Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    স্বদেশ অন্বেষা – আহমদ শরীফ

    আহমদ শরীফ লেখক এক পাতা গল্প227 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    জাতি গঠনে ভাষার প্রভাব

    আত্মীয়তা ও ঐক্যের বন্ধন হিসেবে রক্ত-সম্পর্কের পরেই ভাষার স্থান। গভীরভাবে বিবেচনা করলে মনে হবে ভাষার গুরুত্ব রক্ত-সম্পর্কের চাইতেও বেশি। কেননা, বোধগম্য ভাষার মাধ্যমেই হয় জানাজানি ও মন দেয়া-নেয়া। অপরিচয় যেমন অনাত্মীয়তার নামান্তর, তেমনি পরিচয় মানে চাক্ষুষ করা নয় বরং পরস্পরের মন-মেজাজ ও মত-পথ জানা। এটি কেবল কথার মাধ্যমেই সম্ভব। অতএব, অর্থপূর্ণ ধ্বনিই মানুষের ব্যষ্টি জীবন ও সামষ্টিক-সামাজিক জীবন নিয়ন্ত্রণ করে। ভাষার মাধ্যম ব্যতীত আমরা যেমন ভাবতে পারিনে, তেমনি ভাষা ছাড়া আমরা নিজেদেরকে অনুভব করতেও অসমর্থ। কাজেই চেতনা প্রকারান্তরে ভাষারই অন্য নাম। মানুষের মানসিক কিংবা বৈষয়িক জীবন তাই ভাষানির্ভর। বলতে গেলে, অন্য প্রাণী থেকে মানুষ যে উৎকর্ষ ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে, তার মন-বুদ্ধি-আত্মার যে বিকাশ ও বিস্তার হয়েছে, তা মুখ্যত ভাষার কারণেই এবং গৌণত তার কায়িক-সৌকর্যের দরুণ। অসংখ্য ধ্বনি-সৃষ্টির শক্তি ও হাত প্রয়োগের সামর্থ্যই রয়েছে তার যাবতীয় বিকাশের মূলে।

    প্রেম-প্রীতি-স্নেহ, ঘৃণা-বিদ্বেষ-অবহেলা প্রভৃতির উদ্ভব আর অবসানও অনেকখানি নির্ভর করে কথার উপরই। ব্যক্তিগত জীবনে ভাষার মাধ্যমে পরিচয় না ঘটলে রাগ বা বিরাগ জন্মাবার কারণ সহজে মেলে না। অতএব, রক্ত-সম্পর্ক ও ভাষার অভিন্নতাই পারস্পরিক মিলনের আদি ভিত্তি। অভিন্ন ভাষাই আদিকালে বিভিন্ন গোত্রের সমবায়ে সমাজ গঠনের সহায়ক হয়েছে।

    ভাষার মাধ্যমেই ভাব-চিন্তার বিকাশ ঘটে বলেই সৌজন্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতা বৃদ্ধিরও মুখ্য অবলম্বন হয়েছে এ ভাষাই। স্বভাষার বিকাশবিরহী কোনো মানবগোষ্ঠীই সভ্য নয়। কেননা, ভাষার মাধ্যমেই শ্রেয় ও প্রেয়বোধ সমাজে বিস্তার লাভ করে। অভিন্ন ভাষার মাধ্যমেই বিচ্ছিন্ন গোত্রগুলো পরস্পরের সন্নিহিত হয়ে সংহত ও সঙ্ঘবদ্ধ জীবন-ভাবনায় ও জীবন-রচনায় ব্রতী হয়।

    জন্মসূত্রে মানুষ যে ভাষা পায় অর্থাৎ আশৈশব মানুষ যে ভাষায় অভ্যস্ত হয়, সেটিই তার স্বভাষা বা মাতৃভাষা। ঐ ভাষাই তার চেতনার নিয়ামক বলে তার প্রাণেশ্বর হয়ে উঠে। অতিক্রান্ত শৈশবে পড়ে-পাওয়া ও শুনে-শেখা ভাষা ঐ ভাষার মতো চেতনা- সংপৃক্ত হয় না, প্রিয়ও হয় না। ফলে স্বভাষী ব্যতীত অন্যভাষী লোকও প্রীতির ক্ষেত্রে আনুপাতিক দূরত্বে অবস্থান করে।

    বিদ্বানেরা বলেন, মানুষের বাকযন্ত্রে কোনো ধ্বনিই অবকল ভাবে দ্বিরুক্ত হতে পারে না। প্রতি মুহূর্তেই তা পরিবর্তিত হচ্ছে। কায়িক অসামর্থ্যই তার মুখ্য কারণ। যেহেতু প্রতি মানুষেরই রয়েছে। স্বতন্ত্র অবয়ব, সেহেতু কোনো দুটো মানুষের ধ্বনি-সৃষ্টির শক্তি অভিন্ন নয়। তাছাড়া অজ্ঞতা ও অনবধানতাবশেও ধ্বনি বিকৃত হয়। অতএব, দৈহিক অসামর্থ্য ও অজ্ঞতাই ধ্বনি-বিকৃতির কারণ। ভাষার ক্ষেত্রে এই বিকৃতিকে আমরা সৌজন্যবশে বিবর্তন বা রূপান্তর বলে থাকি। একটা পরিমিত দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে এই বিবর্তনটা স্পষ্ট হয়ে উঠে। অর্থাৎ চার-পাঁচ পুরুষের ব্যবধানে তা কানে ধরা দয়। এমনি করেই এক মূল ভাষা বিবর্তিত হয়ে অসংখ্য বুলি ও ভাষাতে পরিণত হয়। আমাদের আর্য ভাষাও এমনি করেই এশিয়া-য়ুরোপে অসংখ্য ভাষা হয়ে বিশিষ্ট বিকাশ লাভ করেছে।

    ঋগ্বেদের আমলের ভাষার ক্রমবিবর্তনে গড়ে উঠেছে উত্তরভারতের আধুনিক ভাষাগুলো। বাঙলাও এদের একটি। ভাগলপুর থেকে কক্সবাজার, মালদহ থেকে গোয়ালপাড়া অবধি এ ভাষার লেখ্যরূপ আজো অভিন্নরূপে চালু রয়েছে। কিন্তু আঞ্চলিক বুলি হয়েছে বিচিত্র ও স্বতন্ত্র। বুলিতে বুলিতে পার্থক্য এত বেশি যে, আনাড়ির চোখে এদের গৌত্রিক অভিন্নতা সহজে ধরা পড়ে না। অতএব কেবল লেখ্যরূপের মাধ্যমেই ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতির উদ্ভব সম্ভব হয়েছে। এ লেখ্যরূপের উদ্ভব বিলম্বিত হলে আমরা আজকের বাঙালি জাতিকে এত বড় ভূখণ্ডে আজকের সংখ্যায় পেতাম না।

    প্রমাণস্বরূপ বলা যায়, এক সময় মাগধী-প্রাকৃত চালু ছিল বিহারে, উড়িষ্যায়, বাঙলায় ও আসামে। মাগধী প্রাকৃতের ক্রমবিকৃতিতে উদ্ভূত হয় অবহরে। তখনো আঞ্চলিক পার্থক্য তেমন প্রকট ও প্রবল হয়ে উঠেনি। তাই লেখ্য অবহট্ট ছিল এসব অঞ্চলে অভিন্ন। প্রাকৃত-পৈঙ্গল, দোহাকোষ প্রভৃতিই তার প্রমাণ। আরো পরে অর্বাচীন অবহট্ট যুগেও লেখ্যরূপে আনুগত্য ছিল অবিচল। তাই চর্যাগীতিতে পাই বঙ্গ-কামরূপ ও বিহার উড়িষ্যার পদকার।

    একচ্ছত্র শাসনই অভিন্ন লেখ্য ভাষার উদ্ভবের মুখ্য কারণ। দশ শতক.অবধি মোটামুটিভাবে এসব অঞ্চল গুপ্ত ও পাল শাসনে ছিল। তাই অর্বাচীন অবহট্ট যুগেও ভাষিক ঐক্য দৃশ্যমান। পালরাজত্বের অবসানে এই রাষ্ট্রিক ঐক্য বিঘ্নিত হয়। তাই যদিও তেরো শতক অবধি বাঙলা উড়িষ্যা এবং ষোলো শতক অবধি বাঙলা-আসামী অভিন্ন ছিল, তবু একচ্ছত্র শাসনের অর্থাৎ এককেন্দ্রিক শাসন-সংস্থার অনুপস্থিতির দরুন অর্বাচীন অবহট্ট-উত্তর ভাষা সর্বজনীন লেখ্যরূপ। পায়নি। তাই আঞ্চলিক বুলিই স্থানিক প্রয়োজনে লেখ্য ভাষায় উন্নীত হয়। ফলে বিহারে, উড়িষ্যায়, . বাঙলায় ও আসামে চালু হল চারটি স্বতন্ত্র লেখ্য ভাষা। আর এর সুদূরপ্রসারী ফল এই দাঁড়াল যে মাগধী প্রাকৃত ভাষী একটি ভাষিক জাতি বা সম্প্রদায় কালে চারটি ভাষিক জাতিতে পরিণত হল। যদি গুপ্ত ও পাল আমলের মতো একচ্ছত্র শাসন আধুনিক বুলিগুলোর স্বরূপ প্রাপ্তির সময়ে ও লেখ্যরূপ গ্রহণকালে চালু থাকত, তাহলে বিহার, উড়িষ্যা, বাঙলা ও আসাম জুড়ে একটি বিরাট ভাষিক জাতি গড়ে উঠতে পারত, এবং তাহলে আর্থিক, রাজনৈতিক কিংবা সাংস্কৃতিক শক্তিরূপে পূর্ব-ভারতে একটি মর্যাদাবান রাষ্ট্রের স্থিতি অবধারিত ছিল। কিন্তু একচ্ছত্র শাসন-সংস্থার অভাবে তা হতে পারেনি এবং আর কোনদিন হবেও না। অবশ্য অভিন্ন ভাষা দিয়ে যে একক রাষ্ট্র গড়ে উঠবে এমন নিশ্চয়তা আগেও কখনো ছিল না, এখনো নেই। তবে এ-কথা সত্য যে এমনি পরিবেশ সংহতির ও একক রাষ্ট্রগঠনের অনুকূল।

    বাঁকুড়া ও চট্টগ্রামের এবং মালদহ ও গোয়ালপাড়ার মানুষ যে একই লেখ্য ভাষার বন্ধনে ধরা দিয়েই বাঙালি হয়েছে, এ সত্য অস্বীকার করবার উপায় নেই। নইলে তাদের স্থানিক বুলি এতই পৃথক যে তারা কোনক্রমেই অভিন্নভাষী জাতি হতে পারত না। মালদহ কিংবা বাঁকুড়ার লোক সহজেই হতে পারত বিহারী, যেমন মেদিনীপুরের লোক হতে পারত উড়িয়া এবং সিলেটীরা হত আসামী। কাজেই আজকের বাঙালির স্বাজাত্যবোধের উৎস স্বভাষা। কেননা এ জাতি পরিচয়ে নৃতত্ত্ব, গোত্রচিহ্ন, ধর্মমত ও বর্ণবিন্যাস অস্বীকৃত। এমনকি আঞ্চলিক অভিমানও এক্ষেত্রে অবহেলিত। তাই পুরেনো রাঃ, সুম্ম, সমতট, বরেন্দ্র, বঙ্গ, গৌড় প্রভৃতি গোত্রবাচক ও অঞ্চল নির্দেশক পরিভাষাগুলোও আজ অবলুপ্ত।

    এককালের অবজ্ঞেয় যে বঙ্গ সেই নামেই সব কয়টি অঞ্চল হয়েছে সংহত। যদিও লেখ্য ভাষাটি রূপ নিয়েছে দক্ষিণ রাঢ়ের বুলি ভিত্তি করেই। মুঘল আমলে প্রায়ই বিহার-উড়িষ্যাও যুক্ত থাকত বাঙলার শাসন-সংস্থার সঙ্গে। বস্তত ১৯০৫ সন অবধি সুবে বাঙ্গালাহ বা বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি ছিল বাঙলা, বিহার ও উড়িষ্যা নিয়ে। এ ব্যবস্থা যদি পাল আমলের পরেও চালু থাকত, তা হলে সেই সুবে বাঙ্গালাহই হত আজকের বাঙালির স্বদেশ বা মাতৃভূমি। কেননা, তা হলে লেখ্য ভাষারূপে রাজধানী অঞ্চলের বাঙলাই গৃহীত হত সর্বত্র। এবং সে ভাষা হত সবারই মাতৃভাষা। কারণ, ইতিহাসের সাক্ষ্যে প্রমাণিত যে, দেশে লেখ্য ভাষার অনুপস্থিতির সুযোগে বহিরারোপিত ধর্মের কিংবা বহিরাগত শাসকের ভাষা শাসিত-অঞ্চলে লেখ্য ভাষারূপেও স্থায়িত্ব লাভ করে। যেমন আমরা বাঙালিরা কেউ আর্য ছিলাম না। আমরা অস্ট্রিক ও ভোটচীনার রক্ত-সঙ্কর মানুষ। আমাদের বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে একসময় অস্ট্রিক (দ্রাবিড়) ও মঙ্গোলীয় বুলি চালু ছিল। কিন্তু উত্তরভারতীয় ধর্ম ও লেখ্য ভাষা গ্রহণ করে আমাদের পূর্বপুরুষেরা স্বভাষা ও স্বাজাত্য পরিহার করে বিস্মৃত হয়ে আর্যত্বের মিথ্যা গৌরব-গর্বে স্ফীত হয়েছিল। ফলে আমাদের নৃতাত্ত্বিক স্বাতন্ত্র, গৌত্রিক অভিমান, মাতৃভাষার মমতা, জীবনযাত্রার রীতিনীতি প্রভৃতি সবকিছু সানন্দে বিসর্জন দিয়ে হয়তো তারা আত্মপ্রসাদ লাভ করেছিল।

    নৃতাত্ত্বিক স্বাতন্ত্র ও গো-চেতনা বিলুপ্তির পক্ষে ধর্মের চেয়ে ভাষার প্রভাব যে অধিক এবং অমোঘ ফলপ্রসূ, তা দুনিয়ার অন্যত্রও দেখতে পাই। এখনকার আরব জাতি বলতে ইরাক থেকে জিব্রাল্টর অবধি বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের অধিবাসীদেরই নির্দেশ করে, অথচ তারা আদিতে এক গোত্রীয় কিংবা অভিন্ন ভাষী ছিল না–বেবেলীয়, কালদীয়, আশিরীয়, ফিনিশীয়, হিত্তি, কপ্ট, অর্য, শক, হুন প্রভৃতি নানা পুরোনো স্বতন্ত্র ও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সমবায়ে গড়ে উঠেছে এ আরব জাতি। এবং তা ধর্মের অভিন্নতায় সম্ভব হয়নি, ভাষার ঐক্যেই নির্মিত হয়েছে। আজকের য়ুরোপীদের কিংবা ল্যাটিন আমেরিকানদের জাতি-চেতনাও রক্ত-নির্ভর নয়–ভাষাভিত্তিক।

    যারা ভাষিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে, তাদেরকে অভিন্ন ধর্মের বন্ধন কিংবা অভিন্ন ভৌগোলিক সংস্থিতি অপরের মধ্যে আত্মমিশ্রণে প্রেরণা দেয়নি। তারা অন্যদের সঙ্গে থেকেও স্বতন্ত্র। অন্যভাষীর সঙ্গে সহঅবস্থান করেও স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে অসংলগ্ন। বিগতকালের য়ুরোপে এবং আধুনিক ভারতে, কানাডায়, আফ্রিকায় ও ল্যাটিন আমেরিকায় এটিও সামাজিক অথবা রাষ্ট্রিক বিরোধের ও বিপর্যয়ের মুখ্য কারণ। আজকের পাকিস্তানও এ সমস্যা থেকে মুক্ত নয়। পশ্চিম পাকিস্তানে সিন্ধি, বেলুচ এবং পাখতুন অসন্তোষও মূলত ভাষিক স্বাতন্ত্র্যজাত অর্থাৎ এর যতটা ভাষিক স্বাতন্ত্র্য চেতনা প্রসূত, ততটা আঞ্চলিক ব্যবধানগত কিংবা গোত্ৰ-চেতনাজাত নয়। পাঞ্জাবের সারাইকী-ভাষী মুলতানীদের সাম্প্রতিক মনোভাবও আমাদের এ ধারণার সমর্থক। পূর্ব বাঙলার সাম্প্রতিক বাঙালি-বিহারী দ্বন্দ্বেরও উৎস এই ভাষাই। তাই পশ্চিম বাঙলা থেকে আগত উদ্বাস্তুদের চিহ্নিত করা যেমন দুঃসাধ্য, বিহারীদের স্বজন বলে গ্রহণ করা তেমনি দুষ্কর। ভাষাগত ঐক্য ও স্বাতন্ত্রই এই মিলন ও বিরোধের, এই আপন-পর পার্থক্যের মূলে ক্রিয়াশীল, বলতে গেলে আজকের দুনিয়ার তাবৎ মানুষ বর্ণ-সঙ্কর বা রক্ত-সঙ্কর। বিচিত্র কারণে যুগ যুগ ধরে যাযাবর মানুষ স্থানান্তরে গেছে, নিঃশেষে মিশে গেছে স্থানীয় মানুষের মধ্যে, এবং ভাষার ঐক্যে গড়ে তুলেছে সংহত সমাজ। যেখানে ভাষা অভিন্ন হয়ে উঠেনি, সেখানে বিরোধ-বিদ্বেষ চিরন্তন হয়ে রয়েছে। প্রমাণস্বরূপ বলা চলে আমাদের দেশে বলখী, সমরখন্দী, বোখারী, খোরাসানী, সবজওয়ারী, সিরাজী, নিশাপুরী, মক্কী, মদনী, হেজাকী, ইয়ামিনী কিংবা সৈয়দ, কোরাইশী, ফারুকী, সিদ্দিকী, উসমানী, আলাভী, ফাতেমী প্রভৃতি দেশ-গোত্র জ্ঞাপক ও আভিজাত্য সূচক কুলবাচির আধিক্য সত্ত্বেও ভাষাগত ঐক্যের কারণে জাতি পরিচয়ে এগুলো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। এবং পাকিস্তানীর জন্যে এক সাধারণ ভাষা নির্মাণের আড়ালেও রয়েছে এই অভিপ্রায়।

    .

    ০৪.

    আদিকালের ধর্মপ্রবর্তক, শাসক এবং সাম্রাজ্যবাদীদের এ তত্ত্ব জানা ছিল, তাই তারা দীক্ষিত মানুষকে, বিজিত জাতিকে, শাসিত জনগোষ্ঠীকে স্বভাষা গ্রহণে বাধ্য, প্ররোচিত কিংবা অনুপ্রাণিত করত। এমনি প্রয়াস ও রেওয়াজ আজকের দিনেও দুর্লভ নয়। পাকিস্তানে উর্দুভাষা ও হরফ চালু করার পশ্চাতে ছিল এমনি অভিসন্ধি। আজ উপনিবেশিক প্রতিবেশ ও সাম্রাজ্যবাদ অবসিত। কাজেই প্রবলের এই প্রবণতাও আজ নিষ্ফল ও নিষ্ক্রিয়। বৈদিক, ল্যাটিন, ফরাসি, আরবি ও আধুনিক ইংরেজি ভাষা এমনি করেই স্বগোত্রের মানুষে ও অঞ্চল-বহির্ভুত ভু-খণ্ডে ভাষিক আধিপত্য বিস্তার করেছে।

    অবশ্য ধর্মপ্রবর্তকেরা, শাসক-সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেরাও দীক্ষিত ও বিজিত জনের ভাষা শিখতে পারতেন, কিন্তু তাতে তাদের উদ্দেশ্য সাধিত হত না। নিজেদের ভাষার মাধ্যমে নিজেদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ইতিহাস ও দর্শনের সঙ্গে শাসিতদের পরিচয় ঘটিয়ে শাসকদের প্রতি একপ্রকারের অনুরাগ ও আনুগত্য সৃষ্টি করা সম্ভব। এভাবে শাসকদের অন্তরঙ্গ পরিচয়-মুগ্ধ অনুরাগী ও অনুগত প্রজাগোষ্ঠী বিদেশী-বিজাতি শাসকের প্রতি সহিষ্ণু হয়ে উঠে। ইংরেজ আমলে আমাদের শিক্ষিতশ্রেণীর ইংরেজ এবং ইংরেজি সাহিত্য, দর্শন ও সংস্কৃতি-প্রীতি এ সূত্রে স্মর্তব্য। ভাষা ছাড়া অন্য কোনো কিছুর মাধ্যমে এই অনুরাগ ও সহিষ্ণুতা সৃষ্টি করা সম্ভব হত না। কেননা, কেবল বাহুবলে প্রভাব ও প্রতাপ চালু রাখা চলে না। কেননা, যেখানে মন জানাজানির উপায় নেই, সেখানে সমঝোতা ও প্রীতি অসম্ভব। অপরিচয়ই অপ্রীতি ও অসহিষ্ণুতার উৎস। এসব কারণেই সম্ভবত বা অন্যতম ব্রহ্মরূপে পরিকীর্তিত।

    .

    ০৫.

    আবার বাঙালির কথাই বলি। লেখ্য বাঙলার প্রভাবে বিভিন্ন অঞ্চলের লোক বাঙালি জাতিরূপে সংহত হল বটে, কিন্তু ভাষিক ও ধর্মীয় ঐক্য সত্ত্বেও আঞ্চলিক দূরত্বের দরুন আচারে-সংস্কারে, মনে-মননে, জীবন-ভাবনায় ও রীতি-নীতিতে পার্থক্য সুপ্রকট হয়ে বিদ্যমান ছিল। এই আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতার প্রভাব আঠারো শতক অবধি নির্বিঘ্ন ছিল। উনিশ শতকে যান্ত্রিক যানবাহন চালু হওয়ার ফলে এবং মুখ্যত মুদ্রণ-শিল্পের দ্রুত বিকাশের বদৌলতে পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে সংহতি ও সান্নিধ্যের সুযোগে, আর প্রতীচ্য বিদ্যা ও সংস্কৃতির প্রভাবে বাঙালির সেই আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র ও বৈশিষ্ট্য আজ লুপ্তপ্রায়।

    এভাবেই বাঙালি শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, সাহিত্যে, ইতিহাসে, দর্শনে, আচারে, আচরণে, ধ্যানে ও ধারণায় অভিন্ন হয়ে উঠেছে ও আজো উঠছে। মধ্যযুগের সাহিত্য- শিল্প এবং ঘরোয়া আচার-সংস্কার ও রীতি-নীতিই এর সাক্ষ্য। সাহিত্য ক্ষেত্রে আমরা দেখছি, ধর্মমঙ্গল কেবল উত্তর রাঢ়ের সম্পদ; তেমনি বৈষ্ণব সাহিত্যের বিকাশও কেবল পশ্চিমবঙ্গেই সীমিত, চণ্ডীমণ্ডপ ও চণ্ডীমঙ্গল রাঢ় অঞ্চলেই নিবন্ধ; তেমনি মনসা মঙ্গল ও লোকগীতিকা পূর্ববঙ্গেরই ঐশ্বর্য, বাউল-সহজিয়া মতের প্রভাব ও প্রসার-ক্ষেত্র হয়েছে উত্তর ও পশ্চিম বঙ্গ। প্রণয়োপাখ্যানের উদ্ভব হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে। খাদ্যবস্তুর রন্ধন প্রণালীর আঞ্চলিক রকমফের যেমন ছিল; দারু, কারু ও চারুশিল্পেরও তেমনি স্থানিক বিকাশই কেবল সম্ভব ছিল। শাস্ত্রনিরপেক্ষ আচার-সংস্কারের ক্ষেত্রেও ছিল স্থানিক পার্থক্য। আসবাব-তৈজসেও ছিল আঞ্চলিক রূপ। কাজেই কোনো কিছুই ভৌগোলিক বাধা অতিক্রম করে দেশময় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়তে পারেনি। গ্রামীণ জীবনে রীতিনীতির এ পার্থক্য আজো নিশ্চিহ্ন হয়নি। তবু অন্তত হাজার বছর ধরে লেখ্য ভাষার মাধ্যমে এ অঞ্চলের মানুষ এক অবিচ্ছেদ্য আত্মীয় সমাজ গড়ে তুলছে যার আধুনিক নাম বাঙলা দেশ ও বাঙালি। অতএব অভিন্ন ভাষাই জাতি-চেতনার অকৃত্রিম ভিত্তি ও জাতি-নির্মাণের মৌল উপাদান। আর সবকিছুই কৃত্রিম এবং তাই স্বল্পস্থায়ী। অর্থাৎ ভৌগোলিক ঐক্য, ধর্মীয় অভিন্নতা, মতবাদের একতা, রাষ্ট্রিক বন্ধন ও গোত্রিক পরিচয় কখনো অকৃত্রিম জাতি গড়ে তুলতে পারে না–অন্তত অতীতে কোনো দিন পারেনি।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleজীবনে-সমাজে-সাহিত্যে – আহমদ শরীফ
    Next Article সাহিত্য ও সংস্কৃতি চিন্তা – আহমদ শরীফ

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }