শিলাকান্থ • ডক্টর দিলীপ রায়চৌধুরী
এ জায়গাটা আমার ভারী ভাল লাগে। সমুদ্র যেন কবে আপন খেয়ালে এই পাহাড়ে ঘেরা নির্জন খাঁড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। তারপর আর বেরোতে পারে নি, জোয়ারের সময় দুই পাহাড়ের মাঝখানে ঐ সিংহদুয়ারের মতো পথ দিয়ে হু হু করে জল ছুটে আসে। তারপর নিষ্ফল আক্রোশে সারাদিন পাথরের গায়ে মাথা খুঁড়ে মরে।
জাহাজ কোম্পানীর লোকেদের বুদ্ধি আছে। বন্দর অনেকটা দূরে। তবুও এই অঞ্চলের বিশেষ আকর্ষণের দিকে লক্ষ্য রেখে সাগরের মুখোমখি একটা টিলার উপর সুন্দর বিদেশী কায়দায় হোটেল বানিয়েছে। বর্ষাকাল ছাড়া বাকী আট-ন মাস হোটেলটা লোকে গিজ্ গিজ্ করে। জাহাজের যাত্রীরা ছাড়াও দূর-দূরান্তর থেকে লোকের ছুটি কাটাবার জন্য এখানে আসে। বিশেষতঃ অক্টোবর থেকে জানুয়ারী এখানে ঠাঁই মেলাই মুস্কিল।
অফিসের কাজে এ অঞ্চলে এলেই আমি এখানেই উঠি, শহরের ভেতর গরমে পচবার চাইতে এ ঢের ভাল। সঙ্গে অপিসের জীপখানা যতক্ষণ রয়েছে ততক্ষণ দূরের পথ আর গায়ে লাগে না। উপকূলে ছড়ানো কফি ও রাবার প্লান্টেশানেই আমার কাজ। এক একদিনে পঞ্চাশ কি একশো মাইল দূরে আসি। তারপর সন্ধ্যায় হোটেলের পোর্টিকোতে যখন পা ছড়িয়ে নিম্বুপানি হাতে নিয়ে বসি, দূরে মাঝ সমুদ্রের জাহাজের আলোগুলো একে একে জ্বলে ওঠে।
সেবারে ঠিক করেছিলাম অফিসের কাজ শেষ করে দিন সাতেক ছুটি নিয়ে এই হোটেলটায় কাটাবো। অনেকদিনের এক গাদা লেখার কাজ জমে রয়েছে। কোলকাতায় আড্ডার নেশায় হয়েই ওঠে না। সেপ্টেম্বর মাস—কোলকাতায় কাজের চাপ কম, স্নেহপ্রবণ ম্যানেজার এক কথাতেই রাজী হয়ে গেলেন।
সবে বর্ষা শেষ হয়েছে, আবহাওয়া ভারী চমৎকার, সমুদ্রে চান করেও আরাম। রোদ্দুরে হাত-পা ছড়িয়ে বসে থাকলেও গা পুড়ে যায় না। দিন কাটছে বেশ, হোটেলের লবিতে বসে সারা সকাল কলম কামড়াচ্ছি। এক লাইন লেখা বার করে কার সাধ্য, কোনও রকমে আর মিনিট পনেরো কুড়ি কাটিয়ে দিতে পারলেই লাঞ্চ, তারপর খেয়ে-দেয়ে দিব্যি তোফা এক ঘুম।
হঠাৎ মনে হল হন্ হন্ করে যেন এক পরিচিত ভদ্রলোক পাশ দিয়ে ডাইনিং
হলের দিকে বেরিয়ে গেলেন। মিনিট পাঁচেক বাদেই সন্দেহ ভঞ্জন হল। ঠিক ধরেছি, হলের এক প্রান্তে একটি ছোট টেবিলে আপন মনে খেয়ে চলেছেন আমাদের অতি পরিচিত অধ্যাপক সুশোভনবাবু।
কি ব্যাপার, এখানে কি মনে করে স্যার! আমার দিকে না তাকিয়েই উনি বললেন—কেন, সমুদ্র, কি আমাদের টানতে পারে না নাকি। কলেজ জীবন সে কবেকার কথা, আমাদের ছোট কলেজে পড়াতেন বলে ভুলেই গিয়েছিলাম সুশোভনবাবু একজন উচ্চ শিক্ষিত ম্যারিন বাইওলজিষ্ট। দেশ স্বাধীন হবার ক’বছর বাদেই সরকারী সামুদ্রিক জীব বিজ্ঞানের দপ্তরে যোগ দেওয়ার পর উনি আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসের উড্স হল ল্যাবরেটরীতে কাজ করে বেশ নামও করেছিলেন। এখন আন্তজাতিক সংস্থার চেষ্টায় সমুদ্রের তলদেশ সম্পর্কে যে সব গবেষণা চলছে, সুশোভনবাবু তার সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত।
সময় কাটাবার এ রকম একজন অভাবিত সঙ্গী পেয়ে ভীষণ উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলাম। ভারতীয় নৌবাহিনীর চন্দ্রশেখর জাহাজখানাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ভারত মহাসাগরের উপকূলে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার কাজের জন্য। সুশোভনবাবু সেই গবেষক গোষ্ঠীর প্রধান। সারাটা দিন জাহাজেই কাটান, কেবল খাওয়ার জন্য কিছুক্ষণ ফেরেন। কখনো সখনো দূরের পাড়ি হলে জাহাজেই কদিন কাটে।
সন্ধ্যার পর একা একা হোটেলের লবিতে বসে কোলকাতার প্লেনে সদ্য আমদানী ষ্টেটসম্যান কাগজখানায় চোখ বুলিয়ে দেখছি এমন সময় সুশোভনবাবু এলেন। চান-টান করে মেজাজ বেশ শরীফ মনে হচ্ছে।
মাফ কোরো সঞ্জয়, সকালে তাড়াহুড়োয় তোমার সঙ্গে ভাল করে কথা বলা হয়ে ওঠে নি। কিছু মনে করোনি ত?
না স্যার, আমি বুঝতেই পেরেছিলাম, কিন্তু আমি কেবল ভাবছি কোথায় সেই ল্যাবরেটরী আর কোথায় জাহাজের ডেক? এ জীবন আপনার কেমন লাগছে স্যার?
কোনোদিন পাহাড়ে চড়েছ সঞ্জয়? উঁচু পাহাড়ে চড়ার যে উত্তেজনা মহাসাগরের তলায় ব্যাথিস্ফিয়ারে নেমে যাওয়া তার চেয়ে কম উত্তেজক নয়।
আস্তে আস্তে গল্প জমে গেল, সুশোভনবাবু অদ্ভুত বলতে পারেন।
সমুদ্রের রৌদ্রালোকিত উপর তলার এবং একেবারে নীচেকার পাহাড় ও উপত্যকার মাঝখানেই মহাসাগরের সবচেয়ে অজানা অংশ। এই গভীর অন্ধকার রহস্যময় সাম্রাজ্যের সঠিক খবর সংগ্রহ করাই এই শতাব্দীর ওশিওনোগ্রাফারদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবে এই রহস্যভেদ করার কাজে আমাদের
ক্ষমতা কতটুকু! ডুবুরীরা অক্সিজেন সিলিণ্ডার নিয়ে ৩০০ ফুট পর্যন্ত যেতে পারে। বিশেষ হেলমেট ও রাবারের পোশাক পরে মেরে-কেটে আরও কিছুটা নিরন্ধ্র অন্ধকারের রাজ্যে যেতে গেলে ব্যাথিস্ফিয়ার ছাড়া গতি নেই। প্রায় ত্রিশ বছর আগে দুজন আমেরিকান প্রায় আধ মাইল পর্যন্ত ব্যাথিস্ফিয়ারে নামতে পেরেছিলেন। তার চেয়ে উন্নত ধরনের ষ্টিল স্ফিয়ার এখন তৈরি হয়েছে যাতে আরও তলায় যাওয়া যায়।
…আচ্ছা এক কাজ করা যাক। তুমি কাল আমার সঙ্গে চলো না, আমাদের জাহাজটা দেখে আসবে। ব্যাথিস্ফিয়ার ছাড়া আমাদের আরও ইন্টারেষ্টিং যন্ত্রপাতি আছে। সমুদ্রতলের জন্য উন্নত ধরনের কামেরা, প্রতিধ্বনি যন্ত্র, অ্যাসকানিয়া গ্রাফ সমুদ্রের গ্রাভিমিটার—যা দিয়ে কিনা সমুদ্রের তলাকার মাধ্যাকর্ষণের তারতম্য বুঝতে পারি—এই সব নানা কিছু। কাল সকালেই চলো কেমন? রাত হয়ে গেছে, চলো খেয়ে নেওয়া যাক।
ভীষণ উৎসাহিত হয়ে পড়লাম, এ যে মেঘ না চাইতে জল। এর চেয়ে ছুটি কাটাবার ভাল সুযোগ আর কি হতে পারে। চুলোয় যাক লেখা। উত্তেজনায় রাত্তিরে ঘুম এলো না।
সকাল এখানে দেখবার মতো, পাহাড়ের ওদিকটা দিয়েই আমাদের ঘুরে যেতে হবে।
ওঁদের জাহাজটা হার্বার থেকে প্রায় মাইল দশেক দূরে নোঙর করা হয়েছে। সমুদ্রের কোল ঘেঁষে অপূর্ব মসৃণ পথ। ডাইনে সমুদ্রের দিকে যতদূর নজর যায় দু একটা সী গাল ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। খালি একপাশে একটি আলোকস্তম্ভ সকালের কাঁচা রোদে চিক্ চিক্ করেছে।
‘চন্দ্রশেখর’ জাহাজের কাছাকাছি আসতেই সুশোভনবাবু নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে বললেন: তোমাকে যে নিয়ে যাচ্ছি সঞ্জয়, এটা সম্পূর্ণআমার নিজের দায়িত্বে। ওখানে আমার এ্যাসিষ্টান্ট অমরেশ তোমার সহপাঠী ছিল, সে ছাড়া আর কেউ তোমাকে চেনে না। সরকারী ঝামেলা এড়াতে তোমাকে সদ্য আমেরিকা প্রত্যাগত ডঃ বোস বলে পরিচয় দেবো। ওদের কাছে তুমি একজন নাম করা বৈজ্ঞানিক বলেই প্রতিভাত হবে।
কাঠের সিঁড়ি বেয়ে অনেকটা উঠতে হল। জাহাজের ডেকে দু একজন সাধারণ খালাসী ঘষা মাজা করছে, এছাড়া প্রাণের আর বিশেষ সাড়া নেই। কেবিনের মধ্যে ঢুকে দেখি কে একজন কানে হেডফোন লাগিয়ে কি শুনছে এবং তাকে ঘিরে প্রায় জনা দশ পনেরো চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে। ভীড়ের মধ্যে অমরেশকে চিনতে কষ্ট হল না। সে আমাকে বিশেষ লক্ষ্য না করে সুশোভনবাবুর দিকে
এগিয়ে এল, তার গলায় ঈষৎ উত্তেজনার আভাস।
স্যার, কি এক অদ্ভুত আওয়াজ আসছে হাইড্রোফোন মারফৎ! কখনো মনে হচ্ছে ক্রুদ্ধ পশুর গর্জন, কখনো মনে হচ্ছে বাঁশ ঝাড়ে আগুন লেগেছে—কাঁচা বাঁশ ফাটার আওয়াজ!
সুশোভনবাবু একটু বিরক্ত হয়ে বললেন: এখানে এত ভীড় কেন? তোমরা সকলে যে যার কাজে যাও। গোয়েল, প্লিজ, হেডফোনটা আমাকে দাও।
আস্তে আস্তে কেবিনটা খালি হয়ে গেল। সুশোভনবাবু হেডফোন কানে দিয়ে চিন্তিত মুখে মাঝে মাঝে কি যেন নোট করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ বাদে হেডফোনটা নামিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করলেন: অমরেশ, যেখানে হাইড্রোফোনটা রয়েছে তার গভীরতা কত হবে?
স্যার, পঞ্চাশ ফ্যাদমের বেশী হবে না।
মাত্র! ভাবিয়ে তুললে ত, আওয়াজটা কোনো বড়-সড়ো সামুদ্রিক জীবের হলে আমরা আগে জানতে পারতুম, কারণ একোসাউন্ডিং-এ তাহলে দুটো প্রতিধ্বনি আসতো। আচ্ছা ও জায়গাটার টোপোগ্রাফি আমরা কি জানি?
স্যার, ঐ টোপোগ্রাফিকাল ম্যাপটা আমরা কালকেই শেষ করেছি। যেখানে জাহাজটা আছে সেটা মহাদেশের ঢালু অংশের প্রান্তে। এরপর অগভীর অংশটা খুবই এবড়ো-খেবড়ো, অবশ্য পঞ্চাশ কিলোমিটার এগোলে এটা মসৃণ হয়ে এসেছে।
আমি বিস্মিত হয়ে ওদের ম্যাপটা দেখছিলাম, ভীষণ খেটেছে বলতে হবে। উপকূল থেকে পাঁচশো কিলোমিটার পর্যন্ত সমুদ্রতলের খুঁটিনাটি অনেক কিছু জেনে ফেলেছে। কোথায় কি ধরনের সেডিমেন্ট আছে, সেডিমেন্টের তলায় কি ধরনের পাথর সবই এক ঝলকে বোঝা যায়।
ঘণ্টা দু-তিন কাটতেই বুঝলাম সুশোভনবাবু আমার অস্তিত্ব বেমালুম ভুলে গেছেন। সেই যে কখন একবার কফি খেতে খেতে দু-একজনের কাছে আমাকে ডঃ বোস বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তারপর একেবারে নিজের কেবিনে। আমিও বিশেষ ঘাঁটাতে সাহস পাচ্ছি না।
জাহাজের ডেকে অবশ্য বিশেষ খারাপ লাগবার কথা নয়। একটা ডেক চেয়ারে বসে উপভোগ করছি সমুদ্রের হাওয়া। দূরে কয়েকটা জেলে ডিঙিতে নুলিয়ারা জাল ফেলে মাছ ধরছে।
হঠাৎ লক্ষ্য করলাম দূরের একটি ডিঙিতে যেন কিসের একটা উত্তেজনা। একটি নুলিয়া তার পাশের সঙ্গীকে নিয়ে যেন কি এক অজানা ভয়ে বিপর্যস্ত। পাশের কেবিনে গোয়েল ছিল। ওর সঙ্গে ইতিমধ্যেই আমার আলাপ হয়ে গিয়েছিল।
ওকে বললাম, গোয়েল, প্লিজ, বাইনোকুলারটা একবার দেবে।
বাইনোকুলার লাগিয়ে দেখি ইতিমধ্যে নুলিয়ার হাত নেড়ে ওদের আশপাশের বেশ কিছু সঙ্গী সাথীদের জড়ো করেছে। সবাই মিলে উপুড় হয়ে নৌকোর খোলের মধ্যে কি যেন দেখছে।
কৌতূহল আর রাখতে পারলুম না। ডেকে লাইফ বোটের অভাব নেই। নাবিক-লস্কর নিতান্ত কম নয়, সোজা গিয়ে সুশোভনবাবুকে বললাম: স্যার, চুপচাপ বসে আছি, আপনি যদি অনুমতি দেন তবে দুজন লোক নিয়ে একটা নৌকোয় কিছুক্ষণ ঘুরে আসি।
সুশোভবাবু অন্যমনস্কভাবে বললেন: সে তো ভালই, কিন্তু বেশী দূরে যেও না। আর একটা কথা। চারটের আগেই ফিরে এসো, কারণ তোমার সঙ্গে হোটেলে ফিরে গিয়ে আমাকে কয়েকটা ট্রান্স-কন্টিনেন্টাল টেলিফোন করতে হবে।
জেলেদের নৌকোটাকে ধরতে কুড়ি মিনিটের বেশী সময় লাগলো না। সমুদ্র যেন শান্ত হ্রদ। মাল্লারা ওদের ভাষা জানে। সরকারী জাহাজ থেকে দেখতে এসেছে শুনে ওরা সসম্ভ্রমে সরে দাঁড়ালো। যা দেখলাম, অবশ্য তা কোনদিন কল্পনাও করিনি।
একটা অবিশ্বাস্য মাছ—না জন্তুও বলা যায়। প্রায় পাঁচ ফুটের মতো লম্বা হবে; বিচিত্র ধরনের উজ্জ্বল নীল আঁশ, এক অস্বাভাবিক বিরাট মাথা, পাখা, লেজ, সব জড়িয়ে যেন প্রাগৈতিহাসিক কাহিনীর পৃষ্ঠা থেকে নেমে এসেছে। দেখলে গা শিরশির করে।
মাল্লাদের বললাম: ওদের বুঝিয়ে দাও গভর্মেন্ট এ মাছ কিনে নেবে। এ রকম হিংস্র জীব এদের কাছে থাকা ঠিক নয়। মাছটা তখনও অল্প নড়ছে। ওটাকে জাল মুড়ি দিয়ে লাইফ বোটে তুলতে চারজন লোক হিমসিম। জাহাজের উপরে তুলতে বেগ পেতে হল না। ভাগ্যে ছোট ক্রেনের বন্দোবস্ত ছিল। ইতিমধ্যে ডেকে এক উৎসুক ভীড়। কখন কে যেন সুশোভনবাবুকে খবর দিয়েছে। তিনি ভীড় সরিয়ে এসে থমকে দাঁড়ালেন, যেন ভূত দেখেছেন। অস্ফুট স্বর তাঁর মুখ দিয়ে বেরোলো: মাই গড, শিলাকান্থ! ছ’কোটি বছর আগে এদের যে ফুরিয়ে যাবার কথা!
সকলে প্রায় পাঁচ মিনিট বিস্ময়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত স্থাণু, হঠাৎ সুশোভনবাবুর গলার আওয়াজে সম্বিৎ ফিরলো।
শিগগির, এখনো বেঁচে আছে, আর কয়েক মিনিটের মধ্যে হয়ত মারা যাবে। তার আগে নিয়ে চল জাহাজের একোয়ারিয়ামে।
এ জাহাজে যে এত সুন্দর একটা একোয়ারিয়াম আছে কে জানতো। জলের
তাপ প্রয়োজনানুযায়ী বাড়ানো কমানো যায়। এই অদ্ভুত জীবটার প্রয়োজন মতো পরিবেশ সৃষ্টি করতে খুব বেশী সময় লাগলো না। যখন আবার স্বাভাবিক ভাবে মাছটা চলাফেরা করতে লাগলো, বেশ কয়েক জোড়া উৎসুক চোখ ওর দিকে সে সময়ে নিবদ্ধ। এতক্ষণ লক্ষ্য করি নি, একোয়ারিয়ামের মধ্যে একটা ছোট হাইড্রোফোন লাগানো। সুশোভনবাবুর কানে হেডফোন এবং মুখের চেহারায় যেন কোন এক দুরূহ সমস্যা সমাধানের আনন্দের চিহ্ন।
হোটেলে ফিরে যাওয়া আর হল না। সারা বিকেল সারা রাত ধরে ওঁরা শিলাকান্থ সম্পর্কে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালালেন। মেটাবলিজম্, রেসপিরেসন রেট আরও কতও কি সব জৈব রাসায়নিক ব্যাপার। সে রাতে কারোরই ভাল করে ঘুমানো হল না! ভোরবেলায় দেখি বিরাট তোড়জোড় চলেছে। যে জায়গায় হাইড্রোফোন মারফৎ ঐ সব বিচিত্র আওয়াজ আসছিল সেখানে ব্যাথিস্ফিয়ার নামিয়ে দেখা হবে। কি করে যে ঐ ব্যাথিস্ফিয়ারে যাত্রী হওয়া যায় তাই ভাবতে ভাবতে আস্তে আস্তে সুশোভাবাবুর কেবিনের দিকে গেলাম।
কেবিনের দরজা ভেজানো ছিলো। নক্ করতেই আওয়াজ এলো: কাম ইন, ওঃ তুমি, দেখতো কি কাণ্ড! ছুটিতে বেড়াতে এসে তুমি কিসের মধ্যে পড়ে গেলে। যাই হোক ডক্টর বোস, জাহাজের প্রত্যেকটি কর্মীর কাছে তুমি এখন একজন অত্যন্ত নাম করা লোক, তোমার অনুসন্ধিৎসায় আমরা বিবর্তনের একটা হারানো সূত্র খুঁজে পেয়েছি।
আমি একটু লজ্জিত হয়ে পড়লাম: সে কি কথা স্যার? আমি আবার কি করলুম?
এটাকে চিনতে পারা তো খুব সহজ কথা নয়।
সেটা ঠিকই, যদিও পৃথিবীর বহু মিউজিয়মে শিলাকান্থের ফসিল সংগৃহীত হয়েছে, আগে কেবলমাত্র দুবার সজীব প্রাণীর দেখা পাওয়া গেছে।
প্রথম ১৯৩৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার উপকূলে। সেবারে যে জেলের দল এই জীবটিকে ধরেছিল বিজ্ঞানীরা জানবার আগেই তারা ওটাকে কেটেকুটে শেষ করে ফেলে। তারপর ১৯৫২ সালে মাদাগাস্কারের কাছে যেটিকে পাওয়া যায় তার সম্পর্কেও পুরো গবেষণা হয়নি।
আমরা জানি ফসিল হিসাবে অন্ততঃ ছ’কোটি বছর আগে এরা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, কিন্তু অন্ততঃ ত্রিশ কোটি বছর আগে যে এদের পূর্ব পুরুষরা প্রাগৈতিহাসিক সমুদ্রে বিচরণ করতে এ কথা জোর করে বলা যায়। সেই দিক থেকে এরা ডিনোসরসের চেয়েও বয়সে বড়!
শিলাকান্থ কথাটার অর্থ হল ফাঁপা মেরুদণ্ড। এই জাতের মাছ থেকেই সব
রকমের মেরুদণ্ডী জীব—খেচর, ভূচর, উভচর উদ্ভূত হয়েছে, একথা আমরা একটু খুঁটিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবো। লক্ষ্য করে দেখেছো ওটার পাখনাগুলো ঠিক অন্য মাছের পাখনার মতো নয়, বরং কতকটা হাঁসের পায়ের মতো। যেন এখন উঠে আসবে ডাঙায়। অগভীর জলে ওদের পাওয়া গেলে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।
আমার প্রশ্ন হল, এই যে একেকটা শিলাকান্থ ধরা পড়ছে এদের সত্যিকার বাসস্থল কোথায়? সমুদ্রের এত উপরতলাকার বাসিন্দা ওরা নয়। সেটা ওদের গায়ের আঁশের রং, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের ধরন-ধারণ দেখলে বোঝা যায়…
…কিন্তু এখন আমাকে থামতে হবে। আমাদের ব্যাথিস্ফিয়ারে নামবার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। তা বেশ তো, তুমিও চল না।
বাইরে বেরিয়ে দেখি, শিলাকান্থের গল্পে এত তন্ময় হয়েছিলাম যে বুঝতে পারি নি জাহাজ নোঙর তুলে কতদূরে চলে এসেছে। ফেনায় ফেনা সাগর জাহাজের প্রোপেলারের ঘায়ে, গাং চিলের ভীড় করেছে খাবারের লোভে লোভে জাহাজের গায়ে।
কতদূর এসে যে জাহাজের গতি মন্থর হল তা বলতে পারি না। সূর্য তখন প্রায় মাথার ওপরে। ঝাঁ ঝাঁ করছে রোদ।
ব্যাথিস্ফিয়ারের ভেতরকার বন্দোবস্ত ভারী চমৎকার। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, বসবার আসন পুরু গদি মোড়া। টেলিফোন, লেখার ডেস্ক, একপাশে সবই ব্যবস্থা আছে। প্রথমে সিঁড়ি বেয়ে ঢুকে গেল অমরেশ। ভেতর থেকে সিগন্যাল দেওয়ার পর সুশোভনবাবু, আমি ও রহমান বলে আরেকটি এ্যাসিষ্টান্ট একে একে ঢুকলাম। শুনতে পেলাম প্রেসারাইজড্ ঢাকনাটা ওরা বাইরে থেকে সশব্দে বন্ধ করে দিলো। এরপর ভেতরে এয়ার কন্ডিশনারের ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের মতো আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। কয়েক মিনিটের মধ্যে উইঞ্চ-লিফটে ব্যাথিস্ফিয়ারে আমরা নামতে আরম্ভ করলাম।
দেখি হাত ঘড়িতে তখন প্রায় বেলা বারোটা। সুশোভনবাবু আগে একবার বলেছিলেন চারটের আগে উপরে উঠে ওঁকে আজ রাত্তিরের মধ্যেই হোটেলে ফিরতে হবে। আস্তে আস্তে ব্যাথিস্ফিয়ারের জানলায় সূর্যের আলো মিলিয়ে গেল। তবুও দেখি এক তীব্র লাল আভা জেগে রয়েছে। এখানে ওখানে দু-একটা সামুদ্রিক মাছ; কখনো বা ভাসমান শ্যাওলা। তারপর হঠাৎ কোন যাদুমন্ত্রে যেন সেই লাল আভা অদৃশ্য হল। পাশে মিটারে দেখি নেমেছি মাত্র দুশো ফিট। বাইরে এখন নীল সবুজে মেশানো যেন গাঢ় শীতল এক ভয়ের রাজ্য। ব্যাথিস্ফিয়ারের তীব্র আলোয় কখনো মাছের ঝুঁকি ত্রস্ত দ্রুতগতিতে এদিক থেকে ওদিকে চলে যায়। কত রকমের মাছ—কোনটা কাচের মতো স্বচ্ছ, এক্স-রে ছবির মতো অশরীরী। আবার কোনটার হাঙ্গরের মতো ধারালো দাঁত।
—ঐ যে ওগুলো এরোওয়ার্ম, তার পাশেরগুলো কম্বজেলী, সুশোভবাবু বলে যেতে লাগলেন। আমাদের দৃষ্টি যেন চুম্বকের মতো জানালায় আঁটা।
মনে শৈশবের অনেক প্রশ্ন চুপিসাড়ে যেন মাথা চাড়া দিতে লাগলো: মাছ কি করে গভীর সমুদ্রের তলায় অত চাপ সহ্য করে বেঁচে থাকে? এক একবার ভাবি সুশোভাবাবুকে জিজ্ঞেস করবো কিন্তু সাহস পাই না। উনি একেবারে নিমগ্ন হয়ে গেছেন।
সহসা এ্যালার্ম ঘণ্টার ঝন্ ঝন্ আওয়াজে আমরা সকলেই সচকিত হয়ে পড়লাম। কি ব্যাপার! কোনো ডুবো পাহাড়ের সঙ্গে ধাক্কা লাগলো নাকি। তাই বা কি করে হয়। অমবেশ তো সর্বক্ষণ রেডারের সামনে বসে কন্ট্রোল করছে এবং ওপরে গোয়েলকে নির্দেশ দিচ্ছে। এদিকে এমার্জেন্সী ল্যাম্পটা দপ্ দপ্ করে কি যেন জানাতে চাইছে।
—কুইক, অমরেশ, গোয়েলকে বলো আমাদের সাউথ-ওয়েষ্টে সরিয়ে নিতে আমরা নিশ্চয়ই কোনো বড় মাছের সঙ্গে সংঘর্ষে পড়েছি। এটা পাহাড়ের সংঘর্ষের চেয়ে অনেক বেশী বিপজ্জনক হতে পারে, কারণ অনেক মাছের লেজের ঝাপটায় পুরু ইস্পাতের পাতও চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়।
সুশোভনবাবুর ধারণা নির্ভুল। কয়েক মিটার সরে যেতেই সার্চ লাইটের আলোয় পরিষ্কার দেখতে পেলাম সেই বিচিত্র উজ্জ্বল নীলমাছ—
শিলাকান্থ! অকস্মাৎ ধাক্কা লাগায় চোখ থমথমে ক্রুদ্ধ।
দেখুন স্যার, ওটা কোন একটা গহ্বর থেকে বেরিয়েছিল। দ্রুত সেইখানে ঢুকে যাচ্ছে!—অমরেশ প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো।
ভাল করে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে গহ্বরের মধ্যে ঢুকছে সেটা একটা ডুবো আগ্নেয়গিরির গহ্বর। কবে কোন সুদূর অতীতে এই আগুন পাহাড়ের আগুন নিভে গিয়েছিল কে জানে! সার্চ লাইটের তীব্র আলোয় দেখা গেল যে গহ্বরের মুখটা যথেষ্ট বড়। প্রায় কুড়ি ফুট ব্যাসের এক বৃত্ত। শিলাকান্থটা মিলিয়ে যাবার পর সূচীভেদ্য অন্ধকারে আর কোনও প্রাণের সাড়া নেই।
অনেকক্ষণ আমরা নিস্তব্ধ হয়ে কাটালাম। আমাদের সকলের মধোই প্রশ্ন—গহ্বরের মধ্যে আমরা… তাকিয়ে দেখি সুশোভনবাবু গভীর চিন্তামগ্ন। অবশেষে স্তব্ধতা ভঙ্গ করে উনি বললেন: আমাদের নীচে নামতে হবে। রিস্ক কিছুটা আছে কিন্তু নাটকের শেষ দৃশ্য দেখতে হলে এছাড়া আর উপায় কি? কিছু না জানিয়ে গোয়েলকে খুব শান্তভাবে গাইড করো অমরেশ।
গহ্বরের মুখ বরাবর বাথিস্ফিয়ার ধীরে ধীরে নামতে শুরু করলো, ২৫০০ ফুট… ২৭০০ ফুট… কিছুদূর এগোনোর পর অন্ধকার যেন তরল হল। কোথা থেকে যেন আলো আসছে। অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ছোট গাছপালায় ভর্তি পাহাড়। কিন্তু সে গাছপালা পৃথিবীর কোনো পরিচিত চৌহদ্দির নয়। পাহারাগুলো ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যায় সেগুলো গ্রানাইটের নয়, যেন প্রবালে পূর্ণ। আরও বোঝা যায় সেখানে অসংখ্য স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো তারামাছ লেগে রয়েছে। তাদের দেহ থেকে বিচ্ছুরিত আলো কেমন এক আলো-আঁধারি ভৌতিক অবস্থার সৃষ্টি করেছে। প্রবাল ও অন্যান্য সামুদ্রিক গাছপালা দেখলে মনে হয় সমুদ্র এখানে খুব ঠাণ্ডা নয়।
সুশোভনবাবু হঠাৎ উত্তেজিতভাবে বলতে আরম্ভ করলেন: একি! আমরা একেবারে প্রাগৈতিহাসিক পরিবেশে এসে পড়েছি। ঐ তো দ্যাখো, কাঁকড়ার মতো ওগুলো ক্রাষ্টাসিয়া গ্রানটোলাইট আরও কত কি? রুদ্ধ নিঃশ্বাসে আমরা তখন দেখছি চোখের সামনে দিয়ে সিনেমার ছবির মতো সরে যাচ্ছে অসংখ্য অচেনা সামুদ্রিক প্রাণী। কোনটার পুরু আঁশ, কোনটা বুকে হাঁটা চিংড়ির মতো সাঁতারু কপালের মাঝখানে একটা বিরাট ভয়াল চোখ। সমুদ্রের উপরতলায় যা ভাবা যায় নি, বোঝা যায় নি সেই সব অবিশ্বাস্য জীব!
অমরেশ, লক্ষ্য করো সমস্ত প্রাণীগুলো যেন পুবদিকে চলেছে কোন এক অন্তঃশীলা স্রোতে ভর করে। জলের টেম্পারেচারটা একবার দেখ তো। অমরেশ অনেকক্ষণ মন দিয়ে কি সব মিটার যেন দেখল, তারপর চেঁচিয়ে উঠলো—গুড হেভেনস্ স্যার! সত্তর ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড! আর নামাটা কি…
ওর মুখের কথা মুখেই হয়ে গেল। দিগন্তে কোথায় যেন একসঙ্গে একশোটা বাজ পড়লো। কি হয়েছে কিছু বোঝবার আগেই চারদিকে যেন প্রচণ্ড আলোড়ন। প্রাথমিক বিমূঢ় ভাবটা কাটিয়ে দেখি আমরা সকলেই ব্যাথিস্ফিয়ারের চারিদিকে ছিটকে পড়েছি। মাথাটা কেমন ঝিম্ঝিম্ করছে… মনে হচ্ছে ব্যাথিস্ফিয়ারের ইস্পাতের দরজায় বিরাট এক গহ্বরের সৃষ্টি হয়েছে, সেখান দিয়ে জল ঢুকছে কুলকুল করে। ক্রমে সেই জল যেন আমার মাথা বেয়ে জামার মধ্যে ঢুকছে… হাত দিয়ে দেখি জল নয় রক্ত! পড়ে গিয়ে দেখি ধাক্কায় কেটে গিয়েছে। সেই চেতন-অর্ধচেতন অবস্থার মধ্যে দেখলাম সমুদ্রের তলা থেকে বিস্ফোরণের বেগে উঠে আসছে ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মতো উৎক্ষিপ্ত মাটি, পাথর। পাহাড়ের প্রান্ত থেকে ভয়ার্ত চিৎকার করতে করতে ছুটে আসছে যেন এনসাইক্লোপিডিয়ায় দেখা প্রাগৈতিহাসিক ছবির জীবন্ত প্রতিমূর্তি: ইক্থাইওসর! হাড়ের খাঁচায় ঢাকা চোখ, তেকোণা ধারালো দাঁত অস্পষ্ট আলোয় ইস্পাতের ফলকের মতো চক্চক্ করছে, বীভৎস লম্বা গলা ও পাখনাওয়ালা সামুদ্রিক সরীসৃপ—প্লেসিওসর… সেই প্রবাল পাহাড় খান্ খান্ হয়ে ভেঙে পড়ছে! যেন কোন আহত দানবের অসংখ্য ক্ষতস্থান দিয়ে রক্তপ্রবাহের মতো সেই পাহাড়ের বিদীর্ণ জায়গাগুলো দিয়ে বেরিয়ে আসছে গরম আগুনের মতো লাভা স্রোত…
মনে হল বর্ষার নদীতে চান করতে নেমেছি। প্রচণ্ড ঝড় উঠেছে, আমার নাক, কান ও মুখ দিয়ে প্রমত্ত বেগে জল ঢুকছে। ভেসে থাকতে পারছি না। আমি ডুবছি, চোখ খোলবার চেষ্টা করলেই ঘোলা জলে সবকিছু মুছে অন্ধকার করে দিচ্ছে। অবসাদে সমস্ত শরীর শিথিল… ঘুমে সমস্ত শরীর ভেঙে পড়ছে দীর্ঘ, ক্লান্ত দিনের শেষে ঘু… ম…
তারপর কখন চোখ খুলেছি জানি না। দেখি একটা খোলা জানালার পাশে শুয়ে আছি। বাতাসে জানালার পর্দাটা অল্প অল্প দুলছে। একটি ছোট টিপয়ে ফুলদানীতে সুন্দর ফুল সাজানো। পরিষ্কার ইংরাজীতে শাসনের সুরে নারীকণ্ঠে কে যেন বলছে:
এখন কিন্তু মোটেই ওঠার চেষ্টা করবেন না, শরীর আপনার ভীষণ দুর্বল।
মাথায় আমার পুরু ব্যাণ্ডেজ, কোনো এক তীব্র ওযুধের গন্ধে সমস্ত ঘর ভরে আছে।
কোথায়? কোথায় আমি?
এটা হার্বার হস্পিটাল।
সংক্ষেপে আমাকে আশ্বস্ত করে মেয়েটি চলে গেল। বোধ করি কঠিন নার্স হবে। কিছুক্ষণ বাদেই নার্সটি ফিরে এলো। সঙ্গে সুশোভনবাবু ও অমরেশ।
এই যে সঞ্জয়! এখন কি রকম বোধ করছো, বাপরে তুমি যা ভাবিয়ে তুলেছিলে। তোমার ছাড়া আমাদের কারো আঘাতই গুরুতর হয় নি।
অমরেশের কপালে ছোট একটা প্লাষ্টার লাগলো। ও বললে: ভাগ্যিস বিদ্যুৎ আমাদের আচ্ছন্ন মস্তিষ্কের চেয়ে দ্রুত কাজ করে তাই, আমাদের বিপদের সঙ্কেত কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে গোয়েলের কাছে পৌঁছে যায়। আমার হাতে সব সময় একটা কর্ড নিয়ে এমার্জেন্সী এলার্মটা বাঁধা থাকতো, পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওপরে খবরগেছে।
হাসপাতালে কদিন কাটিয়ে হোটেলে ফিরেই কোলকাতা যাবার গোছগাছ আরম্ভ কবেছি। কাল সকালের প্লেনেই যাবো। সেদিন রাত্রে ‘চন্দ্রশেখর’ জাহাজে সব অফিসারদের খেতে বলেছি। খাওয়াদাওয়ার পর আমাদের প্রিয় পোর্টিকোতে বসে কফি খাচ্ছি সকলে মিলে। রাত্রি দশটার পর হোটেল এখন নির্জন হয়ে গেছে। আমরা ছাড়া কেউ বোধ হয় জেগে নেই।
সুশোভনবাবুকে জিগ্যেস করলামঃ স্যার সমুদ্রের এ কাহিনী কাকেই বা বলবো, কেই বা বিশ্বাস করবে। তবুও নিজের মনটাকে পরিষ্কার করবার জন্য একটা প্রশ্ন করি: যা আমরা দেখেছি তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কি? বিবর্তনের রাস্তায় কোটি কোটি বছর আগেকার প্রাণীদের ওভাবে টিকে থাকবার উপায় কি?
দুঃখের কথা সঞ্জয়, একটা ডুবন্ত আগ্নেয়গিরির আকস্মিক অগ্ন্যুৎপাতে ওরা ধ্বংস হয়ে গেল। এমন কি আমাদের ক্যামেরার ছবিগুলো পর্যন্ত নষ্ট হয়ে গেল—নইলে আমাদের এই তথ্য পৃথিবীর বৈজ্ঞানিক সমাজে এক দারুণ আলোড়নের সৃষ্টি করতো। প্রায় একশো বছর আগে ইংল্যান্ড থেকে ‘চ্যালেঞ্জার’ জাহাজে চড়ে বিজ্ঞানী দল গভীর সমুদ্রের তলায় যে প্রাণের সাড়া আছে তার প্রমাণ স্বরূপ নানা জাতের বিদঘুটে মাছ সংগ্রহ করেন। তার মধ্যে প্রাগৈতিহাসিক কিছু বিশেষ ছিল না, যদিচ যা তাঁরা এনেছিলেন মানুষের চোখে তা অতি অদ্ভুত ঠেকেছিল অর্থাৎ পরিচিত চৌহদ্দির কিছুই নয়।
আমার মনে হয় সমুদ্রের গভীরে প্রাণীদের বসবাস সময়ের হিসাবে অপেক্ষাকৃত আধুনিক। অগভীর জলে যাদের জন্ম সমুদ্রের তলায় খাপ খাইয়ে নেওয়া তাদের পক্ষে কঠিন। শীতল অন্ধকার আবর্তে অত গভীর চাপে প্রাণী বাঁচে কি করে? অবশ্য আস্তে আস্তে সইয়ে নিয়ে কিছু মাছ সমুদ্রের তলায় বাস করছে বটে কিন্তু তাদের সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য।
অন্যদিকে এমন যদি হয় যে সমুদ্রতলে অপেক্ষাকৃত উত্তপ্ত ও নিম্নচাপের একটা এলাকা অনেকদিন ধরে বজায় রয়ে গিয়েছে, যে সব সামুদ্রিক প্রাণীরা সৃষ্টির সেই আদিম প্রভাতে তার সন্ধান পেয়েছিল তারা সেখানে গিয়ে বংশ পরম্পরায় টিকে থাকতে পারে। ঐ যে ডুবন্ত আগ্নেয়গিরির মধ্যে আমরা ঢুকেছিলাম ঐ এলাকাটা এমনি একটা জায়গা। তবে আমরা বাইরে থেকে বুঝতে পারি নি যে ওর সমস্ত অংশ এখনও সম্পূর্ণ মৃত নয়। অথবা এমনও হতে পারে যে আমরা সমুদ্রতলে এক বিরাট ভূমিকম্পের মধ্যে পড়েছিলাম।
স্যার, ওখানকার জল কি করে অত উত্তপ্ত হল? সত্তর ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড।
এই দ্যাখে… তোমরা তো জানোই যে সমুদ্র এক অতিকায় ইঞ্জিনের মতো। নিরক্ষরেখার কাছ থেকে গরম জল আভ্যন্তরীণ স্রোতে চলে আসছে উত্তর মেরুর দিকে। তারই স্থান ছেড়ে দিতে উত্তরের ঠাণ্ডা জল তলা থেকে উপরে উঠে আসছে। তবে খুব সম্ভব ভূমিকম্পে পৃথিবীর অভ্যন্তর থেকে কিছু সুপারহীটেড জল এসে ওর সঙ্গে মিশেছে তাই অত গরম হয়ে পড়ছিল।
—স্যার, এ রকম জায়গা কি আরো থাকতে পারে?
—হয়তো খুব কমই আছে। সমুদ্রের গভীর অংশ সম্বন্ধে আমরা এত কম
জানি যে আছে কি নেই বলে দেবে কে। কোটি কোটি বছর আগে সমুদ্রের উপর তলার যে সব বাসিন্দারা ধ্বংস হয়ে গেছে তার সামান্য দু-একটি হয়তো এখনও সমুদ্রের নীচে টিকে থাকবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে।
আমাদের গল্পের প্রবাহে হঠাৎ বাধা পড়লো। পেকেজ ডেস্ক ক্লার্কটি এসে সুশোভনবাবুকে খবর দিলে আমেরিকার সঙ্গে টেলিফোনে সংযোগ করা গেছে, উনি উঠে গেলেন।
হু হু করে হাওয়া দিচ্ছে আরব সমুদ্রের ওপার থেকে। আমাদের কারো মুখে আর কোনও কথা নেই। প্রত্যেকেই যেন এই নির্জন বিশ্রামের মুহূর্তগুলো তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছি।
গুড নিউজ অমরেশ! ম্যাসাচুসেটস থেকে প্রফেসর হ্যাগষ্ট্রম পরশুর মধ্যেই এসে পড়ছেন। ওঁরা শিলাকান্থ সম্বন্ধে ভীষণ উত্তেজিত। এখন ওটাকে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। ওটা থেকে যা খবর আমরা পাবো তার মূল্য অসীম।
অনেক রাত হয়ে গেছে সঞ্জয়, তোমাকে তো আবার ভোরে উঠে প্লেন ধরতে হবে। অল দি ক্রেডিট গোজ টু ইউ—ইয়েস মাই বয়।
সুশোভনবাবু, অমরেশ সবাই করমর্দন করে বিদায় নিলো। আমি চিত্ৰার্পিতের মতো বসে রইলাম। আজ রাতে আর কি ঘুম আসবে?
.
প্রথম প্রকাশ: আশ্চর্য!, অগাস্ট, ১৯৬৪
ক্ষণজন্মা লেখকের প্রথম কল্পবিজ্ঞান গল্প। প্রেমেন্দ্র মিত্র পছন্দ করে সম্পাদকীয় দপ্তরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।