বিদ্রূপ ব্ৰহ্মর ব্রহ্মাণ্ড • অদ্রীশ বর্ধন
এ গল্প যাকে নিয়ে তার শক্তি ছিল অনেক—অতিরিক্ত।
চেয়েচিন্তে একজন সেই শক্তির কিছুটা নিয়েছিল। প্রয়োজনের বেশি নিয়েছিল।
ঘাবড়াবেন না। গল্পের নাম করে রাজনীতির কচকচি আমি শোনাব না।
শক্তি যার ছিল, তার নাম বিদ্রূপ ব্রহ্ম। অপরজন তার ব্যাঙ্কার।
বিদ্রূপ ব্ৰহ্ম নামটি যেমন অদ্ভুত, লোকটিও তেমনি। বিদ্রূপ বৈজ্ঞানিক। থাকত ভারত মহাসাগরের একটা ছোট্ট দ্বীপে। একা।
গল্পের বৈজ্ঞানিকদের মতো বামনাবতার নয় বিদ্রূপ ব্রহ্ম। পাগলাটেও নয়। নিজের স্বার্থের জন্য সে কিছুই করত না। ব্যক্তিগত লাভের জন্য বিজ্ঞানকে সে হবি করেনি। বিদ্রূপ ব্রহ্ম কপট নয়, কুটিল নয়, মায়াবী নয়, কুহকী নয়; ধ্বংসের কল্পনা তার মগজের অতীত ছিল, যেমন ছিল বিনাশক চিন্তাধারা। বিদ্রূপ ব্রহ্ম নিয়মিত চুল কাটত, নখ কাটত, পরিষ্কার জামাকাপড় পরত এবং আর পাঁচটা সুস্থ মানুষের মতোই জীবনযাপন করত। বিদ্রূপ ব্রহ্মর মুখে ছিল ছেলেমানুষি ভাব; চাহনি ছিল মুনিঋষির দৃষ্টির মতো শুচিস্নিগ্ধ। মাথায় খাটো; তেলচুকচুকে নধরকান্তি চেহারা। বুদ্ধি-উজ্জ্বল মুখশ্রী, ধীমান কান্তি! জৈবরসায়ন বিদ্যা অর্থাৎ বায়োকেমিস্ট্রি ছিল ওর বিশেষ বিষয়। বিদ্রূপ ব্রহ্ম কেবল বিদ্রূপ ব্রহ্ম নামেই পরিচিত ছিল; নামের আগে ‘ডক্টর’ বা ‘প্রফেসর’ ছিল না। ঐ ভাবে কেউ ডাকতও না। বলত হয় ‘বিদ্রূপবাবু’ আর না হয় ‘ব্রহ্মমশাই’।
সব মিলিয়ে মানুষটা একটু বিদঘুটে সন্দেহ নেই। স্কুল কলেজ ইউনির্ভাসিটির ধার ধারত না বিদ্রূপ ব্রহ্ম। গ্রাজুয়েট সে নয় কারণ কলেজে সে পড়েনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠও মাড়ায় নি। কেন? বিদ্রূপ ব্রহ্ম দেখেছিল, কলেজ-ইউনির্ভাসিটির শিক্ষাদানের ধারা অতিশয় মন্থর-গতি। শুধু তাই নয়, পড়াশুনা ব্যাপারটাকে যেন একটা বাঁধাধরা ছকের জিনিস মনে করা হয় সেখানে। প্রফেসররা যা পড়ান, তার সবটাই যে তাঁরা জানেন, এমন অদ্ভুত ধারণা কিছুতেই মাথায় আনতে পারত না বিদ্রূপ ব্রহ্ম।
পাঠ্যপুস্তকের ক্ষেত্রেও একই ধারণা পোষণ করত সে। শ্রাবণের ধারাবর্ষণের মতো ঝমাঝম প্রশ্ন করে যেত। প্রশ্নগুলো যে কতখানি গোলমেলে এবং যে কোন পণ্ডিত-শ্রোতাকেও ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট—তা বুঝেও বুঝতে চাইত না, কাজেই ক্ষ্যামা দিত না। বিদ্রূপ ব্ৰহ্ম ডারউইনকে বলত উদ্ভট-মস্তিষ্ক দার্শনিক, স্যার জগদীশকে বলত কৌতূহলোদ্দীপক প্রবন্ধকার, আর আইনস্টাইনকে বলত সায়ান্স-ফিকশ্যনের আধুনিক পৃষ্ঠপোষক। তার সব কথাই ছিল এরকম চিমটিকাটা, বুদ্ধি-ঘুলিয়ে দেওয়া। শুনতে শুনতে শ্রোতা বেচারী হাঁসফাঁস করত, দম আটকে আসত। অমুক লোকের অনেক জ্ঞান আছে, এ কথা একবার শুনলেই হল। অমনি সেখানে দৌড়ে যেত মেশিনগানের মতো প্রশ্ন বর্ষণ করে বেচারীর দম বন্ধ করার উপক্রম করত। শ্রোতার জ্ঞান যদি আগে থেকে তার জানা থাকত, তাহলে একটাই প্রশ্নই জিজ্ঞেস করত বারবার—‘কি করে জানলেন বলুন তো?’ যে সব বিজ্ঞান মানব জাতির উন্নতির জন্য চেষ্টিত এবং বংশগতির নিয়ামক, বিশেষ করে সেই সব বিজ্ঞানের বিজ্ঞানীদের ধরে জেরা আর প্রশ্নবাণে বিপর্যস্ত করাই ছিল বিদ্রূপ ব্রহ্মর অতীব আনন্দের বিষয়। তাই কেউ তার সঙ্গ পছন্দ করত না। কেউ তার বন্ধু হতে চাইত না। কেউ তাকে চায়ের আড্ডায় ডাকত না। ব্ৰহ্ম বিনয়ী বটে, কিন্তু বৈঠকী নয়। তাই চালিয়াৎ না হয়েও নিঃসঙ্গ হল সে।
বিদ্রূপ ব্ৰহ্মর নিজের টাকা বলতে খুব সামান্যই ছিল। কুড়িয়ে বাড়িয়ে তাই দিয়ে দ্বীপটাকে লীজ নিল বিদ্রূপ। বানাল একটা ল্যাবরেটরী। আগেই বলেছি, বিদ্রূপ ব্রহ্ম বায়োকেমিস্ট অর্থাৎ জৈবরসায়নবিদ। শুধু জৈবরসায়ন নিয়ে পড়ে থাকা সম্ভব ছিল না তার পক্ষে। তাই নিজের এখ্তিয়ার ছেড়ে নাক গলিয়েছিল বহুবিধ ব্যাপারে।
ভিটামিন বি-ওয়ানকে স্ফটিক আকারে তৈরি করার পদ্ধতি আবিষ্কার করার ব্যাপারটা অবশ্য ওর কাছে তেমন কিছুই নয়। এ পদ্ধতির ফলে টন হিসেবে ভিটামিন বি-ওয়ান তৈরি করা যায় এবং দেদার মুনাফা থাকে। যদিও টন হিসেবে এ ভিটামিন উৎপাদন করার কথা এখনও কেউ ভাবতেও পারে না। যাই হোক, সামান্য এই গবেষণার ফলে প্রচুর টাকা রোজগার করে ফেলল বিদ্রূপ ব্রহ্ম। সেই টাকা দিয়ে দ্বীপটা কিনেই ফেলল। আটশ লোক খাটিয়ে ছ’বিঘে জমির ওপর আরও বড় ল্যাবরেটরী তৈরি করল। বিস্তর যন্ত্রপাতি আনাল এবং কিছু নিজে বানিয়ে নিল।
মোচার শুঁয়ো থেকে এক রকম নিদারুণ শক্ত সুতো উদ্ভাবন করল বিদ্রূপ। সেই সুতো দিয়ে এমন এক দড়ি বানাল, যা দামে যেমন সস্তা তেমনি শক্ত। জাহাজ বাঁধা যায়, ছেঁড়ে না। এই দড়ি দিয়ে বেড়া তৈরি করে ল্যাবোরেটরী ঘিরল। এ দিকে দেখতে দেখতে পৃথিবী জুড়ে কলা উৎপাদনের ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠল
শুধু মোচার সুতো তৈরির জন্য।
দড়ি কত যে শক্ত তা যাচাই করে দেখানোর জন্য বিদ্রূপ ব্রহ্মর সেই প্রদর্শনীর ঘটনা নিশ্চয় আপনার মনে আছে। নায়গ্রা জলপ্রপাতের ওপরে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিল সে। দড়ির একটা খুঁট বাঁধা ছিল এ তীরে, অপর খুঁট ও তীরে। মাঝখান থেকে ঝুলছিল একটা দশ-টন লরী। ছেঁড়া তো দূরের কথা, যে ইস্পাতের আঁকশিটার নিচে লরীটা ঝুলছিল, তার ঘষা লেগে দড়িটার একটা শুঁয়োও উঠে যায় নি। এরপর থেকেই গুনটানা থেকে শুরু করে জাহাজ বাঁধা পর্যন্ত সব কাজে লেড পেন্সিলের মতো সরু দড়ির রেওয়াজ হয়েছে। একটা বড়-সড় কাটিমেই গুটিয়ে রাখা যায় দড়িটা। সামান্য এই আবিষ্কার থেকে দেদার পয়সা করে ফেলল বিদ্রূপ ব্রহ্ম। কিনল একটা সাইক্লোট্রন মেশিন।
এরপর টাকা গোনাটা একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। কাজেই নোটের তাড়াগুলো আসত মোটামোটা বইয়ের আকারে। তা থেকে যৎসামান্য খরচ করত বিদ্রূপ ব্রহ্ম শুধু খাবার দাবার আর যন্ত্রপাতি কেনার জন্যে। কিন্তু কিছু দিন পরে এ সব খরচও বন্ধ হয়ে গেল।
ব্যাংকের টনক নড়ল। সীপ্লেনে লোক পাঠালো তারা বিদ্রূপ ব্রহ্ম এখনো বেঁচে আছে কি না দেখার জন্য। লোক গিয়ে দেখল বহাল তবিয়তে বেঁচে রয়েছে বিদ্রূপ ব্রহ্ম। দুদিন পরে ফিরে এল ব্যাংক প্রতিনিধি। দ্বীপের কাণ্ড কারখানা দেখে তার নাকি আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেছে।
কারণ, বিদ্রূপ ব্ৰহ্ম শুধু বেঁচেই নেই, রাশি রাশি খাবার তৈরি করছে। সিনথেটিক খাবার। অর্থাৎ ক্ষেতখামারের খাবার নয়—ল্যাবরেটরীতে তৈরি। পদ্ধতিটা না কি আশ্চর্যজনকভাবে সরল। অথচ খাবারের উৎপাদন বিস্ময়করভাবে প্রচুর। প্রয়োজনের অতিরিক্ত!
রিপোর্ট পেয়েই চিঠি লিখল ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। বিদ্রূপ ব্ৰহ্ম কি বিনা ক্ষেতে খাবার উৎপাদনের গোপন কৌশলটা ব্যাংককে লীজ দেবেন?
সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল বিদ্রূপ। লিখল, খুশী মনেই দেবে। সেই সঙ্গে দিল ফরমুলাটা। পুনশ্চ দিয়ে লিখল, খবরটা বাইরের জগতে পাঠানোর কথা মনেই ছিল না বিদ্রূপের। এ ফরমুলা যে কারো কাজে আসতে পারে, এ ধারণা না কি ওর মাথায় আসে নি।
ভাবুন দিকি কাণ্ডটা! বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের বৃহত্তম সমাজ বিপ্লবের সে পুরোধা, যার সামান্যতম খামখেয়ালের ফলে কারখানাকৃষির সূচনা—সেই মানুষটা কিনা চিঠি লিখলেন এ ফরমুলা যে কারও কাজে আসতে পারে তা জানা ছিল না। ঐতিহাসিক সেই চিঠিটা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সোনার ফ্রেম দিয়ে বাঁধিয়ে রেখেছে।
ফলে, আরও টাকা আসতে লাগল বিদ্রূপের ভাঁড়ারে। না। ভুল বললাম। টাকা জমতে লাগল ব্যাংকের কোষাগারে। টাকা নিয়ে কোনো ভাবনাই ছিল না তার।
ব্যাংক প্রতিনিধি ঘুরে যাওয়ার মাস আষ্টেক পরেই নাকি সত্যিকারের কিছু কাজ করেছিল বিদ্রূপ। সামান্য একজন বায়োকেমিস্ট বই কিছু তো নয়, তাও নামের আগে ডক্টর খেতাব নেই। অথচ তার আবিষ্কারের খানিকটা তালিকা শুনলেই মাথা ঘুরে যাবে। যেমন শুনুন:
অ্যালুমিনিয়ামের সঙ্গে খাদ মিশিয়ে এমন একটা সংকর ধাতু যা কি না সেরা ইস্পাতের চাইতেও মজবুত অথচ পালকের মতো হাল্কা। কারখানা বা অট্টালিকার কাঠামো নির্মাণের ব্যাপারে না হলেই নয়।
একটা আজব কল; নাম ‘লাইট পাম্প’। ‘লাইট পাম্পে’র থিওরীটি চিত্তাকর্ষক। বিদ্রূপ ব্ৰহ্মর মতে লাইট অর্থাৎ আলো নাকি এক ধরনের বস্তু। কাজেই তা পদার্থ আর তড়িৎচুম্বক সম্বন্ধীয় নিয়ম সূত্র মেনে চলতে বাধ্য। একটা ঘরে আলো আসার সব ফুটো বন্ধ করে দিন। আলো আসুক শুধু একটা উৎস থেকে। পাম্প থেকে কম্পমান চৌম্বক ক্ষেত্র চোঙার আকারে নিক্ষেপ করুন সেই আলোর ওপর। দেখবেন, আলো সেই চৌম্বক পথে সুড়সুড় করে বেঁকে নেমে আসবে। এবার আলোকে ‘ব্রহ্ম লেন্সে’র মধ্যে দিয়ে যেতে দিন। ‘ব্রহ্ম-লেন্স’ আর কিছুই নয়—বলয়াকারে একটা বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র। ব্যবস্থাটা হাইস্পীড ক্যামেরার সঙ্গে লাগানো থাকে। ওর ঠিক নিচেই থাকে ‘লাইট-পাম্পে’র প্রাণকেন্দ্র—যা কিনা আলো শুষে নিতে মহাওস্তাদ—শতকরা ভাগই শুষে নেয়। প্রাণকেন্দ্র স্ফটিক আকারে নির্মিত। ফলে স্ফটিকের ভেতরকার অগণিত মসৃণ গাত্রে প্রতিফলিত হতে হতে অবশেষে স্ফটিকের ভেতরেই সে আলো ‘হারিয়ে’ যায়। কোন ঘরকে অন্ধকার করার পক্ষে এ যন্ত্রের নাকি জুড়ি নেই। আমি মশাই বিজ্ঞান টিজ্ঞান বুঝি না। মোটামুটি জিনিসটা বোঝাতে চেষ্টা করলাম আমার আনাড়ি ভাষায়।
নলচের মধ্যে ক্লোরোফিল সংশ্লিষ্ট করা।
শব্দের চেয়ে আটগুণ বেশি বেগসম্পন্ন একটা এরোপ্লেন প্রপেলার।
এক ধরনের বেজায় সস্তা আঠা। পুরানো রঙের ওপর এই আঠা বুরুশ দিয়ে মাখাতে হয়। শুকিয়ে শক্ত হয়ে গেলে কোণ ধরে টানলেই হল। কাপড়ের মতো পুরানো রঙ চড়চড় করে উঠে আসবে। এই আবিষ্কারের পর অবশ্য বিদ্রূপ ব্রহ্মর বন্ধু সংখ্যা হু-হু করে বেড়ে গিয়েছিল।
ইউরেনিয়াম আইসোটোপ ২৩৮-কে স্বয়ংচালিত পদ্ধতিতে পরমাণুতে বিভাজন করা—সেকেলে ইউ ২৩৫-এর চেয়ে যা কিনা ২০০ গুণ বেশি সম্পদশালী।
আপাতত এই পর্যন্তই থাক। সামান্য একজন বায়োকেমিস্টের পক্ষে এসব আবিষ্কার বাস্তবিকই বিস্ময়কর।
বিদ্রূপ ব্রহ্ম নিজে কিন্তু জানত না তার শক্তির পরিমাণ। জানত না বিশ্বের সম্রাট হবার মতো বিপুল ক্ষমতা ছোট্ট ঐ দ্বীপে বসে সে জমিয়েছে একক সাধনার ফলে। জানত না কেননা এসব চিন্তা ওর মাথায় আসত না। নিজের পরীক্ষা নিরীক্ষা নিয়েই সে সন্তুষ্ট। বাকি দুনিয়া আদিম আর বর্বর অবস্থায় রয়ে গেল কিনা, তা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। বিদ্রূপের সঙ্গে যোগাযোগ করার মাত্র একটা পথ ছিল। একটা রেডিওফোন। নিজের আবিষ্কার। যন্ত্রের অপরদিকটা ব্যাংকের ভল্টে তালাচাবি দেওয়া থাকত। একজনই জানত রেডিওফোনে কথা বলার কৌশল। ব্যাংকের চেয়ারম্যান। চেয়ারম্যানের দেহতরঙ্গের সংস্পর্শে এলেই অসাধারণ রকমের সচেতন ট্রান্সমিটারটা সরব হয়ে উঠত। আর কারও দেহতরঙ্গে কাজ হত না।
চেয়ারম্যান ধুন্ধুমার সাহার সঙ্গে অলিখিত চুক্তি ছিল তার। দারুণ দরকার না হলে যেন বৈজ্ঞানিককে বিরক্ত করা না হয়। তার ধ্যানধারণার ফলশ্রুতিগুলোর পেটেন্ট হত ছদ্মনামে। চেয়ারম্যান সাহা ছাড়া আর কেউ জানত না সেই নাম। বিদ্রূপ নিজেও নয়। ও নিয়ে কোন মাথাব্যথাও ছিল না।
পরিণামে, সভ্যতার ঊষালোক থেকে আজ পর্যন্ত যত অগ্রগতি হয়েছে, তার বহুগুণ বেশি উন্নতি ঘটল অতি অল্প সময়ের মধ্যে। লাভ হল জাতির। লাভ হল বিশ্বের। সবচাইতে বেশি লাভ হল ব্যাংকের। দিনে দিনে বাড়তে লাগল, ফুলতে লাগল ব্যাংকের তহবিল। শুরু হল অন্যান্য ব্যাপারেও নাক গলানো। ফলে আরও টাকা আসতে লাগলো। আরও বেড়ে উঠতে লাগল ব্যাংক। আরও। আরও। কয়েক বছরের মধ্যেই বিদ্রূপ ব্ৰহ্মর বিবিধ হাতিয়ার কাজে লাগিয়ে দানবীয় আকার ধারণ করল ধুন্ধুমার ব্যাংক। ক্ষমতায় বিদ্রূপ ব্রহ্মর প্রায় সমান সমান হয়ে দাঁড়াল!
এবার একটু ধৈর্য ধরুন। মুষ্টিমেয় যে কজন ব্যক্তি বলত বিদ্রূপ ব্রহ্ম নাকি একটা জীবন্ত ধোঁকাবাজি, বলত বিজ্ঞানের দিকে মনীষার চমক দেখানো একা মানুষের পক্ষে অসম্ভব—তাদেরকে একটু ঘেঁটে দিই।
ধরেছেন ঠিক। বিদ্রূপ ব্ৰহ্ম জিনিয়াস সন্দেহ নেই। বিদ্রূপ ব্রহ্ম মানেই সূর্যের মতো একটা প্রচণ্ড প্রতিভা। গনগনে। জলন্ত।
কিন্তু এ প্রতিভা সৃষ্টিশীল নয়। ভেতরে ভেতরে বিদ্রূপ ব্ৰহ্ম ছাত্র। যা দেখেছে, যা জেনেছে, যা শিখেছে এক্সপেরিমেন্টের পর এক্সপেরিমেন্ট করে সেই সবই প্রয়োগ করেছে বিদ্রূপ ব্রহ্ম। ছোট্ট দ্বীপের নতুন ল্যাবোরেটরীতে কাজ শুরু করার সময়ে মনে মনে সে যে যুক্তি খাড়া করেছিল, তা এই:
“আমি যা কিছু জেনেছি, শিখেছি, তা অন্যের লেখা পড়ে, অন্যের কথা শুনে। এরা আবার এইসব তত্ত্ব লিখেছে, জেনেছে অন্যের লেখা পড়ে অন্যের কথা শুনে। এইভাবেই চলছে যুগযুগ ধরে।
ক্কচিৎ হয়তো নতুন কিছু জেনে ফেলে কেউ। নতুন আইডিয়াকে বেশ কৌশলে আর পাঁচজনের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। একজনকে তখন ছেঁকে ধরে কোটি-জন। যুগের ধারাই তাই।
কিন্তু এই ধারাকে যদি আমি টপকে যেতে পারি, তবেই অনেক কিছু জানা সম্ভব হবে। দুর্ঘটনা কবে ঘটবে, তার জন্য বসে থাকা দারুণ সময় সাপেক্ষ। আর, দুর্ঘটনা না ঘটলে মানুষের জ্ঞান বাড়বে না, আমারও জ্ঞান বাড়বে না।
যদি সময়কে মুঠোয় এনে ভবিষ্যতে পাড়ি জমানো যেত, তাহলে ভবিষ্যৎ তোলপাড় করে অনেক কিছু চিত্তাকর্ষক সম্পদ তুলে আনা যেত। কিন্তু সময় তো সে রকম নয়। সময়কে গুটিয়ে পেছনে হটানো যায় না, সামনে ঠেলা যায় না। সুতরাং যাই কোন পথে?
একটা পথ আছে। মানবজাতির বুদ্ধিবৃত্তির বিবর্তনকে দ্রুতগতি করে তোলা যায়। ঝড়ের বেগে ধীশক্তি যখন বিবর্তিত হয়ে চলবে, তখন হুঁশিয়ার হয়ে দেখতে হবে বিবর্তনের পথে কি-কি পাচ্ছি। কিন্তু এ পথ তেমন সুবিধের নয়। এতে খাটুনি অনেক। কারণ বুদ্ধিবৃত্তির এই প্রচণ্ড উন্নতির সময়ে মানুষের মনকে নিয়মানুবর্তিতার লাগাম দিয়ে টেনে রাখতে হবে। ফলে আমাকেও দৌড়োতে হবে তাদের সাথে। কিন্তু আমি তো তা পারব না। একক কোনো মানুষই পারবে না।
মনের ওপর আমার অনেক বোঝা। আমি নিজেকে তুরঙ্গ গতিতে ছোটাতে পারি না। অন্যের মনকেও পারি না। এর কোনো বিকল্প পথ কি নেই? নিশ্চয় আছে। কোথাও, কোনভাবে গুপ্ত রয়েছে এ হেঁয়ালীর সমাধান। থাকতেই হবে।”
সাধনার শুরুতে এই যুক্তির বনিয়াদ মনে মনে তৈরি করে নিয়েছিল বিদ্রূপ ব্রহ্ম। মানুষ নামক প্রজাতির উন্নতিসাধনের বিজ্ঞান নয়, লাইট পাম্প নয়, উদ্ভিদ বিজ্ঞান নয়, পরমাণু বিজ্ঞান নয়। বাস্তববাদী মানুষের কাছে হয়ত সমস্যাটা একটু আধ্যাত্মিক ধাঁচের, কিন্তু বিদ্রূপ ব্ৰহ্ম সূচ্যগ্র অনুসন্ধিৎসা নিয়ে আক্রমণ করল হেঁয়ালীটাকে। হাতিয়ার হল ওর বিশেষ মার্কামারা যুক্তিধারা। দিনের পর দিন উদ্ভ্রান্তের মতো চষে বেড়ালো দ্বীপের ও প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত; সামুদ্রিক গাংচিলের দিকে নিষ্ফল আক্রোশে নিক্ষেপ করল শামুক আর ঝিনুক; গজরাতে লাগল আপন মনে। তারপর এল সেই দিন যেদিন ল্যাবোরেটরীর দরজা বন্ধ করে সুগভীর চিন্তায় আত্মহারা হয়ে গেল বিদ্রূপ ব্ৰহ্ম। আর ঠিক তখনি ক্ষিপ্তের মতো শুরু করল এক কল্পনাতীত গবেষণা।
গবেষণা শুরু হল নিজের লাইনেই—বায়োকেমিস্ট্রিতে। সমগ্র প্রতিভা কেন্দ্রীভূত করল বিশেষত দুটি বিষয়ের ওপর—প্রজনন বিদ্যা আর জীবকুলের বিপাকের ওপর। যতই দিন যেতে লাগল, অনেক নতুন নতুন জ্ঞান উদিত হল তার মনে। কিন্তু শেষ নেই তার জ্ঞান তৃষ্ণার। তাই তার মূল হেঁয়ালীর সঙ্গে সংযোগরহিত বহু আশ্চর্য জ্ঞানকে অবহেলে জমিয়ে রাখল মগজের কোণে। যা জানতে চাইছে তা জানল খুব সামান্যই। কিন্তু এই সামান্য তত্ত্বজ্ঞানকেই সযত্নে জমাতে লাগল পূর্বলব্ধ জ্ঞান বা অনুমানের ওপর। ধীরে ধীরে অনেক কিছুই জানল বিদ্রূপ ব্রহ্ম—মনের ভাঁড়ারে সঞ্চিত রইল সব কিছু।
গোঁড়ামির লেশমাত্র ছিল না বিদ্রপের মনে। বিদ্রূপ ব্রহ্মর বৈশিষ্ট্যই তাই। গবেষণার সময়ে মন তার সংস্কারমুক্ত। তাই পেয়ারাকে মটরশুঁটি দিয়ে গুণ করার মতো উদ্ভট অংক কষত। সমীকরণের ভারসাম্য বজায় রাখতে একদিকে বিয়োগ চিহ্ন এবং ওপর দিকে অনন্ত চিহ্ন বসিয়ে। ভুল হত। কিন্তু সে ভুল মাত্র একবারই হয়েছিল। পরে আর একবার হয়েছিল একটা প্রজাতি সম্পর্কে। মাইক্রোসকোপ নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক নাগাড়ে কাজ করত বিদ্রূপ ব্রহ্ম। করতে করতে দুঃস্বপ্ন দর্শন শুরু হল। অমূলপ্রত্যক্ষ বিভীষিকা। যেন ওর নিজের হৃদপিণ্ডই পাম্প করে মাইক্রোসকোপের মধ্যে দিয়ে রক্ত ঠেলে তুলে দিচ্ছে ওপরে। বাধ্য হয়ে দিন কয়েক সাধনায় বিরতি দিতে হল।
ঠেকে শেখা পদ্ধতি একদম পছন্দ করত না বিদ্রূপ। এ পদ্ধতি নাকি বড় পিছল পদ্ধতি—আছাড় খাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
তাই হাতে হাতে ফল পেল বিদ্রূপ ব্রহ্ম।
সাধনার সূত্র সম্বন্ধে নিজস্ব ধারণা খুবই স্পষ্ট ছিল বিদ্রূপের। যা কিছু সম্ভবপর, তার একটা নিয়ম আছে। এ নিয়মের একটা ফরমুলা বার করেছিল বিদ্রূপ। ফরমুলাটাকে এমন সহজ সরল করে এনেছিল যে কোন্ এক্সপেরিমেন্ট করা দরকার, আর কোনটা নাকচ করা দরকার, তা অংক কষেই বার করে ফেলত।
তাই মেঘাল, মণ্ডের মতো আঠাল, আধ-পাতলা বস্তুটা যখন নড়ে চড়ে উঠতে লাগল ওয়াচ-গ্লাসের ওপর, বিদ্রূপ ব্রহ্ম বুঝল ঠিক পথই ধরা হয়েছে। যখন বস্তুটা নিজে থেকেই খাবার খুঁজতে লাগল, বিদ্রূপ উত্তেজিত হত। যখন বস্তুটা দ্বিধাবিভক্ত হল, এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আবার দ্বিধাবিভক্ত ঘটল; এবং প্রতিটি স্বতন্ত্র অংশ বড় হতে হতে আবার দুভাগ হল, বিজয়োল্লাসে উল্লসিত হল বিদ্রূপ ব্রহ্ম।
কারণ, বিদ্রূপ ব্ৰহ্ম প্রাণ সৃষ্টি করেছে।
ধাইমা’র মতো মগজ-শিশুকে লালন পালন করতে লাগল বিদ্রূপ। ঘেমে
নেয়ে, উদয়াস্ত পরিশ্রম করে নিজের হাতে তৈরি প্রাণকে বাঁচিয়ে রাখল। নানারকম কম্পনের মধ্যে প্রাণসম্পন্ন জেলিগুলোকে ডুবিয়ে রাখার ব্যবস্থা করল। টিকা দিল, বিভিন্ন মাত্রার ওষুধ খাওয়াল, স্প্রে করে স্নান করাল। একবার যা করল, তাই থেকে শিখল পরের ধাপে কি করতে হবে। তাই বিভিন্ন কম্পন আধার, টিউব আর ইনকিউবেটরের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল অ্যামিবার মতো কীটাণু। দ্রুত হতে দ্রুততর হল সৃষ্টির ধারা। এল চোখওলা জীব, স্নায়ুসহ কোষ। আনন্দে আটখানা হওয়ার দিন এল তার পরেই। বহুকোষসম্পন্ন একটা সত্যিকারের পা-ওলা প্রাণী সৃষ্টি করল বিদ্রূপ। এরপর কাজের গতি কমে এলেও খেটেখুটে বানাল একটা উন্নততর জীব। জীবটার শুধু পা নেই, পাকস্থলীও আছে। বিদ্রূপের সেদিন আনন্দের সীমা পরিসীমা ছিল না। এরপর অবশ্য বিদঘুটে জীবটাকে অন্যান্য দেহযন্ত্র উপহার দিল বিদ্রূপ। প্রতিটি দেহযন্ত্রের নিজস্ব কাজ রইল। শুধু তাই নয়, বংশপরম্পরায় দেহযন্ত্রগুলি যাতে থাকে, সে ব্যবস্থাও করল বিদ্রূপ।
এরপরেই এল মেরুদণ্ডবিহীন জীবেরা। শাঁখ শামুকের দল। বিশ্বকর্মার মতো নিপুণ হতে ফুলকা বানিয়ে দিল বিদ্রূপ। ধীরে ধীরে সুষ্ঠু করে তুলল ফুলকাগুলো। তারপর একদিন একটা কিম্ভুতকিমাকার সৃষ্টিছাড়া জীব জলাধারের ঢালের ওপর কিলবিল করতে করতে ভেসে উঠল, কানকো নাড়তে নাড়তে শ্বাস নিতে লাগল খুব ধীরে ধীরে।
যেন এক নিমেষে গুঁড়িয়ে গেল বিদ্রূপ ব্ৰহ্ম। কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল দ্বীপের অপর প্রান্তে। পাগলের মতো মদ্যপান করে বেহুঁশ হয়ে পড়ে রইল সারারাত।
মদের নেশা মিলিয়ে গেল পরের দিন ভোরে, বিক্ষিপ্তচিত্ত অনেকটা শান্ত হল। ল্যাবোরেটরীতে ফিরে এল বিদ্রূপ। কিন্তু ঘুমোতে পারল না। দিবারাত্র উন্মাদের মতো পরিশ্রম করে চলল—হেঁয়ালীর জট তাকে ছাড়াতেই হবে। শিব গড়তে গিয়ে বানর গড়া চলবে না।
তাই এবার একটা বিজ্ঞানসম্মত চোরা রাস্তা ধরল বিদ্রূপ। তারই অন্যতম কীর্তি—জীবকুলের বিপাককে দ্রুতগতি করে তোলার পথ ধরল। শরীরের যে ক্রিয়ার বলে দেহের সজীব পদার্থ রক্ত থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে—বিপাক নামক সেই ক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করল। অ্যালকোহল, কোকা, মরফিন এবং ক্যানাবিস ইন্ডিকাকে বিশ্লেষণ করল বিদ্রূপ, উত্তেজক পদার্থগুলো নিষ্কষ করে নিয়ে বিশুদ্ধ রূপ দিল। রক্তের জমাট বাঁধার মূলে যে অক্সালিক অ্যাসিড ছাড়া আর কিছু নেই, এ তথ্যটা অনেক বিশ্লেষণের পর আবিষ্কার করেছিলেন এক বিজ্ঞানী। বিদ্রূপ ব্ৰহ্মও অনেক বিশ্লেষণ, অনেক পরীক্ষানিরীক্ষার পর আবিষ্কার করল কোন্ মৌল বস্তুটা মানুষের নৈতিক চরিত্রকে নীচু স্তরে নামিয়ে নিয়ে যায়। বিভিন্ন উত্তেজক আর নিদ্রাকর ওষুধের মধ্যে থেকে আলাদা করে ফেলল সেই মৌল বস্তুটি। এই কাণ্ড করতে গিয়ে আর এক কাণ্ড করে বসল বিদ্রূপ। নতুন একটা আবিষ্কার। একটা আশ্চর্য আরক। বিদ্রূপের নিজেরই ভয়ানক দরকার হয়ে পড়েছিল এই আরকের। ঘুম তাড়ানোর আরক। ঘুম একটা সময় নষ্ট করার শারীরিক ক্রিয়া। এ আরক পান করলে শরীরের ক্ষয়ক্ষতি আপনা থেকেই পূরণ হয়ে যায়—ঘুমের দরকার হয় না। এই বিস্ময়কর আবিষ্কারের পর থেকেই এক নাগাড়ে চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করে চলল সে।
যে মৌলবস্তুটা আলাদা করেছিল বিদ্রূপ, কৃত্রিম উপায় তার বেশ কিছু বানিয়ে নিল সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায়। অনেকগুলো আজেবাজে উপাদান বাদ দিল কাজ করতে করতে। বিকিরণ আর কম্পনের মূলে যে সূত্র, সেই সূত্রের ভিত্তিতেই গবেষণা চালাল। বর্ণালীর শেষপ্রান্তের অবলোহিত রশ্মিকে শব্দতরঙ্গে কম্পমান একটা বাতাসভর্তি আধারের মধ্যে দিয়ে নিয়ে গিয়ে সমবর্তন করার পর আশ্চর্য ফল দেখা গেল। অতি লাল রশ্মিটা ক্ষুদে প্রাণীদের হৃদ্ঘাত বিশগুণ বাড়িয়ে তুলল। ক্ষিদে বাড়ল বিশগুণ, খেতেও লাগল বিশগুণ বেশি; বড় হতে লাগল বিশগুণ বেশি বেগে, এবং মরতেও লাগল তাড়াতাড়ি।
বিদ্রূপ এবার এমন একটা ঘর তৈরি করল যার মধ্যে বাতাস যাতায়াতের পথ রইল না। সে ঘরের ওপরেই তৈরি হল আর একটা ঘর। দৈর্ঘ্যে প্রস্থে এক মাপ—কিন্তু উচ্চতায় কম। এই ঘরটাই হল ওর কন্ট্রোল চেম্বার।
নিচের বিরাট ঘরটাকে চারভাগে ভাগ করল সে। প্রতিটি অংশে চার রকমের তাপমাত্রা আর বায়ুমণ্ডল নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রইল কন্ট্রোল চেম্বারে। প্রতিটি অংশের ওপর রইল ক্ষুদে ক্রেন আর ভার তোলবার স্তম্ভ যন্ত্র। সংক্ষেপে, জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করার যাবতীয় আধুনিক মেশিন। ওপরের ঘর থেকে নিচের ঘরে আসার দরজাও ছিল। সে দরজা অবশ্য মেঝের সঙ্গে মিশোনো। দরজার ফাঁক দিয়ে যাতে বাতাস বেরোতে না পারে, তাই এয়ার লক লাগানো।
এরই মাঝে অন্য ল্যাবরেটরীতে একটা অদ্ভুত প্রাণীর সৃষ্টি করল বিদ্রূপ। সে প্রাণীর রক্ত উষ্ণ, চামড়া সাপের মতো, আর পা চারটে। জীবনচক্র আশ্চর্যরকমের দ্রুত। আয়ুষ্কাল মাত্র পনেরো দিনের।
প্রাণীটা ডিম্বজ। স্তন্যপায়ী। গর্ভধারণের মেয়াদ মাত্র ছ’ঘন্টা। তিন ঘণ্টাতেই সম্পূর্ণ হত ডিমে তা দেওয়া। চারদিনেই যৌনক্ষমতা অর্জন করত তরুণ তরুণীরা। মেয়েরা প্রত্যেকে ডিম পাড়ত চারটে। তা দেওয়ার পর বাচ্ছাগুলো বড় না হওয়া পর্যন্ত বেঁচে থাকত। পুরুষরা যৌনমিলনের দু-তিন ঘণ্টা পরেই মারা
যেত।
কিম্ভুতকিমাকার জীবগুলোকে যে কোনো পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার মতো করে গড়েছিল বিদ্রূপ। গেঁড়ি গুগলির মতো পুঁচকে হলে কি হবে, মস্তিষ্ক জিনিসটা কম ছিল না। লম্বায় খুব জোর তিন ইঞ্চি, উচ্চতায় দু’ইঞ্চি। সামনের থাবাদুটোয় তিনটে করে আঙুল। বুড়ো আঙুলে তিনটে সন্ধি। সে এক বিদিগিচ্ছিরি চেহারা।
প্রচুর অ্যামোনিয়া দিয়ে তৈরি বিশেষ বায়ুমণ্ডলে শ্বাস নিয়ে বাঁচতে শিখেছিল জীবগুলো। এই রকম চারটে সৃষ্টিছাড়া জীবের জন্ম হওয়ার পর বিদ্রূপ তাদের চারটে এয়ার টাইট ঘরে আলাদা আলাদা ভাবে বন্ধ করে রাখল।
এবার শুরু হল মূল গবেষণা। বায়ুমণ্ডল নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা মুঠোয় নিয়ে অদ্ভুত অদ্ভুত এক্সপেরিমেন্ট আরম্ভ করল বিদ্রূপ। তাপমাত্রা, অক্সিজেন আর আর্দ্রতা কখনো কমালো, কখনো বাড়াল। কখনো গাদা গাদা কার্বন ডাই অক্সাইড ছেড়ে মশা-মাছির মতো হাতে গড়া জীবদের হত্যা করল। যারা এই নিধনযজ্ঞের মধ্যে থেকেও টিকে গেল, তার পরবর্তী দু-তিন পুরুষের মধ্যে কার্বন ডাই অক্সাইডের আক্রমণ সহ্য করেও বেঁচে থাকার মতো শারীরিক বাধা তৈরি করে নিলে।
এই বাধা যাতে অঙ্কুর থেকেই বৃদ্ধি পায়, যাতে জীবগুলো যে কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে থেকেও টিকে থাকতে পারে, তাই হামেশাই ডিমগুলোকে কখনো এ চেম্বারে, কখনো ও চেম্বারে রাখত বিদ্রূপ। ফলে, নিয়ন্ত্রিত বায়ুমণ্ডলের মধ্যে এবং সৃষ্টিকর্তার খেয়ালে অদ্ভুত শক্তি নিয়ে বিবর্তিত হতে লাগল জীবগুলো। বিবর্তন এগিয়ে চলল কল্পনাতীত দ্রুতগতিতে।
এই থেকেই বিদ্রূপ ব্ৰহ্ম মূল সমস্যার উত্তর পেল। বিদ্রূপের মন সাধারণ নয়, অসাধারণ। এই অসাধারণ মনে তার একটা অভিলাষই জেগেছিল। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিকে ত্বরান্বিত করে অনেক কিছুই জানতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। নিজেকেও প্রভঞ্জনের বেগে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। তাই একটা নতুন জাত তৈরি করল বিদ্রূপ। সাধারণ জাত নয়। এ জাত মানুষের চাইতে বহুগুণ বেগে বিবর্তিত হবে, মানুষের চাইতে বহুগুণ বেগে সভ্য হবে, উন্নত হবে, ধীমান হবে—অচিরেই মানুষের অতি-উন্নত সভ্যতাকেও অবহেলে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাবে। এবং তখনি বিদ্রূপ ব্রহ্মর শিক্ষা শুরু হবে তাদের কাছে। তারই হাতে গড়া জীবদের কাছে।
নতুন এই জাতকে পুরোপুরি নিজের মুঠোয় রাখল বিদ্রূপ। কোনো দিন যাতে বেয়াড়াপনা করতে না পারে, তাই মরণ-ঘা দিয়ে শেখাল পৃথিবীর স্বাভাবিক বায়ুমণ্ডল তাদের কাছে বিষবৎ। চার পুরুষ অন্তর হাতেনাতে এই শিক্ষা দিতে লাগল বিদ্রূপ। ফলে, সৃষ্টিকর্তাকে অষ্টরম্ভা দেখিয়ে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করার কোন সম্ভাবনাই আর রইল না। ওদের সৃষ্টি হয়েছে যার ইচ্ছায় বাঁচতেও হবে তার ইচ্ছায়। পুরুষানুক্রমে তারা বেঁচে থাকবে, উন্নতি করবে এবং নিজেরা জ্বলে পুড়ে মরে শত শত এক্সপেরিমেন্টের মধ্যে দিয়ে সৃষ্টিকর্তাকে উপহার দিয়ে যাবে শতসহস্র বিচিত্র অজানিত তথ্য। মানুষের পক্ষে যা সম্ভব নয়, তাই সম্ভব হবে তাদের পক্ষে। অসম্ভব তাড়াতাড়ি শেষ হবে পরীক্ষার পালা, অবিশ্বাস্য বেগে বৃদ্ধি পাবে বিদ্রূপ ব্রহ্মর জ্ঞানভাণ্ডার। মানুষকে তারা অনায়াসেই টেক্কা মারবে, কেননা প্রতিভাধর বিদ্রূপ ব্রহ্ম তাদের পথপ্রদর্শক।
তাই যা কোনোদিন সম্ভব হয়নি, তা সম্ভব হল বিদ্রূপের বিজন দ্বীপের ল্যাবরেটরীতে। বিজ্ঞানকে জানতে মানুষ ছ’হাজার বছর সময় নিয়েছে; বিজ্ঞানকে কাজে লাগাতে সময় লেগেছে তিনশ বছর। কিন্তু বিদ্রপের জীবকুল মাত্র দুশ দিনের মধ্যে মানুষের মনের নাগাল ধরে ফেলল। তারপর থেকেই লাফিয়ে এগিয়ে চলল ওদের সভ্যতা। অচিরেই বিদ্রূপ ব্রহ্মর কীর্তিকলাপের তুলনায় টম এডিসনের মতো বিরাট প্রতিভাও ম্লান হয়ে গেল।
বিদ্রূপ এই নতুন জাতের নাম দিল নিওটেরিকস্। ওদের জ্বালাতন করল নিত্য নব উপায়ে। শেখাল, তাদের বাঁচার অধিকার শুধু কাজের জন্য। এবং সে কাজ কেবল মাত্র বিদ্রূপ ব্ৰহ্মর জন্য।
বিদ্রূপ আবিষ্কার করত অনেকটা আদর্শের তাগিদে। অর্থাৎ অনেক কিছু সম্ভবপর সম্ভাবনা কল্পনা করত। কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্যে নিজেকে কিন্তু বিন্দুমাত্র খাটতে হত না।
উদাহরণ দেওয়া যাক। বিদ্রূপের মনে কৌতূহল দেখা গেল, বহুরন্ধ্র বস্তু দিয়ে মাথা গোঁজার মত আচ্ছাদন তৈরি করা কি সম্ভব? ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে নিওটোরিকসদের এই নিয়ে মাথা ঘামাতে হল। একটা ঘরে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি সৃষ্টি করল বিদ্রূপ। কোনো পুরুষে এরকম ঝড়বৃষ্টির সম্মুখীন হয়নি নিওটেরিকস্-রা! তাই বিদ্রূপ ইচ্ছে করেই একটা আচ্ছাদনের চাহিদা ওদের মধ্যে জাগ্রত করল। সেই সঙ্গে কিছু পাতলা ওয়াটারপ্রুফ বস্তু এক কোণে গাদা করে রাখল। নিওটেরিক্সরা দ্রুত মাথা খাটিয়ে তাই দিয়ে মাথা গোঁজবার ঠাঁই বানিয়ে নিল।
তৎক্ষণাৎ কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা দিয়ে পলকা ছাউনিগুলো উড়িয়ে নিয়ে গেল বিদ্রূপ। নিওটেরিক্সরা চটপট আবার ছাউনি গড়ে নিলে এবার আরও মজবুতভাবে—যাতে যুগপৎ বাতাস আর বৃষ্টিকে ঠেকাতে পারে।
ধাঁ করে তাপমাত্রা নামিয়ে আনল বিদ্রূপ। এত তাড়াতাড়ি যে নিওটেরিক্সরা
সেই হিমবাতাসের সঙ্গে দেহের তাপমাত্রাকে সইয়ে নিতে পারল না। তাই তুরন্ত ছোট ছোট ধাতুর পাত্রে অঙ্গার রেখে ঘর গরম করে নিল।
বিদ্রূপ তাই দেখে চট করে তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিল। সাহারার মরুভূমির মতো গরম হলকা ছেড়ে দিল। কিছু নিওটেরিক্স গরম সইতে না পেরে হাঁসফাঁস করতে করতে অক্কা পেল। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই একটা চালাক ছেলে বুদ্ধি বাতলালো। ঝটপট আবিষ্কার করল গরম আটকানোর পন্থা। অনেকটা রবারের মতো তিন-স্তরের একটা নয়া বস্তু দিয়ে বাড়ী বানিয়ে নিল। তিনস্তরের মাঝের স্তরটির মধ্যে রইল লক্ষ লক্ষ পুঁচকে গহ্বর যার মধ্যেকার বাতাস বাইরের গরমকে শুষে নিল—ভেতরে যেতে দিল না। বিদ্রূপ ব্রহ্মর কল্পনা বাস্তব রূপ নিল। সফল হল এক্সপেরিমেন্ট।
বিদ্রূপের বিবিধ কৌশলের এই গেল দু একটা নমুনা। এই ভাবে নানা রকম কায়দায় নিওটেরিক্সদের রীতিমতো উন্নত, সুসভ্য জাতিতে পরিণত করল বিদ্রূপ। তাদের কৃষ্টি, তাদের সংস্কৃতির মান এত ওপরে উঠে গেল যে ধারণাও করা যায় না। একবার একটা অংশে অনাবৃষ্টি সৃষ্টি করল বিদ্রূপ, আরেক অংশে অতিবৃষ্টি। তারপর তুলে দিলে মাঝের পার্টিসন। ফলে, কুরুক্ষেত্রের লড়াই লেগে গেল দুদলে। আর দেখতে দেখতে যুদ্ধ সম্পর্কিত বহুবিধ তথ্যে ভরে উঠল বিদ্রূপের নোটবই। রকমারি অস্ত্র আর নতুন নতুন রণনীতির বিস্তারিত ব্যাখ্যায় একটা নয়, কয়েকটা নোটবই বোঝাই হয়ে গেল।
তারপর ধরুন সর্দির টিকা। আজ সারা পৃথিবী থেকে সর্দি জিনিসটা একদম মুছে গেছে কেন জানেন? বলা বাহুল্য বিদ্রূপের জন্য। নিওটেরিক্সরা অতি অল্প সময়ে সর্দির মোক্ষম টিকা আবিষ্কার করল। বিদ্রূপের নোটবইতে উঠে গেল ফরমুলাটা। তারপরেই একদিন শীতের রাতে ব্যাংক চেয়ারম্যান ধুন্ধুমার সাহা ফোন করল বিদ্রূপ ব্ৰহ্মকে। ভদ্রলোকের ঠাণ্ডা লেগে গলা বসে গেছিল। সর্দিতে নাক বুঁজে গেছিল। ফলে, রেডিও ফোনে ধুন্ধুমার সাহার ভাঙা-ভাঙা বিকট চিৎকার শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে গেল বিদ্রূপ। তক্ষুনি এক শিশি সর্দির টিকা পাঠিয়ে দিল ব্যাংকে। সেই সঙ্গে বলে দিল, এরকম যাচ্ছেতাই রকমের ধরা গলা নিয়ে যেন ভবিষ্যতে আর ফোন করা না হয়। ধুরন্ধর ধুন্ধুমার শিশিভর্তি আজব দাওয়াই বিশ্লেষণ করে ফরমুলাটা বার করে নিল। ফলে, বিদ্রূপ ব্রহ্মর তহবিল থুড়ি—ব্যাঙ্কের তহবিল আর এক দফা ফুলে উঠল।
প্রথম প্রথম নিওটেরিক্সদের যা যা দরকার, সবই দিত বিদ্রূপ। কিন্তু অচিরেই মৌলিক পদার্থ থেকে দরকার মতো জিনিস বানিয়ে নেওয়ার মতো ধীশক্তি ওদের মধ্যে জাগ্রত হল। তখন থেকে প্রতিটি অংশে কাঁচা মাল দেওয়া
শুরু করল বিদ্রূপ।
সত্যিকারের শক্ত অ্যালুমিনিয়াম তৈরির প্রক্রিয়া জানা গেল এই ভাবেঃ একটা অংশে বিশাল চোঙার মতো পিস্টন বসালো বিদ্রূপ। চার দেওয়াল জুড়ে সেই পিস্টন দিনে চার ইঞ্চি হিসেবে নিচের দিকে নামতে লাগল। পরিণাম যে কি সাংঘাতিক তা কল্পনা করা যায়। পিস্টন যখন মেঝে ছোঁবে তখন ঘরের প্রতিটি নিওটেরিক্সকে মেঝের সঙ্গে পিষে যেতে হবে।
নিওরেটিক্সরা বুদ্ধিমান জীব। তারা বুঝল, চটপট উপায় না বাতলালে মরণ সুনিশ্চিত। হাতের কাছে যতরকম শক্ত ধাতু পাওয়া যায়, তাই দিয়ে মৃত্যুকে ঠেকানোর চেষ্টা করল। কিন্তু বিদ্রূপ সে পথ মেরে রেখেছিল। আগে থেকেই ঘরের কোণে বেশ কিছু অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড আর কিছু মৌলিক পদার্থ ছড়িয়ে রেখেছিল। সেই সঙ্গে রেখেছিল প্রচুর বিদ্যুৎ শক্তি।
প্রথম প্রথম ডজন ডজন অ্যালুমিনিয়ামের থাম তৈরি করল নিওটেরিক্সরা। কিন্তু পিস্টনের চাপে যখন সে-সব থাম দুমড়ে তালগোল পাকিয়ে গেল, তখন সেগুলো গালিয়ে অন্য আকার দিল। তাতেও যখন পিস্টনের নিম্নগতি রোধ করা গেল না, তখন চটপট আরও শক্ত থাম বানিয়ে নিল। অবশেষে ঠেকানো গেল পিস্টনকে। বিদ্রূপ একটা থাম বার করে আনল। বিশ্লেষণ করল। পাওয়া গেল সুকঠিন অ্যালুমিনিয়াম। মলিবড্ ইস্পাতের চাইতেও কঠিন।
বিদ্রূপ ঠেকে শিখেছিল, নিওটেরিক্সরা অতি-উদ্ভাবনী হয়ে ওঠার আগেই নিজের শক্তিও খানিকটা বাড়িয়ে নেওয়া দরকার। অর্থাৎ যে শক্তি দিয়ে নিওটেরিক্সদের তাঁবেদার রাখা হয়েছে, সে শক্তিকে ধাপে ধাপে বৃদ্ধি পেতে হবে। পারমাণবিক শক্তি দিয়ে অনেক কিছু করার সুযোগ ছিল। এ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের কৌতূহলও ছিল তার। তা সত্ত্বেও অতি শক্তিমান ক্ষুদে বৈজ্ঞানিকদের ওপর ভরসা রাখতে পারে নি। যদ্দিন না হয়েল সাহেবের মতো পারমাণবিক শক্তিকে বাগে আনতে পরছে, তদ্দিন ও-পথ না মাড়ানোই শ্রেয়।
তাই, দারুণ আতংক সৃষ্টি করে নিওটেরিক্সদের শাসন করতে লাগল সে। যা তার অভিপ্রেত নয়, সে রকম কিছু করার লক্ষণ দেখা গেলেই নেমে আসত মৃত্যুদণ্ড। সে যা চাইছে, তার বাইরে গেলেই খতম করে দিত আদ্দেক জাতকে।
যেমন ধরুন, বিদ্রূপের ইচ্ছে নতুন ধরনের একটা যন্ত্র তৈরি করা। ফ্লাইহুইল স্টার্টার ছাড়াই চালু করা যাবে যন্ত্রটাকে। কিন্তু অতি বুদ্ধিমান কোনো নিওটেরিক্স তরুণ যদি সেই মালমশলা দিয়ে বাড়ীঘরদোর তৈরি করার মতলব আঁটে, সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলা হয় অর্ধেক বাসিন্দাদের।
ওদের একটা ভাষাও ছিল। লিখিত ভাষা। সে ভাষা অবশ্য বিদ্রূপের নিজের
আবিষ্কৃত ভাষা। প্রতি ঘরের এক কোণে একটা কাঁচ-ঘর ছিল। ভেতরে ছিল টেলিটাইপ। টেলিটাইপ মারফৎ বিদ্রূপ যে নির্দেশই পাঠাক না কেন, তা মানতে হবে। অমোঘ সে নির্দেশ না মেনে নিস্তার ছিল না। তাই কাঁচ-ঘরটা নিওটেরিক্সদের কাছে মন্দির হয়ে দাঁড়িয়েছিল। টেলিটাইপকে মনে করত দৈববাণীর যন্ত্র।
এই কায়দার পর বিদ্রূপের কাজ অনেক সহজ হয়ে উঠল। একটু বেচাল দেখলেই যেখানে নির্মম শাস্তির বিধান, সেখানে তার হুকুম টেলিটাইপে ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু হয়ে যেত। হুকুম যত অসম্ভবই হোক না কেন, তিন চার পুরুষের মধ্যে নিওটেরিক্সরা সে হুকুম তামিল করত এবং সমাধান বিদ্রূপ ব্রহ্মর হাতে তুলে দিত।
বিদ্রূপের অনেকগুলো হাইস্পীড টেলিস্কোপ লাগানো ক্যামেরা ছিল। এই ক্যামেরায় একদিন একটা ঘোষণাপত্রের ছবি উঠল। তরুণ নিওটেরিক গোষ্ঠীর হাতে হাতে বিলি হচ্ছিল ঘোষণা পত্রটা। ঘোষণার কিছু অংশ নিচে তুলে দিলাম। উদ্ধৃতিটা অবশ্য নিওটেরিক্সদের অত্যন্ত সহজ সরল ভাষা থেকে অনুবাদ করা।
“এ নির্দেশ আইনের নির্দেশ। প্রত্যেক নিওটেরিক্সকে এ নির্দেশ তামিল করতে হবে। অন্যথায় তাকে মৃত্যুদণ্ড পেতে হবে। জাতির স্বার্থে ব্যক্তি বিশেষকে এই চরম শাস্তি পেতেই হবে। ব্যক্তি বিশেষের আইন অমান্য মানেই সমগ্র জাতির ওপর চরম পিতার রুদ্ররোষ নেমে আসে। সুতরাং মৃত্যুদণ্ডই তার প্রাপ্য।
শব্দ যন্ত্রে যে হুকুম ফুটে উঠবে, জাতির সবাইকে সে হুকুম সর্ব্রাগ্রে তামিল করতে হবে।
শব্দ যন্ত্রে আদেশের আওতার বাইরে কিছু করা চলবে না। তাঁর বিনা আদেশে দেশের কোনো সম্পদ বা শক্তির অপচয় করা চলবে না। অন্যথা ঘটলেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।
নতুন কোনো সমস্যা সম্পর্কে যা কিছু জানা যাবে, অথবা নতুন কোনো আইডিয়া বা এক্সপেরিমেন্টের ফলাফল—কেউ নিজের স্বার্থে গোপন করতে পারবে না। গবেষণা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্যাদি জাতির সম্পত্তি।
এ নির্দেশ যে অমান্য করবে, দেশের সঙ্গে যে অসহযোগিতা করবে, কাজে যে সম্পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ না করবে, তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। এমন কি উপরোক্ত বেআইনী কার্যকলাপ সম্পর্কে প্রত্যক্ষ ব্যতিরেকে কেবলমাত্র সন্দেহের ভিত্তিতে তাকে মৃত্যুদণ্ড পেতে হবে।”
বিদ্রূপ ব্রহ্মর কড়া শাসনের এই হল ফল। ঘোষণাপত্র পড়ে বিদ্রূপ নিজেই অভিভূত হয়ে গেছিল। কারণ, এ আইন স্বতঃস্ফূর্ত। নিওটেরিক্সদের নিজেদের ধর্মবিশ্বাস, পরম পিতার প্রতি ভীতি ও শ্রদ্ধা ফুটে উঠেছে ঘোষণার প্রতি ছত্রে। সমগ্র জাতির কল্যাণ কামনায় স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তারা রচনা করেছে ধর্মসূত্র।
বিদ্রূপ ব্রহ্মর অভিলাষ অবশেষে এই ভাবেই পূর্ণ হল। দোতলায় ছোট্ট ঘরে ঘাড় গুঁজে এ টেলিস্কোপ থেকে সে টেলিস্কোপে ছুটত সে, কখনো হাইস্পীড ক্যামেরা দিয়ে তোলা ছবিগুলোকে ধীরগতি করে দেখত হাতে গড়া জীবকূলের কীর্তিকলাপ। দেখত, শিখত আর লিখে রাখত। অচিরেই এক প্রচণ্ড গতিসম্পন্ন তথ্য সরবরাহ দুনিয়োর একছত্র অধিপতি হয়ে উঠল সে। সে-দুনিয়ার যাবতীয় কার্যকলাপ রইল নখদর্পণে।
বিশাল চৌকোনা সেই ভবনের মধ্যে মানুষের হাতে গড়া জীবকুলের সভ্যতা মানুষকে ছাড়িয়ে অনেক এগিয়ে গেল। চার অংশে পার্টিসন করা প্রকাণ্ড ঘরটার এক-একটা অংশের বিস্তার প্রায় দেড়বিঘে জমির উপর। কাজেই মোট ছ-বিঘে জমির ওপর গড়ে ওঠা সম্পূর্ণ নতুন জগতের বাসিন্দাদের কাছে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা হয়ে রইল বিদ্রূপ ব্রহ্ম।
চেয়ারম্যান ধুন্ধুমার সাহার মনের গতি একদিক দিয়ে বিদ্রূপ ব্রহ্মর মতোই। কোনো সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে খামোকা ঘুরিয়ে নাক দেখানোর পক্ষপাতী নয়। শর্টকাট করে ধুন্ধুমার সাহা। চটপট ভেবে নেয় কি করা উচিত। প্রতিবন্ধক নিয়ে মাথা ঘামায় না।
ব্যাংকের চেয়ারম্যান এইভাবেই হয়েছিল ধুন্ধুমার। ইতিহাস রচনা করেছিল। নির্মম কূটনীতির ইতিহাস! প্রতিবন্ধক ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে, কাতারে কাতারে প্রতিপক্ষ অদৃশ্য হয়ে গেছে। তাতে কী! ধুন্ধুমার যা চেয়েছে তা পেয়েছে।
চৌকস সেনাপতি যেমন শুধু স্রেফ গায়ের জোরে শত্রুকে ঘায়েল করে না, বুদ্ধি খাটায়। কাঁচি প্যাঁচ মেরে এমনভাবে অসহায় করে দেয় শত্রুকে যে আর জীবনে মাথা তুলতে হয় না! তা করতে গিয়ে দু’চারটে নিরীহ দর্শক অবশ্য সাবাড় হয়। কিন্তু তা নিয়ে মাথা ঘামালে চলে কী?
যেমন ধরুন না কেন, হংসরাজ নামে একটা লোকের তিনহাজার বিঘে জমি কিনে নিল ধুন্ধুমার। কিন্তু তবুও মনটা খুঁত খুঁত করতে লাগল। কেন না, শুধু জমির মালিক হলেই তো হল না, জমিটাকে ভোগ করা চাই। অথচ হংসরাজ লোকটা একটা গোটা এয়ারপোর্টের মালিক। টাকার কুমীর। বাবাও বর্তমান। সুতরাং, প্রচুর শক্তি প্রয়োগ করেও যখন হংসরাজকে বিচলিত করা গেল না, তখন নিরুপায় ধুন্ধুমার অন্য পথ অবলম্বন করল। অর্থাৎ শহরের কেষ্টবিন্ধুদের এন্তার টাকা খাইয়ে এয়ারপোর্টের ঠিক মাঝখান দিয়ে একটা নর্দমা খুঁড়িয়ে নিল। ফলে, লাটে উঠল এয়ারপোর্টের ব্যবসা! ধুন্ধুমার জানত, হংসরাজ সহজে ছাড়বে না। প্রতিশোধ নেবেই। তাই সে পথও বন্ধ করতে হল। অর্থাৎ হংসরাজ যে বাংকে টাকা রাখত, অনেক তদ্বির তদারক করে, মুড়ি মুড়কির মতো টাকা ছড়িয়ে, সে ব্যাংকে লালবাতি জ্বালাল। রাতারাতি রাস্তার ফকির হল হংসরাজ, পাগলা গারদে গেল এবং সেইখান থেকেই রওনা হল পরলোকে। ধুন্ধুমার সাহা তাই শুনে গোঁফে তা দিতে দিতে ভাবল, আহারে, কি চালই চেলেছিলাম! এক চালেই কিস্তিমাৎ—রাস্তা সাফ!
একদল লোক আছে যারা অর্থ আর ক্ষমতার পেছনে ধাওয়া করার সর্বনাশা লোভ জীবন গেলেও ছাড়তে পারে না। ধুন্ধুমার সাহা সেই জাতীয় ব্যক্তি। টাকা তার বিস্তর আছে, সেই সাথে আছে ক্ষমতা। দুটোই এসেছে ব্যাংক থেকে। কিন্তু তবুও তৃপ্তি নেই ধুন্ধুমারের। ধুন্ধুমারের কাছে টাকা যতখানি, বিদ্রূপের কাছে জ্ঞান ততখানি। ধুন্ধুমারের কাছে তার পিরামিডসদৃশ কারবার যতখানি, বিদ্রূপের কাছে নিওটেরিক্সরা ততখানি। প্রত্যেকেই নিজের নিজের প্রাইভেট দুনিয়া গড়ে নিয়েছে এবং মায়ায় জড়িয়ে পড়েছে। প্রত্যেকেই নিজের সেই প্রাইভেট দুনিয়াকে রেখেছে কেবল নিজের হুকুম তামিলের জন্য, আরো লাভের জন্য। দুজনের মধ্যে বিদ্রূপকে বেশি নিষ্ঠুর বলা যায়। কারণ সে নিওটেরিক্সদের পুরুষানুক্রমে জ্বালিয়ে মারত, এক মুহূর্তও তিষ্ঠোতে দিত না। সে তুলনায়, ধুন্ধুমার অতটা নির্দয় ছিল না। কারণ, ধুন্ধুমার বিলক্ষণ ধূর্ত। সে জানত, মানুষকে তোয়াজ করার মূল্য কতখানি। তোয়াজ না করে দীর্ঘদিন ঘরে লুঠ চালিয়ে যাওয়া কোনো লুঠেরার পক্ষেই সম্ভব নয়। যাকে লুঠ করতে হবে, তার মন যোগাতেও হবে। কাজটা কঠিন সন্দেহ নেই। উঁচুদরের আর্ট। কিন্তু একবার যদি এ আর্টে আর্টিস্ট হওয়া যায়, তাহলেই কেল্লাফতে।
ধুন্ধুমারের প্রধান ভয় ছিল বিদ্রূপকে নিয়ে। বিদ্রূপ যদি কোনোদিন বিশ্বঘটনাপ্রবাহ নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করে, তাহলেই ক্ষমতার নেশা কোকেনের নেশার মতো পেয়ে বসবে। বিদ্রপের শক্তির তো সীমা নেই। এ তথ্য সারা বিশ্বে ধুন্ধুমার সাহা ছাড়া দ্বিতীয় ব্যক্তি জানে না—বিদ্রূপ ব্ৰহ্ম নিজেও জানে না নিজের শক্তির পরিমাণ। যে কোনো ইলেকশনে জিতে যাওয়া বিদ্রূপের কাছে বিছানায় শুয়ে পাশ ফেরার মতো সহজ ব্যাপার। কাজেই ধুন্ধুমারের প্রধান কাজ ছিল তখন বিদ্রূপের সঙ্গে রেডিওফোনে যোগাযোগ করা আর খোঁজ নেওয়া হাতে তার কোন কাজ আছে কি না। হাতের কাজ মানেই মাথার কাজ। মাথার কাজে বিদ্রূপকে ব্যাপৃত রাখা মানেই কয়েক হপ্তা নিশ্চিন্ত থাকা। তাই, মাঝে সাঝে এমন একটা বিদঘুটে সমস্যা নিয়ে বিদ্রূপকে চ্যালেঞ্জ করত ধুন্ধুমার যে ক্ষেপে গিয়ে তাই নিয়ে গবেষণা শুরু করে দিত আত্মভোলা বৈজ্ঞানিক। এই কৌশলেই “লাইট পাম্পের”
ফরমুলা জেনেছিল ধুন্ধুমার। অসম্ভব কল্পনা সফল হয়েছিল।
একদিন বিকেলে রেডিওফোনের সিগন্যাল শুনে গজ গজ করে উঠল বিদ্রূপ। সদ্য তোলা মুভি ফিল্মটার পর্দায় প্রক্ষেপণ বন্ধ করে এল পুরানো ল্যাবরেটরীতে। রেডিওফোনের সামনে গিয়ে সুইচ টিপতেই বন্ধ হল ক্যাঁ-ক্যাঁ শব্দটা।
“কি খবর?”
“হ্যালো, বিদ্রূপ নাকি?” বলল ধুন্ধুমার। “ব্যস্ত?”
“সামান্য,” জবাব দিল বিদ্রূপ। মেজাজ তখন বিলকুল শরীফ। কারণ মুভি ক্যামেরায় তোলা ফিল্মে এইমাত্র দেখে এসেছে নিওটেরিক্সদের এক আশ্চর্য কীর্তি। স্রেফ গন্ধক থেকে সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় রবার বানিয়েছে কয়েকটা ছোঁড়া। খবরটা ধুন্ধুমারকে দিলে ভাল হত। কিন্তু প্রথম থেকেই যখন নিওটেরিক্স সম্পর্কে ওকে কিছু জানানো হয় নি, তখন কেঁচে গণ্ডুষ করে লাভ নেই।
ধুন্ধুমার বলল—“বিদ্রূপ, সেদিন ক্লাবে গুলতানি করতে করতে কতকগুলো আবোলতাবোল কথা শুনলাম।”
“কী কথা?”
“বলি দেশের খবর-টবর রাখো? যত ‘পাওয়ার’ এদেশে দরকার, তার তিরিশ পার্সেন্ট অ্যাটমিক, বাকীটা ডিজেল, ষ্টিম আর হাইড্রোইলেকট্রিক প্লান্ট থেকে আসছে জানো তো?”
“না তো।” কথাটা সত্যি। কারণ, সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সম্বন্ধে শিশুর মতোই অজ্ঞ ছিল বিদ্রূপ।
“তবে শোনো। আলোচনা চলছিল নতুন পাওয়ার তৈরি করা যায় কি ভাবে। সে পাওয়ার অ্যাটমিক পাওয়ারের মতো প্রচণ্ড শক্তিশালী হবে, অথচ খরচ কম পড়বে। যেখানে খুশী নিয়ে যাওয়া যাবে। এমন কি ব্যাটারীর মতো দোকানে দোকানে বিক্রীও করা যাবে। বুঝেছো ব্যাপারটা? গাঁজার দমের একটা সীমা থাকা উচিত।”
“অসম্ভব কিছু নয়।”
“বলো কি হে?”
“চেষ্টা করে দেখতে পারি।”
“খবর-টবর দিও।” বলে ট্রান্সমিটার বন্ধ করল ধুন্ধুমার। অন্তত ধুন্ধুমার তাই মনে করল। কেননা, ধোঁকা সুইচটা ধুন্ধুমারকে না জানিয়েই ট্রান্সমিটারের ভেতরে বানিয়ে রেখেছিল বিদ্রূপ। ট্রান্সমিটার চালু হত ধুন্ধুমারের দেহতরংগে, বন্ধ হত সামনে থেকে সরে গেলে। তাই, খট করে সুইচ বন্ধ করার শব্দ শোনার পরেই বিদ্রূপ শুনল বিড়বিড় করে বলছে ধুন্ধুমার—“সম্ভব যদি হয়, তাহলে আর আমায় পায় কে। সম্ভব নাও যদি হয়, নিরেট গর্দভটাকে আরো কিছুদিন দ্বীপে আটকে রাখা—”
চোখ কুঁচকে কিছুক্ষণ রেডিওফোনের দিকে তাকিয়ে রইল বিদ্রূপ। পাওয়ার-প্ল্যান্ট-টা যে ধুন্ধুমারের উর্বর মগজের কল্পনা, তা সরল মনে ভাবতেও পারল না। কিন্তু এইটুকু বুঝলো যে ধুন্ধুমারের মাথায় কিছু একটা ঘুরছে। ঘুরলো তো বয়ে গেল। অত ভেবে লাভ কী? কারও খেয়েদেয়ে কাজ নেই আসবে বিদ্রূপকে জ্বালাতে! বিদ্রাপ নিজেই যখন কারও সাতে পাঁচে নেই।
তাই, ‘ধুত্তোর’ বলে নিওটেরিক্সদের ভুবনে ফিরে গেল বিদ্রূপ ব্রহ্ম। মাথার মধ্যে গজ গজ করতে লাগল নতুন ‘পাওয়ার’ তৈরির আইডিয়া।
ঠিক এগারো দিন পরে বিদ্রূপ ব্ৰহ্ম ডাক দিল ধুন্ধুমার সাহাকে। রিসিভারে দু-একটা বাড়তি জিনিস লাগাতে বললে। তাহলেই নাকি শুধু বিদ্রূপের কথা নয়, তার লেখাও শূন্যপথে পাঠানো যাবে।
নির্দেশমত টুকিটাকি জিনিস লাগাবার পর খবর দেওয়া হল বিদ্রূপকে! এবং সেই প্রথম অনেকক্ষণ ধরে বকবক করল বিদ্রূপ।
বলল—“ধুন্ধুমার, সেদিন এমন একটা ‘পাওয়ার’ তৈরির কথা বলছিলে যা অ্যাটমিক পাওয়ারের মতো শক্তিশালী হবে অথচ দামে সস্তা হবে, যেখানে খুশী নিয়ে যাওয়া যাবে। তাই না?”
“হ্যাঁ।”
“এইমাত্র একটা জেনারেটর বসালাম। ছোট্ট জেনারেটর। কিন্তু দারুণ ইন্টারেষ্টিং—অন্তত তোমার কাছে।”
“কী রকম?”
“ধুন্ধুমার, অবিশ্বাস্য রকমের শক্তি সৃষ্টির ক্ষমতা এ জেনারেটরের আছে। অ্যাটমিক পাওয়ার কিছুই নয় এ পাওয়ারের কাছে। এ শক্তি বেতার শক্তির মতোই শূন্যপথে ধাওয়া করে। জিনিসটা আসলে এক রকমের রশ্মি। সূক্ষ্ম কিন্তু ভারি সুন্দর। নাও, ধরো দিকি,” বলে, একটা কাগজ ট্রান্সমিটারের নিচে ঢুকিয়ে দিল বিদ্রূপ। সঙ্গে সঙ্গে ধুন্ধুমারের রিসিভারে পৌঁছে গেল কাগজে আঁকা নক্সা। “পাওয়ার রিসিভারের নক্সা পাঠালাম। রেখে দিও। এবার শোনো। রশ্মিটা দারুণ সূক্ষ্ম, অথচ ভয়ানক তীব্র। যে দিকে পাঠানো যায়, সেই দিকেই ছোটে—অথচ দুহাজার মাইলের মধ্যে পাওয়ারের শতকরা এক ভাগের তিন হাজার ভাগের এক ভাগও নষ্ট হয় না। ‘পাওয়ার’ পদ্ধতি গড়াই হয়েছে সেইভাবে। অর্থাৎ রশ্মির এতটুকুর অপচয় ঘটলেই ট্রান্সমিটারে সিগন্যাল পৌঁছোয়। আপনা হতেই তখন ‘পাওয়ার’ উৎপাদন বেড়ে যায়। এ শক্তির সীমা একটা আছে নিশ্চয়, কিন্তু এখনো তার হদিশ আমি পাই নি। আমার যন্ত্রটা দেখতে ছোট বটে, কিন্তু এই ক্ষুদে যন্ত্র থেকেই আট রকমের রশ্মি পাঠানো যায়। প্রতি রশ্মি পিছু প্রতি মিনিটে যে ‘পাওয়ার’ লাগে, পরিমাণে তা কমবেশি আট হাজার হর্সপাওয়ার। প্রত্যেকটা রশ্মি থেকে তুমি যা ‘পাওয়ার’ পাবে, তা দিয়ে বইয়ের পাতা ওলটানো থেকে আরম্ভ করে সুপার স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার প্লেন পর্যন্ত ওড়ানো যাবে। আরে থামো, থামো—এখনো শেষ হয় নি আমার। আগেই বলেছি, প্রত্যেক রশ্মি সিগন্যাল পাঠায় রিসিভার থেকে ট্রান্সমিটারে। ফলে, পাওয়ারের উৎপাদন কন্ট্রোল করা ছাড়াও আর একটা কাজ হয়। রশ্মিটা রিসিভারের সঙ্গে লেগে থাকে। একবার যোগাযোগ হলেই হল, রিসিভার যেখানে যাবে, রশ্মিও সেখানে যাবে, জলে স্থলে অন্তরীক্ষে যে কোনো যন্ত্রযানকে তুমি কন্ট্রোল করতে পারবে এই রশ্মি দিয়ে। যে কোনো প্লান্টকে পাওয়ার সরবরাহ করতে পারবে ঘরে বসে। পছন্দ হয়?”
ধুন্ধুমার সাহা বিজ্ঞানী নয়, ব্যাঙ্কার। তাই হাতের উল্টো দিক দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল—“বাজে জিনিস তো কোনো দিন আমাকে দাও নি, বিদ্রূপ। তাই বলছিলাম, জিনিসটার খরচ কত?”
“প্রচুর,” ঝটিতি জবাব দিল বিদ্রূপ “অ্যাটমিক প্লান্টে যা খরচ তাই। কিন্তু আর কোনো খরচ নেই। হাইটেনসন লাইন নেই, তার নেই, পাইপলাইন নেই। অর্থাৎ বাদবাকী খরচ শূন্য। রিসিভারের নক্সা তো পেয়েছো। তৈরি হলে দেখবে রেডিও সেটের মতো হাল্কা, ছোট্ট। ট্রান্সমিটারটা অবশ্য একটা জটিল ব্যাপার।”
“খুব চটপট কাজ সেরেছো দেখছি।”
“তা সেরেছি,” সংক্ষেপে বলল বিদ্রূপ। বারোশো অতি উন্নত সুসভ্য প্রাণীর সারা জীবনের সাধনার ফল যে এই রশ্মি তা চেপে গেল। বলল “একটা মডেল ট্রান্সমিটার গড়েছি।”
ধুন্ধুমারের শিরদাঁড়া সিধে হয়ে গেল—“মডেল? পাওয়ার তৈরির মডেল? কত পাওয়ারের?”
“যাট হাজার হর্সপাওয়ারের সামান্য বেশি,” খুশী-খুশী স্বর বিদ্রূপের।
‘সর্বনাশ! মডেলই যদি এই হয় তো… বড় আকারের প্লান্টে তো… মাই গড! একখানা ট্রান্সমিটার দিয়েই—” সম্ভাবনাটা কল্পনা করে বাকরহিত হল ধুন্ধুমার। কিছুক্ষণ পরে শুধোলো—“জ্বালানি কী?”
“কিছু না। আমি এমন একটা শক্তির সন্ধান পেয়েছি, যার শেষ নেই, যা কল্পনা করা যায় না। এ শক্তি অসীম। তাই, প্রচণ্ড। এত প্রচণ্ড যে অপব্যবহার করা সম্ভব নয়। কারোর পক্ষেই নয়। তোমার পক্ষেও নয়।”
“কী? কী বললে?”
ভুরু তুললো বিদ্রূপ। ধুন্ধুমারের পেটে নিশ্চয় কিছু শয়তানি আছে। এই নিয়ে দুবার তার ইঙ্গিত পাওয়া গেল। তাই বিদ্রূপ ব্রহ্মর মতো সাদাসিধে মানুষ, সন্দেহ জিনিসটা যাকে মোটেই মানায় না, তাকেও হুঁশিয়ার হতে হল।
বলল—“যা বলেছি, তুমি শুনেছে। আমাকে বেশি বোঝাবার চেষ্টা কোরো না। এ শক্তি মহাজাগতিক শক্তি। এ শক্তি সৃষ্টির আদিতে ছিল। আছে, থাকবে। এ শক্তিই সূর্য তৈরি করে, অ্যাটম চূর্ণ করে। এই শক্তিই গড়ে ভাঙে। এই শক্তি সাইরাস অর্থাৎ লুব্ধক নক্ষত্রের সঙ্গীদেরও ধ্বংস করেছে। এ শক্তি নিয়ে ছেলেখেলা করা যায় না। এ শক্তির সঙ্গে চালাকি চলে না।”
“আমি চালাকি করি না, ছেলেখেলা করি না—” বিমূঢ় কণ্ঠ ধুন্ধুমারের।
“উদাহরণ দিচ্ছি, শুনে নাও। ধরো, দুটো কাঠিকে ডগায় ডগায় ঠেকিয়ে ঠেলছো। যতক্ষণ ঠেলাটা এক লাইনে হচ্ছে, কিছুই হবে না। কিন্তু জোড়ের জায়গায় আঙুল দিয়ে কেউ ঠেলা দিলেই বিপর্যয় ঘটছে। অর্থাৎ দুটো সমান শক্তি মুখোমুখি থেকে ভারসাম্য বজায় রাখছে। তৃতীয় শক্তিটা পরিমাণে নগণ্য হলেও কাজ করছে জোড়ের মুখে—সমকোণে। তখন দুটো শক্তিই এক সঙ্গে মিশে যাচ্ছে তৃতীয় শক্তির সঙ্গে। ফলে, যে প্রচণ্ড শক্তির উদ্ভব ঘটছে, তাইতেই তোমার আঙুলে গাঁটে গাঁটে ঠোকাঠুকি লাগছে। ধুন্ধুমার, এ ব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্র চলছে এই সমান শক্তির খেলা। ভারসাম্য আছে বলেই প্রলয় ঘটছে না। ভারসাম্য নষ্ট করার রহস্য যে জেনেছে, প্রলয় সৃষ্টি করার কৌশল সে জেনেছে। সে কৌশলও আমি জেনেছি।”
“তাই নাকি,” পুরো চার সেকেণ্ড লাগল ধুন্ধুমারের একটা ঢোঁক গিলতে। তারপর বলল—“কৌশল জেনে আমার দরকার নেই ব্রহ্ম, আমার দরকার একটা ফুল-সাইজ ট্রান্সমিটার।”
রেডিওফোনে বিদ্রূপের খুক-খুক হাসি শোনো গেল—“তোমার উচ্চাশার শেষ নেই দেখছি। এখানে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। চার পাঁচ হাজার টন ওজনের অ্যাপারেটাস তৈরি আমার একা হাতে সম্ভব নয়।”
“আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে পাঁচশ ইঞ্জিনীয়ার আর কুলি পাঠাচ্ছি।”
“না, পাঠাবে না। কেন বিরক্ত করছো আমায়? আমি একা আছি, কিন্তু শান্তিতে আছি। আমার শান্তি নষ্ট কোরো না।”
“বোকামো কোরো না, বিদ্রূপ তোমাকে আমি টাকা দেব, মাইনে দেব—”
“কত টাকা তোমার আছে, ধুন্ধুমার?” বলেই খট করে সুইচ টিপে রেডিওফোন বন্ধ করে দিল বিদ্রূপ। এ সুইচে কাজ হল। বিচ্ছিন্ন হল যোগাযোগ।
তেলেবেগুলে জ্বলে উঠল ধুন্ধুমার। কিছুক্ষণ ষাঁড়ের মতো চেঁচাল ফোনে,
তারপর ঠেস দিয়ে দাঁড়াল সিগন্যাল বোতামে। দ্বীপে দাঁড়িয়ে বিদ্রূপ শুনল ক্যাঁ-কোঁ সিগন্যালধ্বনি। কিন্তু ফিরে তাকালো না। গেল প্রোজেকসন রুমে। ফিল্মের বাকীটুকু এবার দেখতে হবে।
মনটা তাবশ্য খুঁত খুঁত করতে লাগল একটা কারণে। রিসিভারের নক্সাটা পৌঁছে গেছে ধুন্ধুমারের হাতে। নিওটেরিক্সদের এই মডেল ট্রান্সমিটার দিয়ে যে কোনো আকাশযান কি স্থলযানকে পাওয়ার সাপ্লাই করা যেত। মন্দ হত না জিনিসটা। কিন্তু ধুন্ধুমারের মতিগতি ভাল নয়। মরুক গে! নক্সাটা যে কোনো রেডিও ইঞ্জিনীয়ার দেখে বুঝাবে, রিসিভারও বানাবে। কিন্তু ট্রান্সমিটার না থাকলে কোনো কাজেই লাগবে না। রিসিভারকে চালু করতে গেলে দরকার রশ্মি। সে রশ্মি ধুন্ধুমারকে দেওয়া হবে না।
হায়রে, বিদ্রূপ ব্রহ্ম! ধুন্ধুমার সাহাকে তুমি তখনও চিনতে পারো নি!
বিদ্রূপ ব্রহ্মর এক একটা দিন মানেই অফুরন্ত জ্ঞান সঞ্চয়ের এক একটি ইতিহাস।
ঘুম কাকে বলে, তা ভুলে গিয়েছিল বিদ্রূপ। নিওটেরিক্সরাও জানত না ঘুম মানে কি? ঘড়ি ধরে পাঁচ ঘণ্টা অন্তর উদর পূজা করত বিদ্রূপ, বারো ঘণ্টা অন্তর ঠিক আধঘণ্টা ধরে খানিকটা ব্যায়াম করত। সময়ের হিসেব রাখত না—কারণ সময় জিনিসটা অর্থহীন হয়ে গেছিল ওর কাছে। তারিখ কি বছর জানবার দরকার হলে ধুন্ধুমারকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যায়। কিন্তু দরকার কী? সময়ের হিসেব রেখে লাভ কিছু নেই। তাই মাথাও ঘামাত না।
নিওটেরিক্সদের চোখে চোখে রাখাই ছিল ওর দিবারাত্রর কাজ। মাঝে মাঝে তারই ফাঁকে ওদের জন্য নতুন নতুন সমস্যা ভেবে নিত। আপাতত বিদ্রূপের মাথায় ঘুরছে আত্মরক্ষার চিন্তা। ধুন্ধুমারের সঙ্গে কথা কাটাকাটির পর থেকেই ভাবনাটা কিলবিল করছে মাথায়। নিওটেরিক্সরা এক ধরনের আধা-বৈদ্যুতিক কম্পন-ক্ষেত্র নিয়ে উঠে পড়ে গবেষণা করছে। অদৃশ্য একটা দেওয়াল—ব্যস, আর কিছু না। কিন্তু জীবন্ত প্রাণী সে দেওয়াল স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হবে। আইডিয়াটা খারাপ নয়।
ওপরের ঘরে টেলিস্কোপে চোখ রেখে এই সব কথাই ভাবছিল বিদ্রূপ। ক্ষুদে প্রাণীগুলো অবিশ্বাস্য তৎপরতায় গবেষণা এগিয়ে নিয়ে চলেছে। এই বেলা খেয়ে আসা দরকার। আড়মোড়া ভেঙে সিধে হয়ে দাঁড়াল বিদ্রূপ।
খাবার কথা মনে হলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায় বিদ্রূপের। কন্ট্রোলরুম ছেড়ে বেরোতে মন চায় না। দুমুঠো খাওয়ার জন্যে বারবার পুরানো ল্যাবোরেটরীতে যাওয়া এক ঝকমারি ব্যাপার। প্রতিবার তাই কন্ট্রোলরুম ছেড়ে বেরোনোর সময়ে যতটা বিরক্তি থাকে মনের মধ্যে, ফেরবার সময়ে থাকে ততটা আশা আর আনন্দ।
জানি এর মধ্যে নতুন কি আবিষ্কার করে ফেলল নিওটেরিক্সরা। বাইরে এসে দাঁড়াল বিদ্রূপ। কালো বিন্দুটা তখনি চোখে পড়ল। একটা মোটরবোট। দ্বীপ থেকে বেশ কয়েক মাইল দূরে জল কেটে এগিয়ে আসছে দ্বীপের দিকেই। আসছে মূল ভূখণ্ড থেকে। দু পাশে জলের ফেনা পাখীর ডানার মতো ছড়িয়ে পড়ছে।
দুই চোখে অপরিসীম বিরক্তি নিয়ে মোটর বোটটার দিকে তাকিয়ে রইল বিদ্রূপ। বিরক্তির কারণও আছে। অনেক দিন আগে কয়েকটা পণ্ডিতমূর্খ বোট নিয়ে দ্বীপে এসেছিল। আবোল তাবোল প্রশ্ন করে জ্বালিয়ে মেরেছিল বিদ্রূপকে। ফলে, স্নায়ুর অস্থিরতা কাটিয়ে উঠতে বেশ কয়েকটা দিন নষ্ট হয়েছিল।
মোটর বোটটা দেখে বিদ্রূপের তাই নতুন করে মনে হল, মানুষ জাতটাকে ও ঘৃণা করে। অন্তর দিয়ে ঘৃণা করে। তাই মানুষের সঙ্গ ওর কাছে এমন বিষতুল্য।
মনটা খিঁচড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও দুটো অস্বস্তির কাঁটা খচ খচ করতে লাগল মনের মধ্যে। ল্যাবোরেটরীটাকে ফোর্স-ফিল্ড দিয়ে ঘিরে ফেলার ব্যবস্থা না করলেই নয়। অদৃশ্য একটা প্রাচীর দিয়ে ল্যাবোরেটরীকে সুরক্ষিত করে বাইরে একটা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দিলেই হল। বিজ্ঞপ্তিতে লেখাই থাকবে, এগোলেই মরণ।
অস্বস্তির আর একটা কাঁটা হল ধুন্ধুমারকে নিয়ে। রেডিও ফোনে লোকটার সঙ্গে কথা বলার পর থেকেই মনের অনাবিল শান্তি হারিয়েছে বিদ্রূপ। মাত্র দুদিন আগেই ধুন্ধুমার একটা পাওয়ার প্লান্ট বসাতে চেয়েছে নির্জন এই দ্বীপে—কী ভয়ংকর প্রস্তাব।
পুরানো ল্যাবোরেটরীতে বিদ্রূপ ঢুকতেই বেঞ্চি থেকে উঠে দাঁড়াল ধুন্ধুমার।
পলকহীন চোখে দুজনে তাকিয়ে রইল দুজনের দিকে। থমথমে নৈঃশব্দ্য ভঙ্গ করে কারো দিক থেকেই বাক্য স্মৃর্তি ঘটল না।
অনেক বছর পরে ধুন্ধুমারকে দেখল বিদ্রূপ। দেখে খুশী হল কি মুখ দেখে বোঝা গেল না। তবে শিরশির করে উঠল পৃষ্ঠবংশ। ভয়, অস্বস্তি, বিষাদে বিকল হল স্বরকক্ষ।
কান এঁটো করা হাসি হাসল ধুন্ধুমার।
বলল—“বাঃ, বেড়ে আছো দেখছি।”
উত্তর দিল না বিদ্রূপ। ধুন্ধুমার অগত্যা বেঞ্চিতে বসল।
বলল—“কষ্ট করে তোমাকে আর জিজ্ঞেস করতে হবে না। আমিই বলছি। দু ঘণ্টা আগে একটা ছোট্ট বোটে পৌঁছেছি আমি। এইটুকু আসতেই হাড়মাস আলাদা হয়ে গেছে। এখনও গা-বমি-বমি করছে। আসলে তোমাকে চমকে দেব ঠিক করেই চুপিসাড়ে এসেছি। শেষের দু মাইল আমার দুই চেলা দাঁড় টেনেছে। ও রকম হাঁ করে দেখছো কী? বলি, আত্মরক্ষার কোনো ব্যবস্থা করেছো, না আগেই মতোই রিসার্চ নিয়ে মেতে আছো? হুট করে কেউ যদি এসে পড়ে?”
“কার অত মাথাব্যথা?” অস্ফুট স্বরে বলল বিদ্রূপ। ধুন্ধুমার বড় চেঁচিয়ে কথা বলছে। অন্তত সাধক বিদ্রূপের কানে তাই মনে হল। ছোট্ট ঘর। কিন্তু এমনভাবে চেঁচাচ্ছে যে বিদ্রূপের মাথার মধ্যেও ছুঁচফোটার মতো যন্ত্রণা জাগিয়ে তুলছে।
ধুত্তোর! ধুন্ধুমারকে আমল না দিয়ে খাবার সাজানোর দিকে মন দিল বিদ্রূপ।
ব্যাঙ্কার বলল—“মাথাব্যথা আমার।” বলে হীরক-খচিত একটা চুরুটকেস বার করল—“স্মোক করতে পারি?”
“আজ্ঞে না,” তীক্ষ্ণ কণ্ঠ বিদ্রূপের।
অসভ্যের মতো হেসে উঠল ধুন্ধুমার। সিগার-কেসটা পকেটে রেখে বলল—“পাওয়ার স্টেশনটা এই দ্বীপেই তৈরি করতে চাই।”
“রেডিও ফোন কি খারাপ হয়েছে?”
“না, হয় নি। কিন্তু সামনা সামনি কথা বলার সুবিধে আছে। ফট করে সুইচ অফ করে তাড়াতে পারবে না। পাওয়ার স্টেশন নিয়ে ভেবেছো?”
“নতুন করে ভাবার দরকার হয় নি। কারণ, আমার মত পালটায় নি।”
“মাঝে মাঝে বড় ছেলেমানুষ হয়ে যাও। একটু মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবো। দেশের, দশের জন্যে চিন্তা করো।”
“আমি কারো জন্যে ভাবি না। আমি শুধু একা থাকতে চাই।”
“কিন্তু—”
“এ দ্বীপে ষ্টেশন বানাতে চাইছ কেন?”
“জায়গাটা খাসা বলে। এ দ্বীপ তোমার নিজস্ব। কাজেই কাকপক্ষীকে না জানিয়ে চুপিসাড়ে কাজ শুরু করা যাবে। ভেতরে ভেতরে পুরোপুরি তৈরি হয়ে প্লান্ট নিয়ে হাজির হওয়া যাবে মার্কেটে। হই-হই পড়ে যাবে। চমকে দেওয়া যাবে। ভালো দর পাওয়া যাবে। বুঝেছো?”
“বুঝেছি। কিন্তু আমাকে জ্বালিও না।”
“কে জ্বালাচ্ছে তোমাকে এখান থেকে দেড় মাইল দূরে দ্বীপের উত্তর প্রান্তে প্লান্ট বসাবো। ভালো কথা, পাওয়ার ট্রান্সমিটারের মডেলটা কই?”
বিদ্রূপের মুখ ভর্তি তখন সিনথেটিক খাবার। তাই কথা না বলে অঙ্গুলি সংকেতে দেখিয়ে দিল একটা ছোট টেবিলের দিকে। টেবিলের উপর বসানো ছিল একটা অদ্ভুত যন্ত্র। লম্বায়, চওড়ায়, উচ্চতায় প্রায় চারফুট। প্লাস্টিক, ইস্পাত আর ক্ষুদে ক্ষুদে তারের রকমারি জটিল পাক। বিচিত্র দর্শন, ঝকমকে, সূক্ষ্ম।
উঠে দাঁড়াল ধুন্ধুমার। টেবিলের কাজে গিয়ে নির্নিমেয় চোখে তাকিয়ে রইল মডেলটার দিকে।
তারপর, জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বললে—“কাজ দেয় তো? না, খেলনা মডেল? পরে দেখা যাবে ‘খন। বিদ্রূপ, সাফ কথা বালি শোনো। এ দ্বীপে পাওয়ার ষ্টেশন আমাকে গড়তেই হবে। ঘটোৎকচ! কুম্ভকর্ণ!”
সঙ্গে সঙ্গে দুজন মানুষ-দৈত্যের আবির্ভাব ঘটল ঘরের মধ্যে। দুজনেই যেন দুটো মাংসের চলন্ত পাহাড়। ঘাড়ে গর্দানে তফাৎ নেই। আবলুষ কাঠের মতো মিশমিশে রং। করমচার মতো রাঙা চোখ। ঠোঁটের কোণে খুনে হাসি। হাতে ঝুলছে নিকষ রিভলভার।
ফ্যালফ্যাল করে মূর্তিমান দুই উৎপাতের দিকে তাকিয়ে রইল বিদ্রূপ।
ধুন্ধুমার বলল—“ঘাবড়াও মাৎ, এরা মাটি খুঁড়ে বেরোয় নি। ঘাপটি মেরে দেখছিল তোমার দৌড়। বিদ্রূপ, এরা দুজনেই আমার হুকুমের দাস। যা বলব, তাই শুনবে। আধ ঘন্টার মধ্যেই আর একটা দল পৌঁছোচ্ছে। সে দলে আছে ইঞ্জিনীয়ার আর কনট্রাক্টর। দ্বীপের উত্তর দিকটা জরীপ করে পাওয়ার প্লান্ট বসানো হবে। খেয়াল রেখো, তোমার ভবিষ্যৎ শুধু আমার হাতে নয়, এই দুজন যার হাতেও নির্ভর করছে। কাজেই, সাফ বলো, তোমার সহযোগিতা পাবে কি না। তুমি বাঁচো কি মরো, তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। মডেলটার নকল বানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা আমার ইঞ্জিনীয়ারদের আছে।”
বিদ্রূপ চুপ করে রইল। মিশমিশে দৈত্য দুটো আবির্ভূত হওয়ার সময় থেকেই চিবোনো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, এখন সম্বিৎ ফিরে আসতেই কোঁৎ করে গিলে ফেলল মুখের গ্রাস। কিন্তু কথা বলল না।
নৈঃশব্দ্য।
দরজার কাছে গিয়ে ধুন্ধুমার বলল—“ঘটোৎকচ, মডেলটা কাঁধে করে নিয়ে যেতে পারবে?”
ঘটোৎকচ নামধারী মাংসের পাহাড় হাতের রিভলভার পকেটে রাখল। দু হাতে মডেলটা তুলে নিয়ে ঘাড় কাৎ করে বলল, পারবে।
ধুন্ধুমার বললে—“সমুদ্রের ধারে নিয়ে যাও। ইঞ্জিনীয়ারদের বোট এলে চীফ ইঞ্জিনীয়ারকে বলবে এই মডেল মতো প্লান্ট তৈরি হবে।” দ্বিরুক্তি না করে ঘটোৎকচ বেরিয়ে যেতেই বিদ্রূপের দিকে ফিরে বলল—“রাগারাগি করে লাভ নেই। ভয়ানক গোঁয়ার তুমি। আমিও নিরুপায়। তবে হ্যাঁ, তোমাকে আর ঘাঁটাচ্ছি না। তোমার ত্রিসীমানায় কেউ আসবে না—সে কথা দিচ্ছি। তাই বলে যেন নিজেকে কেষ্টবিষ্ণু মনে কোরো না। বেআক্কেলি করলেই মার খাবে। আমার কাজে বাধা দিয়েছো কি মরেছো। তোমার মতো ছোটখাট এক-আধটা জান খতম করতে আমি দ্বিধা করবো না। তোমার জীবনের চেয়ে আমার কাজ বড়।”
অবরুদ্ধ কণ্ঠে বিদ্রূপ শুধু বলল-“দূর হও।” এর বেশি আর কিছু বলতে পারল না। কারণ, ব্রহ্মতালুতে দুটো ধমনী ফুলে উঠেছিল। সেইসঙ্গে প্রচণ্ড দপদপানি। কথা বলার মতো অবস্থা ছিল না।
“তা হচ্ছি। যাবার আগে বলে যাই, একটা কথা। তুমি একটা পয়লা নম্বরের বিচ্ছু,” জ্ঞান-পাগল বিদ্রূপ ব্রহ্মকে এতাবধি এ নামে কেউ সম্বোধন করেনি। “দ্বীপ উড়িয়ে দেওয়ার ফন্দী নিশ্চয় মাথায় আছে তোমার। সম্ভাবনাটা আমার মাথাতেও এসেছে। কিন্তু তুমি যতবড় কিছুই হও না কেন, আমি যদি তুমি হতাম, তাহলে ও পথ মাড়াতাম না। নিরিবিলি থাকতে চাও—পাবে। প্রতিদানে আমাকে নিরিবিলি থাকতে দিতে হবে। আমি এখানে যে কদিন আছি, তার মধ্যে যদি উল্টোপাল্টা কিছু করে ফ্যালো, তাহলে জেনো বোমা ফেলে দ্বীপটাকে পাউডার করার একটা প্ল্যান আমার আছে। এ জন্যে লোক মোতায়েন করেই আমি এসেছি। তবে হ্যাঁ, সে লোক হয়ত শেষ পর্যন্ত বোমা ফেলার বদলে নিজেই বোমা খেয়ে বসল। তুমি সব করতে পার। তাই বিকল্প ব্যবস্থাও আছে। গভর্ণমেন্ট যাতে অবিলম্বে তোমাকে ছাতু বানায়, সে আয়োজনও সম্পূর্ণ করেছি। আশা করি, অত নোংরামি তোমার সইবে না। কাজেই সাবধানে থেকো। একা মানুষের পক্ষে লড়ালড়ির একটা সীমা আছে তো। তারপর ধরো আমি দেশে ফিরে গেলাম। তুমিও গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে নষ্টামি শুরু করলে। প্লান্টের বারোটা বাজালে। ওহে বিদ্রূপ ব্রহ্ম, তাহলেও জেনো তুমি রেহাই পাবে না। বেয়াদবি করলেই মারা পড়বে। সুতরাং, সাধু সাবধান।”
বলে, হেলে দুলে বেরিয়ে গেল ব্যাঙ্কার। পেছন পেছন রিভলভার দুলিয়ে গেল কৃষ্ণকায় গরিলা।
অনেকক্ষণ পাথরের মতো বসে রইল বিদ্রূপ। খেতে ভুলে গেল। আঙুল নাড়তেও ভুলে গেল। মনে হল যেন একটা গ্রানাইট মূর্তি।
বিদ্রূপ ভয় পেয়েছে। নিদারুণ ভয়। জীবন বিপন্ন হয়েছে বলে নয়, দ্বীপের নির্জনতা রইল না বলে। সেই সঙ্গে বিদ্রূপ ব্রহ্মর ব্রহ্মাণ্ডও বুঝি আর গোপন রইল না। এই ভয়টাই অবশ করে তুলল ওর দেহমন। ধুন্ধুমারের আবির্ভাব এবং কশাইয়ের মতো কথাবার্তা ওর অনভ্যস্ত মনকে প্রচণ্ড ঘা দিয়েছে। মারাত্মক ঘা। তাই বিহুল হয়ে গেছে বিদ্রূপ। ব্যবসা ও বোঝে না। লোক খাটানোর কায়দা জানে না। বাকচাতুরীর ধার ধারে না। মানুষ সংসর্গ এড়িয়েছে, পালিয়ে বেড়িয়েছে, নির্জনতা খুঁজেছে। তাই মানুষ কাছে এসে দাঁড়াতেই ভয়ার্ত শিশুর মতো অসহায়
বোধ করল বিদ্রূপ ব্ৰহ্ম।
অনেক… অনেকক্ষণ পরে মাথা ঠাণ্ডা হল বিদ্রূপের। উঠে দাঁড়াল। পাওয়ার প্লান্ট চালু হয়ে গেলে কি হবে ভাবতেই শিউরে উঠল। গভর্ণমেন্ট তো নাক গলাবেই। ধুন্ধুমার নিজে গভর্ণমেন্ট হয়ে যেতে পারে। এ প্লান্ট তো সাধারণ প্লান্ট নয়। শক্তির অকল্পনীয় উৎস। অনন্ত, অপরিমেয়।
ঘাড় হেঁট করে নিজের দুনিয়ায় ফিরে গেল বিদ্রূপ। যে দুনিয়ায় বিদ্রূপ স্বয়ং ভগবান, যে দুনিয়ায় তার ভাবনা বোঝার জীব আছে, সমস্যা সমাধান করার প্রতিভা আছে, বিপদে বুদ্ধি দেওয়ার শক্তি আছে—নিওটেরিকস্দের ক্ষুদে ব্রহ্মাণ্ডে গিয়ে আবার কাজে তন্ময় হয়ে গেল বিদ্রূপ ব্রহ্ম।
সপ্তাহ ফুরোনোর আগেই রেডিওফোনে ধুন্ধুমারকে ডাক দিল বিদ্রূপ। ধুন্ধুমার বিলক্ষণ বিস্মিত হল। কেননা, দু দিন দ্বীপে থাকার সময়ে টিকি দেখা যায়নি বিদ্রূপের। অনেকটা কাজ এগিয়ে গেছে। জাহাজভর্তি কুলি আর মালমসলা এসে পৌঁছতেই চলে এসেছে ধুন্ধুমার। অবশ্য রেডিও মারফৎ যোগাযোগ রয়েছে চীফ ইঞ্জিনীয়ারের সঙ্গে। চীফ ইঞ্জিনীয়ার ঘটকৰ্পর লোকটা খারাপ নয়। কিন্তু মডেল দেখে বেচারীর আক্কেল গুড়ুম হয়ে গিয়েছিল। কি করতে হবে বোঝেনি—শুধু জানত মালিকের হুকুম মতো মডেলটাকে হুবহু নকল করতে হবে। নেহাৎ ব্যাংকের টাকার সীমা নেই, নইলে এই সব বড় বড় বিদ্যেদিগগজদের আর খুনে গুণ্ডাদের ভাড়া করে আনা কোনমতেই সম্ভব হত না।
প্রথমে মডেলটা দেখেই ঘটকর্পর শুধু নাচতে বাকি রেখেছিল। চোখ দুটো শামুকের চোখের মত ঠেলে বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়েছিল। প্রবল ইচ্ছে হয়েছিল বন্ধুবান্ধবকে বিশ্বের এই বিস্ময় সম্পর্কে যৎকিঞ্চিৎ সংবাদ পরিবেশন করার। কিন্তু দ্বীপে রেডিওসেট ছিল মাত্র একটি। তাও বেতারে বাঁধা ছিল ধুন্ধুমারের ব্যাংকস্থিত প্রাইভেট অফিসের রেডিওর সঙ্গে। দ্বীপে আর দ্বিতীয় ট্রান্সমিটার রাখার হুকুম ছিল না। ধুন্ধুমার কড়া ফতোয়া জারি করেছিল, রেডিও ট্রান্সমিটার দেখলেই যেন গুঁড়িয়ে ফেলা হয়। হুকুম তামিল করার জন্যে দেদার পাহারাদার মোতায়েন করেছিল। দুজন কর্মীর পেছনে একজন করে দাগী খুনে সবসময়ে ঘুরত। এই ব্যবস্থা টের পাওয়ার পরেই বুদ্ধিমান ঘটকৰ্পর বুঝেছিল, ধুন্ধুমার তাকে কয়েদ করেছে দ্বীপে। রাগও হয়েছিল। কিন্তু সে রাগ দুর্বাসার রাগ। যখন মনে পড়ল, কয়েদ হওয়ার মাসিক মাইনে নগদ এক লক্ষ টাকা, তখন থেকেই রাগ জল হয়ে গেল। তবে দুজন কুলি আর একজন ইঞ্জিনীয়ার ঘটকর্পরের মতো দার্শনিক হতে পারে নি। দ্বীপে পৌঁছোনোর দিন দুয়েক পরেই বিদ্রোহী হয়েছিল। ফলে রাতারাতি তিনজনেই যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল। গভীর রাতে অবশ্য পরপর পাঁচবার পিস্তল-নির্ঘোষ শোনা গেছিল। কিন্তু পরের দিন সকালে তা নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করেনি। নতুন ঝামেলাও হয় নি।
বিদ্রূপের গলা শুনে অবাক হলেও কথায় সুরে তা প্রকাশ করল না ধুন্ধুমার। গা-জ্বালানো হাসি হেসে শুধোল—“বৎস! কি করতে পারি তোমার জন্যে?”
“শ্রাদ্ধ!” ঠাণ্ডা গলায় বলল বিদ্রূপ। স্বর শুনে মনে হল না ঠাট্টা করছে। রাগ, দ্বেষ, অভিমানের চিহ্নমাত্র ছিল না সে স্বরে। বলল—“তোমার চেলাচামুণ্ডাদের সাবধান করে দাও। আমার আস্তানার পঞ্চাশ গজ উত্তরে যে সাদা দাগটা টেনেছি দ্বীপের এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত তা পেরোনোর চেষ্টা করলেই মারা পড়বে।”
“সাবধান করবো কেন? ওদেরকে তো বলাই আছে তোমার ছায়াও মাড়াবে না।”
“সাধু। এবার সাবধান করে দাও। ল্যাবোরেটরী ঘিরে ইলেকট্রিক ফিল্ড বসিয়েছি। যে ছোঁবে, সে মরবে। খামোকা খুন করতে চাই না বলেই জানিয়ে রাখলাম।”
“ভালোই করেছ। কিন্তু এত কাণ্ডর দরকার ছিল না। তোমার মতো ছুঁচোর গর্তে নাক গলানোর মতো প্রবৃত্তি—”
থেমে গেল ধুন্ধুমার। কেননা সুইচ অফ করে দিয়েছে বিদ্রূপ। মিছিমিছি ডাকাডাকি না করে ঘটকর্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করল ধুন্ধুমার। বলে দিল, সাদা দাগের কাছে যেন কেউ না যায়। ঘটকর্পর সব শুনল। পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারল না। কিন্তু কথা দিল, লোকজনকে এখুনি সাবধান করে দেওয়া হচ্ছে। ধুন্ধুমার মনে মনে ভাবল, ঘটকর্পর লোকটা বাস্তবিকই মন্দ নয়। সেই সঙ্গে মনটা একটু খারাপ হল। কেননা, প্লান্ট বসানো শেষ হলে নরবলির যে ফর্দটা বানিয়ে রেখেছে ধুন্ধুমার, তার প্রথমেই রয়েছে ঘটকর্পরের নাম।
কিন্তু সমস্যা তো বিদ্রূপকে নিয়ে। নিছক আত্মরক্ষার খাতিরে হাতিয়ার বানাক, ক্ষতি নেই। আত্মরক্ষা ছাড়াও যেদিন আক্রমণের কথা ভাবতে বসবে, সেদিন ও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। প্লান্টটা মানে মানে শেষ করতে পারলে হয়। তারপর বিদ্রূপকে একহাত নেওয়া যাবে’খন। ধুন্ধুমার একটা নীতিতে বিশ্বাসী। অত্যন্ত সহজ নীতি। তাঁবেদার নয় অথচ জিনিয়স—এমনি কোন অসাধারণ ব্যক্তিকে ধারে কাছে বরদাস্ত করে না ধুন্ধুমার। করাটা সাংঘাতিক বিপজ্জনক। বিদ্রূপ যদ্দিন নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত, তদ্দিন পাওয়ার ট্রান্সমিটার আর ধুন্ধুমারের আকাশচুম্বী উচ্চাশা নিরাপদ।
দ্বীপের উত্তরে এলাহি কাণ্ডকারখানা শুরু হবার পর মাত্র একবারই আস্তানা ছেড়ে বেরিয়ে ছিল বিদ্রূপ। তাও অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর। কাজ বাগানোর কৌশল ও জানে না। এ ব্যাপারে নেহাতই আনাড়ি। তাই একদিন রেডিওফোনে ডাক দিল ধুন্ধুমারকে। বলল, এই যে বিরাট ব্যাপারটা হচ্ছে, এটা তো একটু তদারক করা দরকার। ট্রান্সমিটারে যদি সামান্য ভুল থেকে যায় তাহলে সৃষ্টি রসাতলেও যেতে পারে। তাই কাজ মোটামুটি শেষ হয়ে গেলে বিদ্রূপ দেখে আসুক না কেন? তবে হ্যাঁ, তদারকির সময়ে ওকে কেউ যদি খতম করে দেয়, তাহলে ফাইনাল রিপোর্ট আর কোন দিনই পৌঁছোবে না ধুন্ধুমারের কাছে। কাজেই যাতে বিনা আঁচড়ে আস্তানায় ফিরে আসতে পারে বিদ্রূপ সে ব্যবস্থা করতে হবে।
রাজী হল ধুন্ধুমার। বিদ্রূপ সুইচ টিপে ইলেকট্রিক ফিল্ড তুলে নিল। রওনা হল দ্বীপের উত্তরে।
প্লান্ট দেখে তো কুল কুল করে ঘাম দিতে লাগল বিদ্রূপের বুকের মধ্যে যেন দুরমুশ পড়তে লাগল। মুষল পেটানো চলল মাথার মধ্যেও। একী সৃষ্টি করেছে নিওটেরিক্সরা? চারফুটের পুঁচকে মডেলটা শত শত গুণ বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। চার ফুট মডেলের মধ্যে যে সব তারের আর কয়েলের জটিলতা ছিল তার প্রতিটি অতিকায় আকারে দেখানো হয়েছে। নিওটেরিক্সদের সূক্ষ্মতা মানুষের হাতে দানবীয় অনুপাতে বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রায় তিনশ ফুট উঁচু একটা বিরাট ইস্পাতের মধ্যে ঠাসা রয়েছে চোখ ধাঁধানো মাথাঘোরানো যন্ত্রপাতির জটিলতা। চূড়ায় রয়েছে একটা বল। পালিশ করা চকচকে সোনালী ধাতুর তৈরি। এই হল পাওয়ার ট্রান্সমিটারের অ্যান্তেনা। এইখান থেকেই বিচ্ছুরিত হবে হাজার হাজার সূক্ষ্ম, নিরেট, আতীব্র রশ্মিরেখা। শক্তি-রশ্মি। যে কোনো দূরত্বে অবস্থিত হাজার হাজার রিসিভার দিয়ে ধরে নেওয়া যাবে সেই রশ্মি। রিসিভারগুলোও নাকি তৈরি হয়ে গেছে। ঘটকর্পর ওদিকের খবর বিশেষ রাখে না, তাই বিস্তারিত বলতে পারল না বিদ্রূপকে। বিশাল ট্রান্সমিটারের প্রতিটি অংশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করল বিদ্রূপ। সব শেষে ঘটকর্পরের দু হাত জড়িয়ে ধরল।
বলল—“আমি কিন্তু এ জিনিস এখানে গড়তে চাইনি। এখনও চাই না। তা সত্ত্বেও বলব, যা দেখলাম, তা ভোলবার নয়।”
“যিনি এর স্রষ্টা, তাঁকেও ভোলবার নয়।”
মুখ লাল হয়ে গেল বিদ্রূপের। অস্ফুট কণ্ঠে বললে—“আমি… আমি না… আমি এর স্রষ্টা নই। স্রষ্টা যারা তাদের দেখতে চান তো—আচ্ছা, আসি।” মুখ ফসকে আরো কিছু বেরিয়ে যাবার আগেই চম্পট দিল বিদ্রূপ।
পেছন থেকে একজন স্টেনগানধারী প্রহরী তাগ করতে করতে বলল—“দোব না কি শেষ করে?”
হাতের ঝাপটায় স্টেনের নল নামিয়ে দিল ঘটকর্পর। বলল—“না, না, না।” তারপর কিছুক্ষণ মাথা চুলকালো। আপন মনেই বলল—“আশ্চর্য! এই লোকটাই তাহলে দ্বীপের রহস্য, একে নিয়েই যত আতংক। কিন্তু দেখে তো মনে হল না? এরকম খাসা মানুষ তো লাখে একটা মেলে না!”
সর্বশেষ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে দিল্লী শহর মাটির সাথে মিশে যায়। লাভের তুলনায় ক্ষতির পরিমাণ অতি সামান্য। কেননা, এই শেষ যুদ্ধের পরেই দুই দেশ মিলে এক হয়ে যায়। গড়ে ওঠে পুরানো ভারতবর্য।
নয়াদিল্লীর ধ্বংসস্তুপের ওপর তৈরি হয় নতুন রাজধানী—নব-মগধ। প্রেসিডেন্ট মহাপদ্ম নবরত্ন ক্যাবিনেট নিয়ে প্রচণ্ড দাপটে দেশ শাসন করতে থাকেন।
নব-মগধের সরকারী ভবন বৃত্তাকার একটি কক্ষে বসে রয়েছে প্রেসিডেন্ট মহাপদ্ম, স্থল, জল ও আকাশ বাহিনীর তিন সেনাধ্যক্ষ, এবং একজন নাগরিক। প্রেসিডেন্টের টেবিলের তলায় রয়েছে একটা লুকোনো ডিকটাফোন। চারজনের মধ্যে যা-যা কথা হচ্ছে, তার প্রতিটি শব্দ ধরা পড়ছে ডিকটাফোনে। হাজার মাইল দূরে একটা রেডিও রিসিভারের ওপর হুমড়ি খেয়ে বসে রয়েছে ধুন্ধুমার। নাগরিকের পকেটে লুকোনো দেশলাইয়ের বাক্সের মতো ক্ষুদে ট্রান্সমিটার মারফৎ সব কথাই চলে আসছে রেডিও রিসিভারে। কান খাড়া করে তাই শুনছে ধুন্ধুমার।
তিন সেনাধ্যক্ষের একজন কথা বলছিল।
“মিষ্টার প্রেসিডেন্ট, জিনিসটা সম্পর্কে এই ভদ্রলোক যা-যা ‘অসম্ভব দাবী’ করছেন, তার প্রতিটি সত্য। খাঁটি সত্য। প্রত্যেকটি দাবী উনি প্রমাণ করেছেন আমাদের সামনে।”
জুল জুল করে নাগরিক ভদ্রলোকের দিকে তাকালেন প্রেসিডেন্ট মহাপদ্ম। পরক্ষণেই সেনাধ্যক্ষের দিকে ফিরে বললেন—“প্রমাণের নমুনা শুনি।”
খাকী রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছল আরেকজন সেনাধ্যক্ষ। বলল—“বিশ্বাস করা না করা আপনার অভিরুচি। কিন্তু এর মধ্যে মিথ্যে নেই। নন্দিকেশ্বর বাবুর হাতে এই যে সুটকেশটা দেখছেন, এর
মধ্যে আছে ডজন তিন চার ছোট ছোট… ইয়ে… বোমা—”
“উহুঁ, ওর নাম বোমা নয়।” আলপিন দিয়ে দাঁত খুঁটতে বলল নন্দিকশ্বের নামধারী নাগরিক।
“তা ঠিক। এ জিনিস বোমা নামের অযোগ্য। কেননা, নন্দিকেশ্বরবাবু দুটো ‘ইয়ে’ নেহাইয়ের ওপর রেখে কামারের হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়েছেন, কিছু হয় নি। আরও দুটোকে ইলেকট্রিক চুল্লীর মধ্যে ফেলে দিয়েছেন, ফাটে নি। একবাক্স দেশলাইয়ের মতো ফস করে জ্বলে গেছে। একটাকে মাঠে ফেলে দূর থেকে গুলি করা হয়েছে—কিসসু হয় নি।” বলে, আবার ঘাম মুছতে মুছতে তৃতীয় সেনাধ্যক্ষের দিকে তাকাল বক্তা।
তৃতীয় জন শুরু করল—“প্রমাণ পাওয়া আরম্ভ হল তারপর থেকেই থর মরুভূমিতে একটা ‘ইয়ে’ ফেলে জেট প্লেনে উঠে গেলাম তিরিশ হাজার ফুট ওপরে। সেখান থেকে কলকাঠি নাড়লেন নন্দিকেশ্বরবাবু। মুঠোর মত এতটুকু একটা ডিটোনেটর দিয়ে ‘ইয়ে’-টাকে ফাটিয়ে দিলেন। এরকম বিস্ফোরণ আমি জীবনে দেখি নি। চার মাইল জমি লাফিয়ে উঠে এল আমাদের দিকে। বিস্ফোরণের ধাক্কা কয়েক শ মাইল দূরে আপনার কাছেও পৌঁচেছে নিশ্চয়।”
“তা পৌঁচেছে,” বললেন প্রেসিডেন্ট। “পৃথিবীর উল্টোদিকের সিসমোগ্রাফেও ভূকম্পন পৌঁচেছে।”
“আধমাইল গভীর গর্ত হয়ে গেছে থর মরুভূমিতে। ইচ্ছে করলে নন্দিকেশ্বরবাবু ঘরে বসেই একটা গোটা শহর উড়িয়ে দিতে পারেন!”
“আরও আছে,” বলে উঠল আরেকজন সেনাধ্যক্ষ। “নন্দিকেশ্বরবাবুর মোটরেও এমনি একটা পুঁচকে প্লান্ট বসানো আছে। মোটরে জ্বালানির কোন ট্যাঙ্কই নেই। ইঞ্জিন জাতীয় কিছুই নেই। শুধু আছে একটা পাওয়ার প্লান্ট। লম্বায় চওড়ায় ছ’ইঞ্চি। উচ্চতাতেও তাই। কিন্তু ওই পুঁচকে জিনিসটার শক্তি যে কি সাংঘাতিক, তা না দেখলে আপনার বিশ্বাস হবে না। আমাদের আর্মি ট্যাঙ্ক মোটরটাকে টেনে রাখতে পারেনি। উল্টে মোটরটাই ট্যাঙ্ককে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে গেছে!”
“আরও আছে,” তৃতীয় সেনাধ্যক্ষ বলল উত্তেজিতভাবে। “খাজাঞ্চিখানার মত একটা নকল ট্রেজারী ভল্টে নন্দিকেশ্বরবাবু ‘ইয়ে’ রেখেছিলেন। ভল্টের এক-একটা দেওয়াল বিশ ফুট পুরু কনক্রিটের। একশ’গজ দূরে থেকে ‘ইয়ে’-টাকে কন্ট্রোল করলেন নন্দিকেশ্বরবাবু। ফলে বোমার মত ফেটে গেল আস্ত ভল্টটা। না, না, ঠিক বিস্ফোরণ বলা যায় না… মনে হল, যেন একটা অবিশ্বাস্য রকমের প্রচণ্ড শক্তি ভেতর থেকে ফুলতে ফুলতে চার দেওয়ালকে ঠেলে ফেলে দিয়ে বেরিয়ে এল। দেওয়াল চৌচির হয়ে গেল, পাউডার হয়ে গেল। ষ্টীলের খাঁচাগুলো ঝাঁটার কাঠির মত ফালিফালি হয়ে গেল। ফুঁ দিতে যেটুকু সময় লাগে, সমস্ত ঘটনাটা ঘটল তার মধ্যে। এই কাণ্ডর পর নন্দিকেশ্বরবাবু আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। ‘ইয়ে’গুলো যে সাধারণ কিছু নয়, তা আমরা টের পেয়েছি। কিন্তু ইনি বলছেন, এ ছাড়াও নাকি ওঁর আরও কি বলার আছে। বিশেষ কথা। আপনার সামনে ছাড়া বলা যায় না।”
কালো মেঘের মত থমথমে মুখ তুললেন প্রেসিডেন্ট মহাপদ্ম। বললেন—“বলুন, কি বলবেন, নন্দিকেশ্বরবাবু।”
উঠে দাঁড়াল নন্দিকেশ্বর। সুটকেশ খুলে বার করল একটা লালচে বাক্স। অনেকটা কম্বলের মত রোঁয়া ওঠা বস্তু দিয়ে মোড়া। হাল্কা। লম্বায় আট ইঞ্চি। চওড়ায় আট ইঞ্চি। উচ্চতায় আট ইঞ্চি।
দেখেই বাকি চারজনে সরে বসল। মুখ দেখেই বোঝা গেল, নাভার্সনেস।
নন্দিকেশ্বর বললে—“মিস্টার প্রেসিডেন্ট, সবই শুনলেন। অথচ, এখনও কিছু শোনেননি। এঁরা তিনজনে যা দেখেছেন, তা কিছুই নয়। যেমন ধরুন কত সূক্ষ্মভাবে যে এ জিনিস কন্ট্রোল করা যায়, সে বিষয়ে আপনি কিছুই জানেন না। আমি দেখাচ্ছি।” বলে, একপাশের একটা পুঁচকে বোতাম টিপে দিয়ে চৌকোনা বস্তুটাকে রাখল প্রেসিডেন্টের টেবিলে।
“একটা কথা আপনারা বার বার জিজ্ঞেস করেছেন। জানতে চেয়েছেন, এ আবিষ্কার আমার না, অন্য কারুর। দ্বিতীয়টাই সত্যি। আমি একজনের প্রতিনিধি। আরও শুনুন, এ জিনিস এই মুহূর্তে যিনি কন্ট্রোল করছেন তিনি কিন্তু বসে রয়েছেন এখান থেকে হাজার মাইল দূরে। একে ফাটানোর ক্ষমতা এখন একমাত্র তাঁর হাতেই রয়েছে,” বলে সুটকেশ থেকে সিগারেট লাইটারের মত একটা জিনিস বার করে রাখল টেবিলে। এক পাশের একটা পিন টিপে দিয়ে বললে—“ডিটোনেটর চালু করে দিলাম। এখন বিস্ফোরণ রোধ করা না করা একজনের মর্জির ওপরেই নির্ভর করছে। প্লেন থেকে আপনারা যে রকম দেখেছিলেন, ঠিক সেইরকমভাবে গোটা রাজধানীটা গুঁড়ো হয়ে যাবে এখন থেকে ঠিক চার ঘণ্টা পরে।” বলে পিছিয়ে এল নন্দিকেশ্বর। হাত বাড়িয়ে ডিটোনেটরের একটা ক্ষুদে সুইট টিপে দিয়ে বললে—“যদি এর তিন ফুটের মধ্যে কেউ আসে, অথবা, আমি ছাড়া আর কেউ ঘর ছেড়ে বেরোনোর চেষ্টা করেন, তাহলেও বিস্ফোরণ ঘটবে। চার ঘণ্টা বসে থাকতে হবে না। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার পর কেউ যদি আমার গায়ে হাত দেয় তাহলেও জানবেন সঙ্গে সঙ্গে উড়ে যাবে আপনাদের সাধের নবমগধ। গুলি করে মারবেন? গুলি আমার গায়ে লাগার তিন সেকেণ্ডের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটবে—রুখতে পারবেন না।”
সেনাবাহিনীর তিন অফিসার—বোবা হয়ে বসে রইল। একজন শুধু খাকী রুমাল বার করে কপালের ঘাম মুছতে লাগল। বাকি দুজন মনে হল যেন কেষ্টনগরের মাটির পুতুল।
মোলায়েম গলায় শুধোলেন প্রেসিডেন্ট—“কিন্তু কেন?”
“বলছি। আমি যাঁর প্রতিনিধি বিশেষ কারণে তিনি আড়ালে থাকতে চান,
তিনি চান, আপনি তাঁর হুকুম তামিল করুন। তাঁর পছন্দমত ক্যাবিনেট মেম্বার নির্বাচন করতে হবে। তাঁর খুশীমত আপনার ক্ষমতা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে হবে। এই গোপন চুক্তির বিষয় কিন্তু আমরা ছাড়া আর কেউ জানবে না। পাবলিক তো নয়ই, এমন কি কোনো পলিটিক্যাল পার্টিও নয়। এই প্রস্তাবে যদি রাজী থাকেন, আপনাদের ভাষায় বোমা নামে এই বস্তুটা ফাটবে না। শুধু এই একটাই নয়। সারাদেশে এরকম হাজার হাজার ‘বোমা’ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে—সেগুলোও ফাটবে না। চেহারা দেখলে ধরতে পারবেন না। কাছে গেলেও বুঝতে পারবেন না। বুঝবেন তখনি, যখন অবাধ্য হবেন। চুক্তিভঙ্গ হলেই একে একে ফাটতে থাকবে ‘বোমাগুলো এক একটা শহর উড়ে যাবে। চার মাইলের মধ্যে যা কিছু থাকবে, ছাতু হয়ে যাবে।
“এখন থেকে ঠিক তিন ঘণ্টা পঞ্চাশ মিনিট পরে, মানে, কাঁটায় কাঁটায় সাতটার সময়ে ‘বিবিধ ভারতী’র কমার্শিয়াল রেডিও প্রোগ্রাম আছে। ঘোষককে বলবেন, সময় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ‘রাজী’ শব্দটা বলতে। কেউ বুঝবে না—শুধু এই বাক্স বোমা যিনি কন্ট্রোল করছেন তিনি ছাড়া। আমার পাছু নেওয়ার চেষ্টা করবেন না। লাভ নেই। কেননা, যাঁর হুকুমে এখানে এসেছি, তাঁর সঙ্গে আর আমার দেখা হবে না। যোগাযোগও হবে না। আর কিছু বলার নেই। নমস্কার।”
পাকা রিপ্রেজেনটেটিভের মতোই খটাৎ করে সুটকেশ বন্ধ করল নন্দিকেশ্বর। ওজন করা হাসি হেসে গটগট করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। চার দিকপাল কাষ্ঠপুত্তলিকাবৎ বসে রইল। ভয়ার্ত দৃষ্টি রইল লালচে রঙের রোঁয়া-ওঠা ভয়ংকর বাক্সটার ওপর।
মিনিটখানেক পরে প্রেসিডেন্ট বললেন—“হুমকিটা সত্যি না মিথ্যে? কি মনে হয় আপনাদের?”।
“সত্যি,” তিনজনেই বলল একসাথে। টেলিফোন রিসিভারের দিকে হাত বাড়ালেন প্রেসিডেন্ট মহাপদ্ম। যেন একটা রুদ্ধশ্বাস নাটক। নাটকের প্রতিটি সংলাপ আড়ি পেতে শুল ধুন্ধুমার সাহা। হাজার মাইল দূরে ব্যাংকের ভল্টে মস্ত টেবিলে বসে শুনল সব। কিন্তু জানতেও পারল না চোরের ওপর বাটপারি হয়ে গেল। অর্থাৎ আরও এক ব্যক্তি আড়ি পেতে শুনল গোপন চুক্তির প্রস্তাব।
ধুন্ধুমারের পাশেই ছোট্ট টুলের ওপর বসানো বিদ্রূপের রেডিওফোন আপনা হতেই চালু হয়ে গিয়েছিল। বহু দূরে দ্বীপে বসে বিদ্রূপ তাই ভাবল, ভাগ্যিস অটোমেটিক ব্যবস্থাটা আবিষ্কার করেছিলাম। নইলে তো এই সাংঘাতিক কাণ্ড জানতেও পারতাম না।
সকাল থেকেই ধুন্ধুমারকে ডাকবার ইচ্ছে ছিল বিদ্রূপের। কিন্তু কিছুতেই
মনস্থির করে উঠতে পারছিল না। ইঞ্জিনীয়ার ঘটকর্পর ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করে খুশী হয়েছে বিদ্রূপ। লোকটার ব্যক্তিত্ব আছে। মনে দাগ রেখে যায়। শুধু তাই নয়। বয়স অল্প হলে কি হবে, ঘটকর্পর খাঁটি বৈজ্ঞানিক। কাজ নিয়ে তার যে সাধনা বিদ্রূপ দেখে এসেছে, তা সাধারণ লোকের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই জীবনে এই প্রথম ব্যক্তিবিশেষের সঙ্গে আবার দেখা হওয়ায় আশায় উন্মুখ হয়েছিল বিদ্রূপ। ভাবছিল, কি করে আরও কিছুক্ষণ কথা বলা যায় ঘটকর্পরের সঙ্গে। কিন্তু ওকে ল্যাবোরেটরীতে আনলে বিপদ আছে। ধুন্ধুমার যখনি জানবে বিদ্রূপের সঙ্গে বেশি মাখামাখি করছে ইঞ্জিনিয়ার, ধরে নেবে দল পাকাচ্ছে। তৎক্ষণাৎ বেচারীকে প্রাণে মেরে দেবে। বিদ্রূপ নিজেও যদি প্লান্টে যায় দেখা করতে, হয়তো গুলি খেয়েই পরলোকে যেতে হবে।
সারাদিন এই নিয়ে মনের সঙ্গে লড়াই করল বিদ্রূপ। শেষকালে মরিয়া হয়ে ঠিক করল, কপালে যা থাকে থাকুক, ধুন্ধুমারকে ডাকা যাক। ভাগ্য ভাল বিদ্রপের, সিগন্যাল না দিয়েই রিসিভার চালু করেছিল। দপ করে জ্বলে উঠেছিল লাল আলো। অর্থাৎ ধুন্ধুমারের ট্রান্সমিটারও চালু হয়েছে।
ফলে, হাজার হাজার মাইল দূরে প্রেসিডেন্টের চেম্বারে যা-যা ঘটল, সব কিছুই রোমাঞ্চিত কলেবরে শুনল বিদ্রূপ। বুঝল, সর্বনাশ হয়ে গেছে। হতভাগা ধুন্ধুমারের মাইনে করা ইঞ্জিনীয়াররা. ক্ষুদে ক্ষুদে আধারের মধ্যে পাওয়ার রিসিভার বসিয়েছে। এক-আধটা নয়; হাজার হাজার; হয়ত লাখ খানেকও নিরীহদর্শন রিসিভারগুলোর নিজস্ব কোন শক্তি নেই। ওদের শক্তি রয়েছে এই দ্বীপে। দানবীয় ট্রান্সমিটার থেকে শক্তি আহরণ করে প্রলয় সৃষ্টি করেছে থর মরুভূমিতে। বেতারে কোটি কোটি হর্স পাওয়ার শক্তি বিচ্ছুরণ করে চলেছে ট্রান্সমিটার। কল্পনাতীত সেই শক্তির কিছুটা অথবা পুরোটা গ্রহণ করার ক্ষমতা এই হাজার হাজার রিসিভারের মধ্যে রয়েছে।
বিষম আতংকে থর থর করে কাপতে লাগল বিদ্রূপ ব্ৰহ্ম। বোবার মতো দাঁড়িয়ে রইল রিসিভারের সামনে। করবার কিছু নেই। পাওয়ার প্লান্ট ধ্বংস করার একটা উপায় হয়ত উদ্ভাবন করা যেতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে গভর্ণমেন্ট হানা দেবে দ্বীপে। নিওটেরিক্সদের রহস্য আর রহস্য থাকবে না।
রিসিভারে আর একটা শব্দ শোনা গেল। কমার্সিয়াল রেডিও প্রোগ্রাম। কিছুক্ষণ যন্ত্রসংগীতের পর ঘোষকের ভরাট স্বর। বিখ্যাত এক ঘড়ির বিজ্ঞাপনের পর কিছুক্ষণ বিরতি। তারপর:
“আকাশবাণী, বিবিধ ভারতীর এই কমার্সিয়াল প্রোগ্রাম প্রচারিত হচ্ছে নব-মগধ স্টেশন থেকে।”
এরপর তিন সেকেণ্ড নৈঃশব্দ্য। অসহ্য উৎকণ্ঠা।
“এখন আমাদের ঘড়িতে… ইয়ে… রাজী…। এখন আমাদের ঘড়িতে ঠিক সাতটা বাজে।”
পরক্ষণেই শোনা গেল একটা শেয়ালের মতো খ্যাঁক খ্যাঁক হাসি। মানুষ পাগল হয়ে গেলে এমনি হাসি হাসে। ধুন্ধুমার যে একরম অর্ধোন্মাদের মতো হাসতে পারে, স্বকর্ণে শুনেও বিদ্রূপ যেন তা বিশ্বাস করতে পারছিল না। ফোনে কড় কড় শব্দ শোনো গেল। ধুন্ধুমার বলছে?
“শস্ত্রপাণি? অল ক্লিয়ার। এবার বেরিয়ে পড়ো। পুরো স্কোয়াড্রন নেবে। দ্বীপের যেখানে বলেছিলাম, যেখানে বোমা ফেলবে। খবরদার, প্লান্টের যেন ক্ষতি না হয়। বাদবাকি সব কিছু ধুলো করে দেবে। চটপট কাজ সারবে। কাজ শেষ হলেই ফিরে আসবে।”
নিদারুণ আতংকে মৃগীরুগীর মতো ছিটকে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল বিদ্রূপ। কম্পাউণ্ড পেরিয়ে বায়ুবেগে দৌড়োলো কন্ট্রোল চেম্বারের দিকে। প্লান্ট থেকে সওয়া মাইল দূরে ইঞ্জিনীয়ার আর কুলিদের ছাউনি। পাঁচশ নিরীহ লোক মরতে চলেছে। কারণ ওদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। বিদ্রূপেরও প্রয়োজন ফুরিয়েছে ধুন্ধুমারের কাছে।
এখন এ দ্বীপে একমাত্র নিরাপদ জায়গা হল প্লান্ট। প্রাণে বাঁচবার একমাত্র আশ্রয়। নিওটেরিকস্দেরও বাঁচাতে হবে। যেভাবেই হোক। এক-এক লাফে তিন চারটে ধাপ টপকে কন্ট্রোল চেম্বারে পৌঁছোলো বিদ্রূপ। সামনেই যে টেলিটাইপ পড়লো, হুমড়ি খেয়ে পড়ল তার ওপর। খটাখট শব্দে হুকুম পাঠালো—“একটা দুর্ভেদ্য ঢাল চাই। জরুরী!”
নিওটেরিকস্দের ভাষায় আদেশটা ফুটে উঠল ওদের মন্দিরে। কি যে লিখল বিদ্রূপ, তা ও নিজেই বুঝল না। দুর্ভেদ্য ঢাল বলতে যে কি বোঝায়, মানস চক্ষে তা দেখবার ফুরসৎও পেল না। আত্মরক্ষার তাগিদে যা বলবার তা বলেই বেগে বেরিয়ে এল বাইরে। নিওটেরিকস্রা নিজেরা প্রাণে বাঁচুক। ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে লাগল প্লান্টের দিকে—সাদা দাগের মারণ গণ্ডীর ওপরেই এসে পড়ল একটা পা।
ঠিক মশার মতো দেখতে নটা উড়োজাহাজের একটা স্কোয়াড্রন নিঃশব্দে বেরিয়ে এল পর্বতকন্দর থেকে। নিঃশব্দে ছুটে এসে নিঃশব্দে উঠে পড়ল আকাশে। ইঞ্জিন নেই—তাই কোনো শব্দ শোনা গেল না। মশা-প্লেনের মধ্যে শক্তির উৎস বলতে ছিল একটা ছ ইঞ্চি মাপের চৌকোনা বাক্স। দ্বীপে থেকে আকাশপথে পাঠানো শক্তি-রশ্মি আহরণ করে এই পুঁচকে বাক্সটাই শব্দের চেয়ে বেশি গতিবেগে প্লেনকে উড়িয়ে নিয়ে চলল দ্বীপের দিকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই
নিচে দ্বীপ দেখা গেল। মাইক্রোফোনের সামনে হুকুম দিল স্কোয়াড্রন-লীডার।
“আগে ব্যারাক। তারপর দক্ষিণ দিক।”
দ্বীপের ঠিক মাঝখানে একটা টিলার ওপর একা দাঁড়িয়ে ছিল ঘটকৰ্পর। হাতে একটা ক্যামেরা। দ্বীপ থেকে মুক্তি অসম্ভব জেনেও ছবি তোলার হবি ছাড়তে পারেনি। ছবি মানে নৈসর্গিক দৃশ্য নয়। বিভিন্ন কোণ থেকে তোলা প্লান্টের বিভিন্ন রকমের ছবির গাদা বানিয়ে ফেলেছিল ঘটকর্পর। শব্দহীন বিমানের আবির্ভাব প্রথমে খেয়াল হয় নি। টনক নড়ল তখনি যখন এক ঝাঁকে বোমা এসে পড়ল ব্যারাকের ওপর। ইঁটকাঠ রক্ত মেদ মজ্জা মাংসর পিণ্ড সৃষ্টি করে দক্ষিণে উড়ে গেল নটা বিমান।
স্তম্ভিতের মতো পঁড়িয়ে রইল ঘটকর্পর। ত্রাস বিস্ফোরিত চোখে দেখল নটা অতিকায় মশার মতো বিমান পর পর আরও দুবার গোঁৎ খেয়ে উঠে পড়ল—দুঝাঁক বোমার বিস্ফোরণে থর থর করে কাঁপতে লাগল ছোট্ট দ্বীপ।
বোমাবর্ষণের ক্ষেত্র ক্রমশ দক্ষিণ দিকে সরে যাচ্ছে। তৃতীয় গোঁৎ দেখেই ঘটকৰ্পর বুঝল ওদের মতলব কী। কিন্তু কি করবে ও? করার কিছু নেই। তবুও টিলা থেকে দৌড়ে নেমে ছুটতে লাগল বিদ্রূপের আস্তানার দিকে। বেশি দূর যেতে হল না। একটা মোড় ঘুরতেই মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটল খর্বাকার বায়োকেমিস্টের সঙ্গে।
উত্তেজনায় পরিশ্রমে আতংকে অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল বিদ্রূপ। কোনো মানুষকে এভাবে পালটে যেতে কোনো দিন দেখে নি ঘটকৰ্পর। ফ্যাকাশে মুখে, বিস্ফোরিত চোখে, থর থর কম্পমান দেহে সে কী আকুলতা!
যেন মূর্তিমান বিহ্বলতা চোখের সামনে দেখল ঘটকর্পর। বোমা বিস্ফোরণের কর্ণবধিরকারী নির্ঘোষ ছাপিয়ে শোনা গেল বিদ্রূপের আর্ত চীৎকারঃ
“ধুন্ধুমার! ধুন্ধুমারের বিমান! খুন করবে সবাইকে!”
“প্লান্টের কি হবে?” নিরক্ত মুখ ঘটকর্পরের।
“প্লান্টে বোমা পড়বে না। কিন্তু আমার ল্যাবোরেটরীর কি হবে… বেঘোরে মারা পড়বে লক্ষ লক্ষ প্রাণী… কি করি… কোথায় যাই?”
“মিথ্যে ভাবছেন! আর সময় নেই।”
“না, না, এখনও সময় আছে। আসুন… হয় তো এখনো বাঁচাতে পারবো…!” বলেই তীরবেগে দৌড়োলো দক্ষিণ দিকে।
পেছনে লেগে রইল ঘটকর্পর। দূর থেকে ছুটন্ত বিদ্রূপের ক্ষুদে ক্ষুদে পা দুটো দেখে মনে হল যেন বিমানের প্রপেলার ঘুরছে। এমন সময়ে আর একবার গোঁৎ খেল গোটা স্কোয়াড্রনটা। আর এক ঝাঁক বোমা ফেলে সাঁ করে উঠে গেল। বোমাগুলো এসে পড়ল ঠিক সেইখানে যেখানে কয়েক মিনিট আগে মুখোমুখি ধাক্কা খেয়েছে দুই বিজ্ঞানী।
বনের মধ্যে থেকে বেরোতেই এক হ্যাঁচকায় বিদ্রূপের হাত ধরে মাঠের ওপর ফেলে দিল ঘটকর্পর। বিদ্রূপ আছড়ে পড়ল সাদা দাগের ঠিক ছফুট দুরে।
“এ কী… মানে কী…?”
“পাগল হলেন না কি? আর এগোলেই তো ইলেকট্রিক ফিল্ড! নিজের অস্ত্রে নিজেই মরতে চান?”
“ইলেকট্রিক ফিল্ড? কিন্তু একটু আগেই তো এখান দিয়ে গেছি আমি। দাঁড়ান, দাঁড়ান,” পাগলের মতো ঘাসের মধ্যে কি যেন খুঁজতে লাগল বিদ্রূপ। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা মস্ত গঙ্গাফড়িং পাকড়াও করে দৌড়ে গেল সাদা দাগের কাছে। ছুঁড়ে দিল মারণ গণ্ডীর ওপর দিয়ে। ঘাসের ওপর নিশ্চল হয়ে পড়ে রইল গঙ্গাফড়িং। | “দেখলেন তো? মরে গেছে” বলল ঘটকর্পর।
“না, মরে নি! ঐ দেখুন লাফাচ্ছে! আসুন, আসুন। ব্যাপার বুঝছি। নিওটেরিকস্রা ছাড়া ও ফিল্ড তুলে নেওয়ার ক্ষমতা আর কারো নেই। ফিল্ড তো আমি বানাই নি—ওরা বানিয়েছে।”
“কি বললেন? নিও—”
“পরে শুনবেন,” বলেই জ্যামুক্ত তীরের মতো বাঁই বাঁই করে ছুটতে লাগল বিদ্রূপ।
হাঁপাতে হাঁপাতে, ধড়ফড় করতে করতে, লম্বা লম্বা লাফে সিঁড়ি টপকে দুই ক্ষিপ্ত মূর্তি ঢুকল নিওটেরিকস্দের কন্ট্রোলরুমে। একটা টেলিস্কোপের ওপর ঝুঁকে পড়ল বিদ্রূপ এবং পরক্ষণেই বিপুল উল্লাসে হেসে উঠল হা হা করে—“পেরেছে! ওরা পেরেছে!”
“কারা?”
“আমার ছোট বন্ধুরা! আমার নিওটেরিকস্রা! দুর্ভেদ্য ঢাল ওরা বানিয়ে ফেলেছে! নিজের চেখেই তো দেখে এলেন, ফোর্স ফিল্ডও আটকে গেছে এই ঢালের কাছে! ভেতর থেকে কম্পন বেরোতে পারছে না। এই তো এখনও চালু রয়েছে ওদের জেনারেটর… ঢাল ক্রমশঃ ওপরে উঠছে! বেঁচে গেল! ওরা বেঁচে গেল! ওদের রক্ষা কবচ ওরা নিজেরাই বানিয়ে নিয়েছে।” আনন্দে ঋষিপ্রতিম বিদ্রূপ ব্রহ্ম এবার হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল।
আর, দুই চোখে সীমাহীন অনুকম্পা নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে হতাশভাবে মাথা নাড়তে লাগল ঘটকর্পর। বলল সহানুভূতির সুরে—“তাতো বটেই—আপনার ছোট্ট বন্ধুরা এখন নিশ্চিন্ত। কিন্তু আমরা নই,” বলার সঙ্গে সঙ্গে মেঝে কেঁপে উঠল—
শোনা গেল বোমা বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দ!
চোখ বন্ধ করে রইল ঘটকর্পর। সামলে নিল নিজেকে। অবশেষে উদগ্র কৌতূহলের কাছে ভয় হার মানল। বাইনাকুলার টেলিস্কোপে চোখ লাগিয়ে উঁকি দিল নিচের জগতে। কিন্তু ধূসর ধাতুর ঢালু চাদর ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না। এরকম পরিপূর্ণ ধূসরতা এর আগে দেখেনি ঘটকর্পর। নিবিড়। প্রশমিত। কোমল নয়, কড়া নয়। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মাথা ঘোরে। চোখ তুলল ঘটকর্পর।
দেখল, টেলিটাইপের চাবির ওপর ঝড়ের বেগে আঙুল চালিয়ে যাচ্ছে বিদ্রূপ। উদ্বেগ থর-থর চোখে তাকিয়ে আছে হলদে রঙের শূন্য ফিতেটার দিকে।
“একী হল! খবর পাঠাতে পারছি না কেন?” গুঙিয়ে উঠল বিদ্রূপ। “কেন এরকম গোলমাল হচ্ছে? কেন? কেন?—আর, তাই তো বটে!”
“কী হল?”
“ঢাল… ওদের ঢাল… পুরোপুরি দুর্ভেদ্য! টেলিটাইপের খবর তাই ওদের কাছে পৌঁচোচ্ছে না… আটকে যাচ্ছে ঢালে… পৌঁছোলে ওদের বলতাম ঢাল দিয়ে গোটা দ্বীপটাকে ঢেকে দিতে! ওরা সব পারে—ওদের অসাধ্য কিছু নেই।”
“ভয়ের চোটে পাগল হয়ে গেল লোকটা! বেচারা!” স্বগতোক্তি করল ঘটকর্পর।
আচম্বিতে নেচে উঠল টেলিটাইপ। দ্রুতছন্দে খটাখট শব্দে খবর আসছে। ঝাঁপ দিল বিদ্রূপ—দুহাত বাড়িয়ে যেন জাপটে ধরল হলদে ফিতের খবর। মেশিনের মধ্যে থেকে ফিতে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যেতে লাগল উচৈঃস্বরে। ঘটকর্পর দেখল বটে, কিন্তু হরফগুলো চিনতে পারল না। এ রকম কিম্ভুতকিমাকার হরফ সে জীবনে দেখেনি।
বিদ্রূপ তখন থেমে থেমে পড়ছে—“পরমপিতা, রুষ্ট হবেন না, দয়া করুন; আমাদের কথা শুনে তারপর শাস্তি দিন। আপনি যে পর্দা বানাতে হুকুম দিয়েছিলেন, আপনার হুকুম ছাড়াই সেই পর্দা সরিয়ে নিয়েছি। হে সর্বশক্তিমান! আমাদের দয়া করুন। আমরা দিশেহারা হয়ে গেছি। যে পর্দা আমরা বানিয়েছি, তা পুরোপুরি দুর্ভেদ্য। ফলে, শব্দযন্ত্রে আপনার বাণী আসাও বন্ধ হয়ে গেছিল। নিওটেরিকস্দের সৃষ্টির মুহূর্ত থেকে এ কাণ্ড কখনো ঘটেনি আপনার বাণী আপনার আদেশনামা ছাড়া আমরা জীবন ধারণ করি নি। আমাদের ক্ষমা করুন। সদয় হোন। আপনার নির্দেশের প্রতীক্ষায় আমরা ছটফট করছি।”
বিদ্রূপের দশ আঙুল নৃত্য করে উঠল টেলিটাইপের চাবির ওপর। রুদ্ধশ্বাসে ঘটকর্পরকে বলল—“যান… একবার দেখুন… চোখ দিন টেলিস্কোপে!”
মাথার ওপর অবধারিত মৃত্যুর গুঞ্জনধ্বনি উপেক্ষা করে টেলিস্কোপে চোখ দিল ঘটকর্পর।
দেখল এক আশ্চর্য দুনিয়া। দেখল, জমি। রূপকথার মতো। চাষ আবাদ চলছে যে জমিতে। দেখল, লোকজনের বসতি, কারখানা এবং জীবন্ত প্রাণী। অবিশ্বাস্য তৎপরতায় নড়ছে সেখানকার সব কিছু। বাসিন্দাদের পলকের জন্যও ভালোভাবে দেখতে পেল না—দেখল শুধু গোলাপী সাদাটে রঙের বিস্তর দ্রুতসঞ্চরমান রেখা—অসম্ভব বেগে ছুটোছুটি করছে বাসিন্দারা। বোবা বিস্ময়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো পুরো একমিনিট সেই ফ্যানটাসটিক জগতের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল ঘটকর্পর। আচম্বিতে পেছনে একটা শব্দ শুনতেই সম্বিৎ ফিরল। ফিরে দেখে, বিদ্রূপ। সহর্ষে হাত কচলাছে। পরমানন্দে মাড়ি বার করে হাসছে।
“হুকুম তামিল হয়ে গেল, শুনছেন তো?”
ঘটকৰ্পর কিন্তু কিছুই শুনতে পেল না। না আছে বোমারু বিমানের বাতাস কাটার শন শন শব্দ, না আছে বোমা বিস্ফোরণের আওয়াজ, না আছে নৈসর্গিক দুনিয়ার কাকলি। চারদিক নিথর নিস্তব্ধ।
এবং তখনি দারুণ চমকে উঠল ঘটকর্পর। মৃত্যুপুরীর মতো এমন নীরবতা কেন? দৌড়ে গেল জানলার কাছে। একটু আগেই যেখানে প্রদোষের ম্লান আভা ছিল এখন সেখানে নিবিড় তমিস্রা। গোধুলির পরিবর্তে রজনী।
—“এ কী ব্যাপার?”
ছেলেমানুষের মতো খিল খিল করে হাসতে লাগল বিদ্রূপ।
“দেখলেন তো নিওটেরিকস্দের কীর্তি? ঐ তো নিচের তলায় রয়েছে ওরা। আমার বন্ধু। ওরাই তো দুর্ভেদ্য ঢাল দিয়ে ঢেকে দিল গোটা দ্বীপটা। আমরা নিরাপদ। সবাই!”
বিস্ময় বিহ্বল ঘটকর্পর তখন ঝুড়ি ঝুড়ি প্রশ্ন নিক্ষেপ করে নাস্তানাবুদ করার উপক্রম করল বিদ্রূপকে। আর আনন্দে আটখানা হয়ে নিচের তলার মহাশক্তিশালী জাতির পূর্ণ বিবরণ ধীরে ধীরে তুলে ধরতে লাগল বিদ্রূপ ব্রহ্ম।
দুর্ভেদ্য খোলসে মোড়া দ্বীপের বাইরে পিলে চমকানো ঘটনা ঘটতে লাগল। আচমকা নটা এরোপ্লেনের শক্তি ফুরিয়ে গেল। একে একে আছড়ে পড়ল ধূসর খোলসের ওপর—গড়াতে গড়াতে সমুদ্রে পড়ে তলিয়ে গেল। যে পাইলটরা ককপিট থেকে জীবিত অবস্থায় বেরোতে পারল, তারাও তেলতেলে মসৃণ খোলসের ওপর দিয়ে পিছলে গিয়ে পড়ল সাগরে। আর উঠল না।
ভারতবর্ষের এক শহরে আচম্বিতে বিকল হয়ে গেল একটা অদ্ভুত মোটর।
মোটরে বসে ঠক ঠক করে কঁপতে লাগল নন্দিকেশ্বর নামে এক ব্যক্তি। কাঁপুনি আর ভয়ার্ত চোখ দেখে সাহস করে চারদিক থেকে ঘিরে ধরল গভর্ণমেন্টের সেপাই শান্ত্রী। প্রাণ হাতে নিয়ে কয়েকজন এগিয়ে এল আরও কাছে—কারণ যে কোনো মুহূর্তেই মহাপ্রলয় সৃষ্টি করতে পারে মর্কটসদৃশ নন্দিকেশ্বর। কিন্তু কিছুই হল না।
নব-মগধের একটি বিশাল কক্ষে উৎকণ্ঠার শেষ সীমায় পৌঁছে ক্ষেপে গেল এক উচ্চপদস্থ আর্মি অফিসার। ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মতো অকস্মাৎ দাঁড়িয়ে উঠে চেঁচিয়ে উঠল চিলের মতো—“আর পারিনা! যা হয় হোক!” বলেই ধেয়ে গেল প্রেসিডেন্টের টেবিলের দিকে, খপ করে লালচে রঙের রোঁয়া-ওঠা বাক্সটা তুলে নিয়ে মারল এক আছাড়; পরক্ষণেই ভারী জুতো পরে ধেই ধেই করে নাচতে লাগল বাক্সর ওপর। দেখতে দেখতে টুকরো টুকরো হয়ে গেল পলকা বাক্সটা।
দিন কয়েকের মধ্যে ব্যাঙ্কের ভল্ট থেকে ভগ্নহৃদয় এক বৃদ্ধকে নিয়ে যাওয়া হল পাগলাগারদে। এক হপ্তা পরে সেখানেই মারা গেল বৃদ্ধ।
ঢালটা কিন্তু বাস্তবিকই দুর্ভেদ্য; পুরোপুরি দুষ্প্রবেশ্য। পাওয়ার প্লান্টে আঁচড়টিও পড়ে নি। তাই সমানে শক্তি-রশ্মি বিচ্ছুরিত হতে লাগল প্লান্ট থেকে। কিন্তু রশ্মি বেরোতে পারল না; তাই তার শক্তিতে শক্তিমান যাবতীয় মেশিন বিকল হয়ে গেল। অবিশ্বাস্য এই কাহিনী জনসাধারণ কোনোদিন জানল না। অবশ্য বেশ কয়েক বছর নৌবাহিনীর তৎপরতা বেজায় বৃদ্ধি পেল একদা যেথায় দ্বীপটি ছিল, তার আশপাশে। লোকে বলে নাকি নৌবাহিনী কামান ছোঁড়া প্র্যকটিশ করার একটা জায়গা আবিষ্কার করেছিল সেখানে। সমুদ্রে ওপর যেন ধূসর ধাতুর একটা উপুড় করা বাটি। বিশাল তার আকার। বিস্ময়কর তার ধূসরতা। ভারী ভারী কামান দেগেও নাকি বাটিটাতে টোল খাওয়ানো যায় নি। ইস্পাত-গলান আগুন দিয়েও পিচ্ছিল জিনিসটাকে তাতানো যায় নি। শেষকালে অ্যাটম বোমার মহড়াও চলেছে—কিন্তু সমুদ্রের মধ্যে এক ইঞ্চিও ডোবানো যায় নি উপুড় করা সেই বিশাল বাটিকে।
বিদ্রূপ আর ঘটকৰ্পর ইচ্ছে করেই রেখে দিয়েছিল ঢালটা। গবেষণা আর নিওটেরিকস্ নিয়ে দুজনেই পরম সুখে দিন যাপন করছিল। কামান গর্জন কানে আসে নি, পারমাণবিক বিস্ফোরণ টের পায় নি কারণ ঢালটা সত্যি সত্যিই দুর্ভেদ্য। হাতের কাছে মালমশলা যা ছিল, তাই দিয়ে দরকার মতো সিনথেটিক খাবার, আলো আর বাতাস তৈরি করে নিত। কারও ধার ধারত না। বোমাবর্ষণ সত্ত্বেও ব্যারাকের তিনজন কুলি জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে ছিল তিন দিন। তারপর থেকেই দ্বীপের মধ্যে মানুষ নামক প্রাণী বলতে রইল শুধু দুজন। বিদ্রূপ আর ঘটকৰ্পর।
এ সব অনেক দিন আগেকার কথা। বিদ্রূপ আর ঘটকর্পর আজও বেঁচে থাকলেও থাকতে পারে, মারা গেলেও যেতে পারে। তাদের মরা বাঁচাটা বড় কথা নয়, তার চেয়ে বড় কথা হল, বিশাল ধূসর খোলসটার ওপর নজর রাখা দরকার। মানুষ মরে, কিন্তু জাতি বেঁচে থাকে। অগণিত বংশানুক্রমের পর একদিন ধারণাতীতভাবে এগিয়ে যাবে নিওটেরিকস্রা। সেই দিন ওরা দুর্ভেদ্য খোলস নামিয়ে পা বাড়াবে দ্বীপের বাইরে।
সে দিনের কথা মনে করে আমি শিউরে উঠছি।
.
প্রথম প্রকাশ: আশ্চর্য!, অগাস্ট-সেপ্টেম্বর, ১৯৬৮
বিদেশী ছায়ায়