গিরগিটির রহস্য • তারাপদ রায়
অবশেষে ছুটি মিললো শশাঙ্ক দাসের। সেই কবে জামসেদপুরে লোহার ফ্যাক্টরীতে ঢুকেছিলেন উনিশ বছর বয়সে সামান্য মিস্ত্রি হয়ে; তারপর ধাপে ধাপে উঠে গেছেন, বয়সও বেড়ে গেছে, অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে পদোন্নতিও হয়েছে।
কিন্তু কতদিন মানুষ চাকরী করতে পারে? একটানা সাতচল্লিশ বছর কাজ করেছেন, শেষের দিকে তাঁর অভিজ্ঞতাই তাঁর মুক্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।
আটচল্লিশ সাল পর্যন্ত টাটায়, তারপরে দেশ স্বাধীন হবার সঙ্গে সঙ্গে যে সব শিল্প নগরী, ইস্পাত শহর গড়ে উঠতে লাগলো, সব জায়গায় ডাক পড়তে লাগলো দাস মিস্ত্রির। অনেক বিলেত ফেরত ইঞ্জিনিয়ার, অনেক ডাকসাইটে সাহেব তাজ্জব বনে গেছে ওঁর জ্ঞান দেখে, লোহা সম্বন্ধে তাঁর মতো ব্যবহারিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোক নাকি বাকিংহামেও পাওয়া যাবে না।
অবশ্য অভিজ্ঞতাই সব নয়, কত লোকেই তো তার সঙ্গে কাজে ঢুকেছিলো তারা তো অনেকেই বড় জোর হেড মিস্ত্রি হয়ে রিটায়ার করলো। টগবগ্ করছে গলিত লৌহপিণ্ড, তাঁর ইচ্ছে করতো কুমোর যেমন মাটি ছানে সেইভাবে ছেনে দলা পাকিয়ে খেলা করেন ইস্পাতের অনল নিয়ে, গনগনে জিহ্বা টেনে লম্বা করে দেন। সারা জীবন লোহা নিয়ে খেলা করেছেন তিনি। সে খেলায় পরিশ্রমের চেয়ে আনন্দ ঢের বেশী ছিলো। চিরকাল সোনার চেয়ে লোহা অনেক বেশী আকর্ষণ করেছে তাঁকে।
সেই দাস মিস্ত্রির অবসর মিললো। জীবনে অনেক ধাপ উঁচুতে উঠে গিয়েছিলেন, কিন্তু মিস্ত্রি উপাধিটা কায়েমি হয়ে গিয়েছিলো, শশাঙ্ক দাসও কখনো আপত্তি করেন নি।
অবসর নিয়ে দাসমিস্ত্রি ঠিক করলেন এবার এমন কোথাও যাবো যেখানে সভ্যতা এখনো পৌঁছয় নি তার ইঁট, লোহা, বিদ্যুতের খাঁচা নিয়ে। নিজের হাতে মনের মতো একটা বাড়ি তৈরি করে থাকবো।
কালিম্পং শহরের বাজারের উত্তর পাশ দিয়ে ঘুরে একটা রাস্তা গেছে ভুটান বরাবর। সেই রাস্তাতেই প্রায় ভুটান সীমান্তে একটা ছোট পাহাড়ের নিচে বিঘে খানিক আধা সমতল জমি ভারী পছন্দ হয়ে গেলো দাসের। চারদিকে ফিকে নীল পাহাড়, ঋজু পাহাড়িয়া গাছের সবুজ চিন্তার এবং অপার নীলিমাময় আনন্দ। একটা মাত্র অসুবিধা এই যে এখানে বছরে ছয় সাত মাসের বেশী থাকা যাবে না, নভেম্বর থেকে মার্চ সমতল ভূমিতে ফিরে যেতে হবে শীতের সময়। এই পাহাড়ী রাস্তা তখন আগাগোড়া বরফে ঢাকা থাকবে। কাছাকাছি ঠিক কোনো লোকালয় নেই, একটা ছোটমতো দেহাতী গ্রাম। চার পাঁচ ঘর আধা যাযাবর পাহাড়ী পরিবার এখানে বছরের কয়েকমাস থাকে। শীত শুরু হলে দার্জিলিং বা কালিম্পং কোথাও কাছাকাছি চলে যায়।
ভালোই হল, সারা বছর এখানে থাকলে একঘেয়ে হয়ে যেতো। ছয় মাস রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবো আর ছয়মাস এখানে বিশ্রাম; তারপর আবার ঘোরো। শশাঙ্ক দাস খুশিই হলেন মনে মনে এই সব ভেবে।
বাড়ি তৈরি হল। সভ্যতাকে যত সহজে এড়ানো যাবে মনে হয়েছিলো তা সম্ভব হল না। কালিম্পংয়ের বাজার থেকে কাঠ কিনতে হল, ইঁট, লোহা, সবই আনাতে হল। কয়েকজন ভুটিয়া মজুর আর নিজে পরিশ্রম করে একদিন বাড়ি সম্পূর্ণ হল। বাড়ির জানালার জন্যে শিক কিনতে গিয়ে শশাঙ্ক দাস একবার মনে হাসলেন, তারই হাতে তৈরি কোনো যন্ত্র থেকে হয়তো এই শিকগুলো এসেছে।
কালিম্পংয়ের বাজার থেকে কেনা কাঠে কিন্তু কুলোয় নি। বাড়ি শেষ হবার আগেই কাঠ ফুরিয়ে গেলো। একজন ভুটিয়া মজুর বললো, ‘বাবু, আমাকে যদি বলেন আমি কাঠ এনে দিতে পারি। ঐ পিছনের দিকের পাহাড়ের গায়ে গাছ আছে। সে কাঠ বেশ ভালো কাজ দেবে, আর আমাকে বাজারের চেয়ে অনেক কম দাম দিলেই চলবে।’ পিছনের দিকের পাহাড় মানে কোনটা শশাঙ্ক দাস ধরতে পারলেন না।
‘এ সব গাছে কি ভালো জানালা দরজা হবে?’
‘বাবু, এখানে যেসব গাছ দেখছেন সে রকম গাছ নয়। আমি যে পাহাড়টার কথা বলছি সে পাহাড়ে এক ধরনের আলাদা ধরনের গাছ আছে, তার কাঠ খুবই মজবুত।’ মজুরটি বিনীত ভাবে জানালো।
‘আচ্ছা, দেখা যাক,’ শশাঙ্ক দাস অবশেষে রাজী হলেন।
মজুরটি দিন দুই পরে একটা খচ্চরের পিঠে করে এক বোঝা কাঠ নিয়ে এলো, ‘এই একটা গাছই ছিলো, আর সব গাছ কারা কেটে নিয়ে গেছে। যত চোরের আমদানি হয়েছে পাহাড়ে। আগে এমন ছিলো না।’ মজুরটি কাঠগুলো নামালো। তারা পরস্পর প্রাক্তন কালের পার্বত্য সততা নিয়ে আলোচনা করতে লাগলো। ততক্ষণ শশাঙ্ক দাস কাঠ দেখতে লাগলেন।
ভালোই মনে হচ্ছে, অদ্ভুত হলুদ রঙ। এক ধরনের গিরগিটির গায়ের মতো
বড় তেলতেলে মনে হয়। যেন কাঁচা রঙ মাখানো হয়েছে। দেখা যাক। আমি সংসারহীন পরিবার মুক্ত ব্যাচেলার। আমি তো আর পুরুষানুক্রমে ভোগ করার জন্য বাড়ি করছি না—আমার এতো খুঁতখুতানি কেন? এই শেষ কটা দিন কেটে গেলেই হল, এই সব কথা ভাবতে ভাবতে বহুদিন পরে আবার দাসমিস্ত্রির মনে পড়লো পিছনে পানা পুকুর, নারকেলের গুঁড়ি দিয়ে পৈঠা করা সিঁড়ি উঠে গেছে উঠোনের দিকে। অনেকদিন আগের একটা আটচালা বাড়ি। কবেকার ফরিদপুরের একটা গ্রাম্য পরিবার, মা, কাকা, জ্যাঠামশায়, সোনাপিসিমা, বরেন। আঠারো বছর বয়সে এক বস্ত্রে নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন আর খোঁজ করেন নি, তারা সব এখন কোথায়? কেউ কেউ কি এখনো বেঁচে আছে?
সারা জীবন গনগনে আগুন আর লোহা পেটানোর শব্দ, একটা ধাতব পদার্থের ভালবাসায় তিনি নিজেকে উপেক্ষা করেছেন।
ততক্ষণে মজুরেরা কাজে লেগে গেছে, জানালার গরাদে শিক লাগানো হল। ঘরের চারদিকে চারটে জানালা ঝুলানো, দুদিকে দরজা। পরের দিন আর কিছু করার বইলো না, শূন্য বাড়িতে অখণ্ড অবসর।
কালিপুর থেকে বাজার করে আনা তাও সপ্তাহে এক-আধদিন, ফাইফরমাস খাটা এই সবের জন্য একটি ভুটানি ছেলে রয়েছে, তারও বিশেষ কিছু করবার নেই। সে তার দেহাতে গিয়ে গল্প করে, ঘুমোয়।
এইভাবে একদিন শীত এসে গেলো। মাথার উপরে দিনরাত শন্শন্ করে শব্দ হতে লাগলো, হিমালয়ের ওপারে থেকে হাঁসেরা সমতল ভূমিতে নদী, নালা, বিলে ফিরে চলেছে। শশাঙ্ক দাসও ফিরলেন।
ছয় মাস এদিক ওদিক ঘুরবার পর আবার কালিম্পং, আবার সেই পাহাড়ি রাস্তা। তার নিজের বাড়ীতে একদিন মাঘ মাসের শেষাশেষি দুপুর নাগাদ পৌঁছালেন। যাওয়ার সময় জানালা দরজা সব বন্ধ করে তালা দিয়ে রেখে গিয়েছিলেন, দেখলেন সবই অটুট আছে। কিন্তু একটা জিনিস দেখে তার খুব অবাক লাগলো। সেই হলুদ তেলতেলে রঙের কাঠ দিয়ে জানালা বানিয়েছিলেন, দরজা জানালার সেই কাঠের রঙ কি করে একেবারে কালো আবলুষ কাঠের মতো মিশমিশে! শশাঙ্ক দাসের মনে পড়লো কাঠটা যখন ভুটিয়া মজুরটা এনেছিলো তখন তার গিরগিটির গায়ের রঙের কথা মনে হয়েছিলো, সত্যিই গিরগিটি এই ছয় মাসে হিমালয়ের বরফে, কুয়াশায়, উত্তরে ঠাণ্ডা ঝড়ে রঙ পাল্টে ফেলেছে।
এখনো তো উদ্ভিদের জগতের আমরা কিছুই জানতে পারিনি, কতো রহস্যই হয়তো গহন অরণ্যে উদ্ভিদমালার মধ্যে রয়েছে, লোকালয়ে আর কটা গাছই বা পৌঁচেছে। পাহাড়ে, সমুদ্রে, এমন কি মরুভূমির মধ্যে যে সব অজ্ঞাত কুলশীল
উদ্ভিদ অনন্তকাল ধরে ছায়া বিস্তার করছে তার কতটুকু মানুষের নজরে এসেছে?
কিন্তু দাসমিস্ত্রির জন্যে বৃহত্তর বিস্ময় তখনো অপেক্ষা করছিলো। দরজার শিকলে তালা লাগানো রয়েছে! চাবি লাগাতেই শিকল শুদ্ধ তালাটা খসে পড়লো। অবাক কাণ্ড, কোনো চোরটোরের ব্যাপার হবে। কিন্তু দুর্গম পাহাড়ে, ভয়ঙ্কর শীতে তার বাড়ীতে এমন কি জিনিস ছিলো যে চোর আসবে? ঘর খুলে কিন্তু নিশ্চিন্ত হলেন না, চোর ডাকাতের কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। জিনিসপত্র সামান্য, তবু যা যেমন ছিলো ঠিকই আছে। পুবের দিকের জানালাটা খুলতে গেলেন, পাল্লা দুটো টান দিতেই কাঠের মেঝের ওপর লোহার শিকগুলো খুলে ঝনঝন করে পড়ে গেলো।
তার কেমন খটকা লাগলো। তিনি একে একে সবগুলো জানালা খুলে ফেললেন, আর সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো। লোহার শিকগুলো খুলে পড়ে গেল মেঝেতে।
একটা শিক মেজে থেকে কুড়িয়ে তুললেন দাস। কে যেন নিখুঁত ভাবে গোড়া থেকে যেখানে জানালার কাঠের সঙ্গে লাগানো হয়েছিল সেখানের থেকে দুপাশেই কেটে নিয়েছে। সবগুলো শিকই দেখলেন। মরচে ধরে অনেক সময় লোহার শিক ক্ষয়ে যায়, এখানে কিন্তু মরচে-টরচে নেই। যেন খুব সূক্ষ্ম অস্ত্রে নিখুঁত ভাবে জানালার গরাদ থেকে শিকগুলো কেটে আলগা করে নেয়া হয়েছে। জানালার গরাদগুলো বিস্মিতভাবে পরীক্ষা করলেন শশাঙ্ক দাস। কিন্তু সেখানে শিক লাগানোর ফুটো ছাড়া কিছুই নেই, শিকের যেটুকু অংশ গরাদের মধ্যে ছিলো তা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
পুরো ব্যাপারটা আস্তে আস্তে বোধগম্য হয় শশাঙ্ক দাসের। সমস্ত জীবন লোহা নিয়ে কাটিয়েছেন তিনি, তাই প্রথমে বিশ্বাস করতে না চাইলেও ঘটনার পারম্পর্য তাকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করে। অপরিচিত উদ্ভিদ থেকে কেটে আনা এই কাঠের টুকরোগুলো যতটুকু লোহা এর ভেতরে ছিলো নিঃশেষে খেয়ে নিয়েছে। ছোটবেলায় শশাঙ্ক দাস প্রাণীভুক্ উদ্ভিদের কাহিনী পড়েছিলেন, তার মনে হল এই আরেক ধরনের ধাতুভুক্ উদ্ভিদ।
এই গাছ কি আরো আছে? লোহার মতো কঠিন ধাতুকে এমন বেমালুম নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে—সত্যিই কোনো যন্ত্রই এমন নিপুণভাবে কাটতে পারবে না লোহা, যেন ছুরি দিয়ে মাখনের ডেলা দুখণ্ড করা হয়েছে—একটা আঁচড়ের পর্যন্ত দাগ নেই। ভুটিয়া মজুরটি বলেছিলো এটিই শেষ গাছ আর গাছ নেই। থাকলেও সেই ভুটিয়া মজুর কিংবা সেই পাহাড় এই বিশালতার মধ্যে আর কোনোদিনও কি খুঁজে পাওয়া যাবে?
একবার শশাঙ্ক দাস ভাবলেন যাই দুর্গাপুর বা জামসেদপুরে একবার। এই এক টুকরো কাঠ নিয়ে গবেষণাকারীদের সঙ্গে দেখা করে আসি এই—রহস্যের কোনো সমাধান হয় কিনা? কিন্তু পরমুহূর্তেই পিছিয়ে এলেন। কি প্রয়োজন? চারদিকে যতদূর চোখ যায় পাহাড়ের পর পাহাড়, মার্চ মাসের রৌদ্রে বরফ গলা শুরু হয়েছে, অল্প অল্প কুয়াশার মতো ধোঁয়া উঠছে আকাশে, সেখানে অনন্ত নীলিমায় সেই কুয়াশা চিররহস্যের জাল ছড়িয়ে রেখেছে। কত রহস্যই তো মানুষের অজ্ঞাত, আরো একটিও না হয় রইলো।
.
প্রথম প্রকাশ: আশ্চর্য!, ডিসেম্বর, ১৯৬৩