Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    স্যার, আমি খুন করেছি – প্রচেত গুপ্ত

    প্রচেত গুপ্ত এক পাতা গল্প201 Mins Read0

    আরও একজন

    এক

    একুশদিনে মোট তিনবার ঘটেছে।

    প্রথম ঘটনার তারিখ, সময় দুটোই মনে আছে। ছয় তারিখ, বুধবার। বেলা দুটো বেজে দশ মিনিট। আমি বসেছিলাম ‘ফিট ওয়েল’ নার্সিংহোমের দোতলায়। ‘ফিট ওয়েল’ আমাদের সুকুলপুরের একমাত্র নার্সিংহোম। শুধু সুকুলপুর কেন, আশপাশের আর প্রাইভেট নার্সিংহোম নেই। ‘ফিট ওয়েল’-কে লোকে বলে ‘সাহাবাবুর গাঁট ওয়েল’। বিশ্বম্ভর সাহা নার্সিংহোমের মালিক। তার একটা চালকল, দুটো গোডাউন। সেই সঙ্গে গুঁড়ো দুধ আর গুঁড়ো সাবানের হোলসেল ডিলার। লোকে বলে, গুঁড়ো দুধ আর গুঁড়ো সাবান চেহারায় কাছাকাছি। দুধে টান পড়লে কৌটোতে সাবান মিশিয়ে সাহাবাবু সামাল দেন। গোডাউনে কৌটো সিল করবার বন্দোবস্থ আছে। বাইরে থেকে বোঝা যায় না। এই রটনা সত্যি মিথ্যে যাই হোক, বিশম্ভর সাহাকে ‘ব্যথিত’ করেছিল। তিনি সুকুলপুরের বাসিন্দাদের ‘সেবাকল্পে’ একটা নার্সিংহোম খুলে ফেললেন। বড় কিছু নয়, একেবারেই ছোটোখাটো। হোমড়াচোমড়াদের দিয়ে ফিতে কাটা হল, ফুলের মালা হল, উদ্বোধনী সঙ্গীত হল, ভাষন হল। সাহাবাবু ভাবলেন, এবার লোকের নিন্দেমন্দ কমবে। কমল না, বরং বাড়ল। কিছুদিনের মধ্যে সুকুলপুরের লোকে বলতে লাগল, ‘ও তো ফিট ওয়েল নয়, ও হল গাঁট ওয়েল। অন্যের গাঁট কেটে, নিজের গাঁটের সেবাকল্পে নার্সিংহোম ফেঁদেছেন সাহাবাবু।’

    সে যাই হোক, সেদিন ‘ফিট ওয়েল’ না গিয়ে আমার উপায় ছিল না। কেন ছিল না সেকথায় পরে আসছি। তার আগে বলে রাখি, এই গল্প বলবার সময় যতই আমি সুকুলপুর, ‘ফিট ওয়েল’ নার্সিংহোম আর আমার পরিবারের লোকদের কথা বলি না কেন, গল্প তাদের নিয়ে নয়। গল্প আমাকে নিয়েও নয়। গল্প আরও একজনের, যাকে আমি চিনি না। দেখিওনি কখনও। অদ্ভুত শোনাচ্ছে না? আমারও তাই মনে হয়েছে। অদ্ভুত, খুবই অদ্ভুত। তবে শুধু অদ্ভুত নয়, প্রথমে গা ছমছমে অস্বস্তি হয়েছে। তারপর ভয়। সেখান থেকে বিরক্তি, রাগ। জানি, ঘটনা ঠিক নয়। এমন হতে পারে না। তারপরেও মনে হয়েছে, হচ্ছে। এরপরেও রাগ হবে না? আমি তো কোনও ছেলেমানুষ নই, উন্মাদও নই। তাহলে কেন এমন হবে?

    বাজারের পাশে লোকের বাড়ির দেড়খানাতলা নিয়ে ‘ফিট ওয়েল’ নার্সিংহোম। একতলা পুরো, দোতলার আধখানা। একতলায় রোগী দেখা আর টাকা পয়সা নেবার ব্যবস্থা। দেড়তলায় অপারেশন থিয়েটার। অপারেশন থিয়েটারের দরজার মাথায় ঘড়ি। পাশের দুটো ঘরে চারটে লোহার খাট। কাঁটাছেড়া হয়ে গেলে রোগীকে এনে শুইয়ে দেওয়া হয়। উলটোদিকে তালা মারা কোলাসিবল। পিছনে সবুজ পর্দা। কোলাসিবল গেটের গায়ে লেখা ‘প্রাইভেটে বাড়ি।’ পর্দার ফাঁক দিয়ে সংসারের হাড়িকুড়ি উঁকি দেয়। এই দুইয়ের মধ্যিখানে একফালি বারান্দার মতো। নার্সিংহোমের লোকজন কায়দা মেরে বলে ‘করিডোর’। পেশেন্ট পার্টির অপেক্ষা করবার জন্য সেখানে দুটো নড়বড়ে বেঞ্চ। বেঞ্চের গায়ে কাগজ সাঁটা। কাগজে মেয়েলি হাতে লেখা ‘বারবার প্রশ্ন করিয়া কর্মীদিগকে বিরক্ত করিবেন না। অপারেশন সমাপন হইলে ডাক্তারবাবু খবর দিবেন।

    কাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি। ক’মাস ধরেই এরকম হচ্ছে। নানা ধরনের দুশ্চিন্তা। নার্সিংহোমে বসে হালকা ঝিমুনির মতো এলও। আর তখনই…। ধড়ফড় করে সোজা হয়ে বসতেই চোখ পড়ল অপারেশন থিয়েটারের ঘড়ির ওপর। দুটো বেজে দশ মিনিট।

    একেকজনের কাছে একেকটা দিন ‘ঠিক’। যেমন আমার বাবার ‘ঠিক দিন’ ছিল শনিবার। সুকুলপুর গঞ্জের এক জ্যোতিষী বাবার হাত দেখে বলেছিলেন, ‘এরপর থেকে কোনও কাজে হাত দিলে শনিবারে দিবা, অন্যদিন দিবা না।’

    বাবা বলেছিলেন, ‘কেন? অন্যদিনে সমস্যা কী?’

    জ্যোতিষ বললেন, অন্যদিনে হাত দিলে কাজ শুরু হবে, কিন্তু কাজে ফল পাবা না। কাজটা তো আসল নয়, কাজের ফলটাই আসল। যে কাজে ফল নাই সে কাজে লাভ কী? তাই বলি, সবার জন্য সব দিন ঠিক নয়। তোমার জন্য ঠিক দিন হইল শনিবার। কথাডা মনে রাখবা।’

    বাবা ছিলেন অ্যাকাউন্টেন্ট। ডিগ্রি কিছু ছিল না। হাতুড়ে ডাক্তারের মতো হাতুড়ে অ্যাকাউন্টেন্ট। কলেজ পাস করে নেতাকে ধরে কাঁচরাপাড়ার দিকে এক জুটমিলে ঢুকে পড়ছিলেন। ক্যাশিয়ারের কাজ। সপ্তাহ শেষে থুতু দিয়ে টাকা গুনে লেবারদের দিতে হত। টাকা এদিক ওদিক হলে সর্বনাশ! কম হলে খিস্তি।

    ‘শালা, শ্রমিকের রক্তচোষার ফন্দি করছো? মেরে ইয়ে ফাটিয়ে দেব শালা। ঝাণ্ডা মেরা করে পুকার…।’

    আবার বেশি দিয়ে ফেললে বিপদ। ফেরত নাও হতে পারে। অতজনের মধ্যে কাকে ধরবে? মালিক তখন নিজের পকেট থেকে টাকা কাটত। তিনবার বাবাকে খেসারত দিতে হয়েছে। তাই পেমেন্টের দিন বাবা থাকতেন ভয় ভয়। এই ভয় নিয়ে বছর তিন কাজ করবার পর জুটমিলে হল লকআউট। যেদিন নোটিশ ঝোলানো হল, সেদিন কিছু না জেনে বাবা কাজে চলে গিয়েছিলেন। ম্যানেজমেন্টে কোনও খবর দেয়নি। কাজ হারিয়ে খেপে থাকা লেবাররা মিলের গেটে বাবাকে ঘিরে ধরল।

    ‘হারামদাজা, মালিকের দালাল। তোকেই আজ জ্যান্ত পোড়াব। কেরোসিনের ডিবে আন।’

    হাতে পায়ে ধরে বাবা বুঝিয়েছিলেন, তিনি মালিকের কেউ নন। হলে কী আর এই ঝামেলার সময় অফিসে আসতেন? শেষ পর্যন্ত ছাড়া পেলেন বটে, তবে তার আগেই দু-চারটে কিল চড় পিঠে পড়ে গেছে। বাবার চাকরির ওখানেই ইতি। ফিরে গেলেন দেশের বাড়ি। সেই থেকে আর কারও চাকরি নয়, ‘নিজের উপার্জন নিজে করও’ প্রকল্পে ঢুকে পড়লেন। প্যান্টের মধ্যে শার্ট গুঁজে, পকেটে ছোটো চিরুনি নিয়ে, ব্রিফকেস হাতে বাবা ‘অ্যাকাউন্টেন্ট’ হয়ে গেলেন। হিসেব পরীক্ষক। সেইসময়ে গাঁ-গঞ্জের চালের আড়ত, গোডাউন, ধানকলে হিসেবের খাতা বাবার মতো হাতুড়ে হিসেব পরীক্ষককে দিয়ে দিব্যি চলে যেত। জল মিশিয়ে একটা হিসেব খাড়া করলেই হবে। মালিক যেমন চাইবে খাতায় যোগ বিয়োগ, লাভ লোকসান তেমন হবে। তিনি যদি বলেন সাত দুগুণে চোদ্দো নয়, সাত দুগুণে সতেরো, তাহলে সাত দুগুণে সতেরোই ধরতে হবে। বাবা একসময়ে বিশ্বম্ভর সাহার কাজও করেছেন। সেই সময়ে অবশ্য নার্সিংহোম হয়নি। তবে বাবার সঙ্গে বিশ্বন্তরের যোগাযোগ আমাকে সাহায্য করেছে। সে কথায় আসব। এর মধ্যেই বাবা একদিন জ্যোতিষীর কাছে গিয়ে, একশো একটা টাকা প্রণামী দিয়ে নিজের ‘ঠিক দিন’ নিয়ে বাড়ি এলেন।

    ‘ঠিক দিন’ স্থির হবার পর থেকে কোনও কাজই বাবা শনিবার ছাড়া শুরু করতেন না। কোথাও যেতে হলে শনিবার, নতুন কোনও হিসেবের কাজে হাত দিতে হলে শনিবার, দিদির বিয়ের কথা শুরু শনিবার, এমনকী ঘরের চাল মেরামতি করতে হলেও ‘শনিবার’ চাই।

    তখন কে জানত এই ‘শনিবারই বাবার কাল হবে?

    এক সোমবার সকালে বাবার এল জ্বর। রাতে সেই জ্বর বাড়ল হু হু করে। সকালবেলা বৃদ্ধ সজনীডাক্তার এসে বললেন, ‘এখনই হাসপাতালে নিয়ে যাও বাপু। লক্ষণ ভাল বুঝিনে। চোখ ফ্যাকাশে, ঘাড় শক্ত লাগে।’

    বাবা ক্ষীণ গলায় বলল, ‘হাসপাতালে যাব ডাক্তারবাবু, তবে শনিবারের আগে নয়।’

    সবাই জোরাজুরি করল। মা কান্নাকাটি শুরু করলেন। বাবা গোঁ ধরে রইলেন। ঘোরের মতো বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, ‘তোমার কী চাও? অ্যাঁ চাওটা কী? আমি মরে যাই? মরে যাই আমি? জানও তো শনিবার ছাড়া কোনও কাজ আমি শুরু করি না। আজ সোমবার। সোমবার হাসপাতালে গেলে কী হবে আমার? চিকিৎসেতে কোনও কাজ হবে? কোনও কাজ হবে না। তাহলে? কী চাও তোমরা? অ্যাঁ চাওটা কী?’

    শনিবার পর্যন্ত গড়াল না। পরদিন দুপুরে হাসাপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে বাবা গত হলেন। আমি তখন কিশোর

    আবার ফিরে আসি বুধবারের ঘটনায়। ঘটনার সূত্রপাত অবশ্য বুধবার নয়, সোমরার। আমাদের সুকুলপুরে ‘শহর’ ভাব এসেছে। গ্রামগঞ্জ থেকে শহর। রেললাইন ধরে সে ছড়াচ্ছে। স্টেশন আর বাজারের কাছে ক্যাটে ক্যাটে হলুদ, ঘেটা গোলাপী রঙের ফ্ল্যাটবাড়ি উঠেছে। হয়েছে সিনেমা হল, দোতলা বাজার, চুলে রঙ করবার সেলুন, মোবাইল ফোনের ঝুপড়ি, বিলিতি মদের দোকান, চাওমিন খাওয়ার রেস্টুরেন্ট। আজকাল মোটোরবাইকের ওপর কালো স্যান্ডো গেঞ্জি পরা ছেলেরা ঘুরে বেড়ায়। সকালে জমি খোঁজে, সন্ধ্যের পর ‘বান্ধবী’ জোগাড় করে মাঠের অন্ধকারে সিধিয়ে যায়। কলকাতায় মিটিং মিছিল থাকলে মাথায় ফেট্টি বেঁধে ট্রেনে উঠে পড়ে। স্টেশন যাতায়াতের পথ ঘিঞ্জি হয়েছে। রাস্তায় বাজার বসছে। রিকশ চলে, ভ্যান চলে, টোটো চলে, বালি, ইট নিয়ে হাফ পাঞ্জা, ফুল পাঞ্জা লরি ঢোকে।

    সোমাবার সকালে হেমলতাদেবী এই স্টেশন রোডেই টোটোর ধাক্কায় পড়লেন হুমড়ি খেয়ে। শহর ছড়ানোর ধাক্কায় চুরাশি বছরের বুড়ির হাঁটু কাটল, ঠোঁট ফাটল, বাঁ হাত ভাঙল। টোটোর ছোকরা-চালককে চেপে ধরল পাবলিক।

    ‘শালা, চোখের মাথা খেয়েছিস?’

    ‘আমি কী করব? বারবার তো হর্ন বাজালাম। উনি যদি শুনতে না পান আমি কী করব?’

    ‘বুড়ি মানুষ শুনতে পায়নি বলে গায়ের ওপর দিয়ে গাড়ি চালাবি?’

    ‘তাহলে কী করব? আকাশ দিয়ে উড়ে যাব?’

    ‘কী এত বড় কথা!

    দু-একজন হাত বাড়াতেই, হেমলতাদেবী কঁকিয়ে উঠলেন, ‘ওকে কিছু বলও না বাবারা। ওর দোষ নেই। সত্যিই আমি কানে শুনতে পাই না। বাঁ কানটা একদম গেছে, ডানটায় পিপিন্ করে। খুব চিৎকার করলে একটু বুঝতে পারি। একন যেমন পাচ্ছি।’

    টোটোর ছোকরা চালক তেড়েফুঁড়ে বলল, ‘শুনতে পান না তো পথে বেরোন কেন?’

    হেমলতাদেবী আরও কঁকিয়ে বললেন, ‘না বেরিয়ে চলবে কী করে বাবারা? ঘরে আনাজপাতি কিছু নাই। একটু আলু কুমড়ো যে ভাতে ফুটিয়ে খাব তার উপায় নাই।’

    পাবলিকের এবার মায়া হল। ‘পাবলিক’ হওয়ার এই সুবিধে। ক্ষণে ক্ষণে মত বদলানো যায়। এই হাসি এই কান্না, এই রাগ এই মায়া। তারা হেমলতাদেবীকে ধরাধরি করে টোটোতে তুলে দিলেন। গোটা ঘটনা খানিকটা দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করল নয়না। টোটো কেরে থাকা হেমলতাদেবীকে নিয়ে রওনা হবার পর সে মোবাইলে তুলে ফোন করল কলকাতায়। শ্রীবল্লীকে গোটা ঘটনা জানাল চিবিয়ে চিবিয়ে।

    ‘তোমার শাশুড়ির কী হয়েছে শোনও। এক্কেবারে চোখের সামনে হল।’

    নয়না প্রায় ঠিকঠাকই সব বলল। শুধু হেমলতাদেবীর ব্যথাকে কমিয়ে কান্নাকে কয়েক দাগ বাড়িয়ে দিল। রেডিওর ভল্যুম কমানো বাড়ানোর মতো।

    ব্যথা আর কান্নাতে যে তফাত রয়েছে জানতাম না। জানাতে পারলাম শ্রীবল্লী ফোন কাটবার পর। সে নয়নার ফোন ছেড়ে এসে ‘ধপাস্’ আওয়াজ করে আমার উলটো দিকের চেয়ারে বসল। গত চোদ্দো বছর ধরে আমি আমার স্ত্রীর হাঁটাচলা, ওঠা-বসার আওয়াজ শুনছি। কোনটা ভালবাসা, কোনটা আহ্লাদ, কোনটা রাগ চিনতে পারি। এবারও পারলাম। সকালবেলার দু’কাপ চায়ের পর অফিসের কাগজপত্র খুলেছি। মেজাজ খিঁচড়ে রয়েছে। এ মাসের সেল ফিগারে অনেকটা ডাউন। টার্গেট কমপ্লিট হয়নি। সামনেরবার না হলে ঝামেলা। আমার সঙ্গে কাজ করে প্রশান্ত। সে হারামজাদা ‘টার্গেট’ ডবল করে ফেলেছে। মিষ্টি হেসে ঝটাপট মাল বেচে দিচ্ছে। ইলেকট্রিকাল পার্টসের সঙ্গে মিষ্টি হাসির কী সম্পর্ক! আজও বুঝিনি। আমার তো আবার হাসিতে অ্যালার্জি। প্রশান্ত শালার জন্য অফিসে আমার পজিশন আরও টাইট। রোজ শুনতে হয় ‘ও পারে, তুমি পারও না কেন…ও পারে, তুমি পারও না কেন?’ শালা, সবাই কি সবসময় পারে? অফিসের ম্যানেজমেন্টের ওপর রাগ করা যায় না, আমি খেপে যাই প্রশান্তর ওপর। সামনে ভাল সম্পর্ক। কচুরি খাই, চা খাই, সিগারেট ভাগ করে টানি। মনে মনে বলি, ‘আমি পারি না, তুই কেন পারিস? কেন পারিস?’ ঠিক করেছি একদিন চান্স পেলে শালাকে গেঁথে দেব।

    ‘কী হল শ্রীবল্লী?’ নরম গলায় বললাম। স্ত্রী রেগে থাকলে নিজের কণ্ঠস্বরের ব্যাপারে কোনও ঝুঁকি নেওয়া ঠিক নয়। সে মেজাজ যতই খিচড়ে থাকুক।

    শ্রীবল্লী চোখ সরু করে বলল, ‘তুমি তোমার মাকে আলু কুমড়ো কিনে দাও না?’

    আমি ভুরু কুঁচকে বললাম, ‘মানে! আলু কুমড়ো আমি কোথা থেকে কিনব?’

    শ্রীবল্লী ফোঁস আওয়াজে নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘মানে আমাকে জিগ্যেস করছো কেন? তোমার সুকুলপুর স্টেশন রোডের পাবলিককে জিগ্যেস কর। তারা আমার থেকে ভাল বলতে পারবে।’

    আমি পড়লাম আরও ফ্যাসাদে। এসব কথার মানে কী! আমি সুকুমার পালিত, বয়স চুয়াল্লিশ বছর তিন মাস। বালক বয়েসে ছিলাম কেবলা ধরনের শান্তশিষ্ট। সেই কেবলামির নানা উদাহরণ রয়েছে। স্কুলে গুণ্ডা ছেলেদের হাতে মার খেয়ে বাড়ি ফিরতাম। ক্যাপটেন খেলায় না নিয়ে মাঠের পাশে বসিয়ে রাখত। সরস্বতী পুজোর প্রসাদ থেকে দরবেশ তুলে নিত। একবার গরমের ছুটিতে বন্ধুদের দলে পড়ে ঘোষেদের আমবাগানে কাঁচামিঠে আম চুরি করতে গেলাম। সবাই মিলে আমাকে গাছে তুলে দিল, আমিও আম পেড়ে নিচে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিলাম। বাগানের দারোয়ান এলে সবাই পালাল, আমি পড়লাম ধরা। দারোয়ান আমার জামা প্যান্ট খুলে নিল। পথে দিদি দেখতে পেয়ে ওড়না দিয়ে ঢেকেঢুকে বাড়িতে নিয়ে গেল। লজ্জার থেকে ভয় বেশি। বাড়িতে জানলে আরও বিপদ। দিদি ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে রেখে বাড়ি থেকে জামা প্যান্ট এনে বাঁচাল। দিদিটা এরকম ছিল। আগে ভাইকে আগলানো চাই। যাই হোক, যত বড় হয়েছি কেবলা ভাব কেটে ধুরন্ধর হয়েছি। তবে চাকরিতে উন্নতি করতে পারিনি। থাকি কলকাতার গড়চা রোডের একফালি ফ্ল্যাটে। এখনও একটা ফ্ল্যাট কিনতে পারিনি বলে, বউয়ের কাছে রোজ গালমন্দ শুনতে হয়।

    ‘সবাই ঘরবাড়ি করে নিল, তুমি কিছু পারও না।’

    আমি বলি, ‘সুকুলপুরে তো আমাদের বাড়ি আছে।’

    শ্রীবল্লী আরও ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ‘সুকুলপুর থাকবার মতো একটা জায়গা হল? ওখানে বাড়ি থাকাও যা, না থাকাও তাই। তুমি কি চাও আমি গণ্ডগ্রামে ফিরে যাই?’

    সত্যিই তো কেন ফিরে যাবে? আমি ব্যথিত মুখে কাজে বেরিয়ে পড়ি। ট্রামে বাসে, লোকাল ট্রেনে চাপি। ভাবি, একটা কিছু ব্যবস্থা করতে হবে।

    আমার মা হেমলতাদেবী থাকেন সুকুলপুরে দেশেরবাড়ি। একতলা বাড়িতে একা থাকেন। বাবা মারা যাবার কিছুদিন আগে দিদির বিয়ে হয়েছিল। পাত্র বসিরহাটের ছেলে। চার ভাইয়ের ছোটোজন। দেখতে সুন্দর, হাসিমুখ। পাত্রের বাবার দুটো ইটভাটা, একটা ভেড়ি, সঙ্গে কিছুটা জমি রয়েছে। তারওপর আবার নিজেদের পাকা বাড়ি। টাকি রোডে থেকে ভ্যানে মোটে বত্রিশ মিনিট। কোন এক শ্রাদ্ধবাড়িতে দিদিকে দেখে পাত্রের বাবার পছন্দ হয়েছে। দাবিদাওয়া কিছু নেই, শুধু মেয়েকে পেলেই হবে। বাবা রাজি হয়ে গেলেন। এমন পাত্র হাত ছাড়া করা যায় না। দিদি তখন সবে কলেজের মাঝামাঝি। পড়া বন্ধ করে পিঁড়িতে গিয়ে বসল। বিয়ে করে ইটভাটা, জমি, বাড়ির সঙ্গে পেল স্বামীর সদা হাস্যমুখ। আমার বাবা জামাই গর্বে গদগদ হলেন।

    ‘হাসিমুখের বর পাওয়া কোনও সহজ বিষয় নয় বুঝলে। ভাগ্য থাকলে হয়। স্বর্ণটার ভাগ্য আছে বলতে হবে। তবে আমার বিশ্বাস, শনিবার দেখে বিয়ের কাজ শুরু করেছিলাম বলেই এমনটা হল।’

    মা চোখে ‘আনন্দাশ্রু’ এনে ঠাকুর ঘরে গিয়ে বসলেন। বাড়িতে খুশির হাওয়া বইল। আমিও খুশি। জামাইবাবুর একমাত্র শ্যালক বলে কথা। সাতদিন পর ধুলো পা করতে বাড়ি এসে দিদিমাকে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

    ‘মা, তোমাদের জামাইয়ের মাথার অসুখ। সবসময় হাসে। হাসির কথা শুনলে হাসে, রাগের কথা শুনলেও হাসে। ওরা ছেলের অসুখ লুকিয়ে বিয়ে দিয়েছে। বাবা, তুমি একটু খোঁজখবর নিলে না?’

    বাবা শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন। না গম্ভীর হয়ে উপায় কী? সত্যি তো আমার হাতুড়ে অ্যাকাউন্টেট বাবা আসল হিসেবটাই গুলিয়ে ফেলেছিলেন। মেয়ের বিয়ে দেওয়ার সময় পাত্রের বাবার বাড়িঘর সম্পত্তির হিসেব কষেছেন, পাত্রের নিজের ‘যোগ-বিয়োগটা আর জানা হয়নি।

    ‘একটু মানিয়ে চল স্বর্ণ। ঠিক মতো চিকিৎসা করলে সব ঠিক হয়ে যাবে।’ দিদি বলল, ‘কী বলছো বাবা! তোমার ভুলের বোঝা আমাকে সারাজীবন বইতে হবে?’

    বাবা মাথা নামিয়ে বললেন, ‘আমি তো জেনেশুনে ভুল করিনি।’

    যাই হোক, দিদি বাবার ওপর অভিমান নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে রয়ে গেল। মুখে কোনওদিন বলেনি, আমি বড় হতে হতে বুঝেছি, দিদি অসুস্থ মানুষটাকে ভালবেসে ফেলছে। জামাইবাবুকে ছাড়তে চাইত না। একেদিনের জন্যও সুকুলপুরে বাড়িতে এসে রাত কাটায়নি। বোধহয় জেনে ফেলেছিল, যে মানুষের সর্বক্ষণ হাসিমুখ সংসারে তার বিপদ। তাকে একা রাখা যায় না। লোকটা অসুখ যত বাড়ে, দিদির প্রেমও যেন তত বাড়ে। দিদির শ্বশুরমশাই মারা গেলেন। জামাইবাবুর দাদারা অসুস্থ ভাইকে গুছিয়ে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করল।

    ‘মাথা খারাপ মানুষ টাকা পয়সা, জমি বাড়ি সামলাতে পারবে কেন? খাওয়া পরা তো দিচ্ছিই। বাড়ির একটা ঘরে বউকে নিয়ে যেমন আছে থাক না। অসুবিধেটা কোথায়? আমরা তাড়িয়ে তো দিইনি, পাগলা গারদেও পাঠায়নি। স্বর্ণ যখন ওর দায়িত্ব নিয়েছে, নিক না।’

    ততদিনে আমার বাবাও ‘টাটা, বাইবাই’ বলে কেটে পড়েছেন। আমি চাকরি পেয়েছি, শ্রীবল্লীকে বিয়ে করেছি। দেখেশুনে বিয়ে। দাবি ছিল না, শুধু একটাই শর্ত ছিল, পাত্রীর মুখ যেন ‘হাসি হাসি’ না হয়। ততক্ষণে ‘হাসিমুখ’-এর বিপদ আমার জানা হয়ে গিয়েছে। শ্রীবল্লী ফর্সা, গোলগাল, গম্ভীর মুখের মেয়ে। সবাই বলল গোলমুখের মেয়ের স্বভাব হয় নরম। মনে কোনও প্যাঁচঘোঁচ থাকে না। সবার জন্য মন কাঁদে। বিয়ের এগারোদিনের মাথায় শ্রীবল্লীর ‘নরম মন’-এর পরিচয় পেলাম। একদিন রাতে নবদম্পতির শরীরপর্ব’ শুরুর আগে শ্রীবল্লী সিলিঙের দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে শুয়েছিল। আমার তর সইছিল না। উস্ করছিলাম। শ্রীবল্লী আবার নিজের জামা কাপড় নিজে খোলে না। তার নাকি লজ্জা করে। এপাশ-ওপাশ করে খুলে দিতে হয়।

    শ্রীবল্লী বলল, ‘এই অজ গাঁয়ে আমি থাকব না।’

    আমি শ্রীবল্লীর নাইটির ফিতেতে হাত দিয়ে বললাম, ‘থাকবে না! নিজের বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাব?’

    শ্রীবল্লী বলল, ‘কলকাতায় যাব। ওখানে সিনেমা হল আছে, রেস্টুরেন্ট আছে, গড়িয়াহাটের বাজার আছে।’

    আমি বললাম, ‘কলকাতায় যাবে!’

    শ্রীবল্লী আমার হাত সরিয়ে, ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, ‘এমন ভাবে বললে যেন কলকাতায় কেউ থাকে না।’

    আমি আবার তার নাইটির ফিতেতে হাত রেখে বললাম, ‘নানা, তা বলিনি। বলছিলাম কী, কলকাতায় থাকা তো অনেক খরচের ব্যাপার। বড় চাকরি তো কিছু করি না। মাইনে কম। মাল বিক্রি না হলে কমিশনও নেই।’

    শ্রীবল্লী আবার হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, দুজন মানুষের খরচ কী? ছোটো ফ্ল্যাট ভাড়া নেব। পরে না হয় কিনব। তোমাকেও রোজ অফিসের জন্য আটটা সতেরোর গাড়ি ধরতে হবে না।’

    আমি এবার ধড়ফড় করে উঠে বসলাম।

    ‘দু’জনে থাকব! আর মা? মা কোথায় থাকবে?’

    শ্রীবল্লী ভুরু কুঁচকে বলল, ‘মা আবার কোথায় যাবেন? তিনি এখানে নিজের বাড়িতেই থাকবেন। তাকে তো আর আমির খানের সিনেমা দেখতে হবে না, গড়িয়াহাটের ফুটপাথে ঘুরে কানের দুল, শায়ার লেস কেনবারও দরকার নেই। উনি মরতে কলকাতায় যাবেন কেন?’

    আমি থতমত খেয়ে বললাম, ‘এই বুড়ো বয়েসে একা থাকবে কী করে?’

    শ্রীবল্লী থমথমে গলায় বলল, ‘নিজেরবাড়িতে আবার একা দোকা কী? আমরা তো শনি-রবি আসব। তুমি এমন লাফালাফি শুরু করলে কেন?’

    আমি শ্রীবল্লীর গায়ে হাত দিয়ে, ঢেঁক গিলে বললাম, ‘মাকে একা বাড়িতে ফেলে রাখাটা কি ঠিক হবে? যদি কিছু অঘটন ঘটে যায়? একটা পাহারা থাকা উচিত। সারাদিন আমিও থাকি না…।’

    শ্রীবল্লী আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলেছিল, ‘আমি কি তোমার মায়ের পাহারাদার? একটা দারোয়ানকে বিয়ে করলেই তো পারতে। তোমার মাকে পাহারা দিত।’

    আমি শ্রীবল্লীর ঘাড়ের ওপর ঝুঁকে বললাম, ‘মাকে যদি কলকাতায় নিয়ে যাই?’

    শ্রীবল্লী ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘সেখানেও তো সেই আমার ঘাড়ে পড়বে। তুমি আমার ঘাড় থেকে সরও তো।’ বলে ঠেলা দিল। একটু পরে খানিকটা ফুঁপিয়ে, খানিকটা দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, ‘আমি তোমার দিদির মতো নই যে চুপ করে সব মেনে নেব। কাল বাপেরবাড়ি যাব। গিয়ে বাবার কাছে জানতে চাইব, সে কোন দায়িত্ব নেবার জন্য আমার বিয়ে দিয়েছে? শাশুড়ির দারোয়ান না শাশুড়ির ঝি? তারপর আমি সুকুলপুরে ফিরব।’

    আমি কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে আবার শ্রীবল্লীর গায়ে হাত দিতে যাই, সে ঝটকা মারে। তার বাঁ হাত লাগে আমার নাকে। চুড়িতে একটু কেটেও যায়। নতুন বউয়ের শরীরের জোর বুঝতে পারি। জামাকাপড় খুললে একরকম জোর, না খুললে আরেকরকম জোর।

    দশদিনের মধ্যে আমরা গড়চার ফ্ল্যাটে চলে যাই। নয় নয় করে নয় বছর হয়ে গেল এখানে। প্রথমদিকে শনি-রবি দুদিনই সুকুলপুর আসতাম। শ্রীবল্লীও দু-এক সপ্তাহ এসেছে। বাজার টাজার করে দিয়ে যেতাম।

    শ্রীবল্লী একদিন বলল, ‘তোমার মায়ের হাতে পায়ে জোর আছে। বাজার দোকান নিজেই পারবে। বরং বসে থাকলে হাতে পায়ে মরচে পড়ে যাবে।’

    আমি ভেবে দেখলাম কথাটা ঠিক। মাকে টাকা দিয়ে গেলেই হবে। তারপর থেকে আমি একা আসি। আসি মাসে একদিন। কোনও কোনও মাসে কাজের চাপে ‘মিস্’ হয়ে যায়। গত তিন মাস যেমন মিস্’ হয়েছে। ‘মিস্‌’ হয়েছে ‘কাজের চাপে’ নয়, মায়ের ‘কানের চাপে’। পাঁচ বছর হল মায়ের কানে সমস্যা। নাকি ছ’ বছর? ছ’মাস হল সমস্যা কঠিন হয়েছে। খুব চিৎকার ছাড়া শুনতে পান না। মোবাইলে ফোনে চিৎকার করতে হয়। ডাক্তার দেখিয়েছি। বলেছে, কানের যন্ত্র চাই। যন্ত্রের দাম কম নয়।

    মা ঘ্যানঘ্যানানি শুরু করল ‘কিনে দে…চোখ তো ভালো নেই…কানেও না শুনলে থাকি কেমন করে?’

    শ্রীবল্লী বিরক্ত হয়ে বলল, ‘কিনে দাও।’

    আমি ভেবে দেখলাম, তাড়াহুড়োর কিছু নেই। কম পয়সার কিছু পাই কিনা দেখি। পরে ভেবে দেখলাম, এই বুড়ো বয়সে মা কানে শুনে কী করবে? যেটুকুই খরচ করব, সেটাই লোকসান। এদিকে সুকুলপুর গেলেই মা ঘ্যানঘ্যানানি চালায়। তাই মাস তিনেক ইচ্ছে করেই ‘মিস্’ করেছি। কে বলবে ন’ বছর আগে এই আমিই ‘ম্যা ম্যা’ করে হেঁদিয়ে মরেছি? পাশে শোয়া নতুন বউ রাগ করে কাপড় পর্যন্ত খোলেনি। আমি কি বদলে যাচ্ছি?

    মায়ের সেই ‘কান’ই যে আমাকে কাজকর্ম সব ফেলিয়ে সুকুলপুরে সোমবার ছুটিয়ে আনবে কে জানত? হেমলতাদেবী যদি টোটোর হর্ন শুনতে পেতেন, তাহলে এই বিপদ হত না। নয়নার দেওয়া রিপোর্টে শ্রীবল্লী শাশুড়ির ওপর রেগে কাঁই হলেও বলল, ‘এখনই যাও। মাকে কলকাতায় নিয়ে এসও। এখানে ট্রিটমেন্ট করাও। এবার থেকে উনি এখানেই থাকবেন।’

    আমি বললাম, ‘অত তাড়াতাড়ি কোনও ডিসিশন নিও না। আমি যাই, গিয়ে দেখি চোট কেমন।’

    শ্রীবল্লী বলল, ‘কাছে আনলে অন্তত রাস্তার লোকের কাছে উনি নালিশ করবেন না। ছিছি। নয়না যখন বলছিল, মনে হচ্ছিল, মাটিতে মিশে যাই।’

    রওনা দেবার সময় শ্রীবল্লী বলল, ‘চলও আমিও যাব।’

    আমি প্রমাদ গুণলাম। ঘটনা যদি সিরিয়াস হয়, শ্রীবল্লী যদি জোর করে মাকে কলকাতায় নিয়ে আসে তাহলে বিরাট ঝামেলা। খরচে হাবুডুবু খাব। এদিকে সেলসে টার্গেট হয়নি। মনে মনে বুঝলাম, আমি বদলে গিয়েছি। মুখ বললাম, ‘এখনই তোমার গিয়ে কাজ নেই শ্রীবল্লী। আমি আগে গিয়ে দেখি। সেরকম হলে খবর দেব।’

    আমি গিয়ে দেখলাম, ঝামেলা বড়। বুড়ি হেমলতাদেবীর ঠোঁটে সেলাই, পায়ে ব্যান্ডেজ, হাতে প্লাস্টার লাগবে। বাড়িতে এসব হবে না। বিশ্বম্ভর সাহার সঙ্গে দেখা করলাম। ‘ফিট ওয়েল’-এ যদি কম খরচে হয়ে যায়। সাহাবাবু ভাল ব্যবহার করলেন।

    ‘তোমার বাবা একসময় আমার কাছে কাজ করেছেন। তোমার মায়ের জন্য এইটুকু করব না? কিন্তু বাপু হে, চেনাজানা বলে জানিয়ে রাখি, আহামরি ব্যবস্থা কিন্তু নেই। চিকিচ্ছে কেমন হবে জানি না।’

    আমি তাড়াতাড়ি বললাম, ‘কাকাবাবু, মায়ের আহামরি চিকিৎসা কিছু লাগবে না। মোটের ওপর হলেই হবে। শুধু খরচটা…।’

    সাহাবাবু বললেন, ‘সে না হয় দেখব, কিন্তু তোমার এখানকার বাড়িটা দিয়ে দিচ্ছও না কেন?’

    আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, ‘বাড়ি দিয়ে দেব! কাকে?’

    সাহাবাবু বললেন, ‘আরে বাপু এখানে তো আজকাল একটা দুটো করে ফ্ল্যাটবাড়ির চল হয়েছে। তোমার ওখানে জমিও কম নেই। প্রোমোটারকে দিয়ে দাও, ভালো দাম পাবে। বলও তো ছেলে পাঠাই। আমি আবার ওদের একটু-আধটু চিনি। বাড়ি জমি ফেলে রাখা ঠিক নয়।’

    আমি একটু ভেবে বললাম, ‘কাকাবাবু, প্রস্তাব তো খুবই ভালো। বাড়িতে কথা বলি। আগে মায়েরটা…’

    জমির লোভেই মনে হয়, বিশ্বন্তর সাহা নার্সিংহোমে ব্যবস্থা করে দিলেন। আমিও মাকে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকিয়ে, শ্রীবল্লীর সঙ্গে মোবাইলে কথা বলে, বেঞ্চে বসে ঝিমোতে লাগলাম। এবার যা হবার হবে। ঠোঁটের স্টিচ একটু বেঁকা হলে ক্ষতি কী? কোনও ক্ষতি নেই। এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কতক্ষণ ঝিমিয়েছি মনে নেই। হঠাৎ কেমন একটা অস্তস্তি হল। ধড়ফড় করে উঠলাম। কী হল! শরীরে কিছু? মনে? আর ঠিক তখনই ফিরে তাকাতে ঘটনা ঘটল।

    পাশের বেঞ্চে কে যেন বসে আছে না?

    আমি চমকে উঠি। পিঠ সোজা করি। ঘাড় এগিয়ে, চোখ সরু করে তাকাই। না কেউ নেই। বেঞ্চে ফাঁকা। তারপরেও মনে হচ্ছে, কেউ আছে। আমি ছাড়া আরও একজন কেউ বসে রয়েছে। আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। নিশ্চয় ঘোর লেগেছে আমার। ঝিমুনির ঘোর। মুখের কাছে হাত মুঠো করে জোর করে দু’বার কাশলাম। অনেক সময় হাঁচি কাশিতে ঘোর কাটে। আমার কাটল না। সেই ‘আরও একজন’ গেল না। বসে রইল, যেমন ছিল। আমার অস্বস্তি বাড়ল। ভুলের একটা সীমা রয়েছে। দিব্য দেখতে পাচ্ছি, কেউ নেই। বেঞ্চে তো নেই বটেই, এই চত্বরেই নেই। একবারেই শুনশান। তারপরেও এরকম অদ্ভুত একটা ‘ভুল’ হচ্ছে কেন? মনকে শক্ত করলাম। ফালতু চিন্তা। কেউ নেই, তারপরেও কেউ আছেএমন হয় নাকি? ঘাড় নামিয়ে ফের ঝিমোতে চেষ্টা করলাম। মিনিটখানেক জোর করে চোখ বুজে থাকলাম। তার বেশি পারলাম না। মনে হতে লাগল, সেই আরও একজন’ আমার দিকে খানিকটা সরে এসেছে।

    আমি উঠে পড়লাম। মায়ের সেলাই, ব্যান্ডেজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত পায়চারি করতে থাকি। বেঞ্চের দিকে ফিরেও তাকাই না। তারপরেও মনে হয়, ‘একজন’ রয়ে গিয়েছে। আমি উঠে আসবার পরও আমাকে দেখছে।

    দ্বিতীয়বার একই ঘটনা ঘটল। ঘটল পনেরো দিনের মাথায়। এবার হল কলকাতায়। যেদিন প্রশান্ত এসে অফিসে মাথায় হাত দিয়ে বসেছিল সেই দিন।

    প্রশান্তর মাথায় হাত দিয়ে বসবারই কথা। চাকরি চলে গেলে কী করবে? মাথায় হাত দিয়ে বসা ছাড়া উপায় কী? ধেই ধেই করে নাচবে? আমি আমি ওর পিঠে হাত রেখে পাশে বসেছিলাম। বেচারি। গত দশদিনে সে যেখানে যেখানে মাল ডেলিভারি করেছে, অধিকাংশতেই ডিফেক্ট ধরা পড়েছে। যারা নিয়েছিল, তারা মাল ফেরত দিয়েছে তো বটেই, অফিসে জানিয়ে দিয়েছে, এই কোম্পানির মাল আর নেবে না। কে ঝুঁকি নেবে? কোম্পানির তো অভাব নেই। প্রশান্ত ম্যানেজমেন্টকে বোঝাতে চেয়েছিল, এটা ওয়ার্কশপের গোলমাল। তারা শুনবে কেন? জিনিস নেওয়ার আগে তার বুঝে নেওয়া উচিত ছিল। লোকসানটা বড় কথা নয়, কোম্পানির বদনামটা বড় কথা। এরপরে আর সেই স্টাফকে দিয়ে কাজ করানো যায় না।

    ‘প্রশান্ত, চিন্তা করিস না। আমি তোর হয়ে বলব।’

    আমার নরম গলা শুনে প্রশান্ত মুখ তুলে বলল, ‘নিশ্চয় কেউ প্ল্যান করে আমার সর্বনাশ করল।’

    আমি বললাম, ‘আমারও তাই মনে হয়। তুই চিন্তা করিস না, আমি দেখব।’ প্রশান্ত আবার টেবিলের ওপর মাথা নামাল। সে ঠিকই বলেছে। প্ল্যান করেই ওর ক্ষতি করা হয়েছে। করেছি আমি। ওয়ার্কশপের ডেলিভারিম্যানকে পয়সা খাইয়ে বাতিল, খুঁত হওয়া মাল দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। কঠিন কাজ। তাও করেছি। না করে উপায় ছিল না। ও আমাকে বড্ড টপকে যাচ্ছে। এতটা সহ্য করা যায় না। আমি আবার প্রশান্তর পিঠে হাত রাখলাম। আর তখনই মনে হল, সামনের চেয়ারে কেউ একজন বসে আছে। তাকে দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু অনুভব করতে পারছি। কেউ চুপিসাড়ে পিছনে কেউ এসে দাঁড়ালে যেমন হয়। দেখা যায় না, কিন্তু মনে হয় কেউ এসেছে। এখনও তাই মনে হচ্ছে। না দেখতে পাওয়া কেউ চেয়ারে বসে আমাকে দেখছে। তার চোখ মুখ কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না, তারপরে মনে হচ্ছে, সে অবাক হয়ে আমাকে দেখছে। অদ্ভুত! আমি চোখ কচলে ভাল করে দেখলাম। কেউ নেই। থাকবার কথাও নয়। তারপরেও কেন এমন অনুভূতি হচ্ছে? কোনও ভূতুড়ে ব্যাপার? তা কী করে হবে? দিনেদুপুরে, সুইনহো স্ট্রিটের অফিসে ভূত! ধস্। জামাইবাবুর মতো আমার মাথাটাও খারাপ হয়ে গেল নাকি? ছোটোবেলা থেকেই আমি ভূতটুতে বিশ্বাস করি না। এই ধেড়ে বয়েসে করব কেন? নিশ্চয় অন্য কোনও সমস্যা হচ্ছে। কী সমস্যা? যাই হোক সেটা অস্বস্তির এবং বিরক্তকর। বারবার একই ব্যাপার আমার ভাল লাগছে না। আজ আমার একটা আনন্দের দিন। প্রশান্তর কাজ চলে গিয়েছে। আজ আমার এমন হবে কেন? আমি জোর করে চোখ ফেরালাম। আর তখনই মনে হল, সেই ‘আরও একজন’ উঠে এসে আমার আর প্রশান্তর সামনে দাঁড়াল।

    আগের দিনের মতো সেদিনও আর পারলাম না। প্রশান্তকে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে আসি। পথে এলোমেলো ঘুরে বেড়াই। আমার কি কোনও অসুখ হচ্ছে? আমি কি ডাক্তারের কাছে যাব?

    ঘটনাটা তৃতীয়বার ঘটল বাড়াবাড়ি চেহারায়। এবার সেই অদৃশ্য একজন আমাকে ধাওয়া করল।

    বাড়ি জমি লিখে দিতে আমি সুকুলপুরে গিয়েছিলাম। বিশ্বম্ভর সাহা খাতির করে তার অফিসে বসাল। নতুন অফিস। বাইরে হোর্ডিং ‘সানসাইন সুকুলপুর’। হোডিং-এ ছবিও রয়েছে। দুটো বড় ফ্ল্যাটবাড়ির মাথার পিছন থেকে সূর্য উঁকি দিচ্ছে। সামনে একজোড়া বৃদ্ধ-বৃদ্ধা হাসছে। নতুন সুকুলপুরে পুরোনো মানুষের হাসি।

    বিশ্বম্ভর সাহা বললেন, আগে কী খাবে বল সুকুমার? গরম না ঠাণ্ডা?’ আমি বললাম, ‘ঠাণ্ডা দিন কাকাবাবু।’

    সাহাবাবু এই বয়েসেও চেহারা ‘ফিট’ রেখেছেন। মনও ‘ফিট’। নইলে নতুন নতুন প্রজেক্টের ঝাঁপাতে পারতেন? সাহাবাবু ‘ঠান্ডা’র অর্ডার দিলেন।

    ‘সুকুমার তুমি অনেক বদলে গেছো। স্মার্ট হয়েছো। ছোটোবেলা থেকেই তো দেখছি তোমায়। শান্তশিষ্ট ছেলে দিদির হাত ধরে স্কুলে যেতে। মনে আছে একবার ঘোষেদের আমবাগানে আম চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লে, দারোয়ান তোমার…।’ কথা থামিয়ে ‘হো হো’ আওয়াজে হেসে উঠলেন সাহাবাবু। তারপর ঝুঁকে পড়ে চকচকে বললেন, ‘ওই বাগান কিনে নিয়েছি সুকুমার। ছোটো ছোটো বাংলো বানাব, সুইমিং পুল বানাব। আজ না হোক কাল এই জায়গায় দর বাড়বে। জলের দরে এখন কিনে সোনার দরে তখন বেচব।’

    আমি বললাম, ‘খুব ভালো কাকাবাবু। আমার জমিতে কী হবে?’

    সাহাবাবু চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, ‘এখনও ভাবিনি। নিয়ে তো রাখি। ফেলে রাখব এখন। পরে যেমন ডিমান্ড, তেমন হবে। ফ্ল্যাট চাইলে ফ্ল্যাট মার্কেট চাইলে মার্কেট, হাসপাতাল চাইলে হাসপাতাল। বাজার কী বলে দেখব।

    ‘কাকাবাবু, মাকে কিন্তু…।’

    বিশ্বম্ভর সাহা বললেন, আরে বাপু বলেছ তো মাকে কলকাতায় নিয়ে যেতে পারবে না। চিন্তা করও না, এখানেই এক কামরার একটা ঘর দেখে দেব। একটা আছেও মনে হচ্ছে। ভালো ঘর। একটু ভিতরের দিকে। উঠোন পেরিয়ে বাথরুম পায়খানা। জলের একটু সমস্যা। তা বুড়ো মানুষের আর জল কত লাগবে? তাছাড়া কতদিন আর…মায়ের বয়স কত হল সুকুমার…।’

    আমি উৎসাহ নিয়ে বললাম, ‘অনেক। কাকাবাবু চেকটা দিন। চারটে দশের গাড়িটা ধরি। ওটা হপিং। তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাব।’

    সাহাবাবু বললেন, ‘দিচ্ছি বাপু। কিন্তু তোমার দিদির দিকটা সব ঠিক আছে তো? পরে জমি নিয়ে ঝামেলা করবে না তো?’

    আমি বললাম, ‘সব ঠিক আছে কাকাবাবু। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। দিদি তো লিখে দিয়েছে, সুকুলপুরের বাড়ির ওপর তার কোনও দাবি নেই। সে কাগজ আপনাকে দিলাম। দিলাম না? তাছাড়া…তাছাড়া দিদি আর ঝামেলা করবে কী? জামাইবাবুর অবস্থা খুবই খারাপ। শুনি খাওয়া ঘুম সব বন্ধ করে এখন শুধুই হাসেন। এত হাসেন যে দরজা বন্ধ করে রাখতে হয়। গত কয়েক বছর দিদিও বাড়ি থেকে বোরোতে পারেনি।’

    বিশ্বম্ভর সাহা ড্রয়ার খুলে চেক বই বের করে বলেন, ‘ইস্ কী বিশ্রী অসুখ!’ আমি চুপ করে রইলাম। এই বিশ্রী অসুখ আমাকে যে কত বড় স্বস্তি দিয়েছে তা শুধু আমি জানি। বাড়ি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর শ্রীবল্লী বলেছিল, ‘দিদিকে টাকার ভাগ দিও।’

    আমি বলেছি, ‘দিদি নেবে না।’

    শ্রীবল্লী বলল, ‘মানে?’

    আমি বলেছি, ‘মানে কিছু নয়। এই বাড়ির ওপর দাবি নেই বলে দিদি অনেকদিন আগেই লিখে দিয়েছে।’

    শ্রীবল্লী সন্দেহের গলায় বলল, ‘কই! আমাকে তো আগে বলওনি।’

    আমি বলেছি, ‘দরকার হয়নি, তাই বলিনি। আগে তো বাড়ি বিক্রি করিনি। ‘মা জানেন?’

    আমি বলেছি, ‘মা জেনে কী করবে? বাড়ি জমি তো মায়ের নামে নয়, বাবার নামে।’

    শ্রীবল্লী স্থির চোখে বলল, ‘আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, তুমি কোনও গোলমাল পাকিয়েছ।’

    আমি বলেছি, ‘আমারও হচ্ছে না। তাও দিদি এই কাজ করেছে। কাগজটা দেখবে?’

    আমি জানি শ্রীবল্লী কাগজ দেখলে. আমার কিছু এসে যায় না। জাল কাগজপত্র নিঃখুত ভাবে তৈরি করেছি। দিদি দেখলেও জাল বুঝতে পারবে না। মনে করবে নিজেরই সই। আর দেখবেই বা কখন? বরের হাসি নিয়ে চোখের জল ফেলতেই তার সময় চলে যায়।

    ঘটনা শুরু হল বিশ্বম্ভর সাহার অফিস থেকে বেরোনোর পর।

    মনে হল, আমার সঙ্গে কেউ হাঁটছে। কখনও পাশে, কখনও পিছনে। স্টেশনে গিয়ে চা খেলাম। সেই দেখতে না পাওয়া লোক চায়ের দোকানের একপাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল। দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল আমাকে। আমার অস্বস্তি হচ্ছে। আধকাপ চা ফেলে দিলাম। প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দাঁড়াতে ‘সে’ এসে সামনে দাঁড়াল। আমার ভয় করতে লাগল। রুমাল বের করে মুখ মুছলাম, ঘাড়-কপাল মুছলাম। এসব কী হচ্ছে! ‘সে’ আমার সঙ্গে ট্রেনেও উঠল। আমি ভিড় ঠেলে ভিতরে সিঁধোতে চাইলাম, লুকোতে চাইলাম। ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল ‘আরও একজন’। এবার আমার ভয় বাড়তে লাগল। আমার কি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে? নিশ্চয় তাই। নইলে যে নেই, যাকে দেখতে পাচ্ছি না, তার অস্তিত্ব কীভাবে অনুভব করছি! হাওড়া স্টেশন থেকে পাড়া পর্যন্ত ধাওয়া করে এল। ট্রামে, বাসে, ফুটপাথে পিছু ছাড়ল না। ইচ্ছে করে সন্ধ্যের সবজি বাজারে ঢুকলাম। যদি মনটাকে ঘোরানো যায়। উবু হয়ে বসে আনাজ কিনতে কিনতে বুঝতে পারলাম, মন ঘোরেনি। মনে হল, একটু দূরে আমারই মতো উবু হয়ে বসে ঢেঁড়শ বাছছে ‘আরও একজন।

    আমি নিশ্চিত, আমার জটিল সমস্যা হয়েছে। ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। শ্রীবল্লীকে কিছু বলার দরকার নেই

    দুই

    ‘কেমন দেখতে?’

    আমি বললাম, ‘বলতে পারব না ডাক্তারবাবু। দেখতে পাই না তো। শুধু মনে হয়।’

    ‘পুরুষ? না মহিলা?’

    আমি বললাম, ‘পুরুষই হবে।’

    ‘বয়স আঁচ করতে পারেন?’

    আমি বললাম, ‘বয়স বুঝতে পারি না। কখনও মনে হয় বালক, কখনও মনে হয়, লোক একটা, আমার মতো বয়সের।’

    ‘পায়ের শব্দ পান, নিঃশ্বাসের আওয়াজ?’

    আমি বললাম, ‘না ডাক্তারবাবু। হঠাৎ হঠাৎ মনে হয়, আমি বা আমরা শুধু নই, আরও একজন রয়েছে।

    ‘সেই আরও একজন কী করে?’

    আমি বললাম, ‘কিছু করে না। আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। ‘কাউকে দেখতে পান না, তারপরেও তাকিয়ে আছে বোঝেন কী করে?’

    আমি বললাম, ‘মনে হয় ডাক্তারবাবু। সবই মনে হয়।’

    ‘কেমন ফিলিংস্ হয়? মানে কেমন মনে হয় আপনার?’

    আমি বললাম, ‘প্রথমে অস্বস্তি হত, ভয়ও করেছে। তারপর বিরক্তি। এ কেমন অসুখ! এখন আবার রাগ হয়। মনে হয়, একজন আমাকে জ্বালাতন করছে। অতিষ্ঠ করে মারছে আমাকে। যদি সত্যি হত, এতক্ষণে একটা কিছু করে ফেলতাম।’

    ডাক্তারবাবু প্রেসক্রিপশন টেনে নিয়ে বললেন, ‘ভেরি গুড। এই রাগই আপনাকে জ্বালাতন থেকে বাঁচাবে। এবার থেকে মনে মনে কাউকে দেখলেই খুব রাগবেন। আপনার অসুখ কিছু হয়নি সুকুমারবাবু। নিছকই মনের ভুল। মায়ের অ্যাক্সিডেন্ট, সহকর্মীর চাকরি চলে যাওয়া, দেশের বাড়ি বিক্রি, দিদির সমস্যা আপনাকে টেলশন মধ্যে রেখেছে। তাই ভুল ভাবছেন। রাতে ঘুমের জন্য হালকা একটা ওষুধ দিচ্ছি। এতেই কাজ হবে।’

    আমি নিচু গলায় বললাম, ‘ডাক্তারবাবু, ওকে?’

    ডাক্তারবাবু মুখ তুলে বললেন, ‘কে হলে খুশি হবেন? আপনি নিজে?’ তারপর হেসে বললেন, ‘বললাম তো কেউ নয়। নো বডি। নিশ্চিত্তে যান।’

    আমি ডাক্তারবাবুর চেম্বার থেকে হালকা মনে বেরোলাম। যাক, কিছু হয়নি। স্রেফ মনের ভুল। পরের সপ্তাহে সুকুলপুর যাব। হেমলতাদেবীকে নিজের বাড়ি থেকে এক কামরার ভাড়া ঘরে শিফ্ট করাতে হবে। মালপত্রও সরাতে হবে। বাড়ি খালি করে দিতে হবে। শ্রীবল্লী চেয়েছিল, মাকে কলকাতায় নিয়ে যাই। প্রশ্নই ওঠে না। মা কানে শুনতে পেত না, এখন কথাও ঠিকমতো বলতে পারছে না। ঠোঁটের সেলাই মনে হয় ঠিক হয়নি। কথা বলতে গেলে টান লাগছে। অবশ্য এই বয়েসে কথা বলবার দরকারই বা কী? বললে তো সেই ‘কান’ আর ‘আলু কুমড়ো’।

    তিন

    এখন অনেক রাত। কত রাত জানি না। সুকুলপুরের বাড়ির সদর দরজায় আমি হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আর দরদর করে ঘামছি। খানিক আগে একটা ভংয়কর কাণ্ড হয়েছে।

    একটু আগে থেকে বলি।

    ডাক্তারের ওষুধ খেয়ে কটাদিন ভালো ঘুম হয়েছিল। আজ সকালে সুকুলপুরে এসে কাজও হয়েছে ভালো। মাকে বাড়ি থেকে সরানো গেছে, জিনিসপত্রও সরেছে। কাল ভোরে বাকিটুকু করে, বিশ্বম্ভর সাহার হাতে চাবি দিয়ে আমি ‘টাটা’ হব। মনটা ফুরফুরে। ডাক্তারবাবু ঠিকই বলেছেন। টেলশন কমেছে, মনের ভুলও পালিয়েছে। এক সপ্তাহ আর কোনও সমস্যা হয়নি। ‘আরও একজন’ কেটে পড়েছেন। বুঝতে পারছি, আর আসবেও না।

    দেশেরবাড়িতে এই আমার শেষ রাত। তাই জেগে রয়েছি। অবশ্য জেগে থাকার অন্য কারণও রয়েছে। বলতে ‘লজ্জা লজ্জা’ করছে। একসময়ে কেবলাচন্দর ছিলাম, এখন কেমন ‘স্মার্ট’ হয়েছি, ভেবে লজ্জা পাচ্ছি। বদলেও গিয়েছি। বিকেলে সাহাবাবুর এক চেলার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। সারাদিন খাটাখাটনিতে গা হাত-পায়ে ব্যথা হয়েছে শুনে বলল, ‘ও কিছু নয়, ঠিক হয়ে যাবে। রাতে লতাকে পাঠিয়ে দেব।’

    আমি বললাম, ‘লতা কে?’

    চেলা মুচকি হেসে চোখ টিপে বলল, ‘লতা ভাল গা হাত পা টেপে। খরচ বেশি না।’

    বাপরে, সুকুলপুরে এখন এও পাওয়া যাচ্ছে! হবেই তো। সেই সুকুলপুর তো আর নেই। ভালই হল। এই অভিজ্ঞতা আগে হয়নি। শ্রীবল্লী কবে হাত পা টিপেছে মনে পড়ে না। আলো নিভিয়ে লতার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এক সময়ে দরজা ‘খুটখুট’ আওয়াজ। তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খুলি। অন্ধকার। বাইরের আলোটাও কি খুলে নিয়ে গিয়েছে।

    গায়ে চাদর জড়ানো মেয়েটি চাপা গলায় বলল, ‘আমি লতা।’

    ‘ভিতরে এসও।’

    এইটুকু ফিসফিস্ করে বলে দরজা থেকে সরে আসতে গেলাম, আর তখনই আমার শরীরে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, লতা একা নয়, তার পাশে আরও একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। সেও ঘরে ঢুকতে চায়।

    এক মুহূর্ত দেরি না করে আমি দরজা বন্ধ করে দিয়েছি। খিল তুলে, পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি ঠায়। ঢুকতে দেব না। কিছুতেই ঢুকতে দেব না।

    দরজায় সমানে ‘খুটখুট্’ আওয়াজ হচ্ছে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআনন্দমেলা রহস্য গল্পসংকলন – সম্পাদনা : পৌলোমী সেনগুপ্ত
    Next Article নীল আলোর ফুল – প্রচেত গুপ্ত

    Related Articles

    প্রচেত গুপ্ত

    দেরি হয়ে গেছে – প্রচেত গুপ্ত

    September 18, 2025
    প্রচেত গুপ্ত

    পঞ্চাশটি গল্প – প্রচেত গুপ্ত

    September 18, 2025
    প্রচেত গুপ্ত

    ধুলোবালির জীবন – প্রচেত গুপ্ত

    September 18, 2025
    প্রচেত গুপ্ত

    রুপোর খাঁচা – প্রচেত গুপ্ত

    September 18, 2025
    প্রচেত গুপ্ত

    মাটির দেওয়াল – প্রচেত গুপ্ত

    September 18, 2025
    প্রচেত গুপ্ত

    নুড়ি পাথরের দিনগুলি – প্রচেত গুপ্ত

    September 18, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }