কায়াহীনের কাহিনী • সৌরেশ দে
—যদি ওরা কেউ সত্যিই আসে?
: আবার তুমি ঐ ঐ সব ভাবছ ইন্দু? তোমায় আমি হাজার বার মানা করেছি। ক্ষোভ ঝরে পড়ে অরিন্দমের কণ্ঠে।
—জান আমার কিন্তু মনে হয় ওরা এসেছে। আমার চোখের আড়ালে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
: বাজে চিন্তা করো না। মন থেকে ঐসব আজগুবি ঝেড়ে ফেলা দেখি।
—আচ্ছা বাবা আচ্ছা। আমি কি ঐসব চিন্তা করতে চাই? চোখের সামনে পড়ে যে। যখনই কোন দিকে তাকাই মনে হয় কে যেন সরে গেল!
: যতসব বাতিকের ব্যামো, তার ওপর সায়ান্স-ফিকশান পড়ার কুফল।
—না মশাই না। তুমি বলে তাই উড়িয়ে দিচ্ছে। থাকতো যদি আজ আমার একটা ছেলে।—ইন্দুমতী চোখের জল লুকোতে মুখ ফেরায়। অরিন্দম ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
: আচ্ছা, ইন্দু, তুমি এবার একটু ঘুমাবার চেষ্টা কর।
—ঘুম যে আমার আসে না। দিনরাতই চেষ্টা করছি। বিছানায় শুলেই চিন্তা আমায় আরো পেয়ে বসে।
: এই পিলটা খেয়ে নাও।—অরিন্দম এককাপ জলসহ স্লিপিং পিলটা এগিয়ে দেয়।
—না, ঐসব বিষ আর আমি খাব না। তোমরা আমায় তিলে তিলে মেরে ফেলতে চাও। এইতো বিছানা থেকে উঠলাম। এখন সবে বেলা নটা।
: আচ্ছা তোমার উল আর কাঁটা কোথায়? আমার সোয়েটারটা বোন বসে বসে। এখানে সুন্দর ঝলমলে রোদে পা বাড়িয়ে দাও। দেখ কি সুন্দর হেমন্তের শিশির ঝরা সকাল।।
—দেখ তোমায় আমি তিনটে সোয়েটার বুনে দিয়েছি। নিজেরও গোটা তিনেক আছে। আর সোয়েটারে কাজ কি?
: তবু, এই নতুন প্যাটার্নটা আমার ভাল লাগে। এটার একটা আমায় করে দাও লক্ষ্মীটি।
—তারপর, এটা হয়ে গেলে কি করবো?
: তোমার পেয়ারের কুকুর, সিলির জন্যেও একটা কর। আচ্ছা তোমায় আমি তাস নিয়ে পেসেন্স খেলা শিখিয়ে দেব।
—আচ্ছা ওরা যদি কেউ আসে তবে ওরা কি আমায় মেরে ফেলবে, না ভাব করবে?
: ও আবার ঐসব বাজে কথা।
—বর্তমান বৈজ্ঞানিকদের ধারণা…।
: ছিঃ ইন্দু এখন মন দিয়ে খেয়ে নাও। খাবার সময় অন্য চিন্তা করতে নেই। শরীর খারাপ করবে।
—তোমার কি মনে হয় ওরা আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে। ধর আমায় যদি ধরে নিয়ে যায়, কিম্বা মেরে ফেলে।
: না ওসব কিছুই ওরা পারবে না। ওসব বাজে চিন্তা তুমি ছেড়ে দাও।
—তবে ওরা কেন আসে? ওদের কি পায়ের পাতায় বেড়ালের মতো প্যাড লাগানো আছে? কোন শব্দ হয় না!
: সবই তোমার কল্পনা। ওসব বাদ দাও।
—তুমি খালি উড়িয়ে দিতে চাও। জান ওরা ঘরে এলেই সিলি বুঝতে পারে। ওর কান খাড়া হয়ে ওঠে। গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠে। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। আর আমি ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালেই মনে হয় কি যেন সরে গেল। জান, আজকে আমার আয়নাতেও ওদের ছায়া পড়েছিল।
অরিন্দম চুপ করে যায়। মনে মনে ভাবে ইন্দুর একটা ছেলে যদি আজ থাকত তাহলে এই সব কল্পনাবিলাসের সুযোগ মিলতো না। আজ থেকে প্রায় পনেরো বছর আগে ইন্দুকে যখন ঘরে নিয়ে আসে সেদিনের কথা মনে পড়ে। তখন ইন্দু কত স্বাভাবিক কত সুন্দর ছিল। দিল্লীর মতো এই নির্বান্ধব কাঠখোট্টা জায়গায় কত সহজে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছিল। কত গান কত হাসি কত আবেগমধুর সন্ধ্যা দুজনের কেটেছে। সব যেন সারবন্দি হয়ে অরিন্দমের চোখের সামনে পেরিয়ে যেতে লাগলো।
যৌবন ছাড়িয়ে প্রৌঢ়ত্বের সীমায় উভয়ে এসে দাঁড়িয়েছে আজ। কিন্তু আজও তারা নিষ্ফল। নিঃসন্তান। অরিন্দম দেখেছে ধীরে ধীরে কেমন ইন্দুমতী পাল্টে যাচ্ছে কেমন বদলে গেছে। তার ব্যথা বেদনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী সে। সে নিজেও বহন করছে সেই ভার। অন্তরও শূন্য হাহাকার। তবু সে পুরুষ মানুষ, তার অনেক যোগাযোগ আছে যা দিয়ে সে নিজেকে ভরিয়ে রেখেছে। কিন্তু ইন্দু? ইন্দুর কি আছে? আয়েসবাগের এই ছোট্ট বাংলো বাড়ী, কুকুর সিলি, আর সে নিজে। সে আর নতুন কিছু ইন্দুকে দিতে পারে না। কি দিয়ে ইন্দুকে আকর্ষণ করবে?
ইন্দু তাই পাল্টে গেল। কিছুই আর ইন্দুর ভাল লাগে না। কিছুই ইন্দুকে আকর্ষণ করতে পারে না। ধীরে ধীরে ইন্দু ভাবপ্রবণ আর কল্পলোকের বাসিন্দা হয়ে উঠেছে। আর এক বেদনার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে অরিন্দমের ভিতর থেকে। আবার নীরবতা ভঙ্গ করে ইন্দুমতী।
—আচ্ছা, ওরা কি রকম দেখতে বলতে পার?
: তুমিই জান, আমি তো ওদের দেখিনি।—অরিন্দমের বিরক্তি ভরা জবাব।
—আমি শুধু একজোড়া চোখ, বেশ বড় বড় চোখ, আর একটা গোমড়া মুখ ছাড়া কিছুই দেখতে পাই না। আচ্ছা, ওরা কি অদৃশ্য হয়ে যাবার মন্ত্র জানে। নাহলে ওদের খুঁজে পাই না কেন?
: তুমিই জান।—এবারেও সংক্ষিপ্ত জবাব দেয় অরিন্দম।
—জান এইভাবে একলা থাকলে একদিন দেখবে আমি মরে পড়ে আছি। এ আমার অসহ্য হয়ে উঠেছে। তুমি একটা ব্যবস্থা কর।
অরিন্দম ব্যবস্থার কথা চিন্তা করে। অনেকদিন থেকেই ভাবছে। ইন্দুর এই মানসিক বৈকল্য নিয়ে কি করা যায়? একটা না একটা ভয় ভাব ভাবনার গোলোক ধাঁধায় ঘুরে মরছে সে। সম্প্রতি সায়ান্স ফিকশান খুব পড়ছিল ইন্দু। এসব তারই কুফল। কোন মনোবিজ্ঞানীর শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া আর গতি নেই। যদিও সে জানে ফলের আশা কম। কি করতে পারে অরিন্দম আর! অনেক চেষ্টা করেছে সে। নিঃসঙ্গতাই যে ইন্দুর একমাত্র ক্ষতির কারণ সেটা সে বোঝে। কিন্তু সে নিরুপায়! গান বাজনা রেডিও গ্রামোফোন আর কুকুর নিয়ে কতক্ষণ কাটান যায়। হঠাৎ আরন্দম ভাবে ইন্দুকে একটা টেলিভিশন সেট কিনে দেবে। সম্প্রতি দিল্লীতে টিভি চালু হয়েছে। কিছু নতুনত্বের আকর্ষণ নিশ্চয়ই পাবে ইন্দুমতী। তাই সামনের মাসেই একটা টিভি সেট কিনে দেওয়া স্থির করে অরিন্দম।
কিছুদিন টিভি নিয়ে ভালই কাটে ইন্দুমতীর। তারপর আবার সেই যথাপূর্বম অবস্থা। আবার সেই ভিনগ্রহের বাসিন্দার আনাগোনা। অশরীরী প্রহরীর অদৃশ্য প্রহরা। আবার হাঁপিয়ে উঠতে থাকে ইন্দুমতী। একমাত্র সিলি তার নির্ভর। সিলিকে লক্ষ্য করেই সে বুঝতে পারে তার ঘরে কোন আগন্তুক আছে কি না। অরিন্দম কোন কালেই এসব বিশ্বাস করবে না।
সেদিন রাত্রে ইন্দুমতী কি ভয় না পেয়েছিল। তার স্থির বিশ্বাস তার মাথার কাছে কেউ এসে দাঁড়িয়ে ছিল। স্পষ্ট নিশ্বাসের আওয়াজ সে শুনেছে নইলে সিলি হঠাৎ দেওয়ালের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে কেন। তখন তার সবে তন্দ্রা এসেছে। কিন্তু অরিন্দম, সে যেন কি! কিছুতেই বিশ্বাস করবে না!
ইদানীং ইন্দুমতীর ভীষণ ভয় বেড়ে গেছে। সব সময় জানলা দরজা বন্ধ করে
বসে থাকে। দরজা জানলার ফাঁকে কাঁথাকানি খুঁজে নিজের নিরাপত্তা দৃঢ় করার চেষ্টা করে। অরিন্দমের এই সমস্ত বাতিকের বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়। সে বেশী চিন্তিত হয়ে পড়ে। কিন্তু কোন উপায় খুঁজে পায় না।
সেদিন দুপুরে ইন্দুমতী এইরকম কাঁথাকানি গুঁজে বসে আছে ঘরে। সামনে টিভি সেট খোলা। পায়ের কাছে সিলি ঘাপটি মেরে পড়ে আছে। ইন্দুমতীর একটু তন্দ্রার ভাব এসেছিল। এমন সময় হঠাৎ সিলির গোঁ গোঁ শব্দে ঘোর কেটে যায়। তাকিয়ে দেখে সেই মুখ সেই টিভি স্ক্রীন জুড়ে রয়েছে। শুধু তাই নয়, তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে। ভীষণ চমকে ওঠে ইন্দুমতী। ভয়ে হৃৎপিণ্ড দাপাদাপি শুরু করে। ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে সিলি নিসপিস করতে থাকে। আগন্তুক মূর্তি স্মিতমুখে ইন্দুমতীকে অভয় দান করে, এবং তার কুকুর সামলাতে বলে। ইন্দুমতী বুদ্ধি হারায় না। সে যথারীতি সিলিকে শান্ত করে। সেদিন অফিস থেকে ফিরতেই অরিন্দম এক নতুন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়।
—জান, আজ কি ভীষণ ব্যাপার ঘটেছিল।
অরিন্দম জবাব না দিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ভাবে আবার কোন নতুন বাতিকের কবলে ইন্দু পড়েছে। ইন্দুমতী আবার বলতে থাকে।
—আজ সেই গ্রহান্তরের লোক এসেছিল! কি করে জান? ভারী অদ্ভুত ব্যাপার। টিভি স্ক্রীন থেকে লাফিয়ে ঘরের মেঝেয় এসে পড়লো! দরজা জানলা বন্ধ করে ওদের ঠেকান যায় না! কি অদ্ভুত মাথা আর হাতসর্বস্ব বেঁটে বামন চেহারা। বড় বড় গোল গোল চোখ।
অরিন্দমের চোখ দুটিও কপালে ওঠে। মনে ভাবে ইন্দু দিন দিন আরোগ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। মুখে বলেঃ তারপর, তোমার কল্পনার দৌড় কতদূর যায় শুনি।
—মোটেই না মশায়, তুমি বরাবর ভুল করছো। ওরা আমার সঙ্গে ভাব করতে এসেছিল। এতদিন শুধু আমাদের ভাষা শিখতে দেরী হয়েছে। তাই আশেপাশে আড়ি পেতে থাকতো। জান, প্রথমে আমি ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। চীৎকার করার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছিলাম। মড়ার মতো কাঠ হয়ে পড়েছিলাম।
: তোমার জ্ঞান ছিল তো?
—তোমার সবেতেই অবিশ্বাস। জান, সিলিটা কি বোকা! আর একটু হলে ওর ঘাড়ে লাফিয়ে পড়তো।
: সেই ভাল হত।
—কখখনো না। তুমি জান না কি ভাল লোক ওরা। ওরা পৃথিবীর মানুষের সাথে আলাপ করতে চায়। তাদের জীবনের খুঁটিনাটি জানতে চায়। তাদের দুঃখদুর্দশা দূর করতে চায়। ওরা ভিন গ্রহের বৈজ্ঞানিকের দল! এসেছে সিরিয়াস থেকে!
: তা তোমার দুঃখদুর্দশার কাহিনী ওদের বলেছ নিশ্চয়ই।
—হ্যাঁ বলেছি। বলেছি আমার সব আছে কিন্তু একটাও ছেলে নেই। সে আশ্বাস দিয়ে গেছে, বলেছে সাধ্যমত চেষ্টা করবে।
অরিন্দম বুঝতে পারে ইন্দুমতীকে আর ফেরানো যাবে না। তার ধ্যানজ্ঞান সেই ছেলের অভাব থেকে ভাবরাজ্যে ঘুরিয়ে মরছে। তাকে নিউরোটিক করে তুলেছে। স্লীপিং পিলের ডোজটা একটু বাড়িয়ে সন্ধ্যের পরেই ঘুম পাড়িয়ে দেয় সে ইন্দুমতীকে। কিন্তু পরের দিন আবার আর এক খবর শোনায় ইন্দুমতী।
—আজকে আবার এসেছিল আমার সেই ভিনগ্রহের বন্ধু। সঙ্গে এনেছিল সেই এক বৈজ্ঞানিক ডাক্তার।
: তারপর?
—তারপর ডাক্তার আমায় এক অদ্ভুত তীব্র হলুদ রশ্মি দিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তন্ন তন্ন করে পরীক্ষা করে দেখলেন এবং এক স্নিগ্ধ নীল আলো পেটের ওপর ফেলে চিকিৎসা চালালেন। তারপর যাবার আগে বলে গেলেন, সব ঠিক হয়ে যাবে আর ভাবনা নেই।
: তোমার চিন্তাশক্তি বেশ শাণিত হচ্ছে বুঝতে পারছি। দয়া করে আমার কথা শোনা আর ওসব বিষয়ে মন দিও না।
অরিন্দম কাতর অনুরোধ জানায়। কিন্তু এরপর থেকেই অরিন্দম আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করে যে ইন্দুমতী অনেকটা সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আবার সেই বিগত প্রথম যৌবনের উচ্ছাস ফিরে পেয়েছে। এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা অরিন্দম কয়েক মাসের মধ্যেই জানতে পারে যে ইন্দু অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে।
যথাসময়ে তাদের এক সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। অরিন্দম সেই ছেলেকে আজ কোলে নিয়ে বসে আছে। মনে পড়ছে অনেক কথা। ইন্দুমতীকে বাঁচান যায় নি। বেশী বয়সে গর্ভবতী হওয়ার ফলে অনেক জটিলতা দেখা দেয়, ফলে ইন্দুমতী মারা যায়।
অরিন্দম আজ ইন্দুমতীর কথা ভাবছে আর ভাবছে তার ভিনগ্রহের বন্ধুদের কথা। মৃত্যুপাণ্ডুর ইন্দুর মুখে সে দেখেছে এক বিরাট প্রশান্তির ছাপ। ইন্দু বলেছিল, অরিন্দম, আমার আর কোন খেদ নেই। আমি সার্থক, সফল হয়েছি। আমার ভিনগ্রহের বন্ধুদের সাথে যদি আবার দেখা হয় বলো তাদের।
আজ আর অরিন্দম সেকথা অবিশ্বাস করতে পারে না! বরং ভাবে, যদি ভিনগ্রহের বন্ধুরা সেদিন থাকতো তবে নিশ্চয়ই ইন্দুকে মৃত্যুর কোলে ছেড়ে দিতে
হতো না।
.
প্রথম প্রকাশ: আশ্চর্য!, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ১৯৬৭