Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সোনার কেল্লা – সত্যজিৎ রায়

    উপন্যাস সত্যজিৎ রায় এক পাতা গল্প116 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৭. কাল মাঝরাত্তিরে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল

    কাল মাঝরাত্তিরে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল একবার, তখন সময় ক’টা জানি না, দেখলাম ফেলুদা বেড-সাইড ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে তার নীল খাতায় কী জানি লিখছে। ও কত রাত পর্যন্ত কাজ করেছিল জানি না। কিন্তু সকাল সাড়ে ছটায় উঠে দেখলাম, ও তার আগেই উঠে দাড়ি-টাড়ি কামিয়ে রেডি। ও বলে, মানুষের ব্রেন যখন খুব বেশি কাজ করে, তখন ঘুম আপনা থেকেই কমে যায়; কিন্তু তাতে নাকি শরীর খারাপ হয় না। অন্তত ওর তো তাই ধারণা, আর ওর শরীর গত দশ বছরে এক দিনের জন্যেও খারাপ হয়েছে বলে তো মনে পড়ে না। আমি জানতাম যে যোধপুরে এসেও ও যোগব্যায়াম বন্ধ করেনি। আজকেও জানি আমার ঘুম ভাঙার আগেই ওর সে-কাজটা সারা হয়ে গেছে।

    ডাইনিং রুমে ব্রেকফাস্ট খেতে গিয়ে সকলের সঙ্গেই দেখা হল। লালমোহনবাবু কাল রাত্রেই সার্কিট হাউসে চলে এসেছিলেন। তিনি বারান্দার পশ্চিম অংশটাতে মন্দার বোসের দুটো ঘর পরেই রয়েছেন। ভদ্রলোক ডিমের অমলেট খেতে খেতে বললেন, তাঁর নাকি চমৎকার একটা প্লট মাথায় এসেছে। ডক্টর হাজরা একদম মুষড়ে পড়েছেন; বললেন যে, রাত্রে নাকি তার ভাল ঘুম হয়নি। একমাত্র মুকুলই দেখলাম নির্বিকার।

    মন্দার বোস আজ প্রথম সরাসরি ডক্টর হাজরার সঙ্গে কথা বললেন—‘কিছু মনে করবেন না মশাই, আপনি যে উদ্ভট জিনিস নিয়ে রিসার্চ করছেন, তাতে এ ধরনের গণ্ডগোল হবেই। যে দেশে কুসংস্কারের এত ছড়াছড়ি, সে দেশে এ সব জিনিস বেশি না ঘাঁটানোই ভাল। শেষকালে দেখবেন, ঘরে ঘরে সব কচি ছোকরারা নিজেদের জাতিস্মর বলে ক্লেম করছে। তলিয়ে দেখলে দেখবেন, ব্যাপারটা আর কিছুই না, তাদের বাপেরা একটু পাবলিসিটি চাইছে, ব্যস। তখন আপনি ঠ্যালা সামলাবেন কী করে? ক’টা ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বিদেশে বিভুঁইয়ে চরে বেড়াবেন?’

    ডক্টর হাজরা কোনও মন্তব্য করলেন না। লালমোহনবাবু এর-ওর মুখের দিকে চাইলেন, কারণ জাতিস্মর ব্যাপারটা উনি এখনও কিছু জানেন না।

    ফেলুদা আগেই বলেছিল যে ব্রেকফাস্ট সেরে একটু বাজারের দিকে যাবে। আমি জানতাম সেটা নিশ্চয়ই শুধু শহর দেখার উদ্দেশ্যে নয়। পৌনে আটটার সময় আমরা বেরিয়ে পড়লাম। দু’জন নয়, তিনজন। লালমোহনবাবুও আমাদের সঙ্গ নিলেন। আমি এর মধ্যে দু’-একবার ভদ্রলোককে দুশমন হিসেবে কল্পনা করার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু প্রতিবারই এত হাসি পেল যে বাধ্য হয়ে সেটা মন থেকে দূর করতে হল।

    সার্কিট হাউসের দিকটা নিরিবিলি আর খোলামেলা হলেও শহরটা গিজগিজে। প্রায় সব জায়গা থেকেই পুরনো পাঁচিলটা দেখা যায়। সেই পাঁচিলের গায়ে দোকানের সারি, টাঙ্গার লাইন, লোকের থাকবার বাড়ি আর আরও কত কী। পাঁচশো বছর আগেকার শহরের চিহ্ন আজকের শহরের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছে।

    আমরা এ-দোকান সে-দোকান দেখতে দেখতে হেঁটে চলেছি। ফেলুদা কিছু একটা খুঁজছে সেটা বুঝতে পারলাম, কিন্তু সেটা যে কী সেটা বুঝলাম না। লালমোহনবাবু হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, ‘হাজরা কীসের ডাক্তার বলুন তো? আজ আবার টেবিলে মিস্টার ট্রটার কী-সব বলছিলেন…’

    ফেলুদা বলল, ‘হাজরা একজন প্যারাসাইকলজিস্ট।’

    ‘প্যারাসাইকলজিস্ট?’ লালমোহনবাবুর ভুরু কুঁচকে গেল। ‘সাইকলজির আগে যে আবার প্যারা বসে সেটা তো জানতুম না মশাই। টাইফয়েডের আগে বসে সেটা জানি। তার মানে কি হাফ-সাইকলিজি—প্যারা-টাইফয়েড যেমন হাফ-টাইফয়েড?’

    ফেলুদা বলল, ‘হাফ নয়, প্যারা মানে হচ্ছে অ্যাবনরম্যাল। মনস্তত্ত্ব ব্যাপারটা এমনই ধোঁয়াটে; তার মধ্যেও আবার যে দিকটা বেশি ধোঁয়াটে, সেটা প্যারাসাইকলজির আন্ডারে পড়ে।’

    ‘আর জাতিস্মরের কথা কী যেন বলছিলেন!’

    ‘মুকুল ইজ এ জাতিস্মর। অন্তত তাই বলা হয় তাকে।’

    লালমোহনবাবুর মুখ হাঁ হয়ে গেল।

    ‘আপনি প্লটের অনেক খোরাক পাবেন’, ফেলুদা বলল, ‘ছেলেটি পূর্ব’জন্মে দেখা একটা সোনার কেল্লার কথা বলে। আর সে নাকি একটা বাড়িতে থাকত যার মাটিতে গুপ্তধন পোঁতা ছিল।’

    ‘আমরা কি সেই সবের খোঁজে যাচ্ছি নাকি মশাই?’ লালমোহনবাবুর গলা ঘড়ঘড়ে হয়ে গেছে।

    ‘আপনি যাচ্ছেন কি না জানি না, তবে আমরা যাচ্ছি।’

    লালমোহনবাবু রাস্তার মাঝখানে দু’-হাত দিয়ে খপ করে ফেলুদার হাত ধরে ফেলল।

    ‘মশাই—চানস্ অফ এ লাইফটাইম! আমায় ফেলে ফস্ করে কোথাও চলে যাবেন না—এইটেই আমার রিকোয়েস্ট।’

    ‘এর পরে কোথায় যাব এখনও কিছুই ঠিক হয়নি।’

    লালমোহনবাবু কী জানি ভেবে বললেন, ‘মিস্টার ট্রটার কি আপনাদের সঙ্গে যাবেন নাকি?’

    ‘কেন? আপনার আপত্তি আছে?’

    ‘লোকটা পাওয়ারফুলি সাসপিশাস্!’

    রাস্তার একধারে একটা জুতোওয়ালা বসেছে, তার চারিদিক ঘিরে নাগরার ছড়াছড়ি। এখানকার লোকেরা এই ধরনের নাগরাই পরে। ফেলুদা জুতোগুলোর সামনে দাঁড়াল।

    ‘পাওয়ারফুল তো জানি। সাস্‌পিশাস্‌ কেন?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।

    ‘কাল গাড়িতে যেতে যেতে খুব বাক্‌তাল্লা মারছিল। বলে—ট্যাঙ্গানিকায় নাকি নেকড়ে মেরেছে নিজে বন্দুক দিয়ে। অথচ আমি জানি যে সারা আফ্রিকার কোনও তল্লাটে নেকড়ে জানোয়ারটাই নেই। মার্টিন জনসনের বই পড়েছি আমি—আমার কাছে ধাপ্পা!’

    ‘আপনি কী বললেন?’

    ‘কী আর বলব? ফস্ করে মুখের ওপর তো লায়ার বলা যায় না! দু’জনের মাঝখানে স্যান্ডউইচ হয়ে বসে আছি। আর লোকটার ছাতি দেখেছেন তো? কমপক্ষে ফর্টিফাইভ ইঞ্চেজ। আর রাস্তার দু’ধারে দেখচি ইয়া ইয়া মনসার ঝোপ্‌ড়া—কনট্র্যাডিক্‌ট করলুম, আর অমনি কোলপাঁজা করে তুলে নিয়ে যদি ওই একটা ঝোপ্‌ড়ার পেছনে ফেলে দিয়ে চলে যায়—ইন নো টাইম মশাই শকুনির স্কোয়াড্রন এসে ল্যান্ড করে ফিস্টি লাগিয়ে দেবে।’

    ‘আপনার লাশে ক’টা শকুনের পেট ভরবে বলুন তো।’

    ‘হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ…’

    ফেলুদা ইতিমধ্যে পায়ের স্যান্ডেল খুলে নাগরা পরে পায়চারি শুরু করে দিয়েছে। লালমোহনবাবু বললেন, ‘ভেরি পাওয়ারফুল শুজ—কিনছেন নাকি?’

    ‘একটা পরে দেখুন না’, ফেলুদা বলল।

    ভদ্রলোকের পায়ের মাপের মতো ছোট জুতো অবিশ্যি দোকানে ছিল না, তাও তার মধ্যে যে জোড়াটা সবচেয়ে ছোট সেটা পরে তিনি প্রায় আঁতকে উঠলেন। ‘এ যে গণ্ডারের চামড়া মশাই! এ তো গণ্ডার ছাড়া আর কারুর পায়ে সুট করবে না!’

    ‘তা হলে ধরে নিন রাজস্থানের শতকরা নব্বই ভাগ লোক আসলে গণ্ডার।’

    দু’জনেই নাগরা খুলে যে যার জুতো পরে নিল। দোকানদারও হাসছিল। সে বুঝেছে শহরের বাবুরা ছোটলোকদের জুতো পায়ে দিয়ে একটু রসিকতা করছে।

    আমরা এগিয়ে চললাম। একটা পানের দোকান থেকে বেদম জোরে রেডিয়োতে ফিল্‌মের গানের আওয়াজ বেরোচ্ছে। মনে পড়ে গেল কলকাতার পুজো-প্যান্ডেলের কথা। এখানে পুজো নেই, আছে দশেরা। কিন্তু তার এখনও অনেক দেরি।

    আরও কিছু দূর এগিয়ে ফেলুদা একটা পাথরের তৈরি জিনিসের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। দোকানটার চেহারা বেশ ভদ্র, নাম সোলাঙ্কি স্টোর্স। বাইরে কাচের জানালার পিছনে সুন্দর সুন্দর পাথরের ঘটি বাটি গেলাস পাত্র সাজানো রয়েছে। ফেলুদা একদৃষ্টে সেগুলোর দিকে চেয়ে আছে। দোকানদার দরজার মুখটাতে এগিয়ে এসে আমাদের ভিতরে আসতে অনুরোধ করল।

    ফেলুদা জানালার দিকে দেখিয়ে বলল, ‘ওই বাটিটা একবার দেখতে পারি?’

    দোকানদার জানালার বাটিটা না বার করে ভিতরের একটা আলমারি থেকে ঠিক সেই রকমই একটা বাটি বার করে দিল। সুন্দর হলদে রঙের পাথরের বাটি। আগে কখনও এ রকম জিনিস দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

    ‘এটা কি এখানকার তৈরি?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।

    দোকানদার বলল, ‘রাজস্থানেরই জিনিস, তবে যোধপুরের নয়।’

    ‘তবে কোথাকার?’

    ‘জয়সলমীর। এই হলদে পাথর শুধু ওখানেই পাওয়া যায়।’

    ‘আই সি…’

    জয়সলমীর নামটা আমি আবছা শুনেছি। জায়গাটা যে রাজস্থানের ঠিক কোনখানে সেটা আমার জানা ছিল না। ফেলুদা বাটিটা কিনে নিল। সাড়ে ন’টা নাগাদ টাঙ্গার ঝাঁকুনি খেয়ে সকালের ডিম-রুটি হজম করে আমরা সার্কিট হাউসে ফিরলাম।

    মন্দার বোস বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। আমাদের হাতে প্যাকেট দেখে বললেন, ‘কী কিনলেন?’

    ফেলুদা বলল, ‘একটা বাটি। রাজস্থানের একটা মেমেন্টো রাখতে হবে তো।’

    ‘আপনার বন্ধু তো বেরলেন দেখলাম।’

    ‘কে, ডক্টর হাজরা?’

    ‘ন’টা নাগাদ বেরিয়ে যেতে দেখলাম একটা ট্যাক্সি করে।’

    ‘আর মুকুল?’

    ‘সঙ্গেই গেছে। বোধহয় পুলিশে রিপোর্ট করতে গেছেন। কালকের ঘটনার পর হি মাস্ট বি কোয়াইট শেক্‌ন।’

    লালমোহনবাবু ‘প্লটটা একটু চেঞ্জ করতে হবে’ বলে তাঁর ঘরে চলে গেলেন।

    ঘরে গিয়ে ফেলুদাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘হঠাৎ বাটিটা কিনলে কেন ফেলুদা!’

    ফেলুদা সোফায় বসে বাটিটা মোড়ক থেকে খুলে টেবিলের উপর রেখে বলল, ‘এটার একটা বিশেষত্ব আছে।’

    ‘কী বিশেষত্ব?’

    ‘জীবনে এই প্রথম একটা বাটি দেখলাম যেটাকে সোনার পাথরবাটি বললে খুব ভুল বলা হয় না।’

    এর পরে আর কোনও কথা না বলে সে ব্র্যাড্‌শ-র পাতা উলটোতে আরম্ভ করল। আমি আর কী করি। জানি এখন ঘণ্টাখানেক ফেলুদার মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোবে না, বা তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে তার উত্তর পাওয়া যাবে না, তাই অগত্যা বাইরে বেরোলাম।

    লম্বা বারান্দাটা এখন খালি। মন্দারবাবু উঠে গেছেন। দূরে একজন মেমসাহেব বসেছিলেন, তিনিও উঠে গেছেন। একটা ঢোলকের আওয়াজ ভেসে আসছে। এবার তার সঙ্গে একটা গান শুরু হল। গেটের দিকে চেয়ে দেখলাম, দুটো ভিখিরি গোছের লোক—একটা পুরুষ আর একটা মেয়ে—গেট দিয়ে ঢুকে আমাদের বারান্দার দিকে এগিয়ে আসছে। ছেলেটা ঢোলক বাজাচ্ছে আর মেয়েটা গান গাইছে। আমি বারান্দা দিয়ে এগিয়ে গেলাম।

    মাঝখানের খোলা জায়গাটায় গিয়ে ইচ্ছে হল একবার দোতলায় যাই। সিঁড়িটা প্রথম দিন থেকেই দেখছি, আর জানি যে উপরে ছাত আছে। উঠে গেলাম সিঁড়ি দিয়ে।

    দোতলায় মাঝখানে পাশাপাশি খান চারেক ঘর। সেগুলোর দু’ দিকে পুবে আর পশ্চিমে খোলা ছাত। ঘরগুলোতে লোকজন নেই বলেই মনে হল। কিংবা হয়তো যারা আছে তারা বেরিয়েছে।

    পশ্চিমদিকের ছাতটায় গিয়ে দেখি যোধপুরের কেল্লাটা দারুণ দেখাচ্ছে সেখান থেকে।

    নীচে ভিখিরির গান হয়ে চলেছে। সুরটা চেনা চেনা লাগছে। কোথায় শুনেছি এ সুর? হঠাৎ বুঝতে পারলাম, মুকুল যে সুরে গুনগুন করে, তার সঙ্গে এর খুব মিল আছে। বার বার একই সুর ঘুরে ঘুরে আসছে, কিন্তু শুনতে একঘেয়ে লাগছে না। আমি ছাতের নিচু পাঁচিলটার দিকে এগিয়ে গেলাম। এদিকটা হচ্ছে সার্কিট হাউসের পিছন দিক।

    ওমা, পিছনেও যে বাগান আছে তা তো জানতাম না। আমাদের ঘরের পিছন দিকের জানালা দিয়ে একটা ঝাউ গাছ দেখা যায় বটে, কিন্তু এতখানি জায়গা জুড়ে এত রকম গাছ আছে এদিকটায় সেটা বুঝতে পারিনি।

    ঝলমলে নীল ওটা কী নড়ছে গাছপালার পিছনে? ওহো—একটা ময়ূর। গাছের পিছনে লুকোনো ছিল শরীরের খানিকটা, তাই বুঝতে পারিনি। এবারে পুরো শরীরটা দেখা যাচ্ছে। মাটি থেকে খুঁটে খুঁটে কী যেন খাচ্ছে। পোকাটোকা বোধহয়; ময়ূর তো পোকা খায় বলেই জানি। হঠাৎ মনে পড়ল কোথায় যেন পড়েছিলাম যে, ময়ূরের বাসা খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল। তারা বেছে বেছে নাকি অদ্ভুত সব গোপন জায়গা বার করে বাসা তৈরি করে।

    আস্তে আস্তে পা ফেলে ময়ূরটা এগোচ্ছে, লম্বা গলাটাকে বেঁকিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে দেখছে, শরীরটা ঘুরলে সমস্ত লেজটা সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে যাচ্ছে।

    হঠাৎ ময়ূরটা দাঁড়াল। গলাটা ডানদিকে ঘোরাল। কী দেখছে ময়ূরটা? নাকি কোনও শব্দ শুনেছে?

    ময়ূরটা সরে গেল। কী জানি দেখে ময়ূরটা সরে যাচ্ছে।

    একজন লোক। আমি যেখানে দাঁড়িয়েছি, তার ঠিক নীচে। গাছের ফাঁক দিয়ে ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে। লোকটার মাথায় পাগড়ি। খুব বেশি বড় না—মাঝারি। গায়ে সাদা চাদর জড়ানো। একেবারে ওপর থেকে দেখছি বলে লোকটার মুখ দেখা যাচ্ছে না। খালি পাগড়ি আর কাঁধ। হাত দুটো চাদরের তলায়।

    লোকটা পা টিপে টিপে এগোচ্ছে। পশ্চিমদিক থেকে পুবদিকে। আমি রয়েছি পশ্চিমের ছাতে। পুবদিকে একতলায় আমাদের ঘর।

    হঠাৎ ইচ্ছে করল লোকটা কোথায় যায় দেখি।

    মাঝের ঘরগুলো দৌড়ে পেরিয়ে গিয়ে উলটোদিকের ছাতের পিছনের পাঁচিলের কাছে গিয়ে সামনে ঝুঁকে পড়লাম।

    লোকটা এখন আবার আমার ঠিক নীচে। ছাতের দিকে চাইলে আমাকে দেখতে পাবে, কিন্তু দেখল না।

    এগিয়ে আসছে সামনের দিকে লোকটা। আমাদের ঘরের জানালার দিকে এগিয়ে আসছে। হাতটা চাদরের ভিতর থেকে বার করল। কবজির কাছটায় চকচকে ওটা কী?

    লোকটা থেমেছে। আমার গলা শুকিয়ে গেছে। লোকটা আরেক পা এগোল—

    ‘ক্যাঁ ও য়্যাঁ!’

    লোকটা চমকে পিছিয়ে গেল। ময়ূরটা কর্কশ স্বরে ডেকে উঠেছে। আর সেই সঙ্গে সঙ্গেই আমিও চেঁচিয়ে উঠলাম—

    ‘ফেলুদা!’

    পাগড়ি পরা লোকটা ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে যেদিক দিয়ে এসেছিল, সেদিকে অদৃশ্য হয়ে গেল, আর আমিও দুড়দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে বারান্দা দিয়ে এক নিশ্বাসে দৌড়ে গিয়ে আমাদের ঘরের দরজার মুখে ফেলুদার সঙ্গে দড়াম করে কলিশন খেয়ে ভ্যাবাচ্যাকা চুপ!

    আমাকে ঘরে টেনে নিয়ে গিয়ে ফেলুদা বলল, ‘কী ব্যাপার বল তো?’

    ‘ছাত থেকে দেখলাম, একটা লোক…পাগড়ি পরে…তোমার জানালার দিকে আসছে…’

    ‘দেখতে কী রকম? লম্বা?’

    ‘জানি না…উপর থেকে দেখছিলাম তো!…হাতে একটা…’

    ‘হাতে কী?’

    ‘ঘড়ি…’

    আমি ভেবেছিলাম ফেলুদা ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দেবে কিংবা আমাকে বোকা আর ভিতু বলে ঠাট্টা করবে। কিন্তু তার কোনওটাই না করে ও গম্ভীরভাবে জানালাটার দিকে গিয়ে বাইরে মুখ বাড়িয়ে এদিক ওদিক দেখে নিল।

    দরজায় একটা টোকা পড়ল।

    ‘কাম ইন।’

    বেয়ারা কফি নিয়ে ঢুকল।

    ‘সেলাম সা’ব!’

    টেবিলের উপর কফির ট্রে-টা রেখে পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা চিঠি বার করে ফেলুদাকে দিল।

    ‘মৈনেজার সা’বনে দিয়া।’

    বেয়ারা চলে গেল। ফেলুদা চিঠিটা পড়ে একটা হতাশার ভাব করে ধপ করে সোফার উপর বসে পড়ল।

    ‘কার চিঠি ফেলুদা?’

    ‘পড়ে দ্যাখ।’

    ডক্টর হাজরার চিঠি। ডক্টর হাজরার নাম লেখা প্যাডের কাগজে ইংরিজিতে লেখা ছোট্ট চার লাইনের চিঠি—‘আমার বিশ্বাস আমাদের পক্ষে আর যোধপুরে থাকা নিরাপদ নয়। আমি অন্য আরেকটা জায়গায় চললাম, সেখানে কিছুটা সাফল্যের আশা আছে মনে হয়। আপনি আর আপনার ভাইটি কেন আর মিথ্যা বিপদের মধ্যে জড়াবেন; তাই আপনাদের কাছে বিদায় না নিয়েই চললাম। আপনাদের মঙ্গল কামনা করি। —ইতি এইচ এম হাজরা।’

    ফেলুদা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘অত্যন্ত হেস্টি কাজ করেছেন ভদ্রলোক।’ তারপর কফি না খেয়েই সোজা চলে গেল রিসেপশন কাউন্টারে। আজ একটি নতুন ভদ্রলোক বসে আছেন সেখানে। ফেলুদা জিজ্ঞেস করল, ‘ডক্টর হাজরা কি ফিরবেন বলে গেছেন?’

    ‘না তো। উনি ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে গেছেন। ফেরার কথা তো কিছু বলেননি।’

    ‘কোথায় গেছেন সেটা আপনি জানেন?’

    ‘স্টেশনে গেছেন এটাই শুধু জানি।’

    ফেলুদা একটুক্ষণ ভেবে বলল, ‘জয়সলমীর তো এখান থেকে ট্রেনে যাওয়া যায়, তাই না?’

    ‘আজ্ঞে হ্যাঁ। বছর দুয়েক হল ডিরেক্ট লাইন হয়েছে।’

    ‘কখন ট্রেন?’

    ‘রাত দশটা।’

    ‘সকালের দিকে কোনও ট্রেন নেই?’

    ‘যেটা আছে সেটা অর্ধেক পথ যায়, পোকরান পর্যন্ত। সেটা এই আধ ঘণ্টা হল ছেড়ে গেছে। পোকরান থেকে যদি গাড়ির ব্যবস্থা থাকে তা হলে অবিশ্যি এ ট্রেনটাতেও জয়সলমীর যাওয়া যায়।’

    ‘কতটা রাস্তা পোকরান থেকে?’

    ‘সত্তর মাইল।’

    ‘সকালে যোধপুর থেকে অন্য কী ট্রেন আছে?’

    ভদ্রলোক একটা বইয়ের পাতা উলটে-পালটে দেখে বললেন, ‘আটটায় একটা প্যাসেঞ্জার আছে, সেটা বারমের যায়। নটায় আছে রেওয়ারি প্যাসেঞ্জার। দ্যাট্‌স অল।’

    ফেলুদা কাউন্টারের উপর ডান হাতের আঙুলের ডগা দিয়ে কয়েকবার অসহিষ্ণুভাবে টোকা দিয়ে বলল, ‘জয়সলমীর তো এখান থেকে প্রায় দু’শো মাইল, তাই না?’

    ‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

    ‘আপনি অনুগ্রহ করে একটা ট্যাক্সির বন্দোবস্ত করে দেবেন? আমরা সাড়ে এগারোটা নাগাদ বেরতে চাই।’

    ভদ্রলোক সম্মতি জানিয়ে টেলিফোন তুললেন।

    ‘কোথায় চললেন আপনারা?’

    মন্দার বোস। স্নানটান করে ফিটফাট হয়ে হাতে সুটকেস নিয়ে বেরিয়েছেন ঘর থেকে।

    ফেলুদা বলল, ‘একটু থর মরুভূমিটা দেখার ইচ্ছে আছে।’

    ‘ও, তার মানে নর্থ-ওয়েস্ট। আমি যাচ্ছি একটু ইস্টে।’

    ‘আপনিও চললেন?’

    ‘মাই ট্যাক্সি শুড বি হিয়ার এনি মিনিট নাউ। বেশিদিন এক জায়গায় মন টেকে না মশাই। আর আপনারাও যদি চলে যান তা হলে তো সার্কিট হাউস খালি হয়ে যাচ্ছে এমনিতেও।’

    কাউন্টারের ভদ্রলোক কথা শেষ করে টেলিফোনটা নামিয়ে রেখে বললেন, ‘ইট্‌স অ্যারেঞ্জড্‌।’

    ফেলুদা একবার আমাকে বলল, ‘দ্যাখ তো লালমোহনবাবুর দেখা পাস কি না। বল যে, আমার এগারোটায় জয়সলমীর যাচ্ছি। যদি উনি আসতে চান আমাদের সঙ্গে, তা হলে যেন ইমিডিয়েটলি তৈরি হয়ে নেন।’

    আমি ছুটলাম দশ নম্বর ঘরের দিকে। কী উদ্দেশ্যে যে জয়সলমীর যাচ্ছি জানি না। ফেলুদা অন্য সব জায়গা ফেলে এ জায়গাটা বাছল কেন? বোধহয় মরুভূমির কাছে বলে! ডক্টর হাজরাও কি জয়সলমীর গেছেন? এই কি আমাদের বিপদের শেষ? না এই সবে শুরু?

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleএক ডজন গপ্‌পো – সত্যজিৎ রায়
    Next Article ফেলুদা প্লাস ফেলুদা – সত্যজিৎ রায়

    Related Articles

    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }