Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    স্বদেশ অন্বেষা – আহমদ শরীফ

    আহমদ শরীফ লেখক এক পাতা গল্প227 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    বাঙালির সংস্কৃতি

    অন্যান্য প্রাণী ও মানুষের মধ্যে পার্থক্য এই যে, অন্য প্রাণী প্রকৃতির অনুগত জীবন ধারণ করে আর মানুষ নিজের জীবন রচনা করে। প্রকৃতিকে জয় করে, বশীভূত করে প্রকৃতির প্রভু হয়ে সে কৃত্রিম জীবন যাপন করে– এ-ই তার সংস্কৃতি ও সভ্যতা। অতএব, এইভাবে জীবন রচনা করার নৈপুণ্যই সংস্কৃতি। স্বল্প কথায় সুন্দর ও সামগ্রিক জীবনচেতনাই সংস্কৃতি। চলনে-বলনে, মনে-মেজাজে, কথায়-কাজে, ভাবে-ভাবনায়, আচারে-আচরণে অনবরত সুন্দরের অনুশীলন ও অভিব্যক্তিই সংস্কৃতিবানতা। সংস্কৃতিবান ব্যক্তি অসুন্দর, অকল্যাণ ও অপ্রেমের অরি। সুরুচি ও সৌজন্যেই তাই সংস্কৃতিবানতার প্রকাশ। সংস্কৃতিবান মানুষ কখনও জ্ঞাতসারে অন্যায় করে না, অল্যাণকর কিছুকে প্রশ্রয় দেয় না, অপ্রীতিতে বেদনাবোধ করে এবং কৌৎসিত্যকে সহ্য করে না। অন্য কথায়, যেখানে কথার শেষ সেখানেই সুরের আরম্ভ, যেখানে Photography-র শেষ সেখান থেকেই শিল্পের শুরু, নক্সার উধ্বেই সাহিত্যের স্থিতি, তেমনি যেখানে স্কুল জৈব প্রয়োজনের শেষ, সেখান থেকেই সংস্কৃতির শুরু। সংস্কৃতিবান মানুষ জ্ঞানে-প্রজ্ঞায়, অভিজ্ঞতায় ও প্রয়োজনবোধে চালিত হয়ে অনবরত জীবনকে রচনা করতে থাকে এবং পরিবেশকে স্নিগ্ধ ও সুন্দর করবার প্রয়াসী হয়। এজন্যে সংস্কৃতিবান ব্যক্তিমাত্রেই কেবল নিজের প্রতি নয়, প্রতিবেশীর প্রতিও নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য স্বীকার করে। এবং সচেতনভাবে ও সযত্নে নিজেকে সুন্দর করে, সৃষ্টি করে এবং নিজের আচারে আচরণে, মনে-মননে, কথায়-কাজে অপরের পক্ষে স্মরণীয়, বরণীয়, অনুকরণীয়, অনুসরণীয় ও আকর্ষণীয় লাবণ্য ছড়িয়ে তৈরি করে প্রতিবেশীদের সুষ্ঠু জীবনের ভিত্।

    বীজের আত্মবিকাশের জন্যে যেমন কৰ্ষিত ক্ষেত্র প্রয়োজন, সংস্কৃতির উদ্ভব ও বিকাশের জন্যেও তেমনি সুকর্ষিত মনোভূমি তথা পরিস্রত চেতনা আবশ্যক। তাই সংস্কৃতির স্রষ্টামাত্রেই বিজ্ঞ ও বিবেকবান, সুন্দরের ধ্যানী ও আনন্দের অন্বেষ্টা, বুদ্ধি ও বৃদ্ধির সাধক,মঙ্গল ও মমতার বাণীবাহক এবং প্রীতি ও প্রফুল্লতার উদ্ভাবক।

    চরিত্রবল, মুক্তবুদ্ধি ও উদারতার ঐশ্বর্যই এমন মানুষে সম্বল ও সম্পদ। বেদনা-মুক্তি ও আনন্দ-অন্বেষাই মানুষের জীবনসত্য। এক্ষেত্রে সিদ্ধির জন্যে প্রয়োজন সুন্দর ও কল্যাণের প্রতিষ্ঠা। আর এই সৌন্দর্য-অন্বেষা ও কল্যাণকামিতাই সংস্কৃতি। . মানুষের জীবনে সম্পদ ও সমস্যা, আনন্দ ও যন্ত্রণা পাশাপাশি চলে, বলা যায় একটি অপরটির সহচর। কিন্তু এগুলো যখন আনুপাতিক ভারসাম্য হারায়, তখন সুখ কিংবা দুঃখ বাড়ে। সুখ বৃদ্ধি পেল তো ভালই, কিন্তু সমস্যা ও যন্ত্রণার চাপে যখন জীবন-জ্বালা আত্যন্তিক হয়ে উঠে, তখনই বিচলিত-বিপর্যস্ত মানুষ স্বস্তি কামনায় সমাধান খোঁজে। এ সমাধান দিতে পারেন এবং দেনও কেবল সংস্কৃতিবান মানুষই।

    মানুষ মাত্রেই সচেতন কিংবা অবচেতনভাবে সংস্কৃতিকামী। কিন্তু সাধনার মাত্রা ও পথ পদ্ধতি সবার এক রকম নয়। তাই সংস্কৃতিতে আসে গৌত্রিক, আঞ্চলিক, সামাজিক, আর্থিক ও আত্মিক বৈষম্য ও বিভিন্নতা। এবং স্তরভেদে তা হয় নিন্দনীয় কিংবা বন্দনীয়, অনুকরণীয় কিংবা পরিহার্য।

    আগের কথা জানিনে, কিন্তু ইতিহাসান্তৰ্গত যুগে দেখতে পাই বাঙালি মনোভূমি কর্ষণ করেছে সযত্নে। এবং এই কর্ষিত ভূমে মানবিক সমস্যার বীজ বপন করে সমাধানে ফল ও ফসল পেতে হয়েছে উৎসুক। এই এলাকায় বাঙালি অনন্য। এ যেন তার নিজের এলাকা, সে এই মাটিকে। ভালবেসেছে, সে এ জীবনকে সত্য বলে জেনেছে। তাই সে দেহতাত্ত্বিক, তাই সে প্রাণবাদী, তাই সে যোগী ও অমরত্বের পিপাসু। এজন্যেই নির্বাণবাদী বুদ্ধের ধর্মগ্রহণ করেও সে কায়া সাধনায় নিষ্ঠ। তার কাছে এ মর্ত্যজীবনই সত্য, পারত্রিক জীবন মায়া। মর্ত্যজীবনের মাধুর্যে সে আকুল, তাই সে মর্ত্যে অমৃতসন্ধানী। সে বিদ্রোহী, সে বলে :

    কিংতো দীবে কিংতো নিবেজেঁ
    কিংতো কিজ্জই মন্তহ সেব্ব।
    কিংতো তিথ-তপোবন জাই।
    মোখক কী লবভই পানী হ্নাই।
    –কী হবে তোর দীপে আর নৈবেদ্যে? মন্ত্রের সেবাতেই বা কী হবে তোর, তীর্থ-তপোবনই। বা তোকে কী দেবে? পানিতে স্নান করলেই কী মুক্তি মেলে?

    অনেককাল পরে এই ধারারই সাধক বাউলের মুখে শুনতে পাই :

    সখিগো, জন্ম মৃত্যু যাহার নাই।
    তাহার সনে প্রেম গো চাই।
    উপাসনা নাই গো তার
    দেহের সাধন সর্বসার।
    তীর্থব্রত যার জন্য
    এ দেহে তার সব মিলে।

    জীবনবাদী বাঙালি তাই বৌদ্ধ হয়েও মর্ত্যের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তার বাঞ্ছায় অসংখ্য উপ ও অপদেবতার সৃষ্টি ও পূজা করেছে। সাংখ্যকেই সে তার দর্শনরূপে এবং যোগকেই তার সাধনপদ্ধতি রূপে গ্রহণ করেছে। তন্ত্রকেই সার বলে মেনেছে। দেহে-মনে আত্ম-অধিকার প্রতিষ্ঠাকেই। জীবনকাঠি বলে জেনেছে। আর যোগ-তান্ত্রিক কায়া-সাধনার মাধ্যমে সে কামনা করেছে দীর্ঘ জীবন ও অমরত্ব। এ জীবনকে সে প্রত্যক্ষ করেছে চলচঞ্চল ও তরঙ্গভঙ্গে লীলাময় মন-পবনের নৌকারূপে। বৌদ্ধ যুগে তার সাধনা ছিল নির্বাণের নয়–বাঁচার, কেবল মাটি আঁকড়ে বাঁচার। মন ভুলানো ভুবনের বনে বনে, ছায়ায় ছায়ায়, জলে-ডাঙায় ভালবেসে, প্রীতি পেয়ে মমতার মধুর অনুভূতির মধ্যে বেঁচে থাকার আকুলতাই প্রকাশ করেছে সে জীবনব্যাপী। হরগৌরীর মহাজ্ঞান, মীননাথ, গোরক্ষনাথ, হাড়িফা-কানুফা, ময়নামতী-গোপীচাঁদ প্রভৃতির কাহিনীর মধ্যে আমরা এ তত্ত্বই পাই। অবশ্য এ বাঁচা স্কুল ও জৈবিক ভোগের মধ্যে নয়, ত্যাগের মধ্যে সূক্ষ্ম, সুন্দর ও সহজ মানসোপভোগের মধ্যে বাঁচা। কিন্তু এই জীবন-সত্যে সে কী নিঃসংশয় ছিল?–মনে হয় না। তাই বিলুপ্ত যোগীপাল, ভোগীপাল, মহীপাল গীতে তার দ্বিধা ও মানস-দ্বন্দ্বের আভাস পাই। পাল আমলের গীতে মনে হয়, সে মধ্যপন্থা (golden mean) অবলম্বন করেছে। যোগেও নয়, ভোগেও নয়, মর্ত্যকে ভালবেসে দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যেই যেন সে বাঁচতে চেয়েছে, চেয়েছে জীবনকে উপলব্ধি ও উপভোগ করতে। তার সেই জানা-বোঝার সাধনায় আজও ছেদ পড়েনি। বাউলেরা তাই গৃহী, যোগীরা তাই অমরত্বের সাধক, বৈষ্ণব বৈরাগীরা তাই ঘর করে, আর ফকিরেরা বাঁধে ঘর।

    সেন আমলে এখানে ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রবল হয়। লুপ্তপ্রায় বৌদ্ধসমাজ বর্ণে বিন্যস্ত হয়ে বল্লালসেনের নেতৃত্বে উগ্র ব্রাহ্মণ্য সমাজ গড়ে তোেলে। কিন্তু তা স্থায়ী হয়নি। গীতা-স্মৃতি উপনিষদের মত সে মুখে গ্রহণ করলেও মনে মানেনি। তার ঠোঁটের স্বীকৃতি বুকের বাণী হয়ে উঠেনি। কেননা সে ধার করে বটে, কিন্তু জীবনের অনুকূল না হলে অনুকরণ কিংবা অনুসরণ করে না। তাই সে তার প্রয়োজনমতো জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তার প্রতীক দেবতা সৃষ্টি করে পূজা করেছে, আশ্বস্ত হতে চেয়েছ ঘরোয়া ও মানস জীবনে। তার মনসা, চণ্ডী, শীতলা, ষষ্ঠী, শনি তার স্বসৃষ্ট দেবতা। জীবনের সামাজিক সমস্যার সমাধানে ও অধ্যাত্মজীবনের বিকাশ সাধনে সে আরো এগিয়ে এসেছে। জীমূতবাহন ও বল্লালসেন, রঘুনাথ, রামনাথ প্রভৃতির স্মৃতি ও ন্যায় দৈবকী বানন্দ-পঞ্চাননের মেল-পটি প্রভৃতি গোত্র ও বর্ণবিন্যাস প্রয়াস, চৈতন্যের ভগবৎপ্রেম ও মানব প্রীতিবাদ বাঙালি জীবনে রেনেসাঁস আনে। এবং তার প্রসাদে আপামর বাঙালির দেহ-মন-আত্মা গ্লানিমুক্ত হয়। এ নতুন কিছু ছিল না, গৌতমের করুণা ও মৈত্রীতত্ত্বের ঐতিহ্যে সূফীমতের প্রভাবেই মানব-মহিমা বাঙালি চিত্তে নতুন মূল্যে ও ঔজ্জ্বল্যে প্রতিভাত হয়। বাঙালি নতুন করে জীবে ব্রহ্ম এবং নরে নারায়ণ দর্শন করে। তখন বাঙালির মুখে উচ্চারিত হয় মানুষের মর্যাদা ও মনুষ্যত্বের মহিমা চণ্ডালেহপি দ্বিজশ্রেষ্ঠ হরিভক্তি পরায়ণঃ।–মানবিক সম্ভাবনার এ স্বীকৃতি সেদিন জীবন-বিকাশের নিঃসীম দিগন্তের সন্ধান দিয়েছে। তাই বাঙালির কণ্ঠে আমরা সেদিন শুনতে পেয়েছিলাম চরম সত্য ও পরম কাম্য বাণী–শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।

    বাঙালি এই ঐতিহ্য আজও হারায়নি। আজো হাটে-ঘাটে-প্রান্তরে বাউলকণ্ঠে সেই বাণী শুনতে পাই। মানববাদী বাউলেরা আজো উদাত্তকণ্ঠে মানুষকে মিলন-ময়দানে আহ্বান জানায়, আজো তারা মানবতার শ্রেষ্ঠ সাধক ও চিন্তানায়কের কণ্ঠের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে সাম্য, সহঅবস্থান ও সম্প্রীতির বাণী শোনায়। তারা বলে :

    নানা বরণ গাভীরে ভাই
    একই বরণ দুধ
    জগৎ ভরমিয়া দেখিলাম
    একই মায়ের পুত।

    কাজেই কাকেই বা দূরে ঠেলবি আর কাকেই বা কাছে টানবি! তোরা তো ভাই ফুল কুড়োতে কেবল ভুলই কুড়োচ্ছিস। কৃত্রিম বাছ-বিচারের ধাঁধায় কেবল নিজেকেই ঠকাচ্ছিস। গোত্রীয়, ধর্মীয় ও দেশীয় চেতনা বিভেদের প্রাচীরই কেবল তৈরি করেছে বিদ্বেষ ও বিবাদ সৃষ্টি করেছে, হানাহানির প্রেরণাই কেবল দিয়েছে, তাই বাউল বলেন :

    যদি

    সুন্নত দিলে হয় মুসলমান।
    নারী লোকে কী হয় বিধান?
    বামুন চিনি পৈতার প্রমাণ
    বামনী চিনি কী করে?

    একালের ইংরেজি শিক্ষিত কবি যখন বলেন :

    সবারে তুই বাসরে ভাল, নইলে তোর মনের কালি ঘুচবে না রে।

    কিংবা –

    কালো আর ধলো বাহিরে কেবল
    ভিতরে সবার সমান রাঙা

    অথবা,–

    গাহি সাম্যের গান।
    মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই।
    নহে কিছু মহীয়ান;

    তখন তা আমাদের কাছে নতুন ঠেকে না। কেননা প্রকৃত বাঙালির অন্তরের বাণী স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চারিত হতে দেখেছি আমরা কত কত কাল আগে।

    ওহাবী-ফরায়েজী আন্দোলনের পূর্বে এখানে শরীয়তী ইসলামও তেমন আমল পায়নি। একপ্রকার লৌকিক তথা দেশজ ইসলামই লোকের অবলম্বন হয়েছিল। তখন পার্থিব জীবনের স্বস্তির ও জীবিকার নিরাপত্তার জন্য কল্পিত হয়েছিলেন দেব-প্রতিম পাঁচগাজী ও পাঁচপীর। নিবেদিত চিত্তের ভক্তি লুটেছে খানকা, অর্ঘ্য পেয়েছে দরগাহ্ আর শিরনী পেয়েছেন দেশের সেনানী-শাসক জাফর-ইসমাইল-খান জাহান-গাজীরা এবং বিদেশাগত বদর-আলম-জালাল-সুলতান প্রভৃতি সুফীরা, তার পরেও প্রয়োজন হয়েছিল সত্যপীর-খিজির-বড়খা-গাজী-কালু-বনবিবি-ওলাবিবি প্রভৃতি দেবকল্প কাল্পনিক পীরের। এঁরা বাঙালির ঐহিক জীবনের নিয়ন্তা দেবতা। জীবনবাদী বাঙালি এঁদের উপর ভরসা করেই সংসার-সমুদ্রে ভাসাত জীবন-নৌকা। এখানেই শেষ নয়। চিন্তাজগতে বাঙালি চিরবিদ্রোহী। বৌদ্ধ, ব্রাহ্মণ্য ও মুসলিম ধর্ম সে নিজের মতো করে গড়তে গিয়ে যুগে যুগে সে চিন্তাজগতে বিপ্লব ঘটিয়েছে। বাহ্যত সে ভাববাদী হলেও, উপযোগ-তত্ত্বেই তার আস্থা ও আগ্রহ অধিক।– বৌদ্ধযুগে বৌদ্ধ বজ্রমান-সহজযান-কালচক্রযান, থেরবাদ, অবলোকিতেশ্বর ও তারা দেবতার প্রতিষ্ঠা এবং যোগতান্ত্রিক সাধনায় বিকাশ সাধন করে সে তার স্বকীয়তার, সৃষ্টিশীলতার, মনন বৈচিত্র্যের ও স্বাতন্ত্রের স্বাক্ষর রেখে গেছে।

    ব্রাহ্মণ্যযুগে জীমূতবাহন, বল্লালসেন, রামনাথ, রঘুনাথ, রঘুনন্দন প্রভৃতি নবস্মৃতি ও নবন্যায় সৃষ্টি করে তাঁদের চিন্তার ঐশ্বর্যে ও প্রজ্ঞার প্রভায় জ্ঞানলোক সমৃদ্ধ ও উজ্জ্বল করেছেন।

    মুসলিম আমলে চৈতন্যদেবের নবপ্রেমবাদ, সত্যপীর-কেন্দ্রী নবপীরবাদ, চাঁদ সদাগরের আত্মসম্মানবোধ ও তেজস্বিতা, বেহুলার বিদ্রোহ ও কৃচ্ছ্ব-সাধনা, গীতিকায় পরিব্যক্ত জীবনবাদ আমাদের সাংস্কৃতিক অনন্যতা ও বিশিষ্ট জীবনচেতনার সাক্ষ্য।

    তারপরেও কী আমরা থেমেছি! রামমোহনের ব্রাহ্মমত, বিদ্যাসাগরের শ্ৰেয়োবোধ, ওহাবী ফরায়েজী মতবাদ, রবীন্দ্রনাথের মানবতা, নজরুল ইসলামের মানববাদ কী সংস্কৃতি ক্ষেত্রে আমাদের এগিয়ে দেয়নি?

    মনীষা ও দর্শনের জগতে বাঙালি মীননাথ, কানপা, তিলপা, শীলভদ্র, দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অতীশ, জীমূতবাহন, রঘুনাথ, রঘুনন্দন, রামনাথ,চৈতন্যদেব, রূপ-সনাতন-জীব-রঘুনাথাদি গোস্বামী, সৈয়দ সুলতান, আলাউল, হাজী মুহম্মদ, আলিরজা, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, কৃত্তিবাস-কাশীদাস রামমোহন-বিদ্যাসাগর-মধুসূদন, তীতুমীর-শরীয়তুল্লাহ্-দুদুমিয়া, বঙ্কিম-রবীন্দ্র-প্রমথ-নজরুল নির্মাণ করেছেন বাঙালি মনীষার ও সংস্কৃতির গৌরব মিনার। এঁদের কেউ বলেছেন ঘরের ও ঘাটের কথা, কেউ জানিয়েছেন জগৎ ও জীবন-রহস্য; কারো মুখে শুনেছি প্রেম, সাম্য ও করুণার বাণী; কারো কাছে পেয়েছি মুক্তবুদ্ধি ও উদারতায় দীক্ষা; কেউবা শিখিয়েছেন ঘর বাঁধা ও ঘর রাখার কৌশল, কেউ শুনিয়েছেন ভোগের বাণী, কেউ জানিয়েছেন ত্যাগের মহিমা, আবার কেউ দেখিয়েছেন মধ্যপন্থার ঔজ্জ্বল্য। আত্মিক, আর্থিক, সামাজিক, পারমার্থিক সব চিন্তা, সব মন্ত্রই আমরা নানাভাবে পেয়েছি এদের কাছে।

    বাঙালির বীর্য হানাহানির জন্যে নয়, তার প্রয়াস ও লক্ষ্য নিজের মতো করে স্বচ্ছন্দে বেঁচে থাকার। স্বকীয় বোধ-বুদ্ধির প্রয়োগে তত্ত্ব ও তথ্যকে, প্রতিবেশ ও পরিস্থিতিকে নিজের জীবনের ও জীবিকার অনুকূল ও উপযোগী করে গড়ে তোলার সাধনাতেই বাঙালি চিরকাল নিষ্ঠ ও নিরত। এই জন্যেই রাজনীতির তত্ত্বের (Theory) দিকটিই তাকে আকৃষ্ট করেছে বেশি–বাস্তব-প্রয়োজনে সে অবহেলাপরায়ণ; কেননা তাতে বাহুবল, ক্রুরতা ও হিংস্রতা প্রয়োজন। এজন্যেই কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ বাঙালির মানস-সন্তান হলেও নেতৃত্ব থাকেনি বাঙালির। বিদেশাগত ভূঁইয়াদের নেতৃত্বে সুদীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছর ধরে মুঘল বাহিনীর সঙ্গে সংগ্রামে জানমাল উৎসর্গ করতে বাঙালিরা দ্বিধা করেনি বটে, কিন্তু নিজেদের জন্যে স্বাধীনতা কিংবা সম্পদ কামনা করেনি। কিন্তু মননের ক্ষেত্রে সে অনন্য। নতুন কিছু করার আগ্রহ ও যোগ্যতা তার চিরকালের। প্রজারা যেদিন গোপালকে রাজা নির্বাচিত করেছিল, ইতিহাসের এলাকায় সেদিন ভারতের মাটিতে প্রথম গণতান্ত্রিক চিন্তার বীজ উপ্ত হল। সেদিন এ বিস্ময়কর পদ্ধতির উদ্ভাবন ও প্রয়োগ কেবল বাঙালির পক্ষেই সম্ভব ছিল।

    ওহাবী, ফরায়েজী ও সশস্ত্র বিপ্লবকালে বাঙালির বল ও বীর্য, ত্যাগ ও অধ্যবসায় বাঙালির গৌরবের বিষয়।

    স্বাতন্ত্র আসে উৎকর্ষে, অনন্যতায় ও অনুপমতায়–বৈপরীত্যে ও বিভিন্নতায় নয়। বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রও তার উৎকর্ষে, নতুনত্বে ও অনন্যতায়। আমাদের দুর্ভাগ্য ও লজ্জার কথা এই যে, ইংরেজ আমলে ইংরেজি শিক্ষিত অধিকাংশ বাঙালি লেখাপড়া করে কেবল হিন্দু হয়েছে কিংবা মুসলমান হয়েছে, বাঙালি হতে চায়নি। হিন্দুরা ছিল আর্য-গৌরবের ও রাজপুত-মারাঠা বীর্যের মহিমায় মুগ্ধ ও তৃপ্ত এবং মুসলমান ছিল দূর অতীতের আরব-ইরানের কৃতিত্ব-স্বপ্নে বিভোর। এরা স্বাদেশিক স্বাজাত্য ভুলেছিল, বিদেশীর জ্ঞাতিত্ব গৌরবে ছিল তৃপ্তমন্য। এদের কেউ স্বস্থ ও সুস্থ ছিল না। তাই বাঙলা সাহিত্যে আমরা কেবল হিন্দু কিংবা মুসলমানই দেখেছি। বাঙালি দেখেছি ক্কচিৎ। এজন্যেই আমাদের সংস্কৃতি আশানুরূপ বিস্তার ও বিকাশ পায়নি। আজ বাঙালি পায়ের তলার মাটির সন্ধান নিচ্ছে। এই মাটিকে সে আপনার করে নিচ্ছে। এর মানুষকে ভাই বলে জেনেছে। আজ আর কেবল ধর্মীয় পরিচয়ে সে চলে না। স্বদেশের ও স্বভাষার নামে পরিচিত হতে সে উৎসুক। দুর্যোগের তমসা অপগতপ্রায় প্রভাত হতে দেরী নেই সামনে নতুন দিন, নতুন জীবন। নিজেকে যে চেনে, অন্যকে জানা-বোঝা তার পক্ষে সহজ। আজ বাঙালি আত্মস্থ হয়েছে। তার আত্ম-জিজ্ঞাসা য়েছে প্রখর, সংহতি কামনা হয়েছে প্রবল। শিক্ষিত তরুণ বাঙালি জেগেছে, তাই সে তার ঘরের লোককে জাগাবার ব্রত গ্রহণ করেছে। বলছে বাঙালি জাগো। জাগ্রত মানুষই সংস্কৃতি চর্চা করে। এবার স্বস্থ ও প্রকৃতিস্থ বাঙালি জাগবে ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে দ্রুত এগিয়ে যাবে। জীবনে ও জগতে সে নতুনকে করবে আবাহন এবং নতুন ও ঋদ্ধ চেতনায় হবে প্রতিষ্ঠিত।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleজীবনে-সমাজে-সাহিত্যে – আহমদ শরীফ
    Next Article সাহিত্য ও সংস্কৃতি চিন্তা – আহমদ শরীফ

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }