Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ১. খবরটা এনেছিল মাধব

    আশাপূর্ণা দেবী এক পাতা গল্প77 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৩. রাত ছাড়া দেখা হয় না

    রাত ছাড়া দেখা হয় না।

    মলিনা তখন সুনাথের কাছে এসে চাকরি জুটিয়ে দেবার দরবার করছিল। টর্চ নিভিয়ে চাবির মোচড় দিয়ে দরজাটা সবে খুলেছে সুধানাথ, পিছন থেকে মলিনা বলল, তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে ঠাকুরপো।

    সুধানাথ থমকে তাকাল।

    তারপর বলল, বলুন।

    সুধানাথের ঘরে লাইট নেই। মলিনার ঘরে আছে। সেই লাইটের কিয়দংশ এসে এ দাওয়ায় পড়েছিল। আর মলিনার ঘরটা যে খালি, তা খোলা দরজা দিয়ে দেখা দিচ্ছিল।

    সুধানাথের অস্বস্তি হচ্ছিল।

    তবু বলল, বলুন।

    মলিনা বলল।

    সুধানাথ চমকে বলল, চাকরি? কি চাকরি?

    তা আমি কি আর আপিসের চাকরি চাইছি? বামুনের মেয়ের যাতে লজ্জা নেই, সেই কাজই করব। একটা রাঁধুনীর কাজ তুমি আমায়–

    কথা শেষ হবার আগেই মাধব ঘোষের শ্লেষ্মাজড়িত ভারী গলার আওয়াজ বেজে উঠল। সুধানাথবাবু, ভেবেছিলাম কিছু বলব না। কিন্তু না বলেও তো পারছি না। মাধব ঘোষের বাসাটা বিন্দাবন নয়; বুঝলেন? এই আপনাকে আমি নোটিশ দিচ্ছি—তিনদিনের মধ্যে আপনার ওই বান্ধবীকে নিয়ে এই বাসা ছেড়ে সরে পড়বেন।

    সুধানাথ গম্ভীরভাবে বলে, তিনদিনের নোটিশ দিচ্ছেন? বাড়িভাড়া আইনটা বুঝি আপনার জানা নেই?

    মাধব ঘোষ অবশ্যই এ প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল, এবং উত্তরও জুগিয়ে রেখেছিল, তাই সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, জানব না কেন? খুব জানা আছে। আবার হাটে হাঁড়ি ভাঙবার কায়দাও জানা আছে। কেলেঙ্কারির চূড়ান্ত করে যদি থাকতে চান তো থাকুন, তবে অজিতবাবুর পরিবারের মতন খারাপ স্ত্রীলোক আমার বাসায় রাখলে, এরপর আমার ভদ্দর ভাড়াটেরা চলে যাবে। সেই কথাটাই ওঁকে জানিয়ে দেবেন।

    মাধব ঘোষ চলে যায়।

    বেশ গট গট করেই যায়।

    সমস্ত ঘরের দরজা-জানালা যে ঈষৎ উন্মুক্ত তা দেখতে তার বাকি থাকে না। বোঝে কাজটা সুচারু হয়েছে।

    মলিনা?

    সে বোধ করি, আজকাল নিতান্ত শক্ত হয়ে গেছে বলেই সহজভাবে আস্তে আস্তে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ে।

    .

    তিনদিন পরে নয়।

    পরদিনই, সুধানাথের যখন কাজের সময়, তেমন অনর্থকালে একটা ঠেলাগাড়ি এসে মাধব ঘোষের বাসার দরজায় দাঁড়াল।

    সুধানাথও এল। খুব সম্ভব ছুটি নিয়েছে। নিজের যৎকিঞ্চিৎ জিনিস ঠেলায় তুলে, এঘরে এসে নেহাত সহজভাবে বলল, উঠুন, একটু ঠিক হয়ে নিন, জিনিসপত্রগুলো তুলিয়ে ফেলি–

    মলিনা মিনিটখানেক চুপ করে চেয়ে থেকে আস্তে আস্তে বলল, তোমার সঙ্গে যাব?

    যাবেন না তো কি ওই চামারটার মধুর বাক্য শোনবার জন্যে পড়ে থাকবেন?

    কিন্তু এতে তো ইচ্ছে করে আরও বদনাম মাতায় তুলে নওয়া।

    সুধানাথ গম্ভীরভাবে বলে, উপায় কি? বদনামও রইল—অপমানও রইল, সে অবস্থার চেয়ে তো ভালো। যেখানেই নিয়ে যাই আপনাকে, অন্তত প্রতিক্ষণ অসম্মানের মধ্যে তো থাকতে হবে না?

    মলিনা আর একবার স্থির চোখে চেয়ে নির্লিপ্ত কঠিন গলায় বলে, কিন্তু তোমার মতলবই যে খারাপ নয়, তা বুঝব কি করে?

    সুধানাথ একটু থমকাল।

    তারপর সামান্য হেসে বলল, সেটা তো একদিনে বোঝা যায় না? বুঝতে সময় লাগে। ধীরে ধীরেই বুঝবেন। এখন চলুন তো।

    হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যাওয়া মলিনা চৌকির ওপর আছড়ে পড়ে কেঁদে ওঠে, এ বাসা ছেড়ে আমি যেতে পারব না ঠাকুরপো, ও তাহলে জন্মের শোধ মুছে যাবে, সত্যি করে হারিয়ে যাবে।…এই ঘরের সর্বত্র ও রয়েছে। এইখানে শুয়েছে। এইখানে বসেছে–

    কান্নার শব্দে এদিক-ওদিক থেকে উঁকি পড়ে। সুধানাথ টের পায়। সুধানাথ শান্তস্বরে বলে, মানুষকে এর চাইতে আরও অনেক কঠিন কাজ করতে হয়। সেই ভেবে স্থির হোন। আপনি যাব না বললেও তো হবে না। মাধব ঘোষ তো ওর পুণ্যের বাসা থেকে পাপপক্ষীদের উড়িয়ে ছাড়বে।

    মলিনা উঠে দাঁড়ায়।

    মলিনা ভাবে, যাব না বলে জেদ করছি? কোথায় থাকতাম আমি, যদি ও ঘরের ভাড়া দিয়ে দিয়ে আমার বাসা বজায় না রাখত।

    দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বুকের পাঁজর গুঁড়োনো দেখে মলিনা। মুটেগুলো রূঢ় কঠিন হাতে হিড় হিড় করে টানতে থাকে চৌকি, বাক্স, বাসন, বিছানা, শিশি-বোতল, ভাড়ারপত্র।…যে সব বস্তু দিয়ে প্রাণতুল্য করে গুছিয়ে ছিল মলিনা এই তার বাসাকে।

    অজিত আর তার।

    কত টুকিটাকি সৌখিন জিনিস, কত স্মৃতিবিজড়িত জিনিস!

    একখানা ঘরে এত জিনিসও ছিল!

    আবার কোন্ ঘরে এত সব ভরবে? অজিত কেন এমন করল?

    মলিনার সঙ্গে কোন্ জন্মের শত্রুতা ছিল তার?

    কিন্তু অজিত ভটচা নামের সেই মানুষটা, যার জন্যে মলিনা নামের মেয়েটার জীবন মিথ্যে হয়ে গেল, সে কেন সেদিন বাড়ির দরজায় এসে রেল লাইনে মাথা দিয়েছিল?

    কেন?

    মলিনার সঙ্গে সত্যিই কোনো শত্রুতা ছিল নাকি তার?

    না কি সত্যিই পূর্ব জন্মের? সেই পুরনো আক্রোশ মেটাবার এই পথটাই দেখতে পেয়েছিল সে।

    অথচ মনে তো হত মলিনা তার পরম নিধি। মলিনার কষ্ট বাঁচাতে, মলিনাকে স্বাচ্ছন্দ্য দিতে, সধ্যের অতিরিক্ত করেছে ওই অজিত ভটচা।

    এই বারো ঘরের ভাড়াটেদের মধ্যে মলিনা যে সকলের থেকে বাবু বাবু আর উঁচু পর্যায়ের ছিল, সেতো শুধু অজিত ভঠচাযের ওই আপ্রাণ চেষ্টার ফলেই? নইলে দাসকর্তা ওর চেয়ে অনেক

    অনেক বেশি রোজগারী। মণ্ডলকর্তাও কিছু কম নয়।

    তবে হ্যাঁ, এরা যে নিঃসন্তান সেটাও এদের শৌখিন আর বাবু বাবু হয়ে থাকার সহায়ক।

    আর নিঃসন্তান বলেই হয়তো বিয়ের এতদিন পরেও ওদের দুজনের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ আর আবেগ ছিল জোরালো।

    নববিবাহিতসুলভ রঙ্গরস, খুনসুটি ঝগড়া, মান অভিমানও ছিল ওদের হয়তো এই জন্যেই।

    তুচ্ছ কোনো কারণে কথা কাটাকাটি হয়ে হয়তো রাত থেকে কথা বন্ধ, অজিত কর্মস্থলে যাত্রাকালে বলে যেত, এই চললাম আর ফিরব না। নিশ্চিন্তে থাকবে।

    মলিনা মনে মনে দুর্গা দুর্গা বললেও মুখে গাম্ভীর্য অটল রাখতো।

    কিন্তু সেই ভয়ঙ্কর প্রতিজ্ঞার দিনের সন্ধ্যাবেলাটাই হয়তো দেখা যেত, মলিনা বিকেল থাকতেই রান্না সেরে অজিতের প্রিয় কিছু জলখাবার বানিয়ে, পরিপাটি সাজসজ্জা করে বসে আছে। আর অজিত বাড়ি ঢুকছে হয় এক ঠোঙা ডালমুট আর এক ভাঁড় রাবড়ি হাতে করে। নয় রেস্টুরেন্টের চপ কাটলেটের গোছা নিয়ে।

    কখনও কখনও বা দুখানা নাইট শোর সিনেমার টিকিট।

    সিনেমা গেলে অজিত আর মলিনা নাইট শোতেই যেত। মলিনা বলত, এই বেশ বাপু, এসেই টুপ করে শুয়ে পড়লাম, আর কোনো ঝামেলা রইল না।

    মলিনা কোনো ঝামেলা পছন্দ করতো না বলেই কি ভগবান তাকে এই ভয়ঙ্কর একটা নিশ্চল শূন্যতার মধ্যে ফেলে দিলে?

    তা ঝামেলা তো সত্যিই কিছু নেই আর। একটা লোক যদি স্বেচ্ছায় এবং বিনা শর্তে মলিনার দায় নিজের কাঁধে তুলে নেয়, মলিনার কী ঝামেলা রইল?

    কিন্তু অজিত ভটচায কি একথা জানতো? জানতো, ওই তালা লাগানো পড়ে থাকা ঘরটার মালিক, নরলোক যাকে দেখতে পায় না বললেই হয়, সে এসে অজিত ভট্টচাযের স্ত্রী মলিনা ভট্টচাযের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবে?

    তাই অজিত ভট্টচার্য হঠাৎ কর্পূরের মতো উবে গেল?

    কিন্তু কি দরকার ছিল তোর এসবে?

    কি দরকার ছিল ওই মাধব ঘোষের ভাড়াটে হয়েও তোর বউকে কুন্তলবিলাস মাখাবার? কি দরকার ছিল তাকে রুটি কুমড়োর ঘণ্টর বদলে পরোটা ডিমের ডালনা খাওয়াবার? তুই একটা কবরেজের দোকানের প্যাকার মাত্র। তোর বউকে তুই তঁতের ডুরে পরাবি কিসের জন্যে?

    এটাকেই তুই ভালোবাসা ভেবেছিলি?

    অথচ তলিয়ে দেখলে বুঝতে পারতিস এটা ভালোবাসা নয়। মোক্ষম অনিষ্ট করা।

    তা তেমন করে তলিয়ে দেখতে কজন পারে?

    অজিত ভঠ্‌চায তো কোন্ ছার।

    বোধ বুদ্ধি হবে কিসে? ম্যাট্রিকটাও তো পাস করেনি, বার দুই ফেল করে ওই চাকরিটা জুটিয়ে ফেলেছিল।

    আর বিয়েটাও করে ফেলেছিল সেইটুকুর ওপরই নির্ভর করে।

    মা-বাপ মরা মলিনা দূর সম্পর্কের কাকার বাড়িতে জুতো সেলাই চণ্ডীপাঠ করে মুক্তির জন্যে ছটফটাচ্ছিল, কবরেজের দোকানের প্যাকারও তার কাছে মুক্তিদাতার মূর্তিতেই দেখা দিল। ওকে পেয়েই সুখী হল মলিনা।

    আর তাইতেই সে যেন সুখী সুখী হবার অধিকারও পেল।

    তা ওকে ওই সুখীর ভূমিকাতেই প্রতিষ্ঠিত রাখবার জন্যে অজিত ভটচায মনিবের জিনিস না বলে চেয়ে নেবার সহজ পথটা বেছে নিয়েছিল। শেষরক্ষা হল না। মলিনা নামটাকে আছড়ে ভেঙে দিয়ে চলে গেল এক অজানালোকে।

    .

    বাসাটা জোটা আশ্চর্যি!

    একালে কেউ ভাবতেই পারে না, একদিনে বাসা জোগাড় হয়। কিন্তু রাগের চোটে বোধ করি অনেক অসাধ্যসাধনই হয়।

    একে ওকে বলতে বলতে হঠাৎ একজন বলল, বাসা আছে একটু দূরে, রোজ এতটা আসা যাওয়া করতে পারবে?

    সুধানাথ বলল, না পারলে চলবে কেন? লোকে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করছে।

    তা পুরনো বাসার কি হল?

    ঝগড়া হয়ে গেছে।

    শহরতলীর আর এক কোণ!

    তা হোক, যতটা দূর বলেছিল তত কিছু নয়। ছোট্ট বাড়ি, সস্তায় তৈরি। বাড়ির গায়ে পলস্তারা পড়েনি জীবনে।

    তবু দোতলা!

    নীচের তলায় একখানা, দোতলায় একখানা ঘর।

    দোতলায় বাড়িওলা আর বাড়িওলা-গিন্নি থাকেন। একতলার ওই ঘরখানি থেকে কিছুটা আয় করেন।

    .

    ভাড়া যখন নিতে গিয়েছিল, গিন্নি সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন, বলছ তো বোন আছে সংসারে, তা একখানা ঘরে থাকবে কি করে?

    সুধানাথ বলল, বোনই থাকবে, আমি অন্যত্র থাকব, দেখাশোনা করে যাব। এই জন্যেই তো আপনাদের মতো একটি আশ্রয় চাইছি।

    গিন্নি মনে মন বললেন, কি জানি, কেমন ধারা বোন! মুখে বললেন, বড়ো বোন?”

    না, ছোটো। পিঠোপিঠি।

    বিধবা?

    একরকম বিধবাই। স্বামী নিরুদ্দেশ।

    গিন্নি মনে মনে বলেন, স্বামী নিরুদ্দেশ কি তোমরাই নিরুদ্দেশ, তোমরাই জানো। কলিতে কাউকে বিশ্বাস নেই। বোন বললেই বোন।

    মুখে বললেন,—”শ্বশুরবাড়িতে কেউ নেই?

    থাকলে আর আমার এত জ্বালা!

    মা বাপ?

    অনেককাল পাট চুকেছে।

    বোনের ছেলেমেয়ে আছে?

    নাঃ! ভাগ্যিস নেই, তাহলে আমি তো মরেই যেতাম।

    হুঁ! তা তুমি বে-থা করনি?”

    কই আর করতে পেলাম? সামান্য চাকরি, বোনকে পুষতে হয়।

    কর্তাকে জানালেন গিন্নি।

    কর্তা বললেন—”মরুক গে। ছেলেটা তো থাকবে না বলছে—

    .

    গাড়িতে আসতে আসতে মলিনা একবার জিগ্যেস করেছিল, কী পরিচয় দিলে?

    বলে দিলাম বোন! ওটাই ভালো। বউদি-টৌদি অনেক ঝামেলা। তবে মুশকিল এই—ছোটো বোন বলে বসে আছি। এখন আপনার তো আমাকে দাদা বলতে হয়।

    সেটা খুব শক্ত নয়। তুমিই আমাকে আপনি বলে বসবে, এই যা।

    সেরেছে! ওটা তো মাথায় আসেনি। বুড়ির যা জেরা, বাবাঃ! জেরার মুখে যা মুখে এসেছে বলে দিয়েছি–

    মলিনা শঙ্কিত হয়।

    মলিনা মলিন হয়ে যায়।

    মলিনা আস্তে বলে, খুব জেরা করল?

    খুব মানে কি? এমনি, মানে মেয়েলি কৌতূহল আর কি! বড় বোন না ছোটো বোন, বিধবা সধবা, কোলে ছেলেমেয়ে আছে কি নেই, শ্বশুরবাড়ির সবাই সরে গেছে কেন? মা বাপই বা হাওয়া হল কবে? আমি কেন বিয়ে করিনি?—এইসব বহুবিধ মূল্যবান প্রশ্ন।

    মলিনা মাথা নীচু করে বলে, আমার ভয় করছে।

    ভয়ের কি আছে?

    যদি সন্দেহ করে?

    সন্দেহ অমনি করলেই হল? তবে হ্যাঁ, ওই দাদা আর আপনির সমস্যাটা! তালগোল না পাকিয়ে যায়।

    আমার যাবে না তোমার যেতে পারে। এখন থেকে শুরু কর।

    বাসায় যখন ঢুকল তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চারিদিকে কেমন গ্রাম গ্রাম ভাব, বুনো বুনো গন্ধ বেরোচ্ছে। আর পলস্তারা ছাড়া বাড়িটা ঝোঁপের আড়ালে যেন ছায়ামূর্তির মতো গুঁড়ি মেরে বসে আছে।

    মাধব ঘোষের বাসায় আর যাই হোক, প্রাণ ছিল। এ যেন মরে পড়ে আছে।

    এ কোথায় এনে তুলল সুধানাথ মলিনাকে?

    ইচ্ছে হল বলে, মনে হচ্ছে কবরে প্রবেশ করছি।

    বলল না।

    সাড়া পেয়ে বাড়িওলা গিন্নি নামলেন। বেশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে নিলেন মলিলকে। আর দেখে যেন একটু সন্তুষ্টই হলেন। পালিয়ে আসা খারাপ মেয়ের মতো দেখাচ্ছে না। নেহ যেন দুঃখী দুঃখী, বিষণ্ণ বিষণ্ণ। যা বলেছে তাই হবে।

    স্নেহপরবশ হয়ে বললেন, রাতে কি আর রাঁধতে পারবে? আমি বরং দুটো দানা ফুটিয়ে দিই–

    সুধানাথ বলল, পাগল হয়েছেন! আপনি বুড়ো মানুষ, আপনি খাটতে যাবেন কেন? আমি তো বাইরেই খাই, বোনের একটু মিষ্টি-টিষ্টি খেলেই হয়ে যাবে। এই ইয়ে–

    হঠাৎ থেমে গেল সুধানাথ।

    অজিত ভট্‌চাযের স্ত্রীর নাম তো জানে না সে।

    গিন্নি অতটা লক্ষ করলেন না।

    বললেন, তা মেয়ে আমার কাছে খেতে পারত। আমরাও ছোটো জাত নই, তোমাদের মতনই মিত্তির-কায়স্থ।

    দেখিয়ে শুনিয়ে দিয়ে উনি চলে যেতেই মলিনা দুহাতে মুখ ঢেকে ভেঙে পড়ল। মাধব ঘোষের বাসায় তো তবু সব সত্যি ছিল, এ যে আগাগোড়া ছলনা হয়ে গেল। এ কি চালিয়ে যাওয়া সোজা? আমি মলিনা ভটচায–

    সুধানাথ মাথা চুলকে বলে, মানে ব্যাপারটা হল কি—আমি তো মিত্তির।

    বুঝেছি! কিন্তু বরদাস্ত করতে পারছি না, প্রতিপদে মিথ্যে পরিচয়, ধরা পড়ে যাবার ভয়–

    সুধানাথ সহসা ঘোষণা করে, ঠিক আছে, দুচারটে দিন যা হোক করে চালান, অন্য বাড়ি দেখে চলে যাব। সেখানে সব সত্যি কথা বলে ঢুকব।

    মলিনা মুখ তুলল।

    মলিনা একটু ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বলল, তাহলে ঢুকতেই দেবে না।

    .

    সুধানাথ চলে গেল।

    পথে বেরিয়েই যেন অন্ধকারের সঙ্গে মিশে গেল। আর মলিনার মনে হল—ভয়ঙ্কর এক নিষ্ঠুরের মতো ব্যবহার করল ও।

    এইখানে মলিনাকে একা ফেলে রেখে চলে গেল। একবার ওর অসহায়তার কথা চিন্তাও করল না!

    অজিত যেদিন হঠাৎ আর এল না, সেদিনও বুঝি এমন অসহায়তা অনুভব করেনি মলিনা। বারো সংসারের উত্তাপ যেন মলিনাকে ঘিরে রেখেছিল। একঘরে হয়ে পড়ে থেকেও এমন ভয় করেনি।

    কিন্তু আর কি-ই বা করার ছিল সুধানাথের? চলে যাওয়া ছাড়া?

    এই একটা ঘরের বাসায় সে কোথায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে মলিনার ভরসা জোগাত?

    .

    দরজায় খিল লাগিয়েছে।

    জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখল মলিনা। বোধ করি অমাবস্যার কাছাকাছি কোনো তিথি। তাই আকাশ, মাটি সব অমন নীর অন্ধকার। ঠিক যেন মলিনার ভবিষ্যৎ।

    পৃথিবীর এই অন্ধকারের মুক্তি হবে। আকাশে নতুন সূর্য উঠবে। কিন্তু মলিনার?

    তারপর ভাবতে লাগল, মাধব ঘোষের বাসাটা চট করে ছেড়ে আসা কি ঠিক হল?—যদি–সুখদার চোখ নির্ভুল না হয়, যদি অজিত কোনোদিন ফিরে আসে?

    যদি আজকালই আসে?

    দুমাস আসেনি বলে যে, দুমাস পাঁচদিনের দিন আসতে পারে না, তা তো নয়!

    এসে দাঁড়িয়ে যদি ওই বারো ঘরের সামনে প্রশ্ন করে, মলিনা কোথায়?

    ওরা কে কি উত্তর দেবে যেন স্পষ্ট দেখতে পায় মলিনা। দেখতে পায় দাস গিন্নির, মণ্ডল। গিন্নির, নগেন গিন্নির আর সুখদার ঘৃণায় বিকৃত মুখ…

    তারপর অজিতের মুখ দেখতে পায়।

    কিন্তু এ কি!

    অজিতের মুখের একটা কুঞ্চিত পেশীর ভঙ্গি ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছে না কেন মলিনা? আর সব কেমন ঝাঁপসা হয়ে যাচ্ছে।

    অজিতের মুখটা কি মলিনা এই দুমাসেই ভুলে গেল?

    এ কি হচ্ছে ভগবান!

    সেই ফুলে ঢোল হয়ে যাওয়া বিচ্ছিন্ন মুখ শবদেহটাই অজিত হল না কেন? অজিত কেন ঝাঁপসা হয়ে গিয়ে মলিনাকে আঙুল তুলে শাসাবে? কেন তীব্র ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলবে, কি গো, তিনটে মাসও পারলে না এই হতভাগার অপেক্ষায় ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে?

    সুনাথের ওপর তীব্র একটা রাগ পাক দিতে লাগল মনের মধ্যে। ও যদি ওপরপড়া হয়ে এত না করতে আসতো, নিশ্চয়ই আর পাঁচজনে দেখত।…হয়তো—বারো ঘরে চাঁদা করে মলিনার মাসকাবারি বাজার তুলে দিত। হয়তো পালা করে এক একজন এক একদিন নিজেদের বাজার থেকে আলুটা বেগুনটা দিত, হয়তো মলিনার সেই দুর্দশা দেখলে মাধব ঘোষ, সত্যিই ভাড়া চাইত না। আর হয়ত ক্রমশ মলিনা রাঁধুনীগিরিতে পাকা হয়ে উঠত।

    সমস্ত সম্ভাবনাকে ঘুচিয়ে দিয়েছে ওই সুধানাথ!

    ঈশ্বর জানেন ওর কি মতলব! এখন তো ভাইবোন, দাদাদিদি, অনেক ভালো ভালো সম্পর্ক পাতাচ্ছে, পরে কি মূর্তি ধরবে কে জানে! শুনেছি সিনেমায় কাজ করে। আমাকে কারুর কাছে বেচে দেবে না তো? গোড়া থেকেই তাই আমাকে গ্রাস করছে?

    মলিনা নিজেই যে গোড়ার দিন এতগুলো চেনা লোককে বাদ দিয়ে ওই সামান্য চেনা ছেলেটাকেই আশ্রয় বলে গণ্য করেছিল, ঠাকুরপো ডেকে অন্তরঙ্গ হতে চেষ্টা করেছিল, আর অতগুলো লোকের একজনও অজিতের জন্যে একটা আঙুল নাড়েনি, সুধানাথই সাহায্যের হাত নিয়ে এগিয়ে এসেছিল, এসব ভুলে যায় মলিনা।

    মলিনা শুধু সুধানাথের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমিয়ে তুলতে থাকে।…

    বলতে থাকে, ওই আমার শনি!

    ওই আমার রাহু!

    আমার পাঁজরের হাড় খুলে খুলে ছড়িয়ে দিল ও! সেই আমার সাজানো ঘর, সে চলে গিয়েও যেখানে যা অবিকল ছিল, সেই ঘর তছনছ করে যেন দস্যুর মতো লুটে নিয়ে এল আমাকে!

    নিশ্চয় ধুলো পড়া দিয়েছে ও আমাকে। জানে বোধহয় কিছু। নইলে আমার এমন বুদ্ধি হয়ে গেল কেন!

    প্রতিনিয়ত যে সেই সহানুভূতিহীন, নিষ্ঠুর ঠাই থেকে পালাবার জন্যে ছটফট করছিল মলিনা, সেকথা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, ওখানের সক্কলের জন্যে মন কেমন করছে তার। এমনকি আধা-হাবা, ভোলা মদনাটার জন্যে পর্যন্ত।

    এবারে পুজোয় স্বপনকে সে একটা জামা দেবে ভেবেছিল। পুজোয় বোনাস পায় অজিত। ইচ্ছেমতো কিছু করতে পারতো মলিনা। স্বপনের মা তাকে ভালোবাসে, স্বপনকে মলিনা ভালোবাসে।

    ওদের কাছ থেকে মলিনাকে ছিনিয়ে নিয়ে এল সুধানাথ।

    নিয়ে না এলেও যে ওসব কিছু হতো না, সেকথা ভাবছে না মলিনা।

    অনেক ভেবে, অনেক কেঁদে, শেষ অবধি সংকল্প করল মলিনা, কাল সুধানাথ এলেই বলবে, আমায় সেই পুরনো বাসাতেই রেখে এসো। নিজেই একটা রাঁধুনীগিরি জুটিয়ে নিয়ে চালাব আমি। একটা পেট, এত কি ভাবনা! পরের দয়াই বা নেব কেন বারোমাস? তুমি আমার কে?

    এই সিদ্ধান্তটা করে যেন অনেকটা শান্তি বোধ করল মলিনা। শেষ রাত্রের দিকে ঘুমিয়ে পড়ল।

    সকালবেলা যখন ঘুম ভাঙল, হঠাৎ যেন সব ওলট-পালট হয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল।

    মরি মরি, এত সুন্দর জায়গা।

    আর রাত্রে অত বিভীষিকা দেখছিল মলিনা।

    গাছপালা বাগান পুকুরে ঘেরা বাড়িখানা যেন মলিনার দূর শৈশবের পিতৃভূমিকে মনে করিয়ে দিল।

    ওই পুকুরটা যে রাত্রে জানলা দিয়ে একটা অন্ধকারের গহুর মনে হচ্ছিল, আর ওর ধারের নারকেল গাছগুলোকে এক পায়ে খাড়া দৈত্যের মতো লাগছিল, সে কথা ভেবে হাসি পেল মলিনার।

    বাড়িটা ছোট্ট, জমিটা অনেকখানি। সবুজ ঝোঁপঝাড়ের মাঝে মাঝে গাছ আলো করে ফুটে থাকা জবা, করবী যেন মলিনার জ্বরতপ্ত মনে স্নেহের হাত বুলিয়ে দিল।

    ভাবল, বড়ো সুন্দর জায়গাটি আবিষ্কার করেছে সুধানাথ। এমন নিঃসঙ্গ নির্জনতাই তো এখন মলিনার কাম্য। অনেকের দৃষ্টির কলুষ সহ্য করবার ক্ষমতা কি তার আর আছে?

    থাকার মধ্যে দুটো বুড়ো বুড়ি।

    তাও দোতলায় থাকে।

    এক আধবার আসবে। একটু ভেবেচিন্তে কথা বলতে হবে। ভুললে চলবে না, সে সুধানাথ মিত্তিরের বোন।

    সুধানাথ এলে আর বলা হল না মলিনার, আমাকে পুরনো বাসায় রেখে এস।

    বাগানে বুড়ি শাক তুলছিল, তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ও দাদা, দাদাগো, কী চমৎকার জায়গা খুঁজে বার করেছ। মনে হচ্ছে সেই আমাদের ছোটোবেলার গাঁয়ে এসে পড়েছি।…আহা এমন বাড়িতে তুমি থাকতে পাবে না দাদা!…আর একটা যদি ঘর থাকত!

    সুধানাথ কাছে এসে হেসে বলে, এত এরকম দাদা দাদা করলে তো–তুই না ডাকলে মানায় না।

    তা ডাকো! যেটা মানানসই সেটাই কর।

    এদিকে তো দাদা ছোটো বোনের নাম জানে না।

    ওমা তাই নাকি? গিন্নিরা তো ডাকতেন শোননি?

    আমি আর কবে বাড়ি থেকেছি?

    তা বটে। তা জেনে রাখো, আমার নাম মলিনা।

    মলিনা!

    সুধানাথ নাক কুঁচকে বলে, এ, মানানসই কোথায়? একেবারে বেমানান! এ নাম অচল।

    এতদিন চলে এল, আর এখন অচল?”

    হুঁ! পদবী যখন পালটেছে, নামও পালটাক। মলিনা নয়, মণিলা।

    মণিলা আবার নাম হয়?

    হওয়ালেই হয়।

    লাভ কি?

    মলিনা শুনতে বিচ্ছিরি।

    হঠাৎ কথাটা ভারী অদ্ভুত লাগে মলিনার। তার এই উনত্রিশ বছরর জীবনে একথা তো কেউ কোনোদিন বলেনি! অজিত তো মলিনা মলিনাই করেছে, কোনোদিন বলেনি শুনতে বিচ্ছিরি।

    মলিনাকে চুপ করে থাকতে দেখে সুধানাথ একটু ভয় পায়। বলে, রাগ করলেন?

    মলিনা হেসে ফেলে বলে,  করলেন? আবার আপনি! তুমিই ফঁসাবে দেখছি।”

    সুধানাথ জিভ কাটে।

    তারপর বলে, তা হলে রাগ নয়?

    না রাগ কিসের! তবে নামটা ছোটো করেও নিতে পার। লীনা বলতে হয়।

    লীনা! লীনা! তা মন্দ নয়।

    বাড়িওলা-গিন্নি চারটি শাক এনে ধরেন, মেয়ে শাক খাওতো?”

    ওমা খাব না কেন? শাক ভাতই তো সম্বল মাসিমা।

    আহা ষাট! এয়োস্ত্রী-মানুষ! তা নামটি কি গো?

    নীনা।

    লীনা? তা ওসব শক্ত নাম আমার মুখে আসবে না, লীলাই বলব! ভাই খাবে তো তোমার কাছে?

    কোথা? মলিনা বলে, ওতো এক্ষুনি চলে যাবে। দেখুন না, এমন কাজ, খাবার সময় নেই। শুধু নিজের জন্যে রাঁধতে ভালো লাগে?

    তা তো সত্যি। বলে চলে যান গিন্নি শাকগুলি নামিয়ে রেখে।

    মলিনা মৃদু হেসে বলে, আর একবার নাম পালটালো।

    জীবনটাই তো ওলট-পালট।

    গিন্নি আমায় একটু কম ভালোবাসলে হয়। কিন্তু মনে হচ্ছে বড় বেশি ভালোবাসেন।

    সেটা বোধহয় আপ–থুড়ি, তোমার স্বভাবের গুণ।

    স্বভাবের গুণ!

    মলিনার স্বভাবে কোনো গুণ আছে, একথাই বা কে কবে বলেছে? সবাই তো মলিনার মেজাজের নিন্দেই করে। অজিত তো ফি হাত বলতো, রণচণ্ডী! বলতো বাবাঃ আগুনের খনি!

    মলিনার সে স্বভাবের যে পরিবর্তন হয়েছে, ভাগ্যের নিষ্ঠুরতায় মলিনা গুঁড়ো হয়ে গেছে, এ মলিনা নিজে টের পায় না।

    আর এও জানতে পারে না ওই সুধানাথই মলিনাকে উঁচু নাকী বলে অভিহিত করত।

    রোজ সকালে একবার করে আসে সুধানাথ। কি আছে নেই দেখতে।

    অভিনয় চলে। লীনা, তুই বলে হেঁকে হেঁকে কথা বলে। বলে, কী রাঁধছিস, কি? শুধু আলুসেদ্ধ ভাত? কেন, মরতে হবে না কি? তবে তিলে তিলে আর কষ্ট করা কেন? গলায় এক গাছ দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়!

    গলা তুলে বলে, আর গলা নামিয়ে হাসে।

    সেই নামানো গলায় বলে, এর চেয়ে সিনেমা থিয়েটারে নেমে পড়লে আখের গুছিয়ে নেওয়া যেত। তার চাইতে তো কম করছি না।

    করছে না!

    সত্যিই কিছু কম করছে না। দুজনেই!

    সুধানাথ চলে যাবার মুখে মলিনা হেঁকে হেঁকে বলে, ও দাদা, তা এক বাটি খেয়ে যাও অন্তত। রোজ অমনি মুখে চলে যাও।

    সুধানাথ আরও হেঁকে, যাতে দোতলার ঘর ভেদ করে কণ্ঠস্বরটা পৌঁছয় সেইভাবে বলে, আজ আর নয়, কাল। কাল চায়ের সঙ্গে চিড়ে ভেজে রাখিস।

    এমন যে পারবে তারা, এ একেবারে ধারণাই ছিল না। এ যেন এক মজার খেলা! সত্যিই যেন অভিনয়ে নেমে পার্ট প্লে করছে দুজনে। যত করে তত পুলকিত হয়, তত কথার জোগান আসে, তত হাসিতে ঔজ্জ্বল্য আর ভঙ্গিতে সাবলীলতা আসে।

    তবু পণ্ড হল।

    তবু শেষ রক্ষা হল না!

    প্রথমে মাঝে মাঝে তাল ভঙ্গ।

    গিন্নি বলেন, হ গা লীলা, তুমি যে বলেছিলে এখানে আসার আগে শিবপুর থাকতে, আর তোমর ভাই ওনার কাছে বলল, গড়েয় না কোথায় থাকত?

    মলিনা যদিও চটপট বলে, গড়েয় আর কদিন থেকেছি মাসিমা! কুল্লে একটা মাস। ভাড়া বেশি বলে ছাড়তে হল। তবু মলিনার হঠাৎ শুকনো হয়ে আসা মুখটা ক্ষীণদৃষ্টি বুড়িরও নজর এড়ায় না।

    আবার একদিন ধরেন, হ্যাঁ গা লীলা, তোমাদের ভাই বোনের কথার মিল নেই কেন বল তো? তুমি বললে তোমাদের দেশ নবদ্বীপের কাছে পাটুলী, আর ও বলল, মুর্শিদাবাদ। এমন উল্টোপাল্টা কথা আমরা পছন্দ করি না।

    মলিনা কষ্টে হেসে বলে, বিয়ে হওয়া মেয়ের দেশটা যে আর বাপ ভাইয়ের দেশ থাকে না, সে কথাও কি ভুলে গেলেন মাসিমা?

    তবু বুড়ি অসন্তুষ্ট হয়ে বলে, তুমি তো পাটুলীতে তোমার ছেলেবেলার খেলার গল্প করলে–।

    মলিনা তবু বাঁধ দেবার চেষ্টা করে।

    মলিনা তবু হাসে, তা মাসিমা ছেলেবেলা ছাড়া আর কি! বারো বছরে পড়তেই বিয়ে, খেলারই তো বয়েস!

    কিন্তু এই ঝুরো বালির বাঁধে কত দিন আটকানো যায়?

    ধরা পড়ল। অনেক জেরার মুখে জোগাবার মতো বালি আর কুলেল না। বরং ভাঙন ধরলো আর এক ঘটনায়।

    মাধব ঘঘাষের বাসার নগেনবাবু কদিন খুঁজে খুঁজে এ বাসায় এসে লীনার অজান্তে বাড়িওলার সঙ্গে আলাপ করে গেলেন।

    তারপর গিন্নি ধরলেন সাট্টে পাট্টে।

    প্রথমে ভালোমানুষী করে জিগ্যেসবাদ, ক্রমশ জেরা, অতঃপর উগ্রমূর্তি।

    বললেন, দুদিন হলে, তিন দিন করবে না, আমার বাড়ি ছেড়ে দেবে। এত বড়ো পাহাড় মেয়েমানুষ তুমি, সোয়ামি রেলে কাটা পড়ল, সে কথা উড়িয়ে দিয়ে দুদিন না যেতেই একটা পরপুরুষের সঙ্গে ভেগে এলে, আবার ভাই-বোন পরিচয়! ভাই-বোন সম্পর্কয় কলঙ্ক ধরানো! ছিঃ ছিঃ! তুমি বামুনের মেয়ে না? তোমার বরের নাম অজিত ভঠচায্যি ছিল না? ও ছোঁড়া কায়েৎ না?

    এরপর আর কি দিয়ে বাঁধ দেবে মলিনা।

    সুধানাথ এলে বাড়ির কর্তা হাল ধরলেন। বললেন, এই দণ্ডে পার, এই দণ্ডে! আমার এই ধর্মের বাড়িতে এত অনাচার! এমন ইসারাও দিলেন, সুধানাথ লোক দেখিয়ে সকালে এসে চলে যায়, তারপর কে জানে রাতের অন্ধকারে আসা-যাওয়া করে কিনা।

    মাথা হেঁট করে বেরিয়ে আসতে হল সেই বাগান পুকুর ঘেরা স্নিগ্ধ ছায়ার আশ্রয় থেকে।

    .

    আমাকে তুমি ছাড়, বলল মলিনা। আবার আমায় ঘাড়ে করে করে বেড়াবে, আর কলঙ্কের বোঝা মাথায় তুলবে। এ কেন? কি দায় তোমার?

    কি দায় আমার, বাঃ! সুধানাথ তাচ্ছিল্যভরে বলে, এ কথার কোনো মানে হয়? হঠাৎ তোমাকে ছাড়ব কিভাবে? গড়ের মাঠে ছেড়ে দিয়ে আসব?

    সে যাই হোক, মলিনা উত্তেজিত হয়, আমার জন্যে তুমি মিনারের চাকরি ছাড়বে, বেলেঘাটায় বাস করতে যাবে, এর কোনো মানে হয় না। কেন তুমি এত করবে আমার জন্যে?

    হঠাৎ সুধানাথের মুখের চেহারা কেমন একরকম হয়ে যায়। সুধানাথের চোখের দৃষ্টিতে কিসের যেন ছায়া পড়ে। সুধানাথ আস্তে বলে, সব কথা কি খুলে বলা যায়?

    মলিনা মাথা নীচু করে।

    মলিনার সিথির কালচে হয়ে যাওয়া অতীতের সিঁদুরের অস্পষ্ট রেখাটায় যেন সিথিটাকে ক্লেদাক্ত মনে হয়। মলিনা তারপর মুখ তুলে বলে, কিন্তু আমি এত দয়া নেব কেন?”

    না হয় মনে করো, আমায় দয়া করছ।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article ততোধিক – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    আশাপূর্ণা দেবী

    বিবাগী পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    কুমিরের হাঁ – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ঠিকানা – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ততোধিক – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ভালোবাসা চিরকালীন – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }