Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ০৬-১০. গিরিডির কথা

    বুদ্ধদেব গুহ এক পাতা গল্প36 Mins Read0

    ০৬-১০. গিরিডির কথা

    ০৬.

    তুমিও সবসময় গল্প করতে গিরিডির কথা। মামারা কেউ এলে তো কথাই নেই। শালবন, উশ্রী নদী, খালী পাহাড়। উশ্রী নদীর তট, নদীতে পিকনিক, চাঁদনি রাতে। বাসন্তী পূর্ণিমার রাত্রে বসন্তোৎসব, তোমাদের স্কুলের বাংলার মাস্টারমশাই হিমাংশুবাবুর কথা, বড়োমামার কথা, গল্প করতে।

    তোমার ছেলেবেলায় বড়োমামার তখনও কবি হিসাবে প্রতিষ্ঠা হয়নি। কিন্তু তখনই তাঁর কবি-প্রতিভা স্বীকৃতি পেয়েছিল। তোমার পুরোনো দাইয়ের কথা, তোমার যে একটা ছোট্ট সাদা পোষা-ভেড়া ছিল, সেই ভেড়াটার কথা। দাদুর কথা, দিদিমার কথা, সাঁওতালি গ্রামের শীতের রাতের মাদলের আওয়াজের কথা, তোমার কাছে সেইসব গল্প শুনতে শুনতে ছেলেবেলা থেকে কল্পনার জগতের যে চিত্রকল্প আমার মস্তিষ্কে প্রবেশ করেছিল, সেইসব ছবি আমৃত্যু বয়ে বেড়াতে হবে আমাদের।

    বাবার স্বাধীন পেশা শুরু করার বছর তিন-চার পর একবার কোডারমা গেলাম আমরা সকলে মিলে। খ্রিশ্চান মাইকা কোম্পানির একটা অতিথিশালা ছিল শিবসাগরে। কোডারমা স্টেশন থেকে বেশকিছুটা গাড়িতে গিয়ে তবে মাইকা কোম্পানির চত্বরে পৌঁছোনো যেত। ভারতীয় মালিক সবে ইংরেজ মালিকদের কাছ থেকে সেই কোম্পানি কিনেছেন। পেশার সূত্রে সেই মালিকদের সঙ্গে বাবার যোগাযোগ ছিল। সেই অতিথিশালা, পাঁচ-নম্বর বাংলোটি কী যে চমৎকার ছিল!

    একতলা মার্বেল মোজাইকের বাংলো, প্রায় দুশো বিঘে মতন নিয়ে তার হাতা, পেছনে শালবন, সামনে নুড়ি ঢালা রাস্তা, কেয়ারি-করা ফুলের বাগান। বিকেলবেলা সহিস ঘোড়া সাজিয়ে আনত আমাদের ঘোড়া চড়াবার জন্যে। শিকার যাত্রার জন্য একটা জিপ এবং একটা ওয়েপন ক্যারিয়ার সবসময় তৈরি হয়ে থাকত, আর থাকত দুটি প্রাইভেট গাড়ি।

    বাবুর্চিখানার দেখাশোনার জন্যে একজন শিক্ষিত ভদ্রলোক ছিলেন, স্টুয়ার্ডের কাজ করতেন তিনি। লম্বা দাড়িওয়ালা মুসলমান বাবুর্চি। কী ভালোই যে রান্না করত তারা।

    বিকেলে চায়ের সঙ্গে হান্টি পামার বিস্কিট দিত। সে বিস্কিট তখন আসত বিলেত থেকে! কতরকম স্বাদ ও চেহারার যে হত হান্টি পামার বিস্কিট তা যারা না খেয়েছেন তারা জানেন না।

    তুমি বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে সারাদিন আনন্দে শালবনের দিকে তাকিয়ে থাকতে আর আমাকে বলতে, জানিস খোকন আমাদের গিরিডির বাড়ির পেছনে যে শালবনটা ছিল ঠিক এইরকম দেখতে। সবুজ শালবন, কালো পাথর, টিয়ার ডাক, নীলকণ্ঠ পাখির নীল আকাশের মধ্যে কাঁপতে কাঁপতে উড়ে যাওয়া সব একরকম।

    বড়ো ভালো লেগেছিল তোমার কোডারমায় গিয়ে।

    একদিন বিকেলে, মনে আছে; মেঘ করে এল। এপ্রিল মাস। পয়লা বৈশাখের কাছাকাছি, আগে কী পরে মনে নেই। সমস্ত আকাশ কালোমেঘে ঢেকে গেল, তারপর ঝড় উঠল, শুকনো পাতা উড়িয়ে ঘুরিয়ে নাচিয়ে। ঝড়ের পরেই নামল বৃষ্টি, ফোঁটা ফোঁটা, তারপর না বৃষ্টি, না-রোদ, না-মেঘ, না-আলো সব মিলেমিশে কী এক অদ্ভুত অনির্বচনীয় নৈসর্গিক দৃশ্য হল। সেকথা মনে পড়লে আজও আমার গায়ে আনন্দের কাঁটা দেয়। আমি আর তুমি পাশাপাশি বসে সেই আশ্চর্য অদৃষ্টপূর্ব দুর্লভ দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকতাম।

    তুমি নিঃশ্বাস ফেলে বলতে, আহা! ভগবানের কী লীলা!

    তুমি প্রায়ই বাবাকে বলতে তারপরে, অনেক তো তুমি বড়োলোক হলে, বাড়ি করলে, গাড়ি করলে, এতকিছু করলে, এবার আমাকে বিহারের সাঁওতাল পরগনায় লালমাটি আর শালবনের মধ্যে একটা ছোট্ট বাংলো করে দাও। শেষজীবন আমি সেখানেই কাটাব।

    বাবা বলতেন, এসব কবি-কবি ভাব রাখো তো। বাইরে বাড়ি মানেই খরচ। প্রত্যেক মাসে মাসে মালির মাইনে মানি-অর্ডার করে পাঠানো। বাঙালি বোকারাই খালি বাইরে বাড়ি বানায়।

    তুমি শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে, দাও-না বাবা, আমার জন্যে না-হয় একটু খরচ করলেই।

    বাবা বলতেন, ছেলেমানুষি কোরো না।

    বাবা যা বলতেন, ঠিকই বলতেন, সে বিষয়ে কোনো ভুল ছিল না। তবে তুমি যা বলতে তাও আন্তরিকতার সঙ্গেই বলতে।

    অন্য দশজন মেয়ের মতো তুমিও জাগতিক ব্যাপারে অবুঝ ছিলে, বাবার মতো প্র্যাকটিক্যাল লোকের পক্ষে তোমার এই ইমপ্র্যাকটিক্যাল শখ পূরণ করা সম্ভব ছিল না।

    একথাটা আমার মনে ছিল।

    বড়ো হবার পর আমি যখন নিজে রোজগার করতে আরম্ভ করি, ঘটনাচক্রে বিহারেরই শালবন, লালমাটি, কালো পাথরে-ভরা একটি স্বল্পখ্যাত জায়গায় একটি ছোট্ট বাংলোর খোঁজ পাই। সে বাংলোটি ছিল এক স্কচ সাহেবের। তিনি সেটি বিক্রি করে দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানেই বসবাস করার ইচ্ছায়।

    ছেলেবেলা থেকেই তোমার মুখে তোমার কল্পনার বাড়ির যে বর্ণনা শুনেছিলাম, পরিবেশের যে বর্ণনা শুনেছিলাম, তারসঙ্গে সেই জঙ্গল পাহাড়বেষ্টিত ছোট্ট জায়গাটির বড়ো মিল ছিল।

    কিন্তু আমি তোমাকে আগে না দেখিয়ে সেই বাংলো কিনতে চাইনি।

    একদিন যখন তোমাকে আর ছোটোমাসিকে নিয়ে রাঁচি এক্সপ্রেসে ভোরবেলায় শীতের সকালে রাঁচিতে নেমে ট্যাক্সি নিয়ে সে জায়গাটার দিকে রওনা হলাম, তখন থেকে তোমার আনন্দ আর কে দেখে!

    পনেরো মিনিটের মধ্যেই আমরা রাঁচি শহর ছেড়ে লোহার ডাগার রাস্তায় পড়লাম। পথের পাশে কড়াইশুঁটির খেত, সরষে লেগেছে একদিকে, হলুদে হলুদ হয়ে গেছে মাঠ, কোথাও বা সরগুজা। দূরে কিতারীর ফিকে হলুদ-সবুজ খেত দেখা যাচ্ছে। সকালের প্রথম রোদে রোদ পোয়াচ্ছে গাঁয়ের লোকেরা। লাটাখাম্বায় ক্যাঁচোর-কোঁচোর শব্দ করে জল তুলছে কুয়ো থেকে লাল শাড়ি পরা দেহাতি মেয়ে।

    তুমি বললে, আহা রে! যেন মনে হল গিরিডিতে এসেছি।

    প্রায় দেড়ঘণ্টা গাড়িতে যাবার পর যখন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কাঁচারাস্তা দিয়ে ট্যাক্সিটা হাঁপাতে হাঁপাতে এসে লালধুলো মেখে সেই বাংলোর সামনে দাঁড়াল, আমি বললাম, মা চলো, বলে, ট্যাক্সি থেকে নামিয়ে সেই বাংলোটার মধ্যে তোমাকে নিয়ে গেলাম।

    বললাম, দেখো মা, তোমার যদি পছন্দ হয়, তাহলেই কিনব, নইলে কিনব না।

    তুমি দেখে বললে, আহা। কী ভালোরে খোকন! কিনে ফেল, কিনে ফেল! বড়ো ভালো লাগবে আমার।

    সে বাংলোর দরদাম নিয়ে আরও একটু বিতর্ক করা যেত। তুমি বললে, আহা, সে বেচারিরা বিপদে পড়ে সস্তায় বিক্রি করে দিয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে, এইসময় দর করিস না, এতে ভগবান পাপ দেবেন। ওরা বেশি তো চায়নি। ওরা যা চায়, তাই দিয়ে দে।

    আমি বললাম, ঠিক আছে। তোমার কথাই রাখব।

    সে বাংলো কেনা হল। বাবা নিজে গিয়ে থেকে দু-মাস বাংলো সারিয়ে সাজিয়ে-গুছিয়ে সুন্দর করে দিলেন।

    তুমি যখন সেখানে গিয়েছিলে, তখন বড়ো কষ্ট করেই ছিলে। তখন কোনো আসবাব কেনা হয়নি। খাওয়া-দাওয়ার বড়ো অসুবিধা ছিল। অসুবিধা ছিল অনেক কিছুর। তখন একটা ন্যাড়াবাড়িতে যতরকম অসুবিধা থাকা সম্ভব। সবরকম অসুবিধা তুমি সহ্য করেছিলে। পরে সেই বাংলোতে যতটুকু আসবাবপত্র না-নইলে নয় মোটামুটি, জঙ্গলের মধ্যে তাই দিয়ে সাজিয়ে-গুছিয়ে রেখেছিলাম। রান্নার লোকের বন্দোবস্ত ছিল। মালি ছিল। সবরকম মাঝামাঝি আরামের বন্দোবস্ত ছিল। অথচ তখন তুমি এতই অসুস্থ হয়ে পড়লে যে, সাজানো-গোছানোর পর একদিনও তুমি সেখানে গেলে না।

    তোমার মতো মায়েদের পক্ষে কোনোদিনও স্বার্থপর হওয়া তো সম্ভব হত না। যখনই তোমাকে জোর করেছি, এবার যেতেই হবে, আমার সঙ্গে চলো, আমি যাচ্ছি। তখনই তোমার হাজাররকম অসুবিধা। কখনো বাবার শরীর খারাপ, কখনো ভাইদের শরীর খারাপ, কখনো কোনো বন্ধুমাতা আসন্ন-প্রসবা, কখনো তোমার নাতি-নাতনির অসুবিধা হবে তুমি চলে গেলে, ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি।

    তোমার অসুবিধার শেষ ছিল না, তুমি সংসারের মধ্যে শেষজীবনে এমনভাবে মমতার শিকড় ও সে শিকড়ের শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে দিয়েছিল, হয়তো নিজের অজানিতেই যে, তোমাকে সেই শিকড় এবং শিকল ছিঁড়ে বের করে নিয়ে যাওয়াই এক সমস্যা ছিল।

    অথচ তুমি সবসময়েই শেষের দিকে বলতে, আমার বড়ো কষ্ট হয় রে, ঘর-সংসার করতে ভালো লাগে না।

    অথচ তোমার চরিত্রে এমন কিছু ছিল না, যে তুমি সংসার ছেড়ে দাও, তোমার ছেলে মেয়েরা ভালোভাবে খেতে পেল কি পেল না, এ নিয়েও তোমার চিন্তার অন্ত ছিল না। তারা কী খেল এবং আদৌ খেল কি না এসব ছিল তোমার ব্যক্তিগত দায়িত্বর ব্যাপার। বাড়িতে দাসদাসী যতই থাকুক না কেন। যদিও ছেলে-মেয়েরা প্রত্যেকেই অনেক বড়ো হয়ে গেছিল সকলেই, প্রত্যেকেই বিবাহিত, প্রত্যেককেই দেখার লোকজন ছিল তবুও।

    যদিও তুমি পাঁচ-সাত-দশ দিন না থাকলে বাবার কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা ছিল না, কারুরইতেমন কিছু অসুবিধা ছিল না তুমি না থাকলে; কিন্তু তুমি না থাকলে কারুর যদি কিছু অসুবিধা হয়, এই ভেবে ভেবে তুমি নিজের জীবনে সুখ কখনো ছিনিয়ে নিতে পারলে না।

    তুমিও চলে গেলে, আমার কাছে সেই বাংলোর আকর্ষণও বুঝি সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে গেল।

    আমায় ঘনিষ্ঠ অন্য কেউই জানে না সেই জঙ্গলের পর্ণকুটির কেনার ইতিহাস। কার ভালো লাগবে, কে গিয়ে থাকবে বলে তা কিনেছিলাম।

    যখন দেখলাম, ওই জঙ্গলে না-ডাক্তার, না-হাসপাতাল, না-তোমার শারীরিক অবস্থা এমন, যে তুমি সেখানে গিয়ে বেশিদিন থাকতে পারো, তখন থেকেই ভাবছিলাম যে, এই বাংলো রেখে লাভ কী?

    তারপর তো তুমি হঠাৎ চলেই গেলে। মাত্র বাষট্টি বছর বয়েসে, তোমার চলে যাবার পর সে বাংলোর আর কোনো প্রয়োজন আমার কাছে ছিল না। তাই তা হস্তান্তর করে ফেললাম। হস্তান্তরের কারণও গোপনই রইল।

    যে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসত বাংলোটিকে, সেই বাংলোর পরিবেশকে, ঝুমকো জবার গাছটিকে–যে গাছে হাজার হাজার জবা ফুটত, সেই তুমিই যখন নেই, তখন ওই বাংলোর কোনো দামই ছিল না আর আমার কাছে।

    .

    ০৭.

    ছেলেবেলায় যখন আশপাশের বাড়ির মাসিমারা তোমার সঙ্গে গল্প করতে আসতেন অথবা আমাদের কোনো আত্মীয়-স্বজন আমাদের বাড়িতে আসতেন এবং তোমার সঙ্গে গল্প করতেন, তখন আমরা ছোটোরা কাছে থাকি, তুমি তা একেবারেই পছন্দ করতে না।

    অথচ এও মনে পড়ে না যে, তুমি কখনো বাইরের লোকের সামনে আমাদের বকেছ। চোখ তুলে আমার দিকে তাকালে তোমার চোখে কী লেখা আছে তা বুঝতে পেতাম এবং নিঃশব্দে ঘর থেকে বাইরে চলে যেতাম অন্য ঘরে। আমার মনে পড়ে না তুমি কখনো আমাকে মেরেছিলে। তোমার কাছে বকুনিও খুব বেশি খাইনি। না বকে, না মেরে, কী করে শাসন করতে হয়, তুমি তা ভালোভাবেই জানতে।

    আমাদের বাড়িতে তখন রেডিয়ো ছিল না, তখনকার দিনে রীতিমতো অবস্থাপন্ন লোকের ঘরেই রেডিয়ো থাকত। আজকালকার মতো রেডিয়ো, ট্রানজিস্টার, টিভি-র বহুল প্রচার হয়নি। হয়তো এত সস্তাও ছিল না। টাকার অঙ্কে হয়তো আজকের মতো দাম ছিল না। কিন্তু তখনকার দিনে সেই টাকার অঙ্কের মূল্য ছিল বহু বহুগুণ বেশি।

    দুপুরবেলায় আমাদের বাড়ির সেই পেছনের মাঠে যখন মুসলমান ধুনুরি তার সবুজ চেক চেক লুঙ্গি পরে হাঁটু গেড়ে বসে তুলো ধুনত প্রিং-প্রিং করে শব্দ করে, আর তুলোর নরম হালকা আঁশ উড়তো হাওয়ায় হাওয়ায়, তখন মাঠের ওই পাশের বাড়ি থেকে রেডিয়োতে কাননদেবীর গান ভেসে আসত, হারা মরু নদী, ক্লান্ত দিনের পাখি।

    দুপুরবেলায় অনুরোধের আসর শুনতাম আমি, আমাদের পুবের জানলার তাকে বসে। এত আওয়াজ ছিল না তখন কলকাতায়। এত লোক ছিল না। এত ট্রাম, এত বাস, এত গাড়ি, এত ফিরিওয়ালা কিছুই ছিল না। তখন অনেক দূরের কোনো বাড়িতে রেডিয়ো বাজলেই সে আওয়াজ অতিসহজেই অন্য বাড়ি থেকে শোনা যেত।

    মহালয়ার ভোরে পাড়াতে অল্পসংখ্যক রেডিয়ো থাকা সত্ত্বেও শুধু আমাদের পাড়াই নয়, সমস্ত কলকাতা শহরই গমগম করে উঠত শ্রীশ্রীচন্ডীর আরাধনায়।

    একবার পুজোর আগে আগে, বোধ হয় মহালয়ার দিন সাতেক আগে দীপালির ভাই দিলীপ হঠাৎ বলল যে, ওর বাবা একটা রেডিয়ো কিনছেন।

    কী কারণে মনে নেই আজ; ওর সঙ্গে আমার মনোমালিন্য হওয়াতে ও আমাকে বলল, ঠিক আছে আমার সঙ্গে তুই ঝগড়া করলি? আমাদের বাড়িতে রেডিয়ো আসুক, তোকে আমি শুনতে দেব না।

    সে কথা তোমাকে বলাতে তুমি বললে, তুমি ওদের বাড়ির রেডিয়ো শুনতে চেয়েছ কেন? আর তুমি তো বোকা। যদি দোতলায় রেডিয়ো বাজে, তুমি তো এমনিতেই একতলা থেকে শুনতে পাবে। এ নিয়ে অশান্তির কী আছে?

    দিলীপের বাবা যদি রেডিয়ো কেনেন, তবে আমার বাবা কেন রেডিয়ো কিনতে পারেন না এই প্রশ্ন করেছিলাম তোমাকে।

    তুমি প্রথমে এর কী উত্তর দেবে ভেবে পাওনি। তারপর বলেছিলে, সবাই কি সব কিনতে পারে? না সকলের সব থাকে? তোমরা তো কত ভালো আছ খোকন। তোমাদের কত আত্মীয়-স্বজন, এই পাড়াতেই তোমার কত বন্ধু-বান্ধব আছে, যারা তোমার চেয়েও অনেক অসুবিধায় থাকেন।

    তুমি বলতে, সবসময় নীচের দিকে তাকিয়ে। ওপরের দিকে তাকাবার কোনো শেষ নেই।

    সেদিন কথাটা সামান্য শুনিয়েছিল কিন্তু আজ বুঝি যে, কথাটা আদৌ সামান্য ছিল না।

    তুমি আরও বলতে, যাদের সবই আছে, যাদের বাবা মায়েরা যাদের সবকিছুই দিয়ে দিয়েছেন, তাদের নিজেদের তো করে নেবার মতো কিছু বাকি থাকে না। বেশ তো, তোমাদের অনেককিছু নেই, অন্যদের আছে। তুমি বড়ো হও, ভালো করে লেখাপড়া শেখো, তারপরে তুমি সবকিছু নিজে করে নেবে। নিজের জিনিস নিজে করবে, সেটা কত বড়ো আনন্দের কথা। বাবা এনে দিলে তো বাবাই দিলেন। তুমি নিজে করার আনন্দ কি বাবা কিনে দেওয়ার আনন্দের চেয়ে অনেক বড়ো নয়?

    বয়েসের অনুপাতে সকলেরই আত্মসম্মান জ্ঞানটা বাড়ে না। তখন ওই বয়সে অত কিছু বোঝার মতো ধৈর্য আমার ছিল না। কিন্তু পরে বুঝেছিলাম, আজকে বুঝি যে, সেই সাধারণভাবে খেলার ছলে বলা কথাগুলি কত গভীর।

    আমি আর আমার ক্লাস-থ্রির বন্ধু শিবু, দুজনে যখন স্কুল থেকে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরতাম জলযোগের সামনে দিয়ে, তখন প্রায়ই আমাদের একই আলোচনা হত।

    জলযোগ-এর দোকানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা প্রকান্ড ছবি ছিল। হাতে-আঁকা। পাশে লেখা ছিল যে, তিনি পয়োধি পরীক্ষা করে দেখেছেন এবং অত্যন্ত তৃপ্ত হয়েছেন।

    শিবু বলত, এর চেয়ে বাজে কথা হতেই পারে না।

    আমি বলতাম, কেন?

    শিবু বলত, অত বড়ো দাড়ি গোঁফ নিয়ে কেউ কখনো দই খেতে পারে? সমস্ত দই তো গোঁফে দাড়িতেই লেগে যাবে।

    আমি ওর কথায় ভীষণ চিন্তায় পড়ে যেতাম।

    এ ছাড়াও আমরা যে-বিষয়ে প্রায়-ই আলোচনা করতাম, তা হল হঠাৎ যদি আমাদের কেউ অনেক টাকা দিয়ে দেয় অথবা লটারিতে টাকা পাই, তাহলে জলযোগে ঢুকে আমরা কোন কোন মিষ্টি খাব। আমার সঙ্গে শিবুর রসগোল্লা সম্বন্ধে মত মিলত, আর কোনো ব্যাপারেই মিলত না।

    শিবু বলত, মিছিমিছি আলোচনা করে কী লাভ বল? টাকা পেলে তবে তো খাব? যতদিন না পাচ্ছি, ততদিন আর এমনি এমনি আলোচনা করে লাভ নেই। কাল থেকে, বুঝলি, আর আমরা ডানদিকের দোকানে তাকাবই না। কিন্তু আবার পরদিন সেই একই আলোচনা আমাদের করতে দেখা যেত।

    আমার বড়োপিসেমশাই যখন অসম থেকে আসতেন কলকাতায় এবং আমাদের বাড়িতে উঠতেন, তখন আমাদের খুব আনন্দ হত।

    বড়পিসেমশাইয়ের অবস্থা খুব ভালো ছিল। কিন্তু অবস্থা ভালো থাকলেই মানুষের মন বড়ো হয় না। পিসেমশাই কিন্তু ব্যতিক্রম ছিলেন। এমন আমুদে হাসিখুশি, এমন দরদি ছিলেন যে, তাঁকে ভালোবাসত না এমন কেউই বোধ হয় ছিল না।

    আমার ছোটোপিসেমশাইও কলকাতায় থাকতেন এবং যখনই তাঁর তখনকার বেহালার বাড়িতে যেতাম, আমাদের বড়োই আদর যত্ন করতেন। নিজে বাজারে যেতেন আমাদের জন্যে। ছোটোপিসিমার অনুপাতের জ্ঞানটা কম ছিল। একসঙ্গে আটটা দশটা ডিম দিয়ে ওমলেট বানিয়ে বলতেন, ছেলেমানুষ! খেয়ে ফেলে। এই অনুপাত জ্ঞানের অভাবেই একবার ছটোপিসিমার প্রাণ সংশয় হয়েছিল। ভালো ফল হওয়ার জন্যে একসঙ্গে দশটি জোলাপের বড়ি খেয়ে ফেলে তাবৎ আত্মীয়-স্বজন মহলে খবরের সৃষ্টি করেছিলেন একবার।

    বড়োপিসেমশাই যেহেতু এখানে থাকতেন না, উনি এলে যেন বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে যেত।

    তুমি কোন সিনেমা দেখতে যাবে, বাবা চিতলমাছের পেটি ভালোবাসেন না কইমাছ? আমরা কে কী খেতে ভালোবাসি, এইসব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে বড়োপিসেমশাই আমাদের কলকাতার নিস্তরঙ্গ জীবনে বিরাট বিরাট ঢেউ তুলতেন।

    যেবার প্রথম আমরা বড়োপিসিমার বাড়িতে যাই অসমে, সেকথাও পরিষ্কার মনে আছে। তারপরেও বহু বহুবার গেছি সেখানে, সেই প্রথমবারের যাবার কথা বোধ হয় কোনোদিনই ভুলব না। বাবা কাজের জন্য যেতে পারেননি। আমরা একাই গেছিলাম।

    পার্বতীপুর জংশন বিরাট বড়ো জংশন। সে স্টেশনে গাড়ি বদল করে, উত্তরবঙ্গ পেরিয়ে অসমের পরে কোকরাঝাড় বলে একটা ছোট্ট ঘুমন্ত স্টেশনে আমরা ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম। সিমেন্ট বাঁধানো প্ল্যাটফর্ম নয়, খোয়ার প্ল্যাটফর্ম। এক শীতের শেষবিকেলে সেই জঙ্গলবেষ্টিত ছোট্ট স্টেশনে লালপাড়ের কালোশাল গায়ে দাঁড়িয়ে থাকা, অল্প-ঘোমটা টানা তোমার সুন্দর মুখের ভাবটি আজও আমার মনে আঁকা আছে। মাঝে মাঝে স্বপ্নে দেখি।

    গভীর জঙ্গলের মধ্যে স্টেশন, স্টেশন মাস্টারের ছোট্ট ঘর, তাতে টিমটিম করে লণ্ঠন জ্বলছে। স্টেশনের পাশেই ছোট্ট লেভেল-ক্রসিং। ধূলি-ধূসরিত কাঁচারাস্তা চলে গেছে গভীর থেকে গভীরতর জঙ্গলের মধ্যে। বিরাট বিরাট শাল আর সেগুনের গাছ, আরও কত নাম-না জানা গাছ, জার্মান জঙ্গলের গায়ের কটু ও উগ্র গন্ধ শীত-সন্ধ্যার সেগুন গাছের গায়ের গন্ধের সঙ্গে মিশেছিল। তারসঙ্গে মিশেছিল মোষের গাড়ির মোষের গায়ের গন্ধ।

    আমরা যেতেই পিসেমশাই যে মোষের গাড়ির সঙ্গে গাড়োয়ান এবং অন্য একজন লোককে আমাদের আনতে পাঠিয়েছিলেন, তারা হই হই করে এসে আমাদের মালপত্র সব তুলে নিয়ে বয়ে নিয়ে চলল। মোষ জোড়া হল গাড়িতে। ছইয়ের নীচে মোটা করে খড় পাতা, তার ওপরে বিছানা বিছানো। পায়ের ওপর বিছিয়ে রাখা কম্বল। গাড়ির পেছন দিকে গাড়ির নীচে লণ্ঠন ঝুলছিল একটা, আর ছইয়ের ওপর থেকে আর একটা লণ্ঠন জ্বলছিল ভেতরে।

    গাড়ি চলতে শুরু করল। একডেকচি ভরতি ডিম সিদ্ধ, আর একঝুড়ি আসামি কমলালেবু -পথের খোরাকি হিসেবে সঙ্গে পাঠিয়েছিলেন পিসেমশাই। আমরা নুন-গোলমরিচ দিয়ে ডিমসিদ্ধ আর কমলালেবু ছাড়িয়ে খেতে খেতে অন্ধকার জঙ্গলের পথ দিয়ে চললাম তামাহাটের দিকে।

    কাঁচা লালমাটির পথ দিয়ে ক্যাঁচোর-কোঁচোর করে চলতে লাগল মোষের গাড়ি। সে কী গভীর বন। দিনমানেই অন্ধকার থাকে।

    যেতে যেতে পথে একটা সরু নদী পড়ল। জল থেকে ঠাণ্ডা ধোঁয়া বেরোচ্ছিল। জলজ গন্ধ, আর নদীর কুলকুল আওয়াজ বনপথ ভরে রেখেছিল। মোষের গাড়ি তার ওপর দিয়েই পার হবে বলে নেমে পড়ল। নদীতে সবে গাড়িটা নেমেছে এমন সময় মোষ দুটো ভীষণ জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে শিং নাচিয়ে উঠল।

    গাড়োয়ান হঠাৎ বলে উঠল, বাঘ, বাঘ!

    গাড়োয়ানের শাগরেদ যে ছোকরা তার পেছনেই বসেছিল সে বলল, মেলা বাঘ!

    আমরা ছইয়ের মধ্যে দিয়ে ভয়ে ভয়ে উঁকি মেরে দেখি, নদীর ডানদিকে যেখানে ছায়া আরও ঘন, সেখানে দুটি বিরাট বিরাট লাল লাল গোল চোখ মোষ দুটোর দিকে তাকিয়ে আছে।

    সঙ্গের সেই লোকটি ও গাড়োয়ান কীসব দুর্বোধ্য ভাষায় খুব জোরে চেঁচামেচি শুরু করে দিল।

    আমাদের বলতে হল না, আপনা থেকেই গলা দিয়ে যেন নানারকম কম্পমান সুর বেরিয়ে আসতে লাগল বিভিন্ন গ্রামে।

    মোষ দুটো নাকে ভোঁস ভোঁস করে আওয়াজ করতে লাগল আর তাদের বিরাট বিরাট শিং দুটো ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে মাথা এদিক ওদিক করতে লাগল। গাড়ি থেকে মোষজোড়া ছুটে যায় আর কী!

    কিন্তু সেই লাল চোখ দুটো একটুও নড়ল না। যেখানে ছিল, সেখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

    অনেকক্ষণ পর, কতক্ষণ পরে মনে নেই, আস্তে আস্তে সেই চোখ দুটো নদী ছেড়ে উঠে ঘন অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল।

    রাতের কোন প্রহরে যে গিয়ে পৌঁছোলাম, সেকথা এখন আর মনে পড়ে না। ছেলেবেলায় সন্ধেরাতকেই গভীর রাত বলে মনে হয়। তবে একথা পরিষ্কার মনে পড়ে যে, পরদিন ভোরবেলা থেকে এক নতুন অনাবিল প্রাকৃতিক জগতে প্রবেশ করলাম।

    .

    ০৮.

    তুমি যেন সংসারের জোয়াল থেকে ছাড়া পেয়ে কেমন অন্যরকম হয়ে যেতে। তোমার চোখের ভাব স্নিগ্ধতর হয়ে উঠত, সব সময় তুমি হাসতে আর আমাদের বলতে, খোকন, তোমরা বেশি দুষ্টুমি কোরো না যেন।

    পিসেমশাই ও পিসিমা আদর যত্নের কোনোই ত্রুটি রাখতেন না। সকালবেলায় আমাদের প্রাতরাশ হত খেতের চালের সুগন্ধি ফেনা ভাত ডিমসিদ্ধ ও আলু দিয়ে। তারপর বেরিয়ে পড়তাম এদিকে ওদিকে।

    কলকাতার শিশুর জন্যে অসমের সেই গোয়ালপাড়া জেলার ছোট্ট অখ্যাত গ্রামটিতে যে কত-না-কত আশ্চর্য এবং ভরন্ত ভালোলাগা অপেক্ষমাণ থাকত, সেকথা আজকে মনে করে অভিভূত বোধ করি।

    সেই তামাহাট গ্রামের পাশ দিয়ে চলে গেছে গঙ্গাধর নদী, তিস্তার সঙ্গে যার যোগ ছিল। নদীর পারের মাঠ, ঝোঁপ-ঝাড়, গাছগাছালি, পাখির ডাক, রাখাল ছেলের বাঁশির তান সব যেন স্পষ্ট মনে পড়ে। মনে পড়ে হলুদ ফিনফিনে প্রায় স্বচ্ছ ডানায় রোদ চমকানো ফড়িংদের ঝাঁক বেঁধে ওড়া, মনে পড়ে নদীর জল থেকে সাঁতরে উঠে উদবেড়ালদের অন্য পারের বালির ওপর শরীরের জলের ছাপ রেখে গর্তের মধ্যে ভিজে শরীরে আস্তে আস্তে ঢুকে যাওয়া।

    নদীর মধ্যে বিরাট বিরাট চর ছিল। শীতকালে সেই চরে বেদেরা ঘর বেঁধে থাকত। চিতাবাঘে এসে তাদের গোরু, ছাগল, বেতোঘোড়া কখনো-সখনো নিয়ে যেত। নরম সাদা ফুলঝুরির মতো কাশের বন, ধুধু-সাদা দুধলি ঘাস, নীল আকাশ, আর তার পটভূমিতে গাঢ় নীল হিল্লোলিত প্রবহমান জলরাশি–সব মনে পড়ে।

    পিসিমার বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া ছিল বিরাট বাগান, চাপ চাপ ঘন-সন্নিবিষ্ট কচিকলাপাতা সবুজ ঘাসের মাঠ। রঙ্গন, কাঠ-টগর, সজনে, হলুদ রাধাচুড়ো এবং ঝুমকো জবার ডালে বসে টুনটুনি, বুলবুলি, রং-বেরঙের মৌটুসি পাখিরা সকাল থেকে ফিসফিস করে কত কী বলত।

    খাটাশ এসে হানা দিত মাঝে মাঝে, পাখির বাচ্চা ধরত বাগানের গাছে উঠে, নয়তো মুরগির খাঁচা থেকে মুরগি নিয়ে পালিয়ে যেত।

    সপ্তাহে একদিন করে হাট বসত তামাহাটে। সপ্তাহের কোনদিন তা আজ মনে নেই। সেই হাটের কথা এ-জীবনে ভোলার নয়। সকাল থেকে গোরুর গাড়ির পর গোরুর গাড়ি এসে জমা হত দূর দূর গ্রাম থেকে। গোরুর গাড়িতে বোঝাই হয়ে আসত কমলালেবুর ঝুড়ি আর মহাশোল মাছ। সে মাছের যেমন চেহারা; তেমন স্বাদ। বড়ো বড়ো আঁশ, পাথালি করে রাখলে গোরুর গাড়ির এপাশ-ওপাশ ভরে যেত এক একটা মাছে।

    বেতোঘোড়ায় চেপে আসত দূরের বাগডোগরা গ্রাম থেকে মুনসের মিয়া। গ্রামের মোড়ল। তার লাল-সাদা ঘোড়াটিকে সে পিসেমশাইয়ের গদি-ঘরের বারান্দার খোঁটার সঙ্গে বেঁধে রাখত। মুনসের মিয়ার সাদা দাড়ি, মাথায় ফেজ টুপি, পরনে কুর্তা আর লুঙ্গি।

    সে এসে গদিঘরের দাওয়াতে বসে পিসেমশাইয়ের সঙ্গে গল্প করত আর আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে সেসব গল্প শুনতাম। তার কথার মধ্যে দিয়ে এক সম্পূর্ণ অজানা অনামা জগতের ছবি আমার মগজে এসে বাসা বাঁধত।

    সারাদুপুর হাটের মধ্যে ঘুরে বেড়াতাম। নরম খড়কুটো মেশা ধুলোর গন্ধ, চাষাদের গায়ের ঘামের গন্ধ, কেরোসিন তেলের গন্ধ, ঝোলা গুড়ের গন্ধ, মাছের গন্ধ, পাঁঠার গায়ের গন্ধ, গোরু মোষের গায়ের গন্ধ, ঝাল-বিস্কুটের গন্ধ, মুড়ির গন্ধ, চিঁড়ের গন্ধ, নতুন চালের গন্ধ, গন্ধে গন্ধে গন্ধময় হয়ে উঠত সমস্ত দুপুর।

    তারই মধ্যে আসত একটি দুটি মোটর ভ্যান, বিড়ি কোম্পানির বিজ্ঞাপন অথবা টর্চের ব্যাটারির বিজ্ঞাপন করত তারা চোঙা-বসানো কলের গান নিয়ে। গান বাজত উচ্চগ্রামে। সেকালের ফিলমের গান। সেসব গান আজকাল সেই দুপুরবেলার হাটের মিশ্র গন্ধের মতোই তামাদি হয়ে গেছে। সে গান আর কেউই গায় না। সেসব গান আর কারও মনে নেই।

    কোনো কোনো দিন পিসেমশাই তাঁর বন্দুক নিয়ে আমাদের সকলকে সঙ্গে করে গঙ্গাধর নদী বেয়ে নৌকোয় করে চলে যেতেন তিস্তার কাছে। সেখানে তিস্তাটা কী সুন্দর! শীতের তিস্তা। তার শাখা-প্রশাখা, কাঁচের মতো স্বচ্ছ জল, তার নীচে নানা-রঙের নানা আকারের নুড়ি, আর সোনালি রঙের চরের পাশে বসে-থাকা লাল-মাথা, রেড-হেডেড পোচার্ড হাঁস। কোথাও বা চখাচখির ঘন সোনালি রঙে আকাশ সোনালি হয়ে যেত। অন্যদিকে কালো-সাদা রাজহাঁসের দল তাদের হলুদ পা ও বিরাট বিরাট ডানায় রোদকে আড়াল করে কোঁয়াক কোঁয়াক আওয়াজ করে তাদের ধীরমন্থর শ্লথ উড়াল ঢঙে কোন অজানা দেশের পানে পাড়ি দিত।

    একবার মনে আছে আমরা গেছিলাম বৈশাখ মাসে। আলোকঝাড়ি পাহাড়ে সাত বোশেখির মেলা বসে। তামাহাট থেকে অনেক দূরে সে মেলা। ভোরের বেলা গোরুর গাড়িতে চেপে গেলে মেলা দেখে ফিরে আসতে আসতে রাত হয়ে যায়। আমরা সকলেই গেছিলাম। মনে আছে, তিনটি গোরুর গাড়ি বোঝাই করে। গোরুর গাড়ির ওপরে খড় বিছানো, তার ওপরে শতরঞ্চি পাতা, মাথার ওপর ছই দেওয়া।

    আস্তে আস্তে কুমারগঞ্জে পৌঁছে, কুমারগঞ্জকে ডানদিকে রেখে আমরা বাঁ-দিকে টুঙবাগান পেরিয়ে, রাঙামাটি হয়ে আলোকঝাড়ির পাহাড়ে উঠতে লাগলাম।

    জঙ্গলের রূপ যে বিভিন্ন ঋতুতে কত বিভিন্ন তা সেই ছেলেবেলা থেকেই লক্ষ করে আসছি। বৈশাখ মাসে সব গাছের পাতা ঝরে গেছে, সমস্ত জঙ্গল বাঘের গায়ের মতো লাল, পত্রহীন শাখা-প্রশাখার কালো কালো ডোরা কাটা। পোড়া পাতা, ঝরা পাতা, শুকনো পাতা পড়ে আছে তূপীকৃত হয়ে। দুপুরের অলস মন্থর হাওয়া মচমচানি তুলে গড়িয়ে গড়িয়ে সে পাতাদের একবার এপাশে একবার ওপাশে নিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ঘূর্ণি হাওয়ায় সেই পাতারা কোন এক অদৃশ্য দেবতার প্রতি যেন তাদের আরতি জানাচ্ছে ঘূর্ণায়মান উৎসারিত শরীরে। আরতি শেষ করেই আবার নেমে আসছে ধরিত্রীর বুকে।

    মেলার পথেই, মনে পড়ে, দেখেছিলাম, একটি সম্পূর্ণ পত্রশূন্য গাছে লাল মুরগির ঝাঁক বসে আছে। যেন পলাশ ফুল ফুটে আছে কত।

    হঠাৎ বলা নেই, কওয়া নেই, একটি লালরঙের কোটরা হরিণ পথের বাঁ-পাশ থেকে ডান পাশে চলে গেল দুটো গোরুর গাড়ির মাঝখান দিয়ে।

    আমরা সব হই হই করে উঠলাম।

    ভরদুপুরে যখন মেলায় গিয়ে পৌঁছোলাম, তখন যে কী আনন্দ। যতদূর চোখ যায় হলুদ রঙের ছোপানো কাপড় পড়ে আদিবাসী মেয়ে-পুরুষরা এসেছে পুজো দিতে। পায়রা বলি দিচ্ছে, পাঁঠা বলি দিচ্ছে; লাল জঙ্গলের পটভূমিতে কালো পাথরের ওপরে।

    কুল কুল করে বয়ে যাচ্ছে ঝরনা, তাতে এখন জল কম, বালি বেশি। সেই ঝরনার পাশে পুজোর পর পুজো চড়ছে। সেই মেলাতে বিকিকিনিও হচ্ছে কম নয়। পাহাড়ি উপজাতি ম্যাচরা তাদের বাদামি শরীরে, বাদামি চুলে কাঠের কাঁকই খুঁজে, তাদের হাতেবোনা তাঁতের রং-বেরঙের পোশাক পরে অনেক কিছুই নিয়ে এসেছে সেই মেলায়।

    গারো পাহাড়ের পাহাড়তলির কুমির-ভরা জিঞ্জিরাম নদীর অববাহিকা থেকে এসেছে রাভা উপজাতিরা। তারা না জানি কোন না কোন পথ বেয়ে সেই জঙ্গলে এসে হাজির হয়েছে। তাদের যা কিছু কেনা-বেচার জন্যে। তির-ধনুক হাতে আদিবাসী চিকন চেহারার চ্যাটালো বুকের ছেলেরা এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের পেছন পেছন চলেছে তাদের বশংবদ লাল বা কালো রঙের ছুঁচোলো-মুখ দিশি কুকুর।

    জনসমাগমে গমগম করে আওয়াজ উঠেছে। দূর থেকে মনে হয়, কোনো প্রচন্ড জলপ্রপাত বুঝি। মেলায় যেখানে ভিড় খুব বেশি সেখান থেকে সরে এসে একটি দোলা মতো জায়গায়, যেখানে গ্রীষ্মের দাবদাহতেও ছায়া ছিল নরম নিভৃত, ঝরনা ছিল একফালি, সেখানে বসে চড়ইভাতি করলাম আমরা। মা, পিসিমা, আরও কে কে যেন মিলেমিশে খিচুড়ি রান্না করলেন সঙ্গে বেগুনি ও কড়কড়ে আলুভাজা। আমরা ছেলে মেয়ের দল হই হই করে এদিকে-ওদিকে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম।

    ঘাস থেকে পাথর তুলে দেখি, তার নীচে শঙ্খচূড়ের বাচ্চা। হুড়োহুড়ি পড়ে গেল চারদিকে। অন্য পাথরের ফোঁকরে ছিল মেঠো ইঁদুর। কী নরম পেলব সাদা তাদের চেহারা। নতুন চালের গন্ধ তাদের গায়ে। আদিবাসীরা দেখতে পেয়ে ফটাফট ধরে ধপাধপ পাথরে আছাড় মেরে সঙ্গে সঙ্গে পুড়িয়ে নিয়ে নুন দিয়ে খেয়ে ফেলল।

    কত কী অ্যাডভেঞ্চার, কত কী খেলা চারদিকে ঘিরে ঘিরে।

    মাঝে মাঝে তুমি ডাক দিতে। বলতে, সাবধান খোকন, গরমের দিন, সাপ আছে। এই তো কত বাচ্চা বেরোল। পিসিমা বলতেন, বাঘের দেখা; সাপের লেখা। সাপ থাকলেও কি কেউ দেখতে পায়; সাপে কামড়ানো যদি কপালে থাকে তো কামড়াবেই।

    তুমি বলতে, না বাবা, আমার ছেলেকে সাপে কামড়িয়ে দরকার নেই।

    যখন ফিরে আসছিলাম আমরা তখন পশ্চিমদিকে সূর্য ঢলে পড়েছে। টুঙবাগানের মধ্যে ছায়াচ্ছন্ন রাস্তা, বিরাট বিরাট টুঙ গাছ, জঙ্গলটা সবসময় স্যাঁতস্যাঁতে ছায়ানিবিড় হয়ে থাকে। নীচে নীচে টেকির শাকের মতো ঘন সবুজ ফার্ন, শ্যাওলা, গোপন ঝরনার ঝুরঝুর শব্দ, কটকটি ব্যাঙের অস্ফুট কটকট আওয়াজ, ভয় ভয়, শীত শীত সমস্ত পরিবেশটা।

    সন্ধের ঠিক মুখোমুখি একটা চিতাবাঘ পড়ল আমাদের সামনে। গোরুর গাড়ির গোরুরা উত্তেজিত হয়ে উঠল, গাড়োয়ানরা তাদের বিচিত্র সব দেশজ আওয়াজ করে গোরুর ল্যাজ ধরে টানাটানি করে, ফটাফট পাঁচন-বারি পিঠে মেরে সাঙ্কেতিক ভাষায় গোরুদের বুঝিয়ে দিল যে, ভয় নেই; সোজা চলো।

    অতএব তারা সোজাই চলল।

    তামাহাটে ফিরে আসতে আসতে রাত্তির। সবে আমরা গদিঘর দিয়ে ভেতরে ঢুকছি, এমন সময় গুড়ম করে একটা বন্দুকের আওয়াজ। আমরা সবাই দৌড়ে গেলাম।

    পিসেমশাই চোখে কম দেখতেন। বাড়ির চাকর সন্ধের আগে আগে মুরগির খাঁচার দরজা বন্ধ করছিল। এমন সময় তার চোখে পড়ল বন-বেড়ালের মতো একটা কী যেন অন্ধকারে খাঁচার মধ্যে মুরগিদের সঙ্গে লাজুক বরের মতো বসে আছে। আর মুরগিগুলো প্রচন্ড লাফালাফি ঝাঁপাঝাঁপি করছে। তাই না দেখে সে পিসেমশাইকে গিয়ে খবর দিল। পিসেমশাই একে চোখে ভালো দেখতেন না, তার ওপর অন্ধকার হয়ে গেছে। বন্দুকটা নিয়ে এসে উনি চাকরকে বললেন, তুই লণ্ঠনটা তুলে ধর, আমি এক গুলি মেরে দিচ্ছি। কাল সকালে দেখা যাবে কত বড়ো বন-বেড়াল। গুলি মেরে দিচ্ছি বলেই পিসেমশাই গুলি করে দিলেন। সেই গুলির আওয়াজের শব্দই আমরা পেলাম ঢুকতে না ঢুকতেই। গুলি করার পর চাকর বাইরে থেকে খাঁচা বন্ধ করে দিল।

    সে রাতে উত্তেজনায় আমাদের কারোরই ঘুম হল না। বনবেড়াল, সে নাকি কী জিনিস? তার কথা তো খালি বইয়েই পড়েছি, কখনো চোখে দেখিনি।

    ভোরের প্রথম পাখি ডাকার সঙ্গে সঙ্গে আমি উঠে পড়লাম। তখন সবে দেওয়ালের টিনের ফুটোফাটা দিয়ে নরম আলো ঘরে এসে পড়েছে। দরজা খুলে হাত মুখ না-ধুয়েই দৌড়ে গেলাম পাট-বোঝাই গুদামঘরের পাশে সেই মুরগির খাঁচায়। পাটের গন্ধটা ভারি মিষ্টি লাগত নাকে। পরশও ভারি আরামের ছিল, রেশমি নরম। গিয়ে দেখি, বনবেড়াল কোথায়? বিরাট এক চিতাবাঘ মরে পড়ে আছে খাঁচার মধ্যে। আর মুরগিগুলো বাঘটাকে একঘরে করে ভয়ে সিঁটিয়ে একটার ওপর আর একটা হয়ে এককোনায় জড়ো হয়ে আছে।

    দৌড়ে গিয়ে আমি দরজা ধাক্কাধাক্কি করে সমস্ত ঘরের লোকদের তুললাম।

    পিসেমশাই বেরিয়ে এসে বললেন, বলিস কী রে! চল তো দেখি। ততক্ষণে বাড়িসুদ্ধ সকলে এসে খাঁচার সামনে জড়ো হয়েছেন, কেউ কেউ বললেন, খবরদার। খাঁচার দরজা খুলবি না। বাঘ কি অত সহজে মরে? কোথায় না কোথায় লেগেছে। ও মরার ভান করে আছে।

    পিসেমশাই বললেন, ও মরে ভূত হয়ে গেছে। দেখছ না শরীরটা কীরকম শক্ত হয়ে গেছে।

    পিসিমা বললেন, শক্তই হোক আর নরমই হোক, তুমি মোটে ওর কাছে যাবে না, আর বাচ্চাদের এখানে থেকে সরাও।

    পিসিমার বকাবকিতে আমরা সবাই খাঁচার কাছ থেকে সরে দূরে দাঁড়িয়ে রইলাম। পিসেমশাই বন্দুক নিয়ে এসে তাতে দুটো গুলি পুরে খাঁচার পাশে রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আর চাকর, তার নাম গেছি ভুলে; সে খাঁচার দরজা খুলল।

    পিসেমশাই বললেন, ব্যাটাকে ল্যাজ ধরে টান। ল্যাজ ধরে বের করে নিয়ে আয়।

    সে বলল, বাবু ল্যাজ ধরলে তো খাবে আমাকে। ওর মধ্যে আমি নেই। আমার গলায় চারটে ফোঁড়া হয়েছে। বড়ো ব্যথা। বাঘ গলা কামড়ে ধরলে যন্ত্রণাতে মরে যাব।

    তখন পিসেমশাই বললেন, তুই কি বন্দুক ছুঁড়তে জানিস?

    চাকর বলল, কোনোদিনও ছুড়িনি, গুলতি ছুঁড়তে জানি, ইট ছুঁড়তেও।

    তখন পিসেমশাই তাকে পাঠালেন বৈদ্যকাকুকে ডেকে আনতে।

    হাটের অন্যদিকে বৈদ্যকাকুদের বাড়ি। তিনি এলেন। খালি গায়ে, ঘুম থেকে উঠে চোখে ঘোর নিয়েই সোজা বিছানা ছেড়ে উঠে চলে এলেন বাঘ সন্দর্শনে। সাদা ধুতি পরে কালো সাঁওতালের মতো শ্যামলা চেহারার বৈদ্যকাকু। এবং এসেই সোজা পিসেমশাইয়ের জায়গায় বন্দুক নিয়ে দাঁড়ালেন।

    পিসেমশাই নিজেই চিতাবাঘের ল্যাজ ধরে টেনে খাঁচা থেকে বের করতে গেলেন। কিন্তু অত বড়ো ভারী চিতাবাঘ কি পিসেমশাই একা টেনে বের করতে পারেন? জোরে এক হ্যাঁচকা টান দিতেই পিসেমশাই নিজেই পড়ে গেলেন। তখন আমরা সবাই মিলে হো হো করে হেসে উঠলাম আর মা-পিসিমার বকাবকি অগ্রাহ্য করে আমরাও দৌড়ে গিয়ে পিসেমশাইয়ের সঙ্গে চিতাবাঘের ল্যাজে হাত দিয়ে তাকে হেঁইও হেঁইও করে টেনে বের করলাম। আমাদের হাতে অনেকক্ষণ বাঘের গায়ের গন্ধ লেগে রইল।

    .

    ০৯.

    সেই যে বাগডোগরা গ্রামের মুনসের মিয়া, সে একদিন এসে খবর দিল যে, তাদের গ্রামে একটা চিতাবাঘ খুব দৌরাত্ম শুরু করেছে। আজকে গোরু নিচ্ছে, কাল ছাগল নিচ্ছে, এবার কোনদিন মানুষ নিয়ে টানাটানি করবে।

    পিসেমশাইকে বলল যে, কত্তা আপনি চলেন।

    পিসেমশাই বললেন, আমি চোখে দেখি না, রাতের বেলায় কি আমি সে বাঘ মারতে পারব? তার চেয়ে মুনসের তুমি রতুদাদাকে নিয়ে যাও।

    পিসেমশাইর পাশের বাড়িতে থাকেন রতুজেঠু। পিসেমশাইয়ের চেয়ে বয়েসে অনেক বড়ো। তাঁর একটা ছোটোখাটো কারখানা মতো ছিল। তিনি জানতেন না এ হেন হাতের কাজ নেই। পেটা মজবুত চেহারা, ধুতিটাকে লুঙ্গির মতো করে পরতেন। খালি গা, সবসময় কলকবজা নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন।

    তাঁর বড়োছেলের নাম ছিল এককড়ি! আর পিসেমশাইয়ের দাদার ছেলের নাম ছিল তিনকড়ি। আমাদের কড়িদা।

    কড়িদা আমার চেয়ে বয়েসে সামান্যই বড়ো ছিল। আমার বন্ধুর মতো। কড়িদার মতো অমন নরম, হাসিখুশি, পরোপকারী, ভালো মানুষ আমি আমার জীবনে দেখিনি। কী আশ্চর্য! পৃথিবী বোধ হয় ভালো মানুষদের বেশিদিন ধরে রাখতে পারে না। নইলে তুমি চলে যাবার আগেই আমাদের সমবয়েসি হয়েও কড়িদা কেন এতবছর আগে হাসতে হাসতে হঠাৎ চলে গেল!

    যারা সবচেয়ে ভালো, যারা থাকলে এই কুচক্রী কুটিল পৃথিবী মানুষের বসবাসের পক্ষে অনেক সহনীয় হত, তারাই কেন যে, আগে চলে যায় তাড়াতাড়ি বুঝি না।

    রতুজেঠু বললেন, বাঘ মারবে? চলো।

    পিসেমশাই, সেহেতু তাঁর বন্দুকটাও আমাদের দিলেন। তার আগে বন্দুক চালানো একটু আধটু শিখেছি। কিন্তু বাঘ? ওরে বাবা!

    রতুজেঠুর থার্টি-এইট মডেলের একটা ভি-এইট হুড-খোলা ফোর্ড গাড়ি ছিল। সেই গাড়িতে চড়ে আমি, রতুজেঠু আর কড়িদা একদিন দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর চললাম বাগডোগরা গ্রামের দিকে। মাঠ পেরিয়ে, হাট পেরিয়ে, চষা খেত পেরিয়ে, অনেক অনেক ধুলো উড়িয়ে বিকেলে আমরা এসে পৌঁছোলাম বড়ো বড়ো গাছ ঘেরা ছোট্ট একটি গ্রামে। বাগডোগরা গ্রামে।

    মুনসের সর্দার বড়ো খাতির করল আমাদের। বড়ো বড়ো কাঁঠাল-কাঠের পিঁড়ি পেতে দিল বসতে। কী খেতে দেবে, কী করে আমাদের আদর করবে সে ভেবেই কুল পেল না। বলল, একটা বড়ো সাদা পাঁঠা বেঁধে রেখেছে ঝাঁকড়া আমগাছের নীচে, বাঘের চলাচলের রাস্তায়। সন্ধেবেলার আগে সেই আম গাছে বসলে বাঘের সঙ্গে মোলাকাত নিশ্চয়ই হবে।

    রতুজেঠু সঙ্গে তাঁর একনলা বন্দুক এনেছেন, তিনি অনেক বাঘ মেরেছেন। বাঘ, চিতা, কুমির। শিকারি বলে সে অঞ্চলে তাঁর খ্যাতি ছিল।

    তিনি বললেন, দ্যাখ ছোকরারা, কথা কইবিনি। যেমন বসতে বলব, চুপচাপ তেমন গাছের ডালে বসে থাকবি। বাঘ মরে গেলে যখন বলব, তখন গাছ থেকে নামবি! হিসি-ফিসি করতে হয়তো এখনই করে নাও। জল খেতে হয় তো তা-ও। গাছের ডালে বসে নট নড়নচড়ন, নট-কিচ্ছ। মশা কামড়ালে মারতে পারবে না। কান চুলকোলে কানে হাত দিতে পারবে না, একেবারে স্ট্যাচু হয়ে থাকতে হবে।

    তখন বাঘ শিকারে উন্মাদনা। আমি আর কড়িদা বললাম, নিশ্চয়ই জেঠু নিশ্চয়ই জেঠু, আপনি যা বলবেন, তাই-ই করব।

    আমার কাঁধে গুলির থলি, তাতে ভরতি গুলি। কড়িদার হাতে বন্দুক, কথা ছিল বাঘ এলে এবং জেঠুর অনুমতি পেলে কড়িদা আমাকে আগে মারতে দেবে। তারপরেও যদি গুলিখেকো বাঘ না মরে, তাহলে কড়িদাও গুলি করবে।

    আমরা শোভাযাত্রা করে সেই আমগাছের দিকে চললাম। রতুজেঠু প্রথমে পাঁঠাটাকে ভালো করে দেখে নিলেন। তারপর বিনা বাক্যব্যয়ে পাঁঠার পেছনে জোর একটা লাথি মারলেন। পাঁঠাটা মুখ দিয়ে একটা কুঁক আওয়াজ করল শুধু, কিন্তু ব্যাঁ বলে ডাকল না।

    রতুজেঠু বললেন, ব্যাটা জ্বালাবে।

    মনসুর মিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার স্টকে অন্য পাঁঠা আছে?

    মনসুর মিয়া বললেন, পাঁঠা তো এ গ্রামের মানুষদের মধ্যে অনেকই আছে হুজুর, কিন্তু তাদের মধ্যে সত্যিকারের পাঁঠা যাকে বাঘ দিয়ে খাওয়ানো যায়, সেরকম এটা ছাড়া আর আপাতত নেই।

    রতুজেঠু আগে গাছে উঠলেন বন্দুকটা আমাদের হাতে দিয়ে। উনি কিছুটা ওঠেন আর বন্দুকটার নল ধরে টেনে ওঠান। এই করে করে উনি বেশ খানিকটা উঠে গিয়ে একটা জুতসই ডাল দেখে অন্য ডালে হেলান দিয়ে বসলেন আসন করে। কড়িদাও তড়তড় করে উঠে গেল। গ্রামের ছেলে সে। উঠে গিয়ে সে-ও ভালো জায়গায় গিয়ে বসল। আমি বন্দুকের কুঁদো ধরে উঁচু করে নলটা এগিয়ে দিলাম কড়িদার দিকে। কড়িদা নল ধরে টেনে নিয়ে বন্দুকটাকে উঠিয়ে নিলেন। তারপর আমার ওঠার পালা।

    যদিও ছেলেমানুষ, শরীর ছিপছিপে; কিন্তু শহরের ছেলে। গাছে ওঠার অভ্যাস নেই। নীচ থেকে মুনসের মিয়া আমাকে বস্তার মতো ঠেলে দিতে লাগলেন আর ওপর থেকে রতুজেঠু আর কড়িদা আমাকে দু-হাত দিয়ে ধরে ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে টেনে ওপরে তুললেন। এবং ওপরে তুলে একটা ফোঁকরের মধ্যে বসিয়ে দিলেন। বসার সঙ্গে সঙ্গেই একসঙ্গে বোধ হয় গোটা পঞ্চাশ লাল পিঁপড়ে আমার পশ্চাদ্দেশে সজোড়ে কামড়াল। বাবা গোয় মা গোয় করে আমি মুখ থুবড়ে লাফিয়েই পড়তে যাচ্ছিলাম।

    বাঘ মারা যে কত কষ্টকর তখনও বুঝিনি। কড়িদা এবং রতুজেঠু আমাকে কিছুতেই লাফিয়ে পড়তে দিলেন না।

    বললেন, আর একটু ওপরে উঠে ডালে বোসো, ফোকরের মধ্যে পিঁপড়ে কেন, বিছে টিছেও থাকতে পারে, সাপ থাকাও বিচিত্র নয়।

    ততক্ষণে ক্ষতি যা হবার আমার হয়ে গেছে। আমার পশ্চাদ্দেশ জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু কতখানি যে লাল হয়েছে এবং ক্ষতির পরিমাণ ঠিক কতখানি তা বাড়ি গিয়ে দেখা ছাড়া উপায় ছিল না। তবুও বাঘ মারার প্রচন্ড উৎসাহে আমি ওপরের ডালে উঠে যেমন বলা হল, তেমন চুপ করে বসলাম।

    মুনসের মিয়া চলে গেল তার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে। কিছুক্ষণ পরই সন্ধ্যাতারা উঠল পশ্চিমাকাশে জ্বলজ্বল করতে লাগল। আর তার সঙ্গে সঙ্গে উঠল চাঁদ। চাঁদের আলো ধীরে ধীরে জোর হতে লাগল আর বাইরে আলো যত জোর হল, ঝুপড়ি আমগাছের ছায়াটা ততই অন্ধকার হতে লাগল। ফুরফুর করে হাওয়া দিতে লাগল। গরমের দিন। নদী থেকে আসা চমৎকার হাওয়ায় সাদা পাঁঠাটা আরামে ঘুম লাগাল।

    রতুজেই ফিস ফিস করে বললেন, এ মা বিপদ। এ পাঁঠা না-চেঁচালে বাঘ জানবে কী করে যে, এখানে পাঁঠা আছে?

    আমি ফিসফিস করে বললাম, কী করা যায়?

    রতুজেঠু বললেন, তোর থলিতে তো অনেক গুলি। তুই এক কাজ কর, পাঁঠাটাকে ঢিল মার গুলি দিয়ে।

    বাঘ শিকারের জটিল এবং দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় আমার যে কিছুমাত্র ভূমিকা আছে তা জানতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত ও গর্বিত হয়ে উঠলাম এবং থলে থেকে এল-জি এবং বুলেট খপাখপ ধরে পটাপট ছুঁড়তে লাগলাম পাঁঠাটার মাথা লক্ষ্য করে।

    যে-গুলি বন্দুকের নল থেকে নির্গত হওয়ার কথা তা হাত দিয়ে অন্ধকারে ছুঁড়ে সহজে পাঁঠার সঙ্গে যোগাযোগ করা গেল না। তিন-চারটে গুলির মধ্যে একটা গুলি হয়তো পাঁঠাটার গায়ে লাগছিল। লাগামাত্র পাঁঠাটা একটা সংক্ষিপ্ত কুক আওয়াজ করছিল। যেমন রতুজেঠুর লাথি খেয়ে করেছিল। কিন্তু সেই সংক্ষিপ্ত কুঁক ছাড়া ব্যা-ফ্যা ইত্যাদি পাঁঠাজাতীয় শব্দর কিছুই সে করল না।

    রতুজেই বললেন, ক্ষ্যামা দে।

    আমি আবার গুলির ব্যাগ বন্ধ করে ফেললাম।

    সময় বয়ে যাচ্ছে। চারিদিক থেকে নানারকম রাতচরা পাখি ডাকছে। একটা হুতোম পেঁচা ডেকে উঠল দুরগুম, দুরগুম, শব্দ করে বুকের মধ্যে ধুকপুকানি তুলে। গ্রামের কুকুর ডাকল, তারপর অনেকক্ষণ ভুক ভুক করে শব্দ করে সেও থেমে গেল।

    দূরের নদীর বুক বেয়ে নৌকো যাচ্ছিল। চাঁদের আলোয় সে মহাজনি নৌকোর বাদামি পাল অতিকায় পাখির সাদানার মতো যেন স্বপ্নের দেশে ভেসে চলেছিল। হয়তো উজান বেয়ে যাচ্ছিল নৌকোটা, তাই যারা গুণ টানছিল, তাদের গুণ টানার হুমহুমানি অলস হাওয়ায় নদীর উপর দিয়ে ভেসে আসছিল আমাদের কানে।

    বাঘের কোনো সাড়াশব্দ নেই। পাঁঠারও নেই। এমন সময় হঠাৎ আমার মনে হল রতুজেঠু ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাঁর মুখটা বুকের ওপর নুইয়ে পড়েছে। আর মাঝে মাঝে ফোঁৎ-ফোঁৎ করে আওয়াজ হচ্ছে। আওয়াজটা কিন্তু একেবারেই বেতাল নয়। দাদরা কী কাহারবা সে-কথা আজ আমার মনে নেই, কিন্তু আওয়াজটা প্রতিবারেই বিশুদ্ধ তালে হচ্ছিল। আপাতত সে তালের সঙ্গে বাঘের পৌঁছোনোর সম্ভাবনা সুদূর পরাহত ছিল বলেই মনে হল।

    এমন সময় সেই অন্ধকার ছায়ার মধ্যে অন্ধকারতর কী একটা জন্তুকে নড়তে চড়তে দেখা গেল। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে অন্ধকারতর কোনো অবয়ব ছাড়া আরও নিশ্চিততর কিছু আমার চোখে স্পষ্ট হল না। কিন্তু সে জিনিসটা আস্তে আস্তে গোল করে ছায়াটাকে প্রদক্ষিণ করছিল।

    হঠাৎ দেখি, পাঁঠাটা ঘুম ভেঙে ধড়ফড় করে উঠে যে-খুঁটিতে সে বাঁধা ছিল, সেই খুঁটির প্রান্ত থেকে তার গলায় যতটুকু দড়ি ছিল, সেই দড়ির শেষপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে এবং ভীষণ উত্তেজিত হয়েছে। এবং ছায়াটা যেমন প্রদক্ষিণ করতে লাগল গাছের ছায়াটাকে, পাঁঠাটাও তেমন তার বিপরীতে আস্তে আস্তে পিছু হটে হটে ঘুরতে লাগল চরকির মতো।

    কড়িদা দেখতে পেয়েছিল কি না জানি না, কিন্তু আমি বিলক্ষণ দেখলাম যে, চিতাবাঘ এসে হাজির। এক্ষুনি তাকে মারা দরকার। আমি তাই তাড়াতাড়ি রতুজেঠুর হাঁটুতে হাত দিয়ে তাঁকে ঝাঁকিয়ে তুললাম।

    আচমকা ঘুম ভেঙে রতুজেঠু বন্দুকটাকে কোলের ওপরে শোয়ানো অবস্থাতে রেখেই, দু হাত দিয়ে চটাচট, পটাপট হাততালি মেরে বললেন, হতভাগা! হতভাগা!

    বলতেই, পাঁঠাটা এবং বাঘটা দুজনেই ভড়কে গেল।

    ভড়কে গিয়ে বাঘটা একলাফে পালিয়ে গেল চাঁদের আলোয় ভরা মাঠের মধ্যে দিয়ে একটুকরো অন্ধকার বিদ্যুতের মতো।

    আর পাঁঠাটা এই প্রথম পাঁঠামি না-করে প্রাণ বেঁচেছে, সেই আনন্দে ব্যা-এ-এ-এ করে ডেকে উঠল।

    আমি ও কড়িদা যুগপৎ বললাম, কী হল রতুজেঠু?

    রতুজেঠু বললেন, ওটা শেয়াল।

    কিছুই বলার ছিল না। জেঠু আমাদের গুরুজন। কিন্তু আমরা পরিষ্কার দেখলাম, যে হতভাগা এসেছিল, সে শিয়াল নয়, সে মান্যগণ্য বিরাট চিতাবাঘ।

    সেই বিফল শিকার যাত্রার পর রাতে মুনসের মিয়ার বাড়িতে মোরগা এবং রুটি সহযোগে রাতের খাওয়া সমাপ্ত করে আমরা যখন হুডখোলা গাড়িতে চাঁদের আলোয় ভাসতে ভাসতে এসে তামাহাটে পৌঁছোলাম, তখন তো গল্প শুনে তুমি রেগে অস্থির।

    পিসেমশাইয়ের ওপরও তুমি রাগ করলে।

    পিসেমশাই হাসতে লাগলেন গল্প শুনে। কিন্তু তুমি বললে, ইশ, আমি যদি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারতাম যে, আমার ছেলেকে নিয়ে রতুবাবু বাঘ মারতে যাবেন, তাহলে আমি কখনোই ওকে যেতে দিতাম না। আমি জানি, ও আর কড়ি বুঝি গ্রামেই থাকবে আর রতুবাবু একাই বাঘ মারবেন।

    পিসেমশাই হেসে বললেন, বাঘ তো আর মরেনি, আপনার ছেলেও বেঁচে ফিরেছে। কাজেই বৃথা উত্তেজিত হয়ে লাভ কী?

    .

    ১০.

    বাবার যেদিন বরিশালে বদলির অর্ডার হল, মনে আছে, আমি তোমার শোবার ঘরে বসে, ভবানীপুরের ভাড়াবাড়িতে পড়ছিলাম। বাবা অবিভক্ত বাংলার একটা ম্যাপ নিয়ে এসে খাটের ওপরে ম্যাপটা খুলে বসলেন।

    বসে তোমাকে বললেন, এল তো, এবার কোথায় যেতে হবে?

    বদলির কথা অনেকদিন থেকেই হচ্ছিল, কিন্তু যেহেতু বাবা একটি আধা-সামরিক সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সেই কারণে যুদ্ধকালীন সময়ে বারংবার তিনি বদলির অর্ডার হওয়া সত্ত্বেও নাকচ করাতে পেরেছিলেন। কিন্তু তখন যুদ্ধ গেছে থেমে, তাই সেবার সে-অজুহাতে আর বদলি এড়ানো গেল না।

    বাবা আঙুল দিয়ে বাখরগঞ্জ সাব ডিভিশনের ম্যাপটি আমাদের দেখালেন।

    ম্যাপে দেখলাম, সুনীল বঙ্গোপসাগর, আর যেখানে বাংলার মাটি শুরু হয়েছে, তারমধ্যে ছোটো ছোটো অসংখ্য দ্বীপ নদী নালা শিরা উপশিরার মতো ছড়িয়ে আছে। সেই জায়গাটুকুই বাখরগঞ্জ সাব ডিভিশন।

    তুমি বাবাকে বললে, ওরে বাবা, অত নদী, অত নালা, নিশ্চয়ই কুমির আছে, সাপ আছে; আমি যাচ্ছি না।

    প্রথমে অবশ্য বাবা আমাদের নিয়ে যানও নি। প্রথমে উনি একাই গিয়েছিলেন।

    তখন খুবই কষ্ট হত বাবার একা থাকতে। সে কারণেই আমরা সকলে পরে গিয়ে বাবার সঙ্গে ছিলাম। বরিশালের সেই স্বল্পকালীন অভিজ্ঞতা এখনও আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে।

    বাবার এক বন্ধু যাচ্ছিলেন খুলনা। তিনি খুলনাতে সরকারি অফিসার ছিলেন। তাঁরই তত্ত্বাবধানে ও অভিভাবকত্বে আমরা খুলনা অবধি গেলাম।

    খুলনা স্টেশনে নেমে দেখলাম অদূরেই নদী। বিরাট বড়ো স্টিমার দাঁড়িয়ে আছে। স্টিমারের নাম বেলুচি। তার আগে অত বড়ো স্টিমার কখনো দেখিনি। গঙ্গার ঘাটে জাহাজ দেখেছি বটে, কিন্তু স্টিমার দেখিনি।

    বাবার সেই বন্ধু আমাদের স্টিমারে চড়িয়ে চলে গেলেন শোলার টুপি নেড়ে। স্টিমার ছাড়ল বরিশালের দিকে। সে যে কী অভিজ্ঞতা।

    সেকেণ্ড ক্লাসের ডেকে আমরা বসে আছি ইজিচেয়ারে! একেবারে স্টিমারের সামনেটাতে ফার্স্টক্লাস। তার বিরাট ডেক। তারপরই সেকেণ্ড ক্লাস। চমৎকার খাওয়া-দাওয়া। সেই স্টিমারের মুরগির ঝোল আর ভাতের স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে। হু-হুঁ করে হাওয়া ডেকময় ছুটে বেড়ায়। খবরের কাগজ পড়তে গেলে ফরফর করে কাগজগুলো উড়ে চলে যায়।

    পরে যখন রবীন্দ্রনাথের চার অধ্যায় পড়ি, তখন স্টিমারের ডেকের বর্ণনায় এই বেলুচি স্টিমারের কথা বার বার মনে পড়ত।

    এলাকে অন্তু বলছে, প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস, তোমার চোখে দেখেছিলেম, আমার সর্বনাশ। এই কবিতাটি মনে হলে যেন স্টিমারের ডেক, হু-হুঁ হাওয়া, একাত্মভাবে মনে পড়ে যায় বার বার।

    স্টিমার চলেছে। দু-পাশে জনপদ, বাংলার গ্রাম, নারকোল সুপুরি গাছ, গাঁয়ের ঘাটে মেয়েরা নাইছে, কতরকম নৌকো চলেছে নদী বেয়ে, আর স্টিমার চলেছে ঢেউ তুলে তুলে, যে-ঢেউ নদীর দু-পাশের ঘাটে গিয়ে ছলাৎ ছলাৎ করে ভেঙে পড়ছে দুই কোনাকুনি রেখায়। কত কী স্টেশন।

    পরদিন সকালবেলা ঝালকাঠি স্টেশনে এসে স্টিমার দাঁড়াল। তারপর আরও কত স্টেশন। এখন আর নাম মনে নেই।

    বরিশালে অবশেষে গিয়ে পৌঁছোলাম আমরা। তোমার সেই ভয়-ভয় আতঙ্কগ্রস্ত চোখ দুটোর কথা এখনও মনে পড়ে।

    প্রথমে আমরা থাকতাম আমানতগঞ্জ বলে একটা জায়গায়। শহরের প্রায় শেষপ্রান্তে। যে বাড়িতে আমরা ভাড়া থাকতাম, একতলায় দুটো ঘর ছিল। তার পাশে ছিল উঠোন। উঠোনের উলটো দিকে ছিল রান্নাঘর। এখনও ছবির মতো সব মনে পড়ে। সেই বাড়িটার কাছেই এক বিরাট পুকুর ছিল। সে পুকুরের পাশে মাঝে মাঝে যেতাম বেড়াতে। সে-পুকুরে তুমি স্নান করতে দিতে না কখনো। সাঁতারও জানতাম না। কত লোক যে স্নান করত। একঘাটে মেয়েরা, একঘাটে ছেলেরা। বড়ো বড়ো মাছ ঘাই দিত জলের মধ্যে। ছোটো ছোটো ছেলেরা দূর দূর সাঁতার কেটে চলে যেত, এমনকী মেয়েরাও। দেখে বড়ো হীনম্মন্য লাগত।

    আমানতগঞ্জ ছাড়িয়ে গিয়ে ইলেকট্রিক সাপ্লায়ের অফিসের আরও ওপাশে আমার এক মাসিমার বাড়ি ছিল। মাসিমার বাড়িতে ছুটির দিনে আমরা বেড়াতে যেতাম। দোতলা কাঠের বাড়ি। প্রত্যেক ঘরে ঘরে ঝকঝকে ডাবর থাকত। প্রথম প্রথম সে ডাবরের তাৎপর্য বুঝতে পেতাম না।

    প্রথমদিন তুমি তো শুনেই অবাক!

    বললে, কী জংলি দেশে এসেছি রে বাবা!

    তখনও বরিশালে খুব চুরি-ডাকাতি হত, কথায় কথায় কাইজা লেগে থাকত। এদিক-ওদিক হলেই রামদা দিয়ে ধড় থেকে মুন্ডু আলাদা করে দিত। স্যানিটারি বাথরুমের চল তখন ছিল না। বেশিরভাগ গ্রামের বাড়িতেই বাথরুম থাকত দূরে! ওইরকম চোরডাকাতের জায়গায় রাত্তিরে দরজা খুলে বাইরে বাথরুমে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই উঠত না। তাই ছোটো বড়ো সবরকম প্রাকৃতিক আবানের মোকাবিলা করার জন্যে প্রত্যেকের শোবার ঘরে বড়ো বড়ো পেতলের ডাবর থাকত। সে ডাবর রোজ ছাই দিয়ে মেজে ঝকঝকে করা হত।

    মাসিমার বাড়ির রান্নাঘর থেকে বসে নদীটা দেখা যেত। পাশেই ছিল বাগান, বাগানের পাশে বাঁধানো ঘাট, বড়োপুকুর। পাশের বাড়ির সুন্দরী মেয়ে, জবা, আমারই সমবয়েসি; সে আসত সাঁতার কাটত। আমার মাসতুতো ভাই মিহির, সেও খুব ভালো সাঁতার কাটত। আমরা শহুরে ছেলে-মেয়েরা ঘাটে বসে ওদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম।

    জবা যখন তার দুধে-আলতা পায়ে ঢেউ তুলে সাঁতরে যেত নিথর কালোজল, তখন আমার মনের ভেতর এমন এমন অনুভূতি জাগত যে, তার ব্যাখ্যা তখন জানতাম না।

    পরে বুঝেছিলাম, তাকেই বলে ভালো লাগা; হয়তো একটু ভালোবাসাও।

    জবা জলের মধ্যে সাঁতার কেটে কেটে নকসি কাঁথা বানাত আর ফোঁড় দিত সেলাইয়ের, আর আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম।

    একবার নদী থেকে একটা কুমিরের বাচ্চা চলে এসেছিল সেই পুকুরে। সে কী কান্ড!

    মাসিমার বাড়ির কাছে ছিল এক নাম-করা ময়রার দোকান। আমরা গেলেই মাসিমা তার কাছ থেকে গরম রসগোল্লা আনিয়ে দিতেন। সেই রসগোল্লার স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে।

    মাসিমার বাড়ি সাইকেল রিকশা করে যেতে বাঁ-দিকে পড়ত বিরাট বাদা। হোগলার বন, হলদে-পাটকিলে রঙের হোগলা। বাদার মধ্যে থেকে কাম-পাখি ডাকত। ছিটকে উঠত সোজা উপরে মাছরাঙা পাখি। রোদ চমকাত তার রঙিন ডানায়। বাদার জলের গন্ধ ডানায় মেখে বিকেলের নিস্তেজ রোদ সেই হোগলার পাটকিলে রঙের সঙ্গে মাখামাখি হয়ে যেত।

    ক্যাঁচোর কোঁচোর করে সাইকেল রিকশা চলত, আর আমি তোমার পাশে বসে সেই গ্রাম্যপ্রকৃতির দিকে তাকিয়ে আনন্দে বুঁদ হয়ে যেতাম।

    আমানতগঞ্জ ছেড়ে তারপর আমরা কাঠপট্টির বাড়িতে উঠে যাই। কাঠপট্টির বাড়িতে বেশিদিন ছিলাম না। তারও পর আমরা সেই জর্ডন কোয়ার্টারে থাকতাম। বরিশাল জেলা স্কুলের পাশে, সুন্দর ছিমছাম পাড়া, চমৎকার লাল-রঙা সব বাড়ি। আগে সব সাহেব-সুবোরা থাকতেন।

    জর্ডন কোয়ার্টারের বাড়িটা স্টিমার ঘাটের কাছে ছিল। অন্ধকার রাতে নদীর বুক চিরে চলে-যাওয়া স্টিমারের সার্চলাইটের ঘূর্ণায়মান আলোর ঝলক আমাদের বাড়ির উপর দিয়ে চমকে যেত।

    কাছেই ছিল জেলাস্কুল। আমি যে-স্কুলে পড়তাম বিরাট ছিল তার মাঠ। কত ভালো ভালো বন্ধু হয়েছিল আমার। আতাউর রহমান মনজুরুল করিম। কী সুন্দর ছিল মনজুরুলের চেহারা। পড়াশোনায় সে বড়োই ভালো ছিল। একই দেশ, একই মানুষ রাজনৈতিক মানচিত্র পালটে গিয়ে আজ যে কত ব্যবধান হয়ে গেছে মনজুরুলের সঙ্গে আমার। তখন মজজুরুল গান গাইত-ইকবালের গানকে বদলে দিয়ে গাইত : সারে জাঁহাসে আচ্ছা পাকিস্তাঁ হামারা হামারা, হামারা।

    আমি অবাকচোখে চেয়ে থাকতাম ওর দীপ্ত চোখেমুখে। মনজুরুল যে এখন কোথায় আছে, কী করছে, কেমন আছে, কিছুই জানা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। উনিশশো সাতচল্লিশ সনে ক্লাস সিক্স-এ পড়তাম আমরা।

    নদীর ঘাটে ইলিশ মছের নৌকো এসে লাগত। তিন-চার আনা করে টাটকা ইলিশ পাওয়া যেত। ইলিশের জাল যখন দিত নদীতে, তখন কোনো পরিষ্কার সকালে লাফ দিয়ে উঠতে থাকা রুপোলি আঁশগুলো রোদে ঝিকমিক করে উঠত।

    বরিশালের জমিদার ছিলেন মনোরঞ্জন বর্মন। টকটকে তাঁর গায়ের রং। পরনে সব সময় ধুতি ও আদ্দির পাঞ্জাবি। সকালবেলায় পূজা পাঠ সেরে, বড়ো করে সিঁদুরের টিপ পরে কানে মা-কালীর নৈবেদ্য দেওয়া ঝুমকো জবা গুঁজে তিনি হুডখোলা জিপগাড়ি চালিয়ে আমাদের বাড়ি আসতেন।

    বরিশালের অফিসারস ক্লাবে প্রথম টেনিস খেলা শিখি। বাবা একবার কলকাতায় গেলেন কী কাজে। ফেরবার সময় ছোট্ট একটা র‍্যাকেট আমার জন্য নিয়ে এলেন। শিয়ালকোটে তৈরি।

    মনোরঞ্জন কাকু বললেন ভালোই হল। তুমি শিখবে, তাতেই আমারও শেখা হয়ে যাবে।

    নদীর পাশেই ছিল অফিসারস ক্লাব। তাতে টেনিসের বাঁধানো হার্ডকোর্ট। স্কুলের ছুটির পর আমি সেখানে যেতাম টেনিস খেলতে। এবং যেহেতু আমি কিছুদিন আগে আরম্ভ করেছিলাম, মনোরঞ্জন কাকুকে আমিই ট্রেনিং দিতাম।

    নদী থেকে হু হু করে হাওয়া আসত, টেনিস কোর্টের নীলরঙা পর্দাগুলো হাওয়াতে নৌকোর পালের মতো ফুলে ফুলে উঠত। গায়ের ঘাম সঙ্গে সঙ্গে শুকিয়ে দিত সেই হাওয়া।

    হাটখোলার সেনবাবুদের বিরাট ব্যাবসা ছিল। তাঁদের অনেক মোটর বোট ছিল। মাঝে মাঝে বাবা শিকারে নিয়ে যেতেন আমাকে। সঙ্গে অনেকে যেতেন। জজ সাহেব, অ্যাডিশনাল ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট, অতিক্রম মজুমদার মশায়, আমাদের জেলাস্কুলের হেডমাস্টার মশাই, মনোরঞ্জন কাকু আরও কত লোক, এখন আর সেসব নাম মনে নেই।

    দূরে চলে যেতাম আমরা নদী বেয়ে। শীতকালে হাঁস শিকার হত। অনেক সময় কুমির। একবার মনে আছে, ভোলার কাছাকাছি চলে গেছিলাম। সে কী বিরাট নদী; মনে হয় সমুদ্র। এপাশ-ওপাশ দেখা যায় না। মনে হয় সেই অকূল জলরাশির মধ্যে ছোট্ট বোটটি এক্ষুনি ডুবে যাবে বুঝি।

    বাবার সঙ্গে সঙ্গে সেই ছোট্ট নদী-নালা শহরে তোমারও এক বিশেষ ভূমিকা তুমি গড়ে তুলেছিলে। তোমাকে সক্কলে ভালোবাসত। কত লোক যে বউদি বউদি করে আসত। আর তুমি সকলের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতে, সকলকে আতিথেয়তায় সন্তুষ্ট করতে। সেইসব হাসিখুশি হই হই দিনগুলোর কথা বড়ো মনে পড়ে। তখন বাবার বয়েসও কত কম ছিল, তোমার বয়েসও আরও কম ছিল। আর আমরা তো ছোট্টই।

    মানুসের জীবনে, মানুষের অপ্রাপ্তির স্বাদ-আহ্লাদ সবই হয়তো একদিন পূরণ হয়। অতৃপ্ত বাসনা কামনা সব, পরিপূর্ণভাবে পরিপ্লুত হয়, কিন্তু যৌবন চলে গেলে, আর তা ফিরে আসে না। এ-জীবনে যৌবনের বুঝি কোনো বিকল্প নেই। সমস্ত ধনসম্পদ, সমস্ত পার্থিব প্রাপ্তি দিয়েও যৌবনহীনতার গ্লানি ও দারিদ্রও কিছুতেই ঢাকা যায় না।

    একদিন আমরা পাখি শিকারে গিয়ে নদীতে বান আসার কারণে জিপ নিয়ে নদী পার হতে না পেরে রাতে এক গ্রামেই থেকে গেলাম। পরদিন বরিশালে ফিরে শুনলাম যে, তুমি সারারাত ভয়ে বাবার রিভলবারের চামড়ার শূন্য খাপটি বালিশের নীচে নিয়ে জেগে শুয়েছিলে। চোর-ডাকাত এলে রিভলবারের হোলস্টার দেখিয়েই তাদের ভিরমি লাগাবে এমন মতলব করেছিলে!

    বাবা হাসতে হাসতে এই গল্প সব বন্ধু-বান্ধবদের করে বেড়ালেন অনেকদিন।

    আমরা বরিশাল থেকে ফিরে এলাম দেশ বিভাগের সময়ই। সরকারি চাকরিতে তখন হিন্দু, মুসলমান সবাইকে নিজ-নিজ ইচ্ছানুযায়ী ভারতে বা পাকিস্তানে থাকার কথা জানাতে হল উনিশো সাতচল্লিশ সনে।

    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদূরের ভোর – বুদ্ধদেব গুহ
    Next Article ১১-১৫. বরিশাল থেকে ফিরে

    Related Articles

    বুদ্ধদেব গুহ

    বাবলি – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্ৰ ১ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ২ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৩ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৪ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    অবেলায় – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }