সময়ের মোচড় • তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
আজকাল হাঁটতে আর ভাল লাগে না। পঞ্চাশ পেরুনোর পর থেকেই কোমরে একটা ব্যথা হয় মাঝে মাঝে, বেশি হাঁটলে সেটা বাড়ে। কিন্তু উপায় কি? বাড়ি থেকে বাজার প্রায় মাইল খানেক পথ, অন্ততঃ এটুকু তো হাঁটতেই হবে।
ছেলেদের দিয়ে করানো চলে, কিন্তু সন্ধ্যার পর তারা দু-জন মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়তে যায়। অতএব বুদ্ধিমান নিমাই রায় দু-তিন দিনের বাজার এক সঙ্গে করে ফেলেন। তরি-তরকারী ছাড়াও মাছ আর ডিম কেনেন। প্রথম দিন মাছ খাওয়া হয়, কারণ নইলে সেটা পচে যাবে। পরের দিন ডিম। তারপরের দিন নিরামিষ। তারপর আবার বাজার।
শহরের একেবারে বাইরের দিকে নিমাই রায়ের বাড়ি। কাছাকাছি আর বসতি নেই। সেটা নিমাইবাবুর ভালই লাগে—কোলাহল তিনি মোটেও পছন্দ করেন না। পৃথিবীতে যেভাবে মানুষজন বাড়ছে, নতুন বাড়িঘর কলকারখানা উঠছে, তাতে আর দশ বছরের মধ্যে স্বস্তিতে কোথাও পা ফেলার জায়গা থাকবে না। সুন্দর ছিল তাঁর কৈশোর, যখন শহরে হাতে-গোনা লোক বাস করত, সবাই সবাইকে চিনত আর ভালবাসত। পথে ভিড় ছিল না, সর্বত্র একটা শান্তির আবহাওয়া বিরাজ করত। আঃ, সেসব দিন কোথায় গেল।
থলে হাতে সন্ধ্যেবেলা বাড়ি থেকে বেরুলেন নিমাইবাবু। বিলের ধার দিয়ে হেঁটে এসে মাঠের মধ্যে যেখানে কয়েকটা আম-কাঁঠালের গাছ জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে সিগারেট ধরাবার জন্য থামলেন। কেমন শান্ত স্তব্ধতা। গাছের পাতায় বাতাস বেধে ঝিরঝির শব্দ হচ্ছে। উলটোপালটা হাওয়ায় লাইটার ভাল করে ধরছে না। হাত দিয়ে বাতাস আড়াল করে কল ঘোরাতেই দপ করে আগুনের শিখা লাফিয়ে উঠল। মুখ নিচু করে নিমাই রায় সিগারেটের ডগা আগুনে ছোঁয়াতে গিয়ে অনুভব করলেন সমস্তু শরীরটা যেন একবার কেমন করে উঠল—একটু গা-বমি মতো ভাব, একবার যেন মাথাটা সামান্য ঢাল মেরে গেল। ওপরে গাছের পাতায় অদ্ভুত খড়মড় শব্দ। এক মুহূর্তের জন্যই। তারপর আবার সব ঠিক। আরামে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন নিমাইবাবু। বয়স হচ্ছে, দু-একদিনের ভেতর অবিনাশ ডাক্তারকে দিয়ে প্রেসারটা একবার চেক করিয়ে নিতে হবে। মাথাঘোরা ভাল কথা নয়।
সিগারেট শেষ হতে হতে দূর থেকে শহরের প্রান্তে বটগাছটা দেখা গেল। ওর নিচে খোঁড়া রামদাস নাপিত বসে খদ্দেরদের চুলদাড়ি কামায়। এখন অবশ্য সে নেই। সন্ধ্যের আগেই সে তার কাঠের ছোট্ট হাতবাক্সের মধ্যে ক্ষুর, ব্রাশ, আয়না, অ্যালুমিনিয়ামের বাটি ইত্যাদি ভরে বাড়ি চলে যায়। তবে গাছের নিচে একটা আলো জ্বলছে বটে। কাছে গিয়ে দেখলেন একজন আধবুড়ো লোক গ্যাসলাইটের আলোয় পানবিড়ির দোকান পেতে বসেছে। সিগারেট প্রয়োজন, এখান থেকেই কিনে নেওয়া যাক। নিমাই রায় লোকটার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন—এক প্যাকেট চার্মিনার দাও তো ভাই—
লোকটা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল—কি দেব?
—চার্মিনার। চার্মিনার সিগারেট…
—আজ্ঞে, ও নামে তে কোনো সিগারেট নেই বাবু—
নিমাই রায় আশ্চর্য হলেন। লোকটা হাবা নাকি? সিগারেট বিক্রি করে, এদিকে চার্মিনারের নাম জানে না?
—মেপোল আছে বাবু, মেপোল দেব? নইলে কাঁচি নিতে পারেন—-
কাঁচি মানেই সিজার্স। সে সিগারেট এখনো বাজারে পাওয়া যায় নাকি? সে তো কবেই উঠে গিয়েছে। নামটা মনের ভেতরে অনেক পুরানো স্মৃতি জাগিয়ে তুলল।
কাঁচি সিগারেটই এক প্যাকেট কিনে বাজারের দিকে পা বাড়ালেন নিমাই রায়। আজ পথে ভিড় এত কম কেন? শহর ঘুমিয়ে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। যাক, নিরিবিলিতে বাজার সেরে ফেলা যাবে।
দু-পা হেঁটেই হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ায় আবার থামলেন। ওই বটগাছটা! ওটা তো সেই কবেই কেটে ফেলা হয়েছে। এখানে তো কিছু থাকার কথা নয়! পাশেই একটা ছোট হোটেল রয়েছে। দুপুরবেলা রাস্তায় ধারে গাড়ি থামিয়ে ট্রাক ড্রাইভাররা সেখানে খায়। কিন্তু বটগাছটা গত কুড়ি বছর নেই। কি দেখলেন তাহলে?
পেছনে ফিরে তাকালেন নিমাই রায়। হ্যাঁ, ওই যে বটগাছ—বেশ স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। নিচে গ্যাসলাইটের আলোয় সিগারেটের দোকান।
—এই যে নিমু, হাঁ করে পেছনে কি দেখছ হে? বাজার করবে না?
শৈলেন ঘোষের গলা। যথারীতি সন্ধ্যেবেলা কানাইবাবুর দোকানে আড্ডা দিতে চলেছেন। নিমাইবাবু বললেন—হাঁ শৈলেনদা, যাচ্ছি। কেমন আছেন?
—এই ভাই, চলে যাচ্ছে। কানাইয়ের ওখানে যাচ্ছি একটু দাবা খেলবো—
শৈলেন ঘোয় চলে যেতেই নিমাই রায়ের হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
তার জীবনে ভয়ঙ্কর রকমের কিছু একটা গোলমাল ঘটেছে। কিভাবে যেন তিনি তাঁর প্রথম যৌবনের দিনগুলোতে ফিরে গিয়েছেন। প্রথমটা ঠিক খেয়াল করেন নি। কারণ চিরদিনের অভ্যস্ত ঘটনাগুলো আবার ঘটতে থাকায় মস্তিষ্ক সহজভাবেই তাদের গ্রহণ করেছে। কিন্তু এ যেন ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার চলচ্চিত্র আবার প্রোজেকটারে ফেলে দেখানো হচ্ছে। শৈলেনদা মারা গিয়েছেন আজ অন্ততঃ সতেরো-আঠারো বছর, কানাই চাটুজ্যে তারও বছরখানেক আগে। তাহলে এইমাত্র কার সঙ্গে কথা বললেন তিনি?
পুরানো চলচ্চিত্রই বটে। ওই যে ফিরে এসেছে মুকুন্দপালের ছিপ আর বঁড়শির দোকান, তার পাশেই রামপ্রসাদ ভূজাওয়ালার ঝুপড়ি।
সব ঠিক সেই আগেকার মতো। যেন মাঝখানের বছরগুলো একেবারে মিথ্যে।
কিন্তু যথেষ্ট আনন্দ হচ্ছে না কেন? তিনিই তে মাঝখানে প্রার্থনা করেছেন—পুরানো দিনগুলো ফিরে আসুক। এখন, যে অদ্ভুত উপায়েই হোক তা ঘটে গিয়েছে। আর একটু এগিয়ে শহরের মধ্যে ঢুকে গেলেই তিনি পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার পৃথিবীকে সামনে দেখতে পাবেন। এতে তো খুশি হওয়া উচিত।
নিমাইবাবুর ছেলেদের জন্য গিন্নীর জন্য ভয়ানক মন-কেমন করতে লাগল। যদি তিনি সময়ের এই ভাঁজে আটকে যান, তাহলে তাদের সঙ্গে তাঁর আর কখনো দেখা হবে না—কারণ তারা রয়েছে ঠিক পঁয়ত্রিশ বছর পরের ভবিষ্যতে। ওদের না দেখে তিনি থাকতে পারবেন না। পৃথিবীর কোনো স্মৃতি, কোনো ঐশ্বর্যই তাদের সান্নিধ্যের চেয়ে দামি নয়।
সময় বেয়ে তিনি পিছিয়ে গেলেন কি করে?
নিমাই রায় নেহাৎ অশিক্ষিত লোক নন। আইনস্টাইনের রিলেটিভিটি থিয়োরী থেকে কোয়ান্টাম তত্ত্ব পর্যন্ত কিছু কিছু তাঁর পড়া আছে। কোথায় যেন পড়েছেন সময়ের ভেতরের কখনো কখনো এমন মোচড় বা টুইস্ট তৈরি হয়, তার মধ্যে দিয়ে চলে গেলে অদ্ভুত অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে পারে। গাছতলায় সিগারেট ধরানোর সময় সমস্ত শরীরে একটা বিচিত্র অনুভূতি হয়েছিল বটে একমুহূর্তে জন্য। তাহলে এক্ষেত্রে মোচড়টা কি দেশকালের ওই বিশেষ জায়গাটাতেই তৈরি হয়েছে? এবার উল্টো দিক দিয়ে ফিরে গেলে কি চিনি আবার স্ব-কালে আবির্ভূত হবেন?
বাজার না করে নিমাই রায় ফিরতি পথে দৌড়তে শুরু করলেন। এতক্ষণে যদি সময়ের মোচড়টা ওখান থেকে সরে গিয়ে থাকে? তাহলে বৌ-ছেলেপুলেকে আর কোনোদিন দেখতে পাবেন না! কী ভয়ানক!
অন্ধকার গাছতলায় এসে থামলেন। বুকের মধ্যে ধক ধক করছে। মনে মনে ভগবানকে স্মরণ করে পা বাড়াতেই সেই অনুভূতিটা! একটু যেন গা গুলিয়ে উঠল, মাথাটা ঘুরে গেল একবার। তারপর সব ঠিক।
হেঁটে এগুতে এগুতে দূর থেকেই দেখতে পেলেন বাড়িতে আলো জ্বলছে, গিন্নীর গলা শোনা যাচ্ছে। মনে কি শান্তি! যারা তাঁকে ভালোবাসে তারা ওইখানে তাঁর জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে।
.
প্রথম প্রকাশ: ফ্যানট্যাসটক, সেপ্টেম্বর, ১৯৮৯