Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সে ও নর্তকী – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প157 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৬. আজ স্বাতীর বিয়ে

    আজ স্বাতীর বিয়ে। গোপন বিয়ে। অল্প কয়েকজন শুধু জানে। লিলি সেই অল্প কয়েকজনের একজন। সে স্বাতীদের বাসার সামনে ভয়ে ভয়ে রিকশা থেকে নামল। তার হাত-পা কাঁপছে। সে রিকশা থেকে নেমে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। আজ স্বাতীদের বাসা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।

    লিলির স্বপ্নের বাড়ির সঙ্গে স্বাতীদের বাড়িটার খুব মিল আছে। শুধু একটাই অমিল, লিলির স্বপ্নের বাড়ি একতলা, স্বাতীদেরটা দোতলা। স্বাতীদের বাড়ির ছাদে ওঠার ব্যবস্থা নেই–সিঁড়িঘর করা হয় নি। আর লিলির স্বপ্নের বাড়িতে ছাদটাই প্রধান। সেই ছাদে একটা সিঁড়িঘর আছে। এই দুটি অমিল ছাড়া আর কোনো অমিল নেই।

    স্বাতীর বাবা লিলির কল্পনার বাবার চেয়েও ভালো। তিনি রিটায়ার করে ঘরে আছেন। সারাক্ষণই কাজ নিয়ে থাকেন। লিলি কখনও তাঁকে কাজ ছাড়া বসে থাকতে দেখে নি। হয় বাগানে কাজ করছেন, নয় কাঠের কাজ করছেন। মুখে কোনো বিরক্তি নেই। স্বাতীর কোনো বন্ধু-বান্ধবকে দেখলে এত আগ্রহ করে কথা বলেন। হেন-তেন কত রসিকতা। আর লিলির বাবা লিলির বন্ধুদের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকান। ভাবটা এ-রকম–এরা কেন এসেছে? কী চায়? লিলির বন্ধুরা যদি বলে স্নামালিকুম চাচা। তাহলে তিনি বিরক্ত মুখে বলেন–হুঁ। বলেই ওদের সামনেই নাক ঝাড়েন। নাক ঝাড়ার ব্যাপারটা দুমিনিট পরেও করতে পারেন, তা করবেন না। মাঝে মাঝে লিলির মনে হয় ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত।

    লিলি আজ স্বাতীদের বাড়িতে ঢুকল ভয়ে ভয়ে। স্বাতীর বাবা নাজমুল সাহেবের সঙ্গে যদি দেখা হয়ে যায়। যদি তিনি বলেন এত সেজেগুজে বের হয়েছ কী ব্যাপার? তাহলে লিলি কী বলবে? তাঁকে নিশ্চয়ই বলা যাবে না–আজ আপনার মেয়ে গোপনে বিয়ে করবে। আমি তাকে নিতে এসেছি।

    লিলি কিছু না বললেও একদিন তো সব জানাজানি হবে। তখন যদি লিলির সঙ্গে তার দেখা হয় এবং তিনি বলেন–মা, তোমাকে এত স্নেহ করি আর এত বড় একটা ঘটনা সম্পর্কে তুমি আমাকে কিছুই বললে না? এটা তো মা তোমার কাছ থেকে আশা করি নি।

    নাজমুল সাহেব বসার ঘরের বারান্দায় মাদুর পেতে বসেছেন। কেরোসিন কাঠ দিয়ে বক্সজাতীয় কি যেন বানাচ্ছেন। কাঠমিস্ত্রীদের মতো তাঁর কানে পেনসিল গোঁজা। হাতে ছোট্ট একটা করাত। লিলিকে দেখে তিনি হাসিমুখে বললেন, কেমন আছ গো লিলি মামণি?

    লিলি বলল, ভালো। কী বানাচ্ছেন চাচা?

    আগে বলব না। বানানো হোক তারপর সবাইকে চমকে দেব।

    স্বাতী কি বাসায় আছে?

    হ্যাঁ আছে। মেয়েটির কোনো সমস্যা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। খুব অস্থির। অকারণে একবার দোতলায় যাচ্ছে–একবার নামছে। সকালে নাশতা খায় নি–শরীর নাকি ভালো না। তোমাদের কি কোথাও যাবার কথা?

    স্বাতী জবাব দিল না। তার বুক ঢিপ ঢিপ করছে। বেশিক্ষণ জেরা করলে সত্যি কথা বলে ফেলবে। নাজমুল সাহেব বললেন, সোজা দোতলায় উঠে যাও মা। ও ঘণ্টাখানেক ধরে দোতলার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। যাবার আগে আরেকটা কাজ করতে পারবে মা?”

    অবশ্যই পারব।

    রান্নাঘরে গিয়ে তোমার চাচিকে বলো আমাকে এক কাপ চা দিতে। কড়া করে যেন বানায়।”

    লিলি রান্নাঘরের দিকে রওনা হলো। স্বাতীর মা রওশন আরা লিলির দিকে তাকিয়ে এমনভাবে হাসলেন যেন লিলি তারই একটা মেয়ে। অন্যের মেয়েদের দিকে এমন আপন করে তাকানো যে কত বড় গুণ তা-কি এই মহিলা জানেন?

    লিলি বলল, চাচি খুব কড়া করে এক কাপ চা চাচাকে দিন।

    রওশন আরা বললেন, আচ্ছা দিচ্ছি। তোমাকে দূত হিসেবে পাঠিয়েছে বলেই দিচ্ছি। তোমার চাচার চা নিষেধ হয়ে গেছে। ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। চিনি একেবারেই বন্ধ। আর এদিকে তার ঘনঘন চা খাবার অভ্যাস। শুধু লিকার হলে কথা ছিল–একগাদা চিনি দিয়ে চা বানাতে হয়।

    বাজারে স্যাকারিন জাতীয় কি নাকি পাওয়া যায় চাচি?

    পাগল হয়েছ, তোমার চাচা খাবে স্যাকারিনের চা? মুখে দিয়েই থু করে ফেলে .বে না? দিয়ে দেখেছিলাম। লিলি তুমি কী খাবে বলো?

    আমি কিছু খাব না চাচি।

    বললেই হবে? তুমি আজ সারাদিন থাকো। দুপুরে খেয়েদেয়ে তারপর যাবে। স্বাতীর কি হয়েছে তুমি কিছু জানো লিলি?

    লিলি শঙ্কিত গলায় বলল, কেন চাচি।

    ও কাল রাত থেকে কেমন ছটফট করছে। সকালেও কিছু খায় নি। আমাকে কিছু বলল না। তুমি জিজ্ঞেস করো তো ব্যাপার কী?

    আচ্ছা চাচি, আমি জিজ্ঞেস করব।

    লিলি দোতলায় উঠে গেল। দোতলার টানা বারান্দার শেষ মাথায় স্বাতী দাঁড়িয়ে আছে। লিলিকে তার দিকে আসতে দেখেও সে সিউল না। যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল সেভাবে দাঁড়িয়ে রইল। লিলি যখন ডাকল, এই স্বাতী! তখনই সে নড়েচড়ে উঠল। তীক্ষ্ণ গলায় বলল, তুই এত সুন্দর শাড়ি কবে কিনলি? আগে দেখি নি তো? তোকে অদ্ভুত লাগছে। মনে হচ্ছে কুইন অব সেবা।

    লিলি হকচকিয়ে গেল। স্বাতীর ব্যাপারটা সে বুঝতে পারছে না। কেমন পাগলি-পাগলি চেহারা। মনে হচ্ছে দুদিন চুলে চিরুনি দেয় নি, চুল জট ধরে আছে। চোখের নিচে কালি। কিছুক্ষণ আগে মনে হয় পান খেয়েছে। দাঁত লাল হয়ে আছে। পরে আছে সাধারণ একটা শাড়ি। লিলি বলল, তুই এখনও রেডি হোস নি? সাড়ে এগারোটা বাজে। আমাদের না বারোটার মধ্যে যাবার কথা?

    স্বাতী এমনভাবে তাকাল যেন লিলির কথা বুঝতে পারছে না। সে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, মিষ্টি পান খাবি লিলি? আমার ছোট মামা কলকাতা থেকে এক গাদা মিষ্টি পান প্যাকেট করে নিয়ে এসেছে। আচ্ছা বল দেখি মিষ্টি পান কোনো আনার জিনিস? আমি অবশ্যি একটার পর একটা পান খেয়ে যাচ্ছি। দেখ, পান খেয়ে দাঁতের কী অবস্থা করেছি।

    লিলি বলল, তোর ব্যাপারটা কী? আজ না তোর বিয়ে। ভুলে গেছিস?

    স্বাতী হাসল। লিলি বলল, এ রকম অদ্ভুত করে হাসছিস কেন?

    একটা ব্যাপার হয়েছে। আয় ঘরে আয়, বলছি।

    স্বাতী হাত ধরে লিলিকে তার ঘরে নিয়ে গেল। চাপা গলায় বলল, চুপ করে বোস। আমি আসছি। এক্ষুনি আসছি। তোকে এই শাড়িটাতে দারুণ লাগছে। দাম কত নিল? এক হাজারের উপরে নিশ্চয়ই।

    পনেরো শ।

    দাম বেশি নিয়েছে। তবু সুন্দর। আমায় গায়ের রঙ তোর মতো ফর্সা হলে আমিও কিনতাম।

    তোর ব্যাপারটা কি আগে শুনি।

    স্বাতী প্রায় ফিসফিস করে বলল, আমি ঠিক করেছি যাব না।

    কখন ঠিক করলি?

    কাল রাতে। ঠিক এগারোটার সময়। সারারাত আর ঘুম হয় নি। তাকিয়ে দেখ এক রাতে চোখে কালি পড়ে গেছে। সকালে এমন মাথা ঘুরছিল, মনে হচ্ছিল পড়ে যাব।

    হঠাৎ এ-রকম ডিসিশান নিলি কেন?

    স্বাতী আঙুল দিয়ে শাড়ি পেঁচাচ্ছে। খুব যেন অস্বস্তিতে পড়ে গেছে।

    কথা বলছিস না কেন?

    মন স্থির করতে পরছি না।

    বিয়ে পিছিয়ে দিচ্ছিস?

    স্বাতী জবাব দিল না। আঙুলে চুলের জট সারাবার চেষ্টা করতে লাগল। লিলি বলল, উনাকে জানিয়েছিস?

    কাকে? হাসনাতকে?

    হুঁ।

    না।

    উনি তো বসে অপেক্ষা করতে থাকবেন।

    স্বাতী বলল, দাঁড়া তোর জন্য মিষ্টি পান নিয়ে আসি।

    মিষ্টি পান আনতে হবে না। তুই বোস।

    স্বাতী বলল, আমার মনে হয় জ্বর এসেছে, দেখ তো গায়ে হাত দিয়ে।

    লিলি স্বাতীর কপালে হাত দিল। কপাল ঠাণ্ডা, জ্বর নেই। স্বাতী বলল, লিলি, তুই আসায় খুব ভালো হয়েছে। আমি একটা চিঠি লিখে রেখেছি, ওর হাতে দিনি। চিঠিতে গুছিয়ে সবকিছু লেখা আছে।

    আমি কোনো চিঠি দিতে পারব না। তোদর এই হাইড্রামার মধ্যে আমি নেই। আমি এক্ষুনি বিদেয় হচ্ছি।

    আচ্ছা থাক, চিঠি দিতে হবে না। মুখে বলবি। বলবি আমার ভয়ঙ্কর জ্বর। উঠে বসার উপায় নেই। বিছানায় এলিয়ে পড়ে আছি। মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। জ্বরটা কমলেই আমি এসে সব গুছিয়ে বলব।

    লিলি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আমি এসব কিছুই বলতে পারব না। আমি বাসায় যাচ্ছি।

    স্বাতী হাত ধরে লিলিকে বসিয়ে দিল। কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, তোর পায়ে ধরছি লিলি তুই গিয়ে বল। তুই তো আবার সত্যি ছাড়া মিথ্যা বলতে পারিস না। আচ্ছা সত্যি কথাটাই বল।

    সত্যি কথাটা কী?

    স্বাতী নিচু গলায় বলল, সত্যি কথাটা হচ্ছে আমি ওকে বিয়ে করব না। দ্য গেম ইজ ওভার।

    লিলি হতভম্ব গলায় বলল, উনার অপরাধটা কী?

    কোনো অপরাধ নেই। আমি অনেক চিন্তাটিন্তা করে বের করেছি–ওকে আমার পছন্দ হয় নি। ওর সংসার পছন্দ হয়েছে, ওর মেয়েটা পছন্দ হয়েছে, ওর ছবি পছন্দ হয়েছে। আমি চেয়েছিলাম মানুষটাকে ভালোবাসতে।

    .

    চা খাব না।

    আহ খা-না কতক্ষণ লাগবে চা খেতে। আমি যাব আর আসব। চায়ের সঙ্গে আর কিছু খাবি? মা বড়া ভাজছে

    স্বাতী চা আনত গেল। গেল যে গেল আর আসার নাম নেই। অস্বস্তি নিয়ে লিলি অপেক্ষা করছে। সে বুঝতে পারছে না এখান থেকে বাসায় চলে যাবে, না কাজী অফিস হয়ে যাবে। উনার সঙ্গে তার পরিচয় এমন না যে নানান সান্ত্বনার কথাটথা বলে বিয়ে ভাঙার খবর দেবে। একদিনই সামান্য কথা হয়েছে। মানুষটাকে গম্ভীর ধরনের মনে হয়েছে। তবে অপছন্দ হয় নি। ভালো মানুষ বলে মনে হয়েছে। লিলি তাকে কি করে বলকে স্বাতী ঠিক করেছে আপনাকে বিয়ে করবে না। দ্য গেম ইওভার।

    স্বাতী প্লেটভর্তি বড়া আর চা নিয়ে এল। হাসিমুখে বলল, একেবারে আগুন গরম। কড়াই থেকে নামিয়ে এনেছি। ফুঁ দিয়ে ঠাণ্ডা করে আরেকটু ঝাল হলে ভালো হতো। ভাজাভুজি ঝাল না হলে ভালো লাগে না।

    স্বাতী এখন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলছে। শব্দ করে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। পা নাচাচ্ছে। তার পা নাচানোর বিশ্রী অভ্যাস আছে।

    লিলি বলল, আমি উঠি? স্বা

    তী বলল, চল আমি তোকে রিকশায় তুলে দিয়ে আসি।

    রিকশায় তুলে দিতে হবে না।

    আহা চল না।

    রিকশায় তুলে দেবার কথা বলেও বসার ঘরের দরজা পর্যন্ত এসে স্বাতী থমকে দাঁড়িয়ে বলল, আমার এখন আর তোকে এগিয়ে দিতেও ইচ্ছা করছে না–তুই একাই যা।

    স্বাতী বসার ঘরে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে তাকে কেমন ক্লান্ত এবং হতাশ লাগছে। লিলির মনে হলো এখন সে যদি একবার বলে–মন থেকে এসব ঝামেলা দূর করে চল তো আমার সঙ্গে। মানুষটা খারাপ না। বিয়ে করে তুই সুখী হবি। তাহলে স্বাতী বলবে–আচ্ছা একটু দাঁড়া আমি কাপড় বদলে আসি।

    লিলি দেখল স্বাতীর চোখে পানি এসে গেছে। স্বাতীর বড় বড় চোখ। চোখভর্তি পানি। কী সুন্দর যে লাগছে!

    .

    মগবাজার কাজী অফিসের সামনে হাসনাত দাঁড়িয়ে আছে। সে একা না। তার সঙ্গে তিন/চারজন বন্ধুবান্ধব আছে। তাদের মুখ হাসি হাসি হলেও একধরনের চাপা টেনশন টের পাওয়া যায়। প্রত্যেকের হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। প্যাকেট খুলে সবাই নিশ্চয়ই একসঙ্গে ধরিয়েছে।

    হাসনাতের চুল সাধারণত এলোমেলো থাকে। আজ সুন্দর করে আঁচড়ানো। তাড়াহুড়া করে শেভ করায় থুতনির কাছে গাল কেটেছে। রক্ত জমাট বেঁধে আছে। তার পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবি স্বাতীর দেয়া উপহার। পাঞ্জাবি মাপমতো হয় নি, বড় হয়েছে। মৌলানাদের পাঞ্জাবির মতো লাগছে। হাসনাতকে কেমন যেন বিষণ্ণ দেখাচ্ছে।

    লিলি রিকশা থেকে নামতেই সবাই আগ্রহ নিয়ে তাকাল। হাসনাত একটু এগিয়ে এসে বলল, আমার কাছে ভাংতি আছে ভাড়া দিচ্ছি–তুমি ভেতরে চলে যাও লিলি। ভেতরে আমার বড় খালা আছেন। তুমি দেরি করলে কেন?”

    লিলি কি বলবে চট করে বুঝে উঠতে পারল না। হাসনাত রিকশা ভাড়া দিতে দিতে বলল, তোমার বান্ধবী অবশ্যি এখনও আসে নি। দেরি করছে কেন বুঝলাম না।

    লিলি বলল, হাসনাত ভাই, আপনার সঙ্গে আমার একটু কথা আছে।

    বলো কী ব্যাপার?

    লিলি ইতস্তত করছে। কথাটা বলার জন্য একটু ফাঁকা জায়গা দরকার। রাস্তার উপরে ফাঁকা জায়গা কোথায়?

    হাসনাত বিস্মিত হয়ে বলল, জরুরি কোনো কথা?

    জি।

    এসো রাস্তা ক্রস করে ঐ মাথায় যাই। তোমার বলতে কি সময় লাগবে?

    জি না।

    তারা রাস্তা পার হলো। লিলির খুব খারাপ লাগছে। কথাটা শুনে উনি কি করবেন সে অনুমান করতে পারছে না। রেগে যাবেন না তো?

    লিলি বলো।

    লিলি ক্ষীণস্বরে বলল, আমি এখানে আসার আগে স্বাতীর বাসা হয়ে এসেছি। আমার কথা ছিল আমি স্বাতীকে নিয়ে আসব। স্বাতী আমাকে বলেছে আপনাকে যেন বলি, সে আসতে পারবে না।

    হাসনাত তাকিয়ে আছে। লিলি চোখ নামিয়ে নিল। তার যা বলার সে বলে ফেলেছে। আর কি বলবে বুঝতে পারছে না।

    স্বাতী আসবে না?

    জি না।

    ও, আচ্ছা।

    তোমার কাছে কি চিঠিপত্র কিছু দিয়েছে?

    জি-না। লিলি বলল, আমি চলে যাই।

    এসো রিকশা করে দি। এখানে রিকশা পাওয়া মুশকিল।

    লিলি ভেবেছিল তার কথা উনি বিশ্বাস করবেন না। নানান প্রশ্ন-ট্রশ্ন করবেন। সে-রকম কিছু হলো না। হাসনাত লিলির সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছে। লিলির বলতে ইচ্ছে করছে, আপনি চলে যান আপনাকে রিকশা ঠিক করে দিতে হবে না। আমি ঠিক করে নেব।

    এতগুলো কথা বলার মতো শক্তি এখন তার নেই। মানুষটা যে রিকশার জন্য তার সঙ্গে সঙ্গে আসছে এটা একদিক দিয়ে ভালোই। তিনিও চিন্তা করার সময় পাচ্ছেন। তাকে ফিরে গিয়ে বন্ধুদের ব্যাপারটা বলতে হবে। কি বলবে এটা ভাবার জন্যও সময় দরকার।

    রিকশা না, বেবিট্যাক্সি পাওয়া গেল। হাসনাত দরদাম করে ভাড়া ঠিক করল। মগবাজার থেকে রাজিয়া সুলতানা রোড। কুড়ি টাকা। লিলির একটু আশ্চর্য লাগছে এ-রকম অবস্থায় কেউ বেবি ট্যাক্সিওয়ালার সঙ্গে দরদাম করতে পারে। বেবিট্যাক্সি ভাড়াও হাসনাত ট্যাক্সিওয়ালার হাতে দিয়ে দিলো দুটো চকচকে দশ টাকার নোট। মনে হয় বিয়ে উপলক্ষে কিছু চকচকে নতুন নোট ভদ্রলোক যোগাড় করেছেন।

    বিদায় নেবার আগেই বেবিট্যাক্সিওয়ালা হুস করে বের হয়ে গেল।

    হাসনাতের হাতের সিগারেট নিভে গেছে। সে পান-সিগারেটের দোকান থেকে দেশলাই কিনে সিগারেট ধরাল। সে কাজী অফিসের দিকে যাচ্ছে।

    .

    লিলির নিজেদের বাসায় ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে না। নতুন কোনো জায়গায় যেতে ইচ্ছে করছে। শান্ত নিরিবিলি ধরনের কোনো জায়গা। হইচই চেঁচামেচি নেই, ছায়া ছায়া ধরনের কোনো জায়গা। যেখানে প্রচুর গাছপালা। গাছপালার ভিতর ছোট্ট একটা বাড়ি। বাড়ির খুব কাছেই নদী। নদীতে নৌকা-টৌকা কিছু নেই। শুধুই নদী। কিংবা পুকুরও থাকতে পারে। বড় পুকুর, যার পানি কাচের মতো এত সুন্দর সেই পানি যে, দেখলেই গায়ে-মাথায় মাখতে ইচ্ছা করে। নদীর ঘাটটা থাকবে মারবেল পাথরে বাঁধানো।

    সে তার স্বপ্নের বাড়ি নিয়ে আরও কিছুক্ষণ ভাবত কিন্তু তার আগেই বাসার কাছে চলে এল। তার মনটা গেল খারাপ হয়ে। কী বিশ্রী একটা বাড়ি! সদর দরজাটা খোলা। যার ইচ্ছা ভেতরে ঢুকছে। যার ইচ্ছা বেরুচ্ছে।

    একবার এক ভিক্ষুক ভিক্ষা চাইতে একেবারে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। আজও দুজন ফকিরণীকে দেখা গেল বারান্দায় বসে জমিয়ে গল্প করছে। দুজন দুজনের মাথার উকুন বাছছে। লিলিকে দেখে তারা এমনভাবে তাকাল যেন লিলি বাইরের একটা মেয়ে বিনা অনুমতিতে তাদের ঘরে ঢুকে যাচ্ছে।

    একতলার বারান্দায় লিলি খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। বাড়ির পরিস্থিতি বোঝার জন্য এটা দরকার। কাজের বুয়া এক গাদা কাচের বাসন নিয়ে কলঘরের দিকে যাচ্ছে। এক্ষুনি সে একটা-কিছু ঝনঝন করে ভাঙবে। বাসন ভাঙা তার হবি। রোজই ভাঙে। লিলি বলল, বুয়া, মা কোথায়?

    উপরে।

    কী করছে?

    বুয়া নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, ছোট দুই আফারে দরজা বন্ধ কইরা মারতাছে।

    আশ্চর্য কাণ্ড! বড় বড় দুটো মেয়েকে দরজা বন্ধ করে মারা হচ্ছে–এটা যেন খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা।

    আফনেরে আইজ সুন্দর-মুন্দর লাগতাছে।

    তুমি তোমার কাজে যাও বুয়া।

    লিলি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। মার হাত থেকে রুমু ঝুমুকে উদ্ধার করবে কি বুঝতে পারছে না। আর ভালো লাগে না। দরকার কি উদ্ধার করার। যা ইচ্ছা হোক। লিলি নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছে–ফরিদা তখন বের হয়ে এলেন। মেয়েদের শাস্তি দিয়ে তিনি খানিকটা ক্লান্ত। হাঁপাচ্ছেন। লিলিকে স্বাভাবিক গলায় বললেন, ঐ মেয়েটা বার-বার টেলিফোন করছে।

    কোন মেয়েটা?

    ঐ যে শ্যামলা মতো–কি যেন নাম। তোর কাছে প্রায়ই আসে।

    স্বাতী?

    হুঁ। বলেছে খুব জরুরি।

    তুমি কি আবার রুমু ঝুমুকে মারছিলে?

    না মেরে করব কী?

    ফরিদা নিচে নেমে গেলন। কাউকে ফার্মেসিতে পাঠিয়ে তুলা স্যাভলন আনাতে হবে। মার খেয়ে ঝুমুর ঠোঁট কেটে গেছে। রক্ত পড়ছে।

    টেলিফোন বাবার ঘরে। তিনি ঘরে নেই কাজেই ঘরে ঢুকে টেলিফোন করা যায়। বাবা থাকলে টেলিফোনের দশ গজের ভেতর যাওয়া যায় না। লিলি টেলিফোন করবে কি করবে না বুঝতে পারছে না। স্বাতীর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। কথা না বলেও উপায় নেই। স্বাতী কিছুক্ষণ পর-পর টেলিফোন করে যাবে। তারচেয়ে কথা বলে ঝামেলা চুকিয়ে দেয়াই ভালো।

    স্বাতী মনে হয় টেলিফোন সেট কোলে নিয়েই বসে ছিল রিং হওয়া মাত্র স্বাতী বলল, কেমন আছিসরে লিলি? সে ধরেই নিয়েছে লিলির টেলিফোন। লিলি শুকনো গলায় বলল, ভালো।

    গিয়েছিলি?

    কোথায় যাব?

    কাজী অফিসে।

    কাজী অফিসে আমার তো যাবার কথা না।

    তারপরেও তো গিয়েছিলি। তাই না?

    হ্যাঁ।

    আমার ব্যাপারটা গুছিয়ে বলেছিস তো?”

    গুছিয়ে বলার কি আছে? তুই আসবি না–সেটা বললাম।

    কীভাবে বললি?

    সাধারণভাবে বলেছি। আমি তো আর তোর মতো নাটক করতে পারি না।

    সাধারণভাবে মানে কী? এ্যাকজাক্ট ডায়ালগ কী?

    আমার মনে নেই।

    আমি যাব না এটা শোনার পর সে কী করল?

    কিছু করে নি।

    আচ্ছা, তুই ভালোমতো ব্যাপারটা বল না–এ-রকম করছিস কেন?

    ভালোমতো বলার কিছু নেই। আমি যা বলার বললাম, বেবিট্যাক্সি নিয়ে চলে এলাম।

    তার রিএ্যাকশান কী ছিল?

    কোনো রিএ্যাকশান ছিল না।

    তুই ঠিকমতো বলতে পারছিস না। ওর গায়ে কী ছিল?

    এত খেয়াল করি নি।

    শার্ট ছিল, না–পায়জামা-পাঞ্জাবি ছিল?

    পায়জামা-পাঞ্জাবি।

    ক্রিম কালারের পাঞ্জাবি।

    ক্রিম কালারের পাঞ্জাবি? গলার কাছে হাতের কাজ?

    বললাম তো, আমি এত খেয়াল করি নি।

    এ পাঞ্জাবিটা আমি প্রেজেন্ট করেছিলাম। আড়ং থেকে কিনেছি–নয় শ টাকা দাম নিয়েছে।

    টেলিফোন রাখি স্বাতী?

    আরে না, টেলিফোন রাখবি কি? আমি তো কথাই শুরু করি নি। আর কে কে এসেছিল।

    জানি না আর কে কে এসেছিল।

    ওর খালা এসেছিল?

    হুঁ।

    সুস্মিতা এসেছিল?

    সুস্মিতা কে আমি জানি না।

    সুস্মিতা ওর দূর সম্পর্কের মামি। আমার কি ধারণা জানি? আমার ধারণা সুস্মিতার সঙ্গে ওর এক ধরনের সম্পর্ক আছে। তেমন কিছু সা, প্লেটোনিক টাইপ। ও সবকিছুতে কেউ থাকুক বা না থাকুক সুস্মিতা থুকবেই। কী কুৎসিত একটা মেয়ে চিন্তা কর–হাজব্যান্ড আছে, ছেলেমেয়ে তুমছে তার বড় মেয়ে হলিক্রস কলেজে এবার ইন্টারমিডিয়েট দিচ্ছে।

    তোর বকবকানি শুনতে ভালো লাগছে না স্বাতী।

    তুই কি বাসায় থাকবি?

    বাসায় থাকব না তো যাব কোথায়?

    আমি তাহলে চলে আসি।

    না।

    না কেন?

    আমার বাসায় কেউ এলে আমার ভালো লাগে না।

    ভালো না লাগলেও আসছি। অনেক কথা আছে।

    প্লিজ, আসিস না। কাল তো ইউনিভার্সিটিতে দেখা হবেই।

    কাল ইউনিভার্সিটিতে দেখা হবে না। কারণ, কাল আমি ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছি। না। কাজেই আজই দেখা হবে। আমি সন্ধ্যার পর আসব। বাবার কাছ থেকে গাড়ি ম্যানেজ করেছি। ছটা থেকে নটা–এই তিন ঘণ্টার জন্য গাড়ি পাওয়া গেছে। আমি কিন্তু আসছি সন্ধ্যার পর।

    না এলে হয় না?

    হবে না কেন হয় তবে এলেই ভালো হয়।

    .

    টেলিফোন রেখে লিলি দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়াল। তখনই কলঘর থেকে ঝনঝন শব্দ। বুয়া কিছু ভেঙেছে। মার চিৎকারে এখন কান ঝালাপালা হয়ে যাবার কথা–চিৎকার শোনা যাচ্ছে না। কেন শোনা যাচ্ছে না। এই রহস্য লিলির কাছে। পরিষ্কার হচ্ছে না। সে দেখল ফরিদা ব্যস্ত হয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসছেন। তার হাতে তুলা-স্যাভলনের শিশি। তিনি উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, লিলি তুই ঝুমুকে একটু ডাক্তারখানায় নিয়ে যা তো।

    কেন?”

    ঠোঁট কেটে গিয়েছে। রক্ত বন্ধ হচ্ছে না।

    খুব বেশি কেটেছে?

    খুব বেশি না। অল্প, কিন্তু রক্ত বন্ধ হচ্ছে না। কামিজ রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছে।

    বলো কি?

    আমি কামিজ বদলে দেই, তুই ওকে নিয়ে যা।

    ঝুমু কোথায়?

    নিচে।

    ঝুমুকে দেখে লিলি হতভম্ব। আসলেই রক্তে সব ভেসে যাচ্ছে। তুলা ঠোঁটে চেপে ব্রিত ভঙ্গিতে সে দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশেই রুমু। তাকেও বিব্রত মনে হচ্ছে। লিলি বলল, তোরা কি করেছিস যে মা এমন করে মারল?

    দুজনই একসঙ্গে হাসল। লজ্জার চাপা হাসি।

    কলতলায় আবার ঝনঝন শব্দ। বুয়া আরেকটা কিছু ভেঙেছে। প্রথমবার ভাঙার কোনো রিএ্যাকশান হয় নি বলে বোধহয় দ্বিতীয়বার ভাঙা। এবার রিএ্যাকশান হচ্ছে–ফরিদা চেঁচাতে চেঁচাতে নামছেন।

    .

    ঝুমুর কামিজ বদলানো হয়েছে। কামিজ কাঁধের কাছে অনেকখানি ছেঁড়া। ফরিদা বললেন, ওড়না দিয়ে ঢেকে চলে যা। ঝুমু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল, কোনো কিছুতেই তার আপত্তি নেই। রুমু বলল, আমিও ঝুমুর সঙ্গে ডাক্তারের কাছে যাব। ফরিদা তীব্র গলায় বললেন, জ্যান্ত কবর দিয়ে ফেলব। আর যেন কখনও দুজনকে একত্রে না দেখি।

    লিলি বলল, মা ওরা করেছে কী?

    ফরিদা বিরক্ত গলায় বলল, সব সময় যা করে তাই করেছে।

    কী করে সব সময়?

    এত কথা বলতে পারব না। ডাক্তারের কাছে নিতে বলছি নিয়ে যা।

    গাড়ি ছিল না। দরকারের সময় গাড়ি কখনও থাকে না। লিলি রিকশা নিল। রিকশায় উঠে লিলি বলল, ব্যথা করছে নাকি রে?

    ঝুমু না সূচক মাথা নাড়ল।

    লিলি বলল, তোরা দুজন কী করিস যে মা এ-রকম করে মারে?

    ঝুমু লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসল। লিলি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। ঝুমুর কাছ থেকে প্রশ্নের উত্তরে এর বেশি কিছু পাওয়া যাবে না।

    .

    সন্ধ্যাবেলা স্বাতীর আসার কথা। লিলি অস্বস্তি নিয়ে অপেক্ষা করছে। সন্ধ্যার পর থেকে বাবা বাসায় থাকবেন। তিনি ব্যাপারটা কিভাবে দেখবেন কে জানে। মেয়েদের বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে বেড়াতে আসা তিনি অত্যন্ত অপছন্দ করেন। সন্ধ্যার পর কেউ আসবে এটা বোধহয় তার স্বপ্নেও নেই। সম্ভাবনা খুব বেশি যে, স্বাতীকে দেখে তিনি রেগে যাবেন। সভ্য মানুষ মনের রাগ চেপে রেখে হাসিমুখে কথা বলে। নেয়ামত সাহেব তা পারেন না। পারার প্রয়োজনও বোধ করেন না।

    লিলি কলেজে পড়ার সময় তার এক বান্ধবী বিকেলে বেড়াতে এসেছিল। সন্ধ্যা পর্যন্ত সে থেকে গেল। হাসিমুখে খুব গল্প করছে, তখন বিনা নোটিসে নেয়ামত সাহেব তাদের ঘরে ঢুকে পড়লেন থমথমে গলায় বললেন, সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে বাসায় যাচ্ছ না কেন খুকি? সন্ধ্যাবেলা পাখির মতো সামান্য প্রাণীও ঘরে ফেরে। তুমি এখানে বসে আছ কেন? লিলির বান্ধবী আর কোনোদিন তাদের বাড়িতে আসে নি। এই ঘটনার পর সে লিলিকে পর্যন্ত অপছন্দ করত।

    স্বাতী এলে সহজে যাবে না। রাত নটা দশটা পর্যন্ত থাকবে। সম্ভাবনা খুব বেশি যে রাত দশটার সময় সে বলবে, লিলি রাতটা তোর সঙ্গে থেকে যাই। সারা রাত জমিয়ে গল্প করব। লিলির আলাদা ঘর আছে ঠিকই কিন্তু রাতে সে একা ঘুমায় না। নেয়ামত সাহেব কোনো মেয়েকে একা রাখতে রাজি না। ফরিদা রাতে লিলির সঙ্গে ঘুমুতে আসেন। লিলির সেটা খারাপ লাগে না। ভালোই লাগে। সে অনেক রাত পর্যন্ত মার সঙ্গে গল্প করে। ভয়াবহ অস্বস্তির ব্যাপার হয় তখন–যখন মাঝরাতে বাবা এসে দরজায় টোকা দিয়ে গম্ভীর গলায় ডাকেন–ফরিদা, এই এই।

    ফরিদা সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় উঠে বসেন–লিলি ঘুমাচ্ছে কি-না তা দেখেন। লিলি গভীর ঘুমের ভান করে। ফরিদা লজ্জিত ভঙ্গিতে উঠে যান। আধ ঘণ্টার মতো সময় পার করে আবার ঘুমুতে আসেন। ফিরে এসেও লিলি ঘুমুচ্ছে কি-না পরীক্ষা করার জন্য দুএক বার নরম গলায় ডাকেন লিলি, লিলি। লিলি ঘুমুচ্ছে নিশ্চিত হবার পর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন।

    মাঝরাতে মার উঠে যাবার এই ভয়াবই অস্বস্তিকর সমস্যা থেকে লিলি অবশ্যি এখন মুক্ত হয়েছে। রুমু ঝুমুকে আলাদা রাখার ব্যবস্থার নতুন নিয়মে রুমু এখন লিলির সঙ্গে ঘুমায়। ফরিদা ঘুমান ঝুমুর সঙ্গে। লিলির অস্বস্তিকর মুহূর্ত এখন নিশ্চয়ই ঝুমু ভোগ করে কিভাবে সে কে জানে। লিলি ভেবে পায় না, মানুষ এত অবিবেচক হয় কী করে?

    স্বাতী এলো রাত আটটার দিকে। সেজেগুজে একেবারে পরী হয়ে এসেছে। ঘরে ঢুকেই সে বলল, তোরা ভাত খাস কখন? আমি আজ রাতে তোদের সঙ্গে খাব।

    লিলির হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। যেসব নাটক হয় তাদের খাবার টেবিলে, বাইরের কাউকে নিয়ে খেতে বসার প্রশ্নই আসে না।

    নেয়ামত সাহেব দোতলার বারান্দায় রাখা জলচৌকিতে বসে তসবি পড়ছিলেন। তিনি সেখান থেকেই গম্ভীর গলায় বললেন, ফরিদা কে আসল? এত রাতে আসল কে?

    লিলির মুখ শুকিয়ে গেল। লিলি করুণ চোখে মার দিকে তাকাল। সে তাকানোর অর্থ–মা আমাকে বাঁচাও। ফরিদা তৎক্ষণাৎ দোতলায় উঠে গেলেন। লিলি মার ওপর তেমন ভরসা করতে পারছে না। স্ত্রীর কথায় প্রভাবিত হবার মানুষ নেয়ামত সাহেব না।

    স্বাতী বলল, চল তোর বাবার সঙ্গে আগে দেখা করে আসি।

    লিলি ক্ষীণস্বরে বলল, বাবার সঙ্গে দেখা করার দরকার নেই। বাবা তসবি পড়ছেন–এখন গেলে বিরক্ত হবেন।

    বিরক্ত হবেন না, আয় তো।

    স্বাতী তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। লিলিকে বাধ্য হয়ে তার পেছনে পেছনে। যেতে হচ্ছে। বারান্দায় বাতি জ্বলছে। নেয়ামত সাহেব জলচৌকির উপর বসে আছেন। হাতে তসবি। লুঙ্গি পরা খালি গায়ের একটা মানুষ, মাথায় আবার টুপি।

    স্বাতী নিচু হয়ে কদমবুসি করল, নরম গলায় বলল, চাচা ভালো আছেন?

    নেয়ামত সাহেব হকচকিয়ে গেলেন। কদমবুসির জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না।

    আমাকে বোধহয় চিনতে পারছেন না। আমি লিলির বন্ধু। আমার নাম স্বাতী। আগেও কয়েক বার এসেছি। আপনি বোধহয় মনে করতে পারছেন না।

    ও আচ্ছা।

    আমিও অবশ্যি ইচ্ছে করে আপনার কাছ থেকে দূরে দূরে থেকেছি। আপনাকে যা ভয় লাগে। লিলি আপনাকে যতটা ভয় পায় আমিও ততটা পাই।

    নেয়ামত সাহেব খুশি হলেন। তবে খুশি প্রকাশ করলেন না। খুশি যে হয়েছেন তা বোঝা গেল তার পা নাড়া দেখে। খুশির কোনো ব্যাপার হলে তিন পা নাচান। স্বাতী বলল, চাচা, আপনার কাছে আমি একটা নালিশ করতে এসেছি। লিলির বিরুদ্ধে কঠিন একটা নালিশ। আপনি আজ বিচার করে দেবেন।

    নেয়ামত সাহেব পা নাচানো বন্ধ করে শীতল গলায় বললেন, কী ব্যাপার?

    আমি তো দেশের বাইরে চলে যাব। আর ফিরর না। যাবার আগে আমি আমার সব বান্ধবীর বাসায় এক রাত করে থাকব বলে ঠিক করেছি। অনেকের সঙ্গে থেকেছি, সারা রাত গল্প করেছি। লিলি শুধু বাদ। ও কিছুতেই রাতে আমাকে থাকতে দেবে না।

    সারারাত জেগে গল্প করার দরকার কি? শরীর নষ্ট। দিনে গল্প করলেই হয়।

    না চাচা, রাতের গল্পের আলাদা আনন্দ–আপনি লিলিকে একটু বলে দিন। আজ আমি থাকব। মন ঠিক করে এসেছি।

    তোমার বাবা-মা চিন্তা করবে।

    তাদের বলে এসেছি। কিন্তু আপনি লিলিকে কড়া করে ধমক না দিলে ও রাখবে না।

    নেয়ামত সাহেব বিরক্ত-চোখে ফরিদার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি সংসারে কাজকর্ম ফেলে শুধু শুধু এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন?

    ফরিদা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে চলে যাচ্ছেন। লজ্জায় লিলির মরে যেতে ইচ্ছা করছে। সে এখন নিশ্চিত যে বাবা স্বাতীকে বলবেন, নিজের বাড়িঘর ফেলে অন্যের বাড়িতে থাকা তিনি অত্যন্ত অপছন্দ করেন।

    নেয়ামত সাহেব হাত থেকে তসবি নামিয়ে রাখতে রাখতে স্বাতীর দিকে তাকিয়ে শুকনো গলায় বললেন, তোমাদের বাসায় টেলিফোন আছে?

    জি চাচা, আছে।

    লিলি টেলিফোনটা আন। আমি টেলিফোনে তোমার বাবার অনুমতি নিয়ে নিই।

    আমি অনুমতি নিয়েই এসেছি চাচা।

    নেয়ামত সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, তুমি নিয়েছ সেটা তোমার ব্যাপার। আমি তো নেই নাই। টেলিফোন নাম্বার কত?

    ৮৬৫৬০০, এখন টেলিফোন করলে পাবেন না চাচা। বাবা-মা এক বিয়েতে গেছেন। ফিরতে ফিরতে রাত দশটা বাজবে।

    যে বাড়িতে গেছেন তাদের টেলিফোন নাই?

    জি আছে।

    দাও, ঐ নাম্বারটা দাও।

    স্বাতী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল।

    নেয়ামত সাহেব টেলিফোন করলেন। বিয়ে বাড়ির ভয়াবহ হাঙ্গামার ভেতরও স্বাতীর বাবা নাজমুল সাহেবকে টেলিফোনে ধরলেন। কথা বললেন। তারপর টেলিফোন নামিয়ে শুকনো মুখে বললেন, তোমার বাবা থাকার অনুমতি দিয়েছেন। থাকো।

    লিলি স্বাতীকে নিয়ে দ্রুত তার বাবার সামনে থেকে সরে এলো। বড় চাচার ঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় তিনি ডাকলেন–কে যাচ্ছে লিলি না-কি, শুনে যা

    তো! লিলি দাঁড়াল না, চট করে সরে গেল।

    স্বাতী বলল, তুই তো কঠিন এক বাড়িতে বাস করছিস।

    লিলি বলল, হুঁ।

    আমার এত ঠাণ্ডা মাথা। সেই মাথাও তোর বাবা প্রায় এলোমেলো করে ফেলেছিলেন। তবে আমিও বাঘা তেঁতুল। থাকার অনুমতি আদায় করে ছাড়লাম।

    হুঁ।

    হুঁ হুঁ করিস না। প্রাণখুলে গল্প কর। তোরা ভাত কখন খাস?

    একেকজন একক সময়। ধরাবাধা কিছু নেই।

    তাহলে তো সুবিধাই হলো। আমরা দুজন রাত বারোটার দিকে চুপি চুপি এসে খেয়ে চলে যাব। সারা রাত গল্প চলবে। ফ্লাক্স ভর্তি চা বানিয়ে রাখব। ঘুম পেলে চা খাব, সিগারেট খাব।

    সিগারেট খাবি মানে?

    আকাশ থেকে পড়ার মতো ভঙ্গি করবি না। সিগারেট এক প্যাকেট নিয়ে এসেছি। মেয়েদের জন্য বানানো স্পেশাল আমেরিকান সিগারেট। নাম হচ্ছে কাট সিল্ক। তামাক নেই বললেই হয়। আচ্ছা শোন, তোদের বাসার ছাদটা কেমন, ভালো?

    হুঁ।

    তাহলে ছাদে বসে গল্প করব। চাদর থাকবে, বালিশ থাকবে, মশার কয়েল জ্বালানো থাকবে। আমরা আকাশের তারা দেখতে দেখতে গল্প করব। তুই কি কখনও আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে গল্প করেছিস?

    না।

    দারুণ ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হয়। ধর দুজনে মিলে ছাদে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে গল্প করছিস। তারা ঝিলমিল করছে। হঠাৎ দেখছি তারাগুলো আকাশ থেকে নেমে চোখের সামনে চলে এসেছে। এত কাছে যে ইচ্ছা করলে হাত দিয়ে তারাদের ছোঁয়া যায়।

    লিলি অস্পষ্ট স্বরে বলল, তুই কার সঙ্গে শুয়ে তারা দেখেছিস?”

    স্বাতী হাসল। হাসতে হাসতেই বলল, তুই যা ভাবছিস তাই।

    কতক্ষণ তারা দেখেছিস?

    এত ইন্টারেস্টিং লাগছিল যে সারারাতই দেখলাম। খালার বাসায় যাবার কথা বলে ওর ওখানে চলে গিয়েছিলাম। তারপর কাণ্ড কি হয়েছে শোন, ভোররাতে ঘুমিয়ে পড়লাম। হঠাৎ জেগে উঠে দেখি ধুম বৃষ্টি হচ্ছে–আমরা দুজনে বৃষ্টি মাখামাখি। হি হি হি।

    লিলির গা কাঁটা দিয়ে উঠল–কী সর্বনাশের কথা!

    স্বাতী বলল, আমাকে তোর ঘরে নিয়ে চল। বাতি নিভিয়ে দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকব। রাত জাগার জন্য ব্যাটারি চার্জ করে নিতে হবে। গত দুরাতেও ঘুমুই নি। আমাকে দেখে কি সেটা বোঝা যাচ্ছে?

    তোকে দেখে কিছুই বোঝা যায় না।

    ঠিক বলেছিস। আমি হলাম বরফের মতো–বারো ভাগের এগারো অংশই পানির নিচে, এক অংশ উপরে।

    লিলি স্বাতীকে তার ঘরে নিয়ে গেল। স্বাতী আসবে এই ভেবে ঘর কিছুটা গোছানো ছিল তারপরেও কি বিশ্রী দেখাচ্ছে। কতদিন দেয়ালে চুনকাম হয় না। উত্তর দিকের দেয়ালে নোনা ধরেছে। প্রাস্টার খসে খসে পড়ছে। খাটের নিচে রাজ্যের ট্রাঙ্ক, অ্যালুমিনিয়ামের বড় বড় ডেকচি–যেগুলো বছরে একবার কোরবানির ঈদে বের হয়।

    খাটের পাশে ড্রেসিং টেবিল একটা আছে–যার আয়না নষ্ট হয়ে গেছে। চেহারা খানিকটা দেখা যায়, খানিকটা দেখা যায় না। ড্রেসিং টেবিলের সঙ্গেই লিলির পড়ার টেবিল। পড়ার টেবিলে বইপত্রের সঙ্গে এক কোনায় শ্যাম্পুর বোতল, ক্রিমের কৌটা, চিরুনি। স্বাতী এই ঘরে রাত কাটাবে ভাবতেই কেমন লাগে। স্বাতীর নিজের ঘর ছবির মতো গোছানো। কে জানে হয়তো ছবির চেয়েও সুন্দর।

    স্বাতীর ঘরের তিন দিকের দেয়াল দুধের মতো শাদা, একদিকের দেয়ালে নীল রঙ। সেই দেয়ালে পেইন্টিং ঝুলছে। নিচু একটা খাট। খাটটার পায়ের কাছে ছোট্ট বারো ইঞ্চি রঙিন টিভি। পুরো দেয়াল ঘেঁষে মিউজিক সেন্টার সাজানো। সেখানে মনে হয় দিনরাতই গান বাজে। লিলি যতবারই ঘরে ঢুকেছে ততবারই শুনেছে গান হচ্ছে। ঘরের মেঝে দেয়ালের মতোই ধবধবে শাদা। সেই শাদার উপর ছোট্ট নীল রঙের সাইড কার্পেট। ঘরের এক কোনায় একটা পড়ার টেবিল আছে। ফাইবার পলিশ করা কাঠের চেয়ার টেবিল দেয়ালের রঙের সাথে মেলানো।

    সবচেয়ে সুন্দর স্বাতীর বাথরুম। যেন আলাদা একটা জগত। গোল বাথটাব লিলি স্বাতীর বাথরুমেই প্রথম দেখে যেন ঘরের ভেতর ছোট দিঘি। বাথটাবের ভেতরটা নীল রঙ করা বলেই পানি দিয়ে ভর্তি করলে পানিটাকে নীল দেখায়।

    যে স্বাতী এ-রকম জায়গায় থেকে অভ্যস্ত, সে লিলির ঘরে ঘুমুবে কি করে। তারচেয়ে ছাদে সারারাত জেগে থাকাই ভালো। স্বাতী অবশ্যি লিলির ঘরে ঢুকে তপ্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, তোর খাটটা তো বিরাট, হাত ছড়িয়ে শোয়া যায়। আমি শুয়ে পড়লাম। শুয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ব। তুই বাতি নিভিয়ে চলে যাবি। আমাকে ডেকে তুলবি ঠিক বারোটায়। তখন ভাত খেয়ে গল্প শুরু করব।

    স্বাতী জুতা খুলে বিছানায় উঠে পড়ল। সহজ গলায় বলল, পাতলা একটা চাদর আমার গায়ে দিয়ে দে, ঘুমে চোখের পাতা মেলে রাখতে পারছি না।

    লিলি তার ঘরের বাতি নিভিয়ে দরজা বন্ধ করে বের হয়েছে। তার কাছে মনে হচ্ছে এখন তার আর কিছু করার নেই। রাত বারোটা না বাজা পর্যন্ত তাকে অস্বস্তি নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে। ছাদে গিয়ে একবার ছাদটা দেখে আসা দরকার। তার মনে হচ্ছে ছাদে রাজ্যের ময়লা। বুয়াকে নিয়ে একটু বোধহয় পরিষ্কার করে রাখা দরকার। লিলি ছাদে উঠল।

    ছাদের চিলেকোঠার ঘরে বাতি জ্বলছে। লিলির ছোট চাচা জাহেদুর রহমান এই সময় ঘরে ফেরে না। আজ ফিরেছে। ছোট চাচার ঘরটা আজ রাতের মতো নিয়ে নিতে পারলে খুব ভালো হতো, এই ঘরটা সুন্দর। স্বাতী এই ঘরে অস্বস্তিবোধ করবে না। তা ছাড়া এই ঘরে থাকলে যখন ইচ্ছা করবে তখন ছাদে আসা যাবে। লিলি খোলা দরজা ধরে দাঁড়াল। জাহেদ লিলির দিকে না তাকিয়েই বলল, কি খবর মাই ডিয়ার লিলি বেগম। হার এক্সেলেন্সি!

    খবর ভালো ছোট চাচা! তুমি আজ সকাল সকাল ফিরলে যে। এগারোটা বারোটার আগে তো কখনও ফেরো না।

    একদিন ফিরে দেখলাম কেমন লাগে। আয়, ভেতরে আয়। তোকে তো কখনও সন্ধ্যার পর ছাদে দেখা যায় না। আজ কি মনে করে?

    তোমার কাছে একটা আবেদন নিয়ে এসেছি, ছোট চাচা।

    আবেদন গ্রান্টেড।

    না শুনেই গ্রান্ট করে দিলে?

    হুঁ। আজ আমার মনটা ভালো। এইজন্যই পেয়ে গেলি।

    মন ভালো কেন?

    এখন বলব না। যথাসময়ে বলব। আবেদনটা কি?

    আমার এক বান্ধবী এসেছে–রাতে আমার সঙ্গে থাকবে। তুমি কি আজ রাতে তোমার ঘরটা আমাদের ছেড়ে দেবে।

    একি! তুই দেখি রাজত্ব চেয়ে ফেললি। ঘরটাই আমার রাজত্ব।

    শুধু এক রাতের জন্য চেয়েছি।

    নিজের ঘর ছাড়া অন্য কোনো ঘরে আমার এক ফোঁটা ঘুম হয় না। যাই হোক বেকুবের মতো আগেই যখন গ্রান্টেড বলে দিয়েছি তখন গ্রান্টেড। এক্ষুনি ঘর ছেড়ে দিচ্ছি।

    রাত বারোটার সময় ছাড়লেই হবে। ছোট চাচা, থ্যাংক য়্যু। তুমি এবারে অবশ্যই আমেরিকার ভিসা পাবে। আমি সত্যি সত্যি তোমার জন্য দোয়া করব।

    জাহেদুর রহমান বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল, ড্রয়ারে হাত দিবি না। টেবিলের উপর কাগজপত্র আছে, ঘাটাঘাটি করবি না।

    কোনো কিছুতেই আমরা হাত দেব না।

    গুড।

    .

    রাত একটার দিকে লিলি স্বাতীকে নিয়ে ছাদে এলো। চিলেকোঠার কাছে এসে স্বাতী। থমকে দাঁড়াল। অবাক হয়ে বলল, তোদের ছাদের এই ঘরটা তো সুন্দররে। কে। থাকে এখানে?

    আমার ছোট চাচা?

    বাহ্, ঘরটাও তো খুব গোছানো। শুধু একটাই সমস্যা ব্যাচেলার ব্যাচেলার গন্ধ।

    লিলি বলল, রাতে আমরা এই ঘরে ঘুমুব।

    স্বাতী বলল, ঘুমুবার জন্য তোর এখানে এসেছি না-কি? ঘুমুব না। আমার যা ঘুমানোর ঘুমিয়ে ফেলেছি। ছাদে বিছানা করতে বলেছিলাম, করিস নি?

    করেছি। ঐ কোনায়।

    বাহ সুন্দর তো! অসাধারণ।

    একটা শীতল পাটি বিছিয়েছি শুধু–অসাধারণের কি!

    এইটাই অসাধারণ। ছাদের উপর শীতল পাটি মানায়, গদির বিছানা মানায় না। বালিশ কোথায়?

    ছোট চাচার ঘর থেকে নিয়ে আসছি।

    উহু-ব্যাচেলার গন্ধওয়ালা বালিশে আমি ঘুমুব না। তুই তোর ঘর থেকে বালিশ নিয়ে আয়। ফ্লাস্কভর্তি করে চা আনতে বলেছিলাম, এনেছিস?

    আমাদের ফ্লাক্স নেই।

    বলিস কি, তোদের ফ্লাক্স নেই?

    লিলি হাল্কা গলায় বলল, আমাদের কিছুই নেই।

    চা ছাড়া সারারাত জাগব কীভাবে?

    তোর যখন চা খেতে ইচ্ছা করবে বলবি, ছোট চাচার ঘরে ওয়াটার হিটার আছে, টি ব্যাগ আছে। চা বানিয়ে দেব।

    দেয়াশলাই আনবি। সিগারেট খেতে হবে। তুই আবার না না করে ঢং করতে পারবি না। তুইও খাবি।

    লিলি এবং স্বাতী পাটিতে শুয়ে আছে। মাথার উপর তারা ভরা আকাশ। স্বাতী বলল, তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকবি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে না, সাধারণভাবে। তারার দিকে তাকিয়ে গল্প করতে থাকবি।

    কী গল্প?

    যা মনে আসে।

    লিলি বলল, তুই আমার গল্প শোনার জন্য এত যন্ত্রণা করে আমার সঙ্গে শেয়ার ব্যবস্থা করেছিস তা কি ঠিক? তুই এসেছিস তোর গল্প বলার জন্য। কী বলতে চাস বল, আমি শুনছি।

    স্বাতী নিচু গলায় বলল, হাসনাতকে যখন বললি–আমি আসব না তখন সে কী বলল?

    টেলিফোনে তো একবার বলেছি।

    আবার বল। টেলিফোনে কি বলেছিস আমার মনে নেই। উনি কিছুই বলেন নি।

    কিছুই না?

    না।

    ভালো করে ভেবে বল। হয়তো কিছু বলেছে।

    বলেছেন–ও আচ্ছা।

    সেই ও আচ্ছাটা কিভাবে বলল?

    ও আচ্ছা বাক্যটা অনেকভাবে বলা যায়। হাই ড্রামা করে বলা যায়, গভীর বিষাদের সঙ্গে বলা যায়, রাগের সঙ্গে বলা যায়। ও কীভাবে বলল?

    খুব সাধারণভাবে বলেছেন।

    স্বাতী নিশ্বাস ফেলে বলল, আমার ধারণা ওর মধ্যে ড্রামা কম। আবেগ আছে–তবে তা আইসবার্গের মতো। চোখে পড়ে না।

    লিলি শান্ত গলায় বলল, একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠভাবে মিশলি, সারারাত জেগে তারা দেখলি, বিয়ে ঠিকঠাক করলি, তারপর হুট করে সব ভেঙে দিলি?

    স্বাতী বলল, আমার চায়ের পিপাসা হচ্ছে।

    তুই আমার প্রশ্নের জবাব দিস নি।

    প্রশ্ন কোথায়? প্রশ্ন না করলে জবাব দেব কী? বল, তোর প্রশ্ন বল।

    বিয়ে সত্যি সত্যি পুরোপুরি ভেঙে গেছে?

    হুঁ।

    কেন?

    আমি ঠিক যে রকম মানুষ চাচ্ছি সে রকম মানুষ ও না।

    তুই কী রকম মানুষ চাচ্ছিস?”

    ব্যাখ্যা করতে পারব না।

    উনি যে সে রকম মানুষ না সেটা বুঝলি কী করে? মানুষ বুঝতেও তো সময় লাগে।

    তাকে সময় দিয়েছি। এত ঘনিষ্ঠভাবে তার সঙ্গে যে মিশলাম, কেন মিশলাম? তাকে ভালোমতো জানার জন্যই মিশলাম। লিলি চা খাব।

    লিলি চা বানানোর জন্য উঠে গেল। স্বাতী শুয়ে শুয়ে তারা দেখছে। ঐ রাতের মতো হচ্ছে না, তারাগুলো ঝট করে চোখের উপর নেমে আসছে না। কে জানে আকাশের তারা নামানোর জন্য একজন প্রেমিক পুরুষ হয়তো দরকার হয়।

    লিলি চা নিয়ে এসেছে। স্বাতী উঠে বসতে বসতে বলল, দেয়াশলাই এনেছিস?

    লিলি দেয়াশলাই সামনে রাখল।

    স্বাতী বলল, তুই দেয়াশলাইটা এমনভাবে ছুঁড়ে ফেললি যেন আমি দেয়াশলাই দিয়ে ভয়ঙ্কর কোনো পাপ করতে যাচ্ছি। তা কিন্তু করছি না। আমি অতি নিরীহ একটা সিল্ককাট সিগারেট আগুন দিয়ে পুড়াব। তুইও পুড়াবি।

    আমি না।

    আচ্ছা লিলি, তোর মধ্যে কি কৌতূহল বলে কিছু নেই? এই যে হাজার হাজার ছেলে, বুড়ো, জোয়ান ধুমসে সিগারেট খাচ্ছে, কায়দা করে ধোঁয়া ছাড়ছে–ব্যাপারটা কি একবার জানারও ইচ্ছা হয় না?

    না।

    এই যে আমি সিগারেট টানছি, আমাকে দেখেও ইচ্ছা হচ্ছে না?

    না।

    থাক তাহলে, জোর করব না। খুব মানসিক চাপের মধ্যে আছি। ভেবেছিলাম তোর সঙ্গে রাত জেগে, হইচই করে, সিগারেট টেনে চাপটা কমাব। তোর কাছে আসায় লাভের মধ্যে লাভ এই হয়েছে মনের চাপটা বেড়েছে। তুই তোর সুন্দর মুখ শ্বেতপাথরের মূর্তির মুখের মতো করে রেখেছিস। আমার সঙ্গে এ-রকম আচরণ করছিস যেন আমি সিন্দাবাদের ভূত হয়ে তোর ঘাড়ে চেপে আছি। শুনুন ইয়াং লেডি, আমি কোনো সিন্দাবাদের ভূত না। আমি কারোর ঘাড়ে চাপি না।

    তোর চাপটা কী জন্য? বিয়ে ভেঙে দেয়ার জন্য?

    না। ওর কাছে আমার একটা পেইন্টিং আছে। পেইন্টিংটা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে।

    লিলি ভীত গলায় বলল, কী রকম পেইন্টিং?

    বুঝতেই তো পারছিস কি রকম।

    বুঝতে পারছি না।

    স্বাতী সিগারেটটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল, নুড স্টাডি।

    সেটা আবার কী?

    ন্যাকামি করিস না তো লিলি। ন্যাকামি আমার অসহ্য লাগে। নুডু স্টাডি কি তুই সত্যি জানিস না?

    না।

    ছবিটার নাম মধ্যাহ্ন। ছবিটা হচ্ছে এ-রকম–আমি উপুড় হয়ে শুয়ে একটা বই পড়ছি, খুব মন দিয়ে পড়ছি। আমার মাথার চুলে বইটারএকটা পাতা ঢাকা। আর আমার গায়ে কোনো কাপড় নেই।

    লিলি আতঙ্কিত গলায় বলল, গায়ে কাপড় নেই মানে কী?

    কাপড় নেই মানে কাপড় নেই।

    এ রকম ছবি আঁকার মানে কী?

    স্বাতী দ্বিতীয় সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল–খালি বাড়ি, ঝাঝা দুপুর। একটি তরুণী মেয়ের নগ্ন হয়ে বই পড়তে ইচ্ছা হয়েছে, সে বই পড়ছে। আর্টিস্ট সেই ছবি এঁকেছেন।

    কোনো মেয়ের এ-রকম নগ্ন হয়ে বই পড়ার অদ্ভুত ইচ্ছা হবে কেন?

    স্বাতী বিরক্ত হয়ে বলল, তোর সঙ্গে ছবি নিয়ে আমার কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। চুপ করে থাক।

    লিলি বলল, ঐ ছবির জন্য তোর দুশ্চিন্তা হচ্ছে?

    হ্যাঁ। ছবিটা এত সুন্দর হয়েছে আমার ধারণা শিল্পকলা একাডেমীতে ওর যে সলো এক্সিবিশন হবার কথা সেখানে ছবিটা থাকবে। হাজার হাজার মানুষ আমাকে নগ্ন দেখবে।

    তোর অসম্মান হবে এ-রকম কাজ উনি কখনও করবেন না।

    ও করবে। লেখক, কবি, শিল্পী এদের কাছে সৃষ্টিটাই প্রধান। সৃষ্টির পেছনের মানুষটা প্রধান না। আমার সম্মান হবে, না অসম্মান হবে তা সে দেখবে না। সে দেখবে তার ছবি সুন্দর হয়েছে। ছবিটা অন্যদের দেখানো দরকার।

    এখন তাহলে কী করবি?

    আমি কিছু করব না। যা করার তুই করবি। তুই তার সঙ্গে কথা বলে ছবিটা নিয়ে আসবি।

    আমি?

    হ্যাঁ তুই। তুই ছাড়া এসব কথা আমি কি আর কাউকে বলতে পারি? দুজনের মধ্যে যখন সমস্যা হয় তখন সমস্যা সমাধানের জন্য একজন মিডলম্যান লাগে। তুই সেই মিডলম্যান। নে, ফাঁসির আসামীর মতো চেহারা করবি না।

    আমি একা একা ঐ বাড়িতে যাব?

    হ্যাঁ–ও বাঘ-ভালুক না। তোকে খেয়ে ফেলবে না।

    আমাকে খুন করে ফেললেও আমি যাব না।

    আচ্ছা বেশ। না গেলে না যাবি। নে সিগারেট খা। এখনও যদি না বলিস–আমি কিন্তু তোকে ধাক্কা দিয়ে ছাদ থেকে নিচে ফেলে দেব।

    লিলি কিছু বলল না। স্বাতী বলল, আয় আকাশের তারা দেখতে-দেখতে গল্প করি। বিপদ হয়েছে আমার আর তুই ভয়ে এত অস্থির হয়ে পড়েছিস কেন?

    .

    লিলি তার বান্ধবীকে নিয়ে ছাদে কি করছে এটা দেখার জন্য নেয়ামত সাহেব রাত তিনটার দিকে ছাদে এলেন। তিনি দেখলের দুজন পাটি পেতে আকাশের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে। দুজনের হাতেই জ্বলন্ত সিগারেট।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনীল হাতী – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article ১৯৭১ – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই বসন্তে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই মেঘ, রৌদ্রছায়া – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এইসব দিনরাত্রি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 23, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Our Picks

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }