সৈকত রহস্য – ৪
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
(১)
বালিগঞ্জ থানা আদৌ বালিগঞ্জে নয়, বেলতলা রোডে, বেলতলা মোটর ভিকিলস আপিসের গায়ে। বেলতলা রোডের একদিকের মুড়োটা শরৎ বোস রোড থেকে বেরিয়েছে। সেই মুড়ো ধরে কয়েক মিনিট হাঁটলেই থানা। জায়গাটা বালিগঞ্জের চাইতে ভবানীপুরের কাছাকাছি।
আগের দিন অসীম দত্তর বাড়ি পৌঁছতে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল, তাই আজ আদিত্য হাতে সময় রেখে বেরিয়েছে। শরৎ বোস রোড দিয়ে একটাই মিনি যায়, কোনও কারণে আজ সেটা বন্ধ। তাই গতকাল যে রুটের মিনিবাসটা ধরে অসীম দত্তর বাড়ি গিয়েছিল, বিবাদী বাগ থেকে আজও সেটাই ধরল আদিত্য। আপিস যাত্রীদের উল্টো পথ বলে বাসে মোটেই ভিড় নেই। বালিগঞ্জ সারকুলার রোডে ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজের উল্টোদিকে নেমে, রাস্তা পেরিয়ে, কলেজের পাশ দিয়ে ঢুকে, বালিগঞ্জ গভরমেন্ট ইস্কুলের ধার ঘেঁষে সে যখন বালিগঞ্জ থানার সামনে পৌঁছল তখনও হাতে প্রায় আধ ঘণ্টা সময় রয়েছে। তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট বেলা এগারোটায়।
মোটর ভিকিলস আপিসের সামনে বেশ ভিড়। কেউ লাইসেন্স রিনিউ করতে এসেছে, কেউ এসেছে নতুন লাইসেন্স নিতে। কারও গাড়ি পুলিশ আটকে রেখেছে, জরিমানা দিয়ে ছাড়াতে হবে, আবার কেউ কেউ মোটর বাইকের ড্রাইভিং টেস্ট দেবার জন্য অপেক্ষা করছে। আদিত্য আড়ি পেতে লোকজনের কথাবার্তা শুনছিল। সবার ওপরে অবশ্য দালালদের ভিড়। এখানে তাদেরই রাজত্ব। দালালদের টপকে কিছুই হবার উপায় নেই। আদিত্য রাস্তার ধারে একটা চায়ের দোকানে বসে রাস্তা দেখতে দেখতে চা খাবে ভেবেছিল। কিন্তু এখানে শান্তিতে বসে চা খাবার জো আছে! তিন মিনিটের মধ্যে চার-পাঁচজন দালাল এসে তাকে জিজ্ঞেস করে গেল তার কী চাই— লাইসেন্স রিনিউয়াল নাকি ট্যাক্স টোকেন রিনিউয়াল নাকি অন্য কিছু? কয়েক চুমুকে ভাঁড়ের চা-টা শেষ করে আদিত্য উঠে দাঁড়াল। এখানে বসে বসে উত্যক্ত হবার থেকে থানার ভেতরে গিয়ে অপেক্ষা করা ভাল। এগারোটা বাজতে এখনও মিনিট কুড়ি বাকি।
বালিগঞ্জ থানার ইন্সপেক্টার মাজির পুরো নাম সুভদ্র মাজি। সে থানাতেই ছিল। বলতে গেলে আদিত্যর জন্যই অপেক্ষা করছিল। তার সঙ্গে দুএকটা কথা বলেই আদিত্যর মনে হল সুভদ্র সার্থকনামা পুরুষ। বস্তুত, ওরকম ভদ্র, মার্জিত পুলিশ আদিত্য খুব বেশি দেখেনি। এটা ঠিক যে, আদিত্য মজুমদারকে যেন সাধ্যমতো সাহায্য করা হয় এই মর্মে লালবাজার থেকে একটা ফোন বালিগঞ্জ থানায় গিয়েছিল। তাই বালিগঞ্জ থানার থেকে আদিত্য কোনও বৈরিতা আশঙ্কা করছিল না। কিন্তু সুভদ্র মাজি যেরকম মার্জিতভাবে আদিত্যকে আপ্যায়ন করল তাতে আদিত্যর মনে হল পুলিশ নয় সে কোনও সাহিত্যের অধ্যাপকের সঙ্গে কথা বলছে।
‘লালবাজার থেকে ইন্সপেক্টার সিকদার ফোন করেছিলেন। বললেন, আপনি অসীম দত্তর কেসটা তদন্ত করছেন। আপনাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করতে বললেন।’ সুভদ্র মাজি জানাল।
‘আমি একটু আগে আগে এসে পড়েছি। আপনার অসুবিধে হবে না তো?’ আদিত্য বিনীতভাবে বলল।
‘না, না। অসুবিধে কীসের? আমি তো আপনার জন্যেই বসে আছি। সিকদার সাহেব ফোন না করলেও কোনও অসুবিধে ছিল না। আপনি এসে শুধু নিজের পরিচয়টা দিলেই হত। কলকাতা পুলিশ মহলে আপনার কথা জানে না, এমন কেউ নেই।’
আদিত্য লজ্জা পাচ্ছিল। আবার একই সঙ্গে এসব কথা শুনলে তার বুকের মাঝখানে ছেলেমানুষের মতো একটা অনুভূতি হয়। সেই অনুভূতিকে আনন্দই বলতে হবে। সে জীবনে যা যা করতে চেয়েছিল কোনওটাই হয়নি। লেখাপড়া, গানবাজনা কোনওটাই নয়। এ-নিয়ে তার দুঃখও কম নেই। কিন্তু গোয়েন্দাগিরি, সে যেটা করার কথা স্বপ্নেও ভাবেনি, পেটের দায়ে তাকে যেটা করতে হচ্ছে, সেটাও যদি ভাল করে হয়, মন্দ কী?
আদিত্যকে অন্যমনস্ক দেখে সুভদ্র মাজি খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ‘আদিত্যবাবু আমি আপনাকে বিব্রত করতে চাইনি। আপনি বসুন। একটু চা আনতে বলি।’
চায়ে আদিত্যর কখনোই আপত্তি নেই। বিশেষ করে আগের চা-টা মোটেই জুত করে খেতে পারেনি। সে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।
কেটলিতে চা এসেছে, সঙ্গে ভাঁড়, দিশি বিস্কুট। আদিত্য চায়ের ভাঁড়ে চুমুক লাগিয়ে বলল, ‘অসীম দত্তর কেসটা কিছু বুঝতে পারলেন?’
‘বুঝতে পেরেছি বললে মিথ্যাভাষণ হবে। যতদূর মনে হচ্ছে অসীমবাবুর কোনও নিকট আত্মীয়ই এর পেছনে আছে। কিন্তু কে সেটা এখনও ধরতে পারিনি। এদের প্রত্যেকের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। এদের সম্বন্ধে যতটা জানতে পেরেছি ফাইলে নোট করে রেখেছি। আপনি যদি অসীম দত্তর ফাইলটা দেখেন তাহলে বুঝতে পারবেন আমি কতটা জানতে পেরেছি। অবশ্য ওই ফাইলে চরিত্রগুলির সম্বন্ধে আমার ব্যক্তিগত কিছু ইম্প্রেশনও নোট করা আছে। আপনি চাইলে ওটুকু অনায়াসে বাদ দিয়ে দিতে পারেন।’
‘বাদ দেব কেন? আপনার ধারণাগুলো তো আমি জানতেই চাই। ফাইলটা পেলে আমার খুব উপকার হবে।’ আদিত্য কৃতজ্ঞস্বরে বলল। ‘আর যদি দুটো সাদা পাতা পাওয়া যায় খুব ভাল হয়। একটু নোট নিতে পারি। আর একটা বসে লেখার জায়গা। খুব বেশি চেয়ে ফেলছি বোধহয়?’
‘মোটেই না, মোটেই না। আপনি এখানে একটু বসুন, আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। বড়বাবু আমার ওপর নির্দেশ দিয়ে গেছেন, আপনার যা যা দরকার সব কিছুর ব্যবস্থা করে দিতে। বড়বাবু বেরিয়েছেন, ফিরতে দেরি হতে পারে। তাই এই নির্দেশ। আপনার সঙ্গে দেখা করা হল না বলে ক্ষমাও চেয়ে গেছেন।’
‘বড়বাবুকে আমার নমস্কার জানাবেন। বলবেন, আর একদিন এসে তাঁর সঙ্গে আলাপ করে যাব। আপনি ব্যবস্থা করুন, আমি দু-মিনিটের মধ্যে বাইরে থেকে একটা সিগারেট খেয়ে আসছি।’
‘আপনাকে কষ্ট করে বাইরে যেতে হবে না। থানার ভেতরে একটা বারান্দা আছে। একজোড়া চেয়ার-টেবিলও আছে সেখানে। আমি ওখানেই আপনার কাজ করার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আপনি ওখানে ধূমপানও করতে পারেন।’
ফাইলটা ইংরেজিতে। আদিত্য পড়ছিল আর কাগজে ইংরেজিতেই নোট নিচ্ছিল। তার বাংলা করলে ব্যাপারটা এই রকম দাঁড়ায় :
গত জানুয়ারি মাসের তিন তারিখ বিকেল তিনটে চল্লিশ মিনিটে ২৭/১/এফ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে অবস্থিত ‘আবাসিকা’ নামক বহুতলের ৩০১ নম্বর ফ্ল্যাটের মালিক (তিনতলার দক্ষিণ দিকের ফ্ল্যাট) অসীম দত্ত বাড়িতে ঢোকার সময় বাড়ির মূল ফটকের সামনে গুলিবিদ্ধ হন। বুক-পকেটে রাখা মোবাইল ভেদ করে গুলিটি তাঁর শরীরে প্রবেশ করতে পারেনি। তাই তিনি প্রাণে বেঁচে যান। গুলিটি .৩২ ক্যালিবারের স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন রিভলভার থেকে ছোঁড়া হয়েছিল। রিভলভারটি আনুমানিক ১৯৫২/৫৩ সালে তৈরি। সাধারণত অল্প দূরত্বে এই অস্ত্র বেশ কার্যকরী। কিন্তু এই ধরনের রিভলভারের রেঞ্জ খুব বেশি হবার কথা নয়। তাই দূর থেকে ছোঁড়া হয়েছিল বলেই হয়তো গুলিটি তার গতিবেগ হারায় এবং সেই কারণে অসীম দত্তর বুক-পকেটে রাখা মোবাইল ভেদ করে সেটি আর এগোতে পারেনি।
প্রাথমিক তদন্তে মনে হয়, অসীম দত্তর নিকট আত্মীয়দের কেউ এই হত্যার চেষ্টা করেছিল। অসীম দত্ত এবং তাঁর নিকট আত্মীয়দের সংক্ষিপ্ত বিবরণ নীচে দেওয়া হল।
অসীম দত্ত— কনস্ট্রাকশন এবং সিভিল ওয়ার্ক-এর ব্যবসা। বয়েস ছেষট্টি। বিপত্নীক। চব্বিশ বছর আগে স্ত্রী মারা গেছেন। একা থাকেন। তাঁর কম্পানি অনেক বাড়ি, রাস্তা, ব্রিজ, ফ্লাইওভার ইত্যাদি বানিয়েছে। সম্প্রতি অসীম দত্ত পুরী এবং কোনারকের মাঝে একটা লাক্সারি রিসর্টও বানিয়েছেন। রিসর্টটি তাঁর কোম্পানিই চালাবে। খুব শিগগির রিসর্টটি উদ্বোধন করা হবে। স্থাবর অস্থাবর মিলে অসীম দত্তর মোট সম্পত্তি আনুমানিক ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ কোটি টাকা।
অনিকেত দত্ত —অসীম দত্তর জ্যেষ্ঠ সন্তান। বয়েস তেতাল্লিশ। জয়পুরের এক অখ্যাত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বাবার ফার্মে যোগ দেয়। তেরো বছর সেখানে কাজ করার পর বাবার ফার্ম ছেড়ে নিজের ফার্ম খোলে। কেন বাবার ফার্ম ছাড়ল সে ব্যাপারে নানা লোক নানারকম কথা বলছে। অনিকেত নিজে বলছে, বাবার ছত্রছায়ায় না থেকে সে নিজের চেষ্টায় কিছু একটা করে দেখাতে চেয়েছিল। অসীম দত্ত নিজে এই বিষয়ে কিছু না বললেও তাঁর কোম্পানির একাধিক সিনিয়ার অফিসার বলছে, অনিকেত দত্ত বারবার কোম্পানির টাকা-পয়সা নিয়ে গণ্ডগোল করত। শেষে অতিষ্ঠ হয়ে অসীম দত্ত ছেলেকে তাঁর কোম্পানি ছেড়ে চলে যেতে বলেন। অনিকেতের নিজের কোম্পানি খোলার জন্য টাকাও দেন।
অনিকেত দত্তর কোম্পানি খুব ভাল চলে না। মাঝেমাঝেই তাকে বাবার কাছে এসে হাত পাততে হয়।
অনিকেত দত্ত নার্ভাস স্বভাবের মানুষ। তাড়াতাড়ি কথা বলে। সামান্য তোতলা। তাকে দেখে মনে হয় আত্মবিশ্বাসের অভাব আছে।
ছন্দা দত্ত— অসীম দত্তর পুত্রবধূ, অনিকেত দত্তর স্ত্রী। বয়েস আটত্রিশ। সুন্দরী, কিন্তু বাপের বাড়ির জোর নেই। সম্ভবত অসীম দত্ত গরিব ঘর থেকে সুন্দরী দেখে মেয়ে এনেছিলেন। ছন্দা দত্ত পুরোদস্তুর গৃহবধূ, নিজে কোনও আয় করে না। নিজস্ব কোনও মতামতও নেই। খুবই নিরীহ প্রকৃতির মানুষ, স্বামীর একান্তই অনুগত। সম্ভবত স্বামীর অসাফল্যের আঁচ তার চরিত্রেও লেগেছে। নিজের তৈরি খোলসের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে।
অসীম দত্ত পুত্রবধূকে পছন্দ করেন। পুত্রবধূরও শ্বশুরের ওপর টান আছে।
শুভ্র দত্ত— অনিকেত দত্তর ছেলে, বয়েস কুড়ি। বাবা-মার একমাত্র সন্তান, মধ্যমেধা, টাকা দিয়ে ব্যাঙ্গালোরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। ছোটবেলায় দাদুর খুব নেওটা ছিল। ইস্কুলে পড়ার সময় দাদুর সঙ্গে নিয়মিত মোহনবাগানের খেলা দেখতে যেত, ইডেনে ক্রিকেট খেলা দেখতে যেত। এখনও কলকাতায় এলে দাদুর সঙ্গে অনেকটা সময় কাটায়।
শ্বেতা মল্লিক— অসীম দত্তর মেয়ে। তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে দ্বিতীয়। বয়েস একচল্লিশ। সাহেব পাড়ার এক মিশনারি ইস্কুল থেকে স্কুল লিভিং পাশ করার পর আর লেখাপড়া হয়নি। স্কুল লিভিং পাশ করার আগেই বিয়ে। স্বামী মিলিটারি অফিসার, কোনও একটা পার্টিতে শ্বেতার সঙ্গে আলাপ। শ্বেতা মল্লিকের এক মেয়ে। সে দিল্লির একটা কলেজ থেকে পাস করে দিল্লিরই একটা ইংরেজি কাগজে সাংবাদিকতা করে। শ্বেতা এক সময় শাড়ির ব্যবসা করত। সেটা উঠে যাবার পর এখন স্বামীর সঙ্গে যৌথভাবে এয়ারপোর্টের কাছে একটা যাত্রীনিবাস চালায়। ইনভেস্টমেন্টটা কিছুটা শ্বেতার নিজের, কিংবা বলা যায় তার বাবার, আর বাকিটা শ্বেতার স্বামী, ব্রিগেডিয়ার জয়ন্ত মল্লিকের। শ্বেতার স্বামীই যাত্রীনিবাসটা দেখাশোনা করে। কিন্তু যাত্রীনিবাসের কর্মচারীদের ইম্প্রেশন শ্বেতাই তার স্বামীকে চালায়। তার সঙ্গে কথা বলে ইন্সপেক্টার মাজিরও মনে হয়েছে শ্বেতার প্রবল ব্যক্তিত্ব। কিংবা অন্যভাবে বললে, বেশ জাঁদরেল মহিলা।
স্বামীর সঙ্গে শ্বেতা মল্লিক ভারতের নানা জায়গায় ঘুরেছে। সেই সময়ের তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি।
শ্বেতার দাদা অনিকেত দত্ত এবং অসীম দত্তর সেক্রেটারি চন্দ্রিমা সেন দুজনেই বলছে শ্বেতা তার বাবার কাছে মাঝে মাঝেই টাকা চাইতে আসত। বস্তুত, সে তার বাবাকে টাকার জন্য প্রবল চাপ দিত। কেন তার অত টাকার দরকার পড়ত সেটা কেউই বলতে পারেনি। অসীম দত্ত নিজে এ-ব্যাপারে নীরব।
ব্রিগেডিয়ার জয়ন্ত মল্লিক— অসীম দত্তর জামাই, শ্বেতা মল্লিকের স্বামী। বয়েস চুয়ান্ন। খুবই সফল এবং দক্ষ মিলিটারি অফিসার। একাধিক অ্যাওয়ার্ড পাওয়া। খোলামেলা মানুষ। হাসিখুশি। আবার রেগে গেলে হুঁস থাকে না। একবার ফোর্ট উইলিয়মে এক ঝাড়ুদারের ওপর রেগে গিয়ে তাকে এত জোরে চড় মেরেছিল যে সে প্রায় মারাই যাচ্ছিল। ব্যাপারটা ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হয়। এত রাগী লোক, কিন্তু স্ত্রীর সামনে জুজু।
রিটায়ার করার পর স্ত্রীর সঙ্গে যাত্রীনিবাস চালায়। যুদ্ধের কৌশল যেমন ভাল বুঝত, ব্যবসা ব্যাপারটা তেমনি কম বোঝে।
জয়ন্ত মল্লিকের একটা বিরাট অন্ধকার দিক হল সে প্রচণ্ড মদ্যপ এবং জুয়াড়ি। নিয়মিত রেসের মাঠে যায়। বাজারে তার অনেক ধার।
স্বামীর ধার মেটানোর জন্যেই কি শ্বেতা তার বাবাকে টাকার জন্য চাপ দেয়?
স্বাতী মল্লিক — জয়ন্ত মল্লিক, শ্বেতা মল্লিকের একমাত্র সন্তান। বয়েস তেইশ। দিল্লিতে চাকরি করে। সাংবাদিক। কর্মক্ষেত্রে সুনাম হয়েছে। এখনও বিয়ে করেনি। শোনা গেছে কার সঙ্গে যেন ‘লিভ টুগেদার’ করে।
স্বাতী মল্লিকের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা যায়নি। তার সম্বন্ধে আর কিছু জানাও যায়নি।
মূলত শুভ্র আর স্বাতী, দুই নাতি-নাতনি মিলে গোল্ডেন স্যান্ড রিসর্টে দাদুর ছেষট্টি বছরের জন্মদিন উদযাপন করার একটা প্ল্যান করেছে।
অনির্বাণ দত্ত— অসীম দত্তর কনিষ্ঠ সন্তান। বয়েস পঁয়ত্রিশ। ভাইবোনদের মধ্যে সব থেকে উজ্জ্বল, সব থেকে মেধাবী। বম্বে আই আই টি থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে বি টেক। পরে আমেদাবাদ আই আই এম থেকে ম্যানেজমেন্ট করেছে। কয়েকটা কোম্পানিতে চাকরি করার পর এখন একটা বিদেশি ব্যাঙ্কের পশ্চিমাঞ্চলের কর্ণধার। বম্বেতে অফিস। আলিপুরেও একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিনেছে।
অনির্বাণকে যারা চেনে তারা সকলেই বলে অনির্বাণ মেধাবী কিন্তু অত্যন্ত উদ্ধত এবং দুর্মুখ। বিশেষ করে তার অধস্তনদের জীবন সে দুর্বিষহ করে তুলেছে। তার পরিবারের লোকেরা, অর্থাৎ তার বাবা এবং দাদা-দিদিরা, সকলেই একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছে অনির্বাণের মতো অহঙ্কারী, অসভ্য, দুর্বিনীত এবং সবার ওপরে খারাপ ধরনের মানুষ তাদের পরিবারে আর কেউ নেই। অনির্বাণ মনে করে তার আশেপাশে যারা রয়েছে তারা প্রত্যেকেই তার তুলনায় নিকৃষ্ট এবং কথা বলার অযোগ্য।
পাঁচ বছর আগে অনির্বাণ বিয়ে করেছিল। সম্বন্ধ করা বিয়ে। অসীম দত্তই তার ইস্কুলের বন্ধুর মেয়ের সঙ্গে ছোট ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন। বিয়েটা জমেনি। এখনও ডিভোর্স হয়নি বটে তবে অনির্বাণের স্ত্রী তাকে মুম্বাইতে রেখে কলকাতায় বাপের বাড়িতে ফিরে এসেছে। ছেলেমেয়ে হয়নি। বিয়েটা সম্ভবত এই কারণে ভেঙে গেছে যে অনির্বাণের মতো মানুষের সঙ্গে কারও বসবাস করা সম্ভব নয়। তবু অনির্বাণের স্ত্রী প্রায় দু-বছর চেষ্টা করেছিল। তারপর আর পারেনি। যাতে খোরপোষ দিতে না হয়, অনির্বাণ স্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যাভিচারিতার মামলা করবে বলে শাসিয়েছে। অনির্বাণের স্ত্রীর মামলা লড়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য নেই, অসীম দত্তই তার একমাত্র ভরসা।
অসীম দত্ত অনির্বাণের স্ত্রী দীপশিখার প্রতি সম্পূর্ণ সহানুভূতিশীল। তিনি বলছেন,অনির্বাণ স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করলে তিনি দীপশিখাকে মামলার সময় আর্থিক সাহায্য করবেন।
দীপশিখা মজুমদার দত্ত— অসীম দত্তর ভূতপূর্ব পুত্রবধূ। বয়েস একত্রিশ। স্বামীকে ছেড়ে আসার পর বাপের বাড়িতে থাকে। একটা বেসরকারি স্কুলে পড়ায়। দীপশিখার বাবা, অসীম দত্তর বাল্যবন্ধু, খুবই অসুস্থ। তার চিকিৎসার জন্য যে বিপুল খরচ হয়, দীপশিখার একার পক্ষে সেটা বহন করা ক্রমশই অসম্ভব হয়ে উঠছে। অনুমান, অসীম দত্ত দীপশিখার পরিবারকে নিয়মিত আর্থিক সাহায্য করেন।
নোট নিতে নিতে আদিত্য সুভদ্র মাজির তারিফ করছিল। সে নিজে গিয়ে তদন্ত করলে এর থেকে বেশি কিছু জানতে পারত বলে মনে হয় না।
আদিত্য থানা থেকে বেরিয়ে আসার আগে সুভদ্র মাজি বলল, ‘আপনার ই-মেলটা দেবেন? তাহলে ভবিষ্যতে আরও কিছু তথ্য জানতে পারলে আপনাকে মেল করে দিতে পারি। তাছাড়া আপনার ফোন নাম্বারটা তো রইলই।’
(২)
থানা থেকে বেরিয়ে আদিত্য ভাবল শরৎ বোস রোডে বাসের জন্য অপেক্ষা না করে বরং চক্রবেড়িয়ার ভেতর দিয়ে জগুবাবুর বাজারে পৌঁছে যেতে পারলে ওখান থেকে মেট্রো পেয়ে যাবে। শীত যাই যাই করেও পুরোটা যায়নি। রোদ্দুর এখনও নরম। তার ওপর কাল বৃষ্টি হবার পর মাঝে মাঝে একটা জোলো হাওয়া দিচ্ছে। হাঁটার পক্ষে অতি উত্তম সময়। শুধু বৃষ্টি না নামলেই হল। আদিত্যর সঙ্গে আজও ছাতা নেই।
পুরোনো ভবানীপুর দিয়ে হাঁটতে আদিত্যর ভাল লাগে। বড় বড় প্রাসাদের মতো বাড়ি, তাদের অনেকেই যত্নের অভাবে এখন ভেঙে পড়ছে। মাঝে মধ্যে পুরোনো বাড়ি-ভাঙা দৃষ্টিকটু হাইরাইজ, আদিত্যর মনে হয়, না থাকলেই ভাল হত। দু-একটা বাড়ি ভেঙে প্রোমোটারি চলছে। নতুন শহর এসে পুরোনো শহরটাকে অচিরেই গ্রাস করে ফেলবে।
আদিত্যর যতদূর মনে পড়ছে, চক্রবেড়িয়ার মোড়ে একটা পাঞ্জাবি ধাবা ছিল। সেখানে পৌঁছে দ্যাখে, সেটা এখনও রয়েছে।
চা খাবার উদ্দেশ্যে ধাবার ভেতরে ঢুকেছিল আদিত্য। দেখল সেখানে মধ্যাহ্নভোজন শুরু হয়ে গেছে। খাবারের গন্ধে আদিত্যর নিজেরই খিদে পেয়ে গেল। সে ঠিক করল, দুপুরের খাওয়াটা এখানেই সেরে নেবে।
কাঁচা পেঁয়াজ, কাঁচা লংকা সহ তড়কা রুটি। শেষে টক দই। আদিত্য তৃপ্তি করেই খেল। এবার চা-সিগারেট। ধাবার ভিতরে সিগারেট খাওয়া বারণ। তবে বাইরে বসার জায়গা আছে, সেখানে বসে চা সিগারেট খাওয়া চলবে। সিগারেট ধরিয়ে আদিত্য মোবাইলে বিমলের নম্বরটা লাগাল।
‘কোথায় রয়েছ এখন? একটু দরকার ছিল।’ বিমলের গলার আওয়াজ শুনতে পেয়ে আদিত্য বলল।
‘বাড়িতেই আছি স্যার। আপনার বাড়ি চলে যেতে পারি। যাব?’
‘আমার বাড়িতে আসার দরকার নেই। আমি বাড়িতে নেই। ফোনে বলে দিচ্ছি কী করতে হবে।’
‘বলুন স্যার।’
‘তোমাকে আরও কয়েকবার জামির লেনের ওই বাড়িটাতে যেতে হবে। খোঁজ নিতে হবে অনিতা চৌধুরির বন্ধু কবে অনিতার সঙ্গে দেখা করতে আসে। সম্ভবত কোনও নির্দিষ্ট দিনে আসে না। তাই তোমাকে ওখানে থেকে তার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। তার দেখা পেলে, তার পিছু নিয়ে দেখবে সে কোথায় যায়। সে যখন বাড়ি যাবে তার পেছন পেছন সেই বাড়ি অব্দি পৌঁছবে। বাড়িতে কে আছে খোঁজখবর নেবে। আর মাঝে মাঝে আমাকে রিপোর্ট করবে।’
‘ঠিক আছে স্যার।’
‘আর হ্যাঁ, শোনো। যে কাজটা বললাম সেটা অনেক কাজ। এর জন্যে আরও কিছু টাকা তোমার অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে দেব। আগের টাকাটা পেয়েছিলে তো?’
আদিত্য মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে অসীম দত্তর দেওয়া অ্যাডভান্স এর একটা অংশ দিয়ে আপাতত সৈকত চৌধুরির কেসটার খরচ চালাবে। যাকে বলে ক্রস সাবসিডাইজেশন। অসীম দত্তর কেসটা হাতে না এলে বোধহয় সৈকত চৌধুরির কেসটা ছেড়েই দিতে হত।
বিল মিটিয়ে আদিত্য উঠে পড়তে যাচ্ছিল। হঠাৎ তার ফোনটা বেজে উঠল।
‘আমি প্রদীপ চক্রবর্তী বলছি। অনিতা চৌধুরির পড়শি। মনে আছে? সেদিন আপনি আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন?’ ওপার থেকে শোনা গেল।
‘অবশ্যই মনে আছে। বলুন কী ব্যাপার।’ প্রদীপ চক্রবর্তীর কাছ থেকে ফোন পেয়ে আদিত্য একটু অবাকই হয়েছে।
‘কিছু কথা আপনাকে বলার ছিল যেগুলো সেদিন বলা হয়নি। আসলে সেদিন আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না কথাগুলো আপনাকে বলা ঠিক হবে কিনা। আপনি চলে যাবার পর অনেক ভাবলাম। আমার স্ত্রীর সঙ্গেও পরামর্শ করলাম। মনে হল, কথাগুলো আপনাকে জানানো দরকার। আমার স্ত্রীও তাই বলল। তারপর অনিতার কাছ থেকে আপনার ফোন নম্বর নিয়ে আপনাকে ফোন করছি।’
‘বুঝতে পারছি। তা কবে দেখা হলে আপনার সুবিধে হবে?’
‘আগামীকাল হতে পারে কি? আসলে, পরশু মানে শুক্রবার থেকে কয়েকদিন আমরা একটু ব্যস্ত হয়ে পড়ব। তার আগে হলে ভাল হয়। মাঝে তো একটাই দিন। বেস্পতিবার।’
আদিত্যর মনে পড়ে গেল আগামীকাল, অর্থাৎ বেস্পতিবার, সকালে অচিন্ত্য সাহার সঙ্গে মণিময় গুপ্তর বাড়িতে যাওয়ার কথা। ওখানে কতক্ষণ লাগবে কে জানে! বেস্পতিবার অন্য কোনও কাজ না রাখাই ভাল।
সে বলল, ‘বেস্পতিবারটা একটু অসুবিধে আছে। আর আপনারা তো শুক্রবার থেকে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন বলছেন। সেক্ষেত্রে আজই করতে হবে। আমি এখন ভবানীপুর অঞ্চলে রয়েছি। আপনাদের অসুবিধে না হলে আধঘণ্টার মধ্যে আপনাদের বাড়ি পৌঁছে যেতে পারি।’
‘আপনি যদি আজই আসেন তাহলে তো খুবই ভাল হয়। এখন এলে আমাদের কোনও অসুবিধেই নেই। আসলে রাখি, মানে আমার স্ত্রী, এত অসুস্থ থাকে যে ওকে একা বাড়িতে রেখে বেশিক্ষণ বাইরে থাকতে পারি না। নাহলে আমিই আপনার কাছে চলে যেতাম।’
‘তাহলে ওই কথাই রইল। আমি আধঘণ্টার মধ্যে আপনাদের বাড়িতে পৌঁছে যাচ্ছি।’
‘একটা জিনিস। এই ব্যাপারটা আমি কিন্তু অনিতাকে কিছু বলিনি। আমার কথাগুলো শুনলেই আপনি বুঝতে পারবেন কেন বলিনি। অনিতার কাছ থেকে আপনার ফোন নম্বরটা নেবার সময় বলেছি আমার এক বন্ধুর নম্বরটা দরকার।’
‘আপনাদের বাড়িতে ঢোকার সময় অনিতা যদি আমাকে দেখতে পায়?’
‘অনিতা বাড়িতে নেই। সন্ধের আগে ফিরবে না।’
আদিত্যর আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে বৃষ্টি নামল। ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে আদিত্য দোকান থেকে বেরিয়ে পড়তে যাচ্ছিল। আবার দোকানে ঢুকে পড়তে হল। বেশ জোরে বৃষ্টি পড়ছে। পুরোনো বাড়ির ওপর বৃষ্টি পড়লে তাদের খুব রহস্যময় দেখায়। একটা ষাঁড় রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে নির্বিকারভাবে ভিজে যাচ্ছে। হয়তো ভিজতে ওর ভালোই লাগছে। দুটো কাক ছাদের কার্নিশে বসে ঠোঁট দিয়ে পালক পরিষ্কার করছে। উল্টোদিকের বাড়িতে বেশ শব্দ করে একটা জানালা বন্ধ হল। তারপর আর কোনও শব্দ নেই। শুধু বৃষ্টির ঝুপঝুপ শব্দ। আদিত্যর সিগারেট ধরাতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু দোকানের ভেতরে সিগারেট খেতে দেয় না।
মিনিট দশেক পরে যখন বৃষ্টির বেগ কমল তখন রাস্তার ধারে একটু একটু জল জমতে শুরু করেছে। আদিত্য আর অপেক্ষা না করে জোরে হাঁটা লাগাল। বৃষ্টি এখনও পুরো থামেনি। নেতাজি ভবন স্টেশনে পৌঁছতে পৌঁছতে আদিত্য বেশ ভিজে গেছে। স্টেশনে ঢোকার আগে আদিত্য রাস্তার ধারের একটা দোকান থেকে একটা ফোল্ডিং ছাতা কিনে ফেলল। বলা যায় না, আবার যে কোনও সময় বৃষ্টি নামতে পারে।
‘আপনাকে কষ্ট দিলাম বলে ক্ষমা চাইছি। আসলে সেদিন অনিতার সামনে কথাগুলো বলা যেত না।’ প্রদীপ চক্রবর্তী চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে বললেন।
রাখি চক্রবর্তী এ-ঘরে নেই। তিনি পাশের ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছেন। গতকাল একটা কেমোথেরাপি নেবার পর এখন দু-একদিন তাঁর শরীরটা খারাপ থাকবে। প্রদীপ চক্রবর্তী নিজেই চা করে এনেছেন।
আদিত্য কিছু বলল না, উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে রইল।
‘আসলে সেদিন একটা দরকারি কথা বলা হয়নি যেটা অনিতার সামনে বলা যেত না।’
আদিত্য এখনও উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছে।
‘কথাটা সৈকতের লাইফ ইনশিয়োরেন্স করা নিয়ে। আপনি নিশ্চয় জানেন, মারা যাবার কিছুদিন আগে সৈকত পাঁচ কোটি টাকার একটা লাইফ ইনশিয়োরেন্স করেছিল। সৈকত এত টাকার ইনশিয়োরেন্স করতে গেল কেন? আর ইনশিয়োরেন্স করার কিছুদিনের মধ্যেই যখন সৈকত খুন হল, তখন অনিবার্যভাবে প্রশ্ন উঠবে, এর পেছনে কি কোনও ফাউল প্লে আছে?’
‘এই প্রশ্নগুলো নিয়ে আমিও ভেবেছি। এখনও কোনও উত্তর পাইনি। আপনার কাছে যদি কোনও উত্তর থাকে সেটা জানতে পারলে আমার খুবই উপকার হবে।’ আদিত্য এতক্ষণ পরে মুখ খুলল।
‘উত্তর আমার কাছে নেই। হয়তো আমি যেটুকু জানি সেটা বললে উত্তর পাওয়া দূরে থাক ব্যাপারটা আরও ঘেঁটে যাবে। তবু মনে হল, আপনাকে সবটা খুলে বলা দরকার।’
‘বলুন, বলুন। আমি তো শুনতেই এসেছি।’
‘দেখুন, পলিসি করার কয়েকদিন আগে সৈকত আমার কাছে এসে বলেছিল তার কিছু কথা বলার আছে। ব্যাপারটা গোপনীয়। সে আমার পরামর্শ চায়। সৈকতের সঙ্গে সেদিন কী কথা হয়েছিল সেটা এখানে বিশদে বলার দরকার নেই। মোদ্দা কথাটা হল, সৈকত মনে করছিল কেউ তাকে প্রাণে মেরে ফেলতে চায়। দু-দুবার তার ওপর খুনের চেষ্টা হয়েছে। একবার একটা গাড়ি তাকে প্রায় চাপা দিয়ে দিচ্ছিল। আর একবার একটা ছাতের ওপর থেকে কেউ তার মাথায় ভারী লোহা-লক্কড় ফেলার চেষ্টা করেছিল, সে অল্পের জন্যে বেঁচে গেছে। তার মনে হচ্ছিল, শিগগির আবার একটা চেষ্টা হতে পারে। তাই সে একটা খুব মোটা টাকার লাইফ ইনশিয়োরেন্স করতে চায়। যাতে তার কিছু হয়ে গেলে অনিতার কোনও টাকা-পয়সার অসুবিধে না হয়।’
‘কারা তাকে মারতে চায় সে ব্যাপারে কি সৈকতের কোনও ধারণা ছিল?’
সৈকত একেবারে নিশ্চিত ছিল না। তবে তার পার্টনার মণিময় গুপ্তর ওপর তার একটা সন্দেহ ছিল। ডিটেলে সে আমাকে ব্যাপারটা বলেনি, কিন্তু যা আভাস দিয়েছিল তাতে মনে হয় সৈকত মনে করত মণিময় তাকে কোনওভাবে ঠকিয়েছিল। এবং সেটা সৈকত ধরেও ফেলেছিল। ব্যাপারটা জানাজানি হবার আগেই হয়তো তাই মণিময় বা তার লোক সৈকতকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল।’
‘সৈকত যে মণিময়কে সন্দেহ করত সেটা অনিতাও আমাকে বলেছে। তাহলে তার সামনে এইসব কথা বলতে আপনার অসুবিধে কেন?’ আদিত্য সন্দেহের গলায় জিজ্ঞেস করল।
‘আমি তো পুরোটা এখনও বলিনি। সৈকত মণিময় গুপ্তকে যেমন সন্দেহ করত তেমনি ইদানীং অনিতাকেও কিছুটা সন্দেহ করতে শুরু করেছিল। ব্যাপারটা বেশ জটিল। আমি আমার মতো করে যেটুকু বুঝতে পেরেছি, বলছি। কোনও কারণে, কী কারণে আমার জানা নেই, কিছুদিন যাবত সৈকত বেশ ডিপ্রেসড থাকত।’
‘কবে থেকে ডিপ্রেসড থাকত?’
‘একেবারে সঠিক তো বলতে পারব না, মোটামুটিভাবে খুন হবার সাত-আট মাস আগে থেকে সৈকতের ব্যবহারে একটা পরিবর্তন আমরা লক্ষ করেছিলাম। এটা নিয়ে আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অনেকবার কথাও হয়েছিল। সৈকত অনেক চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল, বলা যায় নিজের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল।’
‘তারপর?’ আদিত্য ব্যগ্র হয়ে শুনছিল।
‘আমার ধারণা, সৈকত নিজেকে গুটিয়ে নেবার ফলে অনিতার সঙ্গে তার সম্পর্কটাতেও ধীরে ধীরে চিড় ধরছিল। ঠিক এই সময় অনিতার এক পুরোনো বন্ধু সমীর প্যাটেল অনিতার সঙ্গে যোগাযোগ করে। সে নিজে থেকে যোগাযোগ করে, নাকি অনিতাই তার সঙ্গে যোগাযোগ করে, আমি বলতে পারব না। হয়তো সৈকত মানসিকভাবে দূরে সরে যাবার ফলে অনিতাই অন্য কারও অবলম্বন খুঁজছিল। যাই হোক, গত সাত-আট মাসে ওদের সম্পর্কটা মনে হয় অনেকটাই গভীর হয়েছে। সমীর এখনও নিয়মিত এখানে অনিতার সঙ্গে দেখা করতে আসে।’
‘সৈকত কি আশঙ্কা করত অনিতা আর তার বন্ধু সমীর মিলে তাকে খুন করতে পারে?’
‘সৈকত সম্ভাবনাটা একেবারে উড়িয়ে দিত না। এটা নিয়ে ওর সঙ্গে আমার কয়েকবার কথা হয়েছে। সৈকত খোঁজ নিয়ে জেনেছিল এই সমীর প্যাটেল ছেলেটা বিশেষ কিছু করে না। সেক্ষেত্রে সৈকতের অবর্তমানে সে যদি অনিতাকে বিয়ে করতে পারে, তাহলে তো তার একসঙ্গে রাজত্ব এবং রাজকন্যা দুটোই পাওয়া হয়ে যাবে। কোম্পানির অর্ধেক মালিকানা তো সৈকতেরই ছিল, যার একমাত্র ওয়ারিশ অনিতা। এমন হতে পারে, সমীর একাই সৈকতকে খুন করার প্ল্যান করেছিল। তার প্ল্যান সম্বন্ধে অনিতাকে কিছু বলেনি।’
‘আচ্ছা, একটা জিনিস বলুন তো। সৈকত যদি তার বউকে সন্দেহই করবে তাহলে সে ইনশিয়োরেন্স পলিসির বেনিফিশিয়ারি করতে গেল কেন?’
‘এই প্রশ্নটা তো আমার মনেও এসেছিল। প্রশ্নটা আমি সৈকতকে করেও ছিলাম। সৈকত একটা অদ্ভুত উত্তর দিয়েছিল। সৈকত বলেছিল, ইনশিয়োরেন্সের টাকা পাওয়া অত সহজ নয়, বিশেষ করে টাকার অঙ্কটা যখন পাঁচ কোটি। যদি তার কিছু হয়ে যায়, ইনশিয়োরেন্স কোম্পানির ডিটেকটিভ সত্যিটা টেনে বার করবেই। যদি দেখা যায়, অনিতা নির্দোষ, সৈকত তাকে মিথ্যে মিথ্যে সন্দেহ করছে, তাহলে ন্যায়সংগত ভাবেই অনিতা টাকাটা পাবে। আর যদি তা না হয়, তা হলে অনিতাকে তার কৃতকর্মের জন্যে শাস্তি পেতে হবে। সৈকত বলেছিল, আসল সত্যিটা যাতে তার মৃত্যুর পরে ঠিকমতো প্রকাশ পায়, সেই জন্যেই সে পলিসিটা কিনছে।’
‘ভারি অদ্ভুত যুক্তি তো। খুন যে সে হবেই এটা তো সৈকত নিশ্চিতভাবে জানত না। হয়ত যে ঘটনাগুলো থেকে সৈকতের মনে হয়েছিল তাকে খুন করার চেষ্টা করা হচ্ছে, সেগুলো বিশুদ্ধ দুর্ঘটনা। কাকতালীয়। আমি ধরে নিচ্ছি পাঁচ কোটি টাকার পলিসির প্রিমিয়ামটাও অনেক হবে। নেহাত একটা সন্দেহের বশে সৈকত এতগুলো টাকা প্রিমিয়াম দিয়ে যেত?’
‘স্বীকার করছি, এই প্রশ্নের উত্তরটা আমার জানা নেই।’ প্রদীপ চক্রবর্তী আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে বললেন।
‘আচ্ছা, অনিতা কি সৈকতের ইনশিয়োরেন্সের ব্যাপারটা জানত? মানে, সৈকত খুন হবার আগে কি অনিতা জানত তার স্বামী পাঁচ কোটি টাকার একটা ইনশিয়োরেন্স করেছে যার নমিনি সে নিজে?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘অনিতা আমাকে বলেছে সৈকত মারা যাবার আগে সে ইনশিয়োরেন্সের ব্যাপারটা কিছুই জানত না।’
‘অনিতা আমাকেও তাই বলেছে।’ আদিত্য মৃদু স্বরে বলল।
প্রদীপ চক্রবর্তী খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর ধীরে ধীরে বললেন, ‘কিন্তু সৈকত আমাকে বলেছিল সে পলিসির ব্যাপারটা অনিতাকে জানিয়ে দিয়েছে। সেক্ষত্রে প্রশ্ন হচ্ছে অনিতা আমাদের মিথ্যে কথা বলল কেন?’
আদিত্য ঘড়ির দিকে তাকাল। প্রায় চারটে বাজে। সন্ধেবেলা কেয়াকে নিয়ে একটা জায়গায় যেতে হবে। তার মানে এক্ষুনি উঠে পড়া দরকার। সে বলল, ‘প্রদীপবাবু আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার সঙ্গে কথা বলে অনেকগুলো নতুন দিক খুলে গেল। আজ উঠি। একটু তাড়া আছে।’
প্রদীপ চক্রবর্তী বললেন, ‘রবিবার আমরা কয়েকদিনের জন্যে কলকাতার বাইরে যাচ্ছি, তাই জোরাজোরি করে আপনাকে আসতে বললাম। আপনার সঙ্গে কথা বলে খুব স্বস্তি লাগছে।’
‘কোথাও বেড়াতে যাচ্ছেন?’ আদিত্য হালকাভাবে জিজ্ঞেস করল।
‘হ্যাঁ। বেড়াতেই যাচ্ছি। কোথাও তো যাওয়া হয় না। ভাবলাম, কটা দিন সমুদ্রের ধারে ঘুরে এলে রাখির ভাল লাগবে। ওর পরের কেমোটা মাসখানেক বাকি। তার অনেক আগেই চলে আসব।’
‘কোথায় যাচ্ছেন?’ আদিত্য কিছুটা কৌতূহলী।
‘খুব দূরে কোথাও নয়। বাঙালিরা যেখানে যায়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেখানে যাচ্ছে। সেই পুরী।’
‘পুরী?’ আদিত্যর কৌতূহল বাড়ছে।
‘ঠিক পুরী নয়। পুরী আর কোনারকের মাঝামাঝি একটা কোথাও সমুদ্রের ধারে একখানা নতুন রিসর্ট হয়েছে। সেখানে দিন চারেকের জন্য যাচ্ছি।’
‘গোল্ডেন স্যান্ড রিসর্ট?’
‘হ্যাঁ। ওখানেই তো যাচ্ছি। আপনি এটার নাম জানলেন কী করে? অবশ্য মাস দুয়েক ধরে খবর কাগজে এটার খুব বিজ্ঞাপন দিচ্ছে।’
‘আপনি কি কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে ঠিক করলেন এখানে যাবেন?’
‘ঠিক তা নয়। অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম রাখিকে নিয়ে কটা দিন কলকাতার বাইরে ঘুরে আসব। তারপর একদিন কাগজে এই বিজ্ঞাপনটা দেখলাম। ফোন করে খবর নিলাম। ওরা দুজনের জন্যে চারদিনের প্যাকেজের যে দামটা বলল, আমি দেখলাম সেটা দেওয়া আমার ক্ষমতার বাইরে। কথায় কথায় সেটা সৈকতকে বলেছিলাম। সৈকত বলল, আরে এ তো সেই অসীম দত্তর হোটেল। অসীম দত্ত আমার খুব চেনা লোক। দেখি, আপনাদের একটা ডিসকাউন্ট জোগাড় করে দিতে পারি কিনা।
‘পেলেন ডিসকাউন্ট?’
‘না পেলে আর যাচ্ছি কী করে?
‘ওখানে গিয়ে হয়তো দু-একজন চেনাও বেরিয়ে পড়তে পারে।’
‘হ্যাঁ, তা পারে। কলকাতা থেকেই তো বেশিরভাগ লোক যাবে। তার মধ্যে দু-একটা চেনা বেরিয়ে যাওয়া আশ্চর্য কী? তবে আমরা খুব বেশি লোককে তো চিনি না।’
আদিত্য আর কিছু ভেঙে বলল না। বিয়ের পরে সে এই প্রথম বউ নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছে, চেনা লোকের থেকে যতটা লুকিয়ে থাকা যায় ততই ভাল। তবে সত্যিই তারা লুকিয়ে থাকতে পারবে কি?
(৩)
রাত্তিরেও বৃষ্টি হয়েছিল। তার ফলে শীতটা আবার জাঁকিয়ে পড়েছে। আদিত্য একটা হাফ সোয়েটার চাপিয়ে বেরোতে যাচ্ছিল, কেয়ার জোরাজোরিতে একটা পুলওভার পরতেই হল। পুলওভারটা রীতিমতো সৌখিন, সোজা-উল্টো দু’দিকে পরা যায়। বলাই বাহুল্য এটা কেয়াই কিনে দিয়েছে। অত সৌখিন পুলওভার পরে তদন্তে যাবার ব্যাপারে আদিত্যর সংকোচ ছিল। কিন্তু ওটা ছাড়া যে ফুলহাতা সোয়েটারটা আদিত্যর আছে সেটা এতটাই পুরোনো এবং বিবর্ণ হয়ে গেছে যে কেয়া কিছুতেই ওটা পরতে দিল না।
মণিময় গুপ্তর বাড়ি লেক রোডে। রাস্তাটা লেক মার্কেটের গা দিয়ে বেরিয়েছে বটে কিন্তু ওই অঞ্চলে থেমে থাকেনি। প্রথমে খানিকটা সোজা গিয়ে, শরৎ বসু রোড পার হয়ে বাঁক নিতে নিতে বিবেকানন্দ পার্কের পাশ দিয়ে সাদার্ন এভিনিউতে গিয়ে পড়েছে। অচিন্ত্য সাহার ভ্যান দেশপ্রিয় পার্কের উল্টো দিক দিয়ে শরৎ বসু রোডে ঢোকার পর একটু এগোতেই লেক রোডের মোড়টা পেয়ে গেল। সেখান থেকে বাঁ দিকে গেলেও লেক রোড, ডান দিকে গেলেও। বাঁ দিকে বিবেকানন্দ পার্ক, ডান দিকে লেক মার্কেট। যখন তারা দাঁড়িয়ে ভাবছে কোন দিকে যাবে, একটি অল্পবয়সি ছেলে সাহায্যের জন্যে নিজের থেকেই এগিয়ে এসেছে। ঠিকানাটা দেখে সে বলল আদিত্যদের বাঁ দিকেই যেতে হবে। বাঁদিকের রাস্তাটা ডানদিকের তুলনায় অনেক অভিজাত। মিনিট তিনেক গিয়েই রাস্তার ডানদিকে বাড়িটা পাওয়া গেল।
দোতলা বাড়ি। সদ্য রং হয়েছে। একতলায় একটা ফ্র্যাঞ্চাইজি কফিশপ। দু-চারজন হাল ফেশানের যুবক-যুবতী কফি খাচ্ছে। কফিশপের পাশ দিয়ে গেট, গাড়ি ঢোকার রাস্তা, বাড়ির পেছনে যাবার পথ। একতলার পেছন দিকে একটা ফ্ল্যাট আছে, কোলাপসিবল গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলে তার বন্ধ দরজায় ধাক্কা খেতে হবে। বন্ধ দরজার সামনে দিয়ে দোতলার সিঁড়ি উঠে গেছে। কোলাপসিবল গেট দিয়ে ঢোকার মুখে দেয়ালে দুটি নেমপ্লেট। তার একটিতে লেখা এস সুব্রমনিয়ম, গ্রাউন্ড ফ্লোর, অন্যটিতে মণিময় গুপ্ত, ফার্স্ট ফ্লোর। অর্থাৎ পুরো দোতলা জুড়ে একটাই ফ্ল্যাট এবং সেটিতে মণিময় গুপ্ত থাকেন।
ড্রাইভওয়ে দিয়ে পুলিশের গাড়ি ঢুকতে দেখে দারোয়ান এগিয়ে এসেছিল।
‘কাউকে খুঁজছেন স্যার?’ দরোয়ান হাত কচলাতে কচলাতে বলল।
‘মণিময় গুপ্ত তো দোতলায় থাকেন?’ অচিন্ত্য সাহার গলায় পুলিশি ধমক।
‘থাকেন স্যার। কিন্তু এখন তো নেই। জানুয়ারির গোড়া থেকে উনি দেশের বাইরে আছেন।’
‘কোথায় গেছেন কিছু বলে গেছেন?’ আদিত্য স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করল।
‘না স্যার। বলে তো জাননি। উনি মাঝে মাঝেই এরকম চলে যান। কোথায় যাচ্ছেন কিছু বলে যান না। শুধু বলেন দেশের বাইরে যাচ্ছেন, দেড়-দুমাস বাদে ফিরবেন। দুমাস তো প্রায় হতে চলল। এবার মনে হয় ফিরে আসবেন।’
‘ওঁর কোনও ঠিকানা বা ফোন নম্বর দিয়ে গেছেন, যেখানে ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে?’ অচিন্ত্যর গলায় কড়া ভাবটা এখনও যায়নি।
‘না স্যার।’
‘মণিময় গুপ্তর বাড়ির চাবি তোমার কাছে আছে? আমরা বাড়িটা সার্চ করব।’ অচিন্ত্য তীক্ষ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল।
‘চাবি তো আছে, কিন্তু সাহেবকে জিজ্ঞেস না করে কীভাবে দেব? আমার চাকরি চলে যাবে।’
‘শোনো, আমরা গড়িয়াহাট থানা থেকে একটা খুনের মামলার তদন্ত করতে এসেছি। আমাদের সঙ্গে সার্চ ওয়ারেন্ট আছে। দরকার হলে আমরা নিজেরাই দরজা খুলে নিতে পারি। কিন্তু তুমি যদি চাবিটা দিয়ে দাও তাহলে আমাদের কাজটা সহজ হয়ে যায়। আর যদি না দাও তাহলে ধরে নেব তুমি পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতা করছ না। পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতা না করার মানে জান? আমরা তোমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে লক আপ-এও পুরে দিতে পারি।’ অচিন্ত্য সাহা ঠান্ডা গলায় বলল।
দরোয়ান লোকটা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝে উঠতে পারছে না কী করবে। এক দিকে চাকরি যাবার ভয়, অন্য দিকে জেলে যাবার। শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় ভয়টা প্রথমটাকে হারিয়ে দিল।
লোকটা বলল, ‘একটু দাঁড়ান স্যার। পাম্পের ঘরে চাবিটা আছে। আমি নিয়ে আসছি।’
পাম্পের ঘর গ্যারেজের পাশে। পাশাপাশি দুটো গ্যারেজ। একটাতে একটা হন্ডা সিটি দাঁড় করানো আছে। অন্য গ্যারেজটা ফাঁকা। আদিত্য আন্দাজ করল ফাঁকা গ্যারেজটা গ্রাউন্ড ফ্লোরের সুব্রমনিয়মের। তিনি নিশ্চয় গাড়ি নিয়ে কাজে বেরিয়ে গেছেন। হন্ডা সিটিটা মণিময়ের। অনেক দিনের জন্যে বিদেশ গেলে লোকে গাড়ি গ্যারেজে রেখে ট্যাক্সি করে এয়ারপোর্ট যায়।
মণিময় গুপ্তর ফ্ল্যাটটা রীতিমতো বড়, সৈকত চৌধুরির ফ্ল্যাটের প্রায় দ্বিগুণ হবে। আদিত্য ভাবছিল, সৈকত আর মণিময়ের তো একই রকম রোজগার, তাহলে দুজনের জীবনযাত্রায় এত তফাত হয় কী করে? সে অচিন্ত্য সাহাকে বলল, ‘ফ্ল্যাটটা ভাল করে খুঁজলে হয়তো মণিময় কোথায় গেছে তার কিছু হদিশ পাওয়া যাবে।’
সদর দরজা দিয়ে ঢুকেই একটা মস্ত বসার ঘর। এক কোণে পার্টিশানের আড়ালে খাবার টেবিল। তার পাশে একটা রেফ্রিজারেটারও আছে। আদিত্য রেফ্রিজারেটারের দরজা খুলে দেখল সেটা প্রায় ফাঁকা, আলোও জ্বলছে না। তার মানে বাড়ির মালিক রেফ্রিজারেটার খালি করে, তার সুইচ অফ করে দিয়ে চলে গেছে। অর্থাৎ অনেক দিনের জন্যে সে বাইরে থাকার প্ল্যান করেছে। সোফা এবং সেন্টার টেবিলের ওপরে হালকা ধুলো, খাবার টেবিল-চেয়ারের ওপরেও। একটা অস্বস্তিকর ভ্যাপসা গন্ধ হাওয়ায় ভাসছে। দরজা জানলা অনেক দিন ধরে বন্ধ থাকলে ঘরে যেমন গন্ধ হয়। আদিত্য দরজা জানলাগুলো খুলে দিল। দরজা খুললে বারান্দা। আদিত্য বারান্দায় গিয়ে দেখল নীচে ফুটপাতের ওপর ছাতার তলায় কফিশপের খদ্দেররা কফি খাচ্ছে।
বসার ঘর ছাড়াও ফ্ল্যাটে তিনটে শোবার ঘর আছে। তিনটেই তালাবন্ধ। সৌভাগ্যবশত, যে চাবির গোছাটা দারোয়ান দিয়েছিল তাতে তিনটে শোবার ঘরের চাবিই খুঁজে পাওয়া গেল। দুটো শোবার ঘর খুব একটা ব্যবহৃত নয়। হয়তো অতিথি এলে সেখানে তাদের থাকতে দেওয়া হতো। তৃতীয়টা মাস্টার বেডরুম। অন্য দুটোর থেকে অনেকটা বড়। পরিষ্কার বোঝা যায়, এটা মণিময় গুপ্তর শোবার ঘর।
বিছানার ওপর দু-একটা জামাকাপড় ছড়িয়ে আছে। মেঝেতে একটা চেন-খোলা ব্যাগ। সম্ভবত চলে যাবার আগে জিনিসপত্র প্যাক করার সময় ব্যাগটা নামানো হয়েছিল। এই জামাকাপড়গুলোও। শেষ মুহূর্তে এগুলো আর নেওয়া হয়নি। ঘরে দুটো লোহার আলমারি। তাদের চাবি একটা ড্রয়ারের মধ্যে পাওয়া গেল। ভিতরে কিছু কাগজপত্র, মণিময় গুপ্তর নানা পরীক্ষার সার্টিফিকেট, কয়েকটা ড্রয়িং, দুটো পুরোনো অ্যালবাম ছাড়াও কয়েকটা দামি হাতঘড়ি, হ্যাঙারে ঝোলানো স্যুট, টাই এইসব রয়েছে। কিন্তু এমন কিছু নেই যা থেকে মণিময় গুপ্তর বর্তমান ঠিকানাটা পাওয়া যেতে পারে।
শোবার ঘরের সাইড টেবিলে একটা ডেস্কটপ কম্পিউটার আছে। অচিন্ত্য সাহা সেটা চালু করার চেষ্টা করতে গিয়ে হোঁচট খেল। কম্পিউটারটা পাসওয়ার্ড প্রোটেক্টেড।
আদিত্য বলল, ‘দরকার হলে কাউকে দিয়ে এটাকে খুলিয়ে দেখতে হবে ভিতরে কী আছে। তবে এক্ষুনি সেটার দরকার হবে বলে মনে হয় না।’
অচিন্ত্য সাহা ঘাড় নাড়ল। তারপর দেয়ালের সঙ্গে লাগানো ক্লজেটের পাল্লা খুলে বলল, ‘দেখুন, অনেকগুলো হ্যাঙার খালি। মনে হয় এগুলোতে যে জামা-প্যান্ট ঝোলানো ছিল, সেগুলো মণিময় গুপ্ত সঙ্গে নিয়েছে।’
এবার আদিত্য ঘাড় নাড়ল। বসার ঘর, মাস্টার বেডরুম তন্নতন্ন করে খুঁজেও কাজের কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। আদিত্য বলল, ‘চলুন, গেস্ট রুম দুটো আর একবার দেখি। যদি কিছু পাওয়া যায়।’ তার গলায় হতাশা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
‘তার আগে একটু চা খেলে হত।’ অচিন্ত্য সাহা বলল।
‘চা? খেলে তো খুবই ভাল হত, কিন্তু এখানে চা কোথায় পাবেন?’ আদিত্যর গলায় সংশয়।
‘রান্নাঘরে দেখলেন না? তাকে টি-ব্যাগের বাক্স আছে। আর স্টোভের ওপর একটা কেটলিও বসানো আছে। আশা করছি তাঁর টি-ব্যাগের বাক্স থেকে দুটো টি-ব্যাগ নিলে মণিময় গুপ্ত কিছু মনে করবেন না।’
উদ্যোগ নিয়ে অচিন্ত্য সাহাই চা বানাল। রান্নাঘরের শেলফ থেকে দুটো কাপও জোগাড় হল। খাবার টেবিলে বসে চা খেতে খেতে অচিন্ত্য সাহা বলল, ‘আপনার কি মনে হয় মণিময় গুপ্তর সঙ্গে সৈকত চৌধুরি খুন হবার সত্যিই কোনও সম্পর্ক আছে? আমার তো স্যার এখনও মনে হয় ওই বউটাই তার ভালবাসার লোকের সঙ্গে মিলে সৈকতকে সরিয়েছে। মোটিভটা ওরই সব থেকে জোরাল।’
‘অনিতা চৌধুরির মোটিভটা যে খুব স্ট্রং সেটা মানছি। কিন্তু গুপ্ত অ্যান্ড চৌধুরি কোম্পানির স্টাফেদের কথায় মনে হচ্ছে দুই পার্টনারের মধ্যে কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছিল। কী নিয়ে গণ্ডগোল হয়েছিল আমি এখনও জানতে পারিনি। অনিতা চৌধুরিকেও তার স্বামী বলেছিল তার পার্টনার তাকে ঠকিয়েছে। কীভাবে ঠকিয়েছে সেটা অনিতা বলতে পারেনি। আমার মনে হয়, একটু খোঁজখবর করলেই বেরিয়ে পড়বে কী নিয়ে দুই পার্টনারের মধ্যে অশান্তি। কিন্তু তার আগে জানা দরকার মণিময় গুপ্ত কোথায় ঘাপটি মেরে বসে আছে।’
‘কিন্তু সৈকতকে মেরে মণিময় গুপ্তর কী লাভ? সৈকত মারা গেলে কম্পানিতে তার অংশটা তো অনিতা চৌধুরির হাতে চলে যাবে।’
‘না, না, সেটা নয়। হয়ত মণিময় গুপ্ত কোম্পানির হয়ে এমন একটা ট্রানজাকশান করেছিল যেটা বেআইনি আর সেটা সৈকত জানতে পেরেছিল। কিম্বা হয়তো মণিময় গুপ্ত সৈকতকে তার প্রাপ্য থেকে কোনওভাবে বঞ্চিত করেছিল যেটা সৈকত বুঝতে পেরে যায়। আপনি তো সৈকত চৌধুরির বাড়ি গেছেন। সে কীভাবে থাকত আপনি দেখেছেন। তার পাশে যদি এই ফ্ল্যাটটাকে রাখেন তাহলে বুঝতে পারবেন দুজনের লাইফস্টাইলে কতটা পার্থক্য ছিল। এতটা পার্থক্য হল কী করে? মণিময়ের কি তাহলে বেআইনি ইনকাম আছে?’
কথা বলতে বলতে আদিত্য লক্ষ করল অচিন্ত্য সাহার চায়ের কাপটা খালি হয়ে গেছে। সে নিজের কাপের তলানিটা এক ঢোঁকে গিলে নিয়ে বলল, ‘চলুন, ওঠা যাক। গেস্ট রুম দুটো আর একবার খুঁজে আসি।’
মাস্টার বেডরুমের তুলনায় গেস্ট রুম দুটো নিরাভরণ। দুটোতে প্রায় একই রকমের আসবাব। খাট, লেখার টেবিল, চেয়ার, একটা আরাম কেদারা, দেয়ালে লাগানো আয়না, ক্লজেট। তবে একটা ঘরের সঙ্গে সংলগ্ন বাথরুম আছে, আর একটাতে নেই। যে ঘরটাতে সংলগ্ন বাথরুম নেই, আদিত্য লক্ষ করল, সেই ঘরের লেখার টেবিলের ড্রয়ারটা তালাবন্ধ। চাবির গোছার কোনও চাবি দিয়ে ড্রয়ারটা খুলল না। এদিক-ওদিক খুঁজেও ড্রয়ারের কোনও চাবি পাওয়া গেল না।
‘এটা খোলার কোনও ব্যবস্থা করা যায়?’ আদিত্য অচিন্ত্য সাহার দিকে তাকিয়ে বলল।
‘খোলা খুব দরকার?’ অচিন্ত্য সাহা যেন কী একটা বলতে গিয়ে ইতস্তত করছে।
‘আমার মন বলছে এর ভিতরে দরকারি কিছু আছে। না হলে এটা তালাবন্ধ থাকত না। আর থাকলেও চাবিটা যত্ন করে লুকিয়ে রাখা হত না।’
‘তাহলে তো খুলতেই হবে।’
অচিন্ত্য সাহা পকেট থেকে একটা বহুফলাযুক্ত ছুরি বার করল। তারপর মিনিট পাঁচেক ড্রয়ার এবং টেবিল-টপের মধ্যবর্তী অতি সংকীর্ণ ফাঁকটা দিয়ে নানা মাপের ফলা ঢুকিয়ে কসরত করতে করতে হঠাৎ খট করে ড্রয়ারটা খুলে ফেলল।
ড্রয়ারের ভিতরে একটা আই প্যাড। আর একটা খাম। খামের ভিতর মেয়েলি ছাঁদে লেখা একটা চিঠি। লেখিকা লিখছে, গতকাল রাত্তিরের প্রবল ঝড়বৃষ্টির পর মনে হচ্ছে তোমার মোবাইল টাওয়ার এবং ইমেল কানেকশন দুটোই গেছে। তোমাকে মোবাইলে ধরতে পারছি না, ইমেল করে উত্তর পাচ্ছি না। তাই এই চিঠিটা কুরিয়ার করে পাঠাচ্ছি। আশা করছি, পৌঁছবে। বলার কথা হলো, শান্তনু আরও তিনদিন কলকাতায় থাকছে। ফলে আমি চারদিনের আগে নরেন্দ্রপুর যেতে পারছি না। Love and million kisses মালা।
ভাগ্যক্রমে আইপ্যাডটা পাসওয়ার্ড প্রোটেক্টেড নয়। আদিত্য আই প্যাডটা খুলেছে। ফোটোজ-এ ক্লিক করতে গোটা কুড়ি ছবি বেরিয়ে পড়ল। সবই একজন মহিলার। চল্লিশ পেরিয়েছে। সুন্দরী। কিছু ছবি একজন পুরুষের সঙ্গে। তার মধ্যে দু-চারটে ঘনিষ্ঠ হয়ে তোলা সেলফি। আদিত্য আন্দাজ করল পুরুষটি মণিময় গুপ্ত। আদিত্য ছবিগুলো অচিন্ত্য সাহাকে দেখাল।
‘এই মণিময় গুপ্ত তো স্যার বিয়ে-সাদি করেনি। কিন্তু এসব দেখে মনে হচ্ছে লোকটা ডুবে ডুবে জল খেত।’ বেশ কিছুক্ষণ নীরবতার পর অচিন্ত্য সাহার গলা শোনা গেল।
‘হুঁ, তাই তো মনে হচ্ছে।’ আদিত্য ছবিগুলো দেখতে দেখতে অন্যমনস্কভাবে বলল।
‘আই প্যাডটা তো মালিকের অনুমতি ছাড়া আপনি নিতে পারবেন না। তার থেকে আমি ছবিগুলো নিজেকে হোয়াটসঅ্যাপ করে দিচ্ছি। দরকার মতো আপনি আমার কাছ থেকে নিয়ে নেবেন।’ আদিত্য বলল।
আই প্যাডটায় ইন্টারনেট কানেকশান আছে। তাই হোয়াটসঅ্যাপ করা গেল। তবে ইমেলে পাসওয়ার্ড দিয়ে ঢুকতে হয়। ওটাতে ঢোকা গেল না।
‘কুরিয়ারে পাঠানো চিঠিটা দেখুন।’ আদিত্য অচিন্ত্য সাহার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ‘প্রাপকের নাম যদিও মণিময় গুপ্ত, ঠিকানা লেখা আছে ২৪ রাজপুর রোড, নরেন্দ্রপুর, কলকাতা ৭০০১০৩।’
‘তার মানে নরেন্দ্রপুরে মণিময় গুপ্তর আর একটা বাড়ি আছে?’ অচিন্ত্য সাহার গলায় আবিষ্কারের উত্তেজনা।
‘একদম ঠিক ধরেছেন। এবং সেখানে গিয়ে খোঁজ-খবর করলে হয়তো মণিময় গুপ্তর হদিশ মিলতে পারে।’
‘সেখানে কবে যাবেন?’
‘আপনার যদি অসুবিধে না হয় তাহলে আজই, এক্ষুনি যেতে পারি। আমি পরশু একটা কাজে কিছুদিনের জন্যে বাইরে যাচ্ছি। তার আগে এদিকের কাজগুলো যতটা সেরে ফেলা যায় তত ভাল।’
‘আমার কোনও অসুবিধে নেই। আমি থানাতে বলেই এসেছি ফিরতে দেরি হবে। আমরা এখান থেকেই রওনা হয়ে যেতে পারি। কিন্তু এই চিঠির লেখিকা সম্বন্ধে কী যেন বলবেন বলছিলেন?’
‘দেখুন, আমি যেটা বলছি সেটা আন্দাজে বলছি। আমার মনে হচ্ছে, এই মহিলার সঙ্গে মণিময় গুপ্তর একটা নিষিদ্ধ প্রেম আছে, যেটা সবার সামনে প্রকাশ করা যায় না। হয়তো ভদ্রমহিলা বিবাহিত। হয়ত নরেন্দ্রপুরের বাড়িটা ওদের গোপন মিলনের জায়গা।’ আদিত্য সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল।
‘আমরা তো ছবিগুলো দেখিয়ে নীচের ওই দরোয়ানটিকে জিজ্ঞেস করতে পারি সে এই মহিলাকে মণিময় গুপ্তর ফ্ল্যাটে কখনও আসতে দেখেছে কিনা।’
‘অবশ্যই জিজ্ঞেস করতে পারি। তবে আমার স্থির বিশ্বাস দরোয়ান বলবে সে এই মহিলাকে কখনও দ্যাখেনি।’
আদিত্যর অনুমানই ঠিক হল। আদিত্যর হোয়াটসঅ্যাপ থেকে তিন-চারটে ছবি অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার পর দরোয়ান জানাল সে এই মহিলাকে কখনও এই বাড়িতে ঢুকতে দ্যাখেনি। তবে সে জোর দিয়ে বলল পুরুষ মানুষটি অবশ্যই মণিময় গুপ্ত।
‘তবে রাত্তিরে আটটার পরে কেউ এলে আমি বলতে পারব না। আমার ডিউটি সকাল আটটা থেকে রাত্তির আটটা অবধি।’ দরোয়ান সাবধানী গলায় বলল।
‘রাত্তিরের দরোয়ান কত দূরে থাকে?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘অনেক দূরে স্যার। লক্ষ্মীকান্তপুর লাইনে হোগলা বলে একটা স্টেশন আছে। গোচরণের পরের স্টেশন। সেই হোগলায় নেমে সাইকেলে আরও আধঘণ্টা যেতে হয়।’
‘তোমার বাড়ি কোথায়?’ অচিন্ত্য সাহার গলায় সেই পুরোনো ধমক।
‘আমার বাড়ি এই কাছেই। পূর্ণ দাস রোডের একটা বস্তিতে।’
‘আমার মনে হয়, রাত্তিরের দরোয়ানের সঙ্গে কথা বলার জন্যে আর একদিন আসতে হবে। ছবিগুলো আমি আপনাকে পাঠিয়ে দেব। আপনি যদি একবার সময় করে এসে রাত্তিরের দরোয়ানকে দেখাতে পারেন, ভাল হয়। সাউথ ক্যালকাটাটা আমার পক্ষে একটু দূর হয়ে যায়।’ আদিত্য অচিন্ত্য সাহার দিকে তাকিয়ে বলল।
‘সে আমি চলে আসব। গড়িয়াহাট থানা থেকে এটুকু আসতে আর কী এমন কষ্ট। তাহলে এখন কি আমরা নরেন্দ্রপুর রওনা দেব?’
(৪)
মেঘ কেটে গিয়ে রোদ্দুর উঁকি মারছে। অচিন্ত্য সাহার ভ্যান বাইপাসে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে খোলা জানলা দিয়ে হাওয়ারা দৌড়ে এল। হাওয়াদের দাঁত আছে। তারা আদিত্যর মুখে চোখে গলায় কামড়ে ধরছিল। তবু আদিত্যর ভালই লাগছিল। যেন আদরের কামড়। তাই পেছনের সিটে একা বসে দু’দিকের জানলাই সে খোলা রেখেছে। অচিন্ত্য সাহা সামনে, ড্রাইভারের পাশে।
রাস্তার ধারে কোথাও কোথাও চাষি দম্পতি তাদের খেতের সবজি চুবড়ি করে বেচতে বসেছে। ফুলকপি, বাঁধাকপি, সিম, মুলো, টমেটো। আদিত্য রান্না করতে পারে না, কিন্তু টাটকা সবজি দেখলেই তার কিনতে ইচ্ছে করে। কী বিচিত্র রং, কী অপূর্ব রূপ। সবজিগুলোর গায়ে যেন এখনও ভোরের শিশির লেগে রয়েছে। সে একবার ভাবল অচিন্ত্য সাহাকে গাড়িটা থামাতে বলে কিছু সবজি কিনবে। তারপর ভাবল, থাক গে যাক, অচিন্ত্য সাহা কী মনে করবে, দরকার নেই। সে সামনে তাকিয়ে দেখল অচিন্ত্য সাহা নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে।
গাড়ি কামাল গাজির মোড় পেরিয়ে গেল। রাস্তা খানিকটা সরু হয়ে এসেছে। একটু পরেই রাজপুর এসে পড়বে। এখানে কোথাও একটা পাখিরালয় আছে। আদিত্য সেটার কথা শুনেছে কিন্তু কখনও আসা হয়নি। আচিন্ত্য সাহার ঘুম ভেঙে গেছে। সে বাঁ হাত দিয়ে মুখের গড়িয়ে পড়া লালা মুছতে মুছতে বাইরে তাকাচ্ছে। এবার বোধহয় কাউকে ঠিকানাটা জিজ্ঞেস করতে হবে।
বাড়িটা বড় রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা ভেতরে। লোকালয় ছাড়িয়েই বলা যায়। বসতি শেষ হয়ে একটা বড় ফলের বাগান— আমগাছ, লিচুগাছ, কাঁঠাল গাছ। তারপর ধানখেত শুরু হয়েছে। বাড়িটা ফলের বাগান পেরিয়ে ধানখেত শুরু হবার ঠিক আগে। পাঁচিল ঘেরা মস্ত জায়গা, তার মধ্যে বাড়ি। পাঁচিলটা খুব উঁচু নয়। পুলিশের ভ্যান থেকে ভিতরটা খানিকটা দেখা যায়। বাড়িতে ঢোকার মুখে লোহার গেট, তালাবন্ধ। গেটের সামনে দুটো ছেলে বসে গল্প করছিল। পুলিশের গাড়ি দেখে উঠে দাঁড়াল।
‘এই, এটা মণিময় গুপ্তর বাড়ি?’ অচিন্ত্য সাহা জানলা দিয়ে গলা বাড়িয়ে ধমক লাগাল।
ছেলে দুটো পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। মনে হয়, পুলিশ দেখে খানিকটা ঘাবড়ে গেছে। শেষে একজন সাহস করে বলল, ‘আমরা বাড়ির মালিককে চিনি না। আমরা শুধু এখানে বসে গল্প করছি। শিবুকাকা এই বাড়িটা দেখাশোনা করে। উনি বলতে পারবে।’
‘শিবু থাকে কোথায়?’ অচিন্ত্যর হুংকার।
‘ওই তো আমবাগানটা পেরিয়ে। এখান থেকে তিন চার মিনিট। শিবুকাকার নাম শিবপদ।’ এবার অন্য ছেলেটা মুখ খুলেছে।
‘শিবুকাকাকে ডেকে নিয়ে আসতে পারবি? বলবি, পুলিশ এসেছে। বাড়ির মালিককে খুঁজছে। গেটের আর বাড়ির চাবিগুলো যেন নিয়ে আসে। আমরা বাড়ির ভেতরে ঢুকব।’ আদিত্য নরম গলায় বলল।
‘আমরা দুজনেই যাব?’ এবার প্রথম ছেলেটার গলা। একা-একা পুলিশের কাছে বসে থাকতে সে মোটেই রাজি নয়।
‘যা, দুজনেই যা। তবে তাড়াতাড়ি আসবি। আর শিবপদকে যদি বাড়িতে না পাস, এসে বলে যাবি।’ অচিন্ত্য সাহা কিছু বলার আগেই আদিত্য দরাজ গলায় বলল।
মিনিট দশেক হয়ে গেল আদিত্য আর অচিন্ত্য সাহা বসে আছে, কেউ আর আসে না। ছেলে দুটো কি তাহলে কেটে পড়ল? আদিত্য একটা সিগারেট শেষ করে আর একটা ধরাবে কিনা ভাবছে এমন সময় দেখল আমবাগানের দিক থেকে একটা লোক লুঙ্গির কষি আঁটতে অঁটতে ছেলে দুটোর সঙ্গে এদিকে এগিয়ে আসছে। এ-ই নিশ্চয় শিবপদ।
‘তুমি শিবপদ?’ লোকটা কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গে অচিন্ত্য সাহা অবস্থার দখল নিয়ে নিয়েছে।
‘শিবুকাকা চান করতে ঢুকেছিল। তাই আসতে দেরি হয়ে গেল। আমরা বাড়ির বাইরেই বসেছিলুম। কোত্থাও যাইনি।’ শিবপদ কিছু বলার আগেই প্রথম ছেলেটা বলল।
‘আমিই শিবপদ।’ ছেলেটাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে লুঙ্গি পরা লোকটা বলল। ‘কী ব্যাপার দাদাবাবু?’ তার গলায় রীতিমতো উদ্বেগ।
‘তুমি এই বাড়ির কেয়ারটেকার?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ। আমিই এই বাড়িটা দেখাশোনা করি।’
‘বাড়ির মালিক কোথায়?’
‘উনি তো নেই। বাড়ি বন্ধ পড়ে আছে।’
‘মালিকের নাম কী?’
‘মালিকের নাম ঠিকানা এই কাগজটায় লেখা আছে। আমি নাম মনে রাখতে পারি না। তাই মালিককে বলেছি এই কাগজে নাম-ঠিকানা লিখে রাখতে। যদি কখনও দরকার হয়।’ শিবপদ তার ফতুয়ার পকেট থেকে একটা দুমড়োনো কাগজ বার করে অচিন্ত্য সাহার হাতে দিল।
অচিন্ত্য সেটাতে চোখ বুলিয়ে আদিত্যর হাতে দিতে আদিত্য দেখল সেখানে মণিময় গুপ্তর নাম আর তার লেক রোডের বাড়ির ঠিকানা লেখা আছে।
‘মালিক এখানে শেষ কবে এসেছিল?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘ঠিক বলতে পারব না। মাসখানেক হবে। মাস দেড়েকও হতে পারে। আমার ঠিক মনে থাকে না।’
‘যাবার আগে মালিক তোমাকে বলে গিয়েছিল কোথায় যাচ্ছে?’ অচিন্ত্য সাহা জিজ্ঞেস করল।
‘না দাদাবাবু। মালিক কোথায় যাচ্ছে আমাকে কখনোই বলে না। কেনই বা বলবে? মালিক কখনও চাকরকে বলে যায় কোথায় যাচ্ছে? তবে…’
এইটুকু বলে শিবপদ চুপ করে কীযেন ভাবতে লাগল। আদিত্য বলল, ‘তবে কী?’
‘একটা জিনিস আমার বেশ অদ্ভুত লেগেছিল। সব সময় মালিক যাবার আগে আমাকে জানিয়ে যায়। বলে, বাড়িটার ওপর নজর রাখিস, আমি যাচ্ছি। আমি তখন মেন গেটে তালা লাগিয়ে দিই। এবার কিন্তু কিছু না বলেই মালিক চলে গেছে।’
‘তারপর?’ আদিত্য উদগ্রীব হয়ে শিবপদর কথা শুনছে।
‘আগের দিনও মালিকের সঙ্গে কথা হয়েছে। পরের দিন সকালে পৌঁছে দেখি মেন গেট খোলা কিন্তু বাড়িতে ঢোকার দরজাটা বন্ধ। আমি মালিককে ফোন করলাম, কিন্তু ফোনটা বাজল না। আমি অনেকবার বেল বাজালাম, বাড়িতে ঢোকার দরজায় ধাক্কা মারলাম। কোনও সাড়াশব্দ নেই। তখন আমার কাছে বাড়িতে ঢোকার যে চাবিটা থাকে সেটা দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। ঢুকে দেখি কেউ কোত্থাও নেই, বাড়ি ফাঁকা। তার মানে আমাকে না জানিয়েই মালিক চলে গেছে। হয়তো তাড়া ছিল। কিন্তু আমাকে একবার ফোন করে দিলেই তো আমি চলে আসতাম। সেই যে মালিক গেল, তারপর থেকে আর তার কোনও ফোন পাইনি, আমিও তাকে ফোনে ধরতে পারিনি। মালিককে ফোন করলে কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।’
‘তুমি পুলিশকে খবর দাওনি কেন?’ অচিন্ত্য গর্জন করে উঠল।
‘পুলিশকে?’ শিবপদ যেন ঠিক উত্তরটা দিতে ইতস্তত করছে।
‘হ্যাঁ, পুলিশকে। কাউকে কিছু না বলে তোমার মালিক হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল, ফোনেও তাকে ধরা যাচ্ছে না, এই অবস্থায় পুলিশে একটা খবর দেওয়া তোমার উচিত ছিল না কি?’ আদিত্যর গলা খানিকটা মৃদু।
‘দাদাবাবু, আপনারা যখন জানতে চাইছেন তখন সত্যি কথাটা বলতেই হবে। সত্যি কথাটা হল আমার মালিক কোনও ব্যাপারেই পুলিশকে জড়াতে চাইত না। গত বছর এই বাড়িতে একটা বড় রকমের চুরি হয়েছিল। মালিকের একটা দামি ক্যামেরা, গান শোনার যন্ত্র, রান্নাঘরে খাবার গরম করার বাক্স আরও যেন কী কী, সবটা মনে পড়ছে না, চুরি হয়ে গেল। চোরেরা পাঁচিল টপকে এসে সদর দরজার তালা ভেঙে বাড়িতে ঢুকেছিল। পরদিন সকালে ব্যাপারটা আমার চোখে পড়ল। আমি মালিককে টেলিফোন করলুম। মালিক এসে সব দেখে-টেখে যা যা খোয়া গেছে তার একটা লিস্টি করল। তাতেই তো বুঝতে পারলাম কী কী চুরি গেছে। লিস্টি তৈরি হবার পর আমি মালিককে বললাম তাহলে এবার পুলিশে খবর দেওয়া যাক। শুনে মালিক তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। বলল, পুলিশের নাম যেন তার সামনে কখনও না করি। আমিও ঘাবড়ে গিয়ে চেপে গেলাম। তাই এবার যখন মালিক হঠাৎ উধাও হয়ে গেল তখন পুলিশের কাছে যাবার কথাটা আমার মাথায় এলেও সেটা করিনি। পুলিশের কাছে গেলে মালিক ফিরে এসে ভীষণ রাগ করত। তাছাড়া…’ বলে শিবপদ চুপ করে গেল।
পাঁচিলের ভেতরে অনেকটা জমি। বাগান, পুকুর, ফলের গাছ, ব্যাডমিন্টন কোর্ট। মাঝখানে বাড়ি। কথা বলতে বলতে ওরা তিনজন প্রায় বাড়ির সদর দরজার কাছে চলে এসেছে। ছেলে দুটোও পেছন পেছন আসছে।
‘এই, তোদের এখানে কী দরকার? যা, ভাগ।’ শিবপদ পেছন ফিরে ছেলে দুটোকে ধমক লাগাল।
ধমক খেয়ে ছেলেগুলো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে গিয়ে আবার আদিত্যদের পেছন পেছন আসতে লাগল। গ্রামের মানুষদের অদম্য কৌতূহল। আদিত্যর মনে হচ্ছে শিবপদ কী যেন বলতে গিয়েও বলল না। সে শিবপদর দিকে ফিরে বলল, ‘তুমি কী একটা বলতে চাইছিলে না?’
‘না, না। আর কিছু বলতে চাইনি তো।’ শিবপদ রক্ষণাত্মক স্বরে বলল।
‘শোনো শিবপদ। তুমি যদি কোনও দরকারি কথা লুকিয়ে রাখ, পুলিশ সেসব কথা ঠিক টেনে বার করবে। তখন কিন্তু তোমাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।’ আদিত্য ভয় দেখানোর গলায় বলল।
‘ওকে তুলে নিয়ে গেলেই তো হয়। দু-একটা কোঁতকা দিলে পেটের সব কথা হুড়হুড় করে বেরিয়ে পড়বে।’ আচিন্ত্য সাহা আরও সরাসরি পদ্ধতিতে বিশ্বাসী।
কোঁতকার কথা শুনে শিবপদ ভয় পেয়েছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে বলল, ‘ঠিক আছে। বলছি। আমি পুলিশের কাছে আরও যাইনি তার কারণ মেমসাহেব আমাকে পুলিশের কাছে যেতে বারণ করেছিল।’
‘মেমসাহেব! কোন মেমসাহেব?’ অচিন্ত্য সাহা অবাক।
‘ওই যিনি মালিকের সঙ্গে থাকত। মালিক এখানে এলে সাধারণত টানা এক-দেড় মাস থেকে যেত। তখন মেমসাহেব এসে মালিকের সঙ্গে থেকে যেত। মালিক চলে যাবার পরের দিনও মেমসাহেব এসেছিল। এসে শুনল মালিক নেই। শুনে অবাক হয়ে গেল। ওর কথা শুনে মনে হল মালিকই ওকে আসতে বলেছিল। এটা তো তাজ্জব ব্যাপার। মেমসাহেবকে আসতে বলে মালিক নিজেই হাওয়া হয়ে গেল? আমি তখন মেমসাহেবকে বললাম পুলিশে একটা খবর দিই। মেমসাহেব আঁতকে উঠে বলল, না, না। পুলিশকে কিছু জানাবার দরকার নেই। ওরা এসে আরও ঝামেলা পাকাবে। আমিও তাই আর পুলিশকে কিছু বলিনি।’
‘তারপরে আর মেমসাহেবের সঙ্গে দেখা হয়েছিল? মানে উনি আর এখানে এসেছিলেন?’
‘উনি আর এখানে আসেনি। কিন্তু সাহেব ফিরেছে কিনা জানতে চেয়ে মাঝে মাঝে আমাকে ফোন করে।’
‘তোমার কাছে ওনার ফোন নম্বরটা আছে? নম্বরটা আমাদের লাগবে।’
‘আজ সকালেই তো ফোন করেছিল। মোবাইলে নম্বরটা তোলা আছে। আমি ইংরিজি পড়তে পারিনা। মোবাইল দেখে আপনাদের লিখে নিতে হবে।’
শিবপদ ফতুয়ার পকেট থেকে চাবি বার করে সদর দরজাটা খুলতে যাচ্ছিল। ভারী সেগুন কাঠের দরজায় দামি ইয়েল লক বসানো। মনে হয়, বাড়িতে একবার চুরি হয়ে যাবার পর গৃহকর্তা অধিকতর সাবধান হয়েছেন।
আদিত্য হঠাৎ পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে মণিময় গুপ্তর বাড়িতে পাওয়া কয়েকটা ছবি শিবপদকে দেখাল। বলল, ‘ইনিই কি তোমাদের মেমসাহেব?’
শিবপদ ছবিগুলো দেখছে তো দেখছেই। তারপর একসময় সে বলল, ‘হ্যাঁ, ইনিই তো আমাদের মেমসাহেব।’
বাড়ির ভেতরে ঠিক সেইরকম একটা ভ্যাপসা গন্ধ যেমনটা মণিময় গুপ্তর লেক রোডের বাড়িতে পাওয়া গিয়েছিল। বোঝা যায়, বাড়িতে অনেকদিন কেউ বাস করেনি। ঢুকেই বসার ঘর, সেটা পেরিয়ে বাড়ির অন্দরমহলে যেতে হয়। বসার ঘরে একপ্রস্ত সোফা সেট, দুটো আরাম কেদারা, বইএর র্যাকে কিছু বিলিতি বেস্টসেলার, একটা ডিভান। ভেতরে আরও তিনটে ঘর আছে। একটা শোবার ঘর, ডবল খাট, দেয়ালের সঙ্গে লাগানো মস্ত আয়না, একধারে লেখার চেয়ার-টেবিল। আর একটা ঘরে খাবার ব্যবস্থা, খাবার টেবিল-চেয়ার, বড় একটা রেফ্রিজারেটার। তৃতীয়টা রান্নাঘর।
‘একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করেছেন?’ আদিত্য খাবার ঘরে ঢুকে বলল, ‘লেক রোডের বাড়িটার রেফ্রিজারেটারটা বন্ধ ছিল, কিন্তু এই রেফ্রিজারেটারটা চলছে। মানে, লেক রোড থেকে বাড়ির মালিক যখন বেরিয়েছে তখন সে জানত অনেকদিনের জন্যে বাইরে যাচ্ছে। তাই সে রেফ্রিজারেটারটা বন্ধ করে দিয়েছিল। এখানে যখন রেফ্রিজারেটারটা চলছে তখন ধরে নিতে হবে মালিক হয় খুব তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গিয়েছিল, আর নয়তো…’ আদিত্য কথাটা শেষ না করে শিবপদর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি বাড়িতে ঢুকে রেফ্রিজারেটারটা চালিয়ে দাওনি তো?’
‘না, না দাদাবাবু। আমি এসব জিনিসে কখনও হাতই দিই না। আমি তো জানিই না কী করে রেফ্রিজারেটার চালাতে, বন্ধ করতে হয়।’ শিবপদ প্রায় আর্তনাদ করে উঠল।
ঘরগুলো থেকে তেমন কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। তবে শোবার ঘরে লেখার টেবিলের একদম নীচের ড্রয়ারটা তালাবন্ধ রয়েছে। এখনও চাবির হদিশ পাওয়া যায়নি। এই ড্রয়ারটার মধ্যে কিছু থাকলেও থাকতে পারে। এই ড্রয়ারের চাবিটা লেক রোডের বাড়ির ড্রয়ারটার থেকে অনেক বেশি পোক্ত। আদিত্য অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে অচিন্ত্য সাহার দিকে তাকাতে সে দুদিকে ঘাড় নাড়ল। অর্থাৎ ছুরি দিয়ে এই ড্রয়ারটা খোলা যাবে না। ওপরের ড্রয়ার দুটো অবশ্য টানতেই খুলে গেছে। তাতে নানান টুকিটাকি জিনিসের সঙ্গে রয়েছে হাজার তিরিশেক টাকা।
বসার ঘরের এক কোনায় গোটানো ব্যাডমিন্টন নেট, কয়েকটা ব্যাডমিন্টন র্যাকেট ইত্যাদির সঙ্গে নানা আকারের গোটা চারেক ছিপ রাখা ছিল। আদিত্য ভাবছে, মণিময় গুপ্তর তাহলে ব্যাডমিন্টন খেলার মতো মাছ ধরাতেও উৎসাহ আছে। বাড়িতে ঢোকার আগে আদিত্য এই বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই বেশ বড় একটা পুকুর লক্ষ করেছে। মণিময় কি সেখানেই মাছ ধরে?
‘তোমার মালিকের কি মাছ ধরার নেশা আছে নাকি?’ আদিত্য শিবপদর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘নেশা বলে নেশা! যখন মেমসাহেব থাকে না, মালিক তো সারাদিন ছিপ নিয়েই বসে থাকে।’
‘ছিপ নিয়ে কোথায় বসে?’
‘কোথায় আবার? বাড়ি থেকে বেরুলেই তো পুকুর। মালিকের নিজের পুকুর। সেখানেই মালিক মাছ ধরে।’
‘কী মাছ পাওয়া যায় পুকুরে?’
‘ছোট ছোট রুই-কাতলা-মিরগেল তো আছেই। তাছাড়া তেলাপিয়া, বেলে, পুঁটি প্রচুর পাওয়া যায়। দু-চারটে শোল মাছও আছে। তবে তাদের ধরা খুব শক্ত।’
‘বড় মাছ নেই? বড় রুই-কাতলা বা বোয়াল?’
‘আছে বইকি। সব আছে। কিন্তু সেসব মাছ ছিপ দিয়ে ধরা যায় না। বড় জাল ফেলতে হয়। জাল ফেলার আলাদা লোক আছে। বছরে এক-দুবার তারা আসে। মালিক শহরে চলে যাবার ঠিক আগে পুকুরে জাল ফেলিয়ে, বড় মাছ ধরিয়ে, কাটিয়ে-কুটিয়ে, সেই মাছ সঙ্গে নিয়ে চলে যায়।’
কিছুক্ষণ হল অচিন্ত্য সাহাকে দেখা যাচ্ছে না। লোকটা গেল কোথায়? আদিত্য এদিক-ওদিক তাকিয়ে তাকে দেখতে পেল না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল নাকি? আদিত্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে সে বাড়ির বাইরে গিয়ে অচিন্ত্য সাহাকে খুঁজবে কিনা এমন সময় অন্তরীক্ষ থেকে উত্তেজিত গলা শোনা গেল, ‘আদিত্যবাবু এদিকে আসুন। দেখুন কী পেয়েছি।’ গলাটা নিঃসন্দেহে অচিন্ত্য সাহার।
আদিত্য বুঝতে পারছে না কোনদিকে যাবে। না বুঝতে পেরে সে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। আবার সেই গলাটা শোনা গেল, ‘আদিত্যবাবু আমি এ-ঘরে।’
আদিত্য এবার নিশ্চিত গলার আওয়াজটা খাবার ঘরের ভিতর থেকে আসছে। কিন্তু খাবার ঘরের ভেতরে ঢুকেও সে অচিন্ত্য সাহাকে দেখতে পেল না।
‘আমি এ-দিকে।’ আবার অচিন্ত্য সাহার গলা।
খাবার ঘরের সংলগ্ন একটা টয়লেট আছে। মনে মনে গলার আওয়াজ অনুসরণ করে আদিত্য দেখল অচিন্ত্য সাহা টয়লেটের ভিতরে কমোডের ওপর দাঁড়িয়ে গিজারের পেছন থেকে একটা কিছু টেনে নামানোর চেষ্টা করছে। আদিত্যকে দেখতে পেয়ে সে বলল, ‘গিজারের পেছনে একটা বড় প্লাস্টিকের প্যাকেট আটকানো রয়েছে। বেশ ভারী। আমি একা নামাতে পারছি না। একটু হেল্প করবেন?’
কিছুক্ষণের মধ্যে দুজনের যৌথ প্রচেষ্টায় প্লাস্টিকের প্যাকেটটা নামানো হল। ভেতরে অনেকগুলো দু-হাজার টাকার নোটের বান্ডিল, গুনে দেখা গেল সব সুদ্ধু সাতাশিটা। এক-একটা বান্ডিলে একশোটা করে নোট, অর্থাৎ দু-লক্ষ করে টাকা। তার মানে সাতাশিটা বান্ডিল মিলিয়ে মোট এক কোটি চুয়াত্তর লক্ষ টাকা প্লাস্টিকের প্যাকেটটাতে রয়েছে। এছাড়াও প্যাকেটের মধ্যে রয়েছে ফাইল করা কিছু কাগজপত্র আর এক গোছা চাবি। তাদের মধ্যে একটা চাবি দিয়ে শোবার ঘরের ড্রয়ারটা খোলা গেল। ড্রয়ারের ভেতরে আটাত্তর বান্ডিল পাঁচশো টাকার নোট ঠাসা রয়েছে। অর্থাৎ আরও ঊনচল্লিশ লক্ষ টাকা।
‘এবার তাহলে ফিরে যাওয়া যাক, কী বলেন? অনেক কিছুই তো পাওয়া গেল।’ অচিন্ত্য সাহার গলায় তৃপ্তির সুর।
‘সত্যিই অনেক কিছু পাওয়া গেল। এবং সব কৃতিত্ব আপনার।’
‘আরে না, না, স্যার। আপনি মণিময় গুপ্তর চিঠি থেকে এখানকার ঠিকানাটা বার করে এখানে আসার কথা না বললে কিছুই পাওয়া যেত না।’
‘সব থেকে দরকারি জিনিসটা কিন্তু এখনও অজানা রয়ে গেল।’ আদিত্য অন্যমনস্কভাবে বলল।
আদিত্যর কথায় অচিন্ত্য সাহা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ঠিক ধরতে পারছে না আদিত্য কোন জিনিসটার কথা বলছে।
‘চলুন, বাইরেটা একবার খুঁজে দেখা যাক। হয়তো সেই জিনিসটার কোনও হদিশ পাওয়া যেতে পারে।’
‘আপনি কোন জিনিসটার কথা বলছেন?’
‘আমি বলছি মণিময় গুপ্তর বর্তমান ঠিকানার কথা। জানতে হবে না লোকটা এই মুহূর্তে কোথায় রয়েছে?’
‘বাইরের মাঠে কি তার কোনও হদিশ পাওয়া যাবে?’ অচিন্ত্য সাহার গলায় সংশয়।
‘দেখতে তো ক্ষতি নেই। চলুনই না একবার।’
বাড়ির সদর দরজাটা টেনে দিয়ে ওরা তিনজন বাইরে বেরোল। ইয়েল লক তালাবন্ধ হয়ে গেছে। শিবপদকে ওরা সাক্ষী হিসেবে সঙ্গে রেখে দিয়েছে। ওর সামনেই টাকাগুলো গোনা হয়েছে। অত টাকা দেখে শিবপদ সেই যে চুপ করে গেছে আর তার গলা থেকে শব্দ শোনা যায়নি। সেই ছেলে দুটো বাইরেই দাঁড়িয়েছিল। আবার ওদের পেছন পেছন আসছে।
শীতের বেলা এক্ষুনি পড়ে আসবে। এখনই সূর্যের তেজ কমে এসেছে। একটা মেঘ মাঠের ওপর ছায়া ফেলতে ফেলতে সরে গেল। ব্যাডমিন্টন কোর্টে এখনও একটা নেট লাগানো আছে। রোদে-জলে সেটা বেশ মলিন। ব্যাডমিন্টন কোর্ট পেরিয়ে পুকুর। আদিত্য অন্যদের নিয়ে ব্যাডমিন্টন কোর্ট পেরিয়ে পুকুর পাড়ে গিয়ে দাঁড়াল।
‘তোমার মালিক ঠিক কোনখানে বসে মাছ ধরত, দেখাতে পারবে?’ আদিত্য শিবপদর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।
অচিন্ত্য সাহার মুখটা কিছুটা হতভম্ব দেখাচ্ছে। সে বুঝতে পারছে না আদিত্য কী করার চেষ্টা করছে।
‘মালিক ঠিক এইখানে গাছের ছায়ায় বসে মাছ ধরত।’ শিবপদ জায়গাটা আঙুল দিয়ে দেখাল।
পুকুরের ধারে একটা মস্ত বটগাছ ডালপালা মেলে দিয়েছে। তার কিছু ডালপালা ডাঙার ওপর বিস্তৃত, কিছু জলের ওপর। এখানে মাটি প্রায় জলের ওপর নেমে এসেছে। মাছ ধরার আদর্শ জায়গা বটে। আদিত্য গাছের নীচের মাটিটা নিচু হয়ে পরীক্ষা করছে। মাটির ওপর ঘাস, আগাছা, পিঁপড়ের ঢিপি। খুব ভাল করে নজর করলে বোঝা যাবে একটা জায়গায় কিছু আগাছা উপড়ে গেছে, ঘাস থেঁতলে গেছে। আরও ভাল করে দেখলে থেঁতলে যাওয়া ঘাসের ওপর একটা হালকা লাল রং চোখে পড়বে। রংটা বৃষ্টির জলে ধুয়ে ফিকে হয়ে এসেছে।
কিছুক্ষণ পরে মাটি থেকে মুখ তুলে আদিত্য বলল, ‘অচিন্ত্যবাবু, পুকুরে ডুবুরি নামাবার ব্যবস্থা করতে হবে। আমার ধারণা, মণিময় গুপ্ত যখন এখানে বসে মাছ ধরছিল, তখন তাকে হত্যা করা হয়। হত্যা করে তার লাশটা পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়। সম্ভবত লাশের গলায় ভারী কিছু বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, যাতে সেটা ভেসে না ওঠে। এতদিনে নিশ্চয় মণিময় গুপ্তর শরীরের অনেকটাই মাছেরা খেয়ে নিয়েছে। বিশেষ করে এই পুকুরে যখন বোয়াল মাছ আছে। কিন্তু কঙ্কালটা তো পাওয়া যাবে। প্রমাণ করা শক্ত হবে না সেটা মণিময় গুপ্তরই কঙ্কাল। আমার আরও ধারণা এই পুকুরে মণিময় গুপ্তর মোবাইলটাও পাওয়া যাবে।’
অচিন্ত্য সাহা একেবারে হতবাক হয়ে গেছে। কয়েক মিনিট বাদে সম্বিত ফিরে পেয়ে সে বলল, ‘এসব কি আপনার ধারণা নাকি অনুমান?’
আদিত্য দৃঢ় গলায় বলল, ‘আমি একটু ভুল বলেছিলাম। এটা আমার নিছক ধারণা নয়, অনুমানও নয়। আমি একশভাগ নিশ্চিত যে ঠিক এইরকমই হয়েছে।’