সৈকত রহস্য – ৬
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
(১)
কাল রাত্তির থেকে রাখি চক্রবর্তী অনেকটা সুস্থ বোধ করছেন। তাই তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট সেরে প্রদীপ এবং রাখিকে সঙ্গে নিয়ে চিলকা হ্রদের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েছে কেয়া। আইডিয়াটা অবশ্য প্রদীপ চক্রবর্তীর। চিলকাতে সিঁড়ি ভাঙতে হবে না, সেটা একটা মস্ত সুবিধে। রাখি চক্রবর্তী আর সিঁড়ি ভাঙতে পারবেন না। না হলে উদয়গিরি-খণ্ডগিরির দিকটাতেও যাওয়া যেত। আদিত্য খুব খুশি। সে নিজে আজ সারাদিন পুলিশের সঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদে ব্যস্ত থাকবে। একা ঘরে বসে কেয়া বোর হবে কেন? আর একটা গাড়ি যখন মজুত রয়েছে প্রদীপ চক্রবর্তীদের আলাদা করে গাড়ি ভাড়াও করতে হবে না। সঙ্গী হিসেবে প্রদীপ এবং রাখি চমৎকার। কেয়ার ভাল সময় কাটবে। মনে হয়, সন্ধের আগেই ওরা ফিরে আসতে পারবে।
সকালবেলা কৃষ্ণ পধির সঙ্গে কথা হয়েছিল। উনি দশটার মধ্যে দলবল নিয়ে চলে আসবেন। ঠিক হল, অসীম দত্তর অফিসটাই ওদের ঘাঁটি হবে। ওখানে একজন একজন করে অসীম দত্তর আত্মীয়দের ডেকে নেওয়া যাবে।
দশটা বাজতে এখনও মিনিট পনেরো বাকি। আদিত্য রিসর্টের সামনে সমুদ্রের ধারে পাইচারি করতে করতে চিন্তা করছিল। অসীম দত্তর জীবনে কোনও একটা স্ক্যান্ডেল আছে। শুভ্র বলতে গিয়েও বলল না। তবে মনে হল স্ক্যান্ডেলটার কথা অনেকেই জানে। টেনে বার করতে অসুবিধে হবে না। সমুদ্রের ধারে খুব হাওয়া। আদিত্য একটা আস্ত দেশলাই বাক্সর প্রায় সব কটা কাঠি শেষ করে একটা সিগারেট ধরাল। হয়তো স্ক্যান্ডেলটার কথা জানা গেলে অসীম দত্তর খুনের ব্যাপারে একটা রাস্তা দেখা যেত। মোবাইলটা বাজছে। ইন্সপেক্টার অচিন্ত্য সাহা। সৈকত চৌধুরি, মণিময় গুপ্তদের আদিত্য যেন ভুলেই গিয়েছিল।
‘পুকুর থেকে একটা বডি পাওয়া গেছে স্যার। মাছগুলো প্রায় সবটাই খেয়ে নিয়েছে। কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।’
‘ওটা মণিময়ের বডি বলে কেউ আইডেন্টিফাই করেনি?’
‘বডি দেখে তো কিছু বোঝার উপায় নেই। জামাকাপড়ও সব জলে ভিজে ফাঁদরাফাঁই হয়ে গেছে। তবে হাতে একটা ঘড়ি ছিল আর আঙুলে একটা আংটি। সেই দু’টো জিনিস শিবপদ বলে লোকটা চিনতে পেরেছে। বলছে এগুলো মণিময় গুপ্তর।’
‘ঘড়িটা কি চলছিল, না বন্ধ হয়ে গিয়েছিল?’
‘আমি বুঝতে পারছি আপনি কী ভাবছেন। যদি ঘড়িটা মণিময় খুন হবার সময় বন্ধ হয়ে যায় তাহলে সেটা থেকে খুনের দিন এবং সময়টা বোঝা যাবে। অবশ্য খুনের অনেক পরে জলে ভিজে ভিজেও ঘড়িটা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ১১টা বেয়াল্লিশ মিনিটে। আপনার কি মনে হয় ওইটাই খুনের সময়?’
‘জানি না। একটু ভেবে দেখতে হবে। ঘড়িটা কোন কম্পানির ছিল?’
‘খুব দামি ঘড়ি। ওমেগা স্পিডমাস্টার।’
‘তা হলে তো ঘড়িটাতে তারিখও থাকবে। ঘড়িটা বন্ধ হয়ে যাবার সময় তারিখ কী দেখাচ্ছে?’
‘তারিখটাই সমস্যা হয়ে গেছে। ঘড়িটা এমনভাবে ভেঙে গেছে যে তারিখ কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
‘হুঁ।’ আদিত্য ভাবছিল জিজ্ঞেস করবে, জামাকাপড় ফাঁদরাফাঁই হয়ে যাওয়ার মানে কী? সেটা না জিজ্ঞেস করে সে বলল, ‘ফরেন্সিক রিপোর্ট থেকে বডি আইডেন্টিফিকেশনের ব্যাপারে আর কোনও হেল্প পাওয়া যায়নি? দাঁতটা দেখেছেন?’
‘দাঁতটাই আমরা দেখছি স্যার। যে ডেন্টিস্ট মণিময় গুপ্তকে দেখতেন তাঁকে খুঁজে বার করা গেছে। সেখানকার রেকর্ডে মণিময় গুপ্তর দাঁতের কিছু এক্সরে আছে। বডিটার দাঁতের সঙ্গে ওই এক্সরেগুলো মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। আজ-কালের মধ্যেই রিপোর্ট পেয়ে যাব। তবে আমার স্থির বিশ্বাস লাশটা মণিময়েরই।’
‘আমারও তাই বিশ্বাস। আচ্ছা, মৃত্যুর কারণ সম্বন্ধে কী জানা গেল?’
‘ও হ্যাঁ, সেটাই তো বলা হয়নি। মৃত্যু হয়েছে পিস্তলের গুলিতে। মণিময় গুপ্ত যখন পুকুরের দিকে ফিরে মাছ ধরছিল তখন পেছন থেকে কেউ গুলি চালায়। গুলি পিঠের হাড় ভেঙে, হার্ট ফুঁড়ে, বুকের পাঁজরের হাড়ে আটকে গেছে। অল্প ক্যালিবারের পিস্তল,তাই গুলিটা শরীর ফুঁড়ে বাইরে চলে যেতে পারেনি। পুকুর থেকে আর একটা জিনিস পেয়েছি। মণিময় গুপ্তর মোবাইল।’
‘সেটার থেকে কি কিছু উদ্ধার করা যাবে? কন্ট্যাক্টস? কলিং লিস্ট?’
‘এখনও করা যায়নি। তবে আমরা চেষ্টা করছি স্যার।’
অচিন্ত্য সাহার ফোনটা নামিয়ে রেখে আদিত্য সুভদ্র মাজির নম্বরটা লাগালো। কিছুক্ষণ কথা বলল সেই নম্বরে। তারপর ফোন রেখে দেবার আগে বলল, ‘আমাকে তাহলে এই নতুন তথ্যগুলো মেল করে দেবেন প্লিজ।’
মোবাইলটা নামিয়ে রাখতে না রাখতে দেখল রিসর্টের উর্দি পরা এক বেয়ারা তার দিকে এগিয়ে আসছে।
‘ডিএসপি সাহেব এসে গেছেন।’ সে জানাল। ‘আপনাকে খুঁজছেন।’
‘সাড়ে ন’টার একটু পরে অসীম দত্ত ব্যাঙ্কোয়েট হল থেকে বেরিয়ে নিজের অফিসে গিয়েছিলেন। পৌনে এগারোটা নাগাদ তাঁর সিকিউরিটি আবিষ্কার করল অফিসের দরজায় ধাক্কা দিলেও তিনি খুলছেন না। রাত্তির সাড়ে ন’টা থেকে পৌনে এগারোটা, এই সময়ের মধ্যে অসীম দত্ত খুন হন। আপনি এই সময় কোথায় ছিলেন?’ প্রশ্নটা করে কৃষ্ণ পধি অনিকেত দত্তর দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন।
‘আ-আমি হলের মধ্যেই ছিলাম। আ-আমার স্ত্রী এবং বোনের সঙ্গে এক টেবিলে বসে ছিলাম। ডিনার করেছিলাম।’
‘একবারও বেরোননি?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘আমি একবার বে-বেরিয়েছিলাম ডিনার শুরু হবার অনেক আগে। তখন গানও শুরু হয়নি। আমার মোবাইলটা ঘরে ফেলে এসেছিলাম। সেটা আনতে গিয়েছিলাম।’
‘কতক্ষণ পরে ফিরেছিলেন?’
‘ঠিক মনে নেই।’
‘আমার মনে আছে। আপনি এক-দেড় ঘণ্টা বাদে ফিরেছিলেন। আমি আপনাকে লক্ষ করেছিলাম। মোবাইল আনতে এক-দেড় ঘণ্টা লেগে গেল?’ আদিত্যর ধমকের স্বরে বলল।
‘না, মানে, ক-করিডোরে জয়ন্তর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। দু’-দুজনে কিছুক্ষণ বা-বারে বসেছিলাম।’
‘এটা প্রথমে বলতে অসুবিধে কী ছিল?’
অনিকেত দত্ত চুপ করে রইল।
‘পরে আর বেরোননি?’
‘প-পরে? হ্যাঁ, খাবার পর একবার বোধহয় বেরিয়েছিলাম। বোধহয় মুখ ধুতে বাথরুমে গিয়েছিলাম।’ অনিকেত দত্তর গলাটা অনিশ্চিত শোনাল।
‘দ্বিতীয়বার বেরিয়ে কতক্ষণ বাইরে ছিলেন?’
‘ঠিক মনে নেই। খুব বেশিক্ষণ হ-অবে না।’
‘বাথরুম ছাড়া আর কোথাও গিয়েছিলেন?’
‘না, আ-আর কোথায় যাব?’
‘আপনার কোম্পানি, দত্ত কন্সট্রাকশান্স, কেমন চলছে?’ আদিত্য প্রসঙ্গ বদলালো।
‘ভালই চলছে। ভা-ভালই তো চলছে।’
‘কোনও সমস্যাই নেই? সব ঠিকঠাক?’ আদিত্য অনিকেত দত্তর চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল।
‘না, মানে কিছু স-সমস্যা তো সব কোম্পানিতেই থাকে। আ-আমাদেরও আছে। বড়সড় কিছু নয়।’ অনিকেত দত্ত চোখ নামিয়ে নিয়েছে।
‘তবে যে শুনলাম আপনারা ব্যাঙ্ক থেকে টাকা নিয়ে শোধ দিতে পারছেন না? শুনলাম, আপনাদের লোনটা এনপিএ হয়ে গেছে। সামনের মাসে ধারের কিস্তি শোধ দিতে না পারলে আপনাদের অ্যাসেটগুলো ব্যাঙ্ক অধিগ্রহণ করে নিলামে চড়াবে। এটা কি ঠিক শুনেছি?’ একটু আগে সুভদ্র মাজিকে ফোন করে আদিত্য যেটা জানতে পেরেছে সেটাই সে অনিকেত দত্তকে দিয়ে যাচাই করে নিতে চাইছিল।
অনিকেত দত্তকে বেশ নার্ভাস দেখাচ্ছে। সে কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারল না। তারপর থেমে থেমে বলল, ‘দেখুন পে-পেমেন্ট আটকে গেলে এরকম ক্রাইসিস কনস্ট্রাকশান ক- কোম্পানিদের মাঝে মাঝেই হয়। আ-আমাদেরও সেটাই হয়েছে। আমরা এটার থেকে বে-বেরিয়ে আসতে পারব।’
আদিত্য বলতেই পারত, কী করে পারবেন? আপনারা তো ব্ল্যাকলিস্টেড হয়ে গেছেন। তাই তো আপনাদের পেমেন্ট বন্ধ। কিন্তু তার মনে হল লোকটাকে আর রগড়ে লাভ নেই। সে একটু নরম গলায় বলল, ‘কোম্পানি চালানোর ব্যাপারে আপনি কি আপনার বাবার কোনও সাহায্য পেতেন?’
‘মাঝে মাঝে পে-পেতাম।’ অনিকেত দত্ত উদাস গলায় বলল।
‘কী ধরনের সাহায্য? আর্থিক নাকি অন্য কিছু?’
‘এক সময় আ-আর্থিক সাহায্যও পেয়েছি। তবে ইদানীং বা-বাবার কাছে পরামর্শ চাইতেই বেশি যেতাম।’
‘তার মানে, এই মুহূর্তে আপনার কোম্পানি যে ব্যাঙ্কের টাকা শোধ করতে পারছে না, সে ব্যাপারে আপনি আপনার বাবার কাছে কোনও অর্থসাহায্য চাননি?’
অনিকেত দত্ত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘চেয়েছিলাম, কিন্তু এ-এখনও পাইনি। জানি না, বাবা চলে যাবার আগে টাকাটা দেবার ব্যাপারে কোনও নি-নির্দেশ দিয়ে গেছিল কিনা।’
‘ঠিক আছে। আমার আর কিছু জিজ্ঞেস করার নেই। ডিএসপি সাহেব কিছু জিজ্ঞেস করবেন?’
‘আপনাকে একটা কথা বলি। আপনি নিশ্চয় এখান থেকে কলকাতায় ফিরে যাবেন। যাবার আগে আপনার ফোন নম্বর আর কলকাতার ঠিকানাটা দিয়ে যাবেন। আর আপনার বাবার মার্ডার মিস্ট্রিটা মীমাংসা না হওয়া অবধি কলকাতা ছেড়ে কোথাও যাবেন না। আমরা এই ব্যাপারে কলকাতা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখব। আপনি এবার আপনার স্ত্রীকে পাঠিয়ে দিন।’
অনিকেত দত্ত ঘর থেকে বেরোনোর আগেই আদিত্যর ফোনটা বেজে উঠল। অচিন্ত্য সাহা আবার ফোন করছে। ঘরের বাইরে গিয়ে ফোনটা ধরল আদিত্য।
‘সকালে একটা ছোট্ট জিনিস বলতে ভুলে গিয়েছিলাম স্যার। একটা উড়ো খবর বলতে পারেন। সত্যি না মিথ্যে জানি না। তাই হয়তো মাথা থেকে বেরিয়ে গেছিল। আপনার দু’মিনিট সময় হবে?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ সময় হবে। বলুন কী উড়ো খবর। বলা যায় না, কাজেও লেগে যেতে পারে।’ আদিত্য ঔৎসুক্য দেখিয়ে বলল।
‘কিছুদিন আগে কলকাতার সিবিআই অফিস ডেপুটেশনে রাজ্য সরকার থেকে লোক চেয়েছিল। ইন্সপেক্টর এবং কন্সটেবল, দুটো পোস্টের জন্যেই। তো বিদ্যুৎ বলে আমার চেনা একটি ছেলে, আগে আমাদের এখানে কন্সটেবল ছিল, ডেপুটেশনে সিবিআই জয়েন করল। ওর সঙ্গে কিছুদিন আগে দেখা।’
‘হুঁ, তারপর?’
‘একথা-সেকথার পর বলল, স্যার আপনি শুনলাম সৈকত চৌধুরির কেসটা ইনভেস্টিগেট করছেন। আমি বললাম, করছি তো, তাতে কী হয়েছে। সুজয় একটু ইতস্তত করে বলল, সৈকত চৌধুরি বলে একজনের বিরুদ্ধে সিবিআই একটা ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন করছিল স্যার। এ-ব্যাপারে আপনি কি কিছু জানেন? এটা অবশ্য আমার জানার কথা নয়, আমি তো চুনোপুঁটি। তার ওপর নতুন এবং ডেপুটেশনে। সব থেকে বড় কথা, ইনভেস্টিগেশনটা মনে হয় খুব কনফিডেনশিয়ালি করা হচ্ছিল। সিবিআই-এর ভেতরেও খুব বেশি লোক এটার কথা জানে না দেখলাম। আমি নেহাত ঘটনাচক্রে ব্যাপারটা জেনে ফেলেছি।’
আদিত্যকে গল্পটা টানছিল। সে উত্তেজনায় সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছে।
‘আসলে আমার ওপর অফিসের গাড়িগুলো কোথায় কোথায় ডিউটিতে যাবে সেটা দেখাশোনা করার দায়িত্ব পড়েছিল। ডিউটি রোস্টারে দেখছিলাম প্রায় ছ’মাস ধরে কিছু অফিসার নিয়মিত সৈকত চৌধুরির সঙ্গে দেখা করতে সল্ট লেকে তার অফিসে গেছে। তাই ভাবলাম, আপনি তো একজন সৈকত চৌধুরির মার্ডার কেস ইনভেস্টিগেট করছেন। আপনি হয়তো ব্যাপারটা জানতে পারেন। মানে আমি ভাবছিলাম, সিবিআই যার বিরুদ্ধে ইনভেস্টিগেট করছিল আর যে সৈকত চৌধুরি খুন হয়েছে দু-জন কি একই লোক? আমি বললাম, আমি এ-ব্যাপারে কিছুই জানি না।’
‘কিন্তু আপনাদের এই বিদ্যুতের এই ব্যাপারে এত উৎসাহ কেন?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘এই প্রশ্নটা আমার মনেও এসেছিল। আমি ওকে জিজ্ঞেসও করলাম। ও বলল, নিছক কৌতূহল। আর কিছু নয়। আমার বিশ্বাস ও পুরোটা বলছে না। এর মধ্যে বোধহয় আরও কিছু আছে। কিন্তু আর কোনও কথা ওর কাছ থেকে বার করতে পারলাম না।’
আদিত্য দেখল করিডর দিয়ে ছন্দা দত্ত তার স্বামী অনিকেত দত্তকে নিয়ে এদিকে আসছে। নিশ্চয় তার স্বামী তাকে এই আপিস অবধি এগিয়ে দিতে এসেছে, যে আপিসে বসে আদিত্যরা জিজ্ঞাসাবাদ করছে।
আদিত্য ফোনে বলল, ‘এখন আমাকে একটু রাখতে হচ্ছে। একটা ইন্টারোগেশনের মধ্যে আছি। আমি যদি কিছু জানতে পারি আপনাকে জানাব। পরশুদিন কলকাতা ফিরে যাচ্ছি। তারপর নিশ্চয় দেখা হবে।’
আদিত্য মোবাইলটা পকেটে রেখে দিল। সিগারেটে দু’টো সুখটান দেবার পর আগুনটা নিভিয়ে সিগারেটের অবশিষ্টাংশ রিসেপশানের পাশে রাখা একটা পেল্লায় গারবেজ ক্যানের মধ্যে ফেলে দিয়ে ছন্দা দত্ত, অনিকেত দত্তর আগমন পথের দিকে তাকিয়ে রইল। রিসেপশনে হোটেল স্টাফ কিংবা গেস্ট কেউ নেই। থাকলে নিশ্চয় এখানে সিগারেট খাওয়া নিয়ে খ্যাচ খ্যাচ করত।
আদিত্যর কাছে এসে অনিকেত দত্ত বলল, ‘আ-আমার স্ত্রীর জিজ্ঞাসাবাদের সময় আ-আমি কি আমার স্ত্রীর সঙ্গে থাকতে পারি? আসলে উনি তো খুব বে-বেশি বাইরে বে-বেরোন না, হয়ত সব কথা গুছিয়ে বলতে পারবেন না।’
‘আমার মনে হয় না আপনার স্ত্রীর ইন্টারোগেশনের সময় আপনার থাকাটা ডিএসপি সাহেব অ্যালাউ করবেন। তবে আপনি জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন।’ আদিত্য কেজো গলায় বলল।
রিসেপশানের সামনে কয়েকটা আরাম কেদারা রয়েছে, একটা টিভিও চলছে। আদিত্য ভাবল এখানে বসে অনিকেত দত্ত দিব্যি সময় কাটিয়ে দিতে পারবে, যদি সে তার স্ত্রীকে ফেরার পথেও এসকর্ট করে নিয়ে যেতে চায়। রিসেপশনের মেয়েটা তার জায়গায় ফিরে এসেছে।
আদিত্যর অনুমানই ঠিক। ডিএসপি কৃষ্ণ পধি অনিকেত দত্তকে বাইরে রিসেপশনের সামনে অপেক্ষা করতে বললেন।
ছন্দা দত্ত চেয়ারে জবুথবু হয়ে বসে আছে। তার শরীরের ভাষা থেকে এটা পরিষ্কার যে একসঙ্গে এতগুলো পুরুষ মানুষের সামনে বসে থাকতে হচ্ছে বলে সে নিজেকে বেআব্রু মনে করছে। বিশেষ করে তার স্বামীকে যখন তার সঙ্গে থাকতে দেওয়া হয়নি। আদিত্যর মনে হল ডিএসপি সাহেব তার টিমে দু-একজন মেয়ে পুলিশ রাখলে ভাল করতেন। বলা যায় না, যা দিনকাল!
ছন্দা দত্তকে যে কোনও মাপকাঠিতেই সুন্দরী বলতে হবে। তবে এখন শরীরে কিছু মেদ জমেছে। শুভ্র দত্ত তার অস্বাভাবিক ফরসা রংটা মনে হয় তার মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছে।
‘আপনাকে খুব অল্প কিছু প্রশ্ন করব।’ ডিএসপি শুরু করলেন। ‘শনিবার রাত সাড়ে ন’টা থেকে পৌনে এগারোটার মধ্যে আপনি কি একবারও ব্যাঙ্কোয়েট হল থেকে বেরিয়ে ছিলেন?’
প্রশ্নটা শুনে ছন্দা দত্ত থতমত খেয়ে গেছে।
‘আমার ঠিক মনে পড়ছে না বেরিয়েছিলাম কিনা। বোধহয় খাবার পরে একবার হাত-মুখ ধুতে বেরিয়েছিলাম।’
‘তখন কি আপনি আর কাউকে বাইরে দেখেছিলেন?’
‘হ্যাঁ। বাইরে তখন অনেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কেউ কেউ সমুদ্রের দিক থেকে ফিরছিল।’
‘আমি বলতে চাইছি, আপনাদের পরিবারের কাউকে কি বাইরে দেখেছিলেন?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘আমাদের পরিবারের?’ ছন্দা দত্তর গলাটা খুব অনিশ্চিত শোনাল। ‘মনে হচ্ছে ঠাকুরপোকে যেন রিসর্ট থেকে সমুদ্রের দিকে যেতে দেখেছিলাম। তবে আমার ভুলও হতে পারে।’
‘তার মানে আপনি যাকে দেখেছিলেন তার সঙ্গে আপনার কোনও কথা হয়নি, তাই তো?’ আদিত্য নিশ্চিত হবার জন্য আবার জিজ্ঞেস করল।
‘না। আমি তো ঠাকুরপোকে দূর থেকে দেখেছিলাম। ওটা ঠাকুরপো ছিল কিনা সেটাও জোর দিয়ে বলতে পারব না।’
‘আর কাউকে আপনি দেখেননি?’
‘আপনি বলতে এখন মনে পড়ছে, আমি যখন আবার ব্যাঙ্কোয়েট হলে ঢুকছি তখন দেখলাম দীপশিখা হল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতে ও হাসল। আমিও হাসলাম।’
‘আচ্ছা, আপনার সঙ্গে আপনার শ্বশুরমশায়ের সম্পর্ক কেমন ছিল?’
‘খুব ভাল ছিল। আমি ওঁকে নিজের বাবার মতোই শ্রদ্ধা করতাম, উনিও আমাকে মেয়ের মতো দেখতেন। আমার তো ছোটবেলায় বাবা মারা গিয়েছিলেন। তাই উনিই ছিলেন আমার বাবা।’ বলতে বলতে ছন্দা দত্তর গলাটা ধরে এল।
একটু সামলে নিয়ে ছন্দা দত্ত বলল, ‘বাবা ওঁর নিজের মেয়ের থেকে আমার সঙ্গে সময় কাটাতে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন।’ ছন্দা দত্ত একটু একটু করে সহজ হচ্ছে।
‘সেটা কেন?’
‘দেখুন খুকু, মানে শ্বেতা, আমার শ্বশুরমশাইকে টাকার জন্যে মাঝে মাঝেই জ্বালাতন করত। বারবার ওদের ব্যবসায় টাকার টান পড়ত। আর টাকার দরকার হলে বাবা ছাড়া আর কে আছে? বাবা দু’একবার টাকা দিয়েও ছিলেন। তারপর বুঝলেন ওদের টাকা দিয়ে কোনও লাভ নেই।’
‘লাভ নেই কেন?’
‘আসলে খুকু মেয়েটা ভিতরে ভিতরে ভীষণ নরম, ওকে ওপর থেকে যাই মনে হোক না কেন। বিশেষ করে স্বামীর কোনও কথা ও ফেলতে পারে না। আর যত গণ্ডগোল সব ওই জয়ন্তদাকে নিয়ে। এমনিতে জয়ন্তদা মানুষটা খারাপ নয়, কিন্তু ওই আর্মিতে যা হয়, ভীষণ ড্রিঙ্ক করে আর প্রবল জুয়ার নেশা। টাকা তো ওদের কম ছিল না। জয়ন্তদাই সব উড়িয়ে দিল। খুকু ওকে এত ভালবাসে যে ওর কোনও দোষ দেখতে পারে না। জয়ন্তদাকে না সামলাতে পারলে ব্যবসা চলবে কী করে?’
‘কিন্তু আমরা তো শুনেছি আপনার স্বামীর ব্যবসাও ভাল চলে না। আপনার শ্বশুরমশায়ের কাছে মাঝে মাঝে আপনাদেরও টাকা চাইতে হয়।’ আদিত্য বুলেটের মতো প্রশ্ন করল।
‘হ্যাঁ হয়।’ একটু চুপ করে থেকে ছন্দা দত্ত বলল। ‘কিন্তু জয়ন্তদার সঙ্গে আমার স্বামীর একটা বড় তফাৎ আছে। জয়ন্তদা বেপরোয়া, দায়িত্বজ্ঞানহীন। কারোর কথা ভাবে না। নিজের স্ত্রীর কথাও নয়। আমার স্বামী কিন্তু একেবারে উল্টো। নিজের পরিবারই আমার স্বামীর কাছে সব। আসলে স্বীকার করতেই হবে, অনেক চেষ্টা করেও ব্যবসা ব্যাপারটা আমার স্বামীর মাথায় ঢুকল না। ওর যদি একটা সাধারণ চাকরি থাকত তাহলে আমরা অনেক বেশি সুখে থাকতাম। কী করব বলুন, আমার অদৃষ্ট।’
‘কিন্তু আপনার স্বামী তো অসীম দত্তর ফার্মে চাকরি করতেন। সেখানে পোষালো না কেন?’
‘উনি যেটা করতেন তাকে চাকরি করা বলে না। ব্যবসাই বলতে হয়। বাবা ওকে নিজের ব্যবসায় বসিয়ে কাজকর্ম শেখাচ্ছিলেন যাতে বাবার অবর্তমানে আমার স্বামী ব্যবসাটা সামলাতে পারে। ঠাকুরপোর সঙ্গে বাবার সম্পর্ক কোনও দিনই ভাল ছিল না। তাই ঠাকুরপোকে ব্যবসায় বসানোর প্রশ্নই ওঠেনি। তার মানে আমার স্বামীকে বাবার ব্যবসাটাই দেখতে হচ্ছিল। সেই কাজটা উনি ভালভাবে করতে পারেননি। তাই বাবা বিরক্ত হয়ে ওকে অন্য কোম্পানি খুলতে বলেন। শুরুর টাকাটা অবশ্য বাবাই দিয়েছিলেন।’
ছন্দা দত্ত ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর আদিত্য ভাবছিল মহিলাকে ওপর ওপর দেখে যতটা বোকাসোকা মনে হয়, উনি আদৌ কি তাই?
(২)
ডিএসপি কৃষ্ণ পধি এবং ইন্সপেক্টার প্রশান্ত পণ্ডার সঙ্গেই লাঞ্চ খেয়ে নিল আদিত্য। রিসর্টেই পুলিশদের খাবার ব্যবস্থা হয়েছে। তবে দুজন কন্সটেবল পরে বসবে। ওপরওলাদের সঙ্গে একাসনে বসে লাঞ্চ খাবার অধিকার তাদের নেই। ডিএসপি সাহেব ভোজনরসিক। তবে মানের থেকে পরিমাণের দিকে তাঁর নজর বেশি। তিনি যতটা মাংস খেলেন, আদিত্য ভেবে দেখল, তিন-চারদিনের লাঞ্চেও সে অতটা খেয়ে উঠতে পারত না। ডিএসপি সাহেবের নাদুসনুদুস চেহারার একটা ব্যাখ্যা পাওয়া গেল। কৃষ্ণ পধি বোধহয় খেয়াল করেছেন আদিত্য তাঁর প্লেটের দিকে টেরিয়ে দেখছে।
‘আসলে কী জানেন, বাড়িতে তো মাটন খেতে দেয় না, তাই বাইরে সুযোগ পেলে একটু বেশি খাওয়া হয়ে যায়। আবার হয়তো এক বছর মাটন জুটবে না।’ ডিএসপি সাহেব কৈফিয়ত দেবার মতো করে বললেন।
মাটন না হয় জুটবে না। কিন্তু চারটে ফিসফ্রাই এবং একটি আস্ত তন্দুরি চিকেন খাবার কী অজুহাত, আদিত্য আর জিজ্ঞেস করল না।
ইন্সপেক্টার প্রশান্ত পণ্ডা ঠিক উল্টো, যেমন স্বল্পবাক তেমনই স্বল্পাহারী। আদিত্য তাকে দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে ডাল-তরকারি সহ দু’টো হাতরুটি এবং একটি ফিসফ্রাই দিয়ে মধ্যাহ্নভোজন সেরে নিল। এটাও অবশ্য ঠিক যে ব্রেকফাস্টে একটু বেশি খাওয়া হয়ে গিয়েছিল বলে তার খিদেও তেমন ছিল না।
খাওয়া শেষ করে কেয়াকে ফোন করল আদিত্য। কেয়ারা চিলকার ধারে বসে স্যান্ডউইচ-ফিসফ্রাই-আলুভাজা দিয়ে লাঞ্চ খাচ্ছে। রিসর্ট থেকেই প্যাক করে দিয়েছে। মন্দ কী!
কেয়া বলল, ‘খুব এনজয় করছি গো। একটু আগে নৌকো করে চিলকায় বেড়িয়েছি। অসাধারণ।’
‘কী রকম নৌকো? হাতে টানা?’
‘না, না, হাতে টানা নৌকোর মতো দেখতে। কিন্তু মোটর লাগানো আছে। বেশ জোরে যায়। শুধু হালটা মনে হল একজন হাতে করে কন্ট্রোল করছে।’
‘খুব সাবধানে থেকো। তুমি তো সাঁতারও জান না।’
‘আর সাবধান হয়ে কী করব? বোট রাইড নেওয়া তো হয়েই গেছে।’ কেয়া খিলখিল করে হাসল। ‘তবে জান তো? প্রদীপদাদের একটা ব্যাগ চিলকায় পড়ে গেছে। একেবারে মাঝ দরিয়ায়। উদ্ধারের কোনও চান্সই নেই।’
‘কী করে পড়ল?’
‘জানি না। মনে হয় ধারে রেখেছিল। নৌকোর ঝাঁকানিতে পড়ে গেছে।’
‘নৌকো ঝাঁকানি দেয় নাকি?’
‘এমনিতে ঝাঁকানি-টাকানি কিছু নেই। খুব স্মুথ। কিন্তু টার্ন নেবার সময় একটু ঝাঁকানি হয়। ভাগ্য ভাল একটা ব্যাগ পড়েছে, কোনও মানুষ পড়েনি।’
‘আমার শুনেই ভয় করছে। সাঁতার জানো না নৌকো চড়তে গেছ! কী ছিল ব্যাগে?’
‘প্রদীপদা বলল দু’টো গায়ের চাদর ছিল, একটা প্রদীপদার, একটা রাখিদির। চিলকায় জলের ধারে এসে যদি ঠান্ডা লাগে তাই এনেছিল। এখানে ঠান্ডা অবশ্য একেবারেই নেই। আর খুব মোটা একটা বই ছিল। কে একজন নকশালদের ইতিহাস নিয়ে থান ইটের মতো একটা বই লিখেছে। প্রদীপদা সেটা গাড়িতে পড়তে পড়তে আসছিল। তারপর বইটা ব্যাগে রেখে দিয়েছিল। সেটাও গেছে। এটা গেলো বলেই প্রদীপদার দুঃখ, চাদরগুলো নিয়ে দুঃখ নেই।’
‘যাক, ছাড় ওসব। ফিরছ কখন?’
‘ফিরতে সন্ধে হয়ে যাবে। রম্ভায় উড়িষ্যা সরকার যে পান্থনিবাস করেছে সেখানে বিকেলের চা খেয়ে রওনা দেব। রাখছি।’
কনস্টেবল দুজন ডাইনিং হলের দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল। আইসক্রিমের বাটিতে চামচ ডোবাতে ডোবাতে ডিএসপি সাহেব তাদের কাছে ডাকলেন।
‘অনির্বাণ দত্তকে বলো পনেরো মিনিট পরে অফিসে চলে আসতে। ওকে এবার ইন্টারোগেট করা হবে।’ ডিএসপি সাহেব ওড়িয়া ভাষায় এই ধরনের একটা কিছু নির্দেশ দিলেন। তারপর আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘অনির্বাণ দত্তকে ডেকে পাঠালাম। পনেরো মিনিট পরে আসছে।’
না বললেও চলত। ‘অনির্বাণ দত্ত’ এবং ‘ইন্টারোগেট’ শব্দ দু’টো আদিত্য ধরতে পেরেছিল। বাকিটা তার থেকে আন্দাজ করা শক্ত নয়। আদিত্যর খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। সে ডিএসপি কৃষ্ণ পধির অনুমতি নিয়ে সিগারেট খেতে বাইরে বেরোল।
আকাশে মেঘ আছে। মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া। তবে সমুদ্র এখনও ততটা উত্তাল হয়ে ওঠেনি। আদিত্য সিগারেট ধরিয়ে সমুদ্রের দিকে গিয়েছিল। সমুদ্রের ধারে অত হাওয়ার মধ্যে সিগারেট খেয়ে সুখ হয় না। তাই আবার রিসর্টের দিকে ফিরে এল আদিত্য। রিসর্টের বাগানে দাঁড়িয়ে সিগারেটে টান দিতে দিতে সে রিসর্টের ওপর অলস দৃষ্টি রাখছিল। সেই দুজন কনস্টেবলের একজন লম্বা করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কোণের দিকের একটা ঘরে গিয়ে কলিং বেল বাজাচ্ছে। অন্যজন তার সঙ্গে খানিকটা এসে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। নিশ্চয় ওটা অনির্বাণ দত্তর ঘর। কনস্টেবলরা ওকে ডাকতে এসেছে। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না কেন? খানিকক্ষণ পরে লোকটা আবার বেল বাজাল। এবারেও কোনও উত্তর নেই। আদিত্য বিপদের গন্ধ পাচ্ছে।
প্রথম কনস্টেবলটি এখন দ্বিতীয় জনকে ডাকছে। এবার আর কলিং বেল নয়, দুজনে মিলে দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। বেশ জোরে ধাক্কা দিচ্ছে। আদিত্য এত দূর থেকে দরজা ধাক্কা দেবার শব্দ শুনতে পাচ্ছে। তবু কোনও সাড়া নেই। অনির্বাণ দত্ত ঘরে নেই নাকি? খেতে গেছে? খেতে গেলে তো ডাইনিং হলে তাকে দেখাই যেত।
আদিত্য আধখাওয়া সিগারেটটা ঘাসে ফেলে পায়ে চেপে দ্রুত গতিতে রিসেপশনের সামনে পৌঁছে গেল। সেখানে কনস্টেবল দুজন ডিএসপি সাহেবকে সমস্যাটা বলছে।
ডিএসপি কৃষ্ণ পধি আদিত্যকে দেখে সংক্ষেপে বললেন, ‘অনির্বাণ দত্ত দরজা খুলছে না, ঘরে আছে কিনা সেটাই বোঝা যাচ্ছে না।’
‘রিসেপশন থেকে ওর ঘরে একটা ফোন করুন না।’ আদিত্যর গলায় উৎকণ্ঠা।
‘সেটাই করব ভাবছিলাম।’
ঘরে ফোন করে কিন্তু কোনও উত্তর পাওয়া গেল না। অনেকক্ষণ ধরে ফোনটা বেজে গেল। রিসেপশানের কম্পিউটার থেকে অনির্বাণ দত্তর মোবাইল নম্বরটাও পাওয়া গেছে। কিন্তু কোনও সাড়া শব্দই করছে না ফোনটা। মনে হচ্ছে সুইচড অফ।
ডাইনিং হলে জিজ্ঞেস করে এটাও জানা গেল যে আজ অনির্বাণ দত্ত ব্রেকফাস্ট খেতে ডাইনিং হলে আসেননি, রুম সার্ভিসেও ব্রেকফাস্ট অর্ডার দেননি। আর প্রথম দিন এসেই তিনি বেড টি দিতে বারণ করে দিয়েছেন কারণ খুব সকালে তিনি ঘুম থেকে উঠতে পারেন না। কাল রাত্তিরে ডিনার খাবার সময় অনির্বাণ দত্তকে শেষ দেখা গেছে, তারপর আর তাকে কেউ দেখেনি। আদিত্যরও মনে পড়ল, সে আর কেয়া কাল রাত্তিরে যখন ডিনার খাচ্ছিল, তখন অনির্বাণও একা একটা টেবিলে বসে ডিনার খাচ্ছিল।
ডিএসপি সাহেব বললেন, ‘আর কোনও উপায় দেখছি না। এবার ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে অনির্বাণ দত্তর ঘরটা খুলতে হবে। লোকটা যদি ভেতরে লুকিয়ে বসে না থাকে, ধরে নিতে হবে সে জেরার ভয়ে পালিয়ে গেছে। ওর নামে ট্রেন স্টেশন, এয়ারপোর্ট, টাক্সিস্ট্যান্ড সব জায়গায় পাহারা বসাতে হবে। কাজ বেড়ে গেল।’
আদিত্য কিছু বলল না। কিন্তু মনে মনে সে আরও বড় কোনও ঘটনার জন্যে তৈরি হচ্ছে।
পুলিশের দলটা ম্যানেজার রঘুনন্দন পানিগ্রাহীকে সঙ্গে নিয়ে অনির্বাণ দত্তের ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। রঘুনন্দনের হাতে দরজা খোলার স্মার্টকার্ড।
দরজা খুলে দেখা গেল ঘর ফাঁকা। বিছানা পরিপাটি করে পাতা। কাল রাত্তিরে হাউসকিপিং-এর লোক এসে বিছানা করে দেবার পরে মনে হয় না অনির্বাণ এই বিছানায় শুয়েছিল। করিডোরের দিকে কোনও জানলা নেই, শুধু একটা দরজা, যে দরজাটা খুলে ওরা ঘরে ঢুকল। উল্টোদিকে, অর্থাৎ সমুদ্রের দিকে আর একটা দরজা এবং একটা জানলা। জানলায় ভেনেশিয়ান ব্লাইন্ড ফেলা বলে বাইরে থেকে ঘরের ভেতরটা দেখা যায় না। কিন্তু ব্লাইন্ডের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে ঘরটাকে কিছুটা আলোকিত করে রেখেছে। হয়ত সেই কারণেই আদিত্য প্রথমে খেয়াল করেনি ঘরে আলো জ্বলছে। ব্যাপারটা খেয়াল করার পর সে দেখল অনির্বাণ দত্তর স্মার্টকার্ডটা সকেটে লাগানো আছে। ওটা সকেট থেকে বার করে নিলে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ঘরের আলো নিভে যেত। আদিত্য সেদিকে ডিএসপি সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
ইন্সপেক্টার পণ্ডা ডিএসপি কৃষ্ণ পধিকে ওড়িয়া ভাষায় কিছু একটা বলল। আদিত্য ধরতে পারল না কী বলছে। সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
ডিএসপি আদিত্যর দিকে ফিরে বলল, ‘পণ্ডা বলছে, ঘরে আলো জ্বললেও এসি কিংবা পাখা কিছুই চলছিল না। কাল রাত্তিরে কিন্তু বেশ গরম ছিল। এসি চালানোর মতো গরম।’
আদিত্য বলল, ‘হুঁ।’ ওইটুকু বলেই সে চিন্তায় ডুবে গেছে।
‘এমন হতে পারে অনির্বাণ দত্ত পালিয়ে যাবার আগে ইচ্ছে করে ঘরে আলোটা জ্বেলে রেখে গিয়েছিল যাতে লোকে মনে করে সে ঘরেই আছে। কিন্তু অভাসবশত এসিটা নিবিয়ে দিয়েছিল।’ ডিএসপি সাহেব চিন্তিত গলায় বললেন।
‘হতেই পারে, হতেই পারে। বিশেষ করে রিসর্টের আংশিক মালিকানা এখন তো তার। মিছিমিছি ইলেকট্রিক বিল উঠলে তারও ক্ষতি। হয়তো সেইজন্যে সে এসিটা নিবিয়ে গিয়েছিল। তবে একটা জিনিস দেখুন, অনির্বাণ দত্তর স্যুটকেসটা কিন্তু ঘরেই রয়েছে। এবং এই দেখুন স্যুটকেসে তার অধিকাংশ জামাকাপড়ও রয়েছে। মনে হচ্ছে, লোকটা একবস্ত্রে বেরিয়ে গিয়েছিল। কেন? কী এমন তাড়া ছিল তার?’ আদিত্য প্রায় নিজের মনেই বিড়বিড় করছে।
আদিত্য খেয়াল করল অনির্বাণ দত্তর মোবাইল এবং পার্স ঘরে নেই।
‘আমি হেড কোয়ার্টারে অনির্বাণ দত্তর মোবাইল নম্বরটা জানিয়ে দিচ্ছি। ওদের বলছি, যদি মোবাইলটা চালু হয় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ওটাকে ট্রেস করে ওটার লোকেশানটা জানিয়ে দিতে। আর অনির্বাণ দত্তর কোনও ছবি কি পাওয়া যাবে? তা হলে ছবিটা আমার অফিসারদের হোয়াটসঅ্যাপ করে দিতাম। লোকটাকে খুঁজতে সুবিধে হত।’
‘ছবি নিশ্চয় পাওয়া যাবে। শনিবার রাত্তিরে তো প্রফেশানাল ফটোগ্রাফার এসে অনেকগুলো ছবি তুলেছিল। নিশ্চয় অনির্বাণের ছবিও তুলেছিল। আপনি ম্যানেজার রঘুনন্দনকে জিজ্ঞেস করলে ও বলতে পারবে। ও-ই তো পুরো ইভেন্টটা ম্যানেজ করছিল।’
আদিত্য সমুদ্রের দিকের দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে সিগারেট ধরাল। ঘরের মধ্যে তার যা দেখার দেখা হয়ে গেছে।
অনির্বাণ দত্তকে খোঁজার জন্য নির্দেশ দিতে ডিএসপি সাহেবের বেশ খানিকটা সময় লেগে গেল। ইতিমধ্যে কী করে যেন রটে গেছে অনির্বাণকে পাওয়া যাচ্ছে না। অসীম দত্তর পরিবারের কয়েকজন এসে পুলিশের কাছে খোঁজ খবর করছিল। তাতেও কিছু সময় নষ্ট হয়েছে। ফলে পরবর্তী ইন্টারোগেশন যখন শুরু হল তখন প্রায় চারটে বাজে। অনির্বাণ দত্তর স্ত্রী দীপশিখাকে ডাকা হয়েছে।
‘আপনি নিশ্চয় শুনেছেন আপনার স্বামীকে পাওয়া যাচ্ছে না। কাউকে কিছু না বলে উনি কোথাও একটা চলে গেছেন। এ-ব্যাপারে আপনি কি কিছু জানেন?’ ডিএসপি কৃষ্ণ পধি শুরু করলেন।
‘আমি কী করে জানব? আমার সঙ্গে আমার স্বামীর কোনও সম্পর্ক নেই। সকলেই এটা জানে। উনি কোথায় যাচ্ছেন না যাচ্ছেন আমি জানব কী করে?’ দীপশিখার মুখটা কঠিন দেখাল।
‘বুঝতে পারছি। আচ্ছা, অনির্বাণবাবুর সঙ্গে শেষ কবে আপনার কথা হয়েছে?’
দীপশিখা চুপ করে আছে। কিছু একটা বলতে গিয়ে ইতস্তত করছে। আদিত্য তাকে সময় দিতে চায়। ডিএসপি সাহেব অধৈর্য হয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, আদিত্য তাঁকে হাত তুলে নিরস্ত করল। তার মনে হচ্ছে যা বলার দীপশিখা নিজের থেকেই বলবে।
একটু পরে দীপশিখা বলল, ‘আপনাদের কাছে সত্যিটা লুকিয়ে লাভ নেই। আপনারা পরে হয়ত নিজেরাই বার করে ফেলবেন। তাছাড়া সত্যিটা বললে কোনও ক্ষতিও নেই। সত্যিটা হল, যে রাত্তিরে আমার শ্বশুরমশাই খুন হন, সেই রাত্তিরেই আমার সঙ্গে অনির্বাণের কথা হয়েছিল।’
‘ঠিক কখন কথা হয়েছিল? কী নিয়ে কথা হয়েছিল? একটু খুলে বলবেন?’ আদিত্য ঈষৎ উত্তেজিত গলায় বলল।
‘হ্যাঁ, বলছি।’ দীপশিখা চুপ করে থেকে আবার শুরু করল।
‘আপনারা নিশ্চয় জানেন আমার স্বামীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভাল নয়। আমি দু’বছর অনির্বাণের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর পারলাম না। কলকাতায় ফিরে এলাম। ব্যাপারটা এখন ডিভোর্সের দিকে এগোচ্ছে। অনির্বাণ ভয় দেখাচ্ছে আমার নামে অ্যাডালট্রির চার্জ আনবে। সেই চার্জ প্রমাণিত হলে অনির্বাণকে অ্যালিমনি দিতে হবে না। অনির্বাণের যা টাকা আছে তাতে ও বেস্ট লইয়ারদের নিয়োগ করে কেস জিতে যেতে পারবে। আমার তো কোনও টাকা-পয়সাই নেই। আমি অনির্বাণের সঙ্গে লড়ব কী করে?’
‘আপনার বাপের বাড়ি থেকে সাহায্য পাবেন না?’ ডিএসপি জিজ্ঞেস করলেন।
‘না। তার কোনও আশা নেই। আমার বাবা দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী। মা কিছু করে না। আমার আর কোনও ভাই-বোন নেই। আমাকেই ওদের হেল্প করতে হয়।’
‘আপনার শ্বশুরমশাই এই ব্যাপারটা জানতেন না?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘জানতেন। আমিই বাধ্য হয়ে জানিয়েছিলাম। আমাকে উনি ছোট থেকেই খুব স্নেহ করেন। আমার বাবা আর শ্বশুরমশাই ইস্কুলের বন্ধু। তাই আমার শ্বশুরমশাই আমাকে ছোট থেকে দেখছেন। আমাদের বিয়েটা দুই বাবা মিলে ঠিক করেছিলেন।’
দীপশিখা আবার থামল। আদিত্য বুঝতে পারছে না পুরোনো স্মৃতি তাকে আরাম দিচ্ছে নাকি যন্ত্রণা।
‘যাক, যেটা বলছিলাম,’ দীপশিখা অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে এসেছে, ‘আমার শ্বশুরমশাই যখন শুনলেন অনির্বাণ আমার বিরুদ্ধে অ্যাডালট্রির অভিযোগ আনতে চলেছে উনি ভীষণ রেগে গেলেন। উনি আমাকে বললেন উনি আমার সঙ্গে আছেন। মামলার সমস্ত খরচ উনি দেবেন। কথাটা উনি অনির্বাণকেও জানিয়ে দিলেন। অনির্বাণ একটু ঘাবড়ে গেল। বুঝল, যত সহজে সে কেসটা জিতে যাবে ভেবেছিল ব্যাপারটা তত সহজ হবে না।’
‘অনির্বাণ দত্তর বিরুদ্ধে আপনার কী চার্জ?’ ডিএসপির জিজ্ঞাসা।
‘ক্রুএলটির চার্জ। দিনের পর দিন অনির্বাণ আমাকে ভার্বালি অ্যাবিউস করেছে। আমাকে যে ভাবে ট্রিট করেছে লোকে রাস্তার কুকুরকেও তার থেকে ভাল ভাবে ট্রিট করে। আর সবার ওপরে ফিসিকাল অ্যাবিউস তো আছেই। একবার তো মেরে মাথাটাই ফাটিয়ে দিল। আর একবার হাতটা এত জোরে মুচড়ে দিল যে হাড়ে স্প্রেন হয়ে গেল। আমার কাছে সমস্ত মেডিকাল রিপোর্ট আছে। ভাল লইয়ার পেলে আমার কেসটা দাঁড় করাতে অসুবিধে হবে না।’
‘হুঁ। তারপর?’ আদিত্য নিবিষ্ট হয়ে শুনছে।
‘আমার শ্বশুরমশাই তাঁর ফাইন্যান্সিয়াল রিসোর্স নিয়ে আমার পাশে দাঁড়ানোর পর অনির্বাণ একটু পিছিয়ে গেল। শ্বশুরমশাই অনির্বাণকে বললেন আমার সঙ্গে বসে কথা বলে সে যেন মিউচুয়াল ডিভোর্সে রাজি হয়ে যায়। একটা অ্যালিমনি অনির্বাণকে দিতেই হবে। ঠিক হল, টাকার অঙ্কটা কী হবে সেটা নিয়ে আগে অনির্বাণ আর আমি কথা বলব। তারপর দুজনে একসঙ্গে শ্বশুরমশায়ের সঙ্গে বসব। সেই অনুযায়ী, শনিবার রাত্তিরে ডিনারের পর আমি প্রাথমিক কিছু কথাবার্তা বলতে অনির্বাণের সঙ্গে দেখা করেছিলাম।’
‘কোথায় দেখা করেছিলেন?’
‘আমাদের ঘরগুলোর পেছন দিক দিয়ে যে সরু করিডোরটা গেছে তার একেবারে পশ্চিমপ্রান্তে দেখবেন একটা ঘর আছে। ঘরটা খুব ছোট নয়। ঘরটাতে অনায়াসে দশ-পনের জনের জন্মদিন বা বিবাহবার্ষিকীর পার্টি হতে পারে। মনে হয় ওই উদ্দেশ্যেই ভাড়া দেওয়া হবে বলে ঘরটা তৈরি হয়েছে। এখন তো ঘরটা ফাঁকা পড়ে রয়েছে। ওখানেই অনির্বাণের সঙ্গে দেখা করেছিলাম।’
‘কতক্ষণ কথা বলেছিলেন আপনারা?’
‘ঠিক মনে নেই, তবে মিনিট দশেকের বেশি হবে না। আমি মনে মনে ভেবে নিয়ে গিয়েছিলাম একটা সমঝোতা করব। কিন্তু গিয়ে দেখলাম সেটা অসম্ভব। অনির্বাণ একটুও বদলায়নি। সেই ঔদ্ধত্য, সেই অন্যকে হেয় করে মজা পাওয়ার চেষ্টা। আসলে ও মানসিকভাবে অসুস্থ। কোনও ভাল সাইকিয়াট্রিস্ট-এর কাছে গিয়ে অসুখটা না সারালে ও বদলাবে না। এত অপমানিত লাগছিল। মিউচুয়াল ডিভোর্স-এর প্রসঙ্গ না তুলেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।’
‘আপনি যে ঘরটার কথা বলছেন সেটা আমি দেখেছি। ওখান থেকে অসীম দত্তর অফিস ঘরটার পেছন দিকটা দেখা যায়। আপনি কি খেয়াল করেছিলেন পেছন দিকের জানলা দিয়ে আলো আসছে কিনা?’
‘তখন খুব সচেতনভাবে খেয়াল করিনি। কিন্তু আপনি বলার পর মনে হচ্ছে অফিসের জানলা দিয়ে একটা আলো করিডোরে এসে পড়ছিল। আসলে আমি খুব সচেতনভাবে এটা খেয়াল করিনি তার কারণ বোধহয় আমি আগেই জানতাম উনি ওঁর অফিসে আছেন। উনি অফিসে কাজ করবেন বলেই তো উঠে গেলেন, তাই না? আপনিও তো শুনেছেন।’ শেষ কথাগুলো আদিত্যকে।
‘আপনি কি কাউকে আপনার শ্বশুরমশায়ের অফিসের পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখেছিলেন?’ আদিত্য সরাসরি উত্তর দিল না।
‘না। দেখিনি। দেখলে নিশ্চয় আমার মনে থাকত।’ দীপশিখা বেশ জোর দিয়ে বলল।
‘আচ্ছা একটা অন্য প্রসঙ্গে আসছি। আপনার শ্বশুরমশায়ের জীবনে কি কোনও স্ক্যান্ডেল ছিল?’
‘স্ক্যান্ডেল!’ আদিত্যর মনে হল দীপশিখা চেষ্টা করে অবাক হবার অভিনয় করছে। তার কানদুটো লাল হয়ে গেছে। কপালে সামান্য ঘাম।
‘কই না তো। আমার শ্বশুরমশায়ের কোনও স্ক্যান্ডেলের কথা আমি অন্তত জানি না। কিন্তু এরকম অদ্ভুত প্রশ্ন করার মানে কী?’ দীপশিখা ভাব করছে যেন প্রশ্নটা শুনে সে ভীষণ আহত হয়েছে।
ডিএসপি বললেন, ‘একটা পারসোনাল অবজারভেশন। ছন্দা দত্ত তার শ্বশুরকে বাবা বলে রেফার করছিলেন। আপনি কিন্তু অসীমবাবুকে শ্বশুরমশাই বলেই রেফার করে গেলেন। হোয়াই দিস ডিফারেন্স?’
‘দেখুন এক-একজন এক-একরকম ভাবে চিন্তা করে। আমার মনে হয়, শ্বশুর যতই ভাল হোন না কেন তিনি কখনও বাবার জায়গা নিতে পারেন না। এটা অবশ্য আমার ব্যক্তিগত মত।’ দীপশিখা মজুমদার দত্ত ম্লান হাসল।
ঘরে একজন কনস্টেবল ঢুকে পড়েছে। এ সেই দুজনের একজন যারা অণির্বাণ দত্তকে ডাকতে গিয়েছিল। লোকটাকে খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছে। ওড়িয়া ভাষায় সে ডিএসপি সাহেবকে যা বলল, আদিত্য তার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারল না। তবে আন্দাজ করল কিছু একটা ঘটেছে।
ডিএসপি কৃষ্ণ পধি আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনার আর কোনও প্রশ্ন নেই তো?’
আদিত্য ঘাড় নেড়ে না বলার পর দীপশিখার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমাদের আর কোনও প্রশ্ন নেই। আপনি এখন তাহলে আসতে পারেন।’
দীপশিখা ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর আদিত্য বলল, ‘ব্যাপার কী ডিএসপি সাহেব? মনে হল আপনার কনস্টেবল কিছু একটা খবর নিয়ে এসেছে।’
‘হ্যাঁ। খবর এসেছে অনির্বাণ দত্তর মোবাইলে কাল রাত্তিরে একটা ফোন এসেছিল। অনির্বাণ দত্ত ফোনটা ধরে প্রায় তিন মিনিট কথা বলেছিল।’
‘ক’টার সময় সেই ফোনটা এসেছিল?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘রাত্তির সাড়ে এগারোটা নাগাদ। তখন তো বটেই আজ সকাল সাতটা পনেরোতেও অনির্বাণ দত্তর ফোনটা চালু ছিল। সকালে একটা ফোন এসেছিল, অনির্বাণ দত্ত সেটা ধরেনি। বেজে বেজে ফোনটা থেমে গেছে।’
‘রাত্তির সাড়ে এগারোটার ফোনটা ট্রেস করার চেষ্টা হয়েছিল?’
‘হয়েছিল। কিন্তু সেই ফোনটা ততক্ষণে সুইচঅফ হয়ে গেছে। তবে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আমরা আবিষ্কার করেছি। খুন হবার আগে অসীম দত্তকে যে ফোনটা থেকে ফোন করা হয়েছিল, এটা সেই নাম্বার। অর্থাৎ খুনের আগে যে নম্বর থেকে অসীম দত্ত ফোন পেয়েছিলেন এটা এক্স্যাটলি সেই নম্বর। আমরা অসীম দত্তর কল লিস্ট থেকে ফোনটা ট্রেস করার পর একবার ফোন করেছিলাম। তখনও ফোনটা বন্ধ ছিল। মাঝে নিশ্চয় ফোনটা সুইচ অন করে অনির্বাণ দত্তকে ফোন করা হয়েছিল। কিন্তু আমরা সেটা ধরতে পারিনি। আমাদের উচিত ছিল কনটিনুয়াসলি ফোনটা মনিটর করা। সেটা করা হয়নি।’
‘যাগগে যা হবার তো হয়েই গেছে। কিন্তু কী জানেন? আমার মন বলছে ওই ঘরটা একবার দেখা দরকার যেখানে অনির্বাণের সঙ্গে দীপশিখা দেখা করেছিল। চলুন না একবার গিয়ে দেখে আসি। মোবাইলটা তো অনির্বাণের পকেট থেকেও ওখানে পড়ে যেতে পারে। হয়তো পড়ে গিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে।’
‘ঠিক আছে চলুন। আপনি বলছেন যখন।’ ডিএসপি সাহেবের কণ্ঠস্বর থেকে এটা স্পষ্ট যে তাঁর মনে হচ্ছে যাওয়াটা বিফল হবে।
পিছনের করিডোরে খুব হাওয়া। হাওয়াদের ঢেউ সরাসরি সমুদ্র থেকে দৌড়ে দৌড়ে আসছে। সমুদ্রের ওপরে পুঞ্জীভূত কালো মেঘমালা। সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গের সঙ্গে সংগতি রেখে ঝাউবন হাওয়াদের সঙ্গে নাচছে। হাতে সময় থাকলে আদিত্য তন্ময় হয়ে দেখত।
আকাশের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে আদিত্যর মনে হঠাৎ কামড় দিল চিলকার দিকে যদি বৃষ্টি নামে কেয়ারা ঠিকঠাক ফিরতে পারবে তো? কেয়ারা কি রওনা হয়ে গেছে?
কোণের ঘরের দরজা বন্ধ, তবে তালা দেওয়া নয়। নব ঘোরাতেই দরজা খুলে গেল। ভিতরে কুপকুপে অন্ধকার। কিচ্ছু দেখা যায় না। একজন কনস্টেবল ঘরের ভিতরে ঢুকে হাতড়ে হাতড়ে সুইচবোর্ডটা বার করে ফেলল। আলো জ্বলে ওঠার পর কয়েক সেকেন্ড আদিত্যর চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল। চোখে আলো সয়ে আসতে সে দেখতে পেল সামনের সোফার ওপর অনির্বাণ দত্ত মরে কাঠ হয়ে বসে আছে। বুকের বাঁদিকে জমাট বাঁধা রক্ত। মুখের অভিব্যক্তিতে অবিশ্বাস। যেন সে শেষ মুহূর্তেও বিশ্বাস করতে পারেনি আততায়ী তাকে গুলি করতে পারে। অনির্বাণ দত্তর বুকে যে গুলি লেগেছে এবং তার দেহে যে আর প্রাণ নেই এগুলো বোঝার জন্যে কাছে গিয়ে লাশ পরীক্ষা করার দরকার পড়ে না।
পার্সটা অনির্বাণ দত্তর পেছনের পকেটে রয়েছে কিন্তু অনেক খুঁজেও ঘরের মধ্যে কোথাও অনির্বাণ দত্তর মোবাইলটা পাওয়া গেল না।
(৩)
কেয়া ভয় পেয়েছে। বারবার বলছে, এই রিসর্ট ছেড়ে আজই চলে যাবে। কাছাকাছি অনেক থাকার জায়গা আছে, কোথাও জায়গা পাওয়া যাবে না, হতেই পারে না। রিসর্টে সবসুদ্ধু চব্বিশটা ঘর। তার মধ্যে ছ’টা ঘর অসীম দত্তর পরিবারের দখলে, একটা আদিত্যদের জন্য বরাদ্দ, অসীম দত্ত যে ঘরটায় ছিলেন সেটাও ফাঁকা পড়ে আছে। বাকি ষোলোটা ঘরের সব ক’টাতেই বাইরের গেস্ট, যারা পয়সা দিয়ে থাকছে। প্যাকেজ অনুযায়ী আগামীকাল অবধি এদের বুকিং। এদের অনেকেই পয়সার মায়া ত্যাগ করে রিসর্ট ছেড়ে চলে যাচ্ছে। যে কয়েকজন রয়ে গেছে, প্রদীপ চক্রবর্তীরা তাদের মধ্যে আছে। প্রদীপ এবং রাখির সহজ কথা। এত কষ্টের পয়সা খরচ করে যখন এসেছি, পুরোটা উসুল করে যাব। ম্যানেজার রঘুনন্দন জানাল, পরশু থেকে যত বুকিং ছিল সব ক্যানসেল করা হয়েছে। পরশু থেকে রিসর্ট অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হবে।
আদিত্য আর কেয়া প্রদীপ চক্রবর্তীদের সঙ্গে ডিনার খাচ্ছিল। ডাইনিং হল আজ ফাঁকা, ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাঁচ-ছ’টা পরিবার ডিনার খাচ্ছে। কিন্তু দত্ত বা মল্লিক বাড়ির কাউকে দেখা যাচ্ছে না। প্রদীপ এবং রাখি চক্রবর্তী রিসর্ট ছেড়ে যাচ্ছে না শুনে কেয়া, মনে হয়, একটু বল-ভরসা পেয়েছে। আর ‘চলে যাব’ ‘চলে যাব’ বলে আদিত্যকে ভয় দেখাচ্ছে না।
‘অনির্বাণ দত্ত কখন খুন হয়েছিল গো?’ কেয়া জিজ্ঞেস করল।
‘পুলিশের ডাক্তার বলছে খুনটা কাল রাত্তিরে এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে হয়েছিল। সময়টা এর থেকে একটু এদিক-ওদিক হতে পারে কিন্তু এটা নিয়ে সন্দেহ নেই যে খুনটা কাল রাত্তিরেই হয়েছে।’
‘লোকটা অতক্ষণ ওই ঘরটাতে মরে পড়ে রইল, অথচ কেউ খেয়ালই করল না? এটা কিন্তু বেশ আশ্চর্য ব্যাপার।’ প্রদীপ চক্রবর্তী মন্তব্য করল।
‘ওই ঘরটাতে সাধারণত কেউ যায় না। তাই হয়ত কেউ লক্ষ করেনি। একজন সিকিউরিটি গার্ড অবশ্য বলছে সে রাত্তির এগারোটা সাড়ে এগারোটা নাগাদ অনির্বাণ দত্তকে ওই ঘরে দেখেছে। অন্য কোনও গেস্ট হলে সে আপত্তি করত, কিন্তু সে জানত অনির্বাণ দত্ত মালিকের ছেলে। তাই সে কিছু বলেনি। সিকিউরিটি গার্ড দেখেছে অনির্বাণ ঘরের দরজা খুলে রেখে কারও জন্যে অপেক্ষা করছিল। বলাই বাহুল্য, ঘরে তখন আলো জ্বলছিল, কিন্তু আমরা যখন ওই ঘরে ঢুকলাম তখন ঘরটা ছিল একেবারে অন্ধকার।’
‘এটা তো আশ্চর্য কিছু নয়।’ প্রদীপ চক্রবর্তী ভুরু কুঁচকে বলল। ‘খুনি নিশ্চয় কাজ সারার পর আলো নিভিয়ে, দরজা টেনে দিয়ে চলে গেছিল। যাতে ঘরটা কারও দৃষ্টি আকর্ষণ না করে।’ তারপর মুচকি হেসে যোগ করল, ‘আমি খুনি হলে তাই করতাম।’
‘আপনি ঠিকই বলেছেন, প্রদীপদা। সেই সিকিউরিটি গার্ডই রিসর্টটা টহল দিতে দিতে ঘণ্টা দেড়েক পরে যখন ওই ঘরটার সামনে আবার ফিরে এসেছিল, সে ঘরের দরজা বন্ধই দেখেছিল। আর জানলার ভেনিশিয়ান ব্লাইন্ড-এর ফাঁক দিয়েও কোনও আলো আসছিল না। অতএব সে ধরে নিয়েছিল অনির্বাণ ঘরের আলো নিভিয়ে দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরে ফিরে গেছে।’
‘কিন্তু আজ সকালে ঝাড়পোঁচ করার জন্যেও কি কেউ ঘরটাতে ঢোকেনি?’ রাখি জিজ্ঞেস করল।
‘আমরা হাউসকিপিং-এ খোঁজ নিয়েছিলাম। যে মহিলা ওই ঘরটা পরিষ্কার করার দায়িত্বে আছে সে বলল ওই ঘরটা যেহেতু নিয়মিত ব্যবহার হয় না তাই সে একেবারে শেষে, বাড়ি যাবার ঠিক আগে, সে ওই ঘরটা ঝাড়পোঁচ করে। গতকালও তাই করত। কিন্তু তার আগেই আমরা ওই ঘরে ঢুকে পড়ি।’
‘তুমি কী করে বুঝলে গো অনির্বাণ দত্তর বডিটা ওই ঘরেই আছে?’ কেয়া ঈষৎ আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করল।
‘ঠিক জানি না। বলতে পার ইনটুইশান। এর কোনও ব্যাখ্যা নেই।’
‘আপনার কী মনে হয় অসীম দত্তকে যে খুন করেছে সে-ই অনির্বাণ দত্তকে খুন করেছে?’ প্রদীপ চক্রবর্তীর গলায় কৌতূহল।
‘প্রাথমিকভাবে দেখে আমার তো তাই মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, একই বন্দুক থেকে দু’জনকে গুলি করা হয়েছিল। ব্যালিস্টিক রিপোর্টটা পেলে নিশ্চিত হওয়া যাবে।’
‘তার মানে ওদের বাড়ির কেউই দু’জনকে খুন করেছে?’ রাখি সরলভাবে জিজ্ঞেস করল।
তার প্রশ্নের উত্তর দেবার আগেই খাবার এসে গেছে। যেসব গেস্টরা এত সব সত্ত্বেও থেকে গেল তাদের জন্য রিসর্ট স্পেশাল মেনু করেছে। তার মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোগ্য লবস্টার থার্মিডোর এবং স্মোকড হিলসা। চিংড়ি ও ইলিশের সহাবস্থান দেখে সকলেই বেশ হকচকিয়ে গেছে। ফলে রাখি চক্রবর্তীর প্রশ্নটা চাপা পড়ে গেল।
পরের দিন সকাল দশটা নাগাদ ডিএসপি কৃষ্ণ পধি তাঁর দলবল নিয়ে হাজির। শ্বেতা মল্লিক এবং তার স্বামীকে এখনও জিজ্ঞাসাবাদ করা বাকি আছে।
আজই এখানে আদিত্যদের শেষ দিন, তাই সে ভেবেছিল কেয়াকে নিয়ে সমুদ্রের ধারে অনেকটা সময় কাটাবে। সমুদ্র তার বুকের ওপর চেপে বসেছে।
কিন্তু কৃষ্ণ পধি রিসর্টে হাজির হয়েই তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। ইন্টারোগেশনের সময় তিনি চান আদিত্য উপস্থিত থাকুক। পেশাগত দিক থেকে সেটাই আদিত্যর করা উচিত, কিন্তু আজ এই শেষ দিনে কেয়াকে সঙ্গে নিয়ে সমুদ্রের ধারে সময় কাটাতেই বেশি ইচ্ছে করছে।
গতকালের ঝোড়ো হাওয়া, মেঘ কিছুই আর নেই। সমুদ্রের ধারে চড়চড়ে রোদ্দুর। গুমোট। আদিত্য ভাবল, ভালই হয়েছে এখন সমুদ্রের ধারে যাওয়া হচ্ছে না। এত রোদ্দুরে সমুদ্রটাকে খুব একটা উপভোগ করা যেত না। কেয়াও বোধহয় ব্যাপারটা বুঝতে পারছে। তাই আদিত্যর অনুপস্থিতি নিয়ে সে খুব একটা রাগারাগি করছে না। শুধু বলল, ‘কাজ শেষ করে খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবে। আমাকে যেন একা একা লাঞ্চ খেতে না হয়।’
আদিত্য আপিসঘরে ঢুকে দেখল তার জন্যে সকলে অপেক্ষা করছে। টেবিলের একদিকে শ্বেতা মল্লিক একা একটা চেয়ারে বসে আছে। টেবিলের উল্টোদিকে তিনটে চেয়ার। তার মধ্যে দুটো ডিএসপি কৃষ্ণ পধি এবং ইন্সপেক্টার পণ্ডার দখলে। আর একটা চেয়ার ফাঁকা, সেটা, ধরে নেওয়া যায়, আদিত্যর জন্যে।
‘আপনার বাবা এবং ভাই-এর মৃত্যুর জন্যে আপনাকে আমাদের গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।’ আদিত্য চেয়ারে বসার পর ডিএসপি শুরু করলেন। ডিএসপির বাংলার ওপর দখল আদিত্যকে মুগ্ধ করেছে।
ডিএসপির নরম কথার কোনও সাড়া কিন্তু শ্বেতা মল্লিকের দিক থেকে পাওয়া গেল না। সে রুক্ষ গলায় বলল, ‘সমবেদনা-টমবেদনা ছাড়ুন। আপনারা যদি একটু তাড়াতাড়ি এই ইন্টারোগেশনের ঝামেলাটা চুকিয়ে দিতে পারেন তাহলেই হবে।’
ডিএসপি সাহেব চটেছেন। তিনি চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ‘মিসেস মল্লিক, আপনার বাবা এবং ভাই খুন হয়েছেন। এদের মৃত্যুতে আপনার এবং আপনার স্বামীর প্রচুর লাভ। তাছাড়া আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি আপনাদের ফাইন্যান্সিয়াল অবস্থাও এখন ভাল যাচ্ছে না। তাই অসীম দত্ত এবং অনির্বাণ দত্তকে খুন করার মোটিভ আপনার এবং আপনার স্বামীর দুজনেরই আছে। অর্থাৎ আপনি একজন প্রাইম সাসপেক্ট। এই অবস্থায় আপনাকে আমরা যতক্ষণ খুশি ইন্টারোগেট করব। দরকার হলে থানায় নিয়ে গিয়ে ডিটেনও করতে পারি। অতএব মেজাজ ঠাণ্ডা রেখে আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিন। অধৈর্য হলে আপনারই ক্ষতি।’
শ্বেতা মল্লিক কিছু একটা উত্তর দিতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিল। সে চুপ করে বসে আছে।
‘আমাদের প্রথম প্রশ্ন, গত শনিবার রাত্তির সাড়ে নটা থেকে পৌনে এগারোটার মধ্যে আপনি একবারও কি ব্যাঙ্কোয়েট হল থেকে বেরিয়েছিলেন?’
‘মনে নেই। বোধহয় বেরিয়েছিলাম।’ শ্বেতা মল্লিক তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল। ‘আর বেরোলেই বা কী হয়েছে?’
শ্বেতা মল্লিকের হাবভাব আদিত্যকেও রাগিয়ে দিচ্ছে। সে বলল, ‘মিসেস মল্লিক, আপনার খুব ভাল করেই মনে থাকার কথা আপনি অন্তত দুবার বেরিয়েছিলেন। দুবারই আপনার বাবা হল থেকে বেরিয়ে যাবার পর। একবার আপনি আপনার মাতাল স্বামীকে ধরে আনতে রিসর্টের বারে গিয়েছিলেন। বারম্যান আপনাকে এবং আপনার স্বামীকে নিশ্চয় আইডেন্টিফাই করতে পারবে। আর একবার ডিনার শেষ করে অন্যদের মতো আপনিও হাত-মুখ ধুতে বেরিয়েছিলেন। আপনার স্বামীও ডিনার শেষ করে আর একবার বেরিয়েছিলেন। ফর আ কাপল অফ লাস্ট ড্রিঙ্কস। বারম্যান আর ডিঙ্ক সার্ভ করতে চাইছিল না। তার সঙ্গে আপনার স্বামীর মৃদু কথা কাটাকাটি হয়েছিল।’
শ্বেতা মল্লিক উত্তর দিল না। চোয়াল শক্ত করে বসে রইল।
‘আর একটা কথা। আপনাদের বাইরে বেরোনোটা দরকারি একটা তথ্য। যেহেতু আপনারা বাইরে বেরিয়েছিলেন, অসীম দত্তকে খুন করার সুযোগ আপনাদের ছিল।’
‘তার মানে আপনারা বলতে চান আমি আর আমার স্বামী মিলে আমার বাবাকে খুন করেছি? হাউ ডেয়ার ইউ সে দ্যাট?’ শ্বেতা মল্লিক আবার আক্রমণাত্মক।
‘আমরা এখনও বলিনি আপনারা খুন করেছেন। আমরা বলছি, আপনাদের সুযোগ এবং মোটিভ দুটোই ছিল।’ আদিত্য ঠান্ডা গলায় বলল।
শ্বেতা মল্লিক কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘আপনাদের আর কোনও প্রশ্ন আছে?’
‘হ্যাঁ আছে। পরশু রাত্তিরে এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে অনির্বাণ দত্ত খুন হয়েছে। আপনি তখন কোথায় ছিলেন?’ ডিএসপির প্রশ্ন।
‘রাত্তিরে লোকে যেখানে থাকে। আমি আমার ঘরে ছিলাম। ঘুমোচ্ছিলাম।’
‘আপনাদের গেস্ট হাউস কেমন চলছে?’ আদিত্য হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলালো।
‘আমার মনে হয় এটা ইররেলেভেন্ট প্রশ্ন। আমার বাবা এবং ভাই-এর খুনের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্কই নেই।’
‘ইররেলেভেন্ট না রেলেভেন্ট সেটা আমরা বুঝব। আপনাকে যেটা জিজ্ঞেস করা হচ্ছে তার উত্তর দিন।’ ডিএসপি সাহেব হুঙ্কার ছাড়লেন।
‘আমাদের গেস্ট হাউস ভাল চলছে।’ শ্বেতা মল্লিক কেটে কেটে উত্তর দিল।
‘আপনাদের গেস্ট হাউস যদি ভালই চলবে তাহলে কেন বারবার বাবার কাছে টাকার জন্যে হাত পাততে হত?’
‘এটা আমার এবং আমার বাবার ব্যক্তিগত ব্যাপার। পুলিশকে কৈফিয়ত দেব কেন?’
‘মিসেস মল্লিক, আপনি কেন বুঝতে পারছেন না আপনার বাবা খুন হয়েছেন। খুনের মামলায় ব্যক্তিগত বলে কিছু হয় না।’
‘ঠিক আছে। আমি বলছি। আমাদের ব্যবসায় মাঝে মাঝে টাকার দরকার পড়েছে। তখন বাবার কাছ থেকে টাকা চাইতে হয়েছে।’
‘ইদানীং কি এমন হয়েছে যে আপনি বাবার কাছে টাকা চেয়ে পাননি?’
শ্বেতা মল্লিক আবার নিরুত্তর।
‘সেই রাত্তিরে ব্যাঙ্কোয়েট হলেও আপনি আপনার বাবার কাছে টাকা চান, এবং আপনার বাবা টাকা দিতে অস্বীকার করেন। এটা আমি নিজের চোখে দেখেছি।’
শ্বেতা মল্লিকের মুখে কুলুপ।
‘আপনারা কি কোনও দোষ করেছিলেন যাতে আপনার বাবা আপনাদের ওপর রেগে গিয়েছিলেন?’
শ্বেতা মল্লিকের হঠাৎ ধৈর্যচ্যুতি হল। সে চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘দ্যাট ওল্ড ফুল ওয়াজ মেন্টেনিং এ ডাবল স্ট্যান্ডার্ড। যবে থেকে আমার মেয়ে ফুলকি, মানে স্বাতী, অভয় সিনকরের সঙ্গে লিভ ইন করছে, বাবা আমাদের ওপর খেপে গেছে। বলছে, আমার নাতনি এই ধরনের কেচ্ছা করবে এটা আমি মেনে নেব না। আমরা নাকি এ-ব্যাপারে তাকে প্রশ্রয় দিচ্ছি। এই নিয়ে বাবার সঙ্গে প্রচণ্ড ঝামেলা। এই ঝামেলার ফলে বাবা আমাদের টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।’
‘কী নাম বললেন? অভয় সিনকর?’ আদিত্য উৎকর্ণ হয়ে বলল।
‘হ্যাঁ অভয় সিনকর। ফটো জার্নালিস্ট। ও আর ফুলকি লিভ ইন করছে। ওরা বিয়ে করেনি। কোনও দিন করবে কিনা তাও জানি না। যুগের সঙ্গে সঙ্গে ইয়াংগার জেনারেশানের চিন্তাগুলোও তো বদলাচ্ছে।’
‘বুঝতে পারছি।’ আদিত্য মৃদু গলায় বলল।
‘আপনি বুঝতে পারছেন, কিন্তু মোস্ট আনফরচুনেটলি আমার বাবা বুঝতে পারেনি। বাবা বলত, এটা একটা স্ক্যান্ডেল। জানাজানি হলে নাকি সমাজে মুখ দেখানো যাবে না। বাবার ধারণা ছিল, একটু বোঝালেই ফুলকি বুঝতে পারবে। হয় অভয়কে বিয়ে করে ফেলবে আর না হয় অভয়কে ছেড়ে অন্য কাউকে। আরে বাবা, ফুলকি কী আর বাচ্চা আছে নাকি যে বোঝালেই বুঝে যাবে? তাছাড়া ও খুব লিবারেল অ্যাটমোস্ফিয়ারে বড় হয়েছে। ওর চিন্তাভাবনা খুব লিবারেল। আর সব থেকে বড় কথা, আমি বা ওর বাবা তো আপত্তি করছি না। আমার বাবার এত মাথাব্যথা কেন?’
‘কিন্তু আপনার বাবা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড মেন্টেন করছেন এটা কেন বললেন?’
শ্বেতা মল্লিক আবার কিছুক্ষণ নিরুত্তর। তারপর বিষণ্ণ গলায় বলল, ‘আমাদের মা অনেকদিন আগে চলে গেছে। তারপর থেকে বাবার একজন মিস্ট্রেস আছে। আমরা অনেকদিন কিছু জানতাম না, কিন্তু এখন সবই জানি। তবে কেউ কিছু বলতে পারিনি যেহেতু বাবার ওপর আমরা ইকনমিকালি ডিপেন্ডেন্ট ছিলাম।’
‘আপনারা সকলেই নিশ্চয় অসীমবাবুর ওপর ইকনমিকালি ডিপেন্ডেন্ট ছিলেন না। অনির্বাণ দত্তও কি তার বাবার ওপর ইকনমিকালি ডিপেন্ডেন্ট ছিল?’
‘না, ও নিজেই ভাল রোজগার করত। কিন্তু ও কী করে কথা বলবে? ওর শাশুড়ির সঙ্গেই তো বাবার সম্পর্ক।’ শ্বেতা মল্লিক ঘরের মধ্যে বোমা ফাটিয়েছে।
আদিত্য ভাবল, এটাই তাহলে সেই স্ক্যান্ডেল যার কথা বলতে বলতে শুভ্র থেমে গিয়েছিল। কেসটার একটা সম্পূর্ণ নতুন অ্যাঙ্গেল পাওয়া গেল।
শ্বেতা মল্লিক বলে যাচ্ছে, ‘আমার ছোট ভাই পুচকুর শ্বশুর রাহুল মজুমদার আর আমার বাবা ছোটবেলার বন্ধু। আমার ছোট ভাইকে বাড়ির সবাই পুচকু বলে ডাকে। তো সে যাই হোক, অল্প বয়েসে রাহুল মজুমদারের সেরিব্রাল হয়। উনি ইনভ্যালিড হয়ে যান। রোজগারও বন্ধ হয়ে যায়। দীপশিখা তখন খুবই ছোট। আমার বাবার টাকায় রাহুল মজুমদারের ফ্যামেলিটার পুরো খরচটাই চলত। আস্তে আস্তে রাহুল মজুমদারের স্ত্রী সোমা মজুমদারের সঙ্গে বাবার একটা ইল্লিসিট সম্পর্ক তৈরি হয়। রাহুল মজুমদার সবই জানত, কিন্তু কী বলবে? বাবাই তো সংসারটা চালাচ্ছে।’
‘অনির্বাণের সঙ্গে দীপশিখার বিয়েটা কীভাবে ঠিক হল?’
‘সকলে জানে বাবা বিয়েটা ঠিক করেছে। কিন্তু আমাদের, মানে আমার স্বামীর আর আমার, ধারণা সোমা মজুমদার বিয়েটা নিয়ে বাবাকে জোর করেছিল। দেখুন, সোমা মজুমদার তো আর বাবার সম্পত্তির কিছু পাবে না। এই একটা ব্যাপারে বাবা একেবারে অ্যাডামেন্ট ছিল। তাই সোমা মজুমদার চেয়েছিল সম্পত্তির কিছুটা যেন ওর মেয়ে পায়।’
‘কিন্তু অনির্বাণ রাজি হল কেন?’
‘এটা তো মানবেন, দীপশিখা ইজ ভেরি অ্যাট্র্যাক্টিভ। পুচকু ওকে প্রথম দেখেই একেবারে হেড ওভার হিলস। আনফরচুনেটলি সেই ফ্যাসিনেশনটা বেশিদিন টেকেনি।’
‘একটা শেষ প্রশ্ন। আপনার বাবার মৃত্যুতে না হয় অনেকের লাভ হতে পারে, কিন্তু আপনার ভাইকে খুন করে কার লাভ?’
‘একটু ভেবে দেখুন, একজনেরই লাভ। দীপশিখার সঙ্গে পুচকুর ফর্মাল ডিভোর্সটা কিন্তু হয়নি। বাবার সম্পত্তির যে অংশটা পুচকু পেত তার পুরোটাই এখন দীপশিখা পাবে। ফলে পুচকু মারা গেলে দীপশিখার লাভ। আরও একটু পিছিয়ে ভেবে দেখুন। বাবার খুন হওয়ার পেছনেও এই একই মোটিভ কাজ করছে। বাবা খুন না হলে পুচকু সম্পত্তি পাবে কী করে? এইভাবে না ভাবলে আপনি এক সঙ্গে দুটো খুন এক্সপ্লেন করতে পারবেন না।’
‘আপনার তা হলে মনে হচ্ছে দুটো খুনই দীপশিখা করেছে?’
‘লজিকালি তাই তো দাঁড়াচ্ছে। আর সাইকোলজিকালি, দীপশিখা তার স্বামীকে তো অবশ্যই ঘেন্না করত, কিন্তু আমার মনে হয় শ্বশুরকে, মানে আমার বাবাকেও কম ঘেন্না করত না। মায়ের লাভারকে ঘেন্না করাটাই তো স্বাভাবিক। বিশেষ করে সে যদি অসহায় অবস্থার সুযোগ নেয়। অতএব ওদের মারতে ওর কোনও অসুবিধে হবার কথা নয়।’
শ্বেতা মল্লিক ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পরে আদিত্য ডিএসপি কৃষ্ণ পধিকে বলল, ‘একটা জিনিস খেয়াল করলেন? এই মহিলাকে যখন তার নিজের সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা হচ্ছিল তখন উনি একদম কোঅপরেট করছিলেন না। কিন্তু যেই প্রসঙ্গটা অন্যদের দিকে ঘুরে গেল, উনি গড়গড় করে নিজেদের বাড়ির কেচ্ছা বলে গেলেন।’
‘হুঁ। কিন্তু ভদ্রমহিলা শেষে যেসব কথাগুলো বললেন তার মধ্যে সাবস্টেন্স আছে।’ ডিএসপি সাহেবকে চিন্তান্বিত দেখাল।
(৪)
জয়ন্ত মল্লিকের মতো লম্বা লোক বাঙালিদের মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না। জয়ন্ত মল্লিক যখন দরজা দিয়ে ঢুকছে আদিত্য হাঁ করে ওর হাইটটা দেখছিল।
‘আপনার হাইটটা কত হবে?’ কথাটা বলেই আদিত্য বুঝল খুব বোকাবোকা একটা প্রশ্ন করে ফেলেছে। সে মুখটাকে যথাসম্ভব সরল করার চেষ্টা করল।
অবশ্য তার দরকার ছিল না। জয়ন্ত মল্লিক চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ‘আমাকে দেখার পর এই প্রশ্নটা প্রায় সকলেই করে। বলুন তো কত হতে পারে আমার হাইট?’ জয়ন্ত মল্লিক চওড়া করে হেসে পালটা প্রশ্ন করল।
‘ছয়-তিন, নাকি ছয়-চার?’ আদিত্যও হাসতে হাসতে বলল।
‘পুরো ছয় ফুট সাড়ে চার ইঞ্চি। তার থেকে আধ ইঞ্চিও কম নয়।’
‘আপনি স্কুলে গোল কিপিং করেননি? আপনার হাইটে গোল কিপিংটা বিরাট অ্যাডভান্টেজ।’
‘না, ফুটবলটা তেমন করে খেলা হয়নি। তবে আর্মিতে থাকতে নিয়মিত বাস্কেটবল খেলতাম।’
‘ব্রিগেডিয়ার মল্লিক, আমরা আপনাকে দু-একটা প্রশ্ন করব। বুঝতেই পারছেন দুদিনে দুটো খুন হয়ে গেছে। তাই আমাদের কিছু কমপালশান আছে। না হলে আপনাদের বিরক্ত করতাম না।’ ডিএসপি সাহেব আর সময় নষ্ট করতে রাজি নন।
‘আমাদের প্রথম প্রশ্ন, শনিবার, মানে যেদিন রাত্তিরে অসীম দত্ত খুন হলেন, সেদিন রাত্তির সাড়ে ন’টা থেকে পৌনে এগারোটার মধ্যে আপনি কোথায় ছিলেন?’
‘আমি ঘড়ি দেখিনি, তাই বলতে পারব না ঠিক সাড়ে ন’টা থেকে পৌনে এগারোটার মধ্যে আমি কোথায় ছিলাম। তবে এটুকু বলতে পারি আই ফাউন্ড দ্য প্রোগ্র্যাম ইন দ্য ব্যাঙ্কোয়েট হল কোয়াইট বোরিং। সো আই স্লিপড আউট অ্যান্ড ওয়েন্ট টু দ্য বার। আমি রাত্তির পর্যন্ত বারেই ছিলাম।’
‘আপনি একবার ডিনার খেতে ফিরে আসেননি?’
‘ও হ্যাঁ। শ্বেতা, মানে আমার স্ত্রী, আমাকে ধরে নিয়ে এসেছিল। বলল, সবার সঙ্গে ডিনার না খেলে খারাপ দেখাবে। সো আই হ্যাড টু গো। আমার খুব একটা খিদে ছিল না। বারে যেটুকু স্ন্যাক্স খেয়েছিলাম তাতেই আমার পেট ভরে গিয়েছিল। তাই ব্যাঙ্কোয়েট হলে ফিরে এসে সামান্য কিছু খেয়েছিলাম।’
‘তারপর কি আপনি আবার বারে ফিরে গিয়েছিলেন?’
‘হ্যাঁ। ফর আ ডাইজেস্টিফ। এখানকার বারে দেখলাম কোঁয়াত্র পাওয়া যাচ্ছে। সো আই হ্যাড টু সারভিংস।’
‘আপনি কি বার থেকে বেরিয়ে আর কোথাও গিয়েছিলেন?’
‘আই ওয়েন্ট টু দ্য জন আ কাপ্ল অফ টাইমস। ঠিক কখন গিয়েছিলাম মনে নেই।’
‘কোথায় গেছিলেন?’ ডিএসপি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন।
‘ওয়েন্ট টু দ্য লু।’
ডিএসপির ভ্রুকুঞ্চন তখনও যায়নি দেখে আদিত্য বলল, ‘উনি বলছেন যে উনি বার দুয়েক বাথরুমে গিয়েছিলেন।’
‘ও বাথরুমে গেছিলেন।’ ডিএসপিকে আশ্বস্ত মনে হল।
‘আপনি কি বারে একাই ছিলেন?’
‘না, বেশ কিছুক্ষণ আমার বড় শালা অনিকেত আমার সঙ্গে ছিল।’
‘আমাদের হিসেব অনুযায়ী রবিবার রাত্তির এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে আপনার শালা অনির্বাণ দত্ত খুন হয়েছেন। আপনি ওই সময় কোথায় ছিলেন?’
‘এগারোটার সময় বার বন্ধ হয়। আমি এগারোটা অবধি বারেই ছিলাম। তারপর সোজা ঘরে ফিরে আসি।’
‘আপনি যখন ফিরলেন তখন কি আপনার স্ত্রী ঘুমিয়ে পড়েছিলেন?’
‘না, না। ও অত তাড়াতাড়ি ঘুমোয় না। আমি যখন ঘরে ফিরলাম তখন ড্রেসিং টেবল-এর সামনে বসে ও মুখে ক্রিম মাখছিল।’
‘আমি অন্য একটা প্রশ্ন করছি। আপনারা কলকাতায় যে গেস্ট হাউসটা চালান, সেটা কেমন চলছে?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘ভাল চলছে না, মোটেই ভাল চলছে না। আমি ওয়ার স্ট্র্যাটেজি ভাল বুঝতে পারি, কিন্তু বিজনেস স্ট্র্যাটেজি আমার মাথায় ঢোকে না। ব্যবসা জিনিসটা শ্বেতাও খুব ভাল বোঝে বলে আমার মনে হয় না। আমাদের গেস্ট হাউসটা প্রচুর লসে চলছে। অনেক টাকা ধার হয়ে গেছে। হয়ত ওটাকে বন্ধই করে দিতে হবে।’
‘আপনাদের তো ভাল পেনশন আছে।’ ডিএসপি সাহেব হালকা চালে বললেন।
‘আছে। কিন্তু আমি তো অর্ধেক পেনশন কমিউট করে দিয়েছি। রিটায়ার করে যে টাকাটা পেলাম সেটা দিয়েই তো ব্যবসা শুরু করলাম।’
‘লোকে কিন্তু বলে আপনাদের গেস্ট হাউসটা খুব ভাল চলার কথা। আসলে ওটার ঠিকমতো মেনটেনেন্স হচ্ছে না। আপকিপ খুব খারাপ। তাই লোকে ওখানে থাকতে আসছে না। কিছু টাকা দিয়ে যদি জায়গাটা সারিয়ে নেওয়া যেত তা হলেই ওটা খুব ভাল চলত।’ আদিত্য বলল।
‘আপনি এত কথা কী করে জানলেন?’
‘পুলিশ ইনভেস্টিগেশন থেকে জেনেছি। অসীম দত্ত প্রথমবার অ্যাট্যাকড হবার পরে পুলিশ আপনাদের গেস্ট হাউসে তো ইনভেস্টিগেট করেছিল।’
‘আই সি। আপনি যেটা বললেন সেটা কিন্তু ঠিক। ইন ফ্যাক্ট আমার এক্সট্রাভ্যাগেন্স-এর জন্যেই ব্যবসাটা ডুবতে বসেছে। প্রথম দিকে যে প্রফিটটা করছিলাম সেটা যদি খানিকটা জমিয়ে রাখতাম তা হলে সেই টাকাটা দিয়ে গেস্ট হাউসটা মাঝেমাঝেই রেনোভেট করা যেত। বাট মাই ড্যাম ড্রিঙ্কিং অ্যান্ড গ্যাম্বলিং হ্যাবিটস! ইফ আই ডিডন্ট হ্যাভ দোজ ভাইসেস তা হলে ব্যবসাটা এই জায়গায় পৌঁছত না। শ্বেতাকেও এত কষ্ট পেতে হত না।’
‘এখন তো আপনারা অসীম দত্তর সম্পত্তির একটা অংশ পেয়ে যাবেন। এখন ব্যবসাটা দাঁড় করাতে পারবেন না?’
‘জানি না পারব কিনা। নিজের ওপর কনফিডেন্স চলে গেছে।’
‘আচ্ছা, আপনি যখন ফোর্ট উইলিয়ামে পোস্টেড ছিলেন তখন একটা ঘটনা ঘটেছিল। একজন লোক আপনার হাতে মার খেয়েছিল। ঘটনাটা ঠিক কী হয়েছিল?’ ডিএসপি সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।
‘দেখুন ওই ইন্সিডেন্টটা আমি মনে করতে চাই না। ইটস ভেরি এমব্যারাসিং। সি, আই হ্যাভ আ ভেরি ব্যাড টেম্পার। যখন রেগে যাই, কোনও হুঁশ থাকে না। ওই লোকটি ছিল একজন সুইপার। আমার ঘর ঝাড়ু দিত। ঝাড়ু দিতে গিয়ে আমার ঘর থেকে দুটো রামের বোতল সরিয়েছিল। এমন কিছু ব্যাপার নয়। কিন্তু দোষটা কিছুতেই স্বীকার করছিল না। দোষ স্বীকার করলেই আমি ছেড়ে দিতাম। শেষে এমন রাগ হয়ে গেল মারলাম কষে এক থাপ্পড়। আসলে নিজের হাতের জোরের কথা আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। লোকটা প্রায় মরেই যাচ্ছিল। মরে গেলে আমি সত্যিই ঝামেলায় পড়তাম। যাই হোক আমার ভাগ্য ভাল। আর্মি হসপিটালে কিছুদিন থেকে ও সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পেরেছিল। অ্যান্ড দ্য ম্যাটার এন্ডেড দেয়ার।’
‘একটা শেষ প্রশ্ন করি। আপনার কোনও ফায়ার আর্মস আছে?’
‘আছে। ব্রুগার অ্যান্ড থমেট এম পি নাইন। এটাকে বলে মেশিন পিস্তল। সুইস মেড। স্টেট অফ দ্য আর্ট ওয়েপন। ইটস আ বিউটি।’
‘অস্ত্রটা কি আপনি আপনার সঙ্গে এখানে এনেছেন?’
‘ওটা সব সময় আমার সঙ্গে থাকে।’
‘অ্যামিউনিশন্স?’
‘অ্যামিউনিশন্স ছাড়া তো ওটা রাখার মানে হয় না। কিছু অ্যামিউনিশন্স আমার সঙ্গে থাকে।’
লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে। ডিএসপি বললেন, আরও কয়েকটা ইন্টারোগেশন বাকি আছে। লাঞ্চ খেয়ে তিনি সেগুলো শেষ করতে চান। অসীম দত্তর নাতি এবং নাতনির সঙ্গে পুলিশ এখনও কথা বলেনি। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। তাছাড়া অনির্বাণ দত্তর মৃত্যুর আগে যাদের ইন্টারোগেশন শেষ হয়ে গিয়েছিল তাদের আবার জিজ্ঞেস করতে হবে রবিবার রাত্তির এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে তারা কোথায় ছিল। এটা একটা রুটিন জিজ্ঞাসা। এর থেকে কিছু পাওয়ার আশা না থাকলেও করতে হবে। আদিত্য বলল, চন্দ্রিমা সেন বলে অসীম দত্তর যে সেক্রেটারি আছে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে কিছু পাওয়া যেতেও পারে। দীপশিখার মা সোমা মজুমদারের সঙ্গেও একবার কথা বলা যেতে পারে। ডিএসপি বললেন, অফিশিয়াল চ্যানেলে ক্লিয়ারেন্স নিয়ে কলকাতা যেতে যেতে তাঁর কিছুটা সময় লেগে যাবে। আদিত্য যদি প্রাথমিক ভাবে এদের দুজনের সঙ্গে কথা বলে তাঁকে জানায় তাহলে ভাল হয়। আদিত্য রাজি। সে ডিএসপি কৃষ্ণ পধিকে বলে দিয়েছে লাঞ্চ পরবর্তী জিজ্ঞাসাবাদের সময় সে থাকতে পারছে না।
‘আর একটা কথা।’ আদিত্যকে উঠতে দেখে কৃষ্ণ পধি বললেন। ‘মার্ডার ওয়েপনটা তো পাওয়া গেল না। আমি ভাবছি এই রিসর্টটা ভাল করে সার্চ করব। অসীম দত্তর রেলেটিভদের ঘরগুলো তো সার্চ করতেই হবে, অন্য গেস্টদের ঘরগুলোও দেখব। রিসর্টের কমপাউন্ডটাও। বলা যায় না, খুনি হয়তো কোথাও ওয়েপনটা লুকিয়ে রেখেছে বা ফেলে দিয়েছে।’
‘গুড আইডিয়া। দেখুন কিছু পাওয়া যায় কিনা। যাঁরা খুন হয়েছেন তাদের মোবাইল দুটোও তো মিসিং। মার্ডার ওয়েপনের সঙ্গে সঙ্গে দেখবেন ও দুটোও পাওয়া যায় কিনা।’
আদিত্য ঘরে এসে দেখে কেয়া লাঞ্চে যাবে বলে সেজেগুজে বসে আছে। আরও কিছুক্ষণ এইভাবে বসে থাকতে হলে কেয়া বেজায় রেগে যেত, বিশেষ করে যেহেতু ক্রমশ তার খিদে পেয়ে যাচ্ছিল। আদিত্য সময় মতো ফিরে এসেছে।
‘তোমার বন্ধুরা কোথায়? তারা লাঞ্চ খেতে যাবে না?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘আমি ওদের ফোন করেছিলাম। রাখিদির শরীরটা আবার খারাপ হয়েছে। তাই ওরা ঘরেই খাবার আনিয়ে নিচ্ছে।’
‘তাহলে চল, আমরাই যাই।’ আদিত্য মনে মনে একটু খুশি হয়েছে। সে খানিকটা প্রাইভেসি চাইছিল।
কেয়াকে দেখে হঠাৎ তার আদর করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু শাড়িটার ইস্ত্রি নষ্ট হয়ে গেলে কেয়া মোটেই খুশি হবে না। তার ওপর এখন কেয়ার খিদেও পেয়েছে। আদিত্য ভাবল, এই অবস্থায় নিজেকে সংযত রাখাই বুদ্ধির কাজ হবে।
ডাইনিং হলে ডিএসপি সাহেব ইন্সপেক্টার পণ্ডাকে নিয়ে এক কোণে বসে লাঞ্চ খাচ্ছেন। আদিত্য তাদের দিকে হাত নেড়ে কেয়াকে নিয়ে অনেক দূরে গিয়ে বসল। পুলিশের সঙ্গ আর ভাল লাগছে না। সেই কনস্টেবল দুজন দরজা পাহারা দিচ্ছে।
খাওয়া শেষ করে আদিত্য আর কেয়া ভেবেছিল কিছুক্ষণ সমুদ্রের ধারে কাটাবে। আজই এখানে শেষ দিন। কাল সকালবেলা ফেরার ফ্লাইট, অর্থাৎ কোনও রকমে ব্রেকফাস্ট খেয়েই বেরিয়ে পড়তে হবে। কিন্তু সমুদ্রের ধারে রোদ্দুর যেন ঝলসে দিচ্ছে। এই রোদ্দুরে সমুদ্রের ধারে গেলে শরীর অসুস্থ হয়ে পড়বে। জানলার ব্লাইন্ডটা তুলে দিলে ঘর থেকে সমুদ্র দেখা যায়। ওরা ঠিক করল ঘরেই ফিরে যাবে। বিকেলে রোদ্দুর পড়লে না হয় সমুদ্রের ধারে যাবার কথা ভাবা যেতে পারে।
ঘরে ফিরে অবশ্য জানলার ব্লাইন্ড তুলে সমুদ্র দেখা হল না। তার বদলে ঘরের আধো-অন্ধকারে এসির ঠান্ডায় আদর-টাদর শেষ হবার পর কেয়া ঘুমিয়ে পড়ল। দুপুরে আদিত্যর ঘুম আসে না। সে শুয়ে শুয়ে আকাশ পাতাল ভাবছে।
সেই ঘরটার একটা ছবি তার চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে, যে ঘরটাতে অনির্বাণ দত্ত খুন হয়েছিল। ঘরটাতে কি কিছু একটা আছে যেটা আদিত্যর চোখ এড়িয়ে গিয়েছে? এমন কিছু যেটা সে খোলা চোখে দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু তার অবচেতন মন দেখতে পেয়েছে? আদিত্য চোখ বুঝে মনঃসংযোগ করার চেষ্টা করল। সে ঘরটা দেখতে পাচ্ছে। সেই সোফা, সোফার ওপর অনির্বাণ দত্ত বসে আছে। সামনে একটা টেবিল। টেবিলের ওপর অনির্বাণ দত্তর মোবাইল। ঘরের দরজা খোলা।
খোলা দরজা দিয়ে একজন ঘরে ঢুকল। আততায়ী। গায়ে চাদর জড়ানো। সে পকেট থেকে পিস্তল বার করে অনির্বাণ দত্তকে গুলি করল। খুব কাছ থেকে গুলিটা করল। রক্ত ছিটকে টেবিলের ওপর পড়েছে। আততায়ী টেবিলের ওপর থেকে মোবাইলটা তুলে নিল। সেটাকে সুইচ অফ করার চেষ্টা করল। পারল না। সাইলেন্ট মোডে দেবার চেষ্টা করল এবং পারল। আততায়ী মোবাইলটা পকেটে পুরে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
না, এটা ঠিক ছবি নয়। অনির্বাণ দত্তর ঘরে আলো জ্বলছিল কেন?
আদিত্য যেটা দেখতে পাচ্ছিল না এখন সেটা দেখতে পেয়েছে। সে বিছানা ছেড়ে উঠে রিসেপশনে ফোন করে দীপশিখা মজুমদার দত্তর ইন্টারকম নম্বরটা জানল। তারপর তার ঘরের ইন্টারকম থেকে নম্বরটা লাগাল।
‘আমি আদিত্য মজুমদার বলছি। এই বিশ্রী সময় ফোন করে কি ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম?’
‘না, না। আমি দুপুরে ঘুমোই না। বই পড়ছিলাম। বলুন।’
‘একটা ছোট্ট জিনিস জানার ছিল। মনে হল আপনিই বলতে পারবেন। আপনার কি মনে আছে আপনার স্বামী অনির্বাণ দত্ত কী ধরনের বা কী ব্র্যান্ডের মোবাইল ব্যবহার করতেন?’
‘মোবাইলের ব্যাপারে অনির্বাণ খুব ফাসি ছিল। খুব প্রোটেক্টিভও বটে। কাউকে নিজের মোবাইল ধরতে দিত না। ওর ভাব দেখে মনে হতো মোবাইলে ওর অনেক পার্সোনাল সিক্রেট আছে।’
‘মোবাইলটা কি পাসওয়ার্ড দিয়ে খুলতে হত?’
‘ডবল পাসওয়ার্ড। একটা অ্যালফা-নিউমারিক। আর একটা ওর নিজের ভয়েস। নাহলে মোবাইল খুলবেই না।’
‘আচ্ছা, আপনার শ্বশুরমশাই কী রকম মোবাইল ব্যবহার করতেন মনে আছে?’
‘উনি খুব একটা টেক স্যাভি ছিলেন না। তাই খুব সিমপ্ল মোবাইল ব্যবহার করতেন।’
‘আইফোন?’
‘হ্যাঁ, আইফোন। তবে একেবারে বেসিক।’
‘সেটা খুলতে গেলে কি পাসওয়ার্ড লাগত?’
‘আমার মনে হয় না। কিন্তু মোবাইল নিয়ে আমাকে এত সব জিজ্ঞেস করছেন কেন?’
‘আসলে অসীম দত্ত এবং অনির্বাণ দত্ত দুজনের মোবাইলই মিসিং। খুনি সম্ভবত দুজনের মোবাইলই সঙ্গে নিয়ে গেছে। তাই ভাবছিলাম, মোবাইলগুলো ঠিক কেমন ছিল? মনে হল, আপনিই দুটো মোবাইল সম্বন্ধে সঠিক তথ্য দিতে পারবেন। আপনাকে বিরক্ত করা জন্য দুঃখিত।’
কথাবার্তায় কেয়ার ঘুম ভেঙে গেছে। ঘুম জড়িত গলায় বলল, ‘রোদ্দুর পড়ে গেছে?’
আদিত্য ভেনিশিয়ান ব্লাইন্ড ফাঁক করে দেখল সমুদ্রের ধার থেকে রোদটা সরে গেছে। এখন সমুদ্রের ধারে যাওয়া যেতেই পারে।
রাত্তির সাড়ে-আটটা নাগাদ ডিএসপি সাহেবের ফোন।
‘অনেক খুঁজেও মার্ডার ওয়েপনটা পাওয়া গেল না। মোবাইল দুটোও পাওয়া যায়নি। দত্ত বাড়ির সঙ্গে রিলেটেড সবার ঘর সার্চ করেছি। কিচ্ছু নেই।
আদিত্য ভাবছে, এরকমই কিছু একটা হবে সে আন্দাজ করেছিল।