Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ১৯৭১ – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প75 Mins Read0
    ⤶

    ১৩-১৬. মেজর সাহেব এক মগ কফি হাতে

    ১৩.

    মেজর সাহেব এক মগ কফি হাতে ঘরে ঢুকলেন। তাঁর সমস্ত গা ভেজা। মাথায় টুপি নেই। ভেজা চুল বেয়ে ফোঁটা-ফোঁটা পানি পড়ছে। আজিজ মাস্টার উঠে দাঁড়াল। ইমাম সাহেব বসেই রইলেন। তাঁর উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। কিছু সময় পরপরই তাঁর বমি হচ্ছে। ঘরময় বমির কটু গন্ধ। রফিক একটি হারিকেন টেবিলের উপর রেখে চেয়ার এগিয়ে দিল মেজর সাহেবের দিকে। তিনি বসলেন। একটি পা রাখলেন চেয়ারে। গভীর গলায় প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। প্রশ্নগুলি ইমাম সাহেবের প্রতি। রফিককে প্রতিটি প্রশ্ন ও উত্তর ইংরেজি করে দিতে হচ্ছিল। প্রশ্নোত্তর পর্বের গতি হল শুথ, সে ওন্যে মেজর সাহেবের কোনো ধৈর্ষচ্যুতি হল না।

    তারপর, ইমাম ভালো আছ?

    জ্বি।

    আমি তো খবর পেলাম ভালো নেই। ক্রমাগত বমি হচ্ছে।

    জ্বি হুজুর।

    শাস্তির দৃশ্যটা ভালো লাগে নি?

    ইমাম সাহেব জবাব দিলেন না। বমির বেগ সামলাবার চেষ্টা করতে লাগলেন। ম ওর সাহেবের মুখে ক্ষীণ হাসি দেখা গেল।

    দৃশ্যটি কি খুব কঠিন ছিল?

    জ্বি।

    তুমি নিজে নিশ্চয়ই গরু-ছাগল জবাই করা কর না?

    জ্বি, করি।

    তখন খারাপ লাগে না?

    ইমাম সাহেব একটি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললেন। মেজর সাহেব কফির মগে দীর্ঘ। চুমুক দিয়ে জবাবের প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। জবাব পাওয়া গেল না।

    ইমাম।

    জ্বি স্যার।

    এখন আমাকে বল, তোমাদের ঐ জঙ্গলে মোট কত জন বাঙালি সৈন্য আছে?

    আমি জানি না স্যার।

    সঠিক সংখ্যাটি না বলতে পারলেও কোনো ক্ষতি নেই। অনুমান করে বল।

    আমি জানি না স্যার।

    সৈন্য আছে কিনা সেটা বল।

    স্যার, আমি জানি না।

    আচ্ছা বেশ—সৈন্য নেই, এই কথাটিই তোমার মুখ থেকে শুনি।

    স্যার, আমি জানি না। কিছুই জানি না স্যার।

    মেজর সাহেব কফির মগ নামিয়ে রাখলেন। সিগারেট ধরালেন। তার কপালের চামড়ায় সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ল।

    তুমি কখনো ঐ বনে যাও নি?

    জ্বি-না স্যার। আমি ধর্মকর্ম নিয়ে থাকি।

    ধর্মকর্ম নিয়ে থাক?

    জ্বি স্যার।

    মসজিদে লোক হয়?

    হয় স্যার।

    সেখানে তুমি কি পাকিস্তানের জন্যে দোয়া কর?

    ইমাম সাহেব চুপ করে গেলেন। মেজর সাহেবের কণ্ঠে অসহিষ্ণুতা ধরা পড়ল।

    খুতবার শেষে পাকিস্তানের জন্যে কখনো দোয়া কর নি?

    পৃথিবীর সব মুসলমানের জন্যে দোয়া খায়ের করা হয় স্যার।

    তুমি আমার কথার জবাব দাও। পাকিস্তানের জন্যে দোয়া কর নি?

    জ্বি-না স্যার। বাংলাদেশের জন্যে কখনো দোয়া করেছ?

    ইমাম সাহেব চুপ করে রইলেন।

    মেজর সাহেব হঠাৎ প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিলেন। ইমাম সাহেব চেয়ার থেকে উল্টে পড়ে গেলেন। রফিক তাঁকে উঠে বসাল। মেজর সাহেব ঠাণ্ডা স্বরে বললেন, ব্যথা লেগেছে?

    জ্বি-না।

    এতটুকু ব্যথা লাগে নি।

    জ্বি-না স্যার।

    আমার হাত এতটা কমজোরি তা জানা ছিল না।

    মেজর সাহেব হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে দ্বিতীয় চড়টি দিলেন। ইমাম সাহেব গড়িয়ে নিচে পড়ে গেলেন। তার নাক দিকে রক্ত পড়তে শুরু করল। রফিক তাঁকে তুলতে গেল। মেজর সাহেব বললেন, ও নিজে নিজেই উঠবে। ইমাম, উঠে বস। ইমাম সাহেব উঠে বসলেন।

    এখন বল, তুমি শেখ মুজিবর রহমানের নাম শুনেছ?

    জি, শুনেছি।

    সে কে?

    ইমাম সাহেব চুপ করে রইলেন।

    সে কে তুমি জান না?

    মেজর সাহেব এগিয়ে এসে তৃতীয় চড়টি বসালেন। ইমাম সাহেব শব্দ করে দোয়া ইউনুস পড়তে লাগলেন। মেজর সাহেব তাকালেন আজিজ মাস্টারের দিকে।

    তারপর কবি, তুমি কেমন আছ? ভালো আছ?

    জি।

    তুমি শুনলাম বেশ শক্তই ছিলে? বমিটমি কিছু কর নি?

    আজিজ মাস্টার জবাব দিল না।

    বাংলাদেশের উপর কখনো কবিতা লিখেছ?

    জ্বি-না স্যার।

    কেন, লেখ নি কেন?

    আজিজ মাস্টার চুপ করে রইল।

    শেখ মুজিবের ওপর লিখেছ?

    জ্বি-না।

    আজিজ মাস্টারের পা কাঁপতে লাগল। মেজর সাহেব বললেন, তুমি প্রেমের কবিতা ছাড়া অন্য কিছু লেখ না?

    জ্বি-না।

    তুমি দেখি দারুণ প্রেমিক-মানুষ। সব কবিতা কি মাল নামের ঐ বালিকাটিকে নিয়ে লেখা? জবাব দাও। বল হ্যাঁ কিংবা না।

    হ্যাঁ।

    শোন আজিজ, আমি কথা রাখি। আমি কথা দিয়েছিলাম ঐ মেয়েটির সঙ্গে তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করব, সেটা আমার মনে আছে। আমি ঐ মেয়ের বাবাকে আনকে লোক পাঠিয়েছি। এখন তুমি আমাকে বল, ঐ বনে কত জন সৈন্য লুকিয়ে আছে?

    স্যার, বিশ্বাস করেন আমি কিছুই জানি না।

    আমি তোমার কথা বিশ্বাস করলাম না। তুমি বোধহয় জান না আমি কী পরিমাণ নিষ্ঠুর হতে পারি। তুমি জান?

    জ্বি স্যার, জানি।

    না, তুমি জান না। তবে এক্ষুণি দেখতে পাবে। রফিক, তুমি ওর জামা-কাপড় খুলে ওকে নেংটো করে ফেল।

    আজিজ মাস্টার হতভম্ব হয়ে তাকাল। এই লোকটা বলে কী। আজিজ মাস্টারের পা কাপতে লাগল। মেজর সাহেব বললেন, দেরি করবে না, আমার হাতে সময় বেশি নেই। রফিক।

    জ্বি স্যার।

    এই মিথ্যাবাদী কুকুরটাকে নেংটো করে সমস্ত গ্রামে ঘুরে-ঘুরে দেখাবে। বুঝতে পারছ?

    পারছি।

    আর শোন, একটা ইটের টুকরো ওর পুরুষাঙ্গে ঝুলিয়ে দেবে। এতে সমস্ত ব্যাপারটায় একটা হিউমার আসবে।

    আজিজ মাস্টার কাঁপা গলায় বলল, আমি কিছুই জানি না স্যার। একটা কোরান শরিফ দেন, কোরান শরিফ ছুঁয়ে বলব।

    তার কোনো প্রয়োজন দেখি না। রফিক, যা করতে বলছি কর।

    রফিক থেমে থেমে বলল, মানুষকে এভাবে লজ্জা দেবার কোনো অর্থ হয় না। মেজর সাহেবের চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হতে থাকল। তিনি তাকিয়ে আছেন রফিকের দিকে। রফিক বলল, আপনি যদি একে অপরাধী মনে করেন তাহলে মেরে ফেলেন। লজ্জা দেবার দরকার কি?

    তুমি একে অপরাধী মনে কর না?

    না। আমার মনে হয় সে কিছু জানে না।

    সে এই গ্রামে থাকে আর এত বড় একটা ব্যাপার জানবে না?

    জানলে বলত। কিছু জানে না, তাই বলছে না।

    বলবে সে ঠিকই। ইট বেঁধে তাকে বাড়ি-বাড়ি নিয়ে যাও—দেখবে তার মুখে কথা ফুটেছে। তখন সে প্রচুর কথা বলবে।

    রফিক ঠাণ্ডা স্বরে বলল, স্যার, ওকে এ-রকম লজ্জা দেয়াটা ঠিক না।

    কেন ঠিক না?

    আপনি শুধু ওকে লজ্জা দিচ্ছেন না, আপনি আমাকেও লজ্জা দিচ্ছেন। আমিও ওর মতো বাঙালি।

    তাই নাকি! আমি তো জানতাম তুমি পাকিস্তানি? তুমি কি সত্যি পাকিস্তানি?

    জ্বি স্যার।

    আমার মনে হয় এটা তোমার সব সময় মনে থাকে না। মনে রাখবে।

    জ্বি স্যার, রাখব।

    এটা তোমার নিজের স্বার্থেই মনে রাখা উচিত।

    রফিক চুপ করে গেল। মেজর সাহেব বললেন, একটা মজার ব্যাপার কি জান রফিক? তুমি যদি আজিজ মাস্টারকে চয়েস দাও মৃত্যু অথবা লজ্জাজনক শাস্তি—তাহলে সে লজ্জাজনক শাস্তিটাই বেছে নেবে। মহানন্দে পুরুষাঙ্গে ইট বেঁধে মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াবে। জিজ্ঞেস করে দেখ।

    রফিক কিছুই জিজ্ঞেস করল না। মেজর সাহেব কঠিন স্বরে বললেন, আজিজ, পরিষ্কার উত্তর দাও। মরতে চাও, না চাও না? আমি দ্বিতীয় বার এই প্রশ্ন করব না। ত্রিশ সেকেণ্ডের ভেতরে জবাব চাই। বল, মরতে চাও, না চাও না?

    মরতে চাই না।

    মেজর সাহেব হাসিমুখে বললেন, বেশ, তাহলে কাপড় খুলে ফেল। তোমাকে ঠিক এক মিনিট সময় দেয়া হল তার জন্য। আজিজ মাস্টার কাপড় খুলতে শুরু করল।

    রফিক, আমার কথা বিশ্বাস হল?

    হল।

    বাঙালিদের মান-অপমান বলে কিছু নেই। একটা কুকুরেরও আত্মসম্মান জ্ঞান থাকে, এদের তাও নেই। আমি যদি ওকে বলি—যাও, ঐ ইমামের পশ্চাৎদেশ চেটে আস, ও তাই করবে।

    রফিক মৃদু স্বরে বলল, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ালে অনেকেই এ-রকম করবে।

    তুমি রবে?

    জানি না, করতেও পারি। মৃত্যু একটা ভয়াবহ ব্যাপার। মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে কে কী করবে তা আগে থেকে বলা সম্ভব নয়।

    তাই বুঝি?

    জ্বি স্যার। আপনার মতো একজন সাহসী মানুষও দেখা যাবে কাপুরুষের মতো কাণ্ডকারখানা করছে।

    মেজর সাহেব ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। এবং তারো মিনিটখানেক পর জয়নাল মিয়াকে সেই ঘরে ঢুকিয়ে দেয়া হল। আজিজ মাষ্টার দুহাতে তার লজ্জা ঢাকতে চেষ্টা করল। ইমাম সাহেব বেশ স্বাভাবিক গলায় বললেন, জয়নাল মিয়া ভালো আছেন?

    জয়নাল কিছু একটা বলতে চেষ্টা করল—বলতে পারল না। আজিজ মাস্টারের মতো একজন বয়স্ক মানুষ সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে—এটি এখনো সে বিশ্বাস করতে পারছে না। ইমাম সাহেব বললেন, বড় খারাপ সময় জয়নাল সাব, আল্লাহ্ খোদার নাম নেন।

    জয়নাল মিয়া আবারো কিছু বলতে চেষ্টা করল, বলতে পারল না। কথা আটকে গেল।

    রফিক শান্ত স্বরের বলল, জয়নাল সাহেব, আপনি বসেন। স্যার যা যা জিজ্ঞেস করবেন তার সত্যি জবাব দেবেন। বুঝতেই পারছেন।জয়নাল মিয়া মাটিতে বসে পড়ল। ইমাম সাহেব বললেন, চেয়ারে বসেন, মাটিতে প্রস্রাব আছে। নাপাক জায়গা।

    ১৪.

    মেঘ নেই।

    আকাশে তারা ফুটতে শুরু করেছে।

    রাত প্রায় আটটা, কিন্তু মনে হচ্ছে নিশুতি। হাওয়া থেমে গেছে। গাছের একটি পাতাও নড়ছে না। সফরউল্লাহ্ একটা দা হাতে মাঠে নেমে পড়ল। সে দু জনকে খুজছে। এক জন তালগাছের মতো লম্বা। গোঁফ আছে। অন্য জন বাঙালি, তার মুখে বসন্তের দাগ। সফরউল্লাহ কোনো রকম শব্দ না করে হাঁটছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। তাতে তার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। সে যেভাবে হাঁটছে তাতে মনে হয় অন্ধকারেও দেখতে পাচ্ছে। কোনো-কোনো সময়ে মানুষের ইন্দ্রিয় অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে।

    সে প্রথমে গেল বিলের দিকে। কেউ নেই সেখানে। বেশ কিছু কাটা ডাব পড়ে আছে চারদিকে। সফদরউল্লাহ্ দীর্ঘ সময় বিলের পারে দা হাতে বসে রইল। বাতাস নেই কোথাও, তবু বিলের পানিতে ছলাৎছলাৎ শব্দ হচ্ছে। ওরা আবার হয়তো আসবে। পানিতে দাঁড় করিয়ে আরো মানুষ মারবে। সফরউল্লাহর মনে হল কেউ-একজন যেন এদিকে আসছে। সে শক্ত করে দাটি ধরে চেঁচিয়ে বলল, কেডা?

    আমি নিজাম। আপনে কী করেন?

    কিছু করি না।

    অন্ধকারে বইয়া আছেল কাল?

    সফদরউল্লাহ ফুঁপিয়ে উঠল। নিজাম বলল, সব মিলিটারি জমা হইতেছে জঙ্গলা মাঠে। দেখবেন? সফরউল্লাহ্ সঙ্গে-সঙ্গে উঠে দাঁড়াল।

    হাতে দাও ক্যান?

    আছে, কাম আছে। দাওয়ের কাম আছে।

    কৈবর্তপাড়া খালি হয়ে যাচ্ছে।

    এরা সরে পড়ছে নিঃশব্দে। এদের অভ্যাস আছে—অতি দ্রুত সব কিছু গুছিয়ে সরে পড়তে পারে। অন্ধকারে এরা কাজ করে। ওদের শিশুরা চোখ বড়-বড় করে দেখে, হৈচৈ করে না, কিছুই করে না। মেয়েরা জিনিসপত্র নৌকায় তুলতে থাকে। কোনো জিনিসই বাদ পড়ে না। হাঁস, মুরগি, ছাগল—সবই ওঠানো হয়। এরা কাজ করে নিঃশব্দে। প্রবীণরা ইকো হাতে বেশ অনেকটা দূরে বসে থাকে। তাদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় কি হচ্ছে না হচ্ছে এরা কিছুই জানে না। এরা ঝিমুতে থাকে। ঝিমুতে ঝিমুতেই চারদিকে লক্ষ রাখে। বুড়ো বয়সেও এদের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ।

    মীর আলি খুনখুন করে কাঁদে।

    ভাতের জন্যে কাঁদে। বদিউজ্জামান বাড়ি ফেরে নি। সে না-ফেরা পর্যন্ত অনুফা ভাত চড়াবে না। ঘরে চাল-ডাল সবই আছে। চারটা চাল ফোটাতে এমন কি ঝামেলা মীর আলি বুঝতে পারে না। অনেক রকম ঝামেলা আছে ঠিকই—মাথার উপর টিনের ছাদ নেই। গ্রামে মিলিটারি মানুষ মারছে। তাই বলে মানুষের ক্ষুধা-তৃষ্ণা তো চলে যায় নি? পরীবানুও বিরক্ত করছে না। ঘুমাচ্ছে। অসুবিধা তো কিছু নেই।

    মীর আলি মৃদু স্বরে বলল, বৌ, চাইরডা ভাত রাইন্ধা ফেল। অনুফা তীব্র স্বরে বলল, আপনে মানুষ না আর কিছু?

    মীর আলি অবাক হয়ে বলে, আমি কী করলাম।

    পনের-বিশ জন সেপাই বসে আছে স্কুলের বারান্দায়। এরাও ক্ষুধার্ত, সমস্ত দিন কোনো খাওয়া হয় নি। ওদের জন্যে রান্না হবার কথা মধুবনে। ঝড়ের জন্যে নিশ্চয়ই কোনো ঝামেলা হয়েছে। রান্না-করা খাবার এসে পৌঁছায় নি। কখন এসে পৌঁছাবে কে জানে? এরা সবাই দেয়ালে ঠেস দিয়ে শান্তি ভঙ্গিতে বসে আছে। কয়েক জন স্পষ্টতই ঘুমাচ্ছে। কিছু বাঙালি রাজাকার ওদের সঙ্গে গল্প জমাবার চেষ্টা করছে। গল্প জমছে না। ওরা হাল ছাড়ছে না, ওস্তাদজী ওস্তাদজী বলেই যাচ্ছে।

    বদিউজ্জামানের মনে হল জ্বর এসেছে। সে নিশ্চিত হতে পারছে না। মাথায় হাত দিলে কোনো উত্তাপ পাওয়া যায় না। কিন্তু তার কান ঝাঁঝাঁ করছে। কিছুক্ষণ আগেও তার শীত করছিল। এখন আর করছে না। খুকখুক করে কে যেন কাশল। নাকি সে নিজেই কাশছে? নিজামের মতো তারও কি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে? একবার মনে হল শীতল। ও লম্বা একটা কি যেন তার শার্টের ভেতর ঢুকে গেছে। সে প্রায় চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিল। কিন্তু চিৎকার করল না। মনের ভুল। শার্টের ভেতর কিছুই নেই। বুদিউজ্জামানের মনে হল সে যেন অনেকের কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছে। কথাবার্তা বলতে বলতে কারা যেন এগিয়ে আসছে। এটাও কি মনের ভুল? বদিউজ্জামান উৎকর্ণ হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। সে ঠিক করে রাখল মিলিটারিরা তাকে মেরে ফেললে সে বলবে, ভাইয়েরা কেমন আছেন? বড় মজার ব্যাপার হবে। বদিউজ্জামান নিজের মনে খুকখুক করে হাসতে লাগল। বাঁ দিকে চারটা সবুজ চোখ তাকিয়ে আছে তার দিকে শেয়াল। দিনে যে-শেয়ালটা তাকে দেখে গিয়েছিল সে নিশ্চয়ই তার স্ত্রীকে ডেকে নিয়ে এসেছে। ভাবতে বেশ মজা লাগল বদিউজ্জামানের। সে আবার হাসতে শুরু করল। এবার আর নিজের মনে হাসা নয়, শব্দ করে হাসা।

    ১৫.

    রফিক বাইরে এসে দেখল, মেজর সাহেব স্কুলঘরের শেষ প্রান্তের বারান্দায় একাকী দাঁড়িয়ে আছেন। রফিককে দেখে তিনি কিছুই বললেন না। রফিক বারান্দায় নেমে গেল। অপেক্ষা করল খানিকক্ষণ, তারপর হাঁটতে শুরু করল গেটের দিকে। মেজর সাহেব ভারি গলায় ডাকলেন. রফিক।

    রফিক ফিরে এল।

    কোথায় যাচ্ছিলে?

    তেমন কোথাও না?

    তোমাকে একটা কথা বলার প্রয়োজন মনে করছি।

    বলুন।

    তুমি কি জান আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না?

    জানি।

    কখন থেকে অবিশ্বাস করতে শুরু করেছি জান?

    শুরু থেকেই। কোনো বাঙালিকেই আপনি বিশ্বাস করেন না।

    তা ঠিক। যারা বিশ্বাস করেছে, সবাই মারা পড়েছে। আমার বন্ধু মেজর বখতিয়ার বিশ্বাস করেছিল। ওরা তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছে।

    মেজর বখতিয়ার বিশ্বাস করেছিল কি করে নি—সেটা আপনি জানেন না। অনুমান করছেন।

    হ্যাঁ, তাও ঠিক। আমি জানি না।

    মেজর সাহেব হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি ঐ মাস্টারটির বিশেষ অঙ্গে ইট ঝুলিয়ে দিয়েছ?

    না।

    কেন? প্রমাণ সাইজের ইট পাও নি?

    রফিক কথা বলল না। মেজর সাহেব চাপা স্বরে বললেন, বাঙালি ভাইদের প্রতি দরদ উথলে উঠেছে?

    আমার মধ্যে দরদটরদ কিছু নেই মেজর সাহেব। ইট ঝোলানোটা আমার কাছে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয়েছে।

    মোটেই অপ্রয়োজনীয় নয়। আমি ইট-বাঁধা অবস্থায় ওকে ওর প্রেমিকার কাছে নিয়ে যাব। এবং ওকে বলব সেই প্রেমের কবিতাটি আবৃত্তি করতে।

    কেন?

    রফিক।

    জ্বি স্যার।

    তুমি আমাকে প্রশ্ন করার দুঃসাহস কোথায় পেলে?

    আপনি একজন সাহসী মানুষ। সাহসী মানুষের সঙ্গে থেকে-থেকে আমিও সাহসী হয়ে উঠেছি।

    আই সি।

    এবং স্যার, আপনি এক বার আমাকে বলেছিলেন—আমার মনে কোনো প্রশ্ন থাকলে তা বলে ফেলতে।

    বলেছিলাম?

    জ্বি স্যার।

    সেই প্রিভিলেজ এখন আর তোমাকে দিতে চাই না। এখন থেকে তুমি কোনো প্রশ্ন করবে না।

    ঠিক আছে স্যার।

    রফিক।

    জ্বি স্যার। আজ তোমাকে অস্বাভাবিক রকম উৎফুল্ল লাগছে।

    আপনি ভুল করছেন সার। আমাকে উৎফুল্ল দেখানোর কোনো কারণ নেই। এমন কিছু ঘটে নি যে আমি উৎফুল্ল হব।

    তুমি বলতে চাও যে বিমর্ষ হবার মতো অনেক কিছু ঘটেছে?

    আমি তাও বলতে চাই না।

    মেজর সাহেব পশতু ভাষায় কি যেন বললেন। কোনো কবিতাটবিতা হবে হয়তো। রফিক তাকিয়ে রইল। মেজর সাহেব বললেন, রফিক, তুমি পশতু জান?

    জ্বি-না স্যার।

    না চাইলেও শোন। এর মানে হচ্ছে—বেশি রকম বুদ্ধিমানদের মাঝে-মাঝে বড় রকম বোকামি করতে হয়।

    রফিক কিছুই বলল না। মেজর সাহেব বললেন, চল, জয়নাল লোকটির কাছ থেকে কিছু জানতে চেষ্টা করি। তোমার কি মনে হয় ও আমাদের কিছু বলবে?

    না স্যার, বলবে না।

    কি করে বুঝলে?

    এরা কিছুই জানে না। কাজেই কিছু বলার প্রশ্ন ওঠে না।

    চল দেখা যাক।

    তোমার নাম জয়নাল?

    জ্বি।

    এই নেংটা মানুষটাকে তুমি চেন?

    জ্বি স্যার।

    ও তোমার মেয়েকে বিয়ে করতে চায়।

    জয়নাল মিয়া হতভম্ব হয়ে তাকাল।

    কিন্তু ওর যন্ত্রপাতি বেশি ভালো বলে মনে হচ্ছে না। আমার মনে হয় ভয় পেয়ে ওটার এই অবস্থা। আমি নিশ্চিত, উত্তেজিত অবস্থায় এটা আরো ইঞ্চিখানেক বড় হবে। কি বল জয়নাল?

    জয়নালের পা কাঁপতে লাগল—এসব কী শুনছে?

    তবে আমি ঐ যন্ত্রটার জন্যে একটা একসারসাইজের ব্যবস্থা করেছি। আমি ঠিক করেছি ওখানে একটা ইট ঝুলিয়ে দেব। এতে এটা আরো কিছু লম্বা হবে বলে মনে হয়।

    ইমাম সাহেব অস্ফুট একটি ধ্বনি করলেন। মেজর সাহেব বললেন, কিছু বলবে ইমাম?

    জ্বি-না স্যার।

    জয়নাল, তুমি কিছু বলবে? জ্বি-না।

    আমি ঠিক করেছি মাস্টারকে এই অবস্থায় তোমার মেয়ের কাছে নিয়ে যাব। জিজ্ঞেস করব এই সাইজে ওর চলবে কি না। জয়নাল, তোমার মেয়েটি কি বাড়িতে আছে?

    জয়নাল মিয়া মাটিতে বসে পড়ল। মেজর সাহেব হাসি-হাসি মুখে তাকিয়ে রইলেন। যেন কিছু শোনার জন্যে অপেক্ষা করছেন। ঘরে একটি শব্দও হল না।

    জয়নাল।

    জ্বি।

    তোমার মেয়েটি বাড়িতেই আছে আশা করি।

    জয়নাল মিয়া হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। মেজর সাহেব প্রচণ্ড ধমক দিলেন, কান্না বন্ধ কর। কান্না আমার সহ্য হয় না। চল যাই। দেরি হয়ে যাচ্ছে। চল চল।

    আজিজ মাষ্টার তখন কথা বলল। অত্যন্ত স্পষ্ট স্বরে বলল, মেজর সাহেব, আমি মরবার জন্যে প্রস্তুত আছি। আমাকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচান।

    মেজর সাহেব মনে হল বেশ অবাক হলেন। কৌতূহলী গলায় বললেন, মরতে রাজি আছ?

    হ্যাঁ।

    ভয় লাগছে না?

    লাগছে।

    তবু মরতে চাও?

    আজিজ মাস্টার জবাব না দিয়ে নিচু হয়ে তার পায়জামা তুলে পরতে শুরু করল। মেজর সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করতে লাগলেন। কিছুই বললেন না।

    আজিজ মাস্টারকে তার প্রায় দশ মিনিটের মধ্যে রাজাকাররা নিয়ে গেল বিলের দিকে। আজিজ মাস্টার বেশ সহজ ও স্বাভাবিকভাবেই হেঁটে গেল। যাবার আগে ইমাম সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, স্নামালিকুম। ইমাম সাহেব বা জয়নাল মিয়া কেউ কিছু বলল না।

    আজিজ মাস্টার চলে যাবার পর দীর্ঘ সময় কেউ কোনো কথা বলল না। মেজর সাহেব গম্ভীর মুখে সিগারেট টানতে লাগলেন। জয়নাল মিয়া কাঁপতে লাগল থরথর করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্কুলঘরের পেছনে কয়েকটি গুলির শব্দ হল। ইমাম সাহেব ক্রমাগত দোয়া ইউনুস পড়তে লাগলেন।

    মেজর সাহেব বললেন, জয়নাল, তুমি আমার প্রশ্নের ঠিক-ঠিক জবাব দাও। আমাকে রাগিও না। বল, মোট কত জন সৈন্য লুকিয়ে আছে তোমাদের জঙ্গলা মাঠে? মনে রাখবে আমি একই প্রশ্ন দু বার করব না। বল কত জন?

    প্রায় এক শ।

    ইমাম সাহেব চোখ বড়-বড় করে তাকালেন। রফিক অন্য দিকে তাকিয়ে রইল। মেজর সাহেব সিগারেট ধরালেন। সিগারেট ধরাতে গিয়ে তাঁর হাত কাঁপতে লাগল।

    এরা কবে এসেছে এই বনে?

    পরশু।

    এই গ্রাম থেকে তোমরা ক বার খাবার পাঠিয়েছ?

    তিন বার।

    আজিজ মাস্টার এবং ইমাম এরা এ-খবর জানে?

    জ্বি-না, এরা বিদেশি মানুষ। এদের কেউ বলে নাই।

    ঐ সৈন্যরা এখান থেকে কোথায় যাবে জান?

    জ্বি-না।

    কেউ জানে? জ্বি-না।

    ওদের মধ্যে কত জন অফিসার আছে?

    আমি জানি না।

    ওদের সঙ্গে গোলাবারুদ কী পরিমাণ আছে?

    জানি না স্যার।

    ওদের মধ্যে আহত কেউ আছে?

    আছে। কত জন?

    ছয়-সাত জন।

    ওরাও বনেই আছে?

    জ্বি-না।

    ওরা কোথায়?

    কৈবর্তপাড়ায়। জেলেপাড়ায়।

    বনে খাবার নিয়ে কারা যেত?

    কৈবর্তরা।

    মেজর সাহেব থামলেন। জয়নাল মিয়া মাটিতে বসে হাঁপাতে লাগল। রফিক এখনো জানালার দিয়ে তাকিয়ে আছে। মেজর সাহেব বললেন, ঠিক আছে, তুমি যাও।

    জ্বি স্যার?

    তুমি যাও। তোমাকে যেতে বললাম।

    জয়নাল মিয়া নড়ল না। উবু হয়ে বসে রইল। মেজর সাহেব বললেন, নাকি যেতে চাও না?

    যেতে চাই।

    তাহলে যাও। দৌড়াও। আমি মত বদলে ফেলার আগেই দৌড়াও।

    জয়নাল মিয়া উঠে দাঁড়াল। নিচু হয়ে বলল, স্যার, স্লামালিকুম।

    মেজর সাহেব বললেন, ইমাম, তুমিও যাও।

    ইমাম সাহেব নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না।

    যাও, যাও। চলে যাও। কুইক।

    ওরা ঘর থেকে বেরুল। স্কুলগেট পার হয়েই ছুটতে শুরু করল। মেজর সাহেব জানালা দিয়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর মুখ অত্যন্ত গম্ভীর।

    রফিক!

    জ্বি স্যার?

    জয়নাল কি সত্যি কথা বলল?

    মনে হয় না স্যার। প্রাণ বাঁচানোর জন্যে অনেক সময় এ-জাতীয় কথা বলা হয়।

    কিন্তু আমি জানি, ও সত্যি কথাই বলেছে।

    রফিক চুপ করে রইল।

    এবং আমার মনে হচ্ছে তুমিও তা জান।

    রফিক তাকাল জানালার দিকে। বাইরে ঘন অন্ধকার।

    আমার মনে হয় তুমি আরো অনেক কিছুই জান।

    আমি তেমন কিছু জানি না।

    তুমি শুধু বল, তোমাদের সৈন্যরা এখনো কি বনে লুকিয়ে আছে?

    আমি কী করে জানব?

    তুমি অনেক কিছুই জান। আমি কৈবর্তপাড়ায় তল্লাশি করতে চেয়েছিলাম, তুমি বলেছিলে—প্রযোজন নেই।

    আমার ভুল হয়েছিল। সবাই ভুল করে।

    ঝড়ের সময় একটা পাগল ছুটে গেল বনের ভেতর। যায় নি?

    হ্যাঁ।

    ওকে বনের ভেতর যেতে দেখে তুমি উল্লসিত হয়ে উঠলে।

    রফিক একটি নিঃশ্বাস ফেলল।

    বল, তুমি উল্লসিত হও নি?

    ভুল দেখেছেন স্যার।

    আমার ধারণা, ঐ পাগলটি বনে খবর নিয়ে গেছে। এবং সবাই পালিয়েছে ঝড়ের সময়।

    মেজর সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। কঠিন কণ্ঠে বললেন, চল আমার সঙ্গে।

    কোথায়?

    বুঝতে পারছ না কোথায়? তুমি তো বুদ্ধিমান, তোমার তো বুঝতে পারা উচিত। বল, বুঝতে পারছ?

    পারছি।

    ভয় লাগছে?

    না।

    ওরা কি ঝড়ের সময় পালিয়েছে?

    হ্যাঁ। এতক্ষণে ওরা অনেক দূর চলে গেছে। খুব তাড়াতাড়ি মধুবনের দিকে গেলে হয়তো এখনো ওদের ধরা যাবে।

    তুমি আবার আমাকে কনফিউজ করতে চেষ্টা করছ। এরা হয়তো বনেই বসে আছে।

    রফিক মৃদু হাসল।

    বল, ওরা কি বনে বসে আছে?

    হয়তো আছে। গভীর রাতে বের হয়ে আসবে।

    ঠিক করে বল।

    আপনি এখন আমার কোনো কথাই বিশ্বাস করবেন না। কাজেই কেন শুধু শুধু প্রশ্ন করছেন?

    কৈবর্তপাড়ায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। চিত্রা বুড়ি অবাক হয়ে আগুন দেখছে। রাজাকাররা ছোটাছুটি করছে। তাদের ছোটাছুটি দেখে মনে হয় খুব উৎসাহ বোধ করছে। আগুন জ্বালানোর জন্যে তাদের যথেষ্ট খাটাখাটনি করতে হচ্ছে। ভেজা ঘরবাড়ি। আগুন সহজে ধরতে চায় না।

    মীর আলি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আগুন আগুন বলে চিৎকার করছে। সে চোখে দেখতে পায় না। কিন্তু আগুন দেখতে পাচ্ছে। গ্রামের মানুষজন সব বেরিয়ে আসছে ঘর থেকে।

    ১৬.

    মেজর এজাজ আহমেদ পাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর পাশে ডান দিকে, চাইনীজ রাইফেল হাতে দুজন জোয়ান এসে দাঁড়িয়েছে। রফিক নেমেছে বিলে।

    বিলের পানি অসম্ভব ঠাণ্ডা। রফিক পানি কেটে এগোচ্ছে। কী যেন ঠেকল হাতে। মনার ছোট ভাই বিরু। উপুড় হয়ে ভাসছে। যেন ভয় পেয়ে কাছে এগিয়ে আসতে চায়। রফিক পরম স্নেহে বিরুর গায়ে হাত রেখে বলল, ভয় নাই। ভয়ের কিছুই নাই।

    পাড়ে বসে থাকা মেজর সাহেব বললেন, কার সঙ্গে কথা বলছ রফিক।

    নিজের সঙ্গে মেজর সাহেব।

    কী বলছ নিজেকে?

    সাহস দিচ্ছি। আমি মানুষটা ভীতু।

    রফিক।

    বলুন।

    ওরা কি বন ছেড়ে চলে গেছে? সত্যি করে বল।

    রফিক বেশ শব্দ করেই হেসে উঠল। আচমকা হাসির শব্দে মেজর সাহেব চমকে উঠলেন।

    কৈবর্তপাড়ায় আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। আলো হয়ে উঠছে চারদিক। রফিককে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে এবার। ছোটখাটো অসহায় মানুষ বুকপানিতে দাঁড়িয়ে আছে। মেজর সাহেব বললেন, রফিক, তুমি কি বেঁচে থাকতে চাও?

    রফিক শান্ত স্বরে বলল, চাই মেজর সাহেব। সবাই বেঁচে থাকতে চায়। আপনি নিজেও চান চান না?

    মেজর সাহেব চুপ করে রইলেন। রফিক তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, মেজর সাহেব, আমার কিন্তু মনে হয় না আপনি জীবিত ফিরে যাবেন এ-দেশ থেকে।

    মেজর এজাজ আহমেদ সিগারেট ধরালেন, কৈবর্তপাড়ার আগুনের দিকে তাকালেন। পশতু ভাষায় সঙ্গের জোয়ান দুটিকে কী যেন বললেন। গুলির নির্দেশ হয়তো। রফিক বুঝতে পারল না। সে পশতু জানে না।

    হ্যাঁ, গুলির নির্দেশই হবে। সৈন্য দুটি বন্দুক তুলছে। রফিক অপেক্ষা করতে লাগল।

    বুক পর্যন্ত পানিতে ডুবিয়ে লালচে আগুনের আঁচে যে-রফিক দাঁড়িয়ে আছে, মেজর এজাজ আহমেদ তাকে চিনতে পারলেন না। এ অন্য রফিক। মেজর এজাজের কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম জমতে লাগল।

    ⤶
    1 2 3 4
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleসে ও নর্তকী – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article কাঠপেন্সিল – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই বসন্তে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই মেঘ, রৌদ্রছায়া – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এইসব দিনরাত্রি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 23, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Our Picks

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }