স্বভূমি – ৬
হেমনলিনী
ঠাকুর! ঠাকুর! আমার আলোকে তুমিই দিয়েছিলে তুমিই ফিরিয়ে নিলে, ওকে তোমার পায়ে ঠাঁই দিয়ো ঠাকুর! কর্তাকে শক্ত করো ঠাকুর, কর্তা একেবারে ভেঙে পড়েছেন—কর্তা ভেঙে পড়লে আমার যে আর কেউ নেই ঠাকুর—অন্ধের নাড়ি ছেলেটা পড়ে রইল সাত সমুদ্দুরের ওপারে—ঠাকুর তুমি আমার কালোকে রক্ষে করো ঠাকুর—আমার তো ওই একটিই রইল। কালোকে তুমি রক্ষে করো—আবার কর্কে না কোথায় যাবে বলছে—প্লেনেই তো যাবে—তুমি ওকে রক্ষে করো—ওকে কৃপা করো—আমাদের একটু দয়া করো ঠাকুর! দয়ার ঠাকুর তুমি, এ তোমার কী নিষ্ঠুর লীলা? আমার জামাইকে, আমার নাতনিকে তুমি রক্ষে করো ঠাকুর, ওদের এই দুর্দিনে দেখবার কেউ নেই—এক তুমি ছাড়া ঠাকুর—ঠাকুর এত বছর তোমার পায়ে মাথা কুটে তোমার পায়ে পড়ে থেকে কি এই তোমার আশীর্বাদ? নাকি আমাকে পরীক্ষা করছ, ঠাকুর? বুক চিরে রক্ত নিয়ে পরীক্ষা করছ এখনও তোমার পায়ে পড়ে থাকি কিনা? কোথায় আর যাব ঠাকুর, যাবার আর জায়গা কোথায়? আমার পায়ের নীচে তো একটাই জমি ঠাকুর, সেটা তুমি, তোমার দয়া—সুখও তোমার দেওয়া, দুঃখও তোমার দেওয়া,—সুখ যখন হাত পেতে নিইচি—দুঃখুও মাথা পেতে নোব বই কি—কিন্তু এ যে আমাদের বুকের শিরা ছিঁড়ে নিলে তুমি ঠাকুর—চার চারটি গর্ভ নষ্ট হবার পরে আমার আলো—কালো—আমার দশমাস দশদিন ধরে বওয়া নাড়ি ছেঁড়া মানিকটি তোমার দরকারে তুমি তুলে নিলে—আমাকে নিলে কি তোমার কাজ চলত না? আমি আর কী বলব ঠাকুর? অবেলা নারী কীই বা বুঝি তোমার মহিমা, শুধু পা দুটো ধরে পড়ে থাকি—চরণে ঠাঁই দিয়ো ঠাকুর—জন্মিলে মরিতে হবে—জানি, কিন্তু মা—বাপের চোখের সামনেই তার ব্যাটা—বেটিদের কেড়ে নিতে হবে এই বা তোমার কেমনধারা বিচার? কেমন হিসেব তোমার? আমাকে এবার নাও ঠাকুর—ভালয় ভালয় চলে যাই—দয়া করে আমাকে এবার নাও ঠাকুর—যা পাবার সবই পেয়েছি—আর কিছু চাই না, এবার আমাকে তুমি নাও ঠাকুর—কর্তার আগেই যেন যেতে পারি—শুধু এইটুকু—
মাসখানেক তো হয়ে গেল। কিন্তু কর্তা সামলে উঠলেন কই? কর্তা যে একেবারে শুয়ে পড়েছেন? এ কী হল ঠাকুর? কর্তাকে নিয়ে যে বড্ড ভাবনা হয়েছে ঠাকুর? ওঁকে যে কখনও এমন দেখিনি? কর্তা কখনও এতটা ভেঙে পড়তে পারেন ভাবিনি। এত শক্ত, এত শান্ত মানুষ। জীবনে কত কঠিন অবস্থার মধ্যে দিয়ে এসেছেন। চোখে জল নেই। না কেঁদে না কেঁদে যেন পাথর। আর মাঝে মাঝে বলছেন ”সত্যি সত্যি ওর কুষ্ঠিটাই ফলে গেল তা হলে? তা হলে কুষ্ঠির কথা সত্যি হয়?”
আমি যত বলি, ”দূর, ওটা গোলে হরিবল—সেরফ কাকতালীয় হয়েছে—কুষ্ঠি ফললে তোমাকে আর বেঁচে থেকে এই সন্তানশোক ভোগ করতে হত না আজকে”—উনি কিন্তু মনে হচ্ছে ভেতরে ভেতরে টলে যাচ্ছেন। আমিই ওঁকে বললুম শেষে, জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা ভবে। ও তো ভালোই গেছে। ভোগেনি। কোথায় গেল গীতা তোমার? মনে নেই, নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ। ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ? তবে কেন অমন ভেঙে পড়ছ? নানুশোচিত মহির্ষ—তুমিই আমাকে তো একথা বলেছিলে ছোড়দা যখন মারা যায়—নিজের মেয়ের বেলায় ভুলে গেলে?
কর্তা বললেন—”আশ্চর্য হেম! মা হয়ে তুমি এত শান্ত আছ কেমন করে?”
শান্ত কি আর আছি ঠাকুর? যা হচ্ছে তা হচ্ছে আমার ভেতরে। বাইরে শান্ত না থেকে উপায় কী? কর্তার তা হলে কী অবস্থা হবে? হে ঠাকুর এবার আমাকে নাও ঠাকুর। আমার মেয়েটার কাছে আমাকে পাঠিয়ে দাও ঠাকুর। আমার আর আয়ুতে কাজ নেই।
আজকে ওখানে আলোর কাজ হবার কথা। কে জানে দেহ না পাওয়া গেলে কেমন করে কাজ হয়। আমি তো কেবল ঠাকুরকে ডাকছি, বলছি মেয়েটাকে শান্তি দাও, তোমার পায়ে ঠাঁই দাও। কর্তা আজ সকাল থেকে গীতা হাতে বসে আছেন। এককাপ চা—ও খাওয়াতে পারিনি। চেহারা যে কী হয়েছে! কালো মাঝেমাঝেই ফোন করে। বাবা—মা’র জন্যে অস্থির হয়ে পড়েছে ছেলেটা।
হে ঠাকুর তুমি ওকেও শান্তি দাও। আমার ফ্রেডকেও শান্তি দাও। ফ্রেড নাকি বড্ড অস্থির, বড্ডই ভেঙে পড়েছে। লালীর কথা ভাবা তো আমি ছেড়েই দিয়েছি। ও যে এখন কী করবে, কেমনধারা হয়ে যাবে, কে জানে? আহারে, বাছার কথা আমি ভাবতেই পারছি না! মায়ের সঙ্গে অবিশ্যি দিন—রাত্তির ঝগড়া ছিল মেয়ের তবুও, মা—হারা হয়ে, এই বয়সে…তুমি ওকে রক্ষে করো ঠাকুর—
একেবারে মায়ের মুখখানা যেন কেটে বসানো—ওকে দেখলেই ওর মধ্যে ছেলেবেলার আলোকে দেখতে পাই—হাসিটা, গালের টোলটা এক্কেবারে মায়ের মতো—অথচ লালীর একদম বাঙালিপনা নেই—অ আ ক খ সব জানে—লিখতেও পারে দিব্যি—অথচ এক বর্ণ বাংলা লিখবে না—আমি তো বাংলায় কথা বলি, লালী সবই বোঝে, তবু উত্তরটি দেবে ইংরিজিতে—জয়ও ঠিক তাই! মউ—পিউ তবু একটু একটু বাংলা বলতে চেষ্টা করে—লালীটা এবারে একেবারেই মেমসাহেব হয়ে যাবে—মা রইল না—দেশের সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ ছিঁড়ে যাবে এবারে—আলোর জন্যেই তো যেটুকু জোর জবরদস্তি দিশিয়ানা তবু বজায় ছিল—এখন আমাদের সঙ্গে আর কি লালীর যোগ থাকবে…? একেবারেই এ দেশটাকে সইতে পারে না ও। বলে ”ডার্টি, ডাস্টি, স্মেলস অফুল!”
আমার মেয়ে তো গেলই সঙ্গে সঙ্গে বোধহয় আমার লালীদিদুকেও হারিয়ে ফেললুম আমরা—আমার প্রথম নাতনি! আমার আলোর মেয়ে। বড় আদরের মেয়ে। মেয়ে মেয়ে করেই পড়াশুনো ছেড়ে দিয়েছিল সে।
মা চলে গেল, বাবা তো সাহেব, বউয়ের জন্যেই যা মাতামাতি করত আমাদের নিয়ে—এখন জামাই হয়তো আবার বিয়ে—থা করবে। ওদেশে বড্ড ফাঁকা ফাঁকা জীবন, একলা থাকবেই বা কেমন করে—কতই বা বয়েস—লালীও বিয়ে করে ফেলবে এবারে—আমার মেয়ে তো একা গেল না—সঙ্গে সঙ্গে সব্বাইকে ছিঁড়ে নিয়ে গেল—আমার অমন সোনার চাঁদ জামাই, আমার অত আদরের বড় নাতনি, সব্বাইকে টেনে নিয়ে চলে গেল, এবার আমাদের বুড়ো বয়েসটা ফাঁকা হয়ে যাবে—অবিশ্যি কালো আমার ছেলে খুবই ভালো, মায়াও আমাদের বুড়ো—বুড়ির জন্যে যথেষ্ট করে—তবু, কর্তাকে বলে দেখি, লালীকে যদি আরেকবার সেই শান্তিনিকেতনে পড়ানোর কথাটা তোলা যায়, আমাদের তো ওকে ছেড়ে দিলে হবে না, আমার আলোর সন্তান, আমরা টানবই—টানবার চেষ্টা করবই—ফ্রেডকে উনি ফোন করে ওদের খবর নিচ্ছেন মাঝে মাঝে—দু’জনেরই যা অবস্থা! ফ্রেড আমাদের পুত্রবৎ—কিন্তু এখন কি আর সে সম্পর্ক বজায় থাকবে? আলোই রইল না!
‘জন—জামাই—ভাগনা তিন নয় আপনা’—ফ্রেড তো জামাই? যতই মা—মা করুক, বাবা—বাবা করুক, আলো চলে গেলে আমাদের আর কী মূল্য ওর কাছে? এ বছরে তৈরি হচ্ছিলুম মস্ত উৎসবের জন্যে ছেলে মেয়ে জামাই বউ তিন নাতনি সবার আসবার কথা হচ্ছিল, ভাবছিলুম কী করে এতটুকু দু’খানা ফ্ল্যাটে এত জন ধরবে? নাতি নাকি কোথায় অনেক দূরের দেশে যাবে বন্ধুদের সঙ্গে, তার আসা হবে না, বাকি সবাই আসবে, তারপরে দল বেঁধে কাশ্মীর যাব সকলে মিলে। আলো তারও বুকিংটুকিং সব করেই আসবে দিল্লি থেকে কথা ছিল—বিধি হঠাৎ ছকের সব ঘুঁটি পালটে দিলেন।
জানি না আর কোনওদিন লালী আর ফ্রেড তাদের এই ফ্ল্যাটে ফিরে আসবে কিনা। আলো না থাকলে কলকাতাতে ফ্ল্যাট রেখেই বা কী করবে ফ্রেড? লালী ইন্ডিয়াতে থাকতে চায় না। আসতেই চায় না! আজকে ওখানে আলোর কাজ হচ্ছে। ঠাকুর! ঠাকুর আমার মনটা শান্ত করে দাও ঠাকুর। আমার মনটা তুমি শান্ত করে দাও। আর ঠাকুর আমার লালীদিদির মনটাও তুমি শান্ত করো। কর্তা ভেঙে পড়েছেন দেখে আমারই এই অবস্থা, ফ্রেডও তো শুনছি একেবারে ভেঙে পড়েছে—বাপকে এখন সামলাচ্ছে লালীই, কালো বলেছে—অথচ সেই বা কতটুকুনি মেয়ে—হে ঠাকুর তুমি তার মনে শান্তি দাও—আজ তার মায়ের কাজ হচ্ছে—কালোরা সবাই তাই টোরোন্টো গেছে—আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে নেই ঠাকুর, অনেক দেখলুম, অনেক পেলুম, কোথায় মুক্তারামবাবুর গলি, কোথায় সাত সাগরের পার—জগৎখানা তুমি ঘুরিয়ে দেখিয়েছ।—অনেক দিয়েছিলে! এবার নিয়ে নেবার পালা শুরু হয়েছে—আলো গেল—সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চয় লালী আর ফ্রেডও চলে গেল—ফ্রেড তো ওদেশেরই ছেলে—মেয়েকে এখন নিজের দেশের মতোই করে ফেলবে—লালী কি আর বুড়ো দাদু—দিদিমার কথা মনে রাখবে? আলোই ছিল এদেশের সঙ্গে ওদের মনের বাঁধন, সেই বাঁধনই ছিঁড়ে গেল, এবার জোড় আলগা হবার পালা—হে ঠাকুর, আমাকে মনের জোর দাও—আমার কর্তাকে মনের জোর দাও—যেন আমরা এই পরম লোকসানও সয়ে নিতে পারি। এই বুড়ো বয়সে এতবড় শোক পাবার কথা ওঁর তো নয়, ঠাকুর, তুমি তো জানো মানুষটাকে, কত খাঁটি, কত নিল্লোভী? নিজের লোকদের তুমি কি এইভাবেই পরীক্ষা করে নাও? কিন্তু, কর্তার এই পাথুরে চেহারা আমার যে আর বুকে সয় না, হ্যাঁ, আমি পাপীতাপী লুভষ্টি মুখ্যু মেয়েমানুষ, হ্যাঁ আমার মনে অনেক কালিঝুলি আছে, আমি জানি, তোমার কাছে তো কিছুই লুকোনো নেই, কিন্তু কর্তার তো গঙ্গাজলে ধোওয়া মনখানা,—দয়া করো, হে দয়াল, দয়া করো, ছেলেটা দূরে, মেয়েটাকে তুমিই নিয়ে নিয়েছ, কর্তা ছাড়া আমার আর কে আছে ঠাকুর? আমার যে বড্ড ভয় কচ্চে। আজকের দিনে আমার আলোমাকে তুমি শান্তি দাও, আর আমাদের মুক্তি দাও এবারে সব মায়া থেকে মুক্তি দাও হে, আমি যে আর পারছিনি ঠাকুর।