সৈকত রহস্য – ২
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
(১)
শনিবার অমিতাভ আসতে পারল না। সকালে ফোন করে জানাল, একটা কাজ পড়ে গেছে তাই আসতে পারছে না। তার বদলে রবিবার রাত্তিরে যদি আদিত্য আর কেয়া ওদের বাড়িতে ডিনার খেতে যায় তাহলে ওদের খুব ভাল লাগবে। আদিত্যর মনে হল, অমিতাভর হাত থেকে রত্না ফোনটা কেড়ে নিয়েছে। রত্না বলল, ‘তুই কেয়াকে দে। আমি ওর সঙ্গে কথা বলব।’
কেয়া বাথরুমে। আদিত্য বলল, ‘কেয়া তোকে একটু পরে ফোন করছে।’
একটু পরে কেয়া বাথরুম থেকে বেরোলে আদিত্য তাকে বলল, রবিবার রাত্তিরে অমিতাভ-রত্না তাদের নেমন্তন্ন করতে চাইছে। ‘সারাদিন পিকনিক করে সন্ধেবেলা যেতে পারবে? নাকি অন্য কোনও দিন বলব?’
কেয়া কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, ‘এমনিতে রবিবারে আমার কোনও অসুবিধে নেই। তুমি পারবে?’
‘আমার তো ভালই হবে। অমিতাভর ওখানে গিয়ে গান শুনব।’
‘রবিবার হলে আর একটা সুবিধে আছে।’ কেয়া আর একটু চিন্তা করে বলল। ‘পিকনিকে যাবার জন্যে একটা গাড়ি তো ভাড়া করতেই হচ্ছে। সেটাকে নিয়েই রত্নাদের বাড়ি চলে যাব। অন্য দিন হলে আবার নতুন করে একটা গাড়ি ভাড়া করতে হত।’
আদিত্য ভাবল, কেয়া আজকাল বেশ সংসারী হয়েছে। হস্টেলে থাকা, বেহিসেবি কেয়া আর নেই।
রত্নার সঙ্গে কথা বলে এগারোটা নাগাদ কেয়া বেরিয়ে গেল। আজ তার স্কুল বন্ধ, কিন্তু কোচিং ক্লাস আছে সেই রাত্তির আটটা অবধি। আদিত্যর মনে হল, হাতে তেমন কোনও কাজ তো এখন নেই, এই ফাঁকে অনিতা শর্মা চৌধুরির বাড়িটা একবার ঘুরে এলে হতো। বাড়ির বাসিন্দাদের সঙ্গে একটু কথা বলে দেখা যেতে পারে। একটা কনস্টেবল সঙ্গে থাকলে সুবিধে হত। বাড়ির বাসিন্দারা তাকে আর একটু সিরিয়াসলি নিত। কিন্তু এর জন্যে অচিন্ত্য সাহাকে বলতে আর ইচ্ছে করছে না। সে মোবাইলটা তুলে অনিতা চৌধুরির নম্বরটা লাগাল।
‘আপনি কি বাড়ি আছেন? তাহলে একবার যেতাম। আপনার পড়শিদের সঙ্গে কথা বলা দরকার ছিল।’
‘আমি বাড়িতেই আছি। কোথায় আর যাব? তবে পড়শিরা সকলে আছে কিনা বলতে পারব না। যেমন শাশ্বতীদিরা ছেলেমেয়েদের নিয়ে কর্তা-গিন্নি সকালে বেরিয়ে গেল। আমার সঙ্গে লিফটে দেখা হয়েছিল। বলল, কাল নাকি পিকনিক আছে তাই ছেলেমেয়েদের মামারবাড়ি রেখে কেনাকাটা করবে। ফিরতে সন্ধে হয়ে যাবে। অন্যরা বাড়ি আছে কিনা বলতে পারব না। তবে রাখিদি অসুস্থ হবার পর থেকে প্রদীপদারা কোথাও যায় না। আর মলয়া বিশ্বাস, সুব্রত বিশ্বাস আপনার সঙ্গে কথা বলবে কিনা বলতে পারব না।’
‘ঠিক আছে। আমি একবার চেষ্টা করে তো দেখি কতজনের সঙ্গে কথা বলতে পারি। অন্তত বাড়িটা দেখা হবে। আমি ঘণ্টা খানেকের মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছি। হয়তো তার আগেই পৌঁছে যাব।’
‘ঠিক আছে, আমি বাড়িতেই আছি।’
শনিবার বলে বোধহয় মেট্রো কম। আদিত্য প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ টিভি দেখল। কিছু চলতি হিন্দি গানের ভিডিও, বাকিটা বিজ্ঞাপন। জামা-জুতোর বিজ্ঞাপন, মুক্তি-আসন্ন সিনেমার বিজ্ঞাপন, চকোলেট-লবেঞ্চুসের বিজ্ঞাপন। আসলে আদিত্য টিভির দিকে তাকিয়েছিল বটে, কিন্তু মন দিয়ে কিছুই দেখছিল না। তার চিন্তাটা সৈকত চৌধুরির খুনের রহস্যে আটকে আছে। সেই একই প্রশ্ন ফিরে ফিরে আসছে। সেই একই খটকা তার কিছুতেই যাচ্ছে না। ধরা যাক, পুলিশ যেটা ভাবছে সেটাই সত্যি, অর্থাৎ অনিতা চৌধুরিই তার প্রেমিকের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে নিজের স্বামীকে খুন করেছে। এবং সে যে বলছে ইনশিয়োরেন্সের ব্যাপারটা সে কিছুই জানত না, সেটা মিথ্যে। ধরা যাক, সে সবই জানত এবং টাকার লোভেই খুনটা করা হয়েছে। এখানেই আদিত্যর বারবার খটকা লাগছে। অনিতা চৌধুরি কি এতই বোকা যে সে আন্দাজ করতে পারবে না ইনশিয়োরেন্স করার পর সৈকত চৌধুরি খুন হলে প্রথম সন্দেহটা বেনিফিশিয়ারির ওপরেই গিয়ে পড়বে? অনিতাকে দেখে খুব বোকা মনে হয়নি। সে এত কাঁচা একটা কাজ করবে, বিশ্বাস করা শক্ত। তাহলে কি ধরে নিতে হবে সৈকত চৌধুরির খুন হবার সঙ্গে তার ইনশিয়োরেন্স কেনার কোনও সম্পর্কই নেই? খুন হওয়া এবং ইনশিয়োরেন্স কেনা দুটো যে এক সঙ্গে ঘটেছে সেটা কাকতালীয়? এতটা কাকতালীয় মেনে নিতে মন চায় না। তারও আগের প্রশ্ন, সৈকত চৌধুরি হঠাৎ পাঁচ কোটি টাকার ইনশিয়োরেন্স করতে গেল কেন? এত টাকার ইনশিয়োরেন্স, ফলে প্রিমিয়ামের অঙ্কটাও তো নেহাত কম ছিল না। সৈকত কি তাহলে খারাপ কিছু আশঙ্কা করছিল? নাকি এর মধ্যে অন্য কিছু রয়েছে?
ঝমঝম করে ট্রেন এসে প্ল্যাটফর্মে ঢুকেছে। মোটামুটি ফাঁকা একটা কামরা আদিত্যর সামনে এসে থামল। বসার জায়গা নেই বটে, কিন্তু উল্টোদিকের দরজা, যেটা শুধু পার্ক স্ট্রিট স্টেশনে খুলবে, তার সামনে আদিত্য দাঁড়াবার জায়গা পেয়ে গেছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ে গেল তার ইস্কুলের বন্ধু সায়ন্তন রায় একদিকে বসে আছে। সায়ন্তন আদিত্যকে দেখতে পায়নি। আদিত্য একবার ভাবল সে নিজের থেকে সায়ন্তনকে দেখা দেবে না। এক একটা সময় এমন আসে যখন কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু সেটা হবার নয়। সায়ন্তন আদিত্যকে দেখতে পেয়েছে। আদিত্য নিজের জায়গা ছেড়ে সায়ন্তনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
ইস্কুল পাশ করে সায়ন্তন আর্ট কলেজে পড়েছিল। এখন কার্টুন আঁকে। একটা নামকরা খবর কাগজে চাকরি করে। সেই কাগজে সায়ন্তনের আঁকা কার্টুন মাঝে মাঝেই দেখা যায়। এদের যে পত্র-পত্রিকাগুলো আছে সেখানে গল্প-উপন্যাসের সঙ্গে সায়ন্তনের ইলাসট্রেশন আদিত্যর চোখে পড়েছে। সায়ন্তন তো কালীঘাটের দিকে থাকত, এদিকে কোথায় চলেছে?
‘কোথায় চললি?’ সায়ন্তনের গলাটা একটু কাহিল শোনাল।
‘বালিগঞ্জের দিকে একটু কাজ আছে। তুই?’
‘আমি তো অফিস যাচ্ছি। তুই আছিস কেমন?’
‘আমি ভালই আছি। তুই কেমন আছিস? তোর গলাটা শুনে মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে।’
‘হয়েছিল। টাইফয়েড হয়েছিল। সিপ্রো রেসিস্টেন্ট। জানিস তো সিপ্রো হল টাইফয়েডের খুব কমন একটা ওষুধ। আমাদের দেশের ডাক্তাররা টেস্ট-ফেস্ট না করেই প্রথমে সিপ্রো খাইয়ে দেয়। তো আমার শরীরে যে পোকাগুলো বাসা বেঁধেছিল, ওই যে বীজাণু না জীবাণু কী যেন বলে, তারা আবার সিপ্রোতে মরে না। সিপ্রো খেয়েও যখন আমার জ্বর কমল না, আমাদের ডাক্তারবাবু ভাবলেন আমার টাইফয়েড হয়নি, অন্য কিছু হয়েছে। তিনি নানারকম এক্সপেরিমেন্ট চালালেন। শরীরটা তো তাঁর নয়। কী এসে যায়। শেষে আর এক ডাক্তারের কাছে যেতে অসুখটা ধরা পড়ল। সেরেও গেলাম, তবে সেরে উঠতে অনেক সময় লেগে গেল। এই তিন চারদিন হল অফিস যেতে শুরু করেছি। এখনও খুব দুর্বল।’
‘তুই এদিক থেকে অফিস যাচ্ছিস কেন? তুই তো কালীঘাটে থাকতিস?’
‘থাকতাম। এখন আর থাকি না। কালীঘাটে আমাদের পৈত্রিক বাড়ি। ভাইরা থাকে। আমি দমদমে নতুন ফ্ল্যাট কিনেছি। অনেকে বলছে, নতুন বাড়ি সবার সহ্য হয় না। তাই এত অসুখে ভুগলাম। হবেও বা। একদিন আয় না আমাদের বাড়ি।’
‘যাব, নিশ্চয় একদিন যাব।’ সায়ন্তনের পাশে একটা জায়গা খালি হয়েছে। আদিত্য সেখানে বসতে বসতে বলল। ‘স্কুলের কারও সঙ্গে যোগাযোগ আছে?’
‘খুব বেশি নেই। আমাদের ক্লাসে তো প্রায় সকলেই হয় ইঞ্জিনিয়ার না হয় ডাক্তার আর নয়তো চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হয়েছে। আমার লাইনে কেউ নেই। তাই যোগাযোগ কারোর সঙ্গেই খুব একটা রাখা হয় না। শুধু স্যমন্তকের সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা হয়, আড্ডাও হয়।’
‘স্যমন্তক, মানে নাটকের স্যমন্তক? ওর সঙ্গে আমারও যোগাযোগ আছে।’
‘জানি। ওর থেকেই তো তোর খবর পাই। তুই তো এখন রীতিমতো বিখ্যাত রে! সেলিব্রিটি! কে জানত আমাদের আদু বড় হয়ে শার্লক হোমস হবে?’
আদিত্যর মনে পড়ে গেল ক্লাস ফাইভ-সিক্সে কোনও কোনও বন্ধু তাকে আদু বলে ডাকত। আদিত্যর এটা ভেবে অস্বস্তি হল যে সায়ন্তন এখনও সেটা মনে রেখেছে। সে তেতো গলায় বলল, ‘আর কিছু করে উঠতে পারিনি তাই টিকটিকির কাজ করে পেট চালাই। বড়াই করে বলার মতো কিছু নয়।’ তারপর কথা ঘুরিয়ে বলল, ‘তোর পুরোনো ফোন নম্বরটাই আছে তো?’
‘না, না। ওটা পাল্টেছে। দাঁড়া নতুন নম্বরটা তোকে হোয়াটস অ্যাপ করে দিচ্ছি। এক্ষুনি পাবি না। মেট্রোর ভেতর নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। তুই মেট্রোর বাইরে গেলেই মেসেজটা এসে যাবে।’ সায়ন্তন পকেট থেকে মোবাইল বার করল। ‘তোর আগের নম্বরটাই আছে তো?’
আদিত্য ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল। সায়ন্তন বলল, ‘তুই যাই বলিস না কেন, মিডিয়ার দৌলতে তোর কীর্তিকলাপ কিন্তু অনেকে জানতে পারছে। বিশেষ করে ওই মন্দাকিনী চৌধুরির কেসটা সলভ করার পর থেকে, জানিস তো তোর একটা ফ্যান ফলোইং তৈরি হয়েছে। আমাদের কাগজে অর্ণব ব্যানার্জী বলে একটি বাচ্চা রিপোর্টার আছে। সে তোর খুব ভক্ত। আমি তোর বন্ধু বলাতে ওর কাছে আমার খাতির বেড়ে গেছে।’
‘অর্ণব ব্যানার্জী?’ আদিত্য ভুরু কুঁচকে ভাবল। ‘নামটা আমি তোদের কাগজে দেখেছি মনে হচ্ছে। ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং খুব ভাল করে। তাই বোধহয় আমার নামটা মনে আছে।’
‘তোর ঠিকই মনে আছে। অর্ণব ইজ ওয়ান অফ আওয়ার এইস রিপোর্টারস। বিশেষ করে কিছুদিন আগে ও পশ্চিমবঙ্গে সরকারি প্রকল্পগুলোর স্ক্যাম নিয়ে একটা সিরিজ করেছিল। ওটা খুব নাম করেছে।’
‘আমিও ওটা পড়েছি মনে হচ্ছে। সব কটা হয়তো পড়া হয়নি, কিন্তু কয়েকটা ডেফিনিটলি পড়েছি।’
‘শোন, আমার স্টেশন এসে পড়েছে।’ সায়ন্তন উঠে দাঁড়াল। ‘একদিন এক সঙ্গে বসা যাক। অর্ণবকেও ডেকে নেব। ও তোর সঙ্গে খুব আলাপ করতে চায়। তুই এখনও বিয়ার-টিয়ার খাস তো?’
‘খাই মাঝে মধ্যে। ওই সোশাল ড্রিংকিং আর কী। কিন্তু তোর যা শরীরের অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে কিছুদিন মদ্যপানটা তোর স্থগিত রাখাই ভাল।’
‘আরে না, না। আমার নতুন ডাক্তার এইসব ব্যাপারে খুব লিবারাল। বলেছে, আর সপ্তাহ খানেক গেলে একটু-আধটু খেতে পারি। চলি রে। ফোন করব।’ সায়ন্তন দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলল।
বাড়ির নাম স্বাগতম। হলুদ-সবুজ চারতলা বাড়ি। আদিত্যর রুচিতে রংটা ক্যাটক্যাটে লাগছে, অন্য কেউ হয়তো ঝলমলে বলবে। একতলায় গাড়ি রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। দোতলা থেকে ফ্ল্যাট শুরু। মূল ফটক পেরিয়ে ড্রাইভওয়ে, তারপর বাড়ি। বাড়ির ভেতরে ঢুকলে ওপরে ওঠার লিফট। ফটকে উর্দিপরা সিকিউরিটি বসে আছে। ‘কোথায় যাবেন?’ জিজ্ঞেস করাতে আদিত্য বলল, ‘মলয়া বিশ্বাস, সুব্রত বিশ্বাসদের বাড়ি।’ আদিত্য শুনেছিল এই বাড়িতে এখনও ইন্টারকম বসেনি। তাই সাহস করে নাম দুটো বলে দিল। সিকিউরিটি ফোন করে চেক করতে পারবে না।
‘খাতায় নাম লিখতে হবে। তার নীচে ঠিকানা। পাশের খোপে যে ফ্ল্যাটে যাবেন তার নম্বরটা লিখবেন।’ সিকিউরিটি ভারিক্কি গলায় জানাল। ‘বিশ্বাসদের ফ্ল্যাট নম্বর টু বি। লিফট থেকে নেমে ডান দিকে। সিঁড়ি দিয়েও উঠে যেতে পারেন। দোতলায়।’
দোতলায় উঠে আদিত্য দেখল দুই প্রান্তে দুটি ফ্ল্যাট। ডানদিকেরটিতে কালো কাঠের দরজা, তার গায়ে তামার ফলকে ইংরেজিতে লেখা ‘বিশ্বাস’। তার ঠিক নীচে লেখা টু বি। বাঁদিকের ফ্ল্যাটের দরজা কাঠ রঙের, সেখানে কোনও নাম-টাম লেখা নেই। শুধু টু এ লেখা আছে। আদিত্য কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে বিশ্বাসদের ফ্ল্যাটে বেল বাজাল। সংক্ষিপ্ত ঘণ্টাধ্বনির পর যে মহিলা দরজা খুললেন তাকে কেউ কেউ হয়ত সুন্দরীই বলবে। লম্বা-চওড়া চেহারা। ফরসা রং, তীক্ষ্ন নাক, বড় বড় চোখ, কিন্তু সব মিলিয়ে লাবণ্যের প্রবল অভাব।
আদিত্যকে দেখে ভদ্রমহিলা ভুরু তুললেন। সেই অভিব্যক্তিতে প্রশ্ন ছাড়াও বিরক্তি এবং তাচ্ছিল্য ফুটে উঠল।
‘নমস্কার। আমার নাম আদিত্য মজুমদার। আমি সৈকত চৌধুরির কেসটা ইনভেস্টিগেট করছি। আপনাদের দু-একটা প্রশ্ন করতে পারি?’
‘পুলিশ কিন্তু অনেকবার এসে আমাদের বিরক্ত করেছে। আপনি কে? আপনি কি পুলিশ?’
‘না আমি পুলিশ নই। আমি একজন বেসরকারি গোয়েন্দা। তবে পুলিশের সঙ্গেই কাজ করে থাকি। এই কেসটাতে অবশ্য অনিতা চৌধুরি আমাকে নিয়োগ করেছেন।’
‘অনিতা চৌধুরি? তার লোককে আমরা বাড়িতে ঢোকাব কেন? গোল্লায় যাওয়া একটি মেয়েছেলে। আপনি যান, এখানে আপনার কিছু সুবিধে হবে না।’ ভদ্রমহিলা মুখের এমন একটা ভাব করলেন যেন ভিখারি তাড়াচ্ছেন। ‘বেসরকারি গোয়েন্দা না হাতি। যত সব উটকো লোক দুপুরে এসে ঝামেলা করছে। সিকিউরিটি একে ঢুকতে দিয়েছে কেন?’ ভদ্রমহিলা আদিত্যকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন।
আদিত্য আধখোলা দরজা দিয়ে দেখেছিল একজন কালো লম্বা লোক ভদ্রমহিলার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। নিশ্চয় গৃহকর্তা। তার মুখটা আদিত্যর খুব হালকাভাবে চেনা মনে হল।
‘ওঁকে ঢুকতে দাও। আমি চিনি ওঁকে। আমাদের ব্যাঙ্কের একটা ফ্রড কেসে উনি খুব সাহায্য করেছিলেন। আদিত্যবাবু আপনি ভিতরে আসুন। আমার স্ত্রীর কথায় কিছু মনে করবেন না। আমি তো সারা সপ্তাহ এখানে থাকি না, আমার স্ত্রীকে মেয়ে নিয়ে একা থাকতে হয়। তার ওপর আমাদের ঠিক ওপরের ফ্ল্যাটে এই কাণ্ড। সব মিলিয়ে উনি একটু ওভার সেন্সিটিভ হয়ে পড়েছেন।’ গৃহকর্তার গলার আওয়াজটা গমগমে।
আদিত্য নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানাল। ভাগ্যিস এই লোকটা তাকে চিনতে পেরেছে। সে-ও এখন লোকটাকে মনে করতে পারছে। কিছুদিন আগে একটা ব্যাঙ্ক জালিয়াতির কেসে লোকটার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। অনেক অফিসারের মধ্যে এ-ও ছিল। চেনা না বেরোলে ফিরে যেতে হত। পুলিশ নিয়ে আবার আসতে হত। অনেকটা খাটনি বেঁচে গেল।
মলয়া বিশ্বাস নিজের মনে গজগজ করতে করতে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেছে। আদিত্য সোফার একধারে বসল।
‘আমার প্রশ্নগুলো কিন্তু আমি আপনার স্ত্রীকেই করব। আপনি তো এখানে থাকেন না, আপনার পক্ষে প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা সম্ভব নয়। আপনি কি আপনার স্ত্রীকে একবার রাজি করাতে পারবেন? আমি বেশি সময় নেব না। আপনি বলুন যে আমি অনিতা চৌধুরিকে বাঁচাতে আসিনি, সত্যটা জানতে এসেছি মাত্র। কেবল দুটো প্রশ্ন আমি করব। একটু দেখুন না, যদি একবার আসার জন্য আপনার স্ত্রীকে রাজি করাতে পারেন।’ আদিত্যর গলায় অনুনয়।
‘নিশ্চয় উনি আসবেন এবং আপনার প্রশ্নের উত্তর দেবেন।’ সুব্রত বিশ্বাস জোর দিয়ে বলল। ‘আপনি একটু বসুন।
মিনিট পাঁচেক আদিত্য বসে আছে। এর মধ্যে একটি বছর দশেকের বালিকা পর্দার আড়াল থেকে তাকে বিস্ময়াবিষ্ট চোখে নিরিক্ষণ করে গেছে। যেন ভিনগ্রহের কোনও প্রাণীকে দেখছে। আদিত্য হাত নেড়ে তাকে কাছে আসতে বলার সঙ্গে সঙ্গে সে অন্দরমহলে গা ঢাকা দিল।
অবশেষে বাড়ির ভেতর থেকে সস্ত্রীক বেরিয়ে এলেন সুব্রত বিশ্বাস। তিনি তাঁর স্ত্রীকে কী বুঝিয়েছেন আদিত্য জানে না, কিন্তু মলয়া বিশ্বাসের হাবভাবে একটা পরিষ্কার পরিবর্তন হয়েছে। তিনি আদিত্যর দিকে তাকিয়ে একবার হাসির চেষ্টা করলেন। প্রত্যুত্তরে আদিত্যও মুখে একটা হাসির ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করল। আদিত্য খেয়াল করল ভদ্রমহিলা তাঁর বাড়ির পোশাকটা পাল্টে একটা শাড়ি পরে এসেছেন। যতদূর মনে হয়, ঠোঁটেও হালকা রং মেখে এসেছেন। ব্যাঙ্ক জালিয়াত ধরার সময় আদিত্যকে যে সুব্রত বিশ্বাসের অন্তত চার-পাঁচ ধাপ ওপরের অফিসারদের সঙ্গে কাজ করতে হত, এটা বোধহয় মলয়া বিশ্বাস জানতে পেরেছেন।
‘আপনার সময় বেশি নষ্ট করব না। মাত্র দুটো প্রশ্ন করব আপনাকে। আমি চাইব আপনি কোনও ব্যক্তির কথা না ভেবে, যেটা আপনার সত্যি মনে হয়, সেটা বলবেন। আমি কিন্তু কাউকে প্রোটেক্ট করতে আসিনি। শুধু সত্যিটা জানতে এসেছি।’ আদিত্য মলয়া বিশ্বাসের দিকে তাকিয়ে বলল।
‘হ্যাঁ বলুন, কী জানতে চান।’ মলয়ার গলা শুনে মনে হয় একটা বনবিড়ালকে কেউ পোষ মানিয়েছে।
‘আমার প্রথম প্রশ্ন, সৈকত চৌধুরি যখন বাড়িতে থাকতেন না তখন অনিতা চৌধুরির কাছে নিয়মিত কি তার কোনও পুরুষ বন্ধু আসত?’
প্রশ্নের আকস্মিকতায় বোধহয় মলয়া একটু থতমত খেয়ে গেছে। সে প্রথমে তার স্বামীর দিকে তাকাল। যেন সত্যিটা বলার জন্যে স্বামীর অনুমতি চাইছে।
‘আমি আবার বলছি ম্যাডাম, আপনি খোলা মনে যেটা সত্যি মনে হয় সেটা বলুন। কারোর প্রতি আপনাকে পক্ষপাতিত্ব দেখাতে বলছি না। আবার অকারণ বিদ্বেষ দেখাতেও বলছি না।’
‘আপনি যখন বারবার সত্যিটা জানতে চাইছেন তখন খোলাখুলি বলছি। সৈকত চৌধুরি লোকটা মোটেই খারাপ ছিল না। কিন্তু তার বউটা একটা নষ্ট মেয়েছেলে, এক নম্বরের ভিজে বেড়াল। আপনি ওপর থেকে দেখে কিছু বুঝতে পারবেন না। কিন্তু দিন কয়েক দেখলেই বুঝে যাবেন। কথাটা খোলাখুলি বললাম কারণ আপনি সত্যিটা জানতে চেয়েছেন।’
‘ব্যাপারটা আর একটু খুলে বলবেন?’
‘দেখুন, খুলে বলার খুব বেশি কিছু নেই। দুপুরবেলা সৈকতবাবু যখন বাড়ি থাকতেন না তখন অনিতার এক বয় ফ্রেন্ড নিয়মিত তার সঙ্গে দেখা করতে আসত। আমি বারান্দা থেকে তাকে অনেকবার আসতে দেখেছি। যেতেও দেখেছি। বেলা একটা-দুটোর সময় সে আসত আর পাঁচটা বাজার আগে চলে যেত। আপনি সিকিউরিটিকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে অনিতা তার বয় ফ্রেন্ডের সঙ্গে ঠিক কী করত আমি বলতে পারব না।’
‘কতদিন থেকে এই বয় ফ্রেন্ড আসছে?’
‘তা ধরুন ছ-সাত মাস হবে। এটা অবশ্য আমি আন্দাজে বলছি।’
‘আপনাদের ফ্ল্যাটের আর কেউ কি তাকে দেখেছে?’
‘বলতে পারব না। আমি কাউকে জিজ্ঞেস করিনি। তবে রাস্তার দিকে বারান্দা আমাদের আর সৈকত চৌধুরিদের। আর আগে যারা এই জায়গাটার মালিক ছিল তাদের চারতলার একটা ফ্ল্যাট থেকেও রাস্তা দেখা যায়। কিন্তু সেই ফ্ল্যাটটা বন্ধই পড়ে থাকে। ফলে অন্য যে দুটো ফ্ল্যাট আছে সেখান থেকে দেখাই যায় না বাইরের কে বাড়িতে ঢুকছে বেরোচ্ছে। তবে সিকিউরিটি ছেলেটা সব জানে।’
‘আপনি কী করে জানলেন যে লোকটি নিয়মিত আসছে সে অনিতা চৌধুরির ফ্ল্যাটেই আসছে? অন্য কোনও ফ্ল্যাটেও তো সে যেতে পারে?’
‘সিকিউরিটি ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করে জেনেছি। আপনি আমাকে খোলাখুলি কথা বলতে বলেছেন বলে বলছি, আমার বারান্দা থেকে অনিতার বয় ফ্রেন্ডের কয়েকটা ছবি তুলে আমি সৈকতবাবুকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। তাঁকে জানিয়েছিলাম এই লোকটা রোজ দুপুরে আপনার বউ-এর সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করতে আসে। বাড়ির মধ্যে এই বেলেল্লাপনা আমার অসহ্য লাগছিল।’
‘সৈকতবাবুর কী রিঅ্যাকশান হয়েছিল জানেন?’
‘জানি না। ওর দিক থেকে কোনও উত্তর পাইনি। তবে আমাদের যে কাজের লোক আছে সে সৈকতবাবুদের বাড়িতেও কাজ করে। সে আমাকে বলেছে সৈকতবাবু খুন হবার বেশ কয়েক মাস আগে থেকে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কথাবার্তা ছিল না। এটা আমার ছবি পাঠানোর ফল কিনা বলতে পারব না।’
‘আচ্ছা আপনি যে ছবিগুলো পাঠিয়েছিলেন তার কপি আমাকে দিতে পারেন?’
‘নিশ্চয় পারি। ইনশিয়োরেন্স কোম্পানি থেকে যে ভদ্রলোক এসেছিলেন, বিপ্লব সমাদ্দার না কী যেন নাম, বললেন আগে পুলিশে কাজ করতেন, তাকেও তো ছবিগুলো দিয়েছি। আপনার হোয়াটস অ্যাপ নম্বরটা বলুন, পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
ছবি পাবার পর আদিত্য উঠতে যাচ্ছিল। হঠাৎ কী মনে পড়ে যেতে বলল, ‘আপনাকে দ্বিতীয় প্রশ্নটা তো করাই হল না। আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন, ঘটনার দিন, অর্থাৎ সৈকতবাবু যেদিন খুন হন সেদিন, আপনি কি সন্দেহজনক কিছু দেখেছিলেন?’
‘না আমি কিছু দেখিনি। আমার স্বামী সেদিন বাড়ি ছিলেন না। সারা দুপুর এবং বিকেল আমি ঘুমিয়েছিলাম। পাশের বাড়ির প্রদীপবাবু বেল বাজাতে ঘুম ভাঙল। দরজা খুলে দেখি এই ব্যাপার।’
‘আপনার মেয়ে কোথায় ছিল?’
‘আমার মেয়ে কোচিং ক্লাসে গিয়েছিল। শনিবার ওর পরপর চারটে কোচিং ক্লাশ থাকে। আমার ড্রাইভার যখন ওকে নিয়ে ফিরল তখন বাড়িতে পুলিশ এসে গেছে।’
‘আর একটা প্রশ্ন করব?’ আদিত্য উঠতে উঠতে বলল। ‘এটা অবশ্য প্রথম প্রশ্নটার সঙ্গেই কানেকটেড। সৈকতবাবু খুন হবার পরেও কি আপনি অনিতার বয় ফ্রেন্ডকে এই বাড়িতে আসতে দেখেছেন?’
‘দেখেছি। এখনও মাঝে মধ্যেই লোকটা আসে। পরশু দিনও তো লোকটাকে আসতে দেখলাম।’
‘আমার আর কিছু জিজ্ঞেস করার নেই। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।’
মলয়া বিশ্বাসের স্বামীর সঙ্গে কয়েকটা কুশল প্রশ্ন বিনিময় করে আদিত্য টু বি ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এল। সামনেই টু এ ফ্ল্যাট। কিন্তু এখানে অনিতাকে সঙ্গে করে আসাই ভাল। তার আগে একটা দরকারি কাজ সারতে হবে। এখানকার নিয়ম, ভিজিটারদের খাতায় নাম ঠিকানা লিখতে হবে। হয়তো সিকিউরিটির কাছে গেলে অনিতার বয় ফ্রেন্ডের নাম ঠিকানা পাওয়া যেতে পারে।
(২)
‘১৯৬৮ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে ঢুকেছিলাম। ১৯৭১-এ পাশ করে বেরোনোর কথা ছিল। সেটা আর হয়ে ওঠেনি। রাজনীতির ভূত মাথায় চাপল। সশস্ত্র বিপ্লব করতে গ্রামে চলে গেলাম। ফিরলাম ছবছর জেলখানায় কাটিয়ে, ১৯৭৭ সালে। ঝাড়গ্রাম কলেজ থেকে বি এসসিটা পাশ করলাম। ঝাড়গ্রামের কাছেই আমাদের আদি বাড়ি।’
প্রদীপ চক্রবর্তী কথা বলেন নিচু গলায়, থেমে থেমে। কথা বলার ঢঙটা তাঁর চেহারার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। শ্যামবর্ণ, পক্ককেশ, দীর্ঘদেহী, কৃশতনু পুরুষ। চশমায় ঢাকা শান্ত এক জোড়া চোখে কোনও অনিশ্চয়তা নেই, কোনও উত্তেজনার লেশ মাত্র নেই। যেন পৃথিবীর সব সংশয়, সব দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মীমাংসা হয়ে গেছে।
‘আমি আপনার আড়াই দশক পরবর্তী। আপনারা যখন কলেজে ঢুকছেন তখনও আমাদের জন্ম হয়নি। তবে আমরা কলেজে ঢুকে প্রেসিডেন্সির সেই উত্তাল দিনগুলোর গল্প অনেক শুনেছি। রাজনীতির সঙ্গে আপনার আর কি কোনও যোগ আছে?’ আদিত্য খেয়াল করল, প্রদীপ চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তার নিজের ভাষাও কিছুটা শুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। লোকটা ব্যক্তিত্ববান, সন্দেহ নেই।
‘মনে মনে যোগ আছে। বাহ্যত নেই। টিভি খুব একটা দেখা হয় না। তবে নিয়মিত খবর কাগজ পড়ি। আজকাল ইন্টারনেটের দৌলতে দেশ-বিদেশের চার-পাঁচটা খবর কাগজ তো অনায়াসেই পড়ে ফেলা যায়। হাতে সময়ও অঢেল। বছর পাঁচেক হল অবসর নিয়েছি।’
‘কী পড়েন খবর কাগজে?’ আদিত্য খেই ধরিয়ে দেবার মতো করে জিজ্ঞেস করল।
‘দেশ-বিদেশের খবর পড়ি। মনে হয় পৃথিবীটা খুব একটা বদলালো না। সেই একই রকম দারিদ্র্য, সেই অন্যায়, সেই অসাম্য। মানুষের দুঃখ-কষ্ট আগের মতোই আছে। তাই আমার রাজনৈতিক বিশ্বাসটাও বিন্দুমাত্র বদলায়নি।’
‘আপনারা তো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটাকেই তুলে দিতে চেয়েছিলেন?’ আদিত্য ইচ্ছে করে প্রদীপ চক্রবর্তীকে উত্তেজিত করে দিতে চাইছে।
‘গণতন্ত্র? গণতন্ত্র আমাদের কী দিয়েছে? গণতন্ত্র তো বড়লোকদের জন্যে। আমি তো বলব, ডেমক্রেসি ইজ অফ দ্য রিচ, বাই দ্য রিচ, ফর দ্য রিচ। গণতন্ত্র কখনও গরিবদের হয়ে কাজ করে না।’ প্রদীপ চক্রবর্তী থেমে থেমে জোর দিয়ে দিয়ে বললেন।
‘একটা কথা তো ঠিক। বাজারে যেমন গরিবদের থেকে বড়লোকদের দাপট বেশি, কারণ বেশি টাকা দিয়ে বাজারের সব কিছু বড়লোকরা কিনে নিতে পারে, গণতন্ত্রে কিন্তু তা নয়। সেখানে গরিব-বড়লোক সকলেরই একটা করে ভোট। এটাকে আপনি সাম্য বলবেন না?’ আদিত্যকেও তর্ক পেয়ে বসেছে।
‘ওপর ওপর ওই সাম্যটা আছে। কিন্তু ওটা একটা মানুষ ঠকানো ব্যাপার। তলায় তলায় টাকার খেলা চলে। একটা ইলেকশান লড়তে গেলে কোটি কোটি টাকা খরচ করতে হয়। বড়লোক ব্যবসায়ীরা ইলেকশন ফান্ড করে নিজেদের স্বার্থে। ইলেকশন হয়ে গেলে তারা সরকারের কাছ থেকে নানারকম সুযোগ সুবিধে আদায় করে নেয়। সেই সুযোগ সুবিধেগুলো গরিবদের স্বার্থ বিরোধী।’ আদিত্য লক্ষ করল কথা বলতে গিয়ে প্রদীপ চক্রবর্তীর গলাটা একবারের জন্যেও চড়ছে না।
‘কিন্তু গণতন্ত্রের যে বিকল্পটার কথা আপনারা বলেন, সশস্ত্র বিপ্লব বা ওই ধরনের একটা কিছু, সেটাতে তো বহু নিরীহ মানুষ মারা পড়ে। সেটাকে আপনি কী ভাবে জাস্টিফাই করবেন? এন্ড দিয়ে কি মিনস জাস্টিফাই করা যায়?’
‘অবশ্যই যায়। অবশ্যই যায়। উদ্দেশ্যটা যদি মহৎ হয় তাহলে সেটাকে হাসিল করতে গিয়ে দু-একটা অনৈতিক কাজ করাটা আমি অন্যায় মনে করি না। এই যে ধরুন আমি, মনে প্রাণে কর্পোরেটদের বিরোধী, সারা কর্মজীবন একটা কর্পোরেটেই চাকরি করে গেলাম। পেট চালানোর জন্যে এটা আমাকে করতে হয়েছে। এতে আমার বিবেকের সায় ছিল না, কিন্তু মানুষের জীবনে বেঁচে থাকাটা যে আরও ফান্ডামেন্টাল একটা লক্ষ্য সেটা তো স্বীকার করবেন। এই লক্ষ্য বা এন্ডটা অ্যাচিভ করতে গিয়ে আমাকে বিবেক-বিরুদ্ধ একটা মিনস নিতে হয়েছে।’
‘কিন্তু এটা তো মানবেন, জীবিকার জন্য বিবেকের বিরুদ্ধে কাজ করা আর বিপ্লবের নামে পাইকারি হারে মানুষ মারার মধ্যে একটা বড় তফাত আছে?’ আদিত্য খানিকটা উত্তেজিত হয়ে বলল।
‘বিপ্লবের সঙ্গে অগণিত পিছিয়ে পড়া মানুষের স্বার্থ জড়িত। তার জন্য যদি দু-একজন ব্যক্তি মারা যায়, যারা বিপ্লবের শত্রু, তাতে আমি কোনও দোষ দেখি না। কারণটা যদি জোরালো হয়, তাহলে আমার মতে, একজন ব্যক্তিমানুষের জীবনের আলাদা করে তেমন দাম নেই। আমি এই অব্জেক্টিভিটিতে এখনও বিশ্বাস করি।’
প্রদীপ চক্রবর্তীর স্ত্রী রাখি চক্রবর্তী চায়ের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকেছেন। তিনি ঘরে ঢুকে অনিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুই এখানে বসে কী করছিস? এইসব ইন্টেলেকচুয়াল আলোচনার মধ্যে বসে থেকে বোর হচ্ছিস নিশ্চয়।’ তারপর স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমরা যদি তোমাদের কথাবার্তাটা একটু আমাদের লেভেলে নামিয়ে আনতে পার, তাহলে আমরাও এখানে তোমাদের সঙ্গে বসে চা খেতে পারি।’
আদিত্য লজ্জা পেয়ে গিয়েছিল। সে কুণ্ঠিতভাবে বলল, ‘দোষটা আমারই। আমিই মনে হয় প্রদীপবাবুকে উত্তেজিত করে দিয়েছিলাম।’
‘উত্তেজিত হবার লোক আমার স্বামী নয়। আসলে ও এসব নিয়ে খুব ভাবে। কথা বলতেও ভালবাসে, কিন্তু বলার লোক পায় না। দেখছেন না আপনাকে পেয়ে ওর মুখটা কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।’ রাখি স্বামীর দিকে তাকিয়ে হাসলেন। আদিত্যর মনে হল, রাখি চক্রবর্তীর চেহারাটা একটু কাঠ কাঠ হলেও মানুষটা খাঁটি।
‘আমি যা নিয়ে কথা বলতে এসেছিলাম সেটা কিন্তু শুরুই করা হয়নি।’ আদিত্য সুযোগ পেয়ে বলল। ‘আমি সৈকত চৌধুরি সম্বন্ধে একটু জানতে এসেছিলাম।’
‘খুব ভাল ছেলে ছিল সৈকত। খুব পরোপকারী ছিল। এত ভাল ছেলেটাকে কে যে এভাবে মারতে পারে আমার মাথায় আসে না।’ রাখি চক্রবর্তীকে হঠাৎ খুব বিষণ্ণ দেখাল।
‘ঘটনার দিন আপনারা কোথায় ছিলেন?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘সেই সময় আমি একটু অসুস্থ ছিলাম। ঘুমোচ্ছিলাম। তার আগের দিন একটা কেমো নিয়ে হাসপাতাল থেকে ফিরেছিলাম। অনিতা আপনাকে বলেছে কিনা জানি না, আমি একজন ক্যান্সার ফাইটার। কিছুদিন ধরে কেমো চলছে। কেমো নেবার পরের কয়েক দিন শরীরটা এমন খারাপ হয়ে যায় যে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারি না। সেদিনও সেই রকম শরীর খারাপ ছিল। প্রদীপ জেগে ছিল। কিন্তু আমাকে আর জাগায়নি। পরের দিন সকালবেলা খবরটা দিল।’ রাখি চক্রবর্তীর গলাটা স্বাভাবিকই মনে হল।
‘রাখি ঠিক বলেছে। ঘটনার সময় রাখি ঘুমিয়েছিল। ওকে অনেকটা সিডেটিভ দেওয়া হয়েছিল। আমি জেগেই ছিলাম। বারান্দায় বসে বই পড়ছিলাম। দুপুরে ঘুমোনো আমার অভ্যেস নেই। আমাদের বারান্দা থেকে রাস্তা দেখা যায় না, কিন্তু একতলা ওপরে সৈকতদের বারান্দার খানিকটা দেখা যায়। বিকেল নাগাদ একটা হালকা শব্দ শুনলাম। টায়ার ফাটার মতো একটা শব্দ। একবার হয়তো বই বন্ধ করে রাস্তার দিকে তাকিয়েছিলাম। তারপর আর ব্যাপারটাকে আমল দিইনি। তবে শব্দ যে একটা শুনেছিলাম তাতে সন্দেহ নেই। অনেক পরে, তখন সন্ধে নেমে গেছে, আমি বারান্দার আলো জ্বেলে দিয়েছি, রাখি তখনও ঘুমিয়ে যাচ্ছে, হঠাৎ দরজায় দুমদুম শব্দ। কলিং বেল নয়, কেউ প্রাণপণে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। খুলে দেখি অনিতা। উদভ্রান্ত চেহারা। সঙ্গে শাশ্বতী শাসমল। অনিতার কাছে সব শুনে ইন্টারনেট থেকে গড়িয়াহাট থানার ফোন নম্বরটা খুঁজে বার করে আমিই পুলিশকে ফোন করি।’
‘আপনি ছাড়া আর কেউ কি টায়ার ফাটার শব্দটা শুনেছিল?’
‘সিকিউরিটি বলছে সে শুনেছিল। কিন্তু ব্যাপারটা তখন সে ঠিক বুঝতে পারেনি।’
‘আচ্ছা, একটা কথা বলুন। আপনার কি মনে হয় বাইরে থেকে কেউ এসে সৈকতকে খুন করে থাকতে পারে? সিকিউরিটি কিন্তু জোর দিয়ে বলছে সেদিন দুপুরে কিংবা বিকেলে বাইরে থেকে কেউ বাড়িতে ঢোকেনি।’
‘আমার মনে হয় সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সিকিউরিটি যতই বলুক, মনে রাখতে হবে সে গরিব মানুষ। তাকে দু-চার পয়সা ঘুষ দিয়ে মিথ্যে বলিয়ে নেওয়াটা শক্ত নয়। তাছাড়া আমাদের বাড়িতে রাত আটটা নাগাদ সিকিউরিটি বদল হয়। আগের রাত্তিরে সেই সময় সকলের চোখ এড়িয়ে বাইরের কেউ ঢুকে পড়তেই পারে। ঢুকে পড়ে সে অনায়াসে ছাতে রাত্তিরটা কাটিয়ে দিতে পারে। তারপর কাজ হয়ে যাবার পর গণ্ডগোলের সুযোগ নিয়ে টুক করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তে পারে। আমি দেখেছি, ছাদের দরজাটা সব সময় তালা বন্ধ থাকে না। কেবলওলারা তো সারাক্ষণ ছাদে উঠে অ্যান্টেনা ঠিক করছে। তারাই দরজাটা খোলা রেখে দেয়।’
‘বুঝতে পারছি। সব সম্ভাবনাই খোলা আছে।’ আদিত্যকে চিন্তান্বিত দেখাল।
‘কিন্তু প্রদীপদা গুলির শব্দটা শোনার অনেক পরে যে আমি বাড়ি ফিরেছি সেটা তো সিকিউরিটি বলছে। তাহলে এটাই কি প্রমাণ হয় না যে আমি সৈকতকে মারিনি?’ এতক্ষণে অনিতার গলা শোনা গেল। কথাগুলো বলতে বলতে তার স্বর কান্নায় বুজে এসেছে।
‘ইনশিয়োরেন্স কোম্পানি বলবে আপনি যে টাকার লোভে লোক লাগিয়ে আপনার স্বামীকে খুন করাননি তার কী প্রমাণ?’ আদিত্য খানিকটা ইতস্তত করে বলল।
রাখি চক্রবর্তী বললেন, ‘যে জিনিসটা আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না সেটা হল এত লোক থাকতে সৈকতকে কেন কেউ খুন করতে চাইবে? জীবনে আমি অনেক ধরনের মানুষ দেখেছি। ভাল, খারাপ, খুব খারাপ। এত খারাপ মানুষও দেখেছি যাকে খুন করলে পাপের বদলে পুণ্য হয়। কিন্তু সৈকত ছিল এমন একজন মানুষ যে সাধারণ ভাল-খারাপের ঊর্ধ্বে। এক কথায় বলতে গেলে, ওরকম অদ্ভুত মানুষ আমি আমার সত্তর বছরের জীবনে আর একটিও দেখিনি। আমি কিন্তু একটুও বাড়িয়ে বলছি না। আশ্চর্য মাত্রায় উদারহৃদয়, বিবেকসম্পন্ন অথচ ন্যায়বিচারের ব্যাপারে একেবারে নির্দয়, আপোশহীন।’
আদিত্য উদগ্রীব হয়ে শুনছিল। সৈকতবাবুর চরিত্রের এইসব অদ্ভুত দিকগুলোর দু’একটা উদাহরণ দিতে পারবেন?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
রাখি কিছু বলার আগেই অনিতা বলে উঠল, ‘রাখিদি একদম ঠিক বলেছে। একটা ঘটনা তো এই কিছুদিন আগেই ঘটেছিল। সেটা বললেই সৈকত কেমন ছিল খানিকটা বুঝতে পারবেন।
‘মাস ছয়-সাত আগেকার কথা হবে। আমি আর সৈকত রাত্তিরবেলা একটা পার্টি থেকে ফিরছিলাম। সৈকতদের অফিসের পার্টি। সৈকত গাড়ি চালাচ্ছিল। আমরা প্রায় বাড়ি পৌঁছে গিয়েছিলাম। আপনি খেয়াল করেছেন কিনা জানি না, আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ডানদিকে একটু গেলেই একটা বড় বস্তি আছে। বস্তির সামনে দিয়ে আসার সময় একটা লোক আমাদের গাড়ির সামনে পড়ল। একদম ড্রাঙ্ক। লোকটা বস্তিতেই থাকে, আমাদের মুখচেনা। সৈকত অতি কষ্টে ব্রেক করে গাড়িটা থামাল। মনে হল গাড়ির সঙ্গে লোকটার ধাক্কা লাগেনি, শুধু বাইরের আয়নায় ধাক্কা লেগে লোকটা মাটিতে পড়ে গেছে।
‘ইতিমধ্যে আমাদের গাড়ির চারদিকে বেশ ভিড় জমে গেছে। সবই ওই বস্তির লোক। এরা সৈকতকে খুব ভাল করে চেনে। খুব ভালও বাসে। সৈকত বিপদে আপদে অনেকবার ওদের পাশে দাঁড়িয়েছে। ওরা বলল, দাদা আপনি চলে যান। আমরা একে দেখছি। আমরা জানি আপনার কোনও দোষ নেই। এই লালু রোজ রাত্তিরে মদ খেয়ে ঝামেলা করে। আগেও একবার গাড়ি, আর একবার বাইকের সঙ্গে ধাক্কা লাগিয়েছে।
সৈকত অবশ্য শোনার লোক নয়। সে গাড়ি থেকে নেমে লালুকে ধরে ধরে একটা ওষুধের দোকানে নিয়ে গেল। এটিএস নেয়াল। পেন কিলার কিনে দিয়ে বলল, যদি এতে ব্যথা না কমে তা হলে যেন সে সৈকতকে খবর দেয়। আমার মনে হচ্ছিল লোকটার কিছুই হয়নি। তার পা যেটুকু কাঁপছে সেটা অ্যাক্সিডেন্টের জন্যে নয়, নেশা করেছে বলে। কিন্তু সৈকতকে সেটা বিশ্বাস করানো অসম্ভব।
‘রাত্তিরে সৈকত কিছুতেই ঘুমোতে পারে না। মুখে একটাই কথা। আর আমি কোনও দিন গাড়ি চালাব না। আমি একটা লোককে ধাক্কা দিয়ে দিলাম! লোকটা তো মরে যেতে পারত! আমার গাড়ি চালানোর কোনও অধিকার নেই! কিছুতেই ওকে বোঝাতে পারি না দোষটা ওর নয়, সেই লোকটার।
‘পরদিন সকালে আমাদের ফ্ল্যাটে একটা চোদ্দো-পনেরো বছরের ছেলে এসে হাজির। ছেলেটার মুখটা খুব দুঃখী। বলল, সে লালুর ছেলে, নাম মোতি। বলল, তার বাবা সারারাত যন্ত্রণায় ঘুমোতে পারেনি। আজ ডাক্তার দেখাতে যাবে। কিন্তু ডাক্তার দেখানোর খরচ তাদের বাড়িতে নেই। তাছাড়া কাজে যেতে পারবে না বলে বাবা আজ মজুরিও পাবে না। জানতে পারলাম লালু রঙের মিস্ত্রি, বাড়ি রং করে।
‘ছেলেটার কথা শুনে সৈকত সঙ্গে সঙ্গে ওয়ালেট থেকে একটা দু-হাজার টাকার নোট বার করে তার হাতে দিয়ে দিল। আমার মনে হচ্ছিল ছেলেটা সত্যি বলছে কিনা একবার যাচাই করে দেখা দরকার। সৈকতকে বললামও সে কথা। কিন্তু সৈকত আমাকে পাত্তাই দিল না। এর পর প্রায় এক মাস নিয়মিত ছেলেটা আসত, তার বাবার চিকিৎসার জন্যে টাকা নিত। তার বাবার অবস্থার নাকি কিছুতেই উন্নতি হচ্ছে না। সব মিলিয়ে, আমার ধারণা, তিরিশ-চল্লিশ হাজার টাকা সৈকত ছেলেটাকে দিয়েছিল। বলতে ভুলে গেছি, এর মধ্যে সৈকত একদিনও গাড়ি চালায়নি।
‘তারপর একদিন সন্ধেবেলা মাধব সিং আমাদের ফ্ল্যাটে এসে হাজির। মাধব ওই বস্তির মাতব্বর, বস্তির সকলে তার কথা খুব মেনে চলে। মাধব আবার সৈকতকে খুব ভক্তি-শ্রদ্ধা করত। মাধব এসে অনেক কথা বলে গেল। মোদ্দা কথাটা হল, সে গতকালই জানতে পেরেছে সৈকতকে ঠকিয়ে লালু দিনের পর দিন টাকা নিয়ে যাচ্ছে। লালুর আসলে কিছুই হয়নি। মাধব যদি আগে জানতে পারত সৈকতকে সাবধান করে দিত। সৈকত বলল, টাকাটা তো সে মোতির হাতে দিয়েছে। মোতিও কি এর মধ্যে আছে? মাধব বলল, না। ছেলেটার কোনও দোষ নেই। ছেলেটা তার বাবাকে প্রচণ্ড ভয় পায়। বাবার কথা মতো কাজ না করলে তার বাবা বোধহয় মারতে মারতে তাকে মেরেই ফেলত।
‘মাধব চলে যাবার পর সৈকত অনেকক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল। তারপর একবার বিড়বিড় করে বলল, লোকটাকে এর জন্যে শাস্তি পেতে হবে। এর পরে ঠিক কী হয়েছিল আমি জানি না, তবে খানিকটা আন্দাজ করতে পারি। মোতি আর আমাদের বাড়ি আসেনি, হয়তো মাধব তাকে বারণ করে দিয়েছিল। কিন্তু মাধব চলে যাবার সপ্তাহ দুয়েক পরে রাত্তিরে আমরা একটা নেমন্তন্ন খেয়ে বাড়ি ফিরছি, সৈকত আবার গাড়ি চালাচ্ছে, দেখি গেটের মুখে সেই লালু বলে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। একেবারে হতশ্রী অবস্থা। দেখে মনে হয় কয়েক দিন পেটে কিছু পড়েনি। সৈকতকে দেখে লোকটা সৈকতের পা-দুটো জড়িয়ে ধরল। বলল, তার মস্ত ভুল হয়ে গেছে। সে সৈকতের কাছ থেকে যত টাকা নিয়েছে আস্তে আস্তে সব শোধ করে দেবে। সৈকত যেন তাকে ভাতে না মারে।
‘লালুর কথা শুনে মনে হল, যে কনট্রাকটরের কাছে লালু কাজ করত সে সৈকতের চেনা। আন্দাজ করলাম, সৈকতের কথায় লালুর কাজটা চলে গেছে। শুধু ওই কাজটা নয়, সৈকত এমন ব্যবস্থা করেছে যাতে লালুর অন্য কোথাও কাজ পাওয়াও প্রায় অসম্ভব। কলকাতার কনট্রাকটরদের অনেককেই সৈকত চেনে। সৈকত লোকটাকে তার পা ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াতে বলল। আমি ভাবলাম সৈকত হয়তো এবার লোকটাকে ক্ষমা করে দেবে। কিন্তু এর পরে যেটা ঘটল তার জন্যে আমি প্রস্তুত ছিলাম না। লোকটা উঠে দাঁড়াতেই সৈকত তার গালে একটা বিরাট চড় কষাল। সৈকতের হাইট ছ-ফুটের ওপর। খেলাধুলো করা পেটানো স্বাস্থ্য। চড়টা খেয়ে রোগা লোকটা তিন পাক ঘুরে বাড়ির মেন গেটের ওপর গিয়ে পড়ল। তার কষ বেয়ে রক্ত পড়ছে। গেটের রেলিং-এ লেগে কপালটাও কেটে গেছে। আমার মনে হল, সৈকত লোকটাকে একটু বেশি শাস্তি দিয়ে ফেলছে। কিন্তু সৈকত থামল না। আমি অবাক হয়ে দেখলাম সে লোকটাকে মেরেই চলেছে, মেরেই চলেছে। একটা সময় আমার মনে হল মার খেতে খেতে লোকটা এবার মরেই যাবে। আমি সৈকত আর লোকটার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। সৈকতকে কাকুতি-মিনতি করে বললাম লোকটাকে ছেড়ে দিতে। আমি অনেকবার বলার পর সৈকত লোকটাকে ছেড়ে দিল। ছেড়ে দেবার আগে কর্কশভাবে লোকটাকে বলল, আবার যদি তোকে এখানে দেখি তা হলে আরও মারব। কথাটা যেন মনে থাকে। এই বলে সৈকত বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। একবার ফিরেও তাকাল না। এর কিছুদিন পরে শুনলাম লালু পরিবার নিয়ে কলকাতা ছেড়ে চলে গেছে। তাই বলছিলাম, সৈকত যেমন এক কথায় লোককে বিশ্বাস করে ফেলত, তেমনি তার চোখে কেউ অন্যায় করলে তাকে নিষ্ঠুরভাবে শাস্তি দিত। সৈকতের মনটা এত বড় ছিল, কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হল ক্ষমা জিনিসটা ওর মধ্যে একেবারে ছিল না।’
অনিতা থামল। ঘরে একটা স্তব্ধতা নেমে এসেছে।
‘তাহলে তো বলতে হবে সৈকতবাবুর শত্রুর অভাব ছিল না। মানুষ উপকার পেলে ভুলে যায়, কিন্তু কেউ অপকার করলে সহজে ভুলতে চায় না।’ আদিত্য স্তব্ধতা ভেঙে বলল।
স্বাগতম বাড়িটা থেকে বেরোবার সময় আদিত্য দেখল সিকিউরিটি ছেলেটা তখনও গেটের সামনে বসে আছে।
‘শোনো ভাই, তোমাকে দু’একটা জিনিস জিজ্ঞেস করার ছিল। আমি সৈকত চৌধুরির মার্ডার কেসটা তদন্ত করতে এসেছি।’ আদিত্য ভারিক্কি চালে বলল।
কথাটা সত্যি। কিন্তু সে যে পুলিশের লোক নয়, একজন বেসরকারি গোয়েন্দা, সেটা সিকিউরিটি ছেলেটিকে ইচ্ছে করেই আদিত্য বলল না। ফলে ছেলেটা ধরে নিয়েছে আদিত্য পুলিশের লোক। এবং সঙ্গে সঙ্গে সে উঠে দাঁড়িয়েছে। তার আগের তাচ্ছিল্য ভাব আর নেই।
‘বলুন স্যার।’
‘যেদিন সৈকত চৌধুরি খুন হন, তুমি এই গেটে ডিউটিতে ছিলে, তাই তো?’
‘হ্যাঁ স্যার।’
‘তুমি পুলিশকে বলেছ সেদিন বিকেলে তুমি বাইরের কাউকে এই বাড়িতে ঢুকতে দ্যাখোনি, ঠিক তো?’
‘হ্যাঁ স্যার। আমি সারা বিকেল এই গেটেই ছিলাম। বাইরের কাউকে ঢুকতে বা বেরোতে দেখিনি।’
‘বাড়ির কেউ কি বাইরে গিয়েছিলেন, বা বাইরে থেকে বাড়ি ফিরেছিলেন?’
‘আমার পরিষ্কার মনে আছে বিকেলবেলা, মানে এই সাড়ে-তিনটে চারটে হবে, সৈকত চৌধুরি সাহেব বাড়ি ফিরেছিলেন। গাড়ি পার্ক করে লিফট দিয়ে উঠে গেলেন। তার খানিক আগে অনিতা ম্যাডাম বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। অনিতা ম্যাডাম যখন বেরিয়েছিলেন তখনও চৌধুরি সাহেব বাড়ি ফেরেননি।’
‘চৌধুরি সাহেব কখন বেরিয়েছিলেন?’
‘আমার যতদূর মনে পড়ছে সকাল ন’টা-সাড়ে ন’টা নাগাদ সৈকত চৌধুরি সাহেব গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন।’
‘অনিতা ম্যাডাম কি পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেলেন?’
‘উনি বাড়ির সামনে থেকে ট্যাক্সিতে উঠেছিলেন। আমিই ট্যাক্সিটা ধরে দিয়েছিলাম। ফেরার সময়ও উনি ট্যাক্সি করে বাড়ির সামনে নেমেছিলেন।’
‘অনিতা ম্যাডাম কখন ফিরেছিলেন?’
‘আমার যতদূর মনে পড়ছে তখন অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল।’
‘আর কেউ বাড়ির বাইরে যাননি?’
‘হ্যাঁ, দুপুরবেলা দীপক শাসমল সাহেব পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। ফিরেছিলেন অনেক রাত্তিরে। আর হ্যাঁ, তার আগে মলয়া বিশ্বাসের মেয়ে টুম্পা ড্রাইভারের সঙ্গে টিউশানি থেকে ফিরেছিল।’
‘আর কেউ?’
ছেলেটা কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, ‘প্রদীপ চক্রবর্তী সাহেব বিকেলের দিকে ফিরেছিলেন। উনি কখন বেরিয়েছিলেন বলতে পারব না। বোধহয় আমি আটটায় ডিউটিতে আসার আগেই বেরিয়েছিলেন। আমি অন্তত ওকে বেরোতে দেখিনি।’
‘ঠিক আছে। আবার দরকার হলে তোমাকে প্রশ্ন করব।’
(৩)
বেশ সকাল সকাল আদিত্যরা বেরিয়ে পড়েছিল। পিকনিকের জায়গায় গিয়ে ব্রেকফাস্ট খাবার কথা। আজ কেয়ার চেনা ড্রাইভার একটা অন্য গাড়ি নিয়ে এসেছে। নতুন একটা সুইফট ডিজায়ার। ড্রাইভার জানাল তার মালিক পুরোনো গাড়িগুলো বদলে পাঁচটা নতুন গাড়ি কিনেছে। এটা তার মধ্যে একটা। একে রবিবার, তার ওপর সাতটাও বাজেনি। রাস্তা একেবারে ফাঁকা। শ্যামবাজার পেরিয়ে বি টি রোড ধরতে মিনিট পাঁচেকও লাগল না।
ফুটপাথবাসীরা কেউ কেউ ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। কেউ আবার মাটিতে পাতা বিছানায় বসে আড়মোড়া ভাঙছে। মানে ঘুম থেকে ওঠার তোড়জোড় করছে। রাস্তার কলে মুখ ধোয়ার লম্বা লাইন। পাশে চায়েরদোকানে ভিড়, শুধু ফুটপাথের বাসিন্দারাই নয়, ট্যাক্সিচালক, রাজমিস্তিরি, জোগাড়ে, ঠিকে শ্রমিক, রিকশাওয়ালা দিনের কাজ শুরু করার আগে চায়ের সঙ্গে পাঁউরুটি-ঘুগনি খেয়ে নিচ্ছে। ভোরবেলার আধো-ঘুমন্ত বি টি রোড, আদিত্য দেখতে দেখতে যচ্ছিল।
সিঁথির মোড়ের কাছে ট্র্যাফিক সিগনালে গাড়িটা আটকে গেছে। আদিত্য দেখল রাস্তার ধারে একটা দোকানে কচুরি ভাজা হচ্ছে, সঙ্গে জিলিপি। দেখেই লোভ লাগে। আদিত্যর বেশ খিদে পেয়ে গেছে। কেয়াকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, ‘ওরা ব্রেকফাস্টে কচুরি-টচুরি দেবে নাকি গো?’, দ্যাখে কেয়া জানলার কাঁচে মাথা রেখে কাত হয়ে নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছে। আসলে কেয়া একদম ভোরে উঠতে পারে না। কেয়ার ঘুমন্ত মুখটা দেখে আদিত্যর হঠাৎ খুব মায়া হল।
বেলঘরিয়া, আগরপাড়া, খড়দা, টিটাগড়। রবিবার সকালের ফাঁকা রাস্তা, গাড়ি হু হু করে চলছে। এক সময় এসব অঞ্চলে অনেক কলকারখানা ছিল। এখন তার বেশিরভাগই বন্ধ। কেয়া নাগাড়ে ঘুমিয়ে যাচ্ছে। ব্যারাকপুরের মোড়ে পৌঁছে গাড়ি বাঁদিকে বাঁক নিল। গঙ্গা ওদিকেই। ড্রাইভার জানে কোথায় যেতে হবে। যেখানে পিকনিক হবার কথা সেটা বেশ পপুলার একটা রিসর্ট। তাই অভিজ্ঞ ড্রাইভাররা এটার সন্ধান জানে। মনে হচ্ছে গন্তব্যস্থল প্রায় এসে গেছে। আদিত্য কেয়াকে জাগিয়ে দিল। ঘড়িতে নটা দশ।
একটা সবুজ লন। লনের এক প্রান্তে দুটো বড় ঘর। সেখানে খাওয়া এবং বিশ্রামের ব্যবস্থা। অন্য প্রান্তে বিস্তীর্ণ গঙ্গা। নয়নাভিরাম। যিনি পিকনিকের ব্যবস্থা করেছেন তাঁর ব্যবস্থাপনার তারিফ করতেই হবে।
আদিত্যরা যখন পৌঁছল তখন অনেকেই পৌঁছে গেছে। লনের ওপর ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গল্প করছে। নানা বয়সের বাচ্চারাও এসেছে। ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টনের তোড়জোড় চলছে। টানা ঘুম দিয়ে কেয়ার এনার্জি খুব বেড়ে গেছে। সে বিপুল উৎসাহে তার সহকর্মীদের সঙ্গে আদিত্যকে আলাপ করিয়ে দিচ্ছে। তাদের স্বামীদের সঙ্গেও। অত মহিলার নাম মনে রাখা আদিত্যর পক্ষে অসম্ভব। সে শুধু খুব ব্যগ্র হয়ে অনিতার প্রতিবেশিনী শাশ্বতী শাসমলকে খুঁজছিল। কেয়া বলেছিল, শাশ্বতী অন্যতম অরগানাইজার। তাই নিশ্চয়ই কোথাও ব্যস্ত রয়েছে।
শাশ্বতীকে না পেয়ে আদিত্য এখন সিগারেট ধরাবার সুযোগ খুঁজছে। আজকাল সিগারেট নিয়ে মানুষের এত আপত্তি, একটু আড়ালে গিয়ে সিগারেট খাওয়াই ভাল। লনের এক কোণে একটা বটগাছের আড়াল রয়েছে। আদিত্য গাছের তলায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাল। গঙ্গাটাকে বেশ দেখাচ্ছে। একটু দূরে ফেরিঘাট থেকে শ্রীরামপুরের ফেরি ছেড়ে গেল। আবার একটা ফেরি এসে দাঁড়িয়েছে। এটা বোধহয় শেওড়াফুলি যাবে। অন্তত ফেরির গায়ে তাই লেখা আছে।
‘আদিত্যদা? এখানে একা একা দাঁড়িয়ে রয়েছেন? ব্রেকফাস্ট দেওয়া হয়েছে। ভেতরে চলুন। কেয়াদি আমাকে বলল, আমার কর্তাকে ধরে আনতে পারবি? মনে হচ্ছে ওই গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। আমি অদ্রিজা। সবাই আমাকে হিস্ট্রির অদ্রিজা বলে।’
আদিত্য দেখল পাঁচ ফুট লম্বা সুশ্রী, হাসিখুশি একটি বছর তিরিশের যুবতী। সে সিগারেট হাতে ধরা পড়ে যাওয়া ইস্কুলের ছাত্রের মত তাড়াতাড়ি আধ-খাওয়া সিগারেটটা পায়ে মাড়িয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। আপনার কথা কেয়ার কাছে অনেক শুনেছি।’
‘শুনবেনই তো। আমি রেগুলার কেয়াদিকে আপনার কথা জিজ্ঞেস করি। জানেন, আমি আপনার বিরাট ফ্যান।’ অদ্রিজা আদিত্যর পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল।
আদিত্য লজ্জা পেয়ে চুপ করে রইল।
‘আপনার সব কটা বড় কেসের কাটিং, যেগুলো খবর কাগজে বেরিয়েছে, আমি খাতায় পেস্ট করে রেখেছি।’ অদ্রিজা বলেই চলেছে।
আদিত্য বুঝতে পারছে না কী বলবে, তাই চুপ করেই রইল। ভাগ্যক্রমে তারা ইতিমধ্যে খাবার ঘরে পৌঁছে গেছে, তাই তাকে আর উত্তর দিতে হল না।
‘কেয়াদি, ধরে এনেছি তোমার কর্তাকে।’ অদ্রিজা গলা তুলে বলল।
ঘরে কয়েকটা বড় ডাইনিং টেবিল ঘিরে অনেকে বসে খাচ্ছে। কেয়ার পাশে একটা জায়গা ফাঁকা। নিশ্চয় কেয়া আদিত্যর জন্য জায়গা রেখেছে। আদিত্য সেখানে গিয়ে বসল। কেটারিং-এর লোক ব্রেকফাস্ট পরিবেশন করতে শুরু করে দিয়েছে। হাতে গরম রাধাবল্লভী, আলুর দম। অমৃত। শেষে সন্দেশ। সন্দেশটা উত্তর কলকাতার একটি বিখ্যাত দোকানের। অতি উত্তম। তবু আদিত্যর মনে হল রাধাবল্লভী-আলুর দমের পরে গরম বোঁদে হলেই ঠিক হত।
খাবার পরে চা এসে গেছে।
‘আমার নাম দীপক শাসমল।’ আদিত্যর ডানপাশের ভদ্রলোক হাত তুলে নমস্কার করলেন। ‘ইনি আমার স্ত্রী শাশ্বতী।’
‘তুমি তো ওদের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলে?’ কেয়া বাঁ দিক থেকে বলল। ‘তাই ওদের পাশে বসলাম।’
‘আপনারা অনিতা চৌধুরির প্রতিবেশী?’ আদিত্য আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল। ‘আপনাদের সঙ্গে অনেক কথা ছিল।’
‘আমরাই অনিতার পাশের ফ্ল্যাটে থাকি। আমিই অনিতাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছিলাম।’ শাশ্বতী শাসমল বলল। ‘আমরাও আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই।’
‘একটু অপেক্ষা করা যাক। এই জায়গাটা একটু খালি হোক। আমরা এখানে বসেই কথা বলব।’ আদিত্য সাবধানি গলায় বলল।
চা খাওয়া সেরে আস্তে আস্তে সকলেই ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। বাইরে নানারকম খেলাধুলোর ব্যবস্থা হয়েছে। ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন ছাড়াও মেমরি গেম, অন্তাক্ষরী। তাছাড়া নির্ভেজাল আড্ডা তো আছেই। একটু পরেই ঘরটা খালি হয়ে গেল। আদিত্য-কেয়া, শাশ্বতী-দীপক ওরা চারজন চারটে চেয়ারে ছড়িয়ে ছড়িয়ে বসেছে।
‘আমি খুব বেশি প্রশ্ন করব না। আমি জানি আপনি আজ ব্যস্ত, তবু এই জায়গাটা প্রশ্ন করার জন্য বেছে নিলাম কারণ আমি চাইছিলাম প্রশ্ন করার সময় অনিতা যেন উপস্থিত না থাকে। সেটা আপনাদের ফ্ল্যাটে হয়তো সম্ভব হত না।’
‘না, না। আমি মোটেই ব্যস্ত নই। কেটারাররাই তো সব কাজ করছে। আপনি সময় নিয়ে প্রশ্ন করুন।’
‘আমার প্রথম প্রশ্ন, ঘটনার সময়, অর্থাৎ সৈকত চৌধুরি খুন হওয়ার সময়, আপনারা কোথায় ছিলেন?’
‘আমি বাড়ির কাছেই আমাদের হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্টের বাড়ি গিয়েছিলাম। কলেজ নিয়ে কয়েকটা আলোচনা ছিল। আমি কলকাতার একটা কলেজে বটানি পড়াই। আমাদের ডিপার্টমেন্টের দুজন মহিলা ফ্যাকাল্টি একসঙ্গে মেটারনিটি লিভ নিয়েছেন। ফলে পড়ানো নিয়ে একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। সেসব নিয়ে কথা বলতে গিয়েছিলাম। ফিরেছিলাম রাত্তির আটটা নাগাদ। ফিরে দেখি এই কাণ্ড।’ দীপক শাসমল থামলেন।
‘আর আপনি?’ আদিত্য শাশ্বতীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘আমি সারা দুপুর পরীক্ষার খাতা দেখছিলাম। কখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নেমে গেছে টের পাইনি। অনিতার ধাক্কাধাক্কিতে দরজা খুলে সব জানতে পারলাম।’
‘আপনি কোনও শব্দ শুনেছিলেন? টায়ার ফাটার মতো কোনও শব্দ?’
‘পুলিশও আমাকে এই প্রশ্নটা করেছিল। না আমি কোনও শব্দ শুনিনি। হয়তো খুব মন দিয়ে খাতা দেখছিলাম বলে শুনতে পাইনি।’
‘এবার একটা ডেলিকেট প্রশ্ন করব। শোনা যাচ্ছে অনিতা চৌধুরির বাড়িতে, যখন তার স্বামী থাকত না, তখন তার ভাই ছাড়াও অন্য একটি ছেলে তার সঙ্গে দেখা করতে আসত। আপনি কি এ-বিষয়ে কিছু জানেন?’
শাশ্বতী শাসমল কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে রইল। গভীরভাবে কিছু একটা ভাবছে। শেষে মুখ তুলে বলল, ‘এটা অনিতার ব্যক্তিগত ব্যাপার, সাধারণ অবস্থা হলে আমি কখনোই এটা নিয়ে কথা বলতাম না। কিন্তু এখন তো একটা অস্বাভাবিক অবস্থা। তাই আমি যেটুকু জানি সেটুকু বলতেই হবে।’
‘আর একটু চা খাবেন আপনারা?’ কেটারারের ছেলেটি এসে বলল। হয়তো ব্যবস্থাপক বলে শাশ্বতীকে বাড়তি খাতির করতে চাইছে।
‘আমি একটু চা খেতে পারি।’ আদিত্য আগ বাড়িয়ে বলল।
‘আমিও।’ এবার দীপক শাসমলের গলা।
‘আপনারা খাবেন না ম্যাডাম?’
‘খাই একটু? কী বলিস?’ কেয়া শাশ্বতীর দিকে তাকিয়ে বলল।
খানিক পরে, চা-পর্ব শেষ হলে, শাশ্বতী শাসমল বলতে শুরু করল।
‘কীভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না। অনিতা আমাকে অনেক কথাই বলত। ওর কথা থেকে বুঝতে পারতাম সৈকতের সঙ্গে অনিতার সম্পর্কটা কিছুদিন ভাল যাচ্ছিল না। আমি অনিতার ভার্সানটাই বলতে পারি, সৈকতের সঙ্গে এসব নিয়ে কখনও কথা হয়নি। অনিতা বলত, সৈকত যেন মানসিকভাবে তার থেকে সরে যাচ্ছে। যেন ওর কোনও একটা গভীর সমস্যা আছে যেটা ও অনিতাকে বলছে না। বারবার জিজ্ঞেস করার পরেও বলছে না। বলতে পারছে না। অথচ সারাদিন সৈকত ভীষণ বিমর্ষ হয়ে থাকে। কথা বলে না। এইভাবে প্রায় আট-নমাস, নাকি প্রায় এক বছর চলতে থাকার পর, অনিতার সঙ্গে তার একজন পুরোনো বন্ধুর আবার দেখা হয়। ছেলেটি অনিতার কলেজের বন্ধু, কিন্তু ওদের মধ্যে অন্য কোনও রকম সম্পর্ক কখনও ছিল কিনা আমি বলতে পারব না। অনিতা এসব নিয়ে আমাকে সরাসরি কিছু বলেনি। তবে ওর কথাবার্তায় বুঝতে পারতাম যত সৈকত ওর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, ওই ছেলেটির ওপর অনিতার নির্ভরতা তত বাড়ছে।’
‘অনিতা কি ছেলেটির নাম বলেছিল? কী করে? কোথায় থাকে? সেসব কিছু বলেছিল?’ আদিত্য খানিকটা উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘ছেলেটি বাঙালি নয়, গুজরাটি। তবে ভবানীপুরের গুজরাটি, বাঙালিদের মতই বাঙলা বলে। সেদিক থেকে অনেকটা অনিতার মতো। ছেলেটির নাম সমীর, সম্ভবত সমীর প্যাটেল। এজরা স্ট্রিটে ওদের ইলেক্টিÉকাল গুডস-এর দোকান। দোকানটা ওর বাবার। সেখানে ও সন্ধেবেলা বসে। দুপুরে দোকানে বসে ওর বাবা এবং দাদা। তাই দুপুরগুলো ওর ফ্রি। ওই ফ্রি টাইমেই ও অনিতার সঙ্গে দেখা করতে আসত। এসব কথা অনিতা আমাকে বলেছে।’
‘এই সমীর বলে ছেলেটির কথা কি সৈকত চৌধুরি জানত?’
‘সেটাই বলতে যাচ্ছিলাম। অনিতা নিজের মতো করে সমীরের কথা সৈকতকে বলেছিল। হয়তো পুরোটা বলেনি। কিন্তু আমাদের কমপ্লেক্সে একজন অত্যন্ত অবনক্সাস মহিলা থাকেন। নাম মলয়া বিশ্বাস। হয়তো এর কথা অনিতা আপনাকে বলেছে। এই মহিলা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মোবাইলে সমীরের ছবি তুলে সৈকতের কাছে এই বলে পাঠান যে এই ব্যক্তি আপনার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে প্রত্যেক দুপুরবেলা আপনার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে আসে। আপনি আপনার স্ত্রীকে সামলান। এটা ভদ্রলোকদের থাকার জায়গা। এখানে এইসব বেলেল্লাপনা চলবে না। এর ফলে, বুঝতেই পারছেন, অনিতার সঙ্গে সৈকতের সম্পর্কটা আরও ধাক্কা খায়। আমি যতদূর জানি, সৈকত খুন হবার কিছুদিন আগে থেকে অনিতার সঙ্গে সৈকতের কথাবার্তা বন্ধ ছিল।’
‘আর একটা প্রশ্ন। সৈকত চৌধুরি মানুষটি সম্বন্ধে আপনাদের কী ধারণা? মানে, আপনাদের যেটা মনে হয় সেটাই বলুন।’
‘আমি সৈকতকে খুব বেশি চিনতাম বলব না।’ শাশ্বতী একটু চিন্তা করে বলল। ‘বিশেষ করে এই কারণে যে অনিতা আমার ভীষণ ক্লোজ ছিল, তাই সৈকতের সঙ্গে অনিতার দূরত্ব যত বাড়ছিল, আমার সঙ্গেও সৈকতের কথাবার্তা কমছিল। করিডোরে কিংবা লিফটে দেখা হলে হয়তো একটু হাসতাম। কিন্তু ব্যস ওই পর্যন্ত। তাই সৈকত চৌধুরি লোকটা সম্বন্ধে আমি তেমন কিছু বলতে পারব না।’
‘আমি কিন্তু সৈকতকে আর একটু বেশি চিনতাম। রেগুলারলি নয়, তবে মাঝে মাঝে সৈকত আমাকে ফোন করে দাবা খেলতে ডাকত। একজন ক্রিকেটারের যে দাবায় এত উৎসাহ থাকতে পারে ওকে না দেখলে বিশ্বাস হত না।’ দীপক শাসমল বলল।
‘আপনারও কি দাবায় খুব উৎসাহ?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘আমি দাবায় কলকাতা ইউনিভার্সিটি রেপ্রেজেন্ট করেছি। তারপর স্টেট লেভেলেও খেলেছি কিছুদিন। সেখানে অবশ্য খুব বেশি দূর এগোতে পারিনি।’
‘তা দাবা খেলতে গিয়ে সৈকত চৌধুরি সম্বন্ধে কী জানতে পারলেন?’
‘এক কথায় যদি বলতে হয় তাহলে বলব সৈকত খুব সহজ-সরল মানুষ ছিল। অত সরলভাবে চিন্তা করলে ভাল দাবাড়ু হওয়া যায় না। দাবা খেলতে গেলে একটু কূটবুদ্ধির প্রয়োজন হয়। সৈকত খুব পেঁচিয়ে ভাবতে পারত না। ফলে দাবাতে ওর যতটা উৎসাহ ছিল ততটা ন্যাক ছিল না।’
‘ইদানীং কি সৈকতকে কিছুটা ডিস্টার্বড দেখাত?’
‘সেটা ঠিক বলতে পারব না। কারণ বিগত মাস ছয়েক সৈকত আমাকে দাবা খেলতে ডাকেনি।’
‘তোরা চারজন এখানে বসে কী করছিস? বাইরে চল, বাইরে চল। সকলে বাইরে রয়েছে।’ একজন প্রবল চেহারার দিদিমণি ঘরে ঢুকে বললেন। একটু আগে তার সঙ্গে আদিত্যর আলাপ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আদিত্য তার নামটা ভুলে গেছে।
‘আমার প্রশ্ন করা হয়ে গেছে।’ সে নিচু গলায় বলল।
সন্ধেবেলা যখন আদিত্য আর কেয়া পিকনিক সেরে অমিতাভদের বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়েছে, কেয়া বলল, ‘যাই বল, এই অনিতা মেয়েটা কিন্তু বেশ গোলমেলে। সেদিন আমাদের বাড়িতে এসে এমন একটা ধারণা দিল যে ওর বাপের বাড়ির লোকেরাই ওর স্বামীকে খুন করেছে। অথচ শাশ্বতী তো সম্পূর্ণ অন্য কথা বলছে। ওর কথা শুনে এখন মনে হচ্ছে সৈকতের খুনের পেছনে অনিতার ওই বন্ধু না প্রেমিক সমীর বলে ছেলেটার হাত আছে। এই সমীরের কথা অনিতা সেদিন স্রেফ চেপে গিয়েছিল। স্বামীর সঙ্গেও যে ওর গোলমাল চলছে সেটাও বলেনি। কে বলতে পারে অনিতাই ওর স্বামীকে খুন করায়নি? ওর কিন্তু একটা ভিজে বেড়াল ভিজে বেড়াল ভাব আছে। অভিনয়টাও ভাল করে।’
গাড়ি শেয়ালদা পেরিয়ে সি আই টি রোডে ঢুকেছে। রবিবারের সন্ধে, তাই দোকানপাট বন্ধ, রাস্তাঘাট ফাঁকা। আদিত্য সেদিকে তাকিয়ে উদাস গলায় বলল, ‘মেয়েদের চরিত্র, কে কবে বুঝতে পেরেছে?’
‘আমরা অনেক ভেবে দেখলাম। পাকাপাকিভাবে অ্যামেরিকায় থাকা আমাদের পোষাবে না। আমারও না, রত্নারও না।’ অমিতাভ জোর দিয়ে বলল।
‘আমি তো এখানে কলেজ নিয়ে খুব সুখে আছি। ওখানে যদি ওরা আমাকে একটা চাকরিও দেয়, এই বয়েসে নতুন জায়গায় গিয়ে আদৌ মানিয়ে নিতে পারব কিনা জানি না।’ এবার রত্নার গলা।
আদিত্যর মনে হল বিদেশে পাকাপাকিভাবে চলে যাবার ব্যাপারে অমিতাভর সেই উৎসাহটা আর নেই। সে বলল, ‘আমার পক্ষে কোনও মত দেওয়া খুব কঠিন। আমি তো কখনও বিদেশেই যাইনি। সেখানকার হালচাল কিছুই জানি না। তবে শুনেছি বিদেশে, বিশেষ করে আমেরিকায়, নিয়মিত রিসার্চ আউটপুট দেখাতে হয়। তোকে তো ছোটবেলা থেকে চিনি। তোর যা টেম্পারামেন্ট তাতে অত চাপের মধ্যে তুই কাজ করতে পারবি বলে মনে হয় না।’
‘তুই আমার মনের কথাটা বলেছিস। এখানে আমি খুব রিল্যাক্সড হয়ে রিসার্চ করি। একটা আইডিয়া নিয়ে অনেকদিন ভাবতে পারি। কোনও চাপ নেই। ওখানে গেলে হয়তো আউটপুট দেখানোর জন্যে হাফ-বেকড আইডিয়াগুলোকেই লিখে ফেলতে হবে।’
‘আমি বাবা অত শত বুঝি না। আমার তো এই শ্যামবাজারের মোড়, হাতিবাগান, কলেজ স্ট্রিট, কিছুটা গড়িয়াহাট, নিউ মার্কেট এসব জায়গায় ঘুরতে বেশ লাগে। খুব বেশি বেড়াতে অবশ্য যাওয়া হয়নি, তবে যেটুকু গেছি কদিনের মধ্যেই কলকাতার জন্যে মনটা হাঁপিয়ে উঠেছে। বিদেশে চলে গেলে তোমাদের কলকাতার জন্যে মন কেমন করবে না?’ কেয়া খুব সরলভাবে রত্নাকে বলল। এত সরলভাবে বলল যে রত্নাও খানিকটা আবেগতাড়িত।
‘করবে না আবার? খুব মন কেমন করবে। আমরা তাই ঠিক করেছি দুজনেই চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে এক বছরের জন্যে ঘুরে আসব। টুবলুর স্কুল থেকেও এক বছর ছুটি পাওয়া যাবে। এক বছরের জন্যে ঘুরে এলে ওদের অফারটাকেও সম্মান দেওয়া হবে আবার পাকাপাকিভাবে কলকাতাও ছাড়তে হবে না।’ রত্না বলল।
‘হ্যাঁ। আমরা এটাই ফাইনালি ঠিক করেছি।’ অমিতাভ জোর গলায় রত্নাকে সমর্থন করল।
‘বাঁচালি। তোরা বিদেশ চলে গেলে আমি কী করতাম জানি না। আমার দিকের ফ্যামেলি বল বন্ধু বল তোরাই আছিস।’ আদিত্য নিশ্চিন্ত হবার ভঙ্গিতে বলল।
‘যাগগে, ওসব কথা থাক। তোদের কথা বল। কবে হানিমুনে যাচ্ছিস?’ রত্না জিজ্ঞেস করল।
‘হানিমুন? হ্যাঁ ওটার কথা কেয়া রোজ বলছে। আমার হানিমুনে যাবার টাকা কোথায়?’
‘তোমাকে টাকার কথা বলেছি? টাকা আমি দেব। তুমি শুধু যাবার ব্যবস্থা করবে। তাই নিয়ে শুধু গড়িমসি করে যাচ্ছ।’ কেয়া ঝাঁঝিয়ে উঠল।
‘বউ-এর টাকায় হানিমুনে যেতে পৌরুষে লাগে না? তোরাই বল।’ আদিত্যর গলাটা করুণ শোনাল।
‘ও আচ্ছা, ভাল কথা।’ কী একটা মনে পড়ে যেতে আদিত্য রত্নার দিকে তাকিয়ে বলল। ‘তুই তো ইতিহাস পড়াস। সিটি কলেজে গত দশবছর ধরে ইতিহাস পড়াচ্ছে এমন কাউকে চিনিস?’
‘চিনি। আমাদের একজন ক্লাসমেট সিটিতে পড়ায়। অভিজিৎ ঘোষ। আমার থেকে অমিতাভ ওকে আরও ভাল চেনে। কেন বলতো?’
‘একটি মেয়ের সম্বন্ধে জানতে হবে। নাম অনিতা শর্মা। অবাঙালি। বছর ছয়েক আগে সিটি কলেজে ইতিহাস পড়ত। সুন্দরী। থার্ড ইয়ারে পড়তে পড়তেই বিয়ে হয়ে যায়।’
‘কী জানতে হবে?’
‘যা-কিছু জানা যায়।’