মন্দাবতীর জঙ্গলে • ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য
দেশ ভ্রমণের বাতিক আমার কবে থেকে শুরু হয়েছিল তা এখন বলা কঠিন, তবে এটুকু বলতে পারি ভারতবর্ষের এমন অনেক জায়গায় আমার যাবার সুযোগ হয়েছে যা সাধারণ ট্যুরিস্টদের হয় না। এর কারণ, বেড়াতে গেলে কোথায় উঠব, কোথায় খাব, ঘুরবার জন্য গাড়ি জুটবে কিনা, দরকারের সময় গাইড মিলবে কিনা এ সব নিয়ে আমি কখনও মাথা ঘামাই নি। বিলাসবহুল বড় বড় শহর বা ঐতিহাসিক জায়গার চাইতে লোকচক্ষুর আড়ালে প্রকৃতির বুকে যে সব আশ্চর্য সৌন্দর্য এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তার প্রতিই আমার আকর্ষণটা বেশি। এজন্য এমন অনেক অজ-পাড়াগাঁয়ে অজানা-অচেনা বনজঙ্গলে আমি ঘুরে বেড়িয়েছি যার নামও কেউ কখনও শোনেনি। আসল কথা, ছুটি পেলেই আমি লোটাকম্বল নিয়ে বেরিয়ে পড়ি; সব সময় যে কোন নির্দিষ্ট গন্তব্য স্থান ঠিক করা থাকে তাও নয়। কিন্তু তাতে আমার ভ্রমণে কোন অসুবিধা হয় না।
এবার কিন্তু একটা নির্দিষ্ট জায়গায় যাব বলেই বেরিয়েছিলাম। আর, ঠিক একা রওনা হইনি, আমার সঙ্গী ছিল আমার বাল্য বন্ধু কপিল। কপিলই একদিন খবর দিল তার কোন্ এক পিসতুত দাদা মধ্যপ্রদেশের কোন্ এক জঙ্গলে ফরেস্ট অফিসার হয়ে চলে গেছেন। ভদ্রলোক বিয়ে টিয়ে করেন নি, একা একাই থাকেন। মাঝে মাঝে এই নিঃসঙ্গ জীবন যখন ভালো লাগে না তখন আত্মীয়স্বজনদের কাউকে দিন কয়েক তাঁর ওখানে কাটিয়ে যাবার জন্য অনুরোধ জানান। কিন্তু ঐ বন্য পরিবেশের কথা শুনে কেউ বড় একটা যেতে চায় না। কপিলকেও লিখেছিলেন। সেও একা একা যাবার ভরসা পাচ্ছিল না। হঠাৎ আমার কথা মনে পড়ায় আমার কাছে এসে প্রস্তাব করেছিল, আমি গেলে সেও একবার যেতে পারে।
আমার কাছে বলা বাহুল্য, এ এক অভাবিত প্রস্তাব। কাজেই আমি যে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যাব এ কথাও বোধ হয় বলার দরকার করে না। কপিলকে বললাম, ‘আজই লিখে দে, আমরা যাচ্ছি। মালপত্র সঙ্গে বেশি নেবার দরকার নেই। যত হাল্কা হয় ঘোরার পক্ষে ততই ভালো। পিঠে একটা বড় দেখে ন্যাপ্সাক, তার মধ্যেই বাতাসপোরা বিছানা-বালিস আর ২-৪টে জামা কাপড় ভরে নিলেই চলবে। আর হাতে একটা অ্যাটাচি কেসে এটা ওটা দরকারী খুঁটিনাটি জিনিস।
ব্যাস এই যথেষ্ট।’
যথা সময়ে আমরা দু’বন্ধু মন্দাবতীর জঙ্গলে এসে হাজির হলাম। যেমনটা ভেবেছিলাম তার চাইতে এটি অনেক দুর্গম জায়গা। দণ্ডকারণ্য পার হয়ে আরও বহুদূরে গভীর জঙ্গলের মধ্যে এক ফরেস্ট বাংলোয় ডেরা বেঁধেছেন কপিলের দাদা ভগীরথবাবু। কপিল অবশ্য তাঁকে রাঙাদা বলে ডাকে, আমিও সেই সুবাদে তাকে রাঙাদা বলেই বলব। রাঙাদা অবশ্য আমাদের জন্য একটা ট্রাক পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু সেই ট্রাকে করে শতাধিক কিলোমিটার পথ পার হয়ে গায়ে দস্তুর মতো ব্যথা ধরে গেল। আমার তবু অভ্যাস আছে, কপিল একেবারে যেন নেতিয়ে পড়ল। কিন্তু বাংলোয় পৌঁছে দু’জনেই চমকে উঠলাম।
ভারতের বহু জায়গা ঘুরেছি আমি, প্রকৃতির সমারোহও কম দেখি নি। কিন্তু এ যেন একটা আলাদা জগৎ। পাশ দিয়ে কুলু কুলু করে বয়ে চলেছে একটা নদী। এরই নাম মন্দাবতী, আর এরই নাম থেকে এখানকার অরণ্যের নাম হয়েছে মন্দাবতীর জঙ্গল বা অরণ্য। নদীতে জল বেশি নেই, কিন্তু স্রোত প্রবল। জলের মধ্যে এখানে ওখানে ছড়িয়ে রয়েছে বড় বড় পাথরের চাঁই। নদীর জল তার ওপর আছড়ে পড়ে কোথাও ছড়িয়ে পড়ছে ফোয়ারার মতো আবার কোথাও বা সৃষ্টি করছে ছোট ছোট জলপ্রপাত। নদীর ওপারেই গহন অরণ্য। বিরাট বিরাট বনস্পতি ঘেঁষা ঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে জায়গাটাকে প্রায় দুর্ভেদ্য করে রেখেছে।
রাঙাদা বললেন, ‘আগে একটু জলটল খেয়ে জিরিয়ে নাও, তারপর বরঞ্চ একটু বেড়িয়ে আসা যাবে। সঙ্গে থাপাকে নেব, ও বন্দুক নিয়ে সঙ্গে-সঙ্গে যাবে। জাতে নেপালী তো। একসময়ে লড়াইতেও গিয়েছিল। বন্দুক চালাতেও খুব ওস্তাদ। তবে এখানে ও জিনিসটার বড় একটা দরকার হয় না।’
‘কি রকম?’আমি প্রশ্ন না করে পারলাম না।
রাঙাদা বললেন, ‘প্রায় ৮/৯ মাস তো এখানে আছি। কোনদিন কোনও হিংস্র জন্তু চোখে পড়ে নি। কি কারণে ওরা এ জঙ্গল ত্যাগ করেছে ভেবে পাই না। একটু সামনেই দেখবে একটা জায়গায় কেমন খাদের মতো একটা গর্ত হয়েছে, যেখানে নদীর জল এসে জমে থাকে, চট্ করে বেরিয়ে যায় না। এখানকার যত বুনো জানোয়ার, সন্ধ্যা হলেই তারা একে একে ওখানে আসে জল খেতে। নানা জাতের হরিণ, বনগরু, শেয়ালটেয়াল তো আসেই, বানরও কম আসে না। ও জায়গাটায় বানরের খুব আনোগোনা দেখেছি। ছোট-বড় নানা জাতের বাঁদর যাদের সবগুলোর নাম আমি জানি না। কিন্তু রোজই ওরা আসে। হাতিটাতি দূরের কথা, বাঘটাগ কিংবা ভালুকটালুক থাকলে নিশ্চয়ই তাদেরও দু’একটার দেখা পাওয়া যেত, আর অন্য জানোয়ারগুলোও সতর্ক হত, কিন্তু সে রকম এখনও দেখিনি। তাই মনে হয় তেমন হিংস্র জন্তু এখানে নেই বললেই চলে। একবার শুধু একটা বুনোশুয়োর দেখেছিলাম। কিন্তু দলে ভারি থাকায় অন্য জানোয়ারগুলো তাকে তেমন তোয়াক্কা করেনি।’
রাঙাদার কথায় ভরসা পেয়ে সেদিনই আমরা তাঁর সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়েছিলুম। অবশ্য থাপা বন্দুক নিয়ে সঙ্গে-সঙ্গে ছিল। যতই নিরাপদ মনে হোক, জঙ্গল জঙ্গলই। কখন কোন্ দিক্ থেকে বিপদ এসে পড়ে কে বলতে পারে?
কিন্তু দিন কয়েক বেড়িয়েই আমাদের ভয় একদম ভেঙ্গে গেল। শেষে আমি কপিলকে নিয়ে অনেক সময় নিজেরাই বেরিয়ে পড়তাম, রাঙাদা বা থাপার ভরসায় না থেকে। অত বড় আর এত গহন বন আমি এর আগে আর কখনও দেখিনি। তাই যাবার সময় ভালো করে নিশানা রেখে রেখে চলতে হত পথ হারাবার ভয়ে। রাঙাদা অবশ্য প্রায়ই সাবধান করে দিতেন।
অনেক নতুন নতুন গাছ। সেগুন গাছ খুব বেশি। শাল, পিয়াল, শিশু এসব গাছও কম নয়। তা ছাড়া বিরাট বিরাট ঝুরি নামানো বট, অশ্বথ, পাকুড় কী নেই? বুনো আম, বুনো জাম, আরও কত নাম-না জানা বুনো দলের গাছও চোখে পড়ত। শুধু তাইই নয়। নানা রকম জীবজন্তু-ও যখন তখন সামনে দিয়ে দৌড়ে চলে যেত। বিশেষ করে হরিণ আর বানর।
রাঙাদার কাছে একদিন শুনলাম এহেন গভীর জঙ্গলে এখনও কিছু কিছু জংলী মানুষও নাকি বাস করে। তারা লোকালয়ে বড় একটা আসতে চায় না। দু’একজন নৃতত্ত্ববিদ্ ওদের সম্বন্ধে খোঁজ নেবার চেষ্টা করেন নি এমন নয়। কিন্তু খুব যে বেশি তথ্য যোগাড় করতে পেরেছেন এমন মনে হয় না। তবে এটুকু জানা গেছে যে জংলী হলেও এরা খুব নিরীহ জাতের মানুষ, কিছুটা ভীতুও বলা চলে। চাষবাসেরও ধার ধারে না। বুনো ফলমূল, কন্দ জাতীয় খাবার এখানে অঢেল পাওয়া যায়। তাই খেয়েই এদের দিন চলে। তবে সুযোগ পেলে পাখিটাখি বা হরিণটরিণও যে ধরে খেতে ছাড়ে না এমন নয়।
সেদিন কপিলকে নিয়ে বেরিয়েছিলাম, আর বলতে কি বনের মধ্যে একটু বেশি দূরেই ঢুকেপড়েছিলাম। হঠাৎ মনে হল গাছের এক ডাল থেকে আর এক ডালে একটা অদ্ভুত জন্তু চলে গেল। জন্তুটার মুখ দেখে মানুষ বলেই প্রথমটা মনে হয়েছিল, কিন্তু একটু পরেই দেখলাম পেছনে লম্বা লেজ রয়েছে আর পা দিয়ে গাছের ডাল যে ভাবে আঁকড়ে ধরে চলে গেল তাতে বাঁদর জাতীয় জীব ছাড়া আর কিছু ভাবা যায় না ওকে।
কী হতে পারে জন্তুটা? এর নামও তো কোন দিন শুনি নি!
বাংলোয় ফিরে এসে রাঙাদাকে খবরটা দিতেই তিনি তো হতবাক্। ‘বলিস
কি রে, এতদিন এখানে আছি, ও রকম কোন জন্তু তো কোন দিন দেখি নি। বলছিস বাঁদরের মতো পা, বাঁদরের মতো লেজ, কিন্তু মুখটা ঠিক মানুষের মতো। এ যে তাজ্জব ব্যাপার। মিসিং লিঙ্ক নাকি?’
এরপর আমাদের ঝোঁক চাপল যে করে হোক জন্তুটাকে খুঁজে বার করতে হবে। জঙ্গলের ভিতর অনেকটা ঢুকতে হবে ঠিকই, কিন্তু আমি তো আগেই বলেছি, যখনই জঙ্গলের মধ্যে ঢুকি উপযুক্ত নিশানা রেখে যাই যাতে পথ হারাবার ভয় না থাকে। কাজেই ঐ ভাবেই আবার সেই জঙ্গলের গভীরে গিয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করলাম।
কিন্তু না, গোটা কয়েক বনমোরগ আর হরিণ ছাড়া কিচ্ছু চোখে পড়ল না। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা। একবার যখন চোখে পড়েছে তখন আর একবার তাকে খুঁজে বার করতেই হবে। আমার চোখে দৃষ্টিবিভ্রম হলেও কপিলের চোখেও কি তাই হবে? কাজেই যা দেখেছি নিশ্চয়ই ভুল দেখিনি।
পরদিন আবার বেরুলাম। কিন্তু সেদিনও হতাশ হয়ে ফিরতে হল।
এইভাবে পর পর দিন চারেক কাটাবার পর কপিল যখন হতাশ হয়ে অনুসন্ধান বন্ধ করবার প্রস্তাব করল, তখন আমার রোখ আরও চেপে গেল। বললাম, ‘তুই যাস না যাস, আমি একাই যাব।’
রাঙাদাও সায় দিয়ে বললেন, ‘না না, সত্যি যখন ও রকম অদ্ভুত একটা জানোয়ার চোখে পড়েছে বলছ তখন ভালো করে খুঁজে দেখা দরকার বই কি! আজ আমার একটু কাজ আছে, কাল সবাই একসঙ্গে বেরুব। থাপাকেও নিয়ে যাব। একটু সাবধান হওয়া ভালো।’
গভীর জঙ্গল ভেদ করে চলেছি। আগে আগে বন্দুক হাতে থাপা, তার পেছনে আমি আর কপিল, রাঙাদা চলেছেন সবার পিছে। সকলেরই চোখে সতর্ক দৃষ্টি। দেখতে দেখতে জঙ্গল আরও ঘন হয়ে এল। এবার আর পথ করে যাওয়া সহজ নয়। রাঙাদার হাতে একটা মস্ত ভোজালির মতো অস্ত্র। দরকার মতো এগিয়ে এসে তিনি গাছের ডাল কেটে কেটে পথ পরিষ্কার করে দিচ্ছেন। কিন্তু তবু যতই এগোচ্ছি ততই মনে হচ্ছে আর বোধ হয় এগোনো যাবে না। রাঙাদা এখানকার ফরেস্ট অফিসার, তাঁর অন্ততঃ তল্লাটের নাড়ী নক্ষত্র জানা উচিত ছিল। কিন্তু না, তিনিও জানতেন না যে বন এত দূর পর্যন্ত চলে এসেছে আর এত ঘন হয়ে। বনরক্ষীরা কখনও এদিককার কোন হদিস দেয়নি। তারাও হয়তো ভেবেছিল ওদিকে এমন আর কিছু নেই যা সরকারের দিক দিয়ে ভালো করে সার্ভে করা দরকার। রাঙাদার আগে তাঁর জায়গায় যিনি ছিলেন তিনি এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। এ সব দিকে নজর দেওয়ার চাইতে কোন জায়গায় মহুয়া গাছ আছে তার থেকে
ভালো মদ পাওয়া যেতে পারে সেই সব দিকেই নাকি তাঁর উৎসাহ ছিল বেশি।
‘এ সব জায়গায় হিংস্র প্রাণী থাকাও অসম্ভব নয়’ আমি মন্তব্য করলাম। রাঙাদা উত্তরে বললেন, ‘হ্যাঁ, সম্ভব তো সব কিছুই; তবে কথা হচ্ছে হিংস্র প্রাণীদেরও তো প্রয়োজনীয় খাদ্য থাকা দরকার। অর্থাৎ তাদের সঙ্গে কিছু দুর্বলতর প্রাণীও না থাকলে বেচারারা তো না খেয়েই মারা যাবে।’
রাঙাদার কথা শেষ হতে না হতে হঠাৎ কাছের একটা গাছের ওপর থেকে কিচ্ কিচ্ শব্দ শোনা গেল। তাকিয়ে দেখি চার পাঁচটা বাঁদর অবাক চোখে আমাদের দেখছে। বোধ হয় ও রাজ্যে আমাদের মতো বিচিত্র প্রাণী ওরা আগে দেখে নি বলেই ওদের কৌতূহল। কপিলকে একটু ঠেলা দিতেই সে বলল, ‘হ্যাঁ আমিও দেখেছি। ঠিক সেদিনকার মতোই লম্বা লেজ, তেমনি পায়ের গড়ন, মুখখানা তো বাঁদরের মতোই মনে হচ্ছে, মানুষের সঙ্গে কোন মিল আছে বলে তে মনে হচ্ছে না।’
রাঙাদাও লক্ষ্য করলেন, ‘হ্যাঁ, এ জাতের বাঁদর এখানকার জঙ্গলে মাঝে মাঝে দেখা যায়। খুব বড় বড় চেহারা হয় এদের। ধাড়ি হনুমানের চেয়েও বড়। কিন্তু এগুলি এপ্ নয়, বাঁদরই। কি রকম লম্বা লেজ দেখছ না? এপ্ যাকে তোমরা বল বনমানুষ, তাদের তো আর লেজ হয় না, অবশ্য উল্লুকেরও লেজ নেই।’
বলতে বলতে আমরা আর একটু এগিয়ে এসেছিলাম। এবার দেখা গেল বানরের সংখ্যা যত কম মনে করেছিলাম ততটা কম না, প্রায় সব কটা বড় বড় গাছেই দু-চারটে বসে আছে। আমাদের দেখে কিচ্ কিচ্ শব্দ করে এক ডাল থেকে অন্য ডালে লাফিয়ে পড়ছিল ওরা। লাফাবার সময় পায়ের আঙুল দিয়ে অনায়াসে গাছের ডাল আঁকড়ে ধরতেও কোন অসুবিধা হচ্ছিল না ওদের। ‘একটা ফটো নেওয়া দরকার।’ বলে রাঙাদা তাঁর ক্যামেরাটা বার করলেন আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অনেক দূর থেকে কে যেন ইংরেজীতে চেঁচিয়ে উঠল,‘ডোন্ট ডিস্টার্ব দেম, ডোন্ট ডিস্টার্ব।’ ওদের বিরক্ত কর না।
তাজ্জব কাণ্ড! এখানে আবার ইংরেজীতে কথা বলে কে? আর এই সংরক্ষিত বনে রাঙাদার অজ্ঞাতে কোন লোক, শিক্ষিত নিশ্চয়ই, এল কী করে? তবে কি কোন শিকারী লুকিয়ে শিকার করতে এসেছে? শিকারী হলে তার আবার মায়া কেন এত? নাঃ ব্যাপারটা দেখতে হচ্ছে। থাপা এবার বন্দুক উঁচিয়ে ধরে তাড়াতাড়ি শব্দস্থল লক্ষ্য করে যতটা সম্ভব দ্রুত পায়ে এগোতে লাগল। আমরাও সমান তাল রেখে তাকে অনুসরণ করলাম। এবারে আবার এক অবাক কাণ্ড। ঘন জঙ্গলের মধ্যে খানিকটা জায়গা ছোট্ট একটা টিলার মতো উঁচু হয়ে আছে। তার আশপাশে কোন জঙ্গল নেই, থাকলেও কেউ তা কেটে পরিষ্কার করে নিয়েছে। সেই টিলার ওপর ছোট্ট একটা কাঠের বাড়ি, মাথায় ঢালু চাল। দেখলেই বোঝা যায় বুনোদের তৈরি নয়, দস্তুর মতো পাকা হাতের তৈরি। ঘরে বাতাস চলাচলের জন্য বড় বড় জানালা বসানো, তাতে কাঠের গরাদ আঁটা। আর, তার চেয়েও আশ্চর্য সেই জানালায় পর্দা ঝুলছে, ফুর ফুর করে উড়ছে হাওয়ায়।
আমরা কাছাকাছি যেতেই দেখলাম ঘরের সামনেকার ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে শার্ট আর ট্রাউজার পরা একটা লোক হাত-পা নেড়ে অনুরূপ পোশাক পরা কয়েকটি লোককে কি যেন বোঝাচ্ছেন। চেহারা দেখে বোঝা গেল এঁরা সকলেই বিদেশী এবং শ্বেতাঙ্গ। অবশ্য কোন দেশের লোক তা গোড়ায় ঠাহর করা গেল না।
এবার থাপাকে পাশে নিয়ে রাঙাদা এগিয়ে গেলেন। নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, তিনি এখানকার বনবিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্তা, তাঁর অজ্ঞাতে এখানে ঘরবাড়ি তৈরি করে আপনারা কারা এখানে বসতি বসিয়েছেন?
ইতিমধ্যে আমাদের সাড়া পেয়ে ঘরের ভিতর থেকে আরও ২-৩ জন বেরিয়ে এলেন। এঁরা স্ত্রীলোক, এবং পোশাক দেখে মনে হল এঁরা নার্সের কাজ করেন।
রাঙাদার পরিচয় পেয়ে দলপতি সাহেবটি হ্যান্ডশেক্ করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন। তারপর একটু ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজীতে বললেন, ‘আমরা বিদেশী, ইয়োরোপ থেকে বন্য প্রাণী নিয়ে রিসার্চ করবার জন্য এখানে এসেছি। বনবিভাগের সব নিয়মকানুন হয়তো জানি না, তবে আমাদের কাছে ভারত সরকারের অনুমতিপত্র আছে। কোনও বদ্ মৎলব নিয়ে আসি নি।’
রাঙাদা পদোচিত গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললেন, ‘সে কি! এখানে রিসার্চ করতে এসেছেন, জঙ্গল কেটে ঘরদোর বানিয়েছেন, অথচ সবচেয়ে গোড়ায় যা করা উচিত ছিল ফরেস্ট অফিসারকে জানানো, তাই করেন নি! কিসের রিসার্চ করছেন আপনারা? কোথা দিয়ে ঢুকলেন এই ঘন জঙ্গলে?
তাঁর কথা শেষ হতে না হতে মাথায় ওপর একটা গুরু গুরু আওয়াজ শোনা গেল। সবাই বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখল ওপর থেকে একটা হেলিকপ্টার ধীরে ধীরে নেমে আসছে! হেলিকপটার নামবার জন্য যেটুক সমতল ভূমি দরকার, ঘরটির পাশে তারও ব্যবস্থা করা হয়েছে!
রাঙাদা ঠোঁট কামড়ে বললেন, ‘ও বুঝেছি। তবে—’
সাহেবও বোধ হয় একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন, বললেন, ‘অন্য কিছু ভাববেন না। উই আর ফ্রেন্ডস্। লেট্স হ্যাভ এ কাপ্ অভ টি,তারপর আলাপ করব।’
সাহেবের রকমসকম দেখে আমরা তাজ্জব বনে গেছি। একটা অকর্ম যে সে করেছে তাতে ভুল নেই, কিন্তু সেজন্য কোন লজ্জা বা অনুশোচনা হচ্ছে বলে তো
মনে হয় না! চালচলন দিব্যি স্বাভাবিক।
বারান্দায় চেয়ার টেবিল পাতাই ছিল, আমরা ইতস্ততঃ করতে করতে যেন নিজেদের অজ্ঞাতসারেই গিয়ে সেখানে বসে পড়লাম। ভিতর থেকে টুংটাং পেয়ালার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। পরক্ষণেই দরজার ফাক দিয়ে কে যেন উঁকি দিল। সাহেব তাকে সরে যেতে ইশারা করলে সে বোধ হয় তা বুঝতে পারল না। আবার এসে উঁকি দিল কৌতূহলের সঙ্গে। এবার আর আমার চিনতে কোন ভুল হল না। সেই লম্বা লোক, সেই লম্বা আঙুলওয়ালা পা আর খোঁচা খোঁচা দাড়িগোঁফওলা মানুষের মত মুখ। এ সেই আশ্চর্য জীব, যেটিকে সেদিন আমি আর কপিল অকস্মাৎ গাছের ওপর আবিষ্কার করেছিলাম।
সাহেবের সঙ্গে রাঙাদার অনেকক্ষণ কথাবার্তা হল। জানা গেল সাহেবটির নাম ডক্টর ভিলহেল্ম্ স্মিট্। বাড়ি ভিয়েনা। পেশায় ডাক্তার এবং বিখ্যাত অস্ত্র চিকিৎসক। গ্রাফ্টিং নিয়ে দীর্ঘদিন রিসার্চ করছিলেন এবং এ ব্যাপারে আশ্চর্য সাফল্যও দেখিয়েছেন। কারও কান বা নাক বা হাত পা কেটে গেলে অপরের শরীর থেকে তা কেটে নিয়ে বেমালুম জুড়ে দেওয়া তাঁর কাছে কিছুই না। ইদানীং তিনি গ্রাফটিং করে এক জানোয়ারের সঙ্গে অন্য জানোয়ারের আধাআধি জুড়ে দিতেও সক্ষম হয়েছেন। প্রথম এক টিকটিকির গায়ে অন্য টিকটিকির কাটা গা জুড়ে কাজ শুরু করেন। তাতে সাফল্য লাভ করার পর আর একটু বড় জানোয়ার নিয়ে পরীক্ষা চালান। এই ভাবে গিনিপিগের সঙ্গে খরগোসের, মেঠো ইঁদুরের সঙ্গে বেড়ালের, এমন কি কুকুরের সঙ্গে ভেড়ার শরীর জুড়ে দিয়ে অসাধ্য সাধন করেছেন। অবশ্য ঐসব কাজ সম্পন্ন করতে তাঁকে দীর্ঘ সময় বিচ্ছিন্ন দেহগুলোকে কৃত্রিম উপায়ে বাঁচিয়ে রাখতে হয়েছিল। আর এ কাজ একবারেও সম্ভব হয় নি। প্রতিক্ষেত্রেই বিশ ত্রিশটি করে জীবকে তাঁর এই রিসার্চ-এর জন্য প্রাণ দিয়ে হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি খোদার ওপর এই খোদকারিতে সাফল্যই লাভ করেছিলেন।
এর পর তাঁর এক বিচিত্র সাধ হল। এবার পরীক্ষা চালাবেন মানুষের ওপর। মানুষের দেহের সঙ্গে অন্য কোন প্রাণীর, মানুষের সঙ্গে চেহারায় যার খানিকটা মিল আছে এমন কোন প্রাণীর দেহাংশ জোড়া লাগিয়ে নতুন সংকর প্রাণী তৈরি করা যায় কিনা তাই দেখবেন পরখ করে। কিন্তু ইয়োরোপের মতো সভ্য দেশে বসে তে আর একাজ চালানো যায় না। কে আসবে তাঁর কাছে এই পরীক্ষার উপাদান হতে? তাই তিনি ঠিক করলেন এমন কোন জায়গায় গিয়ে তাঁর পরীক্ষা চালাবেন যেখানে এমন জংলী মানুষ বাস করে যাকে অন্যেরা মানুষ বলেই মনে করে না। অর্থাৎ যেখানে মানুষের প্রাণের কোনই মূল্য নেই।
কোথায় পাবেন সে রকম জংলী মানুষ? প্রথমেই তাঁর আফ্রিকার কথা মনে হয়েছিল। আফ্রিকার লোকেরা এখন ধীরে ধীরে সভ্য হতে শুরু করলেও এখনও সেখানে বনে জঙ্গলে এমন অনেক মানুষ বাস করে যারা নামেই মানুষ, সভ্য জগতের সঙ্গে এখনও তাদের কোন যোগাযোগ ঘটেনি। এই রকম একটা জায়গা হচ্ছে কঙ্গো দেশ। অর্থাৎ কঙ্গোর অরণ্য। প্রথমে সদলবলে সেখানেই চলে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু গিয়ে দেখলেন, ব্যাপারটা যত সহজ ভেবেছিলেন ততটা সহজ নয়। ওখানকার জঙ্গলে লোকগুলো অসভ্য হতে পারে, কিন্তু ততোধিক হিংস্র। আশপাশের অন্য প্রাণীরাও। তারপর জায়গাটা এত অস্বাস্থ্যকর যে ঐ আবহাওয়ায় মানুষ হয় নি এমন লোকের পক্ষে ওখানে প্রাণ নিয়ে টিকে থাকাই দুষ্কর। তবু চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পর পর নিজের বিশ্বস্ত সহকারীদের মধ্যে তিন তিনজনকে খুইয়ে তাঁকে কাজ অসমাপ্ত রেখেই সেখান থেকে পালিয়ে আসতে হয়।
কিন্তু জেদ তাঁর অলঙ্ঘ্য। যা করবেন মনে করেছেন তা করবেনই। খোঁজ খোঁজ করতে করতে শেষে তাঁর এক নৃতত্ত্ববিদ্ বন্ধুর কাছে খবর পেলেন ভারতবর্ষের মধ্যপ্রদেশে এখনও এমন ২-১ টা গহন অরণ্য আছে যেখানে কোন কোন জাতের জংলী মানুষ লোক চক্ষুর আড়ালে থেকে শুধু নিজেদের সমাজের গণ্ডীর মধ্যেই বাস করে। শুধু তাই নয়, ঐ অঞ্চলের কাছাকাছি এক রকম বড় জাতের বানরও দেখতে পাওয়া যায় যারা আকৃতিতে বড় হলেও স্বভাবে ভারী নিরীহ। ব্যাস, স্মিট সাহেব তাঁর প্রোগ্রাম স্থির করে ফেললেন।
তারপর কি করে ভালোমানুষ সেজে বেড়াবার নাম করে ভারতে এসে শেষে নিজস্ব হেলিকপ্টারে তিনি এই জঙ্গলটি আবিষ্কার করেন এবং সঙ্গীসাথী এনে সেখানে জঙ্গল সাফ করে কাঠটাঠ কেটে ঘরদোর বানিয়ে, যন্ত্রপাতি বসিয়ে তথাকথিত রিসার্চ এর সাজসরঞ্জাম, মায় অপারেশন থিয়েটার সমেত পুরো একটি গবেষণাগার তৈরি করে ফেললেন, সে এক বিরাট কাহিনী। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত তিনি ঐ জংলী মানুষদের আস্তানা খুঁজে বার করে, তাদের উপহার-টুপহার দিয়ে প্রলুব্ধ করে কিংবা অন্য কোন পর্যায়ে পোষ মানিয়ে, তাদেরই একজনের দেহে অস্ত্রোপচার করে তার দেহের নীচের দিকটায় ঐ বড় জাতের বানরের দেহাংশ গ্রাফটিং করে জুড়ে দিতে সমর্থ হলেন। অবশ্য এই পরীক্ষার জন্য কতজন জংলীমানুষ আর বানরকে প্রাণ দিতে হয়েছিল তার কোন হিসেব পাওয়া যায়নি, তিনিও বলেন নি। তবে এটা ঠিক, কাজটা করা হয়েছিল গোপনে এবং অনেক দিন ধরে, সম্ভবতঃ রাঙাদা এখানে আসবার বহুআগে। তবে ঐ ভারত সরকারের অনুমতি পত্রটত্র সব বাজে কথা, ভাঁওতা ছাড়া কিছু নয়। রাঙাদা ভালোমানুষ বলে
ওগুলো দেখতে চাননি। চাইলে সাহেব খুবই মুশকিলে পড়তেন সন্দেহ নেই।
আমরা সেদিনকার মতো ফিরে এলাম। আমার আর বেশিদিন অপেক্ষা করার মতো ছুটি ছিল না, কপিলেরও না। রাঙাদা এর পর কি ব্যবস্থা নিয়েছিলেন কিংবা নেবেন বলে ঠিক করেছিলেন তা এখনও জানতে পারি নি। তবে স্মিট সাহেব দুনিয়ার চোখে যত বড় অপরাধই করে থাকুন, তিনি যে সার্জারি ইতিহাসে একটা অকল্পনীয় নজির রেখে গেলেন তা স্বীকার না করে উপায় নেই। এ যেন সুকুমার রায়ের কল্পনার সেই হাঁস আর সজারু মিলে হাঁস জারুর সৃষ্টি। কিংবা, আরও ভালো করে বললে, সেই গাইবাবুর গল্প। গল্পটা যারা শোনে নি তাদের না হয় বলে দিচ্ছি।
একবার এক কেরানীবাবু আর একটা গরু একসঙ্গে রেললাইন পার হতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে। সেখানে একজন ওস্তাদ ডাক্তার ছিলেন যিনি কাটা দেহ জুড়ে দিয়ে লোকদের বাঁচিয়ে দিতে পারতেন। এক্ষেত্রেও ওদের বাঁচিয়ে দিলেন। কিন্তু তাড়াতাড়িতে একটা ভুল হয়ে গেল। কেরাণীবাবুর ওপরের দিকটার সঙ্গে গরুর নিচের দিকটা জোড়া হল, তেমনি গরুরও নিচের দিকটাও হল কেরাণীবাবুর নিচের দিকটার সঙ্গে যুক্ত। কেরাণীবাবু ঐ নতুন চেহারায় রূপান্তরিত হওয়ায় তার নাম হয়ে গেল, “গাইবাবু”। শুধু এখানেই গল্পের শেষ নয়। সেই থেকে কেরাণীবাবু খুর পায়ে খুটখুট করতে রোজ অফিসে যেতেন আর বিকেলে বাড়ী ফিরে দু’সের করে দুধ দিতেন।
.
প্রথম প্রকাশ: ফ্যানট্যাসটিক, অগাস্ট-সেপ্টেম্বর, ১৯৮২