ইনফ্রা-রেডিওস্কোপ • অজিতকৃষ্ণ বসু
লেডি মিলিসেণ্ট পিণ্টার্ক, বন্ধুমহলে যিনি সুন্দরী মিলিসেণ্ট নামেই পরিচিত, তাঁর শৌখিন নিভৃত কক্ষে একা আরামকেদারায় বসে ছিলেন। সে কক্ষের সবগুলো চেয়ার আর সোফাই নরম; বিজলী বাতিও আবরণ দিয়ে মৃদু করা; তাঁর পাশে একটি ছোট টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে ছিল একটি ঘাগরা পরা বড় পুতুল। দেওয়াল গুলো ঢাকা ছিল জলরঙের ছবি দিয়ে, প্রত্যেকটি ছবিতে নাম স্বাক্ষর করা ‘মিলিসেণ্ট’। ছবিগুলি আলপ্স্ পাহাড়, ভূমধ্য সাগরের ইতালীয় উপকূল, গ্রীসের দ্বীপপুঞ্জ, এবং টেনেরিফ দ্বীপের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্যের। আরেকটি জল রঙের ছবি ছিল তাঁর হাতে, তিনি সেটিকে খুব যত্ন করে খুঁটিয়ে দেখছিলেন। অবশেষে তিনি পুতুলটির দিকে হাত বাড়িয়ে একটি বোতাম টিপলেন। পুতুলটির মাঝখানে ফাঁক হয়ে গেল, দেখা গেল ভেতরে রয়েছে একটি টেলিফোন। তিনি রিসিভারটি তুলে নিলেন। সেই তোলার ভঙ্গিতে তাঁর স্বভাবসুলভ মাধুর্য ফুটে উঠলেও তাতে একটু যেন উত্তেজনার ভাব দেখা যাচ্ছিল, যা থেকে মনে হচ্ছিল তিনি এইমাত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। তিনি একটি নম্বর চাইলেন, এবং সেটি পেয়েই বললেন, ‘আমি স্যার বালবাসের সঙ্গে কথা বলতে চাই।’
স্যার বালবাস ফুটিগার সারা পৃথিবীতে খ্যাত ছিলেন ‘ডেলি লাইটনিং’ নামক দৈনিক কাগজটির সম্পাদকরূপে। শাসনভার যে রাজনৈতিক দলের হাতেই থাকুক না কেন, তিনি সর্বদাই আমাদের দেশের ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম বলে পরিগণিত হতেন। জনসাধারণ থেকে তাঁকে আড়াল করে রাখতে একজন সেক্রেটারি এবং ছয় জন সেক্রেটারির সেক্রেটারি। খুব অল্প লোকই তাঁকে ফোনে ডাকতে সাহস পেতেন, এবং এই খুব অল্পদের ভেতরও একটি অতি ক্ষুদ্র অংশই ফোনে তাঁর কাছে পৌঁছতে পারতেন। নিশাযোগে তিনি যে কাজকর্মে ব্যস্ত থাকতেন, তা এত মূল্যবান যে তিনি কোনো রকমের ব্যাঘাত চাইতেন না। পাঠকদের শান্তিভঙ্গ করবার নানা রকম পরিকল্পনা উদ্ভাবনে মাথা খাটাবার সময় তিনি নিজের শান্তির কোনো রকম ব্যাঘাত ঘটতে দেবেন না, এই ছিল তাঁর নীতি। কিন্তু আত্মরক্ষার জন্যে গড়া এই বেষ্টনী সত্ত্বেও তিনি লেডি মিলিসেণ্টের ডাকে সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিলেন।
বললেন, ‘কি খবর, লেডি মিলিসেণ্ট?’
‘সব কিছু তৈরি।’ বলে লেডি মিলিসেণ্ট রিসিভার রেখে দিলেন।
.
দুই
এই ছোট্ট কয়েকটি কথার আগে রয়েছে অনেক প্রস্তুতির ইতিহাস। সুন্দর মিলিসেণ্টের স্বামী স্যার থিওফিলাস পিণ্টার্ক ছিলেন অর্থনৈতিক জগতের নেতৃস্থানীয়দের একজন, অসামান্য ধনী, কিন্তু তাঁর দুঃখ ছিল পৃথিবীতে এখনো তাঁর সমকক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী রয়ে গেছে, যাঁদের ওপর আধিপত্য করতে পারলে তিনি খুশি হতেন। তখনো এমন অনেকে ছিলেন যাঁরা তাঁর সঙ্গে সমানে-সমানে দাঁড়াতে পারতেন, এবং টাকার লড়াইতে তাঁদের কেউ-কেউ হয়তো জিতেও যেতে পারতেন। তাঁর চরিত্রটি ছিল নেপোলিয়নের মতো; তিনি খুঁজতেন এমন উপায় যার দ্বারা তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব অবিসম্বাদিত এবং প্রশ্নাতীত ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তিনি বুঝেছিলেন যে অর্থের শক্তিই বর্তমান পৃথিবীতে একমাত্র বড় শক্তি নয়, এবং ভেবে দেখেছিলেন আরো তিনটি মহাশক্তি রয়েছে, যথাঃ সংবাদপত্র, বিজ্ঞাপন, এবং—যদিও তাঁর সমপেশাধারীরা এর শক্তিকে প্রায়ই ছোট করে দেখেন—বিজ্ঞান। তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, বিজয়ী হতে হলে ঘটাতে হবে এই চারটি শক্তির সমবায়; এই উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি চারজনের একটি গুপ্ত গোষ্ঠী গঠন করলেন।
এই গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান হলেন তিনি নিজে। ক্ষমতায় এবং মর্যাদায় তাঁর পরই হলেন স্যার বালবাস ফ্রুটিগার, যাঁর নীতি ছিলঃ ‘জনসাধারণ যা চায় তাঁদের তাই দাও।’ তাঁর খবরের কাগজগুলো সবই এই নীতি অনুসারে পরিচালিত হত। এই গোষ্ঠীর তিন নম্বর সদস্য হলেন বিজ্ঞাপন-জগতের একচ্ছত্র অধিপতি স্যার পাবলিয়াস হার্পার। যারা সাময়িক হলেও বাধ্যতামূলক আলস্যে লিফটে ওঠানামা করত, তারা ভাবত আর কিছু করবার থাকে না বলে তারা যাদের বিজ্ঞাপন পড়ে সেই বিজ্ঞাপনদাতারা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু তাঁদের এ ধারণা ছিল ভুল। সমস্ত বিজ্ঞাপন এসে জমা হত একটি কেন্দ্রীয় ভাণ্ডারে, এবং সেখান থেকে কোন বিজ্ঞাপন কোথায় যাবে তা ঠিক করে দিতেন স্যার পাবলিয়াস হার্পার। তাঁর যদি ইচ্ছা হত, আপনার তৈরি দাঁতের মাজন বিজ্ঞাপিত হবে, তাহলে তা বিজ্ঞাপিত হত; যদি তাঁর ইচ্ছা না হয় তাহলে তা যতই ভালো হোক না কেন, অজানাই থেকে যেত। ব্যবহারের বিভিন্ন জিনিস সুপারিশ করার বদলে যাঁরা তৈরি করার মতো বোকামি করতেন, তাঁদের সৌভাগ্যবান করা বা পথে বসাবার ক্ষমতা ছিল তাঁর হাতের মুঠোয়। স্যার বালবাসের প্রতি স্যার পাবলিয়াসের এক ধরনের করুণা মিশ্রিত ঘৃণা ছিল। তাঁর ধারণা ছিল স্যার বলবাসের নীতিটি অত্যন্ত বেশী রকম বিনীত, যো হুকুম ধরনের। স্যার পাবলিয়াসের নীতি ছিলঃ ‘তুমি যা দিতে পার, জনসাধারণকে দিয়ে তাই চাওয়াও।’ এই ব্যাপারে তিনি বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছিলেন। অনেক অতি বাজে শ্রেণীর মদ অতি প্রচুর পরিমাণে বিক্রি হত কারণ তিনি যখন সাধারণকে বলতেন যে এই মদগুলো উপাদেয়, তাঁর কথা অবিশ্বাস করবার মতো সাহস হত না সাধারণ মানুযের। যেখানে হোটেলগুলো নোংরা, যাত্রীনিবাসগুলো মলিন এবং সমুদ্রও পূর্ণ জোয়ারের সময় ছাড়া সর্বদাই কর্দমাক্ত, সমুদ্র উপকূলের এ হেন জায়গাগুলিও স্যার পাবলিয়াসের কার্যকলাপের ফলে ওজোন, উত্তাল সমুদ্র এবং অতলান্তিকের স্বাস্থ্যপ্রদ বাতাসের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠল। সাধারণ নির্বাচনের সময়ে রাজনৈতিক দলগুলো এঁর প্রতিষ্ঠানের কর্মিদের উদ্ভাবনী প্রতিভার শরণ নিতেন; কমিউনিষ্ট ছাড়া অন্য যে কোন দল তার দাবীমতো দাম দিতে পারলেই এই প্রতিভার সহায়তা পেতেন। দুনিয়ার হালচাল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তি স্যার পাবলিয়াসের সহায়তা ছাড়া কোনো প্রচার-অভিযান শুরু করবার কথা স্বপ্নেও ভাবতেন না।
সাধারণের উদ্দেশ্যে প্রচার অভিযানে স্যার বালবাস এবং স্যার পাবলিয়াস পরস্পরের সঙ্গে প্রায়ই যুক্ত থাকলেও চেহারায় ছিলেন দুজনে দুজনের বিপরীত। দুজনেই নিজেদের বেশ তোয়াজে রাখতেন, দুজনেই ছিলেন শৌখিন জীবনবিলাসী। কিন্তু স্যার বালবাসের প্রফুল্ল, স্নিগ্ধ, চেহারাতেই তা ফুটে উঠত আর স্যার পাবলিয়াস ছিলেন একটু রোগা এবং রুক্ষ্ম চেহারার। স্যার পাবলিয়াসের পরিচয় জানা না থাকলে তাঁকে দেখে মনে হতে পারত তিনি অতীন্দ্রিয় দিব্যদৃষ্টির জন্য একাগ্র সাধনা করছেন। কোনো আহার্য বা পানীয় জিনিসের বিজ্ঞাপনে তাঁর চেহারার ছবি ব্যবহার করা যেত না। যাই হোক, প্রায়ই যখন এঁরা দুজন এক সঙ্গে খানা খেতেন কোন নতুন বিজয়ের পরিকল্পনা বা নীতি পরিবর্তনের জন্য পরামর্শ করবার উদ্দেশ্যে, তাঁরা আশ্চর্য রকমে একমত হয়ে যেতেন। একে অন্যের মনের গতিবিধি বেশ ভালোই বুঝতেন; দুজনেই বুঝতেন এঁদের একের পরিকল্পনা সম্পূর্ণ করতে অপরের সহায়তার প্রয়োজন। স্যার পাবলিয়াস বুঝিয়ে দিতেন স্যার বালবাস একটি ছবির কাছে কতটা ঋণী। ছবিটিতে সুন্দর চেহারায় সুসজ্জিত একদল যুবক-যুবতী, প্রত্যেকের হাতে একখণ্ড ‘ডেলি লাইটনিং’ পত্রিকা, অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে অঙ্গুলি নির্দেশ করছে একজন অপরিণত মস্তিষ্ক লোকের দিকে, যে ‘ডেলি লাইটনিং’ পড়ে না। ছবিটি দেখা যেত রাস্তার ধারে সবগুলো বড়-বড় বিজ্ঞাপনের জায়গায়। স্যার পাবলিয়াসের কথার পাল্টা জবাবে স্যার বালবাস বলতেন, ‘তা বটে। কিন্তু কানাডার জঙ্গলগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ কর্তৃত্ব দখল করবার জন্য আমার কাগজগুলোতে যে বিরাট আন্দোলন চালিয়েছিলাম, তা না চালালে আজ আপনি কোথায় থাকতেন? কাগজ না মিললে আপনি কোথায় থাকতেন, আর আমি যদি আমাদের অতলান্তিকের ওপরের সেই মহা উপনিবেশটিতে সেই মোক্ষম নীতিটি চালিয়ে না যেতাম, তাহলে কাগজ আপনার মিলতই বা কি করে?’ আহারের শেষ পর্ব পর্যন্ত তাঁদের দুজনের ভেতর এই ধরনের প্রীতিপূর্ণ কথার লড়াই চলত; তারপর তাঁরা দুজনেই গুরুগম্ভীর হয়েও যেতেন। তাঁদের পারস্পরিক সহযোগিতাও আরো জোরালো এবং সৃজনশীল হয়ে উঠত।
তাঁদের গুপ্ত গোষ্ঠীর চার নম্বর সদস্য পেনড্রেক মার্কল্ ছিলেন অন্য তিন জন থেকে একটু আলাদা ধরনের। তাঁকে গোষ্ঠীতে নেওয়া উচিত হবে কিনা সে বিষয়ে স্যার বালবাস এবং স্যার পাবলিয়াসের মনে কিছুটা সন্দেহ ছিল কিন্তু তাঁদের সেই সন্দেহের আপত্তি বাতিল করে দিয়েছিলেন স্যার থিওফিলাস। এঁদের সন্দেহ কিন্তু অযৌক্তিক ছিল না। প্রথমতঃ অন্যান্য তিন জনের মতো পেনড্রেক মার্কল্ নাইট হবার সম্মান লাভ করেন নি, অর্থাৎ ‘স্যার’ হননি। এছাড়াও তাঁর সম্পর্কে আরো গুরুতর আপত্তি ছিল। তাঁর ঔজ্জ্বল্য আছে একথা কেউই অস্বীকার করতেন না, কিন্তু কিছু কিছু বিচক্ষণ ব্যক্তি সন্দেহ করতেন, তিনি অপ্রকৃতিস্থ, তাঁর মাথার ঠিক নেই। তাঁর নাম কোন কোম্পানীর প্রসপেকটাসে ছাপা হলে সে কোম্পানীর শেয়ার বিক্রির পক্ষে সহায়ক হত না। স্যার থিওফিলাস কিন্তু তাঁকে জোর করেই গোষ্ঠীতে নেওয়ালেন দুটি কারণে: অদ্ভুত ধরনের আবিষ্কারে তাঁর মস্তিষ্কের উর্বরতা ছিল অসামান্য, এবং অন্যান্য বিজ্ঞানীদের মতো তাঁর মনে মনে কোনো রকম নৈতিক খুঁতখুঁতে বাতিকের বালাই ছিল না।
মানুষ জাতটার ওপর তাঁর একটা আক্রোশের ভাব ছিল। যারা তাঁর ইতিহাস জানতেন তাঁরা এর কারণ বুঝতেন। তাঁর বাবা ছিলেন একজন নন-কনফর্মিষ্ট অর্থাৎ প্রচলিত ধর্মপ্রণালী থেকে ভিন্ন প্রণালীতে বিশ্বাসী ধর্মযাজক; তাঁর ধর্মনিষ্ঠা ছিল অসাধারণ! তিনি বালক পেনড্রেককে শোনাতেন এলিশার শাপের ফলে ভালুকদের হাতে পড়ে কতকগুলো শিশু টুকরো টুকরো হয়ে মরল সেই কাহিনী, তাঁকে বোঝাতেন এলিশা ঠিকই করেছিল। সব রকমেই তিনি ছিলেন অতীত যুগের এক জীবন্ত স্মরণচিহ্ন। বিশ্রাম দিবসের প্রতি সম্ভ্রম এবং বাইবেলের প্রতিটি শব্দের আক্ষরিক ব্যাখ্যায় দ্বিধাহীন বিশ্বাস তাঁর গৃহের সমস্ত কথাবার্থার মধ্যে ফুটে উঠত। বালক বয়েসেই পেনড্রেক বুদ্ধিমান হয়ে উঠেছিলেন। একদিন হঠাৎ সম্ভাব্য ফলাফল চিন্তা না করে তিনি তাঁর বাবাকে প্রশ্ন করে ফেলেছিলেন খরগোশ রোমন্থন করে একথা বিশ্বাস না করলে খাঁটি খ্রিস্টান হওয়া অসম্ভব কিনা। ফলে বাবার হাতে তিনি এমন বেদম মার খেয়েছিলেন যে এক সপ্তাহ তিনি বসতে পারেন নি। এই ধরনের সতর্ক শাসনের আওতায় বেড়ে উঠেও তিনি রাজি হলেন না তাঁর বাবার ইচ্ছা তানুযায়ী নন কনফর্মিষ্ট ধর্মযাজক হতে। স্কলারশিপ পেয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করলেন উচ্চতম সম্মানসহ। তাঁর প্রথম গবেষণার ফলটি চুরি করে তাঁর অধ্যাপক তারই দৌলতে রয়েল সোসাইটির একটি পদক পেলেন। তিনি যখন নালিশ জানাতে গেলেন, কেউ তাঁকে বিশ্বাস করলেন না, সবাই ভেবে নিলেন তিনি একটি অসভ্য চাষা। প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে তিনি হলেন সন্দেহভাজন। এই অভিজ্ঞতার ফলে তিনি হয়ে উঠলেন তিক্তহৃদয় মানবিদ্বেষী। এরপর থেকে তিনি হুঁশিয়ার হলেন কেউ যেন আর তাঁর কোন আবিষ্কার চুরি করে নিতে না পারে। পেটেন্ট সম্পর্কে গোপন লেনদেনের অনেক কদর্য কাহিনী শোনা গেল কিন্তু প্রমাণিত হল না। কাহিনীতে-কাহিনীতে অমিলও ছিল, এবং কাহিনীগুলোর মূলে কতটা সত্য ছিল তা কেউ জানতেন না। যাই হোক, অবশেষে তিনি যথেষ্ট টাকার মালিক হয়ে একটি নিজস্ব ল্যাবরেটরি করলেন, তাতে কোন সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীকে তিনি ঢুকতে দিতেন না। ক্রমে তাঁর কৃতিত্ব অনেকের অনিচ্ছাকে ব্যর্থ করে স্বীকৃতি আদায় করে নিল। শেষকালে সরকারের তরফ থেকে তাঁকে অনুরোধ করা হল তিনি যেন রোগজীবাণুর সাহায্যে যুদ্ধের উন্নততর পদ্ধতির আবিষ্কারে তাঁর প্রতিভা নিয়োগ করেন। তাঁর জবাব হল—সবারই কাছে সে জবাব অত্যন্ত অদ্ভুত বলে মনে হল—তিনি রোগজীবাণুতত্ত্ব সম্বন্ধে কিছুই জানেন না। অনেকেই সন্দেহ করলেন তাঁর অমন জবাবের আসল কারণ হচ্ছে তিনি ঘৃণা করেন শৃঙ্খলাবদ্ধ সমাজের প্রতিটি শক্তিকে,—প্রধানমন্ত্রী থেকে অতি সাধারণ পাহারাওয়ালা পর্যন্ত।
বিজ্ঞান জগতে প্রত্যেকেই তাঁকে অপছন্দ করতেন কিন্তু তাঁকে আক্রমণ করতে কেউ সাহস পেতেন না, কারণ তর্কের দ্বন্দ্বযুদ্ধে তাঁর ক্ষমতা ছিল অসাধারণ এবং নির্মম, যার দ্বারা প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তিনি প্রতিপক্ষকে বোকা বানাতে সক্ষম হতেন। সারা পৃথিবীতে তিনি মাত্র একটি জিনিস ভালবাসতেন, সেটি হল তাঁর নিজস্ব ল্যাবরেটরি। দুর্ভাগ্যবশতঃ এর যন্ত্রপাতি এবং সাজসরঞ্জামে তাঁর খরচ গেল মাত্রা ছাড়িয়ে। ফলে ঋণ শুধতে তাঁর ল্যাবরেটরি বিক্রি করতে হবে, এমনি পরিস্থিতিতে স্যার থিওফিলাস এসে প্রস্তাব করলেন ঐ বিপদ থেকে তিনি পেনড্রেককে রক্ষা করবেন, তার বদলে পেনড্রেক চতুর্থ সদস্য হয়ে গুপ্ত গোষ্ঠীকে সাহায্য করবেন।
গোষ্ঠীর প্রথম বৈঠকে স্যার থিওফিলাস বুঝিয়ে বললেন তিনি মনে-মনে কি ভেবে রেখেছেন, এবং তাঁর আশাগুলোকে কিভাবে বাস্তবে রূপায়িত করা যাবে সে বিষয়ে পরামর্শ চাইলেন। তিনি বললেন, মিলিতভাবে কাজ করলে সারা পৃথিবীর ওপর আধিপত্য স্থাপন করা তাঁদের চার জনের পক্ষে নিশ্চয়ই সম্ভব হবে। শুধু পৃথিবীর এ অংশ বা সে অংশ নয়, শুধু পশ্চিম ইউরোপ অথবা পশ্চিম ইউরোপ আর আমেরিকা ও নয়, সেই সঙ্গে লৌহ-যবনিকার ও ধারের পৃথিবীর ওপরও। বিজ্ঞভাবে তাঁদের দক্ষতা এবং সুযোগের সদ্ব্যবহার করলে কোন কিছুই তাঁদের প্রতিরোধ করতে পারবে না।
তিনি তাঁর উদ্বোধনী বক্তৃতায় বললেন, ‘আমাদের দরকার শুধু একটি সত্যিকারের লাভজনক পরিকল্পনা। এটি জোগানো হবে মার্কল্-এর কাজ। ভালো একটি পরিকল্পনা পেলে তাকে কার্যকরী করবার জন্য টাকা জোগাব আমি, তার বিজ্ঞাপন করবেন হার্পার, এবং এ পরিকল্পনার যারা বিরোধিতা করবে তাদের বিরুদ্ধে জনমতকে ক্ষেপিয়ে তুলবেন। মার্কল্-এর সম্ভবতঃ কিছুটা সময় লাগবে। সুতরাং আমি প্রস্তাব করছি আমাদের এ বৈঠক এক সপ্তাহের জন্য স্থগিত রাখা হোক। আমি নিশ্চিত জানি এই সময়ের শেষে আমাদের সমাজনিয়ন্তা, চারটি শক্তির অন্যতম রূপে বিজ্ঞান তার নিজের দাবী প্রমাণ করবে।’
এই বলে মার্কল্কে অভিবাদন জানিয়ে তিনি সভা ভেঙে দিলেন। এক সপ্তাহ বাদে তাঁরা যখন আবার মিলিত হলেন তখন মার্কল্-এর দিকে তাকিয়ে স্যার থিওফিলাস হেসে বললেন, ‘কি হে মার্কল্? বিজ্ঞান কি বলে?’ মার্কল্ গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলতে শুরু করলেনঃ
‘স্যার থিওফিলাস, স্যার বালবাস, স্যার পাবলিয়াস! সারা গত সপ্তাহ ধরে আমি আমার সেরা চিন্তা—আমার সেরা চিন্তা যে খুবই ভালো, সে আশ্বাস আপনাদের দিতে পারি—গত সপ্তাহের বৈঠকে যে ধরনের পরিকল্পনার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল তাতেই আমি নিয়োগ করেছিলাম। নানা ধরনের ভাবনা আমার মনে ভিড় করে আসছিল আর বাতিল হয়ে যাচ্ছিল। নিউক্লিয়ার শক্তির নানা বিভীষিকার কথা শুনতে-শুনতে জনগণ হদ্দ হয়ে গেছে; আমি ভেবে দেখলাম এ বিষয়টাই হয়ে গেছে ভয়ানক সেকেলে, একঘেয়ে। তাছাড়া এ হচ্ছে এমন একটা বিষয় যাতে বিভিন্ন দেশের সরকারী বাধার সম্মুখীন হব। এর পরই আমি চিন্তা করলাম জীবাণুতত্ত্বের সাহায্যে কি করা যেতে পারে। আমি ভাবলাম সমস্ত রাষ্ট্রের প্রধানদের জলাতঙ্ক রোগ দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তাতে আমাদের কি লাভ হবে সেটা খুব স্পষ্ট নয়, তাছাড়া তাঁদের মধ্যে একজন তার রোগে নির্ণীত হবার আগেই আমাদের একজনকে কামড়ে বসতে পারে। তারপর অবশ্য একটা পরিকল্পনা ছিল যে পৃথিবীর এমন একটি উপগ্রহ তৈরি হবে, যেটা তিন দিনে একবার করে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করবে। তাতে একটি ঘড়ি যন্ত্রে এমনভাবে ঠিক করে দম দেওয়া থাকবে যে উপগ্রহটি যখন রাশিয়ার ক্রেমলিন প্রাসাদের পাশ দিয়ে যাবে তখনই তার ওপর গুলি চালাবে। কিন্তু এ হল বিভিন্ন দেশের সরকারের ব্যাপার। আমাদের থাকতে হবে এসব লড়াই ঝগড়ার ঊর্ধ্বে। পুব আর পশ্চিমের ঝগড়ায় আমরা কোনো দিকেই যোগ দেব না। এটা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে যাই ঘটুক না কেন আমরাই যেন থাকি সবার ওপর। সেজন্যই এমন সব পরিকল্পনাই বাতিল করে দিলাম যাতে আমাদের নিরপেক্ষতা বজায় থাকে না।
‘একটা পরিকল্পনা আমি আপনাদের সামনে পেশ করতে চাই যাতে, আমার মনে হয়, অন্যান্য পরিকল্পনার দোষত্রুটিগুলো অনুপস্থিত। সম্প্রতি কয়েক বছর ধরে জনসাধারণ ইন্ফ্রা-রেড ফোটোগ্রাফি সম্বন্ধে শুনেছে। জনসাধারণ অন্যান্য সমস্ত বিষয়ে যেমন অজ্ঞ, এ বিষয়েও তেমনি। তাঁদের এই অভিজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে আমরা লাভবান হব না কেন, তার কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ আমি দেখছি না। আমার প্রস্তাব হচ্ছে আমরা একটি যন্ত্র আবিষ্কার করব, তার নাম হবে “ইনফ্রা-রেডিওস্কোপ”; আমরা জনসাধারণকে বোঝাব যে এই যন্ত্রটিতে ইনফ্রা-রেড রশ্মির সাহায্যে এমন সব জিনিসের ফোটোগ্রাফ উঠবে যা অন্য কোনো উপায়েই দৃশ্য নয়। যন্ত্রটি হবে অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং খুব সতর্কভাবে ব্যবহৃত না হলে সহজেই বিকল হয়ে যাবার মতো। যাদের ওপর আমাদের কর্তৃত্ব চলে না তাদের হাতে পড়লেই যন্ত্রটি বিকল হয়ে যাবে, এ বিষয়ে আমরা যত্নবান হব। ঐ যন্ত্রটি দিয়ে কি দেখা যাবে তা আমরাই ঠিক করে দেব, এবং আমার মনে হয় আমাদের মিলিত প্রচেষ্টার ফলে অবস্থা এমন দাঁড়াবে, যে এই যন্ত্রের চোখে যা ধরা পড়ছে বলে আমরা প্রচার করব, সারা পৃথিবীর লোক তাই বিশ্বাস করবে। আপনারা যদি আমার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তাহলে আমি যন্ত্রটি তৈরি করবার ভার নেব, কিন্তু কিভাব এটিকে কাজে লাগাবেন সেটা ঠিক করবেন স্যার বালবাস এবং স্যার পাবলিয়াস।’
এঁরা দুজনেই পেনড্রেক মার্কল্-এর কথাটা বেশ মন দিয়ে শুনেছিলেন। দুজনেই এঁর মতলবগুলি বেশ উৎসাহের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন, দুজনেই দেখেছিলেন এ পরিকল্পনায় রয়েছে তাঁদের দক্ষতা কাজে লাগাবার অসামান্য সম্ভাবনা।
স্যার বালবাস বললেন, ‘এ যন্ত্রটি কি প্রকাশ করবে তা আমি জানি। যন্ত্রটি প্রকাশ করবে মঙ্গলগ্রহ থেকে এমন ভয়ঙ্কর প্রাণীদের এই পৃথিবীর ওপর গুপ্ত আক্রমণ অভিযান, আমাদের যন্ত্র না থাকলে যাদের অদৃশ্য সেনাবাহিনীর জয়লাভ নিশ্চিত। আমি আমার সবগুলো খবরের কাগজে এই ভীষণ বিপদ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তুলব। তাদের ভেতর লক্ষ লক্ষ লোক এই যন্ত্র কিনবে। স্যার থিওফিলাস এর ফলে যে অর্থসম্পদের মালিক হবেন অত অর্থ কোনো একজনের হাতে কখনো সঞ্চিত হয়নি। আমার খবরের কাগজ অন্য সব কাগজের চাইতে বেশি বিক্রি হবে, এবং এমন দিন শীগগিরই আসবে যখন আমার কাগজ ছাড়া পৃথিবীতে অন্য কোনো কাগজই থাকবে না। এ অভিযানে বন্ধুবর পাবলিয়াসও কিছু কম যাবেন না। তিনি প্রত্যেকটি বড় বিজ্ঞাপনের জায়গা ঢেকে দেবেন সেই ভয়ঙ্কর জীবগুলোর ছবি দিয়ে, ছবির তলায় লেখা থাকবেঃ “আপনি কি এদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে সবকিছু হারাতে চান?” এ ছাড়াও সবগুলো বড় রাস্তার ধারে ধারে, ষ্টেশনে এবং আরো যেসব জায়গায় লোকেরা এ ধরনের জিনিসের দিকে তাকিয়ে দেখবার অবসর পাবে সেখানে তিনি ব্যবস্থা করবেন বিরাট বিরাট হরফে বিজ্ঞপ্তি টাঙিয়ে দিতে, যাতে বলা হবেঃ “পৃথিবীর অধিবাসিবৃন্দ! তোমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় এসেছে। জেগে ওঠ তোমরা লক্ষ লক্ষ লক্ষ মানুষ। এই মহাজাগতিক বিপদে ভীত হয়ো না। সাহসেরই জয় হবে, যেমন হয়ে এসেছে আদিমানব আদমের সময় থেকে। একটা ইনফ্রা-রেডিওস্কোপ কিনে প্রস্তুত হও।”
এইখানে স্যার থিওফিলাস একটু বাধা দিলেন।
তিনি বললেন, ‘পরিকল্পনাটি ভালো। এতে এখন একটি জিনিস বাকি রইল, সেটি হচ্ছে মঙ্গলগ্রহের বাসিন্দার এমন একটি ভয়ঙ্কর ছবি, যা দেখে সত্যি-সত্যি আতঙ্ক উপস্থিত হয়। আপনারা সবাই লেডি মিলিসেণ্টকে জানেন, কিন্তু শুধু তাঁর কমনীয় গুণাবলীর সঙ্গেই আপনারা পরিচিত। তাঁর স্বামীরূপে আমি তাঁর কল্পনার এমন কতকগুলো বৈচিত্র্যের কথা জানতে পেরেছি যা অধিকাংশ লোকেরই অজ্ঞাত। আপনারা জানেন জলরঙের ছবি আঁকতে তিনি সুপটু। তিনি মঙ্গলগ্রহবাসীর একটা জলরঙ ছবি আঁকুন, এবং তাঁর ছবির ফোটোগ্রাফ ভিত্তি করেই আমাদের অভিযান চালু হোক।’
অন্য সবাইকে প্রথমে একটু সন্দিহান দেখা গেল। লেডি মিলিসেণ্টকে তাঁরা দেখেছিলেন একজন কোমল স্বভাবের, হয়তো বা স্বল্পবুদ্ধি মহিলা-রূপে, এমন একটি ভয়ঙ্কর অভিনে অংশগ্রহণ করবার মতো মানুষ বলে তাঁকে ভাবতে পারেন নি। কিছুক্ষণ বিতর্কের পর ঠিক হল তাঁকে চেষ্টা করে দেখতে দেওয়া হবে, এবং তাঁর আঁকা ছবি মিঃ মার্কল্ যথেষ্ট ভয়ঙ্কর বলে মনে করলে পর স্যার বালবাসকে জানানো হবে যে অভিযান শুরু করবার জন্য সব কিছু তৈরি।
এই মহা গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক থেকে বাড়ি ফিরে স্যার থিওফিলাস সুন্দরী মিলিসেণ্টকে বোঝাতে বসলেন তিনি কি চান। তিনি এই অভিযানের বিশদ বিবরণ তাঁর কাছে তুলে ধরলেন না, কারণ লোককে বিশ্বাস করে কোনো গোপন কথা বলতে নেই এই নীতিতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি শুধু বললেন কতকগুলো ভয়ঙ্কর চেহারার কাল্পনিক জীবের ছবি তিনি চান; ছবিগুলো তিনি ব্যবসায়ে যেভাবে কাজে লাগাবেন তা মিলিসেণ্টের পক্ষে বুঝতে পারা শক্ত হবে।
লেডি মিলিসেণ্ট ছিলেন বয়সে স্যার থিওফিলাসের চাইতে অনেক ছোট। পড়তি অবস্থার একটি সম্রান্ত পরিবারের মেয়ে তিনি। তাঁর বাবা, একজন দরিদ্র দশায় পতিত আর্ল, ছিলেন রানী এলিজাবেথের যুগের একটি পল্লী ভবনের মালিক। এই ভবনটির প্রতি গভীর আকর্ষণ তিনি পুরুষানুক্রমে পেয়েছিলেন। পূর্বপুরুষদের এই ভিটা তিনি কোনো ধনী আর্জেন্টিনাবাসীর কাছে বেচে ফেলতে বাধ্য হবেন, অবস্থা অনেকটা এই রকম দাঁড়িয়েছিল, এবং এই সম্ভাবনা ভেবে ভেবে ধীরে ধীরে তাঁর মন ভেঙ্গে যাচ্ছিল। মিলিসেণ্ট তাঁর বাবাকে অত্যন্ত গভীরভাবে ভালবাসতেন, তিনি স্থির করলেন তাঁর বাবার জীবনের বাকি দিনগুলো যাতে বেশ শান্তিতে কাটে, সেই উদ্দেশ্যে নিজের চোখ ধাঁধানো রূপ কাজে লাগাবেন। পুরুষমাত্রেই রূপে মুগ্ধ হত। এই মুগ্ধ ভক্তদের ভেতর স্যার থিওফিলাস ছিলেন সেরা ধনী, মিলিসেণ্ট তাই তাঁকেই বেছে নিলেন। এই বেছে নেওয়ার শর্ত হল স্যার থিওফিলাস এমন ব্যবস্থা করে দেবেন যাতে মিলিসেণ্টের বাবা সবরকম আর্থিক দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকেন। মিলিসেণ্ট স্যার থিওফিলাসকে অপছন্দ করতেন না, কারণ স্যার থিওফিলাস তাঁকে দেখতেন সশ্রদ্ধ ভালোবাসার দৃষ্টিতে এবং তাঁর যে কোন খেয়াল মেটাতেন; কিন্তু স্যার থিওফিলাসকে ভালবাসেন নি মিলিসেট। সত্যি কথা বলতে কি, তখন পর্যন্ত কোনো পুরুষই তাঁর হৃদয়ে দোলা দেয়নি। স্যার থিওফিলাসের কাছ থেকে তিনি যা পেয়েছিলেন বা পেতেন, তার বিনিময়ে তিনি যখনই সম্ভব তার আদেশ মানা কর্তব্য বলে মনে করতেন।
একটি ভয়ঙ্কর জীবের জলরঙা ছবি এঁকে দেবার অনুরোধটা তাঁর একটু যেন কেমন-কেমন মনে হল, কিন্তু তিনি স্যার থিওফিলাসের এমন অনেক কাণ্ড কারখানা দেখে-দেখে অভ্যস্ত, যার মানে তিনি কিছুই বুঝতে পারেন নি, এবং তাঁর ব্যবসা-সংক্রান্ত পরিকল্পনাগুলি বুঝবার জন্যেও তাঁর মাথাব্যথা ছিল না। মিলিসেণ্ট সুতরাং কাজে লেগে গেলেন। স্যার থিওফিলাস তাঁকে এই পর্যন্ত বলেছিলেন যে “ইনফ্রা-রেডিওস্কোপ” নামক যন্ত্রের সাহায্যে কি দেখতে পাওয়া যাবে তাই দেখবার জন্য ঐ ছবিটি দরকার। কয়েকবার চেষ্টা করেও যখন কোনো ছবি নিজেরই পছন্দ হল না, মিলিসেট তখন একটি জীবের ছবি আঁকলেন, যার দেহ অনেকটা গোবরে পোকার মতো, কিন্তু উচ্চতা ছ ফুট, সাতটি পা লোমে ভরা, মুখ মানুষের মতো, মাথাভরা টাক, দৃষ্টি কটমটে, আর দাঁতগুলো বিশ্রী হাসির ভঙ্গিতে বার করা। দুটি ছবি আঁকলেন তিনি। প্রথমটিতে আঁকলেন একটি লোক ইনফ্রা-রেডিওস্কোপ যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে এই জীবটিকে দেখছে; দ্বিতীয়টিতে আঁকলেন ঐ লোকটি ভীষণ ভয় পেয়ে এই যন্ত্রটিকে হাত থেকে ফেলে দিয়েছে, এবং লোকটি তাকে দেখে ফেলেছে বুঝতে পেরে সেই ভয়ঙ্কর জীবটি তার সাত নম্বর পায়ের ওপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বাকি ছটি লোমশ পা দিয়ে জড়িয়ে ধরে লোকটির শ্বাসরোধ করে ফেলেছে। স্যার থিওফিলাসের আদেশে এই ছবি দুটি তিনি মিঃ মার্কল্কে দেখালেন। মিঃ মার্কল্ ছবিটিকে প্রয়োজনের উপযোগী বলে গ্রহণ করলেন এবং তিনি বিদায় নেবার সঙ্গে সঙ্গেই লেডি মিলিসেণ্ট টেলিফোনে স্যার বালবাসকে সেই গুরুত্বপূর্ণ খবরটি জানিয়ে দিলেন।
.
তিন
স্যার বালবাসের কাছে এই খবরটি যেইমাত্র পৌঁছাল, অমনি সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের গুপ্ত গোষ্ঠীর পরিচালনাধীন বিরাট ব্যবস্থা অনুযায়ী কাজ শুরু হয়ে গেল। স্যার থিওফিলাস পৃথিবীর সর্বত্র অসংখ্য কারখানায় ইনফ্রা-রেডিওস্কোপ যন্ত্রটির উৎপাদন শুরু করিয়ে দিলেন। যন্ত্রটি ছোট, তাতে অনেকগুলো চাকা ঘর্ঘর আওয়াজ করত, কিন্তু ঐ যন্ত্রের সাহায্যে প্রকৃতপক্ষে কোন কিছুই দেখা যেত না। স্যার বালবাস বিজ্ঞানের বিস্ময় সম্বন্ধে নানা প্রবন্ধ দিয়ে তাঁর খবরের কাগজগুলো ভরে ফেললেন, প্রত্যেকটি প্রবন্ধে ইঙ্গিত রইল ইনফ্রা-রেডিওস্কোপ সম্পর্কে। এদের কতকগুলো প্রবন্ধে বিজ্ঞানজগতের কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তি বিজ্ঞানের কিছু কিছু খাঁটি তথ্য পরিবেশন করলেন; অন্য প্রবন্ধগুলোতে ছিল কল্পনার বিস্তার। স্যার পাবলিয়াস প্রাচীরপত্রে সর্বত্র বাণী ছড়ালেন: ‘ইনফ্রা-রেডিওস্কোপ আসিতেছে! পৃথিবীর অদৃশ্য বিস্ময় প্রত্যক্ষ করুন!’ এবং ইনফ্রা-রেডিওস্কোপ কি? ফ্রটিগারের সংবাদপত্রগুলি আপনাকে বলিয়া দিবে। বিচিত্র জ্ঞানলাভের এই সুযোগ হারাইবেন না।
যথেষ্টসংখ্যক ইনফ্রা-রেডিওস্কোপ তৈরি হয়ে যাবার পর লেডি মিলিসেণ্ট এ খবর প্রচার করে দিলেন যে একটি ইনফ্রা-রেডিওস্কোপ যন্ত্রের সাহায্যে তিনি তাঁর শোবার ঘরের মেঝের ওপর এই বিভীষিকার চলাফেরা দেখতে পেয়েছেন। স্যার বালবাসের পরিচালনাধীন সবগুলি কাগজের প্রতিনিধি এসে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করলেন। ব্যাপারটা এমনই নাটকীয় উত্তেজনাপূর্ণ যে অন্যান্য কাগজের প্রতিনিধিরাও না এসে পারলেন না। স্বামীর পরামর্শমত তিনি ঠেকে ঠেকে, মহা আতঙ্কগ্রস্তুতার ভান করে ঠিক সেই ভাবের কথাই বললেন গোষ্ঠীর পরিকল্পনার পক্ষে যা সহায়ক। জনগণের ওপর প্রভাবশালী কয়েকজন চিন্তানায়কদের কাছে একটি করে ইনফ্রা রেডিওস্কোপ দেওয়া হল; স্যার থিওফিলাস তাঁর গুপ্তচরদের কাছে খবর পেয়েছিলেন এঁরা অত্যন্ত আর্থিক অসুবিধায় আছেন। এঁদের প্রত্যেককে এক হাজার পাউন্ড দেবার প্রস্তাব জানানো হল এই শর্তে যে, তিনি বলবেন তিনি এই ভয়ঙ্কর জীবদেব একটিকে এই যন্ত্রের সাহায্যে দেখতে পেয়েছেন। স্যার পাবলিয়াসের বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লেডি মিলিসেণ্টের আঁকা ছবি দুটি সর্বত্র প্রকাশিত হল, সেই সঙ্গে বাণীঃ ‘আপনার ইনফ্রা-রেডিওস্কোপটি হাত হইতে ফেলিয়া দিবেন না। এই যন্ত্র প্রকাশ করে, রক্ষাও করে।’
ফলে অচিরেই বহু হাজার ইনফ্রা-রেডিওস্কোপ বিক্রি হল এবং সারা পৃথিবীময় আতঙ্কের সৃষ্টি হল। পেনড্রেক মার্কল্ একটি নতুন যন্ত্র আবিষ্কার করলেন; যন্ত্রটি শুধু তাঁর নিজস্ব ল্যাবরেটরিতেই পাওয়া যেত। এই নতুন যন্ত্রটি প্রমাণ করে দিল এই অদ্ভুত জীবগুলি এসেছে মঙ্গলগ্রহ থেকে। অন্যান্য বিজ্ঞানীরা মার্কল্-এর বিপুল খ্যাতিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠলেন, এবং তাঁর এই ভাবী প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে অতি সাহসী একজন একটি যন্ত্র আবিষ্কার করলেন যাতে এই জীবদের মনের কথা ধরা পড়ে। তিনি প্রচার করলেন এই যন্ত্রের সাহায্যে তিনি আবিষ্কার করেছেন যে মঙ্গলগ্রহের বাসিন্দারা মানবজাতিকে ধরাপৃষ্ঠ থেকে লুপ্ত করে দেবার যে পরিকল্পনা করেছে, এরা হচ্ছে তারই অগ্রণী বাহিনী।
প্রথম দিকে যাঁরা যন্ত্রটি কিনেছিলেন তাঁরা প্রথম প্রথম নালিশ করেছিলেন যে এই যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে তাঁরা কিছুই দেখতে পাননি, কিন্তু স্বাভাবিক কারণেই তাঁদের মন্তব্যগুলো স্যার বালবাসের পরিচালিত কোনো কাগজেই ছাপা হয় নি। খুব শীগগিরই সারা পৃথিবীময় এই আতঙ্ক এমন গভীর হয়ে উঠল যে, কোনো ব্যাক্তি মঙ্গলগ্রহের বাসিন্দাদের উপস্থিতি তাঁর দৃষ্টিগোচর হয়নি বললেই ধরে নেওয়া হতে লাগল তিনি বিশ্বাসঘাতক দেশদ্রোহী, এবং মঙ্গল গ্রহের বাসিন্দাদের দলে। এই ধরনের কয়েক হাজার দেশদ্রোহী উত্তেজিত জনগণের হাতে নিদারুণভাবে লাঞ্ছিত এবং অত্যাচারিত হবার পর বাকি সবাই ভাবলেন মুখ বুজে থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। এর ব্যতিক্রম ছিলেন মাত্র কয়েকজন, তাঁদের সবাইকে গৃহে অন্তরীণ হতে হল। আতঙ্ক তখন চারিদিকে এমন ভাবে ছেয়ে গেল যে, আগে যাঁদের নিরীহ বলে মনে করা হত তাঁদের অনেকেই গভীর সন্দেহভাজন হয়ে উঠলেন। অসতর্ক মুহূর্তে কেউ রাতের আকাশে মঙ্গলগ্রহের সৌন্দর্যের প্রশংসা করলেই সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে সন্দেহ করা হত। যেসব জ্যোতির্বিদ মঙ্গলগ্রহ সম্বন্ধে বিশেষভাবে চর্চা করেছিলেন তাঁদের সবাইকে অন্তরীণ করা হল। তাঁদের ভেতরে যাঁরা মঙ্গলগ্রহে জীবন নেই বলে মত প্রকাশ করেছিলেন তাঁদের দীর্ঘ-
মেয়াদী কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হল।
যাই হোক, কিছু কিছু লোক ছিলেন যাঁরা আতঙ্কের এই হিড়িকের প্রথম দিকে মঙ্গলগ্রহের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ছিলেন। আবিসিনিয়ার সম্রাট ঘোষণা করলেন যে ছবিটি যত্ন করে পরীক্ষা করে দেখা যাচ্ছে মঙ্গলগ্রহবাসী চেহারার দিক দিয়ে জুডা’র সিংহের খুবই কাছাকাছি, সুতরাং নিশ্চয়ই ভাল, খারাপ নয়। তিব্বতীয়রা বললেন, প্রাচীন গ্রন্থাদি পাঠ করে দেখা যাচ্ছে মঙ্গলগ্রহ থেকে আবির্ভূত আগন্তুক একজন বোধিসত্ত্ব, অবতীর্ণ হয়েছেন বিধর্মী চীনাদের কবল থেকে তাঁদের মুক্ত করতে। পেরুদেশের ইণ্ডিয়ানরা আবার নতুন করে সূর্যের উপাসনার প্রবর্তন করলেন এবং বুঝিয়ে দিলেন মঙ্গলগ্রহ যখন সূর্যেরই আলোকে উজ্জ্বল, তখন মঙ্গলগ্রহকেও শ্রদ্ধা করতে হবে। যখন মন্তব্য করা হল মঙ্গলগ্রহবাসীরা হত্যাকাণ্ড চালাতে পারে তাঁরা বললেন সূর্য-উপাসনায় তো সর্বদাই নরবলি চালু ছিল, সুতরাং খাঁটি সূর্য ভক্তদের এতে অসন্তষ্টির কারণ ঘটবে না। নৈরাজ্যবাদীরা যুক্তি দেখিয়ে বললেন, মঙ্গলগ্রহীরা সমস্ত শাসন ব্যবস্থার বিলোপ সাধন করবে, সুতরাং স্বর্ণযুগ এরাই আনবে। শান্তিবাদীরা বললেন এদের সম্মুখীন হতে হবে হৃদয়ে প্রেম নিয়ে; প্রেম যদি যথেষ্ট জোরালো হয় তাহলে সেই প্রেমের জোরেই ওদের মুখের ঐ বিশ্রী ভঙ্গিটা দূর হয়ে যাবে।
এই কয়টি বিভিন্ন দলের লোকেরা যে-যে জায়গায় সংখ্যায় ভারি ছিলেন সেখানে অল্প কিছু দিনের জন্য নিরাপদ রইলেন। কিন্তু তাঁদের দুরবস্থা শুরু হল যখন কমিউনিষ্ট জগৎকে মঙ্গলগ্রহ বিরোধী অভিযানের অন্তর্ভুক্ত করা হল। গুপ্ত গোষ্ঠী বেশ দক্ষতার সঙ্গে এটি সম্ভব করলেন। এঁরা প্রথমে ধরলেন পাশ্চাত্য জগতের কয়েকজন বিজ্ঞানীকে, যারা সোভিয়েট সরকারের প্রতি বন্ধুভাব পোষণ করেন। বলে জানা ছিল। তাঁদের কাছে এঁরা খোলাখুলি বললেন এই অভিযানটি কিভাবে পরিচালিত হয়েছে; বুঝিয়ে বললেন মঙ্গলগ্রহবাসীদের ভয়ের ভিত্তিতে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের ঐক্য স্থাপিত হতে পারে। এঁরা এই কমিউনিজমে বিশ্বাসী বৈজ্ঞানিকদের এও বিশ্বাস করাতে সক্ষম হলে যে প্রাচ্যে পাশ্চাত্যে লড়াই লাগলে প্রাচ্যের পরাজিত হবার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে, সুতরাং তৃতীয় মহাযুদ্ধ নিবারণের যে কোনো উপায়কেই কমিউনিষ্টদের সাহায্য করা উচিত। এঁরা এও বুঝিয়ে দিলেন যে মঙ্গলগ্রহবাসীদের সম্পর্কে ভীতি তাহলেই প্রাচ্যে পাশ্চাত্যে মিলন ঘটাতে পারবে যদি প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য প্রত্যেক দেশের শাসন কর্তৃপক্ষ বিশ্বাস করেন যে মঙ্গল গ্রহবাসীরা পৃথিবী আক্রমণ করবে। কমিউনিজমে বিশ্বাসী বৈজ্ঞানিকবৃন্দ এঁদের এই যুক্তিগুলো শুনে অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হতে বাধ্য হলেন। কারণ এঁরা ছিলেন বাস্তববাদী, এবং এর চাইতে জীবন্ত বাস্তব আর কি হতে পারে? তাছাড়া দ্বান্দ্বিক জড়বাদ যা দাবি করে, এ হয়তো ঠিক সেই সমন্বয়। সুতরাং তারা রাজী হয়ে কথা দিলেন পুরো ব্যাপারটাই যে ধাপ্পা এ সত্যটা তারা সোভিয়েট সরকারের কাছে প্রকাশ করবেন না। সোভিয়েট সরকারকে তার আপন স্বার্থেই তাঁরা ঘৃণ্য পুঁজিপতিদের দ্বারা তাঁদের পুঁজিবাদী স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্র করে সাজানো এই মিথ্যাকে সত্য বলে বিশ্বাস করতে দেবেন, যেহেতু এতে শেষ পর্যন্ত প্রকারান্তরে মানবজাতির মঙ্গলই হবে, কারণ যথাকালে যখন এই ধাপ্পার রহস্য ফাঁস হয়ে যাবে তখন তার ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার ফলে সারা পৃথিবী ঝুঁকে পড়বে মস্কোর দিকে। এই যুক্তিতে পূর্ণ বিশ্বাসী হয়ে তাঁরা মস্কোকে জানিয়ে দিলেন মানবজাতির আসন্ন ধ্বংসের সম্ভাবনা, এবং মনে করিয়ে দিলেন যে আক্রমণকারী মঙ্গলগ্রহবাসীরা যে কমিউনিষ্ট, এমন কথা মনে করবার কোনো কারণ নেই। তাঁদের এই বিবৃতির ওপর নির্ভর করে কিছুকাল ইতস্ততঃ করে মস্কো সরকার মঙ্গলগ্রহবিরোধী অভিযানে পশ্চিমী শক্তিপুঞ্জের সঙ্গে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন।
তখন থেকে আবিসিনিয়া, তিব্বত এবং পেরু নিবাসীরা, নৈরাজ্যবাদীরা এবং শান্তিবাদীরা আর স্বস্তির অবকাশ পেলেন না। এঁদের কতক নিহত ছিলেন, কতকের ওপর চাপানো হল বাধ্যতামূলক শ্রমের বোঝা, কতক তাঁদের পূর্বমত পরিত্যাগ করলেন, এবং অল্প দিনের ভেতরই পৃথিবীর কোথাও মঙ্গলগ্রহ-বিরোধী অভিযানের প্রকাশ্য প্রতিবাদ করবার কেউ রইল না।
কিন্তু সাধারণের মনে ভয় শুধু মঙ্গলগ্রহবাসীদের সম্পর্কেই সীমিত রইল না। ভয় জেগে রইল তাদের নিজেদের ভেতর। বিশ্বাসঘাতকদের সম্পর্কেও। প্রচার এবং প্রোপাগান্ডা সংগঠনের জন্য যুক্ত জাতিসংঘের একটি সম্মেলন আহ্বান করা হল। অন্যান্য গ্রহের বাসিন্দা থেকে পৃথিবীর বাসিন্দাদের আলাদা করে বোঝাবার জন্য একটি বিশেষ শব্দের প্রয়োজন অনুভূত হল। ‘পার্থিব’ শব্দটি জুৎসই মনে হল না। ‘মর্তীয়’ শব্দটিও যথেষ্ট বলে মনে হল না, কারণ শব্দটির বিপরীতার্থক শব্দ হচ্ছে ‘স্বর্গীয়’। ‘জাগতিক’ও সুবিধাজনক বিবেচিত হল না। অবশেষে বহু আলোচনার পর—এ আলোচনায় সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব দেখালেন দক্ষিণ আমেরিকার বাসিন্দারা—‘টেলুরীয়’, শব্দটি অধিকাংশের সম্মতিক্রমে গৃহীত হল। যুক্ত জাতি সংঘ তখন একটি কমিটি নিযুক্ত করলেন অ-টেলুরীয় কার্যাবলী দমনের জন্য; এই কমিটি সারা পৃথিবী জুড়ে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করল। এও স্থির হল যে যুক্ত জাতি সংঘের বৈঠক বারো মাসই চলু থাকবে একজন স্থায়ী প্রধানের নেতৃত্বাধীনে যতদিন এই সংকট বজায় থাকে। প্রবীণ রাষ্ট্রনীতিজ্ঞদের ভেতর থেকে বেছে একজন সভাপতি নিযুক্ত করা হল। তিনি বিপুল মর্যাদা এবং বিরাট অভিজ্ঞতার অধিকারী, দলাদলির লড়াই থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত, এবং গত দুটি বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতার দৌলতে তিনি আরো ভয়ঙ্কর আসন্ন যুদ্ধের জন্যে বেশ ভালোভাবেই তৈরি ছিলেন। তিনি কর্তব্যের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাঁর উদ্বোধনী বক্তৃতায় বললেন:
‘বন্ধুগণ, পৃথিবীবাসিগণ, টেলুরীয়গণ, যাঁরা আজ আগেকার যে কোন সময়ের চাইতে অনেক বেশি একতাবদ্ধ, আজ আমি এই মহা গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতিতে আপনাদের সম্বোধন করে কিছু বলতে চাইছি, আগেকার মতো বিশ্বশান্তির বিষয়ে নয়, তার চাইতে অনেক বেশি জরুরী, অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে। বিষয়টি হচ্ছে এই পৃথিবীর বুকে আমাদের মানবজাতির অস্তিত্ব, মানবিক মূল্যবোধ, সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা বজায় রাখা। আমি বলতে চাই আমাদের মানবজীবন রক্ষা করতে হবে মহাশূন্য পথে ভেসে আসা এক জানি-না-কিসের এবং কি ধরনের ভীষণ আক্রমণ থেকে, যে সম্বন্ধে আমাদের খুলে দিয়েছে আমাদের সেই বিজ্ঞানীদের বিস্ময়কর দক্ষতা, যাঁরা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন ইনফ্রা-রেডিয়েশনের সাহায্যে কি দেখতে পাওয়া যায়, তাঁরা আমাদের দৃষ্টিগোচর করে দিয়েছেন সেই অদ্ভুত ঘৃণ্য এবং ভয়ঙ্কর জীবগুলিকে যারা আমাদেরই বাড়ীর মেঝের ওপর হামাগুড়ি দিয়ে ঘুরে বেড়ায় কিন্তু এই অত্যাশ্চর্য যন্ত্রের সাহায্য ছাড়া এদের একেবারেই দেখতে পাওয়া যায় না; এরা শুধু আমাদের বাড়ীর ভেতর ঘুরেই বেড়ায় না, আমাদের ভেতর অনেক দূষিত জিনিস সংক্রামিত করে দেয়। আমাদের চিন্তা পর্যন্ত দূষিত করে যার ফলে আমাদের নৈতিক জীবনের ভিত্তিই যাবে ধ্বংস হয়ে, এবং আমরা নেমে যাব পশুর স্তরে নয়—কারণ আমাদের পশুরাও আর যাই হোক, টেলুরীয়—আমরা নেমে যাব মঙ্গলগ্রহবাসীদের স্তরে এবং এর চাইতে খারাপ আর কি হতে পারে? এই যে পৃথিবীকে আমরা সবাই ভালোবাসি, এর কোন ভাষাতেই ‘মঙ্গলগ্রহী’র চাইতে নীচ, জঘন্য শব্দ নেই। আমি আজ আপনাদের সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারা কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে দাঁড়ান এই মহাসংগ্রামে। এ সংগ্রামই আমাদের পৃথিবীর যা কিছু মূল্যবান তাকে রক্ষা করবে সেই বিদেশী বিকট জীবগুলোর গুপ্তকৌশলপূর্ণ অপমানজনক আক্রমণ থেকে, যাদের সম্পর্কে আমরা শুধু বলতে পারি যে তারা যেখান থেকে এসেছে সেখানই তাদের ফিরে যাওয়া উচিত।’
এই বলে তিনি বসে পড়লেন। তারপর পুরো পাঁচ মিনিট হাততালির আওয়াজে আর কিছুই শুনতে পাওয়া গেল না। এরপর বক্তৃতা দিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি। তিনি বললেন:
‘পৃথিবীর সহ-নাগরিকগণ, সাধারণের প্রতি কর্তব্যের খাতিরে যাঁরা বাধ্য
হয়েছেন সেই জঘন্য গ্রহটি সম্পর্কে পর্যালোচনা করতে, যার কুবুদ্ধি প্রণোদিত ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবার জন্য আমরা সমবেত হয়েছি, তারাই জানেন ঐ গ্রহটির উপরিভাগে অদ্ভুত কতকগুলো সোজা দাগ আছে, যেগুলোকে জ্যোতির্বিদরা খাল বলে জানেন। যে-কোন অর্থনীতির ছাত্রের কাছে এটা নিশ্চয় জলের মতো পরিষ্কার যে, এই খালগুলো সামগ্রিক শাসনের ফল। সর্বগ্রাসী সামগ্রিক শাসন চালু না থাকলে মঙ্গলগ্রহে অতগুলো খাল তৈরি হতে পারত না। সুতরাং আমাদের অধিকার আছে, উচ্চতম বিজ্ঞানের প্রমাণ অনুসারে আমরা বিশ্বাস করিতে পারি এই আক্রমণকারীরা শুধু আমাদের ব্যক্তিগত জীবনকেই গ্রাস করবে না, আরো ধ্বংস করে ফেলবে সেই জীবনধারা যা আমাদের পূর্বপুরুষেরা চালু করে গেছেন প্রায় দুশো বছর আগে। সেই জীবনধারাই এতদিন আমাদের বেঁধে রেখেছে ঐক্যবন্ধনে। মনে হচ্ছে সেই ঐক্য ধ্বংস করে দিতেই এগিয়ে আসছে একটি শক্তি, যে শক্তির নাম উল্লেখ করা এ সময়ে সুবুদ্ধির কাজ হবে না। হতে পারে মহাবিশ্বের জীবনের বিবর্তনে মানুষ একটা অস্থায়ী স্তর মাত্র, কিন্তু একটি নিয়ম আছে যা মহাবিশ্ব সর্বদাই মানবে, একটি ঐশ্বরিক নিয়ম, সে নিয়মটি হচ্ছে কর্মপ্রচেষ্টার স্বাধীনতা, যে অমর ঐতিহ্য পাশ্চাত্যই দিয়েছে মানুষকে। যে লাল গ্রহটি এখন আমাদের মহা অকল্যাণ করতে উদ্যত তাতে এই কর্মচেষ্টার স্বাধীনতা বহু আগেই লোপ পেয়েছে নিশ্চয়, কারণ সেখানে যে খালগুলো আমরা দেখতে পাই সেগুলো কালকের জিনিস নয়। শুধু মানুষের নামে নয়, কর্মপ্রচেষ্টার স্বাধীনতার নামেও আমি এই সভাকে আহ্বান জানাচ্ছি তার শ্রেষ্ঠ দান দিতে, সকল দুঃখ স্বীকার করে, এতটুকু কার্পণ্য না করে, স্বার্থের কথা মোটেই চিন্তা করে নিশ্চিত আশা বুকে নিয়ে আমি এই আবেদন জানাচ্ছি এখানে সম্মিলিত অন্য যে-যে জাতির প্রতিনিধি রয়েছেন তাঁদের সকলের কাছে।’
ঐক্যের বাণী যে শুধু পাশ্চাত্যের তরফ থেকেই ধ্বনিত হল তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি বসে পড়বার পরেই ভাষণ দিতে উঠলেন সোভিয়েট ইউনিয়নের প্রতিনিধি মিঃ গ্রোলোভস্কি। তিনি বললেন:
‘সময় এসেছে সংগ্রাম করবার, বক্তৃতা দেবার নয়। আমি যদি বক্তৃতা দিই, তাহলে এইমাত্র যে ভাষণ আমরা শুনলাম তার অনেক জিনিসই উড়িয়ে দিতে পারি। জ্যোতির্বিদ্যা হচ্ছে রাশিয়ার বিদ্যা। অন্যান্য দেশের অল্প কিছু লোক এ বিষয়ে একটু-আধটু চর্চা করেছে বটে, কিন্তু সোভিয়েট পণ্ডিতেরা দেখিয়ে দিয়েছেন তাদের জ্ঞান কত ফাঁপা, পরের থেকে ধার করা। এর একটি উদাহরণ হচ্ছে যার নাম মুখে আনতেও আমার ঘৃণা হয় সেই জঘন্য গ্রহের খালগুলো সম্বন্ধে যে কথা বলা হল। মহান জ্যোতির্বিদ লুক্প্স্কি চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করেছেন যে ঐ খালগুলো তৈরি হয়েছে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায়, এবং তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটেছে প্রতিযোগিতার ফলে। কিন্তু এসব আলোচনার সময় এখন নয়। এখন হচ্ছে কাজের সময়। তারপর যখন বাইরের এই আক্রমণ প্রতিহত হয়ে ফিরে যাবে, তখন দেখা যাবে সমস্ত পৃথিবী এক হয়ে গেছে, এবং যুদ্ধের প্রচণ্ড আলোড়নের মধ্য দিয়ে আমাদের ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক অনিবার্যভাবে সামগ্রিক শাসন হয়েছে বিশ্বব্যাপী।’
এ সময়ে অনেকের মনে ভয় হল বৃহৎ শক্তিগুলোর ভেতর এই নব-লব্ধ ঐক্য এই ধরনের বির্তকের ধাক্কায় টিকবে না। ভারত, প্যারাগুয়ে এবং আইসল্যাণ্ড এই অশান্ত পরিস্থিতিকে শান্ত করলেন; অবশেষে অ্যানজোরার গণতন্ত্রের প্রতিনিধির মিষ্টি কথায় সভার সদস্যেরা মুখের চেহারায় যে ঐক্য এবং সম্প্রীতির ঔজ্জ্বল্য নিয়ে বিদায় নিলেন, তার মূলে ছিল পরস্পরের ভাবাবেগ সম্বন্ধে অজ্ঞতা। সভা ভাঙবার আগে সমবেতভাবে ঘোষিত হল বিশ্বশান্তি এবং এই গ্রহের সমস্ত বিভিন্ন রাষ্ট্রের সেনাদলের একীকরণ। এই আশা পোষণ করা হল যে এই একীকরণের কাজ সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত হয়তো মঙ্গলগ্রহীদের প্রধান আক্রমণ শুরু হবে না। কিন্তু তার আগে সমস্ত প্রস্তুতি এবং সম্প্রীতি সত্ত্বেও, বাইরে নিশ্চিন্ত বিশ্বাসের ভাব দেখালেও, ভেতরে-ভেতরে ভয় জেগে রইল সবার মনেই—এ ভয় থেকে মুক্ত রইলেন শুধু সেই গোষ্ঠীর কয়েকজন, এবং তাঁদের সহযোগীরা।
.
চার
এই ব্যাপক উত্তেজনা এবং আতঙ্কের পরিস্থিতিতেও কিন্তু এই সমস্ত ব্যাপারটা সম্বন্ধে কারও-কারও মনে সন্দেহ ছিল, কিন্তু প্রকাশ্যে মুখ খোলা নিরাপদ হবে না বুঝে তাঁরা মুখ বুজে থাকতেন। রাষ্ট্রীয় শাসন কর্তৃপক্ষের সদস্যরা জানতেন তাঁরা নিজেরা কখনো এই মঙ্গলগ্রহের ভীষণ জীব দেখেননি, তাদের প্রাইভেট সেক্রেটারিরাও জানতেন তাঁরাও কখনো দেখেন নি, কিন্তু চারিদিকে আতঙ্ক যখন চরমে উঠেছে তখন এঁরা কেউ তা প্রকাশ্যে স্বীকার করতে সাহস পেলেন না, কারণ অবিশ্বাসের মনোভাব প্রকাশ করলেই গদি হারাবার ভয় তো ছিলই, তার ওপর ক্ষিপ্ত জনতার হাতে প্রাণ হারাবারও ভয় ছিল। ব্যবসায়-ক্ষেত্রে স্যার থিওফিলাস, স্যার বালবাস এবং স্যার পাবলিয়াসের প্রতিদ্বন্দ্বীরা স্বাভাবিক কারণেই এঁদের অসামান্য সাফল্যে ঈর্যা বোধ করলেন, এবং মনে মনে এই ইচ্ছা পোষণ করতে লাগলেন যে কোন উপায়ে সম্ভব হলেই এদের টেনে নামাবো। আগে সংবাদপত্র-জগতে ‘ডেলি থাণ্ডার’ও প্রায় ‘ডেলি লাইটনিং’-এর মতোই প্রভাবশালী ছিল, কিন্তু এই আতঙ্ক প্রচার অভিযানের উত্তেজনাময় পরিস্থিতিতে ‘ডেলি থাণ্ডার’-এর আওয়াজ চাপা পড়ে গেল। সম্পাদক রাগে দাঁত কড়মড় করলেন, কিন্তু বুদ্ধিমান লোক তিনি, সুযোগের অপেক্ষায় ধৈর্য ধরে রইলেন। তিনি জানতেন জনতার হুজুগ যতক্ষণ জোরালো থাকে ততক্ষণ তার বিরোধিতা করে লাভ হয় না। যে বৈজ্ঞানিকরা পেনড্রেক মার্কল্কে অপছন্দ এবং অবিশ্বাস করতেন, তারা যখন দেখলেন তাঁকে নিয়ে এমন করা হচ্ছে যেন তিনি সর্বকালের সেরা বৈজ্ঞানিক, তখন স্বাভাবিক কারণেই তাদের মাথা গরম হয়ে উঠল। তাঁদের অনেকেই ইনফ্রা-রেডিওস্কোপ যন্ত্রটি খুলে দেখেছিলেন এ একটি লোক-ঠকানো ধাপ্পাবাজি, কিন্তু নিজেদের চামড়া বাঁচাবার খাতিরেই তারা ভাবলেন এ বিষয়ে নীরব থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ।
তাঁদের ভেতর শুধু একজন যুবক সুবুদ্ধির ধার ধারলেন না। এঁর নাম টমাস শভেলপেনি। অনেক ইংরেজ পাড়ায় লোকে তাঁকে সন্দেহের চোখে দেখত, তার কারণ তাঁর পিতামহ ছিলেন শিমেলফোনগ নামে একজন জার্মান যিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে নাম বদল করে নিয়েছিলেন। টমাস শভেলপেনি ছিলেন একজন শান্তস্বভাব ছাত্র, বড় বড় ব্যাপারে অনভ্যস্ত, রাজনীতি এবং অর্থনীতি দুই বিষয়েই সমান অজ্ঞ; এবং কেবলমাত্র পদার্থবিজ্ঞানে সুদক্ষ। ইনফ্রা-রেডিওস্কোপ কেনবার পয়সা তাঁর ছিল না, কাজেই যন্ত্রটি যে ভুয়ো তা তিনি নিজে দেখে জানবার সুযোগ পেলেন না। যারা জেনেছিলেন তাঁরা ব্যাপারটা গোপন রাখতেন, এমনকি একসঙ্গে মদ্যপানের অন্তরঙ্গ পরিবেশেও এ ব্যাপারে মুখ খুলতেন না। কিন্তু বিভিন্ন লোকের মুখে তিনি তাদের দেখার যে বিভিন্ন রকমের বর্ণনা শুনলেন সেগুলোর ভেতর তিনি কতকগুলো অদ্ভুত অসঙ্গতি লক্ষ্য করলেন। এই অসঙ্গতি থেকেই তাঁর বৈজ্ঞানিক মনে কতকগুলো সন্দেহের উদয় হল, কিন্তু তাঁর সরল বুদ্ধিতে তিনি ভেবে পেলেন না এ ধরনের রূপকথার সৃষ্টি করে কার কি লাভ হবে।
নিজে তিনি আদর্শ এবং সংযত চরিত্রের লোক হলেও এমন একটি বন্ধুকে তিনি তীক্ষ্ণবুদ্ধি এবং অন্তর্দৃষ্টির জন্য মূল্যবান মনে করতেন যে, স্বভাবচরিত্রের দিক দিয়ে তাঁর মতো সৎ-স্বভাব ছাত্রের বন্ধু রূপে মনোনীত হবার যোগ্য ছিল না। ওই বন্ধুটির নাম ছিল ভেরিটি হগ-পকাস। ভেরিটি প্রায় সর্বদাই নেশাগ্রস্ত থাকত, এবং সাধারণ পানশালার বাইরে তাকে বড় একটা দেখা যেত না। লণ্ডন শহরের একটা অত্যন্ত বাজে বস্তিতে তার একটিমাত্র শোবার ঘর ছিল, সেই ঘরে সে রাত্রে ঘুমুত, কিন্তু এ কথাটা সে কাউকে জানতে দিত না। সাংবাদিকতার আশ্চর্য প্রতিভা ছিল তার, এবং যখনই টাকার টানাটানির দরুন মদ্যপানে বন্ধ রেখে প্রকৃতিস্থ থাকতে হত, তখনই সে বাধ্য হয়ে এমন দুর্দান্ত কৌতুকরসে ভরা প্রবন্ধাদি লিখে ঐ ধরনের লেখা যে সব কাগজে ছাপা হত তাতে পাঠিয়ে দিত যে, তারা ঐ লেখাগুলো না ছেপে পারত না। একটু উঁচু শ্রেণীর কাগজগুলোতে অবশ্য তার লেখা জায়গা পেত না, কারণ ধাপ্পাবাঝি বা ভণ্ডামিকে সে ছেড়ে কথা কইত না। রাজনীতি-জগতের নিচুতলার সব খবরই তার জানা ছিল, কিন্তু তার এই জানাকে কি করে নিজের পক্ষে লাভজনক করা যায়, সেটা তার জানা ছিল না। পর-পর অনেক চাকরিই সে পেয়েছিল, কিন্তু একটিও রাখতে পারেনি। প্রতিবারই তার মনিবরা টের পেয়েছিলেন তারা গোপন রাখতে চান এমন অনেক অসুবিধাজনক গুপ্তকথা সে জানতে পেরেছে, এবং টের পেয়েই তাকে ছাড়িয়ে দিয়েছিলেন। বুদ্ধির অভাবেই হোক, বা কিছুটা নীতিজ্ঞান অবশিষ্ট থাকার জন্যই হোক, গোপন কথা ফাঁস করে দেবার ভয় দেখিয়ে এদের বা অপর কারও কাছ থেকে একটি কানাকড়িও আদায় করবার চেষ্টা সে কখনো করেনি। তার জানা গুপ্ত কথা নিজের লাভের জন্য ব্যবহার না করে সে সস্তা মদের আড্ডায় যে-কোনো সদ্য পরিচিত লোকের সঙ্গে পান করতে করতে সেগুলো একটু একটু করে ছাড়ত।
ধাঁধায় পড়ে শভেলপনি এরই সঙ্গে পরামর্শ করলেন। বললেন, ‘আমার মনে হচ্ছে সমস্তু ব্যাপারটাই ধাপ্পাবাজি, কিন্তু বুঝতে পারছি না এই ধাপ্পার পদ্ধতিটা কি, আর উদ্দেশ্যই বা কি। লোকে কি-কি জিনিস গোপন রাখতে চায় এ বিষয়ে তো তোমার জ্ঞান প্রচুর। কি ব্যাপার চলেছে, তুমি হয়তো আমাকে তা বুঝতে সাহায্য করতে পারবে।’
হগ-পাকাস ব্যঙ্গমিশ্রিত তাচ্ছিল্যের চোখে লক্ষ্য করে আসছিল কি করে জনসাধারণের আতঙ্কের হিড়িক বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্যার থিওফিলাসের ঐশ্বর্যও বৃদ্ধি পাচ্ছিল। শভেলপেনির কথা শুনে সে খুশি হয়ে উঠল। বলল, ঠিক তোমাকেই আমার দরকার। ব্যাপারটা আগাগোড়া ধাপ্পা, এতে আমার কোনই সন্দেহ নেই, কিন্তু মনে রেখো ও কথা বলা নিরাপদ নয়। তুমি বিজ্ঞান যতটা জানো আর আমি রাজনীতির যতটুকু জানি, তাই মিলিয়ে আমরা হয়তো এ রহস্য ভেদ করতে পারব। কিন্তু যেহেতু কথা বলা বিপজ্জনক, এবং পেয়ালায় চুমুক দিলেই আমার মুখে খই ফোটা শুরু হয়ে যায়, তোমার দরকার হবে আমাকে তোমার ঘরে তালাবন্ধ করে রাখা। তা, তুমি যদি ঘরে আমার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে মদ রেখে দাও তাহলে আমার এই অস্থায়ী কারাবাস আমি সহজেই সয়ে নিতে পারব।
প্রস্তাবটা শভেলপেনির মনঃপূত হল, কিন্তু তাঁর পকেটের অবস্থা ভালো ছিল না। হগ-পকাসকে হয়তো বেশ কিছুদিন রাখতে হবে, তার এতদিনের মদ তিনি জোগাবেন কি করে? যাই হোক, হগ পকাস বরাবরই যে সমাজের নিচু তলায় ছিল তা নয়; এককালে লেডি মিলিসেণ্টের সঙ্গে তার পরিচয় ছিল, দুজনেরই যখন বাল্যকাল। দশ বছর বয়সে লেডি মিলিসেণ্টের কি কি গুণ ছিল, সে সম্বন্ধে একটি বেশ জাঁকালো প্রবন্ধ লিখে সে একটি ফ্যাশন সম্পর্কিত সাময়িক পত্রে ভালো দামে বিক্রি করল। ভেবে দেখা গেল এই টাকার সঙ্গে স্কুলের শিক্ষকরূপে শভেলপেনির বেতন যোগ করে যে টাকা হবে, তা থেকেই এই কিছুদিনের মদের খরচ চলে যাবে।
তখন থেকেই হগ-পকাস বেশ বিধিবদ্ধভাবে অনুসন্ধান কার্যে লেগে গেল। অভিযানটা যে ‘ডেলি লাইটনিং’ থেকেই শুরু হয়েছিল সেটা তো পরিষ্কার বোঝাই গেল। নানা জনের নানা খবর হগ পকাসের নখদর্পণে; সে জানত ‘ডেলি লাইটনিং’-এর সঙ্গে স্যার থিওফিলাসের নিবিড় সম্পর্কের কথা। এও সবারই জানা ছিল যে লেডি মিলিসেণ্টই সর্বপ্রথম একজন মঙ্গলগ্রহের বাসিন্দাকে দেখেছিলেন, এবং এ ব্যাপারের বৈজ্ঞানিক অংশটুকু প্রধানতঃ মার্কল্-এরই অবদান। ব্যাপারটা কি ভাবে ঘটেছে তার একটা মোটামুটি কাঠামো অস্পষ্টভাবে গড়ে উঠল হগ-পকাসের উর্বর মস্তিষ্কে, কিন্তু তার মনে হল এ বিষয়ে যারা জানেন তাঁদের কোনো এক জনের মুখ থেকে কথা বার করতে না পারলে আরো স্পষ্টভাবে কিছু জানা যাবে না। হগ-পকাস শভেলপেনিকে পরামর্শ দিল লেডি মিলিসেণ্টের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকার প্রার্থনা করতে, কারণ প্রথম ফোটোগ্রাফটি তাঁরই তোলা, সুতরাং পরিষ্কার বোঝা যায় ব্যাপারটির সঙ্গে প্রথম থেকেই তিনি জড়িত। হগ-পকাস এই ব্যাপারটির যেরূপ নানারকম অদ্ভুত সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দিল, তা শভেলপেনি পুরোপুরি বিশ্বাস করলেন না, কিন্তু তাঁর বৈজ্ঞানিক মন বলে দিল অনুসন্ধান শুরু করবার সেরা উপায় হবে, হগ-পকাসের কথামতো, একবার লেডি মিলিসেণ্টের সঙ্গে দেখা করা। তিনি তাঁকে খুব যত্ন করে একটি চিঠি লিখলেন, তাতে বললেন একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তিনি তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী। তাঁকে বিস্মিত করে লেডি মিলিসেণ্ট রাজি হয়ে একটা তারিখ এবং সময়ের নির্দেশ দিয়ে দিলেন। শভেলপেনি চুল পোশাক ব্রাশ করলেন এবং নিজেকে অন্যান্য দিনের তুলনায় অনেক বেশি পরিচ্ছন্ন করে নিলেন। এভাবে তৈরি হয়ে তিনি রওনা হয়ে গেলেন সেই গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকারে।
.
পাঁচ
পরিচারিকা তাঁকে নিয়ে গেল লেডি মিলিসেণ্টের নিভৃত কক্ষে, যেখানে আগেকার মতোই তিনি রয়েছেন তাঁর আরাম-কেদারায় গাত্র এলিয়ে, তাঁর পাশের ছোট্ট টেবিলটার ওপর রয়েছে তাঁর সেই পুতুল টেলিফোন।
লেডি মিলিসেণ্ট বললেন, ‘মিঃ শভেলপেনি, আপনার চিঠি পেয়ে আমি বিস্মিত হয়ে ভেবেছিলাম এমন কি বিষয় থাকতে পারে যা নিয়ে আপনি আমার সঙ্গে আলোচনা করতে চান? আমি বরাবর জেনে এসেছি আপনি একজন প্রতিভাবান বিজ্ঞানী; আমি একজন অস্থিরচিত্ত মহিলা, ধনী স্বামী ছাড়া আমার উল্লেখযোগ্য আর কিছু নেই। কিন্তু আপনার চিঠি পাওয়ার পর আমি আপনার অবস্থা এবং কর্মজীবন সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হবার জন্য কিছুটা শ্রম স্বীকার করেছি। আমার মনে হয় না আপনি টাকার জন্য আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।’
এই বলে তিনি মনোমুগ্ধকর হাসি হাসলেন। শভেলপেনির আগে কখনো এমন কোন নারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন নি যিনি একাধারে ধনী এবং সুন্দরী। এঁকে দেখে তাঁর মনে যে অপ্রত্যাশিত ভাবাবেগের উদয় হল তার ফলে তিনি অত্যন্ত বিব্রত বোধ করলেন। নিজেকে মনে-মনে বললেন, ‘বাপু হে, তুমি এখানে ভাবাবেগে মত্ত হতে আসোনি, এসেছ একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধানের ব্যাপারে।’ প্রবল চেষ্টায় নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি জবাব দিলেন।
‘লেডি মিলিসেণ্ট, অন্যান্য মানুষদের মতো আপনিও নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন মঙ্গলগ্রহীদের আক্রমণের আশঙ্কায় সমগ্র মানবজাতির চিত্তে কি এক অদ্ভুত আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছে। আমি যা জানতে পেরেছি তা যদি ঠিক হয়ে থাকে, তাহলে এই মঙ্গলগ্রহীদের একজনকে আপনিই সর্বপ্রথম দেখেছিলেন। আমার যা বলবার আছে তা বলতে আমার খুব কঠিন লাগছে, তবু তা বলা কর্তব্য মনে করছি। সযত্নে অনুসন্ধানের ফলে আমার মনে সন্দেহ জেগেছে আপনি অথবা অপর কেউ এই ভয়ঙ্কর জীবদের একটিকেও দেখেছেন কিনা, এবং ইনফ্রা-রেডিওস্কোপের সাহায্যে সত্যিই কিছু দেখতে পাওয়া যায় কিনা। আমার অনুসন্ধান যদি ভ্রান্ত হয়ে না থাকে, তাহলে আমি এই মীমাংসায় উপনীত হতে বাধ্য হচ্ছি যে একটা বিরাট ধাপ্পাবাজির আপনি একজন প্রথম উদ্যোক্তা। আমি বিস্মিত হব না যদি আমার একথা শোনবার পর আপনি আপনার সম্মুখ থেকে আমাকে বলপ্রয়োগে অপসারিত করান এবং আপনার ভৃত্যদের আদেশ দেন যেন আমাকে আর কখনো আপনার বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া না হয়। ওই ধরনের প্রতিক্রিয়া খুবই স্বাভাবিক হত, যদি আপনি নির্দোষ হতেন, এবং আরো বেশী স্বাভাবিক হত যদি আপনি দোষী হতেন। কিন্তু যদি এমন কিছু সম্ভব থেকে থাকে যা আমার চিন্তায় আসেনি, আপনার মতো একজন সুন্দরীকে যাতে দোয়ী করতে না হয়, এমন যদি কোনো উপায় থাকে, —আপনার হাসি দেখে আপনাকে খুব ভদ্র বলে মনে হচ্ছে—যদি বিজ্ঞানকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে আমার যে সংস্কার আপনার সপক্ষে রায় দিচ্ছে তাকেই আমি বিশ্বাস করে নিতে পারি, তাহলে আপনাকে আমি মিনতি জানাচ্ছি, আমার প্রাণের শান্তির জন্য আপনি সম্পূর্ণ সত্য আমাকে জানতে দিন।’
সন্দেহাতীত সরলতা, এবং মিলিসেণ্টের দিকে হৃদয় ঝুঁকলেও তাকে তোষামোদ করতে অনিচ্ছা—শভেলপেনির এই দুটি গুণ লেডি মিলিসেণ্টকে যেমন অভিভূত করল, যেমনি অভিভূত তাঁকে তাঁর পরিচিতদের মধ্যে কেউ কখনো করে নি। স্যার থিওফিলাসাকে বিয়ে করবার জন্য পিতাকে ছেড়ে আসবার পর এই তিনি সর্বপ্রথম সত্যিকারের সহজ সরল অকপট মানুষের সংস্পর্শে এলেন। স্যার থিওফিলাসের বিরাট ভবনে প্রবেশ করার পর থেকেই তিনি যে কৃত্রিম জীবন যাপনের চেষ্টা করে আসছিলেন, তা তাঁর অসত্য হয়ে উঠেছিল। মিথ্যা, ষড়যন্ত্র এবং হৃদয়হীন ক্ষমতার জগৎ তিনি আর সইতে পারছেন না বলে তাঁর মনে হচ্ছিল।
তিনি বললেন, ‘মিঃ শভেলপেনি, কিভাবে আমি আপনার প্রশ্নের জবাব দেব? আমার স্বামীর প্রতি আমার একটি কর্তব্য আছে, মানবজাতির প্রতি কর্তব্য আছে, সত্যের প্রতি কর্তব্য আছে। এই তিনটির অন্ততঃ একটির প্রতি আমাকে মিথ্যাচরণ করতেই হবে। কোনটির প্রতি আমার কর্তব্য সবচেয়ে বেশি, কি করে আমি তা ঠিক করব?’
শভেলপেনি বললেন, ‘লেডি মিলিসেণ্ট, আপনি আমার মনে আশা এবং কৌতূহল দুই সমানভাবে জাগিয়ে তুলেছেন। আপনার পরিবেশ দেখে বুঝতে পারছি আপনি কৃত্রিম জীবন যাপন করেন, কিন্তু তবু, যদি আমি ভুল করে না থাকি, তাহলে আপনার ভেতর এমন একটি জিনিস আছে যা কৃত্রিম নয়, যা অকপট এবং সরল, যার সাহায্যে পারিপার্শ্বিক নোংরামি থেকে আপনি এখনো মুক্তি পেতে পারেন। আপনাকে কাতর অনুরোধ জানাচ্ছি সব কথা আপনি খুলে বলুন। সত্যের পবিত্র-করা আগুনে পুড়ে আপনার আত্মা দোষমুক্ত হোক।
লেডি মিলিসেণ্ট এক মুহূর্ত নীরব রইলেন। তারপর তিনি দৃঢ়কণ্ঠে জবাব দিলেন:
‘হ্যাঁ, আমি কথা বলব। বড় বেশি দিন আমি নীরব রয়েছি। অচিন্তনীয় অকল্যাণে আমি গা ঢেলে দিয়েছিলাম, কি করছি তা না বুঝে। তারপর একদিন বুঝলাম, তখন মনে হল বড় বেশি দেরী হয়ে গেছে, আর কোনো আশা নেই। কিন্তু আপনি আমাকে নতুন আশা দিয়েছেন; হয়তো এখনো খুব বেশি দেরী হয়ে যায় নি, হয়তো এখনো কিছু বাঁচানো যেতে পারে এবং আর কিছু যদি বাঁচাতে না পারি তো অন্ততঃ আমার সেই সততা ফিরে পাব, যা বাবাকে দুঃখ থেকে বাঁচার জন্য আমি বেচে দিয়েছিলাম।
‘স্যার থিওফিলাস যখন মধু-ঝরা কণ্ঠে, দাম্পত্য জীবনে স্বভাবতঃ আমার মন রাখবার জন্য যেভাবে খোসামোদ করে কথা বলতেন তার চাইতেও বেশি খোসামুদে সুরে কথা বলে আমাকে ঐকান্তিক অনুরোধ জানালেন আমার শিল্প প্রতিভা কাজে লাগিয়ে একটি অদ্ভুত জীব তৈরি করতে, তখন ভবিষ্যৎ নাটকীয় ঘটনাবলীর সূত্রপাতের সেই মুহূর্তে, আমি জানতাম না কি ভীষণ উদ্দেশ্যে আমার আঁকা এই ছবিটির প্রয়োজন। আমি অনুরোধটি রক্ষা করলাম। আমি অদ্ভুত জীবটির ছবি আঁকলাম। আমি এই ভীষণ জীবটিকে দেখেছি বলে প্রচারিত হতে দিলাম, কিন্তু তখন জানতাম না কি নীচ উদ্দেশ্যে আমার স্বামী—হায় এখনো তাঁকে ঐ নামেই ডাকতে হবে—আমাকে তাতে রাজি করালেন। ক্রমে ক্রমে যতোই তাঁর অদ্ভুত অভিযানটির রূপ ফুটে উঠেছে, ততোই বিবেকের তাড়না আমি বেশি করে অনুভব করেছি। প্রতি রাত্রে আমি নতজানু হয়ে ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছি, কিন্তু আমি জানি স্যার থিওফিলাস যে বিলাস বৈভবে আমায় ঘিরে রাখতে ভালোবাসেন আমি যতদিন তার ভেতর থাকব, ততদিন ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করবেন না। এ সমস্ত ত্যাগ করে যেতে রাজি না হওয়া পর্যন্ত আমার আত্মা মালিনমুক্ত হবে না। আপনার এই আগমন উটের পিঠে শেষ খড়ের কাজ করেছে। আপনি এসে সরল সহজভাবে সত্যের আবাহন করে আমাকে দেখিয়ে দিয়েছেন আমার কি করা উচিত। আমি আপনাকে সব বলব। আপনি জানতে পারবেন আপনি যে স্ত্রীলোকের সঙ্গে কথা কইছেন, সে কত নীচ। আমার অপরাধের সামান্যতম অংশও আমি আপনার কাছে গোপন করব না। এবং সব কিছুই যখন আমার খুলে বলা হয়ে যাবে, তখন হয়তো যে নোংরা অপবিত্রতা আমাকে আক্রমণ করেছে তা থেকে মুক্ত হয়ে আবার আমি নিজেকে নির্মল বোধ করব।’
লেডি মিলিসেণ্ট এই বলে তারপর শভেলপেনিকে সব কথা খুলে বললেন। বলবার সময় তিনি শ্রোতার মুখে যে নিদারুণ আতঙ্কের অভিব্যক্তি দেখবেন বলে ভেবেছিলেন, তার বদলে দেখলেন তাঁর দুচোখে ফুটে উঠেছে সপ্রশংস মুগ্ধতার ভাব। এর আগে শভেলপেনি হৃদয়ে কখনো প্রেমভাব অনুভব করেননি, এইবার করলেন। শ্রীমতীর যখন সব কথা বলা হয়ে গেল, শভেলপেনি তাঁকে বুকে টেনে নিলেন, শ্ৰীমতীও ধরা দিলেন তাঁর বাহুবন্ধনে।
‘আঃ, মিলিসেণ্ট!’ বললেন শভেলপেনি, ‘মানুষের জীবন কি জটিল, কি ভয়ঙ্কর! হগ-পকাস আমাকে যা-যা বলেছে সব সত্যি, কিন্তু তবু এই হীন ব্যাপারের উৎসমূলেই আমি পেয়েছি তোমাকে, যে তুমি এখনো মনের গহনে অনুভব করতে পারছ সত্যের পবিত্র অগ্নিশিখা। এখন যখন তুমি নিজের সর্বনাশ করেও সব কথা স্বীকার করেছ, তোমার মধ্যে আমি পেয়েছি একজন কমরেড, একজন আত্মার, যেমনটি এই পৃথিবীতে কোথাও আছে বলে আমি আশা করিনি। কিন্তু এই অদ্ভুত জট-পাকানো অবস্থায় কি করা উচিত, তা আমি এখনো ঠিক করতে পারছি না। এবিষয়ে আমাকে চব্বিশ ঘণ্টা গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। তারপর ফিরে এসে আমি তোমাকে আমার সিদ্ধান্ত জানাব।
আপন আবাসে তখন ফিরে গেলেন শভেলপেনি, যখন তাঁর মোহাচ্ছন্ন অবস্থা, ঠিক অনুভব করছেন বা কি চিন্তা করছেন কিছুই যেন বুঝে উঠতে পারছেন না। হগ-পকাস তখন বিছানায় শুয়ে মদের নেশায় চুর হয়ে নাক ডাকাচ্ছে। এই লোকটার ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য শুনতে তাঁর ইচ্ছা হল না; মিলিসেণ্ট সম্পর্কে তাঁর মনে যে অনুভূতির উদয় হয়েছিল তার সঙ্গে এর দৃষ্টিভঙ্গির সামঞ্জস্য ছিল না। মিলিসেণ্টের রূপমুগ্ধ শভেলপেনি মিলিসেণ্টকে দোষী ভাবতে পারলেন না। তিনি হগ-পকাসের বিছানার ধারে এক বোতল হুইস্কি আর একটা গ্লাস রেখে দিলেন; তিনি জানতেন আগামী চব্বিশ ঘণ্টার ভেতরে এই ব্যক্তিটি যদি এক মুহূর্তের জন্যে জেগেও ওঠে, তাহলে সামনে মদ দেখে সে লোভ সামলাতে পারবে না এবং তার ফলে আবার ডুবে যাবে আত্মবিস্মৃতির তলায়। এভাবে বিনা ব্যাঘাতে চব্বিশ ঘণ্টা কাটাবার পাকা ব্যবস্থা করে তিনি গ্যাসের আগুনের ধারে চেয়ারের ওপর বসে পড়লেন এবং মন স্থির করবার চেষ্টা করতে লাগলেন।
জনসাধারণের প্রতি কর্তব্য, এবং ব্যক্তিগত কর্তব্য, দু’রকম কর্তব্য নিধারণ করাই শক্ত হয়ে উঠল। যাঁরা এই ষড়যন্ত্রটি তৈরি করেছিলেন তারা সবাই দুষ্ট লোক; তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল অত্যন্ত হীন, এবং তাঁদের কাজের ফলে মানবজাতির ভালো হবে না মন্দ হবে তা নিয়ে তাঁরা আদৌ মাথা ঘামান নি। ব্যক্তিগত লাভ এবং ব্যক্তিগত ক্ষমতাই ছিল তাদের একমাত্র লক্ষ্য। মিথ্যা, প্রতারণা এবং সন্ত্রাসসৃষ্টি ছিল তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির উপায়। তিনি কি নীরব থেকে নিজেকে এই জঘন্য ব্যাপারের অংশীদার করবেন? যদি তা না করেন, যদি মিলিসেণ্টকে রাজি করান প্রকাশ্যে সবকিছু স্বীকার করতে, যা তিনি পারবেন বলে জানতেন, তাহলে মিলিসেণ্টের অবস্থা কি হবে? তাঁর স্বামী তাঁকে কি করবেন? সারা পৃথিবীময় যাঁরা তাঁর কথায় বিশ্বাস করে বোকা বনেছেন, তারা তাঁকে কি করবেন? কল্পনার চোখে শভেলপেনি দেখলেন সুন্দরী মিলিসেণ্ট ধুলোয় লুটোচ্ছে, পিষ্ট হচ্ছেন অনেক মানুষের পায়ের তলায়, বর্বর জনতা তাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলছে। এ দৃশ্য তাঁর অসহ্য মনে হল, তবু তিনি ভাবলেন তাদের কথাবার্তার সময় মহত্ত্বের যে স্ফুলিঙ্গ তাঁর ভেতর তিনি জেগে উঠতে দেখেছিলেন তাকে নতুন করে নেভানো চলবে না, লাভজনক মিথ্যার নরম বিছানায় শুয়ে জীবন কাটাবেন না মহীয়সী মিলিসেণ্ট।
অতএব তাঁর মন ঘুরে গেল এর বিকল্প সম্ভাবনার দিকে। স্যার থিওফিলাস এবং তাঁর সহযোগীদের কি জয়গৌরব লাভ করতে দেওয়া হবে? এর স্বপক্ষে একাধিক জোরালো যুক্তি ছিল। এই ষড়যন্ত্রটির জন্ম হবার আগে পুবে পশ্চিমে লড়াই আসন্ন হয়ে উঠেছিল, অনেকের মনে হয়েছিল মানুষ জাতটা ব্যর্থ আক্রোশে নিজেই নিজের বিলুপ্তি ঘটাবে। কিন্তু এখন একটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক বিপদের আশঙ্কায় প্রকৃত বিপদটা আর নেই।
রাশিয়ার ক্রেমলিন আর যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউস, মঙ্গলগ্রহীদের প্রতি ঘৃণায় মিলিত হয়ে, প্রিয় বন্ধুতে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর সৈন্যদলগুলিকে এখনো যুদ্ধের জন্য একত্রিত করা যায়, কিন্তু এখন তারা একত্রিত এমন শত্রুর বিরুদ্ধে যে শত্রুর অস্তিত্ব নেই, এবং এক তাদের অস্ত্রশস্ত্রগুলোও যে ক্ষতি করবার জন্যে তৈরি তা করতে পারবেন না। ‘সম্ভবতঃ’ ও তিনি ভাবতে লাগলেন, ‘মিথ্যার সাহায্যেই মানুষকে বাঁচার মতো বাঁচতে উদ্বুদ্ধ করা যায়। মানুষের প্রবৃত্তিগুলোই এই রকম যে সত্য চিরদিনই বিপজ্জনক থাকবে। সত্যের অনুগত হয়ে আমি বোধ হয় ভুলই করেছি। আমার চাইতে বোধহয় স্যার থিওফিলাসই বেশি বুদ্ধিমান। আমার প্রিয়া মিলিসেণ্টকে তার সর্বনাশের দিকে এগিয়ে দেওয়া আমার পক্ষে বোধহয় বোকামি হবে।’
তারপর তাঁর চিন্তার গতি আবার অন্য দিকে ঘুরে গেল। আগে হোক পরে হোক, তিনি ভাবলেন, এই প্রতারণা ধরা পড়বে। যাঁরা আমার মতো সত্যানুসন্ধানী, তাঁদের দ্বারা না হলে পরে যাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী স্বার্থ স্যার থিওফিলাসের স্বার্থের মতোই কুটিল এবং ক্রুর, তাঁদের দ্বারা এই ধাপ্পাবাজি আবিষ্কৃত এবং প্রকাশিত হবেই। এই লোকেরা এই প্রতারণার রহস্য উন্মোচন করে ফেলতে পারলে সেটা কিভাবে কাজে লাগাবেন? স্যার থিওফিলাসের মিথ্যাগুলো যে টেলুরীয়দের মধ্যে সম্প্রীতির সৃষ্টি করেছে তার বিরুদ্ধে এঁরা তার সাহায্যে ঘৃণা বাড়িয়ে তুলবেন। গোটা যড়যন্ত্রের মুখোশ যখন আগে হোক পরে হোক খুলে পড়বেই, তখন ঈর্ষা এবং প্রতিযোগিতার তরফ থেকে না হয়ে সত্যের মহান আদর্শের নামেই সেটা হওয়া ভালো নয় কি? কিন্তু এসব বিষয়ে বিচার করবার আমি কে? আমি তো ভগবান নই। ভবিষ্যৎ আমি জানতে পারি না। ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঢাকা। যে দিকেই তাকাই, যে দিকেই দেখি আতঙ্ক। বুঝতে পারিনা দুষ্ট লোকদের পৃথিবীর ধ্বংস সাধন করতে সহায়তা করা উচিত। এই বিষম দোটানায় পড়েছি আমি; এর সমাধান আমার পক্ষে অসম্ভব।
চব্বিশ ঘণ্টা তিনি ঠায় বসে রইলেন তাঁর চেয়ারে, নাওয়া খাওয়া ভুলে, দুললেন নানা বিপরীত ভাবনার দোলায়। চব্বিশ ঘণ্টার পরে এল লেডি মিলিসেণ্টের সঙ্গে আবার দেখা করবার পূর্ব নির্ধারিত সময়, শ্রান্ত এবং আড়ষ্টভাবে তিনি উঠে দাঁড়ালেন; একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তারপর গুরুগম্ভীরভাবে পা ফেলে
ফেলে অগ্রসর হলেন শ্ৰীমতীর ভবনের দিকে।
গিয়ে দেখলেন লেডি মিলিসেণ্টও তাঁরই মতো ভেঙে পড়েছেন। তিনিও মানসিক দ্বন্দ্বে ছিন্ন ভিন্ন হয়েছিলেন। কিন্তু পৃথিবীর চাইতে তিনি বেশি ভাবছিলেন তাঁর স্বামীর, এবং তাঁর নতুন প্রেমপাত্র টমাসের কথা। রাজনৈতিক চিন্তা করার অভ্যাস তাঁর ছিল না। তাঁর জগৎ গড়ে উঠেছিল এমন ব্যক্তিদের নিয়ে যাদের কার্যকলাপের ফলাফল ছিল তাঁর চেতনার সীমার বাইরে; এই ফলাফলগুলি তিনি বুঝবার আশা করতেন না। তিনি বুঝতেন শুধু তাঁর ব্যক্তিগত জগতের গণ্ডীর ভেতরকার নরনারীদের মানবিক সুখ-দুঃখের কথা। এই চব্বিশ ঘণ্টা ধরে তিনি ভেবেছেন শুধু টমাসের স্বার্থলেশহীন গুণাবলীর কথা, আর দুঃখবোধ করেছেন স্যার থিওফিলাসের ফাঁদে ধরা পড়বার আগে এহেন চরিত্রের কোন মানুষের সংস্পর্শে আসবার সৌভাগ্য কেন তাঁর হয়নি। এতগুলো ঘণ্টার উৎকণ্ঠ প্রতীক্ষার দুঃসহতা ভোলবার জন্য তিনি স্মৃতির সাহায্যে টমাসের একটি ছোট ছবি এঁকে সেটিকে একটি লকেটের ভেতর পুরে রেখেছিলেন। এই লকেটে আগে, জীবনের আরো হালকা সময়ে, তিনি তাঁর স্বামীর ছবি পুরে রাখতেন। এই লকেট তিনি গলার হারের সঙ্গে ঝুলিয়ে দিলেন। উৎকণ্ঠা যখন অসহ্য হয়ে উঠল, তিনি তখন একটু শান্তি পাবার জন্য তাকিয়ে রইলেন টমাস শভেলপেনির ছবির দিকে, যে টমাসকে প্রেমাস্পদ বলবার জন্য তাঁর প্রাণ ব্যাকুল।
অবশেযে শভেলপেনি এলেন তাঁর কাছে, কিন্তু তখন তাঁর পদক্ষেপে নেই সজীবতা, চোখে নেই উজ্জ্বল দৃষ্টি, কণ্ঠস্বরে নেই উচ্ছ্বল প্রাণশক্তির স্পন্দন। বিষণ্ণভাবে ধীরে ধীরে তিনি নিজের একহাতে শ্ৰীমতীর একটি হাত তুলে নিলেন। অন্য হাতে পকেট থেকে একটি বড়ি তুলে নিয়েই তাড়াতাড়ি গিলে ফেললেন।
তিনি বললেন, ‘মিলিসেণ্ট, আমি এই যে বড়িটি গিলে ফেললাম এর ফলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমার মৃত্যু হবে। আমি কোনটা বেছে নেব কিছুতেই বুঝতে পারছি না। বয়স যখন কম ছিল তখন আমার ছিল অনেক আশা, অনেক উচ্চ আশা। তখন ভাবতাম জীবন উৎসর্গ করতে পারব সত্য এবং মানবজাতির সেবায়। হায়, তখন জানতে পারি নি যে তা হবার নয়। আমি কি সত্যের সেবা করে মানবজাতিকে ধ্বংস হতে দেব, না মানবজাতির সেবা করে সত্যকে ধূলায় পদদলিত হতে দেব? সে কথা ভাবতেও ভয় হয়। এই দোটানার মাঝখানে পড়ে আমি বেঁচে থাকা কেমন করে সহ্য করবো? সেই সূর্যের তলায় কি করে আমি নিঃশ্বাস গ্রহণ করব, যে সূর্য হয় দেখবে ভীষণ হত্যাকাণ্ড; না-হয় তো ঢেকে যাবে মিথ্যার মেঘে? না, এ অসম্ভব। তুমি, মিলিসেণ্ট, তুমি আমার পরম প্রিয়, আামার ওপর তোমার আস্থা আছে, তুমি জান আমার প্রেম কত সত্য… কিন্তু তবু… কিন্তু তবু… এই দোটানায়-পড়া অবস্থায় আমার নির্যাতিত আত্মার জন্য তুমি কিই বা করতে পার? তোমার ঐ কোমল বাহু, অপরূপ সুন্দর চোখদুটি, অথবা তুমি আমাকে যা দিতে পার তাঁর কোন কিছুই আমাকে এই দুঃখে সান্ত্বনা দিতে পারে না। না, মরতে আমাকে হবেই। কিন্তু মরবার সময়ে আমার পরে যাঁরা থাকবেন তাঁদের জন্য আমি রেখে যাচ্ছি একটি ভীষণ দায়িত্ব—সত্য এবং জীবন এই দুটির ভেতর একটিকে বেছে নেবার দায়িত্ব। কোনটি বেছে নেওয়া উচিত, তা আমি জানি না। বিদায়, বিদায়, প্রিয় মিলিসেণ্ট। যেখানে অপরাধী আত্মাকে কোনো সমস্যায় জর্জরিত হতে হয় না, সেই দেশে আমি চললাম। বিদায়…’
অন্তিম আবেগে একবার মুহূর্তেকের জন্য তিনি মিলিসেণ্টকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর টমাসের হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেছে অনুভব করেই মিলিসেণ্ট মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে গেলেন। মূর্ছাভঙ্গের পর তিনি তাঁর গলা থেকে লকেটটি ছিনিয়ে নিলেন। কমনীয় আঙুল দিয়ে লকেট খুলে টমাস শভেলপেনির ছোট্ট ছবিটি তার ভেতর থেকে বার করে নিলেন। ছবিটিকে চুম্বন করে তিনি বললেন:
‘ওগো মহাপ্রাণ, যদিও তুমি মৃত, যদিও তোমার যে অধরে আমি এখন বৃথা চুম্বন এঁকে দিচ্ছি তারা আর কথা কইতে পারে না, তবু তোমার কিছুটা এখনো বেঁচে আছে, বেঁচে আছে আমার বুকের ভেতরে। আমার মধ্য দিয়ে, এই তুচ্ছ আমার মধ্য দিয়েই, মানুষকে তুমি যে বাণী দিতে চেয়েছ, মানুষের কাছে সে বাণী পৌঁছবে।’
এই বলে তিনি টেলিফোন তুলে ডাকলেন ‘ডেলি থাণ্ডার’কে।
.
ছয়
কয়েক দিন বাদে,-এ সময়ে লেডি মিলিসেণ্টকে তাঁর স্বামীর এবং তাঁর অনুচরবৃন্দের কোপ থেকে রক্ষা করলেন ‘ডেলি থাণ্ডার’ পত্রিকার কর্তৃপক্ষ—লেডি মিলিসেণ্টের কাহিনী বিশ্বব্যাপী সবারই বিশ্বাস লাভ করল। প্রত্যেকেই হঠাৎ সাহস পেয়ে স্বীকার করলেন ইনফ্রা-রেডিস্কোপের মধ্যে দিয়ে তিনি কিছুই দেখতে পান নি। মঙ্গলগ্রহীদের সম্পর্কে আতঙ্ক যেমন তাড়াতাড়ি চরমে উঠেছিল, তেমনি তাড়াতাড়ি থেমে গেল। থেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুবে পশ্চিমে আবার মনান্তর শুরু হল, এবং মনান্তর অচিরেই পরিণত হল খোলাখুলি যুদ্ধে।
যুদ্ধসাজে সজ্জিত জাতিবৃন্দ বিস্তীর্ণ কেন্দ্রীয় সমতলভূমিতে সমবেত হল। আকাশ কালো হয়ে গেল এরোপ্লেনে-এরোপ্লেনে। ডাইনে বাঁয়ে আণবিক বিস্ফোরণ ধ্বংস ছড়াতে লাগল। বিরাট-বিরাট কামান থেকে গোলা বেরিয়ে মানুষের পরিচালনা ছাড়াই লক্ষ্য সন্ধানে ছুটতে লাগল। হঠাৎ সব আওয়াজ থেমে গেল। প্লেনগুলো মাটির বুকে নেমে এল। বন্ধ হয়ে গেল গোলাগুলি। রণভূমির অনেক দূরে সাংবাদিকরা একাগ্র উৎসাহে তাঁদের এই অদ্ভুত পেশা অনুযায়ী যা দেখবার দেখছিলেন। তাঁরা লক্ষ্য করলেন এই হঠাৎ নিস্তব্ধতা। তাঁরা বুঝতে পারলেন না এই নিস্তব্ধতার কারণ। কিন্তু সাহস করে তাঁরা এগিয়ে গেলেন যেখানে লড়াই হচ্ছিল। গিয়ে দেখলেন, যেখানে লড়াই করছিল সেখানে মরে পড়ে আছে সব সৈন্য—তারা মরেছে, কিন্তু শত্রুর আঘাতে নয়, কোন অদ্ভুত, নতুন, অজ্ঞাত কারণে। সাংবাদিকরা ছুটে গেলেন টেলিফোনে, ফোনে খবর পাঠালেন তাদের নিজ নিজ রাজধানীতে। রাজধানীগুলো লড়াইয়ের ক্ষেত্র থেকে অনেক দূর। সেখানে সংবাদপত্রের অপিসের ‘শেষ সংবাদ’ বিভাগে খবর পৌঁছলঃ ‘লড়াই থামিয়ে দিয়েছে…’ খবর এর বেশি আর এগুলো না। এই পর্যন্ত শোনার সঙ্গে সঙ্গেই কম্পোজিটাররা পড়ে মরে গেল। ছাপার যন্ত্রগুলোও থেমে নীরব হয়ে গেল। মৃত্যু ছড়িয়ে গেল সারা পৃথিবীময়। মঙ্গলগ্রহীরা সত্যিই এসে পড়েছিল।
.
উপসংহার
(মঙ্গলগ্রহের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিশিক্ষার অধ্যাপক লিখিত)
মানবজাতির শেষ কয়েক বছরের উপরিলিখিত ইতিহাস রচনা করিতে আমাকে আদেশ করিয়াছেন সেই মহাবীর যাঁহাকে আমরা সবাই ভক্তি করি দিগ্বিজয়ী মার্টিন। সেই মহান মঙ্গলগ্রহী তাঁহার প্রজাদের মধ্যে এখানে সেখানে লক্ষ্য করিয়াছিলেন যে মিথ্যাবাদী দ্বিপদীগুলিকে তাঁহার সৈন্যেরা বীরের মতো এবং যথাযোগ্যভাবে নিশ্চিহ্ন করিয়াছে তাহাদের প্রতি কেমন একটা দুর্বল হৃদয়াবেগ রহিয়াছে। তিনি তখন তাহার জ্ঞানের আলোকে উদ্বুদ্ধ হইয়া স্থির করিয়াছিলেন যে তাঁহার বিজয় অভিযানের পূর্ববর্তী ঘটনা এবং পরিস্থিতিগুলি নিখুঁতভাবে বর্ণনা করিবার জন্য সর্বপ্রকার পাণ্ডিত্য নিয়োজিত হইবে। কারণ তাঁর মত এই যে, এই ধরনের জানোয়ারগুলিকে আমাদের মহাবিশ্বকে আর দূষিত করিতে দেওয়া ঠিক হইবে না। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস পূর্ববর্তী পৃষ্ঠাগুলির প্রত্যেকটি পাঠক তাঁহার সহিত একমত হইবেন।
আমাদের সপ্তপদী বলিয়া দোষ দেওয়ার চেয়ে জঘন্য নিন্দাবাদ কেহ কল্পনা করিতে পারে কি? পরিবর্তনশীল ঘটনাগুলিকে আমরা যে মধুর হাসি দিয়া অভ্যর্থনা করি তাহাকে যে টেলুরীয়গণ অপরিবর্তনশীল কাষ্ঠহাসি বলিয়া বর্ণনা করিয়াছে তাহাদিগকে কিরূপে ক্ষমা করা যাইতে পারিত? স্যার থিওফিলাসের মতো জানোয়ারকে যেসব সরকার সহ্য করে তাহাদের সম্পর্কে কি ধারণা করিব? যে ক্ষমতার লোভ তাহাকে তাহার অভিযানে প্রবৃত্ত করিয়াছিল, আমাদের ভিতর তাহা ন্যায়সঙ্গতভাবে রাজা মার্টিনেরই বুকের মধ্যে আবদ্ধ। এবং যুক্তরাষ্ট্রসংঘের বিতর্কে আলোচনার যে স্বাধীনতা দেখা গিয়াছিল তাহার সমর্থনে কে কি বলিতে পারে? আমাদের এই গ্রহে জীবন কত মহত্তর! এখানে কি চিন্তা করিতে হইবে তাহা নির্ধারিত হয় বীরচরিত্র মার্টিনের আদেশ দ্বারা, এবং সাধারণ ব্যক্তিদের শুধু সে আদেশ মান্য করিতে হয়!
এখানে যে বিবরণ দেওয়া হইল তাহা প্রমাণ্য। গত টেলুরীয় যুদ্ধ এবং আমাদের সাহসী তরুণদের আক্রমণের পর খবরের কাগজ এবং গ্রামোফোন রেকর্ডের যে টুকরাগুলি অবশিষ্ট ছিল তাহা হইতেই মালমশলা সংগ্রহ করিয়া এই বিবরণ একত্রিত করা হইয়াছে। এই বিবরণে প্রকাশিত কতকগুলি বিবরণের অন্তরঙ্গতায় কেহ-কেহ বিস্ময় বোধ করিতে পারেন, কিন্তু দেখা গিয়াছিল স্যার থিওফিলাস তাঁহার স্ত্রীর নিভৃত কক্ষে তাঁহাকে না জানাইয়া একটি ডিকটাফোন যন্ত্র লুকাইয়া রাখিয়া দিয়াছিলেন। এই যন্ত্র হইতেই শভেলপেনির শেষ কথাগুলি পাওয়া গিয়াছে।
এই জানোয়ারগুলি আর জীবিত নাই, ইহা জানিয়া প্রত্যেক মঙ্গলগ্রহীর হৃদয় স্বস্তিবোধ করিবে। এবং এই চিন্তার আনন্দে অধীর হইয়া আমরা কামনা করিব ভিনাস গ্রহেরও সমান জঘন্য অধিবাসীদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রিয় রাজা মার্টিন যে অভিযান করিবেন মনস্থ করিয়াছেন তাহাতেও তিনি তাঁহার প্রাপ্য জয় গৌরব লাভ করেন।
রাজা মার্টিন দীর্ঘজীবি হোক!
.
প্রথম প্রকাশ: আশ্চর্য!, অক্টোবর, ১৯৬৩
মূল রচনা: বারট্রাণ্ড রাসেল
কলকাতার রূপা এণ্ড কোম্পানীর সঙ্গে ব্যবস্থাক্রমে প্রকাশিত।