Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    স্বভূমি – নবনীতা দেবসেন

    নবনীতা দেবসেন এক পাতা গল্প104 Mins Read0

    স্বভূমি – ৫

    অকলঙ্ক মুখোপাধ্যায়

    ফ্রেড একেবারে ভেঙে পড়েছে। আমাকেই আয়ার্ল্যন্ডে যেতে হবে—বডি আইডেন্টিফিকেশনের জন্য—পিউমউকে মায়া টোরোন্টেতে পাঠিয়ে দিয়ে ঠিকই করেছে। লালীর কাছে, ফ্রেডের কাছে এখন সব সময়ে কারুর থাকাটা খুব দরকার। জয় স্ট্যানফোর্ডে না থাকলে ওকেই পাঠালে ভাল হত। ফ্রেড সত্যি সম্পূর্ণ নির্ভর করত স্ত্রীর ওপরে। আমার বাবাও আমার মায়ের ওপরে এত নির্ভরশীল নন, আমিও নই মায়ার ওপরে। ফ্রেডের এই অবস্থা আমি কল্পনা করতে পারিনি। বেশ তো শান্তশিষ্ট, চুপচাপ পাইপ টানে, আলোই যা দুরন্তপনা করে বেড়ায়। এই আঘাত সয়ে নেবার মতো শক্তি ফ্রেডের থাকবে না, কে ভেবেছিল। আমি কেবল লালীর জন্যে উদ্বিগ্ন হচ্ছিলাম। লালী তো বেশ শক্তই আছে। ফ্রেডকে সামলাচ্ছে। ওর বন্ধু ল্যারিও যথাসাধ্য সাহায্য করছে—কিন্তু ফ্রেড তো ল্যারিকে পছন্দ করে না—এখন ও না এলেই ভাল হয়। কিন্তু সে কথা বলবে কে লালীকে? লালী যে স্ট্রেংথটা পাচ্ছে সেটা তো ল্যারিই যোগাচ্ছে। ছেলেটা খারাপ নয়। ওকে লেখাপড়াটা নতুন করে শেখাতে শুরু করা উচিত। পই পই করে বলেছিলাম ওকে এ সপ্তাহে না—যেতে। সামনের সপ্তাহে তোর বক্তৃতা, এত আগে কেন যাবি? না, দিল্লিতে কিছু শপিং করে নেব। শপিং করার লোভেই এত বড় সর্বনাশটা হয়ে গেল আমাদের।

    আমি আছি, ও নেই, এটা কিছুতেই ভাবতে পারছি না। আমরা যমজ, একই সঙ্গে পৃথিবীতে এসেছি দু’জনে। অথচ যাবার সময়টা একজন কেমন একা একাই চলে গেল। কত আগেই চলে গেল। এখন আমাদের চুয়াল্লিশ। আরও বিশটা বছর তো হেসেখেলেই কাটিয়ে দেওয়া যেত—যদি না সেটা চল্লিশ বছর হয়। তাও অসম্ভব নয়। মৃত্যুর চল্লিশ বছর আগেই ও মারা গেল। পিউ—মউদেরও জীবনে এরকম মুহূর্ত আসবে। যখন একজন থাকবে একজন থাকবে না। অথচ এখন দু’জনে হরিহরাত্মা। ভাবতেই পারে না বিচ্ছেদের কথা। হাত ধরাধরি করে বড় হয়ে উঠছে।

    মিড এয়ারেই টুকরো টুকরো হয়ে গেছে প্লেনটা। অত ওপর থেকে বডিগুলো সমুদ্রে পড়েছে, পথেই শকে মারা গিয়েছে নিশ্চয়ই বেশিরভাগ মানুষ, যদিও না আঘাতে যায়। কাল এয়ারপোর্ট থেকেও টেলিফোন করেছিল। প্লেন ছাড়তে ভয়ানক দেরি করেছিল বলে বিরক্ত হয়ে টেলিফোন। ধৈর্য তো ছিল না স্বভাবে মোটে। অথচ, ধৈর্য একটা ক্ষেত্রে দেখলাম বটে রিসার্চ শেষ করার ব্যাপারে। পনেরো বছর বাদে ল্যাবে ফিরে গিয়ে কাজ শুরু করা, এ একটা অবিশ্বাস্য কাণ্ড। অবিশ্যি ফ্রেডের সহযোগিতা ছিল বটে, তবুও ওর মনের জোর অবিশ্বাস্য! শেষও করে এনেছিল কাজটা—আর শেষ হল না। আমি বুঝতে পারছি না বাবা—মা কীভাবে নিয়েছেন। খবরটা তো টি.ভি—তেই জেনে গেছেন নিশ্চয়। আমি কি ফোন করব? কালই আয়ার্ল্যান্ডে যাচ্ছি—ফোন তা হলে আজই করতে হয়।

    কোথায় শুরু হয়েছিল যাত্রা, ১২/১—এ মুক্তারামবাবুর গলিতে, আর কোথায় এসে আজ দাঁড়িয়েছে। কিছুটা বাবার স্বপ্ন, বাবার পরিকল্পনা, বাকিটা আমাদের দু’জনের চেষ্টা আর জেদ। ছোট্ট থেকেই বিলেত যাবার শখ, মস্ত বড় বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক হবার স্বপ্ন দেখতুম দু’ভাই—বোনে।

    সে সময়ে দিল্লি বম্বেও আমাদের পক্ষে প্রায় দুরতিক্রম্য দূরত্ব। এত আরামের জীবন, এত সুখস্বাচ্ছন্দ্যে মনের মতো করে বিজ্ঞানচর্চার সুযোগ, এভাবে ছেলে—মেয়েদের এডুকেশন দেবার শক্তি, বৃদ্ধ বয়সে বাবা—মা’কে একটু আর্থিক আরাম জোগানোর ক্ষমতা—এসবই যে ঈশ্বর আমাদের দু’ভাই—বোনকে দেবেন, তা বাবার সঙ্গে রোজ ভোরে হেদোয় সাঁতার কেটে এসে মা’র কাছে আদা—ছোলা চিরতার জল খাবার সময়ে কখনও কি ভেবেছিলুম? আলোর জেদেই, আলোর দুঃসাহসেই আমাদের আসা হয়েছিল। অনেক জায়গায় অ্যাপ্লাই করবার পর, দু’ জায়গায় দু’জনের স্কলারশিপ জুটে গিয়েছিল—কিন্তু প্যাসেজমানি ছিল না। তখন জাহাজে ইংল্যান্ড হয়ে আমেরিকা আসতে হত। বাবার পক্ষে দু’জন কেন, একজনকেও প্যাসেজমানি জোগানো সম্ভব ছিল না। কিন্তু আলোর বিয়ের জন্যে অল্প অল্প করে সোনার গয়না গড়িয়ে রেখেছিলেন মা—টাকাও জমানো ছিল পণের জন্য কিছু—আলো জেদ ধরল সে সমস্ত তুলে ফেলতে হবে—তাতে করে একজনের জাহাজে আমেরিকা যাবার খরচ উঠে যায়—আলো বলল—”ভাই চলে যাক।” বাবা বললেন কিন্তু টাকাটা আলোর জন্যেই জমানো—সেটাতে ওরই রাইট। তখন প্রচণ্ড জেদি আলো একট অবিশ্বাস্য কাণ্ড করে ফেললে। সাহাদের বাড়ির মেজো মেয়ে সুলেখা ওদের সঙ্গে পড়ত—তাকে গিয়ে বললে, ”সুদে তিন হাজার টাকা ধার দিবি? তিন বছর ধরে শোধ করে দেব—IOU কাগজ সই করে দিচ্ছি।”

    সুলেখার তখন সদ্য বিয়ে হয়েছে, হাতে টাকার অভাব নেই। তার বর বিনা সুদেই তিন হাজার টাকা ধার দিল। কিন্তু IOU কাগজ লিখিয়ে। আলো নিজে সই করে টাকা ধার নিয়ে এল বাবা—মাকে কিছু না বলে।

    তারপর আমরা দুই ভাই—বোনে বাবাকে গিয়ে প্রাণপণে বোঝালুম স্কলারশিপের টাকা জমিয়ে ওটা শুধে দেওয়া শক্ত হবে না। দু’জনে মিলে চেষ্টা করলে পুরো তিন বছরও লাগবে না—এজন্যে বাবা যেন রাগ না করেন। বাবা হাওলাত দিতেনও না, হাওলাত নিতেনও না। এটা বাবার প্রিন্সিপল ছিল। ধার—কর্জ করব না, ধার—কর্জ দেব না। এটা নাকি গরিবের আত্মরক্ষার একমাত্র পন্থা! বাবা কিছু আর বললেন না। আমরা বম্বে রওনা হলুম। সেই মেয়ে যে বিদেশে এসেই ক’মাসের মধ্যে দুম করে বিয়ে করে বসবে, তা আমরা কেউ ভাবতে পারিনি।

    হঠাৎ কী যে দেখল ফ্রেডের মধ্যে! ছেলেটা অবশ্য খুবই ভালো। টাকাটা শোধ আমিই করেছিলাম, দু’বছর পরেই। কিন্তু আলোর দুঃসাহস না থাকলে সেই বছর আমাদের বিদেশে আসা হত না। দুমদাম রিস্ক নেবার মতো মনের জোর ওর সর্বদাই ছিল। এই তো ধরা যাক আমার ছেলে জয়ের কথা। হার্টে একটা ফুটো নিয়েই জন্মেছিল ও—আট বছর বয়সে অপারেশন করার কথা। কিন্তু আট বছর যখন হল জয়ের—মায়া সাহস করছিল না। ডাক্তাররা ভরসা দিলেও, মায়া কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। আলোই জোর জবরদস্তি ওকে রাজি করাল। —”সারা জীবন খুঁতে হয়ে বাঁচবে কী করে একটা ছেলে? তার চেয়ে এইবেলা করে নে অপারেশন, ঠিক হয়ে যাবে। অন্তত ক্ষতি তো হবে না কিছু অতিরিক্ত? এমনিতেই তো হার্টে ফুটো!” সেই জয় এখন সুস্থ স্বাভাবিক ছেলে। এঞ্জিনিয়ারিং পড়ার স্ট্রেন সহ্য করছে। অন্যের ছেলের বেলাতেও যে রিস্ক নিতে অতটা জোর করেছিল—তার কারণ জয়কে আলো নিজের সন্তানের মতোই দেখে। দেখত। আলোর ভালবাসার চেহারা অনেক সময়ে জোর জুলুমের চেহারা নিয়ে নেয়। মায়া ঠিক বিপরীত। কঠিন, কিন্তু ঠান্ডা, শান্ত। কখনও কাউকে কিছু নিয়েই জোর জুলুম করে না।

    মায়া আলোর চেয়ে একেবারে অন্যরকমের বলেই হয়তো ওর প্রেমে পড়েছিলাম। আমার বাবা—মা যে কখনও শিডিউলড কাস্টের মেয়েকে বউ হিসেবে মেনে নেবেন কে ভাবতে পেরেছিল? অবশ্য ওঁরা যে টাইম স্কোয়্যারে হেঁটে বেড়াবেন, এও কি ১২/১এ মুক্তারামবাবুর গলিতে কেউ কখনও ভাবতে পেরেছিল? কিন্তু অসম্ভবও সম্ভব হয়েছে। একবার নয় বার বার। আর এই যে আজ আলো নেই? আলো নেই আর আমি রয়েছি। বসে বসে ভাবছি আলো নেই। এটাও তো অসম্ভবই সম্ভব হওয়া।

    জাহাজে করে বম্বে থেকে যখন দু’ভাই—বোনে রওনা হলুম প্রথম সি—সিকনেস হয়েছিল। মনে হচ্ছিল মরেই যাচ্ছি বুঝি আর বেঁচে উঠব না। আর মাকে দেখতে পাব না। তারপর জাহাজ আরব সাগর ছেড়ে যেই লোহিত সাগরে পৌঁছে গেল, সমুদ্র শান্ত হয়ে গেল। আমরাও ক্রমে জাহাজের খোল ছেড়ে উপরতলার ডেক—এ বেরিয়ে এলুম। ওঃ সে কী আশ্চর্য অপূর্ব দৃশ্য। দশ দিক ঘিরে চরাচর বিস্তীর্ণ কালো জলরাশি।

    লোহিত সাগরে তখন রাত্রি—চিকচিক করছে ফসফরাস—একটা ম্লান চাঁদ প্রবল মায়াময় এক রাশ জোৎস্না ঢেলে দিয়েছে কালি গোলা জলের ওপরে—সে জ্যোৎস্না যেন তেলের মতো ভাসছে। দেশে কখনও পুরীতেও যাইনি। বম্মেতেই প্রথম সমুদ্র—দর্শন। হঠাৎ টের পেলুম পৃথিবীটা কত বড়, কত সীমাহীন, কত বিস্তীর্ণ—আর এই জাহাজটা কত তুচ্ছ, কত একা।

    আলো আর আমি রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিলুম। আলো বললে, ”ভাই, সাবধানে দাঁড়াস—পড়ে গেলেই হাঙরে খেয়ে ফেলবে, হেদোর সাঁতার এখানে কাজে লাগবে না কিন্তু”—আলো আমাকে ”ভাই” বলেই ডাকত। আমি কিন্তু ওকে আলো ছাড়া কিছু বলিনি।

    যখন আকাশ থেকে টুকরো টুকরো হয়ে প্লেনের অংশগুলো ঝরে পড়ছিল মধ্য আটলান্টিকের নিস্তরঙ্গ নোনাজলে, আলোর শরীর, আলোর সহযাত্রীদের শরীর নিয়ে—তখনও ওর মনে হয়েছিল—”ভাই, আমাদের হেদোর সাঁতার কোনও কাজেই লাগবে না?” তখনও কি ও বেঁচে ছিল? জলে পড়া পর্যন্ত বাঁচা সম্ভব নয়—শকেই মারা যাবে যে কোনও মানুষ। লোকে দশতলা বাড়ি থেকে নীচে অবধি পড়ার আগেই হার্টফেল করে।

    জীবনে প্রথম সমুদ্রযাত্রা আমাদের একসঙ্গে, জীবনে প্রথমবার আটলান্টিক আমরা একসঙ্গেই দেখি। আটলান্টিক পার হয়েছিলুম আমরা ‘সেভেনসিজ’ নামে একটা জাহাজে। জাহাজটা এসেছিল মন্ট্রিয়লে। আমার পড়াশুনো তো ইস্ট কোস্টেই। আলোরই ওয়েস্টে। ওকে ক্রসকান্ট্রি যেতে হয়েছিল গ্রেহাইন্ড বাসে চড়ে। আটলান্টিক পার হওয়ার সময়েও প্রথম দু’দিন বেশ শরীর খারাপ ছিল আমার। আলো কিন্তু চাঙ্গা ছিল দিব্যি। রোজ রোজ দারুণ আইসক্রিম খেত বেলা এগারোটার সময়ে। শেষ চারদিন দু’জনে খুব মজা করেছি। আমাদের ছেলেমেয়েদের এই যাত্রী—জাহাজে চড়ার অভিজ্ঞতাটা আর হল না। বাবা—মায়েরও না। জাহাজ এখন অবসোলিট হয়ে গেছে—এখন লাক্সারি ক্রুজারে চড়ে বেড়াতে বেরোয় শুধু ধনী লোকেরা। সাধারণ লোকে যাতায়াতের জন্যে আর জাহাজ ব্যবহার করে না। অত সময় কারুর হাত নেই, তা ছাড়া খরচও জাহাজে বেশি। আলো দেশ ছেড়ে ছিল সমুদ্রযাত্রায়—দেশে ফেরাও শেষপর্যন্ত তার পক্ষে সমুদ্রযাত্রাই হল।

    অ্যাটলান্টিক পার হবার সময়ে কখনও কি ভেবেছিলুম এই মহাসাগরই আমার আলোকে গিলে খাবে? কেপ কড—এ মার্থাজ ভিনইয়ার্ডে যখন বেড়াতে গেছি, অ্যাটলান্টিকের জলে নেমে কত খেলাধুলো করেছি, কখনও মনে হয়নি এরই রাক্ষুসে জলে আলোর নশ্বর শরীর মিলিয়ে যাবে। আকাশ আর সমুদ্র এই দুই সীমাহীনতার মধ্যে হারিয়ে গেল এক ফোঁটা মাটি—আলো। কালের সীমানা কত সহজেই পার হয়ে গেল, কাউকে কিছু প্রস্তুতির সুযোগ না দিয়ে। নিজেও সম্ভবত অপ্রস্তুত ছিল। আলো বাবার শিক্ষা মতো সব সময়ে পজিটিভ থিংকিংয়ের চেষ্টা করত। যদিও ও ফ্রেডকে ‘আর তিন বছর’ ‘আর দু’ বছর’ করে খ্যাপাত কেবল নিজের আয়ু নিয়ে, আমি জানি আলো নিজে ওসব বিশ্বাস করত না। বিশ্বাস করলে এত বয়সে ও আর নতুন করে রিসার্চ শুরু করত না।

    সামনের বছর টোকিওতে যে কনফারেন্স হচ্ছে, সেখানেও পেপার অ্যাকসেপ্টেড হয়ে গেছে ওর। সোজা কথা? সামনের বছরেই ওর ইচ্ছা ছিল পোস্ট ডকটর‍্যাল কাজ শুরু করবার। যে ‘মরছি’ বলে বিশ্বাস করে সে অত দূর প্রসারিত ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করে না নিজের কাজকর্ম নিয়ে। ও হরস্কোপের কথাটা মুখেই বলত। বিশ্বাস করত না। ওর গভীর বিশ্বাস ছিল ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যে। আজ যদি ওর বদলে আমার দুর্ঘটনাটা ঘটত,ও ঠিক মেনে নিত, ‘ভগবানের ইচ্ছে’ বলে। কিন্তু আমি সেটা পারছি কই? বাবা? বাবা কী করবেন? বাবার যদি ফ্রেডের মতো নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়ে যায় এত বয়েসে—বাবার তো মা’র মতো ঠাকুর দেবতার আশ্রয় নেই।

    জ্যাঠামশায়ের সঙ্গে মামলা হেরেও বাবা ভেঙে পড়েছিলেন বেশ—মা কিন্তু অতটা ভাঙেনি। অবিশ্যি এ তো মামলার হার—জিতের প্রশ্ন নয়। ইগোর প্রশ্ন নয়—এটা জীবন মৃত্যুর প্রশ্ন। সন্তান হারানোর মহাশোক মানিয়ে নেবার মতো শক্তি আমার মা—বাবার আছে তো?

    মায়া তো বলছে কলকাতাতে চলে যেতে। মায়া বলছে বাবা—মা’র বিয়ের তারিখে না গিয়ে এখনই সেই ছুটিটা নিয়ে নিতে। এখনই বাবা—মা’র কাছে সবাই গিয়ে পড়লে ওঁরা সান্ত্বনা পাবেন কিছুটা। জয় না যাক, নাতনিদের কাছে পেয়ে ভুলে থাকবেন খানিকটা। ফ্রেডেরও একটা চেঞ্জ হত। ওর সামার ক্লাসগুলো চলছে—সেই ঝামেলার জন্যে ফ্রেডের পক্ষে সামনের মাসের আগে যাওয়া সম্ভব নয়। আরেকটা সম্ভাবনা হল আমি যদি গিয়ে মা—বাবাকে নিয়ে চলে আসি। কিন্তু আসবেন কি? বাবা—মা’র কি ভালো লাগবে আমেরিকায় আসতে? আমি বুঝতে পারছি না। বাবা—মা’কে ফোনটা অন্তত করাই উচিত। ফোনে আমি লালীকে বললুম, লালী, দিদা—দাদুকে ফোন করবি নাকি একটা? লালী বলল—”হোয়াট ফর?” আমিও ওর তার কোনও সদুত্তর খুঁজে পেলুম না।

    —”হোয়াট ফর?” কিন্তু বাবা—মা’কে তো আমার অন্তত বুঝতে দেওয়া দরকার যে একজন চলে গেলেও দু’জনেই চলে যাইনি। আরেকজন আছি। এখনও বাবা—মা’র এখানে স্নেহের শিকড় বজায় আছে, এখনও এখানে পাকা ভিতই আছে তাঁদের শোকতপ্ত শেষ জীবনের। সহায়হীন হননি, আশ্রয়হীন হননি তাঁরা—যদিও ওই বেশি করত, কেন না ওর হাতে সময় ছিল বেশি, ও পারেও বেশি করতে। আমি অতটা পারি না, মায়াও একটু আনডেমনস্ট্রেটিভ—কিন্তু মায়ার মধ্যে অর্থ নিয়ে নীচতা নেই, দায়িত্ববোধের অভাব নেই।

    আর ফ্রেডকে কী বলব? বেচারি ফ্রেড। নিজের ভাইবোন আত্মীয়স্বজন সবাইকে ছেড়ে সে আমাদেরই একজন হয়ে উঠেছে—যার জন্যে সেই আপনজন হওয়া, সেই আজ হঠাৎ চলে গেল। এখন ফ্রেড কী করবে? ফ্রেডের মা আছেন, আর লালী আছে। আমার তো মনে হয় লালী ফ্রেডেরও যতখানি, আমারও ঠিক ততখানি। লালীর মা চলে গেলেও মামা—মামি রইল। পিউ—মউয়ের থেকে আলাদা করে তো কোনওদিন দেখিনি লালীকে। আর পিউ—মউ তো পিসিরই আদরে আদরে বাঁদর হয়েছে। সত্যি ভালবাসার ক্ষমতাটা ছিল বটে আলোর।

    নিউজবয়, মিল্কম্যান, মাংসওয়ালা, রুটিওয়ালা, সব্বার সঙ্গে গলায় গলায়। সেই গুণটা লালী পায়নি, কিন্তু এদিকে জয় পেয়েছে। জয় ঠিক এইরকম মিশুক। সবার সঙ্গে চটপট ভাব করে ফ্যালে। আমিও পারি না, মায়াও পারে না।

    আলোটা চলে গিয়ে মউ—পিউ জয়কেও মূলহারা করে গেল। লালীর ক্ষতি যা হল তা তো হলই কিন্তু আমি যেটা রক্তের ভেতরে টের পাচ্ছি সেটা অন্য এক স্বার্থ। আলো ওদের সকলকেই একটা অন্যস্বাদের জীবনের ঠিকানা জানাতে চাইত। জয়কে তো নিজের ছেলেই বানিয়ে ফেলেছিল আলো। লালীর মতো জয়ও তাই ভারতকে অস্বীকার করতে চায়। আলোরই জেদের উলটো ফল এই বিদ্রোহ। ও যে কেবলই চেঁচাবে—”স্বভূমির দখল নেবার জন্যেই তো অত কাণ্ড! এদিকে তোরা অ্যান্টিফোলিনিয়ালিজম নিয়ে এত কথা বলবি ওদিকে দ্যাখ আসাম বঙ্গালখেদা করলে বাঙালি রেগে কাঁই! কেন করবে না ওরা? কালচারাল কলোনিয়াজিম কোনওরকমেই কম হার্মফুল?” জয়রা হাসে। ওরা আসামও জানে না, বঙ্গালখেদাও জানে না। তখন আলো ফের চেঁচাবে—”কেন, ইন্ডিয়ান খেদায়নি আফ্রিকা? এখন এত যে তোমাদের আফ্রিকা—প্রেম জেগেছে, আফ্রিকা কি স্বাধীন হয়ে ভারতীয়দের প্রেম করেছে? কিনিয়া থেকে ইউগান্ডা থেকে দলে দলে ভারতীয় বিজনেসম্যানরা সপরিবার উৎখাত হয়ে ব্রিটিশ পাসপোর্ট হাতে লন্ডনে ছুটেছে, শেষে সাদারাও তাদের ঢুকতে দেয়নি। অবাঞ্ছিত সেখানেও। যদিও তারা ব্রিটিশ প্রজা! শেষ অবধি সেই ইন্ডিয়ায়। এরকম কি এখানেও ঘটতে পারে না?” আলো কেবলই বলত—”জয়, তুই তোর বাবাকে দেশে নিয়ে যা। এখানে বসবাস করা কেবল ক্রিচার কমফর্টের জন্যে—এখানে বেশিদিন থাকলে তোদের নিজস্বতা কিছু থাকবে না। তোরা সোললেস হয়ে যাবি এবং হোমলেস। শ্রীলঙ্কার দিকে একবার তাকা, দ্যাখ তামিলগুলোর কী দুরবস্থা—ইউরোপও ওদের খেদাচ্ছে।” আলোর প্রাণটা পড়ে থাকত দেশেই! কলকাতায় এই যে ফ্ল্যাট কিনে রাখার আইডিয়া এও তো ওরই। আমি যখন বাবা—মা’র জন্যে ফ্ল্যাট কিনতে চেয়েছিলুম, আলো বললে—”নিজেরও কাজে লেগে যাবে রে ভাই—বুড়োবয়েসে তো ওইখানেই যেতে হবে, এ দেশ জোয়ানবয়িসিদের দেশ—বুড়ো থুত্থুড়ো হয়ে কি একা ফ্ল্যাটে মরে পচে পড়ে থাকতে চাস? ফ্রেড রিটায়ার করলেই তো আমি ফ্রেডকে সুদ্ধু বগলদাবা করে সোজা নিয়ে গিয়ে ফেলব সল্টলেকে—” ওঃ হো, চব্বিশ ঘণ্টা তো কেটে গেল। এখনও বাবা—মাকে টেলিফোন করলুম না। এখন বাবাই যদি ফোন করে বসেন? কাল আয়ার্ল্যান্ডে যাবার আগে অন্তত ওঁদের খবরটা নিয়ে যাওয়া দরকার। মায়া বলছে বাবার যদি স্ট্রোকটোক কিছু হয়ে যায় এই প্রচণ্ড দুঃসংবাদে, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই—এমনিতেই হাইপারটেনশনের রুগি। ফোনটা করেই ফেলা দরকার।

    ছোটবেলার দিনগুলো ছবির মতো চোখের ওপরে ভেসে উঠছে, পরতে পরতে বিস্মৃতির পরদা সরে যাচ্ছে, আর যন্ত্রণা ছোরার মতো বিঁধে যাচ্ছে বুকের মধ্যে। একটা অদ্ভুত কষ্ট। একলা হয়ে যাবার কষ্ট। জন্ম থেকেই মায়ের পেট থেকে আমরা ছিলুম দু’জন। কোনওদিন ভাবিনি একজন থাকব। কোনওদিন ভাবিনি এইভাবে ওকে আমি হারাব।

    মায়া বলছে সেই হরস্কোপে বলেছিল ওর পঁয়তাল্লিশ পরমায়ু। চুয়াল্লিশ তো কমপ্লিট! ওরেঃ শালা—এইভাবে জীবনে হরস্কোপ মিলে গেলে তো আর ফ্রিডমেরই স্কোপ থাকে না কর্মে বা চিন্তায়। মানুষ কুসংস্কারের দাস হয়ে পড়বে তো এরকম দু’চারটে কাকতালীয় ফললেই। আশ্চর্য ব্যাপার, কিন্তু খুব ডেনজারাস। মানুষের আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায়। ওই হরস্কোপে আমার পরমায়ু আরও চুয়াল্লিশ বছর। অর্থাৎ যত রাস্তা এসেছি, অত রাস্তাই বাকি। অথচ আলোটা—জীবনসঙ্গী, জীবনসঙ্গিনী এসব অনেক কথা শোনা যায়। মায়াই শাস্ত্রমতে আমার জীবনসঙ্গিনী। কিন্তু জৈব নিয়মে আমার জীবনের সঙ্গে যে সঙ্গিনীটিকে বেঁধে দিয়েছিলেন জীবনস্রষ্টা, আজ থেকে সে আমার জীবনের মঞ্চ থেকে সরে গেল। আর ফিরবে না। অথচ ছেলেবেলায় অনেকবার এটাই চেয়েছি। ও যখন আমার ওপরে অত্যাচার করত তখন চেয়েছি, যখন আমাকে খ্যাপাত তখন চেয়েছি, ওকে জন্মের মতো অন্য কোথাও সরিয়ে নিয়ে যাও না কেন ভগবান, যেন কখনও আমার সামনে না আসে। অথচ বড় হয়ে আস্তে আস্তে ওই হয়ে দাঁড়াল আমার ঘনিষ্ঠতম শুভার্থী, বন্ধু। মায়াকে বিয়ে করা নিয়ে মা জাতপাতের প্রশ্ন তুলে কি কম জল ঘোলা করেছিলেন? ও ছাড়া কে তখন সামলাত মাকে? ‘গরিবের মেয়ে’ ‘মুখ্যুর মেয়ে’ ‘ছোটো জাতের মেয়ে’ কী না বলেছেন মা তখন? বাবাতে আর আলোতে মিলেই বকে বুঝিয়ে মাকে ভদ্রস্থ করেছে। রাজি করিয়েছে—বিয়ের পরে ওইসব শব্দ মা যাতে একদিনও উচ্চারণ না করেন সেটা অতি সাবধানে দেখেছে। বাবা কি সাধে আলোকে অত ভালবাসেন। আমি বড় বৈজ্ঞানিক হয়েছি। বাবার স্বপ্ন—সাধ পূর্ণ করেছি, কিন্তু আমার ব্যক্তিত্বটা বাবার মনের মতো হয়নি। আলোর ব্যক্তিত্বটাই বাবার আদর্শ অনুযায়ী ফুটে উঠেছে। জীবনের ঠিক কেন্দ্রে, ঠিক মাঝ রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছি এখন আমরা, চাকরির উন্নতির পথ খুলে গেছে, আন্তর্জাতিক খ্যাতি—পরিচিতি হচ্ছে—স্বামী—স্ত্রীতে আর মান—অভিমান ভুল—বোঝাবুঝির পালা তেমন নেই—ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে—প্রায় নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মতোই হয়ে গেছে—এবং মেয়েরা বিয়ের পাত্র দেখতে শুরু করেছে নিজেদের জন্যে—ও তো আবার নতুন করে নিজস্ব কর্মজীবন, চিন্তার জীবন গড়ে তুলতে শুরু করেছিল, আট—দশ ঘণ্টা ল্যাবেই কাটাচ্ছিল—এখন দ্বৈত জীবন গড়ার টেনশনটা কমে গেছে, অথচ ক্লান্তি আসেনি কাজে—এই তো জীবন উপভোগের সময়, অথচ ঠিক এই সময়েই—! অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে আলো এতকাল, সেই শ্রমলব্ধ ফল ভোগ করার দিন সবে আসছে, এখন—ঠিক এই সময়েই—জানি না ওর ঠাকুরঘরের ঠাকুরেরা কীভাবে এর পরেও বিশ্বাস ধরে রাখে জানি না। আয়ার্ল্যান্ডে যেতে আমার একটুও ইচ্ছে নেই অথচ এয়ার লাইন্স তাড়া দিচ্ছে— ফ্রেড তো যাবেই না—ইনস্যুরেন্সটেন্স অনেক কিছুই ঝামেলা আছে। সবই তো পোয়াতে হবে আমাদের—শোকস্তব্ধ হয়ে শুয়ে থাকলেই তো হবে না—ফ্রেডের সত্যিই একটা নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়েছে—এবং লালীর পক্ষে সেটা খুব ক্ষতিকর অভিজ্ঞতা। মায়াও যেতে পারলে ভাল হত পিউ—মউয়ের সঙ্গে। আলো নেই আলো ফিরবে না আলোর সঙ্গে আর কোনওদিন দেখা হবে না, আলো আর রাত দেড়টার সময় ফোন করে বলবে না—কীরে, সন্ধেবেলাই ঘুমিয়ে পড়লি?” ভাইফোঁটা দেওয়া নিয়ে বিশ—পঁচিশ বছর ধরে আমেরিকার এ প্রান্ত ও প্রান্তে ছুটোছুটি করবে না।

    আশ্চর্য—কী সিকিয়োরিটি চেক হল অত ঘণ্টা ধরে, তা হলে যদি বোমাই চলে গেল প্লেনের ককপিটে? কথায় বলে কপালে মরণ লেখা থাকলে লোহার তৈরি বাসর ঘরেও কালনাগিনী প্রবেশ করে।

    মায়া আলোকে পছন্দ করত কিনা কোনওদিনই ঠিক টের পাইনি, এখনও টের পেলুম না। ও এতই চাপা মেয়ে, কিছুই মনের ভাব বুঝতে দেয় না। এত বড় দুর্ঘটনায় ওকে বিশেষ বিচলিত তো দেখলুম না। অবশ্য ভিতরে বিচলিত হলেও ওর বাইরে থেকে তা দেখা যাবে না। মায়া খুব ব্রিলিয়ান্ট, মায়া আর আমি একই স্কলারশিপে এসেছি, একই চাকরিও করছি এখন দু’জনে, আমাদের পারিবারিক পশ্চাৎপট যদিও একেবারেই আলাদা।

    মায়া গ্রামের মেয়ে, সত্যি সত্যিই ওরা অশিক্ষিত পরিবার, শিডিউলড কাস্ট স্কলারশিপে মায়া দেশে পড়াশুনো করেছে, বাড়িতে মায়াই প্রথম গ্র্যাজুয়েট—ওর ভাইরা কেউই পড়াশুনো করল না—গেঁয়োই থেকে গেল—স্বাভাবিকভাবেই আমার পক্ষে শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে তেমন সম্পর্করক্ষা করা সম্ভব হয়নি অর্থ সাহায্য করা ছাড়া। জানি না এ নিয়ে মায়ার মনে কোনও অভিমান আছে কিনা। আলোর সঙ্গে তুলনা করলে অভিমান তো হতেই পারে। আলোর বাবা—মা নিয়মিত বিদেশে এসে থাকছে। মায়ার বাবা নেই। মা এতই গ্রাম্য, তাঁর আসাটা সম্ভব নয়। মায়া একেবারেই যোগাযোগ রাখেনি নিজের ভাইদের সঙ্গে। মাঝে মাঝে মায়ের নামে টাকা পাঠিয়ে দেয়। বছরে দু’একবার চিঠি আসে। তাই জানি যে ওর মা বেঁচে আছেন। মায়া বহু সন্তানের একজন, খুব একটা ঘনিষ্ঠতা ছিল না মায়ের সঙ্গে। মা যথাসাধ্য বাধা দিয়েছিলেন ওর পড়াশোনায়। এদেশে চলে আসার পর মায়া সম্পর্ক মুছে ফেলেছে বাপের বাড়ির সঙ্গে। বাচ্চাদেরও যেতে দেয় না গ্রামের বাড়িতে। তবুও মায়ার মনে অভিমান থাকা তো অস্বাভাবিক নয়। আলো খুবই মায়াকে স্নেহ করে। মায়ার সাহস, তার প্রচেষ্টা, তার পারিবারিক বিঘ্ন অতিক্রম করে অন্ধকার পশ্চাৎপটকে অগ্রাহ্য করে একা উঠে দাঁড়ানোর শক্তি—আলো এগুলোকে শ্রদ্ধা করে, মায়াকে খুব সম্মান করে ও, আর জয়—পিউ—মউ তো লালীর চেয়ে বেশি বই কম আদর পায় না ওদের পিসির কাছে—তবু আমি টের পাই মায়া আলোকে সম্পূর্ণ হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেনি—মায়াকে যা যুদ্ধ করে পেতে হয়েছে, আলো যে সেই জীবনই বিনা যুদ্ধে পেয়েছে। বাবাই যত্ন করে আলোকে উচ্চশিক্ষা দিয়েছেন, মায়া শুধু বাধাই পেয়েছে। সেও একটা ব্যাপার, আরও বড় একটা ব্যাপার, যে আলো আমার যমজ। আমার সঙ্গে জন্মমুহূর্ত শেয়ার করে সে। আমাকে মায়ার চেয়েও কেউ বেশি বোঝে, এটাই বোধহয় সহ্য করতে পারে না মায়া—আমাদের এত বড় দুঃসংবাদেও ওকে এতটা অবিচল দেখেও আমার বুকের ভেতরে কেমন একটা অজানা ভয় সুড়সুড়ি দিতে শুরু করেছে—মায়াকে আমি কতটুকু জানি? মায়া কি তবে আমাকেও ভালবাসে না? আমার এত বড় শোক তাকে স্পর্শ মাত্র করল না? আশ্চর্য! অথচ, কর্তব্যে অবহেলা নেই! পিউ—মউকে ওই লালীর কাছে পাঠিয়েছে, আমাকে আয়ার্ল্যান্ডে পাঠাচ্ছে, বাবা—মা’র কাছে সবাই মিলে এখনই চলে যাবার প্রস্তাবও মায়ারই। সবগুলোই সহৃদয় সিদ্ধান্ত, সহৃদয় পরামর্শ, কোনও ত্রুটি নেই—অথচ আমার কেমন একটা বিশ্রী দাঁত বের করা ভয় করছে এ দুঃসংবাদে মায়া খানিকটা রিলিভড হয়েছে—যদি ‘সুখী’ নাও হয়ে তাকে—’দুঃখিত’ হয়নি। এত সহজ থাকে কী করে মানুষ?

    শোনার পর খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ল। অ্যাকচুয়ালি ঘুমোল। আমি অস্থির জাগ্রত, সকালে উঠে টিকিট কিনে মেয়েদের টোরোন্টো পাঠিয়ে, নিজে দ্যাখো ঠিক অফিসে চলে গেছে। এতদিন মায়ার সঙ্গে ঘর করছি তো, বিশ বছর হল, তবুও মানুষটাকে চিনতে পারছি না—ঠিক সবটা ভিতর পর্যন্ত দেখায় না ওর—কাদামাটিভরা পুকুরের মতো অস্বচ্ছ—দু’হাত পর্যন্ত দেখা যায়, তারপর সব ঘোলাটে, কত গভীর কিছুই টের পাওয়া যায় না, জলের নীচে কী আছে, ভিতরে যে কী আছে, তলিয়ে যাবার আগে টেরই পাবে না কেউ। আলো আর ফিরে আসবে না, জীবনে কখনও না, এ সংবাদে মায়া যেন একটু নির্ভার বোধ করছে—অথচ ও তো আমার আপন বোন, প্রেমিকা নয়, বান্ধবী নয়, ঈর্ষার সম্পর্কই নয়—আশ্চর্য! আলো কি এটা টের পেত? বোধহয় না—কী জানি, যা বুদ্ধিমতী ও, টের পেলেও আমাকে বলবার পাত্রী নয়—আমাদের মধ্যে যাতে বিন্দুমাত্র টেনশন না হয় সেটাই ও দেখত—আজ থেকে আমার একটা নতুন জন্ম—একলা কালো। ‘আলোকালের কালো’ নয় শুধুই অকলঙ্ক মুখার্জি।

    মানুষ একা জন্মায়। আমিই সঙ্গী নিয়ে জন্মেছিলুম। আজ আমার আরেক জন্মের মুহূর্ত। নিঃসঙ্গজন্ম। আলোর মধ্যে বাঁধা পড়েছিল আমার শৈশব, কৈশোর। আলোর সব মনে থাকত। স্মৃতিকে খুব যত্নে লালন করত ও। কথায় কথায় মনে পড়িয়ে দিত—”তোর মনে আছে কালো? সেই যে”—আর অমনি আমারও মনে পড়ে যেত। আমি নিজে থেকে অতশত মনে রাখতে পারি না। এখন থেকে আস্তে আস্তে হারিয়ে যাবে, বিস্মৃতির মধ্যে চলে যাবে আমার শৈশব, কৈশোর—এখন থেকে আমার সঙ্গী কেবল মায়া। কিংবা, কী জানি? এই হয়তো শুরু হল আমার স্মৃতি উদ্ধারের দিনগুলো? হয়তো এখন থেকে আমিই অলোর মতো যত্নে মনে রাখব সব খুঁটিনাটি—কখন পাশের বাড়ির দেয়ালে হলদে রঙের আলোটা লালচে গোলাপি রঙের হয়ে যেত, অমনি সূর্য ডুবছে বুঝতে পেরে আমরা ছুটতাম লালবাড়ির জোড়া নারকেল গাছের ফাঁকে সূয্যি ডোবা দেখব বলে—আলোর এইরকম যত ছোট্ট ছোট্ট জিনিস মনে থাকত—বিছানায় শুয়ে শুয়ে একতলার ঘরে রাত্তিরবেলায় অন্ধকার ঘরের দেয়ালে আলো আমাকে সিনেমা দেখাত। সিনেমা মানে, রাস্তা দিয়ে যেসব গাড়ি যেত, তাদের হেডলাইটের আলো আমাদের জানলার রডের আর ঘুলঘুলির কারুকার্যের ফাঁক দিয়ে দেয়ালে এসে পড়ে নানারকম ক্যালাইডোস্কোপিক ডিজাইন তৈরি করত—আমরা মুগ্ধ হয়ে দুই ভাই—বোনে সেই ছবি, সেই চলচ্চিত্র দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়তুম। প্লেনটা যখন ফেটে গেল, তখন ঠিক কী ভাবছিল ও? কী করছিল ও তখন? ও কি ওর পেপারটার কথা ভাবছিল? না ছেলেবেলার কথা? না বাবা—মা’র বিয়ের পঞ্চাশ বছর পূর্তির আয়োজন? নাকি লালী আর ল্যারিকে নিয়ে মাথা গরম করছিল? কেউ জানতে পারবে না—কেউ কোনওদিন জানতে পারবে না ওর মনে তখন কী হচ্ছিল। যখন বিস্ফোরণটা ঘটল তখন কি ওর ঠাকুরঘরের চেহারাটা ওর মনে ভেসে উঠেছিল? ও তখন কী প্রার্থনা করেছিল ওর ভগবানের কাছে? বাচ্চা বয়েস থেকে ওর সঙ্গে আমার এখানেই তফাত। ও যেত মা’র সঙ্গে পুজো করতে, আমি বাবার দলে। বাবা অনীশ্বরবাদী নন, কিন্তু পুজোফুজো ফুল চন্দনেও বাবার উৎসাহ নেই। বাবা কী করছেন এখন? মা? মা গো! আমার মা! আলো চলে গেছে মা। এত শখের তোমার সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসবটা আর করতে পারল না ও। কিন্তু বাবা, আমি তো আছি, আমি চলে যাইনি। আমরা আছি। ফ্রেড, মায়া, লালী, জয় পিউ মউ সবাই আছি। তোমার কালো একা নয়। সবাই আছি আমরা তোমাদের সঙ্গে। আমাদের সবার বুক শূন্য করে আলো চলে গেছে, বাবা।

    —কে? ওখানে কে? মায়া ফিরে এল বোধহয়। এই যে। এসো মায়া। টেলিফোন? না তো? ফ্রেডকে আর ফোন করিনি। না—বাবা—মা—ও ফোন করেননি। হ্যাঁ, জয় ফোন করেছিল। বেচারা খুব ডিস্টার্বড। বাবাকে? ফোন করে কী হবে? কী বলব? আমার ওঁদের সঙ্গে কথা বলবার সাহস হচ্ছে না মায়া। করলে তুমিই করো। তোমার যদি ইচ্ছে করে, যদি মন অস্থির করে। ফোন করেই বা কী হবে? ওদের যা গেছে তা তো আমি ফিরিয়ে দিতে পারব না। সান্ত্বনাও দেবার কিছু নেই। ফোনে বাবাকে আমি কী বলব? বাবাকে কিছু বলবার মুখ নেই—দু’জনে একসঙ্গে বিদেশে এসেছিলুম, এবার একা একাই দৌড়ের বাকিটা খতম করতে হবে আমাকে।

    একা একা মাথা নিচু করে বাবা—মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াব—

    —”এই যে তোমার কালো ফিরে এসেছে, মা, পথের মাঝখানে আলোকে হারিয়ে এসেছি আমি—আমার কিন্তু এতে দোষ ছিল না বাবা, আই কুডন্ট ডু এনিথিং অ্যাবাউট ইট,—আই কুডন্ট—” কী হল? মায়া? কলকাতার লাইন পেয়ে গিয়েছ? তুমিই আগে কথা বলো না, আচ্ছা, আচ্ছা আমিও পরে যাচ্ছি—হ্যালো, বাবা? হ্যালো—হ্যাঁ হ্যাঁ আমি কালো বলছি, বাবা, মায়ার কাছে তো সব শুনলে—মা কেমন আছেন? বাবা? তোমার শরীর ঠিক আছে তো? শোনো—আমরা সবাই দেশে আসছি—শিগগিরি—সবাই আসছি বাবা, তুমি উদ্বেগ কোরো না, মাকে বলো আমরা সবাই তোমাদের কাছে চলে আসছি—কী বলছ? আসব না? আসতে হবে না? সেই তো প্লেনে আসা? না না ওতে কিছু হবে না, ধ্যাত ওতে কিছু হবে না বাবা? তুমি আজই একবার প্রেশারটা চেক করিয়ো—আমিও আবার ফোন করব—অ্যাঁ? ফ্রেড?

    ফ্রেড! মম! ফ্রেড আছে, ওই আর কী, ভালো আর থাকবে কী করে? পিউ—মউ তো চলে গেছে ওদের কাছে—শোনো আমি কালই কর্কে যাচ্ছি—কর্ক—বুঝলে তো? আয়ারল্যান্ডে— ফোনটা মাকে একটু দেবে নাকি? মা কেমন আছেন? অ্যাঁ? মা ঠাকুরঘরে? আচ্ছা, পরে কথা হবে—খুব সাবধানে থেকো বাবা, প্রেশারটা চেক করিয়ো—বাবা, আমরা সবাই তোমাদের সঙ্গে রয়েছি। এটা ভগবানের মার, এতে কেউই কিছু করতে পারে না, তবে একটুও যন্ত্রণা পায়নি নিশ্চয়ই এই রক্ষে—যেতে তো হবেই সবাইকে একদিন—এইভাবে যেতে পারাটাই তো মহাসৌভাগ্য—টু ডাই ইন হার্নেস—সেইভাবেই ভাবতে হবে এখন আমাদের—এছাড়া উপায় নেই বাবা—লুক আফটার ইয়োরসেলভস বাবা—টেক কেয়ার—আমরা অ্যাজ অর্লি অ্যাজ পসিব্ল চলে আসব তোমাদের কাছে—আরে না না কোনও ভয় নেই—আচ্ছা—রাখছি, কী? মায়ার সঙ্গে কথা বলবে? মায়া মায়া!”

    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleএকটি ইতিবাচক প্রেমকাহিনী – নবনীতা দেবসেন
    Next Article অ্যালবাট্রস – নবনীতা দেবসেন

    Related Articles

    নবনীতা দেবসেন

    মায়া রয়ে গেল – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    নবনীতা দেবসেনের গল্প

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    ভ্রমণের নবনীতা – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    ভ্রমণ সমগ্র ১ – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.