যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে • বিশু দাস
একটা ঘূর্ণির সৃষ্টি করে মাছটা তলিয়ে গেলো জলের নীচে। টোপ লাগিয়ে সুতোটা ছুঁড়ে দিলাম ঘূর্ণিটার মাঝখানে। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পর অধৈর্য হয়ে সুতোটা আবার দিলাম ঘূর্ণিটার মাঝখানে। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে আনমনে টোপ লাগাচ্ছিলাম কাঁটায়, হঠাং দৃষ্টি থেমে গেলো দূরের বড় পাথরটার ওপর কুটিরটায় বাধা পেয়ে। ঝরণাটা পেরিয়ে যেতে হবে পাথরটার কাছে।
আমার সঙ্গীকে জিজ্ঞেস করলাম, “ওই বাড়িতে কে থাকে?”
বাড়িটার দিকে একবার চেয়ে সে জবাব দিলো, “অধ্যাপক সান্যাল। নতুন এসেছেন।”
“অধ্যাপক সান্যাল মানে, সেই তিব্বত আর মিশরের প্রাচীন ইতিহাসের নামকরা অধ্যাপক সান্যাল নাকি? বেনারস ইউনিভার্সিটিতে আমি তাঁর ছাত্র ছিলাম। সেই অধ্যাপক সান্যালই যদি হন, তাহলে তো তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যেতে হয়। আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন তিনি।”
“কিন্তু তোমার পিঠের লাগানো কোন পাখা তো দেখতে পাচ্ছি না, আর একমাত্র উড়ে যাওয়া ছাড়া ওখানে পৌঁছোনোর আর দ্বিতীয় কোন উপায় নেই।”
“কেন, ওই তো পথ দেখা যাচ্ছে, এই পথ দিয়ে যাওয়া যাবে না? রাস্তাটা তো মনে হচ্ছে কুটিরের কাছে গিয়েই শেষ হয়েছে।”
“কিন্তু বন্ধু, একটু ভালো করে লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবে পথের মাঝখানে প্রায় দশ ফুট চওড়া একটি খাদ আছে। খাদের পাশ থেকে পথটা আবার শুরু হয়েছে। আগে ওই খাদের ওপর একটা কাঠের তৈরি সেতু ছিল। কিছুদিন আগে ধস নামায় সেটা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। অধ্যাপককে বাড়ির বাইরে প্রায় দেখাই যায় না। কোন কিছুর দরকার হলে পাহাড়ী চাকরটাকে পাঠান। কুটিরের ওপাশের পাহাড় চূড়োটা পার হলেই দার্জিলিং-এ যাবার পথ।”
“তোমার কথা শুনে তো হতাশ হয়ে পড়ছি, কিন্তু তবু চেষ্টা আমাকে একবার করতেই হবে। যাবার সময় আমার মাছ ধরার সরঞ্জামগুলো তাঁবুতে নিয়ে যেও। খাদের নীচে ওই যে স্রোতটা বয়ে যাচ্ছে ওটা পার হয়েই যাবো আমি। পাহাড় চড়ার শিক্ষা আমার কাছে, কারণ একসময় আমি মাউন্টেনিয়ারিং স্কুলের ছাত্র ছিলাম। আজ সেই জ্ঞান কাজে লাগাবার সময় এসেছে।” বন্ধুকে বিদায় জানিয়ে
এগিয়ে চললাম আমি।
স্রোত পার হতে খুব বেশী বেগ পেতে হল না, কিন্তু যেখানে এসে পৌঁছোলাম সেখান থেকে সংকীর্ণ পথটা খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে এঁকে-বেঁকে ওপরের দিকে উঠে গেছে। ওই পথ ধরে এগোনো ভীষণ শক্ত কাজ, একথা বুঝতে খুব বেশী দেরী হল না।
প্রথম শ’খানেক ফুট পার হলাম, খুব কষ্ট না করেই, কিন্তু তারপরেই হঠাৎ আরম্ভ হল সোজা খাড়াই। বেড়ালের মত বুকে ভর দিয়ে উঠতে হচ্ছিলো পাহাড়ের গা বেয়ে। আধঘণ্টা এইভাবে ওঠবার পর শরীরের প্রতিটি লোমকূপ দিয়ে ঘাম বেরুতে লাগলো। সমতল একটা পাথর দেখে বিশ্রাম নেবার জন্যে বসতে বাধ্য হলাম তার ওপর। সমান্তরাল পথটা দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। দূরে দেখা যাচ্ছে খাদটার উপর ছোট্ট একটা সেতু। অবশ্য সেতুর কাছে পোঁছোতে হলে কয়েক শ’ ফুট ওপরে উঠতে হবে এখনও। খানিকটা আশ্বস্ত হলাম। যাক, কোন রকমে পার হয়ে যাওয়া যাবে খাদটা। আসল সেতুটা ভেঙ্গে গিয়েছে, তারই ধ্বংসাবশেষ টিকে আছে এখনও। সেতুটার কাছে পৌঁছোবার আশায় বিশ্রাম নেবার কথা প্রায় ভুলেই গেলাম। আবার আরম্ভ হল পাহাড় বেয়ে ওপরে ওঠা। আরও আধঘণ্টাখানেক অক্লান্তভাবে পাহাড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে সেতুটার কাছে এসে পৌঁছোলাম। মোটা মোটা কাঠ দিয়ে তৈরি ছিলো সেতুটা, কিন্তু আজ আর সে সব কাঠের চিহ্নও নেই। দুটো মাঝারি আকারের বাঁশ একসঙ্গে বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে খাদটা পার হবার জন্যে। ধরবার সুবিধের জন্যে আর একটা ওই রকম বাঁশকে রেলিংয়ের মতো করে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। কে এই সমস্ত ব্যবস্থা করেছে কে জানে! তবে সেই লোকটির ওপর শ্রদ্ধার মাথা নুয়ে এলো আপনা-আপনি। খাদের দিকে তাকাতেই ভয়ে শিউরে উঠলাম। প্রায় পাঁচশ ফুট ওপরে পথটা গিয়ে মিশেছে কুটিরে যাবার পথের সঙ্গে। মনে মনে স্থির করলাম বাঁশের সেতুটা পার হয়ে ওপাশে যেতেই হবে, তাতে যত বিপদই আসুক না কেন।
ইঁট দিয়ে বাঁধানো জায়গাটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাঁশের সেতুর ওপর পা দিতেই দেখি সেটা ভীষণভাবে দুলতে শুরু করেছে। এর ওপর দিয়ে পার হওয়া মানে জীবনটা হাতে করে যাওয়া। কিন্তু এখন আর ফিরে যাবার উপায় নেই, এগোতেই হবে। বাঁশের রেলিংটা দুহাত দিয়ে চেপে ধরে যতদূর সম্ভব সাবধানে এগোতে লাগলাম, পাশ ফিরে। বাঁশের মসৃণ গা থেকে পা তুলতে ভয় করছে। পা দুটোকে যতদূর সম্ভব ঘষটে নিয়ে যেতে হচ্ছে।
এইভাবে প্রায় পাঁচফুট পার হবার পর, হঠাৎ পিছলে গিয়ে মাত্র একটা বাঁশের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। পট পট শব্দে পুরানো দড়ির বাঁধন ছিঁড়তে লাগলো। ভয়ে ঘেমে নেয়ে উঠলাম। দেহের ভারসাম্য হারিয়ে একপাশে হেলে পড়লাম। প্রাণপণ শক্তিতে বাঁশের রেলিংয়ের একটা জায়গা দুহাতে চেপে ধরে ঝুলতে লাগলাম। নীচে—অনেক নীচে হু হু করে বয়ে যাচ্ছে খরস্রোতা একটা পাহাড়ী স্রোত। হাত পা অসাড় হয়ে আসতে লাগলো, কিন্তু সে যাত্রা বেঁচে গেলাম কোনরকমে! এটুকু সৌভাগ্যও হয়তো বিধাতার মনঃপুত হল না। বাঁশটা হঠাৎ মট মট করে ভেঙ্গে গেলো। বাঁচবার শেষ চেষ্টায় মরিয়া হয়ে হাত দুটো বাড়িয়ে দিলাম ডুবন্ত লোকের মত কিছু একটা চেপে ধরবার আশায়। এতক্ষণ যেটার ওপর দাঁড়িয়েছিলাম সেটাতে হাত ঠেকলো। সেই বাঁশটা ধরেই ঝুলে রইলাম। দোল খাওয়া না থামা পর্যন্ত ঝুলেই রইলাম, তারপর আস্তে আস্তে সার্কাসের খেলোয়াড়দের মতো ঝুলতে ঝুলতে এগুতে লাগলাম সামনের দিকে। সেতুর শেষ প্রান্তে পৌঁছে দেহের শেষ শক্তিটুকুও আর অবশিষ্ট রইলো না। ক্লান্তিতে ভয়ে মড়ার মতো হয়ে গেছি তখন। এমন সময়, কার বলিষ্ঠ দুটো হাত আমাকে টেনে তুললো ওপরে। বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো স্বস্তির নিঃশ্বাস। সেই অজানা সাহায্যকারীকে দেখার কথাও মনে এলো না একবার, চুপচাপ পড়ে রইলাম, নির্জীবের মতো।
“খুব অল্পের জন্যে বেঁচে গেছো,” ভারী গলায় কে যেন বললো। চোখ মেলে চাইতেই দেখি সামনে দাঁড়িয়ে আছেন অধ্যাপক সান্যাল, আর তার দুই পাহাড়ী চাকর।
একটু প্রকৃতিস্থ হয়ে উঠে দাঁড়াবার পর অধ্যাপকের কাঁধে হাত দিয়ে কুটিরের দিকে এগিয়ে চললাম।
ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখা হল এক মহিলার সঙ্গে। পরে জেনেছিলাম মহিলাটি অধ্যাপকের বাড়ীর পরিচারিকা। নাম মোতিয়া। আমার আধমরা অবস্থা দেখে সে বললো, “আহা বেচারার ভীষণ ধকল গেছে! এসো আমার সঙ্গে জামা কাপড় ছেড়ে হাত মুখ ধুয়ে নাও। আমি ততক্ষণে চা তৈরি করে নিয়ে আসছি।”
অধ্যাপক সান্যাল কৌতূহলী চোখে আমার দিকে চেয়ে বললেন, “তোমাকে কোথায় যেন দেখেছি বলে মনে হচ্ছে?”
“বেনারস ইউনিভার্সিটিতে আমি আপনার ছাত্র ছিলাম অনেকদিন আগে। আপনি আমাদের প্রাচীন ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন। আমি ছিলাম আপনার সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র।”
স্নিগ্ধ হাসিতে ভরে গেলো অধ্যাপকের মুখ। “হ্যাঁ, এবার চিনতে পেরেছি। বেশ, বেশ! আমারই এক ছাত্র নিজের জীবন বিপন্ন করে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছে, ভাবতেও আনন্দ লাগছে।” নিজের মনেই কথাগুলো বলতে বলতে তিনি পাশের ঘরে চলে গেলেন। দরজার কাছে হঠাৎ থেমে বললেন, “একটু বিশ্রাম করে নাও। তারপর, আমার পড়ার ঘরে এসো। গল্প করা যাবে।”
হাত মুখ ধুয়ে বিশ্রাম নেবার পর অনেকটা সুস্থ হলাম। বিশেষ করে মোতিয়ার সুন্দর চা যেন অনেকখানি শক্তি জোগালো। সময় নষ্ট না করে আমি অধ্যাপকের পড়ার ঘরের সামনে এসে ভেতরে যাবার অনুমতি চাইলাম। সাদরে তিনি আমাকে আহ্বান জানালেন ভেতরে যাবার জন্যে। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই ভেতরের দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে গেলাম। সত্যিই প্রশংসা করার মতো চকচকে পালিশ করা মেঝে, তার ওপর মোটা পার্সিয়ান গালিচা। ঘরের মাঝখানে বড় একটা মেহগনি কাঠের টেবিল। টেবিলের ওপাশে বসে আছেন সৌম্যদর্শন অধ্যাপক। দেওয়াল ভর্তি বড় বড় আলমারিতে সাজানো বই। ম্যাপ আর চার্ট-এ ভরা অন্যদিকের দেওয়াল। খোলা জানলাটার সামনে দাঁড় করানো পুরানো আমলের বড় একটা ক্যামেরার মতো জিনিস। স্টুডিওতে যেমন ফিল্ড ক্যামেরা ব্যবহার করা অনেকটা তেমনি দেখতে জিনিসটা। কালো কাপড় দিয়ে সমস্ত জিনিসটা ঢাকা দেওয়া রয়েছে। ঘরের অন্যসব জিনিসের সঙ্গে একান্তই বেমানান সেটা। ক্যামেরার মুখটা লম্বা হয়ে সামনের দিকে বেরিয়ে আছে, দূরবীনের নলের মতো। ঐ নলের মধ্যে আলো ফেলবার জন্যে কতকগুলো বিভিন্ন আকৃতির আয়না লাগানো আছে সামনে। চোখ তুলতেই দেখি অধ্যাপক আমার মুখের দিকে চেয়ে আছেন, এক দৃষ্টিতে। চোখে মুখে চাপা আনন্দের আভাষ।
“খুব অবাক লাগছে, না? বসো, ঐ যন্ত্রটা সম্বন্ধে আলোচনা করবো একটু পারে।”
অধ্যাপক নানা প্রশ্ন করতে লাগলেন। আমিও জবাব দিয়ে যেতে লাগলাম সেই সব প্রশ্নের, আমার পড়াশুনোর কথা সবিস্তারে বললাম, কিন্তু আমার এখানে আসার কারণটা জানতেই তাঁকে বেশী আগ্রহশীল বলে মনে হল।
“মাছ ধরতে এসেছি এখানে। নীচের ঐ স্রোতে এমন কতকগুলো বিশেষ ধরনের মাছ আছে যা পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায় না। সেই জন্যেই এত জায়গা থাকতেও এই বিশেষ জায়গাটা বেছে নিয়েছি বাস করার জন্যে,” অধ্যাপক বলতে লাগলেন। “চতুর্দিকে উন্মুক্ত তুষারক্ষেত্র, দৃষ্টি কোথাও বাধা পায় না। তিয়েস্তা উপত্যকার মাছের কথা আমি আগেই শুনেছিলাম।”
অধ্যাপক একজন পাকা মৎস্যশিকারী।
যাইহোক আমাদের আলোচনা প্রসঙ্গে থেকে প্রসঙ্গান্তরে যেতে লাগলো এরপর। আমার দৃষ্টি কিন্তু বার বার সেই বিচিত্র দিকেই যন্ত্রটার চলে যেতে লাগলো। ওটার রহস্য না জানা পর্যন্ত কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছি না মনে। মাছ ধরার গল্প হঠাৎ মাঝপথে থামিয়ে অধ্যাপক বললেন, “আমার কথা তোমার কানে যাচ্ছে না, আমি বুঝতে পারছি। সুতরাং তোমার কৌতূহল আগে নিবৃত্ত করা দরকার। চেয়ারটা এখানে এগিয়ে নিয়ে এসো। আমার কয়েকটা থিওরী সম্বন্ধে সামান্য কিছু আগে বলে নিই, তাহলে যন্ত্রটার কাজকর্ম বুঝতে সুবিধে হবে তোমার।
“তুমি হয়তো জানো না যে ছেলেবেলা থেকেই আমি জীববিজ্ঞানের একজন অত্যন্ত উৎসাহী ছাত্র। বংশানুক্রমিক গুণ অর্থাৎ ইংরাজীতে যাকে আমরা ‘হেরেডিটি’ বলি, অহমিকা, আর দাম্ভিকতা একপুরুষ থেকে পরবর্তী পুরুষদের মধ্যে কি ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে সে সম্বন্ধে জানবার উৎসাহই ছিলো আমার সবচেয়ে বেশী। গবেষণার ক্ষেত্রে আরও প্রসারিত হল আমার, আমি ঐ বিষয়ের গভীরে তলিয়ে গেলাম। একদিন আবিষ্কার করলাম যে অতীতে যে সমস্ত ঘটনার স্মৃতি পূর্বপুরুষদের মনে স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে, সেগুলো তাঁদের অবচেতন স্মৃতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে দেহ কোষের ক্রোমোজোমের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। ঠিক ঐ ভাবেই আমরা শ্বাস নিতে শিখি, হাত পা নাড়াচাড়া করতে শিখি, চিন্তা করতে, যুক্তি দিয়ে বোঝতে শিখি অর্থাৎ জীবনের যে সব প্রক্রিয়া মানুষকে অতীতের বর্বরতার যুগ পার হয়ে সভ্যতার বেদীতে পৌঁছোতে সাহায্য করেছে সে সবই আমরা শিখি পূর্বপুরুষদের অতীত স্মৃতি থেকে। এই ধরনের নানা স্মৃতি বংশপরম্পরায় সঞ্চারিত হচ্ছে এক পুরুষ থেকে পরবর্তী পুরুষে, সৃষ্টির প্রথম যুগ থেকে আজ পর্যন্ত অবিরত। কোন স্মৃতিই মন থেকে সম্পূর্ণ মুছে যায় না, এ সম্বন্ধে আমি নিঃসন্দেহ, এবং অবচেতন মনের অতল থেকে চেতনার স্তরে তারা ভেসে ওঠে যখন ভয়ঙ্কর বা বুদ্ধিবিভ্রমকারী কোন ভাব উদয় হয় মনে এবং উত্তেজনার সৃষ্টি করে। কতকগুলো বিশেষ ধরনের ওষুধ-এর সাহায্যে বা সম্মোহন শক্তির প্রয়োগে অবচেতন মনের অতল থেকে সুপ্ত ঘটনাগুলোকে চেতন মনে তুলে আনা সম্ভব। এই নীতি কাজে লাগিয়ে একটা যন্ত্র আমি তৈরি করেছি, যা দিয়ে মানুষের অবচেতন মনের গোপন কক্ষগুলোতেও হানা দিতে পারা যায় অনায়াসে। প্রথম চেষ্টা আমার অবশ্য বিফল হয়েছিলো, কিন্তু পরীক্ষা চালাতে চালাতে কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ অদল বদল করে এই বিচিত্র যন্ত্রটা বানিয়েছি। খুব সন্তোষজনক ফলাফল পাওয়া গেছে যন্ত্রটা থেকে। ওটার নাম দিয়েছি “কালের পরীক্ষক”, এবং সত্যি সত্যিই যন্ত্রটা যুগযুগান্তব্যাপী সময়ের মধ্যে অবিশ্বাস্য সমস্ত পরীক্ষা চালাতে পারে। এতক্ষণ যা বললাম তা হচ্ছে আমার পরীক্ষার সামান্য পরিচয় মাত্র, তোমার কৌতূহল নিবৃত্ত করার জন্যে এইটুকুই যথেষ্ট হবে বলে আমার মনে হয়। তুমি নিশ্চয় আমার ব্যাখ্যা শুনে সন্তুষ্ট হয়েছো? বেশ, এবার মাছ ধরার প্রসঙ্গে আসা যাক আবার।”
বলাবাহুল্য, এই ব্যাখ্যা আমার মনে কৌতূহল কমানোর চেয়ে বাড়ালোই বেশী, কিন্তু সেই মুহূর্তে অধ্যাপকের কথায় সায় না দিয়ে পারলাম না। তারপর প্রায় আধঘণ্টা আবার সেই হিমশীতল জলের পাহাড় ঝরণায় মাছধরার গল্প। মোতিয়া আসায় সাময়িকভাবে বাধা পড়লো আলোচনায়। খেতে যাবার কথা বলে গেলো মোতিয়া। আমি মনে মনে ঠিক করলাম খাওয়া শেষ করে ফিরে এলেই অধ্যাপক সান্যালকে যন্ত্রটা হাতে কলমে পরীক্ষা করে দেখাতে বলবো।
এবারও মোতিয়ার অযাচিত সাহায্য পেলাম। খাওয়া শেষ হবার পর কফির কাপ সামনে নিয়ে গল্প-গুজব চলছে, এমন সময় মোতিয়া বলে উঠল, “বেচারাকে আপনার নতুন আবিষ্কারটা একবার হাতে কলমে পরীক্ষা করে দেখিয়েই দিন না! পরীক্ষাটা ওর খুব ভালো লাগবে নিশ্চয়ই। তাছাড়া যতখানি কষ্ট স্বীকার করেও আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে তার একটা উপযুক্ত পুরস্কার অন্ততঃ পাবে।” আমি মৃদু প্রতিবাদের সুরে বললাম, “না, না তা নয়। আমি অধ্যাপক মশায়ের ওপর অগাধ শ্রদ্ধার বশেই দেখা করতে এসেছি, তবে উনি এতক্ষণ ধরে যন্ত্রটার যে সমস্ত ব্যাখ্যা শোনালেন তাতে খুব কৌতূহল হচ্ছে যন্ত্রটার কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখবার।
পড়ার ঘরে ফিরে গিয়েই অধ্যাপক আমাকে যন্ত্রটার সামনে নিয়ে গেলেন। তারপর কালো কাপড়ের ঢাকনিটা তুলে নিয়ে আমাকে বসতে বললেন যন্ত্রটার পেছনে। আমি পেছনের বড় গর্তটার সামনে বসবার পর তিনি কালো কাপড়টা দিয়ে আমার মাথা ঢেকে দিলেন, ফটো তোলার সময় ফটোগ্রাফাররা যেমন ভাবে মাথা ঢেকে দেয় তেমনি করে। অন্য কেউ দেখলে তখন ভাবতে আমি হয়তো ছবি তোলবার জন্যে ক্যামেরাটা ফোকাস করছি। যন্ত্রটার ভেতরটা কালো রং করা। পাশের আর একটা ছিদ্র দিয়ে দূরের পাহাড়গুলো দেখা যাচ্ছে আবছা আবছা। হঠাৎ দৃশ্যপট পালটে গেলো। সম্পূর্ণ অন্ধকার। একটু পরেই অনেক দূরে একটা আবছা আলো দেখা দিলো। আলোটা একটু একটু করে বাড়তে লাগলো। মিনিট দশেক কাটবার পর আলোর জোর বাড়তে লাগলো। উজ্জ্বল আলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ দুটোতে জ্বালা ধরে গেলো। আলোটা তখনও আগের মতোই বাড়ছে। শেযে, সহ্য করতে না পেরে মুখটা কাপড়ের তলা থেকে বার করে আনতে যাবো ঠিক সেই মুহূর্তে আলোটার রং গেল পালটে, আর উজ্জ্বলতাও আগের চেয়ে কমে আসতে লাগলো। আবার চোখ লাগিয়ে দেখতে লাগলাম। এতক্ষণ একাগ্র দৃষ্টিতে আলোটার দিকে চেয়ে থেকে কেমন যেন মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ রঙের পরিবর্তনটা বেশ ভালো লাগলো। আলোটা আকারে আগের সাদা আলোটার চেয়ে অনেকটা বড়। হঠাৎ মনে হল শুধু আলো নয়, কুয়াশাচ্ছন্ন একটা দৃশ্যপট যেন ভেসে উঠলো আস্তে আস্তে। কুয়াশার আবরণ সরে গেলো, চোখের সামনে ভেসে উঠলো বিরাট একটা হ্রদ। জল থৈ থৈ করছে। হ্রদের তীরে নানা জাতের নাম না জানা লতাপাতা। বড় বড় গ্রানাইট পাথরের টুকরো চতুর্দিকে ছড়ানো। চারিদিক নিঝুম, নিস্তব্ধ, কেবল মাঝে মাঝে শিকারী পাখীর শব্দ ভেসে আসছে।
অবাক হয়ে সেই দৃশ্য দেখতে লাগলাম আমি। কৌতূহলের বশে মাথাটা আরও একটু এগিয়ে নিলাম সামনের দিকে, ভালো করে দেখবার জন্যে। হ্রদের ধারে বড় একটা পাথরের ওপর এক বৃদ্ধকে বসে থাকতে দেখে আশ্চর্য হলাম। কাঁধে জড়ানো একটা লোমশ চামড়া। বয়সের ভারে চামড়ায় ভাঁজ পড়ে গিয়েছে।
এমন সময় হঠাৎ নজর চলে গেলো হ্রদের পাশে একটা জায়গায়। প্রকাণ্ড দুটো প্রাণী ভীষণ যুদ্ধে মেতেছে। পাশে পড়ে আছে ছিন্নবিচ্ছিন্ন একটা মৃতদেহ। মৃতদেহের মালিকানা নিয়েই যে যুদ্ধের সূত্রপাত তা বুঝতে কষ্ট হল না। ইতিমধ্যে বৃদ্ধ পাথরটার ওপর থেকে উঠে পড়েছে। ধীরে ধীরে গায়ের থেকে চামড়ার পোশাকটা খুলে ফেলতে লাগলো সে। ওপাশের যুদ্ধরত প্রাণী দুটো পরস্পরকে ছেড়ে দিতেই দেখলাম প্রত্যেকটার দেহে প্রায় ২০ ফুট লম্বা লম্বা ডানা লাগানো। মাথা নেড়া, করাতের মতো দাঁতওয়ালা ভয়ঙ্কর ঠোঁট। বাদুড়ের মতো ডানা বিস্তার করে দুটোই আকাশে উড়ে গেলো। এবার ভালো করে নজর পড়লো মানুষটার ওপর। মানুষ বলছি কেবল ভব্যতার খাতিরে, বরং বিরাট আকারের বাঁদর বললেই ঠিক বলা হতো। শক্তিশালী দেহ লালচে লোমে ঢাকা, কোমরে বাঁধা চামড়ার বেল্টের মতো একটা জিনিস। হাতে লম্বা বর্শার মতো একটা অস্ত্র। বর্শার মাথায় লাগানো ধারালো পাথরের ফলা। পাথরটা চামড়া দিয়ে লাঠির মাথায় বাঁধা। সভ্য মানুষের দৃষ্টিতে অত্যন্ত ভয়াবহ এবং পাশবিক লোকটার মুখ, কিন্তু চোখের দৃষ্টিতে বুদ্ধির আভাস।
আমি তাকে লক্ষ্য করছি সে কথা সে বুঝতেই পারলো না। একটা পাথরের আড়ালে দাঁড়িয়ে একাগ্র দৃষ্টিতে জলের দিকে চেয়ে রইলো। অতর্কিতে হাতের বর্শাটা তুলে জলের ওপর এক ঘা বসিয়ে দিলো খুব জোরে, এবং পরমুহূর্তেই জলে ঝাঁপিয়ে পড়লো। জল থেকে উঠে এলো যখন তখন তার একহাতে বর্শাটা, আর একহাতে বিরাট একটা মাছ। ছাড়া পাবার জন্যে মাছটা প্রাণপণে ছটফট করছে। এমন নিমগ্ন হয়ে গেছিলাম দৃশ্যটা দেখতে দেখতে যে সে আবার এসে পাথরটার ওপর কখন বসেছে লক্ষ্যই করি নি। জলের ভেতরে মাছটাকে দেখেই এমন বিদ্যুৎ গতিতে লাফিয়ে পড়ে সেটাকে ধরে ফেললো যে না দেখলে বিশ্বাসই করা যেতো না। লোকটার অন্যমনস্কতার সুযোগে বিরাট একটা পাখী ছোঁ মেরে মাছটা নিয়ে আকাশে উঠে গেলো। হাতের মাছটা হারিয়ে কিন্তু তার এতটুকু দুঃখ হল বলে মনে হল না। বর্শাটা হাতে করে হ্রদের পাশে সন্ধানী দৃষ্টি মেলে সে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। ঘুরতে ঘুরতে অনেক দূরে চলে গেছে এমন সময় দেখা গেলো একদল জানোয়ার জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসছে হ্রদে জল খাবার জন্যে। লোকটা সঙ্গে সঙ্গে লুকিয়ে পড়লো একটা ঝোপের পাশে। লম্বা দাঁতওয়ালা বুনো শুয়োরের পাল হ্রদের ধারে এনে হাজির হল। লোকটা তীর বেগে ছুটে খানিক দূরে গিয়ে শুয়োরের পালের পথ আটকে দাঁড়ালো। বিরাট একটা পাথর সে ছুঁড়ে মারলো জানোয়ারগুলোর দিকে। পাথরটা একটা শুয়োরের গায়ে লাগতেই সেটা তেড়ে এলো লোকটাকে। লোকটা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো, বর্শার মাথাটা মাটিতে ঠেকিয়ে। শুয়োরটা কাছাকাছি আসতেই দুহাতে বর্শাটা মাথার ওপর তুলে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে এক ঘা বসিয়ে দিলো। প্রচণ্ড আঘাতটা সামলে নিয়ে জানোয়ারটা আবার উঠে দাঁড়ালো। বর্শার লাঠিটা ভেঙ্গে গেছিলো প্রথমের আঘাতেই। ভাঙ্গা লাঠির একটা অংশ দুহাতে বাগিয়ে ধরলো সে, তারপর শুয়োরটার সামনে থেকে একপাশে সরে গিয়ে গায়ের জোরে লাগালো আর এক ঘা। মাথার খুলিটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো সেই আঘাতে। মরা শুয়োরটাকে কাঁধে ফেলে বনের দিকে এগিয়ে চললো সে। অন্য শুয়োরগুলো ততক্ষণে পালিয়েছে সেখান থেকে।
মানুষটাকে চলে যেতে দেখে মনে মনে দুঃখিত হলাম। লোকটা জঙ্গলের আড়ালে অদৃশ্য হবার সঙ্গে সঙ্গেই দেখি বিরাট একটা হলদে রংয়ের জানোয়ার তাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করছে। জানোয়ারটার গায়ের কালো কালো ডোরাগুলো, আর লম্বা লম্বা দাঁতওয়ালা বিরাট চোয়াল দেখে বুঝতে পারলাম এটা প্রকাণ্ড একটা বাঘ! মানুষটার কথা ভেবে ভয়ে রক্ত হিম হয়ে আসতে লাগলো আমার। বেচারা ঘুণাক্ষরে জানতেও পারেনি যে মৃত্যুদূত নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছে পেছনে। একটু পরে বাঘটাও বনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলো। শত্রুর উপস্থিতি কেমন করে মানুষটা টের পেলো জানি না, কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সে বন থেকে ছুটে বেরিয়ে এলো। তারপর, মরা শুয়োরটাকে পথের মাঝে নামিয়ে রেখে একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। পরমূহর্তেই বাঘটা হাজির হল সেখানে এসে। মরা শুয়োরটাকে বার কয়েক দেখে নিয়ে, এদিক ওদিক চাইতে লাগল। কিছুক্ষণ ধরে মানুষ আর বাঘে চলল লুকোচুরি খেলা। খেলাটা হয়তো আনন্দদায়ক হতো যদি না জানোয়ারটার আকৃতি ওরকম ভয়ঙ্কর না হতো। বিচিত্র কৌশলে দুজন দুজনকে ফাঁকি দিয়ে এক গাছ থেকে আর এক গাছের আড়ালে লুকোতে লাগল। একটু পরেই বাধ্য হল গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতে। লুকানো জায়গা থেকে বেরিয়েই সে প্রাণপনে ছুটে চললো হ্রদের দিকে। বাঘটাও তাড়া করে চললো পেছন পেছন। দূরত্ব কমে আসতে লাগলো দুজনার মধ্যে। পরে বুঝতে পারলাম মানুষটা হ্রদের দিকে ছোটেনি, ছুটেছিলো, হ্রদের ধারের বড় বড় গাছগুলোর দিকে। প্রাণের ভয়ে যতদূর সম্ভব দ্রুত গতিতে ছুটতে ছুটতে এসে একটা বড় গাছের নীচু ডালটা ধরে ফেললো সে। তারপর শরীরটাকে সার্কাসের খেলোয়াড়ের মতো বাঁকিয়ে ওপরে ওঠবার চেষ্টা করতে লাগলো। বাঘটা ততক্ষণে গাছের নীচে এসে হাজির হয়েছে। হতভম্ব হয়ে সেও দেখছে লোকটার বিচিত্র কৌশল। হঠাৎ মট মট করে ভেঙ্গে পড়লো ডালটা। সাক্ষাত মৃত্যুর মতো নীচে অপেক্ষমান বাঘটার মুখের সামনে পড়তে লাগলো মানুষটা হাত বাড়িয়ে পাশের ডালটা ধরবার ব্যর্থ চেষ্টা করলো একবার সে। জানি না ডালটা সে ধরতে পারলো কি না, কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার দিকে চাইলো সে। হলদে চোখ দুটো ভয়ে কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে, গলার ভেতর থেকে একটা চিৎকার ও বোধহয় বেরুলো তার, যদিও সে চীৎকার আমার কানে গেলো না। তারপর… তারপর কি ঘটেছে মনে নেই। কেবল এইটুকু মনে আছে যে জ্ঞান হারাবার আগে সেই মৃত্যুপথযাত্রী মানুষটার আর্ত চীৎকারের সঙ্গে সঙ্গে আমার গলা থেকেও বেরিয়েছিলো তীব্র হৃদয়বিদারী চীৎকার, কারণ পরিষ্কার দেখতে পেলাম সেই আদিম মানুষটার দেহে আমারই মুখটা বসানো!
জ্ঞান ফেরবার পর দেখলাম অধ্যাপক সান্যালের পড়ার ঘরে বসে আছি। অধ্যাপক, আর মোতিয়া ঝুঁকে পড়েছে আমার দিকে। গলার মধ্যে ব্রাণ্ডির জ্বলন্ত স্পর্শ।
মোতিয়া আস্তে আস্তে বললে, “বেচারা! ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিলো।” অধ্যাপক ইসারায় ওকে চুপ করতে বললেন। কাঁপুনিটা অনেকটা কমেছে তখন। নিজের অবস্থা বুঝতে পারছি। অধ্যাপক আমার একটা হাত কাঁধে তুলে আমাকে খাবার ঘরে নিয়ে এলেন। গরম কফি সত্যিই যথেষ্ট শক্তি জোগালো দেহে এবং মনে। যা যা দেখেছিলাম সব কথা তাঁকে খুলে বললাম। আনন্দে আর উত্তেজনায় চোখ দুটো চক চক করে উঠলো অধ্যাপকের।
“চমৎকার! চমৎকার! কি দৃশ্য তুমি দেখলে তুমি বুঝতে পারছো না? যে জলাভূমিটা দেখলে ওটা, আমার মনে হয়, জুরাসিক যুগের শেষের দিকের। প্রাগৈতিহাসিক জন্তু জানোয়ারে পূর্ণ জায়গাটা। প্রথমে যে বাদুড়ের মতো পাখী দুটো দেখলে ওগুলো ভয়ঙ্কর টেরোডাকটিল ছাড়া আর কিছুই নয়। বহু দিন আগে ওদের বংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে পৃথিবী থেকে। বুনো বাঘটাকে তুমি ঠিকই চিনতে পেরেছিলে, আর ঐ মানুষটা যদি তোমার কোন সুদূর পূর্বপুরুষ হয়, তবে বুঝতে হবে যে মৃত্যুর হাত থেকে সেদিন কোন রকমে রক্ষে পেয়ে গেছিলো। না হলে তার সেদিনের সেই অভিজ্ঞতার স্মৃতি তোমার মনে এলো কেমন করে? আমার বক্তব্য হচ্ছে, যে সব ঘটনার সঙ্গে তোমার সেই সুদূর অতীতের স্মৃতি জড়িত সেই জাতীয় কতকগুলো বর্তমান কালের ঘটনা দিয়ে সেই স্মৃতিকে জীবন্ত করে তুলেছি আজ, আবার। তোমার মাছ ধরার ঘটনা, এখানে আসবার সময় ভাঙ্গা ব্রীজের ওপর থেকে পড়তে পড়তে অল্পের জন্য বেঁচে যাওয়া, এবং ঠিক তারপরেই আমার বক্তৃতা তোমার স্মৃতির কোন বিশেষ একটি তন্ত্রীতে ঝঙ্কার তুলে অবচেতন মনের অতল থেকে বহু যুগ আগের বংশপরম্পরায় সঞ্চিত স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলেছে। তার ওপর, আমার ঐ যন্ত্রটা হিপনোটিক্, মানে সম্মোহনী শক্তির সাহায্যে সেই স্মৃতিকে তুলে এনেছে একেবারে চেতন মনের ওপরের তলে। আমার থিওরীটা এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছো?”
.
প্রথম প্রকাশ: আশ্চর্য!, সেপ্টেম্বর, ১৯৬৮
Augustus Somervile-এর The Time Probe অবলম্বনে।