সৈকত রহস্য – ১০
দশম পরিচ্ছেদ
(১)
হাতটার জন্যে হাসপাতালে যেতেই হল। তবে রাত্রিবাস করতে হয়নি। ডাক্তার কেয়ার চেনা। বেশি বয়েস নয়। কথা বলতে বলতে ভাঙা হাড় সেট করে দিল। তারপর প্লাস্টার। বলল, ছ’সপ্তাহের আগে প্লাস্টার খোলা যাবে না। তার মধ্যে অন্তত প্রথম দুতিন সপ্তাহ বাড়িতে থাকলে ভাল হয়। আর নেহাত যদি এক-আধদিন বেরোতেই হয়, খুব সাবধানে, ভাঙা হাতটাতে কোনও রকম চাপ না দিয়ে বেরোতে হবে। প্লাস্টার করার পর তিনদিন আদিত্যর বাড়িতেই কাটল। এই ঘটনাটার পর কেয়া ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে।
রাখি চক্রবর্তীর অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। আইসিইউ থেকে বেরোতে পারেননি, হয়তো দুএকদিনের মধ্যে ভেন্টিলেটরে দেওয়া হবে। প্রদীপ চক্রবর্তীর সঙ্গে রোজই ফোনে কথা হয়। মানুষটা একেবারে ভেঙে পড়েছে। এর মধ্যে কেয়া দুদিন রাখি চক্রবর্তীকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিল।
আদিত্যর বন্দিদশার পঞ্চম দিন সকালে উঠে সে খবর কাগজে দেখল পুলিশ অনিতা চৌধুরিকে তার স্বামী সৈকত চৌধুরির খুনের দায়ে গ্রেপ্তার করেছে।
আদিত্য ভেবে দেখল এটা হবারই ছিল। তবু একেবারে টাটকা খবরটা জানার জন্যে সে বাঁ হাতে মোবাইল তুলে অচিন্ত্য সাহার নম্বরটা লাগাল।
‘কেমন আছেন এখন?’ অচিন্ত্য সাহার গলাটা আন্তরিক শোনাল। আদিত্যর অ্যাক্সিডেন্টটা হবার পর অচিন্ত্য সাহা একবার ফোন করেছিল।
‘ওই আছি একরকম। যন্ত্রণাটা নেই। কিন্তু অসুবিধে তো আছেই। ডান হাতটা একেবারে অকেজো হয়ে রয়েছে। তাছাড়া বাড়ি থেকেও বেরতে পারছি না।’
‘না, না। এখন কটা দিন বিশ্রাম করুন। একেবারে বেরোবেন না। সবার আগে হাতটা তো জোড়া লাগা দরকার।’
‘একটা খবর জানতে আপনাকে ফোন করলাম।’ আদিত্য প্রসঙ্গ বদলালো। ‘খবরটা আজ কাগজে বেরিয়েছে। বুঝতেই পারছেন, কোন খবরের কথা বলছি।’
‘আন্দাজ করতে পারছি। অনিতা চৌধুরির অ্যারেস্টের খবরটা বলছেন তো?’
‘হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন।’
‘অ্যারেস্টটা স্যার করতেই হল। ওপরওলার চাপ, মিডিয়ার গালাগালি, সব মিলিয়ে কাউকে না কাউকে অ্যারেস্ট করতেই হত। না হলে লোকে বলত পুলিশ নিষ্কর্মা, হাত গুটিয়ে বসে আছে।’
‘আর কিছু এভিডেন্স পেয়েছেন অনিতা চৌধুরির এগেন্সটে?’
‘নতুন করে আর কিছু পাইনি। কিন্তু মোটিভই বলুন, সুযোগই বলুন, অনিতা সবার থেকে এগিয়ে। যাকে বলে প্রাইম সাসপেক্ট। জানি আপনি একমত হবেন না। কিন্তু এটা তো মানবেন, অন্তত আপাতদৃষ্টিতে এমন কেউ নেই যাকে অনিতার থেকে বেশি সন্দেহ করা যায়।’
‘আসলে অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। ধরে নিলাম, সেদিন সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে অনিতা প্রথমে তার স্বামীর ঘরে গিয়ে স্বামীকে খুন করে। তারপর পড়শিদের জানায় যে সৈকত চৌধুরি খুন হয়ে গেছে। কিন্তু অনিতা মার্ডার ওয়েপনটা পেল কোথা থেকে? খুন করার পর সে অস্ত্রটা রাখলই বা কোথায়? সেটা তো এখনও পাওয়া যায়নি। তাছাড়া প্রশ্ন, অনিতা কি আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতে জানত? এমনিতে না জানাই সম্ভব। তাহলে সে কি কোথাও আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর ট্রেনিং নিয়েছিল?’
‘আমি মানছি স্যার এসব প্রশ্নের উত্তর এখনও আমাদের কাছে নেই। কিন্তু এগুলো জানার জন্যেই তো আমরা অনিতাকে কাস্টডিতে নিয়েছি। আমাদের বিশ্বাস পুলিশি জেরার মুখে পড়লে অনিতা সব কথা বলে দেবে।’
‘ঠিক আছে, দেখুন কী দাঁড়ায়।’ আদিত্য ফোন কেটে দিয়ে কিছুক্ষণ গভীর চিন্তায় ডুবে রইল।
কেয়া স্কুলে গেছে। একটু পরে রান্নার মাসি আসবে। আজকাল আদিত্য বাড়ি থাকছে বলে রান্নার মাসি সন্ধেবেলা আসার বদলে দুপুরেই কাজ সেরে বাড়ি চলে যাচ্ছে। কেয়া লিখে দিয়ে গেছে কী কী রান্না করতে হবে। কেয়ার ধারণা মুখে বলে দিলে আদিত্য কিচ্ছু মনে রাখতে পারবে না। ধারণাটা ভুল নয়। তবে মাসি পড়তে পারে না। কাগজটায় কী লেখা আছে আদিত্যকেই পড়ে দিতে হবে।
রান্নার মাসি আসতে আরও আধঘন্টা দেরি আছে। এই ফাঁকে এক কাপ কফি খাওয়া যেতেই পারে। বাঁ হাত দিয়েই এক কাপ কফি করে নেওয়া সম্ভব। কফি করতে করতে এবং পরে খেতে খেতে আদিত্য গভীরভাবে চিন্তা করছিল। সৈকত চৌধুরি, মণিময় গুপ্ত, অসীম দত্ত এবং অনিকেত দত্ত এই চারটে খুনের রহস্যের সে মোটামুটি সমাধান করে ফেলেছে। এবং কারা রাজারহাট নিউটাউনের রাস্তায় তাকে গুলি করে মারতে চেয়েছিল সেটাও সে জানতে পেরেছে। তা হলে এখন তার কী করণীয়? সে যেটা জানতে পেরেছে, পুলিশকে জানাবে? পুলিশ বিশ্বাস করবে তার কথা? তার হাতে যথেষ্ট প্রমাণ আছে কি?
মোবাইলটা হঠাৎ বেজে উঠল। কেয়া। কেয়া তো এই সময় কখনও ফোন করে না। তার তো এই সময় ক্লাসে থাকার কথা। একটা অজানা আশঙ্কায় আদিত্যর বুকটা কেঁপে উঠল।
‘শোন। একটা খারাপ খবর আছে।’ চাপা উত্তেজনায় কেয়ার গলাটা ভাঙা ভাঙা শোনাচ্ছে। ‘রাখিদি চলে গেলেন। একটু আগে শাশ্বতীর বাড়ি থেকে ফোন এসেছিল। দীপকদা ফোন করেছিলেন। আমি তোমাকে অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছি।। কিন্তু খালি তোমার ফোনটা বিজি পাচ্ছিলাম।’
আদিত্য চুপ করে ছিল। কী বলবে বুঝতে পারছিল না। রাখিদির চলে যাওয়াটা খানিকটা প্রত্যাশিতই ছিল, তবু, যাকে বলে হোপিং এগেন্সট হোপ। সকলেই মনে মনে ভাবছিল একটা মিরাকেল কি ঘটে যেতে পারে না?
‘কী গো? কথা বলছ না কেন? আমরা এখন কী করব? আজই কি একবার যাব?’
‘তুমিই বল কী করা উচিত। আমার এসব ব্যাপারে একদম মাথা খেলে না।’ আদিত্য নিরীহ গলায় বলল।
‘আমার মনে হয়, তোমার হাতের যা অবস্থা তাতে তোমার আজ শ্মশানে না যাওয়াই ভাল। আর গিয়েই বা কী করবে? মানুষটা তো আর ফিরে আসবে না। তার থেকে বরং প্রদীপদাকে একটা ফোন কোরো। আমিও করব। তারপর ধরো কাল সন্ধেবেলা কিংবা পরশু সকালে, মানে শুক্কুরবার সন্ধে কিংবা শনিবার সকাল, দুজনে মিলে একবার প্রদীপদার সঙ্গে দেখা করে আসব। কেমন? তোমার হাত কেমন আছে?’
‘হাত ঠিকই আছে। শ্মশানে কারা নিয়ে যাবে জান?’
‘দীপকদা যাবে। আর রাখিদির স্কুলের কয়েকজন কলিগ যাবে। তারা নাকি এতদিন জানতই না যে রাখিদি এত অসুস্থ। প্রদীপদা তাদের খবরই দেয়নি। আশ্চর্য!’
কেয়ার কথা শুনতে শুনতে আদিত্য অন্য একটা কথা গভীরভাবে চিন্তা করছিল।
বাড়ি ফিরে অবশ্য কেয়া মত বদলাল।
‘কাল সন্ধেবেলা গেলে খুব দেরি হয়ে যাবে না? আমার তো এখন মনে হচ্ছে কাল সকালেই একবার প্রদীপদার সঙ্গে দেখা করে আসা উচিত।’
‘আমি তো যেতেই পারি। কিন্তু তোমার সকালে স্কুল নেই?’
‘একটু দেরি করে যাব। প্রথম দুটো পিরিয়াড দুজন ম্যানেজ করে দিতে পারবে। আমি বলে এসেছি। প্রদীপদার সঙ্গে দেখা করে স্কুলে চলে আসব। ওখানে বেশিক্ষণ থাকব না। স্কুলে এসে থার্ড পিরিয়াডটা নেব। তুমি বরং পারলে আর একটু থেকে যেও।’
‘কিন্তু এই ভাঙা হাত নিয়ে আমি ফিরব কী করে?’
‘সেটা আমি ভেবে রেখেছি। গাড়ি তো একটা ভাড়া করতেই হবে। গাড়িটা প্রথমে আমাদের বালিগঞ্জে প্রদীপদার বাড়িতে নিয়ে যাবে। তারপর আমাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আবার তোমাকে নিতে বালিগঞ্জ ফিরে আসবে।’
রাত্তিরে শুতে যাবার আগে আদিত্য দুটো জরুরি ফোন করল। প্রথমটা বিমলকে। আগামীকাল কী করতে হবে সে-ব্যাপারে আদিত্য বিমলকে বিস্তারিতভাবে নির্দেশ দিল। দ্বিতীয় ফোন সিবিআই অফিসার অমিত সাক্সেনাকে। সাক্সেনার সঙ্গে আদিত্যর অনেকক্ষণ কথা হল।
ঘরে প্রদীপ চক্রবর্তী ছাড়া দুজন মহিলা রয়েছেন। খোলা জানলা দিয়ে এলোমেলো বাতাস ঢুকছে। হয়তো আবার বৃষ্টি হবে। মহিলা দুজন আদিত্যদের দেখে উঠে দাঁড়ালেন।
‘আমরা আজ আসি? পরে আবার একদিন আসব।’
‘আসুন।’ প্রদীপ চক্রবর্তীও দুই তালু একত্র করে উঠে দাঁড়িয়েছেন।
মহিলাদের সদর দরজা অবধি এগিয়ে দিয়ে প্রদীপ চক্রবর্তী আবার ফিরে এলেন। বিষণ্ণ গলায় বললেন, ‘তোমরা বোসো।’
আদিত্যরা এতক্ষণ দাঁড়িয়েই ছিল। এবার বসল। প্রদীপ চক্রবর্তীও বসেছেন। কাজের মাসি এসে ঘরে ঢুকেছে।
‘একটু চা খাও।’ প্রদীপ চক্রবর্তী আদিত্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন।
আদিত্যরা হ্যাঁ, না কিছুই বলল না। প্রদীপ চক্রবর্তী এবার কাজের মাসির উদ্দেশে বললেন, ‘এদের জন্যে চা করো। আমিও একটু খাব।’
‘শেষে হঠাৎ রাখিদির কী হল? আমরা তো ভাবছিলাম রাখিদি এবার ভেন্টিলেটার থেকে বেরিয়ে আসবে।’ কেয়া জিজ্ঞেস করল।
‘মাল্টি-অর্গান ফেলিওর। প্রথমে কিডনি দুটো অকেজো হয়ে গেল, তারপর একে একে শরীরের অন্য যন্ত্রগুলোও বিকল হতে শুরু করল। ডাঃ কুলকার্নি এখানকার ডাক্তারদের সঙ্গে নিয়মিত ভিডিও কনফারেন্স করে ইনস্ট্রাকশান দিচ্ছিলেন। কারোরই চেষ্টার কোনও ত্রুটি ছিল না।’ কথা থামিয়ে প্রদীপ চক্রবর্তী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
‘কাল সব কিছু ঠিকঠাক মিটে গিয়েছিল? আদিত্যর হাতের জন্যে আমরা শ্মশানে যেতে পারিনি। ডাক্তার ওকে বেশি নড়াচড়া করতে বারণ করেছে।’ কেয়াকে কিছুটা কুণ্ঠিত শোনাল।
‘না, না। তোমরা না গিয়ে ভালই করেছ। শ্মশানের কাজ মোটামুটি নির্বিঘ্নে হয়ে গেছে।আমি তো পরলোকে বিশ্বাস করি না, রাখিও করত না। তাই দাহ করার আগে ওইসব মন্ত্র-টন্ত্রর বদলে রাখির একজন পুরোনো কলিগ গান গাইলেন— আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে। ভাল গাইলেন। রাখিদের ইস্কুলে উনি গানের টিচার। এই আর কী। এইটুকুই হল।’ প্রদীপ চক্রবর্তী আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
‘তা হলে শ্রাদ্ধ-শান্তিও…’ আদিত্য কথাটা শেষ করল না।
‘না, শ্রাদ্ধ-শান্তি কিছু হবে না। তবে সপ্তাহখানেক পরে রাখিদের ইস্কুলে একটা স্মরণসভার আয়োজন হয়েছে।’
‘আপনি এখন এখানেই তো থাকছেন?’ আদিত্য হালকা করে জিজ্ঞেস করল।
‘আমি আর কোথায় যাব? তবে সারাদিন বাড়িতে থাকাটা বোধহয় আর হবে না। কিছু ছোটখাটো কাজ দেখতে হবে। আসলে, তোমাদের বলতে দ্বিধা নেই, সংসারটা রাখির পেনশনের টাকাতে চলত। সেটা তো বন্ধ হয়ে গেল। একটা ফ্যামেলি পেনশন অবশ্য আছে। কিন্তু সেটা যৎসামান্য। আর আমি তো বেসরকারি চাকরি করতাম, সেখানে পেনশন-টেনশন কিছু নেই। যেটুকু টাকা জমাতে পেরেছিলাম তার কিছুটা দিয়ে এই ফ্ল্যাটটা কিনেছিলাম। বাকি পুরোটাই রাখির চিকিৎসায় খরচ হয়ে গেছে। আমার শরীর মোটামুটি ঠিকই আছে, সপ্তাহে দু তিনদিন বেরোলে অসুবিধে হবে না। মনটাও অন্য কাজে ব্যস্ত থাকবে। আমার পুরোনো কোম্পানিতেই হয়তো একটা পার্ট টাইম কিছু পেয়ে যাব। তবে সবকিছুই এখনও অনিশ্চিত।’
কাজের মাসি চা এনেছে। সঙ্গে ক্রিম ক্র্যাকার।
চা খেয়ে কেয়া উঠে দাঁড়াল। ‘প্রদীপদা, আমাকে এবার উঠতে হবে। স্কুল আছে। আদিত্য আর একটু থাকছে।’
আরও ঘণ্টা দেড়েক পরে আদিত্য প্রদীপ চক্রবর্তীর বাড়ি থেকে বেরোল। মনটা অসম্ভব ভারাক্রান্ত হয়ে আছে। শরীর-মন দুটোই অবসন্ন। কেয়া ইস্কুলে পৌঁছে গাড়িটা পাঠিয়ে দিয়েছে। আদিত্য ভাঙা হাত বাঁচিয়ে খুব সাবধানে গাড়িতে উঠল। খানিক দূর যেতে না যেতেই গৌতমের ফোন।
‘তুই আছিস কেমন? হাতে আর ব্যথা আছে?’
‘ঠিকই আছি। হাতে যন্ত্রণা খুব একটা নেই, একটা বোঁদা ব্যথা আছে। সেটুকু সহ্য করে নেওয়া যায়।’
‘তুই কি বেরোচ্ছিস, নাকি বাড়িতেই আছিস?’
‘মোটামুটি বাড়িতেই থাকছি। তবে আজ চার-পাঁচদিন পরে একটু বেরিয়েছি। এই মুহূর্তে বাড়ির বাইরে।’
‘ও আচ্ছা। তা হলে কি তুই একবার লালবাজারে আসতে পারবি? আসলে, পুরীর ডিএসপি কৃষ্ণ পধি তার দলবল নিয়ে কলকাতায় এসেছে। দীপশিখার মাকে ইন্টারোগেট করেছে। আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছে। এবার তোর সঙ্গে কথা বলতে চায়। তোর কি দুপুরবেলা সময় হবে?’
‘নিশ্চয় হবে। আমি এখন গড়িয়াহাট মোড়ের কাছে আছি। আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছি। কিন্তু তোকে একটা কাজ করতে হবে। এই মিটিংটার মধ্যে আরও দুজনকে ডেকে নিতে হবে। একজন গড়িয়াহাট থানার অচিন্ত্য সাহা, অন্যজন বালিগঞ্জ থানার সুভদ্র মাজি। এরা দুজনেই আমার সঙ্গে কাজ করেছে।’
‘কিন্তু অচিন্ত্য সাহা তো সৈকত চৌধুরির কেসটা দেখছিল। অসীম দত্ত, অনির্বাণ দত্তদের খুনের কেসটার সঙ্গে ওর কী সম্পর্ক?’
‘শোন। চারজন খুন হয়েছে। সৈকত চৌধুরি, মণিময় গুপ্ত, অসীম দত্ত, অনির্বাণ দত্ত। আমি রহস্যটা ক্র্যাক করে ফেলেছি। চারজনকে একই লোক খুন করেছে। লালবাজারে গিয়ে কৃষ্ণ পধির কথা আমি অবশ্যই শুনব, কিন্তু আমার কথাটাও যাতে সকলে শোনে তোকে তার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। আমার বিশ্বাস, আমার কথা শোনার পর কারও মনে আর খুব বেশি প্রশ্ন থাকবে না।’
‘আদিত্য মজুমদার যখন বলছে একটা রহস্য ক্র্যাক করে ফেলেছে, তখন তো ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নিতেই হবে। আদিত্য মজুমদার তো মিছিমিছি বোস্ট করে না। ঠিক আছে বস। তুই চলে আয়। আমি সবাইকে হাজির করে রাখব। যবনিকা উত্তোলিত হোক।’
(২)
‘কিছু খাওয়াতে পারবি? বেশ খিদে পেয়ে গেছে। ভেবেছিলাম বাড়ি ফিরে খাব। তা, বাড়ি না ফিরে তো এখানে চলে এলাম।’
‘কী খেতে ইচ্ছে করছে বল।’
‘তুই লাঞ্চে কী খাস?’
‘আমি তো আজকাল টিফিন নিয়ে আসি। আজ স্যান্ডউইচ এনেছি। সেটা আমরা শেয়ার করতে পারি। কিন্তু আরও কিছু আনাতে হবে। একজনের খাবার দুজনে খেলে কারোরই পেট ভরবে না।’
‘তোদের এখানে এখনও দইবড়া পাওয়া যায়? একবার খাইয়েছিলি, খুব ভাল লেগেছিল।’
‘অবশ্যই পাওয়া যায়। তা হলে দইবড়াই আনতে দিই। স্যান্ডউইচ এবং দইবড়া। আর কফি। ভালই লাঞ্চ হবে।’
আদিত্য গৌতমের অফিসে একটু আগে আগেই পৌঁছে গেছে। বাঙালি ইন্সপেক্টার দুজনের কেউই এখনও এসে পৌঁছয়নি। উড়িষ্যার টিমও একটু আগে ফোন করে জানিয়েছে তাদের পৌঁছতে পৌঁছতে ঘণ্টা খানেক লেগে যাবে। অতএব এটাই লাঞ্চ খাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময়। তাছাড়া আদিত্যর বেশ খিদেও পেয়ে গিয়েছিল।
খেতে খেতে গৌতম জিজ্ঞেস করল, ‘ব্যাপারটা কী বলত? চার-চারটে খুন, তুই বলছিস একই লোক করেছে। অথচ পুলিশ সম্পূর্ণ অন্যভাবে চিন্তা করছে। দুটো অ্যারেস্টও করে ফেলেছে।’
‘আমি তোকে এক্ষুনি কিচ্ছু বলছি না। বলে দিলে তোর ইন্টারেস্ট চলে যাবে। শুধু এইটুকু বলতে পারি এই রকম আশ্চর্য কেস আমি আগে কখনও হ্যান্ডেল করিনি।’
‘ঠিক আছে আমি কৌতূহল চেপে রাখছি। ঘণ্টা খানেকের তো ব্যাপার।’ গৌতম এক কামড়ে একটা স্যান্ডউইচের প্রায় আধখানা মুখের ভিতরে চালান করে দিল।
ঘণ্টা দেড়েক পরে যখন সকলে এসে গেছে, গৌতমের ঘরে কৃষ্ণ পধি, গৌতম আর আদিত্যর জন্য বোন চায়নায় উৎকৃষ্ট দার্জিলিং চা পরিবেশিত হয়ে গেছে, এবং পুলিশ হায়ারারকির প্রোটোকল অনুযায়ী বাকিরা ডাক পাবার অপেক্ষায় বাইরে অপেক্ষা করছে, অপেক্ষা করতে করতে হয়তো চা-ও খাচ্ছে, কৃষ্ণ পধি আদিত্যকে বললেন, ‘আদিত্যবাবু, আমরা তো একভাবে এগোচ্ছি। একটা অ্যারেস্টও হয়ে গেছে। এই অবস্থায় আরও এগোনোর আগে খুব অনেস্টলি জানতে চাই আপনি এই ব্যাপারটা নিয়ে কোনও সিদ্ধান্তে এসেছেন কি? আসলে আপনার ওপিনিয়নটাকে আমরা খুব ভ্যালু করি। এবং আমরা এটাও জানতে পেরেছি আপনি দীপশিখা চৌধুরির অ্যারেস্টটা অ্যাপ্রূভ করেন না। কিন্তু কেন অ্যাপ্রূভ করেন না সেটা জানতে পারলে আমাদের খুব উপকার হয়। দেখুন, আপনাকে ফ্র্যাঙ্কলি বলছি, আমরা চাই না ভুল স্টেপ নিয়ে আমাদের লস অফ ফেস হোক। তাই খুব পোলাইটলি আপনার ভিউটা জানতে চাইছি।’
আদিত্য ভাবছিল, পধি লোকটা কি সত্যিই এত বিনয়ী নাকি এই বিনয়ের পেছনে অন্য কোনও কারণ আছে? আদিত্য জানে দ্বিতীয়টাই বেশি সম্ভব। বিনয়ের পেছনে কারণটাও সে আন্দাজ করতে পারছে।
সে মুখে বলল, ‘ডিএসপি সাহেব, এই কেসটা আমার মতো করে আমি সলভ করেছি। আপনি যদি অনুমতি দেন তা হলে আমার কথাগুলো আমি বলতে পারি। তবে তার আগে আপনার অনুমতি নিয়ে কলকাতা পুলিশের দুজন ইন্সপেক্টারকে ডেকে নিতে চাই। আর আপনি চাইলে আপনার লোকদেরও ডেকে নিতে পারেন।’
পধি একটু ইতস্তত করে বলল, ‘এই ঘরে যে কথাবার্তা হবে সেটা আমার মনে হয় কনফিডেন্সিয়াল থাকাই ভাল। মানে আপাতত শুধু আমরা তিনজনই না হয় ব্যাপারটা জানলাম। আমার অনুরোধ, আপনি আপনাদের ইন্সপেক্টার দুজনকে এখন বাইরেই রাখুন। দরকার হলে ওদের ডেকে নেওয়া যাবে। আর আমার সঙ্গে যারা এসেছে তারাও বাইরেই থাকুক। আমি পরে ওদের দরকার মতো ব্রিফ করে দেব।’
‘আমার মনে হয় ডিএসপি ঠিকই বলেছেন। আপাতত আমরা দুজন তোর কথা শুনি। ব্যাপারটা পাবলিক করার এক্ষুনি কী দরকার?’
‘ঠিক আছে। আমি তাহলে আমার কথাগুলো বলছি। আমাকে একটু সময় দিতে হবে কিন্তু।’ আদিত্য বলতে শুরু করল।
‘একেবারে গোড়া থেকে শুরু করছি। কিছুদিন আগে একটা রবিবারের সকালে অনিতা চৌধুরি বলে একটি মেয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে এল। মেয়েটি আমার স্ত্রী কেয়ার এক কলিগের পড়শি। খুব বিপদে পড়ে আমার কাছে এসেছে। মেয়েটি বলল তার স্বামী সৈকত চৌধুরি খুন হয়েছে। খুন হবার আগে সে একটা মোটা টাকার ইনশিয়োরেন্স করেছিল, যে ইনশিয়োরেন্সের বেনিফিশিয়ারি অনিতা। পুলিশ সন্দেহ করছে টাকার লোভে অনিতাই তার স্বামীকে খুন করেছে কিংবা কাউকে দিয়ে করিয়েছে।
‘গড়িয়াহাট থানার ইন্সপেক্টার অচিন্ত্য সাহা কেসটা তদন্ত করছিল, আমি তার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। অনিতা যেটা ভয় পেয়েছিল, অচিন্ত্য সাহা সেটাই কনফার্ম করল। পুলিশ অনিতাকেই মূলত সন্দেহ করছে। অচিন্ত্য সাহা কেসটাতে আর একটা মাত্রা যোগ করল। বলল, অনিতার একটা বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক চলছে। সম্ভবত, অনিতা এবং তার প্রেমিক মিলে সৈকত চৌধুরিকে খুন করেছে। পরে অনিতার পড়শিদের কাছেও শুনলাম, সৈকত যখন বাড়ি থাকত না তখন একটি ছেলে অনিতার সঙ্গে দেখা করতে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে যেত। এর কথা কিন্তু প্রথম দিন অনিতা আমাকে বলেনি।
‘অচিন্ত্য সাহার কাছে এটাও শুনলাম যে বিপ্লব সমাদ্দার বলে একজন গোয়েন্দা ইনশিয়োরেন্স কোম্পানির তরফ থেকে কেসটা তদন্ত করছে। বিপ্লব প্রাক্তন পুলিশ অফিসার, অচিন্ত্যর চেনা। পুলিশ ফোর্স ছাড়ার পর বিপ্লব সমাদ্দার ওই বেসরকারি ইনশিয়োরেন্স কোম্পানিটাতে কাজ করছে যাদের কাছ থেকে সৈকত জীবনবিমা কিনেছিল। বিপ্লব সমাদ্দারের কথায় পরে বিস্তারিতভাবে আসব। আপাতত শুধু এইটুকু বলে রাখি যে যেহেতু বিপ্লব সমাদ্দার ইনশিয়োরেন্স কোম্পানির হয়ে সৈকত চৌধুরির কেসটা ইনভেস্টিগেট করছিল, তার উদ্দেশ্য ছিল অনিতাকে সৈকতের খুনি প্রমাণ করা। কারণটা সহজ। অনিতাকে সৈকতের খুনি প্রমাণ করতে পারলে ইনশিয়োরেন্সের টাকাটা কোম্পানিকে দিতে হবে না।’
আদিত্য দম নেবার জন্যে একটু থামল। সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু এখানে সেটা সম্ভব নয়। আদিত্য উদাস হয়ে বাইরে তাকাল। জানলার ফ্রেমে রোদ-ঝলমলে চিৎপুর রোড। একটা ট্রাম ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে চলে যাচ্ছে। প্রায় ফাঁকা, শুধু মাঝখানের দুটো সিটে, দুটো লোক। কী বোকা লোকগুলো, আদিত্য ভাবল। ড্রাইভারের পেছনের সিটটা ফেলে কেউ মাঝখানে বসে নাকি?
‘আচ্ছা, আদিত্যবাবু, আপনি আমাকে এই সৈকত চৌধুরির মার্ডার কেসটার কথা কেন বলছেন? এটার সঙ্গে আমাদের, মানে উড়িষ্যা পুলিশের কী সম্পর্ক?’ আদিত্যকে থেমে যেতে দেখে কৃষ্ণ পধি জিজ্ঞেস করল।
‘গভীর সম্পর্ক, ডিএসপি সাহেব, গভীর সম্পর্ক। এক্ষুনি বুঝতে পারবেন, কেন।’
‘আবার একটু চা খাবি নাকি?’
‘চায়ে আমার কোনওদিনই আপত্তি নেই।’
‘পধি, আপনি?’
‘আমিও একটু চা খেতে পারি।’
‘ডিএসপি সাহেব, এবার আপনার প্রশ্নের উত্তরে আসছি।’ আদিত্য আবার বলতে শুরু করেছে। সৈকত খুন হবার কাছাকাছি সময় আরও দুটো অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল। একটা খুন, আরেকটা খুনের চেষ্টা। খুন হয়েছিল সৈকতের পার্টনার এবং এক সময়ের মেন্টর মণিময় গুপ্ত। খুন করার চেষ্টা করা হয়েছিল সৈকতদের কম্পানির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত একজন বড় কন্ট্রাকটরকে যার নাম অসীম দত্ত। অসীম দত্তর ধারণা হয়েছিল তাঁর ওপর আবার খুনের চেষ্টা হতে পারে। তিনি আমাকে নিয়োগ করলেন। কে তাঁকে খুন করার চেষ্টা করেছিল, সেটা খুঁজে বার করা এবং সত্যিই যদি ভবিষ্যতে তিনি খুন হয়ে যান তা হলে সেই খুনের রহস্য সমাধান করা, এই হবে আমার কাজ।’
আদিত্য লক্ষ করল অসীম দত্তর নাম উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণ পধির মনঃসংযোগ বেড়ে গেছে।
চা এসেছে। চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে আদিত্য আবার শুরু করল।
‘কে অসীম দত্তকে খুন করার চেষ্টা করেছিল সেটা ইনভেস্টিগেট করতে গিয়ে বালিগঞ্জ থানায় হাজির হলাম। সেখানে ইন্সপেক্টার সুভদ্র মাজি আমাকে অসীম দত্তর ফাইলটা দেখতে দিল। প্রসঙ্গত বলি, সুভদ্রর মতো এত সৎ এবং দক্ষ পুলিশ অফিসার আমি খুব বেশি দেখিনি। তো সে যাই হোক, ফাইলে আমি একটা আশ্চর্য জিনিস লক্ষ করলাম যেটা পুলিশ লক্ষ করেনি। সৈকতের সূত্র ধরে যদি অচিন্ত্য সাহা অসীম দত্তর আক্রমণকারিকে খুঁজতে বালিগঞ্জ থানায় পৌঁছে যেত, তা হলে হয়তো সেও ব্যাপারটা লক্ষ করত। কিন্তু তার মাথায় অনিতা চৌধুরি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কেন ছিল না সে প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে।
‘আমি বালিগঞ্জ থানায় গিয়ে কী আশ্চর্য জিনিস লক্ষ করলাম সেটা বলি। আমি লক্ষ করলাম, যে-শনিবার বিকেল-সন্ধে নাগাদ সৈকত খুন হয়, ঠিক সেদিনই, সম্ভবত সৈকত খুন হবার একটু আগে, অসীম দত্তর ওপর আক্রমণ হয়। এবং পরে আমি জানতে পেরেছি সেই একই দিন সকালের দিকে মণিময় খুন হয়। এটা কি সমাপতন? যদি হয়েও থাকে, তা হলে খেয়াল করতে হবে, সমাপতন আরও আছে। সৈকত এবং মণিময়ের মৃত্যু হয়েছিল .৩২ পিস্তলের গুলিতে, যে বুলেটটা অসীম দত্তর মোবাইলে আটকে গিয়েছিল সেটাও .৩২। এটাও লক্ষণীয় যে, পরবর্তীকালে পুরীর নিকটবর্তী রিসর্টে .৩২ পিস্তলের গুলিতেই অসীম দত্ত এবং তার ছোট ছেলে অনির্বাণ দত্ত খুন হয়েছিলেন। সৈকত ও তার পার্টনার মণিময়ের মৃত্যু এবং অসীম দত্ত, অনির্বাণ দত্তর মৃত্যুকে যদি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে ধরে নিই, তাহলে এটা একটা সমাপতন যে চারটে খুনই একই ধরনের পিস্তলের গুলিতে হয়েছে। কিন্তু এতটা সমাপতন কি সম্ভব?’
আদিত্য চায়ের কাপে আর একটা চুমুক দিল। তারপর আরো একটা। শেষে লম্বা একটা চুমুকে কাপের চা শেষ করে আবার বলতে শুরু করল।
‘আরও একটা কারণে ঘটনাটা সমাপতন বলে মেনে নেওয়া শক্ত। ব্যালিস্টিক রিপোর্ট বলছে, গুলিগুলো ছোঁড়া হয়েছে ৫২-৫৩ সালের মডেলের স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন পিস্তল থেকে। এটা একটা পুরোনো মডেলের পিস্তল যেটা বাজারে এখন প্রায় পাওয়াই যায় না। দুটো আলাদা লোক দুটো আলাদা আলাদা ৫২-৫৩ মডেলের স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন জোগাড় করে একই দিনে সামান্য সময়ের তফাতে সৈকত, মণিময় এবং অসীম দত্তর দিকে তাক করে গুলি চালিয়েছে, এটা মেনে নেওয়া অসম্ভব। নির্মোহ যুক্তি দিয়ে বিচার করলে এই সিদ্ধান্তেই আসতে হবে যে গত ৩রা জানুয়ারি একটাই লোক কয়েক ঘণ্টা সময়ের ব্যবধানে গুলিগুলো চালিয়েছিল। প্রথমে মণিময়ের ওপর, তারপর অসীম দত্তর ওপর, এবং সব শেষে সৈকত চৌধুরির ওপর। বরাত জোরে সেদিন অসীম দত্ত বেঁচে গিয়েছিলেন, সৈকত বা মণিময় বাঁচতে পারেনি। তবে কিছুদিন পরে ওই একই আততায়ীর হাতে একই স্মিথ ওয়েসনের দ্বারা অসীম দত্ত এবং তার ছেলে অনির্বাণ দত্ত খুন হন।’
ঘরে অখণ্ড নীরবতা। শুধু দেয়ালে পুরোনো আমলের একটা দেয়াল ঘড়ি টিকটিক করে চলছে।
‘মণিময় গুপ্তও যে ওই ৩ জানুয়ারি খুন হন, এটা কী করে জানা গেল?’ গৌতমের জিজ্ঞাসা।
‘বলছি কী করে। সৈকত চৌধুরির কেসটা ইনভেস্টিগেট করতে করতে আমরা, মানে আমি আর অচিন্ত্য সাহা, সৈকতের পার্টনার মণিময় গুপ্তর নরেন্দ্রপুরের বাগানবাড়িতে পৌঁছে গিয়েছিলাম। এই বাগানবাড়িটা, বলা যায়, মণিময়ের গোপন প্রেমের কুঞ্জবন। আমরা আবিষ্কার করলাম, যে সময়টা, মণিময় ঘোষণা করত, সে বিদেশে আছে, সেই সময়টা আসলে সে একজন বিবাহিত মহিলার সঙ্গে নরেন্দ্রপুরের বাগানবাড়িতে বসবাস করত। এছাড়াও আমরা আবিষ্কার করলাম ওই বাগানবাড়িতে প্রচুর ক্যাশ টাকা মণিময় লুকিয়ে রেখেছে। বলাই বাহুল্য, এগুলো কালো টাকা।
‘নরেন্দ্রপুরের বাগানবাড়ি থেকেই মণিময়ের লাশ আবিষ্কৃত হল। কেউ মণিময়কে খুন করে বাগানবাড়ির পুকুরে ফেলে রেখেছিল। মণিময়ের বান্ধবীর কাছ থেকে আমি পরে জানতে পেরেছি ৩ জানুয়ারি সকালেও মণিময়ের সঙ্গে তার ফোনে কথা হয়েছিল, মণিময় বলেছিল সে এবার মাছ ধরতে যাবে, কিন্তু ৪ জানুয়ারি নরেন্দ্রপুর পৌঁছে বান্ধবী আর মণিময়কে দেখতে পায়নি। অতএব এটা মোটেই অসম্ভব নয় যে মণিময়ও ওই ৩ জানুয়ারিই খুন হয়েছিল। আগেই বলেছি, মণিময়ের শরীর থেকে যে বুলেটটা পাওয়া গেছে সেটাও .৩২ স্মিথ করোনা থেকে ছোঁড়া। সেই জন্যেই বলছি, কোনও আততায়ী ৩ জানুয়ারি প্রথমে মণিময় গুপ্ত, তারপর অসীম দত্ত এবং সব শেষে সৈকত চৌধুরির দিকে তার স্মিথ করোনা থেকে গুলি চালায়। তাৎক্ষণিকভাবে আততায়ী নিশ্চয় ভেবেছিল মণিময় এবং সৈকতের মতো অসীম দত্তও মারা গেছেন। পরে তার ভুল ভাঙে। অবশ্য আমার ধারণা ইন্সপেক্টার অচিন্ত্য সাহা মণিময় হত্যার দায়টা মণিময়ের বান্ধবী ঊর্মিমালা মিত্রর ঘাড়ে চাপিয়ে দেবার জন্য কেস সাজাচ্ছে।
‘পুলিশ অনিতা চৌধুরিকে সৈকত হত্যার দায়ে এবং দীপশিখা দত্তকে অনির্বাণ দত্ত হত্যার চার্জে গ্রেপ্তার করেছে। আমি আন্দাজ করছি, ঊর্মিমালা মিত্রকেও মণিময় হত্যার দায়ে অ্যারেস্ট করার কথা ভাবা হচ্ছে। প্রশ্ন হল, যদি ধরে নিই একই ব্যক্তি খুনগুলো করেছে তা হলে এই তিনজনের কেউ কি সেই ব্যক্তি হতে পারে? আমার পরিষ্কার উত্তর না, হতে পারে না। অনিতা সৈকত এবং মণিময়কে চিনলেও অসীম দত্তকে খুব সামান্যই চিনত। আর অনির্বাণ দত্তকে তো চিনতই না। দীপশিখা অসীম এবং অনির্বাণকে চিনলেও সৈকত এবং মণিময়কে চিনত না। ঊর্মিমালা শুধু মণিময়কেই চিনত, আর কাউকে নয়। অর্থাৎ এদের কারোরই এক সঙ্গে এই সব ক’টা খুন করার কোনও কারণ ছিল না।
‘খুন করার জন্যে দুটো জিনিস সবার আগে দরকার মোটিভ এবং সুযোগ। কার ছিল চার চারটে খুন করার মোটিভ এবং সুযোগ? কিন্তু সেই মূল প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে আরও দুটো প্রশ্ন করা যেতে পারে। অনিতার প্রেমিক সমীর প্যাটেলকে কে মারধোর করে হাসপাতালে পাঠাল? কেন মারধোর করল? দুনম্বর প্রশ্ন, গত শনিবার রাজারহাট নিউ টাউনে কারা আমাকে খুন করতে চেয়েছিল? কেন চেয়েছিল?
ইন্টারকমে গৌতমের একটা ফোন এসেছে। ফোনে সংক্ষিপ্ত কথা বলার পর সে ফোন নামিয়ে রেখে বলল, ‘আমাকে কমিশনার সাহেব ডেকে পাঠিয়েছেন। একটা ব্যাপারে ওঁকে ব্রিফ করতে হবে। আমি মিনিট দশেক ঘুরে আসছি।’
‘আমি তাহলে বাইরে বেরিয়ে একটা সিগারেট খেয়ে আসি?’ গৌতম উঠে দাঁড়াতেই আদিত্য উঠে দাঁড়িয়েছে।
‘আপনি তাহলে এখানেই একটু বসুন।’ ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে কৃষ্ণ পধির দিকে তাকিয়ে গৌতম বলল।
(৩)
‘যেটা বলছিলাম, মূল প্রশ্নটা হল, কার বা কাদের ওই চারজনকে খুন করার মোটিভ এবং সুযোগ ছিল?’ মিনিট কুড়ি বিরতির পর আদিত্য বলতে শুরু করল।
‘প্রথমে মোটিভ। পৃথিবীতে যত খুন হয় তার একটা বড় অংশ ঘটে টাকার কারণে। এই খুনগুলোর পেছনেও একটা জোরাল টাকার মোটিভ থাকতে পারে না কি? অসীম দত্ত এবং অনির্বাণ দত্ত মারা গেলে টাকার দিক থেকে তিনজনের লাভ—অনিকেত-ছন্দা, শ্বেতা-জয়ন্ত, দীপশিখা এবং তার মা সোমা মজুমদার। বাবা এবং ভাই মারা গেলে অনিকেত কোম্পানির মালিক হবে, এটাই তার এবং তার স্ত্রীর লাভ। শ্বেতা-জয়ন্তের বেলাতেও তাই। সোমা মজুমদারের স্বামী দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী, অসীম দত্ত দীর্ঘদিন বিপত্নীক। তাদের মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বস্তুত, অসীম দত্তই সোমার সংসারটা চালাতেন। সোমা জানত, একটা মোটা টাকা অসীম দত্ত তার জন্য রেখে গেছেন। কিন্তু অসীম দত্তর এক্ষুনি মারা গেলে সোমার তেমন লাভ নেই। অসীম দত্তর রেখে যাওয়া টাকাটা সে পাবে বটে কিন্তু মোটা মাসোহারাটা বন্ধ হয়ে যাবে। অসীম দত্তকে এক্ষুনি মেরে তার কী লাভ? বাকি রইল দীপশিখা। অসীম দত্তর অবর্তমানে তার সম্পত্তির একটা অংশ পাবে অনির্বাণ আর ডিভোর্সের আগে অনির্বাণ মারা গেলে দীপশিখা তার স্বামীর অংশটা পেয়ে যাবে। তাছাড়া মায়ের প্রেমিকের প্রতি দীপশিখার একটা স্বাভাবিক ঘৃণা থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু দীপশিখা সৈকত বা মণিময়কে মারতে যাবে কেন? বাকি রইল জয়ন্ত-শ্বেতা এবং অনিকেত-ছন্দা।
‘সমস্যাটা ভাল করে বোঝার জন্যে এইস বিল্ডার্স এবং গুপ্ত অ্যান্ড চৌধুরি এই দুটি কম্পানির অভ্যন্তরে ঢুকতে হবে। এখানে তিনটে জিনিস বলার আছে। এক, মণিময়-সৈকতের কম্পানি অসীম দত্তর কোম্পানির কাছে গলা অবধি ধারে ডুবে ছিল। দুই, দুটি কম্পানি যৌথভাবে প্রচুর দুনম্বরি কাজ করত যা থেকে লাভ করত মণিময় এবং অসীম দত্ত। সৈকত কোম্পানির আর্থিক দিক নিয়ে একদম মাথা ঘামাত না বলে অনেকদিন অবধি সে এই দুনম্বরির কথা জানতে পারেনি। যখন জানতে পারল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তিন, সমস্ত আর্থিক অনিয়মের ব্যাপারে সৈকতকে শিখণ্ডি খাড়া করা হত। সৈকত তার একদা মেন্টর মণিময়কে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করত বলে অন্ধভাবে সে সমস্ত কাগজপত্রে সই করে দিত। তারপর এমন একটা ঘটনা ঘটল যেটা থেকে সৈকত বুঝতে পারল মণিময় এবং অসীম দত্ত তাকে ভীষণভাবে ঠকিয়েছে।’
আবার ফোন বাজছে। এবার আদিত্যর ফোন। বিমল। ‘বাড়ি থেকে বেরোয়নি? ঠিক আছে। তুমি নজর রাখ, আর বেরোলে আমাকে সঙ্গে সঙ্গে জানিও।’ আদিত্য ফোন রেখে দিল। গৌতমদের দিকে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করেছে।
‘হ্যাঁ, একটা ঘটনার কথা বলছিলাম। ঘটনা না বলে দুর্ঘটনাই বলা উচিত। এটার কথা নেহাত কপালের জোরে এক সাংবাদিকের কাছ থেকে আমি জানতে পেরেছিলাম। ব্যাপারটা এইরকম। কয়েক বছর আগে ন্যাশানাল হাইওয়ে ডেভেলপমেন্ট অথরিটি অজয় নদীর ওপর একটা ব্রিজ বানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। জায়গাটা চিত্তরঞ্জনের কাছে, নাম সিমজুড়ি। ব্রিজটা তৈরি করার বরাত দেওয়া হয় গুপ্ত অ্যান্ড চৌধুরি সিভিল কনস্ট্রাকশানসকে, অর্থাৎ মণিময় এবং সৈকতের কোম্পানিকে। মণিময় এবং সৈকতের কোম্পানি ব্রিজের ডিজাইন তৈরি করে দিয়ে অসীম দত্তর এইস বিল্ডার্সকে কনট্র্যাকটটা দেয়। এইস বিল্ডার্স আবার সাব-কন্ট্রাক্ট করে কাজটা দত্ত কনস্ট্রাকশান্সকে, অর্থাৎ অনিকেত দত্তর কোম্পানিকে দিয়ে দেয়। উল্লেখ করা যেতে পারে, দুনম্বরি কাজগুলো অসীম দত্ত তার বড় ছেলে অনিকেত দত্তর কোম্পানিকে দিয়ে করাত, যাতে তার নিজের গায়ে সরাসরি আঁচ না লাগে। আর এই ব্রিজ তৈরির ব্যাপারে বিরাট দুনম্বরি হয়েছিল। অনুমোদিত প্ল্যানটা মানা হয়নি। তাছাড়া খুব খারাপ মেটিরিয়াল দিয়ে তৈরি হয়েছিল ব্রিজটা।
‘ব্রিজটা উদ্বোধন হবার আগেই ভেঙে পড়ল। এতটাই খারাপ ছিল মালমশলা এবং প্ল্যান। ব্রিজের নীচে অজয় নদীর বালির ওপর, তাঁবু খাটিয়ে কিছু মিস্ত্রি সপরিবারে থাকছিল, তাদের ওপর হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল ব্রিজ। এগারো জন মারা গেল, তার মধ্যে তিনজন মহিলা, দুজন শিশু। গুপ্ত অ্যান্ড চৌধুরি সিভিল কনস্ট্রাকশানস-এর বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্ত শুরু হল, মূলত সৈকত চৌধুরি তাদের লক্ষ্য, কারণ কাগজপত্রে সব সই তার। দত্ত কনস্ট্রাকশানস এবং এইস বিল্ডার্স আইনের ফাঁক দিয়ে গলে বেরিয়ে গেল। মণিময়ও। কারণ সে কোথাও সই করেনি। সেই প্রথম সৈকত বুঝতে পারল মণিময় এবং অসীম দত্ত তাকে কীরকম ঠকিয়েছে।’
‘আমাকে সিবিআই ফোন করেছিল।’ কৃষ্ণ পধি নিচু গলায় বলল।
‘জানি, জানি। আপনার সঙ্গে কথা হবার আগে অমিত সাক্সেনা সাহেবের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। সিবিআই বলেছে বলেই তো আপনি আমার কথা এত মন দিয়ে শুনছেন, তাই না ডিএসপি সাহেব?’ আদিত্য ম্লান হাসল। কৃষ্ণ পধি মাথা নামিয়ে নিয়েছে।
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমরা আসল গল্পটা থেকে সরে যাচ্ছি। আদিত্য বল তারপর কী হল।’ মিটমাট করিয়ে দেবার ভঙ্গিতে গৌতম বলল।
‘এবার অনিকেত-ছন্দা এবং জয়ন্ত-শ্বেতার প্রসঙ্গে আসি। আমি এখানে শ্বেতা এবং ছন্দাকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রাখছি, কারণ ওদের পক্ষে আলাদা করে এই ক্রাইমগুলো করা আনলাইকলি। কিন্তু অনিকেত এবং জয়ন্তর কথা আলাদা।
‘অনিকেতের একটা অপরাধ প্রবণতা ছিল। সে কয়েকবার তার বাবার কোম্পানি থেকে চুরি করে ধরাও পড়েছিল। তার বাবা তাকে আলাদা কম্পানি করে দেয়। সে যাতে নিজেকে শোধরাতে পারে সেজন্য নয়, তার অপরাধ প্রবণতাকে কাজে লাগিয়ে এবং তাকে শিখণ্ডী বানিয়ে যাতে আরও বড় চুরি করা যায় সেজন্যে। অনিকেতের বাবা অনিকেতের থেকেও বড় চোর ছিল এবং চুরির ব্যাপারে নিজের ছেলেকে শিখণ্ডি খাড়া করতেও তার বিন্দুমাত্র দ্বিধা ছিল না। এই কারণে অনিকেত তার বাবাকে ঘৃণা করত। ঘৃণার আরেকটা কারণ সোমা মজুমদারের সঙ্গে তার বাবার অবৈধ সম্পর্ক। সোমা মজুমদারের ব্যাপারে শ্বেতাও ঘৃণা করত তার বাবাকে।
‘অনিকেত আর জয়ন্ত মল্লিকের প্রভূত টাকার দরকার হয়ে পড়েছিল। জয়ন্ত খানদানি জুয়াড়ি, দুর্বল চরিত্রের অনিকেত তার পাল্লায় পড়ে সেও জুয়াড়ি হয়ে গিয়েছিল। আমার লোক তাদের দিনের পর দিন ফলো করে দেখেছে রেস এবং তাসের জুয়া ছাড়াও বহু টাকা দুজনে মিলে শেয়ার বাজারে নষ্ট করেছে। না হলে অনিকেতের কোম্পানির এবং জয়ন্তর গেস্ট হাউসের অতটা খারাপ অবস্থা হবার কথা নয়। আশ্চর্য, অনিকেতের বউ ছন্দা এসব কিছুই টের পায়নি। শ্বেতা মল্লিক অবশ্য সবই জানত। যাই হোক, জুয়া এবং ফাটকা খেলে জয়ন্ত মল্লিক তো বটেই, অনিকেত দত্তরও বাজারে বিপুল ধার হয়েছিল।
‘অনিকেত তার বাবার এবং সৈকত-মণিময়ের কোম্পানির ভিতরের খবর সবই রাখত। সে জানত, এইস বিল্ডার্সের পুঁজির প্রায় সবটাই গুপ্ত অ্যান্ড চৌধুরি কনস্ট্রাকশান্সকে দীর্ঘ মেয়াদে ধার দেওয়া আছে। যদি অনিকেত বা তার সাঙাত জয়ন্ত মল্লিক এইস বিল্ডার্সের মালিকানা পেয়েও যায় তা হলেও ঋণের শর্ত অনুযায়ী সেই টাকা সঙ্গে সঙ্গে ফেরত পাওয়া যাবে না। ফলে তাদের যে টাকাটা এক্ষুনি দরকার সেটা তারা এইস বিল্ডার্স থেকে জোগাড় করতে পারবে না। তাছাড়া গুপ্ত অ্যান্ড চৌধুরি সিভিল কনস্ট্রাকশান্স-এর ওপর সিবিআই-এর নজরের কথাও অনিকেত জানত। তার ভয় ছিল, সিবিআই এনকোয়ারির ফলে গুপ্ত অ্যান্ড চৌধুরি কনস্ট্রাকশান্স যদি বন্ধ হয়ে যায় তা হলে সেখান থেকে এক্ষুনি টাকা পাবার সম্ভাবনা আরও কমে যাবে।
‘একটাই উপায় ছিল। ঋণের শর্ত অনুযায়ী গুপ্ত অ্যান্ড চৌধুরি কনস্ট্রাকশান্স-এর দুজন পার্টনারেরই যদি মৃত্যু হয় তাহলে কোম্পানির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে উত্তমর্ণ কোম্পানি এইস বিল্ডার্স তার টাকা তুলে নিতে পারবে। ফলে শুধু অসীম দত্ত, অনির্বাণ দত্ত মরলেই চলবে না, সৈকত এবং মণিময়কেও মরতে হবে। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করার ব্যাপারে জয়ন্ত মল্লিকের কোনও জড়তা নেই। সে অনায়াসে সৈকত খুন হবার আগের রাত্তিরে দুজন সিকিউরিটির ডিউটি চেঞ্জের ফাঁকে সৈকতদের আবাসনে টুক করে ঢুকে গিয়ে ছাতে ট্যাঙ্কের আড়ালে সারা রাত্তির লুকিয়ে থাকতে পারত। একজন মিলিটারির পক্ষে ওইটুকু কষ্ট করা কিছুই নয়। পরের দিন কাজ সেরে ডামাডলের মধ্যে টুক করে সরে পড়াও তার কাছে সহজ কাজ।’
‘তা হলে তুই বলছিস অনিকেত আর জয়ন্ত মিলে খুনগুলো করেছে? নাকি অনিকেতের বুদ্ধিতে জয়ন্ত একাই খুনগুলো করেছে?’ গৌতম রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করল।
‘না, না। আমি এখনও কিছুই বলছি না। শুধু লজিকালি এগোনোর চেষ্টা করছি। আচ্ছা, এই স্টেজে এসে আমি দীপশিখা আর তার মাকে সন্দেহভাজনের তালিকা থেকে বাদ দিলাম। এর অনেকগুলো কারণ। প্রথমত, দীপশিখাদের পক্ষে গুপ্ত অ্যান্ড চৌধুরি কনস্ট্রাকশান্স বা এইস বিল্ডার্সের ভিতরের খবরগুলো জানা সম্ভব ছিল না। দ্বিতীয়ত, দীপশিখা বা তার মা বাজার থেকে একটা সেকেলে পিস্তল ভাড়া করে গব্বড় সিং-এর কায়দায় ধাঁই ধাঁই করে চারজনকে খুন করে ফেলবে, এটা ভাবতে আমার অসুবিধে হচ্ছিল। তাছাড়া, সৈকতের বাড়িতে ওরা ঢুকবেই বা কেমন করে? সব থেকে বড় কথা ওদের টাকার এমন কোনও আশু প্রয়োজন ছিল না যে এক্ষুনি চার-চারটে খুন করে ফেলতে হবে।
‘কিন্তু যদি ধরে নিই অনিকেত আর জয়ন্ত মিলে খুনগুলো করেছে তা হলে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্তরহীন থেকে যাবে। এক, সৈকত চৌধুরি খুন হবার আগে হঠাৎ অত টাকার ইনশিয়োরেন্স করতে গেল কেন? দুই, অনিকেতের একার পক্ষে চার-চারটে খুন করা সম্ভব নয়। তবে জয়ন্ত মল্লিকের সঙ্গে মিলে সে খুনের ষড়যন্ত্র করতেই পারত। কিন্তু যদি জয়ন্ত মল্লিক খুনগুলোর পেছনে থাকে তা হলে অত পুরোনো মডেলের একটা পিস্তল সে ব্যবহার করতে যাবে কেন? জয়ন্ত মল্লিককে আমরা অনায়াসে একজন আগ্নেয়াস্ত্র বিশেষজ্ঞ বলে ধরে নিতে পারি। তার তো ভাল করেই জানা উচিত ছিল উল্টোদিকের নির্মীয়মাণ বাড়ি থেকে ওই মান্ধাতার আমলের হ্যান্ডগান দিয়ে গুলি চালালে অসীম দত্তর বাড়ির পোর্টিকোয় পৌঁছতে পৌঁছতে গুলির গতি কমে আসবে। ফলে কাজের কাজ নাও হতে পারে। আর একটা কথা, মিলিটারিদের এমন ট্রেনিং যে প্রতিপক্ষকে মারতে হলে তারা গলায় বা মাথায় গুলি করে, যেহেতু প্রতিপক্ষ সাধারণত বুলেট প্রূফ ভেস্ট পরে থাকে। এক্ষেত্রে অবশ্য যারা খুন হয়েছে তাদের কেউই বুলেট প্রূফ ভেস্ট পরে ছিল না, থাকার কথাও নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও মিলিটারি ট্রেনিংপ্রাপ্ত কেউ গুলিগুলো করলে সেগুলো বুকে না লেগে মাথায় লাগাটা আরও স্বাভাবিক ছিল। ট্রেনিং কেউ সহজে ভোলে না। এইসব ভেবে আমি এই সিদ্ধান্তে এলাম যে অনিকেত দত্ত এবং জয়ন্ত মল্লিক মিলে এই খুনগুলো করেনি।’
‘তাহলে কে করল খুনগুলো?’ পধির গলায় অকৃত্রিম কৌতূহল।
‘বলছি, ডিএসপি সাহেব, বলছি। কিন্তু তার আগে আর একবার চা খেতে হবে।’ শেষের কথাগুলো গৌতমের উদ্দেশে। কৃষ্ণ পধি এবং গৌতমের কৌতূহলটা আদিত্য বেশ উপভোগ করছে।
‘চা খাওয়াচ্ছি। তুই বলে যা। থামিস না।’ গৌতম বেল বাজাল।
‘সন্দেহ নেই, এই মর্মান্তিক কাহিনির শুরু ব্রিজ ভেঙে এগারজন মৃত্যু হওয়ার সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা থেকে। প্রথমে মনে হয়েছিল, যারা মারা গেছে তাদের কারও নিকট আত্মীয় হয়তো খুনগুলো করেছে। কিন্তু পরে মনে হল, সেটা সম্ভব নয়। যারা মারা গেছে তারা গরিব মানুষ। তাদের আত্মীয় বালিগঞ্জ কিংবা গোল্ডেন স্যান্ড রিসর্ট অব্দি পৌঁছবে কেমন করে? তাছাড়া তেমন প্রতিহিংসাপরায়ণ যদি কেউ থেকেও থাকে, সে অনিকেত দত্তকে রেয়াত করবে কেন আর অনির্বাণ দত্তকেই বা মারবে কেন?
‘আরও গভীরভাবে চিন্তা করতে করতে উপলব্ধি করলাম, রহস্যের চাবি লুকিয়ে রয়েছে সৈকত চৌধুরি এবং তার হত্যাকারীর চরিত্রের মধ্যে। দুজনেই ব্যতিক্রমী চরিত্র, তবে দুটি ভিন্ন অর্থে। প্রথমে সৈকত চৌধুরির চরিত্রের দিকে তাকানো যাক। সৈকত ছোটবেলা থেকেই একটু আলাদা—মারকুটে, ন্যায়ের পক্ষে, জেদি, অসম্ভব দৈহিক এবং মানসিক শক্তিধর, বলা যায় মরাল ফ্যানাটিক। সে সহজেই মানুষকে বিশ্বাস করত, কিন্তু কেউ বিশ্বাসভঙ্গ করলে তাকে কখনও ক্ষমা করত না। পাপ করলে শাস্তি পেতেই হবে এই খ্রিস্টান ধারণায় সে বিশ্বাস রাখত। সে যখন জানতে পারল মণিময় এবং অসীম দত্ত দুজনে মিলে তাকে ঠকিয়েছে, তার প্রথম প্রতিক্রিয়া হল দুজনকেই শাস্তি পেতে হবে। শুধু বিশ্বাসভঙ্গের শাস্তি নয়, মানুষ খুন করার শাস্তি, নিরীহ নারী-পুরুষ-শিশুদের মৃত্যু ঘটানোর শাস্তি। এই শাস্তি মৃত্যু ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।
‘কিন্তু কী করে এই শাস্তি দেওয়া যায়? সে নিজের হাতে এই লোক দুটোকে খুন করতেই পারত। কিন্তু তাতে দুটো সমস্যা। খুন করে জেলে গেলে অথবা তার ফাঁসি হয়ে গেলে কে তার স্ত্রীকে দেখবে? স্ত্রীকে সৈকত সত্যিই ভালবাসত। দ্বিতীয় সমস্যা, সে নিজেও তো দোষ করেছে। ব্রিজ ভেঙে পড়ার দায় থেকে সে তো নিজেকে মুক্ত করতে পারে না। যেহেতু সে কিছু নিরীহ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে তাকেও শাস্তি পেতে হবে। এবং সেই শাস্তিও মৃত্যুই হতে হবে। সৈকত দুজনকে খুন করে নিজে আত্মহত্যা করতে পারত, কিন্তু সেক্ষেত্রে তার স্ত্রীর কী হবে?’
‘আপনি এত কথা জানলেন কী করে স্যার? এটা কী অনুমান, নাকি কল্পনা? নাকি সৈকত চৌধুরি মরার আগে আপনাকে এসব কথা বলে গিয়েছিলেন?’ পধির গলায় পরিষ্কার বিদ্রুপ।
‘তিনটের কোনওটাই নয় ডিএসপি সাহেব। কী করে জানলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই জানতে পারবেন। শুধু একটু ধৈর্য ধরে শুনতে হবে।’ আদিত্যকে ঈষৎ বিরক্ত মনে হল।
‘সৈকত একটা প্ল্যান করল। সে অনেক টাকার একটা ইনশিয়োরেন্স কিনল। আত্মহত্যা ছাড়া অন্য কোনও ভাবে সে মারা গেলে তার স্ত্রী টাকাটা পাবে। তারপর সে এমন একজনকে খুঁজতে লাগল যে টাকার বিনিময়ে তাকে খুন করতে পারে। শুধু তাকে খুন করলে চলবে না, মণিময় এবং অসীম দত্তকেও খুন করতে হবে।
‘পেয়েও গেল একজনকে। সেই লোকটার ভীষণ টাকার দরকার। তার স্ত্রী মারাত্মক অসুস্থ। ব্রেন টিউমার। স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে গিয়ে লোকটা প্রায় সর্বস্বান্ত। এখন একটা শেষ চেষ্টা করতে চায়। অরুণ কুলকার্নি দেশের শ্রেষ্ঠ নিউরোসার্জেন। কিন্তু এক নম্বরের অর্থপিশাচ। লোকটা শুনল, একমাত্র অরুণ কুলকার্নিই তার স্ত্রীকে আরও কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারে। ভাগ্য ভাল থাকলে দশ-পনেরো বছরও বেঁচে যেতে পারে তার স্ত্রী। কিন্তু অপরেশনের জন্যে তিরিশ লাখ টাকা খরচ করতে হবে। তিরিশ কেন তিন লাখ টাকা খরচ করার সামর্থ্যও আর লোকটার ছিল না।
‘লোকটার নাম প্রদীপ চক্রবর্তী। সৈকতের পড়শি। ষাট দশকে নকশাল করত। জেল খেটেছে। বন্দুক চালাতে পারে। সম্ভবত মানুষও মেরেছে। এখন বয়েস হয়ে গেলেও শরীর টানটান আছে। সৈকতের সঙ্গে তার চুক্তি হল সে একই দিনে প্রথমে মণিময়কে মারবে, তারপর অসীম দত্তকে। এসবের পর সে সৈকতের বাড়িতে ঢুকে সৈকতকে হত্যা করবে। সৈকত প্রদীপ চক্রবর্তীকে বুঝিয়েছিল, আপনি যদি কাজটা না করেন অন্য কেউ করবে। আমাদের শহরে টাকা ছড়ালে সুপারি কিলারের অভাব হয় না। কিন্তু আপনাকে দিয়েই আমি কাজটা করাতে চাই যাতে আপনার স্ত্রীর চিকিৎসাটা হয়। প্রদীপ চক্রবর্তী যুক্তিবাদী লোক। বামপন্থী। বিশ্বাস করেন এন্ডস ক্যান জাস্টিফাই মিন্স। তাই সৈকতের প্রস্তাবটা তিনি গ্রহণ করলেন।
‘আজ সকালে প্রদীপ চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার বিস্তারিত কথা হয়েছে। আমি তাকে বললাম, আমি সৈকতের প্ল্যানটা মোটামুটি বুঝতে পেরেছি। আপনি যে চারজনকে হত্যা করেছেন সেটাও আমার অজানা নেই। প্রথমে তিনি কিছুই স্বীকার করছিলেন না। আমি তাঁকে বললাম, আর কার জন্যে মিথ্যে বলবেন? আপনার স্ত্রীই তো আর নেই। আস্তে আস্তে তিনি সব কিছু স্বীকার করলেন।
‘প্রদীপদা বলেছেন, একটা ডিটেল্ড কনফেশন লিখে তিনি পুলিশের কাছে সারেন্ডার করবেন। আমি তাঁকে বিশ্বাস করেছি। না করে উপায় নেই। পুলিশ নিজে থেকে প্রদীপ চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে কিচ্ছু প্রমাণ করতে পারবে না।
‘প্রদীপ চক্রবর্তীর কাছে একটা পুরোনো স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন ছিল। যখন তিনি নকশাল করতেন সেই আমলে সংগ্রহ করা। অস্ত্রটা তিনি রেখে দিয়েছিলেন। মণিময়ের বাড়িটা তাঁকে সৈকত চিনিয়ে দিয়েছিল। মণিময়কে মারার পর তিনি বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে চলে এলেন। উল্টোদিকের নির্মীয়মাণ বাড়ি থেকে অসীম দত্তর ওপরে গুলি চালালেন। তাঁর হাতের টিপ এখনও অসাধারণ, কিন্তু অস্ত্রটার রেঞ্জ কতটা হবে তিনি ঠিক মতো বুঝতে পারেননি। ফলে অসীম দত্ত বেঁচে গেলেন। যাই হোক, মণিময় এবং অসীম দত্তর ওপর গুলি চালানোর পর বাড়ি ফিরে তিনি সৈকতকে হত্যা করলেন। যেমন একজন বিপ্লবী দেশের স্বার্থে নির্মোহ হয়ে মানুষ মারে তেমনি করে তিনি স্ত্রীর চিকিৎসার টাকা জোগাড় করার জন্য সৈকতের ওপর গুলি চালালেন।
‘পরে যখন শুনলেন অসীম দত্ত বেঁচে গেছে, প্রদীপ চক্রবর্তী ঠিক করলেন অসীম দত্তকে তাঁর রিসর্টে গিয়ে মারবেন। এই কাজটা তাঁকে করতেই হবে, নইলে কথার খেলাপ হয়ে যাবে। জীবিত ব্যক্তির সঙ্গে যদি বা কথার খেলাপ করা যায়, মৃত ব্যক্তির সঙ্গে কখনই করা যায় না। সেই প্ল্যান মতো দুজনের জন্য রিসর্টে বুকিং করলেন। কাজও হবে আবার অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে একটু বাইরে যাওয়াও হবে।
‘রিসর্টে পৌঁছে প্রদীপদা অসীম দত্তকে একটা মেসেজ করলেন সিমজুড়ি ব্রিজ ভেঙে পড়ার ব্যাপারে কিছু তথ্য তাঁর কাছে আছে। সিবিআইকে সেগুলো জানানোর আগে তিনি অসীম দত্তর সঙ্গে কথা বলতে চান। তিনি সৈকতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং প্রতিবেশি। সৈকত তাকে এই তথ্যগুলো দিয়ে গেছে। অসীম দত্ত তাঁকে রাত্তির সাড়ে ন’টা দশটা নাগাদ অফিসে আসতে বললেন। ততক্ষণে নিশ্চয় অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাবে। আরও বললেন, প্রদীপ চক্রবর্তী যেন পেছনের দরজা দিয়ে আসেন। তা হলে তাঁকে কেউ দেখতে পাবে না। ইচ্ছে করেই একজন সিকিউরিটিকে ব্যাঙ্কোয়েট হলে রেখে দেওয়া হল, যাতে পেছন দিকের দরজা অরক্ষিত থাকে। প্রদীপ চক্রবর্তী সেরকমই শর্ত দিয়েছিলেন। তাছাড়া অসীম দত্তর মাথায় ঘুরছিল তাঁর নিকট আত্মীয়দের মধ্যেই কেউ তাঁকে খুন করতে চায়, তাই প্রদীপ চক্রবর্তীকে তিনি সন্দেহ করেননি।
‘প্রদীপ চক্রবর্তী পেছনের দরজা দিয়ে এসে নক করলেন, অসীম দত্ত দরজা খুলে দিলেন, প্রদীপ চক্রবর্তী তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করলেন। সমুদ্রের গর্জনে গুলির শব্দ ঢাকা পড়ে গেল। প্রদীপ চক্রবর্তী এবার ঘরের ভিতরে ঢুকে অসীম দত্তর মোবাইলটা খুঁজতে লাগলেন। বেশি খুঁজতে হল না। মোবাইলটা টেবিলের ওপরেই ছিল।মেসেজগুলো পুলিশের হাতে গেলে চলবে না। পুলিশকে বিশ্বাস করাতে হবে পরিবারের কেউ খুনটা করেছে। মেসেজগুলো মুছে দেবার মতো সময় প্রদীপ চক্রবর্তীর হাতে ছিল না। তাই তিনি মোবাইলটা সঙ্গে নিয়ে সেটাকে সুইচ অফ করে রাখলেন।
‘রিসর্টে দ্বিতীয় খুনটা প্রদীপ চক্রবর্তী করতে চাননি। কিন্তু যখন তিনি অসীম দত্তকে খুন করার পর অফিসের পেছনের দরজা দিয়ে বেরোচ্ছেন তখন অনির্বাণ তাঁকে দেখতে পায়। দীপশিখা ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পরেও কিছুক্ষণ সে ওই কোণের ঘরটায় বসেছিল। কোণের ঘরটা থেকে অসীম দত্তর অফিসের পেছনের দরজাটার পরিষ্কার ভিউ পাওয়া যায়। সেই সময় অনির্বাণ জিনিসটা আমল দেয়নি। পরে যখন সে জানল ঠিক ওই সময়েই তার বাবা খুন হয়েছেন, তখন সে ব্যাপারটার গুরুত্বটা বুঝতে পারল। পরের দিন ডাইনিং হলে সে প্রদীপ চক্রবর্তীকে দেখতে পেল। একটা চিরকুটে নিজের ফোন নম্বরটা লিখে চুপিচুপি প্রদীপ চক্রবর্তীর হাতে দিয়ে বলল, কাল রাত্তিরে আমি আপনাকে অসীম দত্তর অফিস থেকে বেরোতে দেখেছি। ব্যাপারটা পুলিশকে জানানোর আগে আমি আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।
‘অন্য কেউ হলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে ব্যাপারটা জানাত। কিন্তু অনির্বাণ দত্ত এমন একটা লোক যে মানুষকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায়। অনির্বাণ ভাবল, পুলিশকে জানানোর আগে লোকটাকে একটু রগড়াতে পারলে মন্দ হয় না।
‘প্রদীপ চক্রবর্তীকে রগড়াতে গিয়ে অনির্বাণ নিজেই খুন হয়ে গেল। অনির্বাণকে খুন করার পর একই কারণে তার মোবাইলটা প্রদীপ চক্রবর্তীর দরকার হয়ে পড়ল। মোবাইলের মেসেজগুলো মুছে দিতে হবে। কিন্তু অনির্বাণের সঙ্গে তার মোবাইলটা ছিল না। ফলে অনির্বাণকে খুন করার পর তার পকেট থেকে স্মার্টকার্ড নিয়ে তার ঘরের দরজা খুলে আলো জ্বালিয়ে মোবাইলটা খুঁজে নিতে হল। মোবাইল নিয়ে প্রদীপ চক্রবর্তী দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিয়ে এলেন। কিন্তু তাড়াতাড়িতে স্মার্টকার্ড সকেটে রয়ে গিয়ে আলো জ্বলতে লাগল।
‘একটা সমস্যা হল। অনির্বাণের মোবাইলটা প্রচন্ড সফিস্টিকেটেড, সেটাতে ডবল পাস ওয়ার্ড ছাড়া ঢোকাই যায় না। ফলে সাইলেন্ট করে রাখা গেলেও মোবাইলটা সঙ্গে সঙ্গে সুইচ অফ করা গেল না। পরে ছুরির চাড় দিয়ে মোবাইলটা খুলে ফেলে সেটার ব্যাটারিটা বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। এই কারণে পরের দিন সকালেও মোবাইলটাতে ফোন এসেছিল।
‘পরের দিন চিলকা বেড়াতে গিয়ে প্রদীপ চক্রবর্তী লেকের মাঝখানে তাঁর ব্যাগটা ফেলে দিলেন। ভান করলেন যেন অসাবধানতাবশত পড়ে গেছে। ব্যাগের মধ্যে বই এবং চাদর ছাড়াও ছিল তিনটি মোবাইল। একটা তাঁর নিজের মোবাইল যেটা থেকে তিনি অসীম দত্ত এবং অনির্বাণ দত্তকে ফোন করেছিলেন। এটা তাঁর একটা বাড়তি মোবাইল। আজকাল ফেক আইডেন্টিটি দিয়ে সিম কার্ড কেনা শক্ত নয়। যাতে তাড়াহুড়ো না করতে হয় প্রদীপ চক্রবর্তী একটা সস্তার মোবাইল কিনে নিয়ে তাতে দুনম্বরি সিমটা ভরে রেখেছিলেন। নেহাত দরকার না হলে ফোনটা অন করতেন না। বিসর্জন দেওয়া অন্য দুটো মোবাইলের একটা অসীম দত্তর, অন্যটা অনির্বাণ দত্তর। এছাড়াও ছিল মার্ডার ওয়েপন সেই মান্ধাতার আমলের স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন। মনে রাখতে হবে, চিলকা বেড়াতে যাবার প্রস্তাবটা তিনিই দিয়েছিলেন। এবং ব্যাগে ভারী বই রাখার একটাই কারণ, ব্যাগটা যাতে কোনও ভাবে ভেসে না ওঠে। আমাদের দুর্ভাগ্য মার্ডার ওয়েপনটা আর পাওয়া যাবে না।
‘তো এই হল প্রদীপ চক্রবর্তীর উপাখ্যান।’ আদিত্য থামল। অভাসবশত পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বার করেও আবার ঢুকিয়ে রাখল।
সৈকত চৌধুরির সাইকোলজিটা কিন্তু এখনও আমি ভাল করে বুঝতে পারছি না। নিজেই পয়সা দিয়ে নিজেকে খুন করাল? এরকম হয় নাকি?’ কৃষ্ণ পধির গলায় অবিশ্বাস।
‘আপনি ব্যাপারটা এইভাবে ভাবুন। অনেকেই তো আত্মহত্যা করে। এবং নিজের হাতে বউ-বাচ্চাকে খুন করে তারপর আত্মহত্যা করে। কেন বউ-বাচ্চাকে খুন করে? কারণ তাদের ধারণা তারা মারা গেলে বউ বাচ্চাকে কেউ দেখার থাকবে না। সৈকত আত্মহত্যাই করেছিল। সে জানত তার মৃত্যুর পর অনিতার খুবই টাকা-পয়সার অসুবিধে হবে। কিন্তু সেই কারণে অনিতাকে খুন করার বদলে সে অনিতার জন্যে টাকার ব্যবস্থা করল। মোটা টাকার ইনশিয়োরেন্স কিনল, এবং এমনভাবে নিজেকে মারল যাতে তার মৃত্যুটাকে কেউ আত্মহত্যা না বলতে পারে।’
‘আচ্ছা, সৈকত কি বুঝতে পারেনি সে খুন হয়ে গেলে পুলিশ তার বউকেই সন্দেহ করবে?’ গৌতম জিজ্ঞেস করল।
‘ঠিক এই প্রশ্নটাই প্রদীপ চক্রবর্তী সৈকতকে করেছিলেন। সৈকত একটা অদ্ভুত উত্তর দিয়েছিল। সে বলেছিল, সে বিশ্বাস করে অনিতা যেহেতু নির্দোষ তার কখনই কোনও ক্ষতি হবে না। এই অন্ধ বিশ্বাসের ওপর আর কোনও কথা চলে না।’
‘কিন্তু সব প্রশ্নের তো মীমাংসা হল না। তোর ওপর গুলি চালালো কে? প্রদীপ চক্রবর্তী নিশ্চয় নয়।’ গৌতম আবার জিজ্ঞেস করল।
‘ও হ্যাঁ, ওটা তো বলতেই ভুলে গেছি। আমার ওপর গুলি চালিয়েছে একজন ভাড়াটে গুন্ডা। প্রশ্ন হচ্ছে, আমাকে মারার জন্যে কে তাকে ভাড়া করেছিল? সৌভাগ্যবশত, লোকটা গাড়িতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল, ফলে ধরা পড়েছে। লোকটা বলল, যে তাকে ভাড়া করেছিল তার দাড়ি আছে, চোখে কালো চশমা। ইন্সপেক্টার মাজি আমার নির্দেশে বিপ্লব সমাদ্দারের একটা ছবি জোগাড় করে তাতে দাড়ি-গোঁফ এঁকে, কালো চশমা পরিয়ে গুন্ডাটাকে দেখিয়েছিল। গুন্ডাটা ছবিটা সনাক্ত করেছে। অর্থাৎ বিপ্লব সমাদ্দার আমাকে মারতে চেয়েছিল।
‘বিপ্লব সমাদ্দার তোকে কেন মারতে চাইবে?’
‘কারণ আমি তার বাড়া ভাতে ছাই দিচ্ছিলাম। আমি প্রমাণ করে ফেলছিলাম অনিতা তার স্বামীকে খুন করেনি। এটা প্রমাণিত হলে বিপ্লব সমাদ্দারের কোম্পানিকে টাকাটা দিতে হবে। সেক্ষেত্রে যে মোটা কমিশনটা বিপ্লব সমাদ্দার পেত সেটা সে আর পাবে না। এখানে আমার মনে হয় ইন্সপেক্টার অচিন্ত্য সাহারও কিছু হাত আছে। বিপ্লবকে সে-ই আমার তদন্তের খবরাখবর দিত। ব্যাপারটা নিয়ে আরও তদন্ত দরকার। বিপ্লব তো বোঝাই যাচ্ছে একেবারে আনস্ক্রুপুলাস, কিন্তু অচিন্ত্য সাহাও কতটা ক্লিন আমাদের জানা দরকার।’
‘কিন্তু তুইই তো বললি তোকে সিবিআই-এর খবরটা অচিন্ত্যই প্রথম দিয়েছিল? এটা দিয়ে তার কী লাভ হল? এটার ফলে তো সন্দেহটা অনিতার ওপর থেকে ঘুরে গেল।’
‘না, ঠিক তা নয়। সৈকত কেন ইনশিয়োরেন্স কিনল তার একটা কারণ অচিন্ত্যকে খাড়া করতে হত। প্রদীপ চক্রবর্তী তাকে বলেছিলেন সৈকতকে কারা যেন মারার চেষ্টা করেছে। কথাটা মিথ্যে। কিন্তু এটার সঙ্গে সিবিআই তদন্তের ব্যাপারটা জুড়ে দিয়ে অচিন্ত্য একটা কারণ খাড়া করেছিল। সে বলার চেষ্টা করছিল সিবিআই-এর কাছে যাতে সৈকত তার সহযোগীদের নাম ফাঁস না করে দেয় সেইজন্যে তারা সৈকতকে মারার চেষ্টা করছিল। আর মরার ভয় ছিল বলেই সৈকত ইনশিয়োরেন্সটা কিনেছিল। সিবিআই না আনলে গল্পটা দাঁড়াত না।’
‘তুই নিশ্চিন্ত থাক অচিন্ত্যকে নিয়ে তদন্ত হবে। তবে আমার একটা রিকোয়েস্ট আছে। তুই এবার একটা ফায়ার আর্মস-এর লাইসেন্স নিয়ে নে। আমি সব ব্যবস্থা করে দেব। ওটা তোর সঙ্গে রাখা দরকার।’
‘নিয়ে কী করব? আমি তো ওটা কারোর ওপর চালাতে পারব না। জানিস না আমি গান্ধিবাবার চেলা?’
‘তোকে চালাতে হবে না। ওটা দিয়ে শুধু ভয় দেখাবি। তাতেই কাজ হবে। ঠাকুর কী বলেছিলেন? মাঝে মাঝে ফোঁস করবি, কিন্তু কামড়াবি না।’
আবার চা এসেছে।
‘এবার শেষ প্রশ্নের উত্তর। কারা অনিতার বয়ফ্রেন্ড সমীর প্যাটেলকে ঠেঙিয়ে হাসপাতালে পাঠাল? কেন ঠেঙাল?’ আদিত্য চায়ের কাপে একটা চুমুক দিল।
আদিত্যর ফোনটা বাজছে। বিমল। খুব উত্তেজিত গলা।
‘স্যার, আমি এতক্ষণ বসে বসে প্রদীপ চক্রবর্তীর বাড়ির একতলায় সিকিউরিটি ছেলেটার সঙ্গে গল্প করছিলাম আর আপনার কথা মতো নজর রাখছিলাম ভদ্রলোক বাড়ি থেকে বেরোন কিনা। উনি একবারও বাড়ি থেকে বেরোননি। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে একটা টায়ার ফাটার মতো শব্দ শোনা গেল। শব্দটা মনে হল প্রদীপ চক্রবর্তীর ফ্ল্যাট থেকেই এল। আমি আর সিকিউরিটি দৌড়ে ওপরে গেলাম। অনেকবার বেল বাজালাম। দরজায় ধাক্কা দিলাম। কেউ দরজা খুলছে না। সারা বাড়িটাতে বলতে গেলে কেউই এখন নেই। শুধু টু বি ফ্ল্যাট থেকে একজন ম্যাডাম বেরিয়ে এসেছেন। আমরা কী করব? দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে দেখব?’
‘তোমরা কিচ্ছু করবে না। দরজার সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে। আমি কিছুক্ষণের মধ্যে পুলিশ নিয়ে যাচ্ছি। পুলিশ গিয়ে যা করার করবে।’ আদিত্য ফোনটা কেটে দিয়ে পকেটে রাখল।
ঘরের দুজনে উৎসুক দৃষ্টিতে আদিত্যর দিকে তাকিয়ে আছে।
‘প্রদীপ চক্রবর্তী আমাকে মিথ্যে কথা বলেছিল। স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসনটা প্রদীপদা চিলকায় ফেলে আসেনি। সঙ্গে রেখে দিয়েছিল।’ আদিত্য বিষণ্ণ গলায় বলল।
তারপর একটু সময় নিয়ে আস্তে আস্তে বলল, ‘মনে হচ্ছে, প্রদীপ চক্রবর্তী সুইসাইড করেছে।’
আবার সে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ম্লান হেসে বলল, ‘এর একটাই ভাল দিক। মার্ডার ওয়েপনটা এবার পুলিশ পেয়ে যাবে।’
(৪)
আজকাল রাজারহাট নিউটাউনে কয়েকটা নতুন ক্লাব হয়েছে। কৌলিন্যে তারা নিশ্চয় কলকাতার বনেদি ক্লাবগুলোর থেকে পিছিয়ে, কিন্তু সুযোগ-সুবিধের দিক থেকে তারা যে খানিকটা এগিয়ে সেটা আজকাল কেউ কেউ স্বীকার করে নিচ্ছে।আদিত্যর বন্ধু সুনন্দ সরকার এই রকম একটা ক্লাবের মূল পৃষ্ঠপোষক এবং বলাই বাহুল্য, পরিচালন সমিতির একজন মাতব্বর। আদিত্য আর কেয়াকে খাওয়াবে বলে সে এখানে আজ সন্ধেবেলা একটা বিলাসবহুল প্রাইভেট ডাইনিং রুম ঠিক করেছে। আদিত্যদের সঙ্গে সঙ্গে গৌতম আর মালিনীরও নেমন্তন্ন।
সুনন্দ আদিত্যর ইস্কুলের বন্ধু। গৌতম কলেজের। কোনও এক সময় আদিত্যই ওদের আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। তারপর ওদের মধ্যে পরিচিতি আরও গভীর হয়েছে। এর পনেরো আনা কৃতিত্বই অবশ্য সুনন্দ সরকারের। সে-ই উদ্যোগ নিয়ে ধীরে ধীরে গৌতমের সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি করে ফেলেছে। ক্রিমিন্যাল লইয়ারদের পুলিশের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে হয়।
গৌতম বলেই দিয়েছিল আসতে দেরি হবে, মালিনীর কী যেন একটা কাজ আছে। আদিত্যরা অবশ্য সোয়া সাতটার মধ্যেই পৌঁছে গিয়েছে। একদিক থেকে ভালই হল। সৈকত চৌধুরি, প্রদীপ চক্রবর্তীর উপাখ্যানটা সুনন্দ আর তার বউ সাগরিকা শুনতে চেয়েছিল। গৌতম উপস্থিত থাকলে তাকে দু’বার একই গল্প শুনতে হত। কেয়া অবশ্য খুব ভাল করে গল্পটা আগে শোনেনি বা শুনতে চায়নি। প্রদীপ চক্রবর্তীর ব্যাপারটাতে সে দুতিনদিন ভীষণ ডিপ্রেশড হয়ে ছিল। সে প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছিল না প্রদীপ চক্রবর্তী খুন করতে পারে। তার আত্মহত্যাটাও মেনে নিতে পারছিল না। এখন কেয়া খানিকটা সামলে নিয়েছে।
গৌতমরা এল আটটা পঁচিশে। এর মধ্যে সুনন্দর তিনটে স্কচ হয়ে গেছে। আদিত্য অবশ্য একটাই জিন অ্যান্ড টনিক নিয়ে বসেছিল। গৌতমও স্কচ খাবে বলল। মালিনী সাগরিকার মতো রেড ওয়াইন খাচ্ছে। কেয়া ভার্জিন মেরি।
‘তোরা ঠিক সময় এসেছিস। প্রদীপ চক্রবর্তীর গল্পটা এইমাত্র শেষ হল। তোকে আর দুবার শুনতে হল না।’
‘কোথায় শেষ হল? সেদিন তো জানাই হল না তুই কী করে প্রদীপ চক্রবর্তীকে সন্দেহ করলি?’
‘হ্যাঁ, এটা সেদিন বলা হয়নি। প্রথম প্রথম প্রদীপ চক্রবর্তীকে সন্দেহ করার কোনও কারণই ছিল না। কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে ওঁর কথা মাথায় এল। প্রথমত ভেবে দেখলাম, প্রদীপদাই একমাত্র লোক যিনি দুটো খুনের জায়গাতেই উপস্থিত ছিলেন। আর উপস্থিত ছিলেন রাখি চক্রবর্তী। কিন্তু অসুস্থতার কারণে তাঁকে বাদ দেওয়া যায়। দ্বিতীয়ত, যে মান্ধাতার আমলের অস্ত্রটা ব্যবহার করা হচ্ছিল, আমার মন বলছিল, এটা বয়স্ক কেউ ব্যবহার করছে। মানে, অস্ত্রের বয়েসের সঙ্গে খুনির বয়েসের কোথাও একটা যোগ আছে। এটা অবশ্য নিছক একটা ধারণা, কোনও প্রমাণ নয়। কিন্তু এইভাবে ভাবলে প্রদীপ চক্রবর্তীর কথা সবার আগে মনে পড়ে। বিশেষত যেহেতু, পুলিশ রেকর্ড বলছে, তিনি এক সময় আগ্নেয়াস্ত্র চালিয়েছেন।
‘প্রদীপ চক্রবর্তী আমাকে বলেছিলেন সৈকত তাঁকে রিসর্টে থাকার জন্যে ডিসকাউন্টের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এটা ছাড়া তিনি রিসর্টে থাকার অন্য কোনও কারণ দেখাতে পারছিলেন না। আমি খবর নিয়ে দেখলাম, প্রদীপ চক্রবর্তী গোল্ডেন রিসর্টে ঘর বুক করেছেন সৈকত খুন হবার পরে। এবং তিনি কোনও ডিস্কাউন্টই পাননি। এতে আমার সন্দেহ অনেকটা বেড়ে গেল। কিন্তু সন্দেহ হলেও খুনের কোনও মোটিভ আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তারপর একদিন জানতে পারলাম অনেক টাকা দিয়ে প্রদীপ চক্রবর্তী তাঁর স্ত্রীর অপরেশন করাচ্ছেন। এত টাকা তিনি পেলেন কোথায়? মনে প্রশ্ন জাগল, তিনি কি তা হলে টাকা নিয়ে খুনগুলো করছেন? কেয়া যখন বলল, প্রদীপদার ব্যাগটা চিলকায় পড়ে গেছে, আমি নিশ্চিত হলাম ওই ব্যাগেই মোবাইলগুলো ছিল। আগ্নেয়াস্ত্রটাও যে ছিল সেটা মিথ্যে করে প্রদীপদাই আমাকে বলেছিলেন। আমি সেটা অর্ধেক বিশ্বাস করেছিলাম, অর্ধেক করিনি।
‘সে যাই হোক, কিছুদিন পরে জানতে পারলাম সৈকত অল্প দিনের ব্যবধানে তিরিশ লক্ষ টাকা নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে ক্যাশে তুলে নিয়েছে। এদিকে হাসপাতালে খবর নিয়ে জানা গেল প্রদীপ চক্রবর্তী তাঁর স্ত্রীর অপরেশনের জন্যে ক্যাশ তিরিশ লাখ টাকা জমা দিয়েছেন। সন্দেহ হল, এটা কি তা হলে সৈকতেরই টাকা?
‘কিন্তু সৈকতের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তিনি সৈকতকেই খুন করবেন কেন? এই ধাঁধার উত্তর খুঁজতে গিয়ে তিনটে জিনিস মাথায় এল। এক, সৈকত একটা ইনশিয়োরেন্স করেছিল যার শর্ত হল, সৈকতের মৃত্যু আত্মহত্যা বাদে অন্য কোনও ভাবে হলে তার স্ত্রী বীমার পুরো টাকাটা পেয়ে যাবে। দুই, কিছুদিন আগে সৈকতদের বানানো একটা ব্রিজ ভেঙে পড়ে এগার জনের মৃত্যু হয়েছে। তিন, সৈকত কোনও অন্যায়কে কখনও ক্ষমা করত না। নিজে অন্যায় করলে কি সে নিজেকে ক্ষমা করবে? এই তিনটে উপাদান থেকে আমি একটা গল্প খাড়া করে প্রদীপ চক্রবর্তীকে বললাম। দেখা গেল বাস্তবটা আমার গল্পের খুব কাছাকাছি।
‘আর একটা প্রশ্নের উত্তর সেদিন দিতে শুরু করেছিলাম কিন্তু দেওয়া হয়নি। অনিতার বন্ধু সমীরকে কারা মারধোর করল? কেন করল? এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে আর একটু পেছনে তাকাতে হবে। সৈকতের সঙ্গে অনিতার বিয়েটা অনিতার বাড়ি থেকে মেনে নেয়নি যেহেতু অনিতার বাপের বাড়ির মতো সৈকতরা ব্রাহ্মণ ছিল না। বিশেষ করে অনিতার দাদা সঞ্জয় শর্মা এই বিয়েটাকে তাদের পরিবারের অপমান হিসেবে নিয়েছিল। সে মাঝে মাঝেই অনিতাকে এবং কখনও কখনও সৈকতকে ফোন করে ভয় দেখাত। তারপর একদিন সে একটা গুণ্ডাকে সঙ্গে নিয়ে ফাঁকা রাস্তায় সৈকতকে আক্রমণ করল। সে হয়তো ভেবেছিল সৈকতকে মেরে আধমরা করে হাসপাতালে পাঠাতে পারলে তার গায়ের জ্বালা কিছুটা মিটবে। সৈকতের শারীরিক শক্তি সম্বন্ধে তার কোনও ধারণাই ছিল না। সৈকত একাই দুজনকে মেরে পাট করে দিল, সৈকতের হাতে মার খেয়ে তারা দুজনেই আধমরা হয়ে কোনও রকমে চম্পট দিল।
‘মার খেয়ে, বলাই বাহুল্য, সৈকতের ওপর সঞ্জয় শর্মার রাগ আরও বেড়ে গেল। সে এবার একটা অন্য রাস্তা ধরল। সমীর প্যাটেল বলে অনিতার এক পুরোনো সহপাঠিকে সে খুঁজে বার করল। সমীর প্রায় কিছুই করে না। মাঝে মাঝে বাবার দোকানে বসে একটা সামান্য মাসোহারা পায়। তাতে তার চলে না। সমীরকে সঞ্জয় বলল সমীর যদি অনিতাকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে অনিতার বিয়েটা ভাঙতে পারে তা হলে সে অনেক টাকা পাবে। আন্দাজ করা যায়, বেশ কিছু টাকা সমীরকে সঞ্জয় অ্যাডভান্স দিয়েছিল।
‘এটা এমন একটা সময় যখন সৈকত তার ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে এতটাই মনমরা হয়ে থাকছে যে অনিতার সঙ্গে তার সম্পর্কটা ক্রমশ দূরের হয়ে যাচ্ছে। এই সংকটের মুহূর্তে অনিতার একজন বন্ধুর খুব দরকার হয়ে পড়েছিল। এবং সেই ভূমিকায় সমীর ভালই মানিয়ে গিয়েছিল। সমস্যা হলো, বন্ধুর ভূমিকায় অভিনয় করতে করতে সমীর প্যাটেল আকণ্ঠ অনিতার প্রেমে পড়ে গেল।
সৈকতের অনুপস্থিতিতে সমীর যে ঘনঘন অনিতার কাছে আসে এটা পড়শিদের নজর এড়াল না। কথাটা ধীরে ধীরে সৈকতের কানেও উঠল। ততদিনে সৈকত ঠিক করে ফেলেছে মণিময় আর অসীম দত্তকে মেরে সে নিজেকেও শেষ করে দেবে। তার অবর্তমানে লাইফ ইনশিয়োরেন্সের টাকায় অনিতার ভালই চলে যাবে। কিন্তু টাকাটাই তো সব নয়। সৈকত ভাবল, সে চলে গেলে অনিতাকে দেখাশোনার করার জন্য একজন বন্ধু দরকার। তাই সমীরের সঙ্গে অনিতার মেলামেশায় আপত্তি করার বদলে সে খানিকটা উৎসাহই দিচ্ছিল।
সৈকত খুন হবার পর অনিতার বাড়িতে সমীরের যাতায়াত আরও বেড়ে গেল। এবং সমীর আরও আরও অনিতার প্রেমে ডুবে যেতে লাগল। এদিকে সঞ্জয় চাপ দিচ্ছে সমীরকে এমন একটা কিছু করে বেরিয়ে আসতে হবে যাতে অনিতার নামটা সারা জীবনের মতো কালিমালিপ্ত হয়ে যায়। সে যাতে আর ভদ্র সমাজে মুখ দেখাতে না পারে। সমীর একদিন সঞ্জয় শর্মাকে বলল, এই কাজটা তার দ্বারা হবে না। সঞ্জয় শর্মা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বলল, তাহলে আমার টাকা ফেরত দে। সমীর বলল, টাকা খরচ হয়ে গেছে। এর পরে যা ঘটার তাই ঘটল। দুটো গুণ্ডাকে দিয়ে সঞ্জয় সমীরকে অসম্ভব পেটাল। তবে সে নিজে মারামারির মধ্যে ছিল না। সৈকতকে মারতে গিয়ে তার যথেষ্ট শিক্ষা হয়ে গিয়েছিল। এই হলো সমীর প্যাটেলের কাহিনি। দেরিতে হলেও, সমীর সঞ্জয় শর্মার নামে এফ আই আর করেছে। সে এফ আই আর-এর ভিত্তিতে ইন্সপেক্টর মাজি সঞ্জয়কে তুলে এনে একটু থার্ড ডিগ্রি দিতেই সে সব স্বীকার করে নিয়েছে। যারা মনে করে গায়ের জোর ফলিয়ে সব সমস্যার সমাধান করা যায়, থার্ড ডিগ্রিই তাদের ঠিক ওষুধ।’
আদিত্য থামল। তার গেলাসে একটা চুমুক লাগাল। সুনন্দ বলল, ‘শুনলাম দীপশিখাকে উড়িষ্যা পুলিশ ছেড়ে দিচ্ছে। অনিকেত দত্ত এবং শ্বেতা মল্লিক নাকি তাদের স্টেটমেন্ট উইথড্র করেছে। জজকে বলেছে পুলিশ তাদের চাপ দিয়ে ভুল সাক্ষী দেওয়াচ্ছিল।’
‘এটার পেছনে আমার খানিকটা হাত আছে। আমি অনিকেতকে ফোন করে বললাম আমার কাছে বেশ কিছু ডকুমেন্ট আছে যা দিয়ে তোমাকে জেলে পাঠানো যায়। তুমি এবং তোমার বোন যদি তোমাদের মিথ্যে সাক্ষী উইথড্র না কর তা হলে ডকুমেন্টগুলো পুলিশের হাতে আমি তুলে দেব।’
‘এ তো ব্ল্যাকমেল! তুই লোকটাকে ব্ল্যাকমেল করলি?’ গৌতম ব্যাপারটা ঠিক মেনে নিতে পারছে না।
‘শুধু ব্ল্যাকমেল? ব্লাফও তো বটে। আমার কাছে মোটেই ওইরকম কোনও ডকুমেন্ট নেই। অনিকেত দত্তটা একই সঙ্গে বোকা এবং ভিতু। আমার কথায় ভয় পেয়ে গেল।’
‘তা নয় হল। কিন্তু তাও বলব ব্ল্যাকমেল করাটা ঠিক নয়। তুইই তো বলিস এন্ড দিয়ে মিনস জাস্টিফাই করা যায় না। তুই না গান্ধিবাবার চেলা?’
‘অবশ্যই আমি গান্ধিবাবার চেলা। ব্ল্যাকমেল জিনিসটা তো তাঁর কাছেই শেখা। নন-ভায়োলেন্স ব্যাপারটা ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল নয়? তুইই বল?’ আদিত্য চওড়া করে হাসল।
‘একটা লিগাল ব্যাপার কিন্তু এখনও সেটলড হয়নি। সৈকতের মৃত্যুটা খুন না আত্মহত্যা? এটা নিয়ে ইনশিয়োরেন্স কোম্পানি কিন্তু ফাইট করবে।’ সুনন্দ বলল।
‘সে করলে করবে। আমি আমার কাজ করে দিয়েছি। অসীম দত্তর খুনিকে ধরে দিয়েছি। তাই অসীম দত্তর কাছ থেকে ফিজ নিতে আমার কোনও বিবেকের দংশন নেই।’ আদিত্য উঠে দাঁড়াল। সে বাইরে গিয়ে একটা সিগারেট খেয়ে আসবে ভাবছিল।
ক্লাবের ম্যানেজার দরজায় নক করে ভিতরে এসেছে। জিজ্ঞেস করছে, ডিনার কী এখন সার্ভ করা হবে? আদিত্য আবার বসে পড়েছে।
কেয়া আর আদিত্য বাড়ি ফিরে আসছিল। রাত্তির এগারোটা বেজে গেছে। রাজারহাটের মেন রাস্তাটায় গাড়ি প্রায় নেই। পেছনের সিটে কেয়া আদিত্যর হাত দুটো শক্ত করে ধরে, আদিত্যর শরীরে শরীর লাগিয়ে, তার কাঁধে মাথা রেখে, চোখ বুজে রয়েছে। গাড়ি ইকো পার্ক ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আদিত্য একবার ভাবল যেখানে তার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল সেই জায়গাটা কেয়াকে দেখাবে। তারপর ভাবল কী দরকার মনে করিয়ে দিয়ে। আদিত্যর অ্যাক্সিডেন্ট থেকে শুরু করে এত দ্রুত ঘটনাগুলো ঘটে গেল! কেয়া আর নিতে পারছে না। ওর কিছুদিন মনের বিশ্রাম প্রয়োজন।
আদিত্য ভেবেছিল কেয়া ঘুমিয়ে পড়েছে।
‘সৈকত কিন্তু অনিতাকে ভালবাসত না। মোটেই ভালবাসত না। ভালবাসলে সে প্রথমেই অনিতাকে সব কথা বলে দিত।’ কেয়া চোখ বন্ধ রেখে হঠাৎ বলে উঠল।
আদিত্য চুপ করে আছে।
‘আমার কষ্ট হলে আমি কাকে বলব? তোমাকেই তো?’ কেয়ার চোখ বন্ধই রয়েছে।
আদিত্য এখনও চুপ করে আছে।
‘আমাকে তুমি কখনও কোনও কথা লুকিও না গো। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি কী করব? কোথায় যাব?’ কেয়া আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বলল।
আদিত্য টের পেল কেয়া কাঁদছে।
.
সমাপ্ত