প্রফেসর ত্রিশঙ্কু • শিশির কুমার মজুমদার
এই গল্প প্রঃ শঙ্কুর নয়, প্রঃ ত্রিশঙ্কুর গল্প।
ও সোজা কথায় বলতে হলে বলতে হবে, প্রঃ শঙ্কু টু দি পাওয়ার তিন ইকোয়লটু প্রঃ ত্রিশঙ্কু। তবেই বুঝে নিন তিনি, কে, কেমন, কত শক্তিধর।
একটা বিজ্ঞান মেলায় ভীড়ের মাঝে ঘুরে সব কিছু দেখছিলাম, মনে মনে ভাবছিলাম, ইউরোপ, আমেরিকায়, রাশিয়ায়, ওরা বিজ্ঞানকে কোথায় এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে, আমাদের দেশ… হঠাৎ খপ করে কে যেন আমার হাতটা চেপে ধরল। বলল, পেয়েছি।
চমকে তাকিয়ে দেখি সেই বিখ্যাত প্রঃ ত্রিশঙ্কু আমার সামনে দাঁড়িয়ে। এক গাল হেসে তিনি বললেন, আপনাকেই খুঁজছিলাম। আরে মশাই সেবারে সেই মুলতানি গাইটা… যাকগে সে কথা। এবারে যা আবিষ্কার করেছি তা জগৎ কাঁপাবে। চলুন, দেখবেন চলুন। আজই এখুনি। এখানে আর কি দেখছেন, আমার ওখানে গেলে চমকে যাবেন।
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, এবারের যন্ত্রটা কি নিয়ে? তা না শুনে ভালভাবে না বুঝে আর যাচ্ছি না। একথা বললাম বটে, তবে মনে মনে ভাবছিলাম, গেলে যদি সেই আগের বারের মত একটা গল্প লেখা যায় তো মন্দ কি? কিছু টাকা তো পকেটে আসবে। ও হো, সে গল্পটা বুঝি, আপনারা জানেন না? ও তাহলে পরে শোনানো যাবে। কি বলেন? এখন যা বলছি তাই শুনুন।
প্রঃ ত্রিশঙ্কু বললেন, পাগল হয়েছেন আপনি? এখানে এই ভীড়ের মধ্যে আমার সব কথা বলি আর কি, অমনি ভিনদেশী স্পাইরা তা শুনে নিয়ে ওদের দেশে গিয়ে পেটেন্ট নিয়ে নিক, আর আমি এখানে বসে বসে বুড়ো আঙুল চুষি। চলুন, চলুন, বাইরে চলুন! ট্যাক্সিতে বসেই সব কথা হবে। ভয় নেই ট্যাক্সি ভাড়া আমার। সেবারের মতো পত্রিকায় গল্প লিখে আপনার হবে নিট লাভ।
বুঝলাম, আগের গল্পটা ওঁর চোখ পড়েছে। তাতেও যখন ওঁর কোনও ভাবান্তর নেই, তখন দ্বিতীয় গল্পটাই বা ছাড়ি কেন?
বললাম, চলুন, কোথায় যেতে হবে। তা এবারের যন্ত্রটা কি নিয়ে?
উনি আমাকে প্রায় টানতে টানতেই মেলার বাইরে আনলেন। সামনের ট্যাক্সির দরজা খুলে ঠেলে আমাকে তুলে দিয়ে নিজেও উঠে পড়লেন। দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বললেন, সব কিছুরই অনেক রকম রূপ আছে। জল, তিন রকম। লোহা তিন রকম, না, না, দুরকম। মানুষের, হাজার রকম, ভাল মন্দ, বদমাশ, পাজী থেকে শুরু করে পঞ্চভূতে মিলিয়ে যাবার সময় পর্যন্ত যে কত রকম রূপ, তার হিসাব কে রাখে? তাই যদি হবে তো শব্দেরই বা নানান রকম রূপ হবে না কেন বলুন? শব্দ কি জিনিস নয়?
আমি ভ্যাবাচাকা খেয়ে বললাম, এ বটে, শক্ত শব্দ, পাতলা শব্দ, ধোঁয়াটে শব্দ, তেকোণা শব্দ, এসবই বা হবে না কেন? কিন্তু তা দিয়ে কি হবে আমাদের?
ধমকে উনি বললেন, বোকার মতো কথা বলবেন না। এতটা বুঝলেন, আর বাকীটা বুঝতে পারলেন না? শক্ত শব্দ ছুঁড়ে মারা যায়। তাতে শত্রুপক্ষ ঘায়েল হবে, প্রাণে মরবে না। মারতে হলে পাতলা শব্দে চুবিয়ে মারতে হবে। আর দম বন্ধ করতে চান তো ধোঁয়াটে শব্দ ছাড়ুন। আর একটা হিরোসিমা নাগাসাকি ঘটিয়ে দেওয়া যাবে ওই শব্দ ধোঁয়া ছেড়ে। খরচ? কুল্লে হয়তো চার পাঁচ পয়সা, যার পঁয়ষট্টি ভাগই মেকী। তাও আবার এক কালে মাঝে ফুটো ছিল। তা হলেই বুঝুন আমার আবিষ্কারের গুরুত্বটা।
আমি তো হাঁ হয়ে গেছিলাম! কথা বলব কি? শক্ত শব্দ মাঝে মাঝে অফিসের বসের কাছে শুনি, যখন তিনি কাজে ভুল করে সে ভুলের দায়িত্ব আমার ঘাড়ে চাপান। কিন্তু তা বলে পাতলা শব্দ, ধোঁয়াটে শব্দ!! সে আবার কি?
কি জানি বাবা, এবারে প্রঃ ত্রিশঙ্কু কি কাণ্ডই না করে বসেন। যন্ত্রের হাতল ধরে টান দিলে, শেষে আমরাই না আবার পাতলা শব্দের মাঝে হাবুডুবু খেয়ে ডুবে মরি। ছলাৎ ছল, কলাৎ কল, ঝর ঝর, কল কল, কুলু কুলু, টিপ টিপ, টুপ টাপ, এর বেশীও কি পাতলা শব্দ আছে? সব যদি এক সঙ্গে তেড়ে যন্ত্রের মুখ দিয়ে বার হতে আরম্ভ হয় তাহলেই তো সর্বনাশ! একেবারে ভেসেই যাব!
প্রঃ ত্রিশঙ্কু বললেন, ভাল্ব ছত্রিশটা, দাঁতকাটা চাকা আটচল্লিশটা, এমনি চাকা ডজন দুই। তা ছাড়া ট্রানজিস্টার, চোক, ট্রান্সফরমার, স্পিকার, লাউড স্পিকার যে কতগুলো লেগেছে, তার হিসাব আমি জানলেও, বললেও আপনি বুঝবেন না। চলুন, আপনার সামনে হাতল টানব, আর শব্দের সঠিক রূপ স্বচক্ষে আপনি দেখতে পাবেন। হুঁ হুঁ বাব্বা, এবারে মুলতানি গাই না।
আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, সেবারে তো একটা মুলতানি গাই আর একজন লেখক ছিল আপনার যন্ত্রের জ্বালানি, এবারে জ্বালানি কি?
উনি একটুও চিন্তা না করেই বললেন, হিন্দী সিনেমার গান, মাদ্রাজী ছবির ডায়লোগ, হিন্দুস্থানীদের ঝগড়ার ভাষা, মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীদের ব্যবসার ভাষা, সঙ্গে কিছু বিখ্যাত বাঙ্গালী লোকদের সরকারি প্রাইজ পাওয়া বইয়ের অংশের ভাষা, ব্যাস, এই সাফিসিয়েন্ট। তারপর হাতল টানো আর ভাষার আসলি রূপ দেখ। না, না, শব্দের। আর প্রয়োজন মতো যন্ত্রের চাবি ঘুরিয়ে শব্দের এক রূপ এক এক ভাবে কাছে দূরে সামনে পিছনে কাজে লাগিয়ে দাও। শত্রুরা বর্ডার ছেড়ে পালাবে, বিপক্ষের সবাই দু হাত আকাশে তুলে ধেই নৃত্য শুরু করে দেবে। বন্ধুরা বলবে, মাইরী চকাচক। কেউ লাঠি নিয়ে তেড়ে আসবে, কেউ আবার দু চোখ বুঁজে মাথা দোলাবে খুশিতে। অপূর্ব আবিষ্কার। প্রথম এর কদর দেশের লোক বুঝলে হয়। না বোঝে তো সব কিছু তুলে নিয়ে ভিনদেশে চলে যাব। নোবেল প্রাইজ চাই, তো ওটা ছাড়ি কেন?
ট্যাক্সি ড্রাইভার গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিয়ে বলল, স্যার, আপনার ওই যন্ত্রটাতে যাতা ভেঙাস কারের গান শোনা যাবে? আর ওই ছিঃ জনের বেরেক নাচের তালের ভাম্পো ভ্যাম্পো বাজনা শোনা যাবে? সস্তায় আমায় একটা যন্তর দেবেন স্যার? মানথিলি ইনস্টলমেন্টে টাকাটা দিয়ে দেব। সাচ বাত বলছি।
প্রঃ ত্রিশঙ্কু বাধা দিয়ে বললেন, থাক থাক। আর বলতে হবে না। যাচ্ছই তো আমার ওখানে, যন্ত্রের সামনে তোমায় ওই খেউরগুলো শুনিও তো ভাল করে। তাহলে, জ্বালানি কিছু বাড়বে। বেশ, বেশ, তাহলে নয় ফের একটা যন্ত্র দেবার চেষ্টা করব। কিন্তু তুলে নেবে কি করে…?
মহাখুশি হয়ে ড্রাইভার বলল, আপনি লোকটা মাইরী…
সেই আগের মতোই একটা পাঁচিল ঘেরা বাড়ির ফটকের সামনে ট্যাক্সিটাকে দাঁড় করালেন প্রঃ ত্রিশঙ্কু। দরজা খুলে নেমে ব্যস্ত হয়ে জামার পকেটগুলো হাতড়ে বললেন, ঐ যাঃ মেলায় দেখছি আমার পিকপকেট হয়ে গিয়েছে। ভাড়াটা মিটিয়ে দিন তো! বলে আর না দাঁড়িয়ে সোজা লোহার গেটে গিয়ে জোরে জোরে ধাক্কা দিতে লাগলেন।
ড্রাইভার বলল, যাঃ কলা, এ যে দেখছি চালু পূর্জা, ও মশাই, আপনারও পিকপকেট হয়নি তো? দিন দিন ভাড়া। না হলে, মুখের বুকনি নয়, হাতের সুখ করে নেব মশাই। আমি ছাড়ব না।
ভীষণ ভয়ে আমি গুণে গুণে ভাড়ার টাকা মিটিয়ে দিলাম। মিটারে কত যে উঠেছে তা দেখতেই ভুলে গেলাম। দেখলেও, তখন কি আর হিসেব কষতে পারতাম? ড্রাইভার খুশি মনে হাসি মুখে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে হাওয়া হয়ে গেল। তার মানে দেড় চোট খেলাম।
ওদিকে গেটটা তখন বিশ্রী আওয়াজ করে খুলে গেল। একটা নেড়া মাথা ছোকরা মুখ বার করে এদিক ওদিক দেখে ফিস ফিস করে বলল, আপনে ঢোহেন জলদি। পিচনে ইসপাই লাগছে, বোঝেন না? জলদি করেন, জলাদি করেন।
স্পাই! চমকে প্রঃ ত্রিশঙ্কু পিছন দিকে তাকালেন। আমাকে ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, দেখেছেন নাকি তাকে? সর্বনাশ! বেটা গেল কোন দিকে? ঠিক গন্ধে চলে এসেছে। ফর্মুলাটা হাতিয়ে নেবার ফন্দী।
নেড়া বলল, আরে আরে করেন কি!! করেন কি! ইসপাইরেই জিগাইতেছেন ইসপাইয়ের কথা! আপনের ভীমরতি ধরছে। তা না অইলে অমন যন্তর বানান! আসেন, আসেন ভিতরে ঢোহেন।
প্রঃ ত্রিশঙ্কু এই মারেন তো সেই মারেন করে তেড়ে গেলেন ছেলেটার দিকে। বললেন, কাকে কি বলছিস রে নেড়া, এ্যাঁ, কাকে কি বলছিস… স্পাই দেখেছিস কোন দিন, দেখেছিস? তা না…
আমি বললাম, থাক থাক, ছেলেমানুষ। এখন ভিতরে চলুন। যন্ত্রটা দেখি। কি নাম দিয়েছেন যন্ত্রটার?
উনি গজ গজ করতে করতে ভিতরে ঢুকলেন। পিছন পিছন আমিও। নেড়াটাও সমানে গজ গজ করতে লাগল, আমি বুঝুম ক্যামনে। হয়নরেই তো সন্দেহ হয়। তবে?
প্রঃ ত্রিশঙ্কু শান্ত হয়ে বললেন, তোকে তখুনি বলেছিলাম, নেড়া হোসনে, হোসনে। সব বুদ্ধি বেরিয়ে যাবে। তা না, কোথায় মামাতো ভাইয়ের পিসতুতো শালার মাসতুতো দিদির কার যেন কে মরেছে, অমনি অশৌচ হয়েছে বলে নেড়া হলি! দেখ এখন কি ঝামেলা পাকাচ্ছিস।
নেড়া ক্ষেপে কি গিয়ে বলল, জানেন নি অশোচ অইলে ন্যাড়া অইতে হয়। ছেরাদ্দ করতে হয়। তয় ঠিক কে যে মরছে বুঝি নাই বইলা শুধু ন্যাড়া অইছি। হ্যার লেইগ্যা এত কথা ক্যান?
আমি বললাম, থাক থাক, অত রাগ করতে নেই। নেড়া মাথায় চাঁদি গরম হয়ে যাবে। শেষে কি হতে কি হয় কে বলতে পারে?
ও বলল, দেহেন তো আপনে, আমি বইল্যা নাম করা ওয়েল্ডার, বেশী মাইনা পাওনের লোভে এইহানে আইয়্যা ফাইস্যা গেছি। রাত্র দিন নাটের লগে ইসকুরু, তার লগে চাকা, তার গায়েনি পাইপ, পিছনে চোঙ্গা, সামনে হাণ্ডিল ওয়েল্ড করছি, কি যে কিম্ভুতকিমাকার যন্তর অইছে তা উনিই জানেন, এহন কইতাছে, মাথায় বুদ্ধি নাই। নাই তো নাই… থাকলেনি জাহাজের কাম ছাইড়া এই হানে মরতে আসি? অ্যাপনেই কয়েন?
আমি বললাম, তা তো ঠিক। কিন্তু যন্ত্রটা কই?
ক’পা এগিয়ে একটা ভাঙ্গা দালান পার হয়ে বাঁয়ে মোড় নিতেই নেড়া বলল, ওই দ্যাহেন হেই যন্তর! দেহেন, দেহে ওইটা যন্তর না কিম্ভুত এউকগা লোহার
খাঁচা!
থাম, থাম, অনেক বকেছিস। বললেন প্রঃ ত্রিশঙ্কু, ওটার কদর যদি তুই বুঝতে পারতিস, তাহলে তো আমি মাথা নেড়া করে ওয়েল্ডার হতাম, আর তুই নোবেল লরিয়েট হতিস। যাক সে কথা। আপনি শুনুন… বলে হাসি হাসি মুখে আমার দিকে তাকালেন প্রঃ ত্রিশঙ্কু। তারপর দুহাত মহা আনন্দে কচলাতে কচলাতে বললেন, এই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। এটার জন্যেই আমি থাকব না যখন তখনও মানুষে আমার নাম করবে।
আমার মনে হল ওঁর সব যন্ত্রের চেহারাই প্রায় এক রকম। এটার অবশ্য বয়লার পেট নেই। তার বদলে আছে চারদিকে লাগান সেই কুকুর মার্কা গ্রামোফোনের পুরানো বেশ কটা চোঙ্গা। শব্দের সঠিক রূপ বোধ হয় ওর মধ্যে দিয়েই বার হয়। কিন্তু মনে মনে খটকা লাগল, শব্দের শক্ত নিরেট রূপটাও কি ওই চোঙ্গা দিয়েই বার হয়। আটকে যাবে না?
নেড়া ভীষণ রেগে বলল, আমিনি এসিসটেন্ট! ন্যান, কন এহন কোন হেণ্ডেলটা টানতে অইবো?
প্রঃ ত্রিশঙ্কু যন্ত্রটার এক পাশে সরে গেলেন। সে দিকেই দেখলাম যন্ত্রের যেন একটা ফোকলা মুখের মতো ফাঁক আছে। ওঃ, তাহলে শব্দের শক্ত রূপটা বুঝি এখান দিয়েই ঠাই ঠাই করে পড়বে।
প্রঃ ত্রিশঙ্কু অন্যমনস্কের মতো কি যেন বললেন। আমি যেন শুনলাম, উনি বললেন, টান। অমনি নেড়া সামনের হাতলটাই প্রাণপণে ঘ্যাঁ—য়্যাচঁ করে টেনে নিল। অমনি যন্ত্রের ভিতর থেকে সু-উ-উ-ৎ করে মুখ দিয়ে ঝোল টানার মতো একটা প্রচণ্ড শব্দ উঠল! কিন্তু কিছু বোঝার আগেই বাতাসেও টান পড়ল ভীষণ! আমি, আমার আগে প্রঃ ত্রিশঙ্কু দুজনেই সেই টানে যন্ত্রের মুখের কাছে প্রায় গিয়ে পড়লাম। প্রঃ ত্রিশঙ্কু চেঁচিয়ে উঠলেন, আরে আরে আরে ন্যাধা… (বোধ হয় নেড়াকে গাধা বলতে গেছিলেন উনি।) কিন্তু কথা উনি শেষ করতেই পারলেন না, তার আগেই ওঁর মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত সবটাই যন্ত্রের ওই মুখের মধ্যে ঢুকে গেল! চটি পড়া পা দুটো শুধু শূন্যে নেড়াকে খুঁজে লাথি চালাতে লাগল। নেড়া সঙ্গে সঙ্গে জিভ কেটে বলল, সর্বনাশ, ভুল হেণ্ডেল টাইন্যা থুইছি। ওইটা টানলে দুনিয়ার বেবাক হক্ত শব্দ হয়ে যতই হক্ত হউক না ক্যান যন্তরের মধ্যে টাইন্যা লইবো। হামনে তেমন হক্ত শব্দ না পইয়া আমাগো পেপেচোররেই টাইন্যা নিছে। এহন মাথা ঠাণ্ডা কইরা কাম করেন লাগবো। তিন নম্বর হেণ্ডেলটা টানতে অইবো। বলেই ও এক হ্যাচকা টানে একটা হাতল নামিয়ে দিল। দিয়েই চেঁচিয়ে উঠল, এই সারছে, আবার ভুল কইর্যা ফেলাইলাম। এ তো দেহি শব্দ কামানের হেণ্ডেল! জোরসে টাইন্যা দিছি। পলান, পলান, না অইলে ঘয়েল আইবেন কইয়া দিলাম। বলেই ও ছুট লাগাল। আমি তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। নেড়া প্রায় ভাঙ্গা দালানটায় কাছে পৌঁচেছে, অমনি যন্ত্রের ভিতর থেকে বিকট একটা আওয়াজ বার হল, বুম, নেড়া, বুম, তোর একদিন কি আমারই একদিন, বুম, বুম।
ফিরে দেখি নেড়া ঘাসের ওপর পড়ে পা দুটো সমানে ছুঁড়ছে। আর ওদিকে যন্ত্র থেকে সমানে আওয়াজ বার হয়ে চলেছে, বুম, বুম, বুম! বিকট আওয়াজে কান ঝালাপালা হবার যোগাড়, প্রাণ আইঢাই করে উঠল। কিন্তু কি সর্বনাশ ওদিকে যে প্রঃ ত্রিশঙ্কু শূন্যে সমানেই দু-পা ছুঁড়ে চলেছেন। এখুনি কিছু একটা করা দরকার। আমি ভীষণ ভয়ে তিন নম্বরের পাশের পাঁচ নম্বর হাতলটা টেনে দিলাম। অমনি সুরুৎ করে প্রঃ ত্রিশঙ্কু যন্ত্র থেকে বার হয়েই বললেন, বাঁচালেন মশাই। নেড়ার চাকরি খতম। একের পর দুই, তার পর তিন, এমনি করেই তো হাতলগুলো টানবে, তা না.., আপনি মশাই মাথা ঠাণ্ডা রেখে তিনের পর ভাগ্যিস চার টানেন নি, চার টানলেই হয়েছিল আর কি। শব্দের পরমাণু ফাটতো। সে যে কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার তা আজ পর্যন্ত কেউই জানে না, আমি তো কোন ছার। এখন আমি এক নম্বর হাতল টেনে আমার যন্ত্রের গুণ আপনাকে দেখাব। একটু ওদিকে সরে দাঁড়ান। কিছু গোপন রাখার ব্যাপার আছে তো, কে বলতে পারে, আপনি কোনো শত্রু দেশের স্পাই কিনা? রেডি, ওয়ান, টু, থ্রি।
আমি সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলাম, আ হা হা করছেন কি, করছেন। কি, ওটা যে চার নম্বর… কথা আমি শেষ করতে পারিনি। বিকট শব্দের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড যেন ভেঙ্গে পড়ল আমাদের চারপাশে প্রায় বেহুঁশ হয়েই পড়েছিলাম। হুঁশ ফিরে এলো, একটা কাতর শব্দে। ও দিকে নেড়া এক ঘেয়ে ভাবে কাতরাচ্ছে, ওরে বাব্বা, গেছি গেছি গেছি! এউকগ্যা ইসকুরুপ মাথায় আইয়া পড়েছে। হেই তেই এই, বন্টু পড়লে আর দ্যাখতে অইতো না। এমন কাম আর আমি করুম না। জাহাজেই ফিইর্যা যাইমু।
ভাল করে চোখ পিট পিট করে তাকিয়ে দেখলাম, পাশেই প্রঃ ত্রিশঙ্কু চিৎপাত হয়ে পড়ে আছেন। নেড়ার মাথার মাঝখানটা ফুলে ঢিপি। আমার কিছুই হয়নি। সামনের অমন বিশাল যন্ত্রটা আর নেই। তার জায়গায় সারা বাগান জুড়ে ছড়িয়ে আছে লোহা লক্কড়ের টুকরো।
চোখ চেয়ে প্রঃ ত্রিশঙ্কু বললেন, আজ নেড়ার একদিন কি আমারই একদিন। ভাল করে যন্ত্রটা ও ওয়েল্ডিং করেনি। তাই বলেই তো শব্দের পরমাণু না ফেটে যন্ত্রটাই ফেটে চৌচির হল। ও হো হো হোঃ, আমার কি সর্বনাশ হল। আমার
এমন প্রচেষ্টা বিফল। এ দুঃখু আমি রাখব কোথায়!
নেড়া ভীষণ রাগে বলল, হ এহোন তো হক্কল দোষই ন্যাড়ার অইবো। যন্তর ফাটছে তায় না প্রাণে বাঁচছেন, শব্দের এটম বোমা ফাটলে তো আর এমন কইর্যা মিথ্যা গাল পাড়তে পারতেন না। আমার পাওনা গণ্ডা মিটাইয়া দ্যান। আমিও আর এই হানে কাম করুম না। সিধা কথা।
আমি বললাম, মিথ্যা দুঃখ করছেন প্রঃ ত্রিশঙ্কু। আপনার পরের যন্ত্রটা নিশ্চয়ই জগৎ কাঁপাবে। তবে মনে রাখবেন, আমি বাসা বদল করেছি। আগের ঠিকানায় কিন্তু আর আমাকে পাবেন না। নতুন ঠিকানাটাও আনতে ভুলে গেছি।
প্রঃ ত্রিশঙ্কু বললেন, পরের যন্ত্র? না মশাই, যন্ত্র আমার মাথায় থাক। এর পরে আমি ভাবছি, অন্য বিষয় নিয়ে গবেষণা করব। তা ওকি মশাই চললেন যে? আপনাকে তাহলে ফের কোথায় পাব?
বড় বড় পা ফেলে গেটের দিকে যেতে যেতে আমি বললাম, চিন্তা করবেন না, সময় মতো আমি নিজেই যোগাযোগ করব। সোজা বাগানের বাইরে এসে প্রাণ খুলে দম নিলাম। উঃ, খুব বেঁচেছি। আবার…!
.
প্রথম প্রকাশ: ফ্যানট্যাসটিক, সেপ্টেম্বর, ১৯৮৮