পরিশিষ্ট – নিউস্পিকের নীতিকথা
পরিশিষ্ট – নিউস্পিকের নীতিকথা
নিউস্পিক ওশেনিয়ার সরকারি এক ভাষারীতি। ইংসকের বা ইংলিশ সোশ্যালিজমের আদর্শগত প্রয়োজনেই এর সৃষ্টি। ১৯৮৪ সালে এই নিউস্পিকের যে ব্যবহার আমরা দেখছি, হোক তা লেখায় কিংবা বলনে, তা স্রেফ যোগাযোগের প্রয়োজনেই। টাইম পত্রিকার প্রধান নিবন্ধগুলো এই ভাষায় রচিত হচ্ছে। তবে তা সম্পূর্ণই বিশেষ এক দক্ষতায়। বিশেষজ্ঞদের পক্ষেই এই কাজ করা সম্ভব। প্রত্যাশা এই যে, ভাষার এই নতুন কথ্যরূপ একদিন পূরোনো ভাষার ব্যবহারকে ছাপিয়ে যাবে। আর পুরোনো ভাষা কিংবা প্রমিত ইংরেজি, যে নামেই আমরা তাকে ডাকি না কেনো, ২০৫০ সাল নাগাদ পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
এরই মধ্যে নিউস্পিক তার ভিত গেড়ে নিয়েছে, আর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। পার্টির সদস্যরা তাদের প্রাত্যহিক কথনে বলনে এই ভাষা আর তার ব্যকরণগত ব্যবহারে জোর দিয়ে চলছেন। আজ ১৯৮৪ সালে যে ভাষার ব্যবহার প্রচলিত হয়ে গেছে আর নিউস্পিক অভিধানের নবম ও দশক সংস্করণে যার স্থান পাকাপাকি, তা এখন ওশেনিয়ার ভাষারীতিতে রূপ নিচ্ছে। এই ভাষা থেকে বিশেষণের অতিশায়ন কিংবা বিশেষায়িত বিশেষণগুলো বাতিল হয়ে গেছে। আর বলা যায় একসময় তা পুরোই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। অভিধানের একাদশ সংস্করণে বিষয়টি পাকাপাকি হয়ে যাচ্ছে। এতে চূড়ান্ত আর যথার্থ এক নতুন ভাষারূপ স্থান পাচ্ছে, আর সেটা নিয়েই আমাদের কথা।
ইংসকভক্তদের মানসিক ভাবনা আর বিশ্ব নিয়ে তাদের অভিব্যক্তি নিয়ন্ত্রণ করাই কেবল নিউম্পিকের উদ্দেশ্য নয়, চিন্তার অন্য পথগুলোকে অসম্ভব করে তোলাও এর লক্ষ্য। প্রত্যাশা এই যে, নিউস্পিক সবার জন্য প্রযোজ্য হবে, পুরোনো ভাষা সবাই ভুলে যাবে। তার মধ্য দিয়ে তারা ভুলে যাবে উৎপথগামীতার ভাবনাও, যে ভাবনা তাদের ইংসকের নীতির পথ থেকে সরে যেতে পথ দেখায়। আসলে প্রকৃতপক্ষে তাদের চিন্তার শক্তিটিই থাকবে না, অন্তত সেইসব চিন্তা, যা কোনো শব্দ থেকেই উৎসারিত। এর শব্দগুলো এমনভাবে তৈরি যাতে পার্টির কাছে ওই শব্দের যা অর্থ সেটাই হবে সকলেরই ভাবনা বা বোধ, তাতে ওই শব্দের অন্য সব অর্থই বাতিল হয়ে যাবে, কোনো পরোক্ষ পথেও তাদের মনের গহীনে ওই শব্দের ভিন্ন কোনো মানে ঢুকে পড়তে পারবে না। অংশত কাজটি চলছে নতুন শব্দ আবিস্কারের মধ্য দিয়ে, তবে মুখ্যত অপ্রত্যাশিত শব্দগুলো বাদ দেওয়া, প্রথাসিদ্ধ যে কটি শব্দ বাকি রয়েছে সেগুলো ছেঁটে ফেলা, আর যদি থেকেও যায়, কোনো শব্দেরই দ্বৈত অর্থ থাকার সুযোগ না রাখাই উদ্দেশ্য। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন ‘ফ্রি’ শব্দটি। এটি নিউস্পিকে রয়ে গেছে, কিন্তু এর মানে কেবল- ‘কুকুরটির শরীর উকুনমুক্ত’ কিংবা ‘মাঠটি পুরো আগাছামুক্ত হিসেবেই প্রচলিত থাকবে। অতীতে ‘রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন’ কিংবা ‘স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা’র ক্ষেত্রেও এর যে ব্যবহার চলত, তা আর চলবে না, কারণ রাজনৈতিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা এখন আর ধারণাগতভাবেও টিকে নেই। তো যার অস্তিত্বই নেই তার নামেরই কী প্রয়োজন। নব্যতান্ত্রিক শব্দগুলোর অবদমন ছাড়াও শব্দভাণ্ডার সংকোচন চলছে, পরিহারযোগ্য একটি শব্দও যাতে থেকে না যায় তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। এই নিউস্পিকের নকশাটাই এমনভাবে আঁকা হয়েছে যাতে চিন্তার ব্যাপ্তি নয়, বরং চিন্তার অবদমন ঘটে। শব্দ পছন্দাপছন্দের সুযোগ ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে এনে এই উদ্দেশ্য হাসিল করা হচ্ছে। নিউস্পিক ইংরেজি ভাষার ওপরেই তৈরি, কিন্তু এর অনেক নতুন বাক্যই আমাদের দিনগুলোর ইংরেজি ভাষার মতো পরিষ্কার নয়। অথচ বাক্যগুলোতে একটি নতুন শব্দের ব্যবহারও নেই। নিউস্পিকের শব্দগুলো তিনটি সুনির্দিষ্ট শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে এ-ভোকাবুলারি, বি- ভোকাবুলারি (একে যৌগিগ শব্দভাণ্ডারও বলা চলে) আর সি-ভোকাবুলারি। প্রতিটি ভাগ নিয়ে পৃথক আলোচনা অপেক্ষাকৃত সহজ, তবে ভাষার ব্যাকরণগত বিশিষ্টতার দিকটি এ-ভোকাবুলারি অংশেই প্রযোজ্য আর তিন ধরণেই রীতিপদ্ধতি এক।
এ-ভোকাবুলারি। প্রাত্যহিক জীবনের কাজে-কর্মে এই শব্দসম্ভারের ব্যবহার চলে। যেমন- খাওয়া, কাজ করা, পোশাক-পরিধান, ধরা-থোওয়া, উপরে ওঠা, নিচে নামা, গাড়ি চড়া, বাগান করা, রান্না-বান্না এহেন শব্দগুলো। আঘাত করা দৌড়ানো, কুকুর, গাছ, চিনি, ঘর, মাঠ এ ধরনের শব্দগুলোও এতে রয়েছে— কিন্তু প্রচলিত ইংরেজিতে যে বিশাল শব্দভাণ্ডার রয়েছে তার তুলনায় এতে টিকে থাকা শব্দের সংখ্যা নিতান্তই কম, আর এগুলোর অর্থও খুব কঠোরভাবে সংজ্ঞায়িত। শব্দগুলো থেকে সকল ধোয়াশা, অর্থের অস্পষ্টতা ও ছায়াছন্নতা ছেঁটে ফেলা হয়েছে। নিউস্পিকের প্রতিটি শব্দের স্রেফ একটিই ধ্বনি আর একটিই সুস্পষ্ট মানে। সাহিত্যসৃষ্টিতে কিংবা রাজনৈতিক বা দার্শনিক আলোচনায় এ-ভোকাবুলারি থেকে একটি শব্দ ব্যবহারেরও সুযোগ নেই। স্রেফ সাধারণ ইতিবাচক ভাবনা, শারীরিক কাজে কর্মেই যার ব্যবহার চলে তা-ই স্থান পেয়েছে এই অংশে।
নিউস্পিকের ব্যাকরণগত দুটি অসাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর প্রথমটি হচ্ছে বিভিন্ন পদের মধ্যে অনেকটা পরিপূর্ণ আন্তঃপরিবর্তনের সুযোগ। ভাষার যেকোনও শব্দ (নীতিগতভাবে ‘ইফ’ কিংবা ‘হোয়েন’র মতো ভাববাচক শব্দের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য) ক্রিয়া হিসেবে যেমন ব্যবহৃত হতে পারে তেমনি তা বিশেষ্য, বিশেষণ কিংবা ক্রিয়া বিশেষণও হতে পারে। ক্রিয়া ও বিশেষ্য পদের মাঝে কোনো ভিন্নতা থাকে না, আর ঠিক এই রীতির মধ্য দিয়ে শব্দের অনেক অপ্রচলিত ধারার অবলুপ্তি ঘটে। ‘থট’ শব্দটিকে উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক। নিউস্পিকে এর কোনো স্থান নেই। এর স্থানটি নিয়ে নিয়েছে ‘থিংক’ নামের শব্দটি যা একই সঙ্গে বিশেষ্য ও ক্রিয়া দুটি পদেরই কাজ করে। শব্দের ব্যুৎপত্তিগত কোনো নীতি এখানে মানা হয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৌলিক বিশেষ্যটিকে রাখা হয়েছে আবার কোনো ক্ষেত্রে মৌলিক ক্রিয়া পদটি থেকে গেছে। যেসব ক্ষেত্রে বিশেষ্য ও ক্রিয়াপদের অর্থগত স্বজাতি-সম্পর্ক রয়েছে সেগুলোর এটি, নয়তো অন্যটি রেখে অপরটি বাদ পড়েছে। যেমন ‘কাট’ শব্দটি তার অস্তিত্ব হারিয়েছে ‘নাইফ’ শব্দটির বিশেষ্য- ক্রিয়াবাচক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। আর শব্দগুলো বিশেষণের রূপ পাচ্ছে বিশেষ্য- ক্রিয়াবাচকে স্রেফ ‘ফুল’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে, আর ক্রিয়া বিশেষণ করতে ব্যবহার করা হচ্ছে ‘ওয়াইজ’ প্রত্যয়টি। উদাহরণ, স্পিডফুল মানে হচ্ছে ‘দ্রুত’ আর ‘স্পিডওয়াইজ’ মানে ‘তাড়াতাড়ি’। আমাদের সময়ের ‘গুড, স্ট্রং, বিগ, ব্ল্যাক, সফট, শব্দগুলো থেকে গেছে ঠিকই তবে বাদ পড়েছে এমন শব্দের সংখ্যাই বেশি। এগুলোর খুব একটা প্রয়োজনও নেই, কারণ যেকোনো বিশেষ্য-ক্রিয়া পদের সঙ্গে ‘ফুল’ প্রত্যয় যোগ করে দিলেই কাজ চলে। ক্রিয়া-বিশেষণগুলোর যে গুটিকয় –ওয়াইজ প্রত্যয় নিয়ে আগে থেকেই প্রচলিত সেক’টি ছাড়া আর একটিও টিকে নেই। -ওয়াইজ এর ব্যবহার দেখি যত্রতত্র। ‘ওয়েল’ শব্দটির কথাই ধরুন, ওটি পাল্টে বলা হচ্ছে ‘গুডওয়াইজ’।
উপরন্তু, কোনো শব্দ- বলা চলে নব্য ভাষার যে কোনো শব্দ নেতিবাচক রূপ পাবে স্রেফ শব্দের আগে ‘আন’ উপসর্গটি যুক্ত করে। আর শব্দের ওপর জোর দিতে চাইলে আগে থাকবে ‘প্লাস’ উপসর্গের ব্যবহার। আর যদি তার চেয়েও জোর দিতে চান ‘ডাবল প্লাস’ বলে দিন। উদাহরণ ভুরি ভুরি। ‘আনকোল্ড’ মানে হচ্ছে উষ্ণ। আর ‘প্লাসকোল্ড’ কিংবা ‘ডাবল প্লাসকোল্ড’ বললে খুব ঠান্ডা আর ভীষণ ঠান্ডাই বুঝাবে। আগের ইংরেজিতে যে এসবের ব্যবহার সম্ভব ছিল না, তা নয়। অ্যান্টে-, পোস্ট-, আপ-, ডাউন- জাতীয় প্রাসঙ্গিক উপসর্গগুলো দিয়ে অনেক শব্দেরই অর্থ বদলে দেওয়া যেত। তবে নতুন এই পদ্ধতিতে বিপুল সংখ্যক শব্দকে বিদায় জানানো সম্ভব হয়েছে। উদাহরণ দিচ্ছি- ‘গুড’ শব্দটি রয়েছে, তো এখন এর বিপরীতার্থক ‘ব্যাড’ শব্দটির কোনো প্রয়োজন নেই, যখন ‘আনগুড’ বলা হলে একই রকম অর্থ দেয়, বলা চলে অপেক্ষাকৃত সুনির্দিষ্টও হয়। যখন দুটি শব্দ প্রাকৃতিকভাবেই বিপরীতার্থক তখন তার মধ্যে কোনটি টিকিয়ে রাখা হবে, কোনটি বাদ যাবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই এখানে জরুরি। ‘ডার্ক শব্দটির কথাই ধরুন, সহজেই এর ব্যবহার সিদ্ধ হয়ে যায় ‘আনলাইট’ দিয়ে, আবার ‘লাইট’ শব্দটি না বলে ‘আনডার্ক’ বললেও চলে। এখন সিদ্ধান্তের বিষয় কোন শব্দটি অগ্রাধিকার পাবে।
নিউস্পিকের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে এর নিয়মানুবর্তিতা। নিম্নবর্ণিত গুটিকয় ব্যতিক্রম বাদে সকল শব্দরূপের একই রীতি। সকল ক্রিয়াপদের অতীত ও ঘটমান অতীতরূপ অভিন্ন এবং ‘-এড’ দিয়ে শেষ হয়। ‘স্টিল’ শব্দটির অতীতরূপ ‘স্টিলড’, ‘থিংক’ শব্দের অতীতরূপ ‘থিংকড’। গোটা ভাষা থেকে ‘সোয়াম, গেভ, ব্রট, স্পোক, টেকেন জাতীয় শব্দগুলো বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়েছে। বহুবাচনিক শব্দ বোঝাতে স্রেফ ‘-এস’ বা ‘-ইএস’ এর ব্যবহার চলছে। ম্যান, অক্স, লাইফ এখন হয়ে গেছে ম্যানস, অক্সেস, লাইফস। তুলনামূলক বিশেষণেও চলছে স্রেফ ‘ইআর, –ইএসটি’র ব্যবহার (গুড, গুডার, গুডেস্ট), মোর, মোস্ট ধরনের ব্যতিক্রমী শব্দের ব্যবহার উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কিছুটা ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায় সর্বনাম, আপেক্ষিক ও অভিব্যক্তিশীল বিশেষণ, আর সাহায্যকারী ক্রিয়ার ব্যবহারে। এগুলোতে পুরনো ব্যবহাররীতিই অব্যাহত রয়েছে। তবে ‘হুম’ কথাটি অপ্রয়োজনীয় বলে ভাগাড়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, আর বাতিল করা হয়েছে ক্রিয়ার কাল বোঝাতে ‘শ্যাল, শুড’র ব্যবহারও। ‘উইল আর উড’ দিয়েই চলছে এর সবকিছুর ব্যবহার। দ্রুত আর সহজকথনের প্রয়োজনেও শব্দ-গঠনের কিছু ব্যতিক্রমী ব্যবহার রয়েছে। একটি শব্দ যখন উচ্চারণগত দিক থেকে কঠিন কিংবা ভুলভাবে শুনতে পারার সম্ভাবনা থেকে যায় তখন তাকে মন্দশব্দ বলা চলে, সেক্ষেত্রে শব্দগুলো শ্রুতিমধুর করতে কিছু অতিরিক্ত বর্ণ যোগ করা প্রয়োজন পড়ে। এমন শব্দগুলো নিউস্পিকে থেকে গেছে। বি-ভোকাবুলারিতে এ ধরনের শব্দের বেশি ব্যবহার রয়েছে। কেন এই শব্দগুলোতে এতটা গুরুত্ব দিয়ে সহজ উচ্চারণ নিশ্চিত করে রেখে দেওয়া হলো তা এই নিবন্ধের পরের দিকে আলোচনা করবো।
বি-ভোকাবুলারি। এই অংশটি এমন সব শব্দভাণ্ডারে ভরপুর যা স্রেফ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রতিটি শব্দেরই যে কেবল একটি রাজনৈতিক সংসৃষ্টতা রয়েছে তাই নয়, এই শব্দের ব্যবহারকারীর ওপর একটি প্রত্যাশিত মানসিক অভিব্যক্তি আরোপের ইচ্ছাটিও প্রকট। ইংসকের নীতি সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান ও অনুধাবন না থাকলে যে কারো জন্য এই শব্দগুলোর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা কঠিন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এগুলো ওল্ডস্পিকে অনুবাদ করে নেওয়া যেতে পারে, অথবা এ-ভোকাবুলারি থেকে শব্দ নিয়েও করা যায়, কিন্তু তাতে বেশি কথা বলতে হবে আর বক্তব্যের মূল টোনটি হারিয়ে যেতে পারে। বি-ভোকাবুলারির শব্দগুলো অনেকটা কথ্য শর্টহ্যান্ড’র মতো, কখনো কখনো পুরো ধারণাটিকে মাত্র কয়েকটি শব্দাংশে ভরে দেয়, আর একই সঙ্গে তা হয়ে ওঠে সাধারণ ভাষার চেয়ে অনেক বেশি যথার্থ ও শক্তিশালী।
বি-শব্দগুলো সবক্ষেত্রেই যৌগিগ শব্দ। [‘স্পিকরাইট’ শব্দটির মতো যৌগিক কিছু শব্দ এ-ভোকাবুলারিতেও পাওয়া যাবে, তবে সেগুলো যুৎসই সংক্ষেপরূপ বৈ কিছু নয়, আর তাতে কোনো আদর্শগত রঙ চড়ানোও হয়নি।] একেকটি শব্দ দুই বা ততধিক শব্দের, কিংবা শব্দাংশের সমন্বয়ে, সহজ উচ্চারণযোগ্য করে তৈরি। এই মিশ্রণের ফলে সবসময়ই সৃষ্টি হয় একটি ক্রিয়া-বিশেষ্য, আর তা সাধারণ রীতি অনুসারে অভিব্যক্তি দেয়। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক: ‘গুডথিংক’ শব্দটির মোটাদাগে অর্থ দাঁড়ায় ‘প্রথাপন্থিতা’, আর কেউ যদি একে স্রেফ ক্রিয়া হিসেবে দেখতে চায়, তাহলে বলতে হবে ‘প্রথাপন্থির মতো চিন্তা করা’। এখন ‘গুডথিংক’ একটি ক্রিয়া-বিশেষ্য, এর অতীত বা ঘটমান অতীত হবে ‘গুডথিংকড’ ঘটমান বর্তমান হবে ‘গুড-থিংকিং ‘ বিশেষণ ‘গুডথিংকফুল’, ক্রিয়া-বিশেষণ ‘গুডথিংকওয়াইজ’ আর বিশেষ্য ‘গুডথিংকার’।
বি-শব্দগুলো ব্যুৎপত্তিগত পরিকল্পনার ধার ধরে নি। তারা যে শব্দগুলো বানিয়েছে সেগুলো যে কোনো পদে ব্যবহৃত হতে পারবে, যে কোনো ক্রমে বসানো যাবে আর যে অর্থ দিতে চায় সে অর্থে উচ্চারণ সহজ করতে যে কোনোভাবে কাঁটাছেঁড়া করা যাবে। ক্রাইমথিংক (চিন্তাঅপরাধ) শব্দটিকে উদাহরণ হিসেবে আনছি। এখানে ‘থিংক’ পরে আসছে, কিন্তু ‘থিংকপোল (চিন্ত পুলিশ)’ শব্দে এসেছে আগে। আর পরের ‘পোলিস’ শব্দটি তার দ্বিতীয় শব্দাংশটুকু হারিয়েছে। শ্রুতিমাধুর্য ধরে রাখার বিশাল জটিলতার কারণে এমন অস্বাভাবিক, ব্যতিক্রমি শব্দের ব্যবহার বি-ভোকাবুলারিতে যত্রতত্র মিলবে। আরেকটি উদাহরণ, ‘মিনিটু, মিনিপ্যাক্স ও মিনিলাভ-র বিশেষণরূপগুলো হচ্ছে যথাক্রমে ‘মিনিটুথফুল, মিনিপিসফুল ও মিনিলাভলি। খুব সহজেই কারণ, ট্রুথফুল, প্যাক্সফুল ও লাভফুল শব্দগুলো উচ্চারণগত দিক থেকে অপেক্ষাকৃত ঝামেলাপূর্ণ। নীতিগতভাবে সবগুলো বি-শব্দের অভিব্যক্তি থাকবে, আর সবগুলোই একইভাবে অভিব্যক্তি দেবে।
বি-শব্দমালার কোনো কোনোটির রয়েছে আবার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অর্থ। পুরো বিষয়টি যাদের আয়ত্তে নেই তাদের এই শব্দার্থ বোধগম্য হওয়াই কঠিন উদাহরণ হিসেবে টাইম পত্রিকার একটি প্রধান নিবন্ধ থেকে নেওয়া এই বাক্যটির কথা বলা যেতে পারে— ‘ওল্ডথিংকার্স আনবেলিফিল ইংসক।’ এই সংক্ষিপ্ত বাক্যটিকে পুরনো ভাষায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়- ‘বিপ্লবের আগেই যাদের ভাবাদর্শ গঠন হয়ে গেছে তাদের পক্ষে ইংলিশ সোশ্যালিজমের নীতিগুলো পুরোপুরি আবেগ দিয়ে অনুধাবন করা সম্ভব নয়।’ তবে এই অনুবাদ কিন্তু যথেষ্ট নয়। নিউস্পিকে লেখা উপরের ওই বাক্যটির পূর্ণ অর্থ বুঝে নিতে, যে কারও ইংসক সম্পর্কে পূর্ণজ্ঞান থাকতে হবে। আর তার পাশাপাশি ইংসকের সঙ্গে পুরোপুরি নিয়োজিত এমন কেউ ছাড়া ‘বেলিফিল’ শব্দটির পূর্ণ শক্তি অনুধাবনই করতে পারবে না। এই শব্দ দিয়ে দলের অন্ধ, অত্যুৎসাহী, আজকাল আর দেখাই যায় না এমন ভক্তদের ভাবনাকেই বুঝানো হয়েছে। অথবা ‘ওল্ডথিংক’ শব্দটির কথা বলা যায়- অবক্ষয়ী আক্রোশের সমন্বয় বুঝাতে অনুদ্ধরণীয় এক যৌগিক শব্দ এই ‘ওল্ডথিংক’। তবে এর মতো নিউস্পিকের সুনির্দিষ্ট কিছু শব্দের মূল কাজ কিন্তু অর্থ বা ভাব প্রকাশ নয় বরং এই শব্দের কারণে অনেক শব্দকেই ধ্বংস করে দেওয়া যায় বলেই এর সৃষ্টি। সংখ্যায় গুটি কয় হলেও এই শব্দগুলো নিজের মধ্যে কতগুলো শব্দের পূর্ণ শক্তি নিয়ে একক সমন্বিত পদের আবরণে ঢাকা থাকত, যা এখন হয় টেনেটুনে বেঁচে আছে নয়তো বিস্মৃত হয়েছে। নিউস্পিক অভিধানের রচয়িতাদের বড় কষ্ট কিন্তু নতুন শব্দ আবিষ্কারে নয়, বরং, সেই আবিষ্কারের পর তাদের জানতে হচ্ছে আগে এর প্রয়োগ কী ছিল আর নতুন এই শব্দের কারণে কত শব্দ বাদ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।
‘ফ্রি’ শব্দটি নিয়ে আগেই বলেছি, এমন যেসব শব্দ একসময় উৎপথপ্ৰতিপন্ন অর্থ বহন করত, সেগুলোও রেখে দেওয়া হয়েছে। তবে তা স্রেফ নিজেদের সুবিধা নেওয়ার জন্য। আর এসব শব্দ থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত সকল অর্থই হেঁটে বিদায় করা হয়েছে। অনার, জাস্টিস, মোরালিটি, ইনটেনশনালিজম, ডেমোক্রেসি, সায়েন্স আর রিলিজিয়ন’র মতো এমন অসংখ্য শব্দই স্রেফ অস্তিত্ব বিরতিতে চলে গেছে। কিছু ফাঁপা শব্দে সেগুলো ঢেকে দেওয়া হয়েছে, আর এই ঢাকনার অন্তরালে থেকে থেকে সেগুলো বিলুপ্ত হচ্ছে। যে শব্দগুলো স্বাধীনতা বা সমতার মতো কাছাকাছি অর্থ ধারণ করে সেগুলোকে একক শব্দ ‘ক্রাইমথিংক’ এর আওতায় ফেলে দেওয়া হয়েছে, আবার অবজেক্টিভিটি (নৈতিকতা), রেশনালিজম (যৌক্তিকতা)-এর ধারনা দেয় এমন শব্দগুলো একক শব্দ ‘ওল্ডথিংক’ দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছে।
বৃহত্তর শুদ্ধত্বর ধারণাটি হয়ে উঠতে পারে আরও বিপজ্জনক। পার্টির একজন সদস্যের মধ্যে যা চাওয়া হয় তাকে বলা চলে, প্রাচীনকালের কোনো হিব্রুর আচরণ। কোনো কিছু না জেনেই যারা জানত, তারা ছাড়া অন্য সব জাতিই ‘ভুল ঈশ্বর’-এর আরাধনা করছে। হিব্রুরা জানতও না এই ঈশ্বরদের রয়েছে অনেক নাম- বাল, ওসিরিস, মোলোচ, আশতারোথ, আরও অনেক। বিষয়টি হয়তো এমনই, যত কম জানবে, ততই গোঁড়া বিশ্বাসী হয়ে থাকবে। তারা শুধু জানত ঈশ্বর জেহোভার কথা আর তার আদেশের কথা: আর সে কারণেই তারা জানত, অন্য নামের যত ঈশ্বর আর ঈশ্বরের আরাধনা তা সবই ভুল। বলা চলে, অনেকটা ঠিক একইভাবে, পার্টির একজন সদস্য জানে, সদাচরণ কী, আর অতি অস্পষ্ট ও সাধারণীকরণে সে জানে এই আচরণ থেকে কতটুকুই বা সরে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব। তার যৌন জীবন নিয়েই উদাহরণ দেওয়া যাক, এই যৌনজীবন সুনির্দিষ্টভাবে নিউস্পিকের দুটি শব্দদ্বারা নিয়ন্ত্রিত – সেক্সক্রাইম (যৌন অনৈতিকতা) আর গুডসেক্স (কৌমার্য)। সেক্সক্রাইমের আওতায় আসবে সকল যৌন অনাচার। ব্যভিচার, পরদারগমন, সমকামিতা এবং অন্য যে কোনো বিকৃত যৌনাচারতো রয়েছেই পাশাপাশি থাকছে সাধারণ যৌনমিলনও। এগুলোতে আলাদা করে ব্যাখ্যা দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই কারণ এগুলো সব একই ধরনের অপরাধ, আর নীতিগতভাবে সবগুলোরই শাস্তির একই বিধান মৃত্যুদণ্ড।
বৈজ্ঞানিক আর কারিগরি শব্দের সি-ভোকাবুলারিতে, সুনির্দিষ্ট যৌন বিচ্যুতির জন্য আলাদা আলাদা নাম দেওয়া প্রয়োজন হতে পারে, কিন্তু সাধারণ নাগরিকের ক্ষেত্রে তার কোনো প্রয়োজন নেই। পার্টির সদস্য এও জানে ‘গুডসেক্স’ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে কোনো ব্যক্তির সঙ্গে তার স্ত্রীর যৌনমিলন, আর তা স্রেফ বাচ্চা উৎপাদনের জন্য, তাতে নারীটির শারীরিক কোনো আনন্দের বিষয়ই থাকবে না, এর বাইরে সব কিছুই ‘সেক্সক্রাইম’। নিউস্পিকে উৎপথপ্রতিপন্নতা স্রেফ একটি ধারণা ছাড়া কিছুই নয়, খারেজি ভাবনা এখানে কদাচই চর্চা করা সম্ভব।
বি ভোকাবুলারির একটি শব্দও আদর্শগতভাবে নিরপেক্ষ নয়। এর বিপুল সংখ্যকই সুভাষণমাত্র। যেমন ‘জয়ক্যাম্প’ (জবরদস্তিমূলক শ্রম ক্যাম্প) অথবা ‘মিনিপ্যাক্স’ (মিনিস্ট্রি অব পিস, প্রকারন্তরে যেটি মিনিস্ট্রি অব ওয়ার) শব্দ দুটির মূল অর্থ এর প্রকাশার্থের ঠিক বিপরীত। কিছু শব্দ, পক্ষান্তরে, ওশেনিক সমাজের প্রকৃত খোলাখুলি অবজ্ঞার চেহারাটি তুলে ধরে। একটি উদাহরণ হতে পারে ‘প্রোলেফিড’। যার মানে নোংরা বিনোদনমূলক ও বানোয়াট খবর যা পার্টি সাধারণের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চায়। আবার কিছু শব্দ রয়েছে যেগুলো পরস্পর সদৃশ বা বিপরীত দুটি মূল্যই ধারণ করে। যখন পার্টির কারো ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় তখন তা ‘ভালো’ অর্থে দ্যোতনা দেয়, আর শত্রুর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হলে তা মন্দ অর্থ দেয়। তবে এছাড়াও বিপুল সংখ্যক শব্দ রয়েছে, যেগুলো প্রথম দর্শনে বেশ সুভাষিত মনে হবে, তবে সে শব্দগুলোর আদর্শগত বিচ্যুতি ঘটেছে অর্থ থেকে নয়, খোদ কাঠামো থেকে। যতটা সম্ভব হয়েছে, রাজনৈতিক গুরুত্ব কিংবা সংসৃষ্টতা রয়েছে এমন সব কিছুই বি-ভোকাবুলারিতে সন্নিবেশ ঘটানো হয়েছে। প্রতিটি সংস্থা, সংগঠন, মতবাদ, দেশ, প্রতিষ্ঠান কিংবা সরকারি ভবনের নাম ছেঁটেফেঁটে পরিচিত কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছে, যাতে সহজে উচ্চারণযোগ্য সবচেয়ে কম শব্দাংশ ব্যবহার করে একক একটি শব্দ হয়, আবার তাতে আগের নামটিও থেকে যায়।
সত্য মন্ত্রণালয়ের রেকর্ডস ডিপার্টমেন্টটির কথাই ধরা যাক, যেখানে উইনস্টন চাকরি করে, এর নাম রেকডেট। ফিকশন ডিপার্টমেন্টকে বলা হচ্ছে ফিকডেপ, টেলিগ্রামস ডিপার্টমেন্টের নামকরণ হয়েছে টেলিডেপ, এমন আরও অনেক। এসব যে স্রেফ সময় বাঁচানোর জন্য করা হয়েছে তা কিন্তু নয়। এমনকি বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দশকগুলোতেও রাজনৈতিক পরিভাষায় শব্দের দুই অংশ মিলে এক শব্দ তৈরির রেওয়াজ ছিল, আর সমগ্রবাদী দেশ ও সমগ্রবাদী সংগঠনগুলোতে এমন সংক্ষিপ্ত রূপে শব্দ ব্যবহারের প্রবণতা দেখা গেছে। নাজি, গেসটাপো, কমিনটার্ন, ইনপ্রেকর, অ্যাজিটপ্রপ এগুলো এমনই শব্দের উদাহরণ। গোড়ার দিকে এই ব্যবহারগুলো বলতে বলতে এসে গেছে, কিন্তু নিউস্পিকে অতি সচেতনতায় উদ্দেশ্যমূলকভাবে এর ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়েছে। বোঝা যায়, এই সংক্ষেপায়নের মধ্য দিয়ে শব্দের অর্থ পাল্টে দেওয়া বা সংকীর্ণ করে দেওয়াই উদ্দেশ্য। শব্দগুলোর সব ডালপালা ছেঁটে দেওয়া হয়েছে যাতে এর আর কোনো অর্থ না দাঁড়াতে পারে। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল শব্দদুটির কথা ধরা যাক। এর সাথে সাথেই আসে বিশ্ব মানব ভ্রাতৃত্ব, লাল ঝাণ্ডা, অবরোধ, কার্ল মার্কস আর প্যারিস কমিউনও। কিন্তু কমিনটার্ন যখন বলা হবে তখন ঠাস-বুননে গঠিত একটি সংগঠনকেই বুঝাবে যা মতবাদনির্ভর একটি পরিষদ বৈ কিছুই নয়। এটি সহজে চেনা যায়, উদ্দেশ্য সীমিত, ঠিক চেয়ার কিংবা টেবিল শব্দগুলোর মতো। কমিনটার্ন বলা হলে তা থেকে কোনো ভাবনার উদ্রেক হবে না, কিন্তু কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল একটি শব্দবন্ধ যা কানে গেলে একদণ্ড হলেও আপনাকে ভাবতে হবে। একইরকমভাবে মিনিস্ট্রি অব ট্রুথ’র সঙ্গে যে বিষয়গুলো চলে আসে মিনিট্র শব্দটির সঙ্গে তেমনটা আসে না। আসলেও তা অপেক্ষাকৃত নিয়ন্ত্রণযোগ্য। এতে বোঝা যায় যতটা সম্ভব শব্দকে সংক্ষেপ করে ফেলাই কেবল এর উদ্দেশ্য নয়, বরং অনেকটা যত্নের সঙ্গেই সহজ উচ্চারণযোগ্য করে তুলে এগুলোর অর্থ সুনির্দিষ্ট করাও অন্যতম লক্ষ্য। নিউস্পিকে শ্রুতি মাধুর্য, অর্থের যথার্থতা ছাড়া আর সবকিছুকে ছাড়িয়ে যায়। ব্যাকরণের রীতি পদ্ধতি বলি হয়ে যায় প্রয়োজনের কাছে। আর ঠিক এভাবেই, যখনই প্রয়োজন হয়েছে, সর্বোপরি রাজনীতির খাতিরে শব্দগুলোতে নির্ভুল অর্থ সংযোজনে, সহজ উচ্চারণে সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে যাতে বক্তা অনায়াসেই তা বলতে পারে আর বলার সময় তার মনে সুনির্দিষ্ট ওই বিষয়টিরই উদ্রেক ঘটে। বি-ভোকাবুলারির আরেকটি শক্তি হচ্ছে এখানে সন্নিবেশিত শব্দসমূহ অনেকটাই একরকম। গুডথিংক, মিনিপ্যাক্স, প্রোলিফিড, সেক্সক্রাইম, জয়ক্যাম্প, ইংসক, বেলিফিড, থিংকপল- এমন আরও অসংখ্য দুই বা তিন শব্দাংশের একেকটি শব্দ, আর প্রথম থেকে শেষ প্রতিটি শব্দাংশেই থাকে সমান জোর। এগুলোর ব্যবহারে বক্তব্যকে অস্পষ্ট করে তোলার আগ্রহ থাকে, একই সঙ্গে তা চর্বিত চর্বন আর একঘেঁয়ে বলেও মনে হয়। আর এর মূল উদ্দেশ্যও কিন্তু তাই। অভিসন্ধি হচ্ছে- বক্তব্যকে, বিশেষ করে কোনো বিষয়ের ওপর দেওয়া বক্তব্যকে অতিসচেতনতায় আদর্শগতভাবে অর্থ-নিরপেক্ষ করে তোলা। প্রাত্যহিক জীবনের নানা কারণে, সবসময় কিংবা কখনো কখনো কথার একটা প্রতিফলন থাকা চাই, কিন্তু পার্টির একজন সদস্যকে তার মতামতের ক্ষেত্রে প্রতিটি শব্দ উচ্চারণে সঠিক বিষয়টিতেই থাকতে হবে, ঠিক যেন মেশিনগান চাপলে তা থেকে বেরিয়ে আসে অব্যর্থ বুলেট। প্রশিক্ষণই তাকে এভাবে তৈরি করেছে। যে ভাষা তার জন্য তৈরি তা যেন এক অব্যর্থ হাতিয়ার, যে শব্দ তার জন্য বরাদ্দ তার কর্কশ উচ্চারণ ও সুনির্দিষ্ট সেচ্ছারোপিত কদর্যতা ইংসকের চেতনার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ, আর সেভাবেই প্রক্রিয়াটি এগিয়ে চলেছে।
আরেকটি বাস্তবতা হচ্ছে এখানে শব্দ পছন্দ করার সুযোগ খুব কম। আমাদের নিজেদের যত শব্দ জানা, তার তুলনায় নিউম্পিকের শব্দসংখ্য যৎসামান্যই বলা চলে। আর নতুন নতুন পথে তা ক্রমাগত আরও কমিয়েই আনা হচ্ছে। অন্য ভাষার থেকে নিউস্পিকের তফাৎটাই সেখানে যে, অন্য ভাষায় শব্দসম্ভার ক্রমাগত বাড়ে, আর এখানে তা কমে আসে। প্রতিটি শব্দ ছাঁটাই করতে পারাই যেন একেকটি সাফল্য। পছন্দ করে নেওয়ার সুযোগ যত কম হবে, ভাবনা জাগরুক হওয়ার সম্ভাবনাও তত কমবে। কথার জন্য মস্তিষ্কের নয় স্রেফ বাগযন্ত্রের ব্যবহারকেই যথেষ্ট করে তোলা এর উদ্দেশ্য। আর সেকথা নিউস্পিকের একটি শব্দে তুলেও ধরা হয়েছে। ওটি ডাকস্পিক, মানে হচ্ছে- হাঁসের মতো প্যাঁক-প্যাঁক করে ডেকে চলা। বি-ভোকাবুলারির আরও কিছু শব্দের মতো ডাকস্পিক শব্দটিও পরস্পর বিপরীত কিংবা সদৃশ দুটি অর্থই দেয়। যদি প্রথাপন্থি কিছু পই পই করে বলে চলো তাহলে তাতে প্রশংসা বৈ কিছু বুঝাবে না, আর ‘দ্য টাইমস’ যখন পার্টির কোনো বক্তাকে ডাবলপ্লাসগুড ডাকস্পিকার বলবে তখন তাকে উষ্ণ শ্রদ্ধাজ্ঞাপনই বলতে হবে।
সি-ভোকাবুলারি। এই ভোকাবুলারিকে অন্য দুটির সংযোজনও বলা চলে এবং তা মূলত বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি পরিভাষা। আজকাল সেসব বৈজ্ঞানিক পরিভাষা ব্যবহৃত হয় সেগুলো, আর তা একই মূল থেকে গঠিত। তবে এগুলোর সংজ্ঞায়নে আর অপ্রত্যাশিত অর্থ থেকে মুক্ত করতে বিশেষ যত্ন নেওয়া হয়েছে। অন্য দুটি ভোকাবুলারির মতো ব্যকরণরীতি মানা হয়েছে এই ক্ষেত্রেও। প্রাত্যহিক কথনে বলনে কিংবা রাজনৈতিক ভাষণে সি-শব্দগুলোর খুব কমই মূল্য রয়েছে। কোনো বিজ্ঞানী কিংবা কারিগরি বিভাগের কর্মী তার প্রয়োজনের সব শব্দই নিজের বিশেষত্বের ভিত্তিতে এখানে খুঁজে পাবে। এক বিশেষত্বের শব্দটি অন্য তালিকায় খুঁজতে গেলে কদাচই তা পাওয়া যাবে। গুটিকয় শব্দ অবশ্য রয়েছে যা সব তালিকায়ই পাওয়া যাবে, তবে বিজ্ঞানের সঙ্গে মনের বা চিন্তার সম্পর্ক টেনে একটি শব্দও এই ভোকাবুলারির কোনো শাখাতেই মিলবে না। আসলে ইংসক দিয়ে যথেষ্টভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার পর বিজ্ঞানের জন্য কোনো শব্দই রাখা হয়নি যা নতুন কোনো অর্থ দিতে পারে।
নিউস্পিকে প্রথাবিরোধী মতামত দেওয়া মোটামুটি অসম্ভব। উৎপথগামিতার কিছু উচ্চারণ ধর্মাবননার সামিল। ‘বিগ ব্রাদার ইজ আনগুড’ কথাটি হয়তো বলা যাবে। একজন প্রথাপন্থির কানে একথা স্রেফ উদ্ভট ঠেকলেও যুক্তির কাছে তা ধোপে টিকবে না, কারণ কথাটি বলার জন্য প্রয়োজনীয় শব্দের ঘাটতি রয়েছে। ইংসক বিরোধী মতবাদগুলো স্রেফ অস্পষ্ট শব্দহীনতায় মেনে নেওয়া সম্ভব, আর কেবল ব্যাপকার্থক পদেই তার নামকরণ করা চলে, যা দিয়ে কাউকে সুনির্দিষ্ট না করে গোষ্ঠী ধরে উৎপথগামীদের ওপর ঘৃণা ছড়ানো যায়। প্রথাবিরোধী কোনো উদ্দেশ্যে নিউস্পিকের ব্যবহার করতে যে কেউকে তা ওল্ডস্পিকের শব্দমালায় অনুবাদ করে নেওয়ার অবৈধ পথেই হাঁটতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, ‘অল ম্যানস আর ইকুয়াল’ নিউম্পিকের একটি সম্ভাব্য বাক্য। কিন্তু এ বাক্য ওল্ডস্পিকের ‘অল মেন আর রেডহেয়ার্ড’ বলতে ঠিক যেমনটা বোঝাত তারই মতো অর্থবহন করে। এতে কোনো ব্যাকরণগত ভ্রান্তি নেই কিন্তু সুস্পষ্টতই একটি অসত্য অভিব্যক্তি দেয়- যথা : সবগুলো লোক একই মাপের, ওজনের, কিংবা শক্তির। রাজনৈতিক সাম্যের ধারণাটিই আর টিকে নেই, যে কারণে সাম্য বা সমতা, ইকুয়াল শব্দের অর্থ থেকে সচেতনভাবেই বাদ পড়ে গেছে। ১৯৮৪ সালের এই সময়টিতে যখন ওল্ডস্পিকই যোগাযোগের সাধারণ মাধ্যম হিসেবে রয়ে গেছে তখন তত্ত্বগতভাবেই বিপদটি থেকে যায় যে, কেউ নিউস্পিক শব্দের ব্যবহার করতে গিয়ে মনে মনে ওল্ডস্পিকের অর্থ স্মরণ করে বসতে পারে। এখনকার চর্চায় দ্বৈতচিন্তার এই বিষয়টি এড়িয়ে চলা কঠিন কিছু নয় বটে, তবে কয়েক প্রজন্ম পর এমন একটি বিচ্যুতির সম্ভাবনাটাই পুরো উবে যাবে। কেউ যখন এই নিউস্পিককে তার একক ভাষা হিসেবে জেনেই বড় হয়ে উঠবে তখন সে আর জানবেই না ‘ইকুয়াল’ শব্দটির একটি অন্য অর্থ বা অন্য ব্যবহার ছিল। ‘রাজনৈতিক সমতা’ বলেও একটি কথা ছিল। অথবা ‘ফ্রি’ শব্দটিও একদা ‘বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা’ বলে ব্যবহৃত হতো। যে দাবার কথা কখনো শুনেইনি সে কিস্তি মাতের অর্থ কী করে বুঝবে। অনেক অপরাধ বা ভুল করার ক্ষমতাই তারা হারিয়ে ফেলবে, স্রেফ এই কারণে যে, ওগুলোর কোনো নামই থাকবে না, আর তা কল্পনারও অযোগ্য হয়ে উঠবে সময়ের সাথে সাথে নিউস্পিকের এই উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলো আরও বেশি বেশি ফুটে উঠবে, উচ্চারিত হবে— এর শব্দসংখ্যা স্বল্প থেকে স্বল্পতর হবে, তাদের অর্থগুলো হবে আরও সংকীর্ণ আর সাথে সাথে এগুলোর অযথার্থ ব্যবহারের সুযোগও সর্বদাই কমতে থাকবে।
ওল্ডস্পিক যখন পুরোপুরি আর চিরতরে ঢাকা পড়বে, তখন অতীতের সাথে শেষ সংযোগটিও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। ইতিহাস এরই মধ্যে পুনঃরচিত হয়ে গেছে, তবে পুরনো সাহিত্যের ছিটেফোঁটা এখানে সেখানে এখনও টিকে রয়েছে, অযথার্থ কাটাকুটি চলছে, আর যতক্ষণ কারো ওল্ডস্পিকের জ্ঞান থাকবে ওগুলো পড়তেও পারবে। কিন্তু ভবিষ্যতে এই ছিটেফোঁটাটুকু যদি টিকে থেকেও যায়, ওগুলো বুঝতে বা অনূদিত করে পড়তে পারার যোগ্যতার লোকটি খুঁজে পাওয়া যাবে না। ওল্ডস্পিকের একটি অনুচ্ছেদও নিউস্পিকে অনূদিত করা সম্ভব হবে না, যদি না তা কারিগরি কিংবা খুব সাধারণ প্রাত্যহিক জীবনের কোনো বিষয় হয়। অথবা তা এরই মধ্যে প্রথাপন্থি (নিউস্পিকে যা হবে গুডথিংকফুল) হয়ে না যায়। এই যদি হয় চর্চা, তাহলে বলা যায়, ১৯৬০ সালের আগে রচিত একটি বইও আর পুরোপুরি অনুবাদ করা সম্ভব হবে না। প্রাক-বিপ্লব সাহিত্যকর্মের কেবল আদর্শগত অনুবাদের বিষয় হবে- মানে হচ্ছে, ধারণাগতই কেবল নয় ভাষাগতভাবেও তা পাল্টে যাবে। উদাহরণ হিসেবে স্বাধীনতা ঘোষণা থেকে এই সুপরিচিত অনুচ্ছেদটির কথা তুলে ধরা যায়:
‘উই হোল্ড দিজ ট্রুথস টু বি সেল্ফ-এভিডেন্ট, দ্যাট অল মেন আর ক্রিয়েটেড ইক্যুয়াল, দ্যাট দে আর এনডোড বাই দেয়ার ক্রিয়েটর উইথ সারটেইন ইনএলিয়েন্যাবল রাইটস, দ্যাট অ্যামাং দিজ আর লাইফ, লিবার্টি, অ্যান্ড দ্য পারসুইট অব হেপিনেস। দ্যাট টু সিকিউর দিজ রাইটস, গভর্নমেন্টস আর ইনস্টিটিউটেড অ্যামাং মেন, ডেরাইভিং দেয়ার পাওয়ার্স ফ্রম দ্য কনসেন্ট অব দ্য গভর্নড। দ্যাট হোয়েনেভার এনি ফর্ম অব গভর্নমেন্ট বিকামস ডেসট্রাক্টিভ অব দোজ এন্ডস, ইট ইজ দ্য রাইট অব দ্য পিপল টু অলটার অর অ্যাবোলিশ ইট, অ্যান্ড টু ইন্সটিটিউট নিউ গভর্নমেন্ট…’
এই ঘোষণার মূল চেতনা অক্ষুণ্ণ রেখে কথাগুলো নিউস্পিকে পাল্টে নেওয়া সম্পূর্ণ অসাধ্য। পুরো অনুচ্ছেদটি এক ‘ক্রাইমথিংক’ শব্দের মধ্যে ভরে দিলে হয়তো কাছাকাছি কিছু একটা বোঝানো যাবে। পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ হলে তা হতে হবে আদর্শগত, যাতে জেফারসনের এই শব্দমালা স্রেফ ক্ষমতাধর সরকারের স্তুতিগাঁথা ছাড়া আর কিছুই হবে না।
অতীতের সাহিত্য কর্মগুলোর একটি বিশাল অংশ এরই মধ্যে এই পদ্ধতিতে পাল্টে দেওয়া হয়েছে। মর্যাদার বিবেচনায় কিছু সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক চরিত্রের স্মৃতি ধরে রাখা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তাদের সকল অর্জনকে এখন সাজিয়ে দেওয়া হচ্ছে ইংসকের আদর্শের সঙ্গে মিল রেখে। শেক্সপিয়র, মিল্টন, সুইফট, বায়রন, ডিকেনস এবং এমন আরও কয়েকজনের লেখনি এখন এই অনুবাদ প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। আর এ কাজ যখন শেষ হবে তখন তার সাথে সাথে অতীতের যেটুকু সাহিত্যকর্ম এখনও টিকে রয়েছে তাও ধ্বংস হয়ে যাবে। এই অনুবাদের কাজগুলো অপেক্ষাকৃত ধীরে চলছে, আর একটু কঠিনও বটে। আশা করা যায় এসব সাহিত্যের মরণ ঘটতে একবিংশ শতাব্দীর এক কিংবা দুই দশক পর্যন্ত লেগে যাবে। বিপুল সংখ্যক উপযোগবাদী সাহিত্যকর্ম রয়েছে- অপরিহার্য কিছু জ্ঞানধর্মী পুস্তিকা- সেগুলোর ক্ষেত্রেও একই আচরণ চলছে। এগুলোর অনুবাদের প্রাথমিক কাজে একটু ধীরে চলো নীতি রয়েছে তবে ২০৫০ সাল নাগাদ ওগুলোও নিউস্পিকে বদলে যাবে।