সৈকত রহস্য – ৭
সপ্তম পরিচ্ছেদ
(১)
খাঁটি কলকাত্তাইয়া বলতে যা বোঝায় আদিত্য হাড়ে-মজ্জায় তাই। দু-চারদিন কলকাতার বাইরে থাকতে হলেই কলকাতার জন্যে তার মনটা হুহু করে ওঠে। তাদের প্রিপেড ট্যাক্সি ভিআইপি রোড পেরিয়ে উল্টোডাঙার দিকে মোড় নেবার সঙ্গে সঙ্গে আদিত্যর মনটা ভাল হয়ে গেল। এই ভিড়ের রাস্তা, ফুটপাথে মানুষের ট্র্যাফিক জ্যাম, ধুলো, ধোঁয়া, ভাঙাচোরা দোকান, রোদে-জলে মলিন হয়ে যাওয়া পুরোনো বাড়ি—এই সবই তার একান্ত নিজের মনে হয়। পাশে বসে কেয়া কখনও চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ছে আবার কখনও জেগে উঠে ঢুলুঢুলু চোখে ট্যাক্সির জানলা দিয়ে শহরের রাস্তাঘাট দেখছে। অত সকালে উঠে ফ্লাইট ধরতে হয়েছে, ঘুম তো পাবেই। একটা বড় সান্ত্বনা, ফেরার ফ্লাইটটা সময় মতো ছেড়ে সময় মতো আদিত্যদের দমদম পৌঁছে দিয়েছে।
‘বাড়ি গিয়ে খাবে কী?’ কেয়াকে চোখ খুলতে দেখে আদিত্য জিজ্ঞেস করল। ‘তড়কা-রুটি কিনে নিয়ে বাড়ি ঢুকবে নাকি? তা হলে তোমাকে আর রান্নাঘরে ঢুকতে হবে না।’
‘না,না। তড়কা-রুটি খাব না। একগাদা তেল। একে ঘুম হয়নি, অত তেল খেলে শরীর খারাপ হয়ে যাবে। আমি বাড়ি গিয়ে খিচুড়ি চাপিয়ে দেব। খিচুড়ি আর ডিমের অমলেট। ভালোই খাওয়া হবে। আসার সময় ফ্রিজে আধ ডজন ডিম রেখে এসেছি। ঘরে আলু-পেঁয়াজও আছে।’ কেয়া ঈষৎ ঘুম-জড়ানো গলায় বলল।
বাড়ি ফিরে আদিত্য একটা সিগারেট ধরিয়ে ভাবছে এবার চান করতে যাবে, বিমলের ফোন। কেয়া রান্নাঘরে খিচুড়ির তোড়জোড় করছে।
‘পুরী থেকে ফিরে এসেছেন স্যার?’
‘একটু আগে ফিরেছি। কিন্তু তুমি জানলে কী করে আমরা পুরী গিয়েছিলাম? তোমাকে তো বলিনি।’
‘জানার কত রকম উপায় আছে স্যার। একটু চেষ্টা করলেই তো জানা যায়। বলছি, কী করে জানলাম। তার আগে একটা খবর দিই স্যার। সমীর প্যাটেলকে কারা যেন প্রচণ্ড মারধোর করে রাস্তার ধারে ফেলে রেখে গেছিল। পুলিশ জানতে পেরে বাড়ির লোককে খবর দিয়েছিল। তারা সমীরকে বাইপাসের ধারে একটা হাসপাতালে ভর্তি করেছে। ওই ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট না কী যেন বলে, সেখানে। দুদিন জ্ঞান ফেরেনি। গতকাল কিছুক্ষণের জন্য জ্ঞান ফিরেছিল। লোকজন কিছু চিনতে পারছে না। ভাবলাম আপনাকে খবরটা জানাই।’
আদিত্য প্রায় জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, কে সমীর প্যাটেল? হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল সমীর প্যাটেল অনিতা চৌধুরির বন্ধুর নাম। যে বন্ধু মাঝে মাঝেই অনিতার সঙ্গে দেখা করতে আসে।
‘সমীর প্যাটেল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে তুমি জানলে কী করে?’ আদিত্য খানিকটা বিভ্রান্ত।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। সেটা তো আগে বলা দরকার। আসলে কী হয়েছে স্যার, আপনি তো সেদিন বললেন আর এখন আমার কোনও কাজ নেই। শুনে মনটা একটু দমে গেল। ওই সমীর ছেলেটাকে ফলো করে মনে হচ্ছিল এর ভিতরে একটা রহস্য আছে। তা, আপনি যখন বললেন তখন আমি আপনার কথায় জামির লেনের ওই বাড়িটায় যাওয়া কদিন বন্ধ রাখলাম। তারপর এই দুদিন আগে মনে হল একবার গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে আসি না। খোঁজ-খবর নিতে তো কোনও ক্ষতি নেই।
‘ওখানে তো সিকিউরিটির সঙ্গে আমার ভাব হয়ে গিয়েছিল। সে জানত আমি অনিতা ম্যাডামের বন্ধুর ওপর নজর রাখছি। তো আমি ওখানে যেতে সিকিউরিটির ছেলেটা বলল, ‘সাংঘাতিক খবর। ওই ছেলেটা, যার ওপর তুমি নজর রাখছিলে, প্রচণ্ড ধোলাই খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছে। অনিতা ম্যাডাম রোজ ছেলেটাকে দেখতে যাচ্ছে। আমি বললাম, তুমি জানলে কী করে। সে বলল, সবাই জানে। অনিতা ম্যাডামের যে কাজের মাসি আছে সে বলেছে। এইসব কথাবার্তা যখন চলছে তখন দেখি অনিতা ম্যাডাম বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে। সিকিউরিটি ছেলেটা বলল, ওই দ্যাখো, ম্যাডাম বেরোচ্ছেন। মনে হয় হাসপাতালেই যাচ্ছেন। তুমি চাইলে পেছন পেছন গিয়ে দেখে আসতে পার কোন হাসপাতালে ছেলেটা ভর্তি আছে।’
‘তারপর?’ আদিত্য বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনছে।
‘আমার প্রচণ্ড কৌতূহল হল। ম্যাডাম একডালিয়ার মোড় থেকে একটা ডাবলু বি টি সি-র বাস ধরে মুকুন্দপুরে গিয়ে নামলেন। ম্যাডামের পেছন পেছন গিয়ে আমিও তাই করলাম। মুকুন্দপুরের বড় হাসপাতালটায় ম্যাডাম ঢুকে গেলেন। তখন ভিজিটিং আওয়ার। ম্যাডাম লিফটে উঠে চলে গেলেন। আমি রিসেপশনে গিয়ে খোঁজ করলাম সমীর প্যাটেল কোন ফ্লোরে আছে, কেমন আছে। জানা গেল, সমীর ট্রমা কেয়ার সেন্টারের ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে আছে। আগের থেকে ভাল আছে। জ্ঞান ফিরেছে। তবে এখনও লোক চিনতে পারছে না।
‘আমার মোবাইলটায় পয়সা ফুরিয়ে গিয়েছিল। তাই ভাবলাম আপনার আপিসে গিয়ে আপনাকে ব্যাপারটা জানিয়ে তারপর ডিউটিতে চলে যাব। আপনার আপিসে গিয়ে দেখি আপনি নেই। শ্যামল বলে যে ছেলেটা আপনাদের আপিসে কাজ করে বলল আপনারা পুরী গেছেন, আজ ফিরবেন। আমি আজ সকালে মোবাইলে পয়সা ভরে এই আপনাকে ফোন করছি।’
কেয়া ঘরে ঢুকেছে। বিরক্ত গলায় বলল, ‘এখনও ফোন নিয়ে পড়ে আছ? এবার চান করতে যাও। খিচুড়ি হয়ে গেছে।’
‘এক মিনিট।’ আদিত্য কেয়ার দিকে তাকিয়ে বলল। তারপর বিমলকে বলল, ‘তুমি খুব দরকারি তথ্য দিয়েছ। আর একটা কাজ তোমাকে করতে হবে। অনিকেত দত্ত এবং জয়ন্ত মল্লিক, নাম দুটো মনে রাখ। আমি এদের ঠিকানাগুলো হোয়াটসঅ্যাপ করে দিচ্ছি। এদের ওপর নজর রাখতে হবে। তুমি একা না পারলে আর কাউকে সঙ্গে নিয়ে নাও। আমি তাকে আলাদা পেমেন্ট করে দেব। কয়েকদিন পরে আমাকে জানাবে এরা কোথায় যায়, কী করে। বুঝতে পেরেছ? ঠিক আছে, আজ রাখছি।’
আদিত্যর খিদে পেয়ে গেছে।
খাবার সময় আদিত্য দেখল খিচুড়ির সঙ্গে শুধু ডিমের অমলেট নয় আলুর বড়া এবং পেঁয়াজিও আছে। কেয়ার গৃহিণীপনায় আদিত্যর মুগ্ধতা দিনে দিনে বাড়ছে।
‘যদিও বডি একেবারে ডিসইন্টিগ্রেট করে গেছিল তবু অটোপসি এবং ফরেনসিক থেকে দু একটা দরকারি জিনিস জানতে পারা গেছে।’ অচিন্ত্য সাহার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। ‘ঘড়িটা যে সময়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, অটোপসি রিপোর্ট বলছে মৃত্যু ওই সময় নাগাদই হয়েছিল। মৃত্যু যে পিস্তলের গুলিতে হয়েছে সেটা তো আগেই বোঝা গিয়েছিল। এখন জানা গেল পিস্তলটার রেঞ্জ সম্ভবত খুব বেশি ছিল না, কাজেই গুলিটা খুব কাছ থেকে ছোঁড়া হয়েছে। খুনি পাঁচিল টপকে পেছন দিক থেকে চুপিচুপি এসে গুলি করেছে। মণিময়বাবু এত মগ্ন হয়ে মাছ ধরছিলেন যে খুনির আসাটা টের পাননি।’
‘বডি আইডেন্টিফায়েড হয়েছে?’
‘হ্যাঁ। প্রথমত, ফরেনসিক রিপোর্ট মৃতদেহের দাঁতের সঙ্গে ডেন্টিস্টের কাছে মণিময় গুপ্তর দাঁতের যে এক্সরে পাওয়া গেছে সেটা মিলিয়ে দেখেছে। ফরেনসিক রিপোর্ট বলছে দু’টো দাঁতের স্ট্রাকচার আইডেন্টিকাল। অতএব আইডেন্টিটি বিয়ন্ড ডাউট এস্ট্যাব্লিশড হয়ে গেছে।’
‘তার মানে মণিময় গুপ্ত যে মারা গেছেন, খুন হয়েছেন, সেটা আপনারা অফিশিয়ালি ডিক্লেয়ার করে দিয়েছেন, তাই তো?’
‘ডিক্লেয়ার মানে ওর কোম্পানিকে জানিয়ে দিয়েছি। ওর কোনও উকিল-টুকিল ছিল কিনা আমরা জানি না।’
‘ওকে, বুঝেছি। ফরেনসিক রিপোর্ট থেকে আর কী জানা গেল?’
‘ফরেনসিকের দ্বিতীয় ফাইন্ডিংটা বেশ ইন্টারেস্টিং। ফরেনসিক রিপোর্ট বলছে যে ধরনের গুলিতে সৈকত চৌধুরির মৃত্যু হয়েছিল একই ধরনের গুলিতে তার পার্টনার মণিময় গুপ্তরও মৃত্যু হয়েছে। একই পিস্তল থেকে দুটো গুলি বেরিয়েছে এই সম্ভবনা মোটেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’
‘এটা তো খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। তার মানে সম্ভবত একই লোক দুজনকে খুন করেছে।’ আদিত্য চিন্তিত গলায় বলল।
‘তাই তো দাঁড়াচ্ছে স্যার।’
‘আচ্ছা, মণিময়বাবুর হিসেবপত্তরগুলো ভাল করে দেখেছেন? ওর বাগানবাড়ি থেকে যে তাড়াতাড়া ব্ল্যাক মানি বেরোল তার কোনও একটা হদিশ তো হিসেবপত্রে পাওয়া যাবে।’
‘পাওয়া গেছে, আবার পাওয়া যায়নিও বটে।’ অচিন্ত্য সাহা হেঁয়ালি করে বলল।
‘তার মানে কী?’ আদিত্যর হেঁয়ালি ভাল লাগছে না।
‘তার মানে হল, মণিময় গুপ্তকে জড়ানোর মতো কোনও সূত্র আমরা পাইনি। আমাদের অ্যাকাউন্টেন্ট কোম্পানির হিসেবপত্রগুলো খুব ভাল করেই দেখেছে। তবে এটা পরিষ্কার যে কোম্পানির হিসেবপত্রে বেশ বড় রকম গরমিল আছে। কিন্তু সমস্ত গরমিল কোম্পানির অন্য পার্টনার সৈকত চৌধুরির দিকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছে।’
‘সৈকত চৌধুরির দিকে!’ আদিত্যর মনে পড়ে গেল অনিতার মুখে শোনা সৈকতের কথা, মণিময় তাকে ঠকিয়েছে। বিশ্বজিৎ মজুমদার বলে সেই অ্যাকাউন্টেন্ট ছেলেটাও এই ধরনেরই একটা কিছুর ইঙ্গিত দিয়ে ছিল।
আদিত্য মুখে বলল, ‘কী ধরনের গরমিল দেখা যাচ্ছে?’
‘গরমিল নানা ধরনের। তবে যে জোচ্চুরিটা সব থেকে বেশি দেখা যাচ্ছে সেটা হল সরকারি প্রজেক্টে চুক্তি অনুযায়ী মালমশলা না দেওয়া। বা আরও পরিষ্কার করে বললে, যে মানের মালমশলা দেবার কথা তার থেকে নিম্নমানের মালমশলা দেওয়া। বলাই বাহল্য, এর মধ্যে সরকারি অফিসাররাও জড়িত। কোটি কোটি টাকার বেআইনি লেনদেন হয়েছে।’
‘এই জোচ্চুরি সৈকত করেছে?’ আদিত্যর গলায় অবিশ্বাস।
‘সমস্ত এভিডেন্স কিন্তু সেই কথাই বলছে। সরকারি চুক্তিপত্রে সৈকতের সই। মালমশলা কেনার পারচেজ অর্ডারে সৈকতের সই। সমস্ত দুনম্বরি ডিলে সৈকতের সই।’
সৈকতের পার্টনার মণিময় কি সই করতেই জানত না?’ আদিত্য শুকনো গলায় বলল।
‘জানত, জানত। কিছু কাগজপত্রে তার সইও আছে। কিন্তু সেগুলো সমস্ত পরিষ্কার ডিল। কোনও দুনম্বরি সেখানে নেই।’
‘দেখুন অচিন্ত্যবাবু, আমরা তো জানি মণিময় গুপ্ত প্রভূত কালো টাকা উপার্জন করেছিল। তার থেকে এটাই কি মনে হয় না যে সৈকতকে সামনে রেখে মণিময় চুরিগুলো করেছিল? সৈকত চমৎকার ইঞ্জিনিয়ার ছিল, কিন্তু মানুষ চিনত না। বিশেষ করে মণিময়কে সে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করত। মণিময় সেই বিশ্বাসের সুযোগ নিয়েছে।’
‘আমারও তো স্যার এরকমই মনে হচ্ছে। কিন্তু সমস্ত এভিডেন্স সৈকত চৌধুরির বিরুদ্ধে।’ অচিন্ত্য সাহা ঈষৎ কাঁচুমাচু।
‘এইজন্যেই কি সৈকত চৌধুরির পেছনে সিবিআই লেগেছিল?’
‘তাই তো মনে হচ্ছে। তবে সিবিআই এনকোয়ারির বিষয়ে আমি কিছুই বলতে পারব না। বিদ্যুৎ বলে যে ছেলেটির কাছ থেকে সিবিআই-এর ব্যাপারটা জানতে পেরেছিলাম সেও আর কিছু বলতে পারল না। এই ব্যাপারটা স্যার আপনাকে একটু ইনফ্লুয়েন্স খাটিয়ে জানতে হবে। আমাদের মতো চুনোপুঁটিকে সিবিআই গ্রাহ্যই করবে না।’
‘সেটা আমি দেখছি কী করা যায়। কিন্তু একটা কথা বলুন। আপনার তো থিয়োরি ছিল অনিতা চৌধুরি আর তার প্রেমিক মিলে সৈকতকে ইনশিয়োরেন্সের টাকার লোভে খুন করেছে। এখন কি আপনি বলবেন, ওরা মণিময়কেও মেরেছে?’
‘আমার তো তাই মনে হচ্ছে। মণিময়ের কোনও ওয়ারিশ নেই। সে মরে গেলে পুরো কোম্পানির মালিকানাই অনিতার হাতে চলে যাবে। মানুষের টাকার লোভ যে ক্রমশ বাড়তেই থাকে এটা তো আমি পুলিশের চাকরি করতে এসে বারবার দেখেছি স্যার।’
‘ঠিক আছে। আপাতত আপনার কথাটা না হয় মেনে নিলাম। আমার আর একটা দরকারি কথা বলার আছে। আপনি কি মণিময় গুপ্তর মিসট্রেসের সঙ্গে দেখা করার সময় পেয়েছেন?’
‘আরে না, না। এখনও দেখা করিনি। আপনার জন্যে অপেক্ষা করছি। দুজনে একসঙ্গে মিলে একদিন ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা করা যাবে, কী বলেন?’
‘ভেরি গুড। সাধু প্রস্তাব। শিবপদর কাছ থেকে আপনি নিশ্চয় ফোন নম্বরটা জোগাড় করে রেখেছেন। ফোন করে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে নিন। আমি আপনার সঙ্গে চলে যাব।’
‘ঠিক আছে। আমি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আপনাকে জানাব।’
‘আর একটা রিকোয়েস্ট। ঠিক একটা নয়, দুটো রিকোয়েস্ট।’
‘বলুন স্যার।’
‘আমার ইচ্ছে একদিন কল্যাণী গিয়ে সৈকত চৌধুরির মা-বাবার সঙ্গে আলাপ করে আসি। আপনি সঙ্গে গেলে ব্যাপারটা একটু জোর পায়। যাবেন আমার সঙ্গে?’
‘ঠিক আছে যাব। আপনি যখন বলছেন তখন অবশ্যই যাব। কল্যাণী পুলিশ স্টেশন থেকে আমাদের এক কলিগ অবশ্য ওদের সঙ্গে কথা বলে রিপোর্টটা আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। রিপোর্টে কিছুই নেই। তবু আপনি যখন বলছেন, নিশ্চয় যাব। সত্যি কথা বলতে কি, আপনার কাছে আমি খুবই কৃতজ্ঞ স্যার। মণিময় গুপ্তর বাগানবাড়ি থেকে অতগুলো কালো টাকা উদ্ধার হল সে তো আপনারই জন্যে। অন্য কেউ না জানুক আমি তো জানি। ওটার জন্যে হয়তো একটা অ্যাওয়ার্ড-ট্যাওয়ার্ডও পেয়ে যেতে পারি। তাই বলছিলাম, আমাকে রিকোয়েস্ট করবেন না স্যার, অর্ডার করবেন।’
‘আর এক দিন অনিতার বাপের বাড়ি গিয়ে একটু খোঁজখবর করার ইচ্ছে আছে। এখানেও আপনি সঙ্গে গেলে ভাল হয়। আপনি কি ওখানে আগে গেছেন?’
‘হ্যাঁ স্যার, দু’বার ওখানে ইনভেস্টিগেশনে গেছি। লোকগুলো খুব একটা কোঅপরেট করেনি। ওদের একটাই কথা। অনিতার সঙ্গে ওদের আর কোনও সম্পর্ক নেই। তাই অনিতার বিষয় ওরা কিচ্ছু জানে না। সে যাই হোক, আপনি যদি ওখানে যেতে চান আমি অবশ্যই সঙ্গে যাব। আর কিছু আছে?’
‘আপাতত এইটুকুই থাকুক। পরে কথা হবে।’
ফোনটা নামিয়ে রেখে আদিত্য ভাবল চেয়ারে বসেই একটু ঘুমিয়ে নেবে। সকালে উঠে ফ্লাইট ধরতে হয়েছিল বলে গত কাল রাত্তিরে ভাল ঘুম হয়নি। চোখ বন্ধ করতেই মনে পড়ে গেল আরও দু-একটা ফোন করতে হবে।
সুভদ্র মাজিকে ফোনে পাওয়া গেল না। এনগেজড। পরের ফোনটা বিপ্লব সমাদ্দারকে। এই সেই ইনশিয়োরেন্স কোম্পানির ডিটেকটিভ যিনি সৈকত চৌধুরির কেসটা তদন্ত করছেন। অচিন্ত্য সাহা বলেছিল একে আদিত্যর নামটা বলে রাখবে।
‘আমার নাম আদিত্য মজুমদার। আমি আপনারই মতন একজন ইনভেস্টিগেটার। তবে ফ্রি লান্স, প্রাইভেট। আপনাকে কি আমার কথা ইন্সপেক্টার অচিন্ত্য সাহা বলেছেন?’
‘অচিন্ত্য? আমার ঠিক মনে পড়ছে না। কী ব্যাপার বলুন তো?’ বিপ্লব সমাদ্দারের গলাটা কিঞ্চিৎ সন্দিগ্ধ শোনালো।
‘আপনার মতো আমিও সৈকত চৌধুরির কেসটা ইনভেস্টিগেট করছি।’
‘ও হ্যাঁ, হ্যাঁ। মনে পড়েছে। অচিন্ত্য আমাকে ফোন করে বলেছিল আপনাকে সাহায্য করতে। আমি ওকে হ্যাঁ-না কিছুই বলিনি। কিন্তু দেখুন আসল সত্যিটা হল আমি এখন একটা বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করি। তাই সেই কোম্পানির কিছু নিয়ম আমাকে মেনে চলতে হয়। আমাদের কোম্পানির নিয়ম অনুযায়ী আমি আমার তদন্ত থেকে পাওয়া কোনও ইনফর্মেশন বাইরের কারও সঙ্গে শেয়ার করতে পারি না। ইন ফ্যাক্ট, আমার তদন্তের ব্যাপারে কোনও কথাও আমি বাইরের কারও সঙ্গে বলতে পারি না। অতএব বুঝতেই পারছেন সৈকত চৌধুরির কেসটা নিয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
‘না, না। আপনার কাছ থেকে আমি কোনও ইনফর্মেশন জানতে চাইছি না। আমিই আপনাকে এমন দুএকটা তথ্য দিতে চেয়েছিলাম যাতে আপনার লাভ হত। আর দুএকটা জিনিস একটু ভেরিফাই করে নিতাম।’
‘মাফ করবেন। আমার সাহায্যের কোনও প্রয়োজন নেই। আমি আপনার সাহায্য ছাড়াই চালিয়ে নিতে পারব। নমস্কার।’ বিপ্লব সমাদ্দার ফোনটা কেটে দিল।
টেবিলের ওপর মোবাইলটা নামিয়ে রেখে আদিত্য ভাবছিল। একবার সে একটা লোকাল ট্রেনে এক অন্ধ গায়কের গলায় একটা গান শুনেছিল, চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়। সেই গানটার কথা তার মনে পড়ে যাচ্ছিল।
(২)
আদিত্যর কলেজ জীবনে বিধান সরণির ফুটপাতের ওপর যে বিখ্যাত সরবতের দোকানটা ছিল, সেটা এখনও রয়েছে। পুলিশের গাড়ি কৈলাস বোস স্ট্রিট পেরোনোর ঠিক আগে আদিত্য দোকানটা এক ঝলক দেখতে পেল। আগের মতোই আছে। এখনও লোকে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে সরবত খাচ্ছে। আর একটু এগোলে বিবেকানন্দ রোড। বিশাল প্রস্থ নিয়ে সে শহরের ওপর তার শরীর বিছিয়ে দিয়েছে। পাড়াটা আদিত্যর খুব চেনা। পছন্দেরও বটে। সে এক সময় বিবেকানন্দ রোডের ওপর একটা মেসে থাকত। আর কয়েক মিনিট পরেই হেঁদো। আদিত্য ভাবল, এত দূর এসে কেয়ার জন্যে নকুড়ের সন্দেশ না নিয়ে গেলে মনে দুঃখ থেকে যাবে। কথাটা সে খানিক ইতস্তত করে সুভদ্র মাজিকে বলেই ফেলল। সুভদ্র বলল, তাহলে আগে সন্দেশটা কিনে নেওয়া যাক। না হলে এদিকে ফেরার জন্যে অনেক ঘুরতে হবে। অনেকগুলো রাস্তা ওয়ান-ওয়ে আছে তো।
সন্দেশ কেনা হল। আদিত্যর দেখাদেখি সুভদ্রও কিনে ফেলল অ্যাসর্টেড গোটা কুড়ি সন্দেশ। সন্দেশের বাক্সগুলো গাড়িতেই রেখে গন্তব্যস্থলে যেতে হবে। গন্তব্যস্থল বেথুন রো-এর একটা ঠিকানা। রামদুলাল সরকার স্ট্রিট থেকে সন্দেশ কিনে খানিক এগিয়ে ডানদিকে ঘুরতেই বেথুন রো পাওয়া গেল। এখনও তেমন গরম পড়েনি। তাই ধরে নেওয়া যায় সন্দেশগুলো খারাপ হয়ে যাবে না।
বাড়িটা পুরোনো। দোতলা। যত্নের অভাবে জায়গায় জায়গায় ভেঙে পড়েছে। একটা দেয়াল-ফোঁড় অশথগাছ ছাদের পাঁচিল ভেদ করে ঊর্ধ্বমুখী, আকাশ ছুঁতে চায়। বাড়ির নকশাটা সাবেকি, ঢুকেই একটা শ্যাওলা ধরা উঠোন, চৌবাচ্চা, একটা কলঘর। এক ধার দিয়ে সরু একপ্রস্থ সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে। একতলায় তিনটে ঘর, দুটো খোলা, একটা বন্ধ। খোলা ঘরগুলোর একটাতে দুটো লোক উবু হয়ে বসে স্তূপাকার হাতওলা গেঞ্জির ওপর কী যেন একটা যন্ত্রের সাহায্যে ক্রমাগত ছাপ দিয়ে চলেছে। অন্য ঘরটাতে ছাপ দেওয়া গেঞ্জিগুলো দড়িতে শুকোচ্ছে। আদিত্য উঁকি মেরে দেখল, ছাপ-দেওয়া গেঞ্জিগুলোর বুকে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে ‘আই লাভ নিউ ইয়র্ক’। বন্ধ ঘরটার দরজায় ‘কোয়ালিটি ক্যাটারার’ বলে একটা নেমপ্লেট লাগানো। আদিত্য আন্দাজ করল, কাজের দিনে কেটারিং-এর লোক এই ঘরটাতে যজ্ঞিবাড়ির রান্নাবান্না করে।
‘এখানে রাহুল মজুমদার, সোমা মজুমদার থাকেন?’ সুভদ্র মাঝি খোলা দরজার সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করল।
পুলিশের ইউনিফর্ম দেখে লোক দুটো ঘাবড়েছে।
‘বাড়িওলা ওপরে থাকে। ওই সিঁড়ি দিয়ে উঠে যেতে হবে।’ একজন ঈষৎ কাঁপা গলায় বলল।
‘রাহুল মজুমদার কি আপনাদের বাড়িওলা?’
‘সে তো জানি না বাবু। আমরা এখানে গেঞ্জি কলে কাজ করি। আমাদের মালিক বলতে পারবে বাড়িওলার নাম। তা তিনি তো একটু বেরিয়েছেন।’
‘ঠিক আছে। আমরা দেখছি।’
সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলা। কোলাপসিবল গেট। তালা লাগানো। গেটের বাইরে সিঁড়ির দেয়ালে রং-চটা লেটারবক্স। তালা নেই। ছিটকিনিতে মরচে ধরেছে। খুব নজর করে দেখলে বোঝা যাবে লেটারবক্সের গায়ে খুব হালকা করে ‘রাহুল মজুমদার’ ‘সোমা মজুমদার’ দুটো নামই লেখা আছে। প্রথমটার নীচে দ্বিতীয়টা। লেটারবক্সের ওপরে একটা কলিং বেলও রয়েছে। সুভদ্র মাজি পরপর দু-বার কলিং বেল বাজাল।
যে মহিলা এসে কোলাপসিবল গেটের তালা খুলছেন, তাঁর দিকে এক ঝলক তাকিয়ে আদিত্যর মনে হল তাঁর বয়েস পঞ্চাশ পেরোলেও ষাট পেরোতে বাকি আছে। ফেটে পড়া ফরসা রং, ছিপছিপে শরীর এখনও টানটান, মুখেও বিশেষ মেদ জমেনি। দীপশিখা তার মায়ের রং পায়নি এটা স্পষ্ট। সন্দেহ নেই, যৌবনে সোমা মজুমদার তাঁর মেয়ের থেকেও সুন্দরী ছিলেন।
‘আপনারা অনেকটা দেরি করে ফেললেন। আমার এক জায়গায় বেরোনোর ছিল।’ সোমা মজুমদার তাঁর বিরক্তিটা লুকোবার চেষ্টা করলেন না। ‘যদি একটু তাড়াতাড়ি করেন ভাল হয়।’
অন্য কোনও পুলিশ অফিসার হলে ধমক লাগাত। কিন্তু সুভদ্র মাজি তার নামের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে বিনীতভাবে বলল, ‘সত্যিই আমাদের বড় দেরি হয়ে গেল। তার জন্যে ক্ষমা চাইছি। আমরা খুব বেশি সময় নেব না।’
দেরি হওয়া নিয়ে আদিত্যর একটু পাপবোধ ছিল। সে ভাবছিল, বেরোতেই যখন দেরি হয়ে গেল, তখন নকুড়ের দোকানে দাঁড়িয়ে অতটা সময় ধরে সন্দেশ না বাছলেই ভাল হত।
কোলাপসিবল গেট দিয়ে ঢুকে টানা বারান্দা, বারান্দা দিয়ে নীচে তাকালে নোংরা উঠোনটা দেখা যায়। গৃহকর্তী তাদের প্রথম ঘরটাতে বসালেন। এটাই মনে হয় এই পরিবারের বৈঠকখানা। ঘরটা বেশ বড়। তবে তিনটে বেতের চেয়ার, একটা বেতের সেন্টার টেবিল আর এক কোণে একটা মান্ধাতার আমলের দেরাজ বাদ দিলে বাকি ঘরটা ন্যাড়া-ন্যাংটা। আদিত্য আর সুভদ্র মাজি দুজনে দুটো চেয়ার দখল করে বসল। তৃতীয় চেয়ারটা ফাঁকা রেখে ‘এক্ষুনি আসছি’ বলে গৃহকর্ত্রী সেই যে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন, মিনিট পাঁচেক হয়ে গেল তাঁর আর দেখা নেই।
‘উনিই তো দেরি করছেন। আমাদের তা হলে তাড়াতাড়ি করার কোনও দায়িত্ব রইল না।’ সুভদ্র খানিকটা উষ্মার সঙ্গে বলল।
আদিত্য তার কথার উত্তর দেবার আগেই সোমা মজুমদার ফিরে এসেছেন।
‘আমার স্বামীর এই সময় কয়েকটা ওষুধ খাওয়ার কথা। ওষুধগুলো খাইয়ে এলাম। নার্স একজন আছে। কিন্তু তদারকি না করলে দু-একটা ওষুধ মিস করে যাবেই। তাই একটু সময় লাগল।’ মনে হল, পুলিশকে পাঁচ মিনিট বসিয়ে রাখার জন্য সোমা মজুমদারের বিশেষ বিবেক দংশন নেই। যেন পুলিশই তাঁর ব্যক্তিগত পরিসরে ঢুকে একটা মস্ত অন্যায় করে ফেলেছে।
‘এবার বলুন, কী বলবেন।’ সোমা মজুমদার চেয়ারে বসতে বসতে বললেন।
‘আপনি তো জানেন আপনার স্বামীর বন্ধু অসীম দত্ত খুন হয়েছেন। সেই প্রসঙ্গে আপনাকে দু-একটা প্রশ্ন করতে চাই।’ সুভদ্র শুরু করল।
সোমা মজুমদার নিরুত্তর থেকে সুভদ্র মাজির দিকে তাকিয়ে রইলেন। চোখে জিজ্ঞাসা।
‘আপনি অসীম দত্তকে কতদিন ধরে চেনেন?’
‘আমার বিয়ে হয়েছে তেত্রিশ বছর। বিয়ের পর থেকেই অসীম দত্তকে চিনি। অসীমদা আমার স্বামীর স্কুলের বন্ধু।’
‘আমরা শুনেছি আপনার স্বামী অসুস্থ। শয্যাশায়ী। আপনার স্বামী কবে থেকে অসুস্থ?’
‘প্রায় কুড়ি বছর আগে আমার স্বামীর একটা ম্যাসিভ সেরিব্রাল স্ট্রোক হয়। তার পর থেকে উনি প্যারালাইজড।’ সোমা মজুমদারের গলায় ক্লান্তি ফুটে উঠেছে।
‘এখন আপনার স্বামীর বয়েস কত হবে?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘আগামী জুন মাসে ছেষট্টি হবে।’
‘তার মানে, আপনার স্বামী যখন অসুস্থ হন তখন তাঁর বয়েস বছর ছেচল্লিশ। তাই তো?’
‘হ্যাঁ, তাই।’
‘অসুস্থ হবার আগে আপনার স্বামী কী করতেন? মানে ওঁর প্রফেশনটা কী ছিল?’
‘উনি ব্যাঙ্ক অফিসার ছিলেন। ওই বয়সেই ডিজিএম হয়ে গিয়েছিলেন।’
‘আপনারা কি তখন এই বাড়িতেই থাকতেন?’
‘না, না। সল্ট লেকে আমার স্বামীর কোয়ার্টার ছিল। আমরা সেখানে থাকতাম। এই বাড়িটা তখন ফাঁকাই পড়ে থাকত। মানে দোতলাটা। একতলার ঘরগুলো চিরকালই ভাড়া দেওয়া ছিল।’
‘বাড়িটা কে বানিয়েছিলেন?’
‘এই বাড়িটা আসলে আমার শাশুড়ির। আমার শাশুড়ি তাঁর বাবার কাছ থেকে এই বাড়িটা পেয়েছিলেন। শাশুড়ির বাবা বাড়িটা বানিয়েছিলেন। দেখতেই তো পাচ্ছেন বাড়িটা কত পুরোনো।’
‘তার মানে, আপনার স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়ার পর থেকে আপনারা এই বাড়িতে থাকতে আরম্ভ করেন। ঠিক বলছি?’
‘হ্যাঁ, ঠিকই বলছেন।’
‘আপনার স্বামী আর বাড়ি করেননি? ব্যাঙ্ক থেকে তো অল্প সুদে লোন পাওয়া যায়।’
‘আমার স্বামী একটা ফ্ল্যাট কেনার জন্যে কিছু টাকা জমা দিয়েছিলেন। বাকিটা মাসে মাসে দিতে হত। আমার স্বামী অসুস্থ হবার পর আর সেটা সম্ভব হয়নি। ফ্ল্যাটটা আমরা ছেড়ে দিয়েছিলাম।’
‘আপনার স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়ার পর ব্যাঙ্ক থেকে আপনাকে কমপ্যাশানেট গ্রাউন্ডে চাকরি দেয়নি?’
‘দিয়েছিল। আমার স্বামী নিতে দেননি। সত্যিটাই বলছি। হায়ার সেকেন্ডারির পর আমার আর পড়া হয়নি। তাই কমপ্যাশানেট গ্রাউন্ডে চাকরি নিলে আমাকে নিচু কোনও পদে চাকরি করতে হত। আমার স্বামীর তাতে আপত্তি ছিল। আমার স্বামী বলতেন, ডিজিএম-এর বউ বেয়ারার চাকরি করবে এটা হতে পারে না। আর আমার মেয়ে তো তখন খুবই ছোট। তার চাকরি করার প্রশ্নই ওঠে না।’
‘তাহলে আপনাদের চলত কী করে?’
‘আমার স্বামী একটা অতি সামান্য পেনশন পেতেন। এখনও পান। কিন্তু তা দিয়ে সংসার চালানো সম্ভব নয়। কিছুদিন জমা টাকা ভেঙে চলল। তারপর জমা টাকাও ফুরিয়ে গেল।’ এইটুকু বলে সোমা মজুমদার চুপ করে রইলেন।
‘তাহলে আপনাদের চলত কী করে?’ সুভদ্র মাজি তার প্রশ্নটা পুনরাবৃত্তি করল।
‘অসীমদা সাহায্য না করলে আমাদের সংসারটা ভেসে যেত। আমার স্বামী অসুস্থ হবার দুচার বছর পর থেকেই অসীমদা প্রত্যেক মাসে আমাদের আর্থিকভাবে সাহায্য করতেন।’
‘অসীম দত্ত খুন হবার ফলে সেই সাহায্য তো বন্ধ হয়ে গেল। এখন আপনাদের চলবে কী করে?’ প্রশ্নটা করেই আদিত্যর মনে হল কথাটা রূঢ় হয়ে গেল।
ভাগ্যক্রমে সোমা মজুমদার সেই রূঢ়তাটা গায়ে মাখলেন না। বললেন, ‘অসীমদার আর্থিক সাহায্যটা বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের খুবই অসুবিধে হবে। তবে এখন তো আমাদের মেয়ে আমাদের সঙ্গেই থাকে। ও একটা স্কুলে পড়ায়। ওর আয়ে সংসারটা কোনও রকমে চলে যাবে।’ কথাটা বলে সোমা মজুমদার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
‘আপনার মেয়ের বিয়ের প্রসঙ্গে আসছি।’ কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আদিত্য আবার শুরু করল। ‘অসীম দত্তর ছেলের সঙ্গে আপনার মেয়ের বিয়ের প্রস্তাবটা কি আপনাদের তরফ থেকে গিয়েছিল, নাকি অসীমবাবুর দিক থেকে এসেছিল?’
‘দুটোর কোনওটাই নয়। বিয়েটা আমার স্বামী এবং অসীমদা দু’জনে মিলে ঠিক করেছিলেন।’
‘আমরা দেখেছি, দীপশিখা মুম্বই থেকে চলে আসার পরেও অসীমবাবুর সঙ্গে তার সম্পর্ক ভাল ছিল। শুনেছি, অনির্বাণবাবুর সঙ্গে যদি দীপশিখার ফর্মালি ডিভোর্স হয়ে যেত, তাহলেও সে অসীমবাবুর সম্পত্তির একটা অংশ পেত। আপনারা কি এই ব্যাপারটা জানতেন?’
সোমা মজুমদার খানিকটা চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, ‘অসীমদা আমাদের বলেছিলেন দীপশিখার জন্যে কিছু টাকা তিনি তাঁর উইলে রেখে যাবেন। কিন্তু টাকার অঙ্কটা কত সেটা তিনি বলেননি। তবে অনির্বাণের ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে তিনি মাঝে মাঝে বলতেন, ভাবছি, আমার উইলে অনির্বাণের অংশটা পুরোটাই দীপশিখাকে দিয়ে যাব। আমার ছেলের বেয়াড়াপনায় মেয়েটা বড় কষ্ট পেয়েছে।’
‘আপনার কি মনে হয় এটা শুধু কথার কথা, নাকি বাস্তবে এরকম ঘটতেও পারত?’
‘আমি ঠিক বলতে পারব না।’
‘এবার একটা খুব অপ্রিয় প্রশ্ন করব। তদন্তের স্বার্থে প্রশ্নটা আমাদের করতেই হবে।’ আদিত্য একটু থেমে সাহস সঞ্চয় করে নিল।
‘আমাদের প্রশ্ন, অসীম দত্তর সঙ্গে আপনার কি কোনও সম্পর্ক ছিল?’
‘আপনি কী ইঙ্গিত দিচ্ছেন? অসীমদা আমার স্বামীর ছোটবেলার বন্ধু। আমাদের পরিবারেরও বন্ধু। শুধু বন্ধু বললে ভুল হবে। উনি প্রতি মাসে টাকা দিয়ে সাহায্য না করলে আমাদের সংসারটা ভেসে যেত। ওঁর ঋণ আমরা কোনও দিন শোধ করতে পারবো না।’ সোমা মজুমদারের ফরসা রং ক্রমশ রক্তিম হচ্ছে।
‘দেখুন, আপনার স্বামী রাহুল মজুমদার যখন পক্ষাঘাতে পঙ্গু এবং শয্যাশায়ী হয়ে গেলেন তার কয়েক বছর আগে অসীমবাবুর স্ত্রী-বিয়োগ হয়েছে। অসীমবাবু আপনাদের বাড়িতে তখন নিয়মিত আসছেন, আপনাদের পরিবারটিকে আগলে রাখছেন। এই অবস্থায় আপনার সঙ্গে তাঁর একটা ঘনিষ্ঠতা হওয়াটাই কি স্বাভাবিক নয়?’
‘কী ধরনের ঘনিষ্ঠতার কথা আপনি বলছেন, স্পষ্ট করে বলুন?’ সোমা মজুমদারের মুখমণ্ডল আরও রক্তিম।
‘একজন নারীর সঙ্গে একজন পুরুষের যেরকম ঘনিষ্ঠতা হয় আমি সেরকম ঘনিষ্ঠতার কথাই বলছি। কথাটা এর থেকে স্পষ্ট করে বলা সম্ভব নয়।’
‘আপনার প্রশ্নের উত্তর আমি দেব না। এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।’ সোমা মজুমদার মাথা নিচু করে বললেন। ‘আপনার প্রশ্নে আমি খুব অপমানিত বোধ করছি।’ তাঁর চোখে জল টলটল করছে।
আদিত্য আর সুভদ্র কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর সুভদ্র কিছুটা পুলিশি গলায় বলল, ‘অসীম দত্ত তাঁর উইলে আপনাকে একটা মোটা টাকা দিয়ে গেছেন। দীপশিখাকে নয়, আপনাকে। এর কারণ কী বলতে পারেন?’
‘অসীমদা আমাকে টাকা দিয়ে গেছেন?’ সোমা মজুমদার যেন বিস্মিত।
‘হ্যাঁ, বেশ মোটা একটা টাকা। অসীমবাবুর উকিল খুব শিগগির আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।’
‘হয়তো আমাদের পরিবারটার কথা ভেবে অসীমদা এই টাকাটা দিয়ে গেছেন। যদি অবশ্য সত্যিই দিয়ে থাকেন।’
‘ঠিক আছে। আপনাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করব না। আপনার স্বামীর সঙ্গে একটু কথা বলা যাবে?’ আদিত্য বলল।
‘প্যারালিসিস হয়ে যাবার পর আমার স্বামীর কথা কেউ বুঝতে পারে না। আমিও পুরোটা পারি না। তাছাড়া কোনওরকম উত্তেজনা ওঁর শরীরের পক্ষে মারাত্মক হতে পারে। আমি আপনাদের করজোড়ে অনুরোধ করছি আমার স্বামীর সঙ্গে কথা বলতে চাইবেন না।’
‘তাহলে আর একটাই জিনিস বাকি রইল। আপনার যে কটা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে তার প্রত্যেকটার পাশবই আমাদের দেখা দরকার। আর ফিক্সড ডিপোজিট থাকলে তার সার্টিফিকেটগুলো। বেশি সময় লাগবে না। আজ পেলে আগামী কালই ফেরত দিয়ে যাব। পাশবই আর সার্টিফিকেটগুলো পেতে পারি?’
‘আমার ব্যাঙ্কের পাশবই সার্টিফিকেট নিয়ে আপনারা কী করবেন? পাশবই আমি দেব না। তাছাড়া ওগুলো আপডেটও করা নেই।’ সোমা মজুমদারের গলায় বিদ্রোহ।
‘ম্যাডাম, আপনি যদি স্বেচ্ছায় পাশবই সার্টিফিকেটগুলো না দেন তা হলে আপনার বাড়িটা আমাদের সার্চ করতে হবে। আমাদের সঙ্গে সার্চ ওয়ারেন্ট আছে। আপনার অসুস্থ স্বামী জানতে পারবেন বাড়ি সার্চ করা হচ্ছে। জেনে উত্তেজিত হয়ে পড়বেন। ওঁর আরও শরীর খারাপ হবে। তার থেকে পাশবই আর সার্টিফিকেটগুলো স্বেচ্ছায় দিয়ে দেওয়াই ভাল নয় কি? আর আপডেট করা না থাকলে ওগুলো আমরা আপডেট করিয়ে নেব।’ সুভদ্র ঠাণ্ডা গলায় বলল।
‘আর, যদি কোনও পাশবই বা সার্টিফিকেট আপনি লুকিয়ে রাখেন, আমরা পরে ঠিক টের পেয়ে যাব। তখন কিন্তু আপনি পুলিশের সঙ্গে অসহযোগিতা করার দায়ে পড়ে যাবেন।’ আদিত্য যোগ করল।
সোমা মজুমদার তখনও ইতস্তত করছেন।
‘আমার মনে হয় আপনার মেয়ের স্কুল থেকে ফেরার সময় হয়ে যাচ্ছে। ওর সামনে কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হোক আমরা চাই না। পাশবই আর সার্টিফিকেটগুলো পেলেই আমরা চলে যাব।’ আদিত্য আবার বলল।
‘ঠিক আছে। একটু বসুন, দিচ্ছি।’ সোমা মজুমদার উঠে গেলেন।
আধঘণ্টা পরে, বাড়ি ফেরার পথে, পুলিশের গাড়ি যখন মৌলালির সিগনালে আটকে রয়েছে, সুভদ্র মাজি আদিত্যকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি ব্যাঙ্কের পাশবই দেখতে চাইলেন কেন?’
‘কারণ আমি জানতে চাই অসীম দত্ত সোমা মজুমদারকে মাসে মাসে কত টাকা দিতেন। দেখুন, অসীম দত্ত এবং তার ছেলে অনির্বাণ দত্ত মারা যাওয়া ফলে দীপশিখা এবং তার মা দুজনেরই লাভ হয়েছে। তাই উড়িষ্যার পুলিশ মনে করছে দীপশিখাই তার শ্বশুর এবং স্বামীকে খুন করেছে। এটা অসম্ভব নয়। কিন্তু যদি দেখি অসীম দত্ত দীপশিখার মা-কে বেশ মোটা একটা টাকা মাসোহারা দিতেন, যেটা অসীম দত্তর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল, তাহলে দীপশিখাই খুনগুলো করেছে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দেবে। খুন করার তো একটা বিরাট রিস্ক আছে। একান্তই দরকার না হলে কেউ খুন করে না। যদি এমনিতেই মাসে মাসে মোটা টাকা ঘরে আসে তা হলে আমি সোনার ডিম পাড়া হাঁসটাকে খুন করে খামোকা রিস্ক নিতে যাব কেন? তাই অসীম দত্তর কাছ থেকে কত টাকা মাসোহারা আসত সেটা জানা জরুরি।’
‘বুঝতে পারছি।’ সুভদ্র মাজিকে চিন্তামগ্ন দেখাল।
‘আপনি তাহলে পাশবইগুলো দেখে আমাকে একটু জানাবেন কোন জায়গা থেকে সোমা মজুমদারের অ্যাকাউন্টে নিয়মিত টাকা আসত?’
‘নিশ্চয় জানাব। কালকের মধ্যেই জানিয়ে দিচ্ছি।’
গাড়ি ট্র্যাফিক সিগনালের কবল থেকে উদ্ধার পেয়ে আবার চলতে শুরু করেছে।
(৩)
পরের দিন সকাল থেকেই আদিত্য সুভদ্র মাজির টেলিফোনের জন্যে অপেক্ষা করছিল, এমন সময় সায়ন্তনের ফোন।
‘তোর খবরটা কী? সেই যে মেট্রোতে দেখা হল তারপর আর কোনও পাত্তাই নেই। একটা ফোন-টোন করবি তো।’
উত্তরে আদিত্য বলতে পারত, তুইও তো ফোন করিসনি। তার বদলে সে বলল, ‘একটা কাজ নিয়ে খুব ঝামেলায় রয়েছি রে। তাই ফোন করতে পারিনি। তুই কেমন আছিস?’
‘আমি তো ভালই আছি। আপিস যাচ্ছি, ইলাসট্রেশন করছি, বাড়ি ফিরছি, বউকে আদর করছি, আবার বউএর সঙ্গে লাঠালাঠিও হচ্ছে। এর থেকে আর কত ভাল থাকব?’
‘তোর গলা শুনেই বুঝতে পারছি ভাল আছিস। তোর শরীরটা মনে হচ্ছে পুরোপুরি সেরে উঠেছে।’
‘আমার শরীর এখন ফার্স্টক্লাস।’
‘বেশ। বেশ। তা হলে তো একদিন বসে আড্ডা দেওয়া যেতে পারে।’
‘আরে সেই জন্যেই তো ফোন করেছি। আমার সেই কলিগের কথা বলেছিলাম, মনে আছে? অর্ণব ব্যানার্জী?’
‘মনে আছে। সেই ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট। তোর সঙ্গে কথা হবার পরে ওর দুএকটা লেখা পড়লাম।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। তা, তোর সঙ্গে আলাপ করার জন্য অর্ণবের প্রবল আগ্রহ। রোজই বলে তোর কথা। তাই ভাবলাম তাড়াতাড়ি একটা আড্ডা অরগানাইজ করা দরকার। জাস্ট তিনজন, তুই, আমি আর অর্ণব। আজ তো শুক্রবার, উইকএন্ড। সন্ধেবেলা তোর সময় হবে?’
আদিত্য ভাবছিল। আজ সন্ধেবেলা কেয়া আর তার ইস্কুলের কয়েকজন দিদিমণি মিলে দক্ষিণ কলকাতার কোন একটা মলে গিয়ে কেনাকাটা করার প্ল্যান করেছে। কেয়া বলেছে, ফিরতে দেরি হবে। আজই সায়ন্তনের সঙ্গে আড্ডা দেবার প্রকৃষ্ট দিন।
‘আজ সন্ধেবেলা ক’টার সময়?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘এই ধর ছ’টা?’
‘কোথায় দেখা করব?’
‘আমাদের অফিসটা তো তুই চিনিস। আমাদের অফিসের গলিটাতে ঢোকার ঠিক মুখে একটা নতুন বার হয়েছে। ভাল কাবাবও পাওয়া যায়। ওখানে বসা যাক। তুই মেট্রোতেই চলে আসতে পারবি। আসছিস তো তা হলে?’
‘আসছি। ছ’টায় দেখা হচ্ছে।’
কেয়া স্কুলে বেরিয়ে যাবার পর আদিত্য বাড়ির মধ্যে কিছুক্ষণ পায়চারি করল। আসলে সে গভীরভাবে চিন্তা করছে। তার মাথায় এখন দুজোড়া খুন ঘুরছে। আদিত্য মোটামুটি নিশ্চিত, যে অসীম দত্তকে খুন করেছে সে অনির্বাণ দত্তকেও মেরেছে। তাই ওই দুটো খুনকে আদিত্য একটাই রহস্য হিসেবে দেখছে। অন্য রহস্যটা অবশ্যই সৈকত চৌধুরি খুন হওয়া সংক্রান্ত। সৈকত চৌধুরিকে যে মেরেছে সেই কি সৈকতের পার্টনার মণিময় গুপ্তকেও মেরেছে? সৈকত চৌধুরির খুনটাই তাকে বেশি ভাবাচ্ছে। সব থেকে বড় ধাঁধা, কেন সৈকত মৃত্যুর ঠিক আগে অত টাকার ইনশিয়োরেন্স করেছিল? তার কি মনে হয়েছিল কেউ তাকে মারার চেষ্টা করছে?… ফোন বাজছে। সুভদ্র মাজি।
‘বলুন। সোমা মজুমদারের পাশবুক থেকে কিছু পেলেন?’
‘হ্যাঁ, পেয়েছি। সোমা মজুমদারের একটা অ্যাকাউন্টে প্রত্যেক মাসে পঞ্চাশ হাজার করে টাকা জমা পড়ে। কম কথা নয়। পুরো পঞ্চাশ হাজার টাকা।’
‘টাকাটা কে জমা দেয়?’
‘মাসের প্রথমে সোমাই টাকাটা ক্যাশে জমা দেয়। তারপর সারা মাস ওখান থেকে টাকা উইথড্র করে। মাসের শেষে আর বিশেষ কিছু থাকে না।’
‘তার মানে, টাকাটা অসীম দত্ত ক্যাশে সোমার হাতে তুলে দেন। মনে হচ্ছে টাকাটা দুনম্বরি।’
‘পঞ্চাশ হাজারে তো ওদের ভালই চলে যাওয়া উচিত।’
‘নিশ্চয় চলে যাওয়া উচিত। কিন্তু ওদের বাড়ি ঘর দেখে তো সেটা মনে হল না।’
‘এত টাকা ওরা করে কী তাহলে?’
‘সেটা তো অ্যাকাউন্ট দেখে বলা শক্ত।’
‘হয়তো রাহুল মজুমদারের চিকিৎসায় অনেকগুলো টাকা খরচ হয়ে যায়।’ আদিত্য চিন্তা করে বলল। ‘একটা ভাল নার্স রাখলেই তো মাসে-মাসে হাজার তিরিশেক বেরিয়ে যাবে।’
‘একটা কথা। মাসে মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা নিশ্চয় অনেক টাকা, কিন্তু অসীম দত্ত এবং অনির্বাণ দত্ত মারা যাবার পর যে টাকাটা মা-মেয়ের হাতে আসবে সেটা কিন্তু অনেক অনেক বেশি। এতটাই বেশি যে তার জন্যে খুন করাই যায়।’
‘মানলাম। তবে কি জানেন, খুন করতে গেলে এক ধরনের মানসিকতা লাগে। সেটা এদের আছে কিনা এখনও স্পষ্ট নয়।’
‘আপনার কি তাহলে মনে হয় অন্য কেউ খুনগুলো করেছে?’
‘জানি না। এখনও কিছুই জানি না।’ আদিত্য অনিশ্চিত গলায় বলল। ‘আচ্ছা, অন্য অ্যাকাউন্টগুলো থেকে কিছু বোঝা গেল?’
‘না। অন্য দুটো অ্যাকাউন্টে অনেকদিন কোনও ট্রাঞ্জাকশান হয়নি। দুটোই ডরম্যান্ট অ্যাকাউন্ট।’
‘আর ফিক্সড ডিপোজিট?’
‘এক লাখ করে দুটো ফিক্সড ডিপোজিট আছে। ব্যাস। আর কিছু নেই। কয়েকবার রিনিউড হয়েছে। কিন্তু বাড়েনি। কারণ, বছরে বছরে সুদটা তুলে নেওয়া হয়েছে। তাই বলছিলাম, সোমা মজুমদারের টাকার জোর একেবারেই নেই।’
সুভদ্র মাজির সঙ্গে কথাবার্তা সেরে অনেকক্ষণ চান করল আদিত্য। কলকাতা থেকে শীতটা চলেই গেছে বলা যায়। শীতের গোড়ায় কেয়া বাথরুমে একটা গিজার বসিয়েছিল। সেটা না চালিয়ে ঠান্ডা জলেই আদিত্য চান করল। শরীরটা জুড়িয়ে গেল। তোয়ালে দিয়ে গা মুছতে মুছতে হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল মণিময়ের কালো টাকার কথা। সে-ও নিশ্চয় একটা মোটা টাকা তার বান্ধবীর জন্য খরচ করে।
আদিত্য আজ আর তার আপিসে যাবে না। লাঞ্চটা ফ্রিজে আছে, গরম করে নিতে হবে। কিন্তু তার আগে আর একটা ফোন করা দরকার। আদিত্য নম্বরটা লাগাল। কিশোরকুমার গান শোনাচ্ছেন, দুখী মন মেরে। গৌতম আবার কলার টিউন পাল্টেছে।
খানিকক্ষণ বাজার পর গৌতম ফোনটা ধরল। ‘এই যে পোয়ারো সাহেব, খবরটা কি? বিয়ে করে একেবারে বেপাত্তা হয়ে গেলি?’
‘কলার টিউনটা আবার কবে পাল্টালি?’ গৌতমের কথার উত্তর না দিয়ে আদিত্য বলল।
‘আরে এটা হল ফান্টুস সিনেমায় কিশোরকুমারের দুর্দান্ত গান। ক্লাস ইলেভেনে পড়ার সময় স্কুল কেটে দেখেছিলাম। নাজ সিনেমা হলে। ওখানে পুরোনো সিনেমাগুলো আবার আসত। এখন বোধহয় সিনেমা হলটা আর নেই। মনে দাগ কেটে বসে আছে। তা হঠাৎ সেদিন গানটার কথা মনে পড়ে গেল। অমনি কলার টিউনটা বদলে ফেললাম। তোর খবর-টবর বল।’
‘আমি দুটো কেস নিয়ে ল্যাজেগোবরে হয়ে আছি। তোর সাহায্য দরকার। আচ্ছা, সিবিআই-এর সঙ্গে তোদের কেমন সম্পর্ক?’
‘সিবিআই! ওরেব্বাবা! আমাদের সঙ্গে সিবিআই-এর সম্পর্ক এখন একেবারে তলানিতে। এসব পলিটিকাল ব্যাপার। সেন্টার-স্টেট খেয়োখেয়ি। তার মধ্যে পড়ে আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। সিবিআই-এর সঙ্গে তোর কীসের দরকার? তুই তো সেই পুরীতে একটা মার্ডার কেস নিয়ে ব্যস্ত ছিলি?’
‘আরে, সেটা অন্য একটা কেস। এটা আর একটা। এই কেসটাতে সিবিআই একজনের এগেন্সটে ইনভেস্টিগেট করছিল। কিছুদিন আগে সেই লোকটা খুন হয়। আমার জানা দরকার ওই খুন হওয়া লোকটার এগেন্সটে সিবিআই-এর ঠিক কী অ্যালিগেশন ছিল।’
‘সেটা তো সিবিআই-ই বলতে পারবে। কিন্তু আমি সরাসরি জিজ্ঞেস করলে সিবিআই কিচ্ছু বলবে না। তোর যদি খুব দরকার হয় তা হলে অন্যভাবে ট্রাই করতে পারি। দিল্লিতে জানাশোনা বার করে তাদের দিয়ে বলাতে হবে। পারব কিনা জানি না। আর পারলেও অনেকটা সময় লেগে যাবে।’
‘তুই একটু চেষ্টা করে দ্যাখ। যদি কিছু জানা যায়। তবে আউট অফ দ্য ওয়ে গিয়ে কিছু করার দরকার নেই। আমি কেসটার ডিটেলটা তোকে মেল করে দিচ্ছি।’
‘ওক্কে। তুই ডিটেলটা পাঠিয়ে দে। কিছু জানতে পারলে তোকে জানাব। তবে, অ্যাজ আই সেড, চান্সেস আর স্লিম। আর শোন। একটা উইকএন্ডে তোদের নিয়ে কোথাও একটা খেতে যাবার ইচ্ছে আছে। আমি মালিনীর সঙ্গে কথা বলে তোকে ফোন করব।’
‘ঠিক আছে। করিস। এখন রাখলাম।’
কলটা ডিসকানেক্ট করে আদিত্য বিষণ্ণ হয়ে পড়ল। সে খুব আশা করেছিল গৌতমের কাছ থেকে সৈকত চৌধুরির বিরুদ্ধে সিবিআই কেসটার ব্যাপারে কিছু জানা যাবে।
বারের নাম ‘হেলিওট্রোপ’। নামের সঙ্গে সংগতি রেখে ভিতরটা বেগুনি রঙের। ভিতরের আলোগুলো এমনিতেই কম, তার ওপর বেগুনি দেয়াল অনেকটা আলো খেয়ে নিয়েছে। তাই ভিতরটা বেশ অন্ধকার। বারের ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে আদিত্যর মনে পড়ে গেল বহুদিন আগে পড়া জীবনানন্দের লাইন ‘আকাশ উঠেছে ভরে হেলিওট্রোপের মতো রূপে’।
একটা কোণ থেকে সায়ন্তন হাত তুলে তার উপস্থিতি জানাল। সে আর একজনের সঙ্গে বসে আছে। হাত না তুললে অন্ধকারে আদিত্য তাদের দেখতেই পেত না। অন্ধকারটা তার চোখে এখনও সয়ে আসেনি।
‘বোস, বোস। দেরি হল কেন?’ সায়ন্তন জিজ্ঞেস করল।
‘ওই পুরোনো প্রবলেম। কোনও একটা স্টেশনে মেট্রো খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সেটা না সারানো অবধি সব মেট্রো বন্ধ। তুই বুঝবি। তুই তো মেট্রোতে যাতায়াত করিস।’ আদিত্য বসতে বসতে বলল।
‘হ্যাঁ, জানি তো। এই মেট্রো জিনিসটা চললে দারুণ, আর খারাপ হয়ে গেলে ওর থেকে খারাপ আর কিছু হয় না। দাঁড়া, আগে আলাপ করিয়ে দিই। আমার ইস্কুলের বন্ধু আদিত্য মজুমদার, এইস ডিটেকটিভ, আর এ হচ্ছে আমার কলিগ অর্ণব ব্যানার্জী, এইস ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টার। আদিত্য, অর্ণব কিন্তু তোর বিরাট ফ্যান।’
‘আমিও অর্ণবের ফ্যান। আমি আপনার লেখা পেলেই পড়ে ফেলি। ভেরি থরো ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং।’ আদিত্য অর্ণবের দিকে তাকিয়ে হাসল। অর্ণবও হাসল।
আদিত্যকে দেখে বেয়ারা এসে দাঁড়িয়েছে।
‘বল কী খাবি?’ সায়ন্তন আদিত্যর দিকে তাকাল।
‘তোরা কী খাচ্ছিস?’
আদিত্য সায়ন্তনদের গেলাসের দিকে তাকাল। সায়ন্তন এবং তার সঙ্গীর গেলাসে জল-রঙা যে তরল পদার্থটা রয়েছে সেটা ভদকা বা জিন দুটোর যে কোনও একটা হতে পারে। কোনটা আদিত্য বুঝতে পারছিল না।
‘আমরা বাকার্ডি খাচ্ছি। তুই বাকার্ডি খাবি?’
বাকার্ডির কথাটা আদিত্য ভাবেনি। সে বলল, ‘নাঃ, রাম জিনিসটা খেলেই আমার পেটের গণ্ডগোল হয়। আমি বরং বিয়ার খাই।’
‘এই সন্ধেবেলা বিয়ার খাবি? তোর সেই ক্লাসিক্যাল পছন্দগুলো বদলে গেল কেন? সেই সান-ডাউনের পর হুইস্কি, দুপুরে পিঙ্ক জিন কিংবা জিন অ্যান্ড টনিক, রাত্তিরে ডিনারের পর ব্র্যান্ডি বা কনিয়াক?’ সায়ন্তন মুচকি হাসল। বারের ভেতরের অন্ধকারটা আদিত্যর চোখে সয়ে আসছে।
আদিত্যর মনে করতে পারল না ঠিক কবে সে তার এরকম সাহেবি পছন্দের কথা সায়ন্তনকে জানিয়েছিল। সম্ভবত সায়ন্তন ওর পেছনে লাগছে।
‘আজকাল আমার হুইস্কি, পিঙ্ক জিন, বিয়ার, কনিয়াক কিছুই জোটে না রে। যেটা জোটে সেটা হল সান-রাইজ থেকে সান-ডাউন পর্যন্ত অনেকবার চা, কখনও কফি, আর সান-ডাউনের পরেও তাই।’ আদিত্যও হাসল।
সাহেবরা অর্ডার না দিয়ে কথাবার্তা বলছে দেখে বেয়ারা উধাও হয়ে গিয়েছিল। দু’প্লেট কাবাব নিয়ে সে ফিরে এসেছে। চিকেন রেশমি এবং চিকেন মালাই। এগুলো নিশ্চয় আদিত্য আসার আগেই অর্ডার দেওয়া হয়েছিল। বেয়ারা বিয়ারের অর্ডার নিয়ে চলে গেল।
‘তোর খুব কাজের চাপ বলছিলি না? কোনও ইন্টারেস্টিং অ্যাসাইনমেন্ট, নাকি ডিভোর্স মামলার প্রমাণ সংগ্রহের কাজ?’ সায়ন্তন কথাবার্তা শুরু করল। ‘আসলে, কী জানিস তো, তোর কাজটা আমাদের খুব এক্সাইটিং লাগে। অর্ণব আর আমার দুজনেরই লাগে। তাই শুনতে ইচ্ছে করে। অবশ্য কিছু কাজে নিশ্চয় কনফিডেন্সিয়ালিটি মেনটেন করতে হয়। সেরকম কিছু হলে আমাদের বলতে হবে না।’ সায়ন্তন বাকার্ডির গেলাশে চুমুক দিল।
আদিত্য উত্তর দেবার আগেই বিয়ার এসে গেছে। বেয়ারা গ্লাসে বিয়ার ঢেলে অর্ধেক ভর্তি বোতলটা টেবিলে রেখে দিল।
সায়ন্তন বলল, ‘বিয়ার দেখলেই আমার দুটো লাইন মনে পড়ে যায়— আমি আর গুরুদেব দুজন ইয়ার/বিনির বাড়িতে যাই খাইতে বিয়ার—বলত কার লেখা?’ সায়ন্তন মিটিমিটি হাসছে। তার দেখাদেখি অর্ণবও হাসছে।
ভাগ্যক্রমে প্রশ্নের উত্তরটা আদিত্য জানত। সে মুচকি হেসে বলল, ‘রসরাজ অমৃতলাল বসু।’
‘ব্রাভো, ব্রাভো। এই না হলে আমাদের আদু!’ সায়ন্তন চেঁচিয়ে উঠল। তার গলার আওয়াজে কেউ কেউ পেছন ফিরে দেখছে।
আদিত্যর মনে হল সায়ন্তনের সামান্য নেশা ধরেছে। সে বলল, ‘তোরা কখন এসেছিস?’
‘আমরা আজ পাঁচটার সময় অফিস থেকে বেরিয়েই এখানে ঢুকে পড়েছি। দু’রাউন্ড হয়ে গেছে। তৃতীয় রাউন্ড চলছে। আচ্ছা বল তো, এখানে, মানে এই দুটো লাইনে, গুরুদেব বলতে কবি কাকে বোঝাচ্ছে আর বিনিই বা কে?’
‘গুরুদেব হলেন গিরিশ ঘোষ আর বিনি, বলাই বাহুল্য, নটী বিনোদিনী।’ আদিত্য নিচু গলায় বলল।
‘সুপার্ব, সুপার্ব। দশে দশ, একশ তে একশ, হাজারে হাজার।’ সায়ন্তন আবার গলা চড়াল। সামনের টেবিল থেকে আবার সেই লোকগুলো ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে।
অস্বস্তির হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য অর্ণব বলল, ‘সায়ন্তনদা আপনাকে আপনার কাজের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছিলেন। কথাটা চাপা পড়ে গেল। আপনার কেসগুলো খুব জানতে ইচ্ছে করে কিন্তু।’ অর্ণব ব্যানার্জীর কথা বলার ভঙ্গিটা খুব পরিশীলিত।
‘একটা কথা কিন্তু সায়ন্তন ঠিক বলেছে। আমার বেশিরভাগ কেসই খুব আনইনটারেস্টিং। ওই স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া, একজন অন্যজনের বিরুদ্ধে মামলা করবে, আমাকে প্রমাণ জোগাড় করে দিতে হবে। আবার কিছু ফ্রড কেস পেয়েছি, ব্যাঙ্ক-ট্যাঙ্ক থেকে। সেগুলোও বেশ বোরিং। বোর না হয়ে ডকুমেন্টগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সত্যটা আবিষ্কার করতে হবে। কাজটা সোজা নয়, কিন্তু খুব ইন্টারেস্টিংও নয়। সত্যিকারের ইন্টারেস্টিং কেস খুব বেশি পাইনি। তবে এখন দুটো খুনের মামলা ইনভেস্টিগেট করছি। ফেয়ারলি ইন্ট্রিগিং।’
আদিত্য থামল। বিয়ারের গ্লাসে চুমুক দিল। একটা কাবাব তুলে মুখে পুরল।
‘সেই গল্পগুলো একটু বল না। ভাল গল্প না হলে আড্ডা জমে?’ সায়ন্তন কিছুটা শান্ত হয়েছে।
‘কেস দুটো খুব কনফিডেন্সিয়াল বলা যায় না। দুটোর কথাই এক্সটেনসিভলি মিডিয়াতে রিপোর্টেড হয়েছে। দ্বিতীয়টা প্রথমে বলছি। বেশ রিসেন্ট ঘটনা। গত সপ্তাহে পুরীতে তাঁর নিজের রিসর্টে খুন হয়েছেন অসীম দত্ত আর তার একদিন পরে তাঁর ছোট ছেলে অনির্বাণ দত্ত। অসীম দত্তকে আগেও একবার খুন করার চেষ্টা হয়েছিল। সেটার ব্যাপারে তদন্ত করতে অসীম দত্ত আমাকে নিয়োগ করেছিলেন। বলেছিলেন, তিনি যদি খুন হন তাহলে আমি যেন আমার ইনভেস্টিগেশন চালিয়ে যাই। আমি সেটাই করছি। এর বেশি কিন্তু আর কিছু বলতে পারব না। কারণ আমি নিজেই ব্যাপারটা এখনও বুঝতে পারিনি।’
‘অসীম দত্ত খুনের ব্যাপারটা তো রোজই কাগজে বেরোচ্ছে। কিছু কাগজ লিখেছে, পুলিশ নাকি শিগগিরই কাউকে এ-ব্যাপারে অ্যারেস্ট করবে। কেসটা নাকি সলভড হয়ে গেছে। আপনার কি মনে হয় এটা ভুল খবর?’ অর্ণব তার সাংবাদিকের টুপিটা পরে নিয়েছে।
‘জানি না ভুল খবর কিনা। এটুকু বলতে পারি, আমি কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর এখনও পাইনি। কিন্তু দয়া করে এটা আপনাদের কাগজে লিখবেন না। আমার কথা কিছুই লিখবেন না প্লিজ।’
‘না, না। লেখার প্রশ্নই ওঠে না। তাছাড়া আমি তো কেসটার দায়িত্বেও নেই।’ অর্ণব আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে বলল।
‘আর অন্য কেসটা যেটা তুই ইনভেস্টিগেট করছিস?’ এবার সায়ন্তনের গলা।
‘সেটা আরও অদ্ভুত। সৈকত চৌধুরি বলে মাস দেড়েক আগে একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার খুন হয়েছিল। খুন হবার আগে বউকে নমিনি করে সে একটা অবিশ্বাস্য বেশি টাকার ইনশিয়োরেন্স করেছিল। স্বাভাবিকভাবেই ইনশিয়োরেন্স কোম্পানি প্রমাণ করার চেষ্টা করছে টাকার লোভে বউটাই সৈকত চৌধুরিকে খুন করেছে। যদি প্রমাণ করতে পারে তাহলে আর তাদের টাকাটা দিতে হবে না। বউটার আবার একটা পুরুষ বন্ধু আছে। ইনশিয়োরেন্স কোম্পানির গোয়েন্দা প্রমাণ করার চেষ্টা করবে সেই পুরুষ বন্ধুটাও এর মধ্যে রয়েছে। এখন, সৈকত চৌধুরির বউ অনিতা চৌধুরি আমার কাছে সাহায্যের জন্যে এসেছিল। তাই আমি কেসটার মধ্যে জড়িয়ে পড়েছি। ইনশিয়োরেন্স কোম্পানির সহজ ব্যাখ্যা আমি মানতে পারছি না।
দুটো জিনিস কেসটাকে জটিল করে দিয়েছে। এক, আমি বুঝতে পারছি না সৈকত অত টাকার ইনশিয়োরেন্স করতে গেল কেন? দুই, সৈকতের পার্টনার মণিময়কেও কেউ খুন করে পুকুরে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল। কিছুদিন আগে সেই বডি পাওয়া গেছে। আমার স্থির বিশ্বাস দুটো খুনের মধ্যে সম্পর্ক আছে। কিন্তু আসল রহস্যটা আমি কিছুতেই ধরতে পারছি না।’
অর্ণব হাঁ করে আদিত্যর কথা শুনছিল। আদিত্যর কথা শেষ হতে সে ব্যগ্র হয়ে বলল, ‘এই সৈকত চৌধুরি কি গুপ্ত অ্যান্ড চৌধুরি সিভিল কন্সট্রাকশানস-এর পার্টনার ছিল?’
আদিত্য খানিকটা অবাক হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, ছিল তো। আপনি এর কথা জানেন নাকি?’
‘খানিকটা জানি। একে নিয়ে বছর খানেক আগে আমি একটা লম্বা আর্টিকাল লিখেছিলাম। তিনটে পার্টে বেরিয়েছিল।’
‘লেখাটা আমার নজর এড়িয়ে গেছে। সৈকত চৌধুরির ব্যাপারটা আপনি যেটুকু জানেন আমাকে বলবেন? আমার তা হলে খুব উপকার হয়।’ আদিত্যর গলায় প্রায় অনুনয়।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমি যেটুকু জানি বলছি। দাঁড়ান একটু গুছিয়ে নিই।’
বেয়ারা এসে আবার দাঁড়িয়েছে। আরও এক রাউন্ড বাকার্ডি অর্ডার দেওয়া হল। সঙ্গে আরও কিছু কাবাব। আদিত্যর সেই এক বোতল বিয়ার এখনও শেষ হয়নি।
‘আমার যতদূর মনে পড়ছে, কয়েক বছর আগে ন্যাশানাল হাইওয়ে ডেভেলপমেন্ট অথরিটি অজয় নদীর ওপর একটা ব্রিজ বানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। জায়গাটার নাম সিমজুড়ি। চিত্তরঞ্জনের কাছে, অজয় নদী যেখানে ঝাড়খণ্ড থেকে পশ্চিমবঙ্গে এসে ঢুকেছে, সেখানে। ব্রিজটা তৈরি হলে, ঝাড়খণ্ডের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গকে একটা নতুন রাস্তা দিয়ে জুড়ে দেওয়া যাবে। নিয়ম মাফিক টেন্ডার করে এই ব্রিজটা তৈরি করার বরাত দেওয়া হয় গুপ্ত অ্যান্ড চৌধুরি সিভিল কন্সট্রাকশানসকে। বেশ বড় টাকার কাজ। কিন্তু টাকার থেকেও সৈকত চৌধুরির কাছে অনেক বেশি আকর্ষণীয় ছিল কাজটার ইঞ্জিনিয়ারিং চ্যালেঞ্জ।’
আদিত্যর বিয়ারের বোতলটা অবশেষে ফুরিয়েছে। সায়ন্তন হাত নেড়ে বেয়ারাকে ডাকল। আরেক বোতল বিয়ারের অর্ডার নিয়ে বেয়ারা চলে গেল।
‘আমি টেকনিকাল দিকটা ভাল বলতে পারব না, কিন্তু ইনভেস্টিগেট করতে গিয়ে জানতে পেরেছিলাম ব্রিজটা বানানো খুব সহজ কাজ ছিল না। বিশেষ করে একটা জায়গায় ব্রিজটাকে বাঁক নিতে হবে। সেই জায়গাটায় ভারসাম্য রাখাটা ছিল বিশাল চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জটা সৈকত চৌধুরির খুব এক্সাইটিং মনে হয়েছিল। অন্তত গুপ্ত অ্যান্ড চৌধুরি সিভিল কন্সট্রাকশানস-এ সৈকতের সহযোগী ইঞ্জিনিয়াররা আমাকে এটাই বলেছিল। বলে রাখা দরকার, ন্যাশানাল হাইওয়ে অথরিটির সঙ্গে ডিলটা সই করেছিল সৈকত। তার পার্টনার মণিময় গুপ্ত পুরোটাই নেপথ্যে ছিল, যদিও টাকা-পয়সার হিসেব থেকে শুরু করে, কন্ট্রাক্টার নিয়োগ, তাদের বিল চেক করা, পেমেন্ট করা সবটাই ছিল মণিময়ের হাতে।’
আদিত্যর বিয়ার এসে গেছে। সঙ্গে দু’প্লেট কাবাব। বেয়ারা গ্লাসে বিয়ার ঢেলে দিতে যাচ্ছিল। আদিত্য তাকে ইঙ্গিতে জানাল দরকার নেই, তার পানীয় সে নিজেই ঢেলে নেবে।
‘পাঞ্চলাইন হল, তৈরি হবার কয়েকদিনের মধ্যেই ব্রিজটা ভেঙে পড়ে। সৌভাগ্যক্রমে, তখনও ব্রিজটা সাধারণ মানুষের যাতায়াতের জন্যে চালু হয়নি। হলে বড় রকমের অ্যাক্সিডেন্টের সম্ভাবনা ছিল। ঠিক হয়েছিল এক সপ্তাহ পরে কেন্দ্রিয় মন্ত্রী এসে ব্রিজটা উদ্বোধন করার পর ওটা চালু করা হবে। এক দিক থেকে ভাল যে তার আগেই দুর্ঘটনাটা ঘটে গেল। কিন্তু একটা দুর্ভাগ্যের দিকও ছিল। তখন শীতকাল, অজয় নদীতে জল নেই, শুধু বালি। বালির ওপর, সদ্যনির্মিত ব্রিজের নীচে, তাঁবু খাটিয়ে মিস্ত্রিরা পরিবার নিয়ে থাকছিল। ব্রিজটা মিস্ত্রিদের সেই অস্থায়ী থাকার জায়গাগুলোর ওপর ভেঙে পড়ল। ফলে আটজনের মৃত্যু হল, আর জনা কুড়ি আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হল। তাদের মধ্যেও তিনজন পরে মারা যায়। এগারজন নিহতর মধ্যে তিনজন মহিলা, দুজন শিশু।’
আদিত্য উত্তেজিত হয়ে সিগারেট ধরাতে চাইছিল। কিন্তু বার-রেস্টোরেন্টে আজকাল সিগারেট খেতে দেয় না। অগত্যা বিয়ারের গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে আদিত্য বলল, ‘তারপর?’
‘প্রথমে পুলিশ এবং পরে সিবিআই এটা নিয়ে বিস্তারিত তদন্ত করেছিল। আমি যতদূর জানি সিবিআই-এর তদন্ত এখনও শেষ হয়নি, তবে সাময়িকভাবে বন্ধ আছে। যাইহোক, তদন্তে এটা প্রমাণিত হয়েছিল যে ব্রিজটার ডিজাইনে বিন্দুমাত্র ত্রুটি ছিল না, উল্টে তদন্তকারি ইঞ্জিনিয়াররা সকলেই ব্রিজটার প্রভূত প্রশংসা করেছিল। কিন্তু স্যাংশানড প্ল্যান অনুযায়ী ব্রিজটা তৈরি হয়নি। তাছাড়া যে মালমশলা দিয়ে ব্রিজটা বানানো হয়েছিল সেটাও ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের। বস্তত, তদন্তকারি অফিসাররা এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে নিম্নমানের মালমশলা দিয়ে ব্রিজ বানিয়ে গুপ্ত অ্যান্ড চৌধুরি সিভিল কন্সট্রাকশানস অসাধু উপায়ে একটা বিরাট টাকা উপার্জন করেছে। কোম্পানিটা তো ব্ল্যাক লিস্টেড হয়ে গেল। এবং যে কনট্রাকটার ব্রিজটা বানিয়েছিল, তার কোম্পানিও রেহাই পেল না।’
‘কন্ট্রাকটারের কোম্পানিটার নাম মনে আছে?’
‘হ্যাঁ, নামটা সম্ভবত দত্ত কনস্ট্রাকশানস।’
নামটা হজম করতে আদিত্যর একটু সময় লাগল। তার মুখ দেখে সায়ন্তন বলল, ‘কী ব্যাপার? তুই এদের চিনিস নাকি?’
‘কিছুটা চিনি। হুঁ, তারপর কী হল?’
‘আমাকে এই পুরো এপিসোডটা নিয়ে লেখার জন্যে বলা হল। আমি ইনভেস্টিগেট করে দেখলাম ঘটনার পুরো দায়টা সৈকত চৌধুরির ওপর চাপানো হচ্ছে, যেহেতু সমস্ত কাগজপত্রে শুধু তার সই রয়েছে। এমনকি কনট্রাকটারও আইনের ফাঁক দিয়ে গলে বেরিয়ে গেল, কিন্তু সৈকত বেরোতে পারল না। সিবিআই তার জীবন অতিষ্ট করে তুলল। তার পেশাদার সুনাম ভূলুণ্ঠিত হল। সব থেকে বড় কথা, যারা সৈকতকে চেনে তারা সকলেই বুঝতে পারছিল যে সৈকত আসল দোষী নয়, তাকে ফাঁসানো হয়েছে। এবং কনট্রাকটারের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে তাকে ফাঁসিয়েছে তার পার্টনার মণিময় গুপ্ত। কিন্তু কিছু করার ছিল না। সব প্রমাণ সৈকতের বিরুদ্ধে। আমি এই স্ক্যামটা নিয়ে লিখলাম। সৈকত যে আসল দোষী নয় সেটাও লিখলাম। কিন্তু আসল দোষীর নাম লিখতে পারলাম না, যেহেতু আমার কাছে কোনও প্রমাণ ছিল না।’
‘আপনি সৈকত চৌধুরির সঙ্গে দেখা করেছিলেন?’
‘একাধিকবার দেখা করেছিলাম। অনেকক্ষণ কথা বলেছিলাম। সৈকত ভীষণ ডিপ্রেসড থাকত। দেখুন, একটা ব্যাপার আমার ভীষণ পাজলিং লাগে। সৈকতের যা মানসিক অবস্থা ছিল তাতে সে যদি আত্মহত্যা করত, আমি অবাক হতাম না। কিন্তু সে নিজেই খুন হয়ে গেল। এটা কেন?’
‘এই মুহূর্তে জানি না। হয়ত শিগগির জানতে পারব’। আদিত্য অন্যমনস্কভাবে বলল। তারপর একটু থেকে বলল, ‘আপনি আমার অশেষ উপকার করলেন। আপনাকে আর একটা অনুরোধ করব। আপনার ওই লেখাটার একটা কপি আমাকে দিতে পারবেন?’
‘অবশ্যই পারব। আপনার মেল আইডিটা টেক্সট করে দিন, বাড়ি গিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনাকে একটা মিসড কল দিই?’
(৪)
‘তোমাদের হানিমুন কেমন কাটল?’ মালিনী কেয়াকে জিজ্ঞেস করল। সে আজকাল সুন্দর বাংলা বলে।
মালিনীর প্রশ্নে কেয়া ঈষৎ উত্তেজিত। বলল, ‘হানিমুন আবার কী? আদিত্য কাজে গিয়েছিল, আমি সঙ্গে গিয়েছিলাম। ওখানে গিয়ে বিরাট গণ্ডগোল হল। রিসর্টের মধ্যে দু-দুটো খুন। ফলে আদিত্য সারাদিন পুলিশের সঙ্গে ইন্টারোগেশনে ব্যস্ত। আমি ঘরের মধ্যে একা একা বোর হয়েছি। একে হানিমুন বলে?’
‘মন্দিরে গেছিলে?’
‘অনেক কষ্টে আদিত্য একদিন সময় করতে পেরেছিল। সেদিন একবার মন্দিরে গিয়েছিলাম।’
‘আর কোথাও যাওনি? কোনার্ক, চিলকা, উদয়গিরি?’
‘কোনারক আর চিলকা গিয়েছিলাম। কিন্তু আদিত্য সঙ্গে যেতে পারেনি। ওখানে গিয়ে একটা এলডারলি কাপল-এর সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল। তাদের সঙ্গে গিয়েছিলাম।’
‘কেয়ার কথায় মনে পড়ে গেল।’ আদিত্য গৌতমের দিকে তাকিয়ে বলল। ‘তোদের আর্কাইভে নিশ্চয় পুরোনো নকশালদের ফাইলগুলো আছে। তাদের দুজনের সম্বন্ধে জানতে পারলে ভাল হত। একটু জেনে দিতে পারবি? একজনের নাম প্রদীপ চক্রবর্তী। সিক্সটিজে প্রেসিডেন্সি কলেজে ফিজিক্স পড়তেন। অন্যজন রাখি চক্রবর্তী, প্রদীপের স্ত্রী, ক্লাসমেট এবং কমরেড। এদের দুজনের সঙ্গেই কেয়া কোনারক আর চিলকা গিয়েছিল।’
‘প্রদীপদা, রাখিদিকে নিয়ে পড়লে কেন? ওরা তো ওদের অতীত নিয়ে কোনও কথাই বলে না। তোমার কীসের দরকার?’ কেয়া ঝাঁজিয়ে উঠল।
‘ওই নিছক কৌতূহল। তুমি তো জান, নকশাল আন্দোলন নিয়ে আমার একটা ইন্টারেস্ট আছে। আমার জন্মের আগেই আন্দোলন খতম হয়ে গেছে। রক্তমাংসের কোনও নকশাল নেতাকে এত কাছ থেকে আগে দেখিনি। তাই কৌতূহল আর কী।’ আদিত্য খানিকটা মিনমিনে গলায় বলল।
‘তোর কি সিরিয়াসলি ওই দুজনের ফাইলটা দরকার নাকি ক্যাজুয়ালি বলছিস? আর তুই ঠিক জানিস তো ওদের নামে ফাইল আছে?’ গৌতম সন্দেহের গলায় বলল।
‘না, না। সত্যিই দরকার। আমি একদিন ফোন করে তোর অফিসে চলে যাব। গিয়ে দেখে আসব। আর ফাইল মনে হয় ওদের নামে আছে, কারণ দু’জনেই এক সময় জেলে ছিল।’
‘হুঁ। তাহলে তো ফাইল থাকবে।’
মালিনী আর গৌতম আদিত্যদের বাইরে খাওয়াতে এনেছে। বালিগঞ্জ সারকুলার রোডে একটা নতুন গোয়ান রেস্টোরান্ট হয়েছে, সেখানে। আদিত্য শুনেছিল, এখানে একেবারে অথেন্টিক গোয়ান ক্যাথলিকদের কুইজিন পাওয়া যায়। সাবেকি পর্তুগিজ রান্নার সঙ্গে পশ্চিম উপকূলের কঙ্কন রান্নার মিশেল। গৌতমরা আগে দুবার খেয়েছে, আদিত্য আর কেয়া এই প্রথম। এই মুহূর্তে ক্ষুধা-উদ্রেককারি দুটি পদ টেবিলে শোভা পাচ্ছে—ক্রকেট এবং চোরিজো। প্রথমটি দেলখোশ কেবিনের মটন চপের মতো দেখতে, তবে খেতে অন্যরকম। গোয়ান ক্যাথলিকরা এটির ভেতরে মিন্সড বিফ বা কুচোনো গোমাংস ব্যবহার করে। কিন্তু হিন্দুবাদীদের বৈরিতার ভয়ে এই রেস্টোরান্ট গোমাংসের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। ফলে তাদের মিন্সড বিফের বদলে মিন্সড ল্যাম দিয়ে পদটি বানাতে হয়েছে। দ্বিতীয় পদটি গোয়ান কায়দায় প্রস্তুত পোর্ক সসেজ।
‘মেন ডিশ অর্ডার দেবার সময় ভিণ্ডালু এবং সাবেকি গোয়ান ফিশ কারি অর্ডার দিতেই হবে। আমরা আগে খেয়েছি। দুটোই অসাম।’ মালিনী একটা ক্রকেট নিজের প্লেটে তুলতে তুলতে বলল।
‘এরা ফিশ কারিতে নিশ্চয় তেঁতুল এবং নারকোল দেয়?’ কেয়া মালিনীকে জিজ্ঞেস করল।
‘সে তো অবশ্যই দেয়। কিন্তু তা ছাড়াও নানারকমের স্পাইস দেয়। দুর্দান্ত টেস্ট।’
‘ভিণ্ডালুতে কিন্তু আলু নেই। এরা পোর্ক দিয়ে ভিণ্ডালু করে।’ গৌতম তার বিদ্যে জাহির করে বলল। ‘আর সেটাই করার কথা। পর্তুগিজ ভাষায় ভিনিয়া কথাটার অর্থ ওয়াইন, ডি মানে অফ এবং আলু মানে গারলিক অর্থাৎ রসুন। সব মিলিয়ে, ভিণ্ডালু। অর্থাৎ ওয়াইন এবং রসুনে ম্যারিনেট করা মাংস।’ কথাটা বলে একটা ‘কেমন দিলুম’ ভাব নিয়ে গৌতম সবার মুখের দিকে তাকাল।
সবাই অবাক। বিশেষ করে মালিনী। ‘ডিড ইউ সারেপটিশাসলি স্টার্ট লার্নিং পোর্টুগিজ?’ বিস্ময়ে তার মুখ দিয়ে ইংরেজি বেরিয়ে গেছে।
গৌতম এবার হেসে ফেলেছে। ‘তোমাদের ইমপ্রেস করব বলে আজ সকালে ইন্টারনেটে ভিণ্ডালুর মানেটা দেখে এসেছি। জানতাম ওটা অর্ডার দেওয়া হবেই।’ গৌতম তার বউ-এর দিকে তাকিয়ে বলল।
ঘণ্টা দেড়েক পরে যখন মেন ডিশ খাওয়া হয়ে গেছে, ডেসার্ট আসব আসব করছে, তখন আদিত্য গৌতমকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই একটু খোঁজ নিয়ে তিনজনের কনফিডেনশিয়াল রিপোর্ট সম্বন্ধে আমাকে একটু জানাতে পারবি? তিনজনই কলকাতা পুলিশের। একজনের নাম অচিন্ত্য সাহা, গড়িয়াহাট থানায় ইন্সপেক্টর, ইনি সৈকত চৌধুরির কেসটার চার্জে আছেন। দ্বিতীয় জনের নাম সুভদ্র মাজি, ইনি বালিগঞ্জ থানার ইন্সপেক্টর, অসীম দত্তর ওপর প্রথম যে অ্যাটেম্পটটা হয়েছিল, সেটা ইনভেস্টিগেট করছেন। এদিক থেকে অসীম দত্ত এবং অনির্বাণ দত্তের খুনগুলোও। আর তৃতীয় জন বিপ্লব সমাদ্দার। গহিয়াহাট থানা থেকে রিটায়ার করেছেন। রিটায়ার করে একটা বিদেশি ইনশিয়োরেন্স কম্পানিতে চাকরি করেন। কেন এদের সম্বন্ধে জানতে চাইছি, তোকে পরে বিস্তারিত বলব।’
‘নামগুলো আমার মনে থাকবে না। তুই হোয়াটস অ্যাপ করে দিস।’
আদিত্য লালবাজারে গৌতমের ঘরে বসে পুরোনো ফাইল থেকে নোট নিচ্ছিল।
প্রদীপ চক্রবর্তী— দমদম সেন্ট্রাল জেলে বিচারাধীন (১৯৭১-৭৭) নক্সাল নেতা। এর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল মূলত চারটে। (১) ১৯৭০ সালের জুন মাসে প্রেসিডেন্সি কলেজের ফিজিক্স এবং কেমিস্ট্রি ল্যাবোরেটারি ভাঙচুর করা। (২) ১৯৭০ সালের অক্টোবর মাসে বিরুদ্ধ দল সিপিএম-এর এক কর্মিকে (নাম সন্দীপন মাইতি) গুলি করে খুন। (৩) ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে এক ইন্সপেক্টার (নাম সমর সরকার)-কে চার-পাঁচজন মিলে খুন করে তার বন্দুক ছিনতাই করেছিল। দলনেতা প্রদীপ চক্রবর্তী। (৪) ১৯৭১ সালের মে মাসে পুরুলিয়ায় তিনজন জোতদার খুনের সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে বরাহনগরের হাইড-আউট থেকে গ্রেপ্তার। ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বর মাসে সরকারের বন্দিমুক্তি নীতির ফলে জেল থেকে মুক্ত এবং অভিযোগ থেকে অব্যাহতি। পরবর্তীকালে নক্সালদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছে কিনা জানা নেই।
রাখি চক্রবর্তী— আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বিচারাধীন (১৯৭১-৭২) নকশাল নেত্রী। অভিযোগ, ১৯৭০ সালের জুন মাসে প্রেসিডেন্সি কলেজের ফিজিক্স এবং কেমিস্ট্রি ল্যাবোরেটারি ভাঙচুর করা এবং নিষিদ্ধ বিপ্লবী কাগজপত্র, পুস্তিকা সঙ্গে রাখা ও বিলি করা। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে প্রদীপ চক্রবর্তীর সঙ্গে গ্রেপ্তার, ১৯৭২এর জুন মাসে জামিনে মুক্তি। পরে ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বর মাসে বন্দিমুক্তি নীতির ফলে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি। ১৯৭৯ সালে প্রদীপ চক্রবর্তীর সঙ্গে বিয়ে। পুলিশের ধারণা, রাখি চক্রবর্তী নকশালদের সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক রাখে না।
আদিত্য সোফায় বসে নোট নিচ্ছিল। গৌতম তার টেবিলে বসে ফাইল দেখছে। নোট নেওয়া শেষ করে আদিত্য বলল, ‘চা খাওয়াবি না?’
‘এই রে, চা-টা তো বলতেই ভুলে গেছি। আগে মনে করাবি তো।’ গৌতম বেল বাজিয়ে বেয়ারাকে ডাকল।
কিছুক্ষণ বাদে চা আসার পর গৌতমও সোফায় এসে বসেছে। আদিত্য চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, ‘তোদের চা-টা কিন্তু সত্যিই ভাল।’
‘লালবাজারের উল্টোদিকে একটা বিখ্যাত চা-পাতার দোকান আছে। তারা সাপ্লাই দেয়। পুলিশের বড় কর্তাদের ঠকাবার সাহস তাদের নেই।’ গৌতমও চায়ের কাপে চুমুক দিল।
হঠাৎ মনে পড়ে যাবার ভঙ্গি করে আদিত্য বলল, ‘তোকে সেই তিনজন পুলিশ অফিসারের সম্বন্ধে জানার জন্যে রিকোয়েস্ট করেছিলাম, মনে আছে? তাদের ইন্টারনাল রিপোর্টগুলো পাওয়া গেছে?’
‘গেছে, গেছে। আদিত্য মজুমদার হুকুম করলে সব পাওয়া যাবে। দাঁড়া, বলছি।’
গৌতম সোফা থেকে উঠে তার টেবিলে গিয়ে ডাঁই করা ফাইলের ভেতর থেকে খুঁজে খুঁজে একটা কাগজ বার করে আবার সোফায় এসে বসল।
‘মন দিয়ে শোন। প্রথমে অচিন্ত্য সাহা। অচিন্ত্য সাহার রেকর্ড এমনিতে ভালই ছিল, কিন্তু বছর দুয়েক আগে একটা করাপশান কেস-এ ওর নামটা জড়িয়ে গিয়ে দুধে একটু চোনা পড়ে গেছে। তবে শেষপর্যন্ত কিছুই প্রমাণিত হয়নি। অচিন্ত্য সাহা সসম্মানে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেয়ে গেছে। অতএব ও এখন ক্লিন।’
‘কী ধরনের করাপশান চার্জ?’
‘গড়িয়াহাটের মোড়ে ড্রাগ পেডলারদের একটা গ্যাং অপরেট করত। তারা গড়িয়াহাট থানার কাউকে কাউকে নিয়মিত হপ্তা দিত। অভিযোগ উঠেছিল, যারা টাকা পেত তাদের মধ্যে অচিন্ত্য সাহাও ছিল। গ্যাংটা বাস্টেড হবার পর কিন্তু টাকা পেত বলে যাদের নাম জানা গিয়েছিল তাদের মধ্যে অচিন্ত্য সাহার নাম ছিল না। ফলে অচিন্ত্য বেকসুর খালাস। অনেকেই মনে করে অচিন্ত্য সাহার কোনও শত্রু ইচ্ছে করে ড্রাগ পেডলারদের সঙ্গে ওর নামটা জড়িয়ে দিতে চেয়েছিল।’
‘অন্য দুজন?’
‘হ্যাঁ। পরের নাম বিপ্লব সমাদ্দার। এ একেবারে নাম-কাটা সেপাই। তবে অতি ধূর্ত। এর নামে বেশ কয়েকটা অ্যালিগেশন ছিল। কিন্তু কোনওটাই ঠিক মতো প্রমাণ করা যায়নি। বিপ্লব সমাদ্দার ভলান্টারি রিটায়ারমেন্ট নিয়ে এখন বেশি মাইনেতে প্রাইভেট কোম্পানির কাজ নিয়েছে।’
‘বাকি রইল সুভদ্র মাজি।’ আদিত্য মনে করিয়ে দিল। সে খুব মন দিয়ে শুনছে।
‘ঠিক। বাকি রইল সুভদ্র মাজি। সুভদ্র মাজির রেকর্ড যাকে বলে ইম্পিকেবল। অনায়াসে বলা যায়, সুভদ্র আমাদের ফোর্সের একটা অ্যাসেট। দুবার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। ওর অনেস্টি নিয়ে কোনও প্রশ্ন তো ওঠেই না, ওর এফিশিয়ান্সিও প্রশ্নাতীত। সংক্ষেপে এই হল তিনজন অফিসারের কনফিডেনশিয়াল রিপোর্ট।’ গৌতম চায়ের কাপে আরেকটা চুমুক দিল।
‘আর ওই বলেছিলাম না, সিবিআইতে যদি কাউকে চেনা বার করা যায়। সেটা কি সম্ভব হয়েছে?’ আদিত্য একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল।
‘ঠিক সম্ভব এখনও হয়নি, তবে আমাদের ব্যাচমেট একজনকে বার করতে পেরেছি যে এখন সিবিআইতে আছে। আমার সঙ্গে এক সময় ভালই খাতির ছিল। কিন্তু ওর ফোন নম্বরটা এখনও জোগাড় করতে পারিনি। চেষ্টাও ছাড়িনি। হয়তো তোর কাজটা হয়ে যাবে, কিন্তু সময় লাগবে।’ কথাটা শেষ করে গৌতম চায়ের তলানিটুকু গলায় ঢেলে দিল।