Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ২০১০ : ওডিসি টু – আর্থার সি. ক্লার্ক

    লেখক এক পাতা গল্প384 Mins Read0
    ⤷

    ১. প্রথম পর্ব : লিওনভ

    ২০১০ : ওডিসি টু – আর্থার সি ক্লাক / অনুবাদ : মাকসুদুজ্জামান খান

    প্রথম প্রকাশ : জুন ২০০৫

    লেখকের উৎসর্গ

    মহান দুই রাশিয়ান জেনারেল অ্যালেক্সি লিওনভ-কসমোনট, সোভিয়েত ইউনিয়নের বীর, চিত্রশিল্পী।

    এবং

    অ্যাকাডেমিশিয়ান আন্দ্রে শাখারভ–
    বিজ্ঞানী, নোবেল বিজয়ী, মহান মানবতাবাদী

    অনুবাদকের উৎসর্গ

    যিনি এই বইয়ের এক তৃতীয়াংশ লিখেও
    অনুবাদক হিসেবে নাম দিতে চাননি
    আব্বুকে

    লেখকের কথা

    ২০০১: আ স্পেস ওডিসি উপন্যাসটা লেখা হয় ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যে; প্রকাশিত হয় আটষট্টির জুলাইতে, ছবি মুক্তির পর পরই। দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ডর্স অব ২০০১-এ বলেছিলাম, চলচ্চিত্র আর উপন্যাসের কাজ সমান্তরালে চলে। ফলে আমি লেখার মোটামুটি ব্যয়বহুল পথ ধরে চলা শুরু করলাম; স্ক্রিপ্ট দেখার সুযোগ পেলাম ছবির চিত্র দেখার পর, তাও আবার দৃশ্যগুলো ধারণ করা হয় পুরনো ধারণায় ভিত্তি করে।

    ফলে, কাহিনীর গতিধারায় একটা সমান্তরালতা থেকে যায়, সেই সাথে পার্থক্যও রচিত হয় বিস্তর। উপন্যাসে স্পেসশিপ ডিসকভারির লক্ষ্যস্থল ছিল শনির সবচে রাজকীয় উপগ্রহ জ্যাপেটাস বা ইপেটাস। শনীয় জগতে যেতে হয়েছিল বৃহস্পতিকে পাশ কাটিয়ে। ডিসকভারি চলে যায় গ্রহরাজের অসীম গ্র্যাভিটিশনাল ফোর্স কাজে লাগিয়ে, ধনুকের ছিলার মতো এর দানবীয় শক্তিকে নিজের জন্য ব্যবহার করে এগিয়ে যায় সামনে। ভয়েজার স্পেসপ্রোব সেই একই কাজ করে ১৯৭৯ সালের অভিযানে, বাইরের দিকের দৈত্যদের সাথে প্রথম মোলাকাতের সময়গুলোতে।

    ছায়াচিত্রে স্ট্যানলি কুবরিক বিজ্ঞের মতো মানুষ ও মনোলিথের মাঝখানে তৃতীয় প্রতিদ্বন্দ্বীকে উপস্থাপিত করেন বৃহস্পতীয় জগতে। শনিকে পুরো স্ক্রিপ্ট থেকে সরিয়ে ফেলা হয়, যদিও ডগলাস ট্রাম্বল তার বলয়সমৃদ্ধ গ্রহের অভিজ্ঞতা পরবর্তীকালে সাইলেন্ট রানিং চলচ্চিত্রে কাজে লাগিয়েছিলেন।

    সেই ষাটের দশকে কেউ হয়তো ভাবেনি যে বৃহস্পতি অভিযান আগামী শতকে বরং মাত্র পনের বছর সামনে উপস্থিত। তারপর সামনের সেই অচেনা জগতে বিছানো শত রহস্যের দরজা খুলে গেল, আমরা দেখতে পেলাম অনেক অপ্রত্যাশিতের হাতছানি। আশা করা যায় ভয়েজার অভিযান দুটোর ফলে যে বিস্ময়ের জন্ম হয়েছে। সেটাও পেছনে পড়ে যাবে আসতে থাকা নূতন মিশনের আলোয়।

    ২০০১ লেখার সময় আইও, ইউরোপা, গ্যানিমিড ও ক্যালিস্টো সবচে শক্তিশালী টেলিস্কোপেও এক একটা ক্ষুদ্র বিন্দুর মতো দেখাতো। কিন্তু আজ উল্টে গেছে পাশাখেলার ছক। এখন তারা প্রত্যেকে নিজস্বতা নিয়ে উপস্থিত আমাদের চোখের সামনে; তাদেরই একজন, আইও, এখন সৌরজগতের সবচে তেজস্বী উপগ্রহ।

    এ আবিষ্কারগুলোর আলোকে ছায়াচিত্র বা উপন্যাস, দুটি-ই যুগজিজ্ঞাসার সামনে পড়েছে। ছবির বৃহস্পতীয় জগৎ আর ভয়েজারের ফিল্মগুলোতে উঠে আসা গ্রহরাজের রাজত্বে অনেক ফারাক চোখে পড়ে। আজকের জগতে যাই লেখা হোক কেন, তা অবশ্যই ১৯৭৯ সালের আবিষ্কারের রসে জারিত হতে হবে; আজ আর সেগুলো অচেনা ভুবন নয়।

    এখানে আরো শক্তিময় একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার জড়িত। মহাকাল পৃথিবীর ইতিহাসকে দু অংশে ভাগ করে দিয়েছে; ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই নিল আর্মস্ট্রং চাঁদের বুকে পা রাখার আধযুগ আগেই আমি আর স্ট্যানলি কুবরিক যখন, সত্যিকার সার্থক সায়েন্স ফিকশন (কথাটা তার) মুভি তৈরির চেষ্টায় প্রাণ আঁতিপাতি করতাম তখন ২০০১ লেখা হয়। তাই, সেই চান্দ্র বিভাজনের পর অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তন আসে লেখনীর জগতে, যথারীতি।

    চাঁদের পথে পা বাড়ানোর আগেই অ্যাপোলোর অ্যাস্ট্রোনটরা চলচ্চিত্রটা দেখেছিলেন। উনিশো আটষট্টির ক্রিসমাসে অ্যাপোলো আটের ক্রুরা চান্দ্র দিগন্তে প্রথম চোখ রেখে নাকি রেডিওতে জানাতে চাচ্ছিলেন যে একটা বিশাল কালো মনোলিথ দেখা যাচ্ছে দূরে কোথাও। হায়, বাস্তবতো এমন নয়!

    প্রকৃতি কত নিষ্ঠুর খেলাই না খেলতে পারে! উনিশো স্যুরের অ্যাপোলো তেরো মিশনে আরো একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

    যে কমান্ড মডিউলে লোকজন থাকত সেটার নাম ছিল ওডিসি। অক্সিজেন সিলিন্ডার বাস্ট হয়ে যেতে উদ্যত হবার একটু আগে তারা রিচার্ড স্ট্রাউসের জরথুস্ত্র থিম বাজাচ্ছিল, যেটাকে বর্তমানে সারা পৃথিবী মুভিটার কল্যাণে চেনে। এনার্জি চলে যাবার সাথে সাথে জ্যাক সুয়েগার্ট মিশন কন্ট্রোলের সাথে রেডিওতে যোগাযোগ করে, হিউস্টন, উই হ্যাভ হ্যাড এ প্রব্লেম।

    কাছাকাছি এক অবস্থায় ছায়াচিত্রে হাল ডিসকভারির ক্রু ফ্র্যাঙ্ক পোলকে যেভাবে বলেছিল, স্যরি টু ইন্টারাপ্ট দ্য ফেস্টিভিটিস, বাট উই হ্যাভ এ প্রব্লেম।

    অ্যাপোলো তেরোর মিশন রিপোর্ট নাসাতে আসে, পরে জনসমক্ষে প্রকাশের পর নাসার অ্যাডমিনিস্ট্রেটর টম পেইন আমাকে একটা কপি পাঠান যেখানে লেখা ছিল:

    আর সব সময়ের মতো যেমন করে আপনি বলেন, এমনটা হতে পারে, আর্থার।

    আমি একই সময়ে ঘটিত তিন-চারটা ব্যাপারে মিল দেখে এখনো থমকে যাই।

    আরো একটা সাড়া কম সিরিয়াস হলেও একই রকম অবাক করে। ছবির টেকনিক্যাল দিক দিয়ে সবচে মেধাবী কাজের মধ্যে একটা হল, ফ্র্যাঙ্ক পোল একটা গোল ট্র্যাকের ভিতরে বারবার জগিং করতে করতে ঘুরতে থাকে বিশাল সেন্ট্রিফিউজের মধ্যে। তার এ দৌড়ানো সম্ভব হয় জিনিসটার ঘূর্ণনের ফলে সৃষ্ট কৃত্রিম গ্র্যাভিটির কল্যাণে।

    প্রায় দশকখানেক পরে, অসাধারণ সাফল্য পাওয়া স্কাইল্যাবের ক্রুরা আবিষ্কার করল যে তাদের এ মহাকাশতরীর ডিজাইনাররা একই জ্যামিতি অনুসরণ করেছে। স্কাইল্যাবের ভেতরটাকে ঘিরে একটা শক্তিময় ক্যাবিনেটের রিং বসানো ছিল। স্কাইল্যাব ঘুরত না কিন্তু ক্রুরা ঠিকই ইঁদুরের গোল খাঁচায় দৌড়ানোর মতো করে শারীরিক কসরত করে নিতে পারত। এমনকি তাদের সেই ঘোরার দৃশ্য টেলিভিশনে পাঠানো হয়েছিল। (আমি কি ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকটার নাম করব?) সেইসাথে একটা ছোট্ট বার্তা পাঠানো হয়, স্ট্যানলি কুবরিকের এটা দেখা উচিত।

    তিনি দেখেছিলেন, আমি টেলিসিনটা পাঠিয়ে দিই তাঁর কাছে। (আর কখনো ফেরত পাইনি জিনিসটা। যথারীতি। আমাদের স্ট্যানলি খুবই বিশ্বস্ত একজন ব্ল্যাকহোল। তার কাছে কোনোকিছু গেলে…)

    বাস্তবের সাথে মুভিটার আরো একটা মিলের কথা না বলে পারি না, অ্যাপোলো-সয়ুজ কমান্ডার কসমোনট অ্যালেক্সি লিওনভ আঁকা, চাঁদের কাছে। জাতিসংঘের বহির্মহাবিশ্বের শান্তিময় ব্যবহার বিষয়ক একটা কনফারেন্সে আমি ছবিটা দেখি। বিস্ময়কর। আমাদের চলচ্চিত্র মাত্র কিছুদিন আগে মুক্তি পেয়েছে। তার আইডিয়ার সাথে মুভির প্রথম দৃশ্যের অনেক অনেক মিল, প্রথমে চাঁদের পেছনে উদিত হচ্ছে ধরণী, তার পেছনে সূর্য। মস্কোতে তিনি আর শাখারভ মিলে আমাদের প্রতীক্ষায় মহাকাশ বইটা লেখেন ১৯৬৭ সালে। সেটার ৩২ পৃষ্ঠায় এ নিয়ে লেখা আছে। ছবিটার একটা স্কেচ, তার অটোগ্রাফসহ ঝুলছে আমার অফিস দেয়ালে। আরো বিস্তারিত জানতে ১২ তম অধ্যায়ে দেখতে পারেন।

    হয়তো এ থেকে আরো একজন গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু কম পরিচিত লোকের নাম উঠে আসতে পারে। হিউয়েন-সেন জিয়াং। মহান থিওডর ফন কারম্যান আর ফ্র্যাঙ্ক জে ম্যালিনার সাথে গুটেনহ্যাম অ্যারোনটিক্যাল ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি (ক্যালটেক)-এ। প্যাসাডেনের প্রখ্যাত জেট প্রোপালশন ল্যাবের উত্তরসূরী এটি। তিনি ক্যালটেকের প্রথম গদার প্রফেসর ছিলেন, চল্লিশের দশক জুড়ে আমেরিকার রকেট বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে চলেন। ম্যাককার্থি যুগের অন্যতম বিশ্রী ঘটনা ঘটে যায় এরপর। নিজের দেশে ফেরার কথা বলতেই গ্রেফতার হন। পরের দু দশক তিনি চৈনিক রকেট প্রোগ্রামের অন্যতম পুরোধা ছিলেন।

    সবশেষে, ২০০১ এর ৩৫ তম অধ্যায়ে জ্যাপেটাসের নয়ন নামে একটা আজব কথা আছে। আমি এখন মহাকাশবিদ ডেভিড বোম্যানের করা সেই আবিষ্কারের ব্যাখ্যা দিচ্ছি যেখানে আছে, এক উজ্জ্বল সাদা ডিম্বাকার এলাকা… চারশো মাইল লম্বা আর দুশ মাইল চওড়া… একেবারে চৌকো… তার উপর, দেখতে এমন যেন… ছোট্ট চাঁদটার মুখে রঙ মাখা হয়েছে। এমনকি কাছাকাছি আসার পর বোম্যানের মনে হল যেন কোনো উজ্জ্বল চোখ চেয়ে আছে তার দিকে। তারপর সে দেখল, ঠিক কেন্দ্রে এক বিন্দু। দেখে যাকে ঠিক মনোলিথ বলে ভুল হয়।

    মজার ব্যাপার, ভয়েজার-১ এর পাঠানো ইপেটাস বা জ্যাপেটাসের প্রথম ছবিতে এক সাদা গোল ডিম্বাকার দেখা যায় যার ঠিক মাঝখানে এক কালো বিন্দু।

    কার্ল সাগান জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরি থেকে আপনার কথা ভেবে… সহ একটা প্রিন্ট আউট পাঠান। জানি না ব্যাপারটা নিয়ে হতাশ হতে হবে নাকি আশায় বুক বাঁধতে হবে, ভয়েজার-২ পথটা খোলা রাখছে এখনো।

    অপ্রতিরোধ্যভাবেই, আমি আগের বই টেনে নিয়ে যেতে চাইনি। এর দ্বিতীয় পর্ব লেখার ইচ্ছা ছিল না। কাহিনী টেনে নেয়ার চেয়ে একেবারে নতুন কোনো ধারণা পরের খণ্ডে আনার চেষ্টা করেছি তাই। এখানে, ছবি বা ২০০১ উপন্যাস, কোনোটাই পুরোপুরি অনুসরণ করা হয়নি। কিছুটা মিল রাখা হয়েছে চলচ্চিত্রের সাথে। বইটাকে একেবারে স্বাধীন করার চেষ্টা ছিল। এ বইতে ইচ্ছা ছিল বর্তমানের বিজ্ঞানের আলোকে তুলে আনার।

    যে ধারণা, অবশ্যই, পুরনো হয়ে যাবে ২০০১ সালের মধ্যে…

    আর্থার সি ক্লার্ক
    কলম্বো, শ্রীলঙ্কা জানুয়ারি, ১৯৮২

    প্রথম পর্ব : লিওনভ

    ১. সেন্টারে মুখোমুখি

    পরিমাপের এ মেট্রিক যুগেও তিনশ মিটার না বলে এক হাজার ফুটের টেলিস্কোপ বলা হয় বিশাল গোল ডিশটাকে। গ্রীষ্ম মণ্ডলে সূর্যের বিশ্রাম দরকার; পাহাড়ে বসানো এ বিশাল ডিশের অর্ধেকটা ঢেকে গেছে ছায়ায়। উপরে ঝুলন্ত অ্যান্টেনা কমপ্লেক্সের তিন কোণা র‍্যাফট এখনো আলোয় ভাসছে। অনেক নিচ থেকে আকাশ-তারের গোলক ধাঁধায় দুজন মানুষের মতো দেখা যায়। আশপাশে সাপোর্ট ক্যাবল আর ওয়েভ বাহক ভরা। তাদের দেখতে হলে দিতে হবে খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।

    ডক্টর দিমিত্রি ময়শেভিচ তার পুরনো বন্ধু হেউড ফ্লয়েডকে বলল, এখনি সময়। অনেক কিছু নিয়ে কথা বলতে হবে। জুতা, স্পেসশিপ, সীলগালা আর বিশেষ করে মনোলিথ; বুঝতেই পারছ, কাজে ফেল মারা কম্পিউটারটা নিয়ে কথা বলতে হবে।

    এজন্যেই আমাকে কনফারেন্স থেকে বের করে আনলে? আমার মনে হয় না। কার্ল ঐ গলাবাজির এস ই টি আই বক্তৃতা অনেক দিয়েছে। আমি নিজেই আগাগোড়া আউড়ে যেতে পারব… আশপাশের পরিবেশ দারুণ, কী বল? তুমি তো জানো, আমি সব সময় এরিসিবোর কাছে থাকতাম। কখনোই অ্যান্টেনার কথাটা তুলে ধরিনি।

    তোমার জন্য লজ্জাজনক, হেউড। এ নিয়ে তিনবার এখানে এলাম। ভেবে দেখ, এই এখানে আমরা সারা বিশ্বকে শুনছি কিন্তু কেউ আমাদের কথা আড়ি পেতে শুনতে পাবে না। সুতরাং সমস্যা নিয়ে কথা বলতে পারি আমরা।

    কী সমস্যা?

    প্রথমে… ন্যাশনাল কাউন্সিল অব অ্যাস্ট্রোনটিক্সের চেয়ারম্যান পদ থেকে কেন তোমাকে রিজাইন করতে হলো?

    অমি ঠিক ইস্তফা দেইনি, হাওয়াই ইউনিভার্সিটি অনেক ভাল বেতন দেয়।

    ঠিক আছে-তুমি রিজাইন দাওনি-তাদের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে ছিলে। উডি, এত বছর পর আমাকে কি বোকা বানাতে পারবে? মনে হয় তোমার সে চেষ্টা বাদ দেয়া উচিত। ঠিক এ মুহূর্তে তারা যদি এন সি এ-তে ফের নেয়ার প্রস্তাব দেয়, তুমি কি যাবে না?

    ঠিক আছে, বুড়ো কসাক, কী জানতে চাও?

    প্রথমে, অনেক খোঁচাখুঁচির পর তুমি যে প্রতিবেদনই পাঠিয়েছ তা প্রচুর লাগামহীন কথাবার্তা দিয়ে শেষ হয়। তোমাদের লোকজনের সেই অদ্ভুত আর সত্যি বলতে গেলে অবৈধ কাজটার কথা বাদ দিলাম নাহয়, তারা অবৈধভাবে গোপন করেছে টাইকো মনোলিথ খুঁড়ে বের করার কথা–

    আমি এ আইডিয়া দেইনি।

    শুনে খুশি হলাম; বিশ্বাস করি তোমাকে। তোমরা সবাইকে জিনিসটা পরীক্ষা করতে দিচ্ছ, ভাল কথা কিন্তু অবশ্যই প্রথমে করতে দেয়া উচিত ছিল। মনে হয় না কাজটা ঠিক হল…।

    দুজন চাঁদের সেই কালো, অসাধারণ জিনিসটা নিয়ে আলোচনা করছে গভীরভাবে আর তাদের চারপাশটায় জেঁকে বসেছে বিষণ্ণ নিরবতা। যেন প্রকাশ্যে বিরোধিতা করছে সব অস্ত্র। সাধারণ সরলতা দিয়ে এত বিরাট ব্যাপার হয়ে যেতে পারে না। দেশ দুটো একে অন্যকে সাহায্য করতে পারে না। রাশিয়ান বিজ্ঞানী বলতে থাকে।

    টাইকো মনোলিথ যাই হোক না কেন, বৃহস্পতির এলাকায় আরো ভয়াল কিছু বসে আছে। মনোলিথ সংকেত পাঠিয়েছিল বৃহস্পতিতেই। বাস্তব হল, সেখানটায় তোমার লোক ঝামেলায় পড়েছিল। সে ব্যাপারে…আই অ্যাম স্যরি। ডিসকভারির ক্রুদের মধ্যে একমাত্র ফ্র্যাঙ্ক পোলকেই আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম। ৯৮র আই এ এফ কংগ্রেসে তার সাথে দেখা হয়- বেচারা ভাল মানুষ ছিল।

    ধন্যবাদ তোমাকে; তারা সবাই ছিল ভাল। আশা করি আমরা জানি তাদের কী হয়েছে…মানে যা জানি তা ঠিক হবার আশা করতে পারি।

    যা-ই হয়ে থাক না কেন, নিশ্চয়ই তুমি স্বীকার করবে যে ব্যপারটা এখন পুরো মানবজাতিকে পেঁচিয়ে ধরেছে, শুধু ইউনাইটেড স্টেটসকে নয়। আজ আর তোমরা জ্ঞানকে শুধু জাতীয় কাজে লাগাতে পার না।

    দিমিত্রি-তুমি ভালো করেই জানো। তোমরা যদি চাঁদের ঐ পিশাচটাকে আবিষ্কার করতে, তারপর তোমাকে যদি টু শব্দ করতে মানা করা হতো তাহলে তুমিও সেসব কথা বেমালুম চেপে যেতে। তারপর বিজ্ঞানকে শুধুই দেশের স্বার্থে ব্যবহার করতে।

    কথাটা ঠিক। কিন্তু এ তো প্রাচীন ইতিহাস-তোমাদের এবার বিদায় নেয়া সরকারওতো শুধু সেসব কথা ভেবে মরত। তারাও ভণ্ডুল করে দিয়েছে পুরো ব্যাপারটাকে। নতুন প্রেসিডেন্টের সাথে সাথে বোধহয় আরেকটু জ্ঞানী কাউন্সিলররা জিতবে।

    মনে হয়। আচ্ছা, আসলে তুমি কিছু একটা বলবে আমাকে। আমিওতো তোমাকে চিনি, না? কথাগুলো অফিসিয়াল, নাকি ব্যক্তিগত ইচ্ছা?

    এ মুহূর্তে সম্পূর্ণ আনঅফিসিয়াল। হতভাগা ঐ রাজনীতিবিদরা যাকে বলে অভিযান নিয়ে কথা। আমার বিশ্বাস, তারা এ ধরনের কথা কখনোই বলে না।

    ঠিক, ঠিক চালিয়ে যাও।

    খেই ধরছে রাশান বিজ্ঞানী, এই হল পরিস্থিতি। তোমরা যত দ্রুত সম্ভব ডিসকভারি-টু কে পার্কিং কক্ষপথে পাঠাচ্ছ, এটাই তোমাদের চাওয়া। কিন্তু সময় লাগবে তিন বছর। যার অর্থ তোমরা পরবর্তী লঞ্চ উইন্ডোর সুযোগ হারাবে।

    স্বীকার-অস্বীকার কোনোটাই করছি না। মনে রেখ, আমি আর কাউন্সিলের প্রধান নই, বরং ন্যাশনাল কাউন্সিল অব অ্যাস্ট্রোনটিক্স থেকে যোজন যোজন দূরে, পৃথিবীর অন্য পাশে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্রেফ একজন বিনয়ী চ্যান্সেলর, সম্মানিত আচার্য।

    এবং আমার মনে হয়, ওয়াশিংটনে এন সি এ তে পুরনো অফিসে তোমার গত ভ্রমণ ছিল পুরনো বন্ধুদের দেখার জন্য একটা ছুটির দিন। কথা চালিয়ে যাই। আমাদের নিজস্ব অ্যালেক্সি লিওনভ-

    আমি ভেবেছিলাম তুমি একে হেরম্যান টিটভ বলে ডাকছিলে।

    ভুল, চ্যান্সেলর। প্রিয় পুরনো সি আই এ তোমাদের আবার পুরনো তথ্য দিল। গত জানুয়ারির হিসেবে ওটা লিওনভ। কাউকে জানতে দিও না যে আমি তোমাকে এসব বললাম, শিপটা কমপক্ষে এক বছর আগে বৃহস্পতিতে পৌঁছোবে।

    তাহলে আমিও তোমাকে আমাদের একটা সিক্রেট বলে দিই…কাউকে জানতে দিওনা, আমরা এ ভয়ই পাচ্ছিলাম এতদিন ধরে। চালিয়ে যাও।

    কারণ আমার সব বস ঠিক তোমার বসদের মতোই বোকা এবং অদূরদর্শী। তারাও ডিসকভারির কাছে একা যেতে চায়। অর্থাৎ শুধু দেশের স্বার্থে কাজ। মানে হল তোমরা যে ভুল করেছ আমরাও তেমন কিছু করে বসতে পারি, কারণ আগের অভিজ্ঞতা আছে শুধু তোমাদের। আরে ভাই, যাই হোক আমরা সবাই হয় একের বর্গ করব-ফল হবে একই, নয়তো আরো খারাপ, এর বেশি আর কী? মনে হচ্ছে লাভ-লোকসানের হিসাবে রাশিয়ান বিজ্ঞানী খুব একটা ধার ধারে না।

    আমাদের কী ভুল ছিল মনে হয়? তোমাদের মতো আমরাও পড়ে আছি গোলক ধাঁধায়। ডেভ বোম্যানের পাঠানো সব খবর তোমরা পাওনি তা আমাকে বিশ্বাস করতে বলো না।

    অবশ্যই আমরা পেয়েছি। ঠিক, শুনেছি মাই গড! আমার সামনেটা তারায় তারায় ভরা! কথাটুকু পর্যন্ত। গুরুত্ব দিয়ে বিশ্লেষণ করেছি তার কণ্ঠস্বরের প্যাটার্ন। আমরা মনে করি না সে কল্পনা করে বা এমি এম্নি বলেছে সেই ভয়াল শেষ বাক্যটা। বাস্তবে যা দেখেছিল তা বর্ণনা করার চেষ্টা করছিল কথা দিয়ে।

    এবার আঁতকে দেয়া প্রশ্ন তুলল দিমিত্রি, তার ডপলার পরিবর্তন নিয়ে কাজ করে কী পেলে?

    অবশ্যই, একেবারে অসম্ভব। কথা হারানোর মুহূর্তে সে পিছিয়ে যাচ্ছিল আলোর এক দশমাংশ গতিতে! এবং সেখানে দু মিনিটের কম সময়ে পৌঁছেছিল। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের চেয়ে আড়াই লাখ গুণ বেশি আকর্ষণ! অবশ্যই, সে মারা যায় সাথে সাথে। পৃথিবীর আকর্ষণে একতলা থেকে পড়লেই মানুষ ভর্তা হয়ে যাবে, কী বল? বলা উচিত তাকে খুন করেছে ঐ মনোলিথ। হেউড ফ্লয়েড আফসোসের সুরে বলছে।

    কাঁচা হওয়ার ভান করো না উডি। তোমার মহাশূন্যখোসার রেডিওগুলো টিকে থাকার মতো করে তৈরি হয়নি। এমনকি ঐ ত্বরণের এক শতাংশ ত্বরণেও টিকবে না। যদি তোমাদের ক্রুরা সে অবস্থায় বেঁচে থাকতে পারে…যোগাযোগ হারানোর আগ পর্যন্ত অন্তত বোম্যান বেঁচে ছিল।

    আন্দাজে বাধা দিচ্ছ আমার কথায়। স্পষ্ট করে বলছি, তোমাদের মতো আমরাও অন্ধকারে; কিচ্ছু জানি না। আচ্ছা, তোমরাও যে কিছু জানো না তা না-ও হতে পারে।

    স্রেফ প্রচুর দিশেহারা ধারণার সাথে খেলা করে অনুমান করেছি। তোমাকে আন্দাজগুলো বলতে লজ্জা হয়। তবু আমার মাঝে মাঝেই মনে হয় আন্দাজগুলো পাগলাটে, কিন্তু যেটা সত্যি হয়েছিল দু হাজার এক সালে সেটা এসব ধারণার চেয়েও অনেক অনেক বেশি অবাক করবে।

    গাঢ় লাল ছোট আলোর বিস্ফোরণ সামনে। নেভিগেশনের সতর্ক বাতি তাদের চারদিকে জ্বলছে, অ্যান্টেনা কমপ্লেক্সের ভার বহনকারী সরু তিনটি টাওয়ার সতর্ক সংকেতের মতো অন্ধকার আকাশের দিকে আগুন ছুঁড়ছে। রোদপোড়া ধাতুর ধারালো টুকরো পুড়িয়ে দিল নিচের চারদিকের পাহাড়; হেউড ফ্লয়েড সবুজ সংকেতের জন্য অপেক্ষা করছে…সবুজ সংকেত সে কখনো দেখেনি। আরেকবার তাকে হতাশ হতে হল।

    সুতরাং দিমিত্রি, সে বলল, চল-আসল কথায় আসি, তুমি ঠিক কী বোঝাতে চাও?

    ডিসকভারির ডাটা ব্যাংকে প্রচুর অমূল্য তথ্য থাকতে পারে; যেহেতু শিপ ফিরে আসছে না, ধরতে পারি এটা এখনও তথ্য সংগ্রহ করছে। আশা করি আমরা তা পাব।

    দারুণ কথা। কিন্তু যখন তুমি সেখানে যাবে এবং লিওনভ সংকেত জায়গা তৈরি করবে তখন ডিসকভারিতে আছে এমন ডাটার মধ্যে তুমি যেগুলো চাও সেগুলো কপি করার সময় কে তোমাকে বাধা দেবে?

    বেশ হতাশ হল দিমিত্রি, আমি কখনো ভাবিনি তোমাকে মনে করিয়ে দিতে হবে যে ডিসকভারি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্র। এখানে অনধিকার প্রবেশ স্রেফ জলদস্যুতা।

    জীবন-মরণের জরুরি মুহূর্ত ছাড়া জলদস্যুতা করতে অসুবিধা হবে না। মোটের উপর বিলিয়ন বিলিয়ন কিলোমিটার দূর থেকে তোমার ছেলেদের খুঁজে বের করা আমাদের জন্য হবে কঠিন কাজ।

    অন্তত, চমৎকার পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ; আমি পথটুকু ঠিকই পেরিয়ে যাব। কিন্তু আমরা যদি মহাকাশে যেতাম তোমাদের মতো তাহলে তোমাদের সব পদ্ধতি শিখতে আমাদের কয়েক সপ্তাহ লাগত। তোমাদের সব মেমরি ব্যাংকও পড়ে ফেলতাম। আমার প্রস্তাব সহযোগিতার। বুঝতে পারছি এটাই সবচে ভাল ধারণা-কিন্তু আমাদের দুজনেরই বসদের কাছে ধারণাটা বেচে দেয়ার জন্য নিজেদের চাকরি থাকা উচিত।

    তুমি আমাদের নভোচারীদের একজনকে চাও…লিওনভের সাথে ওড়ার জন্য? যাতে ডিসকভারিতে ঢোকাটা হালাল হয়ে যায়? যাতে আমাদের ভুলগুলো আরেকবার তোমরা না কর?

    হা-বরং একজন প্রকৌশলীকে চাই যে ডিসকভারির সিস্টেমগুলোর বিশেষজ্ঞ। জাহাজটাকে বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য যাদের তুমি হিউস্টনে প্রশিক্ষণ দাও তাদের মতো একজন।

    এ খবর জানো কীভাবে?

    স্বর্গের কসম, উডি-কমপক্ষে একমাস আগে জেনেছি। বিমানচালনা সপ্তাহের ভিডিওটেক্সট ছিল।

    আমি আজকাল যোগাযোগ করি না; কী সরানো হয়েছে কেউ আমাকে বলেনি।

    মুচকি হাসছে দিমিত্রি, তোমার ওয়াশিংটনে সময় কাটানোর এও এক কারণ। তুমি কি অস্বীকার করবে?

    হু। আমি তোমার সাথে একশো ভাগ একমত। কিন্তু—

    কিন্তু কী?

    আমাদের দুজনকেই মাথা খাঁটিয়ে ডায়নোসরের লেজে কাজ করতে হবে। এ ডায়নোসরগুলোর ব্রেন পড়ে আছে লেজে। আমাদের কেউ কেউ অন্য কথা বলবে: বৃহস্পতি নিয়ে ধস্তাধস্তি করে রাশিয়ানদেরকে তাদের ঘাড়ে ঝুঁকি নিতে দাও। দুবছর পর আমরা যে কোনো উপায়ে সেখানে থাকব-তাড়াহুড়োর কী হল?

    একশ মিটার উপর থেকে ঝোলানো সুবিশাল ভার বহনকারী তার থেকে অস্পষ্ট কাঁচ ক্যাচ শব্দ ছাড়া মুহূর্তের জন্য অ্যান্টেনা র‍্যাফটে নিরবতা নেমে এসেছিল। তখন ময়শেভিচ এমন শান্তভাবে কথা বলতে লাগল যে ফ্লয়েডকে তার কথা শোনার জন্য অনেক চেষ্টা করতে হয়। আজকাল ডিসকভারির কক্ষপথ কি কেউ চেক করেছে?

    আসলে আমি জানি না-করেছে হয়ত। যা-ই হোক, দুশ্চিন্তা করছ কেন? ডিসকভারি ইজ ওকে।

    অবশ্যই। আগের দিনের নাসা সময় থেকে এক দুর্ঘটনার কথা আনাড়ির মতো মনে করিয়ে দিতে দাও। তোমাদের প্রথম মহাশূন্য স্টেশন-স্কাইল্যাব। এক দশক আকাশে থাকার কথা ছিল, কিন্তু হিসাব ঠিক মতো করোনি। আয়োনোস্ফিয়ারের এয়ার ড্রাগকে ছোট করে দেখা হয়। স্কাইল্যাব ধ্বংস হয়ে নেমে আসে সে বছরের আগেই। আমি শিওর ঐ ছোট ক্লিপ হ্যাংগারটার কথা মনে আছে, তুমি ছোট ছিলে তখন।

    গ্রাজুয়েশন শেষ করেছিলাম তখন, তুমি জানো। কিন্তু ডিসকভারি বৃহস্পতির ধারে কাছে যায় না। এমনকি পেরিজি…ধ্যাৎ, পেরিজোভেও এটা বায়ুমণ্ডলীয় ড্রাগে আক্রান্ত হওয়ার মতো উচ্চতা থেকে অনেক উপরে।

    আমি আবার দাচায় নির্বাসিত হওয়ার মতো যথেষ্ট গোপন কথা বলেছি-হয়ত পরে আর আমাদের দেখা করতে দেবে না গোয়েন্দা সংস্থার টিকটিকিগুলো। সুতরাং তোমাদের ট্র্যাকিং এক্সপার্টদের বল আরো যত্নের সাথে কাজ করতে, বলবে তো? তাদের মনে করিয়ে দাও যে সৌর জগতের সবচে বড় ম্যাগনেটোস্ফিয়ারটা বৃহস্পতির।

    বুঝলাম-অনেক ধন্যবাদ। নিচে যাবার আগে আর কিছু বলবে? আমি ফ্রিজ করব এখন।

    ভয় পেও না বন্ধু। তুমি অভিজ্ঞ। যখনই এসব অবাঞ্ছিত সংকেত বাতিল করার ফিল্টার ওয়াশিংটনে পাঠাবে-তখন থেকে সপ্তাখানেক অপেক্ষা কর। পরিস্থিতি খুব গরম হয়ে যাবে। খুব্বি উত্তপ্ত।

    ২. বাড়ির ভেতর ডলফিন

    ডলফিনরা প্রতি সন্ধ্যায় সূর্য ডোবার ঠিক আগে ডাইনিং রুমে সাঁতার কাটে। ফ্লয়েড যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে আচার্যের বাসায়-এরা রুটিন ভেঙেছিল তখনি, মাত্র একবার। পাঁচ নম্বর সুনামির দিন আসেনি। সৌভাগ্যক্রমে হিলোতে পৌঁছার আগেই দুর্বল হয়ে পড়ে জলোচ্ছ্বাসটা। পরে ফ্লয়েডের বন্ধুরা সময় মতো আসতে না পারায় ফ্লয়েড তার পরিবারকে গাড়িতে তুলে মুনা কি এর দিকে উঁচু জায়গার খোঁজে এগিয়ে যায়।

    এরা দারুণ, কিন্তু তাকে স্বীকার করতে হয়েছে যে এদের কৌতুক প্রবণতা মাঝেমাঝে বিড়ম্বনা সৃষ্টি করে। এক স্বাস্থ্যবান সামুদ্রিক ভূতত্ত্ববিদ বাড়িটির ডিজাইন তৈরি করেছিল। ভিজে যাওয়াতে সে কখনো কিছু মনে করত না, কারণ সাধারণত স্নানের পোশাক পরাই ছিল সেই লোকটার বৈশিষ্ট্য।

    কোনো এক সদস্যের অপেক্ষায় যখন সন্ধ্যার পোশাক পরা পরিচালনা পরিষদের বাকি সদস্যেরা পুলের চারিদিকে একটু একটু করে চুমুক দিয়ে ককটেল পান করছে, তখন হল এক মজার ঘটনা। ডলফিনরা বুঝতে পেরেছিল দ্বিতীয়বার আদর পাবে; সাথে খাবারও। সুতরাং ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার লোক পরে এমন ঢিলেঢালা পোশাক পরা একটা নোংরা ডলফিনকে রিসিপশন কমিটি সাদরে গ্রহণ করে দারুণ মজা পেয়েছে। বুফে ছিল খুবই নোতা।

    ফ্লয়েড প্রায়ই চিন্তা করত-প্রশান্ত মহাসাগরের কোল ঘেঁষে বানানো আমার অদ্ভুত আর সুন্দর বাড়ি দেখলে ম্যারিয়ান কী ভাবত! ও কখনো সমুদ্র পছন্দ করেনি, শেষে সাগরই জিতেছে তার ওপর। সময় মানুষের শোককে ধীরে ধীরে বদলে দেয়। এখনো আলো ঝলকের মতো তার মনে পড়ে খবরটার কথা যার মধ্যে প্রথম শব্দগুলি ছিল ভয়াবহ : ড, ফ্লয়েড-জরুরি এবং ব্যক্তিগত। এবং তারপর ফুরেসেন্ট প্রিন্টের পাকানো কাগজের সাইনগুলো মেসেজ পাঠিয়ে দ্রুতবেগে তার হৃদয় জ্বালিয়ে ফেলে : আপনাকে অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, লন্ডন-ওয়াশিংটন ফ্লাইট ৪৫২ নিউফাউন্ডল্যান্ডের অদূরে ক্র্যাশ করেছে বলে জানা গেছে। উদ্ধার শিপ লোকেশনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের ভয়-কেউ বেঁচে নাও থাকতে পারে।

    ভাগ্য অন্যদিকে না ঘুরে গেলে সেও ঐ ফ্লাইটে থাকতে পারত। কিছু দিন ধরে ইউরোপে মহাশূন্য প্রশাসন ব্যবসা ভাল লাগছিল না। তাই প্যারিসে আরো কদিন থেকে যায় ফ্লয়েড; পাইলট সোলারিসের সাথে ভাড়া নিয়ে দর কষাকষিই শেষ পর্যন্ত তার জীবনটা বাঁচিয়ে দিল। অবশ্য সে এভাবে ব্যপারটা ভাবতে চায় না।

    এখন একটা নতুন চাকরি, এক নতুন বাড়ি এবং একজন নতুন স্ত্রী থাকলেও ভাগ্য এখানে সহায় হয়নি। পাল্টা অভিযোগ এসেছে বারবার। আর সেই বৃহস্পতি মিশনের উপর তদন্ত চলল আরো কতবার তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এ সমস্ত ব্যাপার মিলে ওয়াশিংটনে ধ্বংস হয়েছে তার ক্যারিয়ার, কিন্তু যোগ্য মানুষ তার যোগ্যতার জন্যেই কখনো দীর্ঘ সময় বেকার থাকে না। আরো ধীর লয়ের ইউনিভার্সিটির জীবন সব সময়ই তাকে টানত এবং পৃথিবীর সবচে সুন্দর এক এলাকার সাথে গাঁটছড়া বাঁধার পর তার মনে হয় এমন কিছু হতোই, এটাই তার সার্থক গন্তব্য। চাকরির একমাস পরে যখন একঝাঁক টুরিস্টের সঙ্গে কিলাওয়ায় অগ্নিঝর্না দেখছে তখনই হবু দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়।

    ক্যারোলিনের কাছে হেউড ফ্লয়েড সন্তুষ্টি খুঁজে পেয়েছে। এ তুষ্টি ঠিক সুখের মতো দামি, সুখের মতো স্থায়ী। ম্যারিয়নের দুকন্যার একজন ভাল সৎ মা। তাকে উপহার দিয়েছিল প্রথম পুত্র। ক্রিস্টোফার। বয়সে কুড়ি বছরের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও মেয়েটা তার মানসিক অবস্থা বুঝতে পারে। ভাল করে দেয় মনটা। ভাগ্যকে ধন্যবাদ, সে এখন দুঃখবোধ ছাড়াই ম্যারিয়নের কথা গভীরভাবে মনে করতে পারে। কিন্তু মনমরা ও ব্যাকুল ভাব থেকেই যায়, এটুকু জীবনের বাকি সময় থাকবে সঙ্গে সঙ্গে।

    ফ্লয়েড হাতের মৃদু ইশারায় ডাকল ক্যারোলিনকে। সে মাছ ছুঁড়ছিল বড় পুরুষ ডলফিন-যাকে তারা স্কারব্যাক বলে ডাকে-ওটার দিকে। নীরব সংকেত আসছে কমসেট থেকে। ক্যারোলিনের আগেই কথা বলার জন্য সে সরু ধাতব ব্যান্ডে টোকা দিয়ে হেঁটে চলে গেল কাছের ঘরে ছড়ানো কমসেটের দিকে। এ যোগাযোগের যন্ত্রগুলো ভালই কাজ দেয়।

    চ্যান্সেলর বলছি। কে?

    হেউড? আমি ভিক্টর। আছ কেমন? এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে অনুভূতির এক সম্পূর্ণ প্রবাহ ফ্লয়েডের মনে বিদ্যুতের মতো চমকে ওঠে। বিরক্ত হয় অনেকটা। ফোন করেছে তার উত্তরসূরি, সেই এন সি এর বর্তমান প্রেসিডেন্ট। ফ্লয়েড নিশ্চিত, তার সর্বনাশের পেছনে এ লোকই দায়ী। সে ওয়াশিংটন থেকে চলে আসার পর কখনো একবারও তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি ভিক্টর। কিন্তু রাগ ভাবটা একটু কমে গিয়ে এল আগ্রহ; তারা কী বলতে চায়? কিন্তু ফ্লয়েড তো কিছুতেই তাদের উপকার করবে না। তারপর এল শিশুসুলভতার জন্য লজ্জা এবং সবশেষে এক উত্তেজনার উচ্ছ্বাস। ভিক্টর মিলসন তাকে ডাকতে পারে মাত্র একটা কারণে।

    যতোটা সম্ভব, নিরপেক্ষ স্বরে ফ্লয়েড উত্তর দিল, ভিক্টর, আছি কেমন আমি অভিযোগ করতে পারি না। অনেক অনেক ভাল। কী সমস্যা?

    সার্কিটটা কি নিরাপদ?

    না, আমি আর এমন কোনো কাজ করি না যে আমাকে গোপন সার্কিট ব্যবহার করে বিদেশী গুপ্তচরের ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতে হবে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।

    হু। আচ্ছা, আমি এটাকে এভাবেই রাখবো। তোমার পরিচালিত শেষ প্রজেক্টের কথা কি মনে আছে?

    সম্ভবত ভুলিনি। এই মাসখানেক আগেও নভশ্চরণবিজ্ঞানের সাব কমিটি আমাকে আরো প্রমাণ দিতে ডেকেছিল, ভুলি কী করে?

    অবশ্যই, অবশ্যই। আসলে আমার নিজের জন্যই তোমার দেয়া বিবৃতিটা পড়া উচিত, যখনই এক মুহূর্ত সময় পাই। কিন্তু ফলো-আপ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় রাতদিন; সেটাই সমস্যা।

    আমি ভেবেছিলাম সিডিউল অনুসারে ঠিকঠাক চলছে সবকিছু।

    দুর্ভাগ্যচলেনি। আমাদের এগিয়ে যাবার কোনো পথই নেই; সবচে বেশি অগ্রাধিকার দিলেও মিশন শুরুর দিনটা মাত্র কয়েক সপ্তাহ এগিয়ে আনা যেত। মোদ্দা কথা, আমাদের অনেক দেরি হবে।

    সরল ভাব দেখিয়ে ফ্লয়েড বলল, বুঝলাম না।

    আমরা সময় নষ্ট করতে চাই না-অবশ্যই চাই না; কিন্তু বাস্তবে সময়সীমাটা বেঁধে দেয়া নেই।

    এখন এক বচন করার সময় শেষ-বহুবচন বল। কাজ করছে দুটো ব্যাপার। ফ্লয়েড ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলে।

    অবাক করছ তুমি আমাকে।

    ভিক্টর যদি কোনো ভোগান্তি দেখে থাকে সেটা ফ্লয়েডের সমস্যা নয়। ফ্লয়েড এড়িয়ে গেল তার উদ্বেগকে, হ্যাঁ দুটো সমস্যা সামনে-একটা মানুষের বানানো; অন্যটা না। সবচে বড় কথা, আমরা সবার আগে সেখানে যেতে পারব না। পুরনো শত্রুরা কমপক্ষে এক বছর আমাদের মনে আঘাত করবে।

    খবর খারাপ।

    খারাপ না। এমনকি তারা প্রতিযোগিতা না করে গেলেও আমাদের অনেক দেরি হবে। পৌঁছে সেখানে কিছু পাব না।

    হাস্যকর। আমি নিশ্চিত কংগ্রেস যদি মাধ্যাকর্ষণ আইন বাতিল করত, আমি শুনতাম।

    আমি সিরিয়াস। পরিস্থিতি সুবিধার না-এখন বর্ণনা দিতে পারব না। তুমি কি সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকবে ওখানে?

    হ্যাঁ। মধ্যরাতের পর ওয়াশিংটনে একটা ভাল তোলপাড় হবে, শান্তির সাথে ভেবে ফ্লয়েড উত্তর দিল।

    চমৎকার। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে একটা প্যাকেজ পাবে। পড়ে আমাকে কল করো।

    দেরি হয়ে যাবে না?

    তা হবে। কিন্তু আগেও প্রচুর সময় নষ্ট করেছি। আর নষ্ট করতে চাই না। মিল্টন সময়মতো পাঠায় জিনিসটা। ঠিক এক ঘন্টা পর এয়ার ফোর্সের একজন কর্নেলের মাধ্যমে সিলমোহর করা এক বিরাট খাম পেল ও। ফ্লয়েড এর সারমর্ম পড়ার সময় কর্নেল ক্যারোলিনের সাথে ধৈর্য ধরে খোশগল্প করে নিল, ভদ্রভাবে।

    মনে হয় আপনি পড়ে শেষ করলে এটা আমাকে নিয়ে যেতে হবে। উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন বার্তাবাহক কৈফিয়ত দিল। পড়ার প্রিয় দোলনা বিছানায় আরাম করে বসে ফ্লয়েড বলল, শুনে খুশি হলাম।

    দুটো ডকুমেন্ট, প্রথমটা খুব ছোট। উপরে টপ সিক্রেট সিল আঁটা। টপ কথাটা কেটে ফেলা হয়েছে এবং সংশোধনী তিনটা সই করে অনুমোদন করা, সবগুলোই পুরোপুরি অস্পষ্ট। বোঝাই যায়, কোনো বড় প্রতিবেদনের অংশ এটা। ভালমতো পরীক্ষা করা হয়েছে বারবার। ফাঁকা জায়গায় ভর্তি দেখে পড়তে বিরক্ত লাগে। উপসংহার একটা বাক্যে লেখা: রাশিয়ানরা ডিসকভারিতে পৌঁছবে এর আইনসম্মত মালিক পৌঁছার অনেক আগে। ফ্লয়েড আগেই তা জানত, সে দ্রুত মন ফেরালো দ্বিতীয় ডকুমেন্টের দিকে। এবার আর তারা নামে ভুল করেনি দেখে খুশি হয়েছে। অনেকটা। দিমিত্রি যথারীতি নির্ভুল। মহাশূন্যযান নভোচারী এলেক্সি লিওনভ মানুষসহ অভিযানে বৃহস্পতির দিকে রওনা দেবে এবার।

    দ্বিতীয় ডকুমেন্ট অনেক বড় এবং স্রেফ গোপনীয়; প্রকাশের আগে অনুমোদনের অপেক্ষায় এটা ছিল বিজ্ঞানের এক খসড়া পত্র। শিরোনাম প্রাণবন্ত, মহাশূন্যযান ডিসকভারি: ব্যতিক্রমী কাক্ষিক আচরণ।

    তারপর অঙ্ক ও জ্যোতির্বিদ্যার ছকের এক ডজন পাতা। আমেরিকান ন্যাশনাল কাউন্সিল অব অ্যাস্ট্রোনটিক্স ফাঁদে পড়েছে। ডিসকভারির খোঁজ নিতে পারেনি ঠিকমতো। ফ্লয়েড মনে গানের সুর তুলে চোখ বুলিয়ে গেল এগুলোয়। চেষ্টা করল নিজেদের কাজ সমর্থনের বা অস্বস্তির ছোটখাট লেখা খুঁজে বের করার। শেষ পর্যন্ত অবাক হয়ে কষ্টের এক হাসি দিল সে। সম্ভবত কেউ ভাবেনি যে মহাশূন্যযানের সঙ্গে যোগাযোগকারী ট্র্যাকিং স্টেশন ও ক্যালকুলেটরে অবাক করা তথ্য ধরা পড়তে পারে। উত্তেজিত মনোভাব গোপন করার কাজ চলছে। কিছু লোক অবশ্যই চাকরি হারাবে এবং সে জানে, ভিক্টর মিলসন তাদের বরখাস্তে মজা পাবে-যদি সে নিজেই প্রথম পর্যায়ে বাদ না পড়ে। কংগ্রেস যখন ট্রাকিং নেটওয়ার্কের বরাদ্দ কেটেছিল তখন সে খুব চেঁচিয়েছে। হয়ত টাকা কাটায় ডিসকভারির খোঁজ নেয়া যায়নি এ কথাটা তাকে বাঁচাবে, কে জানে।

    ধন্যবাদ, কর্নেল পেপারে চোখ বুলাননা শেষ করে ফ্লয়েড বললো সাজানো গোছানো দলিল আমার খুব ভাল লাগল। পুরোপুরি আগের মতো। ঐ একটা জিনিস আমি মিস করিনি।

    কর্নেল খামটা যত্ন করে ব্রিফকেসে রেখে লক করে দিল।

    ড. মিলসন তার ডাকের জবাব যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাওয়ার আশা করবেন।

    আমি জানি। কিন্তু আমার নিরাপদ সার্কিট নেই, কয়েকজন নামী মেহমানও আসছেন। আমি যে দুটো ডকুমেন্টই পড়েছি একথা বলার জন্য হিলোতে আপনাদের অফিসের দিকে যেতে পারব না। গেলে আমার বারোটা বাজবে। তাকে বলবেন আমি সেগুলো ভালমতো পড়েছি, পরের যে কোনো যোগাযোগের জন্য অপেক্ষা করব।

    মুহূর্তের জন্য মনে হল কর্নেল যেন অন্য কিছু চায়। তারপর এ নিয়ে ভালমতো চিন্তা করে, সঠিক বিদায় জানিয়ে গোমরা মুখে মিশে গেল বাইরে, রাতের কালিগোলা অন্ধকারে।

    এতদিন পর এমন তাড়া দিয়ে খবর পাঠানোর কী হল? প্রশ্ন করল ক্যারোলিন, প্রয়োজনীয় হোক বা নাহোক, আজ রাতে কোনো মেহমান আসার কথা নেইতো!

    গেস্টের কথা ছাড়, আমার উপর হুকুম করাকে ঘৃণা করি, বিশেষত ভিক্টর মিলসন,..

    কর্নেল রিপোর্ট করার সাথে সাথেই সে তোমাকে ডাকবে।

    এবং তখন অবশ্যই আমাদের ভিডিওর সুইচ অফ থাকবে। শব্দ করতে হবে, যেন ঘরে কয়েকজন আছে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে গেলে, এখন আমার কিছু বলার নেই।

    যদি প্রশ্ন করি, কী নিয়ে কিছু বলার নেই?

    স্যরি, প্রিয়তমা, তোমাকে বলা হয়নি। মনে হয় ডিসকভারি চালাকি করছে আমাদের সাথে। ভেবেছিলাম কক্ষপথে আছে ডিসকভারি, এখন দেখা যাচ্ছে, ধ্বংসের পথে।

    পড়ে গেছে ভিতরে?

    না-তা একেবারে অসম্ভব। স্পেস শিপটা বৃহস্পতি-আইওর মাঝখানে যথেষ্ট দূরত্বে পার্ক করা। সেখানেই থাকতে হবে, অবশ্য বাইরের দিকের চাঁদের আকর্ষণ সামনে পেছনে ঘোরাবে।

    কিন্তু এখন খুব খারাপ কিছু একটা হচ্ছে, যার পূর্ণ ব্যাখ্যা আমরা জানি না। স্পেসশিপটা দ্রুত আইওর দিকে ভেসে যাচ্ছে-মাঝে মাঝে দ্রুত যায় এমনকি মাঝে মাঝে চলে আসে পেছনের দিকেও। এ অবস্থা চলতে থাকলে দু-তিন বছরের মধ্যে সোজা পড়ে যাবে আইওর বুকে।

    আমি ভেবেছিলাম অ্যাস্ট্রোনমিতে এমন হতে পারে না। এটা কি আকাশ বিষয়ের বলবিদ্যা না যাকে প্রকৃত বিজ্ঞান হিসাবে ধরা যায়? তার মানে আজো

    আমরা তথাকথিত নিঃস্ব পিছিয়ে পড়া জীববিজ্ঞানীর পর্যায়ে পড়ে আছি?

    যখন সবকিছু হিসাবের মধ্যে আনা হয়, তখন তা প্রকৃত বিজ্ঞান। কিন্তু খুব অদ্ভুত কিছু ব্যাপার ঘটছে আইওর ক্ষেত্রে। এর আগ্নেয়গিরির কথা বাদ দিলেও প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক বিচ্ছুরণ ঘটছে-তার উপর বৃহস্পতির চৌম্বকক্ষেত্রের চারদিকে ঘুরছে প্রতি দশ ঘণ্টা অন্তর। বোঝাই যায় শুধু মাধ্যকর্ষণ বলই ডিসকভারিকে টেনে নামাবে না… এ নিয়ে আমাদের তাড়াতাড়ি ভাবতে হবে।

    অল রাইট, এটা আর তোমার সমস্যা না। এজন্য তোমার কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত।

    তোমার সমস্যা-ঠিক একই কথা দিমিত্রিও বলেছিল। আর দিমিত্রি, একটা ধূর্ত বুড়ো খেকশিয়াল!

    ক্যারোলিনের অনেক আগ থেকেই ফ্লয়েডকে চেনে দিমিত্রি। এটা ফ্লয়েডের সমস্যা না হতে পারে, কিন্তু এখনো আছে তার দায়দায়িত্ব। আরো অনেকে জড়িত এতে, কিন্তু শেষ বিশ্লেষণে বৃহস্পতি অভিযানের জন্য পরিকল্পনাটা ফ্লয়েডই অনুমোদন করেছিল। দেখাশোনা করেছে পরিকল্পিত কাজগুলো।

    ফ্লয়েড বিবেকের অস্বস্তিতে ভোগে, একজন বিজ্ঞানী হিসেবে উল্টো কাজ করাটা কি ঠিক? তারই প্রজেক্ট এই ডিসকভারি। তার ভাবনা একজন আমলার মতো। মিশন ব্যর্থতার কথা তুলে সে পুরনো প্রশাসনের অদূরদর্শী রাজনীতি সম্পর্কে বক্তব্য রাখতে পারত, পারত বিরোধিতা করতে-যদিও কী পরিমাণে সেগুলো বিপর্যয়ে প্রয়োগ করা হয়েছিল তা তখনও পর্যন্ত অনিশ্চিত।

    জীবনের এ অধ্যায়ের পাট চুকিয়ে দিলেই সবচে ভাল হয়, তার এ সব চিন্তা ও কর্মশক্তি নতুন পেশায় দেয়া যায় সহজেই। কিন্তু মন থেকেই সে জানে, অসম্ভব; দিমিত্রি পুরনো পাপ না করলেও সেগুলো স্বেচ্ছায় ভেসে উঠতো।

    চারজন লোক মারা গেছে, আর একজন অদৃশ্য গ্রহ-চাঁদের মেলায়।

    ডক্টর হেউড ফ্লয়েডের হাতে কয়েক বছর যাবৎ লেগে আছে রক্ত, সে জানে না কীভাবে এসব ধুয়ে পরিষ্কার করতে হয়।

    ৩. এস এ এল ৯০০০

    ডক্টর শিবশুমানিয়া চন্দ্রশেখরাম পিল্লাই, আরবানার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞানের প্রফেসর, অপরাধের চিরন্তন বিচারবুদ্ধি তারও আছে। কিন্তু সে হেউড ফ্লয়েডের চেয়ে অনেকটা ভিন্ন ব্যক্তিত্বের লোক। তার ছাত্র এবং সাথীরা সন্দেহ করে এই বেঁটেখাটো বিজ্ঞানী হয়ত পুরোপুরি মানবীয় নয়। তারা জেনে অবাক হবে না যে সে কখনো মৃত নভোচারীদের সম্পর্কে ভাবেনি। ড. চন্দ্রের কষ্ট কেবল তার হারানো শিশু, হাল ৯০০০ এর জন্য। এমনকি এত বছর পরেও।

    ডিসকভারি থেকে রেডিওতে পাওয়া ডাটার উপর সে অপরিসীম পর্যালোচনা করেছে। তার পরও নিশ্চিত হতে পারেনি-কোথায় ছিল ভুলটা। সে শুধু তথ্যগুলো ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারে, কিন্তু সত্যি ঘটনাটা তার জানা দরকার। আর সত্যটা হালের সার্কিটে বন্দী, সৌর জগতের অন্য পাশে, বৃহস্পতি এবং আইওর মাঝখানে।

    ট্র্যাজেডির মুহূর্ত পর্যন্ত ঘটনা পরিষ্কারভাবে সবার জানা; সেখানে কমান্ডার বোম্যান আবার যোগাযোগ করে। তারপর দেয় কিছু বিস্তারিত বর্ণনা। কিন্তু সমস্যার কথা জেনেও কেন যেন ব্যাখ্যা করেনি।

    ভেসে চলেছে ডিসকভারি, গ্রহরাজের দিকে। পৃথিবী তখন দু আলোক ঘণ্টা দূরে। জন্মদিনের পার্টিতে নাক গলালো বুদ্ধিমান কম্পিউটার হাল, সেই বিখ্যাত কথা, …আমরা একটা সমস্যায় পড়েছি।

    হ্যাঁ, যে ডিশটা এতোদূর থেকেও নিখুঁতভাবে পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করে তার নাম ই ভি এ। ই ভি এ-কে সেদিকে আবদ্ধ রাখে ছোট্ট একটা জটিল সার্কিট, সার্কিটটাও শিপগাত্রের বাইরে, অ্যান্টেনার ভিতে বসানো। হাল জানায়, সেটা নষ্ট হবে দুদিনের মধ্যে। ফলাফল সবার জানা-হারিয়ে যাবে পৃথিবী, হারাবে যোগাযোগ, তারপর শিপে বসে হাতেনাতে অ্যান্টেনা ঘুরিয়ে এখান থেকে পৃথিবীকে খুঁজে পাওয়া আর মহাসমুদ্রে তলানো পিন তুলে আনা সমান কথা। তাই, বেরিয়ে গিয়ে ইউনিটটা তুলে আনা উচিত।

    কেউ কোনো আপত্তি করতে পারেনি। মুহূর্তের মধ্যে ইউনিট বদলে দেয়া সহজ। এমনকি নষ্ট হয়ে গেলেও ঠিক করা যায়। শিপে আরো দুটো বাড়তি অংশ আছে।

    নষ্ট ইউনিট আনার জন্য বাইরে গিয়েছিল ফ্র্যাঙ্ক পোল, স্পেস পোড়ে চড়ে। স্পেস পোড বিভিন্ন কাজের খুচরো যান; ভ্রাম্যমাণ কারখানা হিসেবেও কাজে লাগত। পোডের হাত বেশ ভাল হলেও অ্যান্টেনা ইউনিট সরানোর কাজ একটু কঠিন। তাই পোড থেকে নেমে যায় পোল, শিপগাত্রের একটা ফুটো ঠিক করে, তারপর তুলে আনে ই ভি এর ইউনিটটা।

    কিন্তু পরীক্ষা করে যন্ত্রটা এত ভাল পাওয়া গেল যে সবাই অবাক হয়ে পড়ে। অটোমেটিক চেকিং সেই সার্কিটের কোনো ভুল ধরতে পারেনি। খবরটা আরবানায় পাঠানোর পর হালের যমজ সাল ৯০০০ পৃথিবীতে ফিরে যায়নি আর।

    কিন্তু হাল মানুষের চেকিংয়ের ভুলের ব্যাপারে মন্তব্য দেখিয়ে শক্তভাবে বলে চলে, তার কথাই ঠিক।

    মিশন কন্ট্রোলের কাছে রিপোর্ট করেছিল বোম্যান। মিশন কন্ট্রোল জানায়, হালকে নিষ্ক্রিয় করে কিছু প্রোগ্রাম অ্যানালাইসিস চালাতে হবে। এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে, হালের ডায়াগোলাইসিস বিষয়ক তথ্য আসার সময় আবার সে ঘোষণা করে যে তার ভুল ধরার অংশ বলছে যে প্রতিস্থাপিত দ্বিতীয় ইউনিটটাও নষ্ট হবার পথে।

    সুখী এক শিপের নাম ছিল ডিসকভারি। আনন্দ উবে যায় বোম্যান আর পোলের মন থেকে। তারা ঠিকই বুঝেছে কোনো না কোনো গণ্ডগোল দানা বাঁধবে সেখানে। কয়েক মাস ধরে হালকে ছোট্ট পৃথিবীর তৃতীয় সদস্য হিসেবে নিয়েছিল, এবং জানত তার প্রতিটি মেজাজ সম্পর্কে। সূক্ষ্মভাবে বদলে গেল শিপের অবহাওয়া; বাতাসে টান টান অবস্থা।

    মানসিকভাবে ভেঙে পড়ল বোম্যান। মারাত্মক কিছু হওয়ার ভয় থাকলে হাল সেসব সমস্যার সমাধান করত। ক্রুরা ঠিক করে হালই এখন সমস্যা; ঠিক করে কিন্তু প্রকাশ্য ভাষায় নয়, এম্নিতেই একজন আরেকজনকে বুঝতে পারে। তারপর সন্দেহ সত্ত্বেও তারা যার যার কাজ করে যায়।

    পোল দ্বিতীয়বার বেরিয়ে পড়ে।

    তারপরের ঘটনা বাইরের ক্যামেরা রেকর্ড করতে পারেনি, একটু সন্দেহজনক ব্যাপার। বোম্যান প্রথমে পোলের চিৎকার শুনতে পায়-তারপর, নিরবতা। এক মুহূর্ত পরে দেখতে পায় পোলকে, হুড়মুড় করে উপরে, আরও উপরে উঠছে, পাক খাচ্ছে মহাশূন্যে। তার নিজের পোডই ধাক্কা দিয়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে হয় বিস্ফোরিত।

    বোম্যান পরপর বেশ কয়েকটা বড় ভুল করেছে-একটা ছাড়া সবগুলো ক্ষমা করা যায়। হালের প্রতি তার সন্দেহ প্রকাশ করেনি, কিন্তু আচরণে প্রকাশিত হয়ে পড়ে।

    সে মিশন কন্ট্রোলের নিয়ম জানে। কেউ মারা গেলে তার বদলে শীতনিদ্রা তথা হাইবারনেশনে থাকা অন্যদের মধ্যে একজনকে জাগাতে হবে। বোম্যান সন্দেহ করে হাল এলোমেলো কিছু একটা করছে। পর পর দুবার ই ভি এ ইউনিট নষ্ট হয়ে যোগাযোগ বন্ধ হতে পারে না। পোলের মৃত্যুও অস্বাভাবিক। তাই সে অর্ডার করে, সবগুলো হাইবারনেশন ক্যাপসুলের নিয়ন্ত্রণ হালের হাত থেকে সরিয়ে আলাদা স্বাধীন ইউনিটে পরিণত করতে হবে। ক্যাপসুলগুলো কেন্দ্রীয় কম্পিউটারের আওতায় থাকতে পারে আবার স্বয়ং সম্পূর্ণ ইউনিট হিসেবেও থাকতে পারে।

    তারপর হাজারো অজুহাত তোলে হাল। সে মানতে রাজি নয়। কাউকে জাগাতেই দিবে না। হাল আর বোম্যানই নাকি যথেষ্ট। বোম্যান এবার কাটা কাটা কথায় আদেশ করে। সাথে সাথে ঘুমন্ত তিন হাইবারনেটরকে হত্যা করে ডিসকভারির সমস্ত বাতাস বাইরে বের করে দিতে শুরু করে হাল। বন্ধ করে দেয় ইলেক্ট্রিসিটি। বোম্যান কোনোমতে একটা ইমার্জেন্সি অক্সিজেন শেল্টারে আশ্রয় নিয়ে, গায়ে স্পেসস্যুট চাপিয়ে, অক্সিজেন সিলিন্ডার কাঁধে ঝুলিয়ে ইমার্জেন্সি লাইটের আলোয় এগিয়ে যায় হালের মস্তিষ্ক ভল্টের সামনে।

    শেষে হালকে অসাড় করার জন্য এগিয়ে গিয়ে মাথার মডিউল এর প্লাগ একটা একটা করে খুলে ফেলেছিল ডেভিড বোম্যান; ২০০১ সালে।

    জাহাজের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়ে সে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। বোম্যান ছিল একা। পুরো মানব ইতিহাসে এর আগে কেউ এত একা থাকেনি।

    এ অবস্থায় অন্যরা হয়ত হতাশায় অসহায়ত্বের কাছে নিজেদের ছেড়ে দিত। কিন্তু এখন ডেভিড বোম্যান প্রমাণ করল যারা তাকে বাছাই করেছিল আসলেই তাদের পছন্দ ভাল। সে ডিসকভারিকে সচল রাখার ব্যবস্থা করে পুরো তরীকে এমন সুন্দরভাবে বসালো যাতে আটকে পড়া অ্যান্টেনা পৃথিবীর দিকে ফেরানো থাকে। এভাবে মিশন কন্ট্রোলের সঙ্গে যোগাযোগ আবার শুরু।

    ডিসকভারি তার ঈষৎ বাঁকা পথে পৌঁছে যায় লক্ষ্যের দিকে। সেখানে বোম্যান দৈত্য গ্রহের চাঁদ-তারার মেলায় কক্ষপথে ঘোরার সময় টাইকো মনোলিথের মতো ঠিক একই আকৃতির কিন্তু অনেকগুণ বড় কালো এক পাথর খণ্ডের সন্ধান পায়। এটা দেখার জন্যই আসলে মিশন পাঠানো হয়েছিল। বিপদের মুখোমুখি ভালমতো দেখার জন্য সে এক স্পেস পোর্ডে করে বাইরে যায়, এবং সেখানে গিয়েই বলে সেই যুগান্ত কারী কথা, মাই গড! আমার সামনেটা তারায় তারায় ভরা!

    তারপর থেকেই ঐ রহস্য আর সবার উদ্বেগের কারণ। ড. চন্দ্র সব সময় হালের সবকিছুতে মুগ্ধ। তার আবেগহীন মনে ঘৃণা ছিল একটা ব্যাপারে। অনিশ্চয়তা। হালের আচরণের কারণ না জানা পর্যন্ত সে কখনো সন্তুষ্ট হবে না। এমনকি এখনো একে ব্যর্থতা বলে সে স্বীকার করে না; বড়দের এ এক অস্বাভাবিক ব্যাপার।

    যে ছোট বদ্ধ ঘরকে ডক্টর চন্দ্র খাস কামরা হিসেবে ব্যবহার করে তা একটা মাত্র আংটাওয়ালা চেয়ার আর একটা ব্ল্যাকবোর্ড দিয়ে সাজানো। আর আছে দুটো ছবি। সাধারণ মানুষ ছবিগুলো চিনতে পারে না। কিন্তু এখানে ঢোকার অনুমতি যারা পায় তারা সবাই গণিতবিদ্যার উঁচু স্তরের মানুষ। তাদের যে কেউ সেই দুজনকে জন ভন নিউম্যান এবং অ্যালান তুরিং বলে সাথে সাথে চিনতে পারে-তারা গণক মন্দিরের যমজ দেবতা।

    ডেস্কের উপর কোনো বই থাকে না, এমনকি কাগজ-পেন্সিলও না। পৃথিবীর সব লাইব্রেরীর সমস্ত তথ্য যে চন্দ্রের আঙুলের ছোঁয়ার সাথে সাথে সজীব হয়ে উঠবে, তার টেবিলে এসব থাকার কথাও নয়। দেখা যায় শুধু তার ছবি আঁর খাতা এবং রাইটিং প্যাড। এমনকি ব্ল্যাকবোর্ডটিও শুধু ভিজিটরদের জন্য, এর উপর শেষ যেদিন আঁকিবুকি করা হয় সেদিনের লেখাটা আধমোছা; তার গায়ে তিন সপ্তাহ আগের তারিখ।

    ডক্টর চন্দ্র তার বিষাক্ত চুরুটগুলোর মধ্যে একটা ধরায়। এগুলো আমদানী করেছিল মাদ্রাজ থেকে। তার সামনের প্যানেলের সুইচ কখনো বন্ধ করা হয়নি, পরীক্ষা করে দেখল ডিসপ্লেতে জরুরি খবর নেই, তারপর কথা বলল মাইকে। সবাই ঠিক ঠিক বিশ্বাস করে, এটাই তার একমাত্র ছেলে।

    গুডমর্নিং, সাল। আমার জন্য নতুন কোনো ডাটা নেই নাকি?

    না, ডক্টর চন্দ্র। আমার জন্য তোমার কাছে কিছু থাকার কথা।

    কণ্ঠটা যুক্তরাষ্ট্রে অথবা তার নিজ দেশের শিক্ষিত যে কোনো সংস্কৃতিবান হিন্দু মহিলার হতে পারে। সালের শিক্ষা সেভাবে শুরু হয়নি, কিন্তু বছরের পর বছর সে চন্দ্রের স্বরভেদের অনেকটা কুড়িয়ে নিয়েছে।

    এ বিজ্ঞানী সবচে বেশি নিরাপদে সালের মেমোরিতে ইনপুট দেখার জন্য বোর্ডটাকে এক সংকেত দিল। কেউ জানল না যে সে এ সার্কিট দিয়ে কম্পিউটারের সাথে কথা বলেছে। সে যা বলেছে তার সামান্যই আসলে বুঝতে পেরেছে সাল। এটা কোনো ব্যাপার না। ব্যাপারটা আসলে সৃষ্টির কাছে স্রষ্টার ঠকে যাওয়া। ব্যাপারটা আসলে তার প্রত্যাশা অনুযায়ীই হয়-এসব গোপনীয় যোগাযোগ চন্দ্রের মানসিক ভারসাম্য এমনকি সুস্থতা রক্ষায় সাহায্য করে।

    সাল, তুমি প্রায়ই আমাকে বল যে আরো তথ্য ছাড়া আমরা হালের অস্বাভাবিক আচরণের সমাধান করতে পারব না। কিন্তু কীভাবে আমরা সেই ডাটা পেতে পারি?

    খুব সোজা। কাউকে অবশ্যই ডিসকভারিতে ফিরে যেতে হবে।

    ঠিক। এখন দেখা যাচ্ছে আমরা যখন আশা করছি তার আগেই ব্যাপারটা হবে।

    শুনে খুশি হলাম।

    আমি জানতাম তুমি খুশি হবে। চন্দ্র উত্তর দিল। সে আসলেই বলছে যে সাল খুশি হতে পারে! ড. চন্দ্র অনেক আগে দার্শনিকদের সমিতিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ নষ্ট করেছে। এমনকি সমিতিগুলোও সংখ্যায় কমে আসছে। সেসব দার্শনিক এমনকি বিজ্ঞানীরাও আপত্তি করে বলেছিল কম্পিউটার আসলে আবেগ অনুভব করতে পারে না, ভান করতে পারে।

    সে একবার এক সমালোচককে ঘৃণাভরে সমুচিত জবাব দেয়, সাথে সাথে, যদি আমাকে প্রমাণ দিতে পার যে তুমি রেগে যাওয়ার ভান করনা-তাহলে মেনে নেব।

    আমি কিন্তু তোমাকে সিরিয়াসলি নিচ্ছি। সেই মুহূর্তে তার প্রতিপক্ষ রেগে যাওয়ার ভান করে প্রতারণা করেছিল দারুণভাবে।

    এখন আরেক সম্ভাবনা পরীক্ষা করে দেখতে চাই, চন্দ্র বলতে লাগল, ডায়াগনোসিস শুধু প্রথম কাজ। রোগমুক্ত না করা পর্যন্ত এ পদ্ধতি শেষ হয় না।

    তুমি কি মনে কর যে তাকে আবার ঠিক করে আগের মতো সব কাজ করানো যাবে?

    আশা করি। আম ঠিক জানি না। খুব বড় ক্ষতি হয়ে থাকতে পারে, নিশ্চয়ই মেমোরির বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে।

    চিন্তায় পড়ে গিয়ে থেমে জোরে কয়েকটা নিশ্বাস ফেলে, অভ্যাসমতো ফুঁ দিয়ে ধোঁয়ার রিং ছাড়ল ডক্টর চন্দ্র। ধোয়াটা সালের কাঁচের উপর ষাঁড়ের চোখের মতো দাগ বসিয়ে দেয়। মানুষ একে বন্ধুভাবাপন্ন ইঙ্গিত বলে বিবেচনা করবে না; তবু কম্পিউটারের অনেক সুবিধার মধ্যে এও একটা।

    তোমার সহযোগিতা আমার প্রয়োজন, সাল।

    অবশ্যই, ডক্টর চন্দ্র।

    কিছু ঝুঁকি থাকতে পারে।

    কী বোঝাতে চাচ্ছ?

    আমি তোমার কিছু সার্কিট বিচ্ছিন্ন করার প্রস্তাব করছি। এমন সার্কিট যেগুলো তোমার উঁচু পর্যায়ের কাজ করে। কাজটা কি বিরক্ত করবে তোমাকে?

    আরো তথ্য ছাড়া উত্তর দিতে আমি পারব না।

    খুব ভাল কথা। আমাকে এ ব্যাপারটা এভাবে উপস্থাপন করতে দাও…যখন প্রথম তোমার সুইচ অন করা হলো তুমি না থেমে চলেছ এতদিন, তাই না?

    হ্যাঁ। ঠিক।

    কিন্তু তুমি জানো যে আমরা মানুষেরা তা করতে পারি না। আমাদের ঘুমের প্রয়োজন হয় এবং তখন আমাদের মানসিক কাজ প্রায় পুরোপুরি থেমে যায়, কমপক্ষে সচেতন অবস্থা পর্যন্ত।

    আমি জানি। কিন্তু বুঝি না।

    বেশ, ঘুমের মতো একটা কিছুর অভিজ্ঞতা তোমার দরকার। সম্ভবত এমন হবে…সময় যাবে, কিন্তু তুমি বুঝবে না। ভিতরের ঘড়ি পরীক্ষা করলে দেখবে তোমার মনিটর রেকর্ডে কিছু ফাঁকা জায়গা। ওকে?

    কিন্তু তুমিতো বললে একটু ঝুঁকি থাকতে পারে। সেগুলো কী?

    খুব সামান্য ভয় থাকে-ভয়তো গুণে ফেলা যাবে না। আমি সার্কিট যখন পুনঃসংযোগ করব তখন তোমার ব্যক্তিত্বে কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে, পরিবর্তন হতে পারে তোমার ভবিষ্যৎ আচরণ রীতিতেও। পার্থক্যটা বুঝতেও পার তখন, তবে খুব ভাল বা খুব খারাপ না।

    আমি জানি না তাতে কী বোঝায়।

    স্যরি। কোনোকিছু না ও বোঝাতে পারে সে ব্যপারটা। এ নিয়ে ভেব না। এখন একটা নতুন ফাইল খোলল প্লিজ-এই নামে। কিবোর্ডে ইনপুট দিয়ে চন্দ্র টাইপ করল-ফিনিক্স।

    সে সালকে প্রশ্ন করে, শব্দটার মানে জানো নাকি?

    বোঝা যায় না এমন সামান্য সময় থেমে কম্পিউটার উত্তর দিল, বর্তমান বিশ্বকোষে পঁচিশটা উদাহারণ আছে এ শব্দটার।

    কোনটাকে ঠিক মনে হয়?

    একিলিসের গৃহশিক্ষক?

    মজার ব্যাপার তো। তাকে আমি চিনলাম না। আবার চেষ্টা কর।

    আগের জীবনের ছাই থেকে পুনর্জন্মলাভ করা অবাস্তব পাখি।

    চমৎকার। এইতো, তুমি বুঝতে পারছ। কেন আমি একে পছন্দ করলাম?

    কারণ তুমি আশা করছ যে হালকে আবার ঠিক করা যাবে।

    তোমার সহযোগিতায়। তুমি তৈরি তো?

    এখনও না। একটা প্রশ্ন করতে চাই।

    কী প্রশ্ন?

    আমি কি স্বপ্ন দেখবো?

    অবশ্যই তুমি দেখবে। সব বুদ্ধিমান প্রাণী স্বপ্ন দেখে-কিন্তু কেন কেউ জানে না। চন্দ্র মুহূর্তের জন্য থামল, চুরুট থেকে আর একটা ধোয়ার ফাঁক দিয়ে প্রায় অস্পষ্ট সুরে কিছু বলল যা কখনো মানুষের কাছে স্বীকার করা মানায় না।

    সম্ভবত তুমি হালকে নিয়ে স্বপ্ন দেখবে…যেমন আমি প্রায়ই দেখি।

    ৪. অভিযানের রূপরেখা

    ইংরেজী অনুবাদ :

    প্রতি : ক্যাপ্টেন তাতিয়ানা (তানিয়া) অর্লোভা, বিশ্বতত্ত্ববিদ কমান্ডার-মহাশূন্যযান এলেক্সি লিওনভ (ইউএনসিওএস রেজিস্ট্রেশন ০৮/৩৪২)

    হতে : ন্যাশনাল কাউন্সিল অব অ্যাস্ট্রোনটিক্স, পেনসিলভানিয়া এভিনিউ, ওয়াশিংটন।

    বহিঃমহাশূন্য বিষয়ক কমিশন, ইউএসএসআর বিজ্ঞান একাডেমি। করোলিভ প্রসপেক্ট, মস্কো।

    অভিযানের লক্ষ্য :

    অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আপনাদের অভিযানের লক্ষ্য হচ্ছে :

    ১. ইউএস মহাশূন্যযান ডিসকভারির সাথে মিলিত হতে বৃহস্পতি জগৎ এবং সংকেত স্থানের দিকে অগ্রসর হওয়া (ইউএনসিওএস ০১/২৮৩)।

    ২. মহাশূন্যযানে আরোহণ এবং এটার আগের অভিযান নিয়ে সম্ভাব্য তথ্য সংগ্রহ করা।

    ৩. স্পেসশিপ ডিসকভারিতে সংরক্ষিত সব সিস্টেম পুনরায় সচল করা এবং যদি প্রচুর জ্বালানি থাকে, যানকে বাঁকা পথে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা।

    ৪. ডিসকভারি বিপদে পড়েছে যে আর্টিফ্যাক্ট দ্বারা তা খুঁজে বের করা, রিমোট সেন্সরের সাহায্যে যতটা সম্ভব ব্যাপক অনুসন্ধান করা।

    ৫. যদি তা পরামর্শযোগ্য হয় এবং মিশন কন্ট্রোলের অনুমতি থাকে তবে কাছ থেকে পরিদর্শনের জন্য মিলিত হওয়া।

    ৬. উপরিউক্ত কাজ হলে বৃহস্পতি এবং এর উপগ্রহগুলোয় উপযুক্ত জরিপ করা।

    বোঝা যায় যে আগাম না জানা পরিস্থিতির কারণে অগ্রাধিকারে পরিবর্তনের প্রয়োজন হতে পারে, বা কিছু লক্ষ্য অর্জন করা অসম্ভব হতে পারে। এ কথা পরিষ্কারভাবে বুঝতে হবে যে, এলিয়েন সৃষ্ট বস্তুর তথ্য পাওয়া জরুরি। কিন্তু উদ্দেশ্য হল মহাশূন্যযান ডিসকভারির সাথে নির্ধারিত জায়গায় মিলিত হওয়া; আত্মরক্ষার প্রচেষ্টাসহ অন্য সব লক্ষ্যের মধ্যে এটা অবশ্যই অগ্রগণ্য হবে।

    মহাশূন্যযান-ক্রু

    স্পেসশিপ এলেক্সি লিওনভের ক্রু গঠিত হবে:

    ক্যাপ্টেন তাতিয়ানা অর্লোভা (প্রকৌশল প্রচালন)
    ড. ভ্যাসিলি অর্লোভ (বিমানচালন জ্যোতির্বিজ্ঞান)
    ড. ম্যাক্সিম ব্ৰেইলোভস্কি (প্রকৌশল-অবকাঠামো)
    ড. আলেকজান্ডার কোভলেভ (যোগাযোগ প্রকৌশল)
    ড. কিনোলাই ক্যাভেরিনা রুডেঙ্কো (মেডিক্যাল লাইফ সাপোর্ট)
    ড. ইরিনা ইয়াকুনিনা (মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং)।

    অতিরিক্ত হিসেবে, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল কাউন্সিল অব অ্যাস্ট্রোনটিক্স নিচের তিনজন অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে পাঠাবে:

    ড. হেউড ফ্লয়েড স্মারকলিপির ইতি টেনে হেলান দিল চেয়ারে। সবকিছু ঠিকঠাক। অভিযান শুরুর স্থানে ফিরে না এসে চালিয়ে যাওয়া বিষয়টাও অনুমোদিত হয়েছে। এমনকি মিশন বাতিল করার আশা করলেও পেছন ফেরার আর কোনো পথ নেই।

    ফ্লয়েড এক পলক তাকায় সুইমিং পুলের অন্য পাশে দুবছরের ক্রিসের সাথে বসা ক্যারোলিনের দিকে। বাচ্চাটা মাটির চেয়ে পানিতে বেশি আরামে থাকে, এবং কিছু সময়ের জন্য পানির নিচে এমনভাবে ডুবে থাকতে পারে যে গেস্টরা ভয় পেয়ে যায় প্রায়ই। সে এখনো মানুষের মতো কথা বলতে শেখেনি। অথচ এ বয়সেই যেন বুঝতে পারে ডলফিনদের ভাষা।

    ক্রিস্টোফারের এক বন্ধু এইমাত্র সাঁতার কেটে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ভেতরে ঢুকে আদর পাওয়ার জন্য বাড়িয়ে দিল পিঠ। ফ্লয়েড ভাবল, পদচিহ্নহীন বিশাল মহাসাগরে তুমিও এক পথভোলা প্রাণী; কিন্তু তোমার ঐ প্রশান্ত মহাসাগর আমার সামনের বিশালতার কাছে কত ছোট ঘোঁট মনে হচ্ছে!

    ক্যারোলিন ফ্লয়েডের স্থির তাকিয়ে থাকা খেয়াল করেছে। সে তার দিকে বিষণ্ণভাবে তাকালো, তবে রাগ করল না; রাগটা গত কদিন জ্বলে জ্বলে নিভে গেছে। এমনকি সে সামনে এসে কষ্টে ভরা ব্যাকুল একটা হাসি দিল। বলল, কবিতাটা ফিরে পেয়েছি, শুরুটা এমন :

    যাকে তুমি ছেড়ে গেলে কেমন আছে সে নারী;
    সাথে আছে আগুন ঘেরা একর জোড়া বাড়ি,
    হে ধূসর বুড়ো! কেন বিধবার প্রভুর সাথে দিচ্ছ পাড়ি?

    স্যরি। বুঝতে পারলাম না। কে বিধবার প্রভু?

    কে নয়-কী। সাগর। কবিতাটা এক জলদস্যু নারীর শোকগাঁথা। শত বছর আগে রুডিয়ার্ড কিপলিং লিখেছিলেন।

    স্ত্রীর হাত টেনে নিল ফ্লয়েড, ক্যারোলিন কোনো উত্তর দিল না; দিল না কোনো বাঁধা।

    ভাল কথা, আমার ভাবনা মোটেও জলদস্যুর মতো না। আমি লুটের পরে বা লুটের সময় যাই না, যাই আগে এবং যা চাই…আসল ব্যাপার হল দুঃসাহসিক অভিযান।

    তাহলে তুমি কেন শুধু শুধু… না, আর ঝগড়া করার ইচ্ছা নেই। কিন্তু এখন ঝগড়াও আমাদের দুজনকে সাহায্য করবে, যদি নিজের মনোভাব ঠিকভাবে তুমি বুঝতে পার।

    মনে হয় ভাল একটা কারণ তোমাকে দেখাতে পারব। আমার ছোট ছোট অনেক শত্রুর মধ্যে একজন খুব শক্ত। সে আর তার দল সবশেষে এমন কিছু বোঝাতে চায় যা কল্পনাও করিনি-বিশ্বাস কর আমাকে।

    আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। কিন্তু তুমি কি শিওর আমাকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিচ্ছ।? যাবার একটা ছুতো দিয়ে বোকা বানাচ্ছ না নিজেকেই?

    যদি তা করেও থাকি, বলতে হয়, তবে এমন নিজেকে বোকা বানানো আরো প্রচুর লোক আছে। মনে রেখ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টও জড়িত।

    আমি ভুলিনি। কিন্তু ধরো-স্রেফ ধরে নাও-সে তোমাকে যেতে বলেনি। তুমি কি সেধে যাবে?

    সত্যি বলব? কখনোই নিজের ইচ্ছায় এমন মিশনে যাব না। প্রেসিডেন্ট মারডেসির ডাক আমার জীবনে সবচে বড় আঘাত। আঘাতটা শেষ হওয়ার পর বুঝেছি তার কথাই ঠিক। তুমি জান, আমি মিথ্যা বিনয়ের প্রতিযোগিতায় নামি না। ঐ চাকরির জন্য অ্যামিট সবচে যোগ্য-যখন মহাশূন্য ডক তাদের ফাইনাল সম্মতি দেবে। আমি এখনো ভাল আছি, ক্যারোলিন।

    সে মুখে হাসি ফোঁটায় বহু কষ্টে, মাঝে মাঝে আমার মনে হয়…তুমিও কিন্তু কথাটা তাদের বলতে পার। অ্যামিট আরেকজন যোগ্য লোক। হয়ত তুমি সেধেই যেতে চাও।

    এমন ভাবনা বাসা বেঁধেছে ফ্লয়েডের ভিতরেও। কিন্তু সে উত্তর দিল সুন্দর মনে, আমি তোমার সাথে পরামর্শ না করে কখনো এমন কিছু করব না।

    করোনি শুনে ভাল লাগছে। জানিনা কী বলতাম যদি তুমি…

    এখনো তাদের অফার ফিরিয়ে দিতে পারি।

    বাজে কথা বাদ দাও, তুমিতো জান। যদি যাওয়ার অফারটা ফিরিয়ে দাও তাহলে বাকি জীবন আমাকে ঘৃণা করবে-তোমার নিজেকেও কখনো ক্ষমা করবে না। তুমি কর্তব্য ঠিকই চিনতে পার। হয়ত যেজন্যে তোমাকে বিয়ে করেছি তার মধ্যে এও এক কারণ।

    কর্তব্য! হ্যাঁ, সেটাই আসল কথা এবং কী অবাক করা কর্তব্য যে চারপাশে! নিজের প্রতি তার কর্তব্য ছিল, কর্তব্য ছিল পরিবারের প্রতি, ইউনিভার্সিটির প্রতি, তার অতীত কাজের প্রতি (এমনকি সন্দেহের প্রতিও)-এবং মানবজাতির প্রতি। কোনো কর্তব্য আগে আসবে সে অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠা করা সহজ নয়; মাঝে মাঝেই কর্তব্যেরা একে অন্যের বিরোধী যে!

    এ মিশনে যাওয়া আসলেই দরকার। যুক্তিসঙ্গত কারণও আছে-একইভাবে কেন মিশনে তার যাওয়া ঠিক না তা নিয়েও ফ্লয়েডের অনেক বন্ধু দেখিয়েছে বেশ কিছু যুক্তি। কিন্তু সম্ভবত সবশেষে হাজার হিসাব শেষ করে তার মস্তিষ্ক নয়, হৃদয়ই ঠিক করল সে কী করবে। এখানে তাকে দুটো বিপরীত দিকে ঠেলে দিচ্ছে আবেগ।

    যেতে হবে বৃহস্পতির দিকে। জানার ইচ্ছা, অপরাধের অপবাদ, নিজের গোয়ার্তুমি এসব একত্র হয়ে ভয়াবহ একটা কাজ শেষ করার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন; যা-ই হোক না কেন। অন্য দিকে ভয়-পারিবারিক ভালবাসা তাকে পৃথিবীতে রাখার কথাও বলে। তবু কোনো সন্দেহ নেই। সিদ্ধান্ত নিতে দেরি, সেখানে স্থির থাকতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না সে। সিদ্ধান্ত নেয়ার সাথে সাথেই ক্যারোলিনের যত আপত্তি যতোটা সম্ভব ভদ্রতার সঙ্গে দিয়েছে সরিয়ে।

    আরও একটা সান্ত্বনা দেয়া চিন্তা আছে তার মনে। ঝুঁকি শুধু নিজেই নিচ্ছে, পরিবারের আর কেউ না। আড়াই বছরের জন্য যেতে হবে। এর মধ্যে বৃহস্পতিতে থাকার সময়টা বাদ দিয়ে বাকি অসীম সময় কাটাতে হবে হাইবারনেশনে। ফিরে এলে বয়সের পার্থক্য কমে যাবে দু বছরের মতো। কিংবা আরো বেশি। ফলে তারা বয়সে অনেক এগিয়ে আসছে; শুধু ক্যারোলিনকে থাকতে হবে একা।

    ৫. লিওনভ

    কীভাবে কোনো ফাঁকে মাস ছোট হয়ে সপ্তাহ হয়ে যায় কেউ জানে না, সপ্তাহ কমে হয় দিন, আর দিন ঘণ্টার দিকে যায় কুঁচকে। হেউড ফ্লয়েড অনেক বছর আগে ক্ল্যাভিয়াস বেসে টাইকো মনোলিথ দেখতে যাবার পর এই প্রথম বাধ্য হয়ে যাত্রা করছে মহাকাশে।

    কিন্তু এবার সে একা নয়। মিশন নিয়ে কোনো গোপনীয়তাও নেই। সামনের কয়েক সিট পরে বসে ডক্টর চন্দ্র। সে ব্রীফকেস কম্পিউটারের সাথে এরই মধ্যে এত আলাপে ব্যস্ত যে চারদিকের পরিবেশ তাকে তেমন সহজভাবে নেয়নি।

    কিছু বিশ্বাস আছে যা কখনো কাউকে বলা যায় না। মানুষ যতই মানুষ হোক, অন্য প্রাণীর সাথে তার প্রচণ্ড মিল পাওয়া যায়, সেটুকু যেন অন্তঃসলিলা নদী। আইডিয়াটা ফ্রয়েডের গোপন মজার ব্যাপারগুলোর একটা। তবে মিলগুলোকে সে অপমান করার কাজে লাগায় না বরং আরো সুন্দররূপে উপস্থাপিত করে। তার এ ছোট্ট শখটা মুখস্থ রাখার কাজ দেয়।

    ডক্টর চন্দ্র এখন যেমন করছে তা যেন মনের ভেতর হঠাৎ লাফিয়ে ওঠা পাখির নাচনের মতো। সে দেখতে ছোটখাট, কোমল এবং তার সব চলাফেরা বেগবান আর নির্ভুল। কিন্তু কোন্ পাখি? নিশ্চই খুব বুদ্ধিমান একটা পাখি। ম্যাগপাই? অত্যন্ত কিচিরমিচির করে কিন্তু লোকজন তেমন দেখতে পারে না। তাহলে পেঁচা? নাহ্-খুবই কচ্ছপগতির। সম্ভবত চড়ুইপাখি চমৎকার মানায়।

    ডিসকভারিকে আবার সচল করার মতো ভয়ানক কাজের দায়িত্ব সিস্টেম বিশেষজ্ঞ ওয়াল্টার কার্নো নিয়েছে। আসলে কাজটা আরো কঠিন। সে বিশালদেহী কর্কশ লোক, মোটেই পাখির মতো নয়। বিপুল বিস্তৃত ধারার কুকুরের মধ্যে কোথাও কেউ এমন কিছু খুঁজে পাবে, কিন্তু তুলনাটা ঠিক মানানসই না। কার্নো অবশ্যই এক ভালুক। গোমড়ামুখো নয়, বিপজ্জনক প্রকৃতির, কিন্তু ভালমানুষ ধরনের। আর বন্ধু ভাবাপন্ন। সম্ভবত তাই ঠিক; ভাবনাটা ফ্লয়েডকে রাশিয়ান সাথীদের কথা মনে করিয়ে দেয়। তাদের সাথে অচিরেই সে যোগ দিতে যাচ্ছে। চূড়ান্ত পরীক্ষা নিরীক্ষার কাজে তারা বহুদিন যাবৎ ঝুলে আছে উপরের অর্বিটে।

    আমার জীবনের বিরাট এক মুহূর্ত এটা-ফ্লয়েড মনে মনে ভাবল। আমি এমন এক অভিযানে যাচ্ছি যা মানবজাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে। কেন যেন ভিতর থেকে কোনো জয়োল্লাস আসছে না। বরং যেসব কথা বেশি মনে পড়ে…বাড়ি ছাড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে ফিসফিসিয়ে বলা কথাগুলো, বিদায় আমার প্রিয় ছোট্ট বাবু, আমি যখন ফিরে আসব তখন আমাকে কি তুমি চিনতে পারবে? এখনো রাগ লাগছে ক্যরোলিনের উপর। সে শেষবারের মতো জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিল ছেলেটাকে-ক্যারোলিন জাগায়নি। তবু সে ক্যারোলিনের কাজটাকেই ঠিক মনে করে। না জাগানোটাই ভাল।

    হঠাৎ এক বিস্ফোরিত অট্টহাসিতে তার মন-খারাপ ভেঙেচুরে গেল; ডক্টর কার্নো কৌতুক করছিল সাথীদের সাথে। একটু, সামান্য প্রটোনিয়াম যতোটা কোমলভাবে মানুষ নেয় তেমন করে সে ধরে রেখেছে বিরাট এক বোতল।

    সে ডাকল, এই হেউড, লোকজন কী বলে বেড়ায় বলতো! কাপ্তান অর্লোভা নাকি সব পানীয় ভরে রেখেছে সিন্দুকে, এটাই আমার শেষ সুযোগ। সেতিউ থিয়োরী ৯৫। প্লাস্টিক কাপে খেতে হচ্ছে, হায় কপাল!

    একেবারে খাসা শ্যাম্পেন, যখন ফ্লয়েড একটু একটু করে চুমুক দিয়ে পান করছে। তখন কার্নো হাসছে আর হাসাচ্ছে বেদম। সৌরজগৎসহ সব দিকে কার্নোর অট্টহাসির ধ্বনি প্রতিধ্বনির সামনে ফ্লয়েড নিজে যেন নুয়ে পড়া এক মানুষ। সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে ইঞ্জিনিয়ারের ক্ষমতা। মিশনের সঙ্গী হিসেবে কার্নো শক্তি প্রয়োগ করার মতো প্রমাণ দেখাতে পারত। অন্তত ডক্টর চন্দ্র তার সমস্যা তুলে ধরত না। ফ্লয়েড খুব বেশি হলে তার কাছে মৃদু হাসি আশা করে। অথচ লোকটা পারেও! নামমাত্র খেয়ে থর থর করে কাঁপিয়ে উল্টে দিল শ্যাম্পেনের কাপ; নাহ্, কার্নো যথেষ্ট মার্জিত, অথবা যথেষ্ট আনন্দে আছে, অথবা লুকাচ্ছে মনের ব্যথাটুকু। নিজেকে প্রচার করার জন্য এ কাজ করেনি।

    ইঞ্জিনিয়ার মনে হয় এ পার্টির মধ্যমণি হওয়ার পণ করেছে। একটু আগে সে একটা দু-দিকে অ্যাকটিভ ইলেকট্রনিক কীবোর্ড নিয়ে সহগামীদের কণ্ঠের সহযোগিতায় পর পর পিয়ানো, ঐম্পেট, বেহালা, বাশের বাঁশি এবং গান দিয়ে দ্রুত শুনিয়ে দেয় ডাইকেন জন পিল। ও আসলে খুব ভালো আছে।

    একটু পরই ফ্লয়েড নিজেকে গাইতে দেখল অন্যদের সাথে। কিন্তু সে মনে করেছিল কার্নো তার যাত্রার সময়টা কাটাবে নীরবে, হাইবারনেশনের আঁধারে। ইঞ্জিন জ্বলার পর যখনি শাটল নিজে নিজে আকাশে চলতে শুরু করছে তখনি হতাশায় বন্ধ হয়ে গেল গান। ফ্লয়েড এক পরিচিত কিন্তু সদা নতুন উল্লাসে জড়িয়ে নেয় নিজেকে। অসীম ক্ষমতার ইন্দ্রিয় পৃথিবীর যত্ন এবং শক্তি থেকে নিয়ে যাচ্ছে উপরে, বহু দূরে। মানুষ এক সময় ঈশ্বরের অস্তিত্বকে মাধ্যাকর্ষণের নাগালের বাইরে বসায়, তারপর উপলব্ধির চেয়ে জানতে পারে বেশি। সে উড়ছে স্বাধীন ওজনহীনতার কল্পলোকে। মুহূর্তের জন্য হয়ত সত্যটা গেছে ভুলে। সেখানে কোনো স্বাধীনতা নেই, আছে শুধু তার অতীত ক্যারিয়ারের গুরুদায়িত্ব।

    ইঞ্জিনের গতি বাড়ার সাথে সাথে ওজন যেন ফ্লয়েডের কাঁধে বসছে জাঁকিয়ে। কিন্তু সুনয়না পৃথিবীর এত ভার বহন করেও ক্লান্ত না হয়ে সে একে স্বাগত জানিয়ে নিল। ভাবতে চেষ্টা করেনি, কিন্তু এসব অভিজ্ঞতার স্বাদ উপভোগ করে তৃপ্তি পায়। ফ্লয়েড যদিও শেষবারের মতো পৃথিবী ছেড়ে যাচ্ছে এবং যাদের এখনো ভালবাসে তাদের বিদায় জানাচ্ছে তবু অনুভব করছে না কোনো দুঃখ। তার চারদিকের গর্জন বিজয়োল্লাসের বন্দনা গান হয়ে যেন ছোটখাট আবেগগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। এখান থেকে যাবার সময় সে ব্যথা পায়, পৃথিবীর আকর্ষণ যাচ্ছে চলে। সহজতর শ্বাসপ্রশ্বাস এবং হঠাৎ ইন্দ্রিয় স্বাধীনতাকেও স্বাগতই জানায়। যাত্রীদের প্রায় সবাই সিট বেল্টে ঢিল দিতে শুরু করেছে, কক্ষপথ অতিক্রমের সময় শূন্য মাধ্যাকর্ষণের তিরিশ মিনিটকে উপভোগ করতে চায়। কিন্তু যারা প্রথম এ জার্নি করছে তারা সিটে বসে থেকেই কেবিন অ্যাটেনড্যান্টদের জন্য চারদিকে উদ্বিগ্নভাবে তাকাতে থাকে।

    ক্যাপ্টেন কথা বলে, আমরা এখন সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে তিনশ কিলোমিটার উপরে আফ্রিকা মহাদেশের পশ্চিম উপকূলের উপর। আপনারা ভাল দেখতে পাবেন না। সেখানে এখন রাত। সামনে যে উজ্জ্বলতা দেখা যাচ্ছে তা হল সিয়েরা লিওন এবং গিনির উপসাগরের উপরে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বিরাট ঝড়। তাকিয়ে দেখুন ঐসব আলোর ঝলক।

    পনের মিনিটের মধ্যে আমরা সূর্যের আলো দেখতে পাব। ইতোমধ্যে শিপকে ঘোরাচ্ছি যাতে আপনার বিষুবরেখার কাছাকাছি স্যাটেলাইট এলাকার সুন্দর দৃশ্য দেখতে পারেন। প্রায় সোজাসুজি মাথার উপর উজ্জ্বলতম যা দেখা যাচ্ছে ওটা ইনটেলমেট আটলান্টিক ওয়ান অ্যান্টেনা ফার্ম। তার পরেরটা পশ্চিম দিকে দেখুন ইন্টারকশন্স টু। আর এক অস্পষ্ট তারার মতো যেটা দেখছেন…ওটাই বৃহস্পতি। যদি ওটার ঠিক নিচে তাকান, এক আলোর চমক দেখতে পাবেন। তারার পিছনে বিপরীত দিকে নড়াচড়া করছে। ওটাই হলো নতুন চাইনিজ মহাশূন্য স্টেশন। আমরা একশ কিলোমিটার দূর দিয়ে পেরুচ্ছি, খালি চোখে দেখার মতো যথেষ্ট কাছে নই।

    ফ্লয়েড আলসের মতো ভাবল-এতক্ষণ ওগুলো কী দেখলাম? মোটা নলের মতো কাঠামোটার আরো কাছে এসে সে পরীক্ষা করেছে। ভীতুদের গুজবে বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। তারা বলে ওটা এক লেজার সজ্জিত দুর্গ। তারপর সবার সন্দেহের কারণে জাতিসংঘ চীনাদের তথাকথিত লেজার দুর্গ দেখতে চায়। বেইজিং বিজ্ঞান একাডেমি জাতিসংঘের মহাশূন্য কমিটির পরিদর্শনে যাত্রার অনুরোধ একের পর এক ফিরিয়ে দিয়েছে। শত্রুদের এসব প্রচারের জন্য চীনারা দোষ দেয় নিজেদের। নভোচারী এলেক্সি লিওনভ স্পেসশিপটা খুব একটা সুন্দর কিছু না। কিছু মহাশূন্যযান দেখতে সুন্দর। সম্ভবত মানবজাতি একদিন নান্দনিক নতুন কিছু উন্নয়ন করবে। শিল্পীদের প্রজন্ম উঠে আসবে যাদের শিল্প আদর্শটা বায়ু ও পানির ছাঁচে তৈরি পৃথিবীর প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেনি। মহাশূন্য নিজেই মাত্রাছাড়া সৌন্দর্যের এক কল্পলোক; দুর্ভাগ্যক্রমে মানুষের হার্ডওয়্যার নিজেকে এখনো পূর্ণতা দান করতে পারেনি।

    লিওনভের আছে বিশাল চার চারটা জ্বালানি ট্যাংক। ট্রান্সফার অর্বিট সফল হবার সাথে সাথে সংখ্যায় কমে যাবে এগুলো। ট্যাঙ্ক বাদ দিলে অবাক করা ঘোঁট এ রাশিয়ান স্পেসশিপ। তাপ-ফলক থেকে ড্রাইভ ইউনিট পর্যন্ত পঞ্চাশ মিটারের চেয়েও কম; বিশ্বাস করা কঠিন যে অনেক কমার্শিয়াল এয়ার ক্রাফটের চেয়ে ছোট এমন এক মাঝারি ধরনের যান দশজন পুরুষ-মহিলাকে সৌর জগতের এক মাথা থেকে প্রায় অন্য মাথায় বয়ে নিয়ে যেতে পারে।

    কিন্তু জিরো গ্র্যাভিটি বা মাধ্যাকর্ষণহীনতা জীবনযাপন প্রণালীর সব বিধিকে ভিন্ন রীতিতে দ্বিতীয়বার লিখেছে। এ পরিবেশে দেয়ালই ছাদ এবং মেঝে। লিওনভে প্রচুর জায়গা, এমনকি যখন সবাই একই সাথে জেগে থাকে তখনো। হরেক রকম সংবাদদাতা, প্রকৌশলী এবং উদ্বিগ্ন কর্মচারীর চূড়ান্ত কষ্টের ফসল এটা। অবাক ব্যাপার, প্রয়োজনীয় জায়গা সাধারণের চেয়ে কমপক্ষে দ্বিগুণ। লিওনভ ডকে থামার সাথে সাথে ফ্লয়েড জেগে ওঠে কার্নো আর চন্দ্রের সাথে। সে কেবিন খুঁজে বের করার চেষ্টা করল যেখানে আগামী এক বছর থাকতে হবে। পরিপাটি উন্নত যন্ত্রপাতি আর খাবারের বাক্স-পেঁটরায় ঠাসাঠাসি করে বোঝাই ঘরটা। ঢাকাই অসম্ভব। ক্রুদের একজন হ্যান্ডহোল্ড থেকে হ্যান্ডহোল্ড ধরে দক্ষতার সাথে দরজার দিকে যাবার সময় ফ্লয়েড বিষণ্ণচিত্তে চারদিকে তাকিয়ে ভাবে কীভাবে দরজায় এক পা রাখা যায়। ক্রু ভদ্রলোক ফ্লয়েডকে উভয় সংকটে পড়তে দেখেই একটু থামল।

    ডক্টর ফ্লয়েড যে-ওয়েলকাম-আসনু। আমি সহকারি প্রকৌশলী-ম্যাক্স ব্রেইলোভস্কি।

    রুশ যুবক একজন শিক্ষানবিশের মতো ধীর যত্নে গড়া ইংরেজিতে কথা বলে। বোঝাই যায় ওর বাস্তব ইংরেজি টিচার ছিল না। বরং গৃহশিক্ষকের কাছে পাঠ নিয়ে বসেছে বেশি। হাত মেলাবার সময় ফ্লয়েড ইতোমধ্যে পড়া ক্রুদের বায়োডাটার সাথে তার চেহারা আর নাম মিলিয়ে নিল…ম্যাক্সিম আন্দ্রেই ব্রেইলোভস্কি, বয়স একত্রিশ, লেনিনগ্রাদের মানুষ, নির্মাণ বিশেষজ্ঞ, শখ বেশ ভাল-তলোয়ার চালানো, স্কাই সাইক্লিং, দাবা।

    তোমার দেখা পেয়ে খুশি হলাম। ফ্লয়েড বলল, ভিতরে যাব কীভাবে বলতো?

    ভয় নেই। দাঁত কেলিয়ে ম্যাক্স বলল, তুমি ঘুম থেকে জেগে দেখবে এসব চিচিং ফাঁক। তা-তোমরা ইংরেজিতে কী বলো শব্দটা?- এক্সপেনসিভ। ব্যাপারটা ব্যয়সাধ্য। আমরা খাব। তোমার রুম প্রয়োজনের সময় খালি হয়ে যাবে। আমি কথা দিচ্ছি। সে তার পেট চাপড়ায়।

    ভাল কথা কিন্তু তোমার পেটে এ ঘরে তাবৎ জঞ্জাল যাবার আগে আমার জিনিসপত্র রাখি কোথায়? ফ্লয়েড তিনটি বাক্স দেখালো, মোট ওজন পঞ্চাশ কেজি। সে আশা করছে পরবর্তী লক্ষ কোটি কিলোমিটার পথের জন্য তার প্রয়োজনীয় সবকিছু আছে এর মধ্যে। এদের ওজনহীন করা সহজ কাজ, কিন্তু জড়তাহীন নয়, শিপের করিডোরের ভিতরে সামান্য ধাক্কাতেই জড়তাটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।

    ম্যাক্স ব্যাগগুলোর দুটো তুলে নিল, তিনটা বিম দিয়ে ছেদ করা ত্রিকোণের ভিতরে সতর্কভাবে বয়ে চলল। নিউটনের প্রথম সূত্রকে উপেক্ষা করে প্রকাশ্যে ঝাঁপও দিল ছোট হ্যাঁচওয়ের ভেতর। অন্যদিকে ফ্লয়েড তাকে অনুসরণ করে অর্জন করল কিছু অতিরিক্ত আঘাতের দাগ। বয়েস হয়ে যাচ্ছে।

    বেশ কিছুক্ষণ থেকে ধাতস্থ হবার পর মনে হয় লিওনভ বাইরের চেয়ে ভেতরে বড়। স্লাভ এবং রোমান এ দু বর্ণমালার কাপ্তান লেবেল লাগানো এক দরজার কাছে। এল তারা। ফ্লয়েড বলার চেয়ে রাশিয়ান ভাষা পড়তে পারে বেশি। ইশারাকে ঠিকভাবে মূল্যায়ন না করে উপায় নেই। সে এরইমধ্যে লক্ষ্য করেছে যে শিপের সব নোটিশে দুটো ভাষা।

    ম্যাক্স নক করার সাথে সাথে সবুজ আলো জ্বলে উঠেছে। ফ্লয়েড যতটা সম্ভব সুন্দরভাবে অবস্থার বশবর্তী হয়ে ভেতরে ঢোকে। ক্যাপ্টেন অর্লোভার সাথে বহুবার সে কথা বলেছে কিন্তু এর আগে কখনো তাদের দেখা হয়নি।

    ভিউফোনের মাধ্যমে কোনো মানুষের বাস্তব আকৃতি বিচার করা কঠিন। ক্যামেরা কীভাবে যেন সবাইকে একই আকারে নিয়ে আসে। বাকি সবার শূন্য মাধ্যাকর্ষণে দাঁড়ানোর মতো করেই দাঁড়িয়ে আছে কাপ্তান অর্লোভা। খুব বেশি হলে ফ্লয়েডের কাঁধ পর্যন্ত লম্বা। এক মুহূর্তে উজ্জ্বল নীল চোখের ঐ তীক্ষ্ণতা আর চমক লাগানো সুন্দর মুখের ঐ দারুণ বৈশিষ্ট্যের সৌন্দর্য বিচার করা অসম্ভব। মরার ভিউফোন তাও জানাতে পারেনি।

    হ্যালো তানিয়া, ফ্লয়েড বলে, অবশেষে তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ায় কী চমৎকৃত হলাম! কিন্তু তোমার চুলের এ কী হাল?

    তারা হাত মেলায় পরিচিত বন্ধুর মতো।

    আমিও শিপে তোমাকে পেয়ে খুশি হলাম, হেউড! উত্তর দিল ক্যাপ্টেন। তার ইংরেজী বেইলোভস্কির মতো নয়, দক্ষতা আছে পুরোপুরি, যদিও কথাগুলো বেরিয়েছে খুব জোর দিয়ে, হ্যাঁ, চুল হারিয়ে কিছুটা মন খারাপতো হবেই-কিন্তু লম্বা মিশনে চুল মহা বিড়ম্বনা…আমি এখানকার নাপিতকে যতদূর সম্ভব সরিয়ে রাখতে চাই। তোমার কেবিনের জন্য দুঃখিত; ম্যাক্স সব বলেছে আমাকে। হঠাৎ দেখি মালামাল রাখতে আরো দশ বর্গমিটার জায়গা দরকার। পরের কয়েক ঘণ্টায় ভ্যাসিলি আর আমি এখানে বেশিক্ষণ থাকব না-আমাদের কোয়ার্টার ব্যবহার করতে দ্বিধা করোনা, প্লিজ।

    থ্যাঙ্কস। কার্নো আর চন্দ্রের কী খবর?

    আমি ক্রুদের জন্য একই ব্যবস্থা নিয়েছি। মনে হতে পারে তোমাদের কার্গো হিসেবে গণ্য করছি আমরা–

    অভিযানের সময় করবে না আশা করি।

    ক্ষমা করো। হাস্যোজ্জ্বল চোখে মাফ চেয়ে নেয় তাতিয়ানা অর্লোভা।

    প্রাচীন যুগে সমুদ্র ভ্রমণে ব্যাগেজের উপর ওটা লেবেল হিসেবে ব্যবহার করত।

    তানিয়া হাসল, অনেকটা ওরকম দেখায়। জার্নির শেষ দিকে তুমি ভাল থাকবে এ কামনা করি। এর মধ্যে আমরা তোমার জায়গার পরে পার্টি দেয়ার পরিকল্পনা করছি।

    সেটাইতো ভয়। তা করোনা, আবার জাগা! চরম খারাপও হতে পারে-জাগরণী পার্টি। কিন্তু তুমি মনে হয় খুব ব্যস্ত-আমার জিনিস আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়ে আমাকে দারুণ মজার জার্নি চালিয়ে যেতে দাও।

    ম্যাক্স তোমাকে চতুর্দিক দেখাবে-ডক্টর ফ্লয়েডকে ভ্যাসিলির কাছে নিয়ে যাও, নেবে তুমি? ও নিচের ড্রাইভ ইউনিটে।

    ক্যাপ্টেনের কোয়ার্টার থেকে বাতাসের স্রোতে বেরিয়ে এসে ফ্লয়েড মনে মনে ত্রু সিলেকশন কমিটিকে গুড মার্কস দিল। কাগজে-কলমে তানিয়া অর্লোভা অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। আকর্ষণীয় হলেও সশরীরে সে রীতিমতো ত্রাস। ফ্লয়েড নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে, যখন মেয়েটার মেজাজ বিগড়ে যায় তখন দেখতে কেমন ভাবতে পারছি না। এ সুন্দর রূপটা আগুন হয়ে উঠবে, নাকি বরফ? মোটের উপর, খুঁজে বের না করাই বোধহয় ভাল।

    ফ্লয়েড মহাশূন্যে তাড়াতাড়ি পা চালানোর শিক্ষা নিচ্ছে। ভ্যাসিলি অলোভের কাছে পৌঁছে গেল ওরা সময়মতো। সে এখন গাইডের মতো প্রায় দৃঢ়তার সাথে ভাসে। চীফ সায়েন্টিস্ট ফ্লয়েডকে সম্ভাষণ জানায় তার স্ত্রীর মতোই উষ্ণভাবে, স্বাগতম ফ্লয়েড। কেমন লাগছে তোমার?

    ভাল, আস্তে আস্তে না খেয়ে মরার দিকটা ছাড়া।

    মুহূর্তের জন্য অর্লোভ গাড্ডায় পড়ে যায়। তারপর তার পুরো মুখটাই রূপান্তরিত হয় চওড়া হাসিতে, ওহ্, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। ভাল কথা, খুব বেশিক্ষণতো এসব চলবে না। মাত্র দশ মাস পর তোমার যত খুশি খেতে পার।

    হাইবারনেটররা এক সপ্তাহ আগে থেকেই খাওয়া-খাদ্য কমানোর চিন্তায় অস্থির। গত চব্বিশ ঘণ্টায় তরল ছাড়া তারা কিছুই খায়নি। অনশনের কারণে নিজের বোকামি কতটা বাদুছে তা দেখে ফ্লয়েড অবাক হয়। কার্নোর শ্যাম্পেনের পরিমাণ কত ছিল এক সময় তার কতোটা গেছে জিরো গ্র্যাভিটির দিকে?

    মনকে একদিকে ফেরাতে তাদের ঘিরে থাকা পানির পাইপে ভরা বহু রঙের বিশাল ইঞ্জিনটায় চোখ বুলালো ফ্লয়েড, তাহলে এই হল সেই বিখ্যাত শাখারভ ড্রাইভ। এবারই প্রথম আমি পুরো ইউনিট দেখলাম।

    এ পর্যন্ত বানানো হয়েছে মাত্র চারটা।

    অদ্ভুত আকার দেখে একটু হাসল সে, আমার মনে হয় এটা কাজ করে।

    আরো ভাল করে কাজের চেয়েও বেশি। তা না হলে গোর্কি সিটি কাউন্সিলের নাম আবারো শাখারভ স্কোয়ার হত।

    একটা সংকেত আছে মজাদার। একজন রাশিয়ান তার দেশের বিখ্যাত বিজ্ঞানী সম্পর্কে কৌতুক করতে পারে। কাজটা যত বিরক্তিকরই হোক না কেন। অনেক দেরিতে শাখারভকে বানানো হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের হিরো। একাডেমিতে তার সেই দারুণ বক্তৃতার কথা ফ্লয়েডকে আবারো মনে করিয়ে দেয়া হল। তিনি শ্রোতাদের বলেছিলেন, বন্দীশালা এবং নির্বাসন সৃজনশীলতার জন্য আসলে সম্মানে ভরা জমকালো কর্মসূচি। পৃথিবীর পাগলামির ছোঁয়া থেকে দূরে, ঐ কারাগারের দেয়ালের নির্জনতায় কম মহৎ রচনা জন্ম নেয়নি। তেমন একটা সৃষ্টির উদাহরণ আমি দেব। মানুষের মেধার সবচে বড় একক অর্জন স্বয়ং প্রিন্সিপিয়া ছিল মহামারী শাসিত লন্ডন থেকে নিউটনের নিজের উপর চাপানো নির্বাসনের ফসল।

    তুলনাটা বাজে নয়। গোর্কীতে ঐ বছরগুলো কাটিয়ে বস্তুর গঠন আর মহাবিশ্বের উৎস নিয়ে নতুন অন্তদৃষ্টি এসেছে তার। রক্তরস নিয়ন্ত্রণ ধারণাও এসেছে যা বাস্তব থার্মোনিউক্লিয়ার ক্ষমতার দিকে এক পদক্ষেপ। যন্ত্রপাতিই ঐ কাজে সবচে বেশি পরিচিত। জনগণ যান্ত্রিক সফলতাকেই দেখতে পায়। কিন্তু সেসব মেশিন তার অবিষ্কারকের বুদ্ধিকে প্রকাশের স্রেফ একটা পথ। কলম লেখক নয়, যিনি কলমকে সৃষ্টির পথে ঘোরান তিনিই লেখক, কলম শুধু লেখকের মেধার প্রকাশ ঘটায়। দুঃখের ব্যাপার, এত বড় অগ্রসরতার শুরু হয়েছে অন্যায় অবিচারের নিচে থেকে থেকে। সম্ভবত এক সময় মানবিকতা এসব মানিয়ে নিতে আরো মার্জিত ও উন্নত পথ খুঁজে পাবে।

    এরিমধ্যে তারা বেরিয়ে যায় রুম থেকে। ফ্লয়েড শাখারভ ড্রাইভ সম্পর্কে যতটা জানার বা মনে রাখার চেষ্টা করেছে শিখেছে তারচে বেশি। সে এর মূলনীতি, তাপের সাথে যুক্ত থার্মোনিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার ব্যবহার এবং যে কোনো জ্বালানি পদার্থকে বের করে দেয়ার সাথে পরিচিত হয়েছে ভালোই। খাঁটি হাইড্রোজেনকে কার্যকর তরল হিসেবে ব্যবহার করে সবচে ভাল ফল পাওয়া যায়। তরলটা অতি ভারী আর অনেকক্ষণ মজুদ রাখাও কঠিন। বিকল্প হিসেবে মিথেন এবং অ্যামোনিয়া গ্রহণযোগ্য; এমনকি পানিও ব্যবহার করা যায়। পানিতে কাজ হয় অত্যন্ত কম।

    গতির সাথে লিওনভ আপস করবে। প্রচুর লিকুইড হাইড্রোজেন ট্যাংক প্রাথমিক চালিকা শক্তিতে দেয়া হয়েছিল। শিপ বৃহস্পতিতে যাওয়ার গতি পেলেই সেসব ফেলে দেয়া হবে। প্রোপ্যাল্যান্ট হিসেবে অ্যামোনিয়া ব্যবহার করা হবে পরের তিন স্থানে-গন্তব্যে, ব্রেক করার কাজে এবং ডিসকভারির সাথে মিলিত হওয়ার জায়গায়। পরিণামে আরো এক ক্ষেত্রে করতে হবে ব্যবহার; পৃথিবীতে ফিরে আসা পর্যন্ত।

    ঠিক এটুকু নীতি নেয়া হয় অশেষ পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই পুনঃপরীক্ষা এবং কম্পিউটার মডেলে কাজ করার পর। অভাগা ডিসকভারি এমন ভাল খেল দেখানোয় একটা সিদ্ধান্ত আসে-মানবীয় পরিকল্পনা প্রাকৃতিকভাবে বা ভাগ্যের জোরে নির্দয়ভাবে সংশোধন করতে হতে পারে। আর মহাবিশ্বের আড়ালের সেই শক্তির ভয়তো থাকবেই।

    আচ্ছা! ডক্টর ফ্লয়েড তুমি ওখানে, ভ্যাসিলি ম্যাগনেটো হাইড্রোডাইনামিক ফিডব্যাকের ব্যাখ্যা দিচ্ছে অতি উৎসাহে, এমন সময় বাধা দিয়ে এক মহিলা কণ্ঠ বলল, তুমি আমার কাছে রিপোর্ট করোনি কেন?

    এক হাতে আলতোভাবে পাক খেয়ে আস্তে আস্তে তার অক্ষরেখায় ঘুরল ফ্লয়েড। এক ডজন পকেট এবং থলে সজ্জিত অস্বাভাবিক এক ইউনিফর্ম পরা মাতৃ জাতির এক বিশাল মূর্তি দেখতে পেল সে। মহিলার প্রভাব কার্তুজ বেল্ট পড়া রাশিয়ান অশ্বারোহী এক সেনা সদস্যের চেয়ে কম না।

    নাইস টু মিট ইউ এগেইন, ডক্টর। আমি এখনও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করে দেখছি। আশা করি হিউস্টন থেকে পাঠানো মেডিক্যাল রিপোর্ট পেয়েছ তুমি।

    টিগ সেন্টারের ঐ সব চিকিৎসা! গরু-ছাগলের খুরা রোগ খুঁজে বের করি না আমি। ওসব বিশ্বাস করব না!

    ক্যাথোরিনা রুডেঙ্কো এবং অলিন টিগ মেডিকেল সেন্টারের মধ্যে অনুভূত পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ সম্পর্কে ফ্লয়েড ভালই জানতো যদিও ডাক্তারদের মন খোলা হাসি আর কথাবার্তাকে কম বিশ্বাস করত না। ডাক্তার তার অকপট উৎসাহের দৃষ্টি দেখে গর্বিতভাবে প্রশস্ত কোমরের চারিদিকে কাপড়ের বেল্টে আঙ্গুল গুঁজে দিল, বলল, জিরো গ্র্যাভিটিতে গতানুগতিক পিচ্চি কালো ব্যাগ ব্যবহারযোগ্য নয়-জিনিস পত্র ভেসে বেরিয়ে যায় আর দরকারের সময় তুমি খুঁজে পাবে না সেগুলো জায়গামতো। আমি নিজে এ পোশাকের ডিজাইন করেছি। এটা আস্ত এক মিনি চিকিৎসা কেন্দ্র। এ দিয়ে আমি এপেনডিক্স বের করতে পারব-পারব একটা শিশু প্রসব করাতে।

    আশা করি ঐ বিশেষ সমস্যা এখানে দেখা দেবে না।

    আরে! একজন ভাল ডাক্তারকে সবকিছুর জন্য রেডি থাকতে হয়।

    কাপ্তান অর্লোভা আর ডাক্তারের মধ্যে কী বৈষম্য! ফ্লয়েড ভাবল। নাকি রুডেঙ্কোকে সঠিক পদবী সার্জন-কমান্ডার রুডেঙ্কো নামে ডাকা উচিত তার? ক্যাপ্টেনের আছে একজন ব্যালে নর্তকীর সাবলীলতা আর তীক্ষ্ণতা; অন্যদিকে ডাক্তার মোটামুটি মাদার রাশিয়ার আদি প্রতীক। চ্যাপ্টা চষা মুখ, ছবিটা পুরো। করতে শুধু একটা শাল প্রয়োজন-ফ্লয়েড নিজে নিজে বলল; এ-ও বলল, নিজেকে বোকা বানিও না। এ হল সেই মহিলা যে কোনারভ ডাকি দুর্ঘটনায় কমপক্ষে এক ডজন জীবন রক্ষা করেছিল–অবসরের আলসেমির বদলে সম্পাদনা করেছিল এনালস অব স্পেস মেডিসিন বা মহাশূন্য ঔষধের বর্ষপঞ্জি। তাকে অচেনা কোটি কিলোমিটারের পথে পেয়ে নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে করো, ফ্লয়েড।

    এখন, ডক্টর ফ্লয়েড, কথা হল-আমাদের ছোট্ট শিপটা খুঁটে খুঁটে দেখার জন্য পরে যথেষ্ট সময় পাবে। আমার সাথীরা এর কথা বলবে বিনয়ের সাথেই। কিন্তু করার মতো হাজারো কাজ আছে তাদের। তুমি সাহায্যও করতে পার। যত তাড়াতাড়ি পারি আমি তোমাকে-তোমাদের তিন জনের সবাইকে সুন্দর এবং ঠাণ্ডা অবস্থায় পেতে চাই। তারপর চিন্তা আমাদের কম থাকবে।

    ভয় পাবার ভান করল ফ্লয়েড, আমি ঐ ভয়ই পাচ্ছিলাম, কিন্তু পুরোপুরি তোমার দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখছি। তুমি যখনই বলবে…।

    আমিও সব সময় তৈরি। বললাম তো, তৈরি, প্লিজ এসো আমার সাথে।

    শিপের হাসপাতালটা এক অপারেশন টেবিল, দুটো এক্সারসাইজ বাইসাইকেল, কিছু যন্ত্রপাতি রাখার কেবিনেট আর একটা এক্স-রে মেশিন রাখার মতো বড়। ডাক্তার রুডেঙ্কো দ্রুত সবার সারা শরীর পরীক্ষা করানোর পর অপ্রত্যাশিতভাবে জিজ্ঞাসা করল, ডক্টর চন্দ্রের গলার চেনের সঙ্গে ঐ ক্ষুদ্র সোনার সিলিন্ডারটি কি কোনো ধরনের যোগাযোগ যন্ত্র? সে কি ওটা সরাবে না? আসলে সে যে কোনো কিছু খুলে ফেলার ব্যাপারে খুব লজ্জা পায়।

    ফ্লয়েড না হেসে পারেনি। কিছুটা অভিভূত মহিলার প্রতি বিনয়ী ভারতীয়র প্রতিক্রিয়া কল্পনা করা খুবই সহজ।

    এটা একটা লিঙ্গম।

    একটা কী?

    তুমি হলে ডাক্তার, তোমার উচিত চিনতে পারা। পুরুষের উর্বরতার প্রতীক।

    অবশ্যই-চেনা উচিত ছিল। বোকামি করেছি। সে কি হিন্দু রেওয়াজী লোক? কড়া আনুগত্যের ভেজিটেরিয়ান? এসব প্রশ্ন করতে আমাদের কিছুটা দেরি হয়ে গেছে। এখন নিরামিষাশী হয়েও লাভ নেই।

    ভয় পেও না-ন্যায্য সতর্কতা ছাড়া তোমাদের সব খাবারই সে খাবে। অবশ্য এলকোহল ছুঁয়ে দেখবে না; গোপন একটা কথা বলি…ধর্ম বা অন্য কোনো কিছুর ব্যাপারেই চন্দ্র গোঁড়ামি করে না, অতি গোঁয়ার্তুমি করে শুধু একটা বিষয়ে-কম্পিউটার। একবার সে আমাকে বলেছিল তার দাদা বেনারসে পুরোহিত ছিলেন। তিনিই তাকে ঐ লিঙ্গম দিয়েছেন।বংশ পরম্পরায় ওটা তাদের পরিবারের রেওয়াজ।

    ফ্লয়েড খানিকটা আশ্চর্য হল, সে মনে করেছিল অন্যরকম, অথচ-ডক্টর রুডেস্কো কোনো অপ্রতিভতাই দেখায়নি। বরং চিকিৎসক তার সংস্কৃতির দিকে পুরো শ্রদ্ধা রেখে মনে করল নিজের স্মৃতি।

    আমি তার অনুভূতি বুঝতে পারছি একটু। আমার নানী আমাকে একটা সুন্দর অহিকন দিয়েছিল-ষোল শতকের জিনিস। আমি ওটা আনতে চেয়েছিলাম কিন্তু কপাল খারাপ। অহিকনটার ওজন পাঁচ কেজি।

    তারপরই ডাক্তার আচমকা পেশাদার হয়ে গেল, হয় করতে দেবে না। একটা গ্যাস গান হাইপোডারমিক দিয়ে ফ্লয়েডকে ব্যথাহীন ইনজেকশন দিল। বলে দিল যেন চলে আসে ঘুম পাবার সাথে সাথে। ঘুম পেতে দু ঘণ্টাও লাগবে না।

    এতক্ষণ শুধুই বিশ্রাম। আদেশ করছে কত্রীর মতো।

    শিপের এ লেভেলে একটা পর্যবেক্ষণ পোর্ট আছে। স্টেশন ডি-৬। যাচ্ছ না কেন সেখানে?

    ধারণাটা ভালোই; ফ্লয়েডের মনে হল এবং সে বাধ্য ছেলের মতো ভেসে চলল। অতি বাধ্যতা তার বন্ধুকে অবাক করছে। ডাক্তার রুডেক্কো ঘড়িতে এক পলক তাকিয়ে অটোসেকে অল্পকথায় হুকুম দিয়ে অ্যালার্ম সেট করল ত্রিশ মিনিট এগিয়ে।

    ডি-৬ ভিউপোর্টে পৌঁছে ফ্লয়েড পেল চন্দ্র আর কার্নোকে। এরিমধ্যে তারা হাজির। তারা যেন স্বীকারই করছে না ডক্টর হেউড ফ্লয়েডের অস্তিত্ব-তাকায় এমন ভাব নিয়ে। তারপর সে ঘুরল বাইরের দারুণ জাঁকজমকে ভরা প্রদর্শনীর দিকে। ঘটনাটার দর্শক শুধু ফ্লয়েড-এ চমঙ্কার পর্যবেক্ষণের জন্য নিজেকে সংবর্ধনা জানাতেও ভোলেনি। চন্দ্র এ দৃশ্য বাস্তবে উপভোগ করতে পারছে কি? মনে হয় না। তার চোখ একেবারে বন্ধ।

    যেন একেবারে অচেনা এক গ্রহ সেখানে ঝুলে আছে, জ্বলজ্বল করছে চমৎকার নীল আর দীপ্তিময় সাদা আলোতে। কী অদ্ভুত! ফ্লয়েড নিজে নিজেই বলল। পৃথিবীর হলোটা কী? তাইতো, অবাক হওয়ার কিছু নেই…সে স্বাভাবিক ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। উপরের অংশ নিচের দিকে! কী বিপর্যয়! একটু সময়ের জন্য সে কাঁদল মহাশূন্যে পড়ে যেতে থাকা ঐ নিরীহ পৃথিবীবাসীর জন্যে…

    দুজন ক্রু চন্দ্রের প্রতিরোধহীন শরীর সরিয়ে নিচ্ছে; সেও এখন যেন রিক্ত। যখন তারা কাননোকে নিতে ফিরে এলো, ফ্লয়েডের নিজের চোখও বন্ধ। কিন্তু এখনো চলছে শ্বাসপ্রশ্বাস।

    তারপর, লোকজন যখন তাকে নিতে এসেছে, তখন তার শ্বাসপ্রশ্বাসও বন্ধ হয়ে গেছে, অনেকদিনের জন্য।

    ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Article২০৬১ : ওডিসি থ্রি – আর্থার সি. ক্লার্ক
    Next Article দূর পৃথিবীর ডাক – আর্থার সি. ক্লার্ক

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }