পি-আর রোবট • নিরঞ্জন সিংহ
‘রীগালাস পাঁচ’-এ পৌঁছে অভিযানকারী দলটি তাঁবু ফেললেন ও যন্ত্রদানব পি-আর তিনকে চালু করলেন। পি-আর তিন-এর কাজ হচ্ছে তাঁবু পাহারা দেওয়া। ওর ডাক নাম প্রবীর। প্রবীর মানুষের কথা বুঝতে পারে ও উত্তর দিতে পারে। দেখতেও মানুষের মতো। তাঁবু পাহারা দেওয়ার জন্য ওকে বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে। কোন ভিনগ্রহবাসী বুদ্ধিমান প্রাণী ওর নজর এড়িয়ে কিছুতেই তাঁবুতে ঢুকতে পারবে না। প্রবীর কাজে খুবই দক্ষ। আগে প্রবীরের গায়ের রঙ ছিল ধূসর। কিন্তু ‘রীগলাস-পাঁচ’-এ আসার সময় ওকে রঙ করে নেওয়া হয়েছে। প্রবীরের উচ্চতা চার ফুট। অভিযানকারীরা প্রবীরকে দয়ালু ও যুক্তিবাদী ছোট্ট ধাতব মানুষ বলে ভাবতে অভ্যস্ত হতে পড়েছেন।
কিন্তু প্রবীরের উপর যে গুণগুলো ওঁরা আরোপ করেছিলেন তার একটা গুণও প্রবীরের ছিল কিনা সন্দেহ। প্রবীর একটা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই না। তবে খুবই দক্ষ যন্ত্র তাতে কোন সন্দেহ নেই।
ছোট্ট নীল প্রবীর তার লাল চোখ খুলে সতর্কভাবে তাঁবুর চৌহদ্দি পাহারা দিয়ে চলে। ওর সেন্সরগুলো পুরোদমে কাজ করে। ক্যাপ্টেন মুখার্জী ও লেফটেন্যান্ট দত্ত হোভারজেটে চড়ে এক সপ্তাহের জন্য বাইরে গেছেন অনুসন্ধান চালাবার জন্য। তাঁবুতে এখন একা ক্যাপ্টেন জয়ন্ত বোস।
ক্যাপ্টেন জয়ন্ত বোস একটু বেঁটেখাটো মানুষ। চওড়া বুক, ফর্সা রঙ, অল্প বয়স। সব সময় হাসিখুশি। জয়ন্ত দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে অনুসন্ধানকারীদের সঙ্গে বেতার যোগাযোগ করে রুটিনমাফিক খবর লেনদেন করলেন। এরপর একটা ফোল্ডিং ইজিচেয়ার পেতে আধশোয়া অবস্থায় চারপাশের দৃশ্যাবলী দেখতে লাগলেন। নির্জনতা যাদের প্রিয় ‘রীগালাস’ তাদের কাছে খুবই ভাল লাগবে। চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে সূর্যতাপে উত্তপ্ত পাথর, নুড়ি ও জমাট লাভা। সারা পরিবেশ জ্বলন্ত রোদুরে ঝাঁ ঝাঁ করছে। মাঝে মাঝে চড়াই পাখীর মতো ছোটখাট পাখী দেখা যাচ্ছে দু একটা। জন্তুর মধ্যে ছাগলের মতো দেখতে কিছু জানোয়ার মাঝে মধ্যে চোখে পড়ে। গাছপালার মধ্যে কিছু ক্যাকটাস।
জয়ন্ত ইজিচেয়ারে ছেড়ে উঠে পড়লেন। প্রবীরকে ডেকে বললেন, ‘বসে বসে আর ভাল লাগছে না, আমি একটু তাঁবুর বাইরে থেকে ঘুরে আসছি। তাঁবু পাহারার
পুরো দায়িত্ব এখন থেকে তোমার।’
প্রবীর ঘুরে ঘুরে তাঁবুর বাইরেটা পাহারা দিচ্ছিল। জয়ন্তর কথা শুনে একটু থেমে বলল, ‘ঠিক আছে ক্যাপ্টেন।’
‘সাবধানে থাকবে। দেখো যেন কোন ভিনগ্রহবাসী তাঁবুর এলাকায় ঢুকে না পড়ে।’
‘কিছু ভাববেন না ক্যাপ্টেন।’ জবাব দিল প্রবীর। জয়ন্ত জানেন কোন ভিনগ্রহীবাসীর পক্ষে তাঁবুর এলাকার মধ্যে ঢোকা অসম্ভব ব্যাপার, তা সে যত চালাকই হোক না কেন।
‘ক্যাপ্টেন, আপনার পাস-ওয়ার্ডটা মনে আছে তো?’ প্রবীর জানতে চাইল।
‘আছে। তোমারটা মনে আছে তো?’ প্রশ্ন করলেন জয়ন্ত।
‘হ্যাঁ, ক্যাপ্টেন।’
‘ঠিক আছে, চল্লাম।’ বলে জয়ন্ত আস্তে আস্তে তাঁবুর এলাকার বাইরে চলে গেলেন।
ঘণ্টাখানেক চারপাশে ঘুরেফিরে খুব হতাশ হলেন উনি। একই দৃশ্য। জয়ন্ত আবার ফিরে এলেন। প্রবীর ঘুরে ঘুরে পাহারা দিচ্ছে। দেখে খুশি হলেন। তার মানে সব কিছু ঠিকটাক আছে। ‘প্রবীর, কোন খবর আছে নাকি?’ জিজ্ঞাসা করলেন উনি। হঠাৎ প্রবীর চিৎকার করে উঠল, ‘থামুন, তাঁবুর এলাকার মধ্যে ঢোকার আগে আপনার পাস-ওয়ার্ডটা বলুন।’
‘এখন রসিকতার ইচ্ছে নেই প্রবীর। বাইরে প্রচণ্ড রোদুর।’ বলে এগিয়ে গেলেন জয়ন্ত।।
প্রবীর আবার চিৎকার করে উঠল, ‘থামুন বলছি।’
জয়ন্ত থমকে দাঁড়ালেন। প্রবীরের ফটোইলেকট্রিক চোখ জ্বলে উঠল। দুবার ক্লিক করে শব্দ হল। জয়ন্ত বুঝতে পারলেন প্রবীরের প্রাথমিক অস্ত্রগুলো এখন প্রস্তুত।
‘আমি থেমেছি প্রবীর। আমার নাম জয়ন্ত বোস। র্যাঙ্ক ক্যাপ্টেন। অভিযানকারী দলের আমি দু’নম্বর মানুষ। ঠিক আছে তো?’
‘দয়া করে পাস-ওয়ার্ডটা বলুন।’
‘নীলঘণ্টা,’ বললেন জয়ন্ত। ‘এবার তাঁবুতে ঢুকলে আশা করি তুমি কিছু মনে করবে না?’
‘তাঁবুর চৌহদ্দিতে ঢুকবেন না।’ প্রবীর জোর দিয়ে উঠল, ‘আপনার পাস-ওয়ার্ড ঠিক নয়—ভুল।’
‘বলছ কি তুমি। পাস-ওয়ার্ড আমি নিজে তোমাকে দিয়েছি।’
‘ওটা আগেকার পাস-ওয়ার্ড।’
‘আগেকার? প্রবীর তোমার ‘সেমি-সলিড’ মগজ খারাপ হয়েছে নিশ্চয়। ‘নীলঘণ্টা’ হচ্ছে একমাত্র ‘পাস-ওয়ার্ড’। অন্য কোন নতুন ‘পাস-ওয়ার্ড’ তুমি পেতে পার না, কারণ আর কোন নতুন ‘পাস-ওয়ার্ড’ নেই। যদি না…’
প্রবীর অপেক্ষা করতে লাগল। জয়ন্ত এই অপ্রীতিকর ব্যাপারটা সব দৃষ্টিকোণ থেকে ভেবে দেখলেন। তারপর বললেন, ‘অবশ্য ক্যাপ্টেন মুখার্জী যাওয়ার আগে যদি তোমাকে নতুন কোন পাস-ওয়ার্ড দিয়ে গিয়ে থাকেন, আলাদা কথা।’
‘তাই দিয়ে গেছেন।’ জবাব দিল প্রবীর। ব্যাপারটা আমার আগেই ভেবে দেখা উচিত ছিল। বিড়বিড় করে বললেন জয়ন্ত। অবশ্য এরকম ভুলচুক আগেও ঘটেছে; কিন্তু যেহেতু সে সময় তাঁবুতে অন্য কোন লোক ছিল তারা ভুলটা শুধরে দিয়েছে। কিন্তু এখন তো তাঁবুতে অন্য কেউ নেই ভুল শোধরাবার জন্য। যাহোক এখুনি হতাশ হওয়ার কিছু নেই। ধীরে সুস্থে মাথা ঠাণ্ডা রেখে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। একটা না একটা পথ নিশ্চয় খুঁজে পাওয়া যাবে, ভাবলেন জয়ন্ত।
জয়ন্ত রোবটটাকে বললেন, ‘প্রবীর, বুঝেছি ব্যাপারটা কি ঘটেছে। ক্যাপ্টেন মুখার্জী তোমাকে সম্ভবতঃ নতুন ‘পাস-ওয়ার্ডটা’ দিয়েছেন, কিন্তু তিনি সেকথা আমাকে বলতে ভুলে গেছেন। তাঁবু ছেড়ে যাওয়ার আগে আমার খোঁজখবর করা উচিত ছিল। ব্যাপারটা আমার ভুলের জন্য বেশ ঘোরালো হয়ে উঠেছে।’
প্রবীর কোন কথা বলল না। জয়ন্ত বলে চললেন, ‘অবশ্য ভুলটা এখন শুধরে নেওয়া যেতে পারে।’
‘আমারও তাই মনে হয়।’ মন্তব্য করল প্রবীর।
‘প্রবীর তুমি তো জানো যে ক্যাপ্টেন মুখার্জী ও আমি এই ‘পাস-ওয়ার্ডের’ ব্যাপারে একটা নিয়ম মেনে চলি। উনি যখন তোমাকে নতুন কোন পাস-ওয়ার্ড দেন সঙ্গে সঙ্গে তা আমাকেও জানিয়ে দেন। কিন্তু কোন সময় কোন ভুলচুক হতে পারে এই ভয়ে উনি নতুন ‘পাস-ওয়ার্ডটা’ লিখেও রাখেন।’
‘রাখেন বুঝি?’
‘হ্যাঁ, রাখেন।’ বললেন জয়ন্ত। ‘সব সময় লিখে রাখেন। তোমার পিছনে তাঁবু দেখতে পাচ্ছো?’
প্রবীর ওর একটা সেন্সর ঘুরিয়ে তাঁবুর দিকে ধরল। কিন্তু আর একটা সেন্সর জয়ন্তর দিকে তাক করে রাখল। তারপর বলল, ‘হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি।’
‘ঠিক আছে। এবার তাঁবুর ভিতরে দেখ একটা টেবিল আছে। টেবিলের উপর একটা ক্লিপবোর্ডে একটা কাগজ আটকানো আছে।’
“আপনি ঠিকই বলেছেন।’ জবাব ছিল রোবট।
‘বাঃ, এবার দেখো ওই কাগজটায় প্রচুর প্রয়োজনীয় জিনিস লেখা আছে, যেমন, জরুরী বেতার তরঙ্গের কথা। উপরের কোণের দিকে একটা লাল বৃত্তের মধ্যে নতুন পাস-ওয়ার্ডটা লেখা আছে।’
প্রবীর ওর সেন্সরটাকে আর একটু বাড়িয়ে সঠিক ফোকাস করে জয়ন্তকে বলল, ‘আপনার কথা ঠিক, কিন্তু সম্পূর্ণ নিরর্থক। নতুন ‘পাস-ওয়ার্ড’ কোথায় লেখা আছে তা জেনে আমার কোন লাভ নেই। আমি জানতে চাই আপনি নতুন ‘পাস-ওয়ার্ড’টা বলতে পারবেন কি না? যদি না পারেন তাহলে কিছুতেই এখানে ঢুকতে দেব না।’
‘তুমি পাগলের মতো কথা বলছ। প্রবীর, তুমি কি আমাকে চিনতে পাছ না? আজ কতদিন আমরা দুজনে একসঙ্গে রয়েছি। কত অভিযানে আমরা অংশ নিয়েছি। যথেষ্ট রসিকতা করেছো, এবার আমাকে ভিতরে ঢুকতে দাও।’
‘ক্যাপ্টেন বোসের সঙ্গে চেহারার আপনার অদ্ভুত মিল।’ রোবট মন্তব্য করল। ‘কিন্তু আপনার পরিচয় ঠিক কি বেঠিক তা পরীক্ষা করে দেখার মতো ক্ষমতা আমার নেই, অধিকারও নেই। আপনি নতুন ‘পাস-ওয়ার্ড’টা বললেই আমি আপনাকে ভিতরে ঢুকতে দিতে পারি।’
জয়ন্ত বহুকষ্টে নিজেকে সংযত করে, যতটা সম্ভব স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘প্রবীর, তুমি এমন ভাবে কথা বলছ যেন আমি একজন ভিনগ্রহবাসী শত্রু।’
‘আপনি যখন নতুন ‘পাস-ওয়ার্ড’ বলতে পারছেন না তখন স্বভাবতই আমাকে ওইরকম একটা সিদ্ধান্তে আসতে হচ্ছে।
‘প্রবীর!’ জয়ন্ত চিৎকার করে উঠলেন, ‘ঈশ্বরেই দোহাই।’
‘তাঁবুর এলাকায় ঢোকার চেষ্টা করবেন না। আপনি যেই হোন, যতক্ষণ না নতুন ‘পাস-ওয়ার্ড’ বলবেন ততক্ষণ ওইখানে দাঁড়িয়ে থাকুন।’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমি এখানেই দাঁড়াচ্ছি। তুমি অত ঘাবড়ে যেও না।’ বললেন জয়ন্ত। উনি বুঝতে পারছিলেন প্রবীর আর একটু হলেই গুলি ছুঁড়তে শুরু করে দিত। জয়ন্ত বেশ খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন। প্রবীরের সেন্সরগুলো আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠল। জয়ন্ত একটা পাথরের চাঙরের উপর বসলেন। ব্যাপারটা ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে হবে।
রীগালাস এর হাজার ঘণ্টা দিনের ৫০০ ঘণ্টা কেটেছে। এখন হিসেব মত দুপুর। যমজ সূর্য ঠিক মাথার উপর। খুব ধীরে ধীরে ওরা এগুচ্ছে। চারপাশে কালো গ্রানাইট পাথর ছড়িয়ে রয়েছে। গাছপালাহীন মরুভূমি। শুকনো উত্তপ্ত বাতাস বইছে। মাঝে মাঝে দু একটা পাখি চক্কর দিচ্ছে মাথার উপর। ছোটখাটো দু একটা জন্তু লাফিয়ে লাফিয়ে এক পাথরের আড়াল থেকে আর এক পাথরের ছায়ায় গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে। একটা ছোট নেকড়ের মতো জন্তু ছুটতে ছুটতে গিয়ে তাঁবুর এলাকায় ঢুকে পড়েছিল। প্রবীৱ তাকে লক্ষ্যই করল না। কিন্তু পাথরের উপর বসে বসে একটা মানুষ এই সব লক্ষ্য করতে লাগল।
জয়ন্ত যমজ সূর্যের প্রচণ্ড তাপে যেন ঝলসে যাচ্ছিলেন। তৃষ্ণায় গলাবুক কাঠ। এতক্ষণে যেন সঠিক বুঝতে পারলেন কী ভয়ঙ্কর অবস্থায় তিনি পড়েছেন। মুক্তির উপায় কি? এখন প্রথমেই চাই জল। না পেলে তৃষ্ণায় মারা পড়বেন। কাছাকাছি কোথাও জল নেই। জল আছে শুধু তাঁবুতে। অঢেল জল। কিন্তু এই রোবটটাকে অতিক্রম করে কি করে উনি সেখানে পৌঁছুবেন?
ক্যাপ্টেন মুখার্জী রুটিন মাফিক ওঁর সঙ্গে বেতার যোগাযোগের চেষ্টা করবেন তিন দিন পরে। জয়ন্তর উত্তর না পেলেও ওঁরা খুব একটা চিন্তা করবেন না। কারণ শর্ট-ওয়েভে বেতার যোগাযোগ খুব বিশ্বস্ত নয়। প্রতি সন্ধ্যা ও সকালে একবার করে ওঁরা বেতারে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবেন। ওঁর উত্তর না পেলে কখনই ফিরে আসবেন না। কাজ শেষ করেই ফিরবেন ওঁরা। কিন্তু এতদিন তো জয়ন্ত জল ছাড়া বেঁচে থাকতে পারবেন না। কদিন বাঁচবেন উনি? তা নির্ভর করছে কী পরিমাণ জল নষ্ট হচ্ছে তার উপরে। শরীরের ওজনের তুলনায় যখন দশ থেকে পনের শতাংশ দেহের জলীয় পদার্থ ক্ষয় হয়ে যাবে তখন উনি ‘শক’ খাবেন। বেদুইনরা যখন মরুভূমির মধ্যে দলছুট হয়ে পড়ে, তখন তারা জলের অভাবে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে মারা যায়।
রীগালাস পাঁচ কালাহারি মরুভূমির সঙ্গে তুলনীয়। রীগালাসের একদিন পৃথিবীর হাজার ঘণ্টার মতো। এখন দুপুর, এখনো পাঁচশো ঘন্টা এই ভয়াবহ রোদ্দুরে ওঁকে থাকতে হবে। না আছে কোন আশ্রয়, না আছে একটু ছায়া। কতক্ষণ বাঁচবেন জয়ন্ত? পৃথিবীর একদিন? দুদিন? ক্যাপ্টেন মুখার্জী আর লেফটেন্যান্ট দত্তর কথা ভেবে আর লাভ নেই। তাঁবু থেকে ওঁকে জল জোগাড় করতেই হবে, এবং তা খুবই দ্রুত। অর্থাৎ রোবটকে অতিক্রম করে তাঁবুতে পৌঁছুনোর একটা রাস্তা বের করতেই হবে।
জয়ন্ত ঠিক করলেন উনি যুক্তির আশ্রয় নেবেন। ‘প্রবীর, তুমি নিশ্চয় জানো যে আমি ক্যাপ্টেন জয়ন্ত বোস। আমি তাঁবু থেকে বেরিয়ে ছিলাম এবং আমি ক্যাপ্টেন জয়ন্ত বোস, ঠিক এক ঘণ্টা বাদে ফিরে এসেছি এবং আমিই সেই ক্যাপ্টেন জয়ন্ত বোস তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি; কিন্তু নতুন ‘পাস-ওয়ার্ড’টা বলতে পারছি না।’
‘আপনি যা বলছেন তার সম্ভাবনা খুবই প্রবল।’ জবাব দিল রোবট।
‘তাহলে?’
কিন্তু সম্ভাবনার উপরে কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বিদেশী ভিনগ্রহী শত্রুদের হাত থেকে তাঁবু বাঁচাবার জন্য আমাকে বিশেষ ভাবে তৈরি করা হয়েছে, বুঝেছেন? আর এতদিন বাদে আমি একজন ভিনগ্রহীকে দেখতে পেয়েছি।’
‘তুমি তাঁবু থেকে এক টিন জল আমাকে দিতে পার?’
‘না, এ কাজ নিয়ম বিরুদ্ধ।’
‘জল না দেওয়ার জন্য তুমি কখনো কোন নির্দেশ পেয়েছে বলে তো আমার মনে হয় না।’
‘সে রকম বিশেষ নির্দেশ পাইনি ঠিকই; কিন্তু আমার মগজ আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করছে। কোন ভিনগ্রহবাসীকে কোন রকম সাহায্য করা আমার উচিত নয় এ কথাটা স্পষ্ট বুঝতে পারছি।’
জয়ন্ত এবার চেঁচিয়ে উঠে অনর্গল যা তা বলতে লাগলেন; কিন্তু প্রবীর সে-সব উপেক্ষা করল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর জয়ন্ত ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে একটা পাথরের আড়ালে আশ্রয় নিলেন।
কিছুক্ষণ বাদে সেখান থেকে একটা মানুষ বেরিয়ে এল শিস দিতে দিতে। ইনিই জয়ন্ত বোস।
লোকটি বলল, ‘কি প্রবীর, কি খবর?’
‘ক্যাপ্টেন বোস?’ বলল রোবটটা।
জয়ন্ত তাঁবুর এলাকা থেকে দশফুট দূরে দাঁড়ালেন।
‘চারিদিকে ঘুরে ফিরে দেখছিলাম বুঝছো? কিন্তু না, কিসসু নেই দেখার মতো। এর মধ্যে কিছু ঘটে নি তো এখানে?’
‘হ্যাঁ ক্যাপ্টেন, ঘটেছে। একজন ভিনগ্রহবাসী তাঁবুতে ঢোকার চেষ্টা করছিল।’
জয়ন্ত খুব অবাক হয়ে বললেন, ‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ, ক্যাপ্টেন।’
‘ভিনগ্রহবাসীটাকে দেখতে কেমন?’
‘ঠিক আপনার মতো ক্যাপ্টেন।’
‘বলো কি হে! তা কি করে বুঝলে যে লোকটা আমি নই?’
‘কারণ, লোকটা পাস-ওয়ার্ড ছাড়াই তাঁবুতে ঢোকার চেষ্টা করছিল। আসল ক্যাপ্টেন বোস কখনই এরকম কাজ করতেন না।’
‘ঠিকই বলেছো। লোকটাকে ঢুকতে না দিয়ে ঠিক কাজই করেছো। আমাদের চোখকান খোলা রাখতে হবে। লোকটা হয়ত ধারে কাছেই কোথাও ঘাপটি মেরে
বসে আছে। একটু অন্যমনস্ক হলেই তাঁবুতে ঢুকে পড়বে।’
‘ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন, আপনি খাঁটি কথাই বলেছেন।’
জয়ন্ত মনে মনে খুশি হলেন। প্রবীরের কাছে প্রত্যেকটি ঘটনাই অভিনব। অভিজ্ঞতা ওর কাছে কোন কাজের জিনিস নয়। প্রবীরকে ওইভাবেই তৈরি করা হয়েছে। প্রবীর জানে পৃথিবীর মানুষরা সর্বশেষ পাস-ওয়ার্ড টা জানে, কিন্তু কোন ভিনগ্রহবাসী তা জানে না। আর তা সত্ত্বেও তারা জোর করে বা কৌশলে ঢোকার চেষ্টা করে।
সুতরাং যে তাঁবুতে ঢোকার চেষ্টা করবে না সে পৃথিবীর মানুষ, অবশ্য ঢুকলে ‘পাস-ওয়ার্ড’ বলেই ঢুকবে। জয়ন্ত মনে মনে তাঁর পরিকল্পনা ঠিক করে নিলেন। শরীরের জল শুকিয়ে যাচ্ছে। এখন যে কোন রকম ঝুঁকিই তাঁকে নিতে হবে।
‘প্রবীর?’ জয়ন্ত শুরু করলেন, ‘আমি যখন বাইরে ঘুরছিলাম তখন একটা জিনিস আবিষ্কার করেছি।’
‘কি ক্যাপ্টেন?’
‘দেখলাম আমরা ঠিক একটা ফাটলের পাশেই তাঁবু ফেলেছি। যদিও ফাটলটা খুবই সরু কিন্তু যে কোন মুহূর্তে তা বেড়ে যেতে পারে এবং আমাদের তাঁবুটা সেই ফাটলের মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পারে।’
‘খুবই খারাপ। ভয়ের কোন কারণ আছে কি ক্যাপ্টেন?’
‘নিশ্চয়! আমার মনে হয় তুমি ও আমি দুজনে মিলে তাড়াতাড়ি তাঁবুটা সরিয়ে ফেলি। তা নাহলে আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। জিনিসপত্র গোছাতে শুরু কর।’
‘ঠিক আছে ক্যাপ্টেন। কিন্তু তার আগে আপনি আমায় বর্তমান কর্তব্য থেকে মুক্তি দিন।’
‘আমি তোমাকে মুক্ত করে দিলাম। নাও তাড়াতাড়ি কাজ আরম্ভ করো।’
‘শুধু মুখে বললে তা হবে না ক্যাপ্টেন। নতুন ‘পাস-ওয়ার্ড’টা বলে আমাকে মুক্ত করে দিয়ে বলুন যে তুমি মুক্ত, শুধুমাত্র তখনই আমি এই তাঁবু পাহারা দেওয়ার কাজ বন্ধ করে অন্য কাজ শুরু করতে পারব।’
‘এখন অত সব নিয়মকানুন মানার সময় নেই প্রবীর। নতুন ‘পাস-ওয়ার্ড’ হচ্ছে ‘সাদামাছ’। হয়েছে? নাও নাও তাড়াতাড়ি করো, মনে হল যেন মাটি কেঁপে উঠল একবার’’
‘কৈ নাতো।’
‘তুমি কি করে বুঝবে? তুমি তো একটা পি-আর রোবট। আবার কেঁপে উঠল। এবার নিশ্চয় বুঝতে পেরেছো?’
‘মনে হচ্ছে যেন।’
‘সেই জন্যই তো বলছি তাড়াতাড়ি করতে।’
ক্যাপ্টেন বোস, দয়া করে আমাকে মুক্ত করে দিন, তা নাহলে কি করে আমি অন্য কাজে হাত দেব?’
‘উত্তেজিত হয়ো না। ভেবে দেখলাম তাঁবু সরানোর কোন দরকার নেই।’ বললেন জয়ন্ত।
‘কিন্তু ভূমিকম্প হচ্ছে যে।’
‘হিসেব করে দেখলাম ফাটল বাড়তে বেশ যথেষ্ট সময় লাগবে। আমরা অনেক সময় পাব। আমি বরং আর একবার চারদিকটা ঘুরে আসি।’
জয়ন্ত তাড়াতাড়ি সেই পাথরটার আড়ালে চলে গেলেন। হৃদ্কম্পন বেড়ে গেছে ওঁর। মনে হচ্ছে রক্তের জলীয় পদার্থ শুকিয়ে যাচ্ছে আর শিরা উপশিরার মধ্যে রক্ত যেন থকথকে হয়ে উঠছে। চোখের সামনে নাচছে হলুদ রঙের বেলুন। পাথরের আড়ালে এক চিলতে ছায়ায় মাথা গুঁজে সেদ্ধ হতে থাকলেন উনি।
দীর্ঘ দিন। যমজ সূর্য আগুন ছড়াচ্ছে। পি-আর রোবটের কোনদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই, সে একমনে তাঁবু পাহারা দিয়ে চলেছে। হঠাৎ দমকা বাতাস বইল। তারপর তা বাড়তে লাগল। বালির ঝড় প্রবীরকে ঢেকে ফেলল। কিন্তু সেই প্রচণ্ড ঝড়কে উপেক্ষা করেও প্রবীর ওর সেন্সরগুলোকে আরো সজাগ রেখে ঘুরে ঘুরে তাঁবু পাহারা দিতে লাগল। কিছুক্ষণ বাদে ঝড় থেমে গেল। দেখা গেল পাথরের আড়াল থেকে একটা লোক বেরিয়ে তাঁবুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কে লোকটা? কাপ্টেন বোস? নাকি সত্যি কোন ভিনগ্রহবাসী? প্রবীরের সেন্সরগুলো খুবই সতর্ক ও সজাগ? প্রবীর তাঁবু পাহারা দিতে লাগল।
মরুভূমির দিক থেকে একটা ছাগলের মতো জন্তু ছুটতে ছুটতে প্রায় প্রবীরের গা ঘেঁষে পালিয়ে গেল। একটা বড় পাখী প্রবীরের মাথার ওপর চক্কর দিতে লাগল, তারপর তাঁবু থেকে কি-একটা ছোঁ নিয়ে পালাল। প্রবীর কিন্তু এ-সব দেখেও দেখল না। পাথরের আড়াল থেকে মানুষের মতো যে জীবটি বেরিয়ে এসে তাঁবুর দিকে এগিয়ে আসছিল ও লক্ষ্য করছিল তাকে।
জীবটি প্রবীরের সামনে একটু দূরত্ব রেখে থামল। ‘শুভদিন, ক্যাপ্টেন বোস।’ বলে উঠল প্রবীর। ‘আমার মনে হচ্ছে কথাটা বলা আমার উচিত। আপনি কিন্তু ডি-হাইড্রেসানে আক্রান্ত হয়েছেন। এরপর অজ্ঞান হয়ে পড়বেন, মৃত্যু হওয়াও অসম্ভব নয়।’
‘চুপ করো।’ জয়ন্ত চেঁচিয়ে উঠলেন।
‘ঠিক আছে ক্যাপ্টেন।’
‘আমাকে ক্যাপ্টেন বলবে না।’
‘কেন ক্যাপ্টেন?
‘কারণ আমি ক্যাপ্টেন নই। আমি একজন ভিনগ্রহবাসী—আমি রীগালান-পাঁচ-এর বাসিন্দা।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ, কেন তোমার কি কোন সন্দেহ হচ্ছে?’
‘মানে আপনার কথার স্বপক্ষে তো কোন প্রমাণ নেই…’
‘তাতে কি হয়েছে? আমি প্রমাণ এখুনি দিচ্ছি। আমি নতুন পাস-ওয়ার্ডটা জানি না। এর থেকেও বেশী প্রমাণ চাই?’
রোবটটা ইতস্তত করছে দেখে জয়ন্ত বললেন, ‘দেখো, ক্যাপ্টেন বোস তোমাকে একটা কথা বলতে বলে দিয়েছেন। মনে রেখো পৃথিবীর মানুষ সঠিক পাস-ওয়ার্ড বলতে পারে; কিন্তু একজন ভিনগ্রহবাসী তা জানে না।’
‘হ্যাঁ, তা ঠিক। ‘পাস-ওয়ার্ড’ জানা না জানার উপর আমি বুঝতে পারব কে পৃথিবীবাসী আর কে তা নয়। কিন্তু তবু মনে হচ্ছে কোথায় যেন একটু ভুল হচ্ছে। ধরুন আপনি যদি আমাকে মিছে কথা বলেন?’
‘আমি যদি তোমাকে মিছে কথা বলি, তার মানে আমি পৃথিবীবাসী ও আমি ‘পাস-ওয়ার্ড’টা জানি—তাহলে তো চিন্তার কোন কারণই থাকত না। কিন্তু তুমি জানো যে পৃথিবীর মানুষ তোমার সঙ্গে মিছে কথা বলবে না, কারণ সে তো সত্যি সত্যি পাস-ওয়ার্ডটা জানে।’
‘জানি না আপনি কি বলতে চাইছেন।’
‘কোন পৃথিবীর মানুষ কখনো নিজেকে ভিনগ্রহবাসী বলে পরিচয় দেয়?’
‘না, তা দেয় না।’
‘পাস-ওয়ার্ড জানলে সে মানুষ, না জানলে ভিনগ্রহবাসী, তাই তো?’
‘তাহলে কি প্রমাণিত হচ্ছে?’ রোবট বলল, ‘আমি এখনো ঠিক বুঝতে পারছি না।’
জয়ন্ত বুঝলেন কোন ভিনগ্রহবাসীর কথা ও বিশ্বাস করবে না। যদি সেই ভিনগ্রহবাসী নিজেকে ভিনগ্রহবাসী বলে প্রমাণ করতে চায় তাহলেও নয়। জয়ন্ত একটু অপেক্ষা করলেন। কিছুক্ষণ পরে প্রবীর বলল, ‘ঠিক আছে আমি আপনাকে ভিনগ্রহবাসী বলেই মেনে নিলাম। তাহলে আমি আপনাকে তাঁবুতে ঢুকতে দেব না।’
‘আমি তো ভিতরে যেতে চাইছি না। আসল কথা হচ্ছে আমি ক্যাপ্টেন জয়ন্ত বোসের বন্দী। তার মানে কি তা নিশ্চয় তুমি জানো।’
‘না, আমি জানি না।’ প্রবীর সতর্ক হয়ে উঠল।
‘তার মানে হচ্ছে ক্যাপ্টেন বোস আমার সম্বন্ধে তোমাকে যে নির্দেশ দিয়েছেন তা তুমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। সেই নির্দেশ হচ্ছে যে তুমি আমাকে তাঁবুর এলাকার মধ্যে আটকে রাখবে। এবং তিনি যতক্ষণ অন্য কোন নির্দেশ না দেন ততক্ষণ তুমি আমাকে ছাড়বে না।’
রোবট চিৎকার করে উঠল, ‘ক্যাপ্টেন ভাল করেই জানেন যে আমি আপনাকে তাঁবুর এলাকার মধ্যে কিছুতেই ঢুকতে দিতে পারি না।’
‘সেকথা তিনি ভাল করেই জানেন। কিন্তু তিনি তো আমাকে তাঁবুর এলাকার মধ্যে আমাকে বন্দী করে রাখতে বলেছেন। দুটো ব্যাপার নিশ্চয় এক নয়।’
‘তাই কি?’
‘নিশ্চয়! তুমি তো জানো যে ভিনগ্রহবাসীরা জোর করে তাঁবুতে ঢুকবার চেষ্টা করলে পৃথিবীবাসীরা তাকে বন্দী করে রাখে।’
‘এরকম কথা আমি শুনেছি।’ বলল প্রবীর। ‘তবে আপনাকে আমি তাঁবুতে ঢুকতে দিতে পারব না। তাঁবুর বাইরেই আমি আপনাকে পাহারা দিচ্ছি।’
‘এ আবার কিরকম কথা হল?’
‘এর বেশী আর কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
‘ঠিক আছে।’ বলে জয়ন্ত তাঁবুর এলাকার বাইরে বালির উপর বসে পড়লেন। তারপর রোবটটিকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘তাহলে এবার আমি তোমার বন্দী।’
‘হ্যাঁ।’ জবাব দিল রোবট।
‘আমার তেষ্টা পেয়েছে, একটু জল দাও।’
‘আপনাকে জল দেওয়ার কোন নির্দেশ নেই।’
‘নিশ্চয় আছে। তুমি নিশ্চয় জানো জেনেভা চুক্তি ও অন্যান্য আন্তর্গ্রহ চুক্তি অনুযায়ী প্রত্যেক বন্দীর সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করতে হবে ও তার পদমর্যাদা অনুযায়ী তার জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিতে হবে।’
‘হ্যাঁ, এরকম চুক্তির কথা আমি শুনেছি। তা আপনার পদমর্যাদা কি?’
‘আমি একজন উচ্চ পদস্থ সৈনিক। আমার ক্রমিক সংখ্যা হচ্ছে ১২২৭৮০৩২। এক্ষুনি আমাকে জল না দিলে, তেষ্টায় আমি মরে যাব।’
রোবট বলল, ‘আপনাকে আমি জল দিতে পারি, তবে ক্যাপ্টেন বোস ও অন্য দুজনের জল রেখে তবেই।’
‘তাঁবুতে প্রচুর জল আছে।’
‘একথা আপনি বললে তো হবে না, ক্যাপ্টেন বোসকে বলতে হবে। তবেই আমি আপনাকে জল দেব।’
‘বেশ। জয়ন্ত উঠে পড়লেন।
‘থামুন, যাচ্ছেন কোথায়?’
‘ঐ পাথরটার আড়ালে। এখন আমার প্রার্থনার সময়।’
‘কিন্তু আপনি যদি পালিয়ে যান?’
‘তাতে কোন ক্ষতি নেই। ক্যাপ্টেন বোস আমাকে ধরে ফেলবেন।’
‘তা ঠিক।’ বলল রোবট।
একটু পরেই জয়ন্ত পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন।
‘ক্যাপ্টেন বোস?’
‘হ্যাঁ, বলো।’ জবাব দিলেন জয়ন্ত। ‘আমার বন্দী এখানে ঠিকঠাক আছে তো?’
‘হ্যাঁ, ক্যাপ্টেন। লোকটা ওই পাথরের আড়ালে প্রর্থনা করছে।’
‘তাতে কোন ক্ষতি নেই। শোনো প্রবীর লোকটা যখন আবার আসবে তখন ওকে জল দিও।’
‘আপনি আগে জল খান তারপর ওকে জল দেব।’
‘না, না, আমার এখন তেষ্টা পায় নি। বেচারা ভিনগ্রহবাসীটি যেন জল পায়।’
‘আপনি জল না খাওয়া পর্যন্ত আমি ওকে জল দিতে পারব না। আপনাকে আগেই বলেছিলাম যে আপনি ডি-হাইড্রেসানে ভুগছেন। এখন আপনার অবস্থা আরো খারাপ বলেই আমার মনে হচ্ছে। আপনি এক্ষুনি জল খান, তা না হলে আপনার অবস্থা ভীষণ খারাপ হয়ে পড়বে।’
‘ঠিক আছে। বকবক না করে তাহলে তাঁবু থেকে আমার জল এনে দাও।’
‘কিন্তু, ক্যাপ্টেন—’
‘আবার কি হল?’
‘আপনি তো জানেন। আমার বর্তমান কাজ থেকে ছুটি না দেওয়া পর্যন্ত আমি অন্য কোন কাজ করতে পারব না।’
‘কেন পারবে না?’
‘তার কারণ আমাকে সেই রকমই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তার উপর একজন ভিনগ্রহবাসী বন্দী ওই পাথরটার আড়ালে প্রার্থনা করছে।’
‘আমি তোমার হয়ে লোকটার দিকে নজর রাখছি। যাও এবার লক্ষ্মী ছেলের মতো তাঁবু থেকে জল নিয়ে এসো দিকিনি।’
‘আপনি আপনার মহত্বের পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু ক্যাপ্টেন আমার কাজ আমি আপনাকে করতে দিতে পারি না। আমি একজন পি-আর রোবট। তাঁবু পাহারা দেওয়ার জন্য বিশেষ ভাবে আমাকে তৈরি করা হয়েছে। আমার নিজের কাজের ভার অন্য ঘাড়ে চাপাবার আমার কোন অধিকার নেই। ‘পাস-ওয়ার্ড’টা না শোনা অবধি আমি আমার কাজ আর কোন পি-আর রোবটকেও দিতে পারি না, এ কথা
তো আপনি ভাল করেই জানেন ক্যাপ্টেন।’
‘ঠিকই বলেছো।’ বিড়বিড় করে বলে উঠলেন জয়ন্ত, ‘যাই করি না কেন, ফল সেই শূন্য। তিনি ক্লান্ত পদক্ষেপে আবার পাথরটার দিকে এগুতে লাগলেন।’
‘কি হল? আমি কি অন্যায় কিছু বলেছি?’
জয়ন্ত কোন জবাব দিলেন না।
‘ক্যাপ্টেন বোস?’
তবু কোন জবাব এল না। পি-আর রোবট আবার তাঁবুর চৌহদ্দি পাহারা দিতে লাগল।
জয়ন্ত খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলেন। একটা হতভাগা রোবটের সঙ্গে বকবক করতে করতে গলাবুক কাঠ হয়ে এসেছে। জ্বলন্ত সূর্যের উত্তাপ সারা দেহটা ঝলসে দিচ্ছে। যন্ত্রণা, তেষ্টা এবং ক্লান্তি তাকে শেষ করে আনছে। একমাত্র রাগ ছাড়া আর কোন আবেগের স্থান নেই এখন ওঁর মনে।
নিজেকেই দোষ দিলেন। এমন বোকার মতো একটা কাজ করে ফেলেছেন যার জন্যে এখন পস্তাতে হবে। এখন একমাত্র মৃত্যুই সব জ্বালা যন্ত্রণার শেষ ঘটাবে। পঞ্চাশ গজ দূরে তাঁবু। সেই তাঁবুতে পৌঁছোনোর কোন রাস্তাই বোধহয় আর খোলা নেই। কিন্তু না, ভেঙে পড়লে চলবে না। যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ। আর একবার শেশ চেষ্টা করতে হবে। তিনি রোবটটাকে বিশ্বাস করাতে পেরেছেন যে তিনিই ক্যাপ্টেন জয়ন্ত বোস। তিনি ওকে এ কথাও বিশ্বাস করিয়েছেন যে তিনিই একজন ভিনগ্রহবাসী-ক্যাপ্টেন বোসের বন্দী। কিন্তু কোনভাবেই আসল কাজে সফল হল নি।
আর কি করা যেতে পারে? জ্বলন্ত ধূসর আকাশের দিকে তাকালেন জয়ন্ত। কয়েকটা ঘূর্ণায়মান কালো বিন্দু ওঁর নজরে পড়ল। ওগুলো কি শকুন? এই ‘রীগালাস-পাঁচে’ কি শকুন আছে? ওরা কি নতুন খাবারের লোভে আনন্দে ওই জ্বলন্ত আকাশে পাক খাচ্ছে? নতুন এবং সুস্বাদু খাবার—খুব শীঘ্রই ওদের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হবে।
.
জয়ন্ত জোর করে উঠে দাঁড়ালেন। না, না আমাকে আর একবার শেষ চেষ্টা করতেই হবে। পাস-ওয়ার্ড জানলে সে পৃথিবীর মানুষ আর যে জানে না সে হচ্ছে ভিনগ্রহবাসী—এই হচ্ছে প্রবীরের ধারণা।
তার মানে—। মানে কি? হঠাৎ জয়ন্তর মনে হল তিনি যেন ধাঁধার উত্তর খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু ওঁর মাথা ঝিমঝিম করছে। গভীরভাবে কোন জিনিস চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। শকুনগুলো পাক খেতে খেতে অনেক নিচে নেমে এসেছে। সেই ছাগলের মতো একটা জন্তু কোথা থেকে ছুটে এসে ওঁর পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে হাঁফাচ্ছে। না, না, অন্য কোনদিকে মন দিলে চলবে না। এখন গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। বাঁচবার পথ একটা আবিষ্কার করতেই হবে।
প্রবীর আসলে বোকা। জোচ্চুরী ধরার মতো বুদ্ধি ওকে দেওয়া হয় নি। কে যেন বলেছিলেন মানুষ হচ্ছে পালকহীন দু’পেয়ে জন্তু। কে বলেছিলেন? নাঃ, কিছুতেই মনে পড়ছে না। কিন্তু এসব কথাই বা ভাবছেন কেন জয়ন্ত? তবে কি উনি পাগল হয়ে গেলেন?
প্রবীর—পি-আর রোবট—একটা উল্লুক। তাঁকেই একবার ক্যাপ্টেন বোস ভাবছে আর একবার ভিনগ্রহবাসী ভাবছে। কোথায় কিছু একটা গণ্ডগোল আছে। কি? কি সেই গণ্ডগোল? ছাগলের মতো জন্তুটা ওঁর জুতো শুকছে। জয়ন্ত এবার বুঝতে পারলেন তিনি কি করতে পারেন।
.
ক্যাপ্টেন মুখার্জী ও লেফটেন্যান্ট দত্ত বাহাত্তর ঘণ্টা বাদে তাঁবুতে ফিরে এসে দেখলেন ক্যাপ্টেন বোস প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। মাঝে মাঝে ভুল বকছেন। ডি-হাইড্রেসান ও সানস্ট্রোকে ওঁর এই দশা হয়েছে তা বুঝতে ওঁদের কোন অসুবিধে হল না।
প্রবীর ওঁকে জল খাইয়ে ভিজে কম্বল চাপা দিয়ে ছায়ায় শুইয়ে দিয়েছিল। দু-এক দিনের মধ্যে ক্যাপ্টেন বোস সুস্থ হয়ে উঠবেন বলে মনে হয়।
তাঁবুতে ঢুকে অজ্ঞান হয়ে পড়ার আগে জয়ন্ত একটা ছোট কাগজে একটা নোট লিখে রেখেছিলেন। ক্যাপ্টেন মুখার্জী নোটটা পড়ে একবর্ণও বুঝতে পারলেন না। উনি প্রবীরকে প্রশ্ন করতে লাগলেন। তখন প্রবীর সব কথা ক্যাপ্টেন মুখার্জীকে জানালো। এমনকি ক্যাপ্টেন বোসের মতো দেখতে একজন ভিনগ্রহবাসী এই তাঁবুতে ঢোকার জন্য নানা ভাবে চেষ্টা করে চলেছে তা জানাতেও ভুলল না।
সব শুনে ক্যাপ্টেন মুখার্জী বুঝতে পারলেন এসবই ক্যাপ্টেন বোসের পাস-ওয়ার্ড ছাড়া তাঁবুতে ঢোকার চেষ্টা। যা হোক তিনি জানতে চাইলেন তারপর কি হল? কি করে ক্যাপ্টেন বোস তাঁবুতে ঢুকলেন?
‘উনি তাঁবুতে ঢোকেন নি। এক সময় আমি বুঝতে পারলাম উনি তার মধ্যে রয়েছেন… মানে…।’ ব্যাপারটা কি ঘটেছিল তা প্রবীর বোধ হয় ঠিক বুঝে উঠতে পারে নি তাই ব্যাখ্যা করতে পারছে না ঠিকমত। ‘কি করে তোমার চোখ এড়িয়ে উনি তাঁবুর ভিতরে এলেন—এ কথাটাই তো কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকছে না।’ বললেন ক্যাপ্টেন মুখার্জী।
‘না, না উনি আমার চোখ এড়িয়ে তাঁবুতে ঢোকেন নি ক্যাপ্টেন মুখার্জী। এটা
অসম্ভব ব্যাপার। উনি তাঁবুর মধ্যে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন।’
‘ব্যাপারটা আমার কাছে মোটেও বোধগম্য হচ্ছে না প্রবীর।’
‘সত্যি কথা বলতে কি ব্যাপারটা আমিও ভাল করে বুঝতে পারিনি।’ স্বীকার করল প্রবীর। একটু থেমে ও বলল, ‘আমার মনে হয় একমাত্র ক্যাপ্টেন বোসই এ রহস্যের সমাধান করতে পারেন।’
ক্যাপ্টেন বোস সুস্থ হয়ে না ওঠা পর্যন্ত কিছুই জানা যাবে না তাহলে? ভাবলেন মুখার্জী। বোস যদি একটা সমাধান বের করে তাঁবুতে ঢুকতে পেরে থাকেন, তাহলে চেষ্টা করলে উনিও সে সূত্রটা নিশ্চয় আবিষ্কার করতে পারবেন, ভাবলেন মুখার্জী।
মুখার্জী ও লেফটেন্যান্ট দত্ত যত রকমে সম্ভব সমস্যাটার সমাধানের চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না।
ধাঁধার উত্তর বার করা আর নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে কোন সমস্যার সমাধানের চেষ্টা কখনই এক হতে পারেনা। তাই বোস যা পেরেছিলেন মুখার্জী ও লেফটেন্যান্ট দত্ত তা পারলেন না।
যা হোক কি করে বোস তাঁবুতে ঢুকেছিলেন তা জানতে হলে শেষ দৃশ্যটা প্রবীরের দৃষ্টি দিয়ে দেখতে হবে।
জ্বলন্ত সূর্যের তাপ, ঝোড়ো গরম বালির ঝাপটা, শকুন, ছাগল এসব কোনদিকে নজর দিলে আমার চলবে না। এই তাঁবুর চৌহদ্দি আমাকে পাহারা দিতে হবে। কোন ভিনগ্রহবাসী শত্রু যেন তাঁবুতে ঢুকে সবকিছু নষ্ট করে দিয়ে পালিয়ে যেতে না পারে।
মনে হচ্ছে কী যেন একটা আমার দিকে এগিয়ে আসছে। মরুভূমি পেরিয়ে, পাথরের চাঁইটা পেরিয়ে ওটা কি আসছে এদিকে? বেশ একটা বড় জন্তু বলেই তো মনে হচ্ছে। মুখের উপর ঝুলে পড়েছে মাথার লোম। চারপায়ে হাঁটছে ওটা। আমি জন্তুটাকে থামাবার চেষ্টা করলাম। সে গরগর করে আওয়াজ করল। আমি চেঁচিয়ে বললাম, ‘তাঁবুর চৌহদ্দি থেকে তফাৎ যাও।’ আমি আমার অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হলাম। আমি তাকে ভয় দেখালাম। জন্তুটা গলা দিয়ে গরগর আওয়াজ করতে করতে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। আমি ভাবতে লাগলাম মানুষ ও ভিনগ্রহবাসীরা বুদ্ধিমান। তার প্রমাণ ওরা কথা বলতে পারে ও কথা বুঝতে পারে। জন্তুটা মানুষ বা ভিনগ্রহবাসী হতে পারে না। হলে নিশ্চয় আমার কথার জবাব দিত। মানুষ হলে সঠিক পাস-ওয়ার্ড বলত। মানুষ বা ভিনগ্রহবাসী হলে আমার কথার জবাব দিত। তা ঠিকই হোক আর ভুলই হোক।
তাই যদি হয় তাহলে যে জন্তু আমার কথার উত্তর দেবে না, সে উত্তর দিতে
পারে না—অর্থাৎ কথা বলতে পারে না, অর্থাৎ বুদ্ধিমান কোন জীব নয়। আর সাধারণ জন্তু জানোয়ার নিয়ে আমার মাথা ঘামাবার কোন প্রয়োজন নেই। পাখি বা সরীসৃপ জাতীয় জন্তু আমি উপেক্ষা করতে পারি। এই চারপেয়ে সাধারণ জীবটাকেও আমি স্বচ্ছন্দে উপেক্ষা করতে পারি। সুতরাং আমি আর জন্তুটার দিকে নজর দিলাম না। আমি খুব সতর্ক হয়ে পাহারা দিতে লাগলাম, কারণ জয়ন্ত বোস মরুভূমির মধ্যে কোথাও ঘুরছেন আর একজন ভিনগ্রহবাসী শত্রু ওই পাথরটার আড়ালে নির্জনে প্রার্থনা করছে।
কিন্তু একি ব্যাপার! এখন দেখছি বোস তাঁবুর ভিতরে—ডিহাইড্রেসান আর সানস্ট্রোকে প্রায় মর-মর অবস্থা ওঁর। আর সেই ছাগলের মতো জন্তুটা, যেটা আমার সামনে দিয়ে তাঁবুতে ঢুকেছিল তার চিহ্ন পর্যন্ত নেই কোথাও। আর সেই ভিনগ্রহবাসী শত্রুটা নিশ্চয় এখনো ওই পাথরটার আড়ালে প্রার্থনা করে চলেছে…।
.
প্রথম প্রকাশ: ফ্যানট্যাসটিক, সেপ্টেম্বর, ১৯৭৯
বিদেশী ছায়ায়!