন দেখছেন না। দেখতে দেখতে পনেরোটা বছর একসঙ্গে কাটলো। এমনিতে যে মানুষটা বদরাগী তাতো নয়; দোষের বলতে, যা একটু খেয়ালী। সময় মতো বাড়ি ফিরতে না পারার দরুনই যে মেজাজটা আজ গরম তা আঁচ করতে সুরমার অসুবিধে হয় না।
এত রাতে কি আর চা খাবে? বিশ্বপতির দিকে তোয়ালে আর ধুতিটা এগিয়ে দিতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন সুরমা।
তার মানে? ভুরু কুঁচকে তাকান বিশ্বপতি।
সুরমা রান্নাঘরের দিকে এগোন। ওঁকে জিজ্ঞাসা করাটাই ভুল হয়েছে। রাত্রিবেলা বাড়ি ফিরে গা ধুয়ে চা খেতে খেতে ইংরাজী খবর শোনার অভ্যেস বিশ্বপতির। খবরটা আজ শোনা না হলেও চা খাওয়ার ব্যাপারে যে ব্যতিক্রম ঘটবে না—সেটা বোঝা উচিত ছিল সুরমার। চায়ের পাট না চুকলে রাতের খাবার প্রশ্নই ওঠে না।
জানো, তোমার এক বন্ধু এসেছিল আজ। এঁটো বাসনগুলো টেবিল থেকে তুলতে তুলতে বললেন সুরমা। তোমার সঙ্গে না কি স্কুলে পড়ত, বিলেতে ছিল অনেকদিন। নাম বললে, ‘সমীরণ’।
টেবিল ঘড়িটায় দম দিচ্ছিলেন বিশ্বপতি। রাতের খাওয়ার পর বাড়ির যাবতীয় ঘড়িতে দম দেওয়াটাই ওঁর কাজ।
সমীরণ এসেছিল? অ্যাদ্দিন পরেও আমাদের বাড়ি চিনতে পারলো? বিশ্বপতির চোখে-মুখে বিস্ময়। স্কুলে পড়ার সময় এ বাড়িতে মাঝে মাঝে আসতো, এ পাড়ারই একটা বাড়িতে ভাড়া থাকতো ওর মামা। স্কুলের পাট শেষ হতে ও গেল ডাক্তারী পড়তে। ডাক্তার হয়ে বেরনোর পরও বারকয়েক এখানে এসেছে—তারপর ওর মামাও এ পাড়া ছেড়ে উঠে গেল, ওরও আসা-যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। পরে শুনেছিলাম, ও নাকি বিলেত গিয়ে মস্ত ডাক্তার হয়েছে।
দেখেও তো তাই মনে হল। ভিজে ন্যাতা দিয়ে টেবিলটা মুছতে মুছতে বললেন সুরমা। গায়ের রঙ টকটকে ফর্সা, এক্কেবারে সাহেবদের মতন! যে গাড়িটায় চেপে এসেছিল সেটাও একেবারে ঝকঝকে নতুন।
ঠিকানা কিছু দিয়ে গেছে?
উহুঁ। সুরমা মাথা নাড়েন। তবে তোমার অফিসে যাওয়ার ঠিকানা লিখে নিলে নোট বইতে। হয়তো দু-চারদিনের মধ্যেই অফিসে দেখা করবে।
ও, আচ্ছা; বলেই সদর দরজার দিকে এগোলেন বিশ্বপতি। শুতে যাবার আগে সদর দরজার হাতল ধরে পরপর তিনবার টান দিয়ে থাকেন তিনি। দরজায় ছিটকিনি বন্ধ থাকা সত্ত্বেও বারবার হাতল ধরে টানাটানির যৌক্তিকতা আজও বুঝে উঠতে পারেননি সুরমা।
দরজায় টোকা পড়তেই ফাইল থেকে চোখ তুললেন বিশ্বপতি। সামনেই যে সুদর্শন মানুষটি দাঁড়িয়ে আছে তাঁর মুখের মধ্যে অনেকদিন আগের এক চেনামুখের আদল পাচ্ছেন যেন। আগন্তুক ভদ্রলোক হাসিমুখে বিশ্বপতির দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, আমায় নিতে পারলি না? আমি সমীরণ। সেদিন তোর বাড়ি গেলাম, তোর মিসেসের সঙ্গে গল্পগুজব করলাম, চা আর পাঁপড় ভাজা খেলাম—
বন্ধুর দিকে খানিকটা সমীহ আর খানিকটা বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে থাকেন বিশ্বপতি। কী বলবেন, বুঝতে পারেন না।
টেবিলের উল্টোদিকের কাঠের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে পড়েন সমীরণ। বলেন, কথা বলছিস না যে! কী ব্যাপার, ব্যস্ততার সময় এসে বিরক্ত করলাম নাকি?
না, না, ভাবছিলাম অ্যাদ্দিন পরে তুই হঠাৎ! খানিকটা ঘোরের মধ্যে থেকে বলে ওঠেন বিশ্বপতি। তারপর বেল বাজিয়ে রঘুকে ডেকে চা আনার পয়সা দেন।
চেয়ারের হাতলে কনুই রেখে শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে সমীরণ বলেন, তা সতেরো বছর কাটালাম বিলেতে—বুঝলি? বাবা মারা যাওয়ার পর দিন পনেরোর জন্যে দেশে ফিরেছিলাম। ওদেশেই বিয়েটা সেরে নিয়েছি, না, না, মেমসাহেব নয়, একেবারে খাঁটি বঙ্গ নারী। প্র্যাকটিসও নেহাৎ মন্দ হচ্ছিল না; তা ছেলেমেয়ে বড় হয়ে যাচ্ছে দেখে ভাবলাম, যাই দেশে ফিরে। এখানকার এক হাসপাতাল থেকে অফার পেয়েছিলাম, তাছাড়া প্রাইভেট প্র্যাকটিস্ তো আছে। তোর বাড়ির কাছে বড় রাস্তার ওপর একটা ঘর পেলাম, ওখানেই চেম্বার বানিয়েছি।
কিসের ডাক্তার তুই! হার্ট? প্রশ্নটা যেন ফস্ করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় বিশ্বপতির।
কেন তোর কি হার্টের গণ্ডগোল আছে নাকি?
না, না, এমনি জিজ্ঞাসা করলাম। আসলে হার্টের ডাক্তারদের খুব রমরমা কিনা—
বিশ্বপতির কথায় মুখ টিপে হাসেন সমীরণ। বলেন, এখন তো স্পেশালিস্টদের যুগ রে! চোখ-কান-গলা-পেট-এমনকি মনের রোগ—যার চিকিৎসাই কর না কেন-রুগীর ভিড় লেগেই থাকবেই।
মনের রোগ? বিশ্বপতি টেবিলের ওপর চোখ নামিয়ে বিড়বিড় করে বলে ওঠেন। মনের রোগ সত্যিই সারে?
সব না সারলেও কিছু কিছু রোগ নিশ্চয়ই সারে। রঘুর রেখে যাওয়া চায়ের কাপটা কাছে টেনে নেন সমীরণ। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলেন, তুই খাবি না?
না। আমি চা খাব ঠিক আড়াইটেয়। বিশ্বপতি জবাব দেন। তুই কিসের স্পেশালিস্ট, বললি না তো।
নিউরো-সার্জারী। তিন-চার চুমুকে চা-টা শেষ করে কাপটাকে দূরে সরিয়ে রাখেন সমীরণ। মাথার অসুখের চিকিৎসা করি, বলতে পারিস। এই ধর, মস্তিষ্কের কোথাও যদি কোন গণ্ডগোল হয়। কিংবা শিরদাঁড়া—মানে সব মিলিয়ে যাকে বলে ‘সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম’—সেখানে গণ্ডগোল হলে তা সারানোর ব্যবস্থা করি আমি। তোর বাড়ির কাছে চেম্বার খোলার পর ভাবলাম—ওদিকটায় তো এক তোকে ছাড়া আর কাউকেই তেমন চিনি না। তোর মারফৎ আশেপাশের লোকজনের সঙ্গে যদি আলাপ পরিচয় হয় সেই ভেবেই তোদের বাড়ি গেছিলাম সেদিন। তোর মিসেসের কাছে শুনলাম—রোজই নাকি ফিরতে তোর ন’টা সাড়ে ন’টা বাজে।
সমীরণের কথাগুলো আর কানে যাচ্ছিল না বিশ্বপতির। তাঁর মাথার মধ্যে ঘুরছিল ‘নিউরো-সার্জারী’ আর ‘সেন্ট্রাল নাভার্স’ শব্দ দুটো। সমীরণ থামতেই ফিসফিস করে বললেন, তোকে আমার খুব দরকার। শীগগিরই যাব তোর চেম্বারে। অসুবিধে হবে না তো?
অসুবিধে আবার কি? বিকেল আর সন্ধ্যেটা তো বলতে গেলে মাছি তাড়াই! তুই এলে অন্ততঃ গল্পগুজবও করা যাবে। সমীরণ উঠে দাঁড়ান; তারপর দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলেন, তাহলে ঐ কথাই রইল। বাসস্ট্যাণ্ডের উল্টোদিকে ওযুধের দোকানের ডানদিকে আমার চেম্বার, বাইরে নেমপ্লেট আছে।
উদাস চোখে সমীরণের চলে যাওয়া দেখেন বিশ্বপতি। জীবনের সব ক্ষেত্রে সফল একজন পুরুষ। একই সঙ্গে দুজনে একদিন পড়াশুনা করেছেন। সমীরণ যে সাংঘাতিক কিছু মেধাবী ছিল তাও নয়। অবশ্য ওদের বাড়ির অবস্থাটা ছিল ভাল। ডাক্তারী পড়ার, বিদেশ যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে অনায়াসে। আর ঐ সুযোগটুকুর অভাবেই বিশ্বপতি আজ আধা সরকারী অপিসের হেডক্লার্ক!
রঘু এসে চায়ের এঁটো কাপটা সরিয়ে নিয়ে যায়। বিশ্বপতি দেখলেন—টেবিলের ওপর গোল চাকার মতো জলছাপ। ডিসের নীচে জল লেগেছিল নিশ্চয়ই। রঘুকে কতবার বলেছেন সবসময় রবারের চাকতির ওপর কাপডিস রাখতে। ভুরু কুঁচকে ড্রয়ার টেনে এক ফালি সাদা কাপড় বের করলেন বিশ্বপতি। টেবিল থেকে সযত্নে জলের দাগ তুলতে তুলতে কব্জি উল্টে একবার ঘড়ি দেখলেন। একটা বেজে চল্লিশ। টেবিলের ওপর একগাদা ফাইল। ঠিক সাতটায় উঠতে হবে। এর মধ্যে টিফিন করতে খরচ হবে কুড়ি মিনিট। বড় সাহেবের ঘরে যদি দু-বার ডাক পড়ে তবে আরো কুড়ি মিনিটের ধাক্কা। তাহলে হাতের কাজগুলো শেষ করার জন্য কতক্ষণ সময় থাকছে? মনে মনে সেই হিসেবটা করতে থাকেন তিনি।
.
হ্যাঁ, এবারে খুলে বল দেখি, তোর অসুখটা কী? গদি মোড়া চেয়ারে গা এলিয়ে সমীরণের চেম্বারের দেওয়াল আর আসবাবপত্র খুঁটিয়ে দেখছিলেন বিশ্বপতি। বিকেল পাঁচটা বাজতে না বাজতেই আজ অফিস থেকে বেরিয়েছেন। তার জন্যে অবশ্য রঘুর কৃতিত্ব অনেকখানি। বেলা দুটো থেকে সে ক্রমাগত তাগাদা দিয়ে গেছে। অফিসে বেরনোর সময় সুরমাও ডাক্তারের চেম্বারে যাওয়ার কথাটা মনে করিয়ে দিয়েছে। অফিস থেকে বেরনোর সময় রীতিমতো অস্বস্তি হচ্ছিল বিশ্বপতির। রঘুকে ডেকে বলেছেন, ছুটির পর দরজায় তালাগুলো লাগাস। রাত্তিরটা বড় চিন্তায় কাটবে।
এত ভাবছিস কী? তোর প্রবলেমটা বল।
সমীরণের দিকে চোখ ফিরিয়ে বিশ্বপতি নীচু গলায় বলেন, সময় ধরে সব কিছু করাটাই আমার একটা রোগ। সুরমা বলে—মনের বাতিক!
একটু খুলে বল। সমীরণ টেবিলের ওপর ঝুঁকে আসেন।
এই যেমন ধর, সকাল সাড়ে পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠা, ঠিক ছটায় চা-খাওয়া, তারপর ছটা কুড়িতে দাড়ি কামানো। ছটা চল্লিশে খবরের কাগজ পড়া, সাতটায় বাজারে যাওয়া।
তার মানে, তুই সব কিছু একেবারে ঘড়ি ধরে করিস—এই তো?
করি, মানে করতে হয়, বিষণ্ণ গলায় বলে ওঠেন বিশ্বপতি। সারাদিন সমস্ত কাজ ঘড়ি ধরে করা কি চাট্টিখানি কথা! কিন্তু উপায় নেই। যে কোন একটা কাজের সময়ের একটু হেরফের হলেই কী যে কষ্ট হয়? ধর, সকালে কাগজটা এলো দেরীতে—সেদিন আর কাগজ পড়াই হবে না। কিংবা রাস্তায় হয়তো জ্যামে পড়ে অফিসে পৌঁছতে দশ মিনিট দেরী হল। বুকের মধ্যে যেন তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। আবার টেবিলের কাজ হয়তো শেষ হয়ে গেছে, তবুও সাতটার ঘণ্টা না বাজলে অফিস থেকে আগে বেরিয়ে পড়ি অমঙ্গল কিছু ঘটে যাবে হয়তো। বিরাট কোন ক্ষতি হয়ে যাবে আমার।
রোববার আর ছুটির দিন কী করিস?
রোরবারেরও কাজের রুটিন আছে। দুপুর সাড়ে বারোটা থেকে রেডিও শুনি, বিকেল চারটেয় বেড়াতে বেরোই—তা সে ঝড়বৃষ্টি যাই হোক না কেন। এদিকে সুরমার হয়েছে জ্বালা। তুই তো দেখেছিস ওকে। বড় শান্ত মেয়ে। ছেলে পুলে হয়নি। আমার বাতিক সামলাতে সামলাতেই ওর জীবনটা শেষ হয়ে গেল!
ডাক্তার দেখাসনি কখনো? কোন সাইকিয়াট্রিষ্ট?
দেখিয়েছিলাম। আমার পাশের বাড়ির ভদ্রমহিলার কাছ থেকে ঠিকানা যোগাড় করে সুরমা নিয়ে গিয়েছিল আমায়। ডাক্তার তো প্রথমটা আমার কথায় তেমন আমলই দিলেন না। বললেন—ওরকম বাতিক মশাই সকলেরই একটু আধটু থাকে। রবার্ট ব্রুস-এর গল্প তো জানেন। পরপর সাতবার যুদ্ধে হেরে গিয়েও আবার লড়েছেন। শুনেছি, কলম্বাস নাকি ভারতে আসার টাকা যোগাড়ের জন্যে আঠারো বছর ধরে একনাগাড়ে চেষ্টা চালিয়েছেন। ডারউইন সাহেব তাঁর ইভলিউশন থিয়োরী প্রমাণের জন্য বাইশ বছর ধরে তথ্য যোগাড় করেছেন। এই যে অধ্যবসায়—এও কি এক ধরনের বাতিক নয়? শেষে ওঁর মত মানছি না দেখে বললেন, অতিরিক্ত উদ্বেগের জন্যই নাকি অমনটা করি আমি। আমার অবচেতন মনে নাকি ধারণা আছে—জীবনে যা কিছু আমি পেয়েছি, আমার চাকরি-সংসার—সবই ক্ষণিকের ব্যাপার। সব কিছু হারানোর ভয়েই আমি নাকি নিজেই নিজের চারপাশে সময়ানুবর্তিতার এক মর্ম গড়ে নিয়েছি। ভদ্রলোক আমার ঘুমের ওষুধ টযুধ খেতে দিয়েছিলেন—কোন কাজ হয় নি। আচ্ছা সত্যি বল তো—মানসিক রোগ কি সারে?
বিশ্বপত্তির চোখের কোনটা চিকচিক করছিল। সেদিকে চেয়ে সমীরণ বললেন, এ প্রশ্নের উত্তর তো সেদিন তোর অফিসেই দিয়েছি। কিন্তু এটা তোর মানসিক রোগ নাও হতে পারে। যদি বলি এইসব উপসর্গের পেছনে তোর ব্রেনের কারসাজি রয়েছে—বিশ্বাস করবি?
কী জবাব দেবেন বুঝতে পারেন না বিশ্বপতি। সমীরণ যেন ব্যাপারটা বুঝলেন। বললেন, তোকে একটা ঘটনার কথা বলি। সত্যি ঘটনা। এটা ঘটেছিল এখন থেকে বছর খানেক আগে—কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে। জর্জ নামে এক ছোকরার ছিল নানারকমের বাতিক। মাত্র সতেরো-আঠার বছর বয়স হলে কি হবে—পড়াশুনো খেলাধুলো, আড্ডার ধার ধারতো না। দিনের মধ্যে পঞ্চাশবার নিজের হাত দুখানা কচলে ধুতো। বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাঝরাস্তা থেকে ফিরে আসতো রোজ—ঘরে তালা দেওয়া হয়েছে কিনা দেখতে। বারবার পকেট হাতড়ে দেখতো—মানিব্যাগটা রয়েছে কিনা। তোর মতো ঐ ছেলেটিরও মনে হতো—অদৃশ্য কেউ যেন তাকে দিয়ে জোর করে করিয়ে নিচ্ছে। আমাদের ভাষায়—রোগটার নাম ‘অবসেসিভ কমপালসিভ নিউরোসিস’। ছেলেটি ছিল অতিরিক্ত ভাবপ্রবণ। ওর ঐ অভিশপ্ত জীবন রেখে আর লাভ নেই এরকম কিছু ভেবে ছোকরা একদিন বাপের পিস্তলখানা বাগিয়ে নিজেই নিজের কপাল লক্ষ্য করে গুলি চালালে! গুলি ছোঁড়ার সময় নিশানার ভুলে গুলিটা গিয়ে বিঁধলো মস্তিষ্কের বাঁ দিকের ‘ফ্রন্টাল লোব’ নামে একটা জায়গায়। ছেলেটাকে নিয়ে যাওয়া হয় নামজাদা এক নিউরোসার্জনের কাছে। ছুরি চালিয়ে ফ্রন্টাল-লোব থেকে বুলেটটা বের করা হল। আর তাতেই ঘটলো অবিশ্বাস্য এক কাণ্ড!
কিসের কাণ্ড?
অপারেশনের পর ছেলেটা সুস্থ হতে দেখা গেল—তার মন থেকে যাবতীয় বাতিক একেবারে উধাও! একেবারে অন্য মানুষ হয়ে গেল সে। ঘটনাটা বিশেষজ্ঞ মহলে চাউর হতেই একেবারে হৈ হৈ পড়ে গেল। একদল বললেন—তাঁরা নাকি নিশ্চিত যে মস্তিষ্কের ভেতর ‘ব্যাসাল গ্যাংলিয়া’ নামে নার্ভগুচ্ছ ঠিকমতো কাজ না করলে লোকের মধ্যে নানারকম বাতিক দেখা দেয়। ঐ নার্ভগুলোকে সক্রিয় করে তোলার জন্যে ক্লোমিপ্রামাইন নামে এক ধরনের ওষুধ বের করলেন। আসলে ওঁরা ছিলেন অপারেশনের বিরুদ্ধে।
ওষুধের নামটা খটোমটো ঠেকলেও ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধে হল না বিশ্বপতির। সমীরণ থামতেই উত্তেজিত গলায় বললেন, ওষুধটায় কাজ হল?
উঁহু। আস্তে আস্তে দু-পাশে মাথা নাড়েন সমীরণ। হাজার রোগীর ওপর ঐ ওষুধটা প্রয়োগ করে মাত্র চারশো জনের ক্ষেত্রে সামান্য কিছু সুফল মিললেও বাকীদের ক্ষেত্রে কোন কাজই হয়নি বলতে গেলে—
তাহলে কি অপারেশন ছাড়া গতি নেই? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করেন বিশ্বপতি। মস্তিষ্ক কাটা ছেঁড়া করায় রিস্ক-ও তো আছে?
তা তো আছেই। সমীরণ জবাব দেন। ইতিমধ্যে আরও যেসব রোগীদের ওপর অপারেশন হয়েছে তাদের কারো কারোর ডান হাতপায়ে জড়তা এসেছে অনেকটা প্যারালিসিসের মতন। কয়েক মাসের মধ্যেই ঐসব উপসর্গ অবশ্য কেটে যাওয়ার কথা।
তাহলে আমাকেও কি অপারেশন করতে বলিস? ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে বিশ্বপতির। আমারও যদি প্যারালিসিস হয়, যদি আর কোনদিন তা না সারে?
এখনই এসব নিয়ে ভাবছিস কেন? চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন সমীরণ। আগে তোর ব্রেন-টা স্ক্যান করাই, হাসপাতালে খোঁজখবর নিয়ে দেখি—এ-জাতীয় অপারেশনের সুযোগ সুবিধে মিলবে কিনা। তারপর তো ডিসিশনের পালা। অপারেশনের ব্যাপারে যা সিদ্ধান্ত নেবার তখন নিস না হয়।
সমীরণের চেম্বার থেকে বেরিয়ে আকাশের দিকে তাকালেন বিশ্বপতি। আবছা লাল মেঘে ছেয়ে আছে আকাশটা। রাস্তায় আলোগুলো জ্বলছে না। বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতে বিশ্বপতির মাথায় ‘ব্যাসাল গ্যাংলিয়া’ আর ‘ফ্রন্টাল লোব’ শব্দ দুটো ঘুরপাক খাচ্ছিল। বাড়িতে গিয়ে সুরমার কাছে অপারেশনের কথাটা কিভাবে পাড়বেন তাই ভাবতে ভাবতে বিশ্বপতির মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে উঠলো।
.
ক্রিং ক্রিং করে টেলিফোনটা বেজেই চলেছে। অফিস ঘরের জানলাগুলো টেনে বন্ধ করতে গিয়ে রঘু দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকালো। পাঁচটা বেজে দশ। এর মধ্যেই গোটা অফিসটা ফাঁকা। অথচ ছমাস আগেও ব্যাপারটা ছিল অন্যরকম। পাঁচটার সময় ফোন বেজে যাবে—কেউ ধরার থাকবে না—এটা ভাবাই যেত না। বড়বাবু থাকতেন ঠিক সাতটা অবধি। টেবিলের সমস্ত কাজ নিখুঁত ভাবে শেষ করে তবেই উঠতো! কী যেন একটা অপারেশন করাতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। মাস তিনেক পর যখন অফিসে ফিরলেন—একেবারে অন্য মানুষ। হাঃ হাঃ করে হাসছেন, সারাদিন অফিসের ছেলেছোকরাদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন, অফিসে আসার কোন সময় নেই, সাড়ে চারটে বাজতে না বাজতেই বাড়ি পালাচ্ছেন। বড়বাবুর টেবিলে এখন ফাইলের স্তূপ…
টেলিফোনের বাজনা থেমে গেছে। ঘরের পাখা-আলোর সুইচগুলো নিভিয়ে সদর দরজায় তালা লাগায় রঘু। ছ’টা তেরোর লোকালটা ধরতে হবে। আপনমনে বিড় বিড় করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে এবং ঠিক এগারো নম্বর ধাপে এসে থমকে দাঁড়ায়। তারপর আবার হন হন করে সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে উঠে দরজার তালাগুলো টেনে টেনে দেখে—সেগুলো ঠিকমতো লাগানো হয়েছে কিনা। এটা এখন প্রতিদিনই করে সে। আরও একটা অভ্যেস হালে রপ্ত করেছে। লালবাজার থানায় উল্টোদিকের ফুটপাথে বাক্সবন্দী শনিঠাকুরের কাছে গিয়ে দাঁড়ানো। অফিস থেকে বেরলেই অদৃশ্য কেউ যেন তাকে ঐদিকে ঠেলে নিয়ে যায়।
.
প্রথম প্রকাশ: ফ্যানট্যাসটিক, সেপ্টেম্বর, ১৯৮৯