Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ২০১০ : ওডিসি টু – আর্থার সি. ক্লার্ক

    লেখক এক পাতা গল্প384 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ২. দ্বিতীয় পর্ব : জিয়াং

    ৬. জাগরণ

    তারা না বলল হাইবারনেশনে স্বপ্ন দেখব না! শুতে না শুতেই… রাগের চেয়ে বেশি অবাক লাগছে… ভাবল হেউড ফ্লয়েড। দারুণ লাল রক্তিমাভা। আর চারদিক কী শান্ত! পরিবেশ দেখে তার বারবিকিউ আর ক্রিস্টমাস ফায়ারে কাঠের গুঁড়ির পটপট শব্দের কথা মনে পড়ে যায়। অবশ্য কোনো উষ্ণতা নেই তার শোয়ার জায়গায়, অন্য কিছু অনুভব করছে যদিও এ ঠাণ্ডা সহ্য করা যায় সহজেই।

    কণ্ঠগুলো গুঞ্জন করছে হালকা, এমন কোমলভাবে যে ফ্লয়েড কথা বুঝতেই পারছে না। আস্তে স্বপ্নের শব্দগুলো আরো বাড়ে কিন্তু সে বিন্দুমাত্র বোঝে না। এরপর হঠাৎ প্রচণ্ড অবিশ্বাসে নিজেকে বলল, আমি রুশ ভাষায় স্বপ্ন দেখতে পারি না!

    তখনো মনের ভিতরে গুমড়ে মরছে কথাটুকু, দর ফ্লয়েদ, দক্তর ফ্লয়েদ!

    না হেউড, উত্তরটা এক মহিলা কণ্ঠের, তুমি স্বপ্ন দেখছ না। সময় এসেছে ঘুম থেকে ওঠার। মানোরম লালচে আভা মিলিয়ে যাচ্ছে। সে চোখ খুলল; মুখের উপর আলোর চমক এলে ক্ষণিক দৃষ্টিতে আবছা দেখা যায় সে শুয়ে আছে গদি আঁটা সিটে, শরীরটা ইলাস্টিক ওয়েবিং বেল্ট দিয়ে বাঁধা আর মানব-মূর্তিগুলো চারদিকে

    দাঁড়িয়ে। কিন্তু তারা ফোকাসের এতটা বাইরে যে চেনা যায় না।

    কার যেন নরম আঙ্গুল নেমে এসে তার চোখের পাতা বন্ধ করে দিয়ে কপাল ম্যাসেজ করছে।

    নিজে নিজে চেষ্টা করো না। গভীরভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস নাও… আবার… ঠিক হচ্ছে… এখন লাগছে কেমন?

    ঠিক জানি না… অদ্ভুত… মাথাটা হালকা হালকা… খুব খিদে।

    ভাল লক্ষণ। কোথায় তুমি তা কি জান? চোখ খুলতে পার এখন।

    মানব মূর্তিগুলো দৃষ্টির ফোকাসে এল-প্রথমে ডাক্তার রুডেস্কো, তারপর ক্যাপ্টেন অর্লোভা। কিন্তু তানিয়াকে এমন লাগছে কেন! মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে বিরাট কোনো পরিবর্তন; কী সেটা… কারণটা বের করে সে ভিতরে ভিতরে খেল– প্রায় একটা ধাক্কা।

    তোমার চুল আগের মতো হল কীভাবে!

    যাক, তোমার চোখে ভাল লাগছে তাহলে! আশা করি তোমার দৃষ্টিতে ব্যাপারটা উন্নতি। আমি কিন্তু তোমার দাড়ি সম্পর্কে একই কথা বলতে পারছি না।

    ফ্লয়েড তার হাতটা মুখে ঠেকায়। বুঝতে পারে তার কথাবার্তার আগে প্রতিবার একটু ভেবে নেয়া উচিত ছিল। চিবুক দু তিন দিনের শক্ত খাটো দাঁড়িতে ঢাকা-সাথে সাথে সব বাদ দিয়ে দিন গুনেছে ফ্লয়েড। হাইবারনেশনে চুল জন্মে একশো দিনে একদিনের সমান…তার মানে পরিবর্তন এসেছে আমার ভিতরেও। সে বলল, আমরা এখন বৃহস্পতিতে!

    তানিয়া বিষণ্ণভাবে তার দিকে তাকায়, এক পলকে ডাক্তারকে দেখে, রুডেঙ্কো মাথা নেড়ে সামান্য সম্মতি দিল। সত্যিটা বলা যায়।

    না হেউড। সে বলল, এখনো একমাসের পথ দূরে। ভয় পেয়ো না-শিপের কিছু হয়নি, সবই ঠিকঠাক। কিন্তু ওয়াশিংটন থেকে তোমার বন্ধুরা আমাদের বলেছে সময়ের আগেই তোমাকে জাগাতে। কিছু হচ্ছে…অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত। আমরা ডিসকভারিতে পৌঁছার প্রতিযোগিতায় নেমেছি, হঠাই-বলতে ভয় হয়, মরতে বসেছি আমরা…হয়ত।

    ৭. জিয়াং

    কমসেট স্পিকার থেকে হেউড ফ্রয়েডের কণ্ঠস্বর ভেসে এলে ডলফিন দুটো হঠাৎ করে পুলের চারদিকে বৃত্তাকারে ঘোরা বন্ধ করে সাঁতার কাটতে লাগল কিনারা ধরে। মাথা উঁচু করে রঙিন আর স্থির চোখে মনোযোগের দৃষ্টিতে তাকায় শব্দটা যেখান থেকে আসছে সেদিকে।

    ক্যারোলিনের এখন শুধুই তিক্ততা। তাহলে এরা হেউডকে চিনতে পেরেছে। এতদিন পরেও! অথচ ক্রিস্টোফার তার খেলার ঝাঁপির চারদিকে হামাগুড়ি দিচ্ছে, মহাশূন্যের আধা বিলিয়ন কিলোমিটার দূর থেকে তার পিতার কণ্ঠস্বর পরিষ্কার হয়ে আসছিল আস্তে আস্তে। অথচ ছবির বইয়ের রঙ কন্ট্রোলারের সাথে খেলা বন্ধ করছে না।

    … প্রিয়তমা, একমাস আগেই আমার কথা শুনে তুমি অবাক হবে না। এক সপ্তাহ ধরে তুমি হয়ত জানো যে আমরা এখানে একা নই।

    এখনো ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, এমন পাগলাটে কাজের মানেটা কী? পৃথিবীতে নিরাপদে ফিরে আসার মতো জ্বালানিও সম্ভবত তারা পাবে না। এমনকি বৃহস্পতি পর্যন্ত কীভাবে যাবে তাও বুঝতে পারছি না আমরা।

    কখনো তাদের দেখিনি। এমন কি কাছে গিয়েও না। জিয়াং পাঁচ কোটি কিলোমিটারের চেয়ে বেশি দূরে। তারা চাইলে আমাদের সংকেতের জবাব দিতে পারে। হাতে প্রচুর সময়। অবাক ব্যাপার, আমাদের যেন চেনেই না! এখন বন্ধুদের নিয়ে খোশ গল্পে ভীষণ ব্যস্ত হয়তো। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তারা বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলে টু মারবে-আর তখনই আমরা দেখব ওদের অ্যারোব্রোকিং সিস্টেম কতটা ভালো কাজ করে। তাদেরটা যদি ঠিকমতো কাজ করে তাহলে আমাদের মনোবলের জন্য ভালোই হবে ব্যাপারটা। আর যদি না পারে-থাক, এ নিয়ে কথা বলা বাদ দেই।

    রাশিয়ানরা আগুপিছু বিবেচনা করে জিয়াংকে বেশ ভাল চোখেই নিয়েছে। প্রথমে তারা অগ্নিশর্মা হয়ে পড়েছিল, সেই সাথে হতাশ-কিন্তু অনেকেই অকপটভাবে নিজের বিস্ময় প্রকাশ করে বসে। ওরা কী করে…! শুধু বুস্টারে স্পেসশিপের বৈশিষ্ট্য দেয়ার আগ পর্যন্ত সারা দুনিয়ার চোখের সামনে তারা বানিয়েছে ঐ জাহাজ। সবচে মজার ব্যাপার, এটাকে মহাশূন্য স্টেশন হিসেবে তারা সবার সামনে চালিয়েছে এতদিন। কেউ ভেবেছে এটা লেজার দুর্গ, কেউ গোয়েন্দা দফতর-কিন্তু কেউ কি কল্পনাও করতে পারে যে আসলে একটা স্পেসশিপ তৈরি হচ্ছিল? দারুণ চালাকি। ওরা বাড়তি শক্তি খরচ করেছে অতিরিক্ত গতির জন্য। আল্লা মালুম, পরিণতি কী হবে।

    যাহোক, আমাদের চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই। আমাদের কাছে তো পৃথিবীর মতো গোদা গোদা টেলিস্কোপ নেই; তাই এত কম দূরত্বে থেকেও ভালভাবে দেখতে পাব না। অবশ্যই আমি আশা করি তারা ডিসকভারিকে একা থাকতে দেবে। ভাগ্যের ইচ্ছা যেন আমি তাদের সাহায্য না করি। ওটা আমাদের সম্পত্তি, এবং আমি নিশ্চিত স্টেট ডিপার্টমেন্ট ঘণ্টায় ঘণ্টায় এ কথাটুকু তাদের মনে করিয়ে দেবে।

    ব্যাপারটা নিশ্চই খুব খারাপ-তবু চৈনিক বন্ধুরা যদি আমাদেরকে সময়ের আগে না জাগাতো তাহলে আরো এক মাস তুমি আমার কথা শুনতে পেতে না। কিন্তু এখন যেহেতু ডক্টর ডেস্কো আমাদের ঘুম থেকে তুলেছে সেহেতু আমি আজ থেকে প্রতি দুদিন অন্তর কথা বলব।

    প্রাথমিক ধাক্কাটা যাবার পর আমি সেরে উঠছি ভালভাবে-জাহাজ আর এর ক্রুদের জানছি, আমার স্পেস ল্যাক খুঁজে পাচ্ছি-যে সময়টা ছিলাম ঘুমিয়ে। বড় ব্যাপার হল আমার বাজে রাশিয়ান বলাটাকে দিতে পারছি দক্ষতা। অবশ্য সেই দক্ষতা ব্যবহার করার প্রচুর সুযোগ নেই-প্রত্যেকে ইংরেজিতে কথা বলছে, রাশিয়ান চর্চা করি কীভাবে? আমরা আমেরিকানরা কী জঘন্য ভাষাবিদ! আমি মাঝে মাঝে আমাদের অন্ধ দেশপ্রেম বা আলসেমির জন্য লজ্জা পাই।

    শিপে ইংরেজির মর্যাদা আছে ঠিকই-চিফ ইঞ্জিনিয়ার শাসা কোভলেভ কাজ করছে বিবিসি ঘোষক হিসেবে। আসলে তুমি যদি যথেষ্ট দ্রুত কথা বলতে পার কিছু ভুল করলেও কোনো ব্যাপার না। জেনিয়া মার্শেঙ্কো খুব সাহসী মেয়ে। শেষ মুহূর্তে ও ইরিনা ইউকুনিনার বদলে উঠেছে। কথায় কথায় শুনে আমি খুশি হয়েছি যে ইরিনা বেঁচে গেছে ভালোভাবেই। হতাশ হওয়ার কিছু নেই। অবশ্য অবাক হব না সে যদি আবারো হ্যাং গ্লাইডিং আরম্ভ করে।

    দুর্ঘটনার কথা বলতে গেলে বোঝাই যায় জেনিয়ার ভাগ্যও খুব একটা ভাল না। প্লাস্টিক সার্জন ভালভাবেই করেছে তার কাজ-তবু যে কেউ বুঝবে যে মেয়েটা কখনো না কখনো মারাত্মকভাবে পুড়েছিল। সে ক্রুদের কাছে যেন শিশু। অন্যরা তার সাথে এমন ব্যবহারই করে। আমি বেচারা বলতে যাচ্ছিলাম ভাল ব্যবহার করে। তার প্রতি সবার মনোভাব নরম।

    ক্যাপ্টেন তানিয়ার সাথে মিলেমিশে চলছি কীভাবে সেটা ভেবে হয়ত অবাক হচ্ছ তুমি। ভাল কথা, আমি তাকে খুব পছন্দ করি।কিন্তু রাগানোর মোটেও ইচ্ছা নেই। কোনো সন্দেহ নেই সে-ই চালায় এ শিপটা।

    আর সার্জন কমান্ডার রুডেঙ্কো-দুবছর আগে হনলুলু অ্যারোস্পেস কনভেনশনে দেখেছ তাকে। আমি শিওর তুমি ঐ শেষ পার্টির কথা ভুলে যাওনি। বুঝতে পারবে কেন আমরা তাকে ক্যাথেরিনা দ্য গ্রেট বলে ডাকি-অবশ্যই তার পে ছ-নে-র বিস্তৃত ইতিহাসের জন্য।

    নাহ, যথেষ্ট পরচর্চা হয়েছে। আমি ওভারটাইম করলে সারচার্জ আশা করতাম। তাছাড়া, এই ব্যক্তিগত কলগুলো পুরোপুরি প্রাইভেট মনে করতে হবে। কিন্তু যোগাযোগে প্রচুর পথ থাকে, অন্য কোনো রুট থেকে মাঝে মধ্যে যদি ম্যাসেজ পাও, ভাল, অবাক হয়ো না।

    আমি থাকলাম তোমার কথা শোনার অপেক্ষায় মেয়েদের বলো তাদের সঙ্গে পরে কথা হবে। তোমাদের সবার জন্য ভালবাসা-ক্রিস আর তোমাকে মিস করি সব সময়। প্রতিজ্ঞা করছি ফিরে এসে আর কখনো যাব না কোথাও। রাগের একটু শব্দ করে পুরোপুরি কৃত্রিম কণ্ঠে বলল, মহাশূন্যযান লিওনভ থেকে সাত হতে শুরু হয়ে চার শত বত্রিশ স্টোকে প্রেরণ শেষ হল।

    ক্যারোলিন ফ্লয়েড স্পিকারের সুইচ বন্ধ করার সাথে সাথে ডলফিনগুলো পুলের নিচে গিয়ে মসৃণ গতিতে ভেসে গেল প্রশান্ত মহাসাগরে; রেখে গেল পানির উপর শুধু মৃদু কয়েকটা ঢেউ। বন্ধুদের চলে যাওয়া বুঝতে পেরে ক্রিস্টোফার কান্না শুরু করেছে। মা তাকে হাতে তুলে চেষ্টা করছে শান্ত করার, কিন্তু কাজ হতে তার অনেকক্ষণ লাগবে।

    ৮. বৃহস্পতির পথে

    অদ্ভুত প্রতিচ্ছবি বৃহস্পতির। গায়ে তুষার রঙা মেঘের ফিতার সাথে স্যামন মাছের গোলাপী কমলা রঙের বিচিত্র মিশেল। বিখ্যাত গ্রেট রেড স্পট বা বিরাট লাল দাগটা ফ্লাইট ডেক প্রজেকশন স্ক্রিনে চেয়ে আছে হিংস্র চোখের মতো। তিন চতুর্থাংশ আলোয় ভরা। কিন্তু কেউ তাকাচ্ছে না আলোকিত চাকতির দিকে। সব চোখ সেঁটে আছে গ্রহরাজের কিনারায়, চিকণ চাঁদের মতো দেখতে অন্ধকারের উপর। গ্রহের রাতের অংশের উপর দিকে চৈনিক স্পেসশিপটা সেই বিখ্যাত সঙ্কটের মুখোমুখি। জিয়াং বাঁচলে লিওনভও আশা পাবে। তারাও আশা করতে পারবে যে বৃহস্পতির পাশ কাটিয়ে গতি কমিয়ে ঐপাশে যাওয়া সম্ভব।

    ফ্লয়েড ভাবল-এত আগ্রহ নিয়ে তাকানোর মানেই নেই। চল্লিশ মিলিয়ন কিলোমিটারের মধ্যে আমরা সম্ভবত কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। তাতে কী, যা জানতে চাই রেডিও আমাদের বলবে।

    দুঘন্টা আগে জিয়াং সব ভয়েস, ভিডিও এবং ডাটা সার্কিট বন্ধ করেছে। লংরেঞ্জ অ্যান্টেনাগুলো তাপ ফলকের প্রটেকটিভ শেডের ভেতর তুলে নিলেই সব ট্রান্সমিশন বন্ধ হয়ে যায়। শুধু সবদিকে অপারেট করা আলো-সংকেত চাইনিজ শিপের দিকে ট্রান্সমিট করা হচ্ছে এখনো। শিপটা ঐ মহাদেশের সমান মেঘ-মহাসাগরে মগ্ন। লিওনভের কন্ট্রোল রুমে কর্কশ বিপ… বিপ… বিপই এখন একমাত্র শব্দ। ঐ স্পন্দনের প্রতিটা দু মিনিটেরও আগে বৃহস্পতির এলাকা ছেড়েছে; তার মানে লিওনভ নজর রাখছে দু মিনিটের পুরনো পরিস্থিতির উপর। এরই মধ্যে এ বিপ গুলোর উৎসটা হয়ত বৃহস্পতির আকাশে বিস্ফোরিত হয়ে ভাস্বর গ্যাসের সাথে সাথে জ্বলছে। কে জানে!

    সংকেত ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। জোরালো শব্দগুলো হচ্ছে বিকৃত। কয়েকটা শব্দ পুরোপুরি হাওয়া হয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসে ধারাবাহিকতা। জিয়াংকে ঘিরে তৈরি হচ্ছে একটা রক্তিম আবরণ, শিপটা বেরিয়ে না আসা পর্যন্ত সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করবে মনে হয়। যদি করে থাকে…

    ম্যাক্স চিৎকার করে ডাকল, পসমত্রি! ওখানে ওটা!

    ফ্লয়েড কিছুই দেখেনি প্রথমে। পরে আলোকিত বৃহস্পতি চাকতির কিনারায় একটু পরেই সে পুঁচকে একটা জ্বলজ্বলে তারা আবিষ্কার করল। বৃহস্পতির আঁধার মুখে কোনো তারা থাকার কথা না। তারাটা একেবারে স্থির। সে জানে এটার অবশ্যই সেকেন্ডে একশ কিলোমিটার বেগে চলাফেরা করছে। আস্তে আস্তে বাড়ছে ঔজ্জ্বল্য। বেশিক্ষণ মাত্রাবিহীন বিন্দুর মতো না থেকে জিনিসটা বড় হতে লাগল। মানুষের বানানো একটা ধূমকেতু বৃহস্পতির রাতের আকাশের ভেতর দিয়ে বিদ্যুতের মতো দ্রুতগতিতে ছুটেছে হাজার হাজার কিলোমিটার লম্বা উজ্জ্বল রেখা পেছনে ফেলে রেখে।

    যোগাযোগের আলো-সংকেত থেকে বিকৃত আর হঠাৎ বেড়ে যাওয়া একটা শব্দ শোনা যাচ্ছে বারবার। তারপর বৃহস্পতির নিজস্ব তেজস্ক্রিয়তার অর্থহীন একমাত্র শব্দ শোনা গেল যা মহাজাগতিক রশ্মি ও সুরের মধ্যে পড়ে। কোনো মানেই নেই এর।

    জিয়াংয়ের আওয়াজ আর শোনা যাচ্ছে না। তবে অদৃশ্য হয়ে যায়নি এখনো। ডিসকভারি থেকে উঠে আসা পুঁচকে স্ফুলিঙ্গটা গ্রহের সূর্যমুখী দিক থেকে বোঝা যায় এমনভাবে চলাচল করছে। তাড়াতাড়ি রাতের পাশে অর্থাৎ সূর্যবিমুখী দিকে হচ্ছে বিলীন। এভাবে যদি জিয়াং যেতে থাকে তবে বৃহস্পতি শিপটার গতি ধ্বংস করে কজায় নিয়ে নেবে। পরের বার দৈত্যাকার বিশ্বের পেছন থেকে যখন উঠে আসবে, জিয়াং হবে বৃহস্পতির অন্য এক উপগ্রহ।

    মিট মিট করে জ্বলছে ফুলিঙ্গ। জিয়াং গ্রহটার বাঁক ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়েছে রাতের পাশে। ছায়া থেকে বেরিয়ে আসার আগে কিছুই দেখা যাবে না। সব ঠিক মতো চললে এক ঘণ্টার ভেতরে বেরুবে জিয়াং। চাইনিজদের মনের জন্য তা হবে খুব দীর্ঘ সময়।

    প্রধান বিজ্ঞানী ভ্যাসিলি অর্লোভ আর যোগাযোগ প্রকৌশলী শাসা কোভালেভের হিসেবে ঘন্টাটা পেরিয়ে গেল খুব তাড়াতাড়িই। ঐ ছোট্ট তারা দেখে ওরা পেয়েছে অনেক শিক্ষা। এর হাজির হওয়া এবং হারিয়ে যাবার খবরাখবর ভয়াবহ। আলোর ডপলার শিফট দিয়েছে জিয়াংয়ের নতুন কক্ষপথের আসল খবরটা। লিওনভের কম্পিউটারগুলো সব চিত্র ধরে রেখেছিল আগেই। বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলে সরণের হার সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণা থাকাই স্বাভাবিক লিওনভের কম্পিউটারে। তার উপর ভিত্তি করে জিয়াংয়ের উঠে আসার সময়ও বের করেছে।

    ভ্যাসিলি কম্পিউটার ডিসপ্লে সুইচ বন্ধ করে চেয়ারে বসে চারদিকে ঘুরে সীট বেল্ট ঢিলা করল। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে বাকিরা। ভ্যাসিলি একটু ভেবে শুরু করল বলা।

    সময়মতো ডিস্টার্ব করতে এসেছ? ওটা বৃহস্পতিকে ঘুরে বেরিয়ে আসবে বেয়াল্লিশ মিনিটের মধ্যে। তোমরা একটু ঘুরতে যাচ্ছ না কেন? সব ঠিকমতো করতে হলে মনোযোগ দিতে হবে। তোমাদের সাথে আবার দেখা হবে পঁয়ত্রিশ মিনিট পর। যাও! যাও! বাজে বন্ধুর দল।

    অবাঞ্ছিত ক্রুরা ইচ্ছা না থাকলেও চলে গেল ব্রিজ থেকে-কিন্তু ত্রিশ মিনিটের কিছুটা আগেই সবাই ফিরে এল ভ্যাসিলির বিরক্তি বাড়াতে। সে তার ধারণার উপর ক্রুদের বিশ্বাসের কমতি দেখে বকুনিও দিল। মজার ব্যাপার, তখনি জিয়াংয়ের সাথে যোগাযোগ রক্ষাকারী আলো-সংকেত বিস্ফোরিত হয়ে লাউড স্পীকারে বেরোল পরিচিত শব্দ; বীপ,..বীপ…বীপ…

    ভ্যাসিলি অবাক হয়েছে, তার বাহাদুরির হিসাবটা ভুল! দুঃখও পেয়েছে কিছুটা। কিন্তু বাকিরা তার ভুলের দিকে খেয়াল না দিয়ে বরং স্পেসশিপটার ফিরে আসার আনন্দে মাতোয়ারা। দ্রুত সেও যোগ দেয় হাততালির খেলায়। ফ্লয়েড দেখেনি কে প্রথম হাততালি শুরু করে। জিয়াং বিদ্রোহী হতে পারে, হয়ত চুরি করতে যাচ্ছে ডিসকভারিকে, কিন্তু তারা সবাই মানব-নভোচারি। বাড়ি যত্তো দূরেই হোক যে কোনো মানুষ যখনই ভ্রমণ করে মহাশূণ্যে-প্রথম জাতিসংঘ মহাশূন্য চুক্তির মহৎ বাণী হিসেবে সে মানবজাতির দূত।

    তারা যদি চাইনিজদের সফলতা নাও চেয়ে থাকে, কখনো তাদের বিপর্যয়ের মুখোমুখি হওয়া কামনা করোনি।

    এর সাথে অবশ্য একটা বড় স্বার্থ জড়িত, ফ্লয়েড ভাবতেও পারেনি। এখন তো লিওনভের নিজের সফল হবার সম্ভাবনাও বাড়ছে, এজন্যেও সবাই খুশি হয়ে থাকতে পারে। জিয়াং প্রমাণ করল অ্যারোট্র্যাকিং ম্যানুভার আসলেই সম্ভব। বৃহস্পতির ডাটা ঠিক; এর বায়ুমন্ডলে অপ্রত্যাশিত এবং সম্ভবত মারাত্মক বিস্ময়ের কিছুই নেই।

    চমৎকার! তানিয়া বলল, আমার মনে হয় অভিনন্দন পাঠানো উচিত। কিন্তু আমাদের অভিনন্দন পেলে তারা প্রাপ্তিস্বীকারও করবে না।

    সাথীদের কয়েকজন তখনো ভ্যাসিলিকে নিয়ে করছে কৌতুক। আর বেচারা তার কম্পিউটারের আউট পুটের দিকে সরল অবিশ্বাসে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে।

    আমি বুঝতে পারছি না! সে বিস্ময়ে বলল, এখনো তাদের বৃহস্পতির পিছনে থাকার কথা। শাসা-তাদের বিকনের গতির একটা রিডিং আমাকে দাও তো!

    আরো একটা শব্দহীন ডায়ালগ ঢোকানো হল কম্পিউটারে, তারপর ভ্যাসিলি দিল একটা লম্বা নিচু স্বরের শীষ, কোথায় যেন ভুল হচ্ছে। তারা একটা বন্ধ কক্ষপথে, ভাল-কিন্তু এ অর্বিটটা তাদের ডিসকভারির কাছে যেতে দেবে না। যে কক্ষপথে তারা এখন আছে এটা তাদের নিয়ে যাবে আইও থেকে দূরের পথে। আবার পাঁচ মিনিটের জন্য খুঁজে পেলে আমি ঠিক ডাটা পাব।

    যত যাই হোক তাদের অবশ্যই নিরাপদ অর্বিটে থাকতে হবে, তানিয়া বলল, পরে ঠিক করা যায় অর্বিটের কোথাও গন্ডগোল থাকলে।

    সম্ভবত। কিন্তু ঠিক করতে গেলে কয়েকটা দিনের অপচয় হয়। তাদের জ্বালানি থাকলেও এ কাজ করার সাহস পাবে না। আমার এমনটাই মনে হচ্ছে।

    সুতরাং আমরা এখনো তাদের নিয়ম মাফিক টোকা দিতে পারি।

    এত্তো আশা না করাই ভাল। আমরা এখনো বৃহস্পতি থেকে তিন সপ্তাহ পিছিয়ে। পৌঁছার আগেই ওরা এক ডজন কক্ষপথ গড়ে নিতে পারে আর ডিসকভারির সংকেত স্থানের জন্য সবচে সুবিধাজনক অর্বিটটা বেছে নিতেও পারে।

    মনে হয় ওদের হাতে অনেক জ্বালানি।

    অবশ্যই। এবং তা এমন কিছু যা ধারণা করে আমরা শুধু শিক্ষা নিতে পারি।

    এসব কথাবার্তা এমন দ্রুত এবং উত্তেজনাপূর্ণ রাশিয়ান ভাষায় বলা হল যে ফ্লয়েড পড়ে গেল অনেক পেছনে। তানিয়ার মায়া হয় বেচারা ফ্লয়েডের জন্য। সে ব্যাখ্যা করল যে জিয়াং অনেক দূরে চলে গেছে। বাইরের উপগ্রহের কাছাকাছি একটা অর্বিট; তার মানে বৃহস্পতিকে কেন্দ্র করে বিশাল এক কক্ষপথে ঘুরছে মহাকাশযানটা। সব শুনে ফ্লয়েডের প্রথম প্রতিক্রিয়া হল, তারপর মারাত্মক বিপদে পড়তে পারে। তারা যদি সাহায্যের আবেদন জানায় কী করবে তুমি?

    ঠাট্টা করছ, না? তারা সাহায্য চাইবে তুমি ভাবলে কী করে? ওরা খুব অহংকারী। যাহোক, অসম্ভব। আমরা সাহায্য করতে পারি না, তুমি তো ভালই জান। আমাদের জ্বালানি থাকলেও…।

    অবশ্যই। তোমার কথাই ঠিক। তবে মানব জাতির নিরানব্বই শতাংশ অরবিটাল মেকানিক্স বোঝে না। তাদের কাছে অসহযোগিতার কারণ ব্যাখ্যা করা এক কঠিন ব্যাপার। তারা চিৎকার করে গলা ফাটাবে, লিওনভ কেন জিয়াংকে সাহায্য করতে যায়নি এত কাছে থেকেও! রাজনৈতিক জটিলতা নিয়েও আমাদের চিন্তাভাবনা শুরু করা উচিত-সাহায্য করতে না পারলে ব্যাপারটা আমাদের সবার জন্যই খারাপ দেখায়। ভ্যাসিলি, তোমার কাজের আউটপুট পাওয়ার সাথে সাথে আমাকে তাদের শেষ কক্ষপথটার বর্ণনা দেবে?

    আমি একটু হুক ওয়ার্কের জন্যে নিচে নামার কেবিনে যাচ্ছি।

    ফ্লয়েডের কেবিন, বরং বলা ভাল কেবিনের এক তৃতীয়াংশ তখনো স্টোরের মালামালে ভর্তি। সেখানটার বেশিরভাগই পর্দায় ঢাকা বাংক। বোধ হয় চন্দ্র আর কার্নো লম্বা ঘুম থেকে জেগে উঠলে তাদের দখলে যাবে বাংকের জায়গাটা। ফ্লয়েড নিজের স্বার্থে কাজের কিছুটা ক্ষেত্র পরিষ্কারের ব্যবস্থা করল এমনকি অন্য একটা

    দুঘন মিটার স্থান দখলের আশা করল যেটা তার দরকার নেই। স্রেফ যখনই কেউ। ফার্নিচারগুলো সরাতে তাকে সহায়তা করবে তখনি সেটুকুর দখল আসছে।

    ফ্লয়েড আনলগ করল তার ছোট কমিউনিকেশন ক্যাবিনেট, ডিজঅ্যাব্রাপশন কি বসিয়ে জিয়াংয়ে পাঠানো ওয়াশিংটনের খবরের জন্য কল করল। সে ভয় পাচ্ছে, খবরটা হয়ত অন্য রিসিভাররাও ডিকোড করে পড়ে ফেলবে। সাইফারটাদুশ ডিজিট মৌলিক সংখ্যার গুণফলের উপর বানানো। জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা তার সুনামের উপর বাজি ধরেছে এ দাবি করে যে তারা আসল সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে দ্রুততম কম্পিউটারও এতে ফাটল ধরাতে পারবে না-আফসোস, এ এমন এক দাবি যা কখনো প্রমাণ করা যাবে না।

    সে আরেকবার মনোযোগ দিয়ে চাইনিজ শিপের চমৎকার ছবির দিকে তাকায়। এটা যে স্পেসশিপ সে খবর বেরিয়ে যাবার পর ভোলা হয় ছবিটা। ঠিক পৃথিবীর কক্ষপথ ছাড়ার মুহূর্তে তোলা। পরে নেয়া হয় আরো শট-তেমন পরিষ্কার আসেনি, কারণ ততক্ষণে এটা প্রাইং ক্যামেরা থেকে অনেক দূরে চূড়ান্ত স্তরে বৃহস্পতির দিকে প্রচণ্ড বেগে বেরিয়ে যাচ্ছে। ঐ ছবিগুলো তাকে সবচে বেশি উৎসাহ দেয়। আরো দরকারি ব্যাপার হল কেটে ফেলা ড্রয়িং আর তাদের কৃতিত্বের দামটা বিচার করা।

    সবচে নির্ভরযোগ্য সম্ভাবনাটাই মেনে নেয় সবাই; আসলে চাইনিজরা কী করতে চাচ্ছে তা বোঝা মুশকিল। সৌর জগতে আড়াআড়ি পথে পাগলের মতো তারা এসেছে, যাতে লিওনভকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়া যায়। তাদের নব্বই ভাগ প্রোপ্যাল্যান্ট শেষ। ফিরবে কী করে! অন্যদিকে লিওনভ পৃথিবীর আকর্ষণ ছাড়ার পরই বন্ধ করে জ্বালানি পোড়ানো। পুরোপুরি সুইসাইড মিশন না হলে শুধু হাইবারনেশনের পরিকল্পনা হতে পারে। পরে উদ্ধার করতে পারে অন্য কোনো চৈনিক তরী। ফ্লয়েডের মন বিশ্বাস করে না চাইনিজ হাইবারনেশন টেকনোলজি টিকে থাকার মতো উন্নত। এ ব্যাপারে ওরা বরাবর ভুল করে। এমনকি কাঁচা ঘটনার তুবড়ি মেরে এর তথ্য সার্কিটে গোলমাল খুঁজতে গিয়ে প্রায়ই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হতে হয়েছিল একে। আচ্ছা! জিয়াংয়ে একটা দারুণ কাজ করেছে দ্রুত আসার পরিকল্পনাটা-তা হলো সময়ের স্বল্পতা বিবেচনা করা। ওরা আসলেই হাইবারনেশনে যায়নি বলেই হয়ত ক্রুদের জীবনের দু মাস বাঁচাতে এসেছে এত দ্রুত। ফ্লয়েড আশা করে তার কাছে পাঠানো বিষয় আরও যত্নের সাথে ফিল্টারিং করা উচিত ছিল। এ বিশাল ডাটার অনেক অংশই মিশনের ক্ষেত্রে আবর্জনা।

    তবু, যা খুঁজেছিল তা যখন জানতে পারেনি, আন্দাজে কিছু না বলাই ভাল। কোনো ব্যাপার প্রথমে অবাস্তব বা অর্থহীন মনে হলেও শেষে মাঝেমধ্যে তা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না।

    একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফ্লয়েড আরেকবার দ্রুত পাঁচশ পৃষ্ঠার ডাটার উপর চোখ বুলিয়ে যায়। ডায়াগ্রাম, চার্ট, ফটোগ্রাফের মধ্যে কোনো কোনোটা এমন ঝাপসা দাগ ওয়ালা যে প্রায় যে কোনো কিছু হিসেবে বিক্রি হতে পারে। নিউজ আইটেম, সায়েন্টিফিক কনফারেন্সের প্রতিনিধির তালিকা, টেকনিক্যাল প্রচারণার টাইটেল এবং এমনকি বড় বড় সিদ্ধান্ত নেয়ায় এক কমার্শিয়াল ডকুমেন্ট এটা। গুপ্তচরবৃত্তি এক নিপুণ শিল্প। এ শিল্প এখন মারাত্মক ব্যস্ত। বোঝাই যায় ওরা অনেক জাপানী হলোমেমরি মডিউল বা সুইস গ্যাস-ফ্লো মাইক্রোকন্ট্রোলার বা জার্মান তেজস্ক্রিয়তা ডিটেকটরগুলোর শুকনো লেকের মধ্যে গন্তব্যের খোঁজ করে থাকতে পারে। তারা হাইবারনেশনে পাঠাবে না, আত্মহত্যা করবে না, আসার পথেই ৯০% জ্বালানি শেষ করেছে, আর মাত্র একটা পথই খোলা…এ এলাকাতে তাদের প্রোপ্যাল্যান্ট আছে! তবে কি বৃহস্পতির পথে এটা তাদের প্রথম মাইল ফলক নয়?

    রিপোর্টটাতে কিছু আইটেম কাকতালীয়ভাবে জড়িয়ে পড়েছে মিশনের সাথে যেগুলোর সম্পর্ক নেই। চাইনিজরা যদি সিঙ্গাপুরের কোনো অস্ত্র বা বিজ্ঞান সংস্থার মাধ্যমে আমেরিকায় এক হাজার ইনফ্রারেড সেন্সরের জন্যে কোনো গোপন অর্ডার দিয়ে থাকে, তা শুধুই সামরিক। এটা যে লেসার দুর্গ নয় বরং স্পেসশিপ তাতে প্রমাণ হলোই। লেজারের কথা এ রিপোর্টে ক্যান রে বাবা! খুবই অস্বাভাবিক! জিয়াং হিট সিকিং মিসাইলের পেছনে দৌড়াতে চায়। অথচ হিট সিকিং মিসাইল তৈরি করা হয় আকাশ যানের পেছনে ছোটার জন্য। অথবা এংকরেজ, আলাস্কা আর গ্লোসিয়ার জিওফিজিক্স প্রতিষ্ঠান থেকে বিশেষজ্ঞ আর যন্ত্রপাতি চাওয়াটা আসলে ধোকাবাজি। কোন্ ঢিলা মাথা ভেবেছে যে গভীর মহাশূন্য অভিযানে কোনো দরকার থাকতে পারে–

    মৃদুহাসি ফ্লয়েডের ঠোঁটেই জমে গেল। ঘাড়ের পেছনে চামড়ার হামাগুড়ি বুঝতে পারে সে। মাই গড! তারা কি ঝুঁকি নেয়নি? এতবড় সাহস! আচ্ছা, এতক্ষণে পরিষ্কার হয়ে গেল সবকিছুর অর্থ।

    ছবিগুলোর পেছনে উল্টে দেখে ফ্লয়েড। অনুমান করে চাইনিজ শিপের পরিকল্পনা। হ্যাঁ, এটা স্রেফ কল্পনা-ড্রাইভ পরিবর্তন ইলেকট্রোডগুলোর পাশের ও পেছনের থামের মতো জিনিসগুলোর আকার তাকে ধাঁধায় ফেলে।

    ফ্লয়েড ব্রিজে কল দিল, ভ্যাসিলি, তুমি কি তাদের কক্ষপথ বের করেছ?

    হ্যাঁ। নাবিক উত্তর দিল একদম সংযত কণ্ঠে। যেন এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ফ্লয়েড সাথে সাথে বলল যে তাদের ফুয়েল সমস্যার সমাধান দেখা যায়। সে চেষ্টা করল সমাধান করার।

    তারা ইউরোপার সাথে সিগন্যাল প্লেস তৈরি করছে, তাই না?

    অন্য প্রান্ত থেকে বিস্ফোরণের মতো হাঁপানোর একটা শব্দ এল।

    আশ্চর্য! এমন বেমক্কা কাজের খবর তুমি কীভাবে জানলে?

    জানিনাতো-স্রেফ অনুমান।

    কোনো ভুল থাকার কথা নয় ভ্যাসিলির মনে পড়ে যায় কত বড় হাস্যকর ভুল করেছে একটু আগে,– আমি ছটা জায়গায় জিয়াংয়ের ফিগার চেক করলাম। তাদের ব্রেকিং ম্যানুভারের সমস্যা মনে করি যেটাকে সেটা হয়ত সমস্যা না। সমাধান। তারা ইউরোপার পথে-ব্যাপারটা কাকতালীয় নয়। সতের ঘণ্টার মধ্যে সেখানে পৌঁছবে।

    এবং কক্ষপথে ঢুকবে।

    সম্ভবত; এজন্য বেশি এনার্জি খরচ হবে না। কিন্তু ব্যাটাদের মতলব কী? ভ্যাসিলি এখনো খাবি খাচ্ছে।

    আমি আরেকটা আন্দাজের ঝুঁকি নিই? দ্রুত সার্ভে করবে এবং তারপর নামবে।

    ক্ষেপেছ নাকি? এক মিনিট! তুমি এমন কিছু জানো যা আমরা জানিনা-ঠিক?

    না। এ সম্ভাবনাটা সহজেই বাদ দেবার মতো নয়। তুমি নিজের পায়ে কুড়াল মারা শুরু করবে। চালবাজের মতো এখনো বলে চলছে ফ্লয়েড।

    ঠিক আছে, শার্লক হোমস! তারা কোন উসিলায় ইউরোপায় নামতে চাইতে পারে? ঈশ্বরের দোহাই, কী আছে সেখানে?

    ফ্লয়েড তার বিজয়ের ছোট মুহূর্তটাকে এনজয় করছে। অবশ্যই, সে বসে আছে। এখনো ভুল-সঠিকের মধ্যিখানে।

    ইউরোপায় কী আছে? সামান্য জিনিস। জগতের সবচে মূল্যবান পদার্থ।

    সে অতিরঞ্জিত করলেও ভ্যাসিলি বোকা নয়। ফ্লয়েডের ঠোঁট থেকে উত্তরটা কেড়ে নিল।

    অবশ্যই-পানি!

    ঠিক। এবং বিলিয়ন বিলিয়ন টন। প্রোপ্যাল্যান্ট ট্যাংকগুলো ভরার জন্য যথেষ্ট ঐ পানি। জ্বালানি কম খরচ করে সব উপগ্রহের চারদিকে ঘুরে বেড়াও। ডিসকভারির অবস্থান আর নিজের বাড়ির দিকে অভিযানের জন্যে অনেক পথ বাকি। আমি এ কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছি, ভ্যাসিলি-কিন্তু আমাদের চাইনিজ বন্ধুরা চাতুরীতে আবারো আমাদের ছাড়িয়ে গেছে।

    সব সময় পার পায়। অবশ্যই, এবারও তারা পার পেয়ে যাবে।

    ৯. গ্র্যান্ড ক্যানেলের বরফ

    চকচকে কালো আকাশ ছাড়া এমন একটা ছবি পৃথিবীর মেরু অঞ্চলের যে কোনো জায়গায় তোলা যায়; দিগন্তের ছেড়ে যাওয়া সব পথে কুঁচকে যাওয়া বরফের সাগর মোটেই অন্যরকম নয়। শুধু অন্যরকম দৃশ্যটা হল-মহাশূন্য পোশাক পরা পাঁচটা মানব-মূর্তি সামনে থেকে বলছিল যে সামনের দৃশ্যটা আরেক পৃথিবীর।

    এখনো চীন আগের পথেই চলে। দরকারি-অদরকারি সব কথাই গোপন রাখে। ক্রুদের নামও প্রকাশ করেনি। ইউরোপার জমে যাওয়া বরফের আবরণের উপর নামহীন অনাহুত প্রবেশকারীর সংখ্যা স্রেফ পাঁচজন। প্রধান বিজ্ঞানী, কমান্ডার, নাবিক, প্রথম প্রকৌশলী, দ্বিতীয় প্রকৌশলী। এ এক রকমের আঘাত, ফ্লয়েড ভাবতে পারছে না যে লিওনভে ঢোকার একঘণ্টা আগে পৃথিবীতে প্রত্যেকে খুব কাছে থেকে ঐ ঐতিহাসিক ছবি দেখেছিল। কিন্তু জিয়াংয়ের ট্রান্সমিশন আলোর এমন সংকেতের মাধ্যমে পাঠানো হয় যে এদের কাজে নাক গলানো অসম্ভব ব্যাপার। লিওনভ শুধু আলোক সংকেত রিসিভ করতে পারে আর সব দিকে প্রচার করে, ব্যস। বুঝতে পারে না কিছুই। এমনকি সেই সংকেতও বেশিরভাগ সময় শোনা যায়নি; ইউরোপার ঘূর্ণন একে দৃষ্টির আড়ালে নিয়ে গেছে, বা উপগ্রহটা নিজে বৃহস্পতির ভয়ংকর গ্রহণে পড়েছে। চাইনিজ মিশনের সব খবর পেতে হয়েছে পৃথিবী থেকেই।

    প্রাথমিক জরিপের পর কিছু কঠিন পাথুরে দ্বীপের একটাতে জাহাজ ভোরের আলোকে ছুঁয়ে দেখল। দ্বীপটা বরফের শক্ত আবরণের বাইরে বেরিয়ে আছে, পুরো চাঁদকে ঘিরে ফেলেছে ঐ কঠিন পানি। বরফ মেরু থেকে মেরুতে সমতল। এ জমাট জলকে খোদাই করার জন্যে কোনো রোদ-বৃষ্টি-ঝড় কিছুই নেই ইউরোপায়। আস্তে আস্তে চলমান পাহাড়ে রূপান্তরের জন্যে স্তরের পর স্তর গড়ার জন্যে স্রোতে বা বাতাসে ভাসমান বরফ নেই। বায়ুশূন্য ইউরোপায় উল্কাপিণ্ড পড়ে থাকতে পারে কিন্তু কখনো বরফের টুকরো নয়। সব উচ্চতাকে কমিয়ে এক স্তরে এনে উপরের অংশকে ছাঁচে ঢালাই করার জন্যে একমাত্র শক্তি হল অভিকর্ষের টান। অন্য উপগ্রহগুলো ইউরোপাকে বারবার পেরিয়ে যাবার কারণে তৈরি বিরামহীন কম্পনও এ বরফ স্তর সমান করার জন্য দায়ী। সবচে বড় কথা, বৃহস্পতির প্রভাবও পড়ে। গ্রহরাজের টানে আসা জোয়ার ফুরিয়েছে অনেক অনেক কাল আগে, আজ এ বরফের রাজ্যে কোনো জোয়ার নেই। ইউরোপা তার দৈত্য প্রভুর দিকে এক মুখ ঘুরিয়ে তালাবদ্ধ হয়ে আছে চিরতরে। যেন বৃহস্পতিই এর রক্ষাকবচ।

    এসব জানা যায় উনিশশো সত্তুরের অভিযানে ভ্রমণকারীদের ওড়া থেকে, উনিশো আশির গ্যালিলিও৫৩ জরিপ আর উনিশো নব্বইয়ের কেপলার ল্যান্ডিং থেকে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যে চীনারা আগের সব মিশনের চেয়ে বেশি শিখেছে, জেনেছে ইউরোপা সম্পর্কে। জ্ঞান তারা তাদের মধ্যেই রাখবে; কেউ অনুতপ্ত হতে পারে এ কাজ করায়, কিন্তু সত্যি কথা হল, খুব কম লোকই এসব ব্যাপার বাইরে প্রচারের অধিকার পায়।

    অনেক তীব্রভাবে ব্যাপারটা অস্বীকার করা হত। উপগ্রহ অধিকার করার অধিকার। ইতিহাসে প্রথম বারের মতো একটা জাতি অন্য এক পৃথিবীর কাছে দাবী পেশ করেছে, এবং পৃথিবীর সব সংবাদ মাধ্যম আইনি অবস্থানে থেকেই ভিন্নমত জানিয়েছে। পুরো ব্যাপারটা বিরক্তিকর। শেষে চাইনিজরা মুখের উপর বলে দিল যে তারা কখনো ০২ ইউ এন মহাশূন্য চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। তাই জাতিসংঘের শর্ত মানতেও বাধ্য নয়। সবাই রেগে গিয়ে প্রতিবাদ করলেও তারা থেকেছে নিজের মতো। আসলে ইউরোপাকে চাইনিজ কলোনি বানানোর প্যানপ্যানানির পেছনের অন্য উদ্দেশ্যটা কেউ আঁচও করতে পারেনি।

    হঠাৎ ইউরোপা সৌর জগতের সবচে বড় খবর হয়ে দাঁড়ালো। মনে হয় স্পটে উপস্থিত মানুষের বিরাট চাহিদা আছে।

    .

    বৃহস্পতির পথে এলেক্সি লিওনভ থেকে বলছি কসমোনট হেউড ফ্লয়েড। তোমরা বেশ কল্পনা করতে পার, পার গুজব তুলতে-তাই আমাদের সব চিন্তা ভাবনা এ মুহূর্তে ঝুঁকে পড়েছে ইউরোপার উপর।

    ঠিক এখন আমি এর দিকে তাকিয়ে আছি। আমার চোখে জাহাজের সবচে শক্তিশালী টেলিস্কোপ। তোমরা খালি চোখে চাঁদকে যেমন দেখো তারচে দশগুণ বড় দেখাচ্ছে বরফ-রাজ্যকে। আসলেই, বড় রহস্যময় দৃশ্য।

    উপরের অংশ গোলাপী, সমতল। তার মধ্যে কলঙ্কের মতো কয়েকটা ছোট বাদামি দাগ। সুতায় বোনা জালের মতো, কোঁকড়ানো আর সব দিকে যেন বুনন দিয়ে ঢাকা। আসলে মেডিক্যাল টেক্সটবুকে দেখানো শিরা আর ধমনীর প্যাটার্নের ছবির মতো দেখায় একে। এ সব দাগের কয়েকটা শত শত-বা হাজার হাজার কিলোমিটার লম্বা। দেখতে যেন রহস্যময় খাল। যাকে বলে পারসিভাল লোয়েলের নালা। বিশ শতকের প্রথম দিকের অন্যান্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা কল্পনা করেছিলেন যে তারা দেখেছেন মঙ্গলগ্রহের খাল।

    কিন্তু ইউরোপার নালাগুলো মিথ্যা নয়। আরো একটা কথা, এগুলো অবশ্যই প্রাকৃতিক। আর কী, এগুলোয় পানি বইছে। অন্তত বরফ। সেজন্য উপগ্রহটা গড়ে পঞ্চাশ কিলোমিটার গভীর মহাসাগর দিয়ে প্রায় পুরোপুরি ঢাকা। সূর্য থেকে বহু দূরে বলে ইউরোপার পিঠের তাপমাত্রা খুবই কম। হিমাঙ্কের প্রায় একশ পঞ্চাশ ডিগ্রী নিচে। সুতরাং কেউ আশা করতে পার যে এর এক একটা মহাসাগর বরফের একটা শক্ত টুকরো। এমন হতেই পারে।

    অবাক করা কথা হলেও ব্যাপার তা নয়। প্রচুর তাপ জনে ইউরোপার ভেতরে। জোয়ারের কারণে প্রতিবেশী আইওর আকর্ষণ এ তাপগলা পানিকে নাড়িয়ে রাখে সারাক্ষণ। আইওর দানব আগ্নেয়গিরির শক্তিও এ পানিকে গলিয়ে রাখে। তাই বরফ গলে, ভাঙে আবার জমেও যায়। ফাটল ধরে সব সময় আমাদের পৃথিবীর স্তরের মতো পথও হয় তৈরি। ফাটলের ঐ জটিল নকশা আমি দেখছি এখন। খাদগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই প্রাচীন, আঁধারে ছাওয়া। সম্ভবত শতকোটি বছরের পুরনো। কিন্তু কয়েকটা প্রায় পুরোপুরি সাদা। এগুলো নতুন। কোনো কোনোটা গড়ে উঠছে ঠিক এ মুহূর্তে। মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার ঘন কঠিন স্তরও আছে কোথাও কোথাও।

    জিয়াং নেমেছে তেমনি এক সাদা আঁকাবাঁকা দাগের ডান পাশে-পনেরোশ কিলোমিটার লম্বা সেই খালটা। নাম গ্র্যাণ্ড ক্যানেল। ধরা যায় চৈনিকরা তাদের প্রোপ্যাল্যান্ট ট্যাংকে এখান থেকেই পানি তোলার আশা করে। বৃহস্পতির উপগ্রহ জগৎ খুঁটে দেখতে পাবে তাহলে। শেষে পৃথিবীতেও ফিরে যেতে পারে। বিদঘুঁটে এলাকাটায় সহজে ল্যান্ড করা সম্ভব না। কিন্তু বিধি বাম, তাদের শিপ ল্যান্ড করার মতো করেই বানানো। নিশ্চই যত্নের সাথে ল্যান্ডিং সাইট দেখে নিয়েছে আগেভাগে। কী করতে চলল তাও নিশ্চই তাদের জানা।

    কেন তারা ফুয়েল শেষ করার এমন ঝুঁকি নিল তা এখন পরিষ্কার। কেন তারা ইউরোপার দখল দাবী করছে অনেক আগে থেকে তাও বোঝা যায়। এ স্থান বৃহস্পতিতে আসার জন্য যত জরুরি, তারচে বেশি জরুরি সৌর জগতের বাইরে মিশন পরিচালনার জন্য। পৃথিবী থেকে এ পর্যন্ত এলেই সৌর জগতের অনেকটা পেরুনো হয়, এখান থেকে আবার প্রোপ্যাল্যান্ট নিলেই হল, ঘাঁটি গেড়ে বসতেও দোষ নেই। গ্যানিমিডে পানি থাকলেও ওটা পুরোপুরি জ্যাম হয়ে আছে আর সবসময় ঢোকাও যায় না। উপগ্রহের অভিকর্ষ শক্তিও এক সমস্যা।

    আরো একটা পয়েন্ট এইমাত্র আমার মনে পড়ল। চৈনিকরা ইউরোপার উপর ভিড়তে পারলেও তাদের জীবন বাঁচানোর মতো সামর্থ্য থাকতে হবে, অন্তত যে পর্যন্ত উদ্ধার অভিযানের ব্যবস্থা না করা যায়। তাদের প্রচুর শক্তি আছে, স্যাটেলাইট এলাকায় প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ থাকতে পারে-এবং আমরা জানি চীনারা কৃত্রিম খাদ্য বানানোয় পারদর্শী। হয়ত খুব বিলাসবহুল জীবন কাটানো হবে না, কিন্তু আমার কিছু কাজপাগলা বন্ধু আছে যারা এ জীবন খুশি মনে গ্রহণ করবে। তারা যে শুধু দেশপ্রেম বা বিজ্ঞানপ্রেম বা ক্যারিয়ারের স্বার্থ অথবা অ্যাডভেঞ্চারের আশায় এই কষ্টকর জীবন মেনে নেবে তা নয়। বরং তারা তাদের পছন্দের কাজই করবে; এ এক নেশা, ভয়ংকর নেশা। বৃহস্পতির বিখ্যাত রহস্য-কুয়াশা ভেদ করতে এলোমেলোভাবে আকাশে ছড়িয়ে পড়ার জন্যে তারা বোধহয় তৈরি। কিছুদিনের মধ্যে আমরা স্বয়ং সে দৃশ্য দেখব বলে আশা করছি।

    অ্যালেক্সি লিওনভ থেকে হেউড ফ্লয়েড বিদায় জানাচ্ছি আমার বন্ধুদের।

    এবং ব্রিজ থেকে বলছি। দারুণ! সুন্দর উপস্থাপনা, হেউড। তোমার সাংবাদিক হওয়া উচিত ছিল।

    আমার অভ্যাস আছেরে ভাই। জীবনের অর্ধেকটাই কেটে গেল পি আর ওয়ার্কে।

    পি আর?

    পাবলিক রিলেশন-সারা বছর রাজনীতিক আর মিডিয়ার লোকরা প্রশ্ন করত কেন আমাকে প্রজেক্টে বেশি টাকা দেয়া হয়। কেন মহাকাশ সংস্থা বসে বসে খায়, কেন লোক ছাঁটাই করে না…বাপরে! এ নিয়ে তোমার চিন্তায় পড়ার কিছু নেই।

    আশা করি সত্যি। যাহোক, ব্রিজে এসো। নতুন কিছু ডাটা আসায় তোমার সঙ্গে পরামর্শ করতে চাচ্ছি আমরা।

    ফ্লয়েড মাইক্রোফোনের বোতাম সরালো, জায়গামতো টেলিস্কোপ তালা মেরে দেখার ছোট্ট ধাতব জিনিসটার নাগপাশ থেকে মুক্ত করল নিজেকে। জায়গা ছাড়ার সাথে সাথে একই কাজে বেরুনো নিকোলাই টার্নোভস্কির সাথে প্রায় ধাক্কা খেল।

    নিকোলাই সপ্রতিভভাবে বলে ওঠে, তোমার দারুণ বর্ণনাটা রেডিও মস্কোর জন্য চুরি করছিলাম, উডি। আশা করি কিছু মনে করবে না।

    ইউ আর ওয়েলকাম, টোভারিশ, যাহোক, আমি কি তোমার চৌর্যবৃত্তি ঠেকাতে পারতাম? কীভাবে?

    ব্রিজের উপর ক্যাপ্টেন অর্লোভা শব্দের ঘন তূপের দিকে একবার তাকাচ্ছে, আরেকবার মেইন ডিসপ্লের উপর ফিগারের দিকে। বেচারির মুখটা শুকনো। ফ্লয়েড ব্যাপারগুলোর অর্থ বের করা শুরু করছে। কাজটা বিরক্তিকর। সে তাকে বাধা দিল, বিস্তারিত বর্ণনার জন্যে চিন্তা করো না। জিয়াংয়ে ট্যাংক রিফিল করা এবং উঠে আসার প্রস্তুতি নেবার জন্যে কতটা সময় দরকার শব্দগুলো সেটাই দেখায়।

    আমার লোকজন একই ক্যালকুলেশন করার কাজে ব্যস্ত। কিন্তু এখানে দেখি উল্টোপাল্টা অনেক কিছু ভর্তি। পাল্টানো দরকার। মনে হয় এসব ভুলের একটাকে দূর করলাম একটু আগে। তুমি কি জানো যে সবচে ভাল পানি পাম্প কিনতে পারবে শুধু ফায়ার ব্রিগেডের জন্য? শুনে অবাক হবে নাকি, বেইজিং কেন্দ্রীয় স্টেশনে লেটেস্ট মডেলের তেমন চারটা পাম্প ছিল? হঠাৎ করে ওগুলোকে বাজেয়াপ্ত করেছে সরকার। ফায়ার ডিপার্টমেন্ট মেয়রের অধীন নয়, তাও এ কাজে স্বয়ং বেইজিং সিটির মেয়র বাধা দেয়। সরকারের ছিনিয়ে নেয়া ঠেকানো যায়নি।

    অবাক হইনি-শুধু মন আরো খারাপ হল; সন্তুষ্ট হতে পারছি না। চালিয়ে যাও প্লিজ। বলল ফ্লয়েড।

    হতে পারে কাকতালীয় ব্যাপার। কিন্তু ঐ পাম্পগুলোই স্পেসশিপ…বিশেষ করে জিয়াং স্পেসশিপের পানি সংগ্রহের জন্য হবে ঠিক আকারের। পাইপ ছড়ানোর ঠিক ধারণা নেয়া, বরফের মধ্য দিয়ে ছিদ্র করা এবং এমন আরো কিছু কাজ ঠিক আছে, মনে হয় তারা পাঁচ দিনের মধ্যে আবার শিপকে আকাশে তুলতে পারবে।

    পাঁচ দিন!

    যদি তাদের ভাগ্য ভাল হয় আর সব কিছু ঠিকমতো কাজ করে; যদি তাদের প্রপ্যাল্যান্ট ট্যাংকগুলো ভরতে দেরি না করে। যদি আমাদের আগে ডিসকভারির সাথে নিরাপদ কন্টাক্ট প্লেসে পৌঁছার জন্যে যেটুকু প্রয়োজন স্রেফ সেটুকু ভরে নেয়। এমনকি যদি মাত্র একটা ঘণ্টার জন্য আমাদের টোকা দেয়, ফেলে দেয় পেছনে…তাই যথেষ্ট। ওরা তারপর ডিসকভারিকে আমাদের হাতে ছেড়ে দেবে। আমরা গিয়ে দেখব স্পেসশিপ ভো ভো। ওরা দাবী করবে যে বেশিকিছু উদ্ধার করতে পারেনি। ব্যস!

    কিন্তু ফ্লয়েড আশা ছাড়ার মানুষ নয়, স্টেট ডিপার্টমেন্টের আইনজ্ঞদের মতো কিন্তু ভিন্ন। ঠিক মুহূর্তে, তারা যাওয়ার আগেই আমরা ঘোষণা দেব যে ডিসকভারি পরিত্যক্ত নয়, শুধু পার্ক করা। পার্ক করা থাকবে যে পর্যন্ত আমরা উদ্ধার করতে না পারি। জাহাজটা দখলের যে কোনো চেষ্টা হবে স্রেফ জলদস্যুতা।

    আমি শিওর এত পথ পেরিয়ে এসে এত নরম নরম কথা শুনেই চীনারা যাবে পিছিয়ে! হাহ্! অত্যন্ত ইমপ্রেসড হবে।

    না হলে আর কী করতে পারি?

    আমরা কিন্তু সংখ্যায় তাদেরচে অনেক বেশি। ওদের প্রত্যেকের জন্য দুজন করে। শুধু চন্দ্র আর কার্নোর জ্ঞান ফিরিয়ে আনব। তানিয়ার কথা ভাবলেশহীন।

    তুমি কি সিরিয়াস? জাহাজে জলদস্যুদের সাথে লড়াই করার তলোয়ার কোথায়?

    তলোয়ার?

    সোর্ড-অস্ত্র?

    তানিয়া নিজের অস্ত্রের বর্ণনা দিল, ওহ। আমরা লেসার টেলিস্পেকট্রোমিটার ব্যবহার করতে পারি। ওটা এক মিলিগ্রাম গ্রহাণুকেও বাস্প করে দেবে। রেঞ্জ এক হাজার কিলোমিটার। যথেষ্ট সূক্ষ্ম, কী বল?

    ঠিক জানি না এসব গালগল্প আমার ভাল্লাগে কিনা। আমাদের সরকার অবশ্যই সহিংসতা পছন্দ করবে না। আত্মরক্ষার ব্যাপার হলে আলাদা।

    তুমি সাদাসিধে আমেরিকান! আমরাও বাস্তবধর্মী; আমাদের সহিংস হতেই হবে। তোমার দাদা-দাদী, নানা-নানী বুড়ো বয়সে মারা গেছেন, হেউড। আমার এ পূর্ব পুরুষদের তিন জনকে মহান দেশপ্রেম যুদ্ধে খুন করা হয়েছিল। তুমি বুঝবে না নিজের অধিকার রক্ষার জন্য কেন যুদ্ধ করতে হয়। আচ্ছা, তোমরা খুব অ-সহিংস, না? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তোমাদের সরকার আত্মরক্ষার জন্য জাপানে দুবার এটম বোমা ফেলেছিল, মাই ডিয়ার?

    একা থাকলে তানিয়া তাকে সব সময় উডি বলে ডাকে। কখনো হেউড নয়। তার মানে সে অবশ্যই সিরিয়াস। অথবা শুধু ফ্লয়েডের প্রতিক্রিয়া পরীক্ষা করছিল নাকি? কে জানে?

    যাহোক, ডিসকভারি কয়েক বিলিয়ন ডলার দামের হার্ডওয়ার মাত্র। জাহাজটা নয়-শুধু এর ডাটাগুলো দামি।

    ঠিক বলেছ, তথ্য। ডাটাগুলো কপি করে মুছে ফেলা যাবে।

    তানিয়া, তুমি সব সময়ই মনোরম সব ধারণা পাও। মাঝে মধ্যে আমি ভাবি সব রাশিয়ানের মাথায় সামান্য ছিট থাকেই।

    নেপোলিয়ন আর হিটলারকে ধন্যবাদ তাদের ভুল দেখে আমরা সবদিকে সঠিকতা অর্জন করেছি। কিন্তু আমাকে বলো না যে এর আগে তোমার নিজের জন্যে-তাকে তোমরা কি বলো, সিম্পরিও এর সমাধান বের করোনি তুমি।

    ফ্লয়েড বরং বিষণ্ণভাবে উত্তর দিল, দরকার পড়ে না। নিজের জন্য কোনো সিম্পরিও আমি করিনি। স্টেট ডিপার্টমেন্ট আগেই আমার জন্য করে রেখেছে রূপভেদ সহ। আমাদের স্রেফ দেখতে হবে চাইনিজরা কীসের নাগাল পায়। আমি মোটেই বিস্মিত হবে না যদি তারা আমাদের অনুমানের বাইরে আবারো কিছু করে বসে।

    ১০. ইউরোপার আর্তচিৎকার

    খুব কসরতের ব্যাপার শূন্য অভিকর্ষে ঘুমানো। এটাও শিখতে হয়। হাত এবং পা নোঙ্গর করে রাখার সবচে ভালো পদ্ধতি খুঁজে বের করার জন্য ফ্লয়েড প্রায় এক সপ্তাহ ট্রেনিং নিয়েছে যাতে হাত পা অস্বস্তিকরভাবে না ভাসে। এখন সে এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ। আর আগের অবস্থায় ফিরে যেতে অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। অবশ্য ঠিক ঐভাবে শুয়ে থাকার ব্যাপারটা তাকে মাঝেমধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখায়। ফ্লয়েড কোনোকালেও মাধ্যাকর্ষণহীনতায় শুতে পছন্দ করত বলে মনে হয় না।

    কেউ একজন তাকে জাগানোর জন্য ঝাঁকুনি দিচ্ছে। না-সে অবশ্যই এখন স্বপ্নে! মহাশূন্য শিপে কখনোই গোপনীয়তা ভাঙা যায় না। কেউ অনুমতি ছাড়া কখনো অন্য কুর ঘরে ঢোকে না। সে চোখ শক্তভাবে বন্ধ করার পরও ঝাঁকুনি চলছিল।

    দক্তর ফ্লয়েদ, দক্তর ফ্লয়েদ-ঘুম থেকে ওঠো, প্লিজ! ফ্লাইট ডেকে তোমার ডাক পড়েছে?

    এবং কেউই তাকে ডক্টর ফ্লয়েড বলে ডাকে না, সবচে বেশি আনুষ্ঠানিক অভিবাদন সে গ্রহণ করেছিল ডক্টর চন্দ্রের কাছ থেকে। হচ্ছেটা কী?

    বিরক্তি নিয়ে সে চোখ খুলল। নাহ, সে তো ছোট কেবিনেই আছে। স্লিপিং কোকুন আঁকড়ে রেখেছে মৃদুভাবে। সুতরাং… মনের একটা অংশ তাকে বলে: কেন সে ইউরোপার দিকে… তাকাচ্ছে? চোখ খুলে জেগে ফ্লয়েড কীভাবে সরাসরি উপগ্রহটার দিকে তাকিয়ে আছে? তারা তো এখনো মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে!

    রেখাগুলো একে অন্যকে ছিঁড়ে ফুড়ে বানিয়েছে অদ্ভুত ধূসর পরিবেশ। ত্রিভুজ আর বহুভূজ দিয়ে বানানো নকশার পরিচিত জালি চারপাশে আর অবশ্যই বড় রেখাটা এ্যাও ক্যানেল। না… ঠিক না। তা কীভাবে হতে পারে? সে তো শুয়ে আছে লিওনভের ছোট্ট কেবিনে।

    দক্টর ফ্লয়েদ!

    এবার সে পুরোপুরি জেগে গেল, এবং বুঝতে পারল যে বাম হাত ভাসছে চোখের ঠিক কয়েক সেন্টিমিটার সামনে। কী অদ্ভুত! রেখাগুলোর নকশা হাতের তালুতে এমন রহস্যময় লেগেছে যেন তা ইউরোপার মানচিত্র! কিন্তু হিসেবী প্রকৃতি এমন বিচিত্র পথে বিশালভাবে বিভিন্ন স্তরে নিজেকে সব সময় দেখায়। প্রকৃতি! যেমন দুধের ঘূর্ণি কফির সাথে মিশে যায়-তীব্র ঝড়ো আবহাওয়ার মেঘের রাস্তাও একইভাবে মেশে। আবার পেঁচানো নীহারিকার হাতগুলোও মিশে যাচ্ছে সেই কফির মতোই।

    ম্যাক্স, স্যরি। সে বলল, সমস্যাটা কী? কিছু হয়েছে?

    আমরা তা-ই ভাবছি-কিন্তু আমাদের সমস্যা নেই। জিয়াং পড়েছে বিপদে।

    ক্যাপ্টেন, নাবিক এবং প্রধান প্রকৌশলী ফ্লাইট ডেকে তাদের সিটে সিটবেল্টে বাধা। বাকি কুরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে চারদিকের সুবিধাজনক হ্যাণ্ডহোল্ড ধরে ঘুরছে, ভাসছে অথবা মনিটর দেখছে।

    স্যরি, হেউড। তোমাকে ঘুম থেকে জাগাতে হল। তানিয়ার দুঃখ প্রকাশ কী রূঢ়! পরিস্থিতিই এমন। দশ মিনিট আগে আমরা মিশন কন্ট্রোল থেকে প্রথম শ্রেণীর একটা প্রায়োরিটি পেলাম। জিয়াং বন্ধ করে দিয়েছে সম্প্রচার। একদম হঠাৎ করে সাইফার মেসেজের মাঝখানেই ব্যাপারটা হল; কয়েক সেকেন্ডের জন্যে বিকৃত প্রতিবেদন প্রেরণ-তারপর কিছুই নেই।

    তাদের বিকন?

    এখন সেটাও বন্ধ। অথচ বিকন সব সময় ব্লিপ ব্লিপ করে পৃথিবীর দিকে শিপের ভাল থাকার খবর জানায়। এটাও রিসিভ করতে পারিনি।

    উহ্! তা হলে তো মারাত্মক ব্যাপার-বড় রকমের কোনো বিপদ। কোনো না। কোনো ইশারা পাবার কথা, নাকি?

    ডাটা আছে প্রচুর কিন্তু সব অনুমানের উপর ভিত্তি করে। বিস্ফোরণ-ভূমিধ্বস ভূমিকম্প…কে জানে?

    এবং আমরা কখনো জানতে নাও পারি। জানতে হলে কারো না কারো ইউরোপায় নামতে হবে। অন্তত উড়ে যেতে হবে খুব কাছ থেকে।

    তানিয়া তার মাথা ঝাঁকুনি দিল, আমাদের যথেষ্ট ডেল্টা-ভি নেই। সবচে বেশি নৈকট্য পেতে পারি পঞ্চাশ হাজার কিলোমিটার দূর থেকে। ঐ দূরত্ব থেকে তুমি খুব ভাল দেখতে পাবে না।

    তারপর আমাদের করার কিছুই থাকবে না। একেবারেই নয়, হেউড। মিশন কন্ট্রোলের একটা পরামর্শ দেখতে পার। তারা চায়, আমাদের বিগ ডিশ যেন চারদিকে ঘোরাই। স্রেফ ঘটনাক্রমে যেকোনো দুর্বল প্রয়োজনীয় ট্রান্সমিশন পেয়ে যেতে পারি। তোমার মতে আইডিয়াটা কেমন? বহু দূর থেকে নেয়া শট, কিন্তু বাঘের কাছে যাওয়া যায় না। এই সঠিক প্রচেষ্টা। কী মনে হয়?

    ফ্লয়েডের প্রথম প্রতিক্রিয়া পুরোপুরি না বোধক, তার মানে পৃথিবীর সাথে আমাদের যোগাযোগ বন্ধ।

    অবশ্যই, কিন্তু যখন বৃহস্পতির আশপাশে যাবো আমাদের তা তো করতেই হবে। সার্কিট ঠিক করতে কয়েক মিনিট সময় নেবে মাত্র।

    ফ্লয়েড কথা বলল না। সাজেশনটা আসলেই যুক্তিসঙ্গত, তবু একটু ভয় পাইয়ে দেয়। কয়েক সেকেন্ডের জন্যে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হবার পর হঠাৎ করে বুঝতে পারে কেন সে অ্যান্টেনা ঘোরানোর সিদ্ধান্তের বিরদ্ধে যাচ্ছে বারবার।

    ডিসকভারির গোলমাল আরম্ভ হয় যখন বিগ ডিশ… সেই প্রধান অ্যান্টেনা কমপ্লেক্স পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, এখনও সেসবের কোনো ব্যখ্যা নেই। অবশ্যই জড়িত ছিল হাল। তবু এখানে দেখা দেয়া একই পরিস্থিতিতে কোনো বিপদ নেই। লিওনভের কম্পিউটারগুলো ছোট ছোট এবং অটোনোমাস ইউনিট; আলাদা আর স্বাধীন। একক নিয়ন্ত্রণ মেধা বা বুদ্ধিমত্তা নেই। অন্তত, অমানবীয় কিছু নেই।

    রাশিয়ানরা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে তার উত্তরের জন্যে।

    আমি রাজি, অবশেষে সে বলল, আগে পৃথিবীকে জানতে দাও আমরা কী করি; তারপর শুনতে আরম্ভ কর। আশা করি তোমরা সব স্পেস মে ডে ফ্রিকোয়েন্সির চেষ্টা করবে।

    হ্যাঁ, ডপলার সংশোধনের কাজ শেষ করার সাথে সাথে। শাসা, কেমন হবে ব্যাপারটা?

    আমাকে আরো দুমিনিট সময় দাও, অটোমেটিক অনুসন্ধান চালাতে পারবো। আমাদের শুনতে হবে কতক্ষণ?

    ক্যাপ্টেন তার উত্তর দিতে গিয়ে নামমাত্র থামল। ফ্লয়েড প্রায়ই তানিয়া অর্লোভার সুস্পষ্টতার প্রশংসা করে। আরেকবার তাই বলল তাকে। মেয়েটা সহজে রসিকতা করে না। হঠাৎ চমকে দিয়ে সে বলল, উডি, একজন কমান্ডার ভুল করতে পারে কিন্তু কখনো অনিশ্চিত হয়ে পড়ে না। শোনো পঞ্চাশ মিনিট, পৃথিবীতে প্রতিবেদন দাও দশ মিনিট। চালিয়ে যাও এভাবেই।

    দেখা-শোনার কিছুই নেই। মানুষের নার্ভাস সিস্টেম অসম্ভব গতিময়, তীক্ষ্ণ আর সূক্ষ্ম। মানুষের ইন্দ্রিয়ের চেয়েও ভাল কাজ করে অটোম্যাটিক সার্কিট। বেতার শব্দ ট্রান্সমিশনে এটা একেবারে এক্সপার্ট। তবু সময়ে সময়ে শাসা অডিও মনিটরে গিয়ে বসে থাকে। প্রতিবারই কেবিনকে ভরে তোলে বৃহস্পতির তেজস্ক্রিয় এলাকার গর্জন। পৃথিবীর সমস্ত সমুদ্র সৈকতের ঢেউ ভাঙ্গার শব্দের মতো। মাঝেমধ্যে বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলে বিজলি চমকের সাথে অসীম বজ্রপাত হয়। বিস্ফোরকের হঠাৎ তীক্ষ্ণ কোনো শব্দ নেই। একের পর এক সংকেত দূরে গিয়ে ভাসে; জবাব নেই। অপেক্ষা করার সময় ফ্লয়েড মনে মনে কিছু হিসাব করছে। জিয়াংয়ে যাই ঘটে থাক; পৃথিবীতে এর খবর পাঠানো শেষ হয়েছে দুঘণ্টারও আগে।

    কিন্তু এক মিনিটও দেরি না করে লিওনভের সরাসরি সংবাদ সংগ্রহের সামর্থ থাকা উচিত। সুতরাং চীনাদের সম্প্রচারে ফিরে আসার মতো যথেষ্ট সময় হাতে আছে এখনো। লিওনভের অবিরাম প্রচারের পরও নীরবতার ফলে কোনো না কোনো বিপর্যয়ের সম্ভাবনা উঠে আসে। এমনকি সে নিজেকে ঐ অসীম দৃশ্য গঠন করতে দেখতে পেল।

    এ পঞ্চাশ মিনিটকে মনে হয় কয়েক ঘণ্টার মতো। উপরে থাকার সময় শাসা অ্যান্টেনা কমপ্লেক্সকে পেছনে পৃথিবীর দিকে ফিরিয়ে দিয়েছে। সে একই সাথে দিল ব্যর্থতার খবর। দশ মিনিটের বাকি সময় ব্যবহার করে পৃথিবীতে পেছনের দীর্ঘ খবর পাঠানোর সময় প্রশ্নের দৃষ্টিতে ক্যাপ্টেনের দিকে তাকায়, আবার চেষ্টা করা কি ঠিক হচ্ছে?

    অবশ্যই। আমরা পৃথিবীতে খোঁজ খবরের সময় কমাতে পারি কিন্তু জিয়াংকে শোনার সময় ঠিক রাখব।

    কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বড় ডিশ আরো একবার ইউরোপার দিকে তাক করার সাথে সাথে অটোমেটিক মনিটরের ইমার্জেন্সি লাইট শুরু করে ফ্লাশ।

    শাসার হাত দ্রুতবেগে কাজ করছে অডিও পাওয়ার আশায়। বৃহস্পতির শব্দ কেবিনকে ভরে দেয় আবারো। বজ্রঝড়ের বিরুদ্ধে ফিসফিস করে বলা শব্দের মতো শোনা গেল একটা কিছু। অস্পষ্ট, কিন্তু পুরোপুরি মানুষের কথা। ভাষা চেনাটা অসম্ভব হলেও ফ্লয়েড স্বরভেদ এবং ছন্দ শুনে বুঝেছে চাইনিজ নয়। ইউরোপিয়ান কোনো ভাষা হতে পারে।

    শাসা ফাইন-টিউনিং এবং ব্যান্ড-উইডথ কন্ট্রোলের সাথে দক্ষভাবে খেলার পর তাতে শব্দগুলো একটু পরিষ্কার হয়। আচ্ছা! নিঃসন্দেহে ইংরেজি কিন্তু এখনো কথাগুলো বোঝাই যায় না। বিরক্তিকর।

    শব্দগুলোর একটা সংযুক্তি আছে, সব মানুষের কান সাথে সাথে চিনতে পারবে। এমনকি সবচে গোলমেলে পরিবেশেও।

    শব্দটা হঠাৎ করে বৃহস্পতির পটভূমি থেকে উঠে এলে ফ্লয়েডের মনে হল যেন চোখ খুলেও সে ঘুম থেকে জাগেনি। আটকা পড়েছে কিছু অদ্ভুত স্বপ্নের ফাঁদে। তার সহকর্মীরা সাড়া দিতে একটু দেরি করে ফেলে; তারপর তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকায় একইভাবে, বড় বড় চোখ করে। তারপর ধীরে ধীরে যেন কথাগুলো সাজিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে নিজের ভিতর।

    ইউরোপা থেকে প্রথমবারের মতো স্বীকারযোগ্য শব্দগুলো কাঁপিয়ে দেয় সবাইকে, ডক্টর ফ্লয়েড-আশা করি শুনতে পাচ্ছেন আমার কথা। কারণ এরচে বেশি কিছু আর আশা করার নেই।

    ১১. শূন্যতায় জমাট জল

    হুশ শব্দে কেউ একজন ফিসফিস করে প্রশ্ন ছোঁড়ে ফ্লয়েডের দিকে- কে? ফ্লয়েড হাত তুলে না জানার ইশারা করে-মনেপ্রাণে চায় যেন তার পরিচিত না হয় নোকটা। হলেই তা আরো কষ্ট বয়ে আনবে।

    .. জানি আপনি লিওনভে… বেশি সময় নেই হয়তো… আমার স্যুট অ্যান্টেনা দেখে মনে হয়…

    একটা বিরক্তিকর সেকেন্ডের জন্য সংকেত হাওয়া হয়ে গেল, তারপর ফিরে এল অনেক পরিষ্কারভাবে। খুব উঁচু শব্দ নয়।

    …প্লিজ এ তথ্য পৃথিবীতে রিলে করবেন। জিয়াং তিন ঘন্টা আগে ধ্বংস হয়ে গেছে। একমাত্র আমিই জীবিত। আমার স্যুট রেডিও ব্যবহার করছি-জানি না এটার যথেষ্ট রেঞ্জ আছে কি না কিন্তু এটাই একমাত্র সুযোগ। প্লিজ, মনোযোগ দিয়ে শুনুন। ইউরোপায় জীবন আছে। আমি আবার বলি, ইউরোপার জীবনের অস্তিত্ব আছে…

    সংকেতটা আবার বিলীন হয়ে যায় ধীরে ধীরে। এক অচেনা নীরবতা অনুসরণ করে বোঝা গেল কেউ বাধা দেয়ার চেষ্টা করেনি। অপেক্ষা করার সময় ফ্লয়েড পাগলের মতো হাতড়ে বেড়ায় তার স্মৃতির লুকানো কুঠুরিগুলো। চিনতে পারে

    -পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত চীনের যে কোনো লোক হতে পারে। হয়ত সায়েন্টিফিক কনফারেন্সে তার দেখা পেয়েছে এমন কেউ। যে পর্যন্ত বক্তা নিজের পরিচয় নিজে না দেবে, সে কখনো চিনবে না।

    …স্থানীয় মধ্যরাতের ঠিক পরে। আমরা নিয়মিত পাম্পিং করছিলাম। প্রায় অর্ধেক ভরে গেছে ট্যাংকগুলো। ডক্টর লি আর আমি পাইপ ইনসুলেশন চেক করার জন্যে বাইরে গিয়েছিলাম। জিয়াং দাঁড়িয়ে আছে-দাঁড়িয়ে ছিল-গ্র্যান্ড ক্যানেলের সীমানার প্রায় ত্রিশ মিটার দূরে। পাইপগুলো সরাসরি এখান থেকে নেমে নিচের বরফের মধ্যে ঢোকে। বরফ আবার খুব পাতলা-হাঁটার মতো নিরাপদ নয়। পাইপের পানি অবশ্য গরম…

    …কোনো ব্যাপার না-পাঁচ কিলোওয়াট আলো জ্বালিয়ে জাহাজের উপর টানালাম। ক্রিস্টমাস ট্রির মতো সুন্দর চককে আলো ঠিক বরফের মধ্যদিয়ে প্রতিফলিত হচ্ছিল নিচের পানিতে। চমৎকার রঙ। লি-ই প্রথম দেখে-এক বিশাল কালো পিণ্ড গভীর থেকে উঠছে উপরের দিকে। প্রথম প্রথম আমরা মনে করেছিলাম মাছের বিরাট কোনো ঝাক হবে-একক প্রাণিসত্তার হিসেবে খুব বড় তো-তারপর জিনিসটা এগিয়ে এল বরফের ভিতরে দিয়ে জোর করে পথ বানিয়ে নিয়ে।

    ডক্টর ফ্লয়েড, আশা করি আপনি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন। আমি প্রফেসর চ্যাং-আমরা মিট করেছিলাম দু হাজার দু সালে, বোস্টন আই. এ. ইউ. কনফারেন্সে।

    সাথে সাথে ফ্লয়েডের ভাবনা চলে গেল শত কোটি কিলোমিটার দূরে। সে ভাসাভাসা মনে করতে পারে ঐ রিসিপশনের কথা। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন কংগ্রেস এর সমাপনী সেশনের পর-সবার শেষ ব্যক্তি ঐ চীনদেশি। দ্বিতীয় কালচারাল রেভুলশনেও ছিল। আস্তে আস্তে সে চ্যাংকে খুব ভালভাবে মনে করতে পারল-একজন ছোটখাট বায়োলজিস্ট যার কৌতুকের ভাণ্ডার খুব সমৃদ্ধ। সে এখন আর কৌতুক করছে না।

    …ভেজা সমুদ্রশৈবালের চুলের মতো হামাগুড়ি দিচ্ছিল বরফের উপর। লি ক্যামেরা আনার জন্যে জাহাজের পেছনে যায়-আমি লক্ষ্য করছি, একই সাথে রিপোর্ট করছি রেডিওতে। জিনিসটা এত আস্তে আস্তে চলছিল যে আমি দৌড়ে একে ছাড়িয়ে যেতে পারতাম সহজে। সতর্ক হওয়ার চেয়ে অনেক বেশি উত্তেজিত ছিলাম। ভাবলাম এটা কী ধরনের প্রাণী আমি জানি। ক্যালিফোর্নিয়ার কাছাকাছি বড়

    সামুদ্রিক গুল্ম বনের ছবি আমার দেখা কিন্তু আমার খুব বড় ভুল হয়ে গিয়েছিল।

    … প্রাণীটার কোনো না কোনো সমস্যা ছিল, আমি শিওর। এর সাধারণ পারিপার্শ্বিক অবস্থার চেয়ে একশ পঞ্চাশ ডিগ্রী কম তাপমাত্রায় বেঁচে থাকা অসম্ভব। সামনে আসার সময় জমে কঠিন হয়ে গিয়েছিল-ছোট ছোট টুকরো আলাদা হয়ে যাচ্ছিল কাঁচের মতো কিন্তু তখনো জাহাজের দিকে এগুচ্ছেই। কালো সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস সব সময়ই মন্থর মনে হয়।

    আমি তখনো এত বিস্মিত যে সোজাসুজি চিন্তা করতে পারিনি। কল্পনাই করতে পারিনি এটা কী করার চেষ্টা করছে…।

    ফ্লয়েড মরিয়া হয়ে ফিসফিস করে ওঠে, তার ডাকে সাড়া দেয়ার কোনো পথই কি নেই?

    না-দেরি হয়ে গেছে অনেক। ইউরোপা একটু পরেই বৃহস্পতির পেছনে চলে যাবে। গ্রহণের বাইরে আসা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। লিওনভ কন্ট্রোল জবাব দেয়।

    এদিকে বলে চলেছে প্রফেসর চ্যাং, … জাহাজের উপর উঠে এগিয়ে যাবার সাথে সাথে তৈরি করে বরফের এক সুড়ঙ্গ। সম্ভবত জিয়াংয়ের উষ্ণতা দিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে চায়-মাটির ছোট্ট করিডোরে উইপোকা যেমন আটকা পড়ে যায়, তেমন করে শিপও এর ঘোরটোপে পড়ে গেল।

    …জাহাজের উপর টনকে টন বরফ জমেছে। রেডিও অ্যান্টেনা বন্ধ হয়ে গেছে প্রথমবারের মতো। তারপর দেখতে পেলাম নামতে থাকা পাগুলো সব কুঁচকে যেতে শুরু করে; দুঃস্বপ্নের মতো ধীর গতিতে।

    শিপ নড়বড় হয়ে পড়ে না যাওয়া পর্যন্ত আমি বুঝতেই পারিনি জিনিসটা কী করার চেষ্টা করছে-তখন আর সময় নেই। ঐ লাইটগুলো বন্ধ করে দিলেই নিজেদের আমরা রক্ষা করতে পারতাম।

    সম্ভবত প্রাণীটা আলোতে সক্রিয় হয়, এবং বায়োলজিক্যাল আবর্তনে সূর্যের আলো পড়লে হয়ত এ অদ্ভুত জিনিসটা হিংস্র হয়ে পড়ে। সেই আলো বরফের মধ্য দিয়ে বিশোধিত হয়ে প্রবেশ করে ভিতরের জগতে। আলোর প্রতি পতঙ্গের মতো আকৃষ্ট হতে পারে এটা। আমাদের ফ্লাডলাইট অবশ্যই ইউরোপা এ পর্যন্ত যা দেখেছে তার চেয়ে অনেক অনেক উজ্জ্বল…

    তারপর ভেঙে গেল শিপ। আমি নিজের চোখে জাহাজের কাঠামো লম্বালম্বিভাবে টুকরা হতে দেখলাম। তুষার ফলকের এক মেঘ ঘন ঘন আর্দ্র করে তোলে চারপাশকে। দুমিটার উপরে ক্যাবলে ঝুলছিল একটা বাতি। বাকি সবগুলো নিভে গেল সামনে পেছনে দুলতে দুলতে।

    জানি না কী হল এর পর। আমার আর কী করণীয়? জাহাজের ধ্বংসস্তূপের পাশে লাইটের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই। সূক্ষ্ম ফ্রেশ বরফের পাউডারে আমি আবদ্ধ। এর মধ্যে আমার জুতার ছাপ খুব স্পষ্ট দেখতে পেলাম। অবশ্যই সেখানে হেঁটেছি সম্ভবত মাত্র এক বা দুমিনিট পর। হিতাহিত জ্ঞান ছিল

    চারাগাছটা-আমি এখনো এটাকে ঝাকড়া চারাগাছ হিসেবে ভাবি! জিনিসটা ছিল স্থির। অবাক চোখে দেখি এটা ধ্বংস হচ্ছে আঘাতে আঘাতে, বড় বড় কাটা অংশ মানুষের হাতের মতো ঘন টুকরো টুকরো হয়ে শাখা প্রশাখার মতো ছিটকে পড়ল।

    তারপর আবার চলতে শুরু করে প্রধান কাণ্ডটা। স্পেসশিপের কাঠামো থেকে নিজেকে টেনে বের করে আমার দিকে হামাগুড়ি দিতে শুরু করলে আমি নিশ্চিতভাবে জানলাম যে সেটা আলোতে প্রতিক্রিয়াশীল। দাঁড়িয়ে ছিলাম হাজার ওয়াট বাতির ঠিক নিচে। জিনিসটা এখন বন্ধ করেছে নিজেকে দোলানো।

    একটা ওক গাছের সাথে এর মিল এখনো দেখতে পাই যেন, কোনো বটগাছ বহুশাখা এবং মূল নিয়ে মাধ্যাকর্ষণে চিড়েচ্যাপ্টা হলে যেমন দেখায় তেমন। বরফ। ঘেঁষে চুপিসারে চলতে চেষ্টা করছিল জিনিসটা। আলোর পাঁচ মিটারের মধ্যে পৌঁছে আমার চারদিকে এক নিখুঁত বৃত্ত তৈরি করে নিজেকে ছড়িয়ে দেয় চারপাশে। বোঝাই যায় সে এলাকাই ওটার সহ্যক্ষমতার সীমা-আরো সামনে তার আলোক আকর্ষণ হয়ত অরুচিকর। তারপর কয়েক মিনিটের জন্যে কিছুই হয়নি, আমি বরং ভাবছি মরে জমে কঠিন হয়ে গেল কিনা।

    তারপর দেখলাম বিরাট বিরাট মুকুল গঠিত হতে শুরু করেছে অনেক শাখা প্রশাখা সহ। অনেকক্ষণ। ফুল ফুটতে দেখার মতো ধৈর্য নিয়ে বসে থাকতে হল আমাকে। আসলে ভাবছিলাম আকৃতির কথা। এক একটা ফুল মানুষের মাথার মতো বড়! কোমল, সুন্দরভাবে রঙিন ঝিল্লি ভাজ ভাঙ্গতে শুরু করে। এমনকি তখনও মনে হল যে, কোনো মানুষ বা প্রাণী এর আগে এমন রঙ কক্ষনো দেখেনি। এত রঙের অস্তিত্বই থাকত না যদি আমাদের লাইট-আমাদের প্রাণনাশক লাইট এ দুনিয়ায় বয়ে না আনতাম।

    চারদিকে আস্তে আস্তে দুলছে পুংকেশর… জীবন্ত দেয়ালের উপর দিয়ে হাঁটলাম যাতে ব্যাপারটা ঠিকমতো দেখতে পারি। আমি ঐ প্রাণীকে সামান্যতম ভয় পাইনি কখনোই। শিওর ছিলাম, এটা পরশ্রীকাতর না-যদি তাই হয়ে থাকে তবে আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করত। ও আমার অস্তিত্ব টের পায় ভালভাবেই।

    বড় ফুলগুলোর স্তরে স্তরে ভাজ ভাঙার খাজ। এবার এরা মনে করিয়ে দেয় প্রজাপতির কথা, যা এইমাত্র পুঁয়োপোকার আবরণ থেকে বেরুল-ডানায় ভাঁজ-ভাঁজ চিহ্ন, এখনো ক্ষীণ-আমি ক্রমেই সত্যের কাছাকাছি যাচ্ছিলাম।

    মুকুলগুলোর মধ্যে কিছু কিছু যত তাড়াতাড়ি গঠিত হয় জমেও যায় তত তাড়াতাড়ি-যায় মরে। তারপর মূল মুকুল থেকে একের পর এক ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়ে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে এগুলো শুকনো ভূমিতে মাছের আঁশের মতো ভেঙ্গে পড়ল এলোপাথাড়ি। চারদিকে। অবশেষে বুঝতে পারলাম এগুলো কী। ঐ ঝিল্লিগুলো পাপড়ি না-জলজপ্রাণীর ডানা বা তার সমমানের একটা কিছু। মুক্তভাবে সাঁতার কাটার জন্যে ঐ প্রাণীর একটা স্তর। অনেকটা ডানার মতো। হয়ত জীবনের বেশিরভাগ কাটিয়ে দেয় সমুদ্রগর্ভে শিকড় গেড়ে, তারপর এ চলমান বাচ্চাদের নতুন এলাকা খুঁজে বের করার জন্য পাঠায়। ঠিক যেমনটা করে পৃথিবীর মহাসাগরের প্রবাল।

    ছোট্ট প্রাণীর একটাকে কাছে থেকে দেখার জন্যে আমি হাঁটু গেড়ে বসলাম। সুন্দর রঙ ম্লান হচ্ছিল তখন। বৈচিত্র্যহীন বাদামি রঙ বেরিয়ে পড়ে। পাপড়ি-ডানার কিছুটা হঠাৎ করে জমে যাওয়ায় ভেঙে পড়ে ভঙ্গুর মাটির পাত্রের মতো। প্রাণীটা তখনো ক্ষীণভাবে নড়ছিল, এমনকি আমি সামনে গেলে আমাকে এড়িয়েও গেল। আমিতো অবাক! এটা কীভাবে আমার উপস্থিতি বোঝে?

    তারপর দেখতে পাই পুংকেশরগুলো… এ নামেইতো ডেকেছিলাম-এদের ডগার উপরে উজ্জ্বল নীল ফোঁটা ধরে রেখেছে। দেখতে ঠিক ছোট উজ্জ্বল নীল রঙা তারার মতো অথবা ঝিনুকের আবরণের সাথে নীল চোখের মতো-সেগুলো আবার আলো থেকে সাবধান, কিন্তু সত্যিকারের মুড নিতে পারেনি। তারপর উজ্জ্বল নীল, ম্লান হয়ে যায়, সাধারণ পাথরের মতো…

    ডক্টর ফ্লয়েড অথবা অন্য যে কেউ শুনছেন… আশা করি কেউ না কেউ শুনতে পাবেন আমার কথা, হাতে খুব একটা সময় নেই, বৃহস্পতি কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার সিগন্যাল ব্লক করবে। আমার কথা অবশ্য প্রায় শেষ।

    জানি এরপর আমার কী কাজ। হাজার ওয়াট বাতির তারটা ঝুলছিল মাটির কাছাকাছি। হ্যাঁচকা টান দেয়ার পর লাইটটা নিভে গেল একটু স্পার্ক করে। অনেক দেরি হয়ে গেছে কিনা ভেবে আমি ভয়ও পেয়েছি কিছুটা। কিছুক্ষণ কিছুই হয়নি। সুতরাং মনের ঝাল ঝাড়তে চারদিকের জট পাকানো শাখাপ্রশাখার দেয়ালের উপর হাঁটতে হাঁটতে লাথি লাগালাম কষে।

    ধীরে ধীরে প্রাণীটা শরীরকে ছিন্নভিন্ন করে নেয় গ্র্যান্ড ক্যানেলে ফিরে যাওয়ার জন্য। অনেক আলো থাকার কারণে আমি সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। বৃহস্পতির দু উপগ্রহ গ্যানিমিড আর ক্যালিস্টো আকাশে ভাসে আর গ্রহরাজ বৃহস্পতি দেখায় পাতলা এক চাঁদের মতো। আইওর ঘুরতে থাকা শেষপ্রান্ত বৃহস্পতির দিকে ফেরানো। উপগ্রহটার রাতের আকাশে মেরুজ্যোতির ফুলঝুরি ফুটেছিল। কোনো প্রয়োজন ছিল না আমার হেলমেট লাইট ব্যবহার করার। আমি বেশ আগ্রহের সাথে দৌড়াই প্রাণীটার পেছনে। একটু ধীর হয়ে এলেই লাথিও দিই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে; অনুভব করি বুটের নিচে বরফ ভাঙার কড়মড় শব্দ… ক্যানেলের কাছাকাছি যেতেই মনে হল এটা শক্তি পেয়েছে আরো। ঠিকই, সে ফিরছে নিজের বাড়িতে। ভয় পাচ্ছিলাম এবার একটু একটু। আবার মুকুল সৃষ্টির জন্য বেঁচে থাকতে পারে। শত্রু এলাকায় কিছু মৃত লার্ভা রেখে সে চলে গেল পানির উপর দিয়ে। খোলা পানিতে কিছুক্ষণের জন্য বুদবুদ উঠল যে পর্যন্ত বরফের একটা চাদর পানির স্তরটাকে শূন্যতা থেকে সরিয়ে না আনে। দৃষ্টি সরিয়ে ফিরে গেলাম শিপের কাছে। যদি কেউ বেঁচে থাকে… এ নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। আমার শুধু দুটো অনুরোধ আপনার কাছে, ডক্টর। যখন ট্যাক্সোনমিস্টরা প্রাণীটাকে শ্রেণীভুক্ত করবে, আশা করি নামটা হবে আমার নামে।

    আর… ডক্টর… প্লিজ… পরের শিপ আসার সময় তাদের একটু বলে দেখো-আমাদের কঙ্কাল যাতে চীনে নিয়ে যায়। মাইনাস একশো পঞ্চাশ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডে আমরা পচে যাব না। আর… আমার বাসায় আছে ছোট্ট… না, থাক। যা বলছিলাম, বৃহস্পতি আমাদের ধ্বংস করে দেবে কয়েক মিনিটের মধ্যে। আশা করি এবং আমার বিশ্বাস কেউ না কেউ আমার কথাগুলো শুনছে। যাই হোক, যোগাযোগ করার সুযোগ পেলে এ মেসেজ আবার পাঠাব। অবশ্য আমার স্পেস স্যুট যদি তখনো টিকে থাকে।

    ইউরোপা থেকে প্রফেসর চ্যাং মহাকাশ যান জিয়াং ধ্বংসের প্রতিবেদন দিচ্ছি। আমরা ল্যান্ড করলাম গ্র্যান্ড ক্যানেলের পাশে। আমাদের পাম্পগুলো বসানো হয় বরফের কিনারায়…

    সংকেতটা ধীরে মিলিয়ে গিয়ে আবার মুহূর্তের জন্য ফিরে এসে শ্রাব্যতার সীমার নিচে নেমে চিরতরে হারিয়ে গেল।

    আবার যোগাযোগের সুযোগ হয় এক সময়। একই ফ্রিকোয়েন্সিতে লিওন মনোযোগ দেয়-কিন্তু প্রফেসর চ্যাংয়ের কাছ থেকে আর কোনো মেসেজ আসেনি কোনোদিন।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Article২০৬১ : ওডিসি থ্রি – আর্থার সি. ক্লার্ক
    Next Article দূর পৃথিবীর ডাক – আর্থার সি. ক্লার্ক

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }