হিপেসকাস—সে এক জন্তু • সমরজিৎ কর
মাফ করবেন। পৃথিবীর মনুষ্য-সভ্যতাতে একটি নিদারুণ দুঃসংবাদ যে একদিন আমাকেই জানাতে হবে স্বপ্নেও কোন দিন আমি ভাবতে পারিনি। দোহাই আপনাকে, আমি শুধু একটি নৈতিক দায়িত্বই পালন করতে চলেছি।
ডঃ ওয়াল্ট মেলভিল ব্যাপারটা আপাততঃ চেপে রাখারই উপদেশ দিয়েছিলেন। তার যুক্তি, পৃথিবী যখন বর্তমানে নানা রকম সমস্যা নিয়ে জর্জরিত, তখন এই মরণ কামড় নাই বা দিলাম? কিন্তু সেই সঙ্গে মিঃ ব্রাউনের করুণ চাহনিও উপেক্ষা করা যায় না। সমস্ত মানুষের জন্যে মাত্র একজন মানুষ যে এত বেশী ভাবতে পারে, মিঃ ব্রাউনকে না দেখলে সত্যিই তা উপলব্ধি করা যায় না।
মিঃ ব্রাউন এখন হাসপাতালে। পৃথিবীর কয়েকজন সেরা চিকিৎসক তাকে নিয়ে দিন রাত মাথা ঘামাচ্ছেন। হতাশা, দুর্ভাবনা এবং ভীতি তাকে যেমনভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে, জানি না তাদের থেকে পরিত্রাণ তিনি পাবেন কিনা। আমরা যারা তার নিকটতম বন্ধু—তাদের শুধু এটুকুই সান্ত্বনা যে, তাঁরা তাঁদের অকৃত্রিম বন্ধুর সেবা করার কিছুটা সুযোগ পেলেন।
আসলে সত্যি কথা বলতে কি, মিঃ ব্রাউনের কথা আমরা একরকম ভুলেই গিয়েছিলাম। তাঁর সঙ্গে স্বাভাবিক অবস্থায় আমাদের অর্থাৎ আমি, ডঃ মেলভিল, ডঃ কার্পেন্টেরিয়া উপসাগরের ওয়েলেসলি দ্বীপপুঞ্জে। মিঃ গ্রিমেকভ্, জাতিতে চেক্। তবে মার্কিন নাগরিক। আমরা প্রত্যেকেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় একই মেডিকেল কোরে কাজ করছিলাম এবং ভেতরে ভেতরে জীববিজ্ঞানের ওপর কিছু গবেষণাও। আমাদের দলের হোতা ছিলেন প্রবীণ প্রাণীবিজ্ঞানী মিঃ ব্রাউন। সেনাবিভাগে নাম লেখালেও আসলে তিনি ছিলেন জাত-বিজ্ঞানী। কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটা জানতেন এবং সেনাবিভাগের কাজে কোন ক্ষতি না করে তিনি যাতে গবেষণার কাজ চালিয়ে যেতে পারেন সে ব্যবস্থা করেছিলেন। আর এই গবেষণাকে কেন্দ্র করেই আমরা একত্রে মিলিত হই।
১৯৪৪-এর প্রথম দিকেই পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের দারুণ অবনতি ঘটল। জাপানী আক্রমণে মিত্রপক্ষের তখন হিমশিম অবস্থা। এই সময়েই আমাদের কোম্পানিকে লিবিয়া থেকে সরাসরি পাঠান হয় সুম্বা দ্বীপে। ঠিক হয় পেছন দিকে থেকে আক্রমণ করে আমরা শত্রুকে পর্যুদস্ত করব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর করতে হল না। কেন হল না সেটা রাজনৈতিক ব্যাপার। এ কাহিনীর সঙ্গে তার কোন যোগসূত্র নেই।
দেখতে দেখতে প্রায় মাস চারেক কেটে গেল। সুম্বার প্রাকৃতিক পরিবেশে মিঃ ব্রাউন প্রাণীবিজ্ঞানের ওপর গবেষণার নানান খোরাক জোগাড় করলেন। সত্যি কথা বলতে কি যুদ্ধের থেকে এই সমস্ত কাজেই আমরা বেশী মনোযোগী হয়ে পড়লাম।
আর ঠিক এই সময়েই, সম্ভবতঃ সেটা মে মাস, বেজায় গরম। আর প্যাচপ্যাচানি বৃষ্টি। রবারের ক্ষেতের মধ্যে একটা দারুণ গুমোট ভাব। গিরগিটি জাতীয় একটা অদ্ভুত প্রাণী নিয়ে আমি এবং মিঃ ব্রাউন আলোচনা করছিলাম। রাতের অন্ধকারে সমস্ত ব্যারাকে শুধুমাত্র আমাদের তাঁবু থেকেই টিমটিম আলো জ্বলছিল।
ঠিক এমন সময় কতটা উন্মাদের মতো ছুটে এসে তাঁবুতে ঢুকলেন ডঃ মেলভিল। ভয়শঙ্কিত ভাবে তার এই প্রবেশে আমরা নিজেরাও কম ঘাবড়ে গেলাম না।
—কি ব্যাপার, ডঃ মেলভিল? প্রশ্ন করলাম আমি।
দেয়ার! দেয়ার ইট্ ওয়াজ! আর কোন কথা বলতে পারলেন না তিনি। অসহায়ের মতো চেয়ে রইলেন তাঁবুর দরজার দিকে। সমস্ত শরীর থর থর করে কাপছে। তাঁর কথা মতো আমরাও বাইরের পানে চাইলাম কিন্তু পিচে ঢাকা অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না।
ডঃ মেলভিলকে আমরা শান্ত করার চেষ্টা করলাম। উত্তেজনা কমানর জন্যে মিঃ ব্রাউন তাকে কিছুটা ব্র্যাণ্ডি দিলেন। এক চুমুকে তার সমস্তটা নিঃশেষ করে চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন তিনি। ডঃ স্টোন তাঁর পাল্স্ দেখে বুঝলেন তিনি উত্তেজনায় খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তাই সে রাত্রে কোন রকম ব্যস্ত না করে তাঁকে আমরা বিছানায় শুইয়ে দিলাম।
কিন্তু আসল ব্যাপারটাই বা কি? রাত নটা নাগাদ তো তিনি বেরিয়ে গিয়েছিলেন কি এক ধরনের পাখী সংগ্রহ করতে। আজ সকালেই তিনি ব্যারাকের কিছু দূরে একটি গাছে সেই পাখী দেখে এসেছিলেন। সঙ্গে মরলি নামে একজন ছোকরাও গিয়েছিল। কথাটা ভাবতেই আমার মধ্যে যেন বিদ্যুতের চমক খেলে গেল। তাহলে মরলি? তাকে তো দেখছি না? ডঃ স্টোনকে এদিকটা লক্ষ্য করতে বলে আমি ও মিঃ ব্রাউন বেরিয়ে পড়লাম মরলির খোঁজে।
আশেপাশের দু’একজনকে জিজ্ঞেস করায় তারা কিছুই বলতে পারল না। ব্যারাকের গেটে প্রহরারত পুলিশ সার্জেন্ট ডিক বলল, কেন? ডঃ মেলভিল এবং
মরলি তো কিছুক্ষণ আগেই কোত্থেকে ছুটতে ছুটতে এলেন?
কিন্তু মরলিকে তো পাওয়া যাচ্ছে না! উদ্বেগের সঙ্গে প্রশ্ন করলেন মিঃ ব্রাউন।
আমি আপনাদের কথা বুঝতে পারছি না, স্যার। আমাদেরই সামনে দিয়ে এই কয়েক মিনিট আগে ওঁরা দুজনেই পাগলের মতো কোত্থেকে ছুটতে ছুটতে এলেন। তখন একটু বেশী বৃষ্টি পড়ছিল। নিজেদের কোড নম্বর বলেই ফুরুৎ করে তাঁরা উড়ে গেলেন।
এবার বেশ খানিকটা গম্ভীর কণ্ঠেই বললাম, ব্যাপারটা ঠিক অত সহজ নয়, সার্জেন্ট ডিক। আমরা যেন কিছু একটা আশঙ্কা করছি।
মুহূর্তে ডিকের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল—কি বলছেন, স্যার? এনি আণ্ডারগ্রাউণ্ড অপারেশন স্যা—?
ঠিক তা নয়। কিন্তু তার আগে মরলিকে আমাদের চাই-ই।
ডিক সঙ্গে সঙ্গে কোয়ার্টার্স মাস্টারের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করল। আর তার পরমুহূর্তেই শুরু হল তল্লাসির কাজ। মরলির তাঁবুতে মরলিকে পাওয়া গেল না। সেই অন্ধকারের মধ্যে সমস্ত ব্যারাক জুড়ে খোঁজ খোঁজ রব পড়ে গেল। এবং কিছুক্ষণের মধ্যে পাওয়া গেল তাকে। ব্যারাকের শেষ প্রান্তে একটি ঝোপের ধারে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছে। আমাদের তাঁবুতে তাকে বয়ে নিয়ে আসার পর ডঃ স্টোন পরীক্ষা করে জানালেন মরলি মৃত। তার চোখেমুখে ভেসে ছিল গভীর ভীতি এবং উত্তেজনার ভাব। ডঃ স্টোন মন্তব্য করলেন, ইট ইজ এ ক্লিয়ার কেস অব হার্ট ফেলইওর ডিউ টু সাডেন মেনটাল এ্যাগোনি।
যুদ্ধক্ষেত্রে এ ধরনের মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা ডঃ স্টোনের বহু ঘটেছে। অর্থাৎ শত্রুপক্ষের হঠাৎ রকমের আক্রমণ দেখে অনেক সৈনিকই রীতিমত ঘাবড়ে গিয়ে উন্মাদ হয়ে যায়। কখনও আত্মহত্যা করে। কিংবা আতঙ্কে হার্টফেল করে। কিন্তু মরলি কেন অত ভয় পেল, আমাদের কাছে সেটা যেন একটা সমস্যার মতো হয়ে দাঁড়াল।
ডঃ স্টোন বললেন, ডঃ মেলভিলেরও এমনটি হত। তবে তিনি শক্ত লোক। তাই সামলে নিয়েছেন।
ব্যাপারটা আমাদের কর্তৃপক্ষকেও রীতিমত ঘাবড়ে দিল। অথচ সেই রাত্রেই যত রকম ভাবে সম্ভব অনুসন্ধান চালিয়েও মূল রহস্যের কোন কিনারাই করা গেল না। মোট কথা ডঃ মেলভিল বা মরলির অমন অবস্থার জন্যে যে শত্রুপক্ষের কোন কারসাজিই দায়ী নয়, সে সম্পর্কে আমরা একরকম নিশ্চিন্তই রইলাম তবে একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, মিঃ ব্রাউন কিন্তু এত সব কাণ্ডের পরও কোন সাড়া দিলেন না এবং তাঁর এই নিশ্চুপ ভাব কেমন যেন অস্বাভাবিক ভাবে ধরা দিল আমাদের কাছে। সার্জেন্ট ডিক বলল, একেবারে ভৌতিক ব্যাপার, স্যার। মনে হল অনৈসর্গিক কোন কিছুর আশঙ্কায় সেও বেশ ঘাবড়ে গেছে।
সেদিন রাত্রে কতকটা অস্বস্তি নিয়েই আমরা যে যার শয্যা গ্রহণ করলেও মিঃ ব্রাউন কিন্তু জেগেই রইলেন। নিজের ছোট্ট তাঁবুর মধ্যে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে গ্রিমেকভ্কে নিয়ে কি সব গবেষণার কাজে ব্যস্ত রইলেন। মাঝে মাঝে একবার করে তাঁর কাজকর্ম দেখে আসতে লাগলাম। টেবিলের ওপর একটি খাঁচার মধ্যে সেই টিকটিকির মতো জীব। তার পাশে নানা রকমের যন্ত্রপাতি। কতকগুলি গাছের পাতা এবং রাসায়নিক দ্রব্য। একবার লক্ষ্য করলাম রবারের গ্লব্স পরে জীবটিকে খাঁচার বাইরে বের করে আনলেন তিনি। তারপর কি একটা ইনজেক্সন করলেন তার দেহে। মনে হল ইনজেক্সনের স্যাম্পেলের মধ্যে কার্বন-১৪ আইসোটোপ মিশিয়ে দিলেন। সম্ভবতঃ এর সাহায্যে তিনি বুঝতে চান ইনজেক্সনের ওষুধটি ওর দেহের কোন্ কোন্ স্থানে যাচ্ছে এবং কেমন প্রতিক্রিয়া হচ্ছে।
ওষুধটি ঐ প্রাণীর দেহে প্রবেশ করানর সঙ্গে সঙ্গে সে নিস্তেজ হয়ে গেল। তারপর জটিল যন্ত্রের সাহায্যে মিঃ ব্রাউন তার সারা দেহ নিরীক্ষণ করতে লাগলেন। পরক্ষণেই একটি তীব্ররশ্মি ফেললেন তিনি ওর গায়ে। লক্ষ্য করলাম যে সামান্য জায়গাটায় আলো গিয়ে পড়ল মুহূর্তে সে জায়গাটা গাছের পাতার মতো সবুজ হয়ে গেল। এবং আলো নেভার কিছুক্ষণ পরেই তার দেহের কোন কোন স্থান থেকে ফিকে হলুদ রঙের আভা বের হতে লাগল।
কোন সাড়া নেই, শব্দ নেই। নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন মিঃ ব্রাউন। গ্রিমেকভ্ যা দেখছে নোট করে যাচ্ছে।
ব্রাউন সম্পর্কে আমাদের প্রত্যেকেরই একটা উচ্চতর ধারণা ছিল। লোকটা আমাদের সকলের মধ্যে থেকেও যেন সম্পূর্ণ পৃথক প্রকৃতির। অত্যন্ত স্বল্পভাষী এবং যেটুকু কথা বলতেন তার বেশীর ভাগই বলতেন সহকারী গ্রিমেকভের সঙ্গে। আর বিশেষ করে সুম্বায় এসে তাঁর এই চরিত্র যেন প্রকটভাবে দেখা দিল। মাঝে মাঝে ডাক্তার স্টোনকে জীব দেহের ওপর বিভিন্ন ওষুধের বিক্রিয়ার কথা জিজ্ঞেস করতেন। কখনও বা মেলভিলের সঙ্গে পরিবেশের বিভিন্ন জীবদেহের প্রভাবের কথা আলোচনা করতেন। কিন্তু এ সমস্তের মধ্যে দিয়ে তাঁর আসল স্বরূপ বোঝা কোন দিনই আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এবং ক্রমে ক্রমে এই বিশ্বাসই আমাদের জন্মেছিল, ব্রাউনের সমস্ত রহস্যের যদি কেউ কিছু জেনে থাকে তাহলে সে একমাত্র গ্রিমেকভ্।
পরদিন ডঃ মেলভিল কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলে গত রাত্রের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে
কিছু জানা গেল। সংক্ষেপে তিনি যা বললেন তা হলঃ গত রাত্রে লেফটেনন্ট করনেল হ্যারিসের তাঁবুতে কতকগুলি জরুরী সরকারী কাজ সেরে যখন নিজের তাঁবুতে ফিরছিলেন, ঠিক সেই সময় মরলি এসে জানাল ব্যারাকের কাঁটাতারের বেড়ার বাইরে সে নাকি অদ্ভুত এক ধরনের জানোয়ারকে ঘোরাফেরা করতে দেখেছে। শুধু সে দিনই নয়, কয়েক দিন ধরেই সে দেখে আসছে। বিশেষ করে ঠিক রাত ন’টার পর তার ঘরের জানলা থেকে সে পরিষ্কার দেখতে পায়। তার ঘরটি ঠিক তারের বেড়ার পাশে থাকায় বোধহয় স্পষ্ট করেই দেখা সম্ভব হয়েছে। ব্যারাকের এদিকটায় নিবিড় বন। ঠিক তারই মধ্যে কালো রং-এর একটি প্রাণী গভীর রাত পর্যন্ত চলাফেরা করে। অন্ধকারে তার আসল রূপ দেখা সম্ভব হয়নি। তবে মাঝে মাঝে তার শরীর থেকে ফিকে হলুদ রঙের আলো বের হয়। স্থানীয় অসভ্য লোকদের ধারণা—প্রাণীটি তাদের বনদেবতা। কাউকে সে কিছুই বলে না। পাছে কেউ তাকে ক্ষেপায়, তাই কথাটি আর কাউকের বলেনি মরলি! গত রাত্রেও তাকে নাকি দেখা যায়। মরলির কথায় ডঃ মেলভিল লোভ সামলাতে পারলেন না। সার্জেন্ট ডিককে বলে মরলির সঙ্গে তিনি জঙ্গলে প্রবেশ করেন। কিন্তু প্রায় শ’খানেক গজ সবেমাত্র এগিয়েছেন—ঠিক এমন সময়—মাত্র হাত দশেকের মধ্যে দেখা গেল দপ্ করে একটা মৃদু হলদে আলো জ্বলে উঠল। আর ঠিক তার পরেই মনে হল—আসলে সেটা মানুষ না গিরগিটি—ডঃ মেলভিল কিছুই বুঝতে পারলেন না। দেহের তুলনায় অত্যন্ত ক্ষুদ্র মাথা। দু পায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়ালেও লম্বায় তাকে ফুট তিনেকের বেশী বলা চলে না। আর সব চাইতে বিস্ময়ের ব্যাপার, ওঁদের দেখেই সে থমকে দাঁড়াল এবং দেহ থেকে অতি দ্রুত কম্পনশীল এক ধরনের শব্দ শোনা যেতে লাগল। সে শব্দের অনুভূতি এতই প্রবল যে মুহূর্তের মধ্যে মনে হল—বুঝি-বা বিশ্বের সমস্ত আতঙ্ক যেন পুঞ্জীভূত হয়ে গ্রাস করে ফেলবে তাঁদের। তাঁরা দ্রুত ব্যারাকের দিকে দৌড়তে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত কি হয়েছে সে কথা আর স্মরণ করতে পারলেন না ডঃ মেলভিল।
মিঃ ব্রাউন বললেন, শব্দটা জন্তুটির দেহ থেকে নির্গত হয়েছিল এ সম্পর্কে কি আপনার কোন দ্বিমত নেই, ডঃ মেলভিল?
আমার অত বেশী স্মৃতিভ্রংশ এখনও হয়নি, মিঃ ব্রাউন। কতকটা রাগত ভাবেই জবাব দিলেন ডঃ মেলভিল।
প্রথমে আলো, তারপর শব্দ শুনেছিলেন, তাই না?
ব্যাপারটা ঠিক তাই হয়েছিল। তবে শব্দ বললে ভুল হবে। আসলে বিকট আওয়াজ বলতে যা বোঝায় তা হয়নি। একটা মৃদু গুঞ্জন, তবে সাধারণ শব্দের থেকে তার তরঙ্গ মাত্রা অত্যন্ত বেশী ছিল।
ডঃ মেলভিলের উত্তর শুনে অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে গেলেন মিঃ ব্রাউন। তারপর—সত্যিকথা বলতে কি মিঃ ব্রাউনের অমন করুণ চাহনি জীবনে আর কখনও দেখিনি। মনে হল একটা বিরাট দুঃস্বপ্ন দেখছেন তিনি। আস্তে আস্তে উঠে গেলেন গত রাত্রে যে গিরগিটি জাতীয় জীবটি নিয়ে তিনি পরীক্ষা চালিয়েছেন, তার কাছে। অত্যন্ত মৃদু কণ্ঠে বললেন, দাঁড়ান।
আমরা টেবিলের চারপাশে রুদ্ধশ্বাসে গিয়ে দাঁড়ালাম।
মিঃ ব্রাউন তাঁবুর দরজা জানালা বন্ধ করে দিলেন। অন্ধকারে তাঁবুর মধ্যে কোন কিছুই দেখা গেল না। ছোট্ট টেবিল ল্যাম্পটি জ্বাললেন। একবার আমাদের দিকে চেয়ে বললেন, লক্ষ্য করুন। তারপর গতরাত্রের মত টর্চ থেকে অতি সূক্ষ্ম একফালি আলো ফেললেন গিরগিটিটির ঠিক পিঠের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে অবাক হয়ে আমরা দেখলাম, যেখানটায় আলো গিয়ে পড়েছে সে স্থানটা হঠাৎ সবুজ হয়ে গেল। আর তার কিছুক্ষণ পরই সে জায়গাটা থেকে বের হতে লাগল ফিকে হলুদ রঙের একটি আলো। কিন্তু তার চাইতে বড় কথা অত্যন্ত ক্ষীণ একটা শব্দ যেন কানে ভেসে এল আমাদের।
মুহূর্তে লাফিয়ে উঠলেন ডঃ মেলভিল। —এই তো সেই শব্দ! সেই প্রাণঘাতী শব্দ যা মরলি সহ্য করতে পারেনি। যা আমাকেও প্রায় সাবাড় করে এনেছিল আর কি!
আলো নেভালেন মিঃ ব্রাউন। আর সেদিন রাত্রেই আমাদের সামান্য কয়েকজনকে যে তথ্য জানালেন তা শুনে প্রত্যকেই আমরা ভয়ে, বিস্ময়ে এবং প্রচণ্ড হতাশায় ভেঙে পড়ার সামিল হয়ে পড়লাম।
—এ ও কি সম্ভব! এই যে পৃথিবী, তার আলো, তার সভ্যতা—মানুষের এত অহঙ্কার—ভাবা যায় না। সত্যিই ভাবা যায় না। ঐ ক্ষুদ্র গিরগিটি না বলে কি যে বলব—তার জন্যে শেষ পর্যন্ত—!
কিন্তু সমস্ত কিছু জেনেও যুদ্ধকালীন নিদারুণ পরিস্থিতির কথা ভেবে তখনকার মতো কোন উচ্চবাচ্যই আমরা করতে পারলাম না। সুখের বিষয়, যুদ্ধের শেষ অবধি আমাদের কোম্পানি ওখানেই থেকে গেল। আর দীর্ঘ প্রায় এক বৎসর ধরে আমরা আমাদের নতুন জানা তথ্য সম্পর্কে নির্ভুল হবার জন্যে বার বার পরীক্ষা চালিয়ে দেখতে লাগলাম।
১৯৪৫-এর মাঝামাঝি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মিত্রপক্ষ জয় লাভ করলে আমরা আর্মি থেকে মাস তিনেকের ছুটি নিলাম। ইতিমধ্যে ডঃ মেলভিলও যেন অনেকটা নীরব হয়ে গেছেন। গবেষণার মধ্যে তাঁর তেমন কোন আর উৎসাহ নেই। অনবরতই যেন ভেবে চলেছেন কি যেন। আমি, ডঃ মেলভিল, মিঃ ব্রাউন এবং মিঃ গ্রিমেকভ্ মিলে দল তৈরি করলাম। ডঃ মেলভিল হলেন দলপতি। আসলে তখন আরও তথ্য সংগ্রহ করবার জন্যে আমরা রীতিমত ক্ষেপে উঠেছি। ইতিমধ্যে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে অনেকগুলি যন্ত্রপাতি এবং বিভিন্ন সামগ্রী আনিয়ে নেওয়া হল। সেপ্টেম্বর নাগাদ সুম্বারই প্রায় মাইল পঞ্চাশেক দূরে সাভুল দ্বীপপুঞ্জ থেকে একটা আতঙ্কের সংবাদ আমাদের কাছে এসে পৌঁছল। অর্থাৎ সেখানেও নাকি ঐ ধরনের নতুন জীব দেখা গেছে। রাত্রের দিকে কখনও কখনও তারা লোকালয়ের কাছে আসে এবং তাদের দেখামাত্র কেউ উন্মাদ হয়ে আত্মহত্যা করছে, কেউবা হার্টফেল করে মারা যাচ্ছে। কর্তৃপক্ষরা চেষ্টা করেও তাদের ঠিক হদিশ পাচ্ছে না। কারণটা আমাদের কাছে অত্যন্ত সহজ বলেই মনে হল। অতএব এ সুযোগটি আমরা আর ছাড়তে চাইলাম না।
এরপর যে ঘটনাগুলি অতি দ্রুত ঘটে গেল, আমি জানি আমার পাঠকবর্গের কাছে তা অত্যন্ত অবিশ্বাস্য বা অলীক বলেই মনে হবে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, যে নিদারুণ অভিজ্ঞতা নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের কাটাতে হয়েছে, তার তুলনা নেই। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা, মানুষের জীবনে সে অভিজ্ঞতা দ্বিতীয়বার যেন আর না আসে।
পাহাড় আর জঙ্গলে ঘেরা সাভুল দ্বীপপুঞ্জ। তারপর পাশে সাগর আর সাগর। স্থানীয় অধিবাসীরা খুবই অজ্ঞ। সরকারী সহায়তায় আমরা আমাদের কাজ শুরু করলাম। ইতিমধ্যে মিঃ ব্রাউনের পরিকল্পনা মতো কতকগুলি মুখোশ তৈরি করা হয়েছিল। মুখোশে বিশেষ এক ধরনের লেন্স লাগান ছিল। আর ছিল অতি সূক্ষ্ম-তরঙ্গ প্রতিহতকারী যন্ত্র, দুই কানে চেপে থাকে সেই মতো তৈরি করা।
আমাদের সঙ্গে ছিল উভচর যান। গত মহাযুদ্ধে এই যানগুলি জলে এবং স্থলে সমানে ঘুরে বেড়িয়েছে। যুদ্ধের শেষে এদের বয়ে নেবার মতো ধৈর্য এবং খুব বেশী একটা প্রয়োজনও সরকার বোধ করলেন না। কাজের সুবিধে হবে বলে আমরা চারটে উভচর যান সঙ্গে নিলাম। সেই সঙ্গে প্রচুর পেট্রোল। আর এদের সাহায্যে সাভুল দ্বীপপুঞ্জ তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়াতে লাগলাম। সদা ত্রস্ত। বিশেষ করে মাথার মুখোশের ওপর সকলের নজর বেশী। কারণ মিঃ ব্রাউন বললেন, যে শব্দ ঐ জীবগুলির দেহ থেকে বেরিয়ে আসে তা অতি কম্পনজাত শব্দ অবশ্য সত্যিকারের শব্দ ভুল হবে, আসলে শব্দের অনুভূতি। ওদের গায়ের ঐ হলুদ আলোর তরঙ্গের দৈর্ঘ্য অত্যন্ত কম। ঐ আলোই কানের পর্দায় শব্দের অনুভূতি জাগায়। এমন কি মাথার খুলি ভেদ করে মস্তিষ্কের ওপর দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
সুম্বাতে গিরগিটির মতো ঐ প্রাণীর ওপর পরীক্ষা চালিয়েই এই সমস্ত তথ্যে
তিনি পৌঁছেছিলেন। আসলে ডঃ মেলভিল যা দেখে আতঙ্কগ্রস্ত হয়েছিলেন ঐ প্রাণীটি তারই শাবক। শেষ পর্যন্ত এটিকে অবশ্য বাঁচিয়ে রাখা যায়নি।
তাই বেশ সতর্কতার সঙ্গেই আমরা চলতে লাগলাম।
প্রথম তিন চারদিন কোন কিছুই চোখে পড়ল না। ডঃ মেলভিল একটু দমে গেলেন। তা ছাড়া তাঁর বয়স হয়েছে। এত ঝক্কি এবং ছোটাছুটি করে উঠতে পারছিলেন না। মিঃ ব্রাউন তাই তাঁকে ঘোরাঘুরি কম করতে বললেন। কিন্তু নিজে দিনরাত এদিক সেদিক ছোটাছুটি করতে লাগলেন।
পাঁচ দিনের দিন খবর এল কার্পেন্টেরিয়া উপসাগরের ওয়েলেসলির কোন এক স্থানে চারজন আদিবাসী পাগল হয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে পাগলের মতো আমরাও ছুটলাম টিমোর সাগর, ওয়েলেস দ্বীপপুঞ্জ এবং ভয়ঙ্কর আরহেম অন্তরীপ হয়ে ওয়েলেসলিতে। এখানে এসে পথ কষ্টে হঠাৎ মিঃ মেলভিল দারুণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ডঃ স্টোন তাই ব্যস্ত রইলেন তাঁকে নিয়ে। মিঃ ব্রাউন, গ্রিমেকভ্ এবং আমি অনুসন্ধানের কাজ চালাতে লাগলাম। আর সত্যি সত্যিই একদিন সাক্ষাৎ মিলল আমাদের সেই আকাঙ্ক্ষিত প্রাণীর।
সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা। গভীর পার্বত্য জঙ্গলে আমরা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। পরিষ্কার—একেবারে পরিষ্কার দেখা গেল একটি ঝর্ণার ধারে জল খাচ্ছিল। রীতিমত ঘাবড়ে গিয়ে আমি এবং গ্রিমেকভ যখন বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে গেছি, ঠিক তখনি মিঃ ব্রাউন কখন তাকে লক্ষ্য করে ছুটে গেলেন টেরই পাইনি। কিন্তু তখনও জানতাম না মিঃ ব্রাউনকে আমাদের হারাতে হবে।
মিঃ ব্রাউনকে একা ওভাবে ছেড়ে দেওয়ার মতো নির্বুদ্ধিতার কথা ভেবে ভয়ে উৎকণ্ঠায় আমরা প্রায় পাগলের মতো ছোটাছুটি করতে লাগলাম। কিন্তু বৃথা! সমস্তই বৃথা হয়ে গেল! কয়েকদিন সমানে খোঁজাখুঁজি করার পর না পেলাম মিঃ ব্রাউনের দেখা, না পেলাম তার উভচর যানের কোন হদিশ।
অবশেষে দিন পনের সেখানে অতিবাহিত করার পর আমরা যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গেলাম। মনের দুঃখ মনেই রইল। হতভাগ্য মিঃ ব্রাউনের অবশ্যম্ভাবী স্বরূপটির কথা চিন্তা করে হাল না ছেড়ে দিনের পর দিন আমরা নতুন পরিকল্পনা রচনার কথা নিয়ে ভাবতে লাগলাম। ডঃ মেলভিলের পরিচালনায় নতুন ভাবে উদ্যোগ পর্ব চলতে লাগল। তবে পৃথিবীর মানুষ যাতে আমাদের কার্যাবলীর কথা চিন্তা করে ভেঙে না পড়ে তাই সমস্ত কিছুই চলতে লাগল গোপনে।
এরপর দীর্ঘ পনের বৎসর অতিক্রান্ত হয়েছে। নানা রকম বিপর্যয়ের মধ্যে আমাদের নতুন অভিযান ক্রমেই শ্লথ হয়ে আসছিল। এমন সময় একদিন রাত্রে—সম্ভবতঃ সেটা ৮ই মার্চ হবে—হঠাৎ টেলিফোন কল বেজে উঠল।
ইয়েস, মিঃ কর স্পিকিং। কথা বললাম আমি।
ওপার থেকে ভেসে এল ডঃ মেলভিলের উত্তেজিত কণ্ঠস্বরঃ মিঃ কর? মিঃ ব্রাউন বেঁচে আছেন। হি ইজ ইন অস্ট্রেলিয়া। আই মিন ইন মাউন্ট ককবারন!
তার মানে? এবার আমিও কম উত্তেজিত হলাম না।
হি ইজ আফটার হিপেসকাস।
এ আপনি কি বলছেন, ডঃ মেলভিল। এ-খবর আপনি পেলেন কি করে?
ইতিমধ্যে আমরা ঐ জন্তুটির নাম রেখেছি হিপেসকাস বা হাইপার সাউণ্ড কারেন্ট সিনক্রোনাইজার অর্থাৎ অতিরিক্ত শব্দ এবং বিদ্যুৎশক্তি মিলনক্ষম জন্তু। নামকরণের কারণটি শেষটুকু পড়লেই বুঝতে পারবেন।
ব্রডওয়ে টেলিভিসন কোম্পানির টেলিভিসন চিত্রে। ব্যাপারটা সারা নিউইয়র্কে রীতিমত উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে। লস এঞ্জেলসে বসে হয়ত তুমি পরিস্থিতিটা ঠিক বুঝতে পারছ না। একেবারে আমার নিজের চোখে দেখা। আজ সাতটার প্রোগ্রামে ওরা অস্ট্রেলিয়ার প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখাচ্ছিল। কয়েকদিন ধরেই নাকি দেখছে। শুধু এটি দেখার জন্যে এর মধ্যে কয়েক লক্ষ টেলিভিসন সেট পর্যন্ত বিক্রী হয়ে গেছে। আজ সন্ধ্যে সাতটার প্রোগ্রাম আমিও দেখলাম। একটা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ছুটে চলেছে হিপেসকাস। তার সারা দেহ থেকে যে আলো বেরুচ্ছে রঙিন চিত্রে পরিষ্কার তা বোঝা যায়। আর তার পেছনে পাগলের মতো ছুটে চলেছেন মিঃ ব্রাউন। হ্যাঁ হ্যাঁ! পরিষ্কার চিনতে পেরেছি তাঁকে। যদিও মুখে দাড়ি কিন্তু তাঁর ঐ খুঁড়িয়ে চলাটা আমার কাছে অত্যন্ত পরিচিত।
আর যেন শুনতে পারছি না আমি। উত্তেজনায় আমার সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগল। অস্ফুট স্বরে শুধু বললাম, প্লিজ ডঃ মেলাভিল, কালকের সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। আমি এখন ঠিক কিছু বুঝতে পারছি না।
সেদিন রাত্রেই প্লেনে চলে এলাম নিউইয়র্ক এবং সেই রাত্রেই ব্রডওয়ে টেলিভিসন কোম্পানির সঙ্গে দেখা করে সরকারী সহায়তায় টেলিভিসন চিত্রটি দেখে ফেললাম। কোম্পানীর ম্যানেজারকে বললাম, আমাদের জীবন মরণ সমস্যা, মশায়। এ ছবি দেখান বন্ধ করুন। ভদ্রলোক তো শুনতেই চান না। শেষে আসল কথাটা জানাতে হল। কি ভাবে এই ছবিটি সংগ্রহ করেছে জিজ্ঞেস করায় জানালেন, দিন পনের পূর্বে অস্ট্রেলিয়ার মাউন্ট ককবারন-এ যখন এই কোম্পানি এলোপাথারি ছবি তুলেছিল, তখন গভীর জঙ্গলের মধ্যে হঠাৎ এই ছবিটি ধরা পড়ে। মাত্র মিনিটখানেক তারা ঐ জন্তুটিকে দেখতে পায়। সঙ্গে মিঃ ব্রাউনকে ওরা ঠিক বুঝতে পারে নি। পরে বহু খোঁজাখুঁজি করেও ওদের সাক্ষাৎ পায় নি। নিউইয়র্কে ফিরে আসার পর জনৈক নৃতত্ত্ববিদ নাকি বলেছেন তারা নাকি পৃথিবীর এক নতুন অতি প্রাচীন প্রাণীর ছবি তুলে ফেলেছে যার হদিশ প্রাণীবিজ্ঞানীরা রাখেন না।
মাথা আর মুণ্ডু! বেশ রাগতভাবেই মন্তব্য করলাম আমি। তবে মনে মনে একটু আশার আলোও দেখলাম। এই প্রথম প্রত্যক্ষ করলাম হিপেসকাসকে। বেঁটে। মাথাটা অস্বাভাবিক ছোট। গায়ের কোন জায়গা সবুজ। কোন জায়গা লাল। দেহে লোম নেই বললেই চলে। কতকটা মানুষ, কতকটা গিরগিটির মতো দেখতে। পায়ের তুলনায় হাত অত্যন্ত ছোট। চোখগুলিও ছোট।
অবশেষে ছবি দেখান বন্ধ রইল। সরকারী সাহায্যে আমরা সেদিনই অস্ট্রেলিয়া যাত্রা করলাম। রীতিমত অস্ত্রশস্ত্র নিয়েই যেতে হল। সঙ্গে সাহায্য করার জন্যে আরও জন পনের লোক চলল।
শেষ পর্যন্ত পৌঁছলামও মাউন্ট ককবারনে এবং কি নিদারুণ চেষ্টার পর কোন রকমে মিঃ ব্রাউনকে উদ্ধার করলাম, সে কথা অনিবার্য কারণবশতঃ আপাততঃ প্রকাশ করতে পারলাম না বলে দুঃখিত। শুধু এটুকু বলে রাখছি, যখন তাঁকে আমাদের নাগালের মধ্যে পেলাম তখন তিনি পাগল-উন্মাদ। পুরো পাঁচ দিন মাউন্ট ককবারনের বিজন অঞ্চলে নিজেদের রীতিমত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে আমরা আমাদের অনুসন্ধান কার্য চালিয়ে গেছি। পাগলের মতো আমরাও হিপেসকাসের পেছনে ধাওয়া করে গেছি। অত্যন্ত চতুর সে প্রাণী। মানুষের বুদ্ধি তার কাছে কোথায় লাগে। শুধু তাই নয়—আমাদের মনে হয়েছে ওরা টেলিপ্যাথির সাহায্যে নিজেদের মনের ভাব সহজেই আদান প্রদান করতে পারে। কোন রকম শব্দ না করে কোন এক অজ্ঞাত উপায়ে ওরা পরস্পর যে যোগাযোগ রাখতে পারে তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। অদ্ভুত ওদের কৌশল। বহু চেষ্টা করেও ওদের আমরা নাগালের মধ্যে পাইনি। মিঃ ব্রাউনকে আমরা পেলাম তাঁর পুরানো এবং ভাঙা উভচর যানের কাছে। স্মৃতিভ্রংশ হয়েছিল তাঁর। পাগলের মতো এই কয় বৎসর ঘুরে বেড়িয়েছেন ওদের পেছনে। লোকালয়ের একেবারে বাইরে।
মিঃ ব্রাউন বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। যদি কোনদিন সেরে ওঠেন হয়ত সেদিনই জানতে পারব কি করে সেখানে তিনি গেলেন। কি অভিজ্ঞতাই বা পেয়েছেন।
কিন্তু কি এই হিপেসকাস? সে কেমনধারা জন্তু? এ প্রশ্ন সকলের মনেই জাগা স্বাভাবিক। ইচ্ছে ছিল আপাততঃ একেবারে চেপে যাব কিন্তু টেলিভিসন কোম্পানির কথা প্রকাশ হওয়ার পর অন্ততঃ কিছু না বলে পারা যায় না। এই প্রসঙ্গে গত ৮ই জুন ‘দি ইন্টারন্যাশনাল বাইও-ফিউচার প্রোগ্রাম কাউনসিলের’ সভায় ডঃ মেলভিল যে বক্তৃতা করেন আপনাদের অবগতির জন্যে এখানে তার পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ উদ্ধৃত করলাম। আশা করি আমার পাঠক পাঠিকারা এর মধ্যেই হিপেসকাস নামকরণ এবং তার সম্পর্কে কিছু তথ্য জানতে পারবেন:
‘সম্মানিত অতিথিবৃন্দ, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, পৃথিবীতে নতুন এক ধরনের প্রাণীর আগমন ঘটেছে যার আমরা নামকরণ করেছি ‘হিপেসকাস’। টেলিভিশনে এর চেহারা অনেকেই আপনারা প্রত্যক্ষ করেছেন। এ প্রাণী উদ্ভিদের মতোই শুধু বাতাস থেকে গ্যাসীয় পদার্থ গ্রহণ করে বেঁচে থাকতে পারে। সূর্যের আলো বা যে কোন সাধারণ আলোক রশ্মি এদের গায়ের ওপর পড়লেই যেখানে আলো পড়ে সেখানটা গাছের পাতার মতো সবুজ হয়ে যায়। আর পাতার সবুজ কণিকার সাহায্যে উদ্ভিদ দেহে যেমন কার্বোহাইড্রেট তৈরি হয় এদের দেহেও তেমন হতে থাকে। এদের দেহকোষে মুহূর্তের মধ্যে আলোর অনুপস্থিতিতে আবার তা রূপান্তরিত হয়ে আর এক ধরনের কোষে পরিণত হয়—কতকটা পাসটিডেরই মতো যা বাতাসের নাইট্রোজেন এবং জলের সাহায্যে সরাসরি এ্যামাইন অথবা চর্বি জাতীয় খাদ্য তৈরি করতে সক্ষম হয়। অতএব সাধারণ খাদ্যদ্রব্যের ওপর এদের মোটেই নির্ভর করতে হবে না। আর সবচাইতে অদ্ভুত ব্যাপার, নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য এরা গ্রহণ করে না। আত্মরক্ষার জন্যে এরা দেহ থেকে এক ধরনের আলোকরশ্মি নির্গত করে যার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য সাধারণ আলোর তরঙ্গ থেকে অনেক কম। আর সেই কারণেই অতি সহজে এই আলো মানুষের খুলিকেও ভেদ করতে পারে এবং মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটাতে পারে। মিঃ ব্রাউন সুম্বা দ্বীপে থাকাকালীন এই ধরনের একটি প্রাণীর বাচ্চা নিয়ে পরীক্ষা করেন, সে সংবাদ খুব ভাসা ভাসা ভাবে আমাদের পরিচিত দু-তিনজন জেনেছিলেন। তবে তখন তার ওপর খুব একটা গুরুত্ব তাঁরা দেননি। মিঃ ব্রাউন বলেছিলেন, এরা উদ্ভিদের মতো খাদ্য গ্রহণ করতে পারে আবার প্রাণীর মতো এক স্থান থেকে আরও এক স্থানে ইচ্ছে মতো ঘুরেও বেড়াতে পারে। তাই ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে যখন সাধারণ প্রাণী বিশেষ করে মানুষের বেঁচে থাকার মতো খাদ্যদ্রব্যের অভাব দেখা দেবে তখন এরা অবাধে বেঁচে থাকতে পারবে। অবশেষে মিঃ ব্রাউন একটি তথ্যপূর্ণ সিদ্ধান্তও করেছেন ও রসায়ন শাস্ত্রে যেমন প্রথম মৌলিক পদার্থ হাইড্রোজেন, আধুনিক পদার্থবিদদের মতে এই হাইড্রোজেনেরই রূপান্তর এবং বিন্যাসক্রমে ক্রমে জটিল পদার্থগুলির সৃষ্টি করেছিল, জীবজগতেও ঠিক তেমনই সাধারণ এককোষী প্রাণী বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে মানুষের মতো জটিলতম জীবে পরিণতি পেয়েছে। অবশেষে মানুষ একদিন এ পৃথিবী থেকে বিলীন হবে—যে ভাবে তার তার বংশ বৃদ্ধি হচ্ছে খাদ্যাভাবেই সে মারা যাবে। পৃথিবীর ভূ-প্রকৃতিও ক্রমে তার প্রতিকূলে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু হিপেসকাসের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার ক্ষমতা অনেক বেশী। তাই আজ সব চাইতে একটি বড় প্রশ্ন আমাদের মনে রীতিমত ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ কি তা হলে বির্বতনের শেষ সীমায় উপস্থিত? বিবর্তনের তালিকার পরবর্তী প্রাণী কি তাহলে হবে হিপেসকাস? মানুষের মৃত্যু হবে ক্ষুধার তাড়নায়—একথা ভাবলে একমাত্র এ ছাড়া কোন উত্তরই আমরা আজ খুঁজে পাচ্ছি না।
.
প্রথম প্রকাশ: আশ্চর্য!, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ১৯৬৫