জীবন বনাম মৃত্যু • বরেন গঙ্গোপাধ্যায়
ভোর না হতেই গুজব ছড়াল। গুজব একটা সংক্রামক রোগের মতো; প্রথমে বিন্দুর আকারে, পরে বিরাট আকৃতি ঢেউয়ের মতো সমস্ত লোকালয়ের উপর দিয়ে ঝলকে ঝলকে বয়ে যেতে লাগল। রাস্তায়, ক্যাবারে, বারে রেষ্টুরেন্টে, ফুটপাতে ক্রমে ক্রমে লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠতে লাগল।
অবশ্য একথা ঠিক আজই ইউ, সি রেডিও থেকে সকাল নটার সময় প্রকৃত বিবরণটা প্রচার করা হবে।
‘এখন কটা বাজে মশাই?’
পাশের ভদ্রলোক ঘড়ি দেখে বললেন, ‘ছটা বত্রিশ।’
ছটা বত্রিশ অর্থাৎ এখনো আড়াই ঘণ্টা বাকি। কিন্তু এরই মধ্যে গুজব ছড়ালো সান্টিয়াগো সম্মেলনের সমস্ত তথ্য ফাঁস হয়ে গেছে। আর একটু অপেক্ষা করুন টেলিগ্রাম বেরিয়ে যাবে। পৃথিবীর তাবৎ ডাক্তারদের এবার ধরে ধরে ফাঁসি কাঠে ঝোলান হবে।
অসম্ভব। অতখানি নির্দয় সিদ্ধান্ত পৃথিবীর সব মানুষই মেনে নেবে কেন? স্বার্থসিদ্ধির জন্য কেউ কেউ অমন কিছু চাইতে পারে। কিন্তু বলুন, আপনি মানবেন? আপনাদের পাড়ায় ডাক্তারদের মুখগুলি কি এই মুহূর্তে আপনার চোখের উপর ভেসে উঠছে না!
আমারও ঐ এক কথা মশাই, ডাক্তারদের দোষ দিয়ে লাভ কি, নিজেরা জন্ম নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না, কাতারে কাতারে জন্ম দিয়ে পৃথিবীর জনসংখ্যা দিনে দিনে বাড়িয়ে চলব আর দোষ হল ডাক্তারদের! রাবিশ।
আর তা ছাড়া ডাক্তাররাই বা অমন সিদ্ধান্ত মেনে নেবেন কেন! একবার স্থির মাথায় ভেবে দেখুন, একমাত্র আমাদের এই ভারতবর্ষেই ডাক্তারের সংখ্যা দেড় কোটি। নন-রেজিস্টার্ড ডাক্তার যে আরও কত তার হিসেব কে রাখে। কেবল আমাদের দেশ হলেও না হয় এক কথা ছিল, সমস্ত পৃথিবীর ডাক্তার সংখ্যা কত? কয়েক কোটি। কয়েক কোটি লোককে সান্টিয়াগো সম্মেলনের একটা সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে কাল থেকে ভিন্ন পথ গ্রহণ করতে হবে। তাও কি হয়?
কিন্তু গুজব যেভাবে ছড়িয়েছে তাতে মনে হয় অমন কিছুই সত্যি হতে চলেছে। একবার রেডিও খুলে দেখুন না।
রেডিও খুলব, হ্যাঁ হ্যাঁ—রেডিও আলারা রসিকতা জানে। এ সময় অত্যন্ত নির্বিকার ভাবেই রবীন্দ্র সংগীত বাজিয়ে চলেছে, দিয়ে গেনু বসন্তের এই গান খানি’। আচ্ছা, টেলিভিশন কি বলছে?
কি বলছে? খুলে দেখুন না! আরে হ্যাঁ, এসময় কিনা গম চাষের পদ্ধতি দেখায় কেউ। কড়া করে একটা কমপ্লেন ঠুকে দিতে হবে বেটাদের বিরুদ্ধে।
‘বসুন্ধরা’ কাগজের অফিসে সাতান্ন বার ডায়াল করেও লাইন পাওয়া গেল না। দিল্লী টাইমস বা টোয়েন্টি সেকেণ্ড সেঞ্চুরীর-ও সেই একই অবস্থা।
ফলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে হয়েছে বেশীরভাগ লোককে অগণিত জনসমুদ্র রাস্তায়। যার যা প্রাণে চাইছে, বলে যাচ্ছে। এক কথাই পাক খেতে খেতে বিচিত্র আকার ধারণ করেছে এখন।
সকাল সাতটার সময় রেডিও থেকে আবহাওয়া বার্তা প্রচার করা হল। আবহাওয়া পরিষ্কার। দিনের তাপমাত্রার পরিমাণ জানাবার পর বিশেষ ঘোষণা প্রচার করল ইউ, সি রেডিও। জনতাকে শান্ত হতে আশ্বাস দেওয়া হল। গুজবে কান দেবেন না। গুজব ছড়াবেন না। পরে বলা হল নীতিগত কারণেই সান্টিয়াগো সম্মেলনের সিদ্ধান্ত আগামী কালের পূর্বে প্রকাশ করা সম্ভব নয় বলে নিউজ-এজেন্ট আমাদের জানিয়েছেন, আপনারা ধৈর্য ধরে আর একটা দিনের জন্য অপেক্ষা করুন। রেডিও ইউ, সি।
দেখলেন তো, ছেলেমানুষী কাণ্ডটা দেখলেন! সারা পৃথিবীর সাড়ে নশ কোটি লোক অধীর আগ্রহে আজ সান্তিয়াগো সম্মেলনের দিকে তাকিয়ে আছে, অথচ ব্যাপারটা দেখুন একবার! লোকগুলির যদি এতটুকু দায়িত্ব থাকে।
ওদের আর দোষ কি মশাই। ওরা তো আর নিজেদের ইচ্ছেমতো সংবাদ বলতে পারে না। আমাদের প্রদেশের প্রতিনিধিরা যদি তৎপর না হয়।
কেবল আমাদের প্রদেশ বলে ব্যাপারটাকে ছোট করে দেখবেন না, রেডিওর নব ঘোরান না। দেখুন না অন্যান্য সেন্টার কি বলে। দেখবেন ওরাও সেই একই কথা বলে প্রদেশের লোকদের শান্ত হতে বলছে। পৃথিবীর বিপুল জনসংখ্যার সামনে আজ একটা মস্ত বড় প্রশ্ন, ডাক্তারী ব্যাপারটাকে বে-আইনী ঘোষণা করা হচ্ছে কি না। যদি হয় একদিন, তাহলে অবশ্য মঙ্গল, আর না হলেও অমঙ্গল নয়।
আপনি বুঝি ডাক্তারদের সমর্থন করেন?
শুধু সমর্থন! মনে প্রাণে সমর্থন করি। জানেন আমার ছোট ছেলে একজন ডাক্তার।
যিনি প্রশ্ন করেছিলেন তিনি কেমন গুটিয়ে নিলেন নিজেকে। তাকিয়ে রইলেন
আরো কিছু শুনবার জন্য।
আপনিই ভেবে দেখুন ডাক্তারদের দোষ কি! তারা এক অর্থে তো আপনাদেরই সেবা করে থাকেন। মনে করুন আপনার হঠাৎ বাড়ী ফিরে গিয়ে এস, টি, বি হয়েছে, আপনি সারাটা রাত অমানুষিক যন্ত্রণা পাবেন, সারা পৃথিবী খুঁজেও ডাক্তার পেলেন না, ওযুধ পেলেন না। কেমন? ভাল লাগছে শুনতে?
না, তা ঠিকই। তবে একথাও তো ঠিক রোগ হতে না হতেই ডাক্তাররা তা সারিয়ে দেবে, একটা রুগীও মরবে না তা হলে দিনে দিনে পৃথিবীতে কি ভীষণ জনসংখ্যা বেড়ে যাবে বলুন! এমনিতেই এখন সাড়ে নশ কোটি লোক আমরা। আর কয়েক বছর পর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকলেও পৃথিবীর যেটুকু স্থলভাগ তা পূর্ণ হয়ে যাবে। তখন? তখনকার কথা ভেবেছেন?
না ভেবেছি তা নয়, তবে আমার কথা কি জানেন? উত্তর মেরুতে যেমন মানুষ বসবাস আবহাওয়া সৃষ্টি করে নিয়েছে বরফ গলিয়ে তেমনি দক্ষিণ মেরুর দিকেও অভিযান চালান হচ্ছে না কেন? জানেন কত একর জমি নিয়ে দক্ষিণ মহাদেশ। অতবড় বিরাট একটা মহাদেশে একটাও লোক থাকে না, একথাও ভাবতেও মশাই লজ্জায় মাথা নীচু হয়ে আসে।
ধীরে ধীরে ক্রমশ বেলা বাড়ছিল। প্রখর সূর্যতাপ লাগছিল মাথায়। অনেকেই সান-সেডার নিয়ে বেরয় নি। ফলে আপাত আশ্রয়ের আশায় দোকানে বা রেষ্টুরেন্টে ঢুকবার চেষ্টা করছিল। প্রচণ্ড ভিড় সেখানে। ইতিমধ্যেই গুজব ছড়াল, নর্দান স্কোয়ারে ভিড় সামলানর জন্য পুলিশকে দু’দুবার নকল বৃষ্টি নামাতে হয়েছে। এই অসময়ে বৃষ্টিতে ভেজার ভয়ে জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। পুলিশ শাসিয়েছে, ফের যদি ভিড় বাড়ে বাধ্য হয়েই ওরা মৃদ্যু এ্যাসিড বৃষ্টি করবে। গত তিন-চার বছরের মধ্যেও পুলিশকে এ্যাসিড বৃষ্টি ঘটাবার প্রয়োজন হয় নি।
ধরুন এ্যাসিড বৃষ্টিতে ভিজে হাজার খানেক লোক অসুস্থ হয়ে পড়ল; তখন সমস্ত হাসপাতাল যদি বন্ধ থাকে, সমস্ত নার্সিং হোম, সমস্ত ডাক্তারখানা, তখন অবস্থাটা কেমন নির্মম দাঁড়াবে ভাবুন!
হাজার খানেক লোক মরে যাবে বলছেন তো। যাক না। যত লোক কমে যায় পৃথিবী থেকে ততই তো মঙ্গল।
এ আপনি স্বার্থপরের মতো কথা বলছেন। আপনিই যদি এ্যাসিড সিকনেসে আক্রান্ত হন?
বেঁচে যাই মশাই, বেঁচে যাই। এই ভিড়ের পৃথিবীতে বেঁচে থাকাও মৃত্যুর মতো। তার চেয়ে তিলে তিলে না ভুগে একেবারেই খতম হতে চাই। যে মরতে পারে মশাই সেই পুণ্যবান।
ও! তাই বুঝি। কালো কোট পরা ভদ্রলোক মাথার টুপিটাকে আরো একটু চোখের দিকে টেনে নামালেন। গরমে দরদর করে ঘাম দিচ্ছিল ওঁর চিবুকে। গলায় গ্লাবস জড়ালেন।
যার সঙ্গে কথা হচ্ছিল সে ভদ্রলোক হঠাৎ সন্দিগ্ধভাবে আরো একটু এগিয়ে এসে নীচু গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি? আপনাকে যেন এর আগেও কোথাও দেখেছি মনে হচ্ছে?’
‘হয়ত দেখেছেন।’ কালো কোট পরা ভদ্রলোক এড়িয়ে যাবার জন্য ভিড়ের দিকে এগিয়ে গেলেন।
এমন সময় মনে পড়ল। আশ্চর্য, এতক্ষণ তা হলে ডাক্তার সোমের সঙ্গেই কথা বলছিলাম কি। ডাক্তাররাও অবস্থাটা বুঝবার জন্য ভিড়ের মধ্যে বেরিয়ে পড়েছেন নাকি। ভদ্রলোক ডাকলেন, ‘ও মশাই, ও ডাক্তারবাবু। ডাক্তারবাবু!’
কিন্তু ততক্ষণে ডাক্তার সোম ভিড়ের মধ্যে মিশে হারিয়ে গেছেন।
ভদ্রলোক কেমন করুণভাবে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে। তারপর চেঁচিয়ে উঠলেন বিকটভাবে, ‘না, এর একটা প্রতিবাদ লিখিত ভাবেই পাঠাতে হবে সেন্ট্রাল এসেম্বলিতে। এ অন্যায়, অন্যায়। অত্যন্ত অন্যায়।’
‘আপনি কি ডাক্তারের হয়ে সুপারিশ গাইবেন নাকি মশাই?’ পাশ থেকে একজন টুপি পরা ভদ্রলোক তির্যকভাবে কথা বললেন। গলার স্বর খানিকটা উঁচু হওয়ায় অনেকেই এদিকে তাকাল।
ভদ্রলোক বুঝলেন ডাক্তারদের হয়ে কিছু বলতে গেলে এখানে ওকে ছিঁড়ে খাবে সবাই। কেমন যেন অপ্রস্তুত হয়েই উনি ভিড়ের মধ্যে নিজেকে ঢুকোবার চেষ্টা করতে করতে সরে পড়লেন।
মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে ইতিপূর্বে উচ্চ পর্যায়ে দু তিনবার আলোচনা হয়ে গেছে ঠিক কিন্তু সে আলোচনার ফলশ্রুতি শূন্য। পত্রপত্রিকায় হরদম এ নিয়ে নিবন্ধ লেখা হচ্ছে। তর্ক বিতর্কের শেষ নেই, কিন্তু আসল সমস্যাটা কেউই ঠিক ধরতে পেরেছেন বলে মনে করা যায় না।
দিন কয়েক আগে একজন টিবেটান দার্শনিক এক অদ্ভুত প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এক রাষ্ট্রের আওতা ভেঙে পৃথিবীর সমস্ত দেশ আবার বেরিয়ে না পড়লে মানুষের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আগে পৃথিবীতে যেমন অসংখ্য রাষ্ট্র ছিল, অসংখ্য গভর্নমেন্ট, ঠিক সেই রকম আবার এক গভর্নমেন্টের আওতা ভেঙে অসংখা গভর্নমেন্ট চাই। তার মতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানুষ যখন বিজ্ঞানকে মঙ্গলকর কার্যে গ্রহণ করার শপথ নিল তখন থেকেই এক নতুন বিপদের সূচনা হয়েছে। বিজ্ঞানকে অসৎ পথে চালিত করার বুদ্ধি মানুষকে আবার শিখতে হবে। আবার মারণাস্ত্র তৈরি করার কলা কৌশল জানতে হবে মানুষকে। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে আবার যুদ্ধ ঘটাবার সুযোগ দিতে হবে। জনসংখ্যা না কমাতে পারলে ভয়ানক অবস্থার সৃষ্টি হবে। সভ্যতার নামে যুদ্ধ বর্জন এক চরম অসভ্যতা। চরম নির্বুদ্ধিতা মানুষের।
অবশ্য স্পেন থেকে এ ব্যাপারে প্রচণ্ড আপত্তি উঠেছিল। স্পেন দলে টানল ইটালীকে। ইটালীর রুমে লুয়াক সোজাসুজি বললেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের যন্ত্রণাময় দৃশ্যগুলি এখনো পৃথিবীর মিউজিয়াম থেকে মুছে ফেলা হয় নি। মানুষ হয়ে মানুষের অমন জঘন্য পরিণতি দেখতে প্রস্তুত নই আমরা। পাগলের প্রলাপে বিশ্ব জনগণ যাতে কান না দেন সে জন্য তারা দেশে দেশে আবেদন পাঠিয়েছিলেন।
ভারত থেকে কর্তার সিং সদর্পে ঘোষণা করলেন, যুদ্ধ নয়, আর কখনোই যুদ্ধ নয়। এবার আমাদের অন্য পথ বেছে নেবার সময় এসেছে।
হাস্যকর মন্তব্য। অন্য পথটা কি তাই যদি না বলবেন তবে অমন ছেঁদো কথার মূল্য কি মশাই?
ভারতের বুদ্ধিজীবি সংঘ বিশ্ব বুদ্ধিজীবি সংঘকে জরুরী সভা ডাকবার জন্য আহ্বান করলেন, পৃথিবী এক সংকটের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় আমরা বুদ্ধিজীবিরা একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চাই।
মেলবোর্ণে সভা বসল। সভায় পৃথিবীর বর্তমান সংকটগুলোকে খোলাখুলি ভাবে আলোচনা করার খানিকটা পথ উন্মুক্ত হল। সম্পাদক ডি, পালিত তার রিপোর্টে প্রকাশ করলেন, বর্তমানে পৃথিবীর জনসংখ্যা সাড়ে ন’ শ কোটি। এবং জনসংখ্যা রোধের প্রচণ্ডতম চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও এই সংখ্যা শতকরা ৩৫ ভাগ করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থাৎ আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই জনসংখ্যার চাপে পৃথিবীতে আর তিলার্ধ স্থান থাকবে না। সেই সঙ্গে খাদ্যাভাব দেখা দেবে। খাদ্যাভাব মানুষকে বন্য পর্যায়ে নিয়ে যায়। ফলে কোন মানুষেরই নিরাপত্তা থাকবে না। কোন মানুষই স্বস্তিতে বেঁচে থাকতে পারবে না। যদিও ডাক্তারী শাস্ত্রের কল্যাণে মানুষের মৃত্যুচিন্তা আদৌ নেই তবু বলব জীবিত প্রত্যেকটি মানুষই জীবন্ত অবস্থায় মৃত। পৃথিবীকে ক্রমে ক্রমে মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগের ক্ষেত্র বলে আখ্যা দেওয়া যায়। মৃত্যু ভাল, কিন্তু মৃত্যু যন্ত্রণা অসহ্য। তাই মানুষকে মৃত্যু বরণ করতে শিখতে হবে। ফলে ডাক্তারদের দায়িত্বই এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী। ডাক্তাররা এবার থেকে চিকিৎসা করা বন্ধ করুন। সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দিন ওষুধপত্র, কাটা ছুরি কাঁচি ব্যাণ্ডেজ। মানুষকে মরতে দিন। প্রাকৃতিক নিয়মেই জনসংখ্যা আরো কিছু কমতে দিন। রাশিয়া থেকে বিজ্ঞানীরা কিছুদিন আগে সদর্পে ঘোষণা করেছিল, এ যুগকে ডাক্তারদের যুগ বলে আখ্যা দেওয়া হোক। ডাক্তাররা যে অসাধ্য সাধন করে চলেছেন দিনের পর দিন তার কাছে ঈশ্বর পর্যুদস্ত। মানুষ আজ ঈশ্বরের চেয়েও বেশি শক্তিশালী।
এ ব্যাপারে এক রসিক সাহিত্যিক এক মজার গল্প ফাঁদলেন। গল্পটা ছাপা হল জার্ণালে। সত্যিই মজার কাহিনী। তাতে নায়ক একজন ঈশ্বর। তিনি অত্যন্ত বৃদ্ধ হয়েছেন; তাঁর দৃষ্টিশক্তি অত্যন্ত ক্ষীণ হয়ে এসেছে। হৃদক্রিয়া যথাযথ নয় বলে মৃত্যুর পদধ্বনি যেন শুনতে পাচ্ছেন। তিনি আশু প্রতিকারের লোভে ধন্বন্তরীর দরজায় এসে হাজির হলেন।
ধন্বন্তরী বললেন, ‘দেখ হে, আমি তো সেই পুরানো আমলের ডাক্তার। আমি কি আর তোমার এই রোগ সারাতে পারব! তুমি বরং মর্তে যাও। সেখানকার ডাক্তাররা অনেক বেশি চৌকশ। ওরাই পারবে তোমার রোগ সারিয়ে দিতে।’
‘মহাত্মন্! আমিও সেই কথাই ভাবছিলাম। তবে আপনার একটা মতামত নেওয়া প্রয়োজন ছিল বলেই এসেছিলাম। আর এ কথা তো ঠিক পৃথিবীতে ডাক্তাররা এমন পটু হয়ে উঠেছে যে যমরাজাকে বোধ হয় খুব শীঘ্রই দপ্তর গুটিয়ে ফেলতে হবে।’
যাই হোক ঈশ্বর একদিন মর্তে এলেন। এসে এক ডাক্তারের কাছে নিজের স্লিপ দেখিয়ে সমস্ত উপসর্গের কথা বললেন।
ডাক্তারও পারমাণবিক পরীক্ষার সাহায্যে ভগবানের সমস্ত অসুখ নিরাময় করে দিলেন। শুধু তাই নয়, আরো কয়েক কোটি বছর যাতে ভগবান তার সৃষ্টি রক্ষা করতে সক্ষম হন সেদিকে দৃষ্টি দিতে অনুরোধ করে ডাক্তার তাকে বিদায় দিলেন।
এই কাহিনীর শেষের দিকে সাহিত্যিক যে সংলাপ ব্যবহার করেছিলেন তা চমক সৃষ্টি করে! ভগবান রোগ নিরাময়ের পর ডাক্তারকে শুধোলেন, ‘বৎসে! তোমার অসীম যত্ন আর সেবায় আমি আজ পুনর্জীবন লাভ করেছি। বল, তোমাকে আমি কি বর দিতে পারি?’
ডাক্তার কি বুঝলেন কে জানে! পালটা প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কি ফি এর কথা বলছেন? সাধারণ রুগীরা যা কি দেয় সেই ফি তো আমি আপনার কাছ থেকে গ্রহণ করি নি!’
ঈশ্বর একটু বিরক্ত হলেন। বললেন, ‘আমি তোমাকে বর প্রার্থনা করতে বলছি।’
ডাক্তার চুরুট ধরাতে ধরাতে বললেন, ‘আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন দরজার বাইরে এখনো অনেক রুগী আমার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে?’
এক অর্থে ঈশ্বরকে তাড়িয়েই দিলেন ডাক্তার। ফলে ঈশ্বর চেম্বার পরিত্যাগ
করার পূর্বে আশীর্বাদের বদলে অভিশাপ ছুঁড়ে দিয়ে গেলেন। বললেন, ‘বেশ আমি তোমার সময় নষ্ট করতে চাই না। কিন্তু অভিশাপ দিচ্ছি তোমার অহমিকাই তোমাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে।’
কাহিনীটা এইখানেই শেষ। নেহাতই বানানো কাহিনী। কেন না, ভগবান কখনো ডাক্তারের চেম্বারে রোগ নিরাময়ের জন্য আসবেন এ কল্পনা উন্মাদ ছাড়া কারো পক্ষেই করা সম্ভব নয়। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় এই যে ডাক্তারী শাস্ত্রে স্বর্ণযুগের একটা চিত্র এর মধ্যে ফুটে বেরুচ্ছে। সত্যি সত্যিই আজ ডাক্তারদের স্বর্ণযুগ। কেন না, ডাক্তারদের কল্যাণে এখন অগুনতি কাল বেঁচে থাকার স্বপ্ন কে না দেখতে পারে! ওয়ার্লড ডাইরেক্টরীর পাতা ওল্টালে ব্যাপারটা আরো সহজ ভাবে বোঝা যায়। লক্ষ্য করুন ডাইরেক্টরী বলছে বর্তমান বছরে দুশ বছরের বেশি বয়সের লোকের সংখ্যা এখন সাতান্ন কোটি। দেড়শ থেকে দুশ বছরের মধ্যে সাড়ে তিনশ কোটি। বাকি সব একশ বছরের নীচে। আরো আশ্চর্য ব্যাপার এই যে, দুশ বছরের একজন লোক যে কোন যুবকের মতোই কর্মক্ষম, বীর্যবান। তার দৈহিক লক্ষণে একটা বুড়োটে ছাপ পড়ে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তা নিতান্তই ছাপ। দৃষ্টিশক্তি যেমন আদৌ হারাচ্ছে না সে, তেমনি হৃদক্রিয়া বা অন্যান্য পেশীক্রিয়ার বিন্দুমাত্র দুর্বলতাও তার লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও বোধ হয় ডাক্তাররা এতখানি অসাধ্য সাধন করতে পারবেন বলে আশা করতে পারেন নি। চোখের ব্যাপারটাই সবচেয়ে বেশি গোলমেলে হয়ে দেখা গিয়েছিল। সাধারণত দেখা যেত পঞ্চাশ ষাট বছরের পর প্রাথমিক ছানি চিকিৎসায় আরো পঞ্চাশ ষাট বছর চোখের ক্রিয়া ঠিকমত অব্যাহত থাকত! কিন্তু দেড়শ বছরের পর একবার সম্পূর্ণভাবে চোখের মণি বদলী করে নেবার প্রয়োজন এসে পড়ল। ডাক্তাররা বানরের চোখ পরিবর্ত চোখ হিসেবে গ্রহণ করতে লাগলেন। ফলে বানরকুল ক্রমান্বয়ে ধ্বংস হয়ে আসতে থাকায় পৃথিবীর বহু স্থানেই কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে বানর চাষের কারখানা বসানো হয়েছে। বানরের চোখ পরিবর্ত চোখ হিসেবে আশ্চর্য ফল দেখাতে লাগল। অনুমান করা যাচ্ছে এই চোখে অনায়াসেই একজন লোক একশ দেড়শ বছর নির্ভাবনায় দৃষ্টিশক্তি অটুটভাবে রাখতে পারবে। তিনশ বছর হলে আবার চোখের মণি পাল্টাবার প্রয়োজন হবে। এ ব্যাপারে সব কিছু আলোচনাই থিয়োরী। গত পরীক্ষা কার্য চালাবার জন্য তিনশ বছরের কোন জীবিত লোক এখন অবধি পাওয়া যাচ্ছে না বলে ডাক্তাররা আপাতত এ ব্যাপারটা মূলতবী রাখতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু থিয়োরী যা বলে তাতে যথেষ্ট শঙ্কারই কারণ সূচিত হচ্ছে। কারণ তিনশ বছর পর দ্বিতীয়বার যখন চোখের মণি পাল্টাবার প্রয়োজন হবে তখন এমন কোন জীব কি পাওয়া যাবে যার চোখ পরিবর্ত চোখ হিসেবে গ্রহণ করা চলে। আপাতভাবে দেখা যাচ্ছে এমন কোন জীব নেই। একমাত্র এ পর্যায়ে হিপোর চোখই পরিবর্ত চোখ হিসেবে গ্রহণ করে কাজ চালান যেতে পারে কিন্তু মানুষের চোখের কোটরের যা মাপ সেই মাপের চোখ কোথায়?
যাই হোক সমস্যাটা খুব আশু নয় বলে ডাক্তার বা বিজ্ঞানীদের এ ব্যাপারে এখনো তেমন মাথা ব্যথা ওঠেনি। চোখের পরেই আসছে কয়েকটা অত্যন্ত জরুরী গ্ল্যাণ্ডের বয়স হেতু কর্মক্ষমতা লোপের আশঙ্কা। বিভিন্ন রকম জটিল অপারেশন দ্বারা এ সমস্যাও সমাধান করা সম্ভব হয়ে এসেছে। রশ্মি চিকিৎসার আশ্চর্য যাদু অকল্পনীয়!
দ্বিতীয় আর এক প্রধান সমস্যা দেখা দেয় বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই প্রায় দশ বছরের কাছাকাছি এসে। এ পর্যন্ত গ্ল্যাণ্ডগুলোতে অতিরিক্ত বাহ্যিক শক্তি দিয়ে চিকিৎসার ফলে সারা দেহে নতুন করে লোম গজাতে শুরু করে। টাক মাথায় ঘন কালো চুল গজিয়ে উঠলে ক্ষতি থাকে না। কিন্তু চুল যদি দেহের সব অংশে সমহারে বাড়তে থাকে তা হলে নিশ্চয়ই ব্যাপারটা চিন্তনীয় হয়ে দাঁড়ায়। মহিলা পুরুষ নির্বিশেষে সারা মুখে দাড়ি গোঁফ দাঁড়ায়। চোখের উপর অংশে যেমন ভ্রূ তেমনি নিচের নরম অংশেও ভ্রূর মতো চুলের রেখা প্রকট হয়ে উঠতে থাকে।
ডাক্তাররা বলেন এ চুলগুলি উঠিয়ে দিলে চোখের শক্তি দ্রুতহারে কমে আসবার ভয় যথেষ্ট। ফলে তারা এ ব্যাপারে চিকিৎসা করতে গররাজী।
ছুরি কাঁচির চাতুরীতে ডাক্তাররা অসাধ্য সাধন করেছে সন্দেহ নেই। দেহের যে অংশে জীর্ণতা বা ক্ষীণতা লাভ করছে সে অংশ অনায়াসেই কেটে বাদ দিয়ে নতুন অংশ জুড়ে দেওয়া আজ জলভাতের সামিল। এ ব্যাপারে পশু-পাখীদের দেহ থেকেই মানুষ অসীম উপকৃত।
জামান বিজ্ঞানীরা আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় সাফল্য অর্জন করে পৃথিবীর মানুষকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে গত বছর। একই জাতের দুটো কুকুর নিয়ে তারা পরীক্ষা করলেন। প্রথম পর্যায়ে কুকুর দুটির মস্তক ছেদন করা হল। তারপর প্রথম কুকুরের মাথাটা দ্বিতীয় কুকুরের ধড়ের সঙ্গে এবং দ্বিতীয় কুকুরের মাথাটি প্রথম কুকুরের ধড়ের সঙ্গে যথাযথ ভাবে জুড়ে দেওয়া হল। তাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বৈদ্যুতিক যন্ত্রের সাহায্যে মাত্র সাড়ে সাত মিনিটের মধ্যে এই অস্ত্রোপ্রচার কার্য চালান হল। দেখা গেল দিন দুয়েকের মধ্যে কুকুর দুটি পূর্ণ মাত্রায় সুস্থ হয়ে উঠেছে।
হয়ত এমন দিন আসবে যখন মানুষের মস্তক ছেদন করে অন্য মানুষের ধড়ের উপর বসানো চলতে পারে। বুদ্ধিহীন অথচ চিত্তবান লোকেরা এ ভাবে একদিন হয়ত গোপন চোরাকারবারীদের মতো বুদ্ধিমান লোকের মাথা নিজেদের ধড়ের উপর বসিয়ে নিজেদের বুদ্ধিমান করে তুলতে সচেষ্ট হবেন। আপাতত, এ ধরনের মন্তব্য শুনলে অনেকেই হেসে উড়িয়ে দেবেন, কিন্তু দুশ বছর আগে কে কল্পনা করতে পারত মানুষ একদিন বৃহস্পতি গ্রহ থেকে রকেটে করে বিশেষ ধরনের জ্বালানী এনে এখানকার পারমাণবিক চুল্লীগুলোকে সক্রিয় রাখতে সক্ষম হবে? বা, কে কল্পনা করতে পারত নকল আগ্নেয়গিরি তৈরি করে ভূ-কেন্দ্রের হাজার মাইল নিচ থেকে গলিত সোনা পৃথিবীর উপর একদিন মানুষ উঠিয়ে আনতে পারে? মানুষ আজ সব পারে। সব পারবে। ডাক্তাররাই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। ওরা জেহাদ তুলেছে একটা মানুষকেও মরতে দেবে না। না, একটাও না। মানুষের দুর্বল ক্ষীণায়মান অংশগুলোকে চিকিৎসা করে তারা তার মধ্যে যৌবনের শক্তি যুগিয়ে দেবে। পৃথিবী যতকাল থাকবে একটা মানুষও ততকাল জীবিত থেকে ভোগ করতে পারবে একি একটা কম কথা।
যাক এসব কথায় পরে আসা যাবে। আপাতত আমরা ডাক্তার সোমের চেম্বারে একবার ফিরে যাই চলুন। ডাক্তার সোম একজন ধীর স্থির শান্ত প্রকৃতির লোক। কথা বলেন অল্প কথা শুনতে চানও অল্প। রুগীর মুখ থেকে তার উপসর্গের কথা না শুনেও তিনি রুগীর অবয়ব দেখেই যথাযথ পরামর্শ দিতে পারেন। বিশেষ করে তার মতো ব্রেন-বিষয়ক অভিজ্ঞ এদেশে খুব কমই আছে বলে আমরা ধরে নিতে পারি। মাদ্রাজের তরুণ ডাক্তার রামস্বামী মেডিকেল জার্ণালে একটা যুগান্তকারী প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সে প্রবন্ধের বিষয়বস্তু ছিল ব্রেন চিকিৎসা এবং ডাক্তার ভুবনমোহন সোম। তাঁর ধারণায় মানুষের ব্রেন চিকিৎসার দ্বারাই তা সারান সম্ভব হতে পারে। এবং ডাক্তাররা সোমের এই চিকিৎসা পদ্ধতি আজ না হতে পারে কিন্তু একদিন না একদিন পৃথিবীর সমস্ত ডাক্তারই মেনে নেবেন।
ডাক্তার সোমের চেম্বার আজ ফাঁকা জনমানবহীন বড় বেখাপ্পা দেখাচ্ছিল। দুজন এসিস্টান্ট সামনের লনে বসে উদাস ভাবে রাস্তায় ভিড়ের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। একজনের নাম অপরেশ, অপরজন একজন বার্মিজ, নামমিঃ চাঙ।
চাঙ বহুক্ষণ পর হঠাৎই বলল, ‘সুপারসনিক হেলিকপটারকে বিক্রি করে দিয়ে চীনেই চলে যাব ভাবছি।’
‘গিয়ে?’ প্রশ্ন করলে অপরেশ।
‘গিয়ে আমি এক্সট্রাক্টের গবেষণায় মন দেব।’
‘বিষ তৈরি করবে?’
‘অমৃতও তো হতে পারে। ইচ্ছে আছে ট্যাবলেট ফুড আবিষ্কার করা! খাদ্যের অভাব ঘটবে বলেই তো মানুষের আজ এত চিন্তা। ভাবছি এমন এক একটা
ট্যাবলেট বানাব যা খেলে মাসখানেক আর খাবার দরকার হবে না।’
অপরেশ হাসবে কি কাঁদবে বুঝে উঠতে পারল না। বলল, ‘আইডিয়া যদিও নতুন নয়, তবে সাকসেসফুল হতে পারলে লোকে তোমাকে মাথায় করে নাচবে।’
দুজনেই আবার গম্ভীর। আকাশটা কাচের মতো ঝকঝকে পরিষ্কার। দুটো একটা পাখি আলতো ভাবে ভেসে বেড়াচ্ছে। বহুদূরে কোন এক কারখানা থেকে গল গল করে ধুঁয়ো বেরুচ্ছে। কিন্তু বাতাস ছিল বলে ধুঁয়ো একটুও আকাশের গায়ে দেখা দিচ্ছিল না। অপরেশ আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। পিছনে একটা জামরুল গাছ। তার ছায়াটা ক্রমশই একটু একটু করে সরে ছোট হয়ে আসছিল! অনেকক্ষণ পর মিঃ চাঙ আবার বললেন, ‘কিন্তু যাই বলো মিঃ অপরেশ, আমার এখনো বিশ্বাস হয় না সান্টিয়াগোতে ডাক্তারদেরই অমন সর্বনাশ ডাকা হবে।’
‘অনেক জিনিসই পৃথিবীতে বিশ্বাস করার মতো নয়। কিন্তু ঘটে যায়।’ অপরেশ নীচু গলায় উত্তর করল।
‘তা অবশ্য ঠিক, তবে সভ্যতার চাকচিক্য যত বাড়ছে মানুষ কি মনের দিক থেকে ততই বর্বর হয়ে যাবে।’
‘যাবে কি! গিয়ে বসে আছে যে। নইলে ভাবতে পারো ডাঃ সোমের মতো ভাবুক শান্তিপ্রিয় লোকও আজ পথে পথে জনমত শুনবার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছেন।’
‘ওটা কিন্তু অহেতুক বাড়াবাড়ি। আরে বাবা সারা পৃথিবীতে একমাত্র ডাক্তার সোমই তো ডাক্তার নন, কোটি কোটি লোকের যেখানে প্রশ্ন, সেখানে’
‘ডাক্তার সোম নিজের দায়িত্বের কথাই হয়ত ভাবছেন। তুমি আমি ঝট করে অন্য দিকে চলে যেতে পারব, কিন্তু সোম একশ বছরের বেশী ডাক্তারীই করছেন। এতদিনের অভ্যেস।’ আরো কিছু বক বক করে বলতে যাচ্ছিল অপরেশ হঠাৎ ভূতগ্রস্তের মতো সামনের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল। মিঃ চাঙও উঠে দাঁড়াল। দুজনে দেখল ডাক্তার সোম তার সবুজ রঙের গাড়িটা লনের ভিতর ঢুকিয়ে দিয়েছেন।
চোরের মতো নিঃশব্দে গাড়ীটা লনের ভিতর ঢুকল। অপরেশ এগিয়ে গেল।
‘এ কি! স্যার, আপনি কি অসুস্থবোধ করছেন?’
ডাক্তার সোম টলতে টলতে গাড়ী থেকে নেমে এলেন। বিষন্ন ক্লান্ত চেহারা। ‘আজ কোন পেশেন্ট আসেনি বুঝি?’ মৃদু গলায় শুধোলেন।
চাঙ বলল, ‘না সার!’
‘তা হলে আজ থেকে ডাক্তারদেরই পেসেন্টের ভূমিকা নিতে হবে।’ বিড়বিড় করে বলতে বলতে ডাক্তার সোম চেম্বারের ভিতর ঢুকে এয়ার কুলারের সুইচ টিপে দিলেন।
অপরেশ আর চাঙও পিছন পিছন এগিয়ে এসে ভিতরে ঢুকল। ওপাশে দেয়ালে কতকগুলি ব্রেনের কম্পলিকেটেড মডেল সাজান। মডেলগুলো দেখে অদ্ভুত ভাবে হেসে উঠলেন ডাক্তার সোম। ‘সান্টিয়াগো সম্মেলনের কয়েকটা গাধার মতামতের উপর ওগুলোর ভাগ্য জড়ান, তোমাদের কি একথা ভাবলে হাসি পায় না?’
‘স্যার! আপনি একটু বেশি মাত্রায় বিচলিত হয়ে পড়েছেন।’
‘তুমি কি বলতে চাও? তুমি কি বলতে চাও, ডাক্তার সোম ইজ এ ফুল। যাও, ওগুলোকে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে এসো তো দেখি!’
‘স্যার! আমাকে আপনি ভুল বুঝছেন।’
‘হয়ত তাই হবে চাঙ!’ ডাক্তার সোমের গলা যন্ত্রণায় যেন বুজে এল। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ‘জানো আমার মা একজন দীর্ঘ রুগী। লিভারের ঘা নিয়ে অনেকদিন ভুগছে। কাল থেকে যদি তার চিকিৎসা করতে না পারি তা হলে প্রথম ভিক্টিমই হবেন আমার মা। আমি একজন ডাক্তার হয়ে আমার মাকে আমি মরতে দিতে পারি না!’
অপরেশ ডাক্তার সোমের চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল। দেখল চোখ দুটো আশ্চর্য রকম সজল হয়ে এসেছে। যেন এক শান্তশিষ্ট শিশুর চোখে জল টল টল করছে।
মিঃ চাঙও বুঝতে পারল, ডাক্তার সোম কেন আজ এত বেশি চঞ্চল হয়ে উঠেছেন। মুখ নীচু করে স্থির হয়ে ও দাঁড়িয়ে রইল।
সান্তিয়াগো সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন শ্রীগুণধর রেড্ডি। ভোর হওয়ার আগেই উনি কে-ফাইভ রকেটে করে সান্টিয়াগো গিয়েছিলেন, সন্ধ্যার দিকে আবার ফিরে এলেন। এলাহাবাদের পোর্টে আগে থেকেই রিপোর্টাররা টেপ রেকর্ডার নিয়ে প্রস্তুত হয়েছিল। টেলিভিশন-অলারাও তৈরি ছিল। নীল আলোর ফোকাস ফেলে স্পট ঠিক করে ধীরে ধীরে তার উপর প্লেনটা নেমে দাঁড়াল।
শ্ৰীরেড্ডি সম্পর্কে সাধারণ মানুষ কোন দিনই সন্তুষ্ট নন। লোকটার হামবগ আচরণ নিয়ে কয়েকবার বিক্ষোভও দেখা গিয়েছিল। কিন্তু তা সাময়িক। সাংবাদিকরা, অনেকেরই ধারণায়, রেড্ডির হাতের কেনা পুতুল। পুরো ব্যাপারটাই চলছে টাকার উপর দিয়ে। টাকায় মুখ বন্ধ। টাকায় কি না হয়।
তবে একথা ঠিক রেডি হয়ত ডাক্তারদের সমর্থনেই কথা বলবেন। তার মতে, ডাক্তাররা তো নিমিত্ত মাত্র। সমস্যাটার সমাধানের উপায় আমাদের অন্য ভাবে খুঁজতে হবে।
প্লেনের দরজা খুলে যেতে প্রথমে রেড্ডি এবং পরে তার স্ত্রী প্রীলা রেড্ডি আরো পিছনে পি, এ এবং অন্যান্যরা একে একে নেমে এলেন।
দূরে ব্যারিকেডের বাইরে পুলিশ জনতাকে আটকে রেখেছে। পুলিশদের হাতে ব্যাটারী গান। অবস্থা খারাপ বুঝলেই ফায়ার করে মৃদু ইলেকট্রিক শক ছড়াবে।
বাঙালী ছাড়াও বহু ভাষাভাষিক লোকের ভিড় কম নয়। এরা সকলেই ট্রানস্লেটার যন্ত্র কানে লাগিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছে। রেড্ডির কথা শুনবার জন্য।
রেড্ডি জনতাকে হ্যাট খুলে অভিবাদন করলেন। ‘গুড ইভনিং বন্ধুগণ! আপনারা নিশ্চয়ই সম্মেলনের তথ্য জানবার জন্য আগ্রহী হয়ে এই এয়ার পোর্ট অবধি দৌড়ে এসেছেন। আমি আপনাদের এ ব্যাপারে এক কথাতেই নিরাশ করে দিতে পারি কি?’
জনতা থেকে সোরগোল উঠল। পুলিশও তৎপর হয়ে উঠল।
হঠাৎ সাংবাদিকদের একজন প্রশ্ন করলেন, ‘এ কথা কি ঠিক মিঃ রেড্ডি, আপনারা যে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন তা জনসাধারণের অনুকূলেই যাবে।’
‘জনসাধারণের মঙ্গলের জন্যই সম্মেলন ডাকা হয়।’ সহাস্য উত্তর দিলেন রেড্ডি।
‘এবং সেই সঙ্গে সংখ্যালঘু ডাক্তারদের ভাগ্যও কি জড়িত থাকবে?’
‘ডাক্তারীটা এক জাতীয় বৃত্তি বা পেশা। আসলে তাদেরও সর্বপ্রথম পরিচয় ‘মানুষ’। মানুষের জন্যই সান্টিয়াগো সম্মেলন।’
‘অর্থাৎ আমরা কি ধরে নিতে পারি সম্মেলন এই ধরনের রায় দেবে যার ফলে ডাক্তারী পেশাকে বর্জন করা ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ আর থাকবে না?’
‘এ প্রশ্নের জবাব দিতে আপাতত আমাকে অনুরোধ করবেন না।’
জনতা থেকে আবার গুঞ্জন উঠল।
সাংবাদিকদের মধ্যে আর একজন প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার কি দৃঢ় বিশ্বাস পৃথিবীর জনসংখ্যা কমাতে হলে ডাক্তারী শাস্ত্রকে বে-আইনী ঘোষণা ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ নেই।’
‘আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাসে এমন কিছু আসে যায় না। বেশীরভাগ লোকের বিশ্বাস এক হলে তবেই একটা মতামত গড়ে ওঠে। ব্যক্তিগত লোকের বিশ্বাসের মূল্য একালে নেহাতই সামান্য।’
‘আপনি আপনার বিশ্বাসকে দশজনের মধ্যে প্রচার করেই তো জনমত গড়তে পারেন?’
‘আমি আমার মতামতকে আপনাদের উপর চাপিয়ে দিতে চাই না। আপনার বুদ্ধি বিবেকই আপনাকে মতামত গঠনে সুযোগ এনে দেবে।’
‘তা যাই হোক।’ সাংবাদিক এবার শ্রীরেড্ডি সমেত পুরো দলটাকে স্থির হয়ে দাঁড়াতে অনুরোধ করে ফটো তুলবার জন্য পোজ নিলেন। শ্ৰীমতী প্রমীলা রেড্ডিকে
পাশে নিয়ে ছবি তোলা হল।
ছবি তোলার পর্ব শেষ হলে রেড্ডি সাংবাদিকদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এগিয়ে এলেন। জনতাকে হাত তুলে অভিবাদন করলেন। চারিদিক থেকে স্লোগান উঠল, ডাক্তারী শাস্ত্র বে-আইনী হোক। ডাক্তারী শাস্ত্র বে-আইনী হোক।
ডিনার টেবিলে বসে ডাক্তার সোম স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করছিলেন। সোমের স্ত্রী শ্ৰীমতী বীণা সোম এককালে দর্শনের ছাত্রী ছিলেন। ভাল ছাত্রীই ছিলেন, কিন্তু পরবর্তীকালে চর্চা না থাকায় সব কিছু গুলিয়ে বসে আছে আজ। দীর্ঘ স্বাস্থ্যবতী মহিলা। সাজগোজ করা এক জাতের হবি তাঁর। মুনলাইট হোটেলের ফ্যান্সি ড্রেস কম্পিটিশনে গত বছর জনৈক বিচারক হয়েছিলেন। নিজে অত্যন্ত সাদামাটা পোশাক পরেন ঠিকই কিন্তু যে কেউ দেখলে বুঝতে পারবেন ঐ পোশাক পরার মধ্যেও এক জাতের চাপা অহমিকা লুকান থাকে। কেয়ারফুল কেয়ারলেসনেস।
ডাক্তার শুধোলেন, তুমি কি সন্ধ্যার নিউজটা মন দিয়ে শুনেছিলে বীণা?’
‘শুনেছি। আর একটু কফি দেব?’
ডাক্তার সোমা শ্রাগ্ করলেন। ‘হোয়াট এ পিটি! এমন দুর্দিনেও তুমি এত স্বাভাবিক থাকছ কি করে বল দেখি। জানো মায়ের ট্রিটমেন্টটা আরো তিন মাস চালাতে হবে।’
‘চালাবে। অত ঘাবড়ে যাচ্ছ কেন? তুমিই কি একা ডাক্তার নাকি!’
‘প্রত্যেকটি ডাক্তারই আজ ঘাবড়াচ্ছে। আমাকে দেখে কি তা বুঝতে পারছ না?’
‘হুঁ তোমার মতো সবাই চিকেন হার্টেড কিনা। নাও আর একটু কফি খেয়ে চাঙ্গা হয়ে নাও। তারপর চল টেলিভিশনটা খুলে বসি।’
‘তা হলে কি তোমার ধারণা সান্তিয়াগোতে ডাক্তারদের অমন সর্বনাশ ডাকা হবে না?’
‘হলেই বা ক্ষতি কি। আইন যত আছে, তার ফাঁকও তত আছে। আর একথা তো ঠিক যারা আজ আলোচনার টেবিলে বসে রায় দেবে তারাই কালকে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। তাদেরই কালকে ডাক্তারের দরকার হতে পারে।’
‘পারে কি, পারবেই। সব এখন বুদ্ধি বিকৃতির কবলে পড়েছে।’
‘তাই বলছি আজ যদিও অমন ধারা কিছু করতে পারে, কালই আবার তা প্রত্যাহার করে নেবে। চল, ও ঘরে বসি গিয়ে।’
ডাক্তার সোম ক্লান্ত ভাবে উঠে দাঁড়ালেন। মনে হল হাত পা হঠাৎ কেমন অবশ হয়ে আসছে। এই অবশতা দীর্ঘকাল বেঁচে থাকার ফল। একশ তেত্রিশ বছর বয়স ডাক্তারের। ভগবানের নিয়মকে লঙঘন করে এতকাল বেঁচে থাকার পাপ ওঁর দেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দানা বেঁধে বসে আছে। ভগবানের আক্রোশ যেন পৃথিবীর সমস্ত মানুষের উপর বর্ষিত হচ্ছে আজ। না, একটা লোকও আজ নিস্তার পাবে না।
বীণা দেবী এগিয়ে এলেন ডাক্তারের পাশে, ‘কি হল তোমার? টলছ কেন?’
‘না! টলছি কোথায়!’ ডাক্তার সোম নিজেকে প্রকৃতিস্থ করে ধীর পায়ে এগোতে লাগলেন। বীণার কাঁধের উপর একটা হাত আলতো ভাবে বিছিয়ে দিলেন।
ঘরে ক্ষীণ হালকা একটু আলোয় আলোকিত হয়েছিল। শান্ত স্তব্ধতা। আরাম কেদারায় গা এগিয়ে দিলেন ডাক্তার। নরম গদির মধ্যে অনেকখানি ডুবে গেলেন। বীণা দেবী মুখোমুখি বসলেন। বীণার মুখ পাথরের স্কালপচার বলে ভুল হচ্ছিল। অনেকক্ষণ অপলকে তাকিয়ে রইলেন ডাক্তার সোম। হঠাৎ উত্তেজিতভাবে বললেন, ‘ইমপসিবল।’
‘কি ইমপসিবল? মাথা থেকে ওসব ভূতগুলো সরাবে তুমি? চুলোয় যাক তোমার ডাক্তারী।’ খানিকটা বিরক্ত ভাবেই বীণা দেবী বললেন।
‘তুমি বুঝবে না। এসব তোমাদের মতো মেয়েদের মাথায় ঢুকবে না।’
‘ওফ, ভারী তো আমার পুরুষ। ভাবতে ভাবতে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তো কাহিল হয়ে পড়েছ।’
‘তোমাদের মতো তো কেবল খেয়েদেয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমুলে চলে না আমাদের।’ ডাক্তারও বিরক্ত ভাবে উত্তর দিলেন। ‘মায়ের অসুখটা না থাকলে থোড়াই আমি পরোয়া করতাম।’
‘ওরা যতই আইন করুক, মায়ের চিকিৎসা তাতে বন্ধ হবে না। ঘরে বসে মাকে তুমি অনায়াসেই দেখাশুনা করবে। কে অত খোঁজ নিতে আসছে বলো। আর তা ছাড়া আইন করলেই তো হয় না। তা চালু করতে সময় লাগে, ততদিনে মা বেশ ভাল হয়ে উঠবেন।’
‘আইনের উপরই এখন জগৎটা চলছে তা জানো। আইনের জন্যই মানুষের আজ এত যন্ত্রণা। সব স্বাধীনতা তার আইনের শাসনেই ছোট হয়ে গেছে।’
‘তা অবশ্য গেছে। কিন্তু আইনেই আবার মানুষের সভ্যতা টিকে আছে।’ নরম গলায় বীণা দেবী বললেন। তারপর বাঁ হাত বাড়িয়ে রেডিওর সুইচটা টিপে দিলেন।
দেওয়ালে পারমাণবিক ঘড়িটা জ্বল জ্বল করে জ্বলে সময় নির্দেশ করছে। এখানে বসে স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছিলেন ডাক্তার, রাত নটা সতের। নটার সময় রাতের নিউজ প্রচারের কথা ছিল। কি সংবাদ ওরা ছড়িয়েছে, কে জানে।
বীণা দেবী বললেন, ‘নিউজটা টেপ করা আছে। বাজাব, না রেডিওই চলবে?’
ডাক্তার নোম চোখ বুজে অপেক্ষা করছিলেন। কোন উত্তর দিলেন না। রেডিও, রেকর্ড বা টেলিভিশন কোন কিছুর ওপরই আস্থা নেই ওঁর। ও-সব যন্ত্র। যন্ত্রের কি ভয়াবহ চেহারা হয়েছে এযুগে।
ততক্ষণে রেডিওই বেজে উঠল। কে যেন সারগর্ভ বাণী প্রচার করে জনতাকে শান্ত থাকবার নির্দেশ দিচ্ছে। সান্তিয়াগো সম্মেলনের তাৎপর্য বোঝাচ্ছেন। …হ্যাঁ এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য নয় জোর করে অসহায় মানুষের কাঁধে কিছু চাপিয়ে দেওয়া। জনসাধারণ চেয়েছিল বলেই এই সম্মেলনের প্রস্তুতি। কিন্তু জনসাধারণ নিশ্চয়ই এমন কিছু চায়নি যাতে এখনই একটা লজ্জাকর ইতিহাসের নজির ঘটে যায়। ডাক্তারদের প্রতি নির্মম আচরণ করবেন না। হয়ত দেখবেন আপনারই পরিবারের মধ্যে একজন কি দুজন ডাক্তারীবৃত্তিসম্পন্ন। তাদের প্রতি নিশ্চয়ই আপনি নির্মম হবেন না।…
‘উহ্ বন্ধ কর। রাবিশ!’ ডাক্তার সোম হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন।
বীণা দেবী সুইচ অফ করে দিয়ে ধীরে ধীরে বললেন, ‘কেন, কি এমন খারাপ কথা বলছিল ওরা। সবতায় তোমার অধীর স্বভাব।’
হঠাৎ ফোন বাজল। ডাক্তার সোম তাকিয়ে রইলেন ফোনের দিকে। হাত বাড়াতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। নিশ্চয়ই কোন রুগী কনট্যাক্ট করতে চায়। বীণা দেবী ফোন তুললেন।
‘হ্যালো, হুঁ হুঁআচ্ছা।’ ফোন এগিয়ে দিয়ে বীণা দেবী বললেন ‘তোমার ফোন।’
‘কে ডাকছে?’ নির্বিকার ভাবে প্রশ্ন করলেন ডাক্তার সোম।
‘মাদ্রাজ থেকে। কি সাম নায়ার।’
‘কি চায়?’ আবার প্রশ্ন করলেন ডাক্তার।
‘আহা ধরেই দেখ না। নিশ্চয়ই কোন জরুরী কথা আছে, নইলে এই রাত করে কেউ ডাকে।’
ফোন তুলে ডাক্তার সোম প্রশ্ন করলেন, ‘হ্যালো, কে কথা বলছেন?’
‘আমি সৎপতি নায়ার। আপনি ডাক্তার সোম নিশ্চয়ই।’
‘হ্যাঁ বলুন।’
আমি ডাক্তার রামস্বামীর এ্যাসিস্ট্যান্ট। কিছুক্ষণ আগে ডাক্তার রামস্বামী সুইসাইড করেছেন। পুলিশে এখন বাড়ীটাকে ঘিরে আছেন। রামস্বামী তাঁর চিঠিতে আপনার কাছে খবরটা জানাবার জন্য অনুরোধ করে গেছেন।’
ডাক্তার সোমের হাত কাঁপছিল। উনি সোজা শক্ত হয়ে বসলেন ‘আপনি কি প্রলাপ বকছেন? রামস্বামী, সুইশাইড। ইমপসিব্ল।’
‘উনি চিঠিতে লিখেছেন, আমি ডাক্তারী বেআইনী করার প্রতিবাদে সমস্ত পৃথিবীর
জনসাধারণের কাছে আমার জীবন সমর্পণ করছি। পৃথিবীর সমস্ত ডাক্তার সমবেত হোন। প্রতিবাদ করুন। আমি যে অগ্নিশিখা জ্বালিয়ে দিলাম তাতে ইন্ধন দিয়ে তাকে দীর্ঘস্থায়ী করে রাখুন। লঙ লিভ মেডিক্যাল ম্যান।…’
ডাক্তার সোমের সমস্ত দেহ দরদর করে ঘাম জড়িয়ে এল। কানের উপর ফোনটাকে চেপে ধরেও আর কিছু শুতে পেলেন না উনি। সব কেমন ক্ষীণ হতে হতে মিলিয়ে যাচ্ছে। বীণা দেবীর মুখটাও যেন চোখের দৃষ্টিতে আর প্রচ্ছন্নভাবে ধরা পড়ছে না। ঘরের বাতিটা কি নিভে গেছে! পৃথিবীর সমস্ত বাতি কি নিভে গেছে। অন্ধকার, বিরাট নিঃশব্দ অন্ধকার!
হাত থেকে ফোনটা গড়িয়ে পড়ে গেল। ডাক্তার সোম চিৎকার করে কি যেন বলবার চেষ্টা করলেন, বীণা দেবী ঠিকমতো ধরতে পারলেন না। এগিয়ে এসে ডাক্তার সোমের মাথার সামনে কুলিং মেশিনটা ফুল স্পীডে খুলে দিলেন।
খানিকটা হুইস্কি খাওয়ার পর ডাক্তার সোম আবার ধীরে ধীরে সম্বিৎ ফিরে পেলেন। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে মিঃ চাঙ আর অপরেশকে তলব করলেন।
‘ডাকছিলেন স্যার?’
‘হুঁ, বোস! নিশ্চই খবর পেয়েছে ডাক্তার নায়ার, প্রতিবাদে সুইসাইড করেছেন?
‘হ্যাঁ সার। এইমাত্র রেডিও থেকেও প্রচার করা হয়েছে।’
মিঃ চাঙ বললেন, ‘ডাক্তার নায়ার হাই ভোল্টেজ শক খেয়ে জীবন দিয়েছেন ডাক্তারি আইনের প্রতিবাদে। উনি যে চিঠি লিখে গেছেন তাও পাঠ করে শোনানো হয়েছে।’
‘ব্যাপারটা বেশ প্রচার হয়ে গেছে।’
‘হ্যাঁ স্যার।’ অপরেশ নীচু গলায় বলল! ‘আর সেই সঙ্গে স্যার আর একটা নিউজ আছে।’
‘কি নিউজ?’
‘পৃথিবীর বহু ডাক্তার ঘোর প্রতিবাদ জানিয়ে কাল সকালেই সান্টিয়াগোতে তার পাঠাবে বলে জানা যাচ্ছে।’
‘তা হলে আমাদেরও একটা কিছু করণীয় আছে এ ব্যাপারে?’
‘হ্যাঁ স্যার, আমরাও একটা ড্রাফট করেছি।’
‘ভেরি গুড।’
‘কিছুতেই স্যার এমন অন্যায় আমরা সহ্য করব না।’
অপরেশ খানিকটা উত্তেজিত গলায় বলল। ‘নিশ্চয়ই, এমন কিছু নিশ্চয়ই আমরা সহ্য করতে পারি না। তা ড্রাফটটা তা হলে একবার আমাকে দেখিয়ে সই করিয়ে নিও সকালে?’
‘নিশ্চয়ই স্যার।’
‘আর একটা কাজের কথা। দেখছ তো কেমন দুর্বল হয়ে পড়েছি আমি! অথচ এখনি আমার রকেটে করে মাদ্রাজ যাওয়া উচিত ছিল।’
‘এই রাত করে স্যার আপনি কেন কষ্ট করবেন। তার চে’
‘হুঁ সেই জন্যই তোমাদের ডেকেছি। তোমরা একবার আমার হয়ে মাদ্রাজ যাও। নায়ারের পরিবারকে সান্ত্বনা দেওয়া উচিত আমাদের। ভোরের আগেই আবার ফিরে এসো। একটু কষ্ট হবে ঠিকই, তাএটুকু আমাদের করা উচিত।’
‘নিশ্চয়ই স্যার। আমরা নিশ্চয়ই যাব। এখনি আমরা তৈরি হয়ে নিচ্ছি।’
মিঃ চাঙ বলল, ‘আপনি স্যার একটু বিশ্রাম নিন এবার। আমরা ঠিক ভোরের আগেই আবার ফিরে আসছি।’
‘বেশ। গুড নাইট।’
মিঃ চাঙ আর অপরেশ বাইরে বেরিয়ে এল।
বীণা দেবী পাশেই বসেছিলেন। বললেন, ‘লোক দুটো আশ্চর্য ভাল। এমন মিষ্টি স্বভাব।’
একটা গম্ভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শব্দ করলেন ডাক্তার সোম, ‘হুঁ। এবার বাতিটা নিভিয়ে দাও। খুব ক্লান্ত লাগছে আমার।’
বীণা দেবী সুইচটা অফ করে দিলেন।
.
মধ্যরাতে কি যেন একটা দুঃস্বপ্ন দেখে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল ডাক্তার সোমের। পারমাণবিক ঘড়িতে এখন রাত দুটো! অপলকে উনি ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। ঘড়ির ডায়াল জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। সময় নির্দেশক কাঁটা দুটো আপাতভাবে স্থির হয়ে আছে। যেন মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে ঘড়ি তার সময় চুরি করে এগিয়ে যাচ্ছে। পলে পলে মুহূর্তে মুহূর্তে সময় বয়ে যাচ্ছে। এমনি ভাবে সময় বয়ে যেতে যেতে আজ প্রায় দেড়শ বছরের কাছাকাছি বয়স আমার। ইচ্ছে করলে আমি হাজার বছর বেঁচে থাকতে পারি। এই পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ কি আমার কাছে পুরানো হয়ে যাবে? না, এতটুকু মলিন নয় বসন্তকাল। প্রত্যেকটি ঋতুই যেন নব নব সাজে আমার কাছে এসে তার চেহারা খুলে ধরে। তবে? তবে কেন আমি বেঁচে থাকব না। কেন বাঁচবে না মানুষ?
অথচ ওরা ভুল বুঝে ভুল পথে যেতে চায়। আমি কি তবে প্রত্যেক মানুষকে ধরে ধরে বেঁচে থাকার সমর্থনে কথা বলব? নিশ্চয়ই আমার বোঝান উচিত সবাইকে। ডাক্তার সোম ক্রমশই চিন্তা করতে করতে উত্তেজিত হচ্ছিলেন। ওপাশে বীণা দেবী ঘুমিয়ে আছে। আহা, কি স্নিগ্ধ ওর চোখের পাপড়ি দুটো। স্নেহে মমতায় সুখে, আমার বেঁচে থাকার সব কিছুর প্রেরণাই বীণা। ডাক্তার সোম খানিকটা স্বস্তি বোধ করছিলেন মনে মনে। বাইরে তাকালেন। জানলার বাইরে জ্বলজ্বল আকাশ। অসংখ্য তারা দেখা যাচ্ছে। তারাগুলোর রহস্য আজ এমন কিছু নতুন নয় মানুষের কাছে। সমস্ত বিশ্বটাকে মানুষ যেন তার হাতের মুঠোয় তুলে নিয়েছে।
মানুষ কত শক্তিশালী; তবু কেন এই নির্বুদ্ধিতা? কেন মানুষ জীবনের প্রয়োজনে মৃত্যুকে আজ এত করে কাছে পেতে চায়। কেন? কেন? ডাক্তার সোম মানুষের এই নির্বুদ্ধিতার কোন যুক্তিই খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
হঠাৎ তিনি কি একটা ছোট্ট শব্দ পেয়ে চমকে উঠলেন। পাশের ঘরে কি বাতি জ্বলে উঠল? পাশের ঘরেই শয্যাশায়ী মা। ডাক্তার সোম আরো কিছু শুনবার আশায় অপেক্ষা করে রইলেন। কে যেন ঘরের মধ্যে কিছু একটা ভারী জিনিস নিয়ে টানাটানি করছে। ‘কে?’ ছোট্ট করে প্রশ্ন করলেন ডাক্তার সোম। পলকেই ও ঘরের শব্দ বন্ধ হয়ে গেল।
আশ্চর্য! কি হতে পারে। বাইরের কোন লোকের এ ঘরের দিকে তো ঢোকা একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। কি হতে পারে তবে!
ডাক্তার সোম এগিয়ে এলেন পা টিপে টিপে দরজার সামনে এসে ডাকলেন, ‘মা, ও মা!’
কিন্তু এবারও কোন উত্তর নেই। তবে কি দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ব। হ্যাঁ, দরজায় একটু চাপ দিয়ে ডাক্তার সোম দরজাটা খুলে ফেললেন। তারপর আঁৎকে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ালেন। একি, কি দেখছেন উনি? ‘মা, তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি করছ?’ ডাক্তার সোম দেখছিলেন তাঁর মাকে। ঘরের মধ্যে একটা টুল টেনে এনে তার উপর দাঁড়িয়ে আছেন মা। হাতে দড়ির মতো পাকান কাপড়।
ডাক্তার সোমের বুঝতে অসুবিধা হল না, মা আর একটু সময় পেলেই হয়ত একটা কেলেঙ্কারী করে বসতেন। ভাগ্যিস ঘুম ভেঙে জেগে বসেছিলেন ডাক্তার সোম। সমস্ত দেহে যেন উত্তেজনায় দরদ করে ঘাম জড়াতে লাগল। সোম এগিয়ে এলেন, ‘মা, এ তুমি কি করতে যাচ্ছ মা?’ বিদ্যুৎ বেগে মাকে কোলের উপর টেনে নামিয়ে নিলেন ডাক্তার সোম তারপর বিছানার উপর শুইয়ে দিলেন।
‘খোকা!’ বৃদ্ধার চোখে ঝর ঝর করে জল নেমে এল। ‘খোকা আমায় তুই রেহাই দে খোকা। আমি আর বাঁচব না, আর বাঁচতে চাই না আমি।’
‘মা ও-মা, অমন কথা বলো না মা। আমি যত কাল থাকব, তোমাকে আমার সঙ্গে সঙ্গে রাখব মা। বাবার মৃত্যুর সময় আমি কাছে ছিলাম না। এ দুঃখ আমি কোন দিন ভুলতে পারব না।’
মা ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিলেন। ডাক্তার সোম গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে
সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। ‘মা, আমি যতকাল আছি তোমার ভাবনা কি মা?’
‘আমি সব শুনেছি খোকা। তোকে আর ডাক্তারী করতে দেবে না ওরা, আমি সব শুনেছি।’
‘তুমি ভুল শুনেছ মা। ডাক্তারী কখনো বে-আইনী হয়! হতে পারে! পৃথিবীর সব লোককেই তো ডাক্তারের দরকার হতে পারে। জানো মা, আমরা এর ঘোর প্রতিবাদ করব। আমরা আমাদের দায়িত্ব থেকে এতটুকু নড়ব না। না, এতটুকু না।’
‘আমায় আর সান্ত্বনা দিস না, খোকা। আমি অনেক দেখলাম এ সংসারের, আর আমার ক্ষুধা নেই; আর আমার সাধ নেই বেঁচে থাকার। তোরা আমায় বাধা দিস না খোকা। আমার মরতে দে।’
‘কি তুমি পাগলের মতো বকছ মা। ওরা যতই বে-আইনী করুক চিকিৎসা, আমি তোমায় ভাল করে তুলবই, তুলবই। দেখি, পা ছড়িয়ে শুয়ে পড় দেখি।’
মাকে আয়েশ মতো শুইয়ে দিলেন ডাক্তার সোম। মায়ের সমস্ত দেহে একটা বার্ধক্যের ছাপ। কেবল দুশ্চিন্তাতেই চেহারাটাকে অমন করেছেন মা। কিন্তু কেন? কেন এই চিন্তা? মানুষ কি তবে মৃত্যুর জন্য মনে মনে কামনা করে? আমিও কি মৃত্যুর জন্য অহর্নিশ কামনা করি? এ পৃথিবী কি আমার কাছে সত্যি সত্যি বিরক্তিকর পুরানো হয়ে গেছে! রূপ রস গন্ধ বর্ণ, ভোগের স্পৃহা কি মানুষের তিলে তিলে শুকিয়ে যায়? বৃত্তিগুলি ধীরে ধীরে শুকিয়ে গেছে মায়ের? কোথায়? বৃত্তিগুলিকে সজীব করে রাখার চিকিৎসা তো আমি জানি না।
তবে, কি নিয়ে আমরা গর্ব করি? নিজেকে অত্যন্ত ছোট অসহায় মনে হতে লাগল ডাক্তারের। মায়ের চোখের দিকে তাকাল। টলটল করছে পরিবর্ত চোখের মণি দুটো যেন একটা জলের ফোঁটা মণির উপর বেদনায় প্রতীক হয়ে ভাসছে। বেঁচে থাকার মধ্যে কি নিদারুণ বেদনা ডাক্তার সোম যেন বসে বসে তাই দেখতে লাগলেন।
তারপর এক সময় অসহায় ভাবে মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে নিজেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।
আর পারমাণবিক ঘড়িতে তখন পলে পলে সময় বয়ে যাচ্ছিল, কেউই তা বুঝতে পারছিল না। নিঃশব্দ রাত্রি ক্রমশ ভোরের দিকে এগোতে লাগল।
.
প্রথম প্রকাশ: আশ্চর্য!, জানুয়ারি, ১৯৬৬