Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    হাজার বছর ধরে – জহির রায়হান

    জহির রায়হান এক পাতা গল্প110 Mins Read0

    ০১. মস্ত বড় অজগরের মত সড়কটা

    মস্ত বড় অজগরের মত সড়কটা একেবেঁকে চলে গেছে বিস্তীর্ণ ধান ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে।

    মোঘলাই সড়ক।

    লোকে বলে, মোঘল বাদশাহ আওরঙ্গজেবের হাতে ধরা পড়বার ভয়ে শাহ সুজা যখন আরাকান পালিয়ে যাচ্ছিলো তখন যাবার পথে কয়েক হাজার মজুর খাটিয়ে তৈরি করে গিয়েছিলো এই সড়ক।

    দুপাশে তার অসংখ্য বটগাছ। অসংখ্য শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে সগর্বে দাড়িয়ে রয়েছে সেই দীর্ঘকাল ধরে। ওরা এই সড়কের চিরন্তন প্রহরী।

    কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম।

    চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা।

    মাঝে মাঝে ধান ক্ষেত সরে গেছে দূরে। দুধারে শুধু অফুরন্ত জলাভূমি। অথৈ পানি। শেওলা আর বাদাবনের ফাঁকে ফাঁকে মাথা দুলিয়ে নাচে অগুণিত শাপলার ফুল।

    ভোর হতে আশেপাশের গায়ের ছেলে-বুড়োরা ছুটে আসে এখানে। এক বুক পানিতে নেমে শাপলা তোলে ওরা। হৈ-হুল্লোর আর মারামারি করে কুৎসিত গালাগাল দেয় একে অন্যকে। বাজারে দর আছে শাপলার। এক অ্যাঁটি চার পয়সা করে।

    কিন্তু এমনো অনেকে এখানে শাপলা তুলতে আসে, বাজারে বিক্রি করে পয়সা রোজগার করা যাদের ইচ্ছে নয়।

    মন্তু আর টুনি ওদেরই দলে।

    ওরা আসে ধলপহরের আগে যখন পূর্ব আকাশে শুকতারা ওঠে। তার ঈষৎ আলোয় পথ চিনে নিয়ে চুপি চুপি আসে ওরা। রাতে শিশির ভেজা ঘাসের বিছানা মাড়িয়ে ওরা আসে ধীরে ধীরে। টুনি ডাঙ্গায় দাঁড়িয়ে থাকে।

    মন্তু নেমে যায় পানিতে।

    তারপর, অনেকগুলো শাপলা তুলে নিয়ে, অন্য সবাই এসে পড়ার অনেক আগে সেখান থেকে সরে পড়ে ওরা।

    পরীর দীঘির পাড়ে দুজনে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়। শাপলার গায়ে লেগে থাকা অ্যাঁশগুলো বেছে পরিষ্কার করে।

    মন্তু বলে, বুড়ো যদি জানে তোমারে আমারে মাইরা লাফাইবো।

    টুনি বলে, ইস, বুড়ার নাক কাইটা দিমু না।

    নাক কাইটলে বুড়ো যদি মইরা যায়?

    মইরলে তো বাঁচি। বলে ফিক করে হেসে দেয় টুনি, বলে, পাখির মত উইড়া আমি বাপের বাড়ি চইলা যামু। বলে আবার হাসে সে, সে হাসি আশ্চর্য এক সুর তুলে পরীর দীঘির চার পাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়।

    এ দীঘি এককালে এখানে ছিলো না।

    আশেপাশের গায়ের ছেলে-বুড়োদের প্রশ্ন করলে তারা মুখে মুখে বলে দেয় এ দীঘির ইতিহাস। কেউ চোখে দেখে নি, সবাই শুনেছে। কেউ শুনেছে তার বাবার কাছ থেকে। তার বাবা জেনেছে তার দাদার কাছ থেকে। আর তার দাদা শুনেছে তারও দাদার কাছ থেকে।

    সে অনেক বছর আগে।

    তখন গ্রাম ছিলো না। সড়ক ছিলো না। কিছুই ছিলো না এখানে। শুধু মাঠ, মাঠ, আর মাঠ। সীমাহীন প্রান্তর।

    বৈশাখী পূর্ণিমা রাতে, পরীরা নেমে আসতো এই পৃথিবীতে। ওরা নাচতে, গাইতো, খেলত।

    লাল পরী, নীল পরী আর সবুজ পত্নী। পরীদের অনেকের নামও জানা আছে এ গায়ের লোকের। পুঁথিতে লেখা আছে সব।

    একদিন হঠাৎ পরীদের খেয়াল হলো, একটা দীঘি কাটবে। যার পানিতে মনের আনন্দে সঁতার কাটতে পারবে ওরা। ডুব দিয়ে, পানি ছিটিয়ে ইচ্ছেমত হৈ-হুল্লোড় করতে পারবে।

    যেই চিন্তা সেই কাজ।

    আকাশ থেকে খন্তা কোদাল আর মাটি ফেলবার ঝুড়ি নিয়ে এলো ওরা।

    বৈশাখী পূর্ণিমার রাত।

    রুপালি জোছনার স্নিগ্ধ আলোয় ভরেছিলো এই সীমাহীন প্রান্তর। দক্ষিণের মৃদু বাতাস মুখরিত হয়ে উঠেছিলো পরীদের হাসির শব্দে।

    কথায় গানে আর কাজে।

    রাত ভোর হবার আগে দীঘি কাটা হয়ে গেল।

    পাতাল থেকে কলকল শব্দে পানি ওঠে ভরে গেল দীঘি।

    সেই দীঘি।

    তাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে গ্রাম। এক নয়, অনেক।

    গভীর রাতে ধপাস ধপাস ঢেঁকির শব্দে গমগম করে গ্রামগুলো।

    জোড়া বউকে ঢেঁকির উপরে তুলে দিয়ে রাত জেগে ধান ডানে বুড়ো মকবুল। পিদিমের শিখাটা ঢেঁকির তালে তালে মৃদু কাপে।

    মকবুল ধমকে উঠে বউদের, কি, গায়ে শক্তি নাই? এত আস্তে ক্যান। আরো জোরে চাপ দাও না। এমনভাবে গর্জে উঠে মকবুল, যেন ক্ষেতে লাঙ্গল ঠেলতে গিয়ে রোগী। লিলিকে গরু জোড়াকে ধমকাচ্ছে সে। হুঁ, হট হট। আরো জোরে। আরো জোরে। ধমক খেয়ে ঢেঁকিতে আরো জোরে চাপ দেয় ওরা। টুনি আর আমেনা। পাশের বাড়ি থেকে আম্বিয়ার গান শোনা যায়। স্বপ্নে আইলো রাজার কুমার, স্বপ্নে গেলো চইলারে। দুধের মত সুন্দর কুমার কিছু না গেল বইলারে।

    ঢেঁকিতে চড়লেই গান গাওয়ার সখ চাপে আম্বিয়ার। সতেরো আঠারো বছর বয়স হয়েছে, কিন্তু এখনো বিয়ে হয় নি ওর। অ্যাঁটসাঁট দেহের খাঁচে খাঁচে দুরন্ত যৌবন, আট-হাতি শাড়ির বাঁধন ভেঙ্গে ফেটে পড়তে চায়। চেহারায় মাধুর্য আছে। চোখ জোড়া বড় বেশি তীক্ষ্ণ। ঢেঁকিতে চড়লে, টেকিকে আর সুখ দেয় না ও। এত দ্রুত তালে ধান ভানতে থাকে, মনে হয় টেকিটাই বুঝি ফেটে চৌচির হয়ে যাবে।

    ধান ভানা শেষ হলে গায়ে দর দর ঘাম নামে ওর। একটা চাটাইয়ের ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে জোরে শ্বাস নেয় আম্বিয়া।।

    ঢেঁকির পাশে বসে এই মুহূর্তে বারবার আম্বিয়ার কথা মনে পড়ছিলো বুড়ো মকবুলের। দাঁত মুখ খিচে বউদের আবার ধমক মারলো, ও শুনছনি, আম্বিয়া কেমন ধপাস ধপাস কইরা ধান বাইনতাছে। আর তোরা, কিছু না কিছু না, বলে বার কয়েক মাটিতে থুতু ফেললো মকবুল। বাঁ হাতে কপালের ঘামগুলো মুছে নিল সে।

    দাওয়ার ওপাশে পিদিম হাতে দাড়িয়ে দাড়িয়ে সব দেখছিলো ফকিরের মা। সেখান থেকে বললো, আহা, মকবুল! বউগুলোরে বুঝি এই রাতের বেলাও আর শান্তি দিবি না তুই। সারাদিন তো খাটাইছস, এহন দুপুর রাইতেও, বলে টুনি আর আমেনার জন্য আফসােস করতে করতে নিজের ঘরে চলে গেল ও।

    এ বাড়িতে মোট আট ঘর লোকের বাস।

    সামনে নুয়ে পড়া ছোট ছোট ঘরগুলো একটার সঙ্গে একটা লাগানো। বাঁশের তৈরি। বেড়ার ভাঙ্গা অংশগুলো তালপাতা দিয়ে মোড়ান । চালার স্থানে স্থানে খরকুটো উঠে ফুটো হয়ে গেছে। দিনের সূর্য আর রাতের চাঁদ এসে একবার করে সে ফুটো দিয়ে উঁকি মেরে যায় ঘরের ভেতরে। আম, কাঁঠাল, পাটি পাতা আর বেতাক বনে ঘেরা বাড়ির চারপাশ। মাঝে মাঝে ছোট বড় অনেকগুলো সুপুরি আর নারকেল গাছ লাগানো হয়েছে অনেক আগে । দু’একটা খেজুর গাছও ছড়িয়ে রয়েছে এখানে সেখানে। ছোট পুকুর। পুকুরে শিং কই আর মাগুর মাছের কমতি নেই। দিনরাত শব্দ করে ঘাই দেয় ওরা। পানিটাকে সারাক্ষণ ঘোলাটে করে রাখে। সামনে মাঝারি উঠোন। শীত কিংবা গ্রীষ্মে শুকিয়ে একরাশ ধুলো জমে। বর্ষায় এক হাঁটু কাদা। কাদার ওপর ছোট ছোট ব্যাঙ এসে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ায়। হাঁস কি মোরগ দেখলেই তাড়া করে ওদের। ধরে ধরে মারে। পুবের সারে উত্তরের ঘরটা মকবুলের। বাড়ির অন্য সবার চেয়ে ওর অবস্থাটা কিছু ভালো।

    মকবুল তিন বিয়ে করেছেন। তিন বউই বেঁচে আছে ওর।

    বড় বউ আমেনা। কালো মোটা আর বেঁটে। বয়স প্রায় ত্রিশের কোঠায় পৌঁছেছে এবার। খুব ঘন ঘন কথা বলে। কথা বলার সময় পোকায় খাওয়া দাঁতের ফাঁক দিয়ে থুতু ছিটিয়ে সামনের লোকগুলোকে ভিজিয়ে দেয়। পারিবারিক কলহ বাধলে তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাবার হুমকি দেখায়।

    মেজ ফাতেমা। দেখতে রোগা, হ্যাংলা আর লম্বা। বছরে তিন মাস পেটের অসুখে ভোগে। ছ’মাস বাপের বাড়িতে কাটায়। বয়সের হিসেবটা সে নিজেও জানে না। কেউ পনেরো বললেও সায় দেয় না। পঁচিশ বললেও মেনে নেয়।

    সবার ছোট টুনি। গায়ের রং কালো। ছিপছিপে দেহ। আয়ত চোখ। বয়স তার তেরচৌদ্দর মাঝামাঝি। সংসার কাকে বলে সে বোঝে না। সমবয়সী কারো সঙ্গে দেখা হলে সব কিছু ভুলে গিয়ে মনের সুখে গল্প জুড়ে দেয়। আর হাসে। হাসতে হাসতে মেঝেতে গড়াগড়ি দেয় টুনি।

    বুড়ো মকবুলের পরিবারে আরো একজন আছে।

    নাম তার হীরন। ও তার বড় মেয়ে। বড় বউ-এর সন্তান। এবার দশ ছেড়ে এগারোয় পড়লো সে। এখন থেকে মকবুল ওর বিয়ের জন্যে উঠে-পড়ে লেগেছে। দুএক জায়গায় এর মধ্যে সম্বন্ধও পাঠিয়েছে সে। বড়, মেজ আর ছোট এই তিন বউ নিয়ে মকবুলের সংসার। তিন বউকে বসিয়ে খাওয়ানোর মত জমিজমা নেই ওর। আসলে বউদের আয় দিয়ে চলে ও। বড় দুই বউ দিব্যি আয় করে। বাজার থেকে পাতা কিনে এনে দিয়েই খালাস মকবুল। দুই বউ মিলে একদিনে তিন চারটে চাটাই বুনে শেষ করে। মাঝে মাঝে টুনিও বসে পড়ে ওদের সঙ্গে কাজ করে। চাটাইগুলো বাজারে বিক্রি করে লাভের অংশ দিয়ে পেঁয়াজ, লঙ্কা, পান-সুপুরি কেনে মকবুল।

    ফসলের দিনে সবাই যখন গরু দিয়ে ধান মাড়ায় তখন তিন বউকে লাগিয়ে ধান মাড়ানোর কাজটা সেরে ফেলে ও। বর্ষা পেরিয়ে গেলে বাড়ির উপরে যে ছোট জমিটা রয়েছে তাতে তিন বউকে কোদাল হাতে নামিয়ে দেয় মকবুল। নিজেও সঙ্গে থাকে। মাটি কুপিয়ে কুমড়ো আর সিমের গাছ লাগায়। দুবেলা জল ঢেলে গাছগুলোকে তাজা রাখে। সুখ আছে আবার সুখ নেইও মকবুলের জীবনে। তিন বউ যখন ঝগড়া বাঁধিয়ে চুল ছেঁড়ার লড়াই শুরু করে তখন বড় বিস্বাদ লাগে ওর। হাতের কাছে যা পায় তাই দিয়ে তিনজনকে সমানে মারে সে। কাউকে ছাড়াছাড়ি নেই।

     

    মকবুলের পাশের ঘরটা ফকিরের মার.

    তার পাশেরটা আবুলের।

    তার পাশে থাকে রশিদ।

    পাশাপাশি তিনটে ঘর।

    সবার দক্ষিণে যে ঘরটা সবার চেয়ে ছোট, ওটায় থাকে মন্তু। একা মানুষ। বাবা মা ভাইরোন কেউ নেই। বাবাকে হারিয়েছে ও জন্মের মাসখানেক আগে। মাকে, দশ বছর বয়সে। লোকে বলে, মণু নাকি বড় একগুয়ে আর বদমেজাজী। স্বভাবটা ঠিক জানোয়ারের মত।

    টুনি বলে, অমন মাটির মানুষ নাকি এ জন্মে আর দেখেনি সে।

    আহা অমনটি আর হয় না।

    ওপাশে আর কোন ঘর নেই।

    পশ্চিমের সারে, দক্ষিণের ঘরটা মনুর।

    তার পাশে থাকে সুরত আলী।

    তার পাশে গনু মোল্লা।

    গনু মোল্লা নির্ভেজাল মানুষ। কারো সাথেও থাকে না। পাচেও না। জমি জমা নেই। চাষবাসের প্রশ্ন উঠে না। সারাদিন খোদার এবাদত করে। যেখানে যায় তছবির ছড়াটা হাতে থাকে তার। আপন মনে তছবি পড়ে।

    দীঘিকে কেন্দ্র করে এই গ্রাম।

    কখন কোন্ যুগে পত্তন ঘটেছিলো এ গ্রামের কেউ বলতে পারবে না। কিন্তু এ বাড়ির পত্তন বেশি আগে নয়। আশি কি খুব জোর নব্বই বছর হবে।

    সেই তেরশ সনের বন্যা।

    অমন বন্যা দুচার জন্যে কেউ দেখেনি।

    মাঠ ভাসলো, ঘাট ভাসলো, ভাসলো বাড়ির উঠান।

    ঘর আসলো বাড়ি ভাসলো, ভালো কাজীর কুশান।

    কিছু বাদ নেই। ঘরবাড়ি গোয়াল গরু সব। এমন কি মানুষও ভাসলো। জ্যান্ত মানুষ। মরা মানুষ।

    তাল গাছের ডগায় ঝােলান বাবুই পাখির বাসায়ও কিছুকালের জন্য পরম নিশ্চিন্তে ঘর বেঁধেছিলো পুঁটি মাছের ঝাঁক।

    রহমতগঞ্জ কুলাউড়া নিজামপুর ভেসে সব একাকার হলো।

    বুড়ো কাসেম শিকদার ছিলো কুলাউড়ার বাসিন্দা।

    বুড়ো আর বুড়ি। ছেলেপিলে ছিলো না ওদের। মাটির নিচে তে রাখা টাকা ভরা কলসিটা বুকে জড়িয়ে ধরে বানের জলে ভাসান দিলো বুড়ো আর বুড়ি।

    কলা গাছের ভেলায় চারদিন চার রাত। খাওয়া নেই, দাওয়া নেই। একেবারে উপোস।

    তেষ্টায় বুকের ছাতি ফেটে যাবার উপক্রম। ভেলা ভাসছে আর ভাসছে।

    অবশেষে এসে ঠেকল এই দীঘির পাড়ে।

    লাল পরীর নীল পরী আর সবুজ পরীর দীঘি।

    ছোটখাটো একটা পাহাড়ের মত উঁচু যার পাড়।

    গ্রামটা পছন্দ হয়ে গেল কাশেম শিকদারের।

    কলসী থেকে টাকা বের করে দুচার বিযে জমি কিনে ফেললো সে। গোড়াপত্তন হলো এ বাড়ির।

    বাড়ির চারপাশে আম কঁঠাল সুপুরি আর নারকেলের গাছ লাগালে কাশেম শিকদার। পুকুর কাটলো। ভিটে বাঁধলো। পছন্দ মত ঘর তুললো বড় করে। কিন্তু মনে কোন শান্তি পেলো না সে। ছেলেগুলে নেই। মারা গেলে কে দেখবে এত বড় বাড়ি।

    মাঝে মাঝে চিন্তায় এত বিভোর হয়ে যেত যে খাওয়া-দাওয়ার কথা মনে থাকতো না। তার। বুড়ি ছমিরণ বিবি লক্ষ্য করতেন সব। বুঝতেন কোন স্বামীর মনে সুখ নেই, চোখে ঘুম নেই, আহারে রুচি নেই। মনে মনে তিনিও দুঃখ পেতেন।

    তারপর, একদিন জলভরা চোখে স্বামীর পাশে এসে দাঁড়ালেন ছমিরণ বিবি।

    আস্তে করে বললেন, তুমি আর এক নিকা কর। বলতে গিয়ে বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো। তাঁর। দুগণ্ড বেয়ে অবিরাম পানি গড়িয়ে পড়ছিলো।

    তবু স্বামীকে নিজ হাতে সাজিয়ে দিলেন ছমিরণ বিবি। হাতে মেহেদি দিলেন। মাথায় পাগড়ি পরালেন। ঘরটা লেপে মুছে নিয়ে নিজ হাতে বিছানা পাতলেন স্বামী আর তার নতুন বিয়ে করা বউ-এর জন্য। আদর করে হাত ধরে এনে শোয়ালেন তাদের।

    নতুন বউ-এর কাঁচা হলুদ ঝলসানো দেহের দিকে তাকাতে সাহস পেলেন না ছমিরণ বিবি। ছটে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন। ছুরির তীক্ষ্ণ ফলা দিয়ে কে যেন তখন কলজেটা কুটিকুটি করে কাটছিল তাঁর। নিজেকে আর বেঁধে রাখতে পারলেন না তিনি। পুকুর পাড়ে ধুতরা ফুলের সমারোহ। গুনে শুনে চারটে ফুল হাতে নিলেন। তারপর ধীরে ধীরে সেগুলো মুখে পুরে দিয়ে নীরবে ঘুমিয়ে পড়লেন। দীঘির পাড়ে উঁচু ঢিপির মত তার কবরটা আজো চোখে পড়ে সবার আগে।

    ধপাস ধপাস ঢেঁকির শব্দে গমগম শিকদার বাড়ি।

    ঘুমে ঢুলু ঢুলু বউ দুটোর গা বেয়ে দরদর ঘাম নামে। এতক্ষণে রীতিমত হাঁপিয়ে উঠেছে ওরা। অ্যাঁচলটা কাঁধের ওপর থেকে নামিয়ে নিয়ে, সামনে হাত রাখার বাঁশের ওপরে গুটিয়ে রেখেছে দুজনে। মাঝে মাঝে তুলে নিয়ে বুক আর গলার ঘাম মুছে নিচ্ছে। ঘামে কাপড়টা চপ চপ করছে ওদের।

    সেদিকে খেয়াল নেই মকবুলের। ও ভাবছে অন্য কথা।

    বাড়ির ওপরের জমিটাতে লাঙ্গল না দিলে নয়। অথচ হাল যে একটা ধার পাবে সে সম্ভাবনা নেই। লাঙ্গল অবশ্য যা হোক একটা আছে ওর। অভাব হলো গরুর। গরু না হলে লাঙ্গল টানবে কিসে। আচ্ছা, এক কাজ করলে কেমন হয়। মকবুল ভাবলো, বউ দুটোকে লাঙ্গলে জুড়ে দিয়ে, দূর এটা ঠিক হবে না। লোকে গালাগাল দেবে ওকে। বলবে, দেহ বউ দুইড্যা দিয়া লাঙ্গল টানায়। তার চেয়ে এক কাজ করলে কি ভালো হয় না? না। বউদের দিয়েই লাঙ্গল টানাবে সে। দিনে নয়, রাতে। বাইরের কোন লোকে দেখবার কোন ভয় থাকবে না তখন। বউরা অবশ্য আপত্তি করতে পারে। কিন্তু ওসব পরোয়া করে না মকবুল। মুফত বিয়ে করে নি সে। পুরো চার চারটে টাকা মোহরানা দিয়ে এক একটা বিয়ে করেছে। হুঁ।

    ভাবছিলো আর সোনারঙ ধানগুলো ঢেঁকির নিচে ঠেলে দিচ্ছিলো মকবুল। হঠাৎ একটা তীব্র আর্তনাদ করে হাতটা চেপে ধরলে সে। অসতর্ক মুহূর্তে ঢেঁকিটা হাতের ওপর এসে পড়েছে ওর। আল্লারে বলে মুখ বিকৃত করলো মকবুল।

    টুনি আর আমেনা এতক্ষণে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো ঢেঁকির উপর। ঘোর কাটতে ছুটে নেমে এলো ওরা। ওদের কাছে এগিয়ে আসতে দেখে ওদের গায়ের ওপরে থুতু ছিটিয়ে দিল মকবুল, দূর-হ দূর-ই আমার কাছ থাইকা। বলতে গিয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় দাঁতে দাঁত চাপালো মকবুল।

    আমেনা বললো, দেহ কারবার, নিজের দোষে নিজে দুঃখ পাইল আর এহন আমাগোরে গালি দেয়। আমরা কি করছি।

    তোরা আমার সঙ্গে শতামি করছল। বলতে গিয়ে কেঁদে ফেললো মকবুল। তোরা দুই সতীনে ইচ্ছা কইরা আমার হাতে ঢেঁকি ফালাইছল। তোরা আমার দুশমন।

    হ্যাঁ দুশমনই তো। দুশমন ছাড়া আর কি। কাপড়ের অ্যাঁচল দিয়ে মুখের ঘাম মুছলো আমেনা।

    টুনি এগিয়ে গেলো ওর ফুলো হাতে একটা ভিজে ন্যাড়া বেঁধে দেয়ার জন্যে। লাফিয়ে তিন হাত পিছিয়ে গেলো মকবুল। দরকার নাই, দরকার নাই। অত সোয়াগের দরকার নাই। বলে একখানা সরু কাঠের টুকরো নিয়ে ওর দিকে ছুঁড়ে মারলো মকবুল।

    বিষ উঠছে নাহি বুড়ার? এমন করতাছে ক্যান। চাপা রোষে গজগজ করতে করতে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো টুনি। খোলা আকাশের নিচে এসে দাঁড়াতে ঠাণ্ডা বাতাসে দেহটা জুড়িয়ে গেলো ওর। হঠাৎ মনটা খুশিতে ভরে উঠলো। উঠোন থেকে মন্তুর ঘরের দিকে তাকালো ও। একটা পিদিম জ্বলছে সেখানে। একবার চারপাশে দেখে নিয়ে মন্তুর ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো টুনি।

    মাচাঙের ওপর থেকে কথা বালিশ নামিয়ে নিয়ে শোবার আয়োজন করছিলো মন্তু।

    টুনি দোরগোড়া থেকে বলে, বাহ, বারে।

    মন্তু মুখ তুলে তাকায় ওর দিকে। বলে, ক্যান কি অইছে?

    টুনি ফিসফিসিয়ে বলে, আজ যাইবা না?

    মন্তু অবাক হয়, কই যামু?

    টুনি মুখ কালো করে চুপ হয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, ক্যান ভুইলা গেছ বুঝি?

    মন্তুর হঠাৎ মনে পড়ে যায়। বেড়ার সঙ্গে ঝােলান মাছ ধরার জালটার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলে, অ- মাছ ধরতে।

    যাইবা না? সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে টুনি।

    মন্তু হেসে বলে, যা যামু। কিন্তু পরক্ষণে চিন্তিত হয়ে পড়ে সে, বুড়ো যদি টের পায় তাইলে কিন্তুক জানে মাইরা ফালাইবো।

    হঠাৎ ফিক করে হেসে দেয় টুনি। মারেরে ডরাও নাকি?

    মন্তু সে কথার জবাব না দিয়ে টুনি বলে, ভাত আইছ?

    না। তুমি খাইছ?

    হুঁ। তুমি গিয়া খাইয়া আস যাও। জলদি কইরা আইসো। বিছানাটা আবার গুটিয়ে রেখে। বেড়ার সঙ্গে ঝােলান জালটা মাটিতে নামিয়ে নেয় মন্তু।

    ও ঘর থেকে আমের ডাক শোনা যায়, টুনি বিবি কই গেলা, খাইতে আহ!

    আহি, বলে সেখান থেকে চলে যায় টুনি।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআর কত দিন – জহির রায়হান
    Next Article আরেক ফাল্গুন – জহির রায়হান

    Related Articles

    জহির রায়হান

    শেষ বিকেলের মেয়ে – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    আরেক ফাল্গুন – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    আর কত দিন – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    একুশে ফেব্রুয়ারী – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    কয়েকটি মৃত্যু – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    জহির রায়হান

    তৃষ্ণা – জহির রায়হান

    August 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.