Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সে ও নর্তকী – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প157 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৪. স্বাতী ফিসফিস করে বলল

    স্বাতী ফিসফিস করে বলল, এই, গায়ে হাত দিয়ে দেখ তো আমার জ্বর কি-না। স্বাতীর যত উদ্ভট কথা। জহিরুল হক স্যারের ক্লাস চলছে। মাছিদের যেমন এক লক্ষ চোখ, স্যারেরও তেমনি। স্যারের মনে হয় দুলক্ষ চোখ। কোথায় কি হচ্ছে সবই তিনি দেখেন। শুধু দেখেই ক্ষান্ত হন না, ক্যাট ক্যাট করে কথা বলেন। লিলি জ্বর দেখতে যাবে আর স্যার দারুণ অপমানসূচক কোনো কথা বলবেন না, তা কখনও হবে না। গত সপ্তাহে, দুলালী তার ক্লাসে হাই তুলছিল। তিনি দুলালীর দিকে তাকিয়ে বললেন–এই মেয়ে, হাই তোলার সময় মুখের সামনে বই-খাতা কিছু ধরবে। তুমি যে রকম বড় করে হাই তোলো মুখের ভেতর দিয়ে একেবারে পাকস্থলী পর্যন্ত দেখা যায়।

    ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে হো হো করে হেসে উঠল। হাসিতে ব্যাপারটার ইতি হলে কথা ছিল–ইতি হয় নি। কয়েকটা ছেলে দুলালীকে মিস পাকস্থলী ডাকা শুরু করেছে। যতবার ডাকছে ততবারই দুলালীর চোখে পানি চলে যাচ্ছে। কাজেই ছেলেরা এই ডাক সহজে ছাড়বে না। ইউনিভার্সিটিতে দুলালীকে আরও তিন বছর থাকতে হবে। এই তিন বছরে তার মিস পাকস্থলী স্থায়ী হয়ে যাবার সম্ভাবনা। কী ভয়াবহ সম্ভাবনা!

    স্বাতী আবারও বলল, এই লিলি, দেখ, আমার জ্বর আসছে কি না।

    লিলি ফিসফিস করে বলল, এখন পারবনুর। ক্লাস শেষ হোক। তখন দেখব।

    স্বাতী বলল, ক্লাস শেষ হতে হতে আমার জ্বর কমে যেতে পারে, এখনি দেখ। নাও অর নেভার।

    আর তখনই জহিরুল হক স্যার পড়া বন্ধ করে গম্ভীর গলায় বললেন–এই টু উইম্যান, দুজনই উঠে দাঁড়াও।

    লিলির বুক ধড়ফড় করছে। স্যার কী বলেন কে জানে। ছাত্ররা সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। স্যারের কাউকে দাঁড় করানো মানে মজাদার কিছু সময়। বিড়াল যেমন ইঁদুর মারার আগে ইঁদুর নিয়ে কিছুক্ষণ খেলা করে, তিনিও করেন। সেই খেলা দেখতে ভালো লাগে। লিলির চোখ-মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলেও স্বাতী বেশ স্বাভাবিক। সে দাঁড়িয়েছে হাসি হাসি মুখে।

    স্যার বললেন, তোমরা কী নিয়ে গল্প করছিলে?

    লিলির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করা হলেও জবাব দিল স্বাতী। সহজ স্বাভাবিক গলায় বলল, স্যার, আমরা গল্প করছিলাম না। আমি লিলিকে বলছিলাম আমার গায়ে হাত দিয়ে দেখতো জ্বর আসছে কি-না। ও রাজি হচ্ছিল না।

    ও-টা কে?

    ও হচ্ছে লিলি, রোল থার্টি টু।

    সবাই হেসে উঠল। জহিরুল হক স্যারের মুখ আরও গম্ভীর হয়ে গেল। যে রসিকতা তার করার কথা সেই রসিকতা অন্য একজন করছে, এটা হজম করা তাঁর পক্ষে মুশকিল।

    তোমার কি জ্বর নাকি?

    বুঝতে পারছি না স্যার। রোল থার্টি টুকে বললাম দেখে দিতে। ও দেখল না।

    স্বাতী করুণ ভঙ্গি করে কথা শেষ করল। সবাই আবারও হেসে উঠল। জহিরুল হক স্যারের মুখ রাগে ছাই বর্ণ হয়ে গেল। তিনি অনুভব করলেন কন্ট্রোল এই মুহূর্তে তার হাতে নেই, পরিস্থিতি দ্রুত সামলে নিতে না পারলে ভবিষ্যতে এই মেয়ে ক্লাসে অনেক যন্ত্রণা করবে। তিনি লিলির দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললেন–এই মেয়ে, দেখো, তোমার বান্ধবীর জ্বর দেখো। কপালে হাত দিয়ে দেখো ভালো মতো।

    লিলি দারুণ অস্বস্তি নিয়ে স্বাতীর কপালে হাত দিল।

    কি, জ্বর আছে?

    জি স্যার।

    বেশি না কম?

    মোটামুটি।

    জ্বর নিয়ে ক্লাস করতে হবে না। যাও, চলে যাও।

    ক্লাস থেকে স্বাতী বই-খাত গুটিয়ে হাতে নিল। সে বেশ হাসিমুখে বের হচ্ছে। জহিরুল হক স্যার লিলির দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন? তুমিও যাও। অসুস্থ বান্ধবীকে একা ছেড়ে দেবে, তা কি করে হয়।

    স্বাতীর পেছনে লিলিকেও বের হতে হলো। স্বাতীর উপর রাগে লিলির গা জ্বলে যাচ্ছে। কী ভয়ানক অস্বস্তির মধ্যে স্বাতী তাকে ফেলে দিল। ওর সঙ্গে চলাফেরা করা মুশকিল হয়ে উঠছে।

    স্বাতী বলল, যাক, অল্পের ওপর দিয়ে পার পাওয়া গেল। এখন কী করা যায়। বল দেখি? সামথিং হ্যাজ টু বি ডান। কিছু-একটা তো করা দরকার।

    লিলি জবাব দিল না। তাদের পরের ক্লাস বিকাল তিনটায়। মাঝখানের আড়ই ঘণ্টা কিছুই করার নেই। স্বাতী বলল, আমার সঙ্গে চল এক জায়গায়।

    আমি তোর সঙ্গে কোথাও যাব না।”

    দারুণ একটা জায়গায় নিয়ে যাব।

    বেহেশতে নিয়ে গেলেও যাব না।

    এই আড়াই ঘণ্টা করবি কী?

    যা-ই করি, তোর সঙ্গে যাব না।

    আমি জ্বরে মরে যাচ্ছি আর তুই আমাকে পরিত্যাগ করছিস। এটা কি ঠিক হচ্ছে? আমার যে জ্বর সেটা তো মিথ্যা না।

    জ্বর নিয়ে ঘোরাঘুরিরই-বা দরকার কী? বাসায় চলে যা।

    স্বাতী নিশ্বাস ফেলে বলল, বাসাতেই যাব। জ্বর মনে হয় আরও বাড়বে। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। তুই আমাকে বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দে। না-কি তাও করবি না? বাসায় গিয়ে দুটো পারাসিটামল খেয়ে শুয়ে থাকব। তুই মার সঙ্গে গল্প করবি। ঘণ্টাখানেক রেস্ট নেয়ার পর আমার যদি শরীরটা ভালো লাগে তাহলে লাস্ট ক্লাসটা করব। কি, রাজি?

    লিলি রাজি হলো। রিকশায় বসে হুড তুলতে তুলতে স্বাতী বলল, পথে আমি এক জায়গায় জাস্ট এক মিনিটের জন্য থামব। একজনের সঙ্গে দেখা করে দুটো কথা বলেই চলে আসব। তুই আমার সঙ্গে যেতে না চাইলে রিকশায় বসে থাকিস।

    রিকশায় বসে থাকার ব্যাপারটা হচ্ছে কথার কথা। লিলি খুব ভালো করেই জানে তাকেও নামতে হবে। স্বাতীর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন ব্যাপার। তার মনে যা আসে তা করবেই। লিলির ক্ষীণ সন্দেহ হচ্ছে–আজকের পুরো ব্যাপারটাই স্বাতীর সাজানো। হয়তো সে এক সপ্তাহ আগেই ঠিক করেছে–আজ জহিরুল হক স্যারের ক্লাসে একটা নাটক করে লিলিকে নিয়ে বের হয়ে আসবে…হয়তো…

    স্বাতী বলল, এ রকম মুখ ভোঁতা করে বসে আছিস কেন?

    ভালো লাগছে না।

    পৃথিবীতে কোন বাক্যটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় জানিস লিলি? সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত বাক্য হচ্ছে–ভালো লাগছে না। ভালো লাগছে এ-রকম কথা আমরা প্রায় বলিই না।

    ভালো লাগার মতো কিছু ঘটে না, তাই বলি না।

    ভালো লাগার মতো অনেক কিছুই ঘটে। তারপরও আমরা বলি না এই যে আজ জহিরুল হক স্যারকে কোণঠাসা করে ফেললাম—তোর খুব ভালো লাগছিল কিন্তু তুই কি বলেছিস ভালো লাগছে?

    লিলি চুপ করে রইল। স্বাতী উৎসাহের সঙ্গে বলল, আজ তিনটার ক্লাসটা যে আমরা করব না এটা ভেবেও তোর ভালো লাগছে। কিন্তু মুখ ফুটে তুই তা বলবি না।

    তিনটার ক্লাস করছি না?

    না?

    তুই না করলে না করবি। মরে গেলেও আমি ক্লাস মিস দেব না।

    স্বাতী হাসিমুখে বলল, তোর সঙ্গে এক শ টাকা বাজি, তুই আজকের ক্লাস মিস করবি। আমি তোকে আটকে রাখব না বা কিছু করব না। তুই নিজ থেকেই বলবি–আজকের ক্লাস করব না। রাজি?

    আমি তোর কথাবার্তা কিছু বুঝতে পারছি না।

    বুঝতে পারছিস না কেন? আমি কখনও জটিল কথা বলি না। সহজ কথা বলি। যারা মানুষ হিসেবে খুব জটিল তারা খুব সহজ জীবনযাপন করে, খুব সহজ কথা বলে। আমি খুব জটিল মেয়ে, এজন্যই আমার জীবনযাত্রা সহজ।

    লিলি বলল, তোর ধারণা তুই জটিল মেয়ে, আসলে জটিল না। তুই সহজ ধরনের মেয়ে।

    তোকে যে বাসায় নিয়ে যাচ্ছি সে-বাসায় পা দেয়া মাত্র তুই বুঝবি, আমি জটিল মেয়ে। সে-বাসায় একজন ভদ্রলোক থাকেন। বুড়ো বুড়ো টাইপের একটা লোক। বেঁটে-খাটো গাট্টাগোট্টা ধরনের। যার কোনো ফিক্সড ইনকাম নেই–দিনে-আনি দিনে-খাই টাইপ মানুষ। বিপত্নীক। একটা মেয়ে আছে যে ক্লাস ফোর কিংবা ফাইভে পড়ে। মেয়ে অবশ্যি বাবার সঙ্গে থাকে না, নানার বাড়িতে থাকে। মাঝেমধ্যে বাবার কাছে আসে।

    লিলি বিরক্ত গলায় বলল, ঐ ভদ্রলোকের বাসায় তুই আমাকে নিয়ে যাবি এবং সেই কারণেই তুই জটিল মেয়ে?

    না, আমি জটিল মেয়ে, কারণ ঐ ভদ্রলোককে আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। মোটেই ঠাট্টা করছি না। সত্যি কথা বলছি। ক্রশ মাই হার্ট।

    লিলি তাকিয়ে রইল। স্বাতী যে সত্যি কথা বলছে এটা সে ধরতে পারছে। স্বাতী ঠোঁট সরু করে কাম সেপ্টেম্বরের মিউজিক আনার চেষ্টা করছে। আসছে না। সে শিস বন্ধ করে গম্ভীর গলায় বলল–বিয়ে কোথায় হবে, কিভাবে হবে সেটা উনি ঠিক করবেন। আজ আমাকে তা জানানোর কথা। দুপুরে ওখানে আমার খাওয়ার। দাওয়াত। তুই ইচ্ছা করলে আমার সঙ্গে থাকতে পারিস, ইচ্ছা করলে আমাকে নামিয়ে দিয়ে তিনটার ক্লাস করতে পারিস।

    ভদ্রলোক কী করেন?

    বললাম না দিনে আনে দিনে খায়।

    তার মানে কী?

    স্বাতী হাসতে লাগল। হাসতে হাসতেই বলল, জ্বরটা আরও বেড়েছে না-কি দেখ তো। মনে হয় টেনশনের জ্বর। যত টেনশন হচ্ছে তত জ্বর বাড়ছে।

    লিলি জ্বর দেখল না। তার হতভম্ব ভাব কাটছে না। কেমন ভয় ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে স্বাতী ভয়ঙ্কর কোনো বিপদে পড়ছে, অথচ সে তা বুঝতে পারছে না। স্বাতী যদি জেনেশুনে কোনো বিপদে পড়ে, সেই বিপদ থেকে উদ্ধার করার ক্ষমতা লিলির নেই। স্বাতীকে ফেলে রেখে চলে যাবার ক্ষমতাও লিলির নেই।

    কলাবাগানের এক গলির সামনে স্বাতী রিকশা থামাল। ভাড়া মিটাল। লিলির দিকে তাকিয়ে বলল, তুই ইচ্ছা করলে এই রিকশা নিয়েও চলে যেতে পারিস। চলে যাবি?

    না।

    জানতাম যাবি না। এ-রকম ভূতে-পাওয়া চেহারা করে আছিস কেন? সহজ হ দেখি। বিয়ে তো তোর হচ্ছে না। আমার হচ্ছে।

    তারা গেট খুলে একতলা একটা বাড়ির সামনে দাঁড়াল। বাড়িটা শেওলা ধরা, উচু দেয়ালে ঘেরা। দেয়ালের ভেতরে গাছপালা জঙ্গল হয়ে আছে। ঘাস হয়েছে হাঁটু উচু। তবে বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম। সামনে প্রশস্ত বারান্দা। বারান্দা তারের জালি দিয়ে ঘেরা। লিলি বলল, বাড়িতে জনমানুষ নেই বলে মনে হচ্ছে। কত বড় তালা ঝুলছে দেখছিস!

    স্বাতী বলল, এসে পড়বে। ও জানে আমি একটার সময় আসব। একটা এখনও বাজে নি। একটা বাজতে এখনও পনেরো মিনিট।

    এতক্ষণ আমরা কী করব? বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকব?

    দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না, আমার কাছে চাবি আছে।

    স্বাতী হ্যান্ডব্যাগ থেকে চাবি বের করে দরজা খুলে বলল–আয়, ভেতরে আয়। লিলির বিস্ময়ের সীমা রইল না। চাবি সঙ্গে নিয়ে ঘুরছে। কত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তালা খুলেছে, যেন এটা তার নিজের ঘরবাড়ি। কতদিন থেকে সে স্বাতীকে চেনে। কিন্তু যাকে সে চেনে এই মেয়ে কি সেই মেয়ে!

    লিলি, এটা হচ্ছে ওর বসার ঘর। এখানে বসবি, না ভেতরের বারান্দায় বসবি? ভেতরের বারান্দাটি খুব সুন্দর।

    লিলি জবাব দিল না। তার ঘোর এখনও কাটছে না। স্বাতী বলল, আয় ভেতরে বারান্দায় গিয়ে বসি। না-কি চলে যাবি?

    চলে যাব।

    সত্যি চলে যাবি?

    হুঁ।

    আচ্ছা যা। তুই এত ভড়কে গেছিস কেন বুঝলাম না। যাই হোক, তোর নার্ভাস ভাব দেখে আমার নিজেরই খারাপ লাগছে। পনেরো মিনিট বসে যা না। ও আসুক, ওকে দেখে চলে যাবি।

    আমি এখনই যাব।

    যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি তাকে চোখের দেখাও দেখবি না?

    আমার কাউকে দেখতে ইচ্ছা করছে না।

    আচ্ছা, তাহলে যা। ধর এই নোটটা নে। তোর সঙ্গে এক শ টাকা বাজি ছিল।

    কীসের বাজি?

    এর মধ্যে ভুলে গেলি? বাজি ছিল না–-তুই তিনটার ক্লাস করলে তোকে এক শ টাকা দেব। তুই ক্লাস করতে যাচ্ছিস। ইউ আর দ্য উইনার।

    আমি ক্লাস করব না। বাসায় চলে যাব।

    তাহলে তুই আমাকে এক শ টাকা দিয়ে যাবি। বাজি মানে বাজি.. .

    স্বাতীর কথা শেষ হবার আগেই দরজার কড়া নড়ল। সামান্য কড়া নাড়ার শব্দ, অথচ লিলির মনে হচ্ছে তার বুকে কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছ। স্বাতী বলল, যাক ও এসে পড়েছে। তুই চলে গেলে একলা বাড়িতে আমার ভয় ভয় লাগত। এই বাড়িতে ভূত আছে। মেয়ে-ভূত। সব সময় ঘোমটা দিয়ে থাকে। আমি নিজে একদিন দেখেছি। ইন্টারেস্টিং স্টোরি, মনে করিয়ে দিস–তোকে বলব।

    টিফিন কেরিয়ার হাতে এক ভদ্রলোক ঢুকলেন। লিলি তাঁকে কোনোদিন দেখেনি অথচ লিলির দিকে তাকিয়ে তিনি পরিচিত ভঙ্গিতে হাসলেন। সামান্যতম অবাকও হলেন না। যেন দুপুর একটায় এ বাড়িতে লিলি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।

    ভদ্রলোক সহজ গলায় বললেন, খাবার আনতে দেরি হয়ে গেল। প্রেসক্লাবের সামনে এমন এক যানজট।

    স্বাতী বলল, খাবার কোত্থেকে এনেছ? হোটেলের খাবার?

    না। সেগুনবাগিচায় আমার এক খালা থাকেন। উনাকে বেঁধে রাখতে বলেছিলাম।

    আচ্ছা শোনো, তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই। ও হচ্ছে লিলি, তোমাকে অসংখ্যবার তার কথা বলেছি।

    হ্যাঁ বলেছ।

    স্বাতী আনন্দিত গলায় বলল, লিলি সম্পর্কে তোমাকে কি বলেছি লিলিকে একটু বলো। ও শুনলে খুশি হবে।

    ভদ্রলোক আবারও লিলির দিকে তাকিয়ে হাসলেন। আর ঠিক তখনই লিলি এই ভদ্রলোকের আকর্ষণী ক্ষমতার কারণ বুঝতে পারল। ভদ্রলোক অসম্ভব সুন্দর করে হাসেন। তিনি শুধু চোখে-মুখে হাসেন না, সমস্ত শরীর দিয়ে হাসেন।

    আহা বল না আমি লিলি সম্পর্কে কি বলেছি।

    তুমি বলেছ, লিলি কখনও মিথ্যা কথা বলে না।

    এটা তো বলেছিই, এটা ছাড়া আর কী বলেছি?

    বলেছ–লিলি হচ্ছে উপন্যাসের চরিত্রের মতো নিখুঁত ভালো মেয়ে।

    স্বাতী বিরক্তস্বরে বলল, আসল কথাটা তুমি বলছ না। আসল কথাটা বলো যেটা শুনলে লিলি খুশি হবে। তুমি আসল কথা এড়িয়ে শুধু নকল কথা বলছ।

    ও বলেছে, পৃথিবীতে নিখুঁত সুন্দর বলে যদি কোনো মেয়ে থাকে সে লিলি।

    স্বাতী বলল, আমি ঠিক বলেছি না নিজের বন্ধু বলে বাড়িয়ে বলেছি?

    ভদ্রলোক এই কথার জবাব দিলেন না। ব্যাপারটা লিলির পছন্দ হলো। লিলি যে অস্বস্তিবোধ করছে তা তিনি বুঝতে পেরেছেন। এই অস্বস্তি তিনি আর বাড়াতে চাচ্ছেন না। সাধারণত মানুষ নিজের অস্বস্তির দিকেই লক্ষ রাখে, অন্যদের অস্বস্তির দিকে না।

    লিলি বলল, আমি এখন উঠব।

    ভদ্রলোক খুবই বিস্মিত হলেন। হাসির মতো তাঁর বিস্ময়ও সারা শরীরে ধরা পড়ল।

    তুমি চলে যাবে কেন? তোমার না এখানে দুপুরে খাবার কথা। তিনজনের খাবার এনেছি।

    লিলি যা ভেবেছিল তাই। তাকে এখানে নিয়ে আসা স্বাতীর পূর্বপরিকল্পনার অংশ। হুট করে এই ব্যাপারটা সে করে নি। ক্লাসের নাটকটা সে ইচ্ছে করেই করেছে।

    ভদ্রলোক বললেন, লিলি, আমি এক্ষুনি খাবার দিয়ে দিচ্ছি। দুমিনিটের বেশি লাগবে না। সবই গরম আছে। খেয়ে যাও।

    স্বাতী বলল, তুমি খাবার বেড়ে ফেলো। ও যাবে না। দুপুর একটার সময় ও গিয়ে করবেই-বা কি। ক্লাস হচ্ছে তিনটায়। কি রি লিলি, থাকবি কিছুক্ষণ?

    আচ্ছা, থাকব।

    প্লিজ থাক। তিনজন মিলে জমিয়ে আড্ডা দেব। দুজনে গল্প জমে না। গল্পের ন্য সব সময় তৃতীয় ব্যক্তির দরকার। তৃতীয় ব্যক্তি হলো প্রভাবক–দ্য ক্যাটালিস্ট।

    ভদ্রলোক টেবিলে থালা-বাসন রাখছেন। লিলির বোধহয় সাহায্য করা উচিত। এই কাজগুলো সাধারণত মেয়েরাই করে। কিন্তু লিলি কিছু করল না। আগের মতোই চেয়ারে বসে রইল। তার হতভম্ব ভাব পুরোপুরি কাটে নি। সে সারাক্ষণই অবাক হয়ে স্বাতীকে দেখছে।

    স্বাতী বলল, গরমে আমার গা ঘামছে। ঘামা-গা নিয়ে আমি কিছু খেতে পারব। আমি চট করে গোসল করে আসি। বেশিক্ষণ লাগবে না। তুমি এর মধ্যে লিলিকে তোমাদের বাড়ির ঘোমটা-ভূতের গল্পটা বলো। সুন্দর করে বলবে। এক লাইনে বলবে না।

    লিলির মনে হলো–স্বাতী কি বাড়াবাড়ি করছে না? লোক-দেখানো বাড়াবাড়ি। লিলির চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো যে এই বাড়ি এখন তার বাড়ি। সে এই বাড়িতে যা ইচ্ছা করতে পারে। করুক যা ইচ্ছা কিন্তু তাকে সামনে বসিয়ে কেন?

    স্বাতী ভেতরের দিকে চলে গেল। ভদ্রলোক বসলেন স্বাতীর চেয়ারে। গম্ভীর গলায় বললেন–লিলি, তুমি কি ঘোমটা-ভূতের গল্পটা শুনতে চাও?

    লিলি ক্ষীণস্বরে বলল, বলুন।

    তোমার শুনতে ইচ্ছা করছে না বুঝতে পারছি। দুজন চুপচাপ বসে থাকার চেয়ে যে-কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করা ভালো–শোনো তাহলে, এই বাড়িটা আমার বাবার। তিনি ছিলেন একটা গার্লস স্কুলের হেডমাস্টার। খুব নীরস ধরনের মানুষ ছিলেন। আমার যখন তিন মাস বয়স তখন আমার মা মারা যান। তিনি আর বিয়ে করেন নি। মার মৃত্যুর পর ৩০ বছর বেঁচে ছিলেন। একাকী বেঁচে থাকা। এই ধরনের মানুষদের একসময় নানান টাইপের সমস্যা দেখা দেয়। বাবারও দেখা দিলো। তিনি একসময় বলতে শুরু করলেন–ঘোমটা পরা একটা ভূত তাঁকে বিরক্ত করে। রাতে বাবা যখন ঘুমুতে যান তখন সে আসে। খুব সাবধানে মশারি তুলে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে। বাবা চিৎকার করে উঠলে মিলিয়ে যায়। শেষের দিকে এমন হলো যে বাবা একা ঘুমুতে পারতেন না, আমাকে তার সঙ্গে ঘুমুতে হতো। এই হলো ঘোমটা ভূতের গল্প।

    এই ভূতটাকে শুধু আপনার বাবাই দেখেছেন?

    না। আরও অনেকে দেখেছে। এ বাড়িতে যারা কিছুদিন থাকে তারাই বেশি করে দেখেছ। স্বাতীও না-কি দেখেছে।

    আপনি ভূত-প্রেত এসব বিশ্বাস করেন না?

    দেখি নি তো, এজন্য বিশ্বাস করি না। দেখলে হয়তো করব।

    স্বাতীর সঙ্গে আপনার পরিচয় হলো কীভাবে?

    স্বাতী হোমাকে বলে নি?

    জি না।

    ওকে জিজ্ঞেস করলে ও তোমাকে সুন্দর করে বলবে। অবশ্যি সুন্দর করে বলার কিছু নেই আমার মেয়ের মাধ্যমে ওর সঙ্গে পরিচয়।

    আপনাদের বিয়ে কবে হচ্ছে?

    সামনের সপ্তাহে–বুধবার।

    ও আচ্ছা।

    তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে স্বাতী বের হয়ে বলল, দারুণ খিদে লেগেছে, এসো খেতে বসি। লিলি, তুই হাত-মুখ ধুবি?

    লিলি বলল, না।

    স্বাতীর চুল ভেজা। শাড়ি অগোছালোভাবে পরা। সে খালি পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে কী সুন্দর বউ-বউ লাগছে! এই নির্জন ছায়া ছায়া বাড়িটায় তাকে সুন্দর মানিয়ে গেছে।

    তোর খুব ক্ষিধে লেগেছে, তাই না?

    হ্যাঁ। কিন্তু আমি কিছু খাব না। আমি চলে যাব।

    এই না বললি—থাকবি।

    এখন আর থাকতে ইচ্ছা করছে না।

    আর পাঁচটা মিনিট থেকে খেয়ে গেলে এমন কী মহাভারত অশুদ্ধ হয়?

    মহাভারত অশুদ্ধ হয় না। মহাভারত ঠিকই থাকে কিন্তু আমি এখন চলে যাব।

    যা, চলে যা। রাগ করেছিস?

    কথা বাড়াবার দরকার নেই–তুই চলে যা। তুমি ওকে রিকশায় তুলে দিয়ে এসো।

    লিলি দরজার দিকে রওনা হলো।

    ভদ্রলোক লিলির সঙ্গে সঙ্গে আসছেন। রিকশা চলছে। রাস্তা খানা-খন্দে ভরা। খুব ঝাঁকুনি হচ্ছে। লিলির মনে হচ্ছে থেকে গেলেই হতো। স্বাতী খুব মন খারাপ করেছে। তা ছাড়া বাসায় ফিরতেও তার ইচ্ছে করছে না। তাদের বাড়িটা কুৎসিত ধরনের বাড়ি। এই বাড়িতে বারবার ফিরে যেতে ইচ্ছা করে না। লিলির মনে হচ্ছে তার নিজেরও জ্বর আসছে। স্বাতীর জ্বরটাই চলে এসেছে তার গায়ে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনীল হাতী – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article ১৯৭১ – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই বসন্তে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই মেঘ, রৌদ্রছায়া – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এইসব দিনরাত্রি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 23, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Our Picks

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }