সৈকত রহস্য – ৮
অষ্টম পরিচ্ছেদ
(১)
মণিময় গুপ্তর বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করাটা দরকার হয়ে পড়েছে। কথা ছিল অচিন্ত্য সাহা ভদ্রমহিলার সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আদিত্যকে জানাবে। কিন্তু অচিন্ত্য সাহা অন্য কাজে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যে তাকে ধরাই যাচ্ছে না। ফোন করলে বলছে, এখন বড্ড চাপ যাচ্ছে। আর চার-পাঁচদিনের মধ্যে ফ্রি হয়ে গিয়ে ভদ্রমহিলাকে ফোন করবে।
কেয়া স্কুলে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছে। একটু আগে স্নানঘরে ঢুকে বেসুরো গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছিল। স্নান সেরে বেরিয়ে এখন আয়নায়। গানটা কিন্তু এখনও গুনগুন করে যাচ্ছে। আদিত্য রান্নাঘরে টিপিন বানাচ্ছে। চিকেন স্যান্ডউইচ। কাজের মাসি ব্রেকফাস্টের বাসন ধুচ্ছে।
সেদ্ধ করা চিকেনের টুকরো থেকে মাংস ছাড়াতে ছাড়াতে আদিত্য ভাবছিল মণিময় গুপ্তর বান্ধবীর ফোন নম্বরটা যদি পাওয়া যেত সে নিজেই একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টের চেষ্টা করতে পারত। মণিময় গুপ্তর বান্ধবীর ফোন নম্বরটা তার কাছে নেই বটে, কিন্তু শিবপদর নম্বরটা খুব সম্ভবত আছে। শিবপদকে ফোন করে নম্বরটা চেয়ে নিলেই তো হয়।
কেয়া স্কুলে বেরোবার আগে হলিউডের কায়দায় আদিত্যর গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে চলে গেল। আদিত্য অবাক। কেয়ার হলটা কী? প্রথমে বাথরুমে গুনগুন গান, তারপর এই হলিউডি কায়দায় টা টা। নিশ্চয় ফুর্তির কোনও কারণ ঘটেছে। কিন্তু কারণটা নিয়ে আদিত্য আপাতত মাথা ঘামাচ্ছে না। ওটা পরে নিজের থেকেই জানা যাবে। এই মুহূর্তে তার চিন্তা শিবপদ এবং মণিময়ের বান্ধবীর ফোন নম্বর নিয়ে।
আদিত্য তার মোবাইল থেকে শিবপদর নম্বরটা খুঁজে বার করে ডায়াল করল। ওদিক থেকে সাড়া পেয়ে সে বলল, ‘শিবপদ বলছ নাকি?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ, শিবপদ বলছি। আপনি কে বলছেন?’
‘আমি আদিত্য মজুমদার বলছি। সেদিন তোমার মালিকের বাগানবাড়িতে দারোগাবাবুকে নিয়ে তল্লাশি করলাম, মনে আছে?’
‘মনে আছে। আপনি তো সেই পেলেন ডেরেস পুলিশ। দারোগাবাবুর বড় কর্তা।’
আদিত্য আপত্তি করল না। শিবপদ তাকে অচিন্ত্য সাহার বস ভাবলে ক্ষতি কি? সে বলল, ‘শোনো, যে মেমসাহেব তোমার মালিকের কাছে আসত তার ফোন নাম্বারটা আমায় দিতে পারবে?’
‘পরে যেদিন দারোগাবাবু অনেক লোকজন নিয়ে এলেন, সেদিন তো নম্বরটা ওনাকে দিয়ে দিলুম। আমার কাছে তো নম্বরটা সেভ করা নেই।’
‘সেরেছে। তা হলে নম্বরটা পাব কী করে?’
‘কেন? দারোগাবাবুকে জিজ্ঞেস করলেই তো পেয়ে যাবেন।’
‘আরে, দারোগাবাবু যে নম্বরটা হারিয়ে ফেলেছেন। না হলে তোমার কাছে চাইতে যাব কেন?’
‘হারিয়ে ফেলেছেন? তা হলে কী হবে?’ শিবপদ খানিকটা থতমত খেয়ে গেছে। ‘আমার কিন্তু কোনও দোষ নেই বাবু।’
‘না, না। তোমার দোষ থাকতে যাবে কেন?’ আদিত্য শিবপদকে আশ্বস্ত করল। ‘নম্বরটা তোমার মোবাইলে নিশ্চয় এখনও আছে। আচ্ছা, তুমি এর মধ্যে কোনও দিন কলকাতায় আসছ?’
‘কলকাতায়? আজকেই তো যাচ্ছি। আজ শেয়ালদা কোর্টে আমার একটা মামলা ওঠার কথা। উকিলবাবু যেতে বলেছে।’
‘কখন আসবে?’
‘এই তো এবার বেরিয়ে ট্রেন ধরব।’
‘শোনো, আমি আধঘণ্টার মধ্যে শেয়ালদা পৌঁছে যাচ্ছি। তুমি সাউথ স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের সামনে আমার জন্যে অপেক্ষা করবে। বুঝলে? আর অবশ্যই তোমার মোবাইলটা সঙ্গে রাখবে। ওটার থেকে আমি ওই মেমসাহেবের ফোন নম্বরটা বার করে নেব। বুঝতে পেরেছ?’
‘বুঝতে পেরেছি, দাদাবাবু।’
আদিত্য চান না করেই, কোনও রকমে জামাপ্যান্ট বদলে বেরিয়ে পড়ল।
‘হালো?’যে মহিলা ফোনটা ধরেছেন তাঁর গলাটা রিনরিনে।
‘আমার নাম আদিত্য মজুমদার। আমাকে আপনি চিনবেন না। আমি মণিময় গুপ্তর খুনের ব্যাপারে আপনাকে ফোন করছি।’
ওপারে খানিকক্ষণ নীরবতা। তারপর মহিলা কণ্ঠ বলল, ‘আপনি কার কথা বলছেন বুঝতে পারছি না। ওই নামে আমি কাউকে চিনি না।’ ফোন কেটে গেল।
আদিত্য আবার ফোনটা লাগাল। মহিলা কণ্ঠ এবার ফোন তুলে বলল, ‘আপনি কেন আবোলতাবোল কথা বলে আমাকে বিরক্ত করছেন? বললাম তো ওই নামে আমি কাউকে চিনি না।’ আবার ফোনটা কেটে গেল।
আচ্ছা মুশকিলে পড়া গেছে! আদিত্য এবার মহিলার নম্বরে একটা লম্বা মেসেজ করল—ম্যাডাম, মণিময় গুপ্তর সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা প্রমাণ করা শক্ত হবে না। মণিময়ের লেক রোডের বাড়িতে আপনার হাতে লেখা একটা চিঠি এবং বেশ কিছু ইনটিমিডেটিং ফোটোগ্রাফ পাওয়া গেছে। মণিময়ের নরেন্দ্রপুরের বাড়ির কেয়ারটেকার সাক্ষী দেবে আপনার সেখানে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। আপনার নাম এবং ঠিকানা আপনার ফোন নম্বর থেকে বার করা পুলিশের এক মিনিটের কাজ। পুলিশ আপনাকে খুঁজে বার করার আগে আপনি আমার সঙ্গে এই নম্বরে যোগাযোগ করুন। আমি পুলিশ নই। আপনাকে সাহায্য করতে পারব।
মেসেজটা পাঠিয়ে আদিত্য অপেক্ষা করে রইল। এই মুহূর্তে তার আর কিছু করার নেই। টিপিনবাক্স থেকে নিজের তৈরি করা স্যান্ডউইচ খেতে খেতে জানলা দিয়ে বউবাজার স্ট্রিটের জনস্রোতের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া। কফির জল ফুটে গিয়েছিল। আদিত্য উঠে গিয়ে কফি বানাল। তারপর আবার জানলার ধারে এসে বসল। শীতের রোদ্দুর আর নেই। তার বদলে এক রাশ স্থবির, ধূসর মেঘ আকাশটা ঢেকে রেখেছে। উল্টো ফুটপাতে একটা চালু ঘুগনির দোকান আছে। এখন এই মধ্যাহ্নভোজনের সময় সেখানে খুব ভিড়। স্যন্ডউইচে একটা কামড় দিয়ে আদিত্যর মনে হল সে স্যান্ডউইচটা মন্দ বানায়নি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল আড়াইটে বাজে। কেয়াও হয়তো এখন লাঞ্চ করছে। জিজ্ঞেস করলে হত স্যান্ডউইচটা কেমন হয়েছে? সকালে কেয়া খুব খুশি-খুশি ছিল। কেয়াকে ফোন করবে? কে জানে হয়তো এখন ক্লাসে আছে। আদিত্য কেয়াকে একটা মেসেজ করল স্যান্ডউইচ কেমন লাগল? উত্তর এল কিছুক্ষণের মধ্যেই। এখন খাচ্ছি। দুরন্ত হয়েছে। একটা স্যান্ডউইচের দোকান দিতে পার। কেয়ার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে।
আদিত্য কেয়াকে প্রায় ফোন করতে যাচ্ছিল এমন সময় তার ফোনটা বেজে উঠল। সেই মহিলা নাকি? না বিমল।
‘বিমল বলছি স্যার।’
‘হ্যাঁ, সে তো দেখতেই পাচ্ছি। খবর কী?’
‘ওই ছেলেটা একটু সুস্থ হয়েছে। এখন জেনারেল বেডে দিয়েছে। অনিতা চৌধুরি রোজ দেখা করতে যায়। হাত ধরে বসে থাকে। আপনি একদিন গিয়ে কথা বলুন না।’
‘ঠিক আছে যাব। দেখি কবে সময় করতে পারি।’
‘একটু তাড়াতাড়ি আসবেন স্যার। না হলে হাসপাতাল থেকে ছুটি পেয়ে বাড়ি চলে যাবে।’
‘ঠিক আছে। তাড়াতাড়িই যাব। ওই লোক দুটোর কিছু খবর পেলে?’
‘হ্যাঁ স্যার, সেটাই বলতে যাচ্ছিলাম। যে দুজনের ওপর নজর রাখতে বললেন, তারা তো হরিহর আত্মা। রেসের মাঠ বলুন, নাইট ক্লাবের জুয়ার ঠেক বলুন, সব জায়গায় দুজন এক সঙ্গে যায়। আমার তো স্যার কাজের সুবিধে হয়ে গেল। আর কাউকে লাগছে না। দুজন এক সঙ্গে কুকর্ম করতে যায় বলে আমি একাই ওদের ওপর নজর রাখতে পারছি। কুকর্ম মানে জুয়া। এখন অব্দি এইটুকুই বুঝতে পেরেছি যে দুটোই রাম জুয়াড়ি। তবে মনে হয় লম্বাটা পালের গোদা।’
‘ঠিক আছে তুমি নজর রেখে যাও। আর কিছু বলবে?’
‘তেমন আর কিছু বলার নেই, শুধু আমার মেয়ের বিয়ের কথাটা ভুলবেন না স্যার। আপনাদের দুজনকেই কিন্তু আসতে হবে।’
‘মনে আছে। মনে আছে। এখন রাখছি। আমার একটা দরকারি ফোন আসতে পারে।’
মোবাইলটা কেটে দিয়ে আদিত্য হাপিত্যেস করে বসে আছে, এক ঘণ্টা হয়ে গেল, দরকারি ফোনটা এল না।
অপেক্ষা করতে করতে দুটো সিগারেট খাওয়া হয়ে গেল। আর একবার কফি। ভদ্রমহিলা সময় নিচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু আদিত্যর মনে হচ্ছে, ফোন তাঁকে করতেই হবে। গান শুনলে হত। আদিত্য ল্যাপটপে উলহাস কাসালকরের ললিতাগৌরি লাগাল। চমৎকার গাইছে। খানিকটা ললিত, বাকিটা বোধহয় গৌরি। ললিতের অংশটা তো চেনা, কিন্তু গৌরি রাগটা আদিত্য চেনে না। গৌরি রাগটা কি খানিকটা পূরবীর মতো? ললিতাগৌরির চলনটা জায়গায় জায়গায় পূরবীর মতো লাগছে। এইসব সময় বাবার কথা আদিত্যর খুব মনে পড়ে। বাবা থাকলে ঠিক বুঝিয়ে দিত। শুধু যে বুঝিয়ে দিত তাই নয়, আলমারি থেকে বিভিন্ন স্পুল নামিয়ে বিভিন্ন ঘরানার ওস্তাদদের ইন্টারপ্রেটেশন কেমন আলাদা হতে পারে সেটাও শুনিয়ে দিত।
ফোন বাজছে। ওই নম্বরটা। আদিত্য গান বন্ধ করে দিয়ে ফোনটা ধরল।
‘আপনার সঙ্গে দেখা করব। আপনি এখন কোথায় আছেন?’ মহিলা কণ্ঠ কোনও ভনিতা না করে বলল।
‘আমি আমার অফিসে আছি। আমার অফিসটা বউবাজার স্ট্রিটে। আপনি কি আমার অফিসে আসতে পারবেন?’
‘আপনার অফিসে কি আপনি ছাড়া আর কেউ আছেন? আমি একটু প্রাইভেসি চাইছি।’
‘আমার অফিসে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। প্রাইভেসি সম্বন্ধে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।’
‘তা হলে আপনার অফিসের ঠিকানা এবং ডিরেকশানটা দিন। আমি পৌঁছে যাচ্ছি।’ আদিত্য ভদ্রমহিলার গলায় একটা মরিয়া ভাব লক্ষ করল।
মিনিট চল্লিশ পরে দরজায় টোকা শুনে আদিত্য যাকে দরজা খুলে দিল তার ছবি আদিত্য আগেই মণিময় গুপ্তর লেক রোডের বাড়ির ড্রয়ারে দেখেছে। ঈষৎ চাপা রং, বয়েস চল্লিশ পেরিয়ে গেলেও শরীরের বাঁধুনি অটুট। পুরু ঠোঁট, আয়তচক্ষু, পীনোন্নত বুক। সব মিলিয়ে পুরুষকে কুপোকাত করার মতো সমস্ত মালমশলা শরীরে রয়েছে।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে ভদ্রমহিলা একটু হাঁপাচ্ছিলেন। আদিত্য ভদ্রতা করে একটা চেয়ার এগিয়ে দিল, যদিও তার কোনও দরকার ছিল না।
‘এক গ্লাস জল হবে?’ ভদ্রমহিলার গলায় বিন্দু বিন্দু ঘাম।
কিছুদিন আগে আদিত্য তার ঘরে একটা ওয়াটার পিউরিফায়ার বসিয়েছে। ভাগ্যিস বসিয়েছিল!
‘আপনার নামটা কিন্তু এখনও জানা হয়নি।’ আদিত্য নিজের চেয়ারে বসে বলল।
‘আমার নামটা জানা কি খুব দরকার?’
‘দেখুন পুলিশ আপনার নামটা ঠিকই জেনে যাবে। তাই আগেই জিজ্ঞেস করে নিচ্ছিলাম। অবশ্য মণিময়বাবুর ড্রয়ারে আপনার যে চিঠিটা পাওয়া গেছে তাতে আপনি মালা বলে সই করেছেন আমি দেখেছি। শুধু চিঠি কেন, কিছু ছবিও পেয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটা ফেয়ারলি ইনক্রিমিনেটিং।’
‘আমার ছবি পুলিশ পেয়ে গেছে?’ ভদ্রমহিলার মুখমণ্ডলে হঠাৎ অতিরিক্ত রক্ত-সঞ্চালন ঘটেছে। তবে, সেটা ভয়ে না লজ্জায় বলা শক্ত।’
‘দেখুন ম্যাডাম, আমরা এখানে একটা মার্ডার কেস নিয়ে কথা বলছি। কাগজে নিশ্চয় পড়েছেন মণিময় গুপ্ত তাঁর নরেন্দ্রপুরের বাগানবাড়িতে মাস দেড়-দুই আগে খুন হয়েছেন। কেউ তাঁকে খুন করে ওই বাগানবাড়িরই একটা পুকুরে ফেলে দিয়েছিল। ওই বাগানবাড়ির কথা খুব বেশি লোক জানত না। যে দুএকজন জানত আপনি তাদের একজন। তাছাড়া আপনার সঙ্গে মণিময়বাবুর যে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল সেটা তো পুলিশ জানতেই পেরেছে। আপনাকে কি পুলিশ ছেড়ে দেবে ম্যাডাম?’
‘আপনি বারবার পুলিশের কথা বলছেন। আবার এটাও বলছেন আপনি নিজে পুলিশ নন। আপনি কে?’ ভদ্রমহিলাকে খানিকটা আক্রমণাত্মক দেখাচ্ছে।
‘আমার নামটা তো আগেই বলেছি। আমি পেশায় একজন বেসরকারি গোয়েন্দা। তবে পুলিশের সঙ্গে আমার সখ্য আছে। কিছুদিন আগে একজন পুলিশ ইন্সপেক্টারকে সঙ্গে নিয়ে আমি মণিময় গুপ্তর খুনটা আবিষ্কার করেছিলাম। আপনার একটা চিঠি এবং বেশ কিছু ছবি সেই সময় বেরিয়ে পড়েছিল। তাই এই বিষয়ে আমার কিছু বিশেষ খবর জানা আছে।’
‘আপনারা হঠাৎ মণিময়ের নরেন্দ্রপুরের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলেন কেন?’
‘ও হ্যাঁ। আপনাকে সেটা বলা হয়নি। আমি যে একজন বেসরকারি গোয়েন্দা সেটা তো বললাম। আমি বেসরকারিভাবে মণিময় গুপ্তর পার্টনার সৈকত চৌধুরি খুনের কেসটা তদন্ত করছি। সৈকত খুনের সময় থেকেই মণিময়কে পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই ওকে খুঁজতে খুঁজতে প্রথমে লেক রোডের বাড়ি এবং পরে নরেন্দ্রপুরের বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। আমি তো আমার কথা আপনাকে বললাম। এবার আপনি আপনার কথা বলুন। প্রথমে আপনার নাম।’
‘আপনাকে আমার কথা বলে আমার লাভটা কী?’ ভদ্রমহিলা এখনও বেশ আক্রমণাত্মক।
আদিত্যর মনে হল এই মহিলা তার কাছ থেকে শুধু কথা বার করতে এসেছেন। নিজের কথা বলার ইচ্ছে ওঁর খুব একটা নেই। আদিত্যর হঠাৎ খুব রাগ হয়ে গেল। সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, আমার মনে হয় আই অ্যাম ওয়েস্টিং মাই টাইম, অ্যান্ড প্রব্যাবলি ইউ আর ওয়েস্টিং ইয়োরস।’
কথা বলতে বলতে আদিত্য দরজা অব্দি হেঁটে গিয়ে দরজাটা খুলে রুক্ষভাবে বলল, ‘আপনি আসুন। আপনার সঙ্গে কথা বলে নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই। তবে এটা আপনি জেনে রাখুন, দুএকদিনের মধ্যে পুলিশ নিয়ে আপনার বাড়িতে আমি যাব। আপনার কীর্তিকলাপ তখন আপনার পাড়ার লোকের অজানা থাকবে না।’
ভদ্রমহিলা চেয়ারে বসেই আছেন। আদিত্য আর একবার বলল, ‘এবার আপনি আসুন। আপনাকে অনুরোধ করছি, প্লিজ, আসুন।’
ভদ্রমহিলার ওঠার কোনও লক্ষণ নেই। হঠাৎ আদিত্য দেখল দুহাতে মুখ ডুবিয়ে তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। আদিত্য দরজাটা বন্ধ করে আবার নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল। সে ভাবল ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ কেঁদে হালকা হয়ে নিক।
‘আমার নাম ঊর্মিমালা মিত্র। আমার স্বামী শান্তনু মিত্র মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, বর্তমানে একটা মার্চেন্ট শিপ-এর ক্যাপ্টেন।’ মিনিট কয়েক পরে একটু ধাতস্থ হয়ে ভদ্রমহিলা বলতে শুরু করলেন। ‘আমার স্বামী বছরে দুমাসের বেশি দেশে থাকেন না, জাহাজে জাহাজে ঘুরে বেড়ান। আমার ছেলে,আমাদের একমাত্র সন্তান, নৈনিতালে একটা বোর্ডিং স্কুলে পড়ে। আমার খুব একা লাগত। খুব একা। যদিও শান্তনু আমার জন্যে একটা বুটিক কিনে দিয়েছিল। গড়িয়াহাট মোড়ের কাছে হিন্দুস্থান পার্কে আমার বুটিক। নাম শাওনি। ওটা আমার ডাকনাম। মেয়েদের শাড়ি, ঘাগরা, টপ, চুড়িদার, ছেলেদের পাজামা-পাঞ্জাবি সবই পাওয়া যায়। ওখানেই মণিময়ের সঙ্গে আমার আলাপ।’
আদিত্যর মনে হল সে কোথায় যেন বুটিকটার নাম শুনেছে। কফির জল হয়ে গেছে। সে উঠে গিয়ে দু’কাপ কফি করে নিয়ে এল।
ঊর্মিমালা তার কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল, ‘আমার স্বামী আমাকে জাহাজে নিয়ে ঘুরতে চাইত না। তার কারণ, প্রকৃত নাবিকের মতো তার বন্দরে বন্দরে একটি করে স্ত্রীলোক ছিল। আমিও আমার স্বামীর সঙ্গে জাহাজে ঘুরতে চাইতাম না। দিনের পর দিন চারদিকে জল দেখলে আমার পাগল পাগল লাগত। তাই আমার পক্ষে স্বামীর সঙ্গে ঘোরা সম্ভব ছিল না। ছেলেটাও সঙ্গে নেই। আমার স্বামীর ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে প্রথম শ্রেণির বোর্ডি স্কুলে পাঠানো হয়েছে। আমার কথার তো কোনও দাম নেই। ফলে নিদারুণ একাকিত্ব। এই সময় মণিময় গুপ্তর সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে।
‘এখন মনে হয়, না ঘটলেই ভাল ছিল। তখন কিন্তু তা মনে হয়নি। স্বীকার করছি, তিন বছর আমরা উদ্দাম প্রেম করেছিলাম। আমার ছেলের সিক্স, সেভেন, এইট, এই তিনটে ক্লাস। তারপর আমার আস্তে আস্তে ঘোর কাটতে শুরু করে। আমি মণিময়ের কবল থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিলাম। হাজার হলেও আমার তো একটা সংসার আছে। কিন্তু মণিময় আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিল। ভালবাসা দিয়ে নয়, ভয় দেখিয়ে। মণিময়ের কাছে আমার কয়েকটা ছবি ছিল। মণিময়ের সঙ্গে তোলা সেলফি। ওগুলো শান্তনুর হাতে পড়লে নির্ঘাত ও আমাকে ডিভোর্স করে দিত। ডিভোর্স করে দিলে অ্যালিমনিও আমি পেতাম না। ছবিগুলো হাতে পেলে শান্তনু নিশ্চয় আমার বিরুদ্ধে অ্যাডাল্ট্রি চার্জ আনত। অ্যাডাল্ট্রি চার্জ প্রমাণিত হলে অ্যালিমনি পাওয়া শক্ত।
‘এই রকম করে আরও দু’বছর চলল। শান্তনু যখন জাহাজে থাকে আমি এক-দেড় মাস মণিময়ের নরেন্দ্রপুরের বাগানবাড়িতে কাটিয়ে আসি। ছেলে হস্টেলে। পাড়া প্রতিবেশিকে বলি বুটিকের জন্য এথনিক জামাকাপড় কিনতে নানা জায়গায় ঘুরব। আমার বুটিকটা ভালই চলে। তাই আমার কথা লোকে বিশ্বাস করে নেয়।
‘এইভাবেই চলছিল। মাস দেড়েক আগে মণিময়ের বাড়িতে গিয়ে আমার কিছুদিন কাটিয়ে আসার কথা ছিল। গিয়ে দেখি মণিময় নেই। এরকম আগে কখনও হয়নি। মণিময়ের ফোনও বন্ধ। যোগাযোগের কোনও উপায়ই নেই। ওর লেক রোডের বাড়িতে যেতে মণিময় বারবার বারণ করেছিল। তাই সেখানে আর খোঁজ নিইনি। বাড়ি ফিরে এসে মাঝে মাঝে কেয়ারটেকারকে ফোন করতাম। ও বলত সাহেব এখনও ফেরেনি। তারপর গত সপ্তাহে দেখলাম নরেন্দ্রপুরের বাগানবাড়ির পুকুর থেকে মণিময়ের বডি উদ্ধার হয়েছে। প্রতি মুহূর্তে মনে হত এই বুঝি পুলিশ আমার বাড়িতে চলে আসবে। আজ আপনার ফোন এসে আমার আশঙ্কা সত্যি করে দিল। এই আমার গল্প। আমি কিন্তু কিচ্ছু লুকোইনি। আপনি এবার যা করার করুন।’
‘মণিময় গুপ্তর খোঁজ করার জন্যে পুলিশকে বেনামী চিঠিগুলো আপনারই লেখা, তাই না?’
‘হ্যাঁ, ওগুলো আমিই লিখেছিলাম। মণিময়ের জন্যে কিছুটা চিন্তা তো অবশ্যই হচ্ছিল।’
‘তার মানে মণিময় গুপ্তকে আপনি পুরোপুরি মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেননি।’
ঊর্মিমালা উত্তর দিল না, মাথা নিচু করে রইল।
আদিত্য খুব গভীরভাবে ভাবছিল। ভাবতে ভাবতে কখন সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছে খেয়াল করেনি। ঊর্মিমালা মিত্রর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে সিগারেট ধরানো উচিত ছিল।
‘আপনাকে আমি দুএকটা প্রশ্ন করব। খুব ভাল করে ভেবে উত্তর দেবেন।’ আদিত্য চিন্তান্বিত গলায় বলল। ‘মণিময় গুপ্তর নরেন্দ্রপুরের ওই বাগানবাড়িটার কথা কেয়ারটেকার শিবপদ এবং আপনি ছাড়া আর কেউ কি জানত?’
‘জানত।’ ঊর্মিমালা না ভাবেই উত্তর দিল। ‘ওই বাগানবাড়িটার কথা মণিময়ের পার্টনার সৈকত চৌধুরি জানত।’
‘কী করে বুঝলেন?’
‘এটা মাস ছয়েক আগের ঘটনা। নাকি মাস পাঁচেক হবে। আমি আর মণিময় তখন কিছুদিনের জন্যে নরেন্দ্রপুরে রয়েছি। একদিন সকালে ব্রেকফাস্ট খাচ্ছি, এমন সময় কলিং বেল। শিবপদ ছাড়া কলিং বেল আর কেউ বাজায় না, আর শিবপদ একটু আগেই বাজারের ফর্দ নিয়ে বাজার করতে গেছে, এত তাড়াতাড়ি তার ফেরার কথা নয়, তাই মণিময়ের কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা দিল। কী-হোল দিয়ে এক ঝলক তাকিয়েই মণিময় আমাকে বেডরুমে ঢুকে যেতে বলল। বলে দিল আমি যেন না বার হই। আমি বেডরুম থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম যে এসেছে তার সঙ্গে মণিময়ের প্রচণ্ড কথা কাটাকাটি হচ্ছে। প্রায় আধঘণ্টা পরে লোকটা চলে গেল। মণিময় ঘরে ঢুকতে আমি জিজ্ঞেস করলাম, লোকটা কে? মণিময় বলল, লোকটা ওর পার্টনার সৈকত চৌধুরি। আমি বললাম, লোকটা রাগারাগি করছিল কেন? মণিময় বলল, সৈকতকে কেউ ভুল বুঝিয়েছে যে আমি ওকে ঠকিয়েছি। আমি তো এখন ছুটিতে আছি। তাই ও আমাকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে চলে এসেছে। আমি ওকে অনেক করে বললাম, ওকে কেউ আমার ব্যাপারে ভুল বুঝিয়েছে। ও বুঝল কিনা জানি না। তারপর আর এ-নিয়ে মণিময়ের সঙ্গে আমার আর কোনও কথা হয়নি।’
‘আর একটা প্রশ্ন। আপনার কাছে কি নরেন্দ্রপুরের বাড়িতে ঢোকার চাবি থাকত?’
‘থাকত। একটা চাবি আমার কাছে থাকত। কখনও কখনও এমন হয়েছে যে আমি আগে ওখানে পৌঁছে ঘরবাড়ি গুছিয়ে রেখেছি, মণিময় কয়েক ঘণ্টা পরে এসে পৌঁছেচে।’
‘পরের প্রশ্ন। মণিময়ের ওয়ারিশ কে আপনি জানেন?’
প্রশ্নটা শুনে ঊর্মিমালা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘মণিময়ের নিকট আত্মীয় বলতে কেউ ছিল না। আমিই মণিময়ের একমাত্র ওয়ারিশ। মণিময় যে উইলটা করেছিল তার একটা কপি আমাকে দিয়েছিল। এর পরে আর কোনও উইল করেছিল বলে জানি না।’
‘এই ব্যাপারে কি মণিময়বাবুর উকিল আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে?’
‘এখনও করেনি।’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ঊর্মিমালা বলল, ‘আদিত্যবাবু, আমি মণিময়কে ঘৃণা করতাম, এটা ঠিক। কিন্তু, বিশ্বাস করুন, টাকার লোভে আমি মণিময়কে খুন করিনি।’ শেষ কথাগুলো বলতে গিয়ে ঊর্মিমালার গলা কান্নায় বুজে এল।
আদিত্য তাকে একটু স্বাভাবিক হতে সময় দিল। তারপর বলল, ‘আমার শেষ প্রশ্ন। আপনি কি জানতেন সৈকত চৌধুরি খুন হয়েছেন?’
‘কাগজে পড়েছিলাম। ঠিক কবে পড়েছিলাম, মনে নেই।’
‘আমার আর কিছু জিজ্ঞেস করার নেই।’ আদিত্য ঊর্মিমালার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল। ‘তবে আপনি খুব বিপদে পড়ে গেছেন ম্যাডাম। দুটো বিপদ। এক, মণিময়বাবুর সঙ্গে আপনার সম্পর্কের কথাটা আপনি আর লুকিয়ে রাখতে পারবেন না। ওটা এবার সবাই জেনে যাবে। আপনার স্বামী এটা জানতে পারলে কী হবে সেটা আপনিই ভাল বলতে পারবেন। এ-ব্যাপারে আমি আপনাকে কোনও সাহায্য করতে পারব না। দ্বিতীয় বিপদ, পুলিশ আপনার বিরুদ্ধে মণিময় গুপ্তর খুনের চার্জ আনতে পারে। সে ব্যাপারেও আমি কতটা কী করতে পারব জানি না। আমার মনে হয়, এখন আপনি চুপচাপ বসে থাকুন। আগে পুলিশ আপনার কাছে যাক। তখন দেখা যাবে কী করা যায়।’
ঊর্মিমালা মিত্র চলে যাবার পর আদিত্য অনেকক্ষণ বসে বসে চিন্তা করল। তার মনে হল, একটু একটু করে কিছু জট খুলে আসছে।
রাত্তিরবেলা খাবার টেবিলে বসে কেয়া বলল, ‘আজ দারুণ একটা ব্যাপার হয়েছে, জান?’
‘জানি না। তবে আজ দারুণ একটা ব্যাপার যে হতে চলেছে সেটা সকালে তোমার মুড দেখেই বুঝেছিলাম। ব্যাপারটা কী বলত?’ আদিত্য রুটি চিবোতে চিবোতে বলল।
‘ব্যাপারটা হল, সেদিন আমরা সেই মলে গিয়েছিলাম না? ওখানে আমার মানিব্যাগটা পড়ে গিয়েছিল। ওটার মধ্যে ছিল প্রায় ন’হাজার টাকা, ব্যাঙ্কের ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, প্যান কার্ড, আধার কার্ড সব কিছু। তোমাকে ভয়ে বলিনি। বললেই তো তুমি প্রচণ্ড ধমক দেবে।’ কেয়া ক্লাস ফোরের দোষ করা মেয়ের মতো মুখ করল।
‘ব্যাগটা হারিয়ে যাবার পরেও তুমি ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ডগুলো ক্যানসেল করলে না?’ আদিত্য আতঙ্কিত।
‘না গো। আমি তো নিজে নিজে ওসব করতে পারি না। সেই তোমাকেই করতে হত। তোমাকে বলতে খুব ভয় করছিল। ঠাকুরকে খুব ডাকলাম। আমার মন বলছিল, ঠাকুর ঠিক আমার কথা শুনবে।’
‘তারপর কী হল?’ আদিত্য গল্পের শেষটা জানতে চায়।
‘আজ ভোরবেলা, তুমি তখনও ওঠোনি, এক ভদ্রমহিলা ফোন করেছিলেন। বললেন, আমার ব্যাগটা উনি কুড়িয়ে পেয়েছেন। আমার ফোন নম্বরটা জানতেন না বলে ফোন করতে পারছিলেন না। তারপর দেখেন আধার কার্ডে আমার ফোন নম্বরটা রয়েছে। দুপুরে স্কুলে এসে উনি ব্যাগটা ফেরত দিয়ে গেছেন। এই পৃথিবীতে ভাল লোকও আছে গো।’ কেয়ার চোখে প্রায় জল এসে গেছে।
(২)
‘আমার কোনও উপায় নেই। ওপর থেকে নির্দেশ এসেছে। আমাকে সেই নির্দেশটা পালন করতেই হবে। উড়িষ্যা থেকে একটা টিম আসছে। আমাকে ওদের সঙ্গে থাকতে বলেছে। আমার ওপর নির্দেশ উড়িষ্যার টিমটার সঙ্গে সব রকম ভাবে সহযোগিতা করা। আমি সেটাই করছি। দীপশিখাকে ওরা এখান থেকে অ্যারেস্ট করে উড়িষ্যা নিয়ে যাবে। ওখানকার কোর্টে প্রোডিউস করবে। কারণ খুনগুলো ওখানেই হয়েছিল।’
সুভদ্র মাজি একটু থামল। আদিত্য বলল, ‘উড়িষ্যার পুলিশ কি দীপশিখার বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ পেয়েছে? মানে হাতের ছাপ, মার্ডার ওয়েপন বা ওই ধরনের কিছু যা দিয়ে ওকে ইমপ্লিকেট করা যাবে?’
‘আমি যতদূর জানি পায়নি। ওরা শুধু বলছে দীপশিখার খুব স্ট্রং একটা মোটিভ আছে। ভাল করে ইন্টারোগেট করলে হয়ত ওর মুখ দিয়ে বেফাঁস একটা-দুটো কথা বেরিয়ে যেতে পারে। তাই ওরা দীপশিখাকে ওদের কাস্টডিতে নিয়ে জেরা করতে চায়।’
‘শুধু মোটিভ দিয়ে তো হবে না। এভিডেন্স চাই। আমার মনে হয় ওরা দীপশিখাকে ধরে রাখতে পারবে না। দীপশিখা জামিন পেয়ে যাবে। দীপশিখা বলবে, ইন্টারোগেশনের জন্যে ও সব সময় অ্যাভেলেবল। ডাকলেই আসবে। তাহলে ওকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে কেন?’
‘সেখানেই মুশকিল হয়ে গেছে। আপনি যে কথাগুলো বললেন সেগুলো একজন ভাল উকিলের মুখ দিয়ে বলানো দরকার, যে কোর্টে দাঁড়িয়ে দীপশিখার হয়ে সওয়াল করতে পারে। কিন্তু একজন ভাল উকিলকে পয়সা দিয়ে দাঁড় করানোর মতো পয়সা তো দীপশিখাদের নেই।’
‘এটা আমার আনফেয়ার মনে হচ্ছে। আইন অনুযায়ী সকলেরই আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকা উচিত। উড়িষ্যার টিমটা কবে আসবে মনে হয়?’
‘সম্ভবত কালই ওরা এসে পড়বে।’
‘আমাকে বলে খুব ভাল করলেন। দেখি আমি কী করতে পারি। সময় তো একেবারেই নেই। যা করার আজই করতে হবে।’
আদিত্য ফোনটা কেটে দিয়ে তার পুরোনো বন্ধু ক্রিমিনাল লইয়ার সুনন্দ সরকারের নম্বরে কানেক্ট করল। সুনন্দর সঙ্গে মিনিট পনের কথা বলার পর সে দীপশিখাকে ফোনে ধরল। দীপশিখাকে সুনন্দর ফোন নম্বরটা জানিয়ে কিছু দরকারি নির্দেশ দেবার পর আদিত্য ঘড়ির দিকে তাকাল। বেলা এগারোটা বাজতে খুব বেশি দেরি নেই। এবার বেরোতে হবে।
আজ শনিবার। কেয়ার ইস্কুল ছুটি। কলঘরে কেয়া সময় নিয়ে চান করছে। বোধহয় শ্যাম্পুও করছে। শনিবারটা কেয়ার শ্যাম্পু করার দিন। কেয়া চান করে বেরোনো অবধি অপেক্ষা করতে হবে। ওকে না বলে বেরোনো যাবে না। আদিত্য কফির জল বসাল। কফি তৈরি করে সিগারেট ধরাল। ল্যাপটপে কিশোরী আমনকরের একটা পুরোনো নন্দ লাগাল, যদিও এখন নন্দ শোনার সময় নয়। কেয়া এখনও কলঘরে।
বাথরুম থেকে কেয়া বেরিয়েই আদিত্যকে বলল, ‘শোনো কথা আছে।’
আদিত্য কেয়ার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে কেয়া বলল, ‘একটু আগে রাখিদি ফোন করেছিল। প্রদীপদার সঙ্গেও কথা হল। তুমি অন্য ফোনে ছিলে বলে তোমাকে ডাকিনি।’
আদিত্য এখনও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে কেয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। কথাটা কী, কেয়া এখনও বলেনি।
কেয়া বলল, ‘রাখিদির অপরেশন। আজ বিকেলে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। এটাই জানাতে রাখিদি ফোন করেছিল। প্রদীপদা খুব নার্ভাস হয়ে গেছে। আমার মনে হয়, আমাদের একবার দেখা করে আসা উচিত। যাবে গো?’
‘নিশ্চয় যাব। আমি তো ওদের বাড়ির দিকেই যাচ্ছিলাম। অনিতা চৌধুরির সঙ্গে কিছু কথা ছিল। আমি অনিতার বাড়িতে বারোটা নাগাদ যাব বলেছি। তুমি আমার সঙ্গে চল। তুমি রাখিদিদের বাড়ি ঢুকে যাবে। আমি অনিতার সঙ্গে কথা সেরে রাখিদিদের ওখানে চলে যাব। তারপর একসঙ্গে দুজনে ফিরে আসব।’
‘সোজা বাড়ি ফিরব না। বাইরে লাঞ্চ খেয়ে ফিরব। তুমি আমাকে আজ বাইরে লাঞ্চ খাওয়াবে।’ কেয়া আদুরে গলায় বলল।
আদিত্যরা একটা উবার নিয়েছিল। শনিবার রাস্তায় ভিড় কম। হাওয়া আপিস বলেছে, হালকা দু এক পশলা বৃষ্টি হতে পারে। দশ-পনেরো বছর আগেও হাওয়া আপিসকে বিশ্বাস করা যেত না, আবার অবিশ্বাসও করা যেত না। আজকাল কিন্তু তাদের ভবিষ্যদবাণী প্রায়শই মিলে যাচ্ছে। আদিত্যদের উবার শেয়ালদা পেরোনোর আগেই বৃষ্টি নামল। উবার যখন ফ্লাইওভারের ওপরে ট্র্যাফিক লাইটে আটকে আছে, আদিত্য দেখল নীচে স্টেশন চত্বরে হাজার হাজার খোলা ছাতা। আর যাদের ছাতা নেই তারা মরিয়া হয়ে স্টেশনের দিকে দৌড়চ্ছে। একসঙ্গে অত ছাতা আদিত্য বোধহয় আগে কখনও দেখেনি। নবফাল্গুনের অকালবর্ষণ শব্দহীন অনর্গল শহরের ওপর ঝরে পড়ছে।
বালিগঞ্জ পৌঁছতে পৌঁছতে আরও মিনিট পঁয়ত্রিশ লেগে গেল।
‘দেখুন আপনাকে আমি বলতে গেলে বিনা পয়সায় সাহায্য করছি। আমার আরও অনেক কাজ আছে যেগুলো করলে আমার পেট ভরবে। সেগুলো না করে আমি আপনার কাজটা করছি। এখন আপনি যদি আমাকে সব কথা খুলে না বলেন তাহলে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারব না। আমি আপনাকে খোলাখুলি বলে দিলাম, কারণ এখন স্পষ্ট কথা বলার সময় এসেছে।’ আদিত্য কথাগুলো বলে সিগারেট ধরাল। সে এতটাই বিরক্ত যে সিগারেট ধরাবার আগে অনিতার অনুমতি নেবার কথাও ভুলে গেছে।
‘আমি আপনাকে আগেও তো বললাম, এখনও বলছি, আমি যা যা জানি, মানে যা কিছু সৈকতের খুন হবার ব্যাপারে রেলেভেন্ট, সবই আপনাকে বলেছি।’ অনিতা মৃদু স্বরে বলল।
‘ঠিক আছে। আমি আপনাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করছি। সমীর প্যাটেল বলে যে ছেলেটি নিয়মিত আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসে, যে এখন হাসপাতালে ভর্তি আছে, তার সঙ্গে আপনার কী শুধু বন্ধুত্বের সম্পর্ক নাকি তার বেশি কিছু?’
অনিতা মনে হয় এই ধরনের একটা প্রশ্ন আশঙ্কা করছিল। সে আক্রমণাত্মকভাবে বলল, ‘সমীরের সঙ্গে আমার যেরকম সম্পর্কই থাকুক না কেন সেটা আমার ব্যাক্তিগত ব্যাপার। এটা নিয়ে আমি আপনার বা অন্য কারও সঙ্গে আলোচনা করতে রাজি নই। তাছাড়া সমীর আর আমার বন্ধুত্বের সঙ্গে সৈকত খুন হওয়ার কোনও সম্বন্ধ আছে বলে আমি মনে করি না।’
‘আপনি কী মনে করেন, কী করেন না তা নিয়ে পুলিশের এবং ইনশিয়োরেন্স কোম্পানির বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা নেই। এই মুহূর্তে পুলিশ এবং ইনশিয়োরেন্স কোম্পানি আপনার এবং আপনার প্রেমিক সমীর প্যাটেলের বিরুদ্ধে জোরদার একটা কেস সাজিয়ে ফেলেছে। পুলিশ বলছে ইনশিয়োরেন্সের টাকার লোভে আপনি এবং আপনার প্রেমিক মিলে সৈকতকে খুন করেছেন। ইনশিয়োরেন্স কোম্পানিও তাই বলছে। এটা তো মানতেই হবে সৈকত চৌধুরির মৃত্যুতে সব থেকে বেশি লাভ আপনার। এর ওপর যদি দেখানো যায় সৈকত বেঁচে থাকতে থাকতেই আপনার একটা পরকীয়া প্রেম হয়েছিল তা হলে তো স্বামীকে খুন করার পেছনে আপনার মোটিভটা আরও জোরদার করে দেখানো যায়। সব মিলিয়ে ম্যাডাম আপনি আপাদমস্তক ফেঁসে গেছেন। আপনার বাঁচার একমাত্র উপায় আমাকে সব কথা খুলে বলা।’
অনিতা এখনও ভেবে যাচ্ছে কী করবে। আদিত্য অসহিষু�ভাবে ঘড়ির দিকে তাকাল। এখান থেকে প্রদীপ চক্রবর্তীদের বাড়ি যেতে হবে। তারপর বাড়ি ফেরার পথে কোথাও গিয়ে লাঞ্চ। দেরি হয়ে যাচ্ছে। সে বলল, ‘আমার হাতে অনন্তকাল সময় নেই ম্যাডাম। আপনার দোসর সমীর প্যাটেল একটু সুস্থ হলেই পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করবে। তার পর থার্ড ডিগ্রি করে তার কাছ থেকে কথা বার করতে পুলিশের বেশিক্ষণ লাগবে না। আমি চললাম, আর এটাও বলে যাই যে আজ থেকে আপনার কেসটার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক রইল না। আপনাকে বাঁচাবার কোনও দায়িত্বও আর আমার নেই।’
আদিত্য উঠে দাঁড়াল। সে দরজার দিকে হাঁটা শুরু করতে যাবে এমন সময় অনিতা কান্নাভেজা গলায় বলল, ‘আদিত্যবাবু আপনি প্লিজ যাবেন না। আপনি ছাড়া আর কেউ আমাদের বাঁচাতে পারবে না। আসলে সমীর বলেছিল তার সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথাটা কাউকে না বলতে। বললে নাকি ওটা আমাদেরই বিরুদ্ধে যাবে। তাই আমি আপনাকেও বলিনি।’
‘আশ্চর্য কথা। আপনি না বললে কেউ জানতে পারবে না? এই যে সমীর প্যাটেল সপ্তাহে তিন-চারবার করে আপনার বাড়িতে আসছে। আপনার সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে। এটা তো সবাই দেখতে পাচ্ছে। আপনাদের বাড়িতে ঢোকার সময় সিকিউরিটির কাছে তাকে নাম লেখাতে হচ্ছে। আপনাদের প্রতিবেশিনী তো একবার তার ছবি তুলে আপনার স্বামীকে পাঠিয়েছিলেন। তার মানে আপনার স্বামীও ব্যাপারটা জানতেন। তা, সকলেই যখন জানে তখন ব্যাপারটা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতে অসুবিধে কোথায়?’
অনিতা চুপ করে রইল। আদিত্যর মনে হল সকলে যে তার পরকীয়া প্রেমের ব্যাপারটা জানে এ-ব্যাপারে সে অবহিত। কিন্তু নিজের মুখে সেটা স্বীকার করতে তার সংকোচ হয়। অদ্ভুত মনস্তত্ত্ব। আদিত্যর মনে পড়ে গেল প্রথম যেদিন অনিতা তাদের বাড়ি এসেছিল সেদিন স্বামীর খুনের কথা বলতে বলতে কী আকুল হয়ে সে কাঁদছিল। সেটা কিন্তু অভিনয় বলে আদিত্যর মনে হয়নি। অথচ সেই একই মানুষ স্বামী বর্তমান থাকতেই পরকীয়া করত। অনিতার মনের ভিতরটা আদিত্য এখনও ঢুকতে পারেনি।
‘আপনি হয়তো ভাবছেন আমি ভীষণ খারাপ একটা মেয়ে, স্বামী থাকতেও যারা অন্য ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক করে তাদের তো সকলে খারাপ মেয়েই বলবে। আমি জানি না আমার ব্যাপারটা কেউ বুঝবে কিনা, কিংবা আমিই ঠিক মতো বুঝিয়ে বলতে পারব কিনা, তাই আপনাকেও ব্যাপারটা বলিনি। আপনি বিশ্বাস করুন, সত্যি কথা এটাই যে সৈকত নিজেই আমাকে আস্তে আস্তে সমীরের দিকে ঠেলে দিয়েছিল।’
আদিত্য আবার সোফায় বসে পড়েছে।
‘সৈকত চলে যাবার সাত-আট মাস আগে থেকে সৈকতের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ভাঙতে শুরু করে।’ অনিতা বলতে শুরু করেছে। ‘প্রথম দিকে কারণটা আমি কিছুই বুঝিনি। কিন্তু এইটুকু বুঝতে পারছিলাম সৈকত আমাকে অ্যাভয়েড করছে। তারপর একদিন খবরটা কাগজে বেরোল। ঝাড়খণ্ড-ওয়েস্ট বেঙ্গলের বর্ডারে সৈকতদের বানানো একটা ব্রিজ ভেঙে পড়েছে এবং ব্রিজ ভেঙে পড়ার ফলে বেশ কিছু লোকের মৃত্যু হয়েছে। যারা মারা গেছে তাদের মধ্যে কিছু মহিলা এবং শিশুও ছিল। আমি ভাবলাম, এটা নিয়েই নিশ্চয় সৈকত খুব পারটার্বড হয়ে আছে। তাই বাড়িতে ভাল করে কথা বলে না।’
‘আপনি তখন সৈকতকে কিছু জিজ্ঞেস করেননি?’
‘করেছিলাম। জিজ্ঞেস করতে সৈকত আরও ভয়ঙ্কর কথা বলল। সৈকত বলল, ওর পার্টনার মণিময় গুপ্ত এবং ওদের মূল কনট্রাকটার অসীম দত্ত, দুজনে ষড়যন্ত্র করে সমস্ত দোষ ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে। এটা সৈকতের কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে ওই দুজন মিলে খারাপ মেটিরিয়াল দিয়ে ব্রিজটা বানিয়েছিল বলে ব্রিজটা ভেঙে পড়েছে। প্রচুর টাকা প্রজেক্টটা থেকে সরিয়েছে ওরা। এটাই অবশ্য ওদের প্রথম চুরি নয়, সৈকতের সন্দেহ বেশ কিছুদিন ধরে ওরা এই কাজটা করছে। বলতে বলতে সৈকতের চোয়াল শক্ত হয়ে গিয়েছিল। বলেছিল ও ওই দুজনকে ছাড়বে না। এক্সপোজ করে দেবে।’
‘তারপর?’
‘তারপরের ঘটনা কিন্তু অন্যরকম। মণিময় এবং অসীম দত্ত এত আটঘাট বেঁধে চুরিটা করেছিল যে সৈকত ওদের ছুঁতেও পারল না। উল্টে সিবিআই সৈকতের পেছনে লাগল। কতভাবে যে সিবিআই ওকে হ্যারাস করেছে আমি বলে বোঝাতে পারব না। সৈকতের মতো প্রাণবন্ত, উদার, হাসিখুসি মানুষটা দেখতে দেখতে একটা জ্যান্ত মড়ায় পরিণত হল। দেখলে চেনাই যায় না।’
‘আপনি এইসব কথা প্রথম দিন বলেননি কেন?’
‘বলিনি কারণ আমার মনে হয়েছিল সৈকতের পেছনে সিবিআই লেগেছে বললে সৈকতের এগেন্সটে আপনি বায়াসড হয়ে যাবেন।’
‘কথাগুলো প্রথম দিন বলে দিলে আমার কাজের অনেক সুবিধে হত। যাগগে, যা হবার হয়ে গেছে। আপনি বলুন তারপর কী হল।’
‘এই সময় নাগাদ সমীর আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। সমীর আমার কলেজের বন্ধু, বহুদিন দেখাসাক্ষাৎ নেই, এতদিন পরে হঠাৎ ফোন করতে আমি একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমার অন্য বন্ধুরা বলে কলেজে পড়ার সময় আমার ওপর সমীরের একটা ক্রাশ ছিল। কিন্তু সে তো অনেকদিনের কথা। এতদিন পরে ফোন কেন?
‘আমি তখন একটা মারাত্মক ডিপ্রেশনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। সৈকত অনেক রাত্তির করে বাড়ি ফেরে। আমরা পরস্পরের সঙ্গে কোনও কথা না বলে নিঃশব্দে ডিনার খেয়ে শুয়ে পড়ি। মাঝরাতে মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে গেলে দেখি সৈকত জানলার ধারে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। ঘুমোবে না? জিজ্ঞেস করলে বলে তুমি শুয়ে পড়। বাড়িতে আর কেউ নেই যার সঙ্গে কথা বলতে পারি। বাপের বাড়ি বলতে কিছু নেই। একমাত্র যে ভাইএর সঙ্গে কথা বলতাম সেও অস্ট্রেলিয়ায়। এই অবস্থায় সমীর আমাকে একদিন ফোন করল। বলল, অনেক কষ্ট করে আমার ফোন নম্বর জোগাড় করেছে।
‘স্বীকার করছি, আমি ওকে ফিরিয়ে দিতে পারিনি। বরং একটু বেশি প্রশ্রয় দিয়ে ফেলেছিলাম। সত্যি বলতে কি, একজন কথা বলার মানুষ পেয়ে আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। জানতে পারলাম ও বিয়ে করেনি। ওদের পরিবারের একটা ইলেক্ট্রিকাল গুডস-এর দোকান আছে ও সেখানেই বসে। ইকনমিকালি খুব বেশি দাঁড়ায়নি। কিন্তু আমার তাতে কী?
‘প্রথম দিকে ও রোজ ফোন করত। তারপর বাড়িতে আসতে শুরু করল। দুপুরে যখন সৈকত বাড়ি থাকে না ও তখন আসত। ঘণ্টা দু তিন থাকত। মাঝে মাঝে আমরা এক সঙ্গে লাঞ্চ করতাম। টিভি দেখতাম। ওর সঙ্গে সময় কাটাতে আমার খুব ভাল লাগত। ওদিকে সৈকত আরও আরও ডিসট্যান্ট হয়ে যাচ্ছিল। আস্তে আস্তে আমাদের নেবাররা সমীরকে লক্ষ করতে শুরু করল। তার মধ্যে মলয়া বিশ্বাস, ওই অবনক্সাস মহিলা, সমীরের ছবি তুলে সৈকতকে হোয়াটসঅ্যাপ করে জানাল এই সব অসভ্যতা এই হাউসিং-এ চলবে না। যেন হাউসিং-এর সবার মরাল দায়িত্ব একা মলয়া বিশ্বাসকে কেউ দিয়ে রেখেছে।’
সৈকত ছবিগুলো পেয়ে কী বলল?’
‘ছবিগুলো এবং তার সঙ্গে ওই খারাপ মহিলার হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজটা পেয়ে সৈকতের যে রিঅ্যাকশানটা হল সেটাই আমার কাছে সব থেকে স্ট্রেঞ্জ এবং হার্টব্রেকিং। সৈকত যদি আমাকে গালি দিত, এমনকি দু একটা চড়-থাপ্পড়ও মারত, আমি অবাক হতাম না। মেনেও নিতাম। কারণ দোষটা তো আমার। কিন্তু তার বদলে সৈকত বলল, আমি জানি তোমার থেকে আমি অনেক দূরে সরে গেছি। সারাদিন তোমার সঙ্গে কথাই হয় না। যদি তুমি কোনও পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে খানিকটা সময় কাটিয়ে ভাল থাকতে পার, আমি খুশিই হব। তোমাকে আমি নেগলেক্ট করছি বলে আমার ভীষণ খারাপ লাগে। সেই খারাপ লাগাটা খানিকটা কম হবে যদি আমি জানি তুমি ভাল আছ।
সৈকতের কথাগুলো শুনে আমি কেঁদে ফেললাম। কারণ আমি বুঝতে পারলাম সৈকতের সঙ্গে আমার মেন্টাল সেপারেশনটা কমপ্লিট হয়ে গেছে। আমাকে কাঁদতে দেখে সৈকত কোনও সান্ত্বনা দিল না। কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। এর পরে আমার সঙ্গে সমীরের সম্পর্কটা আরও ক্লোজ হতে শুরু করে। অদ্ভুত ব্যাপার এটা নিয়ে সৈকতের কোনও বিটারনেস ছিল না। বরং মাঝে মাঝে আমাকে জিজ্ঞেস করত সমীর কেমন আছে? সে কি এসেছিল? আমি সৈকতকে বুঝতে পারতাম না।’
‘আপনি আমাকে প্রথম দিন একটা মিথ্যে কথা বলেছিলেন। আপনি বলেছিলেন, সৈকত যে অত টাকার ইনশিয়োরেন্স করেছে এটা আপনি জানতেন না। কিন্তু আমি পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি সৈকত আপনাকে ইনশিয়োরেন্স-এর কথাটা জানিয়েছিল।’
অনিতা চুপ করে রইল। তারপর নিচু গলায় বলল, ‘যে কারণে সেদিন সমীরের কথা আপনাকে বলিনি সেই একই কারণে ইনশিয়োরেন্স-এর ব্যাপারেও মিথ্যে বলেছিলাম। হ্যাঁ, সৈকত আমাকে ইনশিয়োরেন্স-এর ব্যাপারটা বলেছিল। কিন্তু আমি যদি বলতাম ইনশিয়োরেন্স-এর ব্যাপারটা আমার জানা ছিল, তা হলে আমার ওপর সন্দেহ পড়ত না কি?’
আদিত্য বলল, ‘সন্দেহ তো এখনও পড়ছে। মিথ্যে কথা বললে সন্দেহ বাড়বে বই কমবে না। যাক সে কথা। এবার বলুন সমীরকে মারল কারা?’
‘কারা মারল আমি জানি না। সমীরও কিছু বলতে পারছে না। এটা আমার কাছে একটা মিস্ট্রি।’
‘হুঁ।’ বলে আদিত্য কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবল। তারপর বলল, ‘আপনাকে আর একটা প্রশ্ন করব।’
আদিত্য পকেট থেকে তার মোবাইলটা বার করে হোয়াটসঅ্যাপে কিছু একটা খুঁজছে। যেটা খুঁজছিল সেটা একটা ছবি। একটা নয় গোটা চারেক। এই সেই ছবি যেগুলো বিমল রাস্তা থেকে তুলে আদিত্যকে পাঠিয়েছিল। সমীর প্যাটেলের সঙ্গে আর একজন।
আদিত্য ছবিগুলো অনিতাকে দেখাল। বলল, ‘রোগা ছেলেটা তো সমীর প্যাটেল। কিন্তু তার সঙ্গে যে রয়েছে তাকে কি আপনি চেনেন?’
ছবিগুলো দেখতে দেখতে অনিতার মুখের অভিব্যক্তি দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে ছবির অন্য লোকটিও তার চেনা। কিন্তু সমীর প্যাটেলের সঙ্গে এই লোকটিকে সে দেখবে ভাবেনি। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘কোথায় তোলা এই ছবিটা?’
‘দিন পনেরো আগে পার্ক স্ট্রিটের একটা বারের সামনে তোলা। দুজনে একসঙ্গে বার থেকে বেরোচ্ছিল।’
অনিতা আদিত্যর মোবাইলটা ফেরত দিয়ে দিল। তার হাতটাও কাঁপছে।
আদিত্য বলল, ‘আপনার রিঅ্যাকশান থেকে বুঝতে পারছি আপনি লোকটিকে চেনেন। লোকটির মুখের সঙ্গে আপনার মুখের আদল খানিকটা মেলে। লোকটি কি আপনার দাদা সঞ্জয়?’
অনিতা কথা বলতে পারছে না। অনেক পরে সে বলল, ‘হ্যাঁ, লোকটা আমার দাদা সঞ্জয়। কিন্তু সমীর আমার দাদার সঙ্গে কী করছে? আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। আমার খুব অসুস্থ লাগছে। একটু একা থাকতে চাই। ছবিগুলো আমাকে হোয়াটসঅ্যাপ করে দেবেন?’
অনিতার ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আদিত্য ভাবছিল, সেদিন প্রদীপ চক্রবর্তী যেভাবে অনিতা-সমীরের ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করল, অনিতা নিজে তার থেকে একেবারে আলাদা একটা ব্যাখ্যা দিচ্ছে। কে ঠিক বলছে? অবশ্য মিথ্যে কথা বলে আপাতদৃষ্টিতে প্রদীপ চক্রবর্তীর কোনও লাভ নেই, কিন্তু অনিতার আছে। তাহলে কি অনিতা মিথ্যে কথা বলছে? মিথ্যে বলুক বা সত্যি, এটা ঠিক যে সমীরের সঙ্গে তার দাদা সঞ্জয়ের যোগাযোগের কথা অনিতা জানত না। হয়তো আজ হাসপাতালে গিয়ে সমীরকে জিজ্ঞেস করবে।
‘বাবা, কী দেরি, কী দেরি! আমরা তো বলাবলি করছিলাম অনিতা তোমাকে লাঞ্চ খাইয়ে দিচ্ছে।’ কেয়া আদিত্যকে ঢুকতে দেখে বলল।
আদিত্য আর কী উত্তর দেবে? সে একটু বোকা বোকা হাসল। বসার ঘরে প্রদীপ আর রাখির সঙ্গে কেয়া গল্প করছে।
‘কখন ভর্তি হতে হবে?’ আদিত্য রাখি চক্রবর্তীর দিকে তাকিয়ে বসতে বসতে বলল।
‘আজ বিকেলে ভর্তি হব। কাল আর পরশু অবজারভেশনে রাখবে। মঙ্গলবার সকালে অপরেশন। তার মানে, আড়াই দিন হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে বোর হতে হবে। এটা নিয়ে যাচ্ছি।’ রাখি চক্রবর্তী সামনে টেবিলের ওপর রাখা একটা মোটা বইএর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে হাসলেন। আদিত্য দেখল শিবরাম চক্রবর্তীর গল্প সমগ্র।
‘চমৎকার, চমৎকার।’ কথাগুলো একেবারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আদিত্যর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। ‘অপরেশনের আগে শিবরাম চক্রবর্তীর থেকে ভাল সঙ্গী আর কিছু হতে পারে না।’ বইটা দেখে তার নিজেরই পড়তে ইচ্ছে করছিল।
‘রাখিদি তো খুশ মেজাজে আছে। কিন্তু প্রদীপদা ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়েছে।’ কেয়া সিরিয়াস গলায় বলল।
‘আরে না, না। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি ঠিক আছি।’ কথাগুলো যতই জোর দিয়ে বলুক প্রদীপ চক্রবর্তীর গলায় আত্মবিশ্বাসের অভাবটা পরিষ্কার।
‘আসলে প্রদীপদা-রাখিদিদের কেউ নেই। রাখিদিকে অপরেশন টেবিলে নিয়ে যাবার পর প্রদীপদা একেবারে একা পড়ে যাবে। অনিতা থাকতে পারবে না বলেছে। তাই আমি বলেছি অপরেশনের সময় আমি সঙ্গে থাকব। আমার তো স্কুল থেকে ছুটি নেওয়াই হয় না। সেদিন একটা ছুটি নিয়ে নেব না হয়। তুমি কি আমাদের সঙ্গে থাকতে পারবে?’
‘নিশ্চয় পারব, অবশ্যই থাকব।’ আদিত্য তাড়াতাড়ি বলল। সে অন্য কথা ভাবছিল। অনিতা তো এই বিপদের সময় প্রদীপ চক্রবর্তীর সঙ্গে থাকতেই পারত। সে থাকবে না কেন? কেয়ার মনটা সত্যিই খুব ভাল। প্রদীপ-রাখিকে সে কতটুকুই বা চেনে? আদিত্যর হঠাৎ নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হল।
আরও আধঘণ্টা পরে সে আর কেয়া যখন পার্ক স্ট্রিটে লাঞ্চ খাচ্ছে, অচিন্ত্য সাহার ফোন।
‘কাল সকালে কল্যাণী যেতে পারবেন স্যার? সৈকত চৌধুরির বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্যে? ওঁরা সকাল এগারোটায় একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছেন।’
‘নিশ্চয় যেতে পারব। আপনি আমাকে তুলে নেবেন?’
‘আপনাকে আপনার বাড়ি থেকে সাড়ে ন’টা নাগাদ তুলে নেব। শ্যামবাজার থেকে বি টি রোড ধরে ব্যারাকপুর। সেখান থেকে কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে ধরে নেব। টেনে চালালে ঘণ্টা দেড়েকে পৌঁছে যেতে পারব।’
‘খুব ভাল। তা হলে কাল দেখা হচ্ছে।’
(৩)
প্রত্যেক রবিবার আদিত্যদের গলি দিয়ে বেরিয়ে বড়রাস্তার ওপর একটা বড় বাজার বসে। শুধু শাকসবজি, মাছ-মাংসের কাঁচা বাজার নয়। হাওড়ার হাট থেকে আসে শাড়ি-জামা, প্যান্ট-শার্ট, লুঙ্গি-গেঞ্জি। বড়বাজার থেকে স্টেনলেস স্টিলের বাসনপত্র। তাছাড়া হাতা-খুন্তি, বঁটি-ছুরি, কাঠের বেলন-চাকি, প্লাস্টিকের মগ-বালতি-গামলা, কত কী যে আসে—দেখতে দেখতে আদিত্যর মনে পড়ে যায় খুব ছেলেবেলায় সে জহরদাদার কাঁধে চড়ে রথের মেলা দেখতে যেত। এখনও বাজার দেখতে আদিত্যর খুব ভাল লাগে। কত বিচিত্র মানুষ বেসাতি করতে আসে। যারা কিনতে আসে তারা বেশিরভাগই গরিব মানুষ, নইলে ফুটপাতের দোকান থেকে কিনবে কেন? আদিত্যরও মাঝে মাঝে এই রবিবারের বাজার থেকে এটা-ওটা কিনতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কেয়া কী বলবে ভেবে কেনে না। তবে জিনিস কেনার থেকে কেনাবেচা, লোকজনের যাওয়া-আসা দেখতেই আদিত্যর বেশি ভাল লাগে।
অচিন্ত্য সাহাকে আদিত্য বলে দিয়েছিল সে গলির মোড়ের উল্টোদিকের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকবে। কারণ, গলির ভিতর ঢুকলে বাজারের জ্যামে ফেঁসে যেতে পারে গাড়ি। সেই কথা অনুযায়ী, আদিত্য একটু আগে বেরিয়ে উল্টোদিকের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানুষের ভিড় দেখছিল।
অচিন্ত্য সাহার গাড়ি সময়ের আগেই এসে পড়েছে। সম্ভবত রবিবার রাস্তা ফাঁকা পেয়েছে বলে।
‘আমরা ভাবছি এবার অনিতা চৌধুরি এবং তার বন্ধুকে অ্যারেস্ট করে ফেলব। খবর কাগজগুলো এমন হয়েছে, পুলিশের অকর্মণ্যতার কথা ছাড়া আর তাদের কিছু লেখার নেই। সৈকত চৌধুরি মার্ডার কেসে এই অ্যারেস্ট দুটো হলে খবর কাগজওয়ালাদের মুখ কিছুটা বন্ধ হবে।’ গাড়ি চিঁড়িয়ার মোড় ছাড়িয়ে একটু ফাঁকা রাস্তায় পড়তে অচিন্ত্য সাহা বলল।
‘আপনি কি জানেন অনিতার বন্ধু সমীর প্যাটেলকে কারা সব মারধোর করে রাস্তায় ফেলে রেখে গেছিল? গুরুতর আহত হয়ে সমীর অনেকদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিল। এখন বোধহয় ছাড়া পাবার সময় হয়েছে।’
‘সমীর প্যাটেল হাসপাতালে ভর্তি? আমরা তো কিছুই জানি না। আপনি কী করে জানলেন? আমাকে বলেননি তো?’ অচিন্ত্য সাহাকে খানিকটা উত্তেজিত দেখাল।
‘দাঁড়ান, দাঁড়ান। এতগুলো প্রশ্ন এক সঙ্গে করলে আমার গুলিয়ে যাবে।’ আদিত্য অল্প হাসল। ‘আপনার প্রশ্নের একটা একটা করে উত্তর দেবার চেষ্টা করি। পাটুলি পেরিয়ে বাইপাসের ধারে যে নতুন হাসপাতালটা হয়েছে সমীর সেখানে ভর্তি আছে। আমার একজন ব্যক্তিগত ইনভেস্টিগেটার আছে, তার কাছ থেকে খবরটা জেনেছি। আপনারা জানেন না কারণ সমীর এখনও কোনও এফ আই আর করেনি। আর আপনাকে বলিনি কারণ আপনি জিজ্ঞেস করেননি।
‘বুঝতে পারলাম স্যার। কিন্তু আপনার কি মনে হয় না অনিতাকে এবার অ্যারেস্ট করা উচিত? ওর এগেন্সটে কেস তো আমরা ভালই সাজাতে পেরেছি। আর সত্যি কথা বলতে কি, অনিতা ছাড়া সৈকত চৌধুরিকে মারার মোটিভ কিন্তু আর কারও নেই।’
‘দেখুন আমার মনে হয়, অনিতার যেমন সৈকতকে খুন করার খুব স্ট্রং একটা মোটিভ আছে, তেমনি আবার কিছু কিছু প্রশ্ন আছে যেগুলোর সন্তোষজনক উত্তর না পাওয়া অবধি আপনি জোর দিয়ে বলতে পারবেন না অনিতা বা তার সহযোগীই খুনটা করেছে।’
‘কী রকম প্রশ্ন?’
‘প্রথম কথা হচ্ছে, মণিময়ের খুনের সঙ্গে যদি সৈকতের খুনের সম্পর্ক থাকে তাহলে প্রশ্ন উঠবে মণিময়কেও কি অনিতা খুন করেছে? করলে, কেন করেছে?’
‘আমার মনে হয়, মণিময়কে তার বান্ধবী ঊর্মিমালা মিত্র সম্পত্তির লোভে খুন করেছে। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি মণিময় তার সমস্ত সম্পত্তি ঊর্মিমালাকে দিয়ে গেছে। ঊর্মিমালা সেটা জানত। আপনাকে বলা হয়নি, কাল সন্ধেবেলা আমি ঊর্মিমালার সঙ্গে দেখা করেছিলাম। মণিময়ের সলিসিটারের সঙ্গেও ফোনে কথা হয়েছে।’
‘কিন্তু সৈকত আর মণিময়ের খুন দুটো যদি আলাদা আলাদা ঘটনা হয় তাহলে একই পিস্তলের বুলেট দিয়ে যে দুটো খুনই হয়েছে এটাকে আপনি কী করে ব্যাখ্যা করবেন?’
‘একই পিস্তল দিয়ে হয়েছে এটা বলা যাবে না। একই ধরনের পিস্তল দিয়ে হয়েছে, বড়জোর এইটুকু বলা যায়। কিন্তু একই ধরনের পিস্তল তো একাধিক থাকতেই পারে।’
‘অচিন্ত্যবাবু, আপনি জানেন কিনা জানি না, কিছুদিন আগে পুরীর কাছে একটা রিসর্টে রিসর্টের মালিক এবং তাঁর ছেলে খুন হয়েছেন। সৈকত বা মণিময় যে ধরনের পিস্তল দিয়ে খুন হয়েছে, বাবা এবং ছেলেও ওই একই ধরনের পিস্তল দিয়ে খুন হয়েছেন। রিসর্টের মালিক অসীম দত্ত, সৈকত এবং মণিময়ের ঘনিষ্ঠ একজন কনট্রাকটার। এর আগেও একবার অসীম দত্তকে খুন করার চেষ্টা হয়েছিল। ওই একই ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে। এগুলোকে কি আপনি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলবেন?’
‘আমি জানি না। সত্যিই কিছু বুঝতে পারছি না।’ অচিন্ত্য সাহাকে যুগপৎ বিভ্রান্ত এবং উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল।
‘আর একটা বড় প্রশ্ন। খুন হবার আগে সৈকত অত মোটা টাকার ইনশিয়োরেন্স করতে গেল কেন?’
‘স্যার, আমার মনে হয়, ওই ব্রিজ ভেঙে পড়ার কেলেঙ্কারিতে সৈকতের দুএকজন সঙ্গী ছিল। তারা ভয় পাচ্ছিল সৈকত সিবিআইকে তাদের নাম বলে দেবে। তারা সৈকতকে দুবার খুন করারও চেষ্টা করেছিল। সৈকত সেকথা তার পড়শি প্রদীপ চক্রবর্তীকে বলেছিল, উনি আমাকে সে কথা বলেছেন। তাই ভয় পেয়ে গিয়ে সৈকত জীবনবিমা করেছিল।’
‘তার মানে আপনি বলছেন, যাদের ভয়ে সৈকত জীবনবিমা করল তারা সৈকতকে খুন করল না, করল তার বউ। তাও ওই বিমার টাকাটার লোভে।’
‘আমার তো সেরকমই মনে হচ্ছে স্যার।’
‘কাদের ভয়ে সৈকত ইনশিয়োরেন্সটা করেছিল সেটা কি আপনি বার করতে পেরেছেন?’
‘না স্যার, এখনও পারিনি। তবে মনে হয়, পেরে যাব।’
‘এখানেই কিন্তু শেষ নয়। অনিতার বন্ধু সমীরকে কারা মারধোর করল? কেন করল? সেটাও তো বোঝা দরকার।’
অচিন্ত্য সাহা চুপ করে আছে। ভাবছে। একটু পরে সে বলল, ‘তাহলে কি আপনার মনে হয় এক্ষুনি অনিতাকে গ্রেপ্তার করাটা ঠিক হবে না?’
‘আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন আমি বলব, না ঠিক হবে না। এখন গ্রেপ্তার করলে অনিতা ঠিক ছাড়া পেয়ে যাবে আর বদনাম হবে পুলিশ ডিপার্টমেন্ট এবং আপনার। সেটা আপনার ভবিষ্যৎ কেরিয়ারের পক্ষেও ভাল হবে না।’
অচিন্ত্য সাহা গুম হয়ে বসে রইল। গাড়ি ডানলপ ব্রিজ পেরিয়ে গেছে।
ছোট একতলা বাড়ি। চারদিকে বাগান ঘিরে রয়েছে। দূর থেকে দেখেই আদিত্যর মনে পড়ে গেল গোপাল উড়ের পুরাতনী গান ‘ওই দেখা যায় বাড়ি আমার/ চারিদিকে মালঞ্চ বেড়া/ ভ্রমরেতে গুনগুন করে/ কোকিলেতে দিচ্ছে সাড়া’। এখানে অবশ্য ভ্রমর কিংবা কোকিল কাউকেই দেখা গেল না। তাদের পরিবর্তে গোটা সাত-আট কাক ছাদের কার্নিশে বসে মিটিং করছে। এটাই ৩৩ নম্বর বাড়ি। এখানেই সৈকতের বাবা অনুপ চৌধুরি এবং তাঁর সহধর্মিণী অঞ্জনা চৌধুরির বাস করার কথা।
গেট বন্ধ থাকলেও তালা দেওয়া নয়। গোরু-ছাগল ঢুকতে পারবে না। কিন্তু হাত দিয়ে গেটের আগল তুলে মানুষের ঢুকতে বাধা নেই। বাগানের ভিতর দিয়ে সরু বাঁধানো রাস্তা গেট থেকে বাড়ির সদর দরজা অব্দি পৌঁছেছে। অচিন্ত্য সাহা বেল বাজাতে এক ঘোর কৃষ্ণবর্ণ বলিষ্ঠ মহিলা দরজা খুললেন। তাঁকে এক ঝলক দেখেই আদিত্যর মনে হল ইনি নিশ্চয় অনুপ এবং অঞ্জনা চৌধুরির দেখাশোনা করেন। উর্দি পরা পুলিশ দেখে মহিলা ঈষৎ শঙ্কিত।
‘আমরা অনুপ চৌধুরির সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। উনি জানেন আমরা আসব। ওঁকে খবর দিন।’ অচিন্ত্য কেজো গলায় বলল।
‘আমি খবর দিচ্ছি। আপনারা ভিতরে আসুন।’
বসার ঘরটা দেখলেই বোঝা যাবে অধ্যাপকের বাড়ি। দুদিকের দেয়াল জুড়ে সিলিং অবধি বইএর র্যাক উঠে গেছে। ডিভানের ওপরেও উপুড়-চুপুড় বই। আদিত্য বসে বসে বইগুলো দেখছিল। প্রায় সবই সাহিত্যের বই। ইংরেজি সাহিত্য, ইউরোপের সাহিত্য, বাংলা সাহিত্য। ইনি সাহিত্যের অধ্যাপক না হয়ে যান না। আদিত্য ডিভানের ওপর জায়গা করে নিয়ে বসেছে। অচিন্ত্য বেতের চেয়ারে। অন্য একটা বেতের চেয়ার খালি রইল। অনুপ চৌধুরি এলে বসবেন। আর দুটো চেয়ারে স্তূপীকৃত বই রাখা, সেগুলোতে বসা সম্ভব নয়।
অনুপ চৌধুরি এসে চেয়ারেই বসলেন। দীর্ঘকায়, শীর্ণ, গাল বসে গিয়ে হনু দুটো উঁচু দেখাচ্ছে। বয়েস আশি-পঁচাশি পেরিয়ে গেলে এরকম হয়। কিন্তু একটু খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যাবে অনুপ চৌধুরির ততটা বয়েস হয়নি। সম্ভবত পঁচাত্তরের বেশি হবে না। আদিত্য আন্দাজ করল, ছেলের মৃত্যু অনুপ চৌধুরির চেহারার ওপর পাকাপাকি ছাপ ফেলে গেছে।
‘আপনাকে বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আপনার বেশি সময় নেব না।’ অচিন্ত্য সাহা বিনীতভাবে শুরু করল। ‘আমি ইন্সপেক্টার অচিন্ত্য সাহা, সৈকত চৌধুরির কেসটার চার্জের আছি। আমিই আপনাকে ফোন করেছিলাম। আর ইনি আদিত্য মজুমদার, প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর, এই কেসটাতে পুলিশকে সাহায্য করছেন।’
‘আমি ভেবেছিলাম আপনারা আরও আগে আসবেন। যাই হোক, বেটার লেট দ্যান নেভার।’ অনুপ চৌধুরি থেমে থেমে কথা বলেন।
‘আপনার বাগানটা কিন্তু চমৎকার। আপনি নিজেই কি ওটার পরিচর্যা করেন?’ আদিত্য প্রসঙ্গ পাল্টে বলল।
‘করতাম। সৈকত চলে যাবার আগে অব্দি। এখন আর শরীরে শক্তি পাই না। ইচ্ছেটাও চলে গেছে। একটা মালি আছে। সে-ই বাগানটা দেখাশোনা করে।’ অনুপ চৌধুরি চুপ করে গেলেন। হয়তো নীরব হয়ে গিয়ে বলতে চাইলেন এই বৃদ্ধ বয়সে পুত্রশোক পেলে শরীর, মন সবই বিকল হয়ে যায়।
‘আপনি তো এখানকার ইউনিভার্সিটিতেই পড়াতেন। সাহিত্য পড়াতেন, মনে হয়। এত সাহিত্যের বই আপনার ঘরে।’ আদিত্য আবার অন্য প্রসঙ্গে যাবার চেষ্টা করল।’
‘ইংরেজি সাহিত্য পড়াতাম। যখন পড়াতাম তখন কিন্তু এখানে থাকতাম না। ছেলেমেয়ের ইস্কুল-কলেজের জন্যে কলকাতায় থাকতে হত। জমিটা অবশ্য কেনাই ছিল।’
‘তারপর ছেলেমেয়ে বড় হয়ে যেতে এখানে চলে এলেন?’
‘ছেলে বড় হয়ে গেল। মেয়ের বিদেশে বিয়ে হয়ে গেল। আমার কলকাতায় থাকতে কোনও দিনই ভাল লাগত না। দেখলাম থাকার আর দরকারও নেই। তখন এই বাড়িটা করলাম। খুব শান্তিতে ছিলাম এখানে। হঠাৎ কী যে হয়ে গেল!’ অনুপ চৌধুরির কথাগুলো কেঁপে কেঁপে গেল।
‘আপনার ছেলের কি কোনও শত্রু থাকতে পারে? মানে, আমরা বোঝার চেষ্টা করছি সৈকত চৌধুরিকে কে খুন করতে পারে।’ অচিন্ত্য সরাসরি জিজ্ঞেস করল।
‘আমার ছেলেকে কে খুন করতে পারে আমার জানা নেই। তবে সৈকতের শত্রু থাকতে পারে না একথা বলব না।’
‘কেন এরকম বলছেন?’ অচিন্ত্য ব্যগ্র হয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘দেখুন, ছোটবেলা থেকেই সৈকত খুব মারকুটে ছিল। ওর নামে মাঝে মাঝেই নালিশ আসত। আর ওর গায়ে ছিল অস্বাভাবিক একটা শক্তি। তিন-চারজনের সঙ্গে এক সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা ওর ছিল। আমি মাস্টার মানুষ। বুঝতে পারতাম না ওর মধ্যে এত শক্তি, সাহস এবং অ্যাগ্রেশন এল কী করে!’
‘মাফ করবেন, আপনি কি বলতে চাইছেন, সৈকত মাস্তানি করে বেড়াত?’ অচিন্ত্য সাহা বেশ বিভ্রান্ত।
‘না, না। একেবারেই নয়। ঠিক তার উল্টো। সৈকতের স্বভাবটা অত্যন্ত মধুর ছিল। কিন্তু সে অন্যায় একেবারে সহ্য করতে পারত না। বিশেষ করে ইংরেজিতে যাদের বুলি বলে, অর্থাৎ বাংলায় যাদের বলে শক্তের ভক্ত নরমের যম, সৈকত সেই রকম মানুষদের ছোটবেলা থেকেই অপছন্দ করত। একটা ঘটনা বললে বুঝতে পারবেন।
‘একবার, সৈকত তখন ক্লাস নাইনে পড়ে, ওদের ইস্কুলে বারো ক্লাসের দুতিনটে বকাটে ছোঁড়া ছোট ক্লাসের একটা বাচ্চার ওপর নানা রকম অত্যাচার করে মজা পাচ্ছিল। টিফিনের সময় ঘটছিল ব্যাপারটা। অনেকক্ষণ ধরেই ব্যাপারটা সৈকত লক্ষ করছিল। শেষে ও ছেলেগুলোকে ব্যাপারটা থামাতে বলল। তাতে ছেলেগুলো যেন আরও মজা পেয়ে গেল। তারা এবার বাচ্চাটাকে ছেড়ে সৈকতকে নিয়ে পড়ল। বোধহয় সৈকতকে ফিজিকালি অ্যাসল্টও করেছিল। এতদিন পরে ডিটেলটা আমার মনে নেই, শুধু এইটুকু মনে আছে, যে মিশনারি স্কুলে সৈকত পড়ত তার ফাদার প্রিফেক্ট পরের দিন আমাকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, ক্লাস টুএলভের তিনটে ছেলেকে সৈকত এত মেরেছে যে তাদের তিনজনকেই স্কুলের ইনফারমারিতে নিয়ে গিয়ে রীতিমতো ফার্স্ট এড দিতে হয়েছে। সৈকতকে ক্ষমা চাইতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তার একটাই কথা। সে কোনও অন্যায় করেনি তাই সে ক্ষমা চাইতে পারবে না। ফলে তাকে ফাদারের হাতে প্রচণ্ড মার খেতে হয়েছে। সব মার সে মুখ বুজে হজম করেছে, কিন্তু ক্ষমা চায়নি।’
‘ফাদার ওই বদ ছেলেগুলোকে ভালই চিনতেন। আর এটাও জানতেন যে সৈকত ছেলে খারাপ নয়। মন দিয়ে লেখাপড়া করে। খেলাধুলোতেও বেশ ভাল। তাই ব্যাপারটা আর বেশি দূর গড়ায়নি। কিন্তু আর একটা জিনিস এই ঘটনা থেকে বোঝা যাবে। সেটা হল সৈকতের অসম্ভব সহ্যশক্তি।
‘বুঝতে পারছি। আপনি বলছেন, এমন লোকের শত্রু তো থাকতেই পারে।’ অচিন্ত্য সাহা ব্যাপারটা পরিষ্কার করে নিতে চায়।
আদিত্য খুব মন দিয়ে শুনছিল। সে এবার বলল, ‘তাহলে সৈকতকে বেশ অন্য ধরনের একজন মানুষ বলতে হবে। তাই না?’
‘হ্যাঁ। খুব আনিউজুয়াল। ওকে নিয়ে মাঝে মাঝে আমাদের খুব চিন্তা হত। এই নোংরা পৃথিবীটাতে বাস করতে গেলে যেসব দোষ থাকা দরকার, সেগুলো সৈকতের ছিল না। ফলে ও এমন সব কাজ করে বসত যেগুলো পরে ওর ওপরেই বোঝা হয়ে দাঁড়াত। খ্রিস্টান ধর্মটা ওকে খুব টানত। হয়তো মিশনারি স্কুলের ইনফ্লুয়েন্স। একবার বারো ক্লাসে পড়ার সময় ও তো ঠিকই করে ফেলল যে খ্রিস্টান হয়ে যাবে। অনেক বুঝিয়ে-টুঝিয়ে ওকে নিরস্ত করা গেল। তবে পাপ এবং তার শাস্তি খ্রিস্টানদের এই যে ধারণাটা সৈকতকে খুব নাড়া দিয়েছিল। পেনেন্স ব্যাপারটাতেও সৈকতের খুব বিশ্বাস ছিল। কখনও ভুল করে কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে ফেললে ও নিজেকেই শাস্তি দিতে চাইত।’
অচিন্ত্য সাহা পুরোটা বুঝতে পারছে বলে মনে হয় না। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। অনুপ চৌধুরির কথা শেষ হতে না হতে সে বলল, ‘খুন হবার আগে সৈকত কি আপনাদের কিছু বলেছিল? মানে অস্বাভাবিক কোনও ঘটনা বা ওই রকম কিছুর কথা বলেছিল কি?’
‘না সেরকম কিছু বলেছিল বলে মনে পড়ছে না। তবে বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ করছিলাম সৈকত একটু বিমর্ষ হয়ে আছে। এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলত না। আসলে সৈকত খুব চাপা স্বভাবের ছিল। নিজের উদ্বেগ-টুদ্বেগগুলো কারও সঙ্গে শেয়ার করা ওর ধাতে ছিল না। মনে হয় ওর বউএর সঙ্গেও ও সব কিছু শেয়ার করত না।’
সৈকতের সঙ্গে আপনাদের কীরকম ফ্রিকোয়েন্টলি দেখা হত?’
‘মাসে একবার তো দেখা হতই। আমরা আজকাল কোথাও যেতে পারি না। সৈকতই কলকাতা থেকে ড্রাইভ করে এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করে যেত।’
‘শেষ কবে সৈকত আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল?’
‘যেদিন সৈকত খুন হয়, সেদিন সকালে। খুব বেশিক্ষণ ছিল না। দেড়টা নাগাদ ভাত-টাত খেয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। ও এখানে এলে ওর মায়ের হাতের রান্না খেয়ে যেত। আগের রাত্তিরেই জানিয়ে রেখেছিল যে ও আসছে।’
‘সেদিন কি সৈকতের মধ্যে কোনও পরিবর্তন লক্ষ করেছিলেন?’
‘আলাদা করে কিছু লক্ষ করিনি। ছ সাত মাস ধরে সৈকত যেরকম মনমরা হয়ে থাকত, সেদিনও সেই রকমই ছিল।’
‘আচ্ছা, অনিতা, মানে সৈকতের বউএর সঙ্গে আপনাদের কেমন সম্পর্ক? সেও কি মাঝে মাঝে আসত?’
‘ভালই তো। খারাপ বলার কোনও কারণ দেখি না। তবে অনিতা সৈকতের মতো অত ঘনঘন আসত না। মাঝে মাঝে আসত।’
‘আপনি কি জানেন, খুন হবার আগে সৈকত একটা বিরাট মোটা টাকার জীবনবিমা করেছিল যার বেনিফিশিয়ারি ছিল তার স্ত্রী অনিতা চৌধুরি? আপনার কি মনে হয় টাকার লোভে অনিতা তার স্বামীকে খুন করতে পারে?’ অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর অচিন্ত্য সাহা প্রশ্ন করল।
অচিন্ত্য সাহার ডবোল প্রশ্নের তির দৃশ্যতই অনুপ চৌধুরিকে আহত করেছে। তিনি চুপ করে গেছেন। উত্তর দিতে সময় নিচ্ছেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে অনুপ চৌধুরি বললেন, সৈকত এরকম কোনও জীবনবিমা করেছিল বলে আমার জানা ছিল না। আর আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন টাকার লোভে অনিতা সৈকতকে খুন করতে পারে কিনা, আমি জোর দিয়ে হ্যাঁ বা না কোনওটাই বলতে পারব না।’
‘আর আপনাদের জানাই, আমি এবার একটু ক্লান্ত বোধ করছি। যদি আপনাদের প্রশ্ন করা হয়ে গিয়ে থাকে আমাকে ছুটি দিলে কৃতজ্ঞ বোধ করব।’ একটু থেমে অনুপ চৌধুরি বললেন।
‘ঠিক আছে। আপনাকে আর বিরক্ত করব না। আপনার স্ত্রীর সঙ্গে একটু কথা বলা যাবে?’
‘দেখুন, আমার স্ত্রী মোটেই সুস্থ নেই। ছেলের মৃত্যুটা উনি এখনও মেনে নিতে পারেননি। আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাইবেন না। আমি ওঁকে এই পৈশাচিক ব্যাপারটা ভুলিয়ে রাখতে চাই। আপনারা যদি ওঁকে এসব নিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করেন আবার উনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়বেন। তাই হাত জোড় করে বলছি ওঁকে ছেড়ে দিন।’
‘না, না এভাবে কেন বলছেন? আমরা আপনার স্ত্রীকে কখনোই বিরক্ত করব না। আমরা বরং আজ উঠি। আরও কিছু জানতে হলে ইন্সপেক্টার সাহা আপনাকে ফোন করে জেনে নেবেন।’ আদিত্য তাড়াতাড়ি বলল।
অনুপ চৌধুরির বাড়ি থেকে বেরোতে বেরোতে আদিত্যর মনে হচ্ছিল অনুপ চৌধুরির স্ত্রী অঞ্জনা চৌধুরির সঙ্গে কথা বলতে পারলে অচিন্ত্য সাহা খুশি হত।
ফেরার পথে, গাড়ি যখন বি টি রোডে পড়েছে, অচিন্ত্য সাহা বলল, ‘দেখলেন তো, অনুপ চৌধুরি কিন্তু অনিতা চৌধুরির দ্বারা সৈকত চৌধুরির খুন হবার সম্ভবনাটা একেবারে উড়িয়ে দিলেন না।’
সৈকত টের পেল অচিন্ত্য সাহা এখনও তার পুরোনো বিশ্বাসে আটকে রয়েছে।
(৪)
আদিত্য ভেবেছিল রবিবার সন্ধেবেলাটা কেয়ার সঙ্গে কাটাবে। কোথাও যাবে না। বাড়িতেই বসে বসে আবোল তাবোল গল্প করবে। কিংবা যদি ইচ্ছে হয় দুজনে মিলে ল্যাপটপে একটা সিনেমাও দেখে ফেলতে পারে। অথবা মুড হলে দুজনে মিলে একটা নতুন কিছু রান্নাও করতে পারে। সিনেমা দেখা কিংবা নতুন কিছু রান্না করাটা আসল নয়, আসল হল দুজনে এক সঙ্গে থাকা। এক সঙ্গে সময় কাটানো। যেটা, একবার সপ্তাহ শুরু হয়ে গেলে, আর হয়ে উঠবে না।
আদিত্য খেয়াল করেছে প্ল্যান অনুযায়ী তার কোনও কাজ করা হয় না। কিছু একটা কারণে প্ল্যান ভেস্তে যায়। এবারেও ঠিক তাই হল। বিকেলের মুখে গৌতমের ফোন।
‘শোন, আমার ব্যাচমেট এবং বন্ধু অমিত সাক্সেনা কলকাতায় এসেছে। অমিত সিবিআইতে আছে। সৈকত চৌধুরি এবং মণিময় গুপ্ত খুনের মামলায় সিবিআই ইনটারেস্টেড। অমিত কেসটা লিড করছে। ওদের ইন্টারেস্টের কারণ, একটা ব্রিজ ভেঙে পড়া নিয়ে সৈকত চৌধুরির এগেন্সটে ওরা আগেই ইনভেস্টিগেট করছিল। যার এগেন্সটে ওরা ইনভেস্টিগেট করছিল সেই লোকটা হঠাৎ খুন হয়ে গেল, তার পার্টনার খুন হয়ে গেল, প্রজেক্টটার কনট্রাকটার খুন হয়ে গেল, সৈকতের পার্টনারের বাগানবাড়ি থেকে কলকাতা পুলিশ কাঁড়ি কাঁড়ি কালো টাকা উদ্ধার করল এগুলো তো আর আলাদা আলাদা ইন্সিডেন্ট হতে পারে না। সিবিআই এখন কলকাতা পুলিশের সঙ্গে মিলে কাজ করতে চায়। তাই অমিত কলকাতায় এসে আমার সঙ্গে দেখা করেছে।’
‘বেশ। কিন্তু এর মধ্যে আমি আসছি কোথায়?’ আদিত্য একটু কুণ্ঠিতভাবে বলল।
‘কোথায় আসছিস, বলছি। প্রথমত, ওই অচিন্ত্য সাহা বলে ইন্সপেক্টারটি যাই বলুক না কেন, সিবিআই কী করে যেন জেনে গেছে মণিময় গুপ্তর বাড়ি থেকে ব্ল্যাক মানি উদ্ধারের পেছনে তোর হাত বা ব্রেন, যেটাই হোক, সেটা আছে। দুনম্বর কথা, সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের হয়ে তুই কয়েকটা কাজ করে দেবার ফলে দিল্লিতে তোর নামটা খানিকটা ছড়িয়েছে। ফলে সিবিআই-এর বড় এবং মেজ কর্তারা তোর নামটার সঙ্গে পরিচিত। তৃতীয়ত, তারা জানে তুই এই কেসটা নিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছিস। সব মিলিয়ে সিবিআই যেমন কলকাতা পুলিশের সাহায্য চায় তেমনি তোর কাছ থেকেও অ্যাসিস্টেন্স চায়। অমিত সাক্সেনা কাল দিল্লি ফিরে যাচ্ছে। ও আজ তোর সঙ্গে বসতে চায়। ওর সঙ্গে ওদের অ্যাকাউন্ট্যান্ট থাকবে, তার কিছু কিছু জিনিস বলার আছে। আর আমি তো থাকবই। এই মিটিংটার জন্যে আমি আমাদের ক্লাবে একটা চেম্বার বুক করে রেখেছি। তোকে আসতেই হবে।’
‘হ্যাঁ, আসতে তো হবেই। ভেবেছিলাম সন্ধেটা বউএর সঙ্গে কাটাব, সেটা দেখছি আর কপালে নেই। তা কটার সময় আসব?’
‘সাতটার বেশি আর দেরি করিস না। ক্লাবের রিসেপশনে পৌঁছে আমাকে একটা ফোন করিস। আমি তোকে এসে নিয়ে যাব।’
‘ঠিক আছে, চলে আসছি।’
‘ও হ্যাঁ। ডিনার খেয়ে যাবি কিন্তু।’
গৌতমের ক্লাবটা রাসেল স্ট্রিটে। বনেদি ক্লাব। ছোটবেলায় আদিত্য বাবার সঙ্গে প্রতি শনিবার এখানে ডিনার খেতে আসত। সেই সময় প্রত্যেক শনিবার এখানে কন্টিনেন্টাল বুফে ডিনার দেওয়া হত যেটা আদিত্য এবং তার বাবা দুজনেরই খুব পছন্দের ছিল। তারপর বাড়ি ফিরে অনেকক্ষণ গান শোনা হত। কারণ, পরের দিন রবিবার, আদিত্যর স্কুল ছুটি। পার্ক স্ট্রিট মেট্রো স্টেশনে ট্রেন থেকে নামতে নামতে আদিত্যর এইসব পুরোনো কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল।
গৌতমের বন্ধু অমিত সাক্সেনা অল্প কথার মানুষ। কথা বলার থেকে শোনাতেই তার আগ্রহ বেশি। আদিত্য ভাবল, লোকটা পুলিশের গোয়েন্দা হবার উপযুক্ত বটে। সাক্সেনার সঙ্গী রাজীব অগ্রবাল রোগা, বেঁটে, ফরসা। সাক্সেনার কালো লম্বা-চওড়া চেহারার ঠিক বিপরীত। সে আরও কম কথা বলে, বস অনুমতি না দিলে তার বোধহয় মুখ খোলা বারণ। অতএব কথাবার্তা যা বলার গৌতমই মূলত বলছিল, বেশিরভাগটাই ইংরেজিতে, মাঝে মাঝে হিন্দিতে।
‘কিছুদিন আগে বেঙ্গল-ঝাড়খণ্ড বর্ডারে সিমজুড়ি বলে একটা জায়গায় অজয় নদীর ওপর সৈকত চৌধুরি, মণিময় গুপ্তর কোম্পানি গুপ্ত অ্যান্ড চৌধুরি সিভিল কনস্ট্রাকশান্স একটা ব্রিজ বানিয়েছিল। পাবলিকের জন্যে খোলার আগেই ভেঙে পড়েছিল ব্রিজটা। তার ফলে বেশ কয়েকজন মারাও গেছিল। শেষপর্যন্ত সিবিআই-এর হাতে কেসটা চলে আসে।’ গৌতম আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বলছিল।
‘তিনটে অ্যাকাউন্ট এরা ভাল করে দেখেছে।’ একটা অ্যাকাউন্ট গুপ্ত অ্যান্ড চৌধুরি সিভিল কনস্ট্রাকশান্স-এর, অর্থাৎ সৈকত চৌধুরি এবং মণিময় গুপ্তর কোম্পানির। দ্বিতীয়টা এইস বিল্ডার্স অর্থাৎ অসীম দত্তর কোম্পানির এবং তৃতীয়টা দত্ত কনস্ট্রাকশান্স অর্থাৎ অসীম দত্তর বড় ছেলে অনিকেত দত্তর। তিনটে কোম্পানিই বেঙ্গল-ঝাড়খণ্ড বর্ডারের ওই ব্রিজটা ভেঙে পড়ার সঙ্গে যুক্ত। মিস্টার রাজীব অগ্রবাল একজন ফরেনসিক অডিটার। তিনি এই অ্যাকাউন্টগুলো খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে কিছু সিদ্ধান্তে এসেছেন।’
আদিত্য রাজীব অগ্রবালের দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি হাসল। উত্তরে অগ্রবালের মুখেও একটা বিষণ্ণ হাসি দেখা দিল। আদিত্যর মনে হল লোকটার মুখের অভিব্যক্তিগুলোই বিষণ্ণ, নইলে এখন আলাদা করে বিষণ্ণ হবার কোনও কারণ তো ঘটেনি।
‘প্রথম অ্যাকাউন্টটা যাদের সেই গুপ্ত অ্যান্ড চৌধুরি সিভিল কনস্ট্রাকশান্স ন্যাশানাল হাইওয়ে অথরিটির কাছ থেকে সিমজুড়ি ব্রিজটা বানানোর বরাত পেয়েছিল। গুপ্ত অ্যান্ড চৌধুরি সিভিল কনস্ট্রাকশান্স কনট্রাকটার হিসেবে নিয়োগ করেছিল অসীম দত্তর কম্পানি এইস বিল্ডার্সকে। এইস বিল্ডার্স আবার কাজের সিংহভাগ সাব-কন্ট্রাক্টিং-এ অনিকেত দত্তর কম্পানি দত্ত কনস্ট্রাকশান্সকে দিয়ে দিয়েছিল। এই কন্ট্রাকটর এবং সাব-কন্ট্রাকটর নিয়োগ নিয়ম মেনে ওপেন টেণ্ডার করে হয়েছিল কিনা তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন উঠতেই পারে। কী সাক্সেনা, ঠিক বলছি তো?’
শেষ প্রশ্নটা, বলাই বাহুল্য, অমিত সাক্সেনার উদ্দেশে। সাক্সেনা ঘাড় নেড়ে জানাল গৌতম ঠিকই বলছে।
‘যাই হোক, ব্রিজের যে প্ল্যানটা স্যাংশান করা হয়েছিল পরে দেখা গেছে সেটা অনুযায়ী কাজ হয়নি। তাছাড়া বিল্ডিং মেটিরিয়ালসও সাবস্ট্যান্ডার্ড কোয়ালিটির ছিল। ন্যাশানাল হাইওয়ের অনুমোদন ছাড়াই প্ল্যানে যে পরিবর্তন করা হয়েছিল সেটা অনুমোদন করেছিল সৈকত চৌধুরি। মেটিরিয়াল পারচেজও সে-ই অনুমোদন করেছিল। অন্তত কাগজপত্রে একমাত্র তারই সই আছে। সৈকত অবশ্য বলছে এই পরিবর্তনগুলো এবং সাবস্ট্যান্ডার্ড কোয়ালিটির মেটিরিয়াল সে জ্ঞানত অনুমোদন করেনি। এই পরিবর্তনগুলো যে ব্রিজটাকে কমজোরি করে দিয়েছিল এটা সে স্বীকার করছে। সে এটাও বলছে যে পরিবর্তিত প্ল্যান অনুযায়ী খারাপ মালমশলা দিয়ে ব্রিজটা বানালে খরচ অর্ধেক হয়ে যাবার কথা।’
‘তাহলে সৈকত ওই কাগজে সই করল কেন?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
সৈকত বলছে ও যখন অন্য কাজে ব্যস্ত ছিল তখন ওকে দিয়ে তাড়াহুড়ো করে সইগুলো করিয়ে নেওয়া হয়েছে। ও খেয়াল করেনি কোথায় সই করছে।’
‘সইটা কে করিয়েছিল?’
‘আমরা সৈকতের কম্পানির দুজন কর্মচারীকে আইডেন্টিফাই করেছি যারা সৈকতকে দিয়ে সইগুলো করিয়ে নিয়েছিল। তারা দুজনেই অবশ্য বলছে সৈকত জেনে-বুঝেই সইগুলো করেছে।’
সৈকতের পার্টনার এই সময় কী করছিল? তার কাছে কাগজগুলো নিয়ে যাওয়া হয়নি কেন?’
‘যে সময় সইগুলো হয়েছে সেই সময় সৈকতের পার্টনার মণিময় নাকি দেশের বাইরে ছিল। অন্তত সে সেরকমই বলেছিল।’
‘এর মধ্যে এইস বিল্ডার্স আসছে কোথায়? দত্ত কনস্ট্রাকশান্সই বা কোথায় আসছে?’
‘এই কেলেঙ্কারিটার দুটো অংশ। প্রথমটা ব্রিজের প্ল্যান বদলে দেওয়া, দ্বিতীয়টা খারাপ কোয়ালিটির মালমশলা দিয়ে ব্রিজটা বানানো। এই দ্বিতীয় স্ক্যামটার সঙ্গে এইস বিল্ডার্স এবং দত্ত কনস্ট্রাকশান্স আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। এইস বিল্ডার্সকে অবশ্য সরাসরি ধরা যাবে না। কারণ, তারা কাজের একটা বড় অংশ দত্ত কনস্ট্রাকশান্সকে সাব-কনট্রাক্ট করে দিয়েছিল। খারাপ মালমশলা কেনার বিলগুলো অবশ্য গুপ্ত অ্যান্ড চৌধুরি অনুমোদন করেছে। এবং এখানেও সমস্ত বিলগুলো অনুমোদন করেছে সৈকত চৌধুরি। মণিময় গুপ্তর সই কোথাও নেই।’
‘এটা তো খুবই আশ্চর্য ব্যাপার।’
‘হ্যাঁ, আরও আশ্চর্য ব্যাপার হলো কলকাতা পুলিশ মণিময়ের নরেন্দ্রপুরের বাড়ি থেকে মণিময়ের যে পাসপোর্টটা উদ্ধার করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে মণিময় বহুদিন দেশের বাইরে যায়নি। তার মানে, যখন সৈকত এই সব কাগজপত্রে সই করছে তখন মণিময় আসলে ঘাপটি মেরে তার নরেন্দ্রপুরের বাড়িতে বসে ছিল, পাছে দুনম্বরি কাগজে তাকে সই করতে হয়। অর্থাৎ পুরো প্ল্যানটাই সৈকতকে সামনে রেখে এবং ভিকটিম বানিয়ে মণিময় এবং অসীম দত্ত করেছে।’ গৌতম থামল।
‘এখানে আরও একটা ব্যাপার আছে।’ এতক্ষণে অমিত সাক্সেনা মুখ খুলেছে। ‘আমাদের ফরেনসিক অডিটার রাজীব অগ্রবাল এইস বিল্ডার্স এবং দত্ত কনস্ট্রাকশান্স-এর অ্যাকাউন্টসগুলো ভাল করে দেখে বুঝতে পেরেছে সিমজুড়ি ব্রিজ ছাড়াও এইস বিল্ডার্স তাদের অনেকগুলো দুনম্বরি ট্র্যানজাকশান দত্ত কনস্ট্রাকশান্সকে দিয়ে করিয়েছে। এইস বিল্ডার্স-এর বকলমে দত্ত কনস্ট্রাকশান্স বেশ মোটা টাকার ব্যাঙ্ক লোনও নিয়েছে যেগুলো তারা শোধ করেনি। দত্ত কনস্ট্রাকশান্স কোম্পানিটা সম্ভবত খুব শিগগির নিজেদের দেউলিয়া ডিক্লেয়ার করে বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু তারা এর মধ্যেই বিপুল পরিমাণ টাকা অন্য জায়গায়, মানে অসীম দত্ত এবং অনিকেত দত্তর প্রাইভেট অ্যাকাউন্টে, সরিয়ে দিয়েছে। সেগুলো, বলাই বাহুল্য, হিসেব বহির্ভূত টাকা, মানে ব্ল্যাক মানি। সব মিলিয়ে এটাই দাঁড়াচ্ছে যে এই দুনম্বরি ডিলগুলোতে বাবা এবং ছেলে এক সঙ্গে ছিল।’
‘আচ্ছা, আপনারা নিশ্চয় সৈকতের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টগুলো চেক করেছেন। সেখানে কি কোনও বড় টাকা ঢুকেছিল? মানে, এই ডিলটা থেকে সৈকত টাকা পেয়েছিল এরকম প্রমাণ কি আছে?’
‘আমরা সৈকতের সব কটা অ্যাকাউন্ট চেক করেছি। সেরকম কোনও প্রমাণ পাইনি। তবে সৈকত যদি ক্যাশ নিয়ে থাকে তাহলে অন্য কথা। আমরা ভাবছি সৈকতের বাড়িটা একবার সার্চ করব। হয়ত একই সঙ্গে সৈকতের বাবার বাড়িটাও সার্চ করতে পারি।’ অমিত সাক্সেনা ঠান্ডা গলায় জানাল।
‘আমি একটু অ্যাড করতে পারি?’ রাজীব অগ্রবাল তার বসের দিকে তাকিয়ে অনুমতি চাইল।
‘বল, কী বলবে।’
‘আমি বলছি, সৈকতের অ্যাকাউন্টে কোনও মোটা টাকা তো ঢোকেইনি, বরং গত ছমাসের মধ্যে সাত-আটটা ট্রাঞ্চে প্রায় তিরিশ লাখ টাকা সৈকতের অ্যাকাউন্ট থেকে বেরিয়ে গেছে। সবগুলোই ক্যাশ উইথড্রয়াল। টাকাটা নিয়ে সৈকত কী করেছে আমরা জানি না। বারবার সৈকতকে জিজ্ঞেস করেও কোনও উত্তর পাইনি। আমার মনে হয় এটা একটা রেলেভেন্ট ইনফরমেশান।’
আদিত্য ভুরু কুঁচকে শুনছে। সৈকত দুনম্বরি টাকার বখরা পায়নি, উল্টে এক বা একাধিক ব্যক্তিকে টাকা দিয়েছে। কাকে টাকা দিল? কেন দিল?
‘আমরা এখনও কিন্তু দুএকটা ব্যাপার বুঝতে পারিনি।’ সাক্সেনা বলতে শুরু করেছে।’তার মধ্যে সব থেকে পাজলিং হচ্ছে এই খুনগুলো। দাশগুপ্ত সাহেব বললেন আপনি এই খুনগুলোর মিস্ট্রি সলভ করার ব্যাপারে অনেকটা প্রগ্রেস করেছেন। আমরা তো যেটুকু জানতে পেরেছি আপনার সঙ্গে শেয়ার করলাম। এবার আপনি যতটা জানতে পেরেছেন যদি আমাদের সঙ্গে শেয়ার করেন, খুব ভাল হয়।’ অমিত সাক্সেনা আদিত্যর দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
এর পরের এক ঘণ্টা আদিত্য বক্তা, অন্যরা শ্রোতা।
ডিনার খেয়ে আদিত্য যখন বাড়ি ফিরল তখন রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। কেয়া ঘুমিয়ে পড়েছে।