Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    সোভিয়েত সায়েন্স ফিকশন

    পার্থ চট্টোপাধ্যায় এক পাতা গল্প422 Mins Read0

    দেউলিয়া গ্রহ (১৯৬৭)

    দেউলিয়া গ্রহ (১৯৬৭)
    ওলগা লারিয়নোভা। অনুবাদ অদিতি ভট্টাচার্য

    ১.

    মহাকাশযানের জানালার হালকা আলোজ্বলা পর্দার ভেতর দিয়ে জিনাইটদের শহরটাকে আরও বেশি করুণ লাগছে। বিশেষ করে ওর পাহাড়তলি এলাকাটা। সেখানে না আছে হাজারো পিলারওয়ালা কোনো মন্দির, না আছে লাইলাক রঙের চৌকো পাথরে বাঁধানো পথ।

    বাজারটা এখানেই, শহরের অন্যতম ব্যস্ত এলাকায়। চারদিকে শুধু ঝুড়ি আর মাদুর, মাদুর আর ঝুড়ি! বলতে গেলে পথের ধুলোবালির ওপরেই কাঁচা বা আধসেদ্ধ খাবারদাবার স্কুপাকৃতি করে রাখা আছে, সবাই হাতে করে তুলে নিচ্ছে। ফল, শাকসবজি, মাছ বিক্রি হয়ে খদ্দেরের ঝুড়িতে ঢুকে যাচ্ছে আবার কখনো কখনো দরদস্তুরে না পোষালে দোকানদারের কাছেই পড়ে থাকছে। বিকট অঙ্গভঙ্গি, বাকবিতণ্ডা আর সর্বত্র জঘন্য নোংরা…

    কম্যান্ডার খুঁতখুঁতে মানুষ। তার জ কুঁচকে গেল। এত জায়গা থাকতে যানের লোকজন কিনা শেষ অবধি এই যাচ্ছেতাই বাজারটাতেই গেল! পর্দায় দেখা যাচ্ছে। জিনাইটরা এলোমেলোভাবে এদিক ওদিক দৌড়ে বেড়াচ্ছে। এদের মধ্যে কোনজন জিনাইটের ছদ্মবেশে আসলে তার লজিটেনিয়ান বাহিনীর নিরীক্ষক তা বোঝা সত্যিই শক্ত। তবে হ্যাঁ, তারা ওখানেই আছে।

    কম্যান্ডার পর্দার দিকে এগোল, একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল সাদা পোশাক পরা মেয়েটার দিকে। সে কোনোরকম তাড়াহুড়ো না করে চলাফেরা করছে। অন্যদের থেকে অনেক আস্তে হাঁটছে। কেউ তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে, কেউ বা তার একেবারে সামনে পড়ে যাচ্ছে। তবে যে-ই একবার তাকে দেখছে সে দ্বিতীয়বার তার মুখের দিকে না তাকিয়ে পারছে না। যেন আজব, আশ্চর্য কিছু একটা দেখছে। ব্যাপারটা কী? আর দশটা জিনাইট মহিলাদের সঙ্গে এর তফাতটা কোথায়?

    আজ সকাল থেকেই মনিটরের কাজ পনেরো কি কুড়ি পা দূর থেকে মেয়েটার ওপর নজর রাখা। মনিটরের পরনে লম্বা ঝুলের ধূসর রঙের পোশাক, তার ঘন দাড়ি, হাতের মেষপালকদের মতো মুখ বাঁকানো লাঠি, এর কোনোটাই জিনাইটদের কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি। তরুণীটি তার দিকে মাঝেমধ্যে তাকাচ্ছিল আর তাতে সে মাথা এমনভাবে নাড়ছিল যেন মনে হচ্ছিল যে সে পাথুরে পথে হোঁচট খাওয়ার ভয় পাচ্ছে। আসলে এটা সবকিছু যে ঠিকঠাক চলছে তারই ইঙ্গিত।

    পথচলতি লোকজন অবশ্য তরুণীটির দিকে কৌতূহলভরে তাকিয়েই যাচ্ছিল, যদিও ও তা লক্ষ করছিল বলে মনে হয় না। খানিক বাদে বেড়া দিয়ে ঘেরা বাজারে তরুণীটি ঢুকে এল। নিজের টিউনিকটা উঁচু করে তুলে লাল ফলভর্তি একটা ঝুড়ির পাশে সন্তর্পণে পা ফেলল। আর ঠিক তখনই একটা বুড়ো লোক তড়িঘড়ি করে এগিয়ে এল ওর দিকে। ছোটো ছোটো পদক্ষেপে। ক্ষিপ্র গতিতে। বুড়ো লোকটার দাড়ি কমলা রঙে রাঙানো, খুব সম্ভব সে মিনিট খানেক আগেই অর্থ বিনিময়কারীর ছাউনিতে দাঁড়িয়ে ছিল। শুকনো মুখে। কুঁজো হয়ে সে তরুণীটির সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। সম্ভবত ওকে গয়নাগাঁটি দেখাচ্ছে। বিক্রির জন্যে।

    তরুণীটি কি কিনবে কিছু? নাহ, বুড়োটা বোধ হয় খেলো গয়নাগুলো ওকে এমনিই দিয়ে দিতে চাইছে। আর তারপর হঠাৎ তার হাত ধরে টান দিয়ে সে একদিকে ইশারা করল। ঢাকা দেওয়া জঞ্জাল পড়ে রয়েছে সেদিকটায়।

    তরুণীটি মাথা নেড়ে আপত্তি করছে। লোকটা যে ভাষায় কথা বলছে তা সে ভালোভাবে জানে না বলেই বোধ হয়। তবে ওর এহেন অনিশ্চিত হাবভাব মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়। ওর নির্দেশক, সাইকম তো জোর দিয়ে বলেছিল যে রাস্তাঘাটে, বাজারে, বন্দরে এমন অনেক লোকের সংস্পর্শে আসা সম্ভব যারা শহরের বহুল প্রচলিত সাধারণ ভাষা ছাড়া অন্যান্য ভাষাতেও কথা বলে।

    বুড়োটা তার হাত ধরে টানাটানি শুরু করে দিয়েছে এবারে। নাহ। এবার ওর মনিটরের হস্তক্ষেপের দরকার। সে যেন অন্ধ, চোখে দেখতেই পায় না এমন ভঙ্গিতে মনিটর ওদের কাছে এগিয়ে এসে হঠাৎ কমলা রঙের দাড়িওয়ালা লোকটার গায়ে এত জোরে ধাক্কা মারল যে সে হুমড়ি খেয়ে পড়েই গেল। তারপর ধড়মড়িয়ে উঠে যতক্ষণে সে নিজেকে সামলাচ্ছে ততক্ষণে তরুণী বেড়ার ফাঁক গলে তার নাগালের বাইরে বেরিয়ে গেছে।

    এখন এটাও একটা প্রশ্ন যে বাজারে এত মহিলার মধ্যে কমলা দাড়িওলা লোকটা এই তরুণীর দিকেই বা আকৃষ্ট হল কেন? কেনই বা তার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাবার মতলবে ছিল?

    জিনাইটদের চেহারা, জীবনযাপন, অভ্যেস ইত্যাদি বিষয়ে দীর্ঘদিন মন দিয়ে পড়াশোনা করার পরেই সাইকম তরুণীটির চেহারা গড়ে তুলেছিল। কম্যান্ডার নিজেও তার খুঁটিনাটি পরখ করেছে এবং সে একটা ভুলও বের করতে পারেনি। তাহলে পথচলতি লোকজন সবাই মেয়েটাকে ওভাবে বিশেষ চোখে দেখছিলই বা কেন আর কেনই বা কমলা দাড়িওলা বুড়ো লোকটা তার হাত ধরে টানাটানি জুড়ল ওভাবে? ব্যাপারটা একটু তদন্ত করে দেখা দরকার এবারে।

    পর্দার কন্ট্রোল প্যানেলের একটা বোতাল টিপল কম্যান্ডার। “সাতাশ নম্বর, এক্ষুনি মহাকাশযানে ফিরে এসো।” আদেশটা কম্যান্ডার দেবার সঙ্গে সঙ্গেই ছোটো উড়ন্ত প্রাণীর মতো দেখতে একটা ড্রোন তরুণীর মাথার ওপরে সোজা নেমে এসে বার বার ওকে মহাকাশযানে ফিরে যাওয়ার নির্দেশটা শুনিয়ে যেতে লাগল।

    মেয়েটা তার চলা থামিয়ে দিল এবার। তারপর আচমকাই উলটো মুখে ঘুরে শহরতলির দিকে হেঁটে গেল চুপচাপ। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝোঁপঝাড়ে ঢাকা একটা টিলার গায়ে পৌঁছে গেল সে। জায়গাটা নির্জন। আশেপাশে একজন জিনাইটকেও দেখতে পাওয়া যায় না। এইবার, ভালো করে চারদিক একবার দেখে নিয়ে তরুণীটি তার উড্ডয়ন যন্ত্রটা চালু করে দিল।

    কম্যান্ডার স্বস্তিতে চোখদুটো বন্ধ করে ফেললেন।

    .

    ২.

    “তোমার হাতদুটো দেখি!”

    তরুণীটি কম্যান্ডারের সামনে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে কনুইদুটো গায়ের সঙ্গে ঠেকিয়ে হাতদুটো ওপরে তুলল। হাতের তেলোদুটো সামনে সোজা করা। ওই ভঙ্গিতেই একেবারে মূর্তির মতো স্থির হয়ে রইল সে। শুধু মাথাটা পেছনে অল্প হেলে রইল, যেন ওর চকচকে কালো চুলের বড়ো খোঁপাটার ভারেই।

    কম্যান্ডার ওর হাতদুটো ধরে চোখের কাছে নিয়ে এসে এপাশ ওপাশ থেকে ভালো করে দেখল। সবকিছু তো ঠিকই আছে। আঙুলের লম্বা লম্বা নখ, পাতলা চামড়ার নীচে দেখা যাওয়া শিরা-উপশিরা, চামড়ার ভাঁজের বিচিত্র কারিকুরি, যেন গোলাপি মার্বেলের ওপর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ফাটল।

    সবকিছু ঠিক আছে বলেই তো মনে হল! আর যদিও বা সামান্য কিছু গোলমাল থেকে থাকে তা এক্ষুনি চোখে পড়ছে না।

    কম্যান্ডার তরুণীটির হাতদুটো ছেড়ে দিল, সে দুটো ওর শরীরের দু-পাশে শিথিলভাবে ঝুলতে লাগল।

    “তিন পা হাঁটো।”

    তরুণীটি মাথা তুলে সাবলীল ভঙ্গিতে হেঁটে দেখাল।

    “এবার আমার দিকে ঘোরো। পাশ ফেরো।”

    তরুণীটি ঘুরল।

    “দেয়ালের দিকে যাও, আবার ফিরে এসো। আস্তে আস্তে।”

    “এবার আর একটু তাড়াতাড়ি।”

    “থামো। হাঁটো। থামো। আবার হাঁটো। সামনে এগিয়ে এসো, পিছু হটো।” কম্যান্ডারের নির্দেশ দেওয়া চলতেই থাকল।

    “মাথার অবস্থানটা একটু কেমন যেন…” হঠাৎ বলে উঠল কম্যান্ডার।

    তরুণীটি তাড়াতাড়ি মাথাটা উঁচিয়ে তুলল।

    “হুম। তাহলে এখানেই কিছু গোলমাল আছে।”

    “না।” তরুণীটি উত্তর দিল।

    “তুমি এত নিশ্চিত হচ্ছ কী করে?”

    “জানি না। বলতেও পারব না। কিন্তু আমার মনে হয় গোলমাল এখানে নয়।” দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল কম্যান্ডার, তারপর হঠাৎ চেয়ার থেকে উঠে পড়ল, লম্বা লম্বা পা ফেলে তরুণীটির কাছে এল। সাবধানে তরুণীটির কাঁধের কাছে লাগানো পোশাকের আংটাদুটো আর কোমরের পিন খুলে ফেলল। সাবধানে করার কারণ এগুলো জাদুঘরে রাখার মতোই খাঁটি জিনিস। একেবারেই অথেনটিক জিনাইট জিনিস। কোমরের পিনটা খুলে নিতেই আকাশি বর্ডার দেওয়া সাদা রঙের টিউনিকটা মেঝের ওপর নিঃশব্দে পড়ে গেল।

    সাবধানে, একটা একটা করে, যেন ওজন করছে এমনিভাবে সন্তর্পণে তার গায়ের ব্রোঞ্জের গয়নাগুলো খুলে নিল কম্যান্ডার, তারপর সেগুলো সাবধানে টেবিলের ওপরে রাখল। সাদা টিউনিকটা তুলে নিয়ে সে ইন্টারকমের কন্ট্রোল প্যানেলের কাছে এসে বলল, “সেন্ট্রাল ডিপোসিটরি, জিনাইটদের খাঁটি কাপড়ের কিছু নমুনা আমাকে পাঠাও।”

    প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেয়ালে লাগানো অনুভূমিক এলিভেটরের ছোট্ট দরজাটা খুলে গেল আর একটা প্যাকেট নিয়ে ধূসর রঙের কনভেয়ার বেল্ট বেরিয়ে এল। প্যাকেটের ভেতরে নানান রঙের কাপড়ের চৌকো চৌকো টুকরো।

    এবারে দরজা বন্ধ করে কম্যান্ডার আরও একবার তরুণীটিকে ভালো করে পরীক্ষা করল। তার চেয়ার থেকে মাত্র তিন পা দুরে মেয়েটা দাঁড়িয়ে। ওর পায়ে শুধু কাঠের চপ্পল, তাতে একগাদা সাদা লেস জড়াজড়ি হয়ে রয়েছে। মাথা পেছনে সামান্য হেলানো আর চোখ আগের মতোই আধবোজা। কাঠের চপ্পলগুলোকে নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই কারণ ওগুলোও ব্রোঞ্জের ওই গয়নাগুলোর মতোই খাঁটি।

    কম্যান্ডার চেয়ারে বসে পড়ে কাপড়ের নমুনার প্যাকেটটা খুলল এবার। তার যদি ক্লান্ত হওয়ার বিন্দুমাত্র অধিকার থাকত তাহলে সে স্বীকার করত যে সে চূড়ান্ত পরিশ্রান্ত।

    বার বার সে ব্যর্থই হচ্ছে। সে ব্যর্থতা কখনো ছোটো, কখনো-বা বড় আকারের, কিন্তু ব্যর্থতার ধারাবাহিকতাটা একই রয়ে যাচ্ছে। তার নেতৃত্বে একটা অভিযানও আজ অবধি সাফল্যের মুখ দেখেনি। এখনকার এই গোলমালটার কথাই ধরা যাক। সাতাশ নম্বর এক নতুন শিক্ষানবিশ। এই ওর প্রথম অভিযান। আর সেই প্রথম অভিযানেই ওকে এই জিনাইট শহরের আদিম বাসিন্দারা ওকে শত ছদ্মবেশ সত্ত্বেও অন্যরকম বলে চিনে। ফেলল, অথচ তার কারণ কম্যান্ডারের কাছে এখনো স্পষ্ট নয়।

    সাতাশ নম্বর কোনো জিনাইট জন্তুর ছদ্মবেশ নিলে সেটা যে অনেক বেশি বুদ্ধিমানের কাজ হত সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। একশো চল্লিশ তো একটা ছোটো, কালোকোলো জন্তুর চেহারা নিয়ে দিব্যি ভালোই কাজকর্ম করছে। জিনাইটরা যখন এদিক ওদিক কোথাও যায় বা দূরেও যায় তখন অনেক সময়েই তাদের সঙ্গে এই জাতের পুষ্যি একখানা থাকে।

    এই সাতাশ নম্বর মেয়েটা এখনো কাঁচা। সেকথা মাথায় রেখে ওকে এরকমই কোনো জন্তুর চেহারা নেবার পরামর্শ দেয়া উচিত ছিল কম্যান্ডারের। হ্যাঁ, এতে তার পক্ষে সবকিছু ভালোভাবে দেখাশোনা করার সুযোগ কিছুটা হয়তো কমত ঠিকই। জন্তুদের তো আর এখানে সব জায়েগায় যাবার অধিকার নেই! কিন্তু তাতে বিশেষ কিছু যেত আসত না। কারণ দরকারি সব কিছুরই ছবি দূর-নিয়ন্ত্রিত ড্রোনগুলো তো তুলছেই।

    এই নজরদার ড্রোনগুলো জিয়া গ্রহটার জন্যেই বিশেষভাবে তৈরি। এখানকার ছোটো ছোটো উড়ুক্কু প্রাণীদের মতো করে গড়া হয়েছে। কোনোটা কালো, কোনোটা গাঢ় ধূসর। বেশ চড়া একটা গুনগুন শব্দ তুলে ওড়ে। গোটা শহরের ওপর দিয়ে চক্কর কাটতে থাকে এরা সবসময়। কখনো বা বাড়িঘরের ছাদে বা গাছের ডালপালার আড়ালে গিয়ে লুকিয়ে বসে। নজরদারির সীমার মধ্যে যা কিছু পড়ে তার সব খবর অনবরত মহাকাশযানে পাঠায়। মহাকাশযানে রাখা এদের নিয়ন্ত্রক কনসোল আবার তথ্যগুলোকে একত্র করে ভ্রাম্যমাণ রিলে স্টেশনগুলোতে পাঠিয়ে দেয়।

    সাতাশ নম্বরের স্থির হয়ে থাকা জিনাইট শরীরটার দিকে আরেকবার দেখে নিয়ে কম্যান্ডার ইন্টারকমের থার্মাল সুইচ টিপল, “একশো চল্লিশ, এখানে রিপোর্ট করো, এক্ষুনি।”

    মহাকাশযানের কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল রুমের শক্ত মেঝেতে নখের আওয়াজ করতে করতে একটা কালো, লোমশ প্রাণী ঢুকল। পেছনের পায়ের ওপর ভর দিয়ে সেটা যখন সোজা হয়ে দাঁড়াল তখন বোঝা গেল যে একজন জিনাইটের থেকে সেটা উচ্চতায় কম নয়। আস্তে আস্তে লেজ নাড়তে নাড়তে আর মুখ দিয়ে লালা ফেলতে ফেলতে সেটা সাতাশ নম্বরের পাশে এসে দাঁড়াল। কিন্তু একবারও তার দিকে না তাকিয়ে সেখানেই পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে রইল।

    তাদের দিকে তাকিয়ে কম্যান্ডার চুপ করে গেল। হঠাৎ করেই নিজেকে খুব ছোটো বলে মনে হচ্ছিল তার। এই মুহূর্তে নিজেকে আর তার যানের ক্যাপ্টেন, তার মোলোতম অভিযানের কম্যান্ডার এইসব কিছুই মনে হচ্ছে না। এই মুহূর্তে, সে কেবলই চার নম্বর; অবসর নেবার মুখে এসে দাঁড়ানো এক প্রৌঢ় লজিটেনিয়ান। আর মাত্রই গোটাকয়েক অভিযান ঠিকঠাক করে ফেলতে পারলেই যার ছুটি। অথচ ওই ‘ঠিকঠাক ব্যাপারটাই সমস্যায় ফেলে দিয়েছে তাকে।

    কোনো সংগ্রাহক যদি পরীক্ষানিরীক্ষার পরে কোনো গ্রহ সম্পর্কে নির্ভুল তথ্য সংগ্রহ করতে পারে তাহলে তার কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে বলে ধরা হয়। অন্তত সংগ্রাহকের নিয়মাবলিতে সেরকমই লেখা আছে। কোনো গ্রহ ছেড়ে চলে আসার পরে সেই অভিযানের সঙ্গে যুক্ত সাধারণ সদস্যরা গ্রহটা বা সেই অভিযান সম্পর্কে আর কিছুই মনে রাখে না। কেবল তার কম্যান্ডার একটা রিপোর্ট তৈরি করেন। তাতে সমস্ত পর্যবেক্ষণের ফলাফল দিয়ে, তার বিশ্লেষণ করে, গ্রেট লজিটেনিয়াকে সেই গ্রহ কী দিতে পারে সে সম্পর্কে তাঁর যুক্তিসিদ্ধ সিদ্ধান্তও জানাতে হয়। সেইটে ঠিকঠাক করতে পারলে তবেই তার অভিযানকে সফল বলা হবে। সেই প্রতিবেদন এরপর জমা পড়ে ভিনগ্রহের সভ্যতা বিষয়ক সুপ্রিম কমিটির কাছে। এরপর কম্যান্ডার সহ তার দলের সবাই গোটা অভিযানটার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে ফের পরের অভিযানে রওনা দেয়।

    এতদিন এরকমটাই হয়ে এসেছে। কিন্তু এবারের ঘটনা আলাদা। সবকিছু কেমন গড়বড় হয়ে যাচ্ছে এবারে। গোটা অভিযানটাই কেমন বিস্বাদ, তেতো ওষুধ খাবার মতো হয়ে উঠছে তার কাছে।

    একরকম জোর করেই মাথা থেকে চিন্তাগুলো ঝেড়ে ফেলে দিল কম্যান্ডার। এই অভিযানের ভবিষ্যতই তার কাছে এখন একমাত্র চিন্তার বিষয়। সে একশো চল্লিশ আর সাতাশ নম্বরের দিকে তাকাল। ভারি অদ্ভুত ছদ্মবেশ দু’ জনেরই। এদের মতো কাউকে লজিটেনিয়ায় আগে কখনো দেখা যায়নি। দু’ জনেই কম্যান্ডারের সামনে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে, একজন নগ্ন জিনাইট নারী যার মাথাটা পেছনে সামান্য হেলা আর অপরটা কালো রঙের এক চতুস্পদ। এবার আর আলাদা আলাদাভাবে নয়, কম্যান্ডার তাদের দু’ জনকেই একসঙ্গে পরীক্ষা করে দেখে নিল। সাবধানের মার নেই। এই গ্রহের বুকে এদের এখনো অনেক কাজ রয়েছে।

    খানিক দেখাশোনা সেরে কম্যান্ডার এবার বেশ খানিক আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, “একশো চল্লিশ, ফের বাইরে যাবার জন্য তৈরি?”।

    একশো চল্লিশ মাথা নেড়ে অস্পষ্ট আওয়াজ করল একটা, আর তারপর, যেন ঘাবড়ে গিয়ে তার সামনের থাবাদুটোকে গুটিয়ে বলের মতো করে নিল। ছদ্মবেশটা তাকে জিনাইটদের শহরে লুকিয়ে কাজ করতে খুবই সাহায্য করছে সন্দেহ নেই, কিন্তু ওর পাশাপাশি খাওয়াদাওয়া করা আর মহাকাশযানের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখাটা বেশ শক্ত হয়ে পড়ছে তার। তাছাড়া এই ছদ্মবেশটা ধরতে তার এত সময় লাগে আর এতই পরিশ্রম হয় যে প্রতিবার মহাকাশযানে ফিরে সেই ছদ্মবেশটা আর সে খোলবার ঝামেলায় যায় না।

    “বললে এক্ষুনিই যেতে পারি।” লম্বা চোয়ালের ফাঁক দিয়ে ঘড়ঘড়ে আওয়াজ করে একশো চল্লিশ উত্তর দিল।

    “উঁহু, এখন নয়। কাল। কাল তুমি মনিটর হিসেবে যাবে। অন্ধকার হবার পর। জিনাইটরা দেখতে পায় এমন জায়গায় যে-কোনো অস্ত্রশস্ত্র বা উড্ডয়নযন্ত্র ব্যবহার করা বারণ থাকবে। আগের মতোই।”

    তরুণীটিও এবারে ঘর থেকে বেরোনোর উপক্রম করল। ধাতব মেঝের ওপর তার কাঠের জুতো খুব হালকা শব্দ তুলছিল। কম্যান্ডার একটু ভ্ৰ কোঁচকালেন। এত হালকা পায়ে হাঁটছে কেন এ? একজন স্বাভাবিক জিনাইট মেয়ের হাঁটা কি এর চাইতে খানিক ভারী চালে হয়?

    সাধারণ জিনাইটদের সঙ্গে কোথাও কিছু একটা তফাত রয়ে থেকে যাচ্ছে এর চেহারার। এখানকার মেয়েদের শয়ে শয়ে ছবি দেখে, বিশ্লেষণ করে তার ভিত্তিতেই সাইকম এই ছদ্মবেশটা বানিয়েছে, কিন্তু তাও…

    নাহ। তফাৎটা যে ঠিক কী সেটা সে নিজেও ধরতে পারছে না। নিরানব্বই বা একশো চল্লিশ নম্বর –তারাও কেউ এর চেহারার সঙ্গে জিয়ার অন্য কোনো মেয়ের কোনো বুদ্ধিগ্রাহ্য ফারাক ধরতে পারবে না। কিন্তু জিনাইটরা তবুও ঠিক ওকে ভিড়ের মধ্যে আলাদা করে ফেলছে! কী করে? কোন পথে?

    দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। ঘরে কম্যান্ডার এখন একা। তার মন তখন ভেসে গেছে সব সমস্যা থেকে অনেক দূরে… তার নিজের গ্রহে… লজিটেনিয়ায়… আহা, লজিটেনিয়া! বাইরে ছড়িয়ে থাকা এই হতচ্ছাড়া জিয়া গ্রহটাকে নিয়ে সে-মুহূর্তে আর কোনো চিন্তাই তার মাথায় ছিল না। অকাজের জায়গা একটা। এ গ্রহে অভিযানের প্রথম দিনটা থেকেই তার অভিজ্ঞ চোখ বুঝে গিয়েছিল, মহান লজিটেনিয়াকে দেবার মতো কোনো সম্পদ নেই এই গ্রহের ঝুলিতে।

    .

    ৩.

    জিয়া…

    গলায় কেমন একটা দলা যেন আটকে আসে তার। ভাষায় প্রকাশ করা যায় না এমন এক অদ্ভুত, তীব্র হতাশা আর সারল্যে মাখানো অনুভূতি! তার দিকে চোখ রেখে টান টান তারে বাঁধা শরীরটা স্থির হয়ে থাকে। তার পা মাটি ছোঁয় কি ছোঁয় না! মাথার ওপর এই গ্রহের স্ফটিকস্বচ্ছ তারার দল। তাদের সে স্পর্শ করতে পারে না। রাতের কালো আকাশের ছায়া তার মুখে। বসন্তের বাগিচা যেন-বা এই গ্রহটি! ঋতুরাজের স্বচ্ছ শোভা আর ভোরের আকাশের কোমলতায় জড়ানো! তার হলুদ তারার দিকনির্দেশ মেনে উত্তরের দিকে ভেসে চলেছে একদল পরিযায়ী পাখি। তাদের তীক্ষ্ণ চিৎকার গভীর গিরিখাতে প্রতিধ্বনিত হয়… জিয়া জিয়া জিয়া…

    একসঙ্গে একরাশ অনুভুতির প্লাবনে যেন ভেসে চলেছিল সে। এরকম তার আগে কখনো হয়নি। এ গ্রহ যে কী করল তার! একটা শব্দ থেকে এমন সব অনুভূতি… একজন লজিটেনিয়ান নারীর পক্ষে একটু বেশিই স্বভাববিরুদ্ধ। যেমন এই অকারণ মনখারাপ! এতই তীব্র তার অভিঘাত, যে কোনো আলো, কোনো শব্দ সেই মনখারাপের বর্মকে ভাঙতে পারে না। যেমন সহসা জেগে ওঠা তীব্র, অদম্য, যন্ত্রণাদায়ক কামনার ঢেউ… হাতুড়ির মতো ক্রমাগত আঘাত করে যায় তার চেতনায়। অথবা সেই অদ্ভুত অনুভূতি যা সেই সন্ধেয় তাকে আচ্ছন্ন করেছিল! কোনোমতেই যার নাগাল থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারছিল না সে… নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল তার… সে অনুভূতি ছিল তীব্র আতঙ্কের।

    চারজন ছিল ওরা আজ। চারজন সৈনিক। পেছন থেকে দুটো চতুষ্পদের মতোই শব্দ তুলে মাপা পায়ের মার্চের ভঙ্গিতে যখন ওকে লক্ষ করে এগিয়ে আসা শুরু করল তারা, তখনই ও প্রথম ভয় কাকে বলে টের পেয়েছিল। অনুভূতিটা যেন বাইরের কোনো উৎস থেকে আসছিল… ওর চারপাশ থেকেও, আকাশ বাতাসে ঘনিয়ে উঠে ওর মাথাটাকে ঘিরে একটা শক্তিক্ষেত্র তৈরি করে ফেলল যেন। কিন্তু সেই শক্তিক্ষেত্র ওকে রক্ষা তো করলই না, বরং ওর সমস্ত চিন্তাশক্তিকে পঙ্গু করে দিল, ওর রক্তকে ঠান্ডা করে দিল। চিৎকার করে মাটিতে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে পড়বার তীব্র একটা ইচ্ছে সেই মুহূর্তে চেপে ধরেছিল ওকে।

    তবে শেষপর্যন্ত ও এরকম কিছুই করল না। বদলে ও ‘ভয়’ শব্দটাই উচ্চারণ করল কয়েকবার। সেটা উচ্চারণ করামাত্রই অসহায় অনুভূতিটা দূর হয়ে গেল ওর। ও আবার চিন্তা করার শক্তি ফিরে পেল। ও, সাতাশ নম্বর, কড়া নিয়মকানুনের লজিটেনিয়ান দুনিয়ার এক প্রাণী! অথচ ও কিনা নিজেকে ওই অসভ্য জিনাইটদের পর্যায়ে নামিয়ে ফেলেছিল, যারা যুক্তির বদলে জৈবিক প্রবৃত্তির বশে কাজকর্ম করে! কথাটা ভেবে ও নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিল।

    ‘ভয়!’ নিজের মনেই ও আবার বলল, এই জান্তব ভয়ই ওর মধ্যে আত্মরক্ষার প্রবৃত্তিকে জাগিয়ে তুলেছিল। সৈনিকদের পায়ের শব্দ, ঝনঝন আওয়াজ, রাতের ভেজা স্যাঁতস্যাঁতে হাওয়ায় আটকে থাকা তাদের নিঃশ্বাসের শব্দ –এই সবকিছু মিলেই ওকে ওই ছায়া ছায়া রাস্তাটায় ওভাবে উদভ্রান্তের মতো দৌড়তে বাধ্য করেছিল। আতঙ্ক গ্রাস করেছিল ওকে। সেই মুহূর্তটায় ও না ছিল একজন সংগ্রাহক, না একজন যুক্তিবাদি লজিটেনিয়ান মহিলা। ভয় পেয়ে যাওয়া এক ছোটো জিনাইট মেয়ের মতোই হয়ে গিয়েছিল ও তখন।

    যেইমাত্র ও সেটা বুঝতে পারল, ছোটা থামিয়ে দিল ও। ওর পেছনে যে চারজন তাড়া করে আসছিল তারা কিন্তু অত চট করে নিজেদের থামাতে পারল না। আরও কয়েক পা এগিয়ে, ঢালু কর্দমাক্ত পথে পিছলে পা ফাঁক করে বসে পড়ে কোনোমতে তাদের থামতে হল। সাতাশ নম্বরের থেকে মাত্রই কয়েক পা দুরে। তা সত্ত্বেও একই জায়গায় ওরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁফাচ্ছিল। আর কয়েক পা দৌড়ে এসে ওকে ধরবার উৎসাহ ওদের কারোই আর অবশিষ্ট ছিল না।

    সাতাশ নম্বর এইবার পেছন ফিরে ওর পিছু ধাওয়া করা জিনাইট সৈনিক চারজনের দিকে তাকাল, কিন্তু তার শরীরের একটা পেশীও নড়ল না। ওর স্থির হয়ে দাঁড়ানো, ওইভাবে তাকানো –এসব কিছুর মধ্যেই একটা অস্বাভাবিকত্ব ছিল। একটুও নড়াচড়া না করে একেবারে স্থির হয়ে দাঁড়ানোটা একজন জিনাইটের পক্ষে খুবই অস্বস্তিদায়ক এবং অসম্ভবও। একমাত্র লজিটেনিয়ানদের পক্ষেই এটা সম্ভব।

    কিন্তু সাতাশ নম্বর খুবই অনভিজ্ঞ, তাই নিজের এই ভুলটাও বুঝতে পারল না। শান্তভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ও সৈনিকদের ভালো করে দেখে যেতে লাগল। যদিও এতক্ষণ ওর পেছনে দৌড়ে এসে এখন তারা এত নিরীহর মতো দাঁড়িয়ে আছে কেন তা বুঝতে পারল না। ইচ্ছে করলে তো এক লাফে ওর একদম কাছে চলে আসতে পারে।

    ওদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তরুণীটির মন থেকে ভয় একেবারে উধাও হয়ে গেল। কিছুক্ষণ আগে ভয় পাওয়ার জন্যে বরং একটু লজ্জিতও হল। ভয়ের সেই তীব্র অনুভূতি সম্ভবত আর কখনো ফিরে আসবে না। কম্যান্ডারকে কি ও এসব বলবে? একজন লজিটেনিয়ান হিসেবে ও যা অনুভব করছে তা কম্যান্ডারকে তো তার রিপোর্ট করবার কথা! সংগ্রাহকের তো তাই কাজ।

    অবশ্য ও এখন আর আদৌ কোনো লজিটেনিয়ান নয়। এই সৈনিক চারজনের কী করবে ও? ওরা ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁফাচ্ছে। সাধারণত ঠোঁট অল্প ফাঁক করা আর বুকের ওঠানামা দেখে জিনাইটদের শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়া বোঝা যায়। কিন্তু এদের সারা শরীরই যেন ধড়ফড় করছে, ঘড়ঘড় করে গার্গল করার মতো আওয়াজ বেরোচ্ছে গলা দিয়ে, পা থেকে কোমর অবধি কেঁপে কেঁপে উঠছে, বুক মনে হচ্ছে ফেটেই যাবে আর চোয়ালগুলো হাঁ হয়ে ঝুলে রয়েছে। শব্দ করে তারা ঢোঁক গিলল আর তাদের শরীরগুলো একেবারে চুপসে গেল, যেন শরীরের পেশি আর হাড়গোড়গুলো আলাদা হয়ে গেল। আবার ঘড়ঘড় আওয়াজ করে তারা নিঃশ্বাস ছাড়ল।

    তবে যতই হোক, এরা মিলিটারির লোক। প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্যে জিনাইটদের বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এদের সামনে অত জোরে দৌড়েই ভুল করেছে সাতাশ নম্বর।

    দুরুদুরু বক্ষে তরুণীটি তার মেন্টরকে মনে করল। সে আর কেউ নয়, একশো চল্লিশ নম্বর, ওই বিশাল কালো চতুষ্পদ প্রাণীটা। সরাইখানা থেকে বেরিয়ে আসার পর ও আর তাকে দেখতে পায়নি। একশো চল্লিশ ওর সঙ্গে সরাইখানায় ঢুকতে পারেনি, তাই সে আলো-আঁধারি একটা রাস্তায় ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছিল। কিন্তু চারজন সৈনিক সেই সময়ে মারামারি শুরু করল, কাছেই একটা আবর্জনার স্তূপ থেকে সাদা পাথরের টুকরো, মাটির দলা, হাড়গোড় তুলে নিয়ে ছোঁড়াছুড়ি করতে লাগল। তারপরেই ওরা তরুণীটিকে দেখতে পেয়ে ওকে তাড়া করল। এ-গলি ও-গলি দিয়ে তাড়া করতে করতে শহরের বাইরে সেই সমুদ্রের কাছে ওকে ওরা নিয়ে এল। কিন্তু কোথাও একশো চল্লিশকে দেখা গেল না।

    সাতাশ নম্বর বুঝতে পারছিল না এই সৈনিকগুলো এখন এরকমভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে কেন? এতটা পথ ওর পিছু ধাওয়া করে আসার কী কারণ ছিল তাহলে? এখন তো আর ওর কাছে আসার কোনো ইচ্ছেই ওদের মধ্যে আছে বলে মনে হচ্ছে না।

    ওর কী কিছু বলা উচিত বা উলটোমুখো হয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়া উচিত? এইভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবার কোনো অর্থ নেই। একেবারেই বোকার মতো কাজ। এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে বেরোনোর আর কোনো রাস্তা না পেলে ওকে বাধ্য হয়ে ওদের চোখের সামনেই ওর উড়ানযন্ত্র চালু করে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেতে হবে।

    হঠাৎ ও লক্ষ করল ওদের চারজনের মুখের ভাব আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছে। তার মানে কি ওরা কিছুর জন্যে অপেক্ষা করছিল?

    এবার… এরা সবাই একসঙ্গে…

    কিন্তু ওরা কেউ কিছু করতে পারল না। ওদের দেখে মনে হল ওরা কীরকম যেন হতভম্ব হয়ে পড়েছে। আর তার পরেই ওদের মুখে ভয়ের স্পষ্ট ছাপ পড়ল। ঠিক এই একইরকম ভয় ও-ও পেয়েছিল না? কিন্তু ওদের ভয় পাওয়ার কারণটা কী? ফাঁকা একটা জায়গায় তরুণীটি দাঁড়িয়ে, তার মুখের ওপর চাঁদের আলো পড়েছে আর তাতে বোঝা যাচ্ছে যে সে মুখ একেবারে একজন সাধারণ জিনাইট মহিলার। ও তো নড়াচড়াও করছে না। তাহলে হলটা কী?

    হঠাৎ পাথুরে রাস্তায় নখের আওয়াজ ভেসে এল, বহুদূর থেকে। বলা বাহুল্য, জিনাইট সৈনিকরা কিছু শুনতে পায়নি আর সেইদিকে তাকালেও কিছুই দেখতেও পেত না। কিন্তু শব্দটা শোনামাত্র সাতাশ নম্বর বুঝতে পারল যে এই বিচ্ছিরি, অস্বস্তিকর অবস্থা এবার শেষ হবে। শেষমেশ শব্দটা এবারে কাছে এসে যেতে সৈনিকরা যখন পেছন ফিরল, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। জন্তুটা এক লাফে ওদের টপকে সাতাশ নম্বরের পায়ের কাছে চলে এল আর এসেই একেবারে স্থির হয়ে গেল, যেন চকচকে কালো পাথরে তৈরি এক মূর্তি। তরুণীটিও আগের মতোই একটা পেশিও একটুও না নাড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

    জিনাইটরা কয়েক মুহূর্ত দাঁড়াল, তারপরেই ওদের একজন ঝাঁকিয়ে উঠল আর সবাই কাঁপতে কাঁপতে পড়ে গেল। ওদের দাঁতে দাঁত লেগে ঠকঠক করছিল আর তার মধ্যেই ওরা বারবার একটা শব্দ উচ্চারণ করছিল যেটা কোনো লজিটেনিয়ানই আগে কখনো শোনেনি আর তার অর্থও জানে না। শব্দটা হল ‘গেকাটা’।

    সৈনিকদের কাঁপুনি ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছিল। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে এবার ওরা মাথা না তুলেই ছুটে পালিয়ে গিয়ে কাছাকাছি কোনো ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে গা ঢাকা দেবে। ঠিক তখনই কালো মেঘের দল উড়ে এসে চাঁদকে ঢেকে ফেলল। সেই আধো অন্ধকারে ক্রমশ মিলিয়ে যেতে থাকা ছন্দোবদ্ধ পায়ের শব্দে বোঝা গেল যে পিছু ধাওয়াকারীরা পালিয়েছে।

    খানিক বাদে মেঘের আড়াল থেকে চাঁদ ফের বেরিয়ে এলে ওরা দু’জন চলতে শুরু করল। তরুণীটি মাথা নীচু করে কুকুরটার দিকে দেখল একবার। যেন বলতে চাইছে, সবকিছু তো ঠিকঠাকই আছে, আমরা কোনো নিয়ম তো ভাঙিনি, তাই আমরা এখন ফিরে গিয়ে কম্যান্ডারের কাছে রিপোর্ট করতেই পারি! সে-দৃষ্টির জবাবে কুকুরটা অত্যন্ত বীতশ্রদ্ধভাবে মাথা নাড়ল। তার ঘাড়ের রোমগুলো খাড়া খাড়া হয়ে উঠেছে। সেগুলো আর চকচক করছিল না। হ্যাঁ, সবকিছু এখন ঠিক হয়ে গেছে বটে, কিন্তু তারা বিচ্ছিরি কিছু ভুল করেছে যেগুলোর কথাও কম্যান্ডারকে বলতে হবে।

    তরুণীটি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে এল। চার নম্বরকে ও সবকিছু বলবে ঠিকই, কিন্তু ব্রোঞ্জের বর্ম পরা ওই চারজন পিছু ধাওয়াকারী সৈনিককে দেখে যে ভয় পেয়েছিল সেটা কখনোই জানাবে না। সেটা ওর একান্ত নিজস্ব অনুভব এবং সেটা চিরদিন অনুচ্চারিতই থাকবে। তাতে ভালো, মন্দ সে যাই হোক না কেন। তাছাড়া ভয় পাওয়া কোনো লজিটেনিয়ানেরই উচিত নয় আর সে সম্পর্কে জানারও তাদের কোনো প্রয়োজন নেই। এটা এমনই এক অদ্ভুত অনুভূতি যা ও চিরদিন গোপন রাখবে।

    মহাকাশযানে ফিরে আসবার পর সাতাশ নম্বরের মনিটর, ঘটনাটা যতটুকু দেখেছে বুঝেছে সেই সবকিছুই রিপোর্ট করল কম্যান্ডারকে। শুধু ওই ভয় পাওয়ার কথাটাই বলল না।

    সব শুনে কম্যান্ডার মাথা নীচু করে বসে রইল একটুক্ষণ। এই বিশৃঙ্খল আর এলোমেলো জিয়ার জন্যে সে বড়োই ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। এখন যদি কোনো মেসেজ আসত… এক্ষুনি এখান থেকে রওনা হবার মেসেজ… তাহলে সে তার সমস্ত জিনিসপত্র জিয়াতে ফেলে রেখে মাথার ওপরের এই বিচ্ছিরি নীল আলো ছুঁড়ে নক্ষত্রর মাঝে কালো মহাশূন্যে হারিয়ে যেতে এক মুহূর্ত দেরি করত না। নিজের মনোমতো পরিবেশে ফিরে যাওয়া। এটাই একদম ঠিক কথা, নিজের মনোমতো পরিবেশ। ভাবতে ভাবতে একটু হতাশ হয়েই ঘাড় নাড়ল সে। এখন সে সৌভাগ্যের সময় নয়।

    গ্রেট লজিটেনিয়ার ধবধবে সাদা সমাধিগৃহে অনেক সমাধি আছে। তবে সেগুলো সবই সাধারণ লজিটেনিয়ানদের। একজন সংগ্রাহকেরও সমাধি সেখানে পাওয়া যাবে না। ঘটনাচক্রে যদি কোনো সংগ্রাহকের মৃত্যু তার নিজের গ্রহে হয় তাহলে তার দেহাবশেষ হালকা আলোমাখা ক্যাপসুলে পুরে মহাশূন্যে ছুঁড়ে ফেলা হয়, লজিটেনিয়ান মহাকাশযানের যাতায়াতের পথ থেকে বহুদূরে।

    ‘নিজের মনোমতো পরিবেশ’ কথাটা এইজন্যেই চার নম্বরের মনে এসেছ। প্রথমে একটা রসিকতার মতো, তারপরে তিক্ততায় আর তারও পরে একেবারে নিঃস্পৃহ হয়ে। সে বড়োজোর তার চেনাজানা ‘মনোমতো কোনো পরিবেশে থাকতে পারবে, কিন্তু কখনোই নিজের বাড়িতে থাকতে পারবে না, কারণ তার তো কোনো বাড়িই নেই।

    গ্রেট লজিটেনিয়ায় হাজার নিয়মকানুন আছে আর সেগুলোই একেবারে সঠিকভাবে নির্দিষ্ট করে দেয় যে কোনো গ্রহে কে কতক্ষণ থাকবে। জিয়া এমনই এক গ্রহ যার দেওয়ার মতো কিছুই নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও একের পর এক নানান পরীক্ষানিরীক্ষা করে যেতে হবে। নতুন সংগ্রাহকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্যে এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে। এই গ্রহ যে সত্যিই কোনো কাজে আসবে না তার প্রমাণ সংগ্রহ করতে হবে। একমাত্র তারপরেই তারা এই গ্রহ ছেড়ে যেতে পারবে। অবশ্য যাওয়ার আগে নিজেদের উপস্থিতির সব চিহ্ন মুছে ফেলতে হবে। নতুন সংগ্রাহকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া আর নিয়মকানুন আর নিয়মকানুন…

    “শহরে ঢোকার জন্যে কাল তোমার শেষ সুযোগ। তিরানব্বই নম্বর তোমার মনিটর হবে।”

    .

    ৪.

    কম্যান্ডার শুধুমাত্র সাতাশ নম্বরকেই রিপোর্ট করতে বলেছে, তাই একশো চল্লিশ নম্বর মহাকাশযানের বাইরেই রয়ে গেল। যতক্ষণ বাইরে থাকা যায়! আসলে সবসময়েই তার কেমন যেন মনে হয় তার নখওয়ালা থাবা আর গায়ের ঢেউ খেলানো লোম মহাকাশযানের ভেতরের উজ্জ্বল সাদা রঙকে নোংরা করছে।

    একশো চল্লিশ ঘেন্নায় মাথা নাড়ল। দেখলে মনে হবে, যে পোকাটা সারাদিন ধরে তাকে উত্যক্ত করেছে তাকেই তাড়ানোর চেষ্টা করছে সে। এখন রাত হয়ে গেছে, পোকামাকড়ও আর নেই, কিন্তু একঘেয়ে, অবিরামভাবে বয়ে চলা চিন্তাগুলোর হাত থেকে ওর মুক্তি নেই, তাই শান্তিও নেই।

    ওরা সবকিছুই গোলমাল করছে। মেয়েটা কোনোদিনই ঠিকঠাক সংগ্রাহক হয়ে উঠতে পারবে না। এই জঘন্য, বিশৃঙ্খল দুনিয়ার ওপর ও বিশদে অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করতে চাইছে। এই নোংরা শহরের দুর্গন্ধময় অজস্র গলিঘুজির গোলকধাঁধাতে ক্রমাগত ঘুরে মরছে ও। যা কিছু গ্রেট লজিটেনিয়ার মতো নয় তার প্রতি যেমন ওর কোনো ঘৃণা বা বিদ্বেষ নেই, তেমনই ওর নিজের গ্রহের কাজে লাগবে এরকম জিনিসপত্র খোঁজবার ব্যাপারেও বিশেষ কোনো আকর্ষণ নেই। আর ওই বুড়ো কম্যান্ডার? মাতৃগ্রহের প্রতি ওর হৃদয়ে যে অপরিসীম অন্ধ ভালোবাসা আছে তার দশ ভাগের একভাগও মহাকাশযানের সব কর্মীদের মধ্যে মিলিতভাবে নেই। আর এই ভালোবাসার কারণেই ওর মন সব সময় নানান এলোমেলো ভাবনায় ঢেকে থাকে।

    একশো চল্লিশ নম্বর ওর লম্বা নাকওয়ালা মুখটা উঁচু করে বুকফাটা একটা আওয়াজ তুলল। এই শব্দটার কোনো অর্থ না জিনাইটদের ভাষায় আছে, না লজিটেনিয়ানদের। অথচ আওয়াজটা বের হয়ে এসেছে ওর হৃদয় থেকেই। একশো চল্লিশ নম্বর অবশ্য নিশ্চিত নয় সেটা কার হৃদয়, ওর নিজের, না যে প্রাণীর রূপ ও ধারণ করেছে তার।

    ওর মতো দেখতে এরকম জন্তুদের ও শহরের রাস্তাঘাটে, নানান এলাকায় দেখেছে। আকারে, গায়ের রঙে, গলার স্বরে, স্বভাবে তারা একে অপরের চেয়ে আলাদা। তবে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই একশো চল্লিশ নম্বর বুঝেছে যে এদের মোটামুটিভাবে দুটো ভাগে ভাগ করা যায়। একদল গৃহহীন, আর একদলের মালিক নির্দিষ্ট কয়েকজন জিনাইট।

    হালকা আলোয় ঘেরা মহাকাশযানটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একশো চল্লিশ নম্বর বুঝতে পারল ওর আসল বাড়ি কত দূরে! বাড়ি ফেরার জন্যে ওর মন কেমন করে উঠল। চাঁদের আলোয় ঝলমলে বিশাল মহাকাশযানটা আসলে সেই দুরে থাকা দুনিয়ার একজন ক্ষুদ্র প্রতিনিধি মাত্র। নিজের দেশের সেবা করার মধ্যে যে অসীম আনন্দ রয়েছে তা হঠাৎ করে এইভাবে অনুভব করতে পেরে ওর মন আর্দ্র হয়ে উঠল। ফের একবার কুঁই কুঁই করে ডেকে উঠল ও। ছলছলে চোখের সাদাটে পাতাগুলো পিটপিট করতে করতে হামাগুড়ি দিয়ে ও মহাকাশযানের দিকে এগোল।

    .

    ৫.

    নতুন উৎসাহ আর উদ্দীপনা নিয়ে পরেরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠল তিরানব্বই নম্বর। এই নোংরা গ্রহে কাজকর্মের জন্যে আজই ও শেষবারের মতো যাবে।

    তিরানব্বই নম্বরের বয়স হয়েছে। অভিজ্ঞ এবং বিচক্ষণ ব্যক্তি। যে-কোনো গ্রহে গিয়ে ও বেশিরভাগ সময়েই সেখানকার বয়স্ক, দুর্বল কোনো স্থানীয় বাসিন্দার পরিচিত চেহারা ধরে। তবে সে গ্রহে নামার কোনো জায়গা থাকলে আর সেখানে অনুকরণ করার মতো কোনো বয়স্ক বাসিন্দা থাকলে তবেই এটা সম্ভব হয়। গোটা লজিটেনিয়ার দক্ষ সংগ্রাহকদের মধ্যে সে যে অন্যতম একথা ও নিজে খুব ভালো করেই জানে আর সেটা ভেবে ফুর্তিও পায়। সত্যি কথা হচ্ছে, সবকিছু নিয়েই হাসাহাসি করার অভ্যেস ওর আছে, বিশেষ করে ওর সহযাত্রীদের নিয়ে। নিজের এবং অন্যের ছোটোখাটো ভুল-ত্রুটিও খুঁজে বের করা ওর স্বভাব। আর এ নিয়ে যে কম্যান্ডারও মজা পায়, তা ও লক্ষ করেছে।

    একজন আদর্শ সংগ্রাহক হওয়াই ওর জীবনের লক্ষ্য ছিল। আর, তা পূরণ করার জন্যে সংগ্রাহকদের নিয়মাবলীর প্রতিটা নির্দেশের অন্ধ অনুসরণ করে গেছে সে চিরকাল। গ্রেট লজিটেনিয়ার প্রতি একশো চল্লিশ নম্বরের অন্ধ আনুগত্যও ওর কাছে মজার এক বিষয়। সেই গ্রেট লজিটেনিয়া, একশো চল্লিশের মাতৃভূমি; কোনো বিশেষ কাজের পুরস্কার হিসেবেই যার দর্শনলাভ তাদের কপালে কদাচিত জোটে। আর এই হতচ্ছাড়া সাতাশ নম্বরকে দেখে তো ওর হাসি সামলানোই দায় হয়! একে তো গাল টিপলে দুধ বেরোয়, তার ওপর এই প্রথম অভিযান নিয়ে তার সে কী উচ্ছ্বাস! সাতাশ নম্বর এই প্রথম কোনো গ্রহে এল কিনা!

    কিন্তু সে উচ্ছ্বাস বেশিদিন থাকবে না ও-মেয়ের। এরপর আরেকটা গ্রহ, তারপর আরেকটা… এই করতে করতেই এই উচ্ছ্বাস ওর বদলে যাবে নিঃস্পৃহতায় বা নিষ্ঠুরতায়। একশো চল্লিশ নম্বরের ক্ষেত্রে যেরকম হয়েছে। নিজের দ্রুত শেষ হয়ে আসা জীবনীশক্তি, নিঃস্পৃহ স্বভাব আর দায়িত্বজ্ঞানহীনতার তীব্র অনুভূতি তখন সাতাশ নম্বরেরও হবে। সংগ্রাহকের জীবনের সেটাই অবধারিত ভবিতব্য। গ্রহ আর মহাকাশযাত্রা, মহাকাশযাত্রা আর গ্রহ, আর এর মধ্যে দিয়েই গ্রেট লজিটেনিয়ার গৌরবের জন্যে সামান্য যা কিছু তথ্য তারা চুরি করে, তার বিনিময়ে এই তাদের একমাত্র মজুরি।

    ‘বেচারা!’ সরু, পাথুরে রাস্তা ধরে সাতাশ নম্বরের পেছন পেছন যেতে নিজের মনেই বলল তিরানব্বই নম্বর। রাস্তার এখানে ওখানে গৃহবধূরা তাদের বাড়ির দেওয়ালের ওপাশ থেকে আবর্জনা ছুঁড়ে ফেলেছে আর সেই দুর্গন্ধময় আবর্জনার স্তূপের জন্যে রাস্তাটাকে যেন আরও অন্ধকার অন্ধকার লাগছে।

    চারপাশে অনেক গাছ! যেন মন্দিরের সার। ওদের সরু সরু চকচকে পাতাগুলোর গড়ন ভারি সুন্দর। আধা স্বচ্ছ, ছোটো ছোটো পাতাগুলোকে দেখে মনে হয় যেন তাদের ওপর কোনো ধাতুর চূর্ণের প্রলেপ লাগানো আছে। জ্যামিতিকভাবে নিখুঁত মোটা মোটা গাছের ডাল থেকে ঝুলছে থোকা থোকা কালচে নীল রঙের ফল। একেকটা থোকায় এত ঘন হয়ে রয়েছে খুদে খুদে ফলগুলো যে দেখে মনে হবে যেন বিরাট বড়ো একেকটা গোটা ফল… চলতে চলতে ভারি খুশি হয়ে তাই দেখছে মেয়েটা।

    … ‘হুহ। বেজায় ফুর্তি প্রাণে।’ মেয়েটার দিকে দেখতে দেখতে তিরানব্বই মনে মনে ভাবছিল। শুরুটা সবারই এমনভাবেই হয়। গ্রেট লজিটেনিয়ার বিধিসম্মত শৃঙ্খলার শিক্ষার ফল। এর মতো অজস্র তরুণ কর্মী কর্মজীবনের শেষ অবধি টের পায় না যে এই অসহ্য পেশা থেকে বেরোনোর পথ একটাই–নিজের কমরেডদের মিথ্যে কথা বলা আর নিজের পেশার সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা করা।

    ঠিক কতদিন আগে থেকে ও সংগ্রাহকের আসল কাজ বন্ধ করে দিয়েছে সেটা তিরানব্বই নম্বর নিখুঁতভাবে বলতে পারে। ইদানীং নতুন কোনো গ্রহে পৌঁছেই বিপুল অভিজ্ঞতা আর সহজাত জ্ঞানের জোরে ও সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে মিশে যায়। এতটাই, যে ওকে আর অন্যদের থেকে আলাদা করা চেনাই যায় না। যে-কোনো গ্রহের একজন সাধারণ বাসিন্দার কীসে আনন্দ হয় সেটাও ও নিখুঁতভাবে আন্দাজ করে নিতে পারে। উঁহু, কোনো উঁচু দার্শনিক, সুক্ষ্ম আনন্দের খোঁজ ও আদৌ করে না। বরং ও যার রূপ ধারণ করেছে তার একান্ত সাধারণ, মোটাদাগের আমোদ-আহ্লাদগুলোকে বুঝে নিয়ে সেইগুলোকেই চুটিয়ে উপভোগ করে যায়।

    সংগ্রাহক হিসেবে ওর তৃতীয় অভযানে ও গিয়েছিল রেমিজাঙ্গি গ্রহে। সেখানে একবার ও কয়েকটা নিষিদ্ধ নীল মাকড়শা ধরে, চোখমুখ কুঁচকে সেগুলোকে নিজের পেটের ওপর রেখে ঘেঁতলে ফেলেছিল। আহা, কী তার সুবাস! সেই গন্ধ নাকে টেনে রেমিজাঙ্গির হিসেবে প্রায় তিন-তিনটে দিন ও নেশায় চুর হয়ে পড়েছিল। আবার ধরো সেই গ্রহটা, ওর সূর্যের নাম নিনা। সেই সৌরমণ্ডলে ওই একটামাত্র গ্রহ। জনবিস্ফোরণের জন্য সেখানে জায়গা অকুলান। সেখানকার আধা জংলি জীবগুলো এক-একবারে আট থেকে ন টা বাচ্চার জন্ম দিত। অতএব বাচ্চাদের যতদূর সম্ভব নিকেশ করাই তাদের বাঁচবার রাস্তা। সেখানে গিয়ে ও সেই জীবদের সঙ্গে তাদের রূপ ধরে মিশে গেল। তারপর সেখানকার দস্তুর অনুযায়ী মুখ থেকে লালা ঝরাতে ঝরাতে ও এক গুহা থেকে আরেক গুহায় ওদের হলদেচোখো বাচ্চাগুলোকে খুঁজে বেড়াত। আর কখনো তেমন দু-একটার নাগাল পেলেই খপ করে চেপে ধরে হাউমাউ করে হাঁকার ছেড়ে গোটা দলটাকে এনে জোটাত তাকে নিকেশ করবার জন্য। আবার ধরো কপার মাউন্টেনের ঘটনাটা। সেখান থেকে কোনোমতে পালিয়ে বেঁচেছিল সে শেষতক। দলের অর্ধেক নিকেশ হয়ে গিয়েছিল তার সেই অভিযানে। তবে পালাবার আগে ইস্তক লজিটেনিয়ান অর্ডিন্যান্সের ছ’ খানার ভেতর অন্তত চারখানা আইন তো সে ভেঙেই ছিল সেখানে! তাছাড়া পাখিমুখো হঁদুর শেয়েলার সঙ্গে রতিক্রিয়া… হে হে… অর্ডিন্যান্সে এরকম আইনভঙ্গের ক্লজ রাখবার কথা আইন বানানেওয়ালাদের মাথাতেই আসেনি।

    ওই বিশেষ অভিযানটায় যাকে বলে ফুর্তির চূড়ান্ত করে ছেড়েছিল তিরানব্বই। এমনকি সেখানকার বাসিন্দারা নিজেরাও তেমন উদ্দাম ফুর্তি করতে পারে না। অবশ্য তিরানব্বইয়ের পক্ষে সেটাই স্বাভাবিক আচরণ। তবে হ্যাঁ, যখন ও মহাকাশযানে থাকে তখন ও একজন পাক্কা লজিটেনিয়ান আর লজিটেনিয়ানরা কখনোই আইন ভাঙে না। সেটা তাদের আইনবিরুদ্ধ। স্বভাববিরুদ্ধও বটে। অনমনীয়, কড়া আইনকানুন সব পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে মেনে চলার শিক্ষা লজিটেনিয়ানিদের ছোটোবেলা থেকেই দেওয়া হয়। সেখানে লোকজনের দৃঢ় বিশ্বাস, কেউ আইন ভেঙে উলটো কোনো আচরণ করলে মানুষের কল্পনাশক্তি জেগে ওঠে। লজিটেনিয়ানদের পক্ষে সেটা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর, খারাপ মাথার অসুখ বলেই গণ্য করা হয় তাকে।

    কিন্তু তিরানব্বই নম্বর কোনো কিছুতেই ভয় পায় না। ভিনগ্রহের প্রাণীর রূপ ধারণ করার সঙ্গে সঙ্গে ও তাদের প্রবৃত্তি, ভাষা, ভাবনাচিন্তার ঢংগুলোকেও আত্মস্থ করে ফেলে। আর, তারপর তাদের মধ্যে মিশে গিয়ে, তাদের প্রবৃত্তির, তাদের আবেগের বশবর্তী হয়ে বিনা দ্বিধায় যা করার তা করে। নজরদার ড্রোনগুলো যে তার গতিবিধির ওপরেও যে নজর রাখছে তা ও ভালোই জানে। কিন্তু তাদের লুকিয়ে কিছু করবার চেষ্টাও সে করে না। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে মিশে যথেচ্ছ ফুর্তি করে যায় আর ড্রোনগুলো সেইসব কিছুর খুঁটিনাটি রেকর্ড করতে থাকে।

    আর কারো এরকম কাণ্ডকারখানা দেখলে অভিযানের কম্যান্ডার নিঃসন্দেহে ঘাবড়ে গিয়ে তার দফারফা করবার হুকুম দিয়ে ফেলত। কিন্তু তিরানব্বইয়ের ব্যাপারটাই আলাদা। নিয়ম-টিয়ম যথেচ্ছ ভেঙেও মহাকাশযানে ফিরে এসে সে সবসময়েই তার কম্যান্ডারকে দিব্যি বুঝিয়ে দেয় যে তার সব কাজকর্মই আসলে গ্রেট লজিটেনিয়ার জন্যে স্বার্থত্যাগের নিদর্শন।

    যে-কোনো ফিল্ড ট্রিপের শেষে, হা-ক্লান্ত আর নিজের ওপরে যেন ভারি বিরক্ত এমন একটা ভাব করে ও কম্যান্ডারের সামনে আসে আর নজরদার ড্রোনগুলো যা যা দেখে থাকতে পারে বলে তার ধারণা সেই সবকিছু নিজে থেকেই গলগল করে উগড়ে দেয়। একটা কথাও লুকোয় না। আর সেই করতে করতেই সেই গ্রহের অধিবাসীদের জীবনের ছবির মতো একটা বিবরণ আর তার মূল্যায়ন তুলে ধরে ও। আর সেই মূল্যায়নটাকে ও সাজায় একজন লজিটেনিয়ানদের দৃষ্টিকোণ থেকে। ঘটনার বিবরণগুলোও এমন ভঙ্গিতে সাজায় যাতে অবধারিতভাবে বোঝা যাবে যে গ্রেট লজিটেনিয়ার কোনো বাসিন্দার তুলনায় সেই গ্রহের বাসিন্দারা একেবারেই আকাট আর ভয়ানক দুশ্চরিত্র। ফিল্ড ট্রিপে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে বলতেই ভারি নিঃস্বার্থ আর নির্দয় একটা হাবভাব নিয়ে, যেন কতই না ঘেন্না পাচ্ছে এমন গলায় ও নিজেরই করা সবচেয়ে লজ্জাজনক ঘটনাগুলোর বিবরণ দিত। ফলে যে ছবিটা ফুটে উঠত তা লজিটানিয়ান আদর্শের নিরিখে একেবারেই ন্যক্কারজনক, আর ফলত স্বাজাত্যাভিমানী লজিটানিয়ান কম্যান্ডারের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হত।

    কায়দাটার ফল হয়েছে এই যে, আর কোনো সংগ্রাহক যে শৃঙ্খলাভঙ্গগুলো করলে তার চাকরি আর প্রাণ দুটো নিয়েই টানাটানি পড়বার কথা, সেই একই কাজ করে তিরানব্বই নম্বরের সুনাম বৃদ্ধিই পেয়ে চলেছে। ভিনগ্রহের প্রাণীদের অভিজ্ঞ মনস্তাত্ত্বিক হিসেবেই তার খ্যাতি এখন। বলা বাহুল্য, সুনামটা অর্জন করবার জন্য তার একমাত্র মূলধন ছিল ওই বেহিসেবি ফুর্তি।

    মাপা পদক্ষেপে সাতাশ নম্বরকে এখন অনুসরণ করছে ও। প্রতি পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে ওর অস্থির হাঁটুগুলো এমনভাবে ওর পরণের পুরোনো আলখাল্লায় ঘষটে যাচ্ছে যে মনে হচ্ছে এবার আলখাল্লার কাপড়ই ফুটো হয়ে যাবে! চলার ঝাঁকুনিতে ওর ছাগল দাড়িও নড়ছে। যে গলিটা দিয়ে ওরা চলছে সেটা একটা খাড়া পাহাড়ের গা ঘেঁষে। লাইল্যাক রঙের পাথরকুচি পাহাড়ের ওপর থেকে ওর চলার পথে এসে গড়িয়ে পড়ছে। পাহাড়তলি ছুঁয়ে এগোনো রাস্তাগুলোর দিক থেকে তাজা বাতাস বইছিল। সে হাওয়ায় ঠান্ডার হালকা আমেজ, তাতে টাটকা ধরা মাছ আর মাটির ওপর ফলে থাকা ডোরাকাটা বড়ো বড়ো ফলের সুবাস। এ-গ্রহের নক্ষত্র, যাকে এখানে হেলিয়স বলা হয়, সে আলো দিচ্ছে বটে কিন্তু তাতে ওদের ঠান্ডা কাটছে না। তবে ছ্যাঁতলা ধরা ইটের বিশ্রী দেয়ালগুলোতে সে আলো পড়ে তাদের সোনালি গোলাপি রঙে রঙিন করে তুলছে।

    হেলিয়স আকাশ বেয়ে ওপরে উঠতে সেই গোলাপি রঙ আস্তে আস্তে হালকা হয়ে আসছিল। তিরানব্বই নম্বরকেও আর বেশি দূরে যেতে হল না। হেলিয়সের গোলাপের পাপড়ির মতো লালচে হলুদ রঙের আলো ছড়ানো পথ মাড়িয়ে ও তার গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেল। গন্তব্যটা আসলে একটা সরাইখানা। এইবারে সেটা চোখে পড়তে বুড়ো তিরানব্বই নম্বর খুশিতে খুক খুক করে হাসল খানিক।

    সরাইখানার ভেতরটা হালকা আলো-আঁধারি রয়েছে তখনও। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জায়গাটা চালু হয়ে যায়। কিংবা বলা ভালো, এটা কখনো বন্ধই হয় না। কাঠের তক্তা দিয়ে বানানো অসমান টেবিলগুলো কখনোই পরিষ্কার করা হয় না। গভীর রাতে হা-ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফেরবার পথে নীচের রাস্তার মেয়েগুলো এইখানটায় আসে। একটু খাবারের খোঁজে টেবিলগুলো হাতড়ে ছড়িয়ে থাকা উচ্ছিষ্টগুলো তারাই চেটেপুটে সাফ করে দিয়ে যায়।

    সরাইয়ের দরজার ঠিক পাশটাতে একটা টেবিল দেখে নিয়ে বুড়ো সেখানটায় গিয়ে বসল। সামনের গোটা চকটা বেশ ভালোভাবে চোখে পড়ে এখান থেকে। সেখানে লোকজনের ভিড়। সরু সরু গলিগুলো সেখান থেকে বেরিয়ে সটান সমুদ্রের ধার অবধি চলে গেছে। এতক্ষণ ও সাতাশ নম্বরের সঙ্গে সঙ্গেই ছিল, মাত্র কয়েক পা পেছনেই। কিন্তু এইবার ওর স্বাধীনভাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা হোক একটু। তিরানব্বই এইখানটায় বসে আসলে তার ধারেকাছেই রইল অবশ্য। প্রয়োজনে সাহায্যও করবে। সেটার দরকার আছে। কারণ যতবারই সাতাশ নম্বর এই শহরে এসেছে ততবারই জিনাইটদের কৌতূহল জাগিয়েছে সে। প্রতিবার, আক্ষরিক অর্থেই, তার রাস্তা আটকে ধরেছে কৌতূহলী জিনাইটরা। আর এটাই উপস্থিত ওই ব্যাটা কম্যান্ডার… ওই ব্যাটা… আহা বোকা পাঁঠাকে জিনাইটরা কী যেন বলে… যাক গে, ওই বোকা-পাঁঠাটাকে একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে ছেড়ে দিয়েছে।

    সাতাশ নম্বর একটা চড়াই বেয়ে উঠছিল। দু’ হাতে ও ওর জামার দুটো ধার ধরে আছে যাতে তা হাওয়ায় না ওড়ে। তিরানব্বই নম্বর কর্তব্যবশত খানিক সেদিকে চেয়ে রইল। তারপর পিঠের ক্যানভাসের ব্যাগ থেকে একটা মাটির কাপ বের করে নিজের সামনে রেখে ফের একবার টেবিলের ওপর ঝুঁকে গলা বাড়িয়ে বাইরে দেখল। নাহ, এখান থেকে আর নজরে পড়ছে না। ওর জায়গায় চড়াই বেয়ে একটা ক্রীতদাস সমুদ্রের ধারে নেমে আসছে এখন। সেখানে মাছ ধরে ফেরা জেলেদের খদ্দের ডাকবার ঘণ্টার শব্দ উঠছে। মাছ নিতেই আসছে নিশ্চয়! কিন্তু না! থেমে গেছে ক্রীতদাসটা। তিরানব্বই একটু উঁচু হয়ে বসল। সাতাশকে এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না অবশ্য, কিন্তু ক্রীতদাসটা নিঃসন্দেহে ওকে দেখেছে। গোল গোল করে তাকিয়ে রয়েছে সামনের দিকে। যেন চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে।

    সাতাশ নম্বরের সামনে এসে পড়লে যে-কোনো জিনাইট ঠিক এইটেই করে থাকে। ছাগলদাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে তিরানব্বই নম্বর আড়চোখে তাকালো, ফের একবার সেদিকে দেখে নিল। ব্যাপারটায় গোলমাল যে একটা কিছু সত্যিই আছে, সেটা ও আন্দাজ করতে পারছিল একটু একটু। ছদ্মবেশের কোনো ত্রুটি এর কারণ নয়।

    আসলে এই গ্রহে এসে সে অভ্যেসমতো জিনাইটদের রূপ, প্রবৃত্তি স্বভাব এই সবকিছুর মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েই ছদ্মবেশ ধরেছে। বলতে গেলে এই মুহূর্তে সে একজন জিনাইট। সে নিজেও কিন্তু মেয়েটার কাছাকাছি এলে একটা ব্যাখ্যাহীন টান টের পায় নিজের ভেতরে। একেবারেই যুক্তিহীন প্রবৃত্তিগত টান। এধরনের অনুভূতি একজন লজিটেনিয়ানের কাছে একেবারেই অজানা।

    যাক গে। এ তো আর নতুন কিছু নয়! ক’ দিন ধরেই হয়ে চলেছে। ওতে আর নজর রাখবার কী আছে। অতএব সে স্যাঁতসেঁতে টেবিলের গায়ে একটা চাপড় মারল। শব্দ শুনে সরাইখানার মালকিন এসে দরজার সামনে দাঁড়াল। যেটুকু আলো ঢুকছিল তাও বন্ধ হয়ে গেল। সরাইখানাটায় একটাও জানালা নেই। আলোগুলোও এই মুহূর্তে নেভানো।

    মালকিনকে দেখে তিরানব্বই নম্বর ওর হাতের মুঠি খুলল। ওর কোঁচকানো তালুর খয়েরি চামড়ায় চকচক করছে একটা মুদ্রা। সরাইখানার মালকিন এগিয়ে এসে সেটা খপ করে তুলে নিল ওর হাত থেকে। নিঃসন্দেহে টাকাটা বুড়ো ভিখিরির চুরির মাল। তবে তাতে তার কী আসে যায়!

    মুদ্রাটার বদলে তিরানব্বই নম্বর পেল এক প্লেট বাসি মাছ, এক চুমুক হালকা রঙের পানীয় আর ছাতাপড়া কিছু সবজি। খাবারগুলো যত্ন করে খেয়ে সে আবার ছাগলদাড়িতে হাত বোলাল। পানীয়টা একেবারে অখাদ্য। তারপর ফের টেবিলে টোকা মারতে শুরু করল। অধৈর্য বিরক্ত টোকা। এবার মালকিনের হাতে আরও বেশ ক’টা মুদ্রা গুঁজে দিল সে। পরনের কাপড়ের ভাঁজে সেগুলো অদৃশ্য হতে দেখা গেল এইবার মালকিনের চলাফেরায় খানিক উৎসাহ এসেছে। আরও পানীয় এল এবং আরও, আরও।

    মুদ্রাগুলো সত্যিই গতরাতে চুরি করা। জাল মুদ্রা তৈরি করতে অকারণ সময় নষ্ট হয়, তাই এই পথ। কম্যান্ডার ব্যাটাকে বোঝানো গেছে যে চুরিটা আসলে গ্রেট লজিটেনিয়ার গৌরব বৃদ্ধির জন্যে একটা অসমসাহসিক এক্সপেরিমেন্ট। কিন্তু আদতে বুড়ো তিরানব্বইয়ের কাছে এটা বিশুদ্ধ একটা মজা। বিনা খাটুনিতে উপার্জনের মজা, যেরকম অনেক জিনাইটই করে থাকে এখানকার পথে ঘাটে। অবশ্য তিরানব্বইয়ের একটা অতিরিক্ত সুবিধে ছিল যা জিনাইটের ছিঁচকে চোরদের নেই। তার কাছে উড়ুক্কু যন্ত্র আর শব্দহীন প্লাজমা ব্লেড ছিল। আর আজ কাল রাতের সেই রোজগার দিয়ে দেদার ফুর্তি। কেয়াবাত!

    কাপের পর কাপ মদিরা গলায় ঢেলে চলেছিল তিরানব্বই। নেশাটা চড়ছিল তার আস্তে আস্তে। ক্রমশ আর দশটা জিনাইট বুড়োর মতোই ওরও হুঁশ চলে। গেল একেবারে। নেশার ঘোর যেন ওকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরছিল। মাথাটা আস্তে আস্তে নীচু থেকে আরও নীচুতে ঝুঁকে পড়ছিল ওর। কাজেই খানিক বাদে সাতাশ নম্বর যখন, যেন অদৃশ্য কেউ তাকে তাড়া করেছে এমনি ভাব করে ওর একেবারে সামনে দিয়ে উধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে মহাকাশযানের দিকে পালিয়ে গেল তখন ও তাকে খেয়ালই করল না।

    .

    ৬.

    কেবিনের দরজাটা খুলে যেতে সাতাশ নম্বর ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে সেখানে কম্যান্ডার এসে দাঁড়িয়েছেন।

    “তুমি? ফিরলে কখন?”

    সাতাশ নম্বর কোনো জবাব দিল না। কম্যান্ডার ভ্রূ কুঁচকে তার দিকে দেখছিল। প্রশ্নটা অবশ্য নিতান্তই বাহুল্য। সাতাশ নম্বর কখন মহাকাশযান ছেড়ে বেরিয়েছে আর কখনই বা মহাকাশযানে ঢুকেছে তা কম্যান্ডারের চাইতে ভালো আর কেউ জানে না।

    তবে কম্যান্ডারের ভ্র কোঁচকাবার কারণ সেটা নয়। কারণ হঠাৎ করেই তার খেয়াল হয়েছে, সাতাশ নম্বরের পোশাকে একটা বদল এসেছে। সকালে যে টিউনিক আর চপ্পল পরেছিল, এখনও পরনে সেটাই রয়েছে, কিন্তু এখন তার রঙ চোখ ধাঁধানো সাদা। ব্যাপারটা শুরুতেই তার খেয়াল হল না কেন? সাতাশ নম্বর কেবিনে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে কেন এটা কম্যান্ডারের নজরে পড়ল না? শুধু জামাকাপড়ই তো নয়। তার ঠোঁটও একেবারে সাদা, যেমন সাদা তার চোখের পাতা আর গায়ের চামড়া। কীরকম অদ্ভুত একটা সাদা রঙ! যেন নিষ্প্রাণ। অথচ ম্যাড়ম্যাড়ে নয়। বরং ঝলমলে এবং দেখে ভঙ্গুর মনে হয়। যেন ধবধবে সাদা বরফের চাঙড় থেকে সাতাশ নম্বরকে তৈরি করা হয়েছে। ধবধবে সাদা একটা মুখ, সাদা চোখ– যেন নিষ্প্রাণ একটা মুখোশ। আর তাতে কালো রঙের চোখের মণিগুলো নড়াচড়া করছে। তারা অন্তত জীবিত।

    “হঠাৎ রূপ বদলালে যে?” সাতাশ নম্বরকে ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতেই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন কম্যান্ডার।

    সাতাশ চুপ করে রইল। তার হাবভাবে বোঝা যাচ্ছিল, প্রশ্নটার জবাব দেবার কোনো ইচ্ছেই তার নেই।

    “গতকাল সন্ধেবেলা তুমি চারজন জিনাইটের তাড়া খেয়ে পালিয়ে এলে, কিন্তু পালালে কেন সেটা গুছিয়ে বলতে পারলে না। আজ সকালেও নিজের কাজ পুরো শেষ না করেই ফিরে এলে, তার কারণ কী সেটাও কিছু বলছ না। তার ওপর, সংগ্রাহকের কাজ করার জন্যে যে ঠিকঠাক পোশাক তোমাকে দেওয়া হয়েছিল তার বদলে এরকম একটা পোশাক আর রূপ ধরেছ। কেন?”

    তরুণীটি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এমনকি তার চোখের মণিদুটোও কোনোরকম নড়াচড়া করল না। বাকি শরীরের মতো ও-দুটোকেও এখন প্রাণহীন বলেই মনে হচ্ছে। কম্যান্ডার কেবিনের ভেতর গোল হয়ে ঘুরতে লাগল, তার কাঁধ দেওয়ালে ঘষটে যাচ্ছিল। এরকম ছন্দোবদ্ধ গতি তার চিন্তাশক্তিকে উজ্জীবিত করে। এই সাতাশ নম্বরটাকে নিয়ে এখন কী করা যায়? কম্যান্ডার নিয়মকানুন মনে করতে লাগল, কোনটা এর পক্ষে উপযোগী হবে।

    ‘যেসব গ্রহের গ্রেট লজিটেনিয়াকে দেওয়ার মতো কিছুই নেই তাদেরকে নতুন সংগ্রাহকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্যে ব্যবহার করা যাবে।’ এই একটা নিয়মই কম্যান্ডারের মনে পড়ল। প্রশিক্ষণ নেবার জন্য শিক্ষানবিশকে পুরোমাত্রায় উদ্যোগী হতে হয়। অথচ মেয়েটা কেমন যেন বিহ্বল একটা অবস্থায় রয়েছে। তবে সাতাশ নম্বরের সমস্ত মনিটর রিডিং অবশ্য দেখাচ্ছে মেয়েটার কোনো গড়বড় হয়নি। অতএব ওর এই হতভম্ব দশাটা কাটিয়ে দেয়া দরকার।

    “এই যে জিয়া গ্রহটা,” কম্যান্ডার বলতে শুরু করল, “আমি জানি যে তুমি একে গভীর আগ্রহ নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করছ, একজন সংগ্রাহকের যতটা করা দরকার তার থেকেও বেশি মনোযোগ দিচ্ছ। তবে একটা জিনিস জেনে রেখো, গ্রহটার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। ধ্বংস হতে বেশিদিন লাগবে না এর।”

    সাতাশ নম্বর হঠাৎ চিবুক তুলে কম্যান্ডারের দিকে তাকাল। তার দৃষ্টি যেন কম্যান্ডারের শরীর অনায়াসে ভেদ করে চলে যাচ্ছিল। ওরকম করে কী দেখছে মেয়েটা সেইটা জানবার জন্য পেছনে ঘুরে দেখবার ইচ্ছে জাগছিল কম্যান্ডারের।

    একটা অস্বস্তির অনুভূতি ছেয়ে ফেলছিল কম্যান্ডারকে। ছাগল দাড়িওলা তিরানব্বই নম্বরের কেজো ভণ্ডামি বা একশো চল্লিশ নম্বরের সর্বব্যাপী অসীম ঘেন্না –এর কোনোটাই তাকে এরকম দ্বিধাগ্রস্ত করতে পারেনি। কিন্তু এখন এই কয়লার মতো কুচকুচে কালো চোখের মণিদুটোর স্থির দৃষ্টির সামনে সে থমকে গেল। আত্মবিশ্বাসটাই কেমন যেন হারিয়ে যাচ্ছিল তার সেই দৃষ্টির সামনে। কী করতে যাচ্ছিল সে? যা সে বলতে যাচ্ছিল সেটা যুক্তিযুক্ত, এই অবস্থার পক্ষে উপযুক্ত এবং প্রয়োজনীয় এবং… মিথ্যে।

    কম্যান্ডার মুখ ঘুরিয়ে নিল। যত্তসব উলটোপালটা ব্যাপার-স্যাপার! তার স্ট্র্যাটেজিতে কোথাও কোনো ত্রুটি ছিল না। এখন এখানে থাকতে থাকতেই অবাধ্য, একগুয়ে। মেয়েটার আত্মা থেকে জিয়ার সমস্ত ছবিকে ধ্বংস করে দিতে হবে। না হলে এরপর যখন অন্য কোনো সৌরজগতের উদ্দেশ্যে রওনা দেবে সে, তখনও জিয়ার কথা তার মনে থেকে যাবে। সেটা বে-আইনি। নিয়মাবলিতে স্পষ্ট বলা আছে, যে একজন সংগ্রাহক তথ্য সংগ্রহ করবে, কিন্তু কোনো কিছু মনে রাখবে না। মহাকাশযান যখন কোনো গ্রহ ছেড়ে চলে যায় তখন সেখান থেকে জোগাড় করা সব তথ্য জমা করা হবে কম্যান্ড মডিউলের স্মৃতিকোষে আর নমুনাগুলো চলে যাবে তাদের জন্য নির্দিষ্ট করা কিছু পাত্রে। সংগ্রাহকের মন সে-গ্রহের সমস্ত স্মৃতিকে মুছে ফেলে নিজের মস্তিষ্ককে তৈরি রাখবে পরের অভিযানের জন্য। লজিটেনিয়ান মহাকাশযানের অসংখ্য অভিযান এবং সম্ভাব্যতা তত্ত্বর ওপর ভিত্তি করে বলাই যায় যে প্রত্যেকটা নতুন গ্রহ মানেই একেবারে ভিন্ন পরিস্থিতি, ভিন্ন শ্রেণীর জীবজগৎ, ভিন্ন সভ্যতা। অবশ্য শেষের বস্তুটা অধিকাংশ গ্রহেই পাওয়া যায় না।

    এরপর একে ঠিক কী বলে বোঝানো যায় সেইটা ভাবতে ভাবতেই কম্যান্ডার কেবিনের ভেতর আরও কয়েকবার চক্কর কাটল। কিন্তু হঠাৎই, সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে সে সাতাশ নম্বরের দিকে না তাকিয়েই খুব আস্তে আস্তে বলে উঠল, “এখন জিয়া যেরকম, লজিটেনিয়াও কিন্তু একদিন ঠিক সেরকমই ছিল।”

    ছি ছি! গ্রেট লজিটেনিয়ার সঙ্গে, এমনকি তার অতীতের অবস্থার সঙ্গেও এই নির্বোধ জিনাইটদের অসভ্য দুনিয়ার তুলনা করাটা যে কতটা অপবাদসূচক তা কল্পনা করাও দুষ্কর!

    “তবে সত্যি বলতে কী, জিয়ার এখন যে অবস্থা, লজিটেনিয়া কখনো ততটা খারাপ দশায় পৌঁছোয়নি। এখানে যা দেখছ, সেটাকে সভ্যতার করুণতম দশা বললেও ভুল হবে। বলা উচিত, একটা সভ্যতার অকালমৃত্যুর সূচনার অবস্থা এইটে। এখানে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ হয়নি। ফলে এর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক উন্নতি একেবারেই সম্ভব নয়। মানুষ এখানে নানা ভাগে বিভক্ত। তাদের ঘাড়ে ধরে সুনির্দিষ্ট নিয়মকানুন মানিয়ে একটা একক লক্ষ্যের দিকে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে এমন কোনো শক্তি গ্রহে নেই।”

    “কিন্তু সভ্যতার এ মরণদশা এখানে হল কেন?” খানিকটা নিজের মনেই বলে চলেছিল কম্যান্ডার, “যেসব নজরদার ড্রোন জিয়ার চারধারে নানান কক্ষপথে ঘুরপাক খাচ্ছে তাদের কাছ থেকে জানা গেছে, এ গ্রহের বাসিন্দা এক-এক উপজাতির উন্নতি এক-এক স্তরে রয়েছে। আর সে উন্নতিও নানান বৈপরীত্যে ভরা।

    “আলাদা আলাদা উপজাতিদের আলাদা আলাদা শাসনতন্ত্র, আলাদা ঢঙের সরকারি, সামরিক, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। কোনোটার সঙ্গে কোনোটা মেলে না। এক-একটা উপজাতির ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানগুলোও আবার একে অপরের ওপর নজরদারি করে। এদের আচরণের অর্থ বোঝা দায়!

    “একটা কেন্দ্রীয় শাসনতন্ত্রের অভাবে প্রত্যেকটা উপজাতিই যেমন ঝগড়ুটে, তেমনই আগ্রাসী। কোনো উপজাতির নেতৃত্বে যেই কোনো দক্ষ লোক আসে, অমনি সে অন্য উপজাতির জায়গা দখল করে তার নিজের দলের সীমা বাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কখনো ভেবেও দেখে না যে এই নতুন দখল করা এলাকা তারা কতদিন নিজেদের শাসনে রাখতে পারবে।

    “নতুন কোনো এলাকা জয়ের আগে অবধারিতভাবে যা চলে তা হল সে এলাকার সঙ্গে বাণিজ্য, আর তার আড়ালে গুপ্তচরবৃত্তি। তারপর লড়াইয়ের সূত্রপাত করে সেই শক্তিশালী লোকটা। সে হয় উপজাতিটার রাজা, কিংবা কোনো নেতা, কখনো কখনো কোনো প্রধান পুরোহিত।

    “তবে এই যুদ্ধযাত্রাটা সে করে তার উপজাতির স্বার্থে নয়, বরং ব্যক্তিগত লাভের খোঁজে। সেটা অবশ্য খুবই যুক্তিপূর্ণ কাজ। কিন্তু যখন সে যুদ্ধজয় করে ধনসম্পত্তি নিয়ে ফিরে আসে তারপর তার কাজকর্মগুলোর কোনো যুক্তি থাকে না আর। লুঠে আনা ধনসম্পত্তির খানিকটা সে দিয়ে দেয় রাজকোষে। সে-টাকার ওপর তার আর কোনো ব্যক্তিগত অধিকারই থাকে না। বাকি যা রইল তার অনেকটা অংশ আবার সে খরচ করে পুরোহিত সম্প্রদায় আর স্থানীয় ক্ষমতাবান লোকজনকে খুশি রাখবার জন্য। হাস্যকর বোকামো। ক্ষমতার যুদ্ধে যারা তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারে কোথায় একেবারে শেষ করে দেবে তা না, তাদের খুশি করবার নামে, নিজের জোটানো ধনসম্পত্তি বিলিয়ে দিয়ে তাদের হাতই শক্ত করা! আর তারপর দেখা যায় এদের দমিয়ে রাখতেই তার সব শক্তি খরচ হয়ে যাচ্ছে।

    “যুদ্ধে বিজয়ী হলে এমনকি সৈনিকদেরও যথেচ্ছ লুঠের ভাগ দেয়া হয় এখানে। যুক্তিসঙ্গতভাবে তাদের যতটা প্রাপ্য তার থেকে অনেক বেশিমাত্রায়। এতে সৈন্যগুলো বলা বাহুল্য গোল্লায় যায়। আরামের জীবন পেয়ে যুদ্ধ-টুদ্ধয় আর কোনো উৎসাহ থাকে না তাদের। বিজয়ী দলের সৈনিকদের প্রত্যেককে কয়েকটা করে ক্রীতদাসও দেয়া হয়। তার ফলে, আজ যে মুখ বুজে, কোনো ভাবনাচিন্তা না করে হুকুম পালন করা সৈনিক, কাল সে হয়ে ওঠে তার ক্রীতদাসদের হুকুম দেয়া মালিক। হুকুম দিতে গেলে ভাবনাচিন্তা করতে হয়। আর এইভাবেই সমাজের এই নীচু স্তরটাতে স্বাধীন চিন্তাভাবনার মারাত্মক রোগটা দেখা দেয়।

    “তার ওপর জিয়াতে আরও অনেক কিছুই হয় যা লজিটেনিয়াতে কল্পনাও করা যায় । যেমন ললিতকলা বা চারুকলার সৃষ্টি। ফালতু কাজ সব। সময় আর শক্তির চূড়ান্ত অপব্যয়। লজিটেনিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে এইসব শিল্পকলার সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের তো একেবারে ধ্বংস করে দেওয়া উচিত, জিনাইটদের নিজেদের মঙ্গলের জন্যেই। কিন্তু লজিটেনিয়া তো আর সমাজসেবার কাজ করে না, তাই ব্যাপারটা নিয়ে আমারও মাথা ঘামিয়ে কাজ নেই। এখানে এসেছি, কিছু নমুনা সংগ্রহ করব তারপর বিদেয় হব, ব্যস।

    “তাহলে জিয়াতে এখন ঠিক কী ঘটছে? প্রত্যেকটা উপজাতির এলাকাতেই সমাজের নীচুতলার মানুষ ওপরতলার কাছে পুরো বশ মানতে তৈরি নয়। বাধ্যও নয়। কারণ তারা তাদের নিজেদের পরিবার, জিনিসপত্র, দাসদাসী, পোষা জানোয়ার–এই সবকিছু টিকিয়ে রাখতে চায়। সমাজের উঁচুতলায় লোকসংখ্যা অযৌক্তিকরকম বেশি। তারা আবার চুড়ান্ত আলসে, গোলগাল, আর আর্ট-এর বিষে জর্জরিত। ক্রীতদাসের সংখ্যা প্রচুর। স্বাধীন। গরিব মানুষদের যে খুদকুঁড়োটুকু জোটে, তাও তাদের জোটে না। সুযোগ পেলেই তাই তারা বিদ্রোহ করতে তৈরি হয়ে যায়। যে বসতির এমন ছন্নছাড়া দশা, তাকে তার পাশের উপজাতি একদিন না একদিন আক্রমণ করে বসবেই। লড়াই হবে। একদল ধ্বংস হবে। আর এই লড়াই চলতে চলতে একদিন জিয়ার গোটা সমাজটাই ধ্বসে পড়বে।

    “কথা হল, নিজে নিজে এই ত্রুটিটা সেরে ওঠবার কোনো রাস্তা কি আছে এই গ্রহে? । যুক্তি বলছে, নেই। কারণ জিনাইটদের সংখ্যা খুব তাড়াতাড়ি বাড়ে। আর ক্রমশ বেড়ে চলা সেই এই বিপুল জনসংখ্যাকে খাওয়ার জোগান দেওয়ার ক্ষমতা এই গ্রহের নেই। নিজেদের মধ্যে এই লড়াইটা তাদের অবধারিত।

    “সেক্ষেত্রে লজিটেনিয়ার সভ্যতাকে জিয়ার ওপর জোর করে আরোপ করার কোনো উপায় আছে কি? অবশ্যই আছে। এই গ্রহের হিসেবে কয়েকশো বছর ধরে লজিটেনিয়ার শাসনে যদি এদের রাখা যায়, একমাত্র তাহলেই এদের বাঁচানো সম্ভব। কিন্তু লজিটেনিয়া এধরনের সমাজসেবার কাজ করে না। তাই জিয়ার ব্যাপারে আমরা নাক গলাব না, তার ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। না তাকে আমরা কোনো সাহায্য করব, না তাকে ধ্বংসের পথে যাওয়া থেকে আটকাব। তার প্রধান কারণ তাকে বাঁচিয়ে রেখে লজিটনিয়ার কোনো লাভ নেই। জিয়া এমনই এক গ্রহ যার গ্রেট লজিটেনিয়াকে দেওয়ার মতো কিছুই নেই…”

    কম্যান্ডার থামল। এতক্ষণ একসঙ্গে এরকমভাবে কথা সে অনেকদিন বলেনি। কিন্তু তার প্রতিটি কথাই যুক্তিসঙ্গত, বিজ্ঞানসম্মত। লজিটেনিয়ার সমীক্ষা সফরগুলোর প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়মটা এইরকম, ‘একজন কম্যান্ডারের প্রধান কাজই হল মহাকাশযানের সমস্ত কর্মীদের সুরক্ষা প্রদান করা এবং তাদের কর্মদক্ষতা বজায় রাখা। আর এটাই নিখুঁতভাবে করবার জন্যই সে মেয়েটাকে এতক্ষণ ধরে এই কথাগুলো বলে চলেছে।

    “এখন যাও।” আর কথা না বাড়িয়ে কম্যান্ডার বলল।

    সাতাশ নম্বর কিন্তু দরজার দিকে এগিয়ে গেল না। উলটে সে সোজা কম্যান্ডারের সামনে এসে দাঁড়িয়ে হঠাৎ বলে উঠল, “আমি জিয়াতে থাকতে চাই।”

    কোনো জবাব দিল না কম্যান্ডার। সাতাশ নম্বরের দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আতঙ্কিত হয়ে সে খেয়াল করল, একটা অ-কম্যান্ডারোচিত অসীম নিঃস্পৃহতা তাকে গ্রাস করছে। সে বলে উঠতে যাচ্ছিল, ‘থাকো তাহলে’ বা ‘থাকা বা না থাকার মধ্যে কোনো ফারাকই নেই আমার কাছে।

    একরকম জোর করেই কথাগুলোকে গিলে নিল সে। তারপর ফের বলল, “এসো আমার সঙ্গে।”

    সাতাশ নম্বরকে নিয়ে মাঝের করিডোরে বের হয়ে এল কম্যান্ডার। তারপর ডেক কেবিন, রান্নাঘর পেরিয়ে যানে ঢোকার মূল দরজাও পেরিয়ে গেল।

    “ওঠো।”

    “প্রথম তলা। নমুনা সংগ্রহ করে রাখার সব কুঠুরিই ভর্তি।”

    “ওঠো।”

    দ্বিতীয় তলায় এল ওরা। সাতাশ নম্বর কী অসম্ভব লঘু পায়ে হাঁটছে! জিয়ার মহিলারা এভাবে হাঁটে না, যদিও এই মুহূর্তে এতে কিছুই যায় আসে না।

    সাতাশ নম্বর তার চলার গতি কমাল। আরেকটা দরজা সামনে। ওরা সেটা পেরিয়ে গেল। আরও একটা। ওরা সেটাও পেরোল। আবার একটা। এই তিন নম্বর দরজাটার সামনে এসে সাতাশ নম্বর হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। কম্যান্ডার থমকে দাঁড়ালেন।

    আর কোথাও যেতে হল না সাতাশ নম্বরকে। যে কুঠুরিটার সামনে সে আছড়ে পড়েছিল সেটার দিকে চোখ পড়েছে কম্যান্ডারের। কুঠুরিটা ফাঁকা। এমন অনেকগুলো কুঠুরিই ফাঁকা রয়েছে এখনো। সেগুলো ভর্তি করবার মতো সময়ও আর পাওয়া যাবে না। এইখানেই তবে একে আটকে রাখা যেতে পারে।

    “ঢোকো।”

    সাতাশ নম্বর ঘরে ঢুকতেই দরজাটা দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল। এ দরজা ভেতর থেকে ভোলা একেবারেই অসম্ভব।

    দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে কম্যান্ডার দ্রুতপায়ে যানের এয়ার লকের সামনে চলে এল। অভিযানের মোটামুটি সব সদস্যই মহাকাশযানে রয়েছে। কম্যান্ডার পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমের সুইচটা টিপে ধরল।

    “ককপিট কর্মীরা এয়ার লকের কাছে রিপোর্ট করো। সমস্ত ড্রোন আর যানবাহন ফিরিয়ে আনবার আদেশ দাও। যা চিহ্নিত নমুনা এখনো তুলে আনা হয়নি সেগুলো আর আনবার প্রয়োজন নেই। যেসব নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে তাদের মহাকাশযানে বোঝাই করে এমার্জেন্সি টেক অফ-এর জন্যে তৈরি হও।”

    .

    ৭.

    কুঠুরির মেঝেটা খরখরে, তবে একেবারেই ঠান্ডা নয়। এই কুঠুরিগুলোয় অজৈব পদার্থের নমুনা রাখা হয়। সাধারণ অবস্থায় যে তাপমাত্রায় তাদের পাওয়া যায় সেই তাপমাত্রাতেই সংরক্ষণ করা হয়ে তাদের। সাতাশ নম্বর দু-হাঁটুর ওপর চিবুক রেখে বসল। রাত সবে শুরু হয়েছে। সূর্য উঠতে এখনও অনেক দেরি। এই সময়টুকুর মধ্যে সবচেয়ে ধীরগতির আর সবচাইতে ভারী সাইবারনেটিক যানে চড়েও ও অন্তত কুড়িবার জিয়ার ওই শহরটাতে যাতায়াত করতে পারত।

    নাহ। সব শেষ হয়ে যায়নি এখনো। সব শেষ হয়নি। কম্যান্ডারের এতই তাড়া ছিল যে সে ওকে তৃতীয় লেভেল অবধি নিয়ে যায়নি। ওর সৌভাগ্যই বলতে হবে। তৃতীয় লেভেলে নিয়ে গেলে আর কিছু করার থাকত না। ভাগ্যিস কম্যান্ডারকে বোকা বানানোটা কঠিন হয়নি! ব্যাপারটা খানিক অবাক হবার মতোই বটে। এত সহজেই ব্যাপারটা ঘটিয়ে ফেলা গেছে যে ওর মনে হচ্ছিল ওকে আগে থেকেই কেউ শিখিয়ে দিয়েছিল যেন। এমনিতে কোনো সংগ্রাহকের পক্ষে তার কম্যান্ডারকে বোকা বানানো সহজ কাজ নয়। যখন চারজন সৈনিক ওকে তাড়া করেছিল, ওর মনে হয়েছিল ও লজিটেনিয়ান নয়, বরং জিয়ার একটা ছোট্ট মেয়ে! আর ওর ভেতরে উঁকি মারা সেই মেয়েটাই এখন চালাকিটা করল। আটক হবার জন্য যে ঘরটা ওর দরকার ছিল, ও সেটাই বেছে নিয়েছে। কম্যান্ডার ওর কৌশলটা বিন্দুমাত্র ধরতে পারল না। হ্যাঁ, ভেতর থেকে এ দরজা খোলা অসম্ভব ঠিকই কিন্তু বাইরে থেকে মানুষ দুরস্থান, একটা মাল বইবার সাইবারনেটিক যান তার খুদে বুদ্ধিতেও ওটাকে খুলে ফেলতে পারবে।

    দরজার বাইরে কিছু একটা খসখস আওয়াজ হল, কিন্তু ও যার জন্যে অপেক্ষা করছে তার আওয়াজ এইটে নয়। এটা খুব সম্ভবত ক্যাটারপিলার বেল্টে চলা হালকা কোনো আয়নাইজার। তবে মাঝে মাঝেই যে গম্ভীর গুনগুন শব্দগুলো উঠছে, সেগুলো মাল বইবার সাইবারনেটিক যন্ত্রনের ইঞ্জিনের। একটার পর একটা বেরিয়ে যাচ্ছে মহাকাশযান ছেড়ে। প্রথম দলটা চলেও গেছে। এতক্ষণে তারা পাহাড় ডিঙিয়ে শহরের আকাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে, ‘শামুক গুলোর খোঁজে। সাতাশ নম্বর আর তিরানব্বই নম্বর দু’ জনে মিলে এক-একদিনে দু-তিনশো এরকম শামুক গোটা শহরে ছড়িয়ে দিয়েছে। বাইরে থেকে এগুলোকে দেখতে অবিকল জিয়ার একধরনের শামুকের মতো, কিন্তু এদের ভেতরে একটা করে আণুবীক্ষণিক ট্রান্সমিটার বসানো রয়েছে। সেগুলো রাতের দিকে নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কে কাজ করে। এছাড়া প্রাথমিক কিছু স্মৃতি সঞ্চয় করার ক্ষমতাও রয়েছে এদের।

    যেসব নমুনা মহাকাশযানে নিয়ে আসা হবে তাদের প্রত্যেকটার গায়ে এক-একটা এই শামুক আটকে দেয় সংগ্রাহকরা। সেই সঙ্গে কোন নমুনা কত নম্বর ঘরে আর কী অবস্থায় সংরক্ষিত করা হবে সেই হুকুমটাও ঢুকিয়ে দেয় তার স্মৃতিতে। এতে কোনোরকম গোলমাল হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই থাকে না, তা সে যত তাড়াহুড়ো করেই নমুনাগুলোকে মহাকাশযানে ভোলা হোক না কেন।

    এরপর সাইবারনেটিক যন্ত্রযানগুলোর কাজ সহজ। রাডারের সাহায্যে রাতের অন্ধকারেই শামুকদের ট্রান্সমিটারগুলোকে খুঁজে বের করে, নমুনাগুলোকে মহাকাশযানে। নিয়ে এসে নির্দিষ্ট ঘরে রেখে দিলেই হল।

    কম্যান্ডার সাতাশ নম্বরকে দ্বিতীয় তলায় নিয়ে গিয়েছিল একটাই যুক্তিতে। সে জানে, অজৈব পদার্থের নমুনা সংরক্ষণ করার এই কুঠুরিগুলো তার অনুমতি ছাড়া কেউ ব্যবহার করতে পারবে না। সকালবেলা সাতাশ নম্বর যে একটামাত্র নমুনা চিহ্নিত করেছিল সেটা যে এই ঘরেই সংরক্ষণের জন্যে নির্দিষ্ট, আর সেইজন্যই যে সাতাশ নম্বর ওর সামনে এসে অমন আছড়ে পড়বার নাটকটা করেছিল, তা সে কল্পনাও করতে পারেনি।

    অতএব সাতাশ নম্বরের কাজ এখন শুধু অপেক্ষা করা কখন সাইবারনেটিক যন্ত্রযান এসে নমুনা রাখবার জন্য এ-ঘরের দরজা খুলবে। হয়তো তার জন্য সময় লাগবে অনেকটা। কে জানে! দাঁতে দাঁত চেপে সে তাই সুযোগটার অপেক্ষায় রইল।

    ওপরে, নীচে, সামনে করিডর –সবদিক থেকে যন্ত্রপাতির ঝনঝন আওয়াজ ভেসে আসছে। প্রচণ্ড নাড়াচাড়ায় মাঝে মাঝেই কেঁপে উঠছে গোটা যানটা। সে টের পাচ্ছিল, আশেপাশের কুঠুরিগুলোর দরজা খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে বারবার। করিডোর দিয়ে কেউ কোনো জিনিসকে খুব তাড়াতড়ি টেনে নিয়ে চলেছে। সেটা দু’ পাশের দেয়ালে ধাক্কা খেতে খেতে যাচ্ছে। ধাক্কা খেতে খেতে যাওয়ার সেই ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজটা বাড়া-কমা করতে করতে একসময় একেবারেই মিলিয়ে গেল। বোঝা যাচ্ছিল উড়ানের জন্য তৈরি হচ্ছে মহাকাশযান।

    সাতাশ নম্বর মেঝেতে তার মাথা, হাতের তেলো, তার গোটা শরীরটাই চেপে ধরে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। এই এত আওয়াজের মধ্যে সে সাইবারনেটিক যন্ত্রযানের চলার আওয়াজ আলাদা করে চিনবে কী করে? দেরি হয়ে গেছে! হয়তো অনেক দেরি হয়ে গেছে। অনেক আগেই এ নিয়ে ওর ভাবা উচিত ছিল। সকালবেলা একবারও পিছু না ফিরে ঊর্ধ্বশ্বাসে যে ছুটটা দিয়েছিল সে, সেটা মহাকাশযানের দিকে হবার বদলে তার উলটোমুখে দেয়া উচিত ছিল। আসলে, সেই মুহূর্তটায় ভেবেচিন্তে কোনদিকে যাবে সেটা ঠিক করবার বদলে ওর উচিত ছিল, বুকের ভেতরে বসে থাকা জিয়ার সেই ছোট্ট মেয়েটার কথা শোনা। কতবারই তো ও-মেয়ে তাকে ঠিকঠাক পথ দেখিয়ে দিয়েছে! শুধু সেদিন সকালেই, কেন কে জানে, মেয়েটা তাকে উলটোমুখে নিয়ে যেতে পারেনি। কিন্তু এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। যন্ত্রযানের দ্বিতীয় দলটা আর বেরোয়নি। ঘরে ঘরে জোগাড় করে আনা নমুনা ভরবার কাজও প্রায় শেষের পথে।

    ঠিক সেই মুহূর্তে দরজায় দুম করে একটা আওয়াজ হল। শব্দটা কানে যেতেই লাফিয়ে উঠে হাতদুটো দুলিয়ে, মাথাটা সামান্য পেছনে হেলিয়ে ছুট দিল সাতাশ নম্বর।

    .

    ৮.

    শব্দ-টব্দগুলোর দিকে কম্যান্ডারের অবশ্য নজর ছিল না কোনো। সময় কোথায়? তার সামনে তখন কন্ট্রোল প্যানেলে উজ্জ্বল লাল অক্ষরের সার ঝলসে উঠছে ঘনঘন। সব যন্ত্রপাতি মহাকাশযানে তোলা শেষ।

    কন্ট্রোল রুমের দরজাটা দমাস করে খুলে গেল হঠাৎ। ধাতব মেঝের ওপর নখের শব্দ খরখর শব্দ উঠছে। তার মানে একশো চল্লিশ নম্বর যানে ফিরেছে।

    যানের প্রধান উত্তোলক যন্ত্র চালু হয়েছে এবার। রকেট থ্রাস্টারের চাইতে এতে শক্তি খরচ হয় অনেক বেশি। কিন্তু উপায় নেই। কোনো গ্রহের জনবহুল মাটি থেকে রওনা দেবার সময় ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি রকেট থ্রস্টারের আগুন গম্ভীর শব্দ ছড়িয়ে নিজেদের উপস্থিতির জানান দেয়া বে-আইনি। তবে একবার উত্তোলক যন্ত্রের টানে নিঃশব্দে বেশ খানিক উঁচুতে উঠে গিয়ে তারপর রকেট থ্রাস্টার চালানোতে সমস্যা নেই কোনো। নীচ থেকে দূর আকাশের গায়ে সেই আলোর খেলাকে গ্রহের বাসিন্দারা মেঘের কোলে বাজ বিদ্যুতের খেলা বলেই ধরে নেয়।

    কন্ট্রোল রুমের দরজাটা ফের একবার দমাস করে খুলে গেল। যাক! ছাগল-দেড়ে তিরানব্বই নম্বর ঢুকেছে অবশেষে! ব্যস! এবার মহাকাশযান উড়ানের জন্য তৈরি।

    কম্যান্ডারের ছটফটানিটা একটু কমে এল এইবার। ইন্টারকমের সুইচের দিকে হাত বাড়িয়েও কী ভেবে হাতটা ফের পিছিয়ে নিল সে। নাহ, আগে টেক অফ। হতচ্ছাড়া গ্রহের চৌহদ্দি ছেড়ে তারপর বাকি সব কাজ।

    “টেক অফ!”

    হাঁকটা দিয়েই কম্যান্ডার অ্যান্টি-গ্র্যাভিটেটরগুলোর সুইচ অন করে দিল।

    জিয়ার পৃষ্ঠতল থেকে মহাকাশযানটা আস্তে আস্তে ওপরে উঠতে লাগল। যানের ভিউ স্ক্রিন চালু করে দিল কম্যান্ডার। সেখানে একটা বিশাল অন্ধকার গোলক তাদের পায়ের নীচের অন্ধকারে আস্তে আস্তে তলিয়ে যাচ্ছিল। গোলকটার ডানদিকে সমুদ্রের খুব আবছা একটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে। দেখে মনে হবে জনপ্রাণীশূন্য একটা গ্রহ এইমাত্র ছেড়ে এল তারা।

    ক্যাপ্টেন মাথা নাড়ল। দৃশ্যটা সাতাশ নম্বরকে দেখানো দরকার। ভালোই হবে ওর তাতে। জীবনের চিহ্নহীন ওই মরা অন্ধকার একবার নিজে চোখে দেখলে, জায়গাটা ছেড়ে আসবার জন্য বোধ হয় আর কোনো আক্ষেপ থাকবে না তার। থ্রটল টেনে ধরে মহাকাশযানের উড়ানপথকে গ্রহটার সঙ্গে সমান্তরালে বেঁধে দিয়ে কম্যান্ডার কন্ট্রোল রুম ছেড়ে চলে গেল, সেখানে হাজির বাকি কর্মীদের দিকে ফিরেও তাকাল না একবার। বড়ো বড়ো পায়ে দ্বিতীয় লেভেলে উঠে এসে সে নির্দিষ্ট দরজাটার সামনে দাঁড়াল।

    “বেরিয়ে এসো সাতাশ। আর আটক থাকবার দরকার নেই। আমরা এখন মহাশূন্যে।” দরজাটা খুলে ধরে বলে উঠল কম্যান্ডার। সাতাশ নম্বর একটুও নড়াচড়া করল না।

    “জিয়াকে এখনও দেখা যাচ্ছে। আমাদেরকে দেওয়ার মতো কিছুই ওই কালো গ্রহটার নেই। যাও, গিয়ে দেখো।”

    সাতাশ নম্বর উত্তর দিল না।

    “আমি তোমাকে কন্ট্রোল রুমে যেতে হুকুম দিচ্ছি সাতাশ!”

    তরুণীটির একটা পেশিও এতটুকু নড়ল না। তার হাত নীচের দিকে আর মাথা পেছনে হেলানো। কম্যান্ডার চৌকাঠ পেরিয়ে তার কাছে গেল।

    “তুমি…” বলতে বলতেই মাঝপথেই থেমে গেল কম্যান্ডার।

    সাতাশ নম্বরের মুখের মতো তার চোখের মণিদুটোও সাদা হয়ে গেছে! যেন সে-দুটোর কোনো অস্তিত্বই নেই আর।

    কম্যান্ডার সন্তর্পণে তার কপাল ছুঁল, তার গলা, হাতের ওপর আঙুল বোলাল।

    পাথর!

    কম্যান্ডার অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করল। কিন্তু ঠিক কী ঘটেছে তা বোঝার কোনো উপায় তার কাছে নেই। তার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। একটা মেয়ে কীভাবে পাথরে বদলে যেতে পারে? নিঃসন্দেহে খুবই উদ্ভট ব্যাপার। পাথরের মূর্তির মতো রূপ নেয়া… সেটা সম্ভব। কিন্তু সত্যি সত্যি পাথরে বদলে যাওয়া…

    .

    ৯.

    অন্ধকারে তার দুটি হাত ছড়িয়ে দিল তরুণীটি। সূর্যোদয়ের আগে পাথর থেকে যদি হালকা অবলোহিত আলো বিকীরণ না হত তাহলে বোধ হয় ও গতকালের রাস্তাটা খুঁজেই পেত না, যেখান দিয়ে ওর ছাগল-দাড়িওয়ালা মনিটরের সঙ্গে ও গিয়েছিল আগের দিন! খাড়া চড়াই উঠে গেছে ওপরে, ছুঁচোলো পাথরের টুকরোতে ভর্তি পথ, থেকে থেকেই চপ্পলে সেগুলো ফুটে যাচ্ছে। সরু লিকলিকে কাণ্ডের সাইপ্রেস গাছগুলো আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, যেন তারা পাহাড় বেয়ে দৌড়ে উঠে মহাকাশযানের কাছাকাছি চলে যেতে প্রস্তুত, যে মহাকাশযান রাতের অন্ধকারে চোরের মতো জিয়া ছেড়ে পালিয়েছে।

    দু-পাশের এবড়োখেবড়ো দেয়ালগুলোর গায়ে হাতড়াচ্ছিল সে। খানিক বাদে দেয়ালের গায়ে একটা দরজার আভাস মিলল। ভেতর থেকে ফোঁপানি, কাতরানির আওয়াজ আসছে। নিশ্চয়ই কেউ দুঃস্বপ্ন দেখেছে। এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। অন্য কারো ঘুম ভাঙিয়ে দেয়া ছাড়া এতে কারো কোনো ক্ষতি হয় না বিশেষ।

    ওর সাদা জামা বেশ খানিকটা দূর থেকেও দেখা যাচ্ছে। এই সময়ে ওকে যদি কেউ দেখে ফেলে তাহলে ওকে নির্ঘাৎ তাড়া করবে আর ও রাস্তা হারিয়ে ফেলবে, যা ও একেবারেই চায় না। খানিক বাদে, খুঁজতে খুঁজতে আগের দিনের সেই সরাইখানাটার কাছে এসে পৌঁছোল ও। গতকাল অনেক কষ্টে ওখানেই ওই বুড়ো লোকটাকে ফেলে পালিয়েছিল সে। তারপর খানিক এগিয়ে গিয়ে একটা খিলানের দরজা দিয়ে ও গলে চলে গিয়েছিল। তারপর বাকিটা পথ একাই গিয়েছিল।

    একটু একটু করে ও গতকালের রাস্তাটা আবার খুঁজে বের করল। এই তো সেই লম্বা গাছের গুঁড়িটা! ওর ওপরে মেয়েরা জলের কলসি রাখে। এখান থেকে সে সরু একটা গলি ধরে পাহাড়ের চুড়োয় উঠেছিল। জলজ ঘাসের তৈরি জাল নিয়ে যে ক্রীতদাস মাছ কিনতে যাচ্ছিল, তার সঙ্গেও ওর এখানেই দেখা হয়েছিল।

    ক্রীতদাসকে দেখে ও ওর চলার গতি বাড়িয়ে দিয়েছিল। তারপর একসময় টিলাটার চুড়োয় পৌঁছে ও লোকটাকে প্রথম দেখতে পায়।

    লোকটার মধ্যে এমন কিছু ছিল যা অন্যান্য সব জিনাইটদের থেকে তাকে আলাদা। একটা ভাব দিয়েছে। মুখচোখ আলাদা করে তেমন বলার মতো কিছু নয়। সাতাশ নম্বরের সেসব মনেও নেই আর। শুধু লোকটাকে দেখে বুকের ভেতর উঁকি দেয়া ভালোলাগাটুকু মনে আছে। লোকটার জামাকাপড়ও খুব সাধারণ ছিল, এতটাই যে ওর কিছুই মনে নেই। একটা অদ্ভুত শান্ত দুঃখের আবরণে নিজেকে জড়িয়ে রেখে মাপা পদক্ষেপে সাতাশ নম্বরের পাশ দিয়ে চলে গিয়েছিল সে। অন্য জিনাইটদের মতো দু-চোখ দিয়ে তাকে গ্রাস করতে চায়নি। লক্ষই করেনি তাকে।

    পাহাড়ের মাথায় চড়ে লোকটা কী করছিল? সাতাশ নম্বর গতকাল সেটা বুঝতে পারেনি। কিন্তু এখন, যখন ও ভোর হওয়ার আগে হালকা ধূসর আলোয় আলোকিত আকাশটার দিকে তাকিয়ে দেখল, তখন বুঝল লোকটা পুবদিগন্তে উদীয়মান সূর্যটাকে দেখতেই পাহাড়ে উঠেছিল… ভোরের কোমল সূর্য!

    গতকাল ও এসব কিছুই বোঝেনি, কিন্তু তা সত্ত্বেও এরপর লোকটাকে অনুসরণ করে গিয়েছিল সে। সমুদ্রতটের ধার ঘেঁষে সরু সরু গলিঘুজির গোলকধাঁধায় ওরা ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সাতাশ নম্বর বুঝতেই পারছিল না ওরা কোথায় যাচ্ছে, শহরের কেন্দ্রের দিকে, না তার উলটোদিকে। লোকটা একবারের জন্যেও তার চলার গতি বাড়ায়নি। ও ও ধীরেসুস্থে তাকে অনুসরণ করে যাচ্ছিল। সেই করতে করতেই একটা অযৌক্তিক ভয় ক্রমশ ছেয়ে ফেলছিল ওকে। যেন অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটে যাবে। যে-কোনো মুহূর্তে! ও চাইছিল লোকটা আরও জোরে জোরে হাঁটুক। যদি ওর উপায় থাকত তাহলে ও লোকটাকে দৌড় করাত সেই মুহূর্তে। কিন্তু সে উপায় ওর কাছে ছিল না। তাই ওকেও আস্তে আস্তেই হাঁটতে হচ্ছিল। রাগ হচ্ছিল খুব ওর। শিশুসুলভ খামখেয়ালি রাগ। এই লম্বা, আঁকাবাঁকা পথের শেষে কী আছে কে জানে! নাছোড় একটা ভয় আর দ্বন্দ্ব ওকে। কুরে কুরে খাচ্ছিল সেই মুহূর্তে।

    এখন ও নির্ভুলভাবে রাস্তা চিনে এগোচ্ছে। কোথায় কোন রাস্তায় বাঁক নিতে হবে, কোন চৌমাথায় যেতে হবে –এই সবই ও জানে।

    বাড়িগুলোর ফাঁক দিয়ে এঁকেবেঁকে যাওয়া আধো অন্ধকার গলিগুলোর ভেতর দিয়ে হোঁচট খেতে খেতে অবশেষে একসময় ও এসে পৌঁছোল কালকের সেই দরজাটার সামনে। পাথুরে দেয়ালের গায়ে বিরাট একটা দরজা আর তাকে ঘিরে আইভি লতার ঝাড়। ব্যাপারটা একটু বিস্ময়কর, কারণ এই গলির বাকি দরজাগুলো একেবারেই ছোটো ছোটো। এতই ছোটো যে একজন লম্বা জিনাইটকে মাথা নীচু করে ঢুকতে হয় তার ভেতর দিয়ে।

    গতকাল ও বিনা বাধায় এই বড়ো গেটোটা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়তে পেরেছিল, কিন্তু এখন ওতে তালাবন্ধ, সম্ভবত ভোর হবার আগে খুলবে না।

    সাতাশ নম্বর ওর উত্তোলক যন্ত্রটা চালু করে বাতাসে ভেসে উঠল। আইভি লতায় ছাওয়া দেওয়ালটা পেরিয়ে নিঃশব্দে এসে নামল ভেতরের উঠোনে। বাইরের রাস্তার থেকেও এখানে আরও বেশি অন্ধকার। তবুও ওরই মধ্যে শ্যাওলা-ধরা পাথরের কুয়োটা খুঁজতে ওর অসুবিধে হল না। শরীরের সব শক্তি একত্রিত করে ও কুয়োর মুখের ঢাকাটা সরাল। তারপর নিজের বেল্টটা খুলে ফেলল। বেল্টে আটকানো আছে দুটো ছোটো চ্যাপ্টা বাক্স, একটা ট্রানসিভার আর একটা ব্যাটারি চালিত উত্তোলক যন্ত্র।

    ছপ করে একটা আওয়াজ হল, যন্ত্রপাতি সমেত বেল্টটা জলের তলায় ডুবে গেল। ব্যস। এখন ওর কাছে আর লজিটেনিয়ার কোনো জিনিসই অবশিষ্ট নেই।

    ***

    সূর্য এবারে উঠব উঠব করছে। এত তাড়াতাড়ি চারপাশ ফর্সা হচ্ছে যে কিছু বোঝার আগেই আরেকটা নতুন দিন শুরু হয়ে যাবে। পাখি ডাকতে শুরু করেছে, মুরগির ডাকও শহরের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে শোনা যাচ্ছে। সেই রহস্যময় লোকটা যদি আজকেও পাহাড়ের মাথা থেকে সমুদ্রের বুকে জিয়ার সূর্যোদয় দেখতে তাহলে এক্ষুনিই ও বাড়িটা ছেড়ে রওনা দেবে।

    খুদে খুদে জানালাওয়ালা ছোটো বাড়িটার সামনে থেকে বাঁদিকে সরে গিয়ে তাড়াতাড়ি একটা ঘন ঝোঁপের ভেতরে লুকিয়ে পড়ল সে। গতকালও এইখানটাতেই লুকিয়েছিল সে।

    আগের দিন এখানে এসেই ও টের পেয়েছিল, এই বাড়িটা একজন ভাস্করের কর্মশালা। পথঘাট, ঘরবাড়ি এইসবের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্যে অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তৈরি করে লোকটা! বড়ো হতাশ হয়েছিল সে। যখন ও লোকটার পিছু নিয়েছিল তখন একটা ক্ষীণ আশা ছিল ওর মনে, হয়তো একে পর্যবেক্ষণ করে ও লজিটেনিয়ানদের সঙ্গে এই জিনাইটদের এতটা তফাতের কারণটার একটা আন্দাজ পাবে।

    তফাতটা যে কী সেটা সে আগেই অনুভব করেছিল। জিনাইটদের প্রত্যেকেরই প্রত্যেককে প্রয়োজন হয় কোনো না কোনো কারণে। লজিটেনিয়ানদের ক্ষেত্রে সেটা হয় না। সেখানে কেউ কারো ওপরে নির্ভর করে না। এখন অবধি কোনো লজিটেনিয়ান তার ওপর নির্ভর করেনি। সেও একইভাবে দ্বিতীয় কোনো লজিটেনিয়ানের ওপরে কোনো কারণে নির্ভর করবার প্রয়োজন অনুভব করেনি। ওরা সবাই গ্রেট লজিটেনিয়ার অধিবাসী। একে অন্যের সঙ্গে যে সামান্য নির্ভরতার যোগসূত্রটা ওদের রয়েছে সেটাও নিতান্তই কেজো। লজিটেনিয়ার সেবার জন্য অভিজ্ঞ লজিটেনিয়ানদের কাছে অপেক্ষাকৃত কম অভিজ্ঞদের প্রশিক্ষণ নেয়া। ব্যস।

    কিন্তু এখানে, এই জিয়াতে সবকিছুই আলাদা। এই ভিনগ্রহে পা দেওয়ার মুহূর্ত থেকে ও বুঝতে পেরেছে যে এখানকার অধিবাসীদের কোনো না কোনো কারণে পরস্পরের পরস্পরকে প্রয়োজন। ভরসা করবার জন্য, সঙ্গে চলবার জন্য তারা প্রতিমুহূর্তে উপযুক্ত সঙ্গীকে খুঁজে চলেছে। আর সেই সঙ্গী ও নির্ভরতাকে ইচ্ছেমতো বেছে নেওয়ার স্বাধীনতাও তাদের আছে।

    সাতাশ নম্বর আরও বুঝেছিল যে ওকেও এদের দরকার এবং ওকে তাদেরই সম্পত্তিতে পরিণত করতে চাইছে তারা। কিন্তু কেন, তা সে বুঝতে পারেনি। কিন্তু পথে ঘাটে বারংবার তাদের এই ইচ্ছেটার বহিঃপ্রকাশ সাতাশ নম্বরকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে জাগিয়ে তুলছিল ওর মধ্যে।

    অথচ আগের দিন সকালে এই লোকটার সঙ্গে দেখা হবার পর তার কাছ থেকে মোটেও পালিয়ে যাবার ইচ্ছে হয়নি ওর। হয়তো সে তার দিকে চোখ তুলে তাকায়নি বলেই!

    খানিক বাদে, তার পিছু করতে করতে সাতাশ নম্বর ভাবছিল এই লোকটাও যদি অন্য জিনাইটদের মতো হয় তাহলে কী হবে? ও কি ভয় পাবে? কথাটা মনে আসতেই ও খুব অবাক হয়ে খেয়াল করেছিল যে, একবিন্দু ভয় জাগছে না তার মনে। অন্যান্য জিনাইটদের দৃষ্টিতে যে লোলুপতা ও এই ক দিন দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, তা এই লোকটার দৃষ্টিতেও কল্পনা করার চেষ্টা করেছিল সে এরপর। কিন্তু চেষ্টাটা করবার সঙ্গে সঙ্গেই সে বুঝতে পেরেছিল, সেটা এর প্রকৃতির সঙ্গে একেবারেই বেমানান। এই জিনাইটের সৃষ্টি সারা দুনিয়ার শাসক হবার জন্যে। নম্র, খানিক খামখেয়ালি, ভালোবাসা যায়। হয়তো এই জন্যেই সবাই এর আধিপত্য স্বীকার করবে।

    তারপর একসময়, তার পিছু পিছু এই উঠোনে এসে পৌঁছে, এই ঝোঁপের আড়ালে দাঁড়িয়ে জিনাইটটাকে কেবল দেখে গিয়েছিল ভিনগ্রহী সাতাশ নম্বর –শিশুর সারল্য নিয়ে, কোনোরকম ‘অশুভ’ সম্পর্কে একেবারেই অনবহিত হয়ে, এক অপ্রমেয় বিশ্বাসে স্থিত হয়ে। আর সেই বিশ্বাসে ভর করেই সে অবশেষে জানতে চাইল, কেন একজন জিনাইট আরেকজন জিনাইটের ওপরে নির্ভর করে? কেন তাদের একজনকে আরেকজনের প্রয়োজন হয়? আর সেই মুহূর্তে, তার অস্তিত্বের ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন জিনাইটটার দিকে চোখ ফেলে নিজেকে বিশ্রীরকম অপ্রয়োজনীয় ঠেকছিল তার। জিয়ার বুকে একটা ভিনগ্রহী প্রাণী। তাকে কারো প্রয়োজন নেই এখানে।

    সামনে, একেবারেই কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল লোকটা। কিন্তু তাকে ডাক দেবার মতো সাহস জোগাড় করতে পারছিল না সাতাশ নম্বর। কিন্তু তবুও, জায়গাটা ছেড়ে চলে যেতে পারেনি ও। লোকটার স্টুডিওর কাছেই আঙুরলতার ঝোপে তেমনি করেই লুকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ঠায়।

    সেখান থেকে স্টুডিওর ভেতরটা দেখা যায়। তার মেঝেময় পাথরকুচি ছড়ানো। কালো পাথরের দেয়ালের সামনে সাদা ফুলদানি আর লালচে বেগুনি রঙের মাটি থেকে তৈরি জন্তুজানোয়ারের ছোটো ছোটো মূর্তি। আর ঘরটার একেবারে মাঝখানে হালকা রঙের সুতি কাপড়ে ঢাকা একটা মূর্তি রয়েছে। লোকটা ততক্ষণে তার সেই স্টুডিও ঘরে ঢুকে এসেছে। একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে কাপড় দিয়ে ঢাকা মূর্তিটার দিকে। মনে হচ্ছিল আবরণ সরিয়ে মূর্তিটাকে দেখার জন্যে লোকটা যেমন উদগ্রীব, তেমন আবার ভীতও। যেন এইটাই তাকে ঘিরে রাখা সেই শান্ত বিষণ্ণতার উৎস। তার মানে ব্যাপারটা এই! তার অধরা দেবীর মূর্তি! হাহ! মানব শরীরের অমার্জিত একটা প্রতিকৃতি…

    লোকটা মাথা নীচু করে মূর্তিটার দিকে আরও এক পা এগোল, যেন নিজের এই সৃষ্টির দিকে তাকাতেও চাইছে না। তারপর কোনোদিকে একবারও না দেখে একটানে কাপড়টা সরিয়ে নিল।

    মূর্তিটা কোনো দেবীর নয়! মূর্তিটা সাতাশ নম্বরের! যে জিনাইট রূপ ধরে এই গ্রহের বুকে নেমে এসেছে সে, পাথরের পাদানির ওপরে দাঁড়িয়ে শ্বেত মর্মরের মূর্তি হয়ে সে রূপটাই এখন তাকিয়ে রয়েছে মানুষটার দিকে।

    লোকটা মূর্তির সামনে হাঁটু গেড়ে বসল, তার রগ তখন মূর্তিটার পাদমঞ্চে ঠেকানো। তার মুখটা দেখা যাচ্ছিল খানিক। লোকটা কাঁদছে।

    তরুণীটি যেন প্রবল এক ধাক্কা খেল। এ তার কাছে অবিশ্বাস্য। এক পা, এক পা করে ও পিছিয়ে এল। যে দুনিয়ার অংশ সে কোনোদিনই হতে পারবে না, সেখানে একটা লোক ওর পাথরের মূর্তির সামনে কাঁদছে! দৃশ্যটা দেখবার পর সেখানে আর এক মুহূর্ত দাঁড়াবার ইচ্ছে ছিল না তার। সে লজিটেনিয়ার জীব। এই গ্রহের নিয়মকানুন, আচার আচরণ চিরকালই তার বোধগম্যের বাইরে থাকবে।

    পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে মহাকাশযানে ফিরে এসেছিল সাতাশ নম্বর। নিজেকে এই গ্রহের বুকে একজন ভিনগ্রহী ভেবে কেন যে এত যন্ত্রণা হচ্ছে তার, কেন যে এখানে নিজেকে এত অসাড়, এত অপ্রয়োজনীয় ঠেকছে, কেন যে তার বুকটা হঠাৎ বিনা কারণে মুচড়ে মুচড়ে উঠছে, তার কোনো আন্দাজ তার কাছে ছিল না। লোকটার কাছে তার মূর্তি আছে। তাই তাকে আর তার প্রয়োজন নেই কোনো। এই উপলব্ধিটা কেন যে বারবার ছুরির মতো বিঁধে চলেছে তার বুকে, তা সে বুঝতে পারছিল না, আর তাতেই সে আরও বিহ্বল হয়ে পড়ছিল। কাজকর্ম ফেলে মহাকাশযানে এসে পৌঁছে সটান নিজের কেবিনে এসেছিল সে। জিনাইট বা লজিটেনিয়ান –কারো সান্নিধ্যই তখন ওর কাছে স্বস্তিদায়ক ছিল না, ও সম্পূর্ণ একা থাকতে চেয়েছিল।

    কিন্তু একা থেকেও ও নিজেকে শান্ত করতে পারল না। কারণ ও যা দেখেছে সেটা অভাবনীয়। যে রূপ ধরে ও এই গ্রহের বুকে পা দিয়েছে, এক অজ্ঞাতপরিচয় ভাস্করের স্টুডিওতে সেই রূপটার মূর্তি এল কেমন করে? ও তো মাত্র তিনদিন হল জিয়াতে এসেছে! ওই মূর্তি তৈরি করতে যে তিনদিনের অনেক বেশি সময় লেগেছে সে ব্যাপারে ও নিশ্চিত।

    তার মানে… ওই ভাস্কর ওর নয়, অন্য কারো মূর্তি গড়েছে? কিন্তু তাই যদি হবে, তাহলে এই সাদৃশ্যটা কী করে হল?

    আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে, যখন মহাকাশযান থেকে কেউ জিয়াতে নামেনি, সাইকমরা তখন জিনাইটদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে করতে এই মূর্তিটাকে দেখতে পায় আর সাতাশ নম্বরকে এর রূপ ধারণ করতে পরামর্শ দেয়?

    নাহ, তা হতে পারে না। সাইকমদের ভুল হয় না। একটা মূর্তিকে জীবন্ত ভেবে সে-রূপ কাউকে ধারণ করতে বলতে পারে না তারা। জিয়ার মেয়েদের বাহ্যিক চেহারা-সংক্রান্ত যত তথ্য পাওয়া গেছে তার সুষ্ঠু সমন্বয় ঘটিয়ে এক অল্পবয়সী আদর্শ জিনাইট রমণীর রূপ সৃষ্টি করেছে তারা সাতাশের জন্য। তবে অন্ধভাবে কোনো মেয়ের ছবি নকল করে তার রূপটা গড়া হয়নি। সেটা সাইকমদের কাজের পদ্ধতি নয়। বরং এখানকার মেয়েদের চেহারা-সংক্রান্ত তথ্যগুলো থেকে ত্রুটিবিচ্যুতিগুলো বাদ দিয়ে শুধু সঠিক। বৈশিষ্ট্যগুলোকেই একত্র করে গড়ে তোলা হয়েছে সাতাশ নম্বরের প্রস্তাবিত রূপ। সাতাশ নম্বর তাই জিনাইটদের প্রজাতির একজন আদর্শ তরুণী, মানে সমস্ত বৈশিষ্ট্য নিখুঁতভাবে থাকলে একজন জিনাইট রমণীর যে চেহারাটা হবে সাতাশ নম্বরের চেহারাটাও ঠিক তাই। ঠিক যেমনভাবে একশো চল্লিশ নম্বর জিয়াতে পাওয়া যায় এরকম চমৎকার একটা কুকুর আর তিরানব্বই নম্বর করুণা উদ্রেককারী এক ভিখারি।

    তার মানে ওই অজ্ঞাত ভাস্করও আদতে একজন আদর্শ জিনাইট নারীর মূর্তি গড়ছিল… সমস্ত বৈশিষ্ট্য নিখুঁতভাবে থাকলে একজন জিনাইট রমণীর যে চেহারাটা হবে…

    কিন্তু… কেন? একটা নিষ্প্রাণ মূর্তি দিয়ে সে…

    ঠিক তখনই তরুণীটি লক্ষ করেছিল, সারা সকাল যে শামুকটা ওর হাতে ছিল সেটা আর তার সঙ্গে নেই। সেটার স্মৃতিকোষে মহাকাশযানের দ্বিতীয় লেভেলের অব্যবহৃত একটা কুঠুরির নম্বর লাগানো ছিল। লোকটার বাগান থেকে কিছু একটা স্মারক জোগাড় করে নিতে চেয়েছিল সাতাশ নম্বর, আর তারপর, চলে আসবার আগে, একরকম নিজের অজান্তেই শামুকটাকে সে ছুঁড়ে দিয়ে এসেছিল মূর্তিটার শরীরে!

    ঠিকই আছে। রাতে একটা স্বয়ংক্রিয় যান শামুকের সংকেত ধরে মূর্তিটাকে তুলে এনে দ্বিতীয় তলের ওই কুঠুরিটাতে ঢুকিয়ে রাখবে। কেউ ওদিকে নজর দেবে না। সামান্য একটা মাল রাখবার গুদামে উঁকি দেবার আগ্রহটাই বা হবে কার? শুধু সবার চোখের আড়ালে সাতাশ নম্বর একলা একলা সেখানে যাবে। নিজেকে দেখবে… নিজের মূর্তিকে… বুঝতে চাইবে, পাহাড়ের মাথায় জীবন্ত তাকে কেন না দেখে এমন উপেক্ষা করল ওই যুবক, অথচ স্টুডিওর নির্জনে তারই মূর্তির পায়ে মাথা গুঁজে কেন সে কাঁদে?

    তাই হোক। পাথরের মূর্তিটা তোমার বেশি প্রিয় হল বুঝি? আমিও পাথর হব তবে। কোন গুণে আমার রক্তমাংসের চেয়ে ওই পাথর তোমার প্রিয়, যদি তা বুঝতে পারি।

    কঠিন কিছু নয়। পোশাক-আশাকগুলো পালটে ফেলা, তারপর শরীরটাকে মর্মর-শুভ্র একটা রঙে বদলে নেয়া… এইবার… যদি তুমি দেখতে আমায়, বুঝতে তোমার গড়া, তোমার ভালোবাসার ওই পাথরের মূর্তির সঙ্গে আর কোনো তফাত নেই আমার…।

    আর এই সময়েই কম্যান্ডার এসে দাঁড়িয়েছিল তার কেবিনের দরজায়। এই সময়েই কম্যান্ডার তাকে দেখে ফেলল। তারপর সাতাশের কাছে তার প্রশ্নের কোনো জবাব না পেয়ে লোকটা জিয়ার নিন্দামন্দ শুরু করে দিল।

    আর যত বেশি যুক্তিজাল ছড়াচ্ছিল লোকটা, সাতাশ নম্বরের ভেতরে একটা ইচ্ছে ততই বাড়ছিল। জিয়াতেই থেকে যাবে সে। এই তার আসল জায়গা। তারপর, জিয়া যে কেন শীগগির ধ্বংস হয়ে যাবে সেকথা অনেক অকাট্য যুক্তি দিয়ে তাকে বুঝিয়ে ছাড়বার পর কম্যান্ডার যখন তাকে তাদের সুদূর, মহান মাতৃভূমি লজিটেনিয়ার কথা শোনাচ্ছে, ততক্ষণে সে জানে, এই বিশ্বসংসারে আরও একটা জায়গা আছে যেখানে, যেখানে ও ঘর বানাতে চায়। সাতাশ নম্বর জানে যে ও কোনোদিনই পরিপূর্ণ একজন জিনাইট রমণী হয়ে উঠতে পারবে না। নিজের অজান্তেই কিছু না কিছু তফাত রয়েই যাবে। কিন্তু তবুও, ও তাইই চায়।

    ওই বিষণ্ণ ভাস্করের কাছে যাবার জন্য, তার চোখের জলের পুজো পাবার জন্য নিজেকে মূর্তিতে বদলে নিতেও রাজি সে–হ্যাঁ, প্রাণহীন, স্থাবর একটা মূর্তি। যদি সে মূর্তিকে সে চোখ চেয়ে দেখে তাতেই তার পরম পাওয়া হবে।

    কম্যান্ডার তখন নিজের মনেই বকবক করে চলেছে। গ্রেট লজিটেনিয়ার অধীনস্থ দূরদূরান্তের গ্রহদের কথা, অসীম মহাশূন্যের কথা। সাতাশ নম্বর মনে মনে হাসছিল এসব হেঁদো কথা শুনে। কম্যান্ডারের প্রতি ওর মনে তখন অবজ্ঞামাখা করুণা! কারণ ঠিক কোন স্বর্গীয় অনুভূতির ছোঁয়া পেয়েছে তার মন, সেকথা এ লোকটাকে সে বলতেও পারবে না, আর বললেও তা হৃদয়ঙ্গম করা এই লোকটার সাধ্যের বাইরে। একটা তুচ্ছ, প্রাণহীন বস্তু, যেটা প্রতিদিন ভোরবেলায় পাহাড় থেকে নেমে আসা এক বিশেষ জিনাইটের কাছে প্রয়োজনীয়, যার জন্য সে তার জীবন্ত প্রতিরূপকে দেখেও দেখতে পায় না, যার পায়ে সে চোখের জল ফেলে, সেই মূর্তিতে নিজেকে বদলে নিয়ে মানুষটার চোখের জলের অর্ঘ্য পাওয়াতে যে সুখ, আনন্দ আছে তা বোঝা কম্যান্ডারের পক্ষে সম্ভব নয়।

    অন্তত হাজারবার সাতাশ নম্বর এই এক দৃশ্য মনে মনে কল্পনা করেছে… দিনের মধ্যে একবার একটা জিনিস, একেবারে ভোরবেলায়, ঢাকা দেওয়া কাপড়টা সরিয়ে লোকটা তাকে স্পর্শ করবে, কুচি কুচি পাথর ছড়িয়ে থাকা মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসবে, লোকটার চুলগুলো তার শ্বেতপাথরের পাদমঞ্চ ছুঁয়ে যাবে…

    বার বার এরকম অপরিচিত কল্পনায় ক্লান্ত হয়ে ও অপেক্ষা করছিল কম্যান্ডারের একঘেয়ে বকবকানি থামার জন্যে। কিন্তু কম্যান্ডার থামছিল না, সে বলেই যাচ্ছিল, বলেই যাচ্ছিল যেন এইসব কথাবার্তা সাতাশ নম্বরের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

    অবশেষে কম্যান্ডার যখন থামল তখন এই প্রসঙ্গ চিরতরে শেষ করার জন্যে ও বলল, “আমি জিয়াতে থেকে যেতে চাই।”

    তারপরেই ওই ঘর, মহাকাশযানের উড়ে যাওয়ার আগের তুমুল কর্মব্যস্ততা, স্বাধীনতার জন্যে দীর্ঘ প্রতীক্ষা এবং অবশেষে পালানো। পালাবার মুখে, কুঠুরির দরজা খুলে সেখানে সাইবারনেটিক যানের বয়ে আনা নিজের শ্বেতপাথরের প্রতিকৃতিটার দিকে একনজরও তাকানোর অবকাশ পায়নি সাতাশ নম্বর। তারপর পাহাড় পেরিয়ে সেই অন্ধকার গলিখুঁজিতে আসা, আর তারপর এই উঠোনে।

    .

    ১০

    স্টুডিওতে ঢুকেই নরম একটা জিনিসের ওপর ওর পা পড়ল। নীচু হয়ে সেটা তুলে সে দেখে জিনিসটা মূর্তি ঢাকা দেওয়ার সুতির কাপড়টা। দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে। নিখুঁত চৌকো একেবার ধবধবে সাদা একটা পাথরের বেদি। তার ওপর থেকে মূর্তিটাকে শব্দহীন একটা আলট্রাসোনিক ব্লেড দিয়ে মাখনের মতো কেটে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাদের যানে।

    বেদির ওপর উঠে দাঁড়াল তরুণীটি। এখন থেকে এটাই ওর ঠিকানা, ওর আশ্রয়। নিছক একটা প্রাণহীন মূর্তি হিসেবে। চিরদিনের মতো। ভোর থেকে শুরু করে সন্ধে অবধি ও এইরকমই প্রাণহীন, স্থাবর বস্তু হয়ে থাকবে। শুধু রাতে ও নিঃশব্দে ঘুরে বেড়াবে, বাগানে যাবে, গাছ থেকে ফল পাড়বে, কনকনে ঠান্ডা জল তুলবে কুয়ো থেকে।

    আশপাশ আরও পরিষ্কার হয়ে আসছে। সূর্য এখন বোধ হয় শহরের সবচেয়ে কাছের পর্বতশৃঙ্গর ওপরে আলো ছড়াচ্ছে। পাথরের দেওয়ালটার ওপাশের রাস্তায় কেউ একজন তীক্ষ্ণস্বরে চেঁচিয়ে উঠল এক অজানা, অবোধ্য ভাষায়। যে ভাষায় এখানকার স্থানীয় মানুষ কথা বলে এটা সে ভাষা নয়। ভিনদেশি কেউ হবে হয়তো!

    আর দেরি করা যাবে না, যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। মানুষটার সূর্যোদয় দেখে ফিরে আসবার সময় হল। তাড়াতাড়ি কাপড়টা দিয়ে নিজেকে ঢেকে নিল ও। হাতদুটো নীচু করল, মাথাটা পেছনে সামান্য হেলাল, ঠিক মূর্তিটার মতোই। সারা শরীর দিয়ে ও অনুভব করল যে দাঁড়ানোর এই বিশেষ ভঙ্গিমার সঙ্গে ও অভ্যস্ত। যাদের কাছ থেকে ও চিরদিনের মতো স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়েছে, তাদের সামনেও ঠিক এইভাবেই দাঁড়িয়ে ছিল সে গতরাত্রে।

    এভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটা ওর কাছে খুবই সহজ, কিন্তু এই সুতি কাপড়টার তলায় বেশিক্ষণ থাকলে দমবন্ধ হয়ে আসে। তবে উপায় নেই। ওকে এখন আক্ষরিক অর্থেই পাথরের মূর্তির মতো হতে হবে আর শরীরের একটা পেশিও একটুও না নাড়িয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে হবে। সেটা কেবলমাত্র একজন লজিটেনিয়ানের পক্ষে সম্ভব। আর শরীরের উষ্ণতা! হ্যাঁ, সেটাও কমাতে হবে। পাথরের মতোই ঠান্ডা হতে হবে তো ওকে! অসুবিধে নেই। শরীরকে নিয়ে এমনটা করাও লজিটেনিয়ানদের নাগালের মধ্যে। কিন্তু লোকটা এসে ওকে স্পর্শ করার আগেই ওকে এসব করতে হবে।

    ছোটো ঘরটার দরজা এখনো বন্ধ। সাতাশ নম্বর আস্তে পাথরের মূর্তিতে বদলে গেল। শরীরের একটা পেশিও নড়ছে না ওর এখন। লোকটা এখন সমুদ্রতটের দিকে যাবে। হয়তো। কী দুঃখের কথা! একটিবার চোখ ভরে ওকে দেখতেও পেল না…

    কিন্তু আজকে লোকটা সমুদ্রের দিকে যায়নি। সাতাশ নম্বর মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে শরীরের তাপমাত্রা কমাচ্ছে তখন সবে। এমন সময় হঠাৎ লোকটা বড়ো বড়ো পা ফেলে স্টুডিওর ভেতরে ঢুকে এল। তারপর পাগলের মতো এক ঝটকায় এত জোরে কাপড়টা সরিয়ে নিল যে সাতাশ নম্বর বেদিটার ওপর টলমল করে উঠল একবার। আর তারপর নীচু হয়ে বসে ওর তখনও গরম থাকা পায়ের পাতায় নেমে এল মানুষটার উষ্ণ কামনাদীপ্ত ঠোঁট।

    ‘সব গেল!’ সাতাশ নম্বর ভাবল, ‘সবকিছু জলে গেল। আমার শরীরের উষ্ণতা ও টের পেয়েছে… এবার ও বুঝতে পারবে ওকে ঠকানো হয়েছে…

    আমি…

    তার পায়ে ঠোঁট ঠেকিয়েই লোকটা শিউরে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে দেখছে সে। সব আশা শেষ। ধরা পড়ে গেছে সাতাশ নম্বর! একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শ্বেতপাথরের বেদি থেকে নেমে এসে যুবকের মুখোমুখি মাথা তুলে দাঁড়াল সে…

    .

    উত্তর-কথন

    রাস্তার ডানদিকে উদ্ভট সব জন্তুদের মূর্তির সার। সেগুলো নানা রঙের জ্যাসপার কুঁদে তৈরি। জন্তুগুলোর মাথায় একাধিক শিং, তারা গুটিসুটি মেরে বসে আছে, একটার সামনের থাবা আগেরটার পেছনে তুলে দেয়া, তাদের চকচকে লেজের ডগাগুলো ওপরের দিকে উঁচু হয়ে রয়েছে। আকাশ পরিষ্কার, তবে মাঝে মাঝে খুঁড়ো গুঁড়ো বরফ পড়া শুরু হয়েছে। বরফের মিহি গুঁড়োতে পথ ঢাকা, তার ওপর দু-জোড়া পায়ের ছাপ ঘনিষ্ঠভাবে এগিয়ে গেছে বাঁয়ের দিকে।

    “এদিকে।” পায়ের ছাপগুলোর দিকে ইশারা করে বীণা বলল।

    সের্গেই বীণার হাত ছাড়ল, দু’ জনে জেসপার পাথরের মূর্তিগুলোর ফাঁক দিয়ে গলে গেল। জায়গাটা পরিত্যক্ত জিনিসপত্রে ভরা। বিশাল নানান রহস্যময় যন্ত্রপাতি, জিনিসপত্রের ভাঙাচোরা টুকরো, মূর্তি, থাম এইসবের টুকরোটাকরা, প্লাস্টার ছাঁচ, মমির মতো স্টাফ করা মৃত পশুপাখি। আঙুরের লতায় এসে ঢেকে দিতে চাইছে। আবর্জনাগুলোকে। তাদের গায়ে গুঁড়ো গুঁড়ো বরফ।

    “ভাবো একবার।” হাঁটতে হাঁটতেই সের্গেইয়ের দিকে মাথা ঘুরিয়ে বলল বীণা, “এই সবকিছুই আমাদের গ্রেট লজিটেনিয়ার জন্য অপ্রয়োজনীয় বলে ঘোষণা করা হয়েছিল।”

    “তবে এগুলোকে সংরক্ষণ করবার বন্দোবস্ত করা উচিত তোমাদের। প্রথমে প্রত্যেকটা জিনিসকে চিহ্নিত করে, তাকে বায়ুনিরোধক আবরণে ঢেকে তার ভেতরে, যে গ্রহ থেকে তাদের আনা সেখানকার আবহাওয়া তৈরি করা দরকার। সংখ্রক্ষণের উপযুক্ত বন্দোবস্ত হবার পর না হয় প্রত্নবিদরা গবেষণা করে দেখবেন জিনিসগুলোকে।”

    “সেসব বিশেষ কিছুই এখনও করে উঠতে পারিনি আমরা।” বীণা লাজুক মুখে বলল, “দেখতেই তো পাচ্ছ অবস্থাটা…”

    সের্গেই কোনো উত্তর দিল না। ভিনগ্রহ থেকে আনা জ্যাসপারের জানোয়ারের মূর্তি সংরক্ষণের চাইতে অনেক বেশি জরুরি কাজ থাকে একটা গ্রহে, সেকথা তার অজানা নেই।

    “এসে গিয়েছি। দেখো দেখো…” হঠাৎ হাঁটা থামিয়ে সের্গেইকে ডাক দিল বীণা।

    রাস্তাটা সরু। পাশাপাশি দাঁড়ানো যায় না। পেছন থেকে এসে বীণার কাঁধ জড়িয়ে ধরে দাঁড়াল সের্গেই। ঠোঁট আর গাল দিয়ে বীণার জলপাইরঙা মুখের উষ্ণতা নিচ্ছিল সে।

    “কী সুন্দর, তাই না?” বীণা আবার বলল।

    সের্গেই তাকাল। তার সামনে বরফের মাঝখানে কোনো উঁচু বেদি ছাড়াই শ্বেতপাথরের একটা মূর্তি দাঁড় করানো আছে। মূর্তিটা একজন পার্থিব নারীর। অপার্থিব রূপের আলোয় ঝলমল করছে যেন সে।

    “এর নাম সাতাশ নম্বর।” বীণা বলল, “তোমার মনে পড়ছে?

    “হতেই পারে না।” সের্গেই প্রতিবাদ করল, “এটা মানুষের মূর্তি। লজিটানিয়ানের নয়। তবে হ্যাঁ, এত সুন্দর, এত নিখুঁত আমাদের পৃথিবীর মেয়েরাও হয় না অবশ্য। স্বপ্নে কিংবা শিল্পীর কল্পনায় হলে অবশ্য…”

    বীণা হাসিতে ফেটে পড়ল।

    “না গো! এ সত্যি সত্যিই লজিটেনিয়ান মেয়ে ছিল। জাতে সংগ্রাহক। পুরোনো যুগে আমাদের গ্রহে এমন নানান সব সম্প্রদায় ছিল জানো তো? পৃথিবী গ্রহে সংগ্রহ অভিযান করতে গিয়ে ও এইরকম হয়ে যায়। যানের তার কম্যান্ডার, চার নম্বর, যতদূর মনে পড়ছে, সে-ই মূর্তিটাকে খুঁজে বের করে যানে করে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল। ওই থেকেই তো সবকিছুর শুরু। চার নম্বরের নেতৃত্বেই তো সে-যানের সবাই মিলে প্রথম বিদ্রোহ শুরু করে লজিটেনিয়ায়। পৃথিবীর মানুষের মতো লজিটেনিয়ানদেরও স্বাধীনভাবে ইচ্ছে মতন বাঁচবার অধিকারের দাবিতে লড়াই। এ মূর্তিটা তাদের প্রয়োজন ছিল সে লড়াইয়ের প্রতীক হিসেবে, নিশান হিসেবে। তোমাদের পৃথিবীতে নিশান বলে কিছু আছে?”

    এবার হাসার পালা সের্গেইয়ের।

    “আছে তো। যুদ্ধক্ষেত্রে ঐ জিনিস বয়ে নিয়ে যায় সৈনিকেরা। তবে লড়াই যখন হাতাহাতিতে নেমে আসে তখন আর ওর কথা কারো মনে থাকে না। আর লড়াই শেষ হবার পর নিশান দিয়ে সবচেয়ে দুঃখজনক কাজটা করা হয়। সেটা হল মৃতদেহকে ঢাকা দেয়া।”

    “তুমি এত কিছু জানলে কী করে?” বীণা জিজ্ঞেস করল, “এসব কি পৃথিবীতে সত্যিই ঘটে?

    “নাহ, পৃথিবীতে সেসব বহুকাল আগেই ঘুচে-মুছে গেছে। তবে অন্য অনেক গ্রহে এখনো… তুমি ভুলে যাচ্ছ কী করে যে আমি একজন নক্ষত্র-নাবিক? পাইলট?”

    “নক্ষত্ৰ-নাবিক! হুহ। গালভরা নাম।” বলতে বলতে বীণা ঘুরে তাকাল তার সের্গেইয়ের দিকে, “আমার কাছে ওর একটাই অর্থ, আমায় ছেড়ে বার বার উড়ে যাওয়া মানুষ।”

    “এই…”

    “চুপ করো।” আস্তে আস্তে বলল বীণা, “কথা বোলো না গো! একটু চুপ করে দাঁড়াই চলো দু’ জনে ওর সামনে।”

    তারা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। সেখানে তখন শুধু সূর্যাস্তের হালকা আলো, সফেদ আকাশ বেয়ে নেমে আসা ঝুরো তুষারের দল, শুভ্র বরফের মাঝে মাথা উঁচিয়ে থাকা শ্বেতপাথরের মূর্তিটা। পাতলা, ছিপছিপে কাঁধদুটো বীণার। সের্গেইয়ের শক্তিশালী হাতের আলিঙ্গনে ঢেকে গিয়ে তার হৃৎস্পন্দন সের্গেইয়ের শরীরকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল।

    পেছনে পায়ের শব্দ উঠছিল। আরও কোনো জুটি হয়তো এসেছে মূর্তিটার সামনে একটুখানি দাঁড়াতে।

    “ব্যস, আর নয়,” বীণা বলল, “চলো এবারে। ওরা আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে।”

    হাত ধরাধরি করে মূর্তিটার পাশ দিয়ে ফিরে যাচ্ছিল তারা। খানিক এগিয়ে সের্গেই দাঁড়িয়ে পড়ে পেছন ফিরে তাকাল ফের, “বীণা, লোকে এখনও এখানে আসে কেন?” সে জিজ্ঞেস করল।

    ততক্ষণে অন্য একটি অল্পবয়সী জুটি মূর্তিটার সামনে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়েছে এসে, যেমনভাবে তারা দু’জন দাঁড়িয়ে ছিল খানিক আগে।

    সের্গেইয়ের হাত বীণার কাঁধ জড়িয়ে নিল। তারপর একটু বাদে ফের সে একই প্রশ্ন করল বীণাকে, “লোকে এখনও এখানে আসে কেন?”

    “ওই একটা প্রথা আর কী আমাদের। আর কিছু না।” খুব আস্তে আস্তে জবাব দিল বীণা।

    ফের একবার সের্গেই মূর্তির সামনে এসে একে অন্যকে জড়িয়ে রাখা লজিটেনিয়ান জুটিটার দিকে ঘুরে দেখল। তারা তন্ময় হয়ে মূর্তিটার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

    হঠাৎ বুকের গভীরে প্রথাটার কারণটা টের পেল সের্গেই। সামান্য কেঁপে উঠে বীণাকে জড়িয়ে ধরে তার কানে মুখ রাখল সে, “আমি একটা মুখ, আকাট মুখ। তা নইলে কেউ অমন প্রশ্ন করে?”

    তার ঠোঁটদুটো বীণার ঠোঁটে জড়িয়ে ধরেছিল। তাদের নিঃশ্বাস একে অন্যের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল। বীণার এমনভাবে ভ্রু কোঁচকাচ্ছিল যেন সে কেঁদে ফেলবে এবারে। কিন্তু আসলে ও চুমুটাকে উপভোগ করছিল। খানিক বাদে ফের যখন চোখ খুলল ওরা, তখন মূর্তির কাছে ওরা দু’ জন আর পড়ে থাকা বরফ ছাড়া আর কিছু নেই। একই সঙ্গে রোদও উঠেছে আর বরফও ঝরছে। ভারি সুলক্ষণ। বীণার মুখটা হাসিতে ভরে উঠছিল।

    “একে বলে মাশরুম তুষার জানো তো, একই সঙ্গে রোদ উঠলে আর বরফ ঝরলে মাশরুম ভালো ফলে কিনা!”

    “তোমায় বলেছে! একসঙ্গে রোদ উঠলে আর বৃষ্টি পড়লে তবে তো ভালো মাশরুম গজায়! বরফ কোত্থেকে হবে?

    “বোকারাম! এমন উদ্ভুট্টি যুক্তির কথা শিখলে কোথায়? এখানে?”

    “উঁহু, শিখিনি। বানালাম। যাক গে, তোমার মাশরুম বরফ আর ঝরছে না।”

    পেছনে আবার পায়ের শব্দ শুনতে পেল তারা। সাতাশ নম্বরের মূর্তির সামনে। আরেকটা জুটি এসে দাঁড়িয়েছে। “চলো, এবার যাই।” বীণা বলল।

    “হ্যাঁ, সের্গেই সায় দিল, “কিন্তু ফ্লাইটের আগে আরেকবার এখানে আসব। হতে পারে পৃথিবীর জন্য ও কিছু বলে পাঠাতে চাইবে…” মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল সের্গেই।

    “সের্গেই,” বীণা মাথা নাড়ল, “লেজেন্ড তো লেজেন্ডই হয়। মহাকাশে এত গ্রহ। থাকতে ও যে সত্যি সত্যিই পৃথিবীরই বাসিন্দা ছিল এ ব্যাপারে তুমি এত নিশ্চিত হচ্ছ কী করে? জানো তো, সেই উড়ানটার কোনো প্রমাণই নেই। সশস্ত্র বিদ্রোহের সময়ে সমস্ত সংরক্ষণাগার পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। সব পুরোনো তথ্য হারিয়ে গিয়েছে। রয়ে গেছে শুধু এই মূর্তিটা আর তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই কিংবদন্তি।”

    “হয়তো তাই।” মাথা নাড়ল সের্গেই, “তবে আমাদের গ্রহেও এরকম কিছু গল্প আছে জানেনা! পাথরের সুন্দরীর ভালোবেসে মানুষ হয়ে ওঠা… পুরোটা মনে নেই যদিও। তাছাড়া এই যে মার্বেল দিয়ে মূর্তিটা বানানো, সেটা পৃথিবীতে প্রচুর মেলে। আর মেয়েটাও গড়নে পৃথিবীর মেয়েদের মতোই দেখতে তো! যদিও বড্ড বেশি সুন্দরী।”

    “তবে এর উলটোদিকেও একটা শক্তিশালী যুক্তি আছে সের্গেই।” বীণার ঠোঁটদুটোতে দুষ্টুমিভরা একটা হাসি খেলা করে যাচ্ছিল, “জানো তো, আমাদের কিংবদন্তির সেই কম্যান্ডার ‘চার’ কী বলেছিল সেই গ্রহটা সম্বন্ধে? বলেছিল, একটা দেউলিয়া গ্রহ। গ্রেট লজিটেয়েনিয়াকে কিছুই দেবার নেই তার। তা তোমার কি মনে হয় তোমার অমন সমৃদ্ধ শক্তিশালী পৃথিবী গ্রহটার বিষয়ে ওকথাটা আদৌ খাটে?”

    প্যাঁচে পড়ে মাথা নাড়ল সের্গেই, “আরে না। একেবারে না। হতেই পারে না, বুঝলে! নিশ্চয় অন্য কোনো ছোটোখাটো ফালতু গ্রহই হবে। মূর্তিটা অবশ্য এত সুন্দর… তবে যাক গে। পৃথিবীর হতেই পারে না ওটা। কিছুতেই না।”

    বীণা হাসছিল।

    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনিম্নবর্গের ইতিহাস – পার্থ চট্টোপাধ্যায়
    Next Article ওডিসি – হোমার

    Related Articles

    পার্থ চট্টোপাধ্যায়

    নিম্নবর্গের ইতিহাস – পার্থ চট্টোপাধ্যায়

    September 11, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }