হরিহরণ এফেক্ট • সুমিত কুমার বর্ধন
প্রফেসর সুরজিত ব্যানার্জী ক্ষোভে হতাশায় খালি নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে বাকি রাখলেন। দুমদুম করে টেবিলে দুহাতে কিল মারতে মারতে চেঁচাতে লাগলেন—“কেন? কেন? এক্সপেরিমেন্টটা সফল হচ্ছে না কেন? কেন? আমরা… আমরা প্রেসিডেন্সী কলেজের অধ্যাপক, আর আমরা এই সাধারণ এক্সপেরিমেন্টটা সফল করতে পারলাম না। আমাদের ছাত্রদের কানে কথাটা গেলে আমরা যে হাসির পাত্র হব!”
“আহা আপনার আর দোষ কোথায়। যদি অটোমেটিক রেকর্ডারটা কোন রেডিয়েশন রেকর্ড না করে তাহলে আপনি আর কি করবেন।” প্রফেসর শান্তনু হালদার প্রফেসর ব্যানার্জীকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন।
প্রফেসর ব্যানার্জী আরো খাপ্পা হয়ে উঠলেন—“কিন্তু কেন রেকর্ড করছে না সেটাই তো আমরা বের করতে পারলাম না! এরপর ছাত্ররা আমাকে ছাড়বে ভেবেছেন? ওরা নিজেরা পারছিল না বলেই তো আমাকে এক্সপেরিমেন্টটা করতে দিয়েছিল। এরপর আমিও যদিও না পারি তাহলে ওরা যে শুধু হাসাহাসি করবে তাই নয় ক্লাস নিতে গেলেও পেছনে লাগবে।”
তারপর অটোমেটিক রেকর্ডাটার দিকে চোখ পড়তে আবার দ্বিগুণ জ্বলে উঠলেন—“সব দোষ ওই রেকর্ডারটার। ওটাকে… ওটাকে আমি…!” বলে একটা টুল তুলে রেকর্ডারটা ভাঙতে যাচ্ছিলেন, প্রফেসর হাত থেকে টুলটা কেড়ে নিয়ে একরকম জাপটে ধরেই ল্যাবের বাইরে বের করে নিয়ে এলেন।
বাইরের ক্যান্টীন থেকে কয়েক গ্লাস অরেঞ্জ স্কোয়াশ খাইয়ে মাথাটা ঠাণ্ডা করানোর পর প্রফেসর হালদার আর একবার প্রফেসর ব্যানার্জীকে নিয়ে ল্যাবে ফিরে এলেন।
অটোমেটিক রেকর্ডারটার কাছে গিয়ে প্রফেসর হালদার রেকর্ডিং শীটটা হাতে করে তুলে ধরলেন। “এই দেখুন, কুড়ি হাজার অবধি কার্বনডাই অক্সাইডের ইনফ্রারেড রেডিয়েশন আমরা ঠিক ঠিক রেকর্ড করতে পেরেছি। কিন্তু তার ওপরে…”
প্রফেসর ব্যানার্জী ঈষৎ বিরক্তি ভরা গলায় বললেন—“ও তো আগেও দেখেছি। কিন্তু কেন এরকম হচ্ছে সেটা না বের করতে পারলে তো ছাত্রদের কাছে মুখ
দেখাতে পারব না।”
প্রফেসর হালদার অটোমেটিক রেকর্ডারটার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা স্পেকট্রো-মিটারের কাছে গিয়ে বললেন “আপনি শুধু তো অটোমেটিক রেকর্ডারটা নিয়েই পড়েছেন। স্পেকট্রোমিটারেও যে কোন গণ্ডগোল থাকতে পারে সে কথা একবার ভেবে দেখেছেন?”
স্পেকট্রোমিটারটা প্রেসিডেন্সী কলেজের কয়েকজন ফিজিক্সের প্রফেসরের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তৈরি। বলছি বটে স্পেকট্রোমিটার কিন্তু সে বোধহয় যন্ত্রটার কোন নাম কেউ রাখেনি বলেই। সাধারণ স্পেকট্রোমিটার মাপে সাদা আলোর বর্ণালীচ্ছটা, আর এ স্পেকট্রোমিটার মাপত আলোর রেডিয়েশন। অবজারভেটরি টাওয়ারে বসানো বিরাট লেন্সের ওপর সূর্যের আলো এসে পড়ত। তারপর একগাদা প্যারাবোলিক লেন্স আয়না ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে এসে পড়ত স্পেকট্রোমিটারের ভেতর। সেখান থেকে আলোটা আবার নানান ভাবে পরিশোধিত হয়ে শুধু ইনফ্রারেড আলো গিয়ে পড়ত অটোমেটিক রেকর্ডারটার ওপর। অটোমেটিক রেকর্ডার আবার তখন সেই ইনফ্রারেড আলোর পরিমাপ করত।
বলাই বাহুল্য স্পেকট্রোমিটারের কোথায় গণ্ডগোল তা বের করতে কমসেকম তিন চারদিন সময় লাগবে বলেই প্রফেসর ব্যানার্জী ওটাতে হাত দেন নি।
তবুও আর কোন রাস্তা না পেয়ে দুই প্রফেসর মিলে তন্ন তন্ন করে স্পেকট্রোমিটারটা তিনদিন ধরে চেক করলেন।
তিন দিনের দিন বিকেলবেলা শেষ বল্টুটা এঁটে দিয়ে প্রফেসর ব্যানার্জী অ্যাপ্ৰণে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ালেন।
“না। কোথাও কোন গণ্ডগোল নেই! তবুও কেন যে…।”
প্রফেসর হালদার একটা খাতায় কি সব হিসেব করছিলেন। খাতাটা আর কলমটা টেবিলের ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখতে রাখতে বললেন—“ছাড়ুন তো। কালকে চ্যান্সেলরকে বললেই হবে যে ওটা আর কাজ করছে না, কেন কাজ করছে না তা দেখার জন্য উনি বাইরে থেকে লোক নিয়ে আসুন। আমাদের আর মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই, চলুন।”
“হ্যাঁ চলুন, নিচের স্টাফরুম থেকে একটু রেডিও শুনে আসি। তিনদিন ধরে স্পেকট্রোমিটার ঘেঁটে মাথা ঝিম ঝিম করছে।”
“রেডিও!” প্রফেসর হালদার খানিকক্ষণ হাঁ করে প্রফেসর ব্যানার্জির দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর সম্বিং ফিরে পেয়ে বললেন, “এতবড় একটা খবর আর আপনি কিছু জানেন না।”
“কই না! কেন, কি হয়েছে!”
“কদিন ধরেই খবরের কাগজে এই নিয়ে এত হৈ চৈ হচ্ছে আর আপনি কিনা আজ আমায় জিজ্ঞেস করছেন কেন কি হয়েছে! আচ্ছা লোক মশাই আপনি!”
“হেঁয়ালী না করে একটু ঝেড়ে কাশুন দিকি! কি হয়েছেটা কি?”
“হবে আর কি, কদিন ধরে কোন অজানা কারণে পৃথিবীর সমস্ত রেডিও ব্যবস্থা বিকল হয়ে গেছে। পৃথিবীর তাবড় তাবড় রেডিও বিজ্ঞানীরা হাজার চেষ্টা করেও এর কোন কারণই খুঁজে পাচ্ছেন না। ফলে এই কদিন রেডিও শোনাটোনা বন্ধ হয়ে গেছে।”
.
প্রফেসর ব্যানার্জী ফিজিক্স বিল্ডিংয়ের ল্যাবোরেটরিতে বসে কিসব হিসেব নিকেশ করেছিলেন, প্রফেসর হালদার দরজা ঠেলে ধরে এসে ঢুকলেন। “সত্যি মশাই, আপনাকে নিয়ে আর পারা গেল না। কলেজ শুদ্ধ লোক ডক্টর হরিহরণের বক্তৃতা শোনার জন্য লাফালাফি করছে, আর আপনি এখানে বসে আছেন?”
“ডক্টর হরিহরণটা আবার কে?”
প্রফেসর ব্যানার্জীর প্রশ্নটা শুনে প্রফেসর হালদার হাঁ করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর ধপাস করে একটা খালি টুলে বসে পড়লেন।
“এতো দেখছি আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়া গেছে। ডঃ হরিহরণ কে সে খবরও আপনি রাখেন না। আরে মশাই! ডঃ হরিহরণ আগের বছর অ্যাসট্রোফিজিক্সে গবেষণার জন্য নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন। এবার থেকে খবরের কাগজ-টাগজগুলো একটু পড়া আরম্ভ করুন। নইলে শেষকালে কোনদিন লোক হাসাবেন। নিন উঠুন।”
প্রফেসর ব্যানার্জী উঠে দাঁড়ালেন বটে কিন্তু যাবার কোন লক্ষণই দেখালেন না। প্রথমেই প্রশ্ন করলেন—“কিন্তু ওই সব লম্বা লম্বা বক্তৃতাগুলো আমাদের কি কোন কাজে লাগবে!”
যখন দেখলেন প্রফেসর হালদার কোন জবাব দিলেন না তখন আবার বললেন—“মিছিমিছি ও সব থিওরির কচকচানি না শুনে এখানে বসে বসে সেদিনকার ওই অঙ্কটা কষে ফেললে হয় না?”
প্রফেসর হালদার কোন জবাব না দিয়ে প্রফেসর ব্যানার্জীর কাছে উঠে গেলেন। তারপর ডান হাতটা ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে কলেজের অডিটোরিয়ামের দিকে নিয়ে চললেন।
প্রফেসর ব্যানার্জী অবশ্য দু একবার প্রতিবাদ জানবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু যতবারই মুখ খুলতে গেছেন ততবারই প্রফেসর হালদার ওঁর দিকে এমন জ্বলন্ত
চোখে তাকিয়েছেন যে ওর আর মুখ খোলার সাহস হয়নি।
দুজনে মিলে যখন অডিটোরিয়ামে এসে ঢুকলেন তখন হল একেবারে কানায় কানায় ঠাসা। স্টুডেন্ট ইউনিয়নের পাণ্ডা নিরঞ্জন শর্মা দুটো সীট রেখে দিয়েছিল। সেই হাত নেড়ে দুই প্রফেসরকে ডাকল। দুজনে গিয়ে সীটে বসতে বলল—“ডক্টর হরিহরণ এক্ষুণি এসে পৌঁছলেন। ওঁর বক্তৃতা আরম্ভ হতে খানিকক্ষণ দেরি হবে। কিন্তু সীট ছেড়ে কোথাও যাবেন না। আমায় অনেক কষ্টে এ দুটো যোগাড় করতে হয়েছে,” বলে নিরঞ্জন চলে গেল।
হলের তুমুল হট্টগোলের ভেতর দশ মিনিট বসে থাকার পর ডক্টর হরিহরণ মঞ্চে এসে ঢুকলেন। পেছনে ভাইস চ্যান্সেলর সুনীত সেন আর ইউনিয়নের পাণ্ডা নিরঞ্জন শর্মা।
শেষোক্ত দুজনের ধন্যবাদ জ্ঞাপনটাপন হয়ে যেতে ডক্টর হরিহরণ কোনরকম ধানাইপানাই ছাড়াই বক্তৃতা আরম্ভ করলেন।
তাঁর বক্তব্য ছিল তাঁরই নবাবিষ্কৃত হরিহরণ এফেক্ট।
হরিহরণ এফেক্ট কি, এবং তার স্বপক্ষে কি কি প্রমাণ আছে, বোঝাতে ডক্টর হরিহরণ যে সমস্ত লম্বা লম্বা থিওরী এবং ফরমূলা উত্থাপন করলেন সে সব শুনে কলেজের ছাত্রদের তো কোন ছার, এমনকি বড় বড় অ্যাসট্রোফিজিক্সের প্রফেসরদেরও বুদ্ধিশুদ্ধি তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল।
ডক্টর হরিহরণ মূল বক্তব্যের শেষে ছোটখাট একটি বোমা ফেললেন অডিটোরিয়াম ভর্তি জনতার ওপর। বললেন, “হরিহরণ এফেক্ট ব্রহ্মাণ্ডের একটি বিশেষ অবস্থা যখন ব্রহ্মাণ্ডে কুচকে ছোট হয়ে যেতে থাকে। ব্রহ্মাণ্ডের কয়েকটি অংশে আমি এই পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি, আর আমাদের সৌরমণ্ডলের গ্রহগুলোর আচার ব্যবহার লক্ষ্য করে স্থির সিদ্ধান্তে এসেছি যে আমরা ব্রহ্মাণ্ডের যে অংশে বাস করছি সে অংশটুকুতে এ বিশেষ অবস্থা দেখা দিয়েছে কয়েক বছর আগে থেকে।”
ডক্টর হরিহরণ থামার পর বেশ কিছুক্ষণ সব নিস্তব্দ বইল, তারপর হঠাৎ পেছনের সীট থেকে বিখ্যাত গণিতজ্ঞ ডক্টর অজিতেশ আগরওয়ালা লাফিয়ে উঠলেন, “আপনি কি ইয়ার্কির আর জায়গা পাননি! যদি আপনার কথা সত্যি হয় তাহলে আপনার ফরমূলা অনুযায়ী আমরা এত ছোট হয়ে গেছি যে অণুবীক্ষণ ছাড়া আমাদের দেখা যাবে না! বলুন একি সম্ভব!”
হল শুদ্ধু লোকের দৃষ্টিটা ডক্টর আগরওয়ালার মুখের ওপর থেকে ডক্টর হরিহরণের মুখের ওপর আর একবার গিয়ে পড়ল।
ডক্টর হরিহরণ ঠাণ্ডা সংযত গলায় বললেন, “হতে পারে, বলা যায়। সবই সম্ভব।”
ক্যাণ্টীনে বসে খেতে খেতে প্রফেসর ব্যানার্জী ডক্টর হরিহরণের এফেক্টের ওপর লেখা কতকগুলো কাগজপত্র দেখছিলেন। বয় এসে চায়ের কাপটা দিয়ে যেতে মুখ তুলে তাকালেন।
প্রফেসর হালদার চিংড়ির কাটলেটে একটা কামড় দিতে দিতে বললেন— “কি হল, কিছু বোঝা গেল?”
প্রফেসর ব্যানার্জী চায়ের কাপটা টেনে নিয়ে বললেন “হ্যাঁ, কিন্তু ডক্টর হরিহরণের থিওরী অ্যাপ্লাই করতে গেলে সৌরমণ্ডলের চেহারাটা অসম্ভব ছোট হয়ে পড়ে। এত ছোট কি..?”
হঠাৎ কি একটা মনে পড়তে প্রফেসর ব্যানার্জী তড়াক করে সোজা হয়ে বসলেন। “আচ্ছা প্রফেসর হালদার, হরিহরণ এফেক্ট কি শুধু ম্যাটারকে এ্যাফেক্ট করে, না এনার্জিকেও করে?”
“না, এনার্জির ওপর হরিহরণ এফেক্ট দেখা দেয় না, শুধু ম্যাটারই এর দ্বারা এ্যাফেক্টেড হয়। কিন্তু হঠাৎ একথা?”
প্রফেসর ব্যানার্জীর মুখের ওপর চোখ পড়তে মাঝপথেই থেমে গেলেন প্রফেসর হালদার। প্রফেসর ব্যানার্জীর চোখ মুখ দিয়ে যেন আনন্দ উপছে পড়ছে।
“পেয়েছি! পেয়েছি!” প্রফেসর ব্যানার্জী শুধু লাফিয়ে উঠতেই বাকি রাখলেন। “প্রফেসর হালদার, শুনতে চান কেন পৃথিবীর সমস্ত রেডিও স্টেশন আজ বিকল?” প্রফেসর ব্যানার্জী উত্তেজনায় প্রঃ হালদারের হাতের কাজটা বজ্রমুষ্টিতে চেপে ধরেন—“শুনবেন কেন আমরা ২০,০০০ আর্মষ্ট্রঙ্গের বেশী রেডিয়েশন রেকর্ড করতে পারি নি?”
আঙুল দিয়ে নিজের ঝোল মাখানো প্লেটের ওপর একটা গোল্লা আঁকলেন ডক্টর ব্যানার্জী।
“এই দেখুন। মনে করুন এটা আমরা ব্রহ্মাণ্ডের যে অংশে বাস করছি সেইটার বাউণ্ডারী। এখন এই বাউণ্ডারী যত কুঁচকে ছোট হয়ে আসবে ততই বাউণ্ডারীর ভেতরের জিনিসগুলোও কুঁচকে ছোট হয়ে আসবে। কিন্তু হরিহরণ এফেক্ট এনার্জির ওপর খাটে না বলে এনার্জিগুলো ছোট হবে না। এবং যেহেতু বাউণ্ডারীর চাইতে বড় কিছুর অস্তিত্ব সম্ভব নয় সেই জন্য যে সমস্ত এনার্জির ওয়েভ লেংথ এই বাউণ্ডারীর দৈর্ঘের চেয়ে বড় তাদের অস্তিত্ব লোপ পাবে এই সীমারেখার চৌহদ্দির ভেতর থেকে।”
উত্তেজনায় জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলতে লাগলেন প্রফেসর ব্যানার্জী। প্রফেসর হালদার ভয় জড়ানো গলায় ধীরে ধীরে বললেন “সেই জন্যেই রেডিও ব্যবস্থা বিকল আর সেই জন্যই কুড়ি হাজারের ওপর কোন রেডিয়েশন রেকর্ড করতে পারি নি। কিন্তু তার মানে দাঁড়ায় আমাদের আশেপাশের ব্রহ্মাণ্ডের আকার…!”
“হ্যাঁ, প্রফেসর ব্যানার্জী প্রফেসর হালদারের মুখের কথাটা কেড়ে নিয়ে বললেন—“আমাদের ব্রহ্মাণ্ডের আকার এখন মাত্র ২০,০০০ আর্মষ্ট্রঙ্গ, অর্থাৎ—, গভীর উত্তেজনায় প্রফেসর ব্যানার্জীর গলার স্বর ঘসঘসে হয়ে এল।
“—অর্থাৎ এক ইঞ্চির দশ ভাগের একভাগ!”
একটা গোঁ গোঁ আওয়াজ করে প্রফেসর হালদার অজ্ঞান হয়ে গেলেন।
দুঃস্বপ্নের শুরু এইখানে থেকেই। হরিহরণ এফেক্ট সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গী হল আর কয়েকদিন বাদে।
হরিহরণ এফেক্ট অনুযায়ী ব্রহ্মাণ্ড কুঁচকে ছোট হতেই থাকল এবং সেই সঙ্গে একটা একটা এনার্জির অস্তিত্ব লোপ পেতে থাকল।
ইনফ্রারেড আগেই গিয়েছিল, এরপর ডাক এল সাধারণ নীল আলোর—কমপ্লট স্পেকট্রামে যার স্থান ইনফ্রারেডের পরেই।
এর ফল—একদিন সকালে সারা দুনিয়া শুদ্ধু লোক তাজ্জব হয়ে দেখল তাদের বাগানের সব তাজা গোলাপগুলোর রঙ এক রাত্তিরেই কোন মায়াবীর খেলায় কালো হয়ে গেছে। দুনিয়া শুদ্ধু মেয়েরা সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে প্রসাধন করতে গিয়ে আঁতকে উঠে দেখল তাদের ঠোঁটে কে যেন কালো কালির প্রলেপ লাগিয়ে দিয়েছে। যারা কল কারখানায় কাজ করতে গিয়ে হাত কেটে ফেলল, তারা সভয়ে লক্ষ্য করল তাদের ক্ষতস্থান দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে কালিবর্ণ কি এক তরল পদার্থ।
সমস্ত দেশের সরকারই কিন্তু ব্যাপারটাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। সরকারী আদেশ মতো মুখ বন্ধ না করে হরিহরণ এফেক্ট দিয়ে এই সমস্ত অদ্ভুত ঘটনার ব্যাখ্যা করতে গেলেন যে সমস্ত বিজ্ঞানী তাদের হয় কাজ থেকে বহিষ্কৃত আর নয় তুচ্ছ কারণে গৃহবন্দী করা হল। সরকারী ধামাধরা কয়েকজন বৈজ্ঞানিক আর উচ্চপদস্থ অফিসার রিপোর্টারদের কাছে জবানবন্দী দিতে লাগলেন গোটা জিনিসটাকে একটা “সাময়িক পরিবর্তন” বলে, ফলে পৃথিবীর লোক আরও কিছুদিন নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে নিল। হরিহরণ এফেক্ট অনুযায়ী সঙ্কোচনের গণ্ডি আরো দ্রুত হতে লাগল।
এবারে ডাক এল হলুদ আর কমলার। গাঁদা ফুল গোলাপের পদাঙ্ক অনুসরণ করল। যুঁই গাছের ফুলের সঙ্গে পাতার রঙের কোন পার্থক্য রইল না। চিড়িয়াখানার বাঘ সিংহগুলোর রঙ মসীলিপ্ত হয়ে গেল। রেসের মাঠে সবুজ ঘোড়া দেখবার জন্য ভীড় উপচে পড়তে লাগল। যে সব সুন্দরীরা সোনালী চুলের গর্ব
করত তাদের চুলের রঙও আর পাঁচটা মেয়ের মতো হয়ে গেল। আর…
আর একদিন বিশ্ববাসী বিস্ফারিত দৃষ্টি মেলে দেখল দূরের আকাশ বেয়ে উঠে আসছে একটা সবুজ রঙের সূর্য।
আর ব্যাপারটা গোপন রাখা গেল না। পৃথিবী জুড়ে আন্দোলনের ঢেউ বয়ে গেল। নানা তর্কের ঝড় উঠল। এবং শেষ পর্যন্ত জনমতের চাপে পড়ে পৃথিবীর সমস্ত সরকারকে একজোট হয়ে হরিহরণ এফেক্টকে সমগ্র মানবজাতির প্রতি একটা বিপদের সূচনা বলে স্বীকার করতে হল।
তারপরেও অনেক তর্কাতর্কি অনেক আলোচনার পর যখন ঠিক করা হল যে হরিহরণ এফেক্টের আবিষ্কর্তা ডক্টর হরিহরণকে কিছু বলতে অনুরোধ করা হবে, তখন পৃথিবীর নীলাকাশের বুক থেকে নীল রঙের সূর্য পৃথিবীর কালো রঙের গাছপালার ওপর অদ্ভুত নীল আলো ঝরিয়ে চলেছে।
প্রথমে ঠিক করা হয়েছিল যে ডক্টর হরিহরণ দিল্লীতে বক্তৃতা দেবেন কিন্তু যাবার পথে বিরাট জনতার ভীড় থেকে তাকে রক্ষা করা অসম্ভব বুঝেই সরকার কলকাতার ইডেন গার্ডেনসে তার বলার ব্যবস্থা করলেন।
নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে করতেই কেটে গেল আরো কয়েকটা দিন। ইতিমধ্যে অবস্থার আরো অবনতি ঘটল। জনতা এত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল যে নিরাপত্তার ব্যবস্থা অসম্পূর্ণ রেখেই ডক্টর হরিহরণকে ইডেন গার্ডেনসে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হল।
প্রঃ ব্যানার্জী ও প্রঃ হালদারও গেলেন।
ডক্টর হরিহরণের আসার কথা ছিল সন্ধ্যে সাতটায়। সাতটা দশ থেকেই জনতার মধ্যে একটা অস্বস্তি একটা ছটফটানি দেখা দিল। সাতটা কুড়ি নাগাদ সেটা একটা কলরব এবং সাড়ে সাতটা নাগাদ একটা তুমুল হট্টগোলে পরিণত হল। মাঝে মাঝে দুটো একটা করে চটি, পচা আনাজ ইত্যাদি মাঠের ওপর আছড়ে পড়তে লাগল। আর কিছুক্ষণ চললে কি হত বলা যায় না। কিন্তু হঠাৎ বাইরে জনতার নির্ঘোষ শোনা গেল এবং তার কিছু পরেই বড় বড় ফ্লাডলাইটের নীল আলোর তলা দিয়ে হেঁটে সেই বহু প্রতীক্ষিত মানুষটি মঞ্চের ওপর গিয়ে উঠলেন।
জনতা তুমুল উল্লাসে ফেটে পড়ল। কিছুক্ষণ ধরে করতালির আওয়াজে ঢাকা পড়ে গেল সব কিছুর আওয়াজ। তারপর উচ্ছ্বাস থেমে যেতে মাইক্রোফোনে ডক্টর হরিহরণের গলার আওয়াজ গমগম করে উঠল,
“ভদ্রমহোদয়গণ! আমাকে ডাকা হয়েছে হরিহরণ এফেক্ট সম্বন্ধে আরো কিছু জানাতে। আমি আমার বক্তৃতা আরম্ভ করছি কতকগুলো চিঠির জবাব দিয়ে। প্রথম চিঠিটি পাঠিয়েছেন লন্ডন থেকে একজন ভদ্রমহিলা। ইনি লিখেছেন যে, সমস্ত রেডিও স্টেশন বিকল হয়ে পড়ার ফলে বিবিসি থেকে তাঁর স্বামীর চাকরি গেছে। ইনি জানতে চেয়েছেন যে, রেডিও স্টেশনগুলো আবার চালু হবার কোন সম্ভাবনা আছে কিনা। এর উত্তর হল যে, রেডিও স্টেশনগুলোর কোনদিন চালু হবার কোন সম্ভাবনাই নেই।”
যে জনতা এতক্ষণ আশা করে বসেছিল, সেই জনতার মধ্যে এবার শুরু হল নৈরাশ্যের গুঞ্জন। থেকে থেকে ভেসে এল সিটি, অশ্রাব্য গালাগাল আর বেড়ালের ডাক।
প্রফেসর হালদার নিচু গলায় প্রফেসর ব্যানার্জীকে বললেন, “এরা এসেছিল আশার বাণী শোনার জন্যে। কিন্তু ডক্টর হরিহরণ এদের যে সমস্ত কথা শোনাচ্ছেন তাতে তো এদের নৈরাশ্য চরমে উঠে এরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে।”
প্রফেসর ব্যানার্জী জবাবে শুধু মাথাটা ওপর নিচে বাঁকালেন। “ভদ্র-মহোদয়গণ,” সমস্ত আওয়াজ ছাপিয়ে ডক্টর হরিহরণের গলা ভেসে এল—“দ্বিতীয় চিঠিটি পাঠিয়েছেন জাপানের জনৈক ভদ্রলোক। তিনি জানতে চেয়েছেন এই পরিবর্তনের প্রতিকার আমাদের জানা আছে কিনা। উত্তর: না নেই।”
জনতার মধ্যে প্রতিবাদের ঝড় আরো তীব্র হয়ে উঠল। কয়েক পাটি চটি মঞ্চের ওপর এসে পড়ল। গালিগালাজের তীব্রতা আরো বেড়ে গেল। কিন্তু তবুও সব কিছু অগ্রাহ্য করে ডক্টর হরিহরণ বলে চললেন, “আমার পাওয়া তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম চিঠিটি এসেছে যথাক্রমে পোল্যাণ্ড, বেলজিয়াম ও ব্রেজিল থেকে। এদের সবার মূল প্রশ্ন এক: অবস্থার কি উন্নতি ঘটবে? এই প্রশ্নের উত্তর: না, এ অবস্থার ক্রমেই অবনতি ঘটবে। সত্যি বলতে কি আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পৃথিবীর বুক থেকে সব আলো চিরতরে মুছে যাবে।”
ক্ষিপ্র জনতার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। যে হাতের সামনে যা পেল তাই নিয়ে কাটাতারের বেড়া ডিঙ্গিয়ে উন্মত্তের মতো মঞ্চের দিকে ছুটে চলল। মঞ্চ ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপত্তা বাহিনী রাইফেল উঁচিয়ে ধরল, দরকার হলে গুলি করবে।
কিন্তু কিছুই হল না, প্রফেসর হালদার, প্রফেসর ব্যানার্জী, সবাই দেখল এক এক করে ফ্লাডলাইটগুলো নিভে যাচ্ছে।
এক এক করে সমস্ত আলো নিভে যাবার পর, মাথার ওপরের বেগুনি চাঁদ আর টিমটিমে তারাগুলো অন্ধকার আকাশের বুকে মিলিয়ে যাবার পর, খানিকক্ষণ সমস্ত নিস্তব্ধ রইল। তারপর মাইক্রোফোনে আবার ভেসে এল ডক্টর হরিহরণের কণ্ঠস্বর—“মানব সভ্যতার এইখানেই ইতি। দুর্ভেদ্য এই অন্ধকারের ভেতরেই হবে তার কবর।”
আবার নিস্তব্ধতা নেমে এল সমস্ত স্টেডিয়ামের ওপর। কতক্ষণ যে দুই প্রফেসর চুপ করে বসে রইলেন তার হিসেব তারা নিজেরাই ভুলে গেলেন। হঠাৎ প্রফেসর হালদারের ঘোর কেটে গেল, কানে ভেসে এল কয়েকটা গানের কলি—অন্ধকারেই কেউ গাইছে:
অন্ধকারের অন্তরেতে অশ্রু বাদল ঝরে,
কোথায় আলো কোথায় আলো, আকাশ ভরা কালোয় কালো।
প্রফেসর হালদারের চোখের কোল বেয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।
.
প্রথম প্রকাশ: ফ্যানট্যাসটিক, এপ্রিল, ১৯৮২
বিদেশী ছায়ায়