ঘাড় বেঁকা পরেশ • মনোজ বসু
পরেশকে দেখেছেন? একবার দেখলে আর ভোলা যাবে না। ঘাড় বাঁদিকে বাঁকানো—বাঁহাত বাঁ-পায়ের সমসূত্রে। ভাল সার্জন দিয়ে অপারেশন করিয়েছে। একবার নয়, তিন তিনবার। বাঁকা ঘাড় সোজা হয়নি। হবে না, জানা কথা। কিন্তু মন বোঝে না—অকারণ অর্থনষ্ট। শুনুন বলি, সোজা ঘাড় কেমন করে বাঁকল।
বউ বনেদি ঘরের মেয়ে। ভাই নেই, চার বোন তারা। মায়ের যা ছিল, চার বোন ভাগ করে নিয়েছে। সেরিব্রাল থ্রম্বসিসে পরেশের বউ হঠাৎ মারা গেল। রোগের শুরু থেকেই অচেতন—মরার আগে একটি কথাও সে বলে যেতে পারেনি।
দুই ছেলে, এক মেয়ে। বিধবা দিদি আছেন সংসারে—দিদির উপর ছেলেমেয়েদের ভার চাপিয়ে পরেশ হিমালয়ে বেরুল। লোকে বলছে, আহা রে, পত্নী শোকে বিবাগী হয়ে বেরিয়ে গেল। হৃষীকেশের কাছে এক আশ্রমে আস্তানা নিয়েছে। পাহাড়-পর্বতে বনে-জঙ্গলে অহরহ ঘুরে বেড়ায়—সাধু-সন্ন্যাসী সিদ্ধপুরুষের খবর পেলেই চলে যায় সেখানে, যতদূর যত দুর্গমই হোক সে জায়গা। সৎপ্রসঙ্গ হয়, পরলোক-ঘটিত ব্যাপারগুলো পরেশ বেশি করে জানতে চায়। একটা সন্ধান পেতে চায় সে বউয়ের কাছ থেকে। মণি মাণিক্যখচিত পুরানো জড়োয়া হার একটা, লক্ষাধিক টাকা দাম, শাশুড়িঠাকরুণ চুপিচুপি তাকে দিয়েছিলেন। অন্য সবকিছু পাওয়া গেল, কিন্তু জড়োয়া হার বউ যে কোথায় রেখে মারা গেছে—ঘরবাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও মিলল না। বের করে দিয়ে যাক একবার এসে। আসা নিতান্তই যদি অসম্ভব হয়, জিনিসটা কোথায় আছে জানিয়ে দিক পশু-পাখি কিম্বা পেত্নী-শাকচুন্নির মারফতে (মানুষ কদাপি নয়—ঋষিতপস্বী হলেও নয়, কারণ সে ক্ষেত্রে পাচার হবার সম্ভাবনা থেকে যায়)।
ত্রিকালদর্শী এক মহাসাধুর বৃত্তান্ত শুনে পরেশ তাঁর খোঁজে চলল। ভারি দুর্গম জায়গায় থাকেন তিনি। রাত থাকতে বেরিয়েছে, যাচ্ছে তে যাচ্ছেই। পাহাড় জঙ্গল কত যে পার হল, অবাধ নেই। অধ্যবসায়ীর অসাধ্য কিছু নেই, অপরাহ্ন বেলা অবশেষে পৌঁছে গেল। দর্শনও মিলল। ভক্তি-গদগদ হয়ে সে সাধুমহারাজের পাদবন্দনা করল। এবং একতাল মিছরি ও রকমারি ফলমূল-মিষ্টান্ন পাদপদ্মে নিবেদন করে যুক্ত করে বসে আছে আশীর্বাদ লাভের প্রত্যাশায়। পরেশের পানে মহারাজ একদৃষ্টে তাকিয়েই আছেন, শব্দসাড়া দেন না কিছু। অবস্থা দৃষ্টে আখড়ার দুনম্বর সাধু চোখ টিপে পরেশকে কাছে ডেকে বললেন, মৌনীবাবা—সারাদিন সারারাতি ধন্না দিয়ে থেকেও সিকিখানা কথা বের করতে পারবে না বাপু।
পরেশ হাহাকার করে ওঠে: আমি যে বিস্তর আশা নিয়ে বহুদূর থেকে এসেছি—
তার জন্যে ভাবনা নেই। মহারাজ অন্তর্যামী—মনের আশা খুলে বলতে হবে কেন, উনিই মন থেকে টেনে বের করে যথাবিহিত ব্যবস্থা করছেন। করা হয়েই গেছে হয়তো এতক্ষণে।
এ হেন পাইকারি আশ্বাসে পরেশ তৃপ্তি পায় না। বহুদর্শী দু-নম্বর বুঝলেন সেটা। জমিয়ে গল্প আরম্ভ করলেন। মহারাজ-বাবার ইহলোক ও পরলোক ঘটিত বিবিধ তাজ্জব ক্রিয়াকর্ম। দস্তুর মতো রোমাঞ্চকর। বিশ্বাস করো চাই না করো, গল্পের সমাপ্তির আগে কার কার সাধ্য উঠে পড়ে!
কতক্ষণ কেটে গেছে, পরেশের হুঁশ নেই। গুম-গুম-গুম—মেঘগর্জন! সচকিত হয়ে সে উপরমুখো তাকায়। সর্বনাশ, মেঘে আকাশ ঢেকে গেছে। পালা, পালা—
দ্রুত নামছে পাকদণ্ডীর পথ ধরে। উঠতে সময় লেগেছে—নেমে পড়তে কষ্ট কম, সময়ও কম লাগবে। ঘোর অন্ধকার—সে এমন, পথ তো পথ—নিজের হাত-পাগুলো চেনা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বৃষ্টি নামল ছড়ছড় করে, সঙ্গে ঝোড়ো বাতাস। ক্ষণে ক্ষণে গাছতলায় আশ্রয় নেয়, বৃষ্টি কমলে আবার হাঁটে। কতক্ষণ ধরে যাচ্ছে এমনি শঙ্কা জাগল, দুর্যোগের মধ্যে পথ ভুল করেনি তো? জনপ্রাণী দেখা যায় না যে জিজ্ঞাসা করে নেবে।
বৃষ্টি থামল অবশেষে। অন্ধকারও চোখে সয়ে এসেছে—চারিদিকে আবছা রকম নজর চলে। হঠাৎ দেখা যায়, সামান্য দূরে দীর্ঘদেহ একজন। অতি দ্রুত চলেছে।
পরেশ যেন হাতে স্বর্গ পেল। ডাকছে: ও মশায়, শুনছেন, হৃষীকেশ আর কদ্দূর?
সেই দীর্ঘদেহী খিক-খিক করে উৎকট হাসি হেসে উঠল: এদিকে কোথা হৃষীকেশ? পাহাড়ের একেবারে উল্টোদিকে। সারারাত হেঁটেও হৃষীকেশ পাবিনে।
পরেশ আর্তনাদ করে উঠল: মশায় গো, পথ হারিয়ে ফেলেছি। মারা পড়ব, একটা আশ্রয় কোথায় পাই বলে দিন।
যাবি কোথা?
পরেশ বলে, অ্যান্টিবায়োটিক কারখানার কাছাকাছি গেলেই সেখান থেকে চিনে আমি আপন ডেরায় যেতে পারব।
সেই লোক বলে, আমি ঐদিকেই যাচ্ছি। চলে আয় আমার পিছু পিছু।
থেমে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল, আবার সে চলল। চলা মানে রীতিমত দৌড়ানো। পাহাড়-জঙ্গল ভেঙে দৌড়চ্ছে—কিছুই যেন তার গায়ে লাগে না।
পরেশ কাতর হয়ে বলে, আস্তে চলুন মশায়। অত জোরে পেরে উঠিনে আমি।
জোরে কে বলল? আস্তেই তো যাচ্ছিরে। জোরে যাওয়া দেখতে চাস?
পরেশ তাড়াতড়ি বলে, আজ্ঞে না। যা দেখছি, এতেই চক্ষু ছানাবড়া। বয়স হয়ে গেছে, ছুটোছুটি পেরে উঠিনে।
বয়স—কত বয়স তোর, শুনি।
পরেশ বলল, আজ্ঞে, পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই করেছি।
তিন-পঞ্চাশং দেড়শ’ বছর—আমার বয়স তা-ও ছাড়িয়ে গেছে। থপথপিয়ে চলিস—সেটা বয়সের জন্য নয়। গুচ্চের হাড়-মাংস-চর্বি বয়ে বেড়াচ্ছিস, দেহখানি পাল্লায় তুলে দিলে ওজনে দেড় মণ দু-মণ দাঁড়াবে। এত বোঝা চেপে থাকলে ছুটোছুটি হয় না। যখন বেঁচে ছিলাম, আমারও ঐ রকম ছিল রে—বাতে ধরেছিল, হাঁটতেই পারতাম না, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতাম। মরে গিয়ে কত সুখ এখন দেখ। বাতাসের মতন হালকা হয়েছি, যেখানে খুশি পলকে চলে যাই।
তারপর আবদারের ঢঙে আদুরে গলায় ভূত বলে, মরবি? হ্যাঙ্গামা নেই, গলা টিপে এক সেকেণ্ডে শেষ করে দিচ্ছি। দেখতে পাবি, কী মজা তখন। মর্ না রে!
সভয়ে পরেশ বলে, আজ্ঞে না। একবার মরে তারপরে যদি ইচ্ছা হয়, আবার তো বাঁচতে পারব না।
ভূত বলে, তা পারবি নে বটে। কিন্তু ইচ্ছেই হবে না—নিজের অভিজ্ঞতায় বলে দিচ্ছি। বেঁচে থাকার ঝঞ্ঝাট কত! দেহ বয়ে বেড়ানোর মুটেগিরি তো আছেই, আবার যা দিনকাল—ঐ দেহটা ধারণ করে থাকাই বড় চাট্টিখানি কথা নয়। মাছ-তরকারি চাল-ডাল অগ্নিমূল্য। আমরা বাতাসে বুড়ো আঙুল নাচাই: চালের কুইন্টাল হাজার টাকা হোক না—আমাদের এই কলা!
পরেশ কেঁদে পড়ল: মরার মজা বুঝে নিয়েছি ভূতমশায়। কিন্তু তিন ছেলে-মেয়ে আমার পায়ের শিকল। আমি নিজে স্ফূর্তিতে থাকব, কিন্তু বাচ্চারা ভেসে যাবে একেবারে। মরাটা এখন মুলতুবি থাক। দয়া করে আপনি হৃষীকেশের কাছ বরাবর পোঁছে দিন, চিরকাল আমি কেনা গোলাম হয়ে থাকব।
ভূত তখন সদয় হয়ে বলে, চল্ তবে। এমনি ছুটে পারবিনে, আমি তোর হাত ধরে, ছুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।।
ধরতে গিয়ে ভূত তিড়িং করে পিছিয়ে গেল: উ-হু-হু, তোর পায়ে লোহা আছে নাকি রে বেটা? হাত পুড়ে গেল আমার।
গলায় গুচ্চের মাদুলি—পরেশের খেয়াল হল। একটা তার মধ্যে লোহারই বটে। লোহার মাদুলি ছুঁড়ে ফেলে দিল সে। ভূত বলে, লোহায় আমাদের ভয়। লোহা ছুঁলে আগুনের ছ্যাঁকা লাগে। আর একটা জিনিস তোকে মানা করে দিচ্ছি। আমার সঙ্গে যতক্ষণ আছিস, সামনে ছাড়া কোন দিকে তাকাবি নে। ডাইনে বাঁয়ে পিছনে—কোন দিকে নয়। খবরদার!
যেই না ভূত মশায় হাত এঁটে ধরেছে—পরমাশ্চর্য ব্যাপার, পরেশ সঙ্গে সঙ্গে পাখির মতন হালকা। ভূত হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের উপর দিয়ে ঘন জঙ্গল ভেদ করে আবেশে চলেছে—গাছপালা গায়ে বাধে না, শক্ত পাথরের ঘা লাগে না। ঝর্ণা পথে পড়লে দুই পা একত্র করে ভাসতে ভাসতে স্বচ্ছন্দে পার হয়ে যায়। মরা-লোকে একখানি মাত্র হাত ধরেছে তাতেই এমন, আর নিজে মরবার পরে না জানি আরও কত সুখ!
সাঁ সাঁ করে ভূত এক উচু পাহাড়ের উপর নিয়ে এলো। নিচে আঙুল দেখায়-আলোর সারি সেখানে। বলে, চিনতে পারছিস, হৃষীকেশের অ্যান্টিবায়োটিক কারখানা। এবারে যেতে পারবি তো?
যে আজ্ঞে। বড় বাঁচিয়ে দিলেন আপনি আজ—
কৃতজ্ঞতায় গদ গদ হয়ে পরেশ ভূতের পদধূলি নিতে যায়। কিন্তু পা কোথায়—খানিকটা ছায়া মাত্র। ছায়ায় ধুলা লাগে না। পায়ের কোন স্পর্শই পেল না। ভূত বলে, ঐ হয়েছে। নেমে যা এইবারে। আমিও বাড়ি এসে গেছি। ঢুকে পড়ব।
পরেশ শুধায়: কোথায় আপনার বাড়ি?
এই পাহাড়ের নিচে—তোর কি দরকার—তুই চলে যা।
হাত ছেড়ে দিল ভূত। পরেশ তরতর করে নেমে যাচ্ছে। হঠাৎ চড়-চড়-চড়াৎ—পিছন দিকে প্রচণ্ড আওয়াজ। দুনিয়া চুরমার হয়ে গেল বুঝি। ঘাড় ফিরিয়ে পরেশ দেখল, যেখানটা এইমাত্র দাঁড়িয়ে কথা বলছিল—সেই পাহাড় দুদিকে দুই খণ্ড হয়ে হাঁ করে পড়েছে। ফাঁকের ভিতর দিয়ে পাতাল-তল অবধি নজর যায়—পথঘাট ঘরবাড়ি সেখানে, লোকজন কিলবিল করছে। টুপ করে ভূত তার মধ্যে গিয়ে পড়ল। আর, ঝিনুক যেমনধারা মুখ বন্ধ করে, ফাটাপাহাড় দু-পাশ দিয়ে এসে বেমালুম জুড়ে গেল। জঙ্গল, পাথর, ঝর্ণা—ঠিক আগেকার মতোই। গভীর রাত্রে নির্জন পাহাড়ে এই কাণ্ড ঘটে গেল, সামান্য মাত্র নিদর্শনও আর পড়ে নেই। নিচে অদূরে অ্যান্টিবায়োটিক কারখানা বিদ্যুতের আলোয় ঝলমল করছে। কারখানার পাশ দিয়ে থপ থপ করে পা ফেলে একলা পরেশ আস্তানায় ফিরছে।
পাহাড় কাটার আওয়াজে পাশে সেই যে ঘাড় ফিরিয়েছিল, ভূতের মানা মনে ছিল না তার—সেই ঘাড় কিছুতে আর সোজা হল না। পরেশের মুখ বাঁদিকের ফেরানো—বা কাঁধের সমসূত্রে।
.
প্রথম প্রকাশ: ফ্যানট্যাসটিক, সেপ্টেম্বর, ১৯৭৬