জয়পুরের সেই অদ্ভুত ট্যুরিস্ট • দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
ট্যুরিস্ট ব্যুরোর চাকরি নিয়ে প্রথম আমার কর্মক্ষেত্র হল জয়পুর। জয়পুরে মাত্র মাস তিনেক ছিলাম—তারপরেই আমাকে বদল হয়ে কোলকাতায় চলে আসতে হয়েছিলো। কোলকাতায় আজ বছর পাঁচেক হতে চললল, কিন্তু স্বল্পদিনের মেয়াদ হলেও জয়পুরের কথা আমি এখনো ভুলতে পারিনি। আমার চাকরি জীবনের প্রথম কর্মক্ষেত্র বলে তো বটেই—তা ছাড়া এমন একটি অভিজ্ঞতা জয়পুরে আমি একদিন সঞ্চয় করেছিলাম যে ভাবতে বসলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে আজো—ভয় পাই—এবং সত্যি কথা—আমার অভিজ্ঞতার যে-ঘটনা ঘটতে দেখেছিলাম তার কোন ব্যাখ্যা ও সম্ভাব্যতা আজো আমি খুঁজে পাইনি। বলতে গেলে এরকম অভিজ্ঞতা মানুষের জীবনে একবারই মাত্র আসতে পারে—আজ এখন এখানে যে ঘটনার কথা আপনাদের জানাচ্ছি, আপনারা যদি তার কোন ব্যাখ্যা ও কার্যকারণ-সূত্র আবিষ্কার করতে পারেন, অনুগ্রহ করে আমাকে জানাবেন। ‘আশ্চর্য!’ পত্রিকার ঠিকানায় বা সম্পাদকের দপ্তরে চিঠি দিলে, আপনাদের চিঠি পেতে আমার দেরী হবে না।
তখন গ্রীষ্মকাল। বলতে গেলে রাজস্থানের বিস্তীর্ণ ধূ ধূ মরুভূমি অঞ্চলের জন্যে এই দিকে গরম ও উষ্ণ তাপ প্রবাহের মাত্রা খুব বেশি। সেবার গরমটাও খুব অস্বাভাবিক রকম বেশি পড়েছিল। টুরিস্ট ব্যুরোতে দু’টো ফ্যান খুলে বসে থাকলেও স্বস্তি নেই। জানালায় জল-ছিটানো খসখসের পর্দা। তবুও দমকা হাওয়া থেকে থেকে তপ্ত আগুনের ভাপ ঘরে ঢুকছিল। বাইরে দারুণ লু বইছে। এইরকম গরমের দিনে জয়পুরের ট্যুরিস্ট ব্যুরোতে টুরিস্টদের আগমন একেবারেই হয় না বললে চলে। টুরিস্টরা এখানে এসে কি দেখবে? হাওয়া মহল, নোংরা সরু সরু রাস্তাঘাট, গলিঘুঁজি, টাঙা, রাজস্থানী মেয়েদের উজ্জ্বল ঘাগরার শোভাযাত্রা, রুপোর গহনা, ভারী ভারী পায়ের মল, নাকের নথ, গলার হাঁসুলি—এইসব। আর এ ছাড়া থাকলই বা কী! উঁচু নীচু পাহাড়ী মরুভূমি, বালির ঝড়, উট, রাজপুত রাজাদের কয়েক শতাব্দীর পুরানো পরিত্যক্ত দুর্গঘর, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড প্রাকার, আর কোনো কোনো ক্ষয়িষ্ণু খানদানী বংশে বিচ্ছিন্ন কিছু কাংড়া কলমের ছবির দীন সংগ্রহ। এসব দেখার ইচ্ছে হলে যে কোনোদিন হেমন্তে বা শীতে আসা যায়। তখন জার্নি ও ভ্রমণ দুটোই ইন্টারেস্টিং হবে। তাছাড়া বিদেশীরা রাজস্থানের গরম খুব একটা সহ্য করতে পারেন বলে শুনিনি। তার ওপরে আছে গরমের সময় প্রচণ্ড জলকষ্ট। অগভীর ইদারায় নোংরা জল আন্ফিল্টারড্ অবস্থায় দেখেই তো বিদেশীদের মূর্ছা যাবার উপক্রম। সুতরাং এসব জেনেই ট্যুরিস্ট ব্যুরোর আপাতশীতল কক্ষে দিবানিদ্রার আয়োজন করছিলাম। ভাত ঘুম নয়, রুটি ঘুমটা যে খুব রমণীয় হবে না জানা ছিল—কিন্তু একেবারেই যে হবে না; উপরন্তু প্রচণ্ড রৌদ্রের মধ্যে শরীর ও চেহারা নষ্ট করে বাইরে বেরুতে হবে তা’ কী জানা ছিল! সবে দুটো চোখের পাতা এক করেছি ভারী বুটজুতোর শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো। যিনি ঘরে এলেন তাঁকে প্রথম দর্শনেই বুঝতে দেরী হল না যে, এক অদ্ভুত সাধারণ-দশবিশটা মানুষের থেকে স্বতন্ত্র একজন মানুষ। ছন্নছাড়া ভবঘুরে কিংবা মামুলী ধরনের পাগল হওয়াও বিচিত্র নয়। রোদে-পোড়া মুখ, ঘামে স্যাঁতস্যাঁত করছে, রুমাল দিয়ে ঘাম মুছে নেওয়ার এতটুকুও ইচ্ছে হল না, এখন মনে হয় আত্মভোলা মানুষটি রুমালের ব্যবহার জানতেন কিনা সন্দেহ। ক্লোজক্রপড্ চুল, ঘামে জবজব করছে সমস্ত শরীর—সিল্কেন চেক বুশ শার্ট, বহু ব্যবহারে জীর্ণ টেরিকর্ডের ইয়াংকি লংপ্যান্ট—আর পায়ে ততোধিক জীর্ণ মিলিটারী বুট জুতো। বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে। ভদ্রলোকের নাম এখনো মনে আছে, টমাস ব্রিউ। অনেক মানুষের ভিড়ে ঐ মানুষটির চেহারা এখনো আমার মনের মধ্যে থেকে হারিয়ে যায়নি। আগেই বলেছি কোথায় যেন ওঁর একটা স্বাতন্ত্র ছিল—তাই ভুলতে পারি না।
বিদেশী ভদ্রলোক ইংরাজীতে ভাঙা ভাঙা কথা বলা শুরু করেছিলেন। ওঁর দাদা বৃটিশ মরিশাস দ্বীপ থেকে কাঁচালঙ্কা ও অধুনালুপ্ত গোডোপাখির চালান নিয়ে প্রায়ই ভারতবর্যে আসতেন। বছরে তিনবার কখনো বা চারবারও তাঁকে ইণ্ডিয়ায় আসতে হতো। এমনই একবার মাল-জাহাজে চালান তিনি ভারতবর্যে এনেছিলেন। প্রথমে মাদ্রাজ, সেখান থেকে ওয়ালটেয়ার, কোয়েম্বাটুর, পরে উত্তরপ্রদেশের নৈনিতালে কিছু কিছু চালান খালাস করে তিনি এসেছিলেন জয়পুরে। জয়পুরে তিনি তাঁর আমদানী দ্রব্যের অবশিষ্টাংশ বিক্রী করতে পেরেছিলেন বলে শোনা যায়। কিন্তু জয়পুর থেকে তাঁকে আর কেউ দেখতে পায়নি। উনি কোথায় গেলেন, দেশে ফিরলেন, নাকি জয়পুর থেকে কাছাকাছি কোনো গ্রামের দিকে চলে গেলেন, সেখানেই এখনো বসবাস করছেন কিনা তা কেউ বলতে পারে না। আজ তিন বছর তাঁর খবর পাওয়া যাচ্ছে না। ভদ্রলোক সম্পূর্ণ অজ্ঞাত কারণেই নিরুদ্দিষ্ট নিখোঁজ। মরিসাস দ্বীপে তার নিজের বলতে এই ভাই, ছোটো খামার বাড়ী আর কিছু চষা জমি। ভাই আজ তিন তিনটি বছর ভাইয়ের জন্যে অপেক্ষা করছে। শেষে আর থাকতে না পেরে জমিজমা খামারবাড়ী সব বিক্রী করে ইণ্ডিয়ার পাড়ি জমানোর টাকা জোগাড় করেছে—এবং সোজা এসে উঠেছে জয়পুরে। কারণ সে শুনেছিলো এখানেই তার দাদাকে শেষ দেখা গিয়েছিলো। বাজারের পাইকারী ব্যবসাদারেরা যারা ওঁর দাদা ভিলানের কাছে মালপত্র কিনতো ওঁকে বলেছে যে উনিশে মে-র পর হঠাৎ ভিলানকে কেউ আর খুঁজে পায়নি—এমনকি ভদ্রলোক তাঁর পাওনা টাকা পয়সা তুলতেও বাজারে আসেননি। ক্যালেণ্ডারের দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠলাম—আজ আর এক উনিশে মে। এমনি একটি দিনে আমার সামনে দণ্ডায়মান বিদেশী ঐ ভদ্রলোকের দাদা রহস্যজনক ভাবে নিরুদ্দিষ্ট হয়ে গেছেন—আর আজ ছোটো ভাই এতদূরে ছুটে এসেছে। চঞ্চল হয়ে-হারিয়ে যাওয়া দাদাকে যদি আবার ফিরে পাওয়া যায়, যদি জানা যায় দাদা কি বেঁচে আছেন—বেঁচে থাকলে কোথায় আছেন, কেমন আছেন, আর তিনি কি একদিনের জন্যেও তাঁর প্রিয় সবুজ সোনালী সেই দ্বীপদেশে ফিরে যেতে চান না!!
আমি একটু মুস্কিলে পড়লাম। ট্যুরিস্ট ব্যুরোতে যারা আসেন তাঁরা সচরাচর গাইড সংগ্রহের জন্যেই আসেন। এই দেশের দর্শনীয় জায়গাগুলো দেখাতে এবং এক একটি জায়গার ঐতিহাসিক পৌরাণিক কিংবা লৌকিক উপাখ্যান ও কিংবদন্তীগুলো বিদেশীদের সহজ কথায় বুঝিয়ে দিতে গাইডরা সচরাচর তাদের সাহায্য করে থাকেন। এই ভদ্রলোক গাইড সংগ্রহের জন্যেই এসেছেন—কিন্তু কোনো দর্শনীয় জায়গা ঘুরে দেখার ইচ্ছে বা সময় ওঁর নেই। ওঁর ধ্যান-ধারণা শুধু দাদাকে বের করা। তাই এই গ্রীষ্মের প্রচণ্ড সূর্য উত্তাপ অগ্রাহ্য করেও তিনি জয়পুরের টুরিস্ট ব্যুরোতে ছুটে এসেছেন। একজন বিলায়েবল গাইড নিয়ে তিনি জয়পুরের পথ থেকে পথে—এবং তাঁর বাইরের ঈষৎ বিস্তীর্ণ মরুভূমি অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতে চান—যদি দীর্ঘ তিনটি বছর পর আজ কোনো গতিকে দাদার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, যদি দেখা হয়, তাকে জিজ্ঞেস করবেন তুমি এখানে কি পেয়েছে, তোমার এখানে থাকার দরকার কি? আমি বললাম, এই ব্যাপারে আপনি তো পুলিশের সাহায্য নিতে পারেন। মিসিং পার্সনসদের ব্যাপারে পুলিশ আপনাকে যথেষ্ট খোঁজ খবর দিতে পারে, এবং সেটাই খুব নির্ভরযোগ্য। পুলিশের সাহায্য নিতে টমাস রাজী নন। ওঁর ইচ্ছা, নিজেই দাদাকে খুঁজে বের করা—কিন্তু এই দেশটার কোন কিছুই তো জানা নেই—সবকিছুই তো ওঁর অচেনা—আর তাই একজন উৎসাহী ইয়ং গাইড ওঁর দরকার। আমার প্রোগ্রাম রেকর্ড করিয়ে ট্যুরিস্ট ব্যুরোর বাইরে যখন এলাম তখন ঘড়িতে চারটে। বিকেলবেলা। কিন্তু গরমের কি কমতি আছে? আর তখনো কী রোদ! গায়ের চামড়া পুড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। আমরা একটা টাঙা নিলাম।
‘আমার দাদা ব্যবসায়ী মানুষ হলেও খুব খেয়ালী মানুষ ছিলেন। কেমন যেন
অন্যমনস্ক হয়ে যেতেন। একা একা কী সব ভাবতেন। আর তেমনই নিঃসঙ্গ জ্যোৎস্নায় সমুদ্রতীরে বেড়াতে ভালবাসতেন। বালির ওপর দাদার ছায়া পড়তো। দীর্ঘ সুন্দর। সে সময় দাদাকে খুব রহস্যময় মনে হতো। প্রাচীন কালের মহান্ মুনিঋষিদের সঙ্গে তুলনা করতে ইচ্ছে হতো।’
এই টমাস নামক ভদ্রলোকটিকে স্মৃতিচারণায় পেয়েছে। আমাদের টাঙাও যথারীতি এগিয়ে চলেছে। শহরের প্রধান প্রধান রাস্তার দু’একটি পরিক্রমা শেষ হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। ওঁর চোখ কিন্তু রাস্তার দিকে। দুপাশের চলমান অনেক মানুষের ক্লান্তিকর ভিড়ের মধ্যে পরিচিত প্রিয় একজন মানুষকে খুঁজে পেতে চাইছে।
‘স্প্যানিশ জিপস আর অ্যারাবিয়ান টিউন ছিল দাদার প্রিয়। লোকসঙ্গীত প্রাণ দিয়ে শুনতেন। কখনো কখনো বলতেন, শুনতাম, লোকসঙ্গীত থেকে এখনো অনেক বৈচিত্র্যময় সঙ্গীতের জন্ম হতে পারে। স্কুল কলেজের শিক্ষা দাদার বিশেষ ছিলো না। কিন্তু কত দেশের সাহিত্যই যে পড়তেন। আমার মনে পড়ে টমাস মান দাদার ভালো লাগতো। কবিদের মধ্যে প্রিয় ছিলেন গটফ্রীড বেন। কোন্ কবিতাটা দাদা খুব পড়তো জানেন? ‘একটি শব্দ’। দাদাকে কতোবার ঐ কবিতাটা নিজের মনেই আবৃত্তি করতে দেখেছি। নিজে কবিতা আবৃত্তি করে যেন নিজেকেই শোনাচ্ছেন।’
‘একটি শব্দ’ আমিও পড়েছিলাম। বাংলা অনুবাদটাও এত ভালো লাগে। গোটা কবিতাটাই আমার মনে আছেঃ
একটি শব্দ, বাক্রীতি এক, শূন্য থেকে
বিজয়ী জীবন উত্থিত, উদ্দীপ্ত বোধি,
সূর্য স্তব্ধ, মূক দিগন্ত, সবই একে
ঘিরে ঘিরে দেয় শক্তি, এবং সুসংহতি,
শব্দ, রশ্মি, আকাশবিহার, ফুলকি আলোর
অগ্ন্যুচ্ছ্বাস, নক্ষত্রের আভাস, জ্বলে,
তারপরে ফের গভীর গভীর দিনান্ত ঘোর,
আর আমি এই সঙ্গবিহীন ভূমণ্ডলে॥
জয়পুরের এই রাস্তায় প্রায় পড়ন্ত ম্লান এক বিকেলে একজন অচেনা মানুষ, যাকে আমি কোনদিন দেখিনি তার সম্বন্ধে আমার ধারণা হল সত্যি সত্যিই মানুষটি খুব একা ছিলেন, নিঃসঙ্গ—অনন্ত সৃষ্টিলোক এবং নিরন্তর শিল্পমণ্ডলকে তিনি নিরুচ্চার বেদনায় ভালোবাসতেন, খুব নিজের মনে করতেন, আর তাই গটফ্রীড বেনের ঐ কবিতায় তিনি পেয়েছিলেন নিজের বিষন্নতার প্রতিচ্ছবি—অখ্যাত মরিসাস দ্বীপের ততোধিক অখ্যাত ব্যথাতুর মলিন এক মানুষের যন্ত্রণার মানচিত্র ঐ কবিতা যা আমাকে ঐ মুহূর্তে মানুষটি সম্বন্ধে অসীম শ্রদ্ধা জাগাচ্ছে।
‘আর একটা কথা আপনাকে বলা হয়নি’—টমাস ব্রিউ বললেন, ‘দাদা খুব ভালো ছবি আঁকতেন। অবাক হয়ে যাবেন শুনলে রঙ তুলি ক্যানভাস কিংবা কোনো কাগজ-কলম তিনি ব্যবহার করেননি। বলতে গেলে ছবি আঁকার কোন সরঞ্জামই দাদার ছিলো না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে, তাঁর সেই সুন্দর সুন্দর ছবিগুলোকে রক্ষা করা আমাদের পক্ষে কোনক্রমেই সম্ভব ছিলো না।’
আমি ব্রিউয়ের দিকে তাকালাম। ব্রিউ স্মৃতিচারণার মধ্য দিয়ে হারানো স্নেহের মানুষটিকে কিছুক্ষণের জন্যে ফিরে পেতে চাইছেন। ওঁর আত্মমগ্ন উচ্চারণ আমাকেও স্পর্শ করেছে।
‘দাদা ছবি আঁকতেন, কী আশ্চর্য জানেন—সমুদ্রতীরের বালির জমিতে। ছড়ানো বেলাভূমিতে বিকেলবেলায় তিনি ছবি আঁকা আরম্ভ করতেন, আর কখন অন্ধকার এসে আকাশ এবং সমুদ্রকে একটা অলৌকিক কালো চাদরে মুড়ে দিয়ে যেতো তিনি বুঝতেও পারতেন না। ততক্ষণে ওঁর ছবি আঁকা শেষ হয়ে যেতো। কোন ছবিই অসম্পূর্ণ থাকতো না।
‘অনেক বিখ্যাত ছবির প্রতিলিপিও তিনি তৈরি করতেন। আর ওই বিষয়ে ওর দক্ষতা ছিলো অসাধারণ। সাগালের ‘এ্যাট ডাস্ক’, গগাঁর ‘মেটারনিটি’, পিকাসোর ‘নুয়েণিকা’ ‘গার্লস’, ডালির ‘ল্যাণ্ডস্কেপ’—এসব তিনি কতবার আঁকতেন আর মুছে ফেলতেন। ছবিগুলো সমুদ্র সৈকতে একটা আলাদা ডাইমেনসন পেয়ে যেতো। আর, দাদা নিজের ইমাজিনেশনে যেসব ছবি আঁকতেন তারও তুলনা মেলা ভার। অনেক সময় ব্লেক, স্যাণ্ডবার্গ, হোল্ডারলিন, হিমেনেৎ, উনগারেডি, ভালেরি, ক্লোদেল উইলিয়ামস এঁদের কবিতা থেকে ছবির বিষয়বস্তু সংগ্রহ করতেন। আমার স্থির বিশ্বাস, ছবিগুলো যদি ক্যানভাসে আঁকা হতো—এক একটি অমূল্য সম্পদ বলে গণ্য হতো। কিন্তু ক্যানভাসের চার কোণের সীমাবদ্ধ জায়গায় ছবি আঁকায় ছিলো দাদার অনিচ্ছা বলতে গেলে ক্যানভাসকে তিনি ঘৃণা করতেন।’
টমাস ব্রিউয়ের মুখে শেষ বিকেলের এক ফালি নিস্তেজ আলো এসে পড়েছে। এক ধরনের অস্থির উজ্জ্বলতা, যা বেশীক্ষণ স্থায়ী হয় না—ওঁর চোখের ওপর, কপালে, গালের অংশে। বিকেলের এই তির্যক আলোয় যে মানুষটি আমার পাশে চিন্তিত, নিয়তিগ্রস্ত মানুষের মতো বসে আছে—তার অতীত বর্তমান সম্বন্ধে আমি কতটুকু জানি!
‘বিকেলের আঁকা ছবি রাতের ঢেউ নিমর্মভাবে মুছে দিয়ে যেতো। এ ছিলো রোজকার নিয়ম, নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এই ঘটনা দেখে দেখে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। উদ্বেল দুরন্ত ঢেউ দাদার সব ছবিকে নিয়ে গেছে—দাদা আবার পরের দিন ছবি এঁকেছেন। যেন জানতেন নির্লিপ্ত ঢেউ হচ্ছে ছবিগুলোর নিয়তি, যেন জানতেন ঢেউ এসে সব মুছে দিয়ে যাবে। তার ছবি আঁকার সমস্ত পরিশ্রম যে রাতের ঢেউয়ের অত্যাচারে বৃথাই অপব্যয়িত হয়—তার জন্যে দাদার কোন দুঃখ বা হা-হুতাশ ছিলো না—হয়ত তিনি ভাবতেন পৃথিবীর কিছুই থাকে না, কিছুই স্থায়ী হয় না।’
‘মিঃ ব্রিউ, ঘণ্টাখানেক শহরের সমস্ত রাজপথই আমরা ঘুরে দেখলাম। আপনার দাদাকে আমি খুঁজে পাইনি। তিন বছর আগে যিনি হারিয়ে গেছেন, তাঁকে হয়ত এভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাদের আন্তরিক চেষ্টাও ব্যর্থ হতে বাধ্য। আপনি বরং সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিন, পুলিশের সাহায্য ও পরামর্শ গ্রহণ করুন। পুলিশের হেল্পিং হ্যাণ্ড আপনি সব সময় আশা করতে পারেন। হয়ত ভারতবর্ষে আপনাকে কিছুদিন থেকে যেতে হবে। আজকে এখানে সামান্য একজন গাইডের কয়েক ঘণ্টার সহায়তা ও গুড উইল কিভাবে আপনাকে আপনার দাদার সংবাদ এনে দিতে পারে?’ আমি মনে মনে এবার একটু অসন্তুষ্ট হলাম। টমাস ব্রিউ ওঁর দাদাকে খুঁজে বের করার জন্যে যে উপায় অবলম্বন করেছেন, তা যে আদৌ কার্যকরী হবে না, সে বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
আমি ব্রিউয়ের দিকে তাকালাম। বেচারা হতাশায় প্রায় ভেঙে পড়েছে দেখে আমার কষ্ট হল। ব্রিউয়ের জন্যে আমার সমবেদনা উৎসারিত হল।
‘আমি ইণ্ডিয়ার সমস্ত সী বিচ ও রিসর্টগুলো ঘুরে দেখতে চাই—তার আগে আশেপাশের মরুভূমি অঞ্চলগুলোতেও আমাকে যেতে হবে।’
‘শহরের বাইরে মাইল খানেকের মধ্যেই ছোট একটা মরুভূমি আছে। চলুন, বেলা বেশী নেই, আপাতত ওখানেই যাওয়া যাক্। আমরা সন্ধ্যের মধ্যেই ফিরতে পারবো, পরে আপনি জয়পুর থেকে দূরে মরু অঞ্চলে যাওয়ার সুযোগ পাবেন।’ আমার কাজ নয় এইভাবে নিরুদ্দিষ্টের সন্ধানে ঘুরে বেড়ানো। কিন্তু ব্রিউয়ের কথা ভেবে ওকে এই বিদেশে-বিভূঁইয়ে একা ছেড়ে দিতে ইচ্ছে হল না।
আমরা একটা চটির কাছে গিয়ে টাঙা থেকে নামালাম। ওই টাঙাতেই আবার জয়পুরে ফিরে যাবো। টাঙা আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবে। পশ্চিমে সূর্য ঢলে পড়েছে। পোড়া মানুষের দগ্ধ ঝলসানো কর্কশ চামড়ার মতো আকাশের রং। খুব অল্প অল্প হাওয়া দিচ্ছে। হাওয়াতে এখনো উষ্ণতার আমেজ। একটা ছোট ফণিমনসা কাকটাসের ঝোপ পাশে রেখে আমরা সোজাসুজি পশ্চিমের বালির পাহাড়ের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম।
পাশেই একটা পুরানো পরিত্যক্ত কেল্লা। বুরুজ ও কেল্লাপ্রাচীর। বেশ খানিকটা
বালির জায়গা জুড়ে কেল্লাবুরুজ ও প্রাচীবের অদ্ভুত লম্বা এক ছায়া পড়েছে। প্রাগৈতিহাসিক অতিকায় জন্তুর কঙ্কালের মতো ছায়াটা পড়ে আছে। ইতস্তত দু’ একটা কাঁটা গাছ থেকে শেষ আলোটুক সরে গেছে কখন। এই মুহূর্তে আমাদের নিজেদের খুব বিষণ্ণ নীরব নির্জন বলে মনে হল। বিশাল, বিস্তৃত প্রকৃতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমাদের অস্তিত্ব যে কত ছোট আমরা উপলব্ধি করলাম। আমরা অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। বিষণ্ণতা আমাদের মধ্যে একটা সিল্যুয়েট মূর্তি পাচ্ছিল।
কিন্তু একি? আমার পাশে টমাস নেই! ও কেন সামনের দিকে ছুটে যাচ্ছে? আর সামনে সূর্যের আড়াআড়ি মরুদিগন্তের বিস্তীর্ণ এলাকার দিকে চোখ পড়তেই আমার সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো! এবড়ো-খেবড়ো বালির জমিতে প্রহর শেষের স্নান সূর্যের আলোয় একটি বৃদ্ধকল্প মানুষ পরম নিষ্ঠায় বড়ো বড়ো ছবি এঁকে যাচ্ছেন। কে উনি? উনিই কি টমাসের দাদা? সমুদ্রের বেলাভূমিতে নয়, মরুভূমির উষর ধু-ধু জমিতে আঁকা তাঁর জীবন শিল্পের সঙ্গে পারমার্থিক এক খেলা শুরু করেছে, জীব-ধরিত্রীতে অজস্র জন্মচক্র পরিক্রমা করেও যে খেলার শেষ নেই, যে খেলার প্রকৃতি তাঁকে তাবসর নেবার সুযোগ দিচ্ছে না।…কিন্তু আমি এখন কোথায় দাঁড়িয়ে আছি? পায়ের নিচের জমির দিকে চোখ পড়তেই আমি কেঁপে উঠলাম। …ঠাণ্ডা একটা স্রোত রক্তের শিরা উপশিরায় বয়ে গেলো। আমি দাঁড়িয়ে আছি সাগালের ‘অ্যাট ডাস্ক’ ছবিটির প্রতিলিপির ওপর। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছবির বাইরের অংশে খোলা বালির ওপর দাঁড়াবার চেষ্টা করলাম। আমার জুতোর বাবার সোলের দাগ ছবির গায়ে কয়েকটা ধারালো ছুরির নিষ্ঠুর দাগের মতো দপ্দপে হয়ে জেগে রইলো। কিন্তু একি? যেখানে দাঁড়ালাম সেখানেও আর একটা ছবি! আমরা কখন ছবির সাম্রাজ্যে এসে উপস্থিত হয়েছি বুঝতে পারিনি। জুতোর সোল দিয়ে এইসব শ্রেষ্ঠ ছবির নিদর্শনগুলোকে অপমান কিংবা পদদলিত করার অধিকার আমার নেই। আমি পাপবোধ ও বিবেক দংশন অনুভব করলাম। আমি পালিয়ে আসার চেষ্টায় দৌড়ানো শুরু করলাম। ভূত দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে পালিয়ে আসার মতো অবস্থা হল আমার। আর বিস্ময়ে আতঙ্কে আমি লক্ষ্য করলাম এতক্ষণ আবার দাঁড়িয়েছিলাম সাগালের পাশের ছবি রুবেক্সের ‘দা ডেড্ ক্রাইষ্ট’ ছবিটির ওপর। গ্রামের চটি লক্ষ্য করে একটানা অনেক দৌড়ানোর ফলে হাঁপানি এলো। প্রায় হোঁচট লেগে পড়ে যাচ্ছিলাম। আমার ট্রাউজার্সের অনেকটা ছিঁড়ে গেলো। দারুণভাবে ঘেমে যাচ্ছি, হাত-পা থরথর করে কাঁপছে—আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। পিছনের দিকে তাকাতে সাহস হচ্ছিল না। ব্রিউয়ের কথা সম্পূর্ণ ভুলে গেছি তখন। আমি তখন নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত। মোট কথা, কতক্ষণ পরে জানি না, মরুভূমির দিকে যখন ফিরে তাকালাম, দেখলাম—বিকেলের অন্তিম আবছা আলোয় টমাস হাজার হাজার ছবির ওপর দিয়ে সেই রহস্যময় অলৌকিক শিল্পীকে দু’টি সবল হাতে জড়িয়ে ধরবার জন্যে এগিয়ে যাচ্ছেন আর সেই ক্ষমতাবান শিল্পী বয়সের ভার অগ্রাহ্য করে কত সহজেই ওর কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছেন। টমাস তাঁর ধরাছোঁয়াও পাচ্ছেন না। আর চঞ্চল উদ্ৰান্ত টমাসের গোড়ালির আঘাতে প্রতিটি ছবির শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। সেই দৃশ্য কী করুণ, কী ভয়ঙ্কর! কোন বর্ণনায় সম্ভব নয়। ঘটনার যথাযথ ছবিটি তুলে ধরা। আমি চীৎকার করে উঠলাম—‘টমাস, ডিয়ার টমাস, ছবিগুলো নষ্ট করবেন না; আমার কথা শুনুন, প্লিজ কাম ব্যাক, প্লিজ… টমাস…।’ কিন্তু কে কার কথা শোনে। টমাস তখন উন্মাদ; কিংবা আমার চীৎকার ও হয়ত শুনতে পায়নি। শোনার মতো কান তখন ওর ছিল না। আমার বুঝতে দেরী হল না যে, টমাস মরিসাস দ্বীপ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে, এখানে এই মরুপ্রান্তরে ওঁর দাদাকে খুঁজে পেয়েছেন। ছবিগুলো ওঁর কাছে ধর্তব্য নয়, ছবি যিনি আঁকেন সেই মানুষটিকে ওঁর প্রয়োজন। অনেকদিন পরে যখন মুখোমুখি দাঁড়াবার সুযোগ এলো, তখন টমাস ওঁর সহোদরকে ফাঁকা জনমানবশূন্য প্রান্তরে ফেলে যাবেন কোন দুঃখে?
নির্বোধ হতবাক আমি পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকলাম। আজ ভাবি, কেন ওঁদের পশ্চাদ্ধাবন করিনি, আর কেনই বা আমি ভয় পেয়ে দৌড়ে পালিয়ে এলাম। এখন মনে হয় সেই গোধূলিবেলা, সেই নির্লিপ্ত শিল্পী, তাঁর যন্ত্রণাবিদ্ধ ছবি আর ছবির প্রতিলিপি—এসবের মধ্যে সেদিন সঞ্চারিত হয়েছিল কোন এক অলৌকিক শক্তি, কোন মহাপ্রাণ, রিয়ালিটির জগতে থেকে যার মোকাবিলা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু এর পরের ঘটনা সর্বাধিক করুণ, বিয়োগান্তক। টমাস আর ওঁর দাদা দুজনেই একে অপরের পিছনে উঁচু বালিদিগন্তের ওপারে মিলিয়ে গেলেন। আমি স্তম্ভিত, অভিভূত, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। দাঁড়িয়ে থাকলাম… দাঁড়িয়ে থাকলাম…। আমার বিচারবিবেচনা শক্তি লোপ পেয়েছিল। এখন মনে হয় ওঁদের জন্যে আমার হয়ত কিছুই করণীয় ছিল না, কিংবা হয়ত আমি টমাসকে অনুসরণ করে ওর পিছু পিছু যেতে পারতাম, তাহলে স্বচক্ষে টমাসের শেষ পরিণতি কি হল জানা যেতো। কিংবা আমি ওঁকে বাঁচাতে পারতাম। দুই ভাইয়ের পুনর্মিলন হয়ত সম্ভব হতে। টমাসের কাণ্ডজ্ঞান ছিল না, একটা স্বপ্ন ও আচ্ছন্নতার মধ্যে টমাস নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন, অন্তত আমার দিক থেকে সক্রিয় চেষ্টা হলে ওঁকে হয়ত ফিরিয়ে আনা যেতো। কিন্তু আমার দুটো পা কেউ যেন স্ক্রু দিয়ে মাটির সঙ্গেই এঁটে দিয়েছিল। আমি হঠাৎ টমাসের নাম ধরে চীৎকার করে ডাকলাম। ‘আমি অপেক্ষা করছি, টমাস, আমি অপেক্ষা করছি’ —নক্ষত্রতিমির ও উদ্দাম মরুবাতাসের এলাকায় প্রতিধ্বনি আমাকে ব্যঙ্গ করে নির্মম উত্তর দিয়ে গেল।
সেই বর্ণহীন সুষমাহীন অন্ধকারে বিশাল বিরাট শূন্যতার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার চেতনা চেনা-জানা স্পর্শের জগতের বাইরে অন্য কোথাও, অন্য কোন জগতে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল। আমার শারীরিক আস্তত্ব ছিল কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু আমার আত্মা, প্রাণ, বোধ ইত্যাদি এবং ইন্দ্রিয়ের শাসন স্থগিত ছিল। স্পষ্টতই সেই সময়টুকুতে আমার মধ্যে অনুপস্থিত ছিল বিংশ শতাব্দীর বিবেকবান, সচেতন, বিচারশীল সুসভ্য নাগরিকতার প্রতিনিধি। শুধু এখন মনে পড়ে, টমাসের জন্যে আমি অপেক্ষা করছিলাম। পথ চিনে ফিরে আসা কি ওঁর পক্ষে সম্ভব হবে! শিল্পী একাকীত্বের উপাসক। ভিলান তাই সমাজ সংস্কারের বন্ধন থেকে দূরে নিজেকে সমর্পণ করেছেন নিজের সাধনায়। আমার ভয় হল যখন ভাবলাম আসলে ভিলানকে আমরা দেখিনি, দেখেছি আমাদের মনেরই এক কল্পনাকে। মায়ামরীচিকার পিছনে তবে কি টমাস ওঁর জীবন দান করলেন? মনের ভুল ওঁকে নিয়ে গেল মৃতুর পথে? নিশ্চল অন্ধকারে আমি প্রাণহীন আমারই মাপের কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমার কোন ভালমন্দ জ্ঞান ছিল না—আমি আর কোন কিছু ভাবতে পারছিলাম না। প্রাণ ও শরীর তখন জড় পদার্থের এক অংশ! আমাকে যে জয়পুরে ফিরে যেতে হবে ভুলে গিয়েছিলাম। কয়েক লক্ষ বছর ধরে আমি যেন এইভাবে আকাশতলে মরুপ্রান্তরে দাঁড়িয়ে আছি। আমি যেন মানব-সংসারে, আত্মীয়তার অবিচ্ছেদ্য বন্ধন—সবকিছুর থেকে বিচ্ছিন্ন। আমি যেন অভিশপ্ত প্রস্তরীভূত এক প্রহরী, ঘরবাড়ী, ব্যক্তিগত জীবন কিছুই আমার কোনকালে ছিল না, নেই। …অন্ধকারের মহামৌনতায় বিস্ময়ে ভয়ে নির্বাক আতঙ্কে কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম জানি না। সম্বিৎ ফিরে এলো টাঙাওয়ালার ডাকে।
খানিকটা হেঁটে টাঙায় উঠতে হবে। এক দারুণ দুঃস্বপ্নের জগত থেকে ক্লান্ত শ্রান্ত পায়ে ফিরে আসছি আস্তে আস্তে। কৃষ্ণপক্ষের ছোট চাঁদ উঠেছে আকাশে নিষ্প্রভ অল্প দূরে মরুভূমির বালির চর চিকচিক করছে। অপ্রতিরোধ্য এক আকর্ষণ রয়েছে এখানে। কেমন এক অবাস্তব আলো-অন্ধকারময় জগত বলে মনে হল। ওখানেই আঁকা আছে অত্যাশ্চর্য অনেক অনেক ছবি। ছবির বুকে জুতোর দাগ।
আমাদের টাঙা ছাড়ল। টমাস টাঙার যে আসনটিতে বলেছিলেন সেটি ফাঁকা। সেদিকে তাকিয়ে আমি বিষন্ন হলাম। চলমান টাঙায় মরুভূমির উষর পটভূমিতে আমি বিষণ্ণ হলাম আমাদের নিয়তির কথা ভেবে, ছায়া সংগ্রামের কথা ভেবে।
হঠাৎ প্রচণ্ড, হু-হু চাপা ক্রন্দনের মতো এক আওয়াজ মরুভূমির দিক থেকে
ভেসে এলো। অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠার মতো সেই আওয়াজ!
‘আঁধি হো রহা হ্যায়।’—টাঙাওয়ালার আর্ত গুঞ্জরণ।
মরুভূমিতে বালির ঝড় উঠল।
.
প্রথম প্রকাশ: আশ্চর্য!, ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৫
ব্রাডবেরির একটি গল্পের বীজ অবলম্বনে। গল্পটি বিজ্ঞান-গল্প। গটফ্রীড বেনের কবিতাটি অধ্যাপক অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত অনূদিত।