লোকান্তরের হাতছানি • নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
বাংলাদেশ নিশি-পাওয়ার গল্প চলতি আছে। সত্যি-মিথ্যে জানিনে। কিন্তু একটা বিচিত্র অভিজ্ঞতার কাহিনী বলি। এ ঘটনা কী করে ঘটল তা আজও আমার কাছে দুর্বোধ্য।
গোদাগাড়ী ঘাট থেকে কাটিহার পর্যন্ত মীটার গজের যে ব্রাঞ্চ লাইন আছে, সে পথে যাঁরা গেছেন, তাঁরা অনেকেই ছোট একটি স্টেশনকে লক্ষ্য করে থাকবেন। স্টেশনটির নামটা বিচিত্র—বুলবুলচণ্ডী। নামের এমন গুরুচণ্ডালী সচরাচর দেখতে পাওয়া যায় না।
যখনকার কথা বলছি, অর্থাৎ বছরদশেক আগে, সেই সময় সবে এই স্টেশনটি তৈরি হয়েছে। এই ছোট টিলার উপর একখানা ওয়াগন তখন একাধারে স্টেশন এবং স্টেশন মাস্টারের কোয়ার্টার। স্টেশন থেকে প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ ফুট নিচে নামলে সমতল মাটি। তার পাশ দিয়ে নদী আর দূরে কাছে শালের বন। গ্রাম অনেকখানি দূরে—যতটা মনে পড়ছে, ক্রোশখানিকের এদিকে নয়। এক কথায় অখণ্ড নির্জনতার ভেতরে একটুকরো নিঃসঙ্গ স্টেশন।
শরতের এক বিকেলে, মালদহ শহর থেকে এই স্টেশনে এসে আমি নামলুম। এখান থেকে চৌদ্দ-পনেরো মাইল দূরে দিনাজপুর জেলার একটা বড় বন্দর আমার গন্তব্যস্থান।
সাধারণতঃ স্টেশনের নীচেই নদীর ধারে বরাবর গোরুর গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে ভাড়াটের প্রত্যাশায়। আজ পরম বিস্ময়ের সঙ্গে দেখি কোনও একখানা গাড়ীর চিহ্ন নেই।
স্টেশন মাস্টারকে জিজ্ঞেস করলুম, “কী মশাই, গাড়ী দেখছি, না যে একখানাও।”
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “আপনি বোধহয় অনেক দিন এ তল্লাটে আসেন নি।”
বললুম, “না, বছরখানেকের ভেতরে আসিনি।”
তিনি বললেন, “তাই জানেন না। গোপালপুরের দিকে তো সোয়ারী গাড়ীতে ক্রমাগত ডাকাতি আর খুন হচ্ছে কয়েকমাস ধরে। রাত করে কোনো গাড়ী আর ওদিকে যায় না। কাল সকালের আগে গাড়ী পাবেন না।”
তাই তো। অত্যন্ত বিপন্ন বোধ করতে লাগলুম। রাতটা এখন আমি কাটাই কোথায়। এই ওয়াগনে? স্টেশন মাষ্টারের পা ছড়িয়ে শোবার মতো জায়গাই এখানে কুলোয় কিনা সন্দেহ। গ্রামে যাব? সেখানে কেই বা আমাকে চেনে—আর কেনই বা আশ্রয় দেবে?
এমন সময় পেছনে কণ্ঠস্বর শুনতে পেলুম, “আরে, ভায়া যে!”
তাকিয়ে দেখি, জগদীশবাবু। আমার দূর-সম্পর্কের আত্মীয় তিনি। আর সবচেয়ে বড় কথা, আমি যেখানে যাব, সেইখানেই তিনি থাকেন—ব্যবসা করেন।
বললুম, “পলাশপুর যাবেন বুঝি?”
তিনি বললেন,“নইলে আর এখানে মরতে এলুম কেন?”
বললুম, “ভালোই হল। কিন্তু গাড়ী তে পাওয়া যাচ্ছে না। যাবেন কী করে?”
তিনি বললেন, “কেন, স্রেফ হন্টনযোগে। রাজী আছো পনেরো মাইল হাঁটতে? তাহলে বেরিয়ে পড়ে আমার সঙ্গে।”
বললুম, “পনেরো-বিশ মাইল হাঁটা আমার অভ্যেস আছে। কিন্তু পথে যে ডাকাতের উৎপাত হয়েছে শুনছি।”
জগদীশবাবু বললেন, “পায়ে-হাঁটা মানুষকে ওরা ধরে না। আর যদি এসেই পড়ে, হাতের আংটি আর ঘড়িটা খুলে দিয়ো। দুচারটে চড়-চাপড়ের ওপর দিয়েই পার পেয়ে যাবে।”
চমৎকার সমাধান! ডাকাতের চড়-চাপড় কখনো খাইনি, কিন্তু সে যে আমাদের ড্রিল মাষ্টারের চড়ের চাইতে আরো কিছু গুরু ভার হবে—সেটা অনুমান করার মতো বুদ্ধি আমার আছে। কিন্তু কী আর করা যাবে। নাস্তিক মানুষ আমি—আপাততঃ বেরিয়ে পড়লুম দুর্গা নাম জপ করতে করতেই।
চৌদ্দ থেকে পনেরো মাইল রাস্তা। পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ ঘন্টার বেশী লাগা উচিত নয়। সুতরাং আশা করলুম রাতে সাড়ে দশটা নাগাদ লক্ষ্যস্থলে পৌঁছে যাবই।
কিন্তু সেই ধু-ধু মাঠের ভেতরে হাওয়া যে কী প্রচণ্ড রূপ নিতে পারে, জীবনে সে অভিজ্ঞতা হল এই প্রথম। উল্টোমুখী বাতাসের ঝাপ্টা যেন বারে বারে পেছন দিকে ঠেলে দিতে লাগল। ঘণ্টায় চার মাইল পেরুনো দূরে থাক, এক মাইল এগোনোই দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াল। সুতরাং সাড়ে দশটায় পৌঁছে যাওয়া তো দূরের কথা—মাইল আষ্টেক আসতেই দেখি ঘড়ির কাঁটা দশটার কাছাকাছি।
এইখানে ছোট একটি হাট আছে—গোপালপুরের হাট তার নাম। খানদশেক চালা, একটি দেশী মদের দোকান আর একটি হিন্দুস্থানী ভূজাওলার “ঝোঁপড়ী” ছাড়া আর কিছু নেই। সপ্তাহে একটি দিন হাট বসে, তাছাড়া বাকী সময়টা হাট-
খোলা শ্মশানের মতো শূন্য হয়ে পড়ে থাকে।
রাত দশটায় দেশী মদের দোকান খোলা থাকার প্রশ্ন ওঠে না। ভূজাওলা তার ঝোপড়ীতে নাক ডাকাচ্ছে। চারদিকে ঝিঁঝিঁর ডাক আর হাটখোলার বিশাল ঝাঁকড়া বটগাছটায় প্যাঁচার আর্তনাদ যেন অন্ধকারটাকে আরো স্তম্ভিত করে রেখেছে।
জগদীশবাবু বললেন, “কী করবে? রাতটা ঘুমিয়ে নেবে নাকি হাটখোলায়?”
“কোথায় ঘুমুব?”
“কেন, একটা চালার নীচে?”
বললুম, “ক্ষেপেছেন? ওই শুকনো লঙ্কার চালায় গোবরের ওপর শুয়ে থাকব? হাঁচতে হাঁচতে প্রাণ যাবে, তার ওপরে পিলপিল করে গায়ে উঠবে গুবরে পোকা। ওসবের ভেতরে আমি নেই। আর আট মাইল যদি পেরুতে পেরে থাকি, বাকী সাত মাইলও ডিঙোনো যাবে একরকম করে। এখন তো হাওয়াও নেই।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে জগদীশবাবু বললেন, “তবে চলো।”
বুঝলাম, ওঁর আর নড়তে ইচ্ছে নেই, কিন্তু আমি ভাবছিলাম, আর ঘণ্টা-তিনেক হাঁটলেই অন্তত একটা নরম বিছানা পাওয়া যাবে। একটাও যদি বাজে, তা হলেও কয়েক ঘণ্টা আরামে ঘুমুবার মতো যথেষ্ট সময় হাতে থাকবে আমার।
বলা দরকার, হাঁটা পথটা আমার চেনা নয়, জগদীশবাবুই দিশারী। তিনি পা বাড়ালেন, আমি তাঁকে অনুসরণ করলুম।
ঝাঁকড়া বটগাছটার তলা দিয়েই আমাদের পথ। সেখান দিয়ে বেরুতে গিয়ে উঁচু একটা শিকড়ে জগদীশবাবু হোঁচট খেলেন। মাথার ওপর আঁতকে চেঁচিয়ে উঠল প্যাঁচা। আমরা পথে নামলুম।
আকাশে চাঁদ নেই বটে, কিন্তু অন্ধকারে চলে চলে তারার আলোতেই পথ আমরা দেখতে পাচ্ছিলুম।
দুপাশের আদিগন্ত মাঠের ভেতর দিয়ে পরিষ্কার জেলা বোর্ডের রাস্তা। শাদা ফিতের মতো চকচক করছে, ভুল হওয়ার কারণ নেই।
কিন্তু দু-তিন মিনিটের মধ্যেই টের পেলুম, আমরা পথ থেকে দূরে সরে গেছি। রাস্তা ছেড়ে দিয়ে অসমতল ধানের আল ভেঙে ভেঙে এগিয়ে চলেছি আমরা।
বললুম, “এ কী হল জগদীশবাবু? আমরা তো পথ দিয়ে চলছি না।”
জগদীশবাবু বললেন, “ঠিক আছে। পাশেই রাস্তা আছে, এখুনি পাওয়া যাবে।”
কিন্তু পাওয়া গেল না। ঘণ্টা-তিনেক হাঁটার পরে পরম বিস্ময়ের সঙ্গে আমরা আবিষ্কার করলুম একটা বেশ বড় পুকুরের সামনে এসে আমরা দাঁড়িয়েছি। তার তিনদিকে বেত আর শোলার বন বাতাসে শাঁই শাঁই শব্দ করছে আর জ্বলছে অসংখ্য জোনাকি। দূরে দূরে কতকগুলো জঙ্গল, তার ভেতর দপ দপ করে
আলেয়া জ্বলছে—জনমানুষের চিহ্ন নেই।
এ কোথায় এলুম! আমরা মুখ-চাওয়া-চাওয়ি করলুম।
পেছনে তাকালুম। অন্ধকারে দৃষ্টিটা অভ্যস্ত বলেই দেখতে পেলুম, দিগন্তে পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে সেই হাটখোলার বড় বটগাছটা পাহাড়ের চুড়োর মতো দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু ঠিক রাস্তায় চললে গাছটা পূর্ব-দক্ষিণে থাকার কথা। তার মানে আমরা সম্পূর্ণ উল্টো পথে চলেছি।
জগদীশবাবু বললেন, “দিনে-রাতে অনেকবার এ পথে চলেছি, এমন বোকার মতো ভুল তো কখনো করিনি। যাক, যা হওয়ার হয়েছে। চলো আবার গোড়া থেকে শুরু করি।”
আমরা বটগাছটার দিকে ফিরে তাকালুম। কিন্তু বিচিত্র এই আলের পথ। যতই চলি, সেটা যেন বৃত্তাকারে ঘুরতে লাগল। ঘণ্টাখানেক এলোপাথাড়ি হাঁটার পরে আমরা আবিষ্কার করলুম, এতক্ষণ আলের কন্টিকারীতে পা ক্ষত-বিক্ষত করতে করতে আমরা এই পুকুরটাকেই প্রদক্ষিণ করেছি এবং যথাকালে সেই অজানা কালো পুকুরটার ধারে—সেই জোনাকজ্বলা বেত-বনের পাশেই এসে দাঁড়িয়েছি।
জগদীশবাবু হাঁপাচ্ছিলেন। হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমাদের ভূলায় ধরেনি তো?” শুনে সর্বাঙ্গ আমার অমানুষিক ভয়ে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। মনে হতে লাগল দূরের আলেয়াগুলো যেন কাদের জ্বলন্ত চোখ, বেতবনের মধ্যে যেন একরাশ কালো মাথা গুঁড়ি মেরে বসে আছে। আমাদের ঘাড় মটকে ঐ পুকুরটার মধ্যে তারা পুঁতে দেবে।
কিন্তু ভয়টা মুখে প্রকাশ করা চলে না, ধমক দিয়ে বললুম, “কী যা-তা বলছেন। ওসব ভূলা-টুলা একদম নন্সেন্স। আলোর রাস্তায় এ-সব গোলমাল হয়ই। চলুন, আবার বটগাছের দিকেই যাওয়া যাক।”
কন্টিকারীর কাঁটায় পা তখন আর কিছুই নেই। জুতো তো আগেই হাতে নিয়েছি। এখন মনে হচ্ছে হাঁটুদুটো যেন ছিঁড়ে পড়ছে—যন্ত্রণায় টনটন করছে কোমর। কিন্তু এই আলের ওপর কোনোমতেই বসে পড়া চলে না। কারণ, এ অঞ্চলের আল-গোখরো অসাধারণ বিষাক্ত।
প্রবল ইচ্ছা-শক্তির জোরেই বোধহয় শেষ পর্যন্ত আমরা আবার হাটখোলায় পৌঁছে গেলাম। বটগাছটার তলা দিয়ে শাদা ফিতের মতো উজ্জ্বল দীর্ঘপথ পড়ে আছে। এমন স্পষ্ট এতবড় রাস্তাটা আমরা হারালাম কী করে।
আমরা পথে পা দিলুম।
কিন্তু আশ্চর্য। দু-পা এগোতেই কে যেন তলা থেকে রাস্তাটা আমাদের টেনে
সরিয়ে নিলে। অসহায়ভাবে আবিষ্কার করলুম, কখন আমরা আবার সেই আলের ওপরেই উঠে পড়েছি। আর এমনি ভাবেই কন্টিকারীর কাঁটায় ক্ষত-বিক্ষত হতে হতে অজানা পথ দিয়ে গিয়ে চলছি।
যা অনুমান করেছিলুম, তাই হল! ঘণ্টাখানেক পরেই দেখি ঠিক সেইখানেই এসে আমরা দাঁড়িয়েছি। এই আদিগন্ত মাঠের ভেতর পথ ভুল করে করে ঠিক একটি জায়গাতেই এসে পৌঁছোচ্ছি আমরা। কালো একটা পোড়ো পুকুর—জোনাকি শাঁ শাঁ বেত আর শোলার বন-দপ্দপে একরাশ আলেয়ার ব্যঙ্গের হাসি আমাদের চারদিকে।
সীমাহীন ক্লান্তিতে আর নিরুপায় আতঙ্কে সেইখানে কিছুক্ষণ আমরা পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। এবারে যেন স্পষ্ট মনে হল—এই আমাদের শেষ, ওই কালো জলেই প্রতীক্ষা করছে আমাদের মৃত্যু।
জগদীশবাবু প্রায় নিঃশব্দ গলায় বললেন, “চলো, হাটখোলাতেই ফিরে যাই।”
জবাব দেবার কিছু ছিল না। কী ভাবে কী অসহ্য শারীরিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে আমরা আবার বটতলায় ফিরে এলুম, তা অনুভব করার শক্তি পর্যন্ত তখন হারিয়েছি।
যখন হাটখোলায় এসে পৌঁছুলাম, রাত তখন তিনটে। নীরবে আমরা একটা চালার তলায় গড়িয়ে পড়লুম।
ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই ভোরের আলো চারদিক স্পষ্ট করে তুলল। প্রসারিত উজ্জ্বল পথ—ভুল হওয়ার কারণ নেই। এবার আর ভুল আমাদের হল না।
সেই পুকুরটার সন্ধান আমি পাইনি। ফেরার সময় দিনের বেলা হাটখোলায় গাড়ী থামিয়ে অনেক খুঁজে দেখেছি পুকুরটাকে। কিন্তু কোথাও তার চিহ্ন নেই—কালো রাত্রিতে সে কালো অন্ধকারেই হারিয়ে গেছে, হয়তো বা।
.
প্রথম প্রকাশ: ফ্যানট্যাসটিক, সেপ্টেম্বর, ১৯৮৩