সৈকত রহস্য – ৯
নবম পরিচ্ছেদ
(১)
সকাল থেকে একটার পর একটা ফোন। মাঝে মাঝে এরকম হয়। প্রথম ফোন সকাল আটটায়। আদিত্যর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। সে বিছানায় শুয়ে আলস্য করছিল। সপ্তাহের প্রথম দিন, কেয়া আগেই উঠে পড়ে স্কুল যাবার তোড়জোড় করছে।
বিমলের ফোন। এত সকালে বিমল সাধারণত ফোন করে না। আদিত্য ঘুম বিজড়িত গলায় বলল ‘হ্যালো।’
‘একটু দরকারে সকাল সকাল বিরক্ত করছি স্যার।’ বিমলের গলায় অবশ্য কুণ্ঠার চিহ্নমাত্র নেই। ‘সমীর প্যাটেল আজ বিকেলে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাচ্ছে। বেলা এগারোটা থেকে একটা ভিজিটিং আওয়ার আছে। আপনি কি ওই সময় গিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলবেন? আপনি বলছিলেন না ওর সঙ্গে একদিন কথা বলতে চান?’
‘আমি চাইলেই কি ও আমার সঙ্গে কথা বলবে?’
‘সে ব্যবস্থা আমি করে রেখেছি স্যার। ওর সঙ্গে গিয়ে ভাব করেছি। আপনার কথা বলেছি। বলেছি, আপনি অনিতা ম্যাডামকে সাহায্য করছেন। ও অনিতা ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলে দেখে নিয়েছে আমি সত্যি বলছি কিনা। এত কিছু করে ও আপনার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়েছে। আমি ওকে এক রকম বলেই রেখেছি যে আজ এগারোটার সময় আপনি ওর সঙ্গে দেখা করতে আসবেন।’
‘ওই সময় কি অনিতাও থাকবে?’
‘মনে হয় না স্যার। অনিতা ম্যাডাম বিকেলে রুগিকে ডিসচার্জ করার সময় থাকবেন। তার মানে সকালে আর আসবেন না। সমীর প্যাটেলকেও সেই রকম বলে গেছেন।’
‘আর সমীরের বাড়ির লোক?’
‘সমীরের বাড়ির লোক খুব একটা আসে না। অনিতা ম্যাডামই ওর বাড়ির লোক।’
‘তা হলে তো মন খুলে কথা বলা যাবে। আমি যাব। তুমি থাকবে তো?’
‘নিশ্চয় থাকব স্যার। পৌনে এগারোটা নাগাদ হাসপাতালের সামনে পৌঁছে যাব। আপনি চেনেন তো জায়গাটা?’
‘চিনি। কিওর মাল্টিস্পেশালিটি হসপিটাল। বাইপাসের ধারে। পাটুলির আগের স্টপ। তোমার সঙ্গে হাসপাতালের সামনে দেখা হবে। আর শোনো। তোমার জুয়াড়িদের খবর কী?’
‘সেই রকমই চালিয়ে যাচ্ছে স্যার। যে নাইট ক্লাবে ওরা জুয়া খেলতে যায় সেখানকার দরোয়ান বলল, জুয়া খেলতে গিয়ে ওদের নাকি বিরাট ধার হয়ে গেছে। ও হ্যাঁ, আর একটা জিনিস জেনেছি। ওরা নাকি শালা-ভগ্নিপতি। লম্বাটা ভগ্নিপতি, বেঁটেটা শালা। আজ তা হলে রাখি স্যার?’
কেয়া চা তৈরি করে রেখে বাথরুমে ঢুকেছে। বাথরুমের বাইরে বেসিনে দাঁত ব্রাশ করতে করতে আদিত্যর হঠাৎ মনে হল মিঞা কি তোড়ি শুনলে বেশ হয়। চা-টা মাইক্রোওয়েভে গরম করে নিয়ে সে বসার ঘরে এসে ল্যাপটপে জমিয়ে রাখা কিশোরী আমোনকরের মিঞা কি তোড়ি চালাল। অনেক দিন এটা শোনা হয়নি।
বিশুদ্ধ জয়পুর ঘরানার গান। শুদ্ধ আকারে বিস্তার। আদিত্য ইজি চেয়ারে আরাম করে বসল। কী শান্তি! কী শান্তি! এক একটা স্বর মনে হচ্ছে মাইল মাইল লম্বা। এর ওপর দিয়ে যতই পথ হাঁটো, রাস্তা কিছুতেই ফুরোবে না। কিশোরী এক একটা স্বর থেকে নিংড়ে নিংড়ে সুর বার করে নিচ্ছেন। কিন্তু নেবার পরেও যেন আরও সুর বাকি রয়ে যাচ্ছে। মিঞা কি তোড়ি অশেষ, অসীম, অনন্ত!
আর একটু চা খেলে হত। পটের মধ্যে যেটুকু চা তলানিতে রয়ে গেছে সেটা গরম করে খেলে ঠিক যুত হবে না। আদিত্য আবার জল বসাতে যাচ্ছিল, তার আগেই ফোন। প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও আদিত্য গানটা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হল। আদিত্যর বন্ধু ক্রিমিন্যাল লইয়ার সুনন্দ সরকার ফোন করছে।
‘বল। কোনও খবর আছে?’ আদিত্য ফোন তুলে বলল।
‘আছে। খারাপ খবর। দীপশিখা চৌধুরির আগাম জামিনের আবেদন কোর্ট নাকচ করে দিয়েছে।’
‘কেন? কী হল?’
‘পুলিশ নাকি দীপশিখার এগেন্সটে কিছু একটা ইনক্রিমিনেটিং এভিডেন্স পেয়েছে যেটা কনফিডেন্সিয়ালি জজ সাহেবকে তারা দেখিয়েছে। আমরা সেটা দেখতে পাইনি। পুলিশ বলছে, এভিডেন্সটা এখনই পাবলিক করলে তদন্তের ক্ষতি হবে। জজ সাহেব সেটা মেনে নিয়েছেন।’
‘তাহলে এখন কী হবে?’
‘কী আর হবে? দীপশিখাকে অ্যারেস্টেড হতে হবে। কিন্তু অ্যারেস্ট করার পর পুলিশ নিশ্চয় আবার ওকে কোর্টে প্রোডিউস করবে। করলে তখন দেখা যাবে।’
‘ঠিক আছে। তাই হোক। তুই আর কী করবি? তুই তো যা করার করলি।’
‘না, না। এখনও সব কাজ করা হয়নি। যেমন, এখনও তোর বউএর সঙ্গে আলাপই করা হয়নি। তুই বল কবে বউকে নিয়ে আমাদের সঙ্গে ডিনার খেতে পারবি?’
‘এক সপ্তাহ পরে বললে চলবে? এই উইকটা খুব ঝামেলা চলছে।’
‘চলবে। তা হলে এক সপ্তাহ পরে তুই ফোন করে জানাচ্ছিস কবে আমরা এক সঙ্গে ডিনার খাচ্ছি।। আর এর মধ্যে পুলিশ যদি দীপশিখাকে অ্যারেস্ট করে কোর্টে তোলে, তোকে জানাব কী হল। আজ তা হলে রাখছি। বাই।’
ফোনটা রেখে আদিত্য একবার ভাবল গানটা আবার চালিয়ে দেবে। কিন্তু দীপশিখার খবরটা তাকে একটু অন্যমনস্ক করে দিয়েছে। গান শোনার মুড আর নেই। কেয়া বাথরুম থেকে বেরিয়েছে।
‘তুমি কখন বেরবে? সকালে উঠে টিফিন বানিয়ে রেখেছি। নিয়ে বেরিও।’
‘আমি সোয়া দশটা নাগাদ বেরোব। তুমি কখন বেরোবে?’
‘আমি এক্ষুনি বেরিয়ে যাচ্ছি। আজ পেরেন্ট-টিচার্স মিটিং আছে। একটু দেরিই হয়ে গেল।’
কেয়া শাড়ি-জামা পাল্টাতে তাড়াহুড়ো করে শোবার ঘরে ঢুকে গেল। আদিত্য রান্নাঘরে ঢুকে কফির জল বসিয়েছে। দেখল, খাবার টেবিলে কেয়া দুটো টিপিনবাক্স পাশাপাশি সাজিয়ে রেখেছে। একটা টিপিনবাক্স খুলে আদিত্য দেখল কেয়া চিকেন ম্যাকারনি বানিয়েছে। এটা কেয়া চমৎকার বানায়। আদিত্য টিপিনবাক্সর ঢাকাটা বন্ধ করে দিল।
কেয়া বেরিয়ে যাবার আগে গলা তুলে বলল, ‘আসছি।’ তারপর গলাটা একটু নামিয়ে বলল, ‘কালকের কথা মনে আছে তো? কাল কিন্তু রাখিদির অপরেশন। আমরা সকাল সকাল বেরিয়ে যাব।’
আদিত্যর মনে ছিল। সে কেয়ার হাতটা একটু ছুঁয়ে বলল, ‘এসো।’
কফিটা বানিয়ে আদিত্য একটু বসেছে, আবার ফোন। এবার সুভদ্র মাজি।
‘একটা খবর দেবার ছিল। খবরটা কনফিডেনশিয়াল। তাও মনে হল আপনাকে একবার জানানো উচিত।’
‘বলুন, কী খবর।’ আদিত্য গলায় ঈষৎ উৎকণ্ঠা। যথেষ্ঠ কারণ ছাড়া সুভদ্র মাজি ফোন করবে না।
‘একটু আগে দীপশিখা অ্যারেস্টেড হয়েছে। উড়িষ্যার টিমটা ওকে উড়িষ্যা নিয়ে যাচ্ছে। দীপশিখা অ্যান্টিসিপেটারি বেল-এর জন্য কোর্টে গিয়েছিল, কিন্তু কোর্ট ওর প্লি রিজেক্ট করে দিয়েছে।’
‘কেন রিজেক্ট করল জানেন? দীপশিখার জন্য লইয়ার তো আমিই ঠিক করে দিয়েছিলাম। আমার বন্ধু সুনন্দ সরকার কেসটা প্লিড করেছিল। একটু আগে ও আমাকে ফোন করে বলল, পুলিশের হাতে কী যেন একটা ইনক্রিমিনেটিং এভিডেন্স এসেছে। সেটা জজ সাহেবকে দেখানোর পরে উনি অ্যান্টিসিপেটারি বেল-এর আবেদন নাকচ করে দিয়েছেন। এভিডেন্সটা ঠিক কি আপনি জানেন?’
সুভদ্র মাজি উত্তর দিতে দেরি করছে দেখে আদিত্যর মনে হলো সে বোধহয় একটা অন্যায্য প্রশ্ন করে ফেলেছে। সে তাড়াতাড়ি বলল, ‘আমার প্রশ্নটা যদি আপনাকে অস্বস্তিতে ফেলে তা হলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আপনাকে উত্তর দিতে হবে না।’
‘আপনার প্রশ্নটা আমাকে অস্বস্তিতে ফেলেছে শুধুমাত্র এই কারণে যে আমি এটার উত্তরটা জানি না। জানলে আপনাকে জানাতে ইতস্তত করতাম না। অবশ্য উত্তরটা একেবারে জানি না বললে মিথ্যে বলা হবে। আমি শুধু এইটুকু শুনেছি যে ডিএসপি কৃষ্ণ পধি গোল্ডেন স্যান্ড রিসর্ট থেকে একটা সিসি টিভির ফুটেজ পেয়েছেন যেটা নাকি ভীষণভাবে দীপশিখার বিরুদ্ধে যাচ্ছে। এর বেশি আমি আর কিচ্ছু জানি না।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ ইন্সপেক্টার মাজি। আপনি যেটুকু বললেন সেইটুকু জেনেও আমার উপকার হল। আমি ভেবেছিলাম গোল্ডেন স্যান্ড রিসর্টে সিসি টিভিই বসেনি।’
‘সব জায়গায় মনে হয় বসেনি। তবে কোনও কোনও জায়গায় বোধহয় বসেছিল।’
আরও কিছুক্ষণ পরে আদিত্য ব্রেকফাস্ট খেয়ে ব্যাকপ্যাকে ল্যাপটপ এবং টিপিন বাক্স পুরে নিয়ে বেরোতে যাবে আবার তার মোবাইলটা বেজে উঠল। কলটা হোয়াটসঅ্যাপে এসেছে। নম্বরটা সেভ করা ছিল বলে আদিত্য বুঝতে পারল ইনশিয়োরেন্স কোম্পানির সেই ডিটেকটিভ, বিপ্লব সমাদ্দার ফোনটা করেছে। বিপ্লব সমাদ্দার তো তাকে এক রকম ভাগিয়ে দিয়েছিল, তা হলে সে আবার ফোন করছে কেন? আদিত্যর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। তাছাড়া, হোয়াটসঅ্যাপে কল করা মানে খুব সম্ভবত বিপ্লব সমাদ্দার চায় না তাদের কথাবার্তা কেউ আড়ি পেতে শুনুক। কেন এত সাবধানতা? এখন ফোনটা ধরতে গেলে হাসপাতালে পৌঁছতে একটু দেরি হয়ে যাবে, বিমল অপেক্ষা করে থাকবে। তবু কৌতূহলবশত আদিত্য ফোনটা ধরল।
‘আদিত্যবাবু, আপনার সঙ্গে কি কিছুক্ষণ কথা বলা যাবে?’
‘আমি বেরোচ্ছিলাম। ঠিক আছে, পাঁচ মিনিট কথা বলতে পারি। বলুন, কী ব্যাপার?’
‘সেদিন আপনি ফোন করে সৈকত চৌধুরির কেসটা নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন। আমি বলতে রাজি হইনি কারণ আমাদের কোম্পানির দিক থেকে কিছু রেস্ট্রিকশান ছিল। মনে আছে?’
‘হ্যাঁ, মনে আছে। তা এখন কথা বলতে চাইছেন কেন? কোম্পানির রেস্ট্রিকশান উঠে গেছে? আমি ধরে নিচ্ছি সৈকত চৌধুরির কেসটা নিয়েই আপনি কথা বলতে চান।’
‘হ্যাঁ, ওটা নিয়েই কথা বলতে চাই। আমাদের কোম্পানির তরফ থেকে আপনাকে একটা অফার দিতে চাই। আমাদের কোম্পানি আপনাকে এই কেসটাতে এনগেজ করতে চাইছে। এর জন্যে বলাই বাহুল্য একটা খুব ভাল ফি আপনাকে দেওয়া হবে।’
‘আমাকে কী করতে হবে?’
‘আপনাকে কোম্পানির হয়ে অনিতা চৌধুরির বিরুদ্ধে একটা কেস বিল্ড আপ করতে হবে। যাতে এটাই প্রমাণিত হয় যে সৈকত চৌধুরিকে খুন করার ষড়যন্ত্রে অনিতা চৌধুরি শামিল ছিল। যদি প্রমাণ করা যায় যে সৈকত খুন হবার পেছনে অনিতা চৌধুরির হাত আছে, তা হলে কম্পানিকে ইনশিয়োরেন্স-এর টাকাটা দিতে হবে না। টাকাটা অনেক, তাই এটা নিয়ে কম্পানি চিন্তিত।’
‘কিন্তু আমি তো এখনও জানি না অনিতা এই খুনের পেছনে আছে কিনা।’
‘অনিতা আর তার বয়ফ্রেন্ড সৈকতকে খুন না করলে আর কে করতে পারে? ওদেরই তো সব থেকে জোরালো মোটিভ।’
‘ওদের একটা মোটিভ আছে স্বীকার করছি। কিন্তু মোটিভ অন্যদেরও থাকতে পারে।’
‘যেমন?’
‘যেমন, বাড়ির অমতে বিয়ে করার জন্যে অনিতার ওপর অনিতার দাদা সঞ্জয় শর্মার রাগ ছিল। একবার একটা গুন্ডাকে নিয়ে সে সৈকত চৌধুরিকে ফিজিকালি অ্যাসল্ট করার চেষ্টা করেছিল। সে সৈকতকে খুন করতেই পারে। অনার কিলিং-এর ঘটনা তো আমাদের দেশে নতুন নয়। তাছাড়া আরও আছে।’
‘আর কে আছে?’
‘আপনি জানেন কিনা জানি না, একটা ব্রিজ ভেঙে পড়ার ব্যাপারে সৈকতকে সিবিআই ইন্টারোগেট করছিল। সৈকত সব কিছু রিভিল করলে শুধু সৈকতের কোম্পানি নয়, যে কন্টাকটর ব্রিজটা বানিয়েছিল তারাও বিপদে পড়ত। এমন তো হতেই পারে অনিকেত দত্ত বলে সেই কন্ট্রাকটর নিজের কুকীর্তি চাপা দেবার জন্যে সৈকত এবং তার পার্টনার মণিময়কে সরিয়েছে। আমার মনে হয়, এছাড়াও আরও অনেক পসিবিলিটি আছে। কোনটা আসলে ঘটেছে আমি জানি না, কিন্তু আমি নিশ্চিত যে সৈকত এবং মণিময়ের মৃত্যু দুটো রিলেটেড।’
‘দেখুন আদিত্যবাবু, আপনার কী মনে হয় সেটা আমাদের কোম্পানির কাছে আদৌ গুরুত্বপূর্ণ নয়। আপনি আমাদের অফারটা নিলে কোম্পানির স্বার্থটা দেখাই আপনার একমাত্র দায়িত্ব হবে। অর্থাৎ আপনাকে এমনভাবে কেসটা সাজাতে হবে যাতে ইনশিয়োরেন্সের টাকাটা কোম্পানিকে না দিতে হয়। এর জন্যে আপনি যথেষ্ট পারিশ্রমিক পাবেন। ইন ফ্যাক্ট, পারিশ্রমিকের অঙ্কটা নেগোশিয়েবল। আপনি নিজে কোম্পানির বসেদের সঙ্গে ওটা নেগোশিয়েট করতে পারেন।’
আদিত্যর হঠাৎ রাগ হয়ে গেল। তাছাড়া বেরোতেও দেরি হয়ে যাচ্ছে। সে রুক্ষভাবে বলল, ‘সমাদ্দারবাবু, আপনার জানা দরকার আমি ঘুষ নিয়ে কাজ করি না। আমার ইন্টিগ্রিটি টাকা দিয়ে কেনা যায় না। দয়া করে আমার সময় নষ্ট করবেন না।’ আদিত্য ফোনটা কেটে দিল।
আদিত্য বাইরে বেরিয়ে টের পেল হালকা বৃষ্টি নেমেছে। রোজকার মতো আজও সঙ্গে ছাতা নেই। থাকবেই বা কেন? এটা তো বৃষ্টির সময় নয়। তবু এবছর বারবার অকালে বৃষ্টি হচ্ছে। খনার বচন মনে পড়ে গেল—যদি বর্ষে ফাগুন / শস্য হবে দ্বিগুণ। ফাগুন কি শুরু হয়ে গেছে? সম্ভবত। এমনিতেই দেরি হয়ে গেল। এখন বাড়ি ফিরে ছাতা আনতে গেলে আরও দেরি হয়ে যাবে। তার থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে নেওয়া যাক। বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচা যাবে, তাড়াতাড়ি পৌঁছনোও যাবে। তাছাড়া এখন আর ভিড় বাসে উঠতে ইচ্ছে করছে না। বিপ্লব সমাদ্দার মেজাজটা একেবারে খারাপ করে দিয়েছে।
সমীর প্যাটেলের গায়ের রং পরিষ্কার, চোখ দুটো ভাসা ভাসা, নাকটা ঈষৎ চাপা, কপালটা ছোট, মাথায় শাসনহীন ঝাঁকড়া চুল, সব মিলিয়ে বেশ মেয়েলি চেহারা। রোগা শরীরটা দেখে তেমন শক্তপোক্ত মনে হয় না। তার ওপর কপালে এবং বাঁ হাতে এখনও ব্যান্ডেজ।
সমীর শুয়েছিল। আদিত্যদের দেখে উঠে বসার চেষ্টা করল। ঘরে অপর বেডটা ফাঁকা। দুটো চেয়ারের একটাতে আদিত্য বসেছে। অন্য চেয়ারটাতে প্লাস্টিকে মোড়া কিছু জিনিসপত্র রয়েছে। বাড়ি যাবার সময় ওগুলো বোধহয় রুগি সঙ্গে নিয়ে যাবে। বিমল বসার জায়গা না পেয়ে অন্য বিছানাটায় বসল।
‘আমি আপনার কথা অনিতার কাছে অনেক শুনেছি।’ সমীর প্যাটেল মোটামুটি পরিষ্কার বাংলা বলে যদিও তার উচ্চারণে অবাঙালি টান আছে।
‘আপনার ব্যাপারে অনিতার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। অনিতা আপনাকে খুব বিশ্বাস করে। আশা করি আপনি সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবেন।’ আদিত্য গম্ভীর গলায় বলল।
‘আপনি এই কথা কেন বলছেন আমি জানি।’ সমীর সরাসরি মূল বিষয়ে চলে এসেছে। তার মুখও বেশ গম্ভীর। ‘গত পরশু মানে শনিবার আপনি অনিতাকে কয়েকটা ছবি দেখিয়েছিলেন। পরে হোয়াটসঅ্যাপ করে ছবিগুলো অনিতাকে পাঠিয়েও দিয়েছেন। ছবিগুলো পার্ক স্ট্রিটে তোলা। ছবিগুলোতে আমার সঙ্গে অনিতার দাদা সঞ্জয়কে দেখা যাচ্ছে। এটা নিয়ে অনিতা ভীষণ আপসেট। শনিবারই বিকেলে এসে আমাকে ছবিগুলো দেখাল।’
আদিত্য চুপ করে শুনছে। মনে হচ্ছে, সমীর প্যাটেলের আরও কিছু বলার আছে।
‘আমি ভেবে দেখলাম, ভালই হল আপনি ছবিগুলো অনিতাকে দেখিয়েছেন। যে কথাগুলো আমি অনিতাকে বলতে চাইছিলাম কিন্তু পারছিলাম না, এখন সেই কথাগুলো ওকে বলতেই হল। আমার কন্সান্স এখন একদম ক্লিয়ার। কিন্তু মুশকিল হল, অনিতা আমাকে পুরোটা বিশ্বাস করছে না। ও ভাবছে আমি এখনও কিছু লুকিয়ে যাচ্ছি। এ-ব্যাপারে আপনি যদি আমাকে সাহায্য করেন, আই শ্যাল রিমেন রিয়ালি গ্রেটফুল।’
‘কী কথা আপনি অনিতাকে বলতে পারছিলেন না?’
‘কথাগুলো আমি শুধু আপনাকেই বলব। আর রিকোয়েস্ট করব অনিতা ছাড়া আর কারও সঙ্গে যেন আপনি এটা নিয়ে ডিসকাস না করেন।’ সমীর প্যাটেল বিমলের দিকে তাকাল।
বিমল ইঙ্গিতটা ধরতে পেরেছে। সে আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি নীচের লবিতে আপনার জন্যে ওয়েট করছি স্যার।’
আধঘণ্টা পরে সমীর প্যাটেলের কথা শেষ হয়ে গেলে আদিত্য ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার আগে বলল, ‘আমি আপনার কথাগুলো আগে ক্রসচেক করব। যদি আমি স্যাটিসফাইড হই তাহলে অনিতার সঙ্গে কথা বলব। আর একটা কথা। অনিতার স্বামী খুন হয়ে গেছে। আমরা সেটা ইনভেস্টিগেট করছি। ইনভেস্টিগেশনের স্বার্থে আপনার কথাগুলো সম্ভবত পুলিশকে জানাতে হবে। তবে যদি আপনি সত্যি কথা বলে থাকেন, আমি গ্যারেন্টি দিচ্ছি, ইট ওন্ট গো এগেন্সট ইউ।’
লবিতে নেমে আদিত্য দেখল বিমল এক কোণে বসে টিভি দেখছে। আদিত্য তাকে বিরক্ত না করে টেলিফোনে সুভদ্র মাজির নম্বরটা লাগাল।
‘একটা হেল্প চাইছি। একটা লোককে ধরে তার পেট থেকে কিছু কথা বার করতে হবে। হয়তো একটু থার্ড ডিগ্রি লাগতে পারে। লোকটা গুণ্ডা টাইপের। নাম সঞ্জয় শর্মা। ঠিকানা ………’
(২)
আদিত্য আর কেয়া যখন হাসপাতালে পৌঁছল তখনও ন’টা বাজেনি। মস্ত বড় কমপাউন্ড, সার্জারি উইংটা কমপাউন্ডের উত্তর দিকে। প্রদীপ চক্রবর্তী বলে দিয়েছিলেন সোজা ছতলায় চলে আসতে। ওখানেই ওটি। রিকভারি রুম। ইনটেন্সিভ কেয়ার ইউনিট। এসবের বাইরে পেশেন্টের বাড়ির লোকজনদের জন্যে একটা ওয়েটিং রুম আছে। লিফট থেকে নেমে বাঁদিকে।
এটা কলকাতা শহরের সব থেকে দামি হাসপাতাল। বিলাসবহুল, ঝকঝকে, হোটেল-হোটেল। আদিত্য আন্দাজ করল হাসপাতাল বাছার স্বাধীনতাটা প্রদীপ চক্রবর্তীর ছিল না। ডাঃ অরুণ কুলকার্নি যেখানে চাইবেন সেখানেই অপরেশনটা করাতে হবে।
ওয়েটিং রুমে চার-পাঁচজন অপেক্ষা করছে। দুটো আরাম কেদারা আছে যেখানে গা এলিয়ে দিয়ে অনায়াসে ঘুমিয়ে নেওয়া যায়। আপাতত দুটোই অন্যদের দখলে। প্রদীপ চক্রবর্তী একটা বই খুলে বসেছিলেন, পড়ছিলেন কিনা বলা শক্ত। আদিত্যদের ঢুকতে দেখে বললেন, ‘রাখিকে এখনও ওটিতে নিয়ে যায়নি। নার্স বলেছে নিয়ে যাবার সময় আমাদের ডাকবে।’
‘রাখিদি কেমন আছে?’ কেয়া জিজ্ঞেস করল। তার গলার উৎকণ্ঠাটা বানানো নয়।
‘এখন তো দেখতে দিচ্ছে না, তাই সকালে ফোন করেছিলাম। খুশ মেজাজে আছে। তবে কমপ্লেন করছিল কাল থেকে লিকুইড ডায়েটে রেখে দিয়েছে। কাল বেশ খিদে ছিল। আজ সকাল থেকে আর তেমন খিদে নেই। হয়ত সিডেটিভ দিচ্ছে।’
‘ডাঃ কুলকার্নির সঙ্গে কথা বলেছেন?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘নাঃ, সে সুযোগ এখনও পাইনি। তবে শুনলাম কাল রাত্তিরবেলা উনি কলকাতায় পৌঁছে গেছেন। বড় অপরেশান থাকলে উনি নাকি ভোরবেলা উঠে নিজে গণেশ পুজো করেন। সেসব করে-টরে এখনও বোধহয় এসে পৌঁছননি।’
‘এটা কে বলল?’
‘ওঁর জুনিয়র ডাক্তার বললেন, যিনি ডাঃ কুলকার্নিকে অ্যাসিস্ট করবেন।’
‘ভাবা যায়? এত বড় ডাক্তার, তিনিও পুরোপুরি বিজ্ঞানের ওপর ভরসা রাখতে পারছেন না। দৈবী শক্তির সাহায্য নিতে হচ্ছে।’ আদিত্য নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলল।
‘আসলে কী জানো,’ প্রদীপ আজকাল আদিত্য আর কেয়া দুজনকেই তুমি বলছেন। ‘ডাক্তারি, বিশেষ করে এই শল্য চিকিৎসার ব্যাপারটা, পুরো সায়েন্স নয়, কিছুটা আর্টও বটে। সার্জেনের হাতের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। কিছুটা ভাগ্যের ওপরেও। যেখানেই ভাগ্য ঢুকছে সেখানেই তার হাত ধরে গণেশ ঠাকুর, রাহু-কেতু, আঙটি-তাবিজ এইসব ঢুকে পড়ছে। এই যে ধরো ডাঃ কুলকার্নি, এত বড় সার্জেন, কিন্তু ওঁর আঙুলে নাকি মস্ত বড় একটা পলার আঙটি আছে। একবার একটা বড় অপরেশনের আগে আঙটি থেকে পলাটা খুলে পড়ে গিয়েছিল। যতক্ষণ না সেটাকে খুঁজে পাওয়া গেল এবং আঙটিতে আবার লাগিয়ে নেওয়া হল, উনি অপরেশান শুরুই করলেন না। এটা আমি ওঁর ওপর একটা লেখায় পড়েছি।’
‘তাহলে তো বলতে হবে পলা আর গণেশ পুজোই আসল কাজটা করছে। উনি তাহলে কী করছেন?’
‘না, না। ব্যাপারটা অতটা খারাপ নয়। উনি যেটা পারেন, এবং যেটা ওঁর মতো আর কেউ পারে না, সেটা হল টিউমারটাকে কীভাবে অ্যাপ্রোচ করা হবে, মানে কোথা দিয়ে কাটলে টিউমারটার কাছে সব থেকে সহজে, সব থেকে নিরাপদে পৌঁছনো যাবে, সেটা ঠিক করা। এটার জন্য অসম্ভব ভাল কনসেপশান এবং ইম্যাজিনেশানের দরকার। তবু বলব, এই ধরনের অপরেশনে একটা বড় লাক ফ্যাক্টর থেকেই যায়।’ বলতে বলতে প্রদীপ চক্রবর্তীর গলাটা কেঁপে গেল।
‘রাখি চক্রবর্তীর বাড়ির লোক কে আছেন? একবার কথা বলে নিন, পেশেন্টকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’ একজন বয়স্কা নার্স ঘরে ঢুকে বললেন।
‘আমরা তিনজনেই যেতে পারি?’ কেয়া নার্সটিকে জিজ্ঞেস করল।
‘চলুন, তবে বেশি সময় নেবেন না। আর দেখবেন ওয়ার্ডে ঢোকার মুখে শু-কভার রাখা আছে। প্রত্যেকে জুতোয় শু-কভার লাগিয়ে নেবেন।
লাইন করে ওরা তিনজন ভিতরে ঢুকল। সবার আগে প্রদীপ চক্রবর্তী। সব শেষে, বাকিদের থেকে একটু দূরত্ব রেখে, আদিত্য। রুগির পোশাক পরা স্ট্রেচারে শোয়া রাখি চক্রবর্তীকে অন্য রকম দেখাচ্ছে। প্রদীপ চক্রবর্তী এগিয়ে গিয়ে স্ত্রীর হাত দুটো কিছুক্ষণ ধরে রইলেন। অস্পষ্টভাবে দুএকটা কথাও বললেন। কী বললেন, আদিত্য শুনতে পেল না। তারপর হাত ছেড়ে দিয়ে কেয়াকে বললেন, ‘তুমি রাখিকে কিছু বলবে?’
কেয়া হড়বড় করে অনেক কিছু বলে গেল। তার মোদ্দা বক্তব্য, এই অপরেশানটা কোনও ব্যাপারই নয়। কিছুদিনের মধ্যেই রাখি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসবেন। তখন আবার কোথাও এক সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া যাবে। কেয়ার কথা শুনে রাখি ম্লান হাসছেন।
আদিত্য কোনও কথা না বলে হাত তুলল। উত্তরে রাখি চক্রবর্তী আবার ম্লান হাসলেন। আদিত্যর মনে হল, কড়া সিডেটিভের প্রভাবে রাখি চক্রবর্তী ভাল করে কথা বলতে পারছেন না।
রাখি চক্রবর্তীকে নিয়ে অ্যাটেন্ডেন্টরা ওটিতে ঢুকে গেছে।
আদিত্য বলল, ‘দশ তলায় একটা ক্যাফেটিরিয়া আছে। কফি খেতে যাবেন, প্রদীপদা?’
প্রদীপ চক্রবর্তী বিষণ্ণ গলায় বললেন, ‘তাই চল।’
‘রাখির সঙ্গে আমার প্রথম আলাপের দিনগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে।’ প্রদীপ চক্রবর্তী যেন নিজের সঙ্গেই কথা বলছেন। ‘ফার্স্ট ইয়ারের প্রথম তিন-চার মাস রাখিকে তেমন চিনতাম না। আমি তখন গ্রামের ইস্কুল থেকে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে এসেছি। রাখি কলকাতার মেয়ে, হাজরার কাছে বেলতলা রোডে বাড়ি। ওর বাবা মা দুজনেই স্কুল শিক্ষক। রাখি আমাদের বার হায়ার সেকেন্ডারিতে এইটথ হয়েছিল।’
‘আপনিও তো হায়ার সেকেন্ডারিতে স্ট্যান্ড করেছিলেন, প্রদীপদা। রাখিদি আমাকে বলেছে।’ কেয়া বাধা দিয়ে বলল।
‘রাখি বলেছে? রাখি বলে থাকলে তো আমাকে কবুল করতেই হবে। হ্যাঁ আমিও একটা থ্যাঙ্ক করেছিলাম। থার্ড হয়েছিলাম। ছোটবেলায় ভাবতাম বড় হয়ে বিজ্ঞানী হব। ইস্কুলের মাস্টারমশাইরাও খুব উৎসাহ দিতেন। সেসব তো আর হল না। সে যাই হোক, রাখির কথা বলি। রাখিরা হাজরায় থাকত। হাজরা মোড় থেকে দুনম্বর বাস ধরে কলেজে আসত।’
‘আপনি তখন কোথায় থাকতেন?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘কলকাতায় আসার পর কয়েকদিন শ্যামবাজারের কাছে এক কাকার বাড়িতে থাকতাম। নিজের কাকা নয়, গ্রাম সম্পর্কে কাকা। কাকা চমৎকার মানুষ, কিন্তু তার বাড়িতে জায়গার প্রচণ্ড অভাব। আমি বুঝতে পারছিলাম ওদের খুব অসুবিধে হচ্ছে, কিন্তু কী করব, হিন্দু হস্টেলের এক দিকটা তখন সারাচ্ছে। তাই নতুন ছেলেদের হিন্দু হস্টেল জায়গা দিচ্ছে না। এইভাবে মাস তিনেক কাটার পর হরিশ মুখার্জি রোডের কাছে একটা মেস পাওয়া গেল। মেস বলতে একটাই ঘর, তার সঙ্গে একটা বাথরুম, এক চিলতে রান্নাঘর। ঘরে চারটে তক্তপোশ, তিনটেতে আশুতোষ কলেজের তিনটে ছেলে শোয়, একটা ফাঁকা। আমি সেটা দখল করলাম। আমিও হাজরা থেকে কলেজ যাবার বাস ধরতাম। আর সেটাই হল রাখির সঙ্গে আমার প্রথম আলাপের সূত্রপাত।’
‘বাসস্টপে প্রেম? এ তো পুরো ছোটি সি বাত। দেখেছেন ছোটি সি বাত? অমোল পালেকার, বিদ্যা সিনহা। বাসু চ্যাটার্জীর ছবি।’ কেয়া খুব মজা পেয়েছে।
‘আমার ভাই সিনেমা-টিনেমা তেমন দেখা হয়ে ওঠেনি।’ প্রদীপ চক্রবর্তীর গলাটা কিছুটা অপ্রস্তুত শোনাল। ‘তবে বাসস্টপে প্রেম ব্যাপারটা তুমি ঠিকই ধরেছ।’
আদিত্যর ফোনটা বাজছে। অচেনা নম্বর। আদিত্য বলল, ‘আমি বাইরে গিয়ে ফোনে কথা বলে আসছি।’
লিফটের সামনে এসে আদিত্য ফোনটা ধরল।
‘আমি সোমা মজুমদার বলছি, দীপশিখার মা। দীপশিখাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। আপনি জানেন?’ সোমা মজুমদারের গলাটা শুনে মনে হল ভদ্রমহিলা একেবারে ভেঙে পড়েছেন।
‘আমি জানি ম্যাডাম। আমি আমার মতো করে অ্যারেস্টটা আটকাবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পুলিশ বলছে ওদের হাতে খুব স্ট্রং একটা এভিডেন্স আছে। জজ সাহেবও পুলিশের কথা মেনে নিয়েছে। তাই বেলটা পাওয়া যায়নি।’
‘এভিডেন্সটা কী আপনি জানেন? দেখুন, আমার মেয়েকে আমি তো ছোট থেকেই চিনি। ওর পক্ষে কাউকে খুন করা জাস্ট সম্ভব নয়।’
‘আপনার কথা আমি বিশ্বাস করছি ম্যাডাম। বিশ্বাস না করলে আমি দীপশিখার বেলের জন্যে চেষ্টা করতাম না। আর এভিডেন্সটা ঠিক কী আমি জানি না। শুনেছি ওই রিসর্টের সিসি টিভিতে কিছু একটা দেখা গেছে। ঠিক কী দেখা গেছে এখনও জানি না। তবে একটা কথা। দীপশিখা যদি নির্দোষ হয়, তাহলে আজ না হোক কাল ও ছাড়া পাবেই। আপনি আমার ওপর ভরসা করতে পারেন।’
‘আপনার ওপরেই ভরসা করে আছি। দীপশিখাও আপনার ওপর খুব ভরসা করে। আপনি আমাদের বাঁচান, আদিত্যবাবু।’ সোমা মজুমদারের কথাগুলো আর্তনাদের মতো শোনাল।
‘আমার পক্ষে যতটা করা সম্ভব আমি করব। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।’
সোমা মজুমদারকে নিশ্চিন্ত থাকতে বলে আদিত্য নিজেই চিন্তিত হয়ে পড়েছে। সে তার মোবাইলটা থেকে ডিএসপি কৃষ্ণ পধির নম্বরটা খুঁজে বার করে কানেক্ট করল। রিং হয়ে যাচ্ছে, হয়েই যাচ্ছে। বেজে বেজে রিংটা থেমে গেল। কৃষ্ণ পধি হয় ব্যস্ত আছে আর না হয় ইচ্ছে করে আদিত্যর ফোনটা ধরছে না। দ্বিতীয়টা হবার সম্ভাবনাই বেশি। একটু চিন্তা করার পর আদিত্য গৌতমের ফোন নম্বরটা লাগাল।
‘বল, বল।’ গৌতমের ফোনটা একবারেই লেগে গেছে।
‘একটা কাজ করে দিবি?’
‘কাজ? কী কাজ? তোর জন্যে করব না এমন কাজ আছে নাকি?’ গৌতম হালকা মুডে আছে।
‘শোন, পুরীর কাছে গোল্ডেন রিসর্টে রিসর্টের মালিক অসীম দত্ত এবং তার ছোট ছেলে অনির্বাণ দত্ত কিছুদিন আগে খুন হল, তোর নিশ্চয় মনে আছে। এ-ব্যাপারে উড়িষ্যার পুলিশ কলকাতায় এসে অসীম দত্তর ছোট পুত্রবধূ অর্থাৎ অনির্বাণ দত্তর স্ত্রী দীপশিখাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে।
‘হ্যাঁ, আমি জানি। দীপশিখার অ্যান্টিসিপেটারি বেল কোর্ট রিজেক্ট করেছে।’ গৌতমের গলাটা এখন সিরিয়াস শোনাচ্ছে।
‘একদম ঠিক। পুলিশ হয়তো ঠিক কাজই করেছে। দীপশিখার পরিষ্কার একটা মোটিভ আছে। তাছাড়া উড়িষ্যা পুলিশের একটা সিসি টিভির ফুটেজ পেয়েছে যাতে সম্ভবত দীপশিখাকে খুনের জায়গার আশেপাশে ঘোরাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে। উড়িষ্যার পুলিশ এটাকে স্ট্রং এভিডেন্স মনে করে দীপশিখার এগেন্সটে কেস সাজাক, আমার কোনও আপত্তি নেই। আমার শুধু একটাই প্রশ্ন। খুনের সময় নাগাদ ওই সিসি টিভিতে দীপশিখা ছাড়া আর কাউকে দেখা গেছে কি? যদি দেখা যায় কাকে কাকে দেখা গেছে? সম্ভবত দত্তদের চেনে এমন কাউকে দেখা যায়নি তাই অন্য যাদের দেখা গেছে পুলিশ তাদের ইগনোর করছে। কিন্তু যাকে যাকে দেখা গেছে তাদের একটা লিস্ট আমার দরকার। হয়ত রিসর্টের অন্য কোনও গেস্টকে দেখা গেছে। তুই কি লিস্টটা আমাকে জোগাড় করে দিতে পারবি?’
‘তুই নিজে চেয়ে দেখেছিস? ওরা তো তোকে চেনে।’
‘চেনে ঠিকই, কিন্তু ডিএসপি পধি আমার ফোন ধরছে না। হয়তো ভাবছে আমি ওর পাকা ঘুঁটি কাঁচিয়ে দেব।’
‘হুঁ। লিস্টটা পাওয়া সোজা হবে না। আমি চেয়ে দেখব। কিন্তু নাও দিতে পারে।’
‘ঠিক বলেছিস। নাও দিতে পারে। যদি না দেয় তা হলে কোর্টকে বলতে হবে লিস্টটা দেবার জন্য পুলিশকে বলতে। তাতে একটু দেরি হয়ে যাবে। তুই যদি জোগাড় করে দিতে পারিস তা হলে কাজটা সহজ হয়ে যায়।’
ফোনটা পকেটে পুরে আদিত্য ওয়েটিং রুমে এসে দেখল ঘর ফাঁকা। শুধু কেয়া আর প্রদীপ চক্রবর্তী বসে আছে। দুজনকেই উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে।
আদিত্যকে দেখে কেয়া বলল, ‘প্রায় পাঁচ ঘণ্টা হয়ে গেল ডাক্তার এখনও ওটি থেকে বেরোল না। আমরা জিজ্ঞেস করতে নার্স বলল অপরেশন নাকি এখনও চলছে। কী অপরেশন করছে রে বাবা। অন্য পেশেন্টদের তো অপরেশন হয়ে গেল। তাদের বাড়ির লোকরাও সব চলে গেল।’
প্রদীপ চক্রবর্তী একেবারে চুপ করে গেছেন। হাতের বইটা মাঝে মাঝে পড়ার চেষ্টা করছেন। আবার নামিয়ে রাখছেন। বোঝাই যাচ্ছে মন বসছে না। গল্প করার মুড কারোরই আর নেই।
আরও মিনিট কুড়ি এইভাবে কাটার পর মুখে মাস্ক পরা, মাথায় ক্যাপ পরা মাঝারি উচ্চতার এক প্রৌঢ় ঘরে ঢুকলেন। আদিত্যদের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, ‘মে আই স্পিক টু রাখি চক্রবর্তীজ হাজবেন্ড, প্লিজ? আই অ্যাম ডক্টর অরুণ কুলকার্নি।’
‘ইয়েস। ইটস মি।’ প্রদীপ চক্রবর্তী এগিয়ে গেছেন।
‘দি অপরেশন ইজ ওভার। পেশেন্ট ইজ ইন দি রিকভারি রুম। শি উইল বি ট্রান্সফারড টু আইসিইউ আফটার এ ফিউ আওয়ারস।’
‘হাউ অয়াজ দ্য অপরেশন ডক্টর? হাউ ইজ দ্য পেশেন্ট?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘কান্ট সে এনিথিং বিফোর ফরটি এইট আওয়ারস। রাইট নাউ হার কনডিশান ইজ ক্রিটিকাল। আই অ্যাম নো গড। আই অ্যাম জাস্ট হিউম্যান। আই হ্যাভ মাই লিমিটেশন্স। বাট দিস মাচ আই ক্যান অ্যাশিয়োর ইউ, আই হ্যাভ ট্রায়েড মাই ভেরি বেস্ট।’
ডাঃ কুলকার্নি ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রদীপ চক্রবর্তী তার রাস্তা আটকে ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ডোন্ট ইউ হ্যাভ এনিথিং মোর টু সে?’
‘নট মাচ, আই অ্যাম অ্যাফ্রেড। এক্সসেপ্ট দ্যাট ইন দিজ কেসেস দেয়ার ইজ এ লেস দ্যান ফিফটি পারসেন্ট চান্স অফ সারভাইভাল। দ্য টিউমার ওয়াজ ইন এ প্রিটি ব্যাড শেপ।’
(৩)
আদিত্য মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিল, পাছে তারিখটা ভুলে যায়। অবশ্য তার দরকার ছিল না। সকালে উঠেই দিনটা আদিত্যর মনে পড়ে গেল। কেয়া ইতিমধ্যে উঠে পড়েছে। রান্নাঘরে চায়ের জল বসাচ্ছে। আদিত্য চুপিচুপি তার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। বলল, ‘হ্যাপি বার্থ ডে।’ তারপর কেয়াকে জড়িয়ে ধরে একটা জম্পেশ চুমু খেল।
আদিত্যর কবল থেকে ছাড়া পাবার পর কেয়া বলল, ‘ইশ। এখনও মুখ ধোওনি! যাও মুখ ধুয়ে এসো।’
একটু পরে ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে কেয়া আর আদিত্য দুপুরে কোথায় লাঞ্চ খেতে যাবে তার প্ল্যান করছিল। রাত্তিরের খাওয়াটা অবশ্য বাড়িতেই খাওয়া হবে। কেয়া কী সব রেসিপি শিখেছে, নিজে রান্না করবে। আদিত্য বলতে গিয়েছিল, নিজের জন্মদিনে কি কেউ নিজে রান্না করে? কেয়া পাত্তা দেয়নি। আদিত্যকে না জানিয়েই কেয়া গতকাল কই মাছ কিনেছে। পাঁঠার মাংস কিনেছে। তেল কই হবে। আর পাঁঠার কোর্মা। আদিত্যকে মানতেই হবে, কেয়া ক্রমশ পাকা গিন্নি হয়ে উঠছে।
গড়িয়াহাটের কাছে, হিন্দুস্তান পার্কে একটা নতুন চিনে রেস্টুরেন্ট হয়েছে। কেয়ার কলিগরা কেউ কেউ খেয়েছে সেখানে। বলছে, এদের রান্না নাকি খুবই ভাল। কেয়া সেখানেই লাঞ্চ খেতে চাইছে। চিনে খাবার আদিত্যর একটু একঘেঁয়ে লাগে। কিন্তু জন্মদিনটা যেহেতু কেয়ার তাই তার পছন্দটাই মেনে নিতে হবে। তাছাড়া কেয়ার যুক্তি, চিনে খাবার তাড়াতাড়ি হজম হয়ে যায়। অতএব দুপুরে চিনে খেলে রাত্তিরে তেল কই, পাঁঠার মাংস খাবার জন্যে ভাল রকম খিদে হয়ে যাবে।
আজ বুধবার। এমনিতে কেয়ার ইস্কুল খোলা থাকার কথা, কিন্তু ভাগ্যবশত আজ শিবরাত্রি পড়েছে। কেয়াদের বাংলা ইস্কুলে বড় ক্লাশের মেয়েরা অনেকে শিবের মতো বর পাবার আশায় শিবরাত্রির দিন উপোস করে। তাই আজ ইস্কুল ছুটি।
কেয়ার ভাড়া করা গাড়ি এল বেলা বারোটায়। বেরোতে বেরোতে সাড়ে বারোটা। রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিন। দুপুরে শহরের রাস্তায় যানবাহন বেশি বলে ট্র্যাফিক কিছুটা মন্থর। আদিত্য ভাবছিল, জন্মদিনে কেয়াকে কী দেওয়া যায়? সে কেয়াকে জিজ্ঞেস করল, ‘শাওনি বলে কোনও বুটিকের কথা জান?’
‘নাম শুনেছি, কখনও যাইনি। বোধহয় গড়িয়াহাটের কাছে কোথাও একটা।’
‘হিন্দুস্থান পার্কে। আমরা যেখানে খেতে যাচ্ছি তার কাছাকাছি কোথাও হবে।’
‘বাব্বা, তুমি এত জানলে কী করে? আমিই তো জানিই না কোথায়।’
‘লাঞ্চ খেয়ে আমরা আজ যাব সেখানে। তোমাকে একটা শাড়ি কিনে দেব।’
‘ওখানে কেন? ওসব জায়গায় খুব দাম নেয়। জিনিসটা হয়তো ভালই দেয় কিন্তু যা দাম হওয়া উচিত তার থেকে অনেক বেশি দাম নেয়। তার চেয়ে গড়িয়াহাটের মোড়ে অনেক ভাল দোকান আছে। সেখানে যাব।’
‘একবার গিয়ে দেখি না। যদি দেখি খুব দাম তা হলে কিনব না। কিন্তু আমার মনে হয় আমার কাছে বেশি দাম নেবে না।’
‘তোমার কাছে বেশি দাম নেবে না? তুমি কে যে তোমার কাছে বেশি দাম নেবে না?’
‘আমি? আমি হলাম গিয়ে কেয়া বাগচির স্বামী। সেটা বললেই দাম কমিয়ে দেবে।’
‘ইয়ার্কি মেরো না। অকারণে খরচ করতে আমার খুব গায় লাগে।’
‘আরে চিন্তা করছ কেন? গিয়েই দেখা যাক না।’
কেয়া চুপ করে গেল। একটু চটেছে। গাড়ি পার্ক সার্কাসের সাতমাথায় দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ। এবার ছাড়বে।
রেস্টুরেন্টের নাম ওয়ান ফ্যান। খাবারটা বেশ ভাল। খেতে খেতে আদিত্য মোবাইলে গুগল করে দেখল, ওয়ান ফ্যান কথাটার অর্থ সাপার। মেন কোর্সের আগের ক্লিয়ার সুপটা স্বর্গীয়। পরে যে পোর্ক রিবসটা এল সেটাও অতি চমৎকার। কিন্তু চিকেনটা সাদামাটা। তবে স্কুইডস-এর ডিশটা চমৎকার উতরে গেছে। গুরুভোজন হয়ে গেল। আদিত্য ভাবছিল, ভাগ্যিস চিনেরা ডেসার্ট বানাতে পারে না, এর ওপর ডেসার্ট খেতে হলে অসুবিধে হত। কেয়া অবশ্য আইসক্রিম খেল, প্লেন ভ্যানিলা। আদিত্য শুধু কফি।
ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করে আদিত্য জানতে পারল শাওনি বলে বুটিকটা চার-পাঁচটা বাড়ি পরে, উল্টোদিকের ফুটপাতে। যেটা কেয়াকে বলা হয়নি, শাওনির মালিক ঊর্মিমালা মিত্রকে আদিত্য ফোন করে বলে রেখেছে সে আড়াইটে-তিনটে নাগাদ ঊর্মিমালার দোকানে সস্ত্রীক হাজির হচ্ছে।
দোকানটা ছোট, ছিমছাম। দরজার ওপরে ঘন্টা লাগানো আছে। দরজা খুললেই সেটা টুংটাং করে বেজে ওঠে। আদিত্যরা ঢুকতেও বেজে উঠল। ভিতরটা বেশ সাজানো গোছানো। একটা হালকা ধূপের গন্ধ বাতাসে ভাসছে। খদ্দের বিশেষ নেই। শুধু একজন মাঝবয়েসি মহিলা এক কোণে কিছু একটা বাছাবাছি করছেন। আদিত্যদের দেখে যে এগিয়ে এল সে নিশ্চয় ঘণ্টার শব্দ শুনেছে। অল্পবয়সি বিক্রয়-সেবিকা।
‘একটা শাড়ি কিনব। ঢাকাই মসলিন, কাঁথা স্টিচ বা বালুচরী। একটু দেখাবেন?’ আদিত্য ইন্টারনেট থেকে রীতিমতো হোমওয়ার্ক করে এসেছে। কেয়া অবাক, অভিভূত।
‘এই কাউন্টারটায় আসুন।’ মেয়েটি দু’পা এগিয়ে গিয়ে কেয়ার দিকে ফিরে বলল, ‘এঁর জন্যে তো?’
আদিত্য ঘাড় নাড়ল। সে আন্দাজ করার চেষ্টা করছিল বুটিকের মালকিন ঊর্মিমালা মিত্র কোথায় আছেন। ক্যাশ কাউন্টারের পেছনে একটা দরজা রয়েছে। দরজা খুললে সম্ভবত দোকানের আপিসঘরে যাওয়া যায়। হয়ত ঊর্মিমালা সেখানে বিশ্রাম করছেন।
মেয়েটি গোটা পাঁচেক শাড়ি কাউন্টারে নামিয়ে ফেলেছে। একটা ঢাকাই, দুটো বালুচরী, দুটো কাঁথা স্টিচ। ‘তুমি পছন্দ কর।’ আদিত্য কেয়াকে বলল।
‘তুমিও দেখ। তোমার কোনটা পছন্দ?’
‘আমাকে যদি জিজ্ঞেস কর, আমি বলব ঢাকাইটা একটু লাউড আর কাঁথা স্টিচটা একটু ম্যাড়ম্যাড়ে। বালুচরীর মধ্যেই পছন্দ করা যাক।’
‘খুব দাম তো!’ কেয়া নিচু গলায় বলল। যে দুটো বালুচরী কাউন্টারে রয়েছে তার একটার দাম এগার হাজার ন’শ নিরানব্বই, অন্যটা বারো হাজার চারশো নিরানব্বই।
আদিত্য ভাবছিল, সব কিছুরই আজকাল বাটার জুতোর স্টাইলে দাম। সে মুখে বলল, ‘দাম নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি শাড়ি পছন্দ কর।’
মিনিট দশেক পরে যখন কেয়ার পছন্দ একটা সবুজ, একটা গাঢ় নীল আর একটা কালো বালুচরীর মধ্যে সীমিত হয়ে এসেছে, পিছন থেকে এক মহিলার কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘আপনার রঙে কিন্তু কালোটাই সব থেকে মানাবে ম্যাডাম।’ আদিত্য ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার আগেই টের পেল, ঊর্মিমালা মিত্র।
এবার সে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ‘ভাল আছেন?’
‘ভাল আছি।’ বলে ঊর্মিমালা কেয়ার দিকে তাকাল।
‘আমার স্ত্রী কেয়া, আর ইনি ঊর্মিমালা মিত্র, শাওনি বুটিকের কর্ত্রী।’ আদিত্য মৃদু হাসল।
কেয়া বেশ অবাক হয়েছে। সে একবারও ভাবেনি আদিত্য সত্যি সত্যি শাওনি বুটিকের মালিককে চেনে।
‘আপনার কথা মতো কালোটাই বেছে নিলাম।’ আদিত্য বলল।
‘শাড়িটা প্যাক করে দাও।’ ঊর্মিমালা কাউন্টারের মেয়েটিকে চুপিচুপি আরও কিছু বলল। ‘একটু কফি খেতে আপত্তি নেই তো?’ শেষ কথাগুলো কেয়ার উদ্দেশে।
আদিত্য ঠিকই আন্দাজ করেছিল। ক্যাশ কাউন্টারের পেছনে ঊর্মিমালার অফিস। এটাও বেশ ছিমছাম। সেক্রেটারিয়েট টেবিল এবং তার সংলগ্ন কয়েকটা চেয়ার ছাড়াও এক দিকে সোফাসেট। ঊর্মিমালা আদিত্যদের সেখানে বসাল।
ঘরে একটা সিসি টিভির মনিটর রয়েছে। দোকানে কী হচ্ছে এখানে বসে মনিটরে সব দেখা যায়। সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে ঊর্মিমালা বলল, ‘আপনাদের অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করছিলাম। মগ্ন হয়ে শাড়ি বাছাই করছিলেন বলে বিরক্ত করতে চাইনি।’
‘আপনাকে দু’একটা জিনিস জিজ্ঞেস করার ছিল। আমার স্ত্রীর সামনে জিজ্ঞেস করলে আপত্তি নেই তো? অবশ্য কেয়া কিছুই জানে না, তাই কিছুই বুঝবে না।’
‘ঠিক আছে, বলুন।’ একটু ইতস্তত করে ঊর্মিমালা বলল। তার মুখে মৃদু আশঙ্কার ছাপ পড়েছে।
‘আমার প্রথম প্রশ্ন, আপনি যেদিন মণিময় গুপ্তর বাড়ি গিয়ে তাকে পেলেন না বলে ফিরে এলেন, সেই তারিখটা কি আপনার মনে আছে? ভাল করে ভেবে বলুন।’
‘এমনিতে আমার তারিখ-টারিখ একেবারেই মনে থাকে না, কিন্তু এক্ষেত্রে মনে হচ্ছে চেষ্টা করলে মনে করতে পারব।’ ঊর্মিমালা ভাবতে ভাবতে বলল।’একত্রিশে ডিসেম্বর শান্তনুদের ক্লাবে সারা রাত্তির পার্টি ছিল। পরের দিন, মানে ফার্স্ট জানুয়ারি, বিকেলের ফ্লাইটে শান্তনু বম্বে চলে গেল। বম্বে পোর্ট থেকে ওর জাহাজ ছাড়ল তারও পরের দিন, অর্থাৎ সেকেন্ড জানুয়ারি। থার্ড জানুয়ারি আমি বুটিকে এলাম। অনেকগুলো কাজ ছিল। ভেবেছিলাম এক মাস থাকব না, তাই কাজগুলো সেরে নেওয়া দরকার। মণিময়ের সঙ্গে সেদিন সকালেও কথা হয়েছিল। মণিময় তখন নরেন্দ্রপুরের বাড়িতে চলে এসেছে। বলল, এক্ষুনি মাছ ধরতে যাবে। ঠিক হল, আমি পরের দিন, মানে চার তারিখ নরেন্দ্রপুরে যাব। সেই কথা মতো আমি চার তারিখ সকালে নরেন্দ্রপুরের বাড়িতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখলাম মণিময় নেই।’
‘তার মানে মণিময়ের সঙ্গে আপনার শেষ কথা হয়েছিল তিন তারিখে। তাই তো?’
‘হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে।’
‘কটার সময় কথা হয়েছিল মনে আছে?’
‘সকাল বেলা। ঠিক কটায় মনে নেই। তবে এইটুকু মনে আছে, আমি বুটিকে বেরোনোর আগে মণিময়ের ফোনটা এসেছিল।’
‘ঠিক আছে, ওতেই হবে। আর একটা প্রশ্ন। পুলিশ কি আপনার কাছে এসেছিল?’
‘এসেছিল। আবার আসবে বলেছে। রাত্তিরে দুশ্চিন্তায় ঘুম হয় না।’ ঊর্মিমালার গলায় উদ্বেগের ছায়া।
‘আপনার স্বামী কবে কলকাতায় আসছেন?’
‘জুলাইতে এসে মাস দুয়েক থাকার কথা।’
‘ঠিক আছে। দেখি কী করা যায়।’
বেয়ারা কফি নিয়ে ঢুকেছে। সঙ্গে কিছু সৌখিন বিস্কুট। তার ঠিক পেছনে পেছনে শাড়ির প্যাকেট ও ক্যাশমেমো সহ কাউন্টারের সেই বিক্রয়-সেবিকা। তার হাতে একটা ক্রেডিট কার্ড সোয়াইপ করার যন্ত্র।
‘আপনি ক্রেডিট কার্ডে দিতে পারেন ভেবে এটা নিয়ে এলাম।’ মেয়েটি হাতের যন্ত্রটা দেখিয়ে বলল।
দাম দিতে গিয়ে আদিত্যর চক্ষু চড়কগাছ। যা দাম লেখা ছিল তার প্রায় অর্ধেক দাম চার্জ করা হয়েছে।
‘সে কী! এই দামটা তো লেখা ছিল না!’ আদিত্য রীতিমতো বিব্রত।
‘যে দামটা লেখা ছিল সেটা তো বুটিকের কাস্টমারদের জন্যে। যারা বেশি দাম দেবার জন্যে মুখিয়ে আছে। আমার বুটিকে যারা আসে তাদের সমস্যা টাকা কী করে খরচ করবে। তাই দাম-টামগুলো একটু বাড়িয়ে রাখতে হয়। বেশি দাম না হলে আমার কাস্টমারদের মন ওঠে না। আপনার কাছে যে দামটা চাইছি সেটা আমার কস্ট প্রাইস।’
‘কস্ট প্রাইস? তাহলে তো আপনার কোনও প্রফিটই রইল না।’
‘নাই বা রইল প্রফিট। সব জায়গায় প্রফিট করতে নেই।’ ঊর্মিমালা মিষ্টি করে হাসল।
আদিত্য আর কেয়া যখন শাওনি বুটিক থেকে বেরোল তখন প্রায় চারটে বাজে।
আদিত্য বলল, ‘তোমাকে তো বাড়ি গিয়ে রান্না করতে হবে। তুমি বাড়ি ফিরে যাও, আমি দুএকটা কাজ সেরে ফিরছি।’
‘কোথায় যাবে?’ আদিত্য ওর সঙ্গে ফিরবে না শুনে কেয়া একটু ক্ষুণ্ণ হয়েছে।
‘রাজারহাট নিউটাউনে অসীম দত্তর আপিসে একবার যেতে হবে। চন্দ্রিমা সেন বলে ওঁর এক পার্সোনাল সেক্রেটারি ছিল, তার সঙ্গে পাঁচটায় দেখা করব বলেছি। ওদের কোম্পানির অ্যাকাউন্টসটা একবার দেখতে হবে। আমার বেশিক্ষণ লাগবে না। সাতটা-সাড়ে সাতটার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসব।’
‘তা হলে আমি তোমাকে নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছি। একটু ঘুরপথ হবে, কিন্তু গাড়ি ছাড়া তুমি যাবে কী করে।’
‘তুমি নামিয়ে দিয়ে গেলে তো খুবই ভাল হয়। তোমার সঙ্গে আর একটু সময়ও কাটানো যাবে।’
গাড়িতে উঠতে না উঠতে আদিত্যর মোবাইলটা বেজে উঠল। অনিতা চৌধুরি ফোন করেছে।
‘আদিত্যবাবু, রাখিদির খবরটা জানার জন্যে আপনাকে ফোন করলাম। আপনারা তো অপরেশনের সময় ছিলেন। কেমন হল অপরেশান?’ অনিতাকে আন্তরিকই মনে হল।
‘অপরেশান তো যা হবার হয়ে গেছে। রাখিদির অবস্থা এখনও ক্রিটিক্যাল। ডাক্তার বলছেন, লেস দ্যান ফিফটি পারসেন্ট সারভাইভালের চান্স।’
‘তা হলে তো বেশ চিন্তার কারণ আছে।’ অনিতাকে সত্যি সত্যিই চিন্তিত শোনাল।
‘হ্যাঁ, চিন্তার কারণ অবশ্যই আছে। কিন্তু একটা কথা না জিজ্ঞেস করে পারছি না। সেদিন হাসপাতালে গেলেন না কেন? আজ আবার প্রদীপদাকে জিজ্ঞেস না করে আমাকে জিজ্ঞেস করছেন রাখিদি কেমন আছে। ব্যাপারটা কী?’
ওপারে খানিকক্ষণ নীরবতা। তারপর অনিতা চৌধুরি ধীরে ধীরে বলল, ‘কিছুদিন আগে সমীরের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা নিয়ে প্রদীপদা হঠাৎ এমন একটা কমেন্ট করলেন যে আমার রাগ হয়ে গেল। আমিও দুকথা শুনিয়ে দিলাম। সেই থেকে প্রদীপদার সঙ্গে কথা বন্ধ। রাখিদি সুস্থ থাকলে ঠিক মিটমাট করিয়ে দিত। আমি আপনাদের কাছ থেকেই রাখিদির খবর নেব, কেমন?’
গাড়ি বিজন সেতু পেরিয়ে কসবা কানেক্টারে পড়েছে। আবার আদিত্যর ফোনটা বেজে উঠল। এবার গৌতম।
‘শোন, উড়িষ্যা পুলিশের কাছে খবর নিয়েছি। সিসি টিভির গল্পটা ঠিক নয়। ওই রিসর্টে সিসি টিভি এখনও বসেইনি।’
‘তা হলে উড়িষ্যা পুলিশের কাছে দীপশিখার এগেন্সটে কী এমন ইনক্রিমিনেটিং এভিডেন্স আছে যাতে ওর অ্যানটিসিপেটারি বেল রিফিউজড হল?’ আদিত্য বেশ বিভ্রান্ত।
‘শ্বেতা মল্লিক বলছে সে নাকি অসীম দত্ত খুন হবার রাত্তিরে দীপশিখাকে অসীম দত্তর অফিসে ঢুকতে দেখেছে। আর অনিকেত দত্ত বলছে অনির্বাণ দত্ত খুন হবার একটু আগে সে দেখেছে দীপশিখা সেই ঘরটার দিকে যাচ্ছিল যে ঘরে অনির্বাণ খুন হয়। দুজন সাক্ষীই বলছে তারা যে দীপশিখাকে দেখছে সেটা হয়তো দীপশিখা খেয়াল করেছিল। যে দুটো খুন করে ফেলেছে সে আরও খুন করতেই পারে। তাই দীপশিখা ছাড়া থাকলে দুজনেই আনসেফ বোধ করবে। এইসব শুনে জজ সাহেব বেলের আবেদন নাকচ করে দিয়েছেন।’
(৪)
অসীম দত্তর অফিসটা বেশ বড়। সাজানো। আধুনিক রিসেপশান, করিডোর, লিফট, লম্বা হলের মধ্যে ছোট ছোট কিউবিকল, যেমন বড় কর্পোরেটগুলোতে হয়। আদিত্য শুনেছিল, অসীম দত্তর অবর্তমানে অনিকেত দত্ত অফিসের কর্তৃত্ব নিয়েছে। তবে রোজ আসতে পারে না। তার নিজেরও তো একটা কোম্পানি আছে। তবে সেই কোম্পানির অবস্থা ভাল নয়।
চন্দ্রিমা সেন মাঝবয়সি মহিলা, গম্ভীর স্বভাবের, চোখে ভারী চশমা। তিনি আদিত্যকে একটা ছোট ঘরে বসালেন যেখানে সম্ভবত কোম্পানির ক্লায়েন্টরা অপেক্ষা করে। চন্দ্রিমা জানালেন, অনিকেত দত্ত সকালে এসেছিলেন, দুপুরবেলা বেরিয়ে গেছেন।
‘আপনার সার্ভিসটার ব্যাপারে কথা বলতে হবে। মানে আপনার ইনভেস্টিগেশনটার ব্যাপারে। সিনিয়ার মিঃ দত্ত আপনাকে এমপ্লয় করেছিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, তাঁর ওপর যে মার্ডার অ্যাটেম্পট হয়েছিল আপনি সেটা ইনভেস্টিগেট করবেন। আর তাঁর যদি কোনও কারণে আনন্যাচারাল ডেথ হয় তা হলে সেটারও আপনি তদন্ত করবেন। আমরা শুনেছি মিঃ দত্তর মার্ডার চার্জে পুলিশ দীপশিখা চৌধুরিকে অ্যারেস্ট করেছে। তা হলে কি আমরা ধরে নিতে পারি না মিঃ দত্তর মার্ডার কেসটা সলভড হয়ে গেছে?’
‘না পারি না। আমি নিশ্চিত পুলিশ ঠিক লোককে ধরতে পারেনি। কিন্তু সে যাই হোক, আমার ধারণা আমি কেসটা প্রায় সলভ করে ফেলেছি। তার মানে আমি আর আমার সার্ভিসের জন্যে অ্যাডিশানাল কোনও বিল করছি না। যেটুকু সার্ভিস আমি দিয়েছি তার বিলটা আমি পাঠিয়ে দেব। শুধু একবার আপনাদের কোম্পানির অ্যাকাউন্টসগুলো আমার দেখা দরকার। এটা আমার ইনভেস্টিগেশনটা ওয়াইন্ড আপ করার জন্যে দরকার। আমার ইনভেস্টিগেশনের রিপোর্ট আমি মাসখানেকের মধ্যে আপনাদের পাঠিয়ে দেব। পুলিশকেও একটা কপি দেব। যদি তারা কোনও অ্যাকশান নেয়। কিন্তু আপাতত একবার আপনাদের অ্যাকাউন্টসটা দেখা দরকার। অসীম দত্ত আমাকে বলে গিয়েছিলেন তাঁর মৃত্যু হলে সবরকম অ্যাক্সেস আমি পাব। আপনাকেও হয়তো বলে গিয়েছিলেন।’
‘বলেছিলেন, ঠিকই। কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারছি না অ্যাকাউন্টসটা আপনাকে দেখানো ঠিক হবে কিনা।’
‘কেন ঠিক হবে না? এটা তো অডিটেড অ্যাকাউন্টস। আপনাদের অ্যানুয়্যাল রিপোর্টে তো এটা বেরিয়েছে। তার মানে, এটা তো পাবলিক নলেজ। আমি শুধু একটু ডিটেলগুলো দেখতে চাই যেটা অ্যানুয়্যাল রিপোর্টে পাব না।’
‘ঠিক আছে। দেখুন। আমি আপনাকে অ্যাক্সেস কোডটা বলে দিচ্ছি। আপনি ওই কম্পিউটারটার থেকেই অ্যাক্সেস করতে পারবেন।’ চন্দ্রিমা সেন ঘরের কোণে রাখা একটা ডেস্কটপের দিকে আদিত্যর দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন।
আদিত্য অসীম দত্তর আপিস থেকে বেরিয়ে দেখল অন্ধকার নেমে গেছে। রাজারহাটের এদিকটায় এমনিতেই লোকজন কম থাকে, আপিস-কাছারিও খুব বেশি নেই, এখন সন্ধেবেলা রাস্তাঘাট একেবারে খাঁখাঁ করছে। শুধু সেই লাল রঙের গাড়িটা রাস্তার এক ধারে এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে। সকাল থেকেই আদিত্য খেয়াল করছিল লাল গাড়িটা তাদের ফলো করছে। কেয়া ভয় পাবে বলে আদিত্য তাকে কিছু বলেনি।
দুপুরে লাঞ্চ খেতে খেতে জানলা দিয়ে আদিত্য দেখতে পাচ্ছিল তাদের ভাড়া গাড়িটার থেকে একটু দূরে লাল গাড়িটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। গাড়ির ড্রাইভার খবর কাগজ পড়ছে। পেছনের সিটে একটা লোক ব্যাকসিটে হেলান দিয়ে আছে। বোধহয় ঘুমোচ্ছে।
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরনোর সময় আদিত্য খেয়াল করল পেছনের সিটের লোকটাও উঠে বসেছে। আদিত্য আর কেয়া যখন হাঁটতে হাঁটতে শাওনি বুটিকের দিকে এগোচ্ছে তখন পেছনের সিটের লোকটা গাড়ি থেকে নেমে তাদের পেছন পেছন আসছিল। বুটিকে ঢোকার আগে আদিত্য এক ঝলক তার চেহারাটা দেখে নিয়েছিল। মাঝারি উচ্চতা, মাঝারি স্বাস্থ্য, গায়ের রংও মাঝারি, না খুব ফরসা না খুব কালো। মুখের আদলও একেবারে সাদামাটা, মুখাবয়বে এমন কিছু নেই যেটা মনে রাখা যায়। সব মিলিয়ে, লোকটা যদি ভিড়ের মধ্যে চট করে মিলিয়ে যায়, তা হলে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
বুটিক থেকে বেরিয়ে আদিত্য খেয়াল করল গাড়িটা তখনও দাঁড়িয়ে আছে। কেয়া যখন অসীম দত্তর সল্ট লেকের অফিসে আদিত্যকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল আদিত্য চোখের এক কোণ দিয়ে ঠাহর করল লাল গাড়িটা রাস্তার ধারে এসে দাঁড়িয়েছে। এর পর অসীম দত্তর অফিসে কাজ করতে করতে সিগারেট খাবার অছিলায় আদিত্য কয়েকবার বাইরে এসে দেখেছে গাড়িটা ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। একটা জিনিস ভেবে আদিত্য নিশ্চিন্ত হল। গাড়িটা বা তার ভিতরের লোকটা তাকে ফলো করছে, কেয়াকে নয়।
এখন সন্ধেবেলা নির্জন রাস্তায় গাড়িটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আদিত্যর ষষ্ঠেন্দ্রিয় তাকে জানাল, বিপদ আছে। এই ষষ্ঠেন্দ্রিয় আদিত্যকে বহুবার বাঁচিয়েছে। আদিত্যকে দেখে সেই লোকটা গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে। লোকটাকে দেখে আদিত্য আবার অফিসের ভিতরে ঢুকে গেল। অসীম দত্তর অফিস প্রায় ফাঁকা। রিসেপশানেও কেউ নেই। শুধু দুএকজন সিকিউরিটি গার্ড ঘোরাফেরা করছে। আদিত্যকে আবার অফিসে ঢুকতে দেখে একজন সিকিউরিটি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে এগিয়ে এল।
‘একটা উবার ডাকব। না হলে অনেকটা হাঁটতে হবে। এখান থেকে বাস স্টপ তো অনেকটা।’ আদিত্য কৈফিয়ত দেবার মতো করে বলল।
সিকিউরিটি ছেলেটা অমায়িক। বলল, ‘ডাকুন না। ওখানে বসে ডাকুন।’
যেহেতু আদিত্য খুব বেশি ট্যাক্সি চড়ে না, উবার ডাকার ব্যাপারে সে একটু নড়বড়ে। মিনিট পাঁচেক চেষ্টার পর একটা মেসেজ এল, কুড়ি মিনিটের মধ্যে গাড়ি চলে আসছে। এখন কুড়ি মিনিট আদিত্যকে অপেক্ষা করতে হবে।
সিকিউরিটির ছেলেটাকে আবার ফিরে আসতে দেখে সে বলল, ‘কুড়ি মিনিট বসতে হবে। তার আগে গাড়ি আসছে না।’
ছেলেটা হালকা হাসল। রিসেপশান কাউন্টারের পেছনে গিয়ে তার হাতের বোতলটা জল ভরার জন্যে ওয়াটার পিউরিফায়ারের নিচে রাখল। আদিত্য আগে খেয়াল করেনি রিসেপশানের পেছনে একটা ওয়াটার পিউরিফায়ার আছে।
আদিত্য কেয়ার ফোনটা লাগাল। ”তাড়াতাড়ি বল কী বলবে। রান্না বসিয়েছি। পুড়ে যাবে।’
‘বলার কিছু নেই। যে আপিসটার সামনে আমায় নামিয়ে দিলে এখনও ওখানেই বসে আছি। কাজ হয়ে গেছে। উবার আসার জন্যে অপেক্ষা করছি। বলছে, আসতে কুড়ি মিনিট লাগবে।’
‘তবু ভাল উবার বলেছ। হেঁটে হেঁটে বাস স্টপ যাবার চেষ্টা করনি। বসে থাক, যতক্ষণ না উবার আসে। আমি রাখছি। মাংস ধরে যাবে।’
বসে থাকতে থাকতে আদিত্যর বিরক্ত লাগছিল। একবার দরজা দিয়ে বেরিয়ে দেখল লাল গাড়িটা সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির চালক এবং আরোহী গাড়ির বনেটের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। আদিত্যকে দেখে সচকিত হয়ে উঠল। তাদের সচকিত দেখে আদিত্য আবার আপিসের ভিতরে ঢুকে পড়ল।
সিকিউরিটি ছেলেটা আর একটা বোতলে জল ভরছে। আদিত্য তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার কি নাইট ডিউটি?’ ভাবল, ছেলেটার সঙ্গে কিছুটা খেজুর করলে হয়তো সময়টা কেটে যাবে।
‘এমনিতে আমার সকালের ডিউটি। আটটা থেকে আটটা। রাত্তির আটটায় দুজন এসে আমাদের রিলিজ করে দেয়। কিন্তু আজ রাত্তিরের একজন আসবে না। আমাকে তাই ডবল ডিউটি করতে হবে।’ ছেলেটার গলায় কিন্তু তেমন আপত্তির সুর নেই।
‘রাত্তিরে খান কোথায়?’
‘সেটাই তো মুশকিল। এখানে রাত্তিরে খাবার কোনও জায়গা নেই। যারা রাত্তিরে ডিউটি করে তারা টিপিন নিয়ে আসে। আমি তো জানতাম না রাত্তিরের ডিউটি করতে হবে। তাই খাবার-টাবার কিছু আনিনি।’
‘তাহলে কী হবে?’
‘দেখি কী করা যায়। এখান থেকে মিনিট পনেরো হাঁটলে একটা দোকান আছে, রুটি-তরকারি বানায়। ওদিকটায় অনেক কনস্ট্রাকশান হচ্ছে তো, মিস্তিরিরা রাত্তিরে থাকে। তাদের জন্যে বানায়। ওখানে গেলে হয়তো পেয়ে যাব।’
‘আমি তো উবার ধরে বড়রাস্তায় গিয়ে উঠব। রুটির দোকানটা যদি আমার পথে পড়ে তা হলে আমি আপনাকে নামিয়ে দিতে পারি। আপনার এক পিঠের হাঁটাটা বেঁচে যাবে।’
‘তা হলে তো দাদা খুবই ভাল হয়। আমি বরং আমার পার্টনারকে বলে আসি রুটি কিনতে যাচ্ছি। আপনার ট্যাক্সিটা বোধহয় এবার এসে যাবে।’
ছেলেটা তার সহকর্মীকে বলতে ভেতরে গেল। আদিত্যর মোবাইলে একটা মেসেজ এসেছে। আদিত্য দেখল গাড়ি এসে গেছে।
উবারটা একেবারে গেটের মুখে দাঁড়িয়েছে। আদিত্য ইচ্ছে করেই সিকিউরিটি ছেলেটার পেছনে পেছনে থাকছে যাতে লাল গাড়ির লোকটা তাকে ভাল করে দেখতে না পায়। উবার আর লাল গাড়ির মধ্যে একটা গাছের আড়ালও আছে। উবারের কাছে পৌঁছে আদিত্য হঠাৎ গতি বাড়িয়ে দরজা খুলে গাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল। সিকিউরিটি ছেলেটা তখনও বাইরে।
ড্রাইভারকে আদিত্য বলল, ‘এই ছেলেটাকে একটু তুলে নেব? ও এই মোড়ের মাথায় নেমে যাবে।’
‘আমাদের দুটো ডেস্টিনেশনে যাবার নিয়ম নেই। একটা পয়েন্ট থেকে প্যাসেঞ্জার তুলব, আরেকটা পয়েন্টে নামিয়ে দেব, এটাই নিয়ম।’
‘বুঝতে পারছি। কিন্তু উনি তো তিন মিনিটের মধ্যে নেমে যাবেন।’
‘তিন মিনিট হোক, দুমিনিট হোক আমি দুটো জায়গায় প্যাসেঞ্জার নামাতে পারব না।’ কথা বলতে বলতে ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিয়েছে।
‘ঠিক আছে দাদা, আমাকে নিয়ে ভাববেন না। আমি এটুকু হেঁটে চলে যাচ্ছি।’ সিকিউরিটি ছেলেটা বেজার মুখে বলল।
‘ঠিক আছে। আমি আর কী করব বলুন? এ তো আপনাকে কিছুতেই নেবে না মনে হচ্ছে।’ ড্রাইভারের ওপর আদিত্যর বেশ রাগ হচ্ছিল।
উবার চলতে আরম্ভ করেছে। লাল গাড়িটা যেদিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিল উবার তার উল্টোদিক দিয়ে গিয়ে বড় রাস্তায় পড়ল। লাল গাড়ি পেছন পেছন আসছে।
ফাঁকা রাস্তা ধু-ধু করছে। ল্যামপোস্টের আলোয় রাস্তাঘাট আলোকিত। কিন্তু আলো ঝলমলে রাস্তায় মানুষ বা যানবাহন নেই বলে রাস্তাটা ভূতুড়ে লাগছে। লাল গাড়ি আর উবারের দূরত্ব ক্রমশ কমে আসছে। লাল গাড়ি গতি বাড়িয়ে ডানদিকে উবারের একেবারে পাশে চলে এসেছে। দুটো গাড়ির গতিই প্রায় আশি কিলোমিটার।
উবারের ড্রাইভার গতি কমিয়ে লাল গাড়িকে এগিয়ে যেতে বলছে। তবু লাল গাড়ি উবারকে ওভারটেক না করে তার পাশাপাশি চলছে। উবারের ড্রাইভার লাল গাড়ির ড্রাইভারের উদ্দেশে একটা অশ্রাব্য গালাগালি দিয়ে উঠল। লাল গাড়ির ড্রাইভারের ভ্রুক্ষেপ নেই। এখনও দুটো গাড়ি পাশাপাশি চলছে। উবারের গতি কমে গিয়ে এখন পঞ্চাশ কিলোমিটার। লাল গাড়িরও তাই।
আদিত্য জানলার কাঁচ তুলে দিয়েছে। লাল গাড়ির আরোহী তার জানলার কাচ নামিয়ে রেখেছে। আদিত্য দেখল লাল গাড়ির আরোহী এবার একটা রিভলভর বার করল। সে আদিত্যর দিকে রিভলভর তুলে তাক করছে। আদিত্য এক মুহূর্তের মধ্যে গাড়ির মেঝেতে শুয়ে পড়ল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে লাল গাড়ির আরোহী আদিত্যর উদ্দেশে পরপর অনেকগুলো গুলি চালাল।
উবারের জানলার কাচ ঝনঝন করে ভেঙে পড়েছে। উবারের ড্রাইভার গাড়ির নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছে। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উবার ডানদিকে সরে গিয়ে লাল গাড়িকে ধাক্কা মারল। বিকট শব্দে লাল গাড়ি ডানদিকের ডিভাইডারে গিয়ে আঘাত করল। ডিভাইডারে আঘাত করে লাল গাড়ি উল্টে গিয়ে থেমে গেছে। শুধু তার চাকাগুলো শূন্যে ঘুরে যাচ্ছে।
লাল গাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষের জেরে উবার বাঁ দিকে একটা বাতিস্তম্ভে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল। উইন্ডশিল্ডের কাচ ভেঙে চুরমার। ড্রাইভারের কপাল আর নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। আদিত্য দুহাত দিয়ে মাথা ঢেকে গাড়ির মেঝেতে শুয়েছিল। গাড়িটা বাতিস্তম্ভে ধাক্কা মারার সঙ্গে সঙ্গে সামনের সিটটা তীর বেগে পিছনে এসে তার হাতে আঘাত করল। ডান হাতে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। হাতটা নিঃসন্দেহে ভেঙেছে। তবু ভাগ্য ভাল মাথায় লাগেনি।
মিনিট কয়েক ওইভাবে শুয়ে থাকার পর আদিত্য প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে গাড়ির বাইরে বেরোল। উবারের ড্রাইভার যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছে। আদিত্যর ডান হাতটা অকেজো হয়ে গেছে। অসহ্য যন্ত্রণা। সে লাল গাড়ির কাছে গিয়ে দেখল গাড়ির ড্রাইভার এবং আরোহী দুজনেই গাড়ির মধ্যে অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে। আদিত্য অতি কষ্টে বাঁ হাত দিয়ে মোবাইলটা বার করে গৌতমকে ফোন করল।
‘একটা লোক তার গাড়ি থেকে আমার উবারের ওপর গুলি চালিয়েছে … দুটো গাড়িরই অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে … রাজারহাট নিউ টাউনের একটা রাস্তার ওপর … মেন রাস্তা নয় …এই রাস্তাটা গিয়ে ইকো পার্কের উল্টোদিকে মেন রাস্তার সঙ্গে মিশেছে … ইকো পার্ক থেকে এক-দেড় কিলোমিটার … তাড়াতাড়ি হেল্প পাঠা …’ হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে এই কটা কথা বলে আদিত্য রাস্তার ওপর বসে পড়ল।