Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ১৯৭১ – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প75 Mins Read0
    ⤷

    ০১-০৪. মীর আলি চোখে দেখে না

    ০১.

    মীর আলি চোখে দেখে না।

    আগে আবছা আবছা দেখত। দুপুরের রোদের দিকে তাকালে হলুদ কিছু ভাসত চোখে। গত দু বছর ধরে তাও ভাসছে না। চারদিকে সীমাহীন অন্ধকার। তাঁর বয়স প্রায় সত্তুর। এই বয়সে চোখ-কান নষ্ট হতে শুরু করে। পৃথিবী শব্দ ও বর্ণহীন হতে থাকে। কিন্তু তার কান এখনো ভালো। বেশ ভালো। ছোট নাতনীটি যত বার কেঁদে ওঠে তত বারই সে বিরক্ত মুখে বলে, চুপ, শব্দ করিস না। মীর আলি আজকাল শব্দ সহ্য করতে পারে না। মাথার মাঝখানে কোথায় যেন ঝনঝন করে। চোখে দেখতে পেলেও বোধহয় এরকম হত— আলো সহ্য হত না। বুড়ো হওয়ার অনেক যত্র শা। সবচেয়ে বড়ো যন্ত্রণা রাত-দুপুরে বাইরে যেতে হয়। একা-একা যাওয়ার উপায় নেই। তাকে তলপেটের প্রবল চাপ নিয়ে মিহি সুরে ডাকতে হয়, বদি, ও বদি। বদিউজ্জামান।

    বদিউজ্জামান তার বড় ছেলে। মধুবন বাজারে তার একটা মনিহারী দোকান আছে। রোজ সন্ধ্যায় দোকান বন্ধ করে সাত মাইল হেঁটে সে বাড়ি আসে। পরিশ্রমের ফলে তার ঘুম হয় গাঢ়। সে সাড়া দেয় না। মীর আলি ডেকেই চলে—বদি, ও বদি। বদিউজ্জামান। জবাব দেয় তার ছেলের বৌ অনুফা। অনুফার গলার স্বর অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। সেই তীক্ষ্ণ স্বর কানে এলেই মীর আলির মাথা ধরে, তবু সে মিষ্টি সুরে বলে, ও বৌ, এটু বাইরে যাওন দরকার। বদিরে উঠাও।

    অনুফা তার স্বামীকে জাগায় না। নিজেই কুপি হাতে এগিয়ে এসে শ্বশুরের হাত ধরে। বড় লজ্জা লাগে মীর আলির। কিন্তু উপায় কী? বুড়ো হওয়ার অনেক যন্ত্রণা। অনেক কষ্ট। মীর আলি নরম স্বরে বলে, চাঁদনি রাইত নাকি, ও বৌ।

    জ্বি-না।

    চউখে ফসর-ফসর লাগে। মনে হয় চাঁদনি।

    না, চাঁদনি না। এইখানে বসেন। এই নেন বদনা।

    অনুফা দূরে সরে যায়। মীর আলি ভারমুক্ত হয়। অন্য রকম একটা আনন্দ হয় তার। ইচ্ছা করে আরো কিছুক্ষণ বসে থাকতে। অনুফা ডাকে, আব্বাজান, হইছে?

    হুঁ।

    উঠেন। বইসা আছেন কেন?

    ফজর ওয়াক্তের দেরি কত?

    দেরি আছে। আব্বাজান উঠেন।

    মীর আলি অনুফার সাহায্য ছাড়াই উঠোনে ফিরে আসে। দক্ষিণ দিক থেকে সুন্দর বাতাস দিচ্ছে। রাতের দ্বিতীয় প্রহর শেষ হয়েছে বোধহয়। একটা-দুটা করে শিয়াল ডাকতে শুরু করেছে। মীল আলি হৃষ্ট গলায় বলে, রাইত বেশি বাকি নাই।

    অনুফা জবাব দেয় না, হাই তোলে।

    একটা জলচৌকি দেও, উঠানে বইয়া থাকি।

    দুপুর-রাইতে উঠানে বইবেন কি? যান, ঘুমাইতে যান।

    মীর আলি বাধ্য ছেলের মতো বিছানায় শুয়ে পড়ে। এক বার ঘুম ভাঙলে বাকি রাতটা তার জেগে কাটাতে হয়। সে বিছানায় বসে ঘরের স্পষ্ট অস্পষ্ট সব শব্দ অত্যন্ত মন দিয়ে শোনে।

    বদি খুকখুক করে কাশছে। টিনের চালে ঝটপট শব্দ। কিসের শব্দ? বানর? চৌকির নিচে সবগুলি হাঁস একসঙ্গে প্যাকপ্যাক করল। বাড়ির পাশে শেয়াল হাঁটাহাটি করছে বোঝহয়। পরীবানু কেঁদে উঠল। দুধ খেতে চায়। অনুফা দুধ দেবে না। চাপা গলায় মেয়েকে শাসাচ্ছে। বদি আবার কাশছে। ঠান্ডা লেগেছে নাকি? পরশু দিন ভিজে বাড়ি ফিরেছে। জুর তো হবেই। বদির কথা শোনা যাচ্ছে। ফিসফিস করে কী-যেন বলছে। কী বলছে? এত ফিসফিসানি কেন? মীর আলি কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করে। কাক ডাকল। সকাল হচ্ছে নাকি? মীর আলি ভোরের প্রতীক্ষা করে–তার তলপেট আবার ভারি হয়ে ওঠে।

    বদি, ও বদি। বদিউজ্জামান।

    কি?

    এটু বাইরে যাওন দরকার।

    বদি সাড়াশব্দ করে না। পরীবানু তারস্বরে কাঁদে। দুধ খেতে চায়।

    ও বদি, বদিউজ্জামান।

    আসি, আসি।

    তাড়াতাড়ি কর।

    আরে দুত্তোরি। এক রাইতে কয় বার বাইরে যাইবেন?

    বদি প্রচন্ড একটা চড় বসায় পরীবানুর গালে। বিরক্ত গলায় বলে, টর্চটা দাও অনুফা।

    অনুফা টর্চ খুঁজে পায়, কিন্তু অন্ধকারে ব্যাটারি খুঁজে পায় না।

    মীর আলি অপেক্ষা করতে-করতে এক সময় অবাক হয়ে বুঝতে পারে তার প্রস্রাব হয়ে গেছে। বিছানার একটা অংশ ভেজা। সে অত্যন্ত বিচলিত বোধ করে। এ রকম তার আগে কখনো হয় নি।

    আসেন যাই। যত ঝামেলা। দেখি, হাতটা বাড়ান।

    বদি তার হাত ধরে। মীর আলি খুব দুর্বল ও অসহায় বোধ করে। এখন থাইক্যা ঘরের মইধ্যে একটা পাতিলে পেশাব করবেন। ঝামেলা ভালো লাগে না।

    আইচ্ছা।

    আর পানি কম খাইবেন। বুঝলেন?

    আইচ্ছা।

    বদি তাকে উঠোনের এক মাথায় বসিয়ে দেয়। মীর আলি প্রস্রাব করার চেষ্টা করে। প্রস্রাব হয় না—ভোঁতা একটা যন্ত্রণা হয়।

    বদি হাঁক দেয়, কী হইছে? রাইত শেষ করবেন নাকি?

    আর ঠিক তখন মীর আলির সামনে দিয়ে সরসর শব্দ করে একটা কিছু চলে যায়। এটা কী সাপ? মীর আলির দেখতে ইচ্ছা করে।

    আরে বিষয় কি, সুমাইয়া পড়ছেন নাকি?

    নাহ্! একটা সাপ গেল সামনে দিয়া।

    আরে দুত্তোরি সাপ–উঠেন দেখি।

    মনে হয় জাতি সাপ। বিরাট লম্বা মনে হইল।

    আরে ধুৎ, উইঠা আসেন।

    মীর আলি উঠে দাঁড়ায়। আর ঠিক তখন আজান হয়। মীর আলি হাসিমুখে লে, আজান দিছে। ও বদি, আজান দিছে।

    দিছে দেউখ। ঘরে চলেন।

    ওখন আর ঘরে গিয়া কী কাম? গোসলের পানি দে। গোসল সাইরা নামাজটা

    বদি বিরক্ত গলায় বলে, অজু কইরা নামাজ পড়েন। গোসল ক্যান?

    শইলড়া পাক না। নাপাক আইল।

    আপনে থাকেন বইয়া, অনুফারে পাঠাই। যত ঝামেলা।

    বদিউজ্জামান তার বাবাকে একটা জলচৌকির উপর বসিয়ে ভেতরে চলে যায়। “র আসে না। পরীবানু ঘ্যানঘ্যান করে কাঁদে। মীর আলি বসে থাকে চুপচাপ।

    তার কিছুক্ষণ পর পঞ্চাশ জন সৈন্যের ছোট একটা দল গ্রামে এসে ঢোকে। মার্চটার্চ না, এলোমেলোভাবে চলা। তাদের পায়ের বুটে কোনো শব্দ হয় না। তারা যায় মীর আলির বাড়ির সামনে দিয়ে। এবং তাদের এক জন মীর আলির চোখে পাঁচ ব্যাটারি টর্চের আলো ফেলে। মীর আলি কিছু বুঝতে পারে না। শুধু উঠোনে বসে থাকা কুকুরটা তারস্বরে ঘেউঘেউ করতে থাকে। মীর আলি ভীত স্বরে ডাকে, বদি, ও বদি। বদিউজ্জামান।

    কুকুরটি একসময় আর ডাকে না। দলটির পেছনে-পেছনে কিছুদূর গিয়ে থমকে দাঁড়ায়, তারপর দ্রুত ফিরে আসে মীর আলির কাছে। মীর আলি উঁচু গলায় ডাকে, ও বদি, ও বদিউজ্জামান।

    কী হইছে? বেহুদা চিল্লান কেন?

    বাড়ির সামনে দিয়া কারা যেন গেল।

    আরে দুত্তোরি! যত ফালতু ঝামেলা! চুপ কইরা বইয়া থাকেন।

    মীর আলি চুপ করে যায়। চুপ করে থাকে কুকুরটিও। নিম্নশ্রেণীর প্রাণীরা অনেক কিছু বুঝতে পারে। তারা টের পায়।

    গ্রামের নাম নীলগঞ্জ। পহেলা মে। উনিশ শ একাত্তর। ক্ষুদ্র সৈন্যবাহিনীর অধিনায়ক এক জন মেজর—এজাজ আহমেদ। কাকুল মিলিটারি একাডেমির একজন কৃতী ক্যাডেট। বাড়ি পেশোয়ারের এক অখ্যাত গ্রামে। তার গাঁয়ের নাম—রেশোবা।

    ০২.

    ময়মনসিংহ-ভৈরব লাইনের একটি স্টেশন নান্দাইল রোড।

    ছোট্ট গরিব স্টেশন। মেল ট্রেন থামে না। লোকাল ট্রেন মিনিটখানেক থেকেই ফ্ল্যাগ উড়িয়ে পালিয়ে যায়। স্টেশনের বাইরে ইট-বিছানো রাস্তায় চার-পাঁচটা রিকশা ঠুনঠুন করে ঘণ্টা বাজিয়ে যাত্রী খোঁজে। সুরেলা গলা শোনা যায়–-রুয়াইল বাজার যাওনের কেউ আছুইন? রুয়াইল বা-জা-র।

    রুয়াইল বাজার এ-অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বাজার। নান্দাইল রোড থেকে সোজা উত্তরে দশ মাইল। খুবই খারাপ রাস্তা। বর্ষাকালে রিকশা চলে না। হেঁটে যেত। এঁটেল মাটিতে পা দেবে যায়, থিকথিকে ঘন কাদা। নান্দাইল রোড থেকে রুয়াইল বাজার আসতে বেলা পুইয়ে যায়।

    বাজারটি অন্য সব গ্রাম্য বাজারের মতো। তবে স্থানীয় লোকদের খুব অহঙ্কার একে নিয়ে। কী নেই এখানে? ধানচালের আড়ত আছে। পাটের গুদাম আছে, ধান ভাঙানোর কল আছে। চায়ের দোকান আছে। এমনকি রেডিও সারাবার এক জন কারিগর পর্যন্ত আছে। গ্রামের বাজারে এর চেয়ে বেশি কী দরকার!

    রুয়াইল বাজারকে পেছনে ফেলে আরো মাইল ত্রিশেক উত্তরে মধুবন বাজার। যাতায়াতের একমাত্র ব্যবস্থা গরুর গাড়ি। তাও শীতকালে। বর্ষায় হাঁটা ছাড়া অন্য উপায় নেই। উজান দেশ। নদী-নালা নেই যে নৌকা চলবে।

    মধুবন বাজার পেছনে ফেলে পুবদিকে সাত-আট মাইল গেলে ঘন জঙ্গল। স্থানীয় নাম মধুবনের জঙ্গলা-মাঠ। কাঁটাঝোপ, বাঁশ আর জারুলের মিশ্র বন। বেশ কিছু গাব ও ডেফলজাতীয় অন্ত্যজ শ্রেণীর গাছও আছে। জঙ্গলা-মাঠের এক অংশ বেশ নিচু। সেখানে মোরতা গাছের ঘন অরণ্য। শীতকালে সেই সব মোরতা কেটে এনে পাটি বোনা হয়। পাকা লটকনের খোঁজে বালক-বালিকারা বনের ভেতর ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু বর্ষাকালে কেউ যায় না সেদিকে। খুব সাপের উপদ্রব। বনে ঢুকে প্রতি বছরই দু-একটা গরু-ছাগল সাপের হাতে মারা পড়ে।

    জঙ্গলা-মাঠের পেছনে নীলগঞ্জ গ্রাম। দরিদ্র, শ্রীহীন, ত্রিশ-চল্লিশ ঘরের একটি বিচ্ছিন্ন জনপদ। বিস্তীর্ণ জলাভূমি গ্রামটিকে কাস্তের মতো দু দিকে ঘিরে আছে। সেখানে শীতকালে প্রচুর পাখি আসে। পাখি-মারা জাল নিয়ে পাখি ধরে বাজারে বিক্রি করে পাখি-মারারা। চাষবাস যা হয় দক্ষিণের মাঠে। জমি উর্বর নয় কিংবা এরা ভাল চাষী নয়। ফসল ভালো হয় না। তবে শীতকালে এরা প্রচুর রবিশস্য করে। বর্ষার আগে-আগে করে তরমুজ ও বাঙ্গি। দক্ষিণের জমিতে কোনো রকম যত্ন ছাড়াই এ দুটি ফল প্রচুর জন্মায়।

    গ্রামের অধিকাংশ ঘরেই খড়ের ছাউনি। সম্প্রতি কয়েকটি টিনের ঘর হয়েছে। বদিউজ্জামানের ঘরটি টিনের। তার হাতে এখন কিছু পয়সাকড়ি হয়েছে। টিনের ঘর বানানো ছাড়াও সে একটা সাইকেল কিনেছে। চালানো শিখে ওঠে নি বলে এখনো সে হেঁটেই মধুবন বাজারে যায়। সপ্তাহে এক বার নতুন সাইকেলটি ঝাড়পোঁছ করে।

    গ্রামের একমাত্র পাকা দালানটি প্রকাণ্ড। দু বিঘা জমির উপর একটা হুলস্থূল ব্যাপার। সুসং দুর্গাপুরের মহারাজার নায়েব চন্দ্রকান্ত সেন মশাই এ-বাড়ি বানিয়ে গৃহপ্রবেশের দিন সর্পাঘাতে মারা পড়েন। চন্দ্রকান্ত সেন প্রচুর ধনসম্পদ করেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর সে-সবের কোনো হদিশ পাওয়া যায় নি। সবার ধারণা সোনাদানা পিতলের কলসিতে ভরে তিনি যখ করে গেছেন। তাঁর উত্তরাধিকারীরা পেতলের কলসির খোঁজে প্রচুর খোঁড়াখুঁড়ি করেছে। কোনো সন্ধান পাওয়া যায় নি। চন্দ্রকান্ত সেন মশায়ের বর্তমান একমাত্র উত্তরাধিকারী নীলু সেন প্রকাণ্ড দালানটিতে থাকেন। তাঁর বয়স প্রায় পঞ্চাশ। দেখায় তার চেয়েও বেশি। নীলু সেনকে গ্রামে যথেষ্ট খাতির করা হয়। যাবতীয় সালিশিতে তিনি থাকেন। বিয়ে-শাদির কোনো কথাবার্তা তাঁকে ছাড়া কখনো হয় না। লোকটি অত্যন্ত মিষ্টভাষী।

    এ-গ্রামে সবচে সম্পদশালী ব্যক্তি হচ্ছে জয়নাল মিয়া। প্রচুর বিষয়সম্পত্তির মালিক। মধুবন বাজারে তার দুটি ঘরও আছে। লোকটি মেরুদণ্ডহীন। সবার মন রেখে কথা বলার চেষ্টা করে। গ্রাম্য সালিশিতে সবার কথাই সমর্থন করে বিচারসমস্যা জটিল করে তোলে। তবু সবাই তাকে মোটামুটি সহ্য করে। সম্পদশালীরা এই সুবিধাটি সব জায়গাতেই ভোগ করে।

    দু জন বিদেশি লোক আছেন নীলগঞ্জে। এক জন নীলগঞ্জ মসজিদের ইমাম সাহেব। এত জায়গা থাকতে তিনি এই দুর্গম অঞ্চলে ইমামতি করতে কেন এসেছেন সে-রহস্যের মীমাংসা হয় নি। তিনি মসজিদেই থাকেন। মাসের পনের দিন জয়নাল মায়ার বাড়িতে খান। বাকি পনের দিন পালা করে অন্য ঘরগুলিতে খান। কিছু দিল হল তিনি বিয়ে করে এই গ্রামে স্থায়ীভাবে থাকবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।

    প্রস্তাবটিতে কেউ এখনো তেমন উৎসাহ দেখাচ্ছে না। ধানী জমি দিতে পারে জয়নাল মিয়া। সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাচ্ছে। শুনেও না-শোনার ভান করছে।

    দ্বিতীয় বিদেশি লোকটি হচ্ছে আজিজ মাস্টার। সে নীলগঞ্জ প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার। প্রাইমারি স্কুল সরকারি সাহায্যে তিন বৎসর আগে শুরু হয়। উদ্দেশ্য বোধহয় একটিই–দুর্গম অঞ্চলে শিক্ষার আলো পৌঁছানো। উদ্দেশ্য সফল হয় নি। শিক্ষকরা কেউ বেশি দিন থাকতে পারে না। খাতাপত্রে তিন জন শিক্ষক থাকার কথা। এখন আছে এক জন—আজিজ মাস্টার। লোকটি রুগণ, নানান রকম অসুখবিসুখ। তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে হাঁপানি। শীতকালে এর প্রকোপ হয়। গরমকালটা মোটামুটি ভালোই কেটে যায়।

    আজিজ মাস্টার একজন কবি। সে গত তিন মাসে চার নম্বরি একটি রুলটানা খাতা কবিতা লিখে ভরিয়ে ফেলেছে। প্রতিটি কবিতাই একটি রমণীকে উদ্দেশ্য করে লেখা, যাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়েছে, যেমন—স্বপ্ন-রানী, কেশবতী, অচিন পাখি ইত্যাদি। তার তিনটি কবিতা নেত্রকোণা থেকে প্রকাশিত মাসিক কিষাণ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। আজিজ মাস্টারের কাব্যপ্রতিভা সম্পর্কে গ্রামের লোকওন ওয়াকিবহাল। তারা এই কবিকে যথেষ্ট সমীহ করে। সমীহ করার আরেকটি কারণ হল আজিজ মাস্টার গ্রামের সবচেয়ে শিক্ষিত মানুষ। বিএ পর্যন্ত পড়েছিল। পরীক্ষা দেওয়া হয় নি। তার আবার পরীক্ষা দেওয়ার কথা।

    সে জয়নাল মিয়ার একটি ঘরে থাকে। তার স্ত্রীকে সে ভাবসাব ডাকে কিন্তু তার বড় মেয়েটিকে দেখলেই কেমন যেন বিচলিত বোধ করে। মেয়েটির নাম মালা। মাঝে মাঝে মালা তাকে ভাত বেড়ে দেয়। সে-সময়টা আজিজ মাস্টার বড় অস্বস্তি বোধ করে। সে যখন বলে মামা, আরেকটু ভাত দেই? তখন কোনো কারণ ছাড়াই আজিজ মাস্টারের কান-টান লাল হয়ে যায়। আজিজ মাস্টার কয়েক দিন আগে মালা রানী নামের একটি দীর্ঘ কবিতা রচনা করেছে। কবিতাটি কিষাণ পত্রিকায় পাঠাবে কি না এ নিয়ে সে খুব চিন্তিত। হয়তো পাঠাবে।

    নীলগঞ্জের যে-দিকটায় জলাভূমি, একদল কৈবর্ত থাকে সেদিকে। গ্রামের সঙ্গে তাদের খুব একটা যোগ সেই। মাছ ধরার সিজনে জলমহালে মাছ মারতে যায়। আবার ফিরে আসে। কর্মহীন সময়টাতে চুরি-ডাকাতি করে। নীলগঞ্জের কেউ এদের ঘাটায় না।

    গত বৎসর কৈবর্তপাড়ায় খুন হল একটা। নীলগঞ্জের মাতবররা এমন ভাব করলেন যেন তারা কিছুই জানেন না। থানা-পুলিশ কিছুই হল না। যার ছেলে খুন হল, সেই চিত্ৰা বুড়ি কিছু দিন ছোটাছুটি করল নীলু সেনের কাছে। নীলু সেন শুকনো গলায় বললেন, তোদের ঝামেলা তোরা মিটা। থানাওয়ালার কাছে যা। বুড়ি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, থানাওয়ালার কাছে গেলে আমারে দহের মইধ্যে পুইত্তা থুইব কইছে। নীলু সেন গম্ভীর হয়ে গেলেন। টেনে-টেনে বললেন, এদের ঘাটাঘাটি করা ঠিক না। রক্তগরম জাত। কি করতে কি করে।

    বিচার অইত না?

    নীলু সেন তার জবাব দিতে পারলেন না। অস্পষ্টভাবে বললেন, এখন বাদ দে। পরে দেখি কিছু করা যায় কি না।

    বুড়ি আরো কিছুদিন ছোটাছুটি করল। এবং একদিন দেখা গেল কৈবৰ্তরা দল বেঁধে জলমহালে মাছ মারতে গিয়েছে, বুড়িকে সঙ্গে নেয় নি। বুড়ি আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করল কিছু দিন। নীলু সেনের দালানের এক প্রান্তে থাকতে লাগল। চরম দুর্দিন। কৈবর্তরা ফিরে এল তিন মাস পর—কিন্তু বুড়ির জায়গা হল না। সে এ-বাড়ি ও-বাড়ি ভিক্ষা করে খেতে লাগল। হতদরিদ্র নীলগঞ্জের প্রথম ভিক্ষুক।

    সব গ্রামের মতো এই গ্রামে এক জন পাগলও আছে। মতি মিয়ার শালা নিজাম। সে বেশির ভাগ সময়ই সুস্থ থাকে। শুধু দু-এক দিন মাথা গরম হয়ে যায়। তখন তার গায়ে কোনো কাপড় থাকে না। গ্রামের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত ছোটাছুটি করতে থাকে। দুপুরের রোদ খুব বেড়ে গেলে মধুবন জঙ্গলায় ঢুকে পড়ে। পাগলদের সাপে কাটে না প্রবাদটি হয়তো সত্যি। নিজাম বহাল তবিয়তেই বন থেকে বেরিয়ে আসে। ছোটাছুটি করা এবং বনের ভেতরে বসে থাকা ছাড়া সে অন্য কোনো উপদ্রব করে না। গ্রামের পাগলদের গ্রামবাসীরা খুব স্নেহের চোখে দেখে। তাদের প্রতি অন্য এক ধরনের মমতা থাকে সবার।

    ০৩.

    চিত্রা বুড়ি রাতে একনাগাড়ে কখনো ঘুমায় না।

    ক্ষণে-ক্ষণে জেগে উঠে চেঁচায়, কেলা যায় গো? লোকটা কে?

    তার ঘুমোবার জায়গাটা হচ্ছে সেনবাড়ির পাকা কালীমন্দিরের চাতাল। নীলু সেন তাকে থাকার জন্যে একটা ঘর দিয়েছিলেন। সেখানে নাকি তার ঘুম হয় না। দেবীমুর্তির পাশে সে বোধহয় এক ধরনের নিরাপত্তা বোধ করে। গভীর রাতে দেবীর সঙ্গে তার অন্তরঙ্গ কথাবার্তা হয়, দেখিস হেই মা কালী, হেই গো নেংটা বেটি, আমার পুতরে যে মারছে তুই তার কইলজাটা টাইন্যা খা। তরে আমি জোড়া পাঠা দিমু। বুক চিইরা রক্ত দি—হেই মা কালী, দেখিস রে বেটি, দেখিস।

    মা কালী কিছু শোনেন কি না বলা মুশকিল। কিন্তু চিত্ৰা বুড়ির ধারণা, তিনি শোনেন এবং তিনি যে শুনছেন তার নমুনাও দেন। যেমন—এক রাত্রিতে খলখল হাসির শব্দ শোনা গেল। বুড়ির রক্ত জল হয়ে যাবার মতো অবস্থা। সে কাঁপা গলায় ডাকল, হেই মা, হেই গো নেংটা বেটি! হাসির শব্দ দ্বিতীয় বার আর শোনা গেল না। দেবীরা তালের মহিমা বারবার করে দেখাতে ভালবাসেন না।

    চিত্রা বুড়ি আজ রাতেও মা কালীর সঙ্গে সুখদুঃখের অনেক কথা বলল। জোড়া পাঁঠার আশ্বাস দিয়ে ঘুমোতে গেল। তারপর জেগে উঠে চেঁচাল, কেলা যায় গো, লোকটা কে? কেউ জবাব দিল না, কিন্তু বুড়ির মনে হল অনেকগুলি মানুষ যেন এদিকে আসছে। শব্দ করে পা ফেলছে। হুঁ হাঁ হুঁ হাঁ এ-রকম একটা আওয়াজও আসছে। ডাকাত নাকি? চিত্রা বুড়ি ভয়ে কাঠ হয়ে গেল। তার চোখের সামনে দিয়ে মিলিটারির দলটি পার হল। আলো কম। স্পষ্ট কিছু দেখা যাচ্ছে না।

    চিত্ৰা বুড়ি কিছু বুঝতে পারল না। এরা কারা? এই রাতে কোত্থেকে এসেছে? বুড়ি দেখল, সেনবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েক বার টর্চের আলো ফেলল। তার মানে কি ডাকাত? কিন্তু সেনবাড়িতে ডাকাত আসার কথা নয়। সেনরা এখন হতদরিদ্র। এই বিশাল বাড়ির ইটগুলো ছাড়া ওদের আর কিছুই নেই।

    ওরা আবার চলতে শুরু করেছে। জুম্মাঘরের কাছে এসে আবার সেনবাড়ির উপর টর্চের আলো ফেলল। কোন দিকে যাচ্ছে? কৈবর্তপাড়ার দিকে? ওদের আগেভাগে খবর নেওয়া দরকার। সেনবাড়ির পেছন দিক দিয়ে ছুটে গিয়ে খবর দেবে? চিত্ৰা বুড়ির কাছে সমস্ত ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগছে। এই রাতের বেলা দল বেঁধে এরা কেন আসবে?

    না, কৈবর্তপাড়ার দিকে যাচ্ছে না। জুম্মাঘর পেছনে ফেলে এরা সড়কে উঠে গেল। টর্চের আলো এখন আর ফেলছে না। বুড়ির মনে হল এরা স্কুলঘরের দিকে যাচ্ছে। আজিজ মাস্টারকে খবর দেওয়া দরকার। কিন্তু তারও আগে খবর দেওয়া দরকার কৈবর্তপাড়ায়। বিপদের সময় নিজ গোত্রের মানুষের কথাই প্রথম মনে পড়ে।

    চার-পাঁচটা কুকুর একসঙ্গে চেঁচাচ্ছে। এরা কিছু টের পেয়েছে। কুকুর-বেড়াল অনেক কিছু আগেভাগে জানে। বুড়ি কালীমন্দিরের চাতাল থেকে নেমে এল। সে কোন দিকে যাবে মনস্থির করতে পারছে না।

    গ্রামে মিলিটারি ঢুকেছে এটা প্রথম বুঝতে পারলেন নীলগঞ্জ মসজিদের ইমাম সাহেব। পাকা মসজিদের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে তিনি সূরা ইয়াসিন পড়ছিলেন। আজান দেবার আগে তিনি তিন বার সূরা ইয়াসিন পড়েন। দ্বিতীয় বার পড়বার সময় অবাক হয়ে পুরো দলটাকে দেখলেন। এরা স্কুলঘরের দিকে যাচ্ছে।

    প্রথম কয়েক মুহূর্ত তিনি ব্যাপারটা বুঝতেই পারলেন না। সূরা ইয়াসিন শেষ করে দীর্ঘ সময় মসজিদের সিঁড়িতে বসে রইলেন। অন্ধকার এখনো কাটে নি। পাখপাখালি ডাকছে। ইমাম সাহেব মনস্থির করতে পারছেন না—এখানে বসে থাকবেন, না খবর দেওয়ার জন্যে ছুটে যাবেন। কিছুক্ষণ পর তাঁর মনে হল সিড়িতে এ-রকম প্রকাশ্যে বসে থাকা ঠিক না। মসজিদের ভেতরে থাকা দরকার। কিন্তু নীল গঞ্জের মসজিদে তিনি কখনো একা ঢোকেন না। এই মসজিদে জীন নামাজ পড়ে—এ-রকম একটা প্রবাদ আছে। অনেকেই দেখেছে। তিনি অবিশ্যি এখনো দেখেন নি। কিন্তু তাঁর ভয় করে।

    একা বসে থাকতে থাকতে তাঁর মনে হল, এই যে তিনি দেখলেন একদল মিলিটারি, এটা চোখের ভুল নয় তো? নান্দাইল রোডে মিলিটারি আসে নি, সোহাগীতে আসে নি—এখানে আসবে কেন? এখানে আছেটা কী? নেহায়েতই গণ্ডগ্রাম।

    ইমাম সাহেব ইউনিয়ন বোর্ডের রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন। স্কুলঘর বাশবনের আড়ালে পড়েছে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মুসল্লিরা কেউ আসছে না কেন? নাকি মিলিটারির খবর জেনে গেছে সবাই? তাঁর প্রবল ইচ্ছে হতে লাগল নামাজ না-পড়েই ঘরে ফিরে যেতে। আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে, অথচ কারো দেখা নেই।

    দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করবার পর মতি মিয়াকে আসতে দেখা গেল। মতি মিয়া একটা মামলায় জড়িয়ে ইদানীং ধর্মেকর্মে অতিরিক্ত রকমের উৎসাহী হয়ে পড়েছে। ইমাম সাহেব নিচু গলায় বললেন, এই মতি, কিছু দেখলা?

    কী দেখুম? কিসের কথা কন?

    কিছু দেখ নাই?

    নাহ। বিষয়ডা কী?

    ইমাম সাহেব আর কিছু না-বলে চিন্তিত ভঙ্গিতে আজান দিতে গেলেন। আজান শেষ করে মতি মিয়াকে আবার জিজ্ঞেস করলেন, ইস্কুলঘরের কাছে কিছুই দেখ নাই?

    নাহ্। ব্যাপার কি ভাইঙ্গা কন

    মনে হয় গেরামে মিলিটারি ঢুকছে।

    কী ঢুকছে?

    মিলিটারি।

    আরে কী কন? এই গেরামে মিলিটারি আইব ক্যান?

    আমি যাইতে দেখলাম।

    চউক্ষের ধান্ধা। আন্ধাইরে কি দেখতে কি দেখছেন। নান্দাইল রোডে তো এখন তক মিলিটারি আসে নাই।

    তুমি জানলা ক্যামনে?

    আমার শালা আইছে গতকাইল। নেজামের বড় ভাই।

    আমি কিন্তু নিজের চউক্ষে দেখলাম।

    আরে না। মিলিটারি আইলে এতক্ষণে গুলি শুরু হইয়া যাইত। মিলিটারি কি সোজা জিনিস?

    ইমাম সাহেব নামাজ শুরু করবার আগেই আরো তিন জন নামাজী এস পড়ল। তারাও কিছু জানে না। এক জন এসেছে স্কুলঘরের সামনে দিয়ে, সেও কিছু দেখে নি।

    ইমাম সাহেব আজ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত নামাজ পড়লেন। নামাজের শেষে সাধারণত তিনি হাদিস-কোরানের দুই-একটি কথা বলেন। আজ কিছুই বললেন না। বাড়ির দিকে রওনা হলেন। বেশ আলো চারদিকে, অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। জোড়া শিমুল গাছের কাছে এসে তিনি আড়চোখে স্কুলঘরের দিকে তাকালেন। বারান্দায় সারি-সারি সৈন্য বসে আছে। ইমাম সাহেবের মনে হল স্কুল কম্পাউন্ডের গেটের কাছে দাঁড়ানো একটা লোক হাত ইশারা করে তাঁকে ডাকছে। লোকটির পরনে ফুল প্যান্ট এবং নীল রঙের একটা হাফ শার্ট। কিন্তু তাঁকে ডাকছে কেন? নাকি তিনি ভুল দেখছেন। ইমাম সাহেবের কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমল। তিনি এক বার আয়াতুল কুর্সি ও তিন বার দোয়া ইউনুস পড়ে স্কুলঘরের দিকে এগুলেন।

    নীল শার্ট পরা লোকটিও এগিয়ে আসছে তার দিকে। ব্যাপার কী? এ কে? তিনি অতি দ্রুত দোয়া ইউনুস পড়তে লাগলেন, লাইলাহা ইল্লা আন্তা সোবাহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজুয়ালেমিন। এই দোয়াটি খুব কাজের। হযরত ইউনুস আলায়হেস সালাম মাছের পেটে বসে এই দোয়া পড়েছিলেন।

    নীল শার্ট পরা লোকটা এগিয়ে আসছে। কী চায় সে?

    আপনি কে?

    আমি এই গেরামের ইমাম।

    আচ্ছালামু আইয়কুম ইমাম সাহেব।

    ওয়ালাইকুম সালাম ওয়া রহমতুল্লাহ্।

    আপনি একটু আসেন আমার সাথে।

    কই যাইতাম?

    আসেন। মেজর সাব আপনাকে ডাকেন। ভয়ের কিছু নেই। আসেন।

    ইমাম সাহেব তিন বার ইয়া মুকাদ্দেমু পড়ে ডান পা আগে ফেললেন। সঙ্গের নীল শার্ট পরা লোকটি মৃদু স্বরে বলল, এত ভয় পাচ্ছেন কেন? ভয়ের কিছুই নাই।

    ০৪.

    আজিজ মাস্টারের অনিদ্রা রোগ আছে।

    অনেক রাত পর্যন্ত তাকে জেগে থাকতে হয় বলেই অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমুতে হয়। আজ তাকে ভোরের আলো ফোটার আগেই জাগতে হল। কারণ স্কুলের দপ্তরি ও দারোয়ান রামমোহন প্রচন্ড শব্দে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। যেন ভূমিকম্প হচ্ছে, এক্ষুণি আজিজ মাস্টারকে ঘর থেকে বের করতে হবে। বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে আজিজ মাষ্টার কথা বলল, এই রাসমোহন, কী ব্যাপার?

    আপনারে ডাকে, আপনারে ডাকে।

    কে ডাকে?

    মিলিটারি। গেরামে মিলিটারি আসছে। ইস্কুলঘরে।

    কী বলছিস রাসমোহন?

    আপনারে স্যার ডাকে।

    আজিজ মাস্টার দরজা খুলে দেখল রাসমোহনের থুতনি বেয়ে ঘাম পড়ছে! গায়ের ফতুয়াটাও ঘামে ভেজা। স্কুল থেকে দৌড়ে এসেছে বোধহয়। শব্দ করে শ্বাস টানছে। রাসমোহন আবার বলল, মিলিটারি আপনারে ডাকে স্যার। আজিজ মাস্টার রাসমোহনের কথা মোটেও বিশ্বাস করল না। সময়টা খারাপ। খাকি পোশাকের একজন পিওন দেখলেও সবাই ভাবে পাঞ্জাবি মিলিটারি। রাসমোহনের রজ্জুতে সর্পভ্রম হয়েছে। থানাওয়ালারা কেউ এসেছে কেন্দুয়া থেকে। খুব সম্ভব চিত্রা বুড়ির ছেলের ব্যাপারে। মাডার কেইসে পুলিশের খুব উৎসাহ। দল বেঁধে চলে আসে। নগদ বিদায়ের ব্যবস্থা আছে। এখানেও তাই হয়েছে। আজিজ মাস্টার অনেকখানি সময় নিয়ে হাত-মুখ ধুল। তার মাথায় চুল নেই, তবু যত্ন করে চুল আচড়াল। পরিষ্কার একটা পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে রাস্তায় বেরুল। অর্ধেক পথ আসার পর তার মনে পড়ল, চাবি ফেলে এসেছে। আবার ফিরে গেল চাবি আনতে। বাড়ি ফিরবার পথে সত্যি-সত্যি বুঝল গ্রামে মিলিটারি এসেছে। তার স্মৃতি মিয়ার সঙ্গে দেখা হল। রশুন মাক্সির সঙ্গে দেখা হল। বাড়ি ঢোকার মুখে জয়নাল মিয়াকেও ছাতা মাথায় দিয়ে আসতে দেখা গেল। রাসমোহন এদের প্রত্যেককে এক বার এক বার করে তার অভিজ্ঞতার কথা বলল।

    রাসমোহনের বর্ণনা মতো—সে স্কুলঘরের বারান্দায় ঘুমুচ্ছিল। তখনো চারদিক অন্ধকার। কে যেন তার পায়ে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে মুখে টর্চের আলো ফেলল। সে উঠে বসে দেখে স্কুলে মিলিটারি গিজগিজ করছে।

    জয়নাল মিয়া নিচু গলায় বলল, আন্দাজ কত জন হইব?

    চাইর-পাঁচ শর কম না।

    কও কী তুমি!

    বেশিও হইতে পারে। সবটি মস্ত জোয়ান।

    জোয়ান তো হইবই। মিলিটারি দুবলা-পাতলা হয় নাকি?

    হাতে অস্ত্রপাতি আছে?

    জয়নাল মিয়া বিরক্ত মুখে বলল, অস্ত্রপাতি তো থাকবই। এরা কি বিয়া করতে আইছে?

    আজিজ মাস্টার গম্ভীর গলায় বলল, তারপর কী হয়েছে রাসমোহন?

    তারা আমার নাম জিগাইল।

    আজিজ মাস্টার বলল, কোন ভাষায়? উর্দু না ইংরেজি?

    বাংলায়। পরিষ্কার জিগাইল—তোমার নাম কি? তুমি কে? কী কর?

    তা কীভাবে হয়? এরা তো বাংলা জানে না।

    আমি স্যার পরিষ্কার হুনলাম। নিজের কানে হুনলাম।

    তারপর বল। তারপর কী হল?

    আমি কইলাম—আমার নাম রাসমোহন। আমি স্কুলের দপ্তরি। তখন তারা কইল—হেডমাস্টাররে ডাইক্যা আন।

    বাংলায় বলল?

    জ্বি স্যার।

    আরে কী যে বলে পাগল-ছাগলের মতো! এরা বাংলা জানে নাকি? কি শুনতে কি শুনেছ।

    আজিজ একটা সিগারেট ধরাতে গিয়ে লক্ষ করল তার হাত কাঁপছে। এবং প্রস্রাবের বেগ হচ্ছে। খুব খারাপ লক্ষণ। এক্ষুণি হাঁপানির টান শুরু হবে। অতিরিক্ত উত্তেজনায় তার হাঁপানির টান ওঠে। এখন সিগারেট খাওয়াটা ঠিক হবে না জেনেও আজিজ মাস্টার লম্বা-লম্বা টান দিতে শুরু করল। সে সাধারণত জয়নাল মিয়ার সামনে সিগারেট খায় না।

    জয়নাল মিয়া গম্ভীর গলায় বলল, তুমি যাও মাস্টার, বিষয়ডা কি জাইন্যা আস।

    আমি, আমি কী জন্যে যাব?

    আরে, ডাকতাছে তোমারে। তুমি যাইবা না তো যাইবটা কে?

    আজিজ মাস্টারের সত্যি-সত্যি হাঁপানির টান উঠে গেল। সিগারেট ফেলে দিয়ে সে লম্বা-লম্বা শ্বাস নিতে শুরু করল। জয়নাল মিয়া গম্ভীর গলায় বলল, এরা এইখানে থাকবার জন্যেই আসে নাই, বুঝলা? যাইতাছে অন্য কোনোখানে। ভয়ের কিছু নাই। একটা পাকিস্তানি পতাকা হাতে নিয়া যাও। একটা পতাকা আছে না? বাঁশের আগায় বান্ধ।

    আমি একলা যাব? বলেন কী?

    একসঙ্গে বেশি মানুষ যাওয়া ঠিক না।

    ঠিক-বেঠিক যাই হোক, আমি একা যাব না।

    এই রকম করতাছ কেন মাষ্টার? এরা বাঘও না, ভাল্লকও না।

    একা যাব না। আপনারা চলেন আমার সাথে।

    সকাল প্রায় সাতটার দিকে দু জনের একটি ছোট্ট দলকে একটি পাকিস্তানি ফ্লাগ হাতে নিয়ে ইস্কুলঘরের দিকে এগোতে দেখা গেল। রোগা আজিজ মাস্টার দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছে। সে ইস্কুলঘরের কাছাকাছি এসে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করল, পাকিস্তান! দলের অন্য সবাই আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে বলল—জিন্দাবাদ!

    কায়দে আযম।

    জিন্দাবাদ!!

    লিয়াকত আলি খান!

    জিন্দাবাদ!!

    মহাকবি ইকবাল!

    জিন্দাবাদ!!

    ⤷
    1 2 3 4
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleসে ও নর্তকী – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article কাঠপেন্সিল – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই বসন্তে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই মেঘ, রৌদ্রছায়া – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এইসব দিনরাত্রি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 23, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Our Picks

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }