নাগ-নিকেতন • গৌরীশংকর দে
দ্বিতীয় সিগ্রেটটি ধরিয়ে বেশ আয়েস করে একটা টান দিয়ে সর্বাঙ্গসুন্দরবাবু তার জীবনের অত্যাশ্চর্য ঘটনাটি বলতে শুরু করলেন।
আমরা, মানে জন কয়েক যাত্রী বসে আছি চুঁচুড়া রেলওয়ে স্টেশনের ওয়েটিংরুমে। সবার সঙ্গে সবার সম্ভবত এই প্রথম এবং শেষ আলাপ। গাড়ি আসতে এখনো মিনিট চল্লিশেক বাকি। তাই খানিকক্ষণ উসখুস করে সর্বাঙ্গসুন্দরবাবু শেষ পর্যন্ত এই গল্প ফেঁদেছেন। আমরাও নড়েচড়ে তার চারিদিকে গোল হয়ে বসেছি। তিনি বলতে লাগলেন:
“পেশায় আমি একজন খুদে এঞ্জিনীয়র। মহারাষ্ট্রের একটা এলাকায় রেলপথ বৈদ্যুতিক করণের কাজ চলছে। জায়গাটা পুণা থেকে মাইল সত্তরেক দূরে। পাহাড়ী এলাকা। রীতিমতো দুর্গম। তবে এমন সুন্দর যে, নিজের ব্যক্তিগত সুখ দুঃখ কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গিয়ে চারিদিকে তাকালে চোখ জুড়িয়ে আসে।
“খাওয়া-দাওয়া নিয়ে খুঁতখুঁত করার স্বভাব আমার নয়। সারাদিন কাজ করি, আর রাতে সরকারী তাঁবুতে থাকি। আমার সঙ্গী মাত্র দু’জন। সার্ভেয়ার রামকিষণ। আর শিউচরণ। আমাদের খাবার-দাবার ইত্যাদির দায়িত্ব ওর ওপর।
“বৈকালিক ভ্রমণের অভ্যাস আমার সেই ছেলেবেলা থেকে। এখানে, এই বিদেশ বিভূঁইয়ে এসেও, বদ অভ্যাসটা ছাড়তে পারিনি। সঙ্গীদের বারণ সত্ত্বেও নয়। বেলা পড়ে আসার সঙ্গে-সঙ্গে বাইরের পৃথিবী যেন লক্ষ হাতছানি দিয়ে, আমাকে ডাকতে থাকে। যেন আগে থেকে কাকে কথা দিয়ে রেখেছি। আমাকে বেরুতেই হবে। পাহাড়ের ছায়া ঘন হয়ে ওঠে, ম্লান হতে হতে অস্পষ্ট হয়ে যায় গাছপালা। আমি একাই বেরুই অচেনা পথে। সঙ্গে থাকে একটা লাঠি আর একটা মাঝারি সাইজের টর্চ। দু এক দিন পথ হারিয়েও ফেলেছি। খুঁজতে বেরিয়েছে সঙ্গীরা। নিজেকে অপরাধী মনে হয়েছে। ভেবেছি, কাল থেকে আর বেরুব না। কিন্তু বিকেল আসতেই সে সংকল্প ভেসে গেছে মাতালের সুরা-ত্যাগের প্রতিজ্ঞার মতো।”
গৌরচন্দ্রিকাতেই অনেকটা সময় নিয়ে নিচ্ছেন দেখে আমরা একটু অধৈর্য হয়ে উঠেছিলুম। তা টের পেয়েই যেন সর্বাঙ্গসুন্দরবাবু আসল ঘটনায় এসে পড়লেন:
“একদিন বিকেলে বেড়াতে বেড়িয়েছি। অন্যমনস্কভাবে পথ হাঁটছিলুম। হঠাৎ খেয়াল হতেই তাকিয়ে দেখি, যে এলাকায় এসে পড়েছি তা আমার একেবারেই অপরিচিত।
“এ-পথে সে-পথে বেশ খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করেও তাঁবুতে ফেরার পথ খুঁজে পাওয়া গেল না। বুঝলুম, আজো আমাকে সঙ্গীদের সহৃদয়তার ওপর নির্ভর করতে হবে।
“তবে চারদিকে দিনের মতো ফুটফুটে জ্যোৎস্না। এই যা রক্ষে। কৃষ্ণপক্ষ হলে দুর্গতির সীমা থাকত না। সেই জ্যোৎস্নায় চারিদিকের পাহাড় আর গাছপালা কেমন অপার্থিব লাগছিল। যেন পথ ভুলে পরীর দেশে এসে পড়েছি।
“পথটা একবার উঁচু, একবার নিচু হয়ে কোথায় গেছে কে জানে। চড়াই উৎরাই ভেঙে চলতে মন্দ লাগছিল না।
“একটা জায়গায় উঁচু থেকে নিচুতে নামতেই হঠাৎ, একেবারেই হঠাৎ, চোখে পড়ল একটা পুরানো দুর্গ। মহারাষ্ট্রে এ রকম দুর্গ মাঝে মাঝে চোখে পড়ে। এগুলির সাহায্যেই শিবাজী দুর্জয় প্রতিরোধে দাঁড়িয়েছিলেন পরাক্রান্ত মুঘল বাদশাহের বিরুদ্ধে।
“দুর্গটা পথের একেবারে ধারে। আকৃতি গথিক রীতিতে তৈরি গির্জের মতো। উপরের অংশটা কবে ভেঙে গেছে। কেবল আজো টিকে আছে নিচের দিকটা। পথ আর দুর্গের মাঝখানে একটা পরিখা। পরিখার পর খানিকটা ফাঁকা জায়গা তারপর মূল দুর্গ। সেই ফাঁকা জায়গায় কতগুলি ছায়া দেখা গেল। মনে হল জোৎস্নায় সেগুলি নড়া-চড়াও করছে।
“অদ্ভুত এক কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে পা চালিয়ে দিলুম সেদিকে। কাছে গিয়ে দেখতে পেলুম, পরিখায় জল সামান্যই অবশিষ্ট আছে। কিন্তু জায়গাটাতে কেমন একটা স্যাঁতস্যাতে ভাব। পরিখার অপর পাড়ে চোখ পড়তেই সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে রইলুম। এমন দৃশ্য জীবনেই আমি কখনো দেখিনি। দেখার কল্পনাও করিনি। আর কেউ কখনো দেখেছে কিনা আমার সন্দেহ আছে।
“পরিখার ওপারে ফাঁকা জায়গাটাতে খেলা করছে অগুণতি সাপ। সংখ্যায় অন্তত হাজার কয়েক হবে। ছোট ছোট পাথরের ওপর দিয়ে স্বচ্ছন্দ গতিতে চলাফেরা করছে। মনে হচ্ছে অসংখ্য জীবন্ত জলের স্রোত বয়ে চলেছে এঁকেবেকে। কখনো তরতর করে উঠে পড়ছে গাছে। তখন দেখাচ্ছে অবিকল লতার মতো। কয়েকটি তো চোখের নিমেষে কুণ্ডলী পাকিয়ে পরের মুহূর্তেই খুলে যাচ্ছে অনায়াসে। মাঝে-মাঝে ফণা তুলছে শূন্যে। চাঁদের আলোতে চকচক করে উঠছে ধাতব চামরের মতো। কোনোটি অতবড় মোটা শরীর অতি সহজে ঢুকিয়ে দিচ্ছে সরু গর্তের ভেতরে। চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। এত সব কাণ্ড যে করছে তাতে যেন একটি পেশী বা হাড়েরও ব্যবহার মোটেই হচ্ছে না।
হাজার-হাজার-সাপ বিদ্যুৎগতিতে চলাফেরা, জড়াজড়ি করছে একে অন্যের সঙ্গে, চলে যাচ্ছে একে অন্যের ওপর দিয়ে। মনে হল এক বিচিত্র সমুদ্র দেখছি। ওঠানামা করছে ঢেউ। মাঝে-মাঝে তীক্ষ্ণ বাতাসের মতো এরকম হিস হিস শব্দ ছাড়া আর কোনোরকম আওয়াজ নেই। সমস্ত ব্যাপারটা তাই আরো বেশি রহস্যময়, ভয়াবহ মনে হচ্ছে।
এতদিন সাপ সম্পর্কে যে-সব গল্প শুনেছি, যে-সব কথা পড়েছি একসঙ্গে মনে ভিড় করে এল। প্রাচীনকালে সাপকে মানুষ দেবতা জ্ঞানে পূজা করত। সাপ ছিল তখন জ্ঞান আর সম্পদের প্রতীক। সাপের জন্যই মানুষকে স্বর্গ থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল, খ্রিস্টানদের শাস্ত্রে আছে। মধ্যযুগে সাপকে মনে করা হত জাদু আর অশুভ শক্তির প্রতীক। অন্ধকার গুহায় আর সমুদ্রের নিচে সাপ ফণা তুলে গুপ্তধন পাহারা দিচ্ছে এমন গল্প কত পড়েছি। মনে হতে লাগল। সেই সব গল্প এখন অতি সত্য আর বাস্তব বলে মনে হতে লাগল। নাগ-নাগিনীর অপ্রাকৃত শক্তিতে ক্রমেই যেন আমি বিশ্বাসী হয়ে পড়ছিলুম। এই সর্পপুত্রদের মধ্যে শেষনাগ স্বয়ং নিশ্চয়ই আছেন। নাগলোক ত্যাগ করে তিনি সদলে উঠে এসেছেন এখানে। কী অভিপ্রায় কে জানে!
সেই মুহূর্তে সভয়ে লক্ষ্য করলুম ওরাও আমাকে দেখতে পেয়েছে। পরিষ্কার দেখতে পেলুম আলোড়িত নাগ-সমুদ্র আরো আলোড়িত হয়ে উঠেছে। আর সেই সমুদ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কয়েক শ সাপ এসে সার বেঁধে দাঁড়িয়েছে পরিখার ধারে। একেবারে খাঁটি গোখরো। গায়ের রং হলদে-বাদামী, এক একটি লম্বায় অন্তত ছ ফুট হবে। শরীরের তিন ভাগই এখন শূন্যে। মারাত্মক কয়েকশ ফণা দুলছে এ-দিকে ও-দিকে। কাচের মতো চোখে, কেমন ঠাণ্ডা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে আমারই দিকে। একেবারে না বলে কয়ে যে প্রাণীটি ওদের গোপন জগতের রহস্য হঠাৎ দেখে ফেলেছে, তাকে ওরা দেখে নিচ্ছে কুটিল চোখে। লকলকে আগুনের শিখার মতো মাঝে মাঝে বেরিয়ে আসছে চেলা জিভ। আমার দিকে তাকিয়ে, ওরা যেন নিষ্ঠুর বিদ্রূপে হাসছে! সঙ্গে সঙ্গে ওপার থেকে ভেসে এল উৎকট গন্ধ।
পরের মুহূর্তেই যা দেখলুম প্রচণ্ড আতংকে আমাকে পালানোর কথা ভাবতে হল। কয়েকটা সাপ নেমে পড়েছে সেখানে। বাকিরাও তৈরি হচ্ছে তাদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করার জন্য। এই কয়েকশ জীবন্ত মৃত্যুদূত একবার কাছে এসে পড়লে, দৌড়ে যিনি অলিম্পিক চ্যাম্পিয়নশিপ লাভ করেছেন, তার পক্ষেও নিষ্কৃতি পাওয়া কঠিন হবে। শুধু সে-কথা ভেবেই যে-পথে এসেছি ছুটিয়ে দিলুম সে-দিকে। বিপদে পড়লে যে মানুষ ঘোড়ার চেয়েও জোরে ছুটতে পারে, নিজেকে দিয়ে সেদিন তার প্রমাণ পেলুম…”
সর্বাঙ্গসুন্দরবাবু থামলেন। প্লাটফর্মে গাড়ি এসে ঢুকছিল। সবাই ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে গেলুম সামনের দিকে। আমি যে কামরায় উঠে পড়লুম সেখানে ওয়েটিংরুমে চেনা মানুষগুলির একজনও নেই। মনে একটা কথা এল—সর্বাঙ্গসুন্দরবাবুর কাহিনী যদি সত্যি হয়, তবে ওই এক জায়গাতে এত.সাপ জড়ো হয়েছিল কেন? সে কি নেহাৎই কাকতালীয় ব্যাপার। না কি এর পেছনে কোনো বৈজ্ঞানিক কারণ আছে? কিন্তু হাওড়া স্টেশনে এসে গাড়ি দাঁড়াবার পর অনেক খোঁজাখুঁজি করেও বক্তার সন্ধান পাওয়া গেল না। সর্বাঙ্গসুন্দরবাবু বিপুল জনারণ্যে চিরকালের মতোই মিশে গেছেন।
.
প্রথম প্রকাশ: আশ্চর্য!, ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৫