সৈকত রহস্য – ৩
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
(১)
বিশ্বজিৎ মজুমদার বলেছিল সৈকত চৌধুরির আপিস, গুপ্ত অ্যান্ড চৌধুরি সিভিল কনস্ট্রাকশান্স, সল্টলেক সেক্টর থ্রি-র আই বি ব্লকে। আদিত্য জিপিএস ম্যাপে দেখে নিয়েছিল জায়গাটা কলম্বিয়া এশিয়া হাসপাতালের পেছন দিকে। সকাল এগারোটায় বিশ্বজিতের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়েছে। আদিত্য খান্না সিনেমার মোড় অব্দি হেঁটে গিয়ে উল্টোডাঙার অটো ধরল। তারপর উল্টোডাঙা থেকে একটা বাস ধরে স্টেডিয়াম। স্টেডিয়াম থেকে কলম্বিয়া এশিয়া যাবার কি কোনও বাস বা অটো আছে? আদিত্য ঠিক জানে না। বাস থেকে নেমে সে হাঁটা লাগাল।
আদিত্যর মতো যারা শহরের ঘিঞ্জি এলাকায় চলাফেরা করতে অভ্যস্ত তারা সল্ট লেকের দূরত্বগুলো ঠিক আন্দাজ করে উঠতে পারে না। সে ভেবেছিল হাতে অনেক সময় আছে, এগারোটার আগেই তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যাবে। কার্যত দেখা গেল হাঁটছে তো হাঁটছেই। যখন কলম্বিয়া এশিয়া হাসপাতালের সামনে পৌঁছল তখনই এগারোটা পাঁচ। এখান থেকে ঠিক জায়গাটা খুঁজে বার করতে আরও কতক্ষণ লাগবে কে জানে? আদিত্য বিশ্বজিতের নম্বরটা ডায়াল করল।
বিশ্বজিৎ ধীরে সুস্থে আসতে বলছে। সে এখন অফিসেই থাকবে। তাছাড়া কলম্বিয়া এশিয়া হাসপাতাল থেকে গুপ্ত অ্যান্ড চৌধুরি সিভিল কন্সট্রাকশান্স-এর আপিসে যাবার একটা মোটামুটি ডিরেকশনও সে দিয়ে দিয়েছে। তা সত্ত্বেও সৈকত চৌধুরির আপিসে পৌঁছতে পৌঁছতে সাড়ে এগারোটা পেরিয়ে গেল।
আপিসটা খুব ছোট নয় আবার খুব বড়ও নয়। পুরো একতলা জুড়ে ছোট ছোট কিউবিকল। কতগুলোতে ছেলেমেয়েরা কাজ করছে। কিছু ফাঁকা। দুই সারি কিউবিকল-এর মধ্যে দুটো বড় ঘর, একটার দরজায় লেখা ‘মণিময় গুপ্ত’ অন্যটার দরজায় লেখা সৈকত চৌধুরি’। ধরে নিতে বাধা নেই, দুটো ঘরই এখন ফাঁকা। উল্টোদিকে আর একটা ঘর, তুলনায় ছোট, তার বন্ধ দরজার ওপর লেখা ‘বিশ্বজিৎ মজুমদার, জেনারেল ম্যানেজার’। নিজের নাম বলতে রিসেপশানের মেয়েটি আদিত্যকে জানাল, বিশ্বজিৎবাবু আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। সোজা গিয়ে ডানদিকের ঘর। আপনি গিয়ে নক করুন।
‘আমাদের কোম্পানি একটা আনপ্রিসিডেন্টেড ক্রাইসিসের মধ্যে দিয়ে চলেছে। দুজন মালিকের একজন নেই, আর একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। আমি আমার মতো করে যতটা পারছি চালাচ্ছি। অনেকগুলো ছেলেমেয়ের রুটিরুজির ব্যবস্থা হয় এখান থেকে। নতুন প্রজেক্ট কিছু আসছে না। অন গোইং প্রজেক্টগুলোই চলছে। কতদিন এভাবে চলবে জানি না।’
আদিত্য খুব মন দিয়ে বিশ্বজিৎ মজুমদারকে লক্ষ করছিল। টেলিফোনে গলা শুনে বিশ্বজিৎ মজুমদারের যে চেহারাটা আদিত্যর মনে তৈরি হয়েছিল, আসল লোকটা তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। মোবাইলে কথা বলে আদিত্যর মনে হয়েছিল বিশ্বজিৎ মজুমদার একজন ফরসা, মাঝারি হাইটের চশমা পরা দোহারা স্বাস্থ্যের লোক। কেন এরকম মনে হয়েছিল তার কোনও ব্যাখ্যা অবশ্য আদিত্যর কাছে নেই। আসল বিশ্বজিৎ মজুমদার বেশ লম্বা, রীতিমতো কালো, বয়েস বছর পঁয়তাল্লিশ, ছিপছিপে, চোখে চশমা-টশমা কিচ্ছু নেই। চেহারায় একটা ব্যক্তিত্ব আছে। তার সঙ্গে এখন একটা অসহায়তার মিশেল ঘটেছে।
বিশ্বজিৎ মজুমদারের চেম্বারটা ছোট, কিন্তু তার মধ্যেই বেশ গোছানো। দেখে আদিত্যর মনে হল লোকটার কাজে একটা গোছ আছে।
‘মণিময়বাবু কি মাঝে মাঝে এরকম অজ্ঞাতবাসে চলে যান?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘যান। মানে অতীতে অনেকবার গেছেন। পরে ফিরে এসে বেড়ানোর গল্প করেছেন। মিঃ গুপ্ত-র দুর্গম জায়গায় বেড়ানোর খুব শখ। আফ্রিকা, সাউথ আমেরিকা, মোঙ্গোলিয়া, আরও নানা জায়গা, নামই শুনিনি। বিয়ে-সাদি করেননি। ওই নিয়েই থাকেন। আর যখন বেড়াতে যান, কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন না। ফোন করেও পাওয়া যায় না। কিন্তু এবার যেন একটু বেশি দেরি করে ফিরছেন। যদি মিঃ চৌধুরির খবরটা জানতেন তাহলে নিশ্চয় এক্ষুনি ফিরে আসতেন।’
‘মণিময় গুপ্ত-র অনুপস্থিতিতে কি সৈকত চৌধুরিই অফিস চালাতেন?’
‘না। না। মিঃ চৌধুরি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কিচ্ছু দেখতেন না। ওঁর এরিয়াটা স্ট্রিক্টলি টেকনিকাল। ড্রয়িং, ডিসাইনিং এসব কাজে উনি ছিলেন সুপার্ব। সত্যি বলতে কি, কাজে ওঁর সুনামের জন্যই বেশিরভাগ ক্লায়েন্ট আমাদের কম্পানিতে আসত। অ্যাডমিনিস্ট্রেশনটা দেখতেন মিঃ গুপ্ত। ফিনানশিয়াল দিকটাও। উনি না থাকলে আমিই ওগুলো দেখি। এখন যেমন দেখছি।’
‘আপনার ব্যাকগ্রাউন্ডটাও কি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর?’
‘না, না। আমি চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট। একটা ছোটখাটো এমবিএ ডিগ্রিও আছে।’
‘আচ্ছা,’ আদিত্য একটু থেমে থেমে বলল, ‘আপনাদের তো প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি, মানে ব্যক্তিগত মালিকানা।’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘মালিক কারা?’
‘ওই তো ওই দুজন। মণিময় গুপ্ত আর সৈকত চৌধুরি।’
‘মণিময় গুপ্তর ওয়ারিস কে, জানেন?’
‘আমি যতদূর জানি, মণিময় গুপ্তর কোনও ওয়ারিস নেই। খুব দূর সম্পর্কের কেউ থাকলে অবশ্য জানি না।’
‘সেক্ষেত্রে, সৈকত চৌধুরি যখন আর নেই, যদি মণিময় গুপ্তর কিছু হয়ে যায়, মানে আমি হাইপথেটিকালি বলছি, কোম্পানির মালিকানা কি সৈকতের স্ত্রী অনিতার হাতে চলে যাবে?’
‘সেরকমই তো মনে হয়। যদি না অবশ্য মণিময় গুপ্তর কোনও আত্মীয়, যাকে আমরা চিনি না, হঠাৎ উদয় হয়ে কম্পানির অংশ দাবি করে বসে।’
‘আচ্ছা, আপনাদের কম্পানির ফিনান্সিয়াল অবস্থা কেমন? ব্যালেন্স সিটে বার্ষিক প্রফিট কতটা দেখায়?’
‘খুব বেশি প্রফিট আমাদের থাকে না। খরচ, ট্যাক্স সব বাদ দিয়ে ধরুন বছরে দু-তিন কোটিও থাকে না। ইদানীং সেটার থেকেও প্রফিট কমে গেছে।’
‘আপনাদের তো বেশ বড় কোম্পানি। কুড়ি-পঁচিশজন কাজ করে নিশ্চয়। প্রফিট এত কম কেন?’
‘মূল কারণ, কোম্পানির প্রচুর ধার আছে। ধারের টাকা মেটাতেই লাভের বড় অংশ বেরিয়ে যায়। মালিকদের কোম্পানি চালানোর জন্য খুব বেশি টাকা ছিল না। তাই ধার করতে হয়েছিল। ব্যাঙ্ক থেকে খুব একটা ধার পাওয়া যায়নি। মালিকরা কম্পানিতে একটা সার্টেন অ্যামাউন্ট ইনভেস্ট না করলে ব্যাঙ্করা ধার দিতে চায় না। তাই মালিকরা প্রাইভেট সোর্স থেকে ধারটা করেছিলেন। হাই ইন্টারেস্ট। এখন তো চারদিকে সুদের হার কমছে। কিন্তু ওই পুরোনো লোনগুলোর ওপর ইন্টারেস্ট কমানো যায়নি। ওটা কন্ট্রাক্টে ছিল না!’
‘কাদের কাছ থেকে কোম্পানি ধার করেছিল?’
‘মেনলি একটাই সোর্স। অসীম দত্ত একজন বড় কন্ট্রাক্টার। তার এইস বিল্ডার্স বলে একটা কোম্পানি আছে। সেখান থেকেই টাকাটা ধার নেওয়া হয়েছিল।’
‘অসীম দত্তর কোম্পানির সঙ্গে কি আপনাদের কোম্পানির আর কোনও সম্পর্ক আছে?’
‘আছে বইকি। খুব ভাল রকমের সম্পর্ক আছে। আমাদের যত প্রজেক্ট প্রায় সবই তো অসীম দত্তর কোম্পানি এক্সিকিউট করে। মিঃ দত্ত মিঃ গুপ্তর খুব ক্লোজ। ক্লোজ, কিন্তু সুদ একচুলও কমাবে না। মিঃ চৌধুরি অবশ্য এসবের মধ্যে খুব একটা ঢুকতেন না। প্রজেক্টটা ডিসাইন করেই তাঁর কাজ শেষ।’
‘আচ্ছা, এই অসীম দত্ত কি বলতে পারবেন মণিময়বাবু কোথায় আছেন?’
‘ঠিক বলতে পারব না। জিজ্ঞেস করিনি।’
‘আমাকে অসীম দত্তর ঠিকানাটা দিতে পারবেন? আর সম্ভব হলে ফোন নাম্বার?’
‘বাড়ির ঠিকানাটা তো জানি না। অফিসের ঠিকানা এক্ষুনি দিয়ে দিচ্ছি। অফিসের ল্যান্ডলাইনটাও দিচ্ছি। মোবাইলটা না জিজ্ঞেস করে দিতে পারব না।’
‘ঠিক আছে। তাতেই হবে।’
‘আর শেষ কয়েকটা প্রশ্ন। সৈকত চৌধুরির সঙ্গে আপনাদের, মানে স্টাফেদের, সম্পর্ক কেমন ছিল?’
‘দেখুন, এটা আমি উইদাউট এনি হেজিটেশন বলতে পারি যে মিঃ চৌধুরিকে অফিসের প্রত্যেকটি স্টাফ, ইনক্লুডিং মি, ভালবাসত, শ্রদ্ধা করত। এটা শুধু মিঃ চৌধুরির টেকনিকাল নলেজের জন্যে নয়। ওঁর মতো উদার-হৃদয় মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। উনি প্রত্যেকটি স্টাফের বিপদে আপদে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। এই ম্যাগ্ন্যানিমিটিটার জন্যেই স্টাফেরা ওঁকে এত ভালবাসত।’
‘মণিময়বাবুর সঙ্গে স্টাফেদের সম্পর্ক কেমন ছিল?’
‘দেখুন, মিঃ গুপ্ত স্টাফেদের সঙ্গে একটা দূরত্ব বজায় রাখা পছন্দ করতেন। এটা উনি কখনোই ভুলতে দিতেন না যে উনি মালিক আর আমরা কর্মচারী। তাই মিঃ চৌধুরির কাছে আমাদের যতটা সহজ অ্যাক্সেস ছিল, মিঃ গুপ্তর বেলায় সেটা ছিল না।’ বিশ্বজিৎ মজুমদারের গলাটা কিঞ্চিৎ আড়ষ্ট শোনাল।
‘আপনি মণিময়বাবুর বাড়ির ঠিকানাটা আমাকে দিতে পারেন?’
‘হ্যাঁ, এটাও দিতে পারব।’
‘এবার শেষ প্রশ্ন। পার্টনার সৈকত চৌধুরির সঙ্গে মণিময়বাবুর কেমন সম্পর্ক ছিল?’ আদিত্য খানিকটা সতর্কভাবে জিজ্ঞেস করল।
বিশ্বজিৎ মজুমদার চুপ করে রয়েছে। কিছু একটা বলতে চায় কিন্তু বলতে পারছে না। শেষে মৃদু গলায় বলল, ‘এটা নিয়ে আমার কোনও মন্তব্য করা ঠিক হবে না।’
আদিত্য বলল, ‘একবার ভেবে দেখুন। এটা একটা অস্বাভাবিক অবস্থা। যে সৈকতবাবুকে আপনারা এত ভালবাসতেন তিনি খুন হয়েছেন। আমি তাঁর খুনিকে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। আমাকে একটু সাহায্য করবেন না?’
বিশ্বজিৎ মজুমদারের মুখে একটা যন্ত্রণা ফুটে উঠেছে। একদিকে সৈকত চৌধুরির প্রতি তার ব্যক্তিগত টান। অন্যদিকে অফিস ম্যানেজারের প্রফেশনাল এথিক্স। খানিকটা মানসিক সংগ্রাম করার পর সে বলল, ‘না, আমার আর কিছু বলার নেই।’
অনেক চেষ্টা করেও আদিত্য তাকে দিয়ে আর কিছু বলাতে পারল না।
আদিত্য যখন গুপ্ত অ্যান্ড চৌধুরি সিভিল কনস্ট্রাকশান্স-এর আপিস থেকে বেরচ্ছে তখন প্রায় পৌনে একটা।
স্টেডিয়ামের সামনে থেকে বাস ধরে উল্টোডাঙা পৌঁছতে অনেকটা সময় লেগে গেল আদিত্যর। স্টেডিয়ামের উল্টোদিকে বাসের জন্যে দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই, বাস আর আসে না। অনেকক্ষণ পরে যদি বা একটা এল, তাতে এত ভিড় যে ওঠা যায় না। পরেরটা অপেক্ষাকৃত ফাঁকা, এলও কিছু তাড়াতাড়ি। উল্টোডাঙার দিক থেকে যেখানে অরবিন্দ সেতু শুরু হয়েছে সেখানে একটা ভাতের হোটেল আছে। আগে দু-একবার আদিত্য এখানে খেয়েছে। রান্না সাদামাটা, কিন্তু তেল-ঝাল নেই। এত খিদে পেয়ে গিয়েছিল, আদিত্য ঠিক করল এখানেই খেয়ে নেবে।
ভাত, ডাল, আলু-উচ্ছে-ভাজা, মাছের ঝোল দিয়ে পেট ভরে খেয়ে আদিত্যর মনে হল সে এই ভরা পেটে এখন বাসে উঠতে পারবে না। অথচ একবার বউবাজারে তার আপিসে না গেলেই নয়। কিছু কাগজপত্র সেখানে রয়ে গেছে যেগুলো বাকি রিপোর্টটা লেখার জন্যে দরকার। সাত পাঁচ ভেবে সে ট্রাম স্টপে গিয়ে দাঁড়াল। ট্রামের অনেক অসুবিধে। একে তো অনিয়মিত, তার ওপর অনেক ঘুরে ঘুরে যায়, গতিও সামান্য। কিন্তু এই মুহূর্তে সবার ওপরে শরীরটা আরাম চাইছে। আদিত্যর ভাগ্য ভাল, একটু পরেই দেখল একটা বেশ ফাঁকা ষোলো নম্বর ট্রাম হেলতে দুলতে এগিয়ে আসছে।
ট্রামে উঠে আদিত্য রাজা। জানলার ধারে সিট পেয়ে গেছে! ট্র্যাম নিজের গতিতে চলুক, আদিত্যর কোনও তাড়া নেই।
কী কী কাজ করতে হবে? আদিত্য ট্রামের জানলার ধারে বসে মনে মনে তালিকা তৈরি করছিল। মণিময় গুপ্তর বাড়িতে একবার গিয়ে খোঁজ-খবর করতে হবে। অসীম দত্ত বলে লোকটার সঙ্গে দেখা করতে হবে। অনিতার বন্ধু সমীর প্যাটেলের খোঁজে বিমলকে লাগাতে হবে। অনিতার দাদার সঙ্গেও দেখা করলে ভাল হয়। ইনশিয়োরেন্স কোম্পানির ডিটেকটিভ বিপ্লব সমাদ্দারের সঙ্গে কথা বলতে হবে। কাজ কম নয়। আর সবই অবৈতনিক। কিন্তু আদিত্য এই কেসটাতে একটা উৎসাহ পেয়ে গেছে। কিছু একটা ভেতরে ভেতরে চলছে যেটা সে ধরতে পারছে না। ব্যাপারটা সে মাঝপথে ছেড়ে যেতে পারবে না। কিন্তু পেটে কিল মেরেই বা কদিন কাজ করা যায়। এই মুহূর্তে না হলেও কমাস বাদে টাকার টান পড়বে। অবশ্য ততদিনে রিপোর্টটা পুরো জমা দেওয়া হয়ে যাবে। সরকার যদি পেমেন্টটা তাড়াতাড়ি করে দেয় তাহলে কিছুটা সুবিধে হয়। কেয়া সংসারটা চালিয়ে নেবে। কিন্তু হাতখরচ? কেয়ার কাছে হাত পাতার প্রশ্নই ওঠে না। এর মধ্যে আবার কেয়া হানিমুনের বায়না করছে। আদিত্যর হাসি পেয়ে গেল।
(২)
‘চা খাবে না কফি?’ কেয়া কেটলিতে জল বসাতে বসাতে বলল।
‘চা-ই তো ভাল। অফিসে বসে অনেকবার কফি খেয়েছি।’ আদিত্য ল্যাপটপে চোখ রেখে বলল। ‘তোমার ছাত্রী দার্জিলিং থেকে সেই যে চা এনেছিল সেটা তো খাওয়াই হচ্ছে না।’
সারাদিনের মধ্যে এই সময়টা আদিত্যর খুব পছন্দ। দুজনেই কাজ থেকে ফিরে আসার পর একসঙ্গে বসে একটু চা-কফি খাওয়া আর আবোলতাবোল গল্প করা। নব্বইভাগ কথা কেয়াই বলে, অনর্গল বলে যায়। তার ইস্কুলের দিদিমণিদের গল্প, দিদিমণিদের সংসারের গল্প।
‘নমিতাদির কথা মনে আছে? ইংলিশের নমিতাদি?’
‘ওই যার ছেলের বিয়েতে নেমন্তন্ন খেয়ে এলাম?’
‘ঠিক মনে করেছ।’
‘মনে না করে উপায় আছে। যা বোর হয়েছিলাম। তুমি তো বন্ধুদের মধ্যে মিশে গেলে। আমি একেবারে একা। কারও সঙ্গে কথা বলার নেই। নদীয়া হাউসের বড় মাঠটার এক কোণে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছি। ভাগ্যিস বিয়ে বাড়িতে অনেক লোক ছিল, তাই কেউ লক্ষ করেনি। কিন্তু আমার খালি মনে হচ্ছিল এক্ষুনি কেউ এসে বলবে, এই তুই কে রে? চুরি করে খেতে এসেছিস? ভাগ এখান থেকে।’
‘আর বাড়িও না। ওরকম মোটেই হয়নি। আমি বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলছি, আমার মনে হচ্ছিল তুমি পাশেই আছ, হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে তুমি হারিয়ে গেলে। কিছুতেই তোমায় খুঁজে পাই না। তোমার সঙ্গে আমার কলিগদের স্বামীরা অনেকে আলাপ করতে চাইছিল।’
‘যাই হোক। সেদিন আমার পুরোনো বন্ধু বেদব্রত একেবারে সেভিয়ারের মতো উদয় হয়েছিল। বেদব্রতরা মেয়ের বাড়ির লোক। কন্যাযাত্রীর দলে এসেছে। বাকি সন্ধেটা অবশ্য বেদব্রতর সঙ্গে গল্প করে চমৎকার কেটে গেল। তা নমিতাদির কী হয়েছে?’
‘হ্যাঁ সেটাই তো বলছি। নমিতাদির ছেলের নাকি ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে।’
‘সে কী! এই তো বিয়ে হল। ছমাসও হয়নি।’ আদিত্য সত্যিই শঙ্কিত।
‘তাই তো বলছে সবাই। কী কারণে ডিভোর্স নমিতাদি বলছেন না। কিন্তু আমাদের লছিমা সান্যাল মেয়ের দিদিকে চেনে। তিনি নাকি লছিমাকে বলেছেন ছেলের শরীরে দোষ আছে।’ কেয়া একটা ট্রেতে দু-কাপ চা আর একটা প্লেটে কিছু চিঁড়েভাজা নিয়ে এসে আদিত্যর গা ঘেঁষে বসল। আদুরে গলায় বলল, ‘আমাদের ডিভোর্স হবে না, বল।’
‘অন্তত যে কারণে নমিতাদির ছেলের ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে বলছ, সে কারণে হবে না।’ আদিত্য কেয়ার দিকে তাকিয়ে অল্প হাসল। ‘তবে তুমি যদি বল হানিমুনে না গেলে বিয়ে ভেঙে যাবে, তা হলে জানি না।’
‘তুমি হানিমুনে যাবে নাই বা কেন?’
‘টাকা নেই যে, কী করব?’
‘টাকা তো আমি দেব, তোমার কী? এত টাকা রোজগার করছি কার জন্যে?’
‘কোনও ভদ্রলোক বউ-এর পয়সায় হানিমুনে যায়?’
‘তোমার বাবা অদ্ভুত ইগো। আমি আর তুমি কি আলাদা?’
আদিত্যর কাছে সত্যিই এর কোনও উত্তর নেই। সে জানে, সমস্যাটা তার অন্ত- সারশূন্য বনেদি ইগোর, একটা অন্ধ বিশ্বাসের যা নারী-পুরুষকে সমান চোখে দ্যাখে না। এদিক থেকে কেয়া তার তুলনায় অনেক আধুনিক। কেয়ার প্রশ্নের উত্তর এড়ানোর জন্য আদিত্য এখন ধীরে ধীরে কেয়ার শরীরের দখল নিয়ে নিচ্ছে।
মিনিট পাঁচেক পরে আদিত্যর ফোনটা বেজে উঠল।
‘বিমল বলছি স্যার।’
‘হ্যাঁ, বল।’
‘কিছু খবর পেয়েছি। রবিবারে ওই বালিগঞ্জের বাড়িটায় গিয়েছিলাম।
‘বেশ, বেশ। কী জানতে পারলে?’
‘সিকিউরিটি ছেলেটার সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেছে। ছেলেটা আবার আমার শ্বশুরবাড়ির ওদিকে থাকে। ওর নাম ভবেশ। সে যাই হোক, ও বলল, থ্রি বি ফ্ল্যাটে অনিতা চৌধুরির সঙ্গে দেখা করতে সোম থেকে শুক্র, প্রায় প্রত্যেক দুপুরবেলা এক ছোকরা আসে। শনি রবিবার আসে না। আমি যদি সোমবার বেলা দুটোর মধ্যে ওখানে পৌঁছে যেতে পারি তাহলে হয়ত ছেলেটার দেখা পেয়ে যাব। সেই কথা অনুযায়ী আমি আজ দেড়টা নাগাদ ওখানে পৌঁছে গেলাম। ভবেশকে চা খাওয়ালাম আর দুটো বিস্কুট। চা খেতে খেতে ভবেশ বলল, তোমার লোক আজ আগেই এসে গেছে। এখন অনিতা চৌধুরির ফ্ল্যাটে রয়েছে। যখন বেরোবে তখন আমি চিনিয়ে দেব।’
‘তুমি বসে রইলে?’
‘বসে থাকতে তো হবেই, ভবেশের সঙ্গে বসে বসে খেজুর করলাম। আরও দুবার ওকে চা খাওয়ালাম, কিন্তু ছোকরা আর বেরোয় না। সাড়ে তিনটে বেজে গেল, চারটে বাজতে চলল, ছোকরা আর বেরোয় না। আমার ভয় হচ্ছিল কোনও ভাবে আমার চোখ এড়িয়ে ছোকরা বেরিয়ে যায়নি তো? ভবেশ অভয় দিল। বলল, একদম চিন্তা কোরো না। ও বেরোয়নি আমি জানি। কিন্তু একটা কথা বল। ওই ছোকরাকে তুমি খুঁজছ কেন? পুলিশও তো ওর খোঁজ করছিল। ব্যাপারটা কী? অনিতা চৌধুরির ফ্ল্যাটেই তো আবার দুদিন আগে একটা খুন হয়েছে।
‘আমি বললাম, পুলিশ ওকে কেন খুঁজছে বলতে পারব না। তবে আমি কেন খুঁজছি বলতে পারি। আমি রাত্তিরে তোমার মতো সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করি। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে দিনেরবেলা ছোটখাটো টিকটিকির কাজও করি। ওই ছোকরা আমার মক্কেলের কাছ থেকে অনেক টাকা ধার করে শোধ দিচ্ছে না। আমার মক্কেল বলেছে, লোকটা সারাদিন কোথায় যায়, কী করে লোকটাকে ফলো করে এটা জানতে। আমি সেটাই করছি।’
‘ভবেশ বলল, লোকটা যে এখানে আসে জানলে কী করে?’ আমি বললাম, ‘আমার মক্কেলই বলে দিয়েছে।
বিমলের এই দীর্ঘ সংলাপের মাঝে, আদিত্য খেয়াল করেনি, কেয়া কখন উঠে গেছে। এবার রান্নাঘর থেকে তার গলা শোনা গেল, ‘আর একটু চা খাবে নাকি?’
অনর্থক প্রশ্ন। আদিত্য আজ অবধি চায়ে কখনও না বলেনি। কেয়াও সেটা জানে, তাই আদিত্যর উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে দু-কাপ চা নিয়ে ফিরে এসেছে। আদিত্য চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে টেলিফোনে বিমলকে বলল, ‘তারপর?’
‘সোয়া চারটে নাগাদ, স্যার, লোকটা বেরোল। খুব বেশি বয়েস নয়। পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে। ফরসা, ছোটখাটো, লাল্টু চেহারা। একটু মেয়েলি। বাড়ির গেট থেকে বেরিয়ে ছোকরা হনহন করে বালিগঞ্জ স্টেশনের দিকে হাঁটা লাগাল। আমি পেছন পেছন। স্টেশনের কাছে অনেকগুলো ট্যাক্সি দাঁড়িয়েছিল। লোকটা তার একটাতে উঠে পড়ল। আমি ফাঁপরে পড়লাম। লোকটাকে ফলো করতে গেলে আমাকেও একটা ট্যাক্সি নিতে হয়। কিন্তু পকেটে খুব বেশি টাকা নেই। লোকটা কতদূর যাবে কে জানে? বেশি দূরে যেতে হলে আমার পকেটের টাকায় কুলোবে না। আমি তাও জয় মা বলে আর একটা ট্যাক্সিতে উঠে পড়লাম। ভাবলাম মিটারের দিকে নজর রাখব। আমার পকেটের টাকায় যত দূর যাওয়া যায় যাব। তারপর নেমে পড়তে হবে। হয়ত তার আগেই লোকটা তার যাবার জায়গায় পৌঁছে যাবে। আমার ট্যাক্সিটাকে বললাম, সামনের ট্যাক্সিটাকে ফলো করো।
‘আমার ভয় ছিল ছোকরা বাইপাস না ধরে। তাহলেই হুহু করে মিটার উঠবে। ভাগ্য ভাল, সেদিকে না গিয়ে সামনের ট্যাক্সিটা বালিগঞ্জ ফাঁড়ি হয়ে, পার্ক সার্কাস-বেগবাগান হয়ে, শেক্সপিয়ার সরণি ধরে এসে রাসেল স্ট্রিটে বাঁক নিল। আমি মিটারের দিকে তাকিয়ে আছি আর ঘামছি। কিছুক্ষণ পরে পার্ক স্ট্রিটের একটা বিখ্যাত বারের সামনে এসে ট্যাক্সিটা থামল। ছোকরা ট্যাক্সিটাকে ছেড়ে দিয়ে বারের ভেতর ঢুকল। আমিও আমার ট্যাক্সিটাকে ছেড়ে দিলাম। মা কালীর দয়ায় ভাড়ার পয়সা কুলিয়ে গেছে।’
‘তুমি কি বারের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলে?’
‘আর কী করব? ভেতরে যাবার পয়সা তো আর নেই, তাছাড়া আমার মতো জামাকাপড় পরে গেলে ওইসব জায়গায় ঢুকতেই দেবে না। আমি বারটার উল্টোদিকে একটা চায়ের দোকানে বসে চা খেলাম। একটু এদিক ওদিক রাস্তায় পায়চারি করলাম। আবার একবার চা খেলাম। এমনি করে ঘণ্টাখানেক কেটে গেল।’
‘তারপর?’
‘তারপর একসময় ছোকরা বার থেকে বেরোল। সঙ্গে আর একটা লোক। এই সঙ্গের লোকটার ষণ্ডামার্কা চেহারা, বছর চল্লিশ বয়েস, দেখলেই মনে হয় লোকটা ভাল নয়। রাস্তার এপার থেকে আমি ওদের বেশ কয়েকটা ছবি তুললাম। তারপর রাস্তা পেরিয়ে ওদের কাছাকাছি হাঁটতে লাগলাম। যদি আড়ি পেতে ওদের কথা কিছু শোনা যায়। শুনতে পেলাম আমাদের ওই ছোকরা তার সঙ্গের লোকটাকে বলছে, আমাকে এখন এজরা স্ট্রিটের দোকানে গিয়ে বসতে হবে। নতুন কিছু হলে আমি আপনাকে খবর দেব। এইটুকু শুনে ঠিক করলাম আজ এই পর্যন্ত থাক। আমাকেও তো কাজে যেতে হবে। এখন কাজের জায়গা থেকেই আপনাকে ফোন করছি।’
‘খুব ভাল কাজ করেছ।’ আদিত্য বলল। ‘দুটো জিনিস বলছি। এক, তোমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের ডিটেলটা আমার কাছে আছে। আমি ওটাতে এক্ষুনি পাঁচ হাজার টাকা ট্রান্সফার করে দিচ্ছি। আগেই দেওয়া উচিত ছিল। তুমি এখন থেকে পকেটে একটু বেশি করে পয়সা রেখো। পাঁচ হাজারের বেশি দেবার ক্ষমতা এখন আমার নেই।’
‘ছি, ছি। একি বলছেন স্যার। আপনি টাকা পরে দিলেও চলবে।’
‘নাও, ঢের হয়েছে। আর ভদ্রতা করতে হবে না। তোমার টাকাপয়সার অবস্থা আমি জানি না নাকি? আচ্ছা, আর দু-নম্বর কথা হল, ছবিগুলো এক্ষুনি তুমি আমাকে হোয়াটস অ্যাপ করে দাও।’
‘এক্ষুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি স্যার।’
মোবাইলটা নামিয়ে রেখে আদিত্য ভাবছিল, নিজের গাঁটের পয়সা খরচা করে সে অনিতা চৌধুরির কেসটা নিয়ে লড়ে যাচ্ছে কেন? ইন্টেলেকচুয়াল স্যাটিসফ্যাকশান ছাড়া আর কোনও কারণ সে খুঁজে পেল না। সে নিশ্চিত এই কেসটাতে একটা গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে। তার আকর্ষণ এড়িয়ে যাওয়া আদিত্যর পক্ষে অসম্ভব।
মোবাইলে টুং টাং শব্দ শুনে আদিত্য টের পেল বিমল ছবিগুলো পাঠিয়ে দিয়েছে। দুজন পুরুষের চার-পাঁচটা ছবি। দুজনেই ফরসা। একজন ছোটখাটো, রোগা। এ-ই নিশ্চয় সমীর প্যাটেল। অন্যজন লম্বা, বলিষ্ঠ। মুখে একটা নিষ্ঠুরতা আছে। বিমল ঠিকই বলেছিল, লোকটা মনে হয় ভাল নয়।
লম্বা লোকটার ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আদিত্যর মনে হচ্ছিল লোকটাকে সে যেন আগে কোথাও দেখেছে।
নটা নাগাদ কেয়া খাবার গরম করছিল। এটা আদিত্যর কাছে একটা সংকেত। কেয়া খাবার গরম করছে মানে এবার মোড়ের দোকান থেকে রুটি আনতে হবে। পাঞ্জাবিটা গায়ে গলিয়ে সে বেরিয়ে পড়তে যাচ্ছে, হঠাৎ কী মনে করে বসে পড়ল। মোবাইলটা তুলে খুঁজে খুঁজে সাব ইন্সপেক্টার অচিন্ত্য সাহার নম্বরটা লাগাল।
‘বলুন স্যার।’ অচিন্ত্য সাহার গলাটা মোটামুটি আন্তরিকই শোনাচ্ছে।
‘একটু রাত্তির হয়ে গেল অচিন্ত্যবাবু, এখন কথা বলতে অসুবিধে নেই তো?’
‘কোথায় রাত্তির? আমি তো এখনও থানাতেই আছি। বলুন কী ব্যাপার।’
‘মণিময় গুপ্তকে মনে আছে? সৈকত চৌধুরির পার্টনার। আপনারা কি ভাল করে তার খোঁজ করেছিলেন?’
‘তিনি তো বিদেশে। কোথায় তাও জানা নেই। কী করে খোঁজ নেব?’
‘সত্যিই তিনি বিদেশে কিনা যাচাই করে দেখা দরকার। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মণিময়বাবুর কলকাতার বাড়িতে যাওয়া দরকার। সেখানে গেলে হয়তো তিনি এখন কোথায় আছেন তার একটা হদিশ পাওয়া যেতে পারে। আপনারা কি কখনও মণিময়বাবুর বাড়িতে খোঁজ করেছিলেন?’
‘সত্যি বলতে কি, মণিময়বাবুর বাড়িতে আমাদের এখনও যাওয়া হয়নি। আপনি বলাতে এখন মনে হচ্ছে একবার যাওয়া উচিত ছিল।’ অচিন্ত্য সাহার গলায় দোষ স্বীকারের সুর। ‘আসলে, আপনাকে বলা হয়নি, কিছুদিন ধরে আমরা অ্যানোনিমাস চিঠি পাচ্ছি। চিঠির বক্তব্য, মণিময় গুপ্তর কিছু একটা সাংঘাতিক বিপদ ঘটেছে। আমরা যেন খোঁজ নিয়ে দেখি। সবসুদ্ধু তিনটে চিঠি এসেছে। টাইপ করা চিঠি। কারও নাম নেই।’
‘তাহলে তো যাবার যথেষ্ট কারণ আছে। কবে যেতে পারবেন? আপনারা গেলে আমিও সঙ্গে যেতে চাই। যত তাড়াতাড়ি যাওয়া যায় তত ভাল।’
‘কাল পরশু তো হবে না স্যার। দুটো কোর্ট কেসে হাজিরা দিতে হবে। তার পরের দিন চলুন না। বাড়িটা কোথায় জানেন?’
‘বাড়িটা আমি যতদূর জানি লেক মার্কেটের পেছন দিকে কোথাও একটা। আমার কাছে ঠিকানাটা আছে।’
‘তাহলে পরশুদিনের পরের দিন সকালেই যাওয়া যাক। আমি ইতিমধ্যে একটা সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে রাখব। বলা যায় না, কাজে লেগে যেতে পারে। ঠিকানাটা পরে বসিয়ে নিলেই হবে। সকাল দশটা নাগাদ আপনি থানায় চলে এলে আমরা একটা জিপ নিয়ে বেরিয়ে পড়তে পারব।’
‘খুব ভাল, খুব ভাল। আমি তাহলে পরশুদিনের পরের দিন অর্থাৎ বেস্পতিবার সকাল দশটার মধ্যে গড়িয়াহাট থানায় পৌঁছে যাচ্ছি।’
(৩)
আদিত্য ভাবছিল। এই মুহূর্তে কী কী কাজ তার হাতে আছে? সেই বিরক্তিকর সরকারি রিপোর্টের বাকি অংশটা লেখা শেষ হয়েছে। আজ সকালে সেটা মেল করে দিয়েছে সে। সই করে একটা হার্ড কপিও পরে কুরিয়রে পাঠিয়ে দেওয়া দরকার। ওই কাজটা আপিসে পৌঁছে করতে হবে। তা ছাড়া তার হাতে আর কোনও কাজ নেই। অন্য কোনও কেসও নেই হাতে। তাই আপাতত সৈকত চৌধুরির কেসটা নিয়ে কিছুটা এগোনো যেতে পারে।
আগামী বৃহস্পতিবারের আগে মণিময় গুপ্তর খোঁজে যাওয়া হচ্ছে না। এর মধ্যে হাতে দুটো দিন রয়েছে। কন্ট্রাক্টটার অসীম দত্তর সঙ্গে একবার দেখা করতে হবে। অনিতা চৌধুরির বাবা এবং দাদার সঙ্গেও দেখা করতে পারলে হত। ইনশিয়োরেন্স কোম্পানির ডিটেকটিভ বিপ্লব সমাদ্দারের সঙ্গেও একবার কথা বললে মন্দ হয় না।
কেয়া আজ একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেছে। মেয়েদের বাবা-মায়েদের সঙ্গে মিটিং। পেরেন্ট-টিচার মিট। আগে কেয়াদের ইস্কুলে এসব ছিল না। আজকাল ইংরেজি ইস্কুলের দেখাদেখি কেয়াদের বাংলা ইস্কুলেও চালু হয়েছে। প্রতি তিন মাসে একবার। তবে অ্যানুয়ালের রেজাল্ট বেরোনোর পর ফেল করা ছাত্রীদের বাড়ির লোকেরা এসে প্রোমোশনের জন্যে ধরাধরিটা আলাদা। সেটা তো অনন্তকাল থেকেই চলে আসছে।
সাড়ে দশটা বেজে গেছে। আদিত্যর বেরোনোর তাড়া নেই। সে কফির জল বসিয়ে সিগারেট ধরাল। ল্যাপটপে বুধাদিত্য মুখোপাধ্যায়ের শুদ্ধ সারং লাগাল। তারপর জুত করে কফি-সিগারেট খেতে খেতে ভাবতে লাগল কোন কাজটা আগে করবে? খানিকটা ভাবার পর সে ঠিক করল অসীম দত্তর সঙ্গেই সবার আগে যোগাযোগ করবে।
অসীম দত্তর ফোনটা ল্যান্ডলাইন, সরাসরি নয়, সম্ভবত রিসেপশানের। যান্ত্রিক গলা তাকে অপেক্ষা করতে বলার পর যে শ্রুতিকটূ জগঝম্প বাজনাটা বেজেই চলল সেটা আদিত্যকে বিশেষভাবে কষ্ট দিচ্ছিল কারণ তার মাথার মধ্যে তখনও শুদ্ধ সারং বাজছে। একটু পরে মনে হয় রিসেপশনের মেয়েটির দয়া হল। নকল গলায় মার্কিনি উচ্চারণ অনুকরণ করে সে বলল, ‘এইস বিল্ডার্স, মে আই হেল্প ইউ?’ ‘এইস’ কথাটা সে একটু টেনে উচ্চারণ করেছিল যাতে কেউ ইংরেজি অক্ষর ‘এস’-এর সঙ্গে গুলিয়ে না ফেলে।
আদিত্য ঠিক করে নিয়েছে কী বলবে। সে যদি বলে সে একজন বেসরকারি গোয়েন্দা, সৈকত চৌধুরি খুনের ব্যাপারে অসীম দত্তর সঙ্গে কথা বলতে চায়, তা হলে খুব সম্ভবত রিসেপশানিস্ট মেয়েটি তাকে ভাগিয়ে দেবে।
তাই সে গম্ভীর পুলিশি গলায় বলল, ‘অসীম দত্তকে ফোনটা দিন। বলুন, সৈকত চৌধুরি খুনের কেসটার ইনভেস্টিগেশানের ব্যাপারে আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।’
কথাগুলো মিথ্যে নয়, তবে মেয়েটিকে যে ধারণা দেওয়া হল আদিত্য পুলিশের লোক, সেটা, বলাই বাহুল্য, অসত্য।
‘মিঃ দত্ত তো এখনও অফিসে আসেননি।’ মেয়েটি মিনমিন করে বলল। তার আসল গলাটা এবার বেরিয়ে পড়েছে।
‘উনি কখন অফিসে আসেন?’ আদিত্যর গলায় প্রায় হুঙ্কার।
‘সাধারণত বারোটা সাড়ে বারোটার আগে আসেন না।’ মেয়েটি কুণ্ঠিতভাবে বলল।
‘অসীম দত্তর বাড়ির ফোন নম্বরটা দিন।’ আদিত্য আদেশের ভঙ্গিতে বলল।
‘ল্যান্ডলাইনটা দিচ্ছি স্যার। মোবাইলটা ওঁকে না জিজ্ঞেস করে দেওয়ার অর্ডার নেই।’
‘তাই দিন।’
ফোনটা রেখে দিয়ে আদিত্য দেখল এগারোটা বেজে পাঁচ মিনিট। মনে হয়, অসীম দত্ত এখনও বাড়ি থেকে বেরোয়নি। একবার চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে ওকে বাড়িতে পাওয়া যায় কিনা।
অসীম দত্তর বাড়ির ফোনটা ধরলেন এক মহিলা। জানালেন, অসীমবাবু স্নানে ঢুকেছেন, মিনিট পনেরো বাদে ফোন করলে তাঁকে পাওয়া যেতে পারে। মাঝবয়সি, কেজো গলা। মনে হয় না বাড়ির লোক। হয়তো নার্স কিংবা অসীম দত্তর সেক্রেটারি।
এখন অপেক্ষা করতে হবে। আদিত্য আবার কফির জল চাপাল। আবার সিগারেট। গান। এবার কিশোরী আমোনকরের গুণকেলি। বেশিক্ষণ দেরি করাও যাবে না। ভদ্রলোক বেরিয়ে যেতে পারেন। আদিত্য গান বন্ধ করে সতেরো মিনিটের মাথায় আবার ফোন করল। এবার টেলিফোনের ওপার থেকে পুরুষকণ্ঠে শোনা গেল, ‘হ্যালো?’
সেই সম্ভাষণে একটা জিজ্ঞাসা ছিল, যেন জানতে চাওয়া হচ্ছে, আপনি কে কথা বলছেন?
আদিত্য বিনীতভাবে বলল, ‘আমি কি অসীম দত্তর সঙ্গে কথা বলছি?’
‘আমি অসীম দত্ত। আপনি কে বলছেন?’ গলার আওয়াজে একটা প্রচ্ছন্ন বিরক্তির ভাব।
‘আমি একজন বেসরকারি গোয়েন্দা। অনিতা চৌধুরির অনুরোধে তার স্বামী সৈকত চৌধুরির খুনের কেসটা ইনভেস্টিগেট করছি। আপনি কি আমাকে মিনিট পনেরো সময় দিতে পারেন, কয়েকটা প্রশ্ন করতাম।’
‘দেখুন, মশাই, আপনার নামটা আমি জানি না, তবে এটুকু পরিষ্কার করে বলতে চাই যে আমি খুব ব্যস্ত লোক। বেসরকারি গোয়েন্দাদের সময় দেবার মতো অবসর আমার হাতে নেই। তাছাড়া এ-ব্যাপারে পুলিশ তো কখনও কিছু আমাকে জিজ্ঞেস করেনি! আপনি হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হলেন। সরি, আপনাকে আমি সময়-টময় দিতে পারব না।’ অসীম দত্তর বিরক্তিটা এখন আর প্রচ্ছন্ন নেই।
অসীম দত্ত বোধহয় ফোনটা রেখেই দিতে যাচ্ছিল, আদিত্য তার আগেই কড়া গলায় বলল, ‘শুনুন অসীমবাবু। আমার নাম আদিত্য মজুমদার। আমার সঙ্গে পুলিশের বিশেষ সদ্ভাব আছে। আছে কিনা আপনি খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। আপনি যদি আমাকে সময় না দেন, আমি পুলিশ নিয়ে আপনার অফিসে উপস্থিত হব। হয়তো দু-একদিন দেরি হবে। তবে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন পুলিশ নিয়ে আপনার অফিসে আমি যাবই। সেটা কিন্তু আপনার বা আপনার কম্পানির পক্ষে খুব ভাল বিজ্ঞাপন হবে না। এবার আপনিই বলুন কী করবেন।’
‘আপনি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন? এই অসীম দত্ত অনেক ঘাটের জল খেয়েছে। আপনার মতো দু-পয়সার বেসরকারি গোয়েন্দা আমার অনেক দেখা আছে। আপনি জাহান্নমে যেতে পারেন। আর হ্যাঁ, আমার সমস্ত টেলিফোন-কনভার্সেশন টেপ করা হয়। এটিও হয়েছে। আমি এটা পুলিশকে পাঠিয়ে দিয়ে বলব আপনি একজন ফ্রড। পুলিশের নাম করে আমাকে হ্যারাস করছেন।’ অসীম দত্ত খট করে ফোনটা নামিয়ে রাখল।
অসীম দত্তর কাছ থেকে আদিত্য ঠিক এই রকম প্রতিক্রিয়া আশা করেনি। সে মোবাইলটা টেবিলে রেখে গভীরভাবে ভাবছিল। কোনও সন্দেহ নেই, অসীম দত্ত প্রবল স্নায়ুচাপে রয়েছে। না হলে প্রায় অকারণে অতটা টেনস হয়ে উঠত না। তাছাড়া তার কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে সে তার প্রতিটি টেলিফোন কল রেকর্ড করে রাখছে। কেন এই সাবধানতা? কোনও সুস্থ স্বাভাবিক লোক তো এটা করবে না! অসীম দত্ত কি তা হলে কোনও কারণে ভয়ে ভয়ে আছে?
দুপুরটা নানারকম টুকিটাকি কাজ করতে করতে কেটে গেল। রিপোর্টটা কুরিয়ার করতে কিছু সময় লাগল। চাঁদনি থেকে ল্যাপটপের জন্য দুটো ছোট স্পিকার কেনার ছিল, সেটাও কেনা হল। আপিসে ফিরে আদিত্য যখন লাঞ্চ খাবার জন্য টিপিন বাক্স খুলেছে, তখন সাড়ে তিনটে বেজে গেছে।
রত্না ফোন করেছিল। আজ কী একটা মুসলিম পরবের জন্য ওদের কলেজ বন্ধ। তাই সারা দুপুরটা কাজ নেই। বলল, অনিতা শর্মার খোঁজ নিয়েছে। ওর বন্ধু অভিজিৎ ঘোষের অনিতা শর্মাকে মনে আছে। সম্ভবত সুন্দরী বলে (এটা অবশ্য রত্নার সংযোজন)। খুব কনজারভেটিভ বাড়ির মেয়ে। বাড়ির গাড়িতে যাতায়াত করত। কয়েকজন ছেলের নজর ছিল ওর ওপরে। তার মধ্যে একজন একটু এগিয়েছিল। তারপর একদিন অনিতার দাদা এসে ছেলেটাকে প্রচণ্ড ধমকেছিল। বোধহয় মারধোরও করেছিল। এই নিয়ে যে সেই সময় কলেজে একটা অশান্তি হয়েছিল, এইটুকুই অভিজিৎ ঘোষের মনে আছে। আর কিছু মনে নেই।
রত্নার পর বিমল ফোন করল। জানতে চায় তাকে আর কিছু করতে হবে কিনা।
আদিত্য বলল, ‘এই মুহূর্তে তোমাকে কিছু করতে হবে না। তবে যে ছেলেটাকে তুমি জামির লেন থেকে ফলো করে পার্ক স্ট্রিটে গেলে সেই ছেলেটার নাম সমীর প্যাটেল। নামটা মনে রেখো, পরে কাজে লাগতে পারে।’
কেয়া ফোন করল সোয়া চারটের সময়, কোচিং ক্লাসে ঢোকার আগে যেমন রোজ করে।
মাঝখানে আদিত্যর অফিস বিল্ডিং-এর সিকিউরিটি শ্যামল এসে ইনিয়ে বিনিয়ে গল্প করে গেছে। সকলেই বোধহয় ভাবে আদিত্যর কোনও কাজ নেই তাই তার খানিকটা সময় নষ্ট করা যেতেই পারে। তারপর সেই ফোনটা এল। তখন প্রায় পাঁচটা বাজে।
‘আদিত্যবাবু আমি অসীম দত্ত বলছি। আপনার সঙ্গে সকালে খুব খারাপ ব্যবহার করেছি, তাই ক্ষমা চাইছি। আমার মাথার ঠিক ছিল না। আমি সত্যিই খুব স্ট্রেস-এর মধ্যে আছি। আপনি কবে আমার সঙ্গে দেখা করতে চান বলুন। আজ বললে আজই দেখা হতে পারে। আসলে আমাকে আপনার যতটা দরকার তার থেকে অনেক বেশি আমার দরকার আপনাকে।’
আদিত্য খুব তাড়াতাড়ি ভাবছিল। নিশ্চয় সকালে আদিত্য ফোন করার পর অসীম দত্ত তার সম্বন্ধে খোঁজ-খবর নিয়েছে। ফলে তার সুর নরম। কিন্তু অসীম দত্তর শেষ কথাগুলো আদিত্য ঠিক বুঝতে পারল না। তাকে অসীম দত্তর কেন দরকার? সে বলল, ‘আপনি যে চাপের মধ্যে রয়েছেন সেটা আমি বুঝতে পারছিলাম। আমি কিছু মনে করিনি। কোথায় গেলে আপনাকে পাব?’
‘আমার বাড়িতে আসাই সব থেকে ভাল। আমি একাই থাকি। আমার সেক্রেটারি মহিলা সন্ধে ছটায় চলে যায়। তারপর বাড়িতে শুধু আমি আর আমার পুরোনো চাকর সুবল। সুবল খুব বিশ্বাসী। বাড়িতে আর কেউ থাকবে না। আজ আসতে পারবেন? সন্ধে ছটার পরে?’ অসীম দত্তর গলায় অসীম ব্যগ্রতা।
‘আপনার বাড়িটা কোথায়?’
‘বালিগঞ্জ সারকুলার রোডে, সেন্ট লরেন্স স্কুলের পাশে। আমি ঠিকানাটা বলছি আপনি লিখে নিন।’
ঠিকানাটা লিখতে লিখতে আদিত্য বলল, ‘ঠিক আছে। আমি আজই সাড়ে ছটা নাগাদ আপনার বাড়িতে পৌঁছে যাচ্ছি।’
কেয়ার আজ ফিরতে দেরি হবে, আটটা অব্দি টানা কোচিং ক্লাস। তারও যে ফিরতে দেরি হবে এই মর্মে কেয়াকে একটা মেসেজ করে দিয়ে আদিত্য পৌনে ছটা নাগাদ আপিস থেকে বেরিয়ে পড়ল। ভেবেছিল সাড়ে ছটার আগেই অসীম দত্তর বাড়ি পৌঁছে যাবে। বিবাদী বাগ থেকে দক্ষিণে যাবার একটা মিনিবাস আছে যেটা বালিগঞ্জ সারকুলার রোড দিয়ে যায়। গুমটিতে পৌঁছে আদিত্য দেখে সেই বাসের সামনে আপিসফেরতাদের লম্বা লাইন। হওয়াটাই স্বাভাবিক, একটু আগেই বিবাদী বাগ পাড়ায় আপিস ছুটি হয়েছে। আদিত্যের এটা মাথায় ছিল না। সে বেজার মুখে লাইনের শেষে গিয়ে দাঁড়াল। লাইনের দৈর্ঘ্য দেখে মনে হচ্ছে না তিন-চারটে বাসের আগে তার জায়গা হবে। বাস গুমটিতে চিনেবাদাম বিক্রি হচ্ছে। আদিত্য তাই এক প্যাকেট কিনে খানিকক্ষণ চিবোল। তখনও সে লাইনের মাঝখানে।
একটা লোক ম্যাগাজিন বিক্রি করছে। ম্যাগাজিনগুলো তিন-চার সপ্তাহের পুরোনো, তাই অর্ধেকেরও কম দাম। আদিত্য একটা ইংরেজি মাসিকপত্র কিনে তার পাতা ওল্টাতে লাগল। একটা লেখায় চোখ আটকে গেল তার। লেখকের নাম অর্ণব ব্যানার্জী। এর কথাই তো সায়ন্তন বলছিল। এর বাংলা লেখা আদিত্য পড়েছে। ছেলেটা তা হলে ইংরেজিতেও লেখে। এই ইংরেজি মাসিকপত্রটা সায়ন্তনদের হাউসের। সেখানে অর্ণব লিখবে এটা তো স্বাভাবিক।
আদিত্য মন দিয়ে অর্ণবের লেখাটা পড়ছিল। সম্প্রতি কলকাতা পুলিশ ট্যাংরায় একটা জাল ওষুধের চক্র ধরে ফেলেছে, তাই নিয়ে রিপোর্টিং। মানতেই হবে ছেলেটার লেখার হাত আছে। প্রায় থ্রিলারের মতো আগাগোড়া উত্তেজনা ধরে রেখেছে। বোঝা যায় নিজেও বারবার মাঠে নেমে ইনভেস্টিগেট করেছে। না হলে এতটা ডিটেলে লিখতে পারত না। আদিত্য লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রুদ্ধশ্বাসে লেখাটা পড়ে ফেলল। লেখাটা পড়া হয়ে যাবার পর চোখ তুলে দেখল লাইনে তার সামনে আর মাত্র তিন চারটে লোক। তার মানে, পরের বাসটাতে শুধু জায়গা পাবে তাই নয়, বসতেও পারবে। আদিত্যর ভাগ্যটা সত্যিই ভাল যাচ্ছে। রাইটার্সের দিক থেকে একটা ফাঁকা বাস গুমটিতে ঢুকছে।
আদিত্যর দেরি হচ্ছে দেখে অসীম দত্ত ফোন করে ফেলেছিলেন। আদিত্য তখনও বাসে। শেষে যখন আদিত্য তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছল তখন প্রায় সাতটা বাজে।
বাড়িটা দশতলা। অসীম দত্ত তিনতলার একটা ফ্ল্যাটে থাকেন। অন্তত দু-হাজার স্কোয়ার ফিটের বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। ঢুকেই আদিত্যর মনে হল গৃহস্বামীর অর্থ আছে এটা পরিষ্কার, কিন্তু তার সঙ্গে খানিকটা রুচিবোধও আছে।
বেল বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে বেশ বলিষ্ঠ চেহারার এক ব্যক্তি দরজা খুলে আদিত্যকে বসিয়েছে। আদিত্য আন্দাজ করল এ-ই সুবল, অসীম দত্তর পুরোনো ভৃত্য। একটু পরেই অসীম দত্ত বসার ঘরে ঢুকলেন। টকটকে গৌরবর্ণ, তীক্ষ্ন নাক, চোখের মণি ঈষৎ কটা, রগের চুলে পাক ধরেছে। দেখে মনে হয় বয়েস ষাট পেরিয়ে গেছে। আদিত্যর মনে হল, ইনি পুরোনো কলকাতার বণিক সম্প্রদায়ের মানুষ, বাঙালিদের এত ফরসা রং একমাত্র ওই সম্প্রদায়ের মধ্যেই সাধারণত দেখা যায়।
‘বসুন, বসুন। চা খাবেন তো?’ ভদ্রলোকের উচ্চারণে যে পুরোনো উত্তর কলকাতার টান আছে সেটা টেলিফোনে কথা বলার সময়ই আদিত্য খেয়াল করেছিল।
‘একটু চা খেতে পারি।’ আদিত্যর সত্যিই চা তেষ্টা পাচ্ছিল।
‘সুবল, আমাদের চা দাও।’ অসীম দত্ত গলা তুলে বললেন।
‘আমার কিন্তু দুধ-চিনি ছাড়া শুধু লিকার।’ আদিত্য একটু কুণ্ঠিতভাবে বলল।
‘নিশ্চয়, নিশ্চয়। সুবল আলাদা করে লিকার-দুধ-চিনি নিয়ে আসবে। আমরা পছন্দমতো মিশিয়ে নেব। সকালে আপনি যখন ফোন করলেন, কী আর বলব, আপনার নামটাই আমি মিস করে গিয়েছিলাম। অথচ আপনি বললে বিশ্বাস করবেন না, কিছুদিন ধরে আমি আপনার সঙ্গেই যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি। বিকেলে বাড়ি ফিরে যখন টেলিফোনে কথাবার্তার রেকর্ডগুলো চালালাম তখনই খেয়াল করলাম আদিত্য মজুমদার নিজে আমাকে ফোন করেছিলেন। আমি আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার জন্য আবার ক্ষমা চাইছি।’
‘আরে ও প্রসঙ্গ তো মিটে গেছে। আপনি এখন বলুন কেন আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছিলেন।’
অসীম দত্ত উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ইতিমধ্যে ঠেলাগাড়িতে চা-জলখাবার নিয়ে সুবল এসে গেছে। একটি প্লেটে পেস্ট্রি, কিছু স্যান্ডউইচ, কাজু। সুবল চা ঢেলে দিল। চমৎকার দার্জিলিং।
‘আগে খেয়ে নিন, তারপর বলছি।’ অসীম দত্ত নিজের চায়ে দুধ-চিনি মেশালেন।
‘আপনি বলতে থাকুন না, আমি খেতে খেতে শুনছি।’ আদিত্য স্যান্ডউইচে কামড় বসাল। তার বেশ খিদে পেয়ে গেছে।
‘কিছুদিন আগে কেউ আমাকে খুন করার চেষ্টা করেছিল। নেহাত কপাল জোরে বেঁচে গেছি। আমার স্থির বিশ্বাস খুনি আবার আমাকে খুন করার চেষ্টা করবে। আদিত্যবাবু, আমার প্রোটেকশনের জন্য আমি আপনাকে নিয়োগ করতে চাই। পুলিশ মহলে আমার চেনা কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সকলেই আপনার নাম রেকমেন্ড করেছে। আপনি আমাকে বাঁচান।’ অসীম দত্তর থমথমে গলাটা শেষের দিকে প্রায় কান্নায় ভেঙে পড়ল।
এই রকম একটা প্রস্তাবের জন্য আদিত্য একেবারেই তৈরি ছিল না। সে মুখের স্যান্ডউইচটা কোনওরকমে গলাধঃকরণ করে চায়ের কাপে একটা লম্বা চুমুক দিল। আসলে সে এইভাবে খানিকটা চিন্তা করার সময় তৈরি করে নিচ্ছিল।
চায়ের কাপটা টেবিলে ধীরেসুস্থে নামিয়ে রেখে আদিত্য বলল, ‘পুরো ঘটনাটা না শুনলে আমি কিছু বলতে পারছি না। আপনি আগে একেবারে গোড়া থেকে ঘটনাটা বলুন।’
‘মাস দেড়েক আগেকার ঘটনা। একটা ছুটির দিন ছিল সেটা। আমার অফিস বন্ধ ছিল। আমি সকালটা ক্লাবে গিয়ে ব্রিজ খেলছিলাম। ক্লাবে আমাদের একটা দল আছে, সাধারণত আমরা ছুটির দিনগুলো সকালে একটু তাস খেলি। বেলা একটা নাগাদ খেলা শেষ হল, আমার বন্ধুরা একে একে বাড়ি চলে গেল। আমার তো বাড়িতে কেউ নেই। আমার স্ত্রী অনেক দিন আগে মারা গেছেন। স্ত্রী মারা যাবার পর আমি একা একাই থাকি। কোথায় ফিরব? তাই ছুটির দিনগুলোতে আমি ক্লাবেই লাঞ্চটা খেয়ে নিই। সেদিনও তাই নিলাম। খাবার পর আরাম কেদারায় বসে খবর কাগজ পড়তে পড়তে ঘুম এসে গেল। খানিকটা ঘুমিয়েও নিলাম।’
‘আপনি বললেন, স্ত্রীর মৃত্যুর পরে আপনি একা হয়ে গেছেন। আপনার ছেলেমেয়ে নেই?’ আদিত্য প্রশ্ন করল।
‘আছে। ছেলে, মেয়ে, নাতি, নাতনি সবই আছে। যখন ছেলেমেয়েরা ছোট ছিল, তারা আমার সঙ্গে থাকত। এখন তো তারা বড় হয়ে গেছে। কেউ আমার সঙ্গে থাকে না। রোজ যে তাদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে এমনও নয়।’ অসীম দত্ত কিছুটা বিষণ্ণভাবে বললেন।
‘ঠিক আছে। আপনি বলুন তারপর কী হল।’
‘সময়টা ঠিক মনে নেই, সাড়ে তিনটে চারটে নাগাদ আমি বাড়ি ফিরলাম। ফিরলাম মানে, বাড়ির মেন এন্ট্রান্স, যেখান দিয়ে ঢুকে লিফটে উঠতে হয়, আমার ড্রাইভার সেখানে আমাকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে পার্কিং করতে চলে গেল। বাড়ির বেসমেন্ট-এ আমাদের পার্কিং। আমি গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভিতর ঢুকতে যাব এমন সময় একটু দূর থেকে একটা হালকা শব্দ শুনলাম, যেন একটা গাড়ি ব্যাকফায়ার করছে। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বুকের বাঁ দিকে একটা প্রচণ্ড ধাক্কা অনুভব করে মাটিতে পড়ে গেলাম।
‘পড়ে গিয়ে আমি কিছুক্ষণের জন্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। আর কোনও কারণে নয়, স্রেফ শকে। তাছাড়া পড়ে যাবার জন্য হাতেও চোট লেগেছিল। আমাকে পড়ে যেতে দেখে গেটের দুজন সিকিউরিটি ছুটে এল। শব্দটা তারাও শুনেছে। আমাদের বাড়ির ইলেক্ট্রিশিয়ান কাছাকাছি ছিল, সেও ছুটে এল। মুখে জলের ঝাপটা দিতে কিছুক্ষণ পরে আমার জ্ঞান ফিরে এল। তিনজনে ধরাধরি করে আমাকে একটা চেয়ারে বসাল। আমি দেখলাম আমার বাঁ দিকের বুক পকেটে, যেখানে আমি মোবাইলটা রাখি, সেখানে একটা ছোট বন্দুকের গুলি আটকে আছে। গুলিটা মোবাইল ভেদ করে যেতে পারেনি, তবে মোবাইলটাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। কেউ আমাকে খুন করার জন্য গুলি করেছিল, নেহাত কপাল জোরে আমি বেঁচে গেছি। আমার বন্ধুরা আমাকে বুক পকেটে মোবাইল রাখতে বারণ করত। ওতে নাকি হার্টের ক্ষতি হয়। অথচ ওই বুক পকেটে রাখা মোবাইলই আমাকে বাঁচিয়ে দিল।’
অসীম দত্ত থামলেন। সেই দিনের স্মৃতি যেন তাকে এখনও ভয় দেখাচ্ছে।
আদিত্য বলল, ‘আপনার মোবাইলটা কি মেটালের?’
অসীম দত্ত আদিত্যর প্রশ্নটার তাৎপর্য বুঝতে পারলেন। বললেন, ‘মোবাইলটা মেটালের নয়। কভারটা মেটালের। আই ফোনের কভার। খুব শক্তপোক্ত। অন্য কোনও মোবাইল হলে বোধহয় গুলিটা মোবাইল ফুঁড়ে বুকে ঢুকে যেত। তাছাড়া পুলিশ গুলিটা দেখে পরে বলেছিল, যে বন্দুকটা থেকে গুলিটা এসেছে সেটা বেশ পুরোনো মডেলের একটা মার্কিনি হ্যান্ডগান। এদের রেঞ্জ খুব বেশি হয় না। বড় জোর একশ মিটার। আমাদের বাড়ির উল্টোদিকে, রাস্তার ওপারে, পুরোনো দোতলা বাড়ি ভেঙে হাইরাইজ উঠছে। গুলিটা সম্ভবত সেখান থেকেই করা হয়েছিল। মাঝে বড় রাস্তা রয়েছে। সেখান থেকে আমাদের বাড়ির এন্ট্রান্সটার দূরত্ব খুব কম নয়। মার্কিনি হ্যান্ডগানটার রেঞ্জ যেহেতু একশ মিটারের মধ্যে, গুলিটা যখন আমার মোবাইলে এসে লেগেছিল তখন তার গতি অনেকটা কমে এসেছিল। গুলিটা মোবাইল ভেদ করে যেতে না পারার সেটা একটা কারণ। কারণ যাই হোক, আমি যে বেঁচে গেছি সেটাই বড় কথা। কিন্তু কতদিন? খুনি আবার চেষ্টা করবে।’
‘দেখুন মিঃ দত্ত’ আদিত্য থেমে থেমে বলল, ‘আমি আপনার উৎকন্ঠাটা বুঝতে পারছি। কিন্তু আপনাকে চব্বিশ ঘণ্টা প্রোটেকশন দেবার ক্ষমতা আমার নেই।’
আদিত্য আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে দিয়ে অসীম দত্ত বললেন, ‘না, না আদিত্যবাবু। আপনাকে সে কাজ করতে বলছি না। আমাকে চব্বিশ ঘণ্টা প্রোটেকশন দেবার জন্য দু-জন প্রাইভেট গার্ড আমি ভাড়া করেছি। দু-জনেই আর্মড, দু-জনেই এক্স-আর্মি। আপনি হয়তো লক্ষ করেননি আমার ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে করিডরের উল্টোদিকে একটা ঘর আছে। এক সময় ওটাকে আমি সার্ভেন্টস কোয়াটার হিসেবে ব্যবহার করতাম। ওখানে বসে একজন চব্বিশ ঘণ্টা আমার ফ্ল্যাটের ওপর নজর রাখছে। দ্বিতীয় জন ফ্ল্যাটের ভেতরে থাকছে। আমার শোবার ঘরের পাশের অ্যান্টিরুমে। যখন বাইরে যাই এরা দু-জনেই আমার সঙ্গে যায়। এর বেশি সাবধান আর কী হব?’
‘তাহলে আপনি আমাকে কী করতে বলছেন?’
‘হ্যাঁ, সেটাই এবার বলি। প্রথমত, আমি চাই আপনি খুঁজে বার করুন কে আমাকে খুন করতে চাইছে। এই কাজটা আপনার মতো ভাল আর কেউ করতে পারবে না। দেখুন, সিকিউরিটি সঙ্গে নিয়ে কতদিন চলাফেরা করা যায়? সমস্যাটার মূলে গিয়ে তার পাকাপাকি সমাধান করা দরকার। সেটা সম্ভব হবে যদি খুনি ধরা পড়ে।’
‘বুঝলাম। দ্বিতীয় আর কোনও কাজ আছে?’
‘আছে। আপনি তো জানেন আমার মূল ব্যবসা কন্সট্রাকশান। ইদানীং সেখান থেকে ভেঞ্চার আউট করে আমি হোটেল ব্যবসায় ঢুকেছি। পুরী থেকে কোনারক যাবার রাস্তায়, একেবারে সমুদ্রের ধারে, একটা লাক্সুরিয়াস রিসর্ট বানিয়েছি। এই রবিবার তার ইনগরেশন হবে। আমি নিজে গিয়ে জায়গাটা ইনগরেট করব। ওই দিনটা আবার আমার জন্মদিন। ওই দিন আমার ছেষট্টি বছর পূর্ণ হবে। আমার পরিবারের সদস্যদের ইচ্ছে আমার জন্মদিনটা ওই রিসর্টেই পালন করা হোক। আমার আশঙ্কা, ওই রিসর্টে খুনি আমাকে খুন করার চেষ্টা করবে। যদিও আমার সঙ্গে সিকিউরিটি থাকবে, তবু ওখানে আমি সেফ নই। আমার পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও অনেক অচেনা লোক থাকবে। আমরা একটা ডিস্কাউন্ট দিচ্ছি বলে সব কটা ঘর বুকড হয়ে গেছে। হাজার হলেও হোটেল বাড়ি তো। কে আসছে কে যাচ্ছে ট্র্যাক রাখা অসম্ভব। আমি ওখানে চার দিন থাকব। আমার ইচ্ছে ওই কটা দিন আপনি আমার সঙ্গে থাকুন।’
আদিত্য ইতস্তত করছিল। তাই দেখে অসীম দত্ত বললেন, ‘আপনার কি কোনও অসুবিধে আছে? সামনের শনিবার দুপুরের ফ্লাইটে ভুবনেশ্বর যাবেন, সেখান থেকে গাড়িতে। শনি থেকে মঙ্গল চারটে রাত্তির ওখানে কাটিয়ে বুধবার ফিরে আসবেন। অসুবিধে আছে?’
আদিত্য তবুও ইতস্তত করছিল। শেষে সে ঠিক করল সত্যিটাই বলে দেবে।
‘এই মুহূর্তে আমার স্ত্রীকে কলকাতায় রেখে আমার পক্ষে কলকাতার বাইরে যাওয়াটা খুব মুস্কিল।’ আদিত্য একটু কাঁচুমাচু হয়ে বলল।
হয়তো এই কথা বলার জন্য কাজটা তার হাত থেকে বেরিয়ে যাবে। এবং তার কাজের যে খুব দরকার তাতেও সন্দেহ নেই। কিন্তু বিয়ের পর কেয়াকে কোথাও বেড়াতে না নিয়ে গিয়ে সে নিজেই কলকাতার বাইরে ঘুরে আসবে, তাও একটা রিসর্টে, এটা সম্ভব নয়।
‘স্ত্রীকে কলকাতায় রেখে যাবেন কেন? সঙ্গে নিয়ে চলুন।’ অসীম দত্ত দরাজ গলায় বললেন। ‘আমি গ্যারেন্টি দিচ্ছি ওঁর জায়গাটা ভাল লাগবে। আমাদের সব ঘর বুকড হয়ে গেলেও একটা স্পেশাল হানিমুন সুইট খালি আছে। ওটা আমি যে ঘরে থাকব তার ঠিক পাশে। সেফটির জন্য আমি ওটা খালি রেখেছিলাম। আপনারা থাকলে আমি খুব নিশ্চিন্ত হব।
‘আর, বলাই বাহুল্য, রিসর্টে আপনাদের স্টে-টা, মানে ফুড লজিং সব কিছু, পুরোটাই কমপ্লিমেন্টারি।’ আসীম দত্ত একটু থেমে বললেন। ‘এবার আপনি রাজি তো?’
এরপর আর রাজি না হয়ে উপায় কী? ‘ঠিক আছে। আপনার প্রস্তাব মেনে নিলাম।’ আদিত্য বলল।
(৪)
‘আপনাদের নতুন রিসর্টের নাম কি গোল্ডেন স্যান্ড? ইদানীং খবর কাগজে এদের খুব বিজ্ঞাপন দেখছি।’ দ্বিতীয়বার চা এসেছে। আদিত্য চায়ে কাপে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘আপনি একদম ঠিক ধরেছেন। আমাদের রিসর্টের নাম গোল্ডেন স্যান্ড রিসর্ট। ফাইভ স্টার ফেসিলিটি। প্রথম দু-সপ্তাহ আমরা প্রোমোশানাল কারণে বিরাট ডিসকাউন্ট দিচ্ছি। খুব বিজ্ঞাপনও দিচ্ছি। আশা করছি প্রজেক্টটা দাঁড়িয়ে যাবে।’
‘আপনার মূল ব্যবসাটা তো কন্সট্রাকশান?’
‘হ্যাঁ, ওটা আমার বাপ-দাদার ব্যবসা।’
‘হঠাৎ হোটেল ব্যবসায় এলেন কেন?’
‘এটা ঠিকই যে আমরা তিন পুরুষের কনট্রাক্টর। সেই সাহেবি আমল থেকে। মূলত আমরা সরকারের কাজ করি। পশ্চিমবঙ্গের রাস্তা, ব্রিজ, সরকারি বাড়ি এসবের একটা বড় অংশ আমাদের করা। বড় বেসরকারি কাজও করি না, তা নয়। কলকাতার দু-একটা নতুন ফাইভ স্টার হোটেল আমাদের কনস্ট্রাকশন। ওই হোটেল বানাতে বানাতে নিজের একটা হোটেল করার আইডিয়াটা মাথায় এল।’
‘আচ্ছা, সৈকত চৌধুরির কম্পানির সঙ্গে আপনার কতটা সম্পর্ক আছে?’
‘বেশ ভালই সম্পর্ক আছে। আমার বহু কাজের ড্রয়িংগুলো আমি ওদের দিয়ে করাই। সৈকত খুব ট্যালেন্টেড একজন ইঞ্জিনিয়ার। ওকে দিয়ে অনেক কাজ করিয়েছি। ওর মৃত্যুটা আমার কাছে একটা বিরাট শক। তবে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ওর পার্টনার মণিময় গুপ্তর সঙ্গেই বেশি। মণিময়কে আমি বহুদিন ধরে চিনি।’
‘আপনি তো ওদের কোম্পানিকে ধারও দিয়েছেন?’
‘আপনি খোঁজ-খবর নিয়ে এসেছেন দেখছি। হ্যাঁ, মণিময় যখন কম্পানি শুরু করল তখন একটা মোটা টাকা ধার দিয়ে ছিলাম। ওরা বাজার থেকে ধার পাচ্ছিল না।’
‘আচ্ছা, কে সৈকতকে মারতে পারে আপনার কোনও ধারণা আছে?’
‘এ-ব্যাপারে সত্যিই আমার কোনও ধারণা নেই।’
‘মানুষ হিসেবে সৈকত চৌধুরিকে আপনি কীভাবে ইভ্যালুয়েট করবেন?’
‘ভেরি ট্যালেন্টেড ইঞ্জিনিয়র, ইমোশানাল, কিছুটা ইমপ্র্যাকটিকাল, ব্যবসা ব্যাপারটা খুব একটা বুঝত না, কিন্তু আদ্যোপান্ত সৎ, পরোপকারি। এমন একটা ছেলেকে কে মারতে পারে আমি জানি না।’
সৈকতকে খুন আর আপনাকে খুনের চেষ্টা, এই দুইএর মধ্যে কি কোনও যোগাযোগ থাকতে পারে?’
প্রশ্নটা শুনে অসীম দত্তকে বিভ্রান্ত দেখাল। খানিকটা চুপ করে থেকে তিনি বললেন, ‘যোগাযোগ যে থাকতে পারে এটা আমার মাথাতেই কখনও আসেনি। আমার ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি সকলেই আমার মৃত্যুতে লাভবান হবে। আমার কিছু বিজনেস রাইভালও আছে। আমি মারা গেলে তাদেরও লাভ। এদের কেউ আমার মৃত্যু চাইতেই পারে। কিন্তু এরা তো সৈকত চৌধুরিকে চেনেই না। আমার মনে হয় না দুটো ঘটনার মধ্যে কোনও সম্পর্ক আছে।’
‘আমি আপনার ব্যাপারটায় এক্ষুনি আসছি। তার আগে সৈকত চৌধুরির ব্যাপারে একটা শেষ প্রশ্ন। মণিময় গুপ্ত এখন কোথায় আছে, জানেন?’
‘আমি যদ্দুর জানি, মণিময় এখন ল্যাটিন অ্যামেরিকায় ঘুরছে। ঠিক কোথায় ঘুরছে আমি জানি না। সম্ভবত কেউই জানে না। মণিময় একটু খেপাটে লোক। ভ্রমণটাই ওর একমাত্র নেশা। ও যখন পাহাড়-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়, সভ্য জগতের সঙ্গে ওর কোনও সম্পর্কই থাকে না।’
আদিত্য খানিকক্ষণ চুপ করে রইল, যেমন হাওয়া দিক পরিবর্তনের আগে থমকে যায়। তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘এবার আপনার সমস্যাটাতে আসা যাক। প্রথমে আপনার পরিবারের সদস্যদের দিয়ে শুরু করি। আপনার পরিবারে কে কে আছেন?’
‘আমার স্ত্রী চব্বিশ বছর আগে মারা গেছেন। তিন ছেলেমেয়েদের কেউই তখনও দাঁড়ায়নি। তাদের কথা ভেবে আমি আর বিয়ে করিনি। এখন আমার পরিবার বলতে রয়েছে আমার এক মেয়ে, দুই ছেলে, এক জামাই, দুই বউমা, আর নাতি-নাতনি।’
‘তাঁরা কী করেন, কোথায় থাকেন, একটু ডিটেলে বলবেন?’
‘হ্যাঁ। আমার বড় ছেলে সবার বড়। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। আগে আমার কোম্পানিতেই ছিল। কিছুদিন হল নিজের কোম্পানি শুরু করেছে। ওর বউ কিছু করে না, হাউস ওয়াইফ। একটাই ছেলে ব্যাঙ্গালোরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। আমার বড় ছেলেরা থাকে রাজারহাট নিউ টাউনে।
‘সন্তানদের মধ্যে আমার মেয়ে দ্বিতীয়। তার স্বামী মিলিটারিতে ছিল, এখন রিটায়ার করেছে। ওরা এয়ারপোর্টের কাছে ভি আই পি রোডের ওপরে একটা গেস্ট হাউস চালায়। ওখানেই থাকে। ওদের একমাত্র মেয়ে দিল্লিতে চাকরি করে।
‘আমার ছোট ছেলে ভাইবোনদের মধ্যে সব থেকে ছোট। লেখাপড়ায় সব থেকে ভাল। বড় ছেলেকে যেমন পয়সা দিয়ে পড়াতে হয়েছে, ছোট ছেলেকে তা নয়। ও নিজের মেরিটে আইআইটি এবং পরে আইআইএম-এ পড়েছে। এখন একটা মাল্টিন্যাশানালে চাকরি করে। আপাতত বম্বেতে পোস্টেড। আলিপুরেও একটা ফ্ল্যাট আছে। একটা বিয়ে করেছিল। বনিবনা হয়নি। বউমা স্বামীকে ছেড়ে কলকাতায় চলে এসেছে। বাপের বাড়িতে থাকে। তবে ডিভোর্সটা এখনও হয়নি। ভাগ্যিস ছেলেপুলে নেই। আমার ছোট ছেলে কিন্তু একটু ডিফিকাল্ট চরিত্রের। আমার সঙ্গেই খুব একটা বনে না। কারোর সঙ্গেই বনে না। বউমার সঙ্গে কী করে বনবে? আমার ছোট বউমাকে আমি খুব পছন্দ করি। আমার মনে হয়, বউমার সত্যিই কোনও দোষ নেই। আমার ছোট ছেলের সঙ্গে বসবাস করা প্রায় অসম্ভব।
‘তা এই আমার পরিবার। এরা সকলেই আমার জন্মদিন উপলক্ষে গোল্ডেন স্যান্ডে আসছে। আমার নাতি-নাতনিরাও আসছে। ছোট বউমাকেও আসতে বলেছি,অফিশিয়ালি সে তো এখনও আমাদের পরিবারের সদস্য। ওখানে একটা ফ্যামেলি গেট টুগেদার হবে। পুরোটাই আমার নাতি আর নাতনির আইডিয়া।’
‘আপনার অবর্তমানে আপনার সম্পত্তি কীভাবে ভাগ হবে?’
‘মূল সম্পত্তি মেয়ে এবং ছেলেদের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ হবে। নাতি এবং নাতনিও আলাদা করে কিছু পাবে। আর ছোট বউমার জন্যেও কিছু টাকা রেখেছি। মেয়েটা খুব দুঃখী।
‘তবে ছোট ছেলে যদি আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেই যায়, তাহলে ঠিক করেছি তার অংশটা পুরোটাই ছোট বউমাকে দিয়ে দেব। সেটা আমি আমার ছোট ছেলেকে বলেও দিয়েছি।’
‘আপনার কি মনে হয় এরা কেউ সম্পত্তির লোভে আপনাকে খুন করতে পারে?’
অসীম দত্ত অনেকক্ষণ প্রশ্নটার উত্তর দিলেন না। তারপর মৃদুস্বরে বললেন, ‘এ-ব্যাপারে আগ বাড়িয়ে আমি কিছুই বলব না। ওটা বার করা আপনার কাজ।’
‘ঠিক আছে। ফেয়ার এনাফ। আপনি শুধু বলুন, গোল্ডেন রিসর্টে আমি আমার নিজের পরিচয়েই যাব তো? সেটা হলেই আমার ইনভেস্টিগেশনে সুবিধে হবে। আপনি আমাকে ইনট্রোডিউস না করে দিলে আমি কোন পরিচয়ে আপনার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলব?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। আপনি নিজের পরিচয়েই যাবেন। আমিই আপনাকে সকলের সঙ্গে ইনট্রোডিউস করিয়ে দেব। সকলেই জানে আমার ওপর একটা মার্ডার অ্যাটেম্পট হয়েছে। আর একবার হবার সম্ভাবনাও প্রবল। অতএব আমি তো ব্যাপারটা ইনভেস্টিগেট করাতেই পারি।’
‘আর একটা প্রশ্ন। আপনি বলছিলেন আপনার দু-একজন বিজনেস রাইভাল আছে যারা আপনার মৃত্যুতে উপকৃত হতে পারে। তারা কারা?’
‘দেখুন ব্যবসা করতে গেলে কিছু রাইভালরি তো থাকবেই। তবে তার জন্যে আমাকে একেবারে খুন করে ফেলবে, এটা মনে হয় একটু ফার ফেচেড। আমি তখন বলার ঝোঁকে বলে ফেললাম, কিন্তু ওটা আপতত বাদ দিন।’
‘তবু নামগুলো যদি বলেন, আমি নোট করে রাখব। কে জানে কখন কাজে লেগে যায়।’
‘ঠিক আছে। আপনি যখন ইনসিস্ট করছেন। মুখার্জী অ্যাসোসিয়েটস আর মুনশাইন বিল্ডার্স আপনি এই দুটো নাম নোট করে রাখুন। সল্ট লেক সেক্টর ওয়ানে দুজনেরই অফিস। ঠিকানাটা আপনাকে বার করে নিতে হবে।’
‘আর একটা কথা। আপনার কেসটা পুলিশ থেকে কে ইনভেস্টিগেট করছে জানেন?’
‘যতদূর মনে পড়ছে বালিগঞ্জ থানার একজন সাব-ইন্সপেক্টার, পদবিটা সম্ভবত মাজি। নামটা মনে পড়ছে না।’
‘ওতেই হবে। বাকিটা আমি বার করে নেব।’
আদিত্য ঘড়ির দিকে তাকাল। পৌনে নটা। সে অসীম দত্তর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আজ তাহলে এই অবধি থাক। আমি এখন উঠি। পরে যোগাযোগ করব।’
‘দাঁড়ান, একটু দাঁড়ান। আপনার ইমেল অ্যাড্রেস এবং ব্যাঙ্ক ডিটেলটা আমার লাগবে। আর আপনার গিন্নির নাম। ও হ্যাঁ, আপনাদের বয়েসটাও লাগবে। আমার সেক্রেটারি আপনাদের এয়ার টিকিট দুটো মেল করে দেবে। আর অ্যাডভান্স হিসেবে কিছু টাকা আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে দিতে বলছি। পরে আপনার বিল থেকে ওটা অ্যাডজাস্টেড হবে।’
‘ঠিক আছে। আমি আপনাকে আমার ইমেল আই ডি এবং ব্যাঙ্ক ডিটেলটা বাড়ি ফিরে টেক্সট করে দিচ্ছি। আজ তাহলে চলি?’
‘আসুন। আর হ্যাঁ, একটা কথা। যদি সমস্ত সাবধানতা সত্ত্বেও আমি খুন হয়ে যাই, আমার মতে যার সম্ভাবনা যথেষ্টই রয়েছে, তাহলে আপনার ওপর নির্দেশ রইল খুনিকে আপনি অবশ্যই খুঁজে বার করবেন। না হলে আমি মরেও শান্তি পাব না।’
আদিত্য বাইরে এসে দেখল ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। তার সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। এই ফেব্রুয়ারির শেষে বৃষ্টি হওয়াটা স্বাভাবিক নয়। হাওয়া আপিস নিশ্চয় বলবে বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ। মোবাইলটা সাইলেন্ট মোডে ছিল। কেয়া অনেকগুলো ফোন করেছে। আদিত্যর দেরি দেখে নিশ্চয় চিন্তা করছে। এই জিনিসটার সঙ্গে আদিত্য এখনও ধাতস্থ হয়নি। কিছুদিন আগেও সে মুক্ত বিহঙ্গের মতো চলাফেরা করত। আদিত্য কেয়াকে ফোন করে জানাল সে সদ্য ক্লায়েন্টের বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। বাড়ি ফিরতে আরও ঘন্টা খানেক।
বালিগঞ্জ সারকুলার রোড ধরে আদিত্য ফাঁড়ির দিকে হাঁটছিল। রাস্তায় বাস, ট্যাক্সি কিচ্ছু নেই। সঙ্গে ছাতাও নেই। বৃষ্টির বেগ আস্তে আস্তে বাড়ছে। ফাঁড়ি যখন পৌঁছল তখন সে বেশ ভিজে গেছে। দমকা হাওয়ায় ঈষৎ কাঁপুনি লাগছিল। ফাঁড়ির মোড়ে কয়েকটা খালি ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে রয়েছে।
ট্যাক্সিতে উঠে আদিত্য অসীম দত্তর শেষ কথাগুলো ভাবছিল। অসীম দত্ত মনে করছে সব প্রিকশান সত্ত্বেও সে খুন হয়ে যেতে পারে? কেন? সে কি তাহলে সব কথা খুলে বলছে না? খুনি কি তাহলে তার খুব কাছের কেউ?