এস্ এফ • সত্যজিৎ রায়
এই আদ্যক্ষর দুটো লোকের কাছে যতটা পরিচিত হোক বলে ভাবা যায়, ততটা পরিচিত হয়নি। কিন্তু যিনি আসল বিষয়টির সঙ্গে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট তাঁর কানে এই ‘এস’ ধ্বনির শনন আর এই ‘এফ্’ ধ্বনির হুতাশ বাজবে রকেটের শনশনানি তার ঝাপটার মতো, যে-রকেট তাঁকে নিয়ে যায় মানুষের কল্পনার দূরতম প্রান্তরে, সীমার বাইরে নিঃসীমতার অন্ধকারে ছায়াপথ পেরিয়ে, সৌরমণ্ডল ছাড়িয়ে, যার কথা এখনো উপলব্ধির মধ্যে স্থান পায়নি, এখনো যার নামকরণ হয়নি, সেইখানে।
বিজ্ঞানসুবাসিত গল্প বা সায়াস-ফিকশ্যনের পরিমাপ পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে কিংসলী অ্যামিস্ তাঁর ‘নিউ ম্যাপ্স্ অব্ হেল্’ বইতে লিখেছেন, এই ধরনের সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক চাপে যৌবনাগম বয়সেই, নয়তো আর কখনোই সে-ঝোঁক আসে না। আমার মনে হয়, তিনি ঠিকই বলেছেন; কারণ, আমি এখনো কোনো বয়স্ক সায়ান্স-ফিকশ্যন ভক্তের সংস্পর্শে আসিনি যিনি বলেননি যে, তিনি ‘অনেকদিন থেকেই এইসব পড়ে আসছেন।’
আমার জীবনে বছর দশেক বয়স নাগাদ এই ঝোঁক চেপেছিল, তখন আমার ঠাকুরদা কুলদারঞ্জন রায়ের অনুবাদ করা জুল ভর্নের ‘মিসটিরিয়াস আইল্যাণ্ড’ বেরিয়েছে দু’খণ্ড হলদে মলাটের বই হয়ে। আমি একেবারে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, এখনও হই, ভর্নের গল্পের মধ্যে প্রাণমাতানো নিখুঁত বর্ণনার অঢেল প্রাচুর্যের মধ্যে দিয়ে পাঠককে আকর্ষণ করে স্তম্ভিত করে রাখার ক্ষমতা দেখে। এক্ষেত্রে ভর্ন অবশ্যই অগ্রণী, তবে ঠিক সেই ধরনের অগ্রণী নন যাঁরা কোনো নতুন ক্ষেত্রে নতুন কিছু করার মুখপাতটুকু সেরেই ক্ষান্ত হন, বাকী অভিযানটুকু চালিয়ে যাবার ভার দিয়ে যান উত্তরসূরীদের। ভর্ন ছিলেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কল্পনাশক্তিপুষ্ট বিস্ময়কর প্রতিভাধর মানুষ। এর ওপরেও তাঁর একটা গুণ ছিল—তিনি খেটে লিখতেন, খুঁটিয়ে ভেবে লিখতেন। তাঁর প্রথম কল্পনারঙীন ফ্যানটাসি কাহিনী ‘ফাইভ উইক্স্ ইন এ বেলুন’ লিখেছিলেন ৩৫ বছর বয়সে। তখন থেকেই তিনি ঐ ধরনের উপন্যাস প্রতি বছর দু-একটা করে লিখে গেছেন প্রায় বছর তিরিশ ধরে। এই ক’বছর ধরেই তিনি উল্লেখযোগ্য এবং মূল্যবান অনেক লেখার মাঝে মাঝে হেলাফেলায় লেখা গল্পও পরিবেশন করেছেন, কিন্তু কক্ষণো একই ধরনের বিষয়বস্তু পুনরাবৃত্তি করে গল্প লেখেননি।
ভর্ন গোড়া থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন, এই নতুন ধরনের সাহিত্য রচনায় অনেক সময় বেকায়দায় পড়তে হয়। যেমন ধরুন, ফ্যানটাসী গল্পকে আপনি একেবারে উড়িয়ে নিয়ে, রূপকথার মতো, সবপেয়েছির দেশে নামাতে পারেন না। এর মধ্যে বাস্তবতার বাঁধন রাখতে হবে, আর পাঠকরা যাতে দূরদর্শনের অকূল পাথারে দিশেহারা হয়ে না মরে, সেদিকে সযত্ন দৃষ্টি রাখতে হবে। এইজন্যেই ভর্ন যেসব কায়দায় গল্প ফাঁদতেন, সেগুলোর মধ্যে একটি হল, তিনি কোনো ঐতিহাসিক ঘটনাকে সুকৌশলে নতুন ধাঁচে সাজিয়ে গল্পের চরিত্রগুলিকে তারই মধ্যে বসাতেন এবং সেই সাজানো কাহিনীটিকে চমৎকারভাবে কল্পনারঙীন ফ্যানটাসী গল্পের প্যাটার্নে বুনে দিতেন। ঠিক এই কৌশলেই আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পটভূমিকায় বেলুনে করে মুক্তির সন্ধানে পাড়ি দিতে গিয়ে একদল লোক আশ্চর্য দ্বীপে (মিসটিরিয়াস আইল্যাণ্ডে) নেমে পড়েছিলেন। ভারতবর্ষকে নিয়ে ভর্নের ফ্যানটাসী গল্পকল্প ‘টাইগার্স অ্যাণ্ড ট্রেট্যর্স’-এ বহু অংশে সিপাহী বিদ্রোহ এবং নানাসাহেবের কথা জড়ানো। তাঁর লেখা ‘অ্যারাউণ্ড দি ওয়ার্লড ইন এইটি ডেজ’ বিজ্ঞান-ফ্যানটাসী না হয়েও, এর ভেতরের চমৎকার উঁচুদরের গল্পটি সারা পৃথিবীকে ঘিরে দানা বেঁধে উঠেছে আর প্রত্যেকটি দেশের প্রত্যেকটি ঘটনায় সেই দেশের নিখুঁত বর্ণনার ছোঁয়া লেগে রঙীন হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ভারতবর্ষের ঘটনাগুলি এদেশে সেই সময়কার নতুন রেলপথ চালু হওয়ার কথায় প্রাণবন্ত হয়ে রয়েছে।
ভর্ন এচ জি ওয়েলসের লেখা পড়েছিলেন এবং সে-লেখায় অসম্ভব কল্পনায় ভেসে বেড়ানোর প্রবণতাকে খুব বিদ্রূপ করেছিলেন। আজ ওয়েলসের লেখা পড়লে ভর্নের আপত্তির কারণ বোঝা যায়। ওয়েলস সায়ান্স-ফিকশনের দিকে এগিয়ে ছিলেন কাব্যময় রোম্যান্টিক ভাবধারণা নিয়ে এবং এই কবি সুলভ কল্পনা রঙীন মনোভাবের জন্যেই নিষ্প্রাণ নীরস তথ্যভাবের প্রতি তাঁর ছিল প্রচণ্ড বিরাগ। অদৃশ্য মানুষ কেমন করে অদৃশ্য হয়? আমরা তা জানি না; কেননা এই রহস্য যে তিনখানি চামড়া-বাঁধাই মোটা মোটা নোটবইতে লেখা আছে, সেগুলি স্টোই বন্দরের সেই ছোট্ট সরাইখানাটির মালিকের হাতে রয়ে গেছে, আর সে ভদ্রলোক নোটবইগুলো হাতছাড়াও করবেন না, তাতে কি লেখা আছে তাও কিছু বলবেন না। অদৃশ্য মানুষ, অর্থাৎ গ্রিফিন তাঁর ডাক্তার-বন্ধুকে সব ব্যাপারটা তাই এইভাবে বলছেনঃ
‘আমি তোমাকে সব কথা বলবো, কেম্প, আজ হোক কাল হোক সমস্ত জটিল ব্যাপারটা খুলেই বলবো। এখন সে সব কথা পেড়ে কাজ নেই… তবে আসল ব্যাপারটা হল, স্বচ্ছ জিনিসের প্রতিসরণাঙ্ক বা রিফ্র্যাকটিভ ইনডেক্স কমাতে হলে সেটিকে কোনো রকম ঈথার কম্পন বিকিরণকারী দুটি কেন্দ্রের মাঝখানে রাখতে হবে, এবিষয়ে তোমাকে পরে আমি আরো পরিষ্কার করে বলবো… দুটো ছোটো ডায়নামোর দরকার হল আমার, সে দুটোকে আমি সস্তা গ্যাস ইনজিনের সাহায্যে চালালাম। প্রথমে একটা পশমের পোশাক নিয়ে আমার এক্সপেরিমেন্ট হল…’
টাইম মেশিন
এর মধ্যে ওয়েলসের নিজস্ব দুটি কৌশল রয়েছেঃ এক হল বৈজ্ঞানিক কচকচির একটু খোঁচা, আর এমনভাবে বলা হবে যেন মনে হবে বৈজ্ঞানিক রহস্যটা খুব সোজা, অথচ সেটা কখনই সবটা খুলে বলা হবে না। ‘দি টাইম মেশিন’ গল্পটির কথাই ধরুন। এখানে তত বৈজ্ঞানিক বাগাড়ম্বর একেবারেই বাদ দিয়েছেন, শুধু একবার ফোর্থ ডাইমেনশনে ভ্রমণের সম্ভাবনা সম্পর্কে টাইম-ট্রাভেলার ভদ্রলোক সামান্য একটুখানি থিওরী আউড়েছে। মেশিনটার বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ
‘টাইম-ট্রাভেলার ভদ্রলোক যে জিনিসটা হাতে ধরে ছিলেন, সেটি ঝকঝকে ধাতুর তৈরি, ছোট্ট ঘড়ির চেয়ে খুব বড় নয়। জটিল তার গড়ন। হাতীর দাতের কাজ করা, একটা স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো…
‘টেবিলের ওপর কনুই ভর দিয়ে যন্ত্রটার ওপর দুহাত চেপে ধরে টাইম-ট্রাভেলার ভদ্রলোক বললেন, এই ছোট্ট কলটা শুধু একটা মডেল। আমি প্ল্যান করছি এরকম একটা মেশিন করবো যাতে চেপে সময়ের মধ্যে দিয়ে বেড়িয়ে আসা যাবে। আপনারা দেখছেন, এটা দেখতে বিশেষ রকমের উদ্ভট, আর ঐখানটা ঐ পাটাতনটার কাছে কেমন অদ্ভুত ঝিকমিক করছে, মনে হচ্ছে, ওটা যেন ঠিক সত্যিকারের নয়… আর, এই যে এখানে একটা সাদা চাবি রয়েছে, আর এইখানে আর একটা।’
একটা চাবি হল অতীতের জন্যে আর একটা ভবিষ্যতের জন্যে—এর চেয়ে সহজ আর কি হতে পারে? নিজে বিজ্ঞানসেবী হলেও, ওয়েল যখন বিজ্ঞানসুবাসিত গল্প লিখতে বসতেন তখন বিজ্ঞানের টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলোকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে সোজা গল্পের মধ্যে ডুব লাগাতেন। আসলে তিনি যে জিনিসটাতে মেতে উঠেছিলেন, সেটা আবিষ্কারের শতসহস্র বাধা অতিক্রমের নেশা নয়, সেটা ছিল আবিষ্কারের পরেই যে মজা, সেটিকে গল্পের মধ্যে দিয়ে উপভোগের নেশা। এর ফলে ওয়েলসের লেখায় যে মুক্তির হাওয়া ছিল, সব কিছু ঘটার সম্ভাবনা ছিল, ভর্নের তা কোনোদিনই ছিল না। ভর্ন তাঁর ‘ফ্রম দি আর্থ টু দি মুন’ উপন্যাসে যে মহাকাশযানে চেপে প্রথম চাঁদে পাড়ি দেওয়া হবে, তার বর্ণনা দিতেই সারা বইটার ২৮টি অধ্যায়ের মধ্যে ২৬টি অধ্যায় ভরিয়ে ফেলেছে। যদিও তিনি যেভাবে চাঁদে ভ্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন, তা আমাদের বর্তমান যুগে কাজে লাগবে না, তবু গল্পে বেশ বোঝা যায় যে, বিজ্ঞানের কারিগরী দিকটাই তাঁকে বেশি ভাবিয়েছিল। তিনি তাঁর সাহিত্যজীবনে বরাবর এই দিকটাতেই গুরুত্ব দিয়েছেন, এরই ভিত্তিতে ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছে, এবং নতুন আবিষ্কারের কথা বলেছেন—সে-সব আবিষ্কার মানুষকে নতুন চেতনার উন্মাদনা এনে দিয়েছে, নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন দুঃসাহসিকতার সম্মুখীন করেছে। তাঁর বিজ্ঞান ধারণাকে যদি আজকের দিনে অসার বলেও মনে হয়, তবু তাঁর পূর্বজ্ঞান ধারণাকে কিছুতেই তা বলা চলে না; কারণ তাই দিয়েই তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন আজকের দিনের বহু জিনিসের—বলতে পেরেছিলেন সাবমেরিন, হেলিকপ্টার, টেলিভিশন, সিনেমা, মহাশূন্য অভিযানের কথা।
আজ আমরা ভর্ন এবং ওয়েলস দুজনকেই বিজ্ঞসুবাসিত গল্প লেখকের পর্যায়ে মর্যাদার আসন দিয়েছি। এক্ষেত্রে অগ্রণী হওয়া ছাড়াও আজকের দিনে যে-দুটি মূল ধরনের সায়ান্স-ফিকশন প্রচলিত তার আদিস্রষ্টাও তাঁরা। মোটামুটিভাবে তাঁদের আমরা বলতে পারি বস্তুধর্মী আর কাব্যধর্মী। প্রথমজন বৈজ্ঞানিক তথ্য যা পাওয়া যায় তাই দিয়ে ভিত গড়ে তুলে তারপর তার ওপর ভর করে লাফিয়ে পড়েন গল্পের মাঝখানে, কিন্তু কখনই কল্পনাকে সম্ভাব্যতার বেড়া ডিঙিয়ে ছুটতে দেন না। দ্বিতীয়জন কল্পনার লাগাম অনেকটা আলগা করে দেন, তথ্যকে একেবারে উড়িয়ে দেন, না হয়, ঘুরিয়ে দেন, এবং চেষ্টা করেন, কাব্যের স্বর্গরাজ্যের মাটিতে বিশ্বাস গড়ে তুলতে। অবশ্য এমন অনেক গল্প আছে, যার মধ্যে দুটি ধাঁচ মিলেমিশে গেছে, এবং আধুনিক অনেক ভাল ভাল সায়ান্স-ফিকশ্যন লিখছেন আরথার ক্লার্ক ও আইজাক আসিমভের মতো বিজ্ঞানীরা—তাঁরা কল্পনার ভবিষ্যৎ জগতে চমৎকারভাবে উধাও হয়ে যাচ্ছেন, বৈজ্ঞানিক তথ্যের রাজ্যে এতটুকু দখল না হারিয়ে।
এ যুগের বিজ্ঞান-কারিগরীর দ্রুত বিকাশের পরিপ্রেক্ষিতে সায়ান্স-ফিকশ্যনও অবশ্য নবরূপ লাভের পথ ধরেছে। পুরানো মালমশলার বদলে নতুন কিছু আনা হচ্ছে, এবং ব্যবহারিক বিজ্ঞানের প্রত্যেকটি শাখায় নতুন নতুন আবিষ্কারের সম্পদে সমৃদ্ধ হচ্ছে এই সাহিত্য ক্ষেত্রটি। নবশক্তিসম্পন্ন লেজার রশ্মি, অঙ্কবিশারদ কমপিউটার যন্ত্র, অবিরাম পৃথিবী প্রদক্ষিণধারী কৃত্রিম উপগ্রহ, হুকুমে হাজির মনুষ্যাকৃতি অ্যানড্রয়েড রোবট, প্রাণস্পন্দনের ইচ্ছামত বিরাম ও নবজাগরণের বিস্ময়কর কৌশলগুলো সমসাময়িক বিজ্ঞানসুবাসিত গল্পসাহিত্যের উপাদানরূপে বেশ চালু হয়ে গেছে। কল্পনার ক্ষেত্র থেকে চাঁদ আজ প্রায় বহিষ্কৃত। অদৃশ্য হওয়া এবং সময়ের রাজ্যের প্রমাণ করা বৈজ্ঞানিক দিক থেকে অসম্ভব একথা প্রমাণ হয়ে গেছে, তাই গল্পের উপাদান হিসেবে ওগুলো মর্যাদা হারিয়েছে। রোবটের কথা আজ চলছে, তবে বদ-মতলবী রোবটদের গল্পে সবাই কপাল কোঁচকায়, কারণ শত্রুতা করা এমন একটা মানসিক বৈশিষ্ট্য যা রোবটের মতো মেশিনের পক্ষে সম্ভব নয় বলেই সবাই ভাবে। যষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের চেতনা, অলৌকিক এক্সট্রা-সেনসরি পিরশ্যেপসন ইত্যাদির কথা ধীরে ধীরে বেশ জায়গা করে নিচ্ছে, এ নিয়ে অনেক গবেষণালব্ধ তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে, আর গল্পের মধ্যে বহির্জগতের সে সব প্রাণীরা অবতীর্ণ হচ্ছে, তাদের সম্মাহোনশক্তি এবং টেলিপ্যাথীর ক্ষমতায় প্রচুর শক্তিমানও দেখা যাচ্ছে।
কবিদের পক্ষে, মনে হয়, সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হল ভূমণ্ডল বহির্ভূত অনন্ত জগৎ, যার সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান নীহারিকা-ধোঁয়ার মতো অস্পষ্ট রহস্যময় বলেই তার ওপর কবির কল্পনা খোলে ভালো। আমাদের সবচেয়ে কাছের মঙ্গল গ্রহটি পর্যন্ত আজও মেঘে ঢাকা, সত্যিই মেঘ তাকে ঘিরে থাকে, রহস্য তার আজও অজানা। কিন্তু, তাহলেও এস্ এফ লেখক কেবল আমাদেরই সৌরমণ্ডলের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখেন খুব কম। এস্ এফের ক্ষেত্র আজ সত্যি সত্যিই সীমাহীন সুবিস্তৃত।
কিন্তু পরিচিত ভূমণ্ডলের মাটিতে মানুষের প্রচেষ্টা নিয়ে যে কোনো গল্প সাজাতে গেলে তার পেছন বৈজ্ঞানিক তথ্যের সমর্থন থাকা চাই। মহাশূন্যে রকেট উধাও হয়ে যেতে পারে, কিন্তু যদি সে রকেট পৃথিবী থেকে যাত্রা করে, আর যদি তাতে মানুষ থাকে, তাহলে কাহিনীর ঘটনাগুলিকে তথ্যসমর্থিত বৈজ্ঞানিক ধাঁচে পরিবেশন করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
তবে এটা খুব একটা বাধা হওয়ার কথা নয়। একদিক থেকে বলতে গেলে, দুর্ঘটনার কথা বাদ দিলেও মেশিনের নীরস নিষ্প্রাণ ভবিষ্যৎ-ঘোষণা ক্ষমতার সামনেও মানুষের আচরণের অজানা অনেক তুচ্ছ অভিপ্রকাশ সব সময়েই ঘটে যাচ্ছে। আবার আর এক দিক থেকে দেখা যাচ্ছে, সাধারণ পাঠক সম্প্রদায়ের একটা বিপুল অংশ বৈজ্ঞানিক কারিগরীর মধ্যে আজও রঙীন কল্পনা ফ্যানটাসীর যথেষ্ট খোরাক পেয়ে যাচ্ছেন। কোনো ভদ্রলোক যতদিন না নিজে ভারহীনতার অভিজ্ঞতা পাচ্ছেন, কিংবা রকেটে চেপে প্রচণ্ড গতিতে শূন্যে ওঠবার প্রত্যক্ষ অনুভূতির সুযোগ না পাচ্ছেন, কিংবা একটা প্রকাণ্ড অঙ্কবিশারদ কমপিউটার যন্ত্রের অপরিসীম সূক্ষ্ম জটিল বিপুল কলকব্জার অন্তত একটি ক্ষুদ্র অংশের মধ্যেও চোখ চালিয়ে সেখানে কি হচ্ছে তা দেখবার সৌভাগ্য লাভ না করছেন, ততদিন তাঁর কাছে এই সব জিনিসের শুধুমাত্র ধারণাটুকুই বিরাট বিস্ময়ের উপাদান হয়ে
থাকবেই।
আশ্চর্য অবাক বিস্মিত হয়ে যাওয়ার এই অনুভূতির ওপরেই সায়ান্স-ফিকশ্যন জমে ওঠে এবং আরও জমতে থাকবে যতই মানুষ তার সামনে ক্রমশ প্রসারমান বিপুলতর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের তুলনায় নিজেকে ক্ষুদ্র মনে করার উপযোগী গল্পকাহিনীর মধ্যে অবগাহন করতে চাইবে এবং যতই অন্ধকার রহস্যের জগতে—মহাশূন্যে, ভূমণ্ডলে, অন্য কোনো বৈরী গ্রহে কিংবা নিজেরই মনে বা দেহের মধ্যে মানুষের অভিযানের বিজয়গর্বে এবং ব্যর্থতার হীনতায় অংশ নিতে চাইবে।
.
প্রথম প্রকাশ: আশ্চর্য!, জানুয়ারী, ১৯৬৭
ইংরেজী সাপ্তাহিক ‘নাউ’ থেকে অসীম বর্ধন অনুদিত