Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ৫-৬. মসৃণ চওড়া পথ

    বুদ্ধদেব গুহ এক পাতা গল্প31 Mins Read0

    ৫-৬. মসৃণ চওড়া পথ

    গাড়ি চলেছে মসৃণ চওড়া পথ বেয়ে পাহাড় বনের মাঝের চন্দ্রালোকিত রাতে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো বন-অনভিজ্ঞ গামহার চেয়ে আছে বাইরে। গাড়ির ড্যাশবোর্ডের প্যানেলের বহুরঙা নরম আলোগুলিকে যেন দূরের আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র নিচয় বলে মনে হচ্ছে। কেউই কোনো কথা বলছে না। সবাই অনেকক্ষণ চুপচাপ। অনেকক্ষণ। যে যার ভাবনায় মগ্ন।

    প্রত্যেক মানুষই সামাজিক বেষ্টনীর মধ্যে থেকেও যে আলাদা, একেবারেই আলাদা তা বোঝা যায় মানুষ যখন একা থাকে, একা ভাবে।

    ভাবছিল গামহার। স্বামী-স্ত্রী, লিভ-টুগেদারের পার্টনার, প্রেমিক-প্রেমিকা, বাবা-ছেলে, মা-মেয়ে, ভাই-বোন সকলের সঙ্গে সকলের যোগসূত্র একটা থাকলেও তারা প্রত্যেকেই মূলত আলাদা আলাদা মানুষ। তাদের এই একলা থাকা, একলা ভাবা যতদিন থাকবে, মানুষের মনুষ্যত্বও ততদিনই থাকবে। জারুল যেমন বলেছিল, একজনের ভাবনা অন্যে দেখতে পেলে বেশ হতো, তা কোনোদিনই সম্ভব হবে না। ভাগ্যিস হবে না।

    দীর্ঘ নিস্তব্ধতা ভেঙে দিয়ে চিকু বলল, তোমরা এমন চুপ মেরে গেলে অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যাবে যে। এই শেষ রাতটাই বিপজ্জনক। নাও জারুল এবার একটা গান শোনাও তো। মৃণাল চক্রবর্তীর একটা গান গাও।

    গামহারদার সামনে গান গাইতে ভয় করে। ভোর হয়ে আসছে, একটা ভৈরবী ধরো না গামহারদা, বড়ে গুলাম আলি খাঁ নয়তো ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের।

    ভোর এখনও হয়নি।

    তুমি কেমন গাইয়ে? গান গেয়ে মিঞা তানসেন আগুন জ্বালাতেন, বৃষ্টি নামাতেন, বৈজু বাওয়ারা পাথরের মূর্তির চোখে জল আনতেন আর তুমি সূর্য ওঠাতে পারবে না।

    আমি তো আর পরশুরামের থুরি, সত্যজিৎ রায়-এর “পরশ পাথরের” সাধু নই যে, “ওঠ ওঠ” বলব আর সূর্য লাফিয়ে লাফিয়ে উঠবে।

    তারপর বলল, সকালের রাগের মধ্যে কী রাগ ভাল লাগে তোমার?

    ভাল গাইলে, সকালের সব রাগই ভাল লাগে। ভীমসেন যোশীজী অথবা রাশিদ খাঁর মতো যদি কেউ গায় তো চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে যায়। অজয় চক্রবর্তীর মেয়ে কৌশিকীর গান শুনেছেন আপনি গামহারদা?

    শুনেছি। ভারী মিষ্টি মেয়ে। একদিন ভারতের এক নম্বর গাইয়ে হতে পারে। ওর বাবাই ওর ভরসা এবং ওর বাবাই ওর বিপদও বটে। মেয়েকে প্রকৃত ক্লাসিকাল আর্টিস্ট করে তুলতে হলে অজয়বাবুর উচিত ওকে তার নিজের সবরকম প্রভাবমুক্ত করা। আমার মতে, অজয়বাবুর উপরেও ঈশ্বরের অনেক আশীর্বাদ ছিল কিন্তু তিনি হয়ত সস্তা খ্যাতি আর অর্থের জন্যে দলেবলে নিজেকে বাণিজ্যিক করে ফেলছেন। জানি না, আমি ভুলও হতে পারি। খাঁটি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত গাইয়ে আর মায়ের মন্দিরের পূজারীতে কোনো তফাৎ থাকলে তো চলবে না। পবিত্রতা, সততা, ঋজুতা এবং একনিষ্ঠ পূজারীর পুজোতেই দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হয়।

    জারুল বলল।

    গামহার বলল, আমার কিন্তু তা মনে হয় না। সব উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত গাইয়ে কি সবরকম গান গাইতে পারেন? অজয়বাবু পারেন। আমার তো এটাকে দোষ মনে হয় না, গুণই মনে হয়।

    তারপর একটু থেমে গামহার বলল, তা সকালের কোন রাগ তোমার সবচেয়ে ভাল লাগে তা তো বললে না জারুল।

    ললিত, যোগিয়া, কুকুভ-বিলাওল, বিভাস, দেশকার ভাল লাগে সবই।

    তারপরই জারুল চিকুকে বলল, গাড়িটা একটু দেখেশুনে থামাবে।

    কেন?

    থামাও না।

    আরে কেন তা বলবে তো? গাড়ির বনেটে বসে গান গাইবে?

    আরে না।

    শুশু করবে?

    আঃ ভারী অসভ্য তুমি।

    ইসস, কী এ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স। কোথায় হচ্ছিল ললিত আর যোগিয়ার কথা তার মধ্যে শুশু।

    তারপর বলল, দাঁড়াও। সামনে দাঁড় করাচ্ছি। চড়াইটা উঠে। এখানে জঙ্গল বেশ গভীর। তোমাকে ডাকাতে ধরে নিয়ে গেলে? বিয়ে করা বউ তো নও। ঝামেলার একশেষ হবে।

    তা ঠিক।

    গামহার বলল।

    বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, ডাকাতে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা।

    আর পুলিশে ছুঁলে বাহাত্তর ঘা।

    চিকু বলল।

    ওড়িশার পুলিশও কি আমাদের পশ্চিমবাংলার পুলিশের মত ভাল?

    পশ্চিমবাংলো নয়, বলো ‘বাংলা’।

    ওই হলো!

    পুলিশ হচ্ছে ঘোড়ার পুরিষ। ক্ষততে লেগেছে কী ধনুষ্টংকার।

    পিনাকেতে লাগে টংকার। অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলাতে শুনেছ?

    গামহার বলল।

    চিকু বলল, অশোকদা ভারী ভাল মানুষ ছিলেন। কিন্তু গলাটা টাল-খাওয়া চাকার মতো দুলতে অনেক সময়ে তাই না?

    ওরা সকলেই হেসে উঠল চিকুর কথাতে।

    গামহার বলল, পুলিশের কোনো রকমফের নেই। পুলিশ হচ্ছে অর্শ’র যন্ত্রণা। সব দেশেই, সব প্রদেশেই একই রকম।

    আমাদের ভয় কি? তুমি তো ওড়িয়া বলতে পারো।

    টিক্কে টিক্কে কহু পারুচি। এব্বে প্র্যাকটিস ছাড়ি গল্বা।

    চিকু হেসে বলল, কেন যে সেই সুন্দরী ওড়িয়া মহিলার সঙ্গে প্রেমটা চালিয়ে গেলে না বল তো? তাহলে তো প্র্যাকটিস ছাড়ত না!

    আমার এই প্রেম নিয়ে ঠাট্টা কোরো না। বড় পবিত্র ছিল সে প্রেম। পুরো ওড়িশা আর ওড়িশাবাসীই আমার চোখে এক বিশেষ স্থানে বসে আছে শুধু ওরই জন্যে।

    নাও। নামো এবারে। পাহারাদার লাগবে?

    গাড়ি থামিয়ে, চিকু বলল, জারুলকে।

    না।

    বিরক্ত হয়ে বলল জারুল।

    তবু একজনের নামা উচিত।

    গামহার বলল।

    চলো, দু’জনেই নামি। মুক্ত বায়ুতে সিগারেট খাই একটা। তুমি খাবে নাকি?

    দাও। বিনা পয়সাতে দাদের মলম পেলেও খেতে বলেছিল আমার গুরু।

    হেসে উঠল, চিকু।

    জারুল, পথের ডানদিকের ঢালুতে বড় বড় গাছ আর ঝোঁপ যেখানে সেখানে নেমে গেল। পুবের আকাশ সাদা হতে আরম্ভ করেছে। সাদা ঠিক নয়, সাদার আভাস লেগেছে সবে আর পশ্চিমাকাশে অস্তগামী চাঁদের হালকা রুপো রুপোর জল লাগিয়েছে। এখানে জঙ্গল নেই তেমন।

    সিগারেট শেষ হতে হতে জারুল ফিরে এল।

    বলল, ম্যাগো! ভয়ে প্রায় মরেই গেছিলাম।

    কেন?

    একটা কুমীর!

    ডাঙায় কুমীর?

    হ্যাঁ। তবে ছোট।

    গামহার ডাঙায় কুমীর শুনে বিভ্রান্ত হয়ে গেছিল।

    গো-সাপ হবে। কোথায় ছিল?

    চিকু বলল।

    কোথায় আবার? ঠিক আমার সামনেই।

    ব্যাটা জাতে নিশ্চয়ই পুরুষ।

    চিকু বলল।

    সবাই একটুক্ষণ চুপ।

    গামহার বলল, সেই মিঞা-বিবির কী হলো বলতো? তুমি তো এমন কিছু জোরেও চালাচ্ছিলে না, রাস্তায় মাঝেমধ্যে দু-একটা ট্রাক ছাড়া কোন ট্রাফিকও নেই অথচ তাদের এখনও পাত্তা নেই কেন?

    এসে যাবে।

    নিরুদ্বেগ গলাতে বলল চিকু।

    জারুল বলল, দাঁড়ালামই যখন, তখন আরও মিনিট দশেক দেখে নিয়েই এগোনো ভাল। কী বল? গাড়ি খারাপ হলো না তো?

    মারুতি-এস্টিম। মাস দুয়েক হলো নিয়েছে। খারাপ হবে কি? তবু ভোর তো হয়েই গেল। চলো একটু মর্নিং-ওয়াক করে নিই।

    তার চেয়ে একটা গান শোনাও তুমি গামহারদা।

    গামহার ধরে দিল ভীষ্মদেব-এর গাওয়া বিখ্যাত গানটি, রামকেলিতে, ‘জাগো, আলোক লগনে…’

    গান শেষ হলে জারুল বলল, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল গো! সত্যি বলছি গামহারদা। তোমার গলাতে সুর-লয় তো আছেই, এমন ভাব আছে! তুমি গায়ক হলেই ভাল করতে।

    কোনো গুণকেই পেশা করে ফেললেই সরস্বতী চটে যান। সরস্বতী ভাঙিয়ে লক্ষ্মীর আরাধনা কি সহ্য হয়?

    সে কথা হয়ত ঠিক। লেখাই বল, গানই বল, ছবি আঁকাই বল, পেশা করে ফেললেই তাতে আনন্দ অনেকই কমে যায় হয়ত। যাঁরা সে লেখা পড়েন, গান শোনেন ছবি দেখেন তাঁদেরও আনন্দ সম্ভবত ক্রমশই কমে আসতে থাকে। অথচ আনন্দই সব সৃষ্টির উৎস এবং গন্তব্য। পেশাদার হয়ে যাওয়ার পরও সৃষ্টিকে একঘেয়েমি থেকে বাঁচিয়ে রাখা ভারী কঠিন। বড় কম মানুষেই তা পারেন।

    ছবিকে তো বেসাতি করেইছি। গানটা না হয় আমার নিজস্ব গোপন ধন হয়েই থাকল।

    কথাটা ভাববার বটে।

    চিকু বলল, কুড়ি মিনিটেরও বেশি হয়ে গেছে। এবার চিন্তাতে পড়া গেল। মিঞা-বিবি পথের পাশে গাড়ি লাগিয়ে ঘুম লাগালো না তো? চলো গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে দেখতে যেতে হবে।

    পুবের আকাশে সাদা ছোপ লাগলেও পাহাড় থাকাতে এবং ঘন জঙ্গল থাকাতে হেডলাইট জ্বেলেই চলতে লাগল চিকু। ছায়াচ্ছন্ন পথের উপরে অন্ধকারই আছে এখনও। গাড়ি চলেছে তো চলেছেই।

    এবারে চিন্তা হতে লাগল ওদের সকলেরই।

    বাংরিপোসিতে ওরা রাতে থেকে গেল না তো কোনো হোটেল-টোটেলে?

    বাঃ তা কী করে হবে।

    বিসোই-এর ঘাটে পুজো দিল না? সে জায়গা তো বাংরিপোসি পেরিয়ে এসে।

    বাঃ ওরা কোথায় ছিল? আমরা তো আগেই পুজো দিয়ে বেরিয়ে এলাম।

    তাহলে হতেও পারে।

    জারুল বলল।

    ছাড়ো তো। পরস্ত্রী হলেও না হয় বোঝা যেতো। নয়ত প্রেমিকা। বিয়ের পাঁচ বছর পরেও অত রস থাকে না কারো যে হঠাৎ করে পথ-পাশের হোটলে রাত কাটাতে যাবে।

    তোমার মতো আনরোম্যান্টিক তো সকলে নাও হতে পারে।

    হারিত ঘোষ আমার চেয়ে অনেক বেশি আনরোম্যান্টিক। বালান্সশীট মিলিয়ে মিলিয়ে রস- কষ বলতে ওর আর নেই কিছুমাত্রই।

    ওরা প্রায় পাঁচ-সাত কিমি মতো চলে এসেছে এমন সময় চিকু বলল, সর্বনাশ।

    কি?

    জারুল আর গামহার সমস্বরে বলে উঠল।

    ভিড়িয়েছে।

    চিকু বলল।

    চিকরাসির গাড়ির হেডলাইটে পথের ডানদিকে তালগোল পাকানো কাঁচের গুড়োতে মাখামাখি একটা সাদা পিণ্ড দেখা গেল খুব মোটা একটা গাছের সামনে।

    গাছের সঙ্গে ভিড়িয়েছে।

    আবার স্বগতোক্তি করল চিকু।

    চিকু গাড়িটা ডানদিকে করে এগিয়ে নিতে নিতে আবারও স্বগতোক্তি করল, দুজনেই শেষ!

    কী বলছ?

    বলেই, ডুকরে কেঁদে উঠল জারুল।

    বাঁদিকের বুকে খুব কষ্ট হতে লাগল গামহারের। ভাবল, ছবিটা আঁকবে ভেবেছিল মনোমতো করে, আঁকা হলো না আর। ওর কপালটাই এরকম।

    চিকু গাড়ি দাঁড় করিয়ে নামল, ওরা দুজনেও নামল। পরক্ষণেই ভূত দেখার মতো দেখল, সেই পিণ্ড থেকে হারিত আর ঝাঁঝি বেরিয়ে আসছে বেরিয়ে, আশ্চর্য! নিজেদের পায়ে ভর দিয়েই দাঁড়াল। তবে দু’জনেরই সর্বাঙ্গে কাঁচের গুঁড়ো আর রক্তর ফোঁটা।

    গামহার দেখল ঝাঁঝির ঝাঁঝি-রঙা শিফনের শাড়িটার মধ্যে আর তার ছোট হাতার গাঢ় সবুজ ব্লাউজে লাল রক্তর হাজারো বিন্দু ফুটে উঠে একটা দারুণ ডিজাইন-এর সৃষ্টি করেছে।

    ওরা দু’জনে বেঁচে আছে দেখে ওরা তিনজনই একইসঙ্গে বিভিন্নরকম অভিব্যক্তি করল, যা আলাদা করে বোঝা গেল না কিন্তু একই সঙ্গে শোনা গেল।

    গাছের সঙ্গে মারলে, তো গাড়িটার মুখ রাইট অ্যাঙ্গেলে ঘুরে গেল কেমন করে?

    চিকু জিজ্ঞেস করল হারিতকে।

    গাছের সঙ্গে নয়।

    যেন ঘোরের মধ্যে বলল হারিত।

    তো?

    ট্রাকের সঙ্গে।

    ট্রাকের সঙ্গে? মুখোমুখি?

    হুঁ। তবে সে ব্যাটা ট্রাক-ড্রাইভার আমাকে বাঁচাবার অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কী করব। দু’জনেই তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। অথচ দু’মিনিট আগেই গল্প করছিলাম।

    আনথিংকেবল। তোমরা বেঁচে আছ কি করে, তাই তো মাথাতে আসছে না।

    গামহার বলল।

    ঝাঁঝি শব্দ না করে, হেসে বলল, কপালে আরও অনেক দুঃখ আছে, হয়তো তাই।

    আশ্চর্য মেয়ে বটে! অন্য যে কোনো মেয়ে হলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠত সহানুভূতি আর কলের চাবি একইরকম মেয়েদের কাছে। চাবি খুললেই জল ঝরতে থাকবে। এমন শক্ত মেয়ে দেখেনি কখনও।

    গামহার ভাবছিল।

    ও তড়িঘড়ি করে বলল, কে বলতে পারে! কপালে সুখও থাকতে পারে অনেক!

    চিকু বলল, এক ঘুঁট হুইস্কি খেয়ে নাও দু’জনেই। যা শক পেয়েছ। আর সারা শরীরে হুইস্কি ঘষে নাও। তারপর বলল, কতক্ষণ হয়েছে?

    সকাল চারটে কুড়িতে।

    এই গাড়ি দেখলে কেউই কি বিশ্বাস করবে যে, সামনের সিটে বসা দুই যাত্রীই বেঁচে আছে?

    তা করবে না। তবে মারুতি কোম্পানির গাড়ির বিশেষত্ব আছে বলতে হবে।

    ধাক্কা লাগার সঙ্গে সঙ্গে স্টিয়ারিংটা আমার বুকে না লেগে উপরে উঠে গেছিল।

    জারুল বলল, প্লাসটিকের গাড়ি বলে ঠাট্টা করেন অনেকে কিন্তু এ যদি বিড়লার আম্বাসাডার বা মাহিন্দ্রার জীপ হতো মার্সিডিজ ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কা লাগার ইমপ্যাক্টে কী অবস্থা হতো বলো তো। স্পট-ডেড হতে দু’জনেই।

    রাখে কেষ্ট মারে কে?

    হারিত বলল।

    মস্ত গাছটার বিরাট পরিধির কালচে-খয়েরি গুঁড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল ঝাঁঝি। রাত্রি জাগরণে ক্লান্ত, মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ায় ভীত এবং সারা শরীর ও মুখ কাঁচের গুঁড়ো লেগে রক্তাক্ত হওয়া বিভ্রান্ত ঝাঁঝির দিকে তাকাল গামহার। খুব ইচ্ছে হলো ওকে একটা চুমু খায়। অথবা ওর সমস্ত কটি ক্ষতস্থানে জিভ দিয়ে চেটে রক্তবিন্দুগুলি পরিষ্কার করে দেয়। ওকে বুকে নিয়ে একটু আশ্বস্ত করে। গামহার যদি মানুষ না হয়ে কোন চতুস্পদ প্রাণী হতো তবে তো জিভ দিয়ে চেটে-চেটেই শুশ্রূষা করত। প্রথমত ও প্রাণী নয় মানুষ, দ্বিতীয়ত সমাজের মতে ঝাঁঝি তার কেউই নয়। তাই অনাত্মীয়া নারী শরীরে তার হাত ছোঁয়ানোও মানা। হারিত তার স্বামী। ঝাঁঝির শুশ্রূষা করতে পারত সেই কিন্তু তালগোল পাকানো গাড়ির পেছন থেকে বাকার্ডি রাম-এর বোতল খুলে সে তখন সোজা গলায় ঢেলে বল সঞ্চার করছিল।

    হঠাৎই গামহারের মনে পড়ে গেল পরশু কোনো কাগজে একটি বিজ্ঞাপন দেখেছিল যারা দুর্বল তারাই মদ্যপান করে। কথাটা হয়ত সত্যি। হারিতের মুখে মদ আর ঝাঁঝির মুখে হাসি। কী সুন্দর বিধুর হাসি। সে হাসি, যে হাসে তাকে যত না আনন্দ দেয়, তার চেয়ে অনেকই বেশি আনন্দ দেয় যে সেই হাসি দেখে, তাকে।

    লেগেছে খুউব? ঝাঁঝির কাছে গিয়ে বলল, গামহার। কাল বিকেলের পর এই প্রথম সরাসরি কথা বলল গামহার ঝাঁঝির সঙ্গে।

    না তো। লাগেনি।

    চা খাবে?

    কোথায় পাব?

    নিয়ে আসছি যোশীপুর থেকে বোতলে করে।

    বলবার সময় ভুলে গেল যে, সে পরনির্ভর এবং যোশীপুর ছ-সাত কিমি দূরে কম করে।

    চিকু শুনে বলল, উল্টোটাই করছি। তুমি বরং এখানে থেকে গাড়িটা পাহারা দাও গামহারদা। গাড়িটা টেনে যোশীপুরে নিয়ে যাবার বন্দোবস্ত করতে হবে। কিন্তু সামনেটার যা অবস্থা, সামনের দুটো টায়ারই গেছে। টেনেও তো নিয়ে যাওয়া যাবে না। কোনো ট্রাকে করে কলকাতাতে পাঠাবার বন্দোবস্ত করতে হবে। নবেন্দুকে গিয়েই এস টি ডি করতে হবে ও যেন ওর ফিয়াট উনো নিয়ে এখুনি রওয়ানা হয়ে চলে আসে। তা নইলে আমার মারুতি-জেন-এ তো মালপত্র নিয়ে পাঁচজন মিলে যাওয়া যাবে না।

    জারুল বলল, তুমি কি পাগল। এরপরও জঙ্গলে যাবে! এবারে বাদ দাও, বাধা যখন পড়েছে।

    চিকু বলল, বাধা পড়েছে বলেই তো জেদ চেপে গেছে আমার। জঙ্গলে যেতেই হবে। গামহারদাকে জঙ্গল দেখাব বলেছি!

    গামহার বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ যাব।

    ঝাঁঝিও বলল, বাধা পড়েছে তো কি হয়েছে? আমাদের বেঁচে যাওয়াটা সেলিব্রেট করতে হবে না জঙ্গলে গিয়ে? মানুষের তো একটাই মাত্র জীবন।

    গামহারের এতো বয়স হলেও ও যেন ভুলেই গেছিল যে, মানুষের একটা মাত্র জীবন! সেও বিড়বিড় করে বলে উঠল, একটা মাত্র জীবন। মাত্র একটা। ঝাঁঝির সঙ্গে কটা দিন জঙ্গলে কাটাবার জন্য কর্বুর মাৰ্বল বা ঘুড়ি পাওয়ার জন্যে শিশুর যা আকুতি তেমনই আকুতি বোধ করল গতযৌবন গামহার। শিশু হয়ে গেল।

    ইনস্যুরেন্স-এজেন্ট-এর ফোন নাম্বার জানা আছে কি হারিত?

    চিকু আবারও জিজ্ঞেস করল।

    কিসের জন্যে ফোন করবে এজেন্টকে?

    জারুল বলল।

    বাঃ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি তা নইলে থোড়াই ক্লেইম দেবে। থানাতেও ডাইরী করতে হবে একটা।

    কী আছে আর গাড়ির? এ তো টোটাল লস।

    হারিত হতাশ গলায় বলল।

    সে জন্যেই তো আরও করা দরকার।

    গামহার বলল, আরে গাড়ি গেছে আবার নতুন গাড়ি আসবে। প্রাণ গেলে কি প্রাণ আসত? তুমি তো বড় কৃপণ আছ হে হারিত।

    চিকু মনে মনে একটু খুশিই হল। সন্দেহ নেই হারিত বেশ কৃপণ। অথচ কৃপণ হওয়া উচিত ছিল না।

    গামহার-এর দিকে তাকিয়ে এবারে চিকু বলল, পুলিশে ছুঁলে বাহাত্তর ঘা। তুমিই বলেছে গামহারদা। আর আমাদের মধ্যে তুমিই একমাত্র ওড়িয়া জানো। সামলাও এবারে। ছোট জায়গার থানার বাবুরা তো তেমন ইংরেজী জানবেন না।

    তাহলে? আমি কি যাব?

    গামহার বলল।

    দাঁড়াও না। পর্বতই মহম্মদের কাছে আসবে। আমি আহতদের আর জারুলকে নিয়ে যোশীপুরে গিয়ে ওইসব কাজ করছি। প্রাথমিক। ওদের তো ফাস্ট-এইডও দিতে হবে। মেয়েদের একটু বাথরুম-টাথরুমেও যেতে হবে। ফেরবার সময়ে তোমার জন্যে বোতলে করে চা নিয়ে আসব। আর যদি বেশি ঘাবড়ে গিয়ে থাকো তো হুইস্কির বোতল রেখে যাচ্ছি। দু’চুমুক মেরে দাও। সর্বরোগহারী নিজৌষধি।

    গামহার বলল, না, না। খালি পেটে হুইস্কি?

    তাতে কি? নাইনটি পার্সেন্ট কবিরাজী বা বায়োকেমিক ওষুধ তো খালি পেটেই খেতে হয়।

    গররাজি গামহার বলল, না। তোমরা এগোও। সিগারেট আছে কি?

    আছে। তোমাকে কখনও সিগারেট খেতে তো দেখিনি।

    এমন বিপদেও তো কখনওই পড়িনি।

    তাই? নাও একটা প্যাকেট রাখো। আমি এগোলাম।

    বলে, ওর গাড়িতে এ গাড়ির যতখানি লাগেজ আঁটে, ততটুকু নিয়ে চিকু চলে গেল। তবু অনেক মালই রয়ে গেল।

    হারিত কথা বলছিল না। স্তম্ভিত হয়ে গেছিল সে। জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে তফাত যে বড় সামান্যই এই কথাটাই বোধহয় সে আস্তে আস্তে হৃদয়ঙ্গম করে একেবারে নীরব হয়ে গেছিল। এতক্ষণ ভয় পায়নি। কিন্তু এখন তার হাত পা থরথর করে কাঁপতে লাগল।

    গামহার ভাবছিল, ভাগ্যিস ওদের ছেলে-মেয়ে নেই। বাবা-মা একসঙ্গে চলে গেলে সেই শিশুদের কি হতো?

    .

    ০৬.

    ওরা চলে গেলে, গামহার গাড়িটার পেছনের অংশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে অনভ্যস্ত হাতে একটা সিগারেট ধরালো। এবং ধরিয়েই খুক খুক করে কাশতে লাগল। এমন সময়ে জঙ্গলের মধ্যে থেকে যেন জঙ্গল ফুড়েই একটা-দুটো করে মানুষ, অধিকাংশই ছোট ছেলেমেয়ে গাড়ির কাছে এগিয়ে আসতে লাগল আর অনর্গল প্রশ্নবাণে তাকে জর্জরিত করতে লাগল। গামহারও যথাসাধ্য তাদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যেতে লাগল।

    সব্বে মরিলা কি বাবু?

    নাই ম।

    কেত্তেজন থ্বিলা?

    দ্বিজন।

    আপনি থ্বিলে কি?

    নাহি। মু অন্য গাড়িরে থ্বিলা।

    আপনংকু চোট লাগিলা কি?

    নাহি।

    কেমিতি এমিতি হেলা?

    নিন্দ লাগিকি আঁখি বন্ধ হই যাই থিলা।

    এই বাক্যটা লাগসই হল না। ইসস্ কুমুদিনী! তুমি এতো বছর পরে আমাকে এমন করে কষ্ট দেবে কে জানত। মনে মনে নিরুচ্চারে বলল, গামহার।

    সেমানে কুয়াড়ে পলাইলে আপনংকু ছাড়িকি?

    পুলিশ আসিথিলা কি?

    নাহি।

    উত্তর দিয়ে দিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেল গামহার। ভাবল, একদিক দিয়ে ভালই হলো, তার চর্চা চলে-যাওয়া ওড়িয়াটা বাধ্য হয়েই চালু করতে হলো। পুলিশের সঙ্গে কথোপকথনে কাজে লাগবে।

    ঈ গাছুটা কওন গাছুরে পিলা?

    একটি ছোট্ট ছেলেকে জিজ্ঞেস করল গামহার।

    সেটা গুট্টে গাছু বাবু।

    বিরক্ত হয়ে গামহার বলল, সে তো সব্বমানে জানিছি। তাংকু নাম্বটা কন?

    সে মু জানিনান্তি। কহি পারিবুনি।

    তার পাশে দাঁড়ানো মেয়েটি বলল, তু জানিনান্তি? সে গাছুটা কদ্দম গাছু বাবু। সে বহুত বুড়া গাছুটা।

    কদ্দম গাছু?

    হাসি পেয়ে গেল গামহার-এর। কদমতলাতে রাধা-কৃষ্ণর তো একইসঙ্গে থাকার কথা। সে এখন পাণ্ডববর্জিত জঙ্গলের কদমতলাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাধার শাড়ি-জামা-আন্ডি ব্রাসিয়ার ভর্তি শুটকেসটি পাহারা দিচ্ছে। আর রাধা তার নোটারি-পাবলিক-এর অথেনটিকেটেড কৃষ্ণর সঙ্গে গরম গরম চা খাচ্ছে যোশীপুরে। যার কপালের যেমন লিখন। এরই জন্যে বেঁটে-কাকীমা চিরদিন বলে এলেন, কপালে গোপাল করে।

    এখন চারদিকে রোদ ঝকঝক করছে। অনেকক্ষণ ধরে হবোহবো করে সকাল সত্যিই হয়েছে। বসন্তর রোদ। এখনও বসন্তর রেশ আছে। কতরকমের গাছ চারদিকে। নাম জানে না ও। ঘাসে ছাওয়া মাঠ। ক্লোরোফিল-উজ্জ্বল ঝকঝকে সবুজ পাতা। সবুজ আর লাল টিয়া পাখির ঝাঁক ট্যাঁ ট্যাঁ ট্যাঁ করতে করতে উড়ে গেল হাওয়াতে চাবুক মেরে। কোনো জবরদস্ত পুরুষ গায়কের দিল-ধড়কান অচানক হলক্‌ তানেরই মতো।

    যেখানে ঘাস নেই, জমি উদোম, সেখানে জমির রং লাল। ছেলেবেলাতে হাজারিবাগে যেমন দেখেছিল বলে মনে আছে। বিহার ওড়িশার চেহারাতে বোধহয় বিশেষ তফাৎ নেই। ওড়িশাতেও দেখছে বিহারের মতোই পাহাড় আছে। তবে, ওড়িশা সম্ভবত বিহারের চেয়ে বেশি সবুজ। তাছাড়া, ওড়িশাতে সমুদ্র আছে অনেকই জায়গাতে। বিহারে সমুদ্র নেই।

    হারিতের গাড়িটা রাস্তার এক কোণে এই কদম গাছতলাতে সমকোণে যেদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকেই পথের অদূরেই একটি পাহাড় উঠেছে। ছোট পাহাড়। পাহাড়ের পর পাহাড়। তারপরে আরও পাহাড়। সমুদ্রের ঢেউয়েরই মতো। সমুদ্রের ঢেউ নীল, আর সাদা পাহাড়ের ঢেউ সবুজ আর লাল আর হলুদ আর কালো। ভারী সুন্দর মিষ্টি একটা গন্ধ ভাসছে হাওয়াতে। পাহাড়ের উল্টোদিকের ফাঁকা লাল প্রান্তরের মধ্যে ছোট ছোট গাছ ছড়ানো। এগুলো কি শাল? কে জানে। জারুল আর চিকু থাকলে বলতে পারত। সেই প্রান্তরের মধ্যে একটা প্রকাণ্ড বড় প্রাচীন গাছ। এদেরই বোধহয় মহীরূহ বলে। তার নীচে ছোটবড় মেয়েরা ভিড় করে কী যেন কুড়োচ্ছে। হাওয়াটা এদিক দিয়েই আসছে। কোনো ফুল কুড়োচ্ছে কি ওরা? না কি ফল?

    সে বড় গাছুটার নাম কন?

    সেট্টা মহুয়াটা না! আউ কন?

    সে গাছতল্বে সে ঝিওমানে কন করিছন্তি?

    মহুল ফুল নুচিকি নেউচি, আউ কন? সে গাছ মালিক আসি পড়িবে আটটা বেলে। নুচিকি নেইকি পলাইবে সেমানে।

    মানে, মহুয়ার ফুল লুকিয়ে লুকিয়ে কুড়িয়ে নিচ্ছে। সেই গাছের যে মালিক সে আটটার সময় এসে যাবে তাই এতো তাড়া ওদের।

    তাই?

    তাই তো।

    বেলা বাড়তেই ছেলে-মেয়ে ও বয়স্করা নিজের নিজের কাজে চলে গেল। একটা যাত্রীবোঝাই বাস চলে গেল বাংরিপোসির দিকে। দু-একটা টেম্পো, ট্রেকার ও ট্রাকও দেখা যেতে লাগল। সবাই গাড়িটাকে দেখে হায়! হায়! করতে লাগল। হাওয়াতে উড়ে আসতে লাগল তাদের সখেদ মন্তব্য : জনে বাঁচিলানি। সব্বে মরিলা।

    সহযাত্রী বলল, হউ! তম্মে ত সব্ব জানুচি!

    প্রায় দেড় ঘণ্টা হতে চলল। কিছুই করার নেই। গামহার গাছতলাতে গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। তারপর ছবিটা আবার আঁকতে শুরু করল মনে মনে। কল্পনাতে এই রোদ-ঝলমল দিনের মধ্যেই সবজে-হলদে শিফন শাড়ি পরা ঝাঁঝিকে জামা কাপড় এক এক করে খুলিয়ে সম্পূর্ণ নগ্ন করল। তারপর মনে মনে আঁকতে লাগল। যতবার আঁকল, মুছল তার চেয়ে বেশি। চোখ, চিবুক, চুল সবই মিলল কিন্তু মেলাতে পারল না শুধু মনের ভাবটুকুকে। এই তো কিছুক্ষণ আগেই এই কদমতলাতেই ঝাঁঝি দাঁড়িয়েছিল। এরই মধ্যে ভাবটি চুরি গেয়ে গেছে। এই সুন্দর পৃথিবীতে অনেকই সুন্দর জিনিস আছে বিধাতার সৃষ্ট, যাতে মানুষের তৈরি কোনো তালা-চাবিই লাগে না। তা তার নিজ-খেয়ালে রইলে থাকে, না রইলে থাকে না।

    গামহার-এর মনে মনে আকা ছবির ক্যানভাসটা ছিঁড়ে-খুঁড়ে দিয়ে ভটভটানি শব্দ তুলে একটি বড় মোটর সাইকেলে একজন খাকি পোষাকের লোক এসে গাড়ির সামনে নামল। তার প্রায় পেছন পেছন একটা জীপে চার-পাঁচজন পুলিশের উর্দি পরা মানুষ এসে উপস্থিত হলো। যা জানতো, মানে চিকুরা থানাতে যা রিপোর্ট করেছে, তাই নতুন করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে গামহারের কাছ থেকে শুনলো। এমন সময়ে আর. টি.-তে খবর এলো সার্কল ইনসপেক্টর এসেছেন থানাতে রাইরাংপুর থেকে। অতএব জীপটি মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল। মোটর সাইকেল-বাহিত ফর্সা, গোলগাল লম্বা চওড়া মানুষটি বললেন, নমস্কার। মু প্রশান্ত পণ্ডা। সান্ববাবু।

    মানে, থানার ছোটবাবু।

    নমস্কার আইজ্ঞাঁ।

    সবিনয়ে বলল, গামহার।

    থানার সান্ববাবু, অর্থাৎ ছোটবাবু খুব ভাল করে গাড়িটাকে ঘুরে ঘুরে নিরীক্ষণ করে বললেন, এ গাড়ি তো নিজে যেতে পারবে না, টো করেও নেওয়া যাবে না। কোনো ট্রাক ভাড়া করে সেই ট্রাকে ক্রেন-এ করে তুলে যেখানে নিয়ে যাওয়ার সেখানে নিয়ে যেতে হবে।

    তাই?

    আপনারা এসেছেন কোথা থেকে?

    কলকাতা।

    কিন্তু এ গাড়ি তো ছাড়া যাবে না।

    মানে?

    মানে অ্যাকসিডেন্টের কেস হবে। গাড়ি থানাতেই থাকবে এখন।

    কারও তো তেমন চোট লাগেনি।

    তাতে কি? গাড়ির তো লেগেছে।

    গাড়ি তো গেছে আমাদেরই। অন্য কারো ক্ষতি তো হয়নি।

    তা নাই বা হলো।

    কিন্তু সেটা হবে কার বিরুদ্ধে? ওরা তো ট্রাক-এর নাম্বারও নিতে পারেনি। শেষ রাতের অন্ধকারে নির্জন পথে ট্রাক মেরে দিয়ে অথবা বাঁচিয়ে দিয়ে চলে গেছে। ওই অবস্থাতে প্রাণ বেঁচেছে এই ঢের এখন। কে ট্রাকের নম্বর নিতে গেছে।

    সে মানংকু রিলেশনটা জানিচু কি আপুনি?

    হাজব্যান্ড অ্যান্ড ওয়াইফ।

    সত্য করিকি কহন্তু।

    মু কি মিছা কহিলি?

    সে বাবু মদ্দ খাইকি চালাইথান্তি কি?

    মু কেমিতি জানিবি? মু তো অন্য গাড়ির থিলা।

    হউ। যাই হউ। নিশ্চয় কেস করিবাংকু হেব্ব।

    কার বিরুদ্ধে কেস করবেন? ট্রাকের নাম্বারই তো নেই।

    আননোন-ট্রাককু এগেইনস্টে কেস্ব হেব্ব।

    হাঁ হয়ে গেল গামহার। আননোন ট্রাকের এগেইনস্টে কেস!

    ভাবছিল, যে-সব অপরাধীর খুনির, চোর, ডাকাতের নাম ঠিকানাও দেওয়া হয়। সেখানেও পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ তাদের ধরে এনে সাজা দিতে পারে না আর এখানের পুলিশ তাদের কাজে এতই দড় যে আননোন ট্রাকের বিরুদ্ধেও পুলিশ কেস দিচ্ছে। এমন উদ্ভট কথা বাপের জন্মে শোননি গামহার। স্তম্ভিত হয়ে সে গৌরবর্ণ মুখটির দিকে চেয়েছিল। মুখটা দেখে কিন্তু মনে হয় মানুষটা ভাজা মাছটিও উল্টে খেতে জানে না অথচ ‘আননোন ট্রাক’ এর বিরুদ্ধে কেস ঠুকে দেওয়ার ঐশী ক্ষমতা রাখে। গামহারের মনে হলো, তার স্বদেশ এই ভারতবর্ষ প্রকৃতই শিবঠাকুরের আপন দেশ। এখানের আইনকানুন ‘পেরকিতোই’ সব্বেনেশে।

    এমন সময়ে দেখা গেল চিকুরের গাড়ি ফিরে আসছে। একাই এল। গাড়িটা লাগিয়ে বলল, চা খাও। বলেই, আধ-বোতল চা আর দুটো ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া কলাইডালের বড়া দিয়ে বলল, খেয়ে নাও।

    গামহার বলল, ঠাণ্ডা।

    যা পাচ্ছ চাঁদমুখ করে খেয়ে নাও গামহারদা। পরে কখন খেতে পাবে তা মারাংবুরুই জানে।

    তারপর বলল, তুমি তোমার প্রেমিকার ভাষাতে কথা বলে আমাদের কিছু সুরাহা করতে পারলে?

    গামহার হতাশ গলায় বলল, নাঃ! বলছেন, আননোন-ট্রাকের এগেইনস্টে কেস হবে।

    সে মানংকু মেডিকেল এগজামিনেশনভি করিবা হেব্ব।

    তাদের কিছুই তো হয়নি রে বাবা।

    না হেলে, কন হেব্ব। মেডিক্যাল এগজামিনেশন নিশ্চয় করিবাংকু হেব্ব।

    চিকু বলল, এতো মহা চিত্তির। রেপ-কেস না কি?

    তারপরেই পবননন্দনবৎ প্রত্যুৎপন্নমতিত্বর সঙ্গে বাহু ধরে আকর্ষণ করে নিয়ে গিয়ে নিজের গাড়ির সামনের সিটে বসালো। ছোটবাবুর অ্যাসিস্ট্যান্ট হাতে একটা কালো নোটবুক নিয়ে মোটর সাইকেলের পেছনের সীটে বসে এসেছিল। সে নোটবইটা নিয়ে চিকুর গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতেই ছোটবাবু তাকে অঙ্গুলি-সংকেতে ফিরে যেতে বললেন। তার মিনিট পাঁচেক পরেই চিকু ছোটবাবুর হাতে হাত রেখে, যেন তারা প্রেমিক-প্রেমিকা, এমনই ভাবে এসে বলল, যাও গামহারদা তুমি এবারে গাড়িতে গিয়ে বসে চা’টা খাও। ইসস। এই কাকুরে মাটিতে বসেছিলে এতক্ষণ? পেছনে কালশিটে পড়ে যাবে যে।

    কী হলো?

    গামহার জিজ্ঞেস করল।

    যা হওয়ার কথা ছিল, তাই হলো।

    মানে?

    মানে, উনি ফিরে গিয়ে একজন পুলিশ পাঠিয়ে দিচ্ছেন এখানে গাড়ি পাহারা দেবার জন্যে। যতটুকু মালপত্র আছে এ গাড়িতে আমরা সবই নিয়ে যাব।

    তারপর?

    তারপর কি? নবেন্দুর সঙ্গে কলকাতায় কথা হয়ে গেছে। ও, ওর একজন ড্রাইভারকে সঙ্গে নিয়ে ব্রেক-নেক স্পিডে কলকাতা থেকে রওয়ানা দিয়ে এসে পড়ছে। এলে, ওর ড্রাইভার ট্রাকের সঙ্গে বসে গাড়িটাকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে কারখানায় দেবে।

    ট্রাকও ঠিক করে ফেলেছ? কত ভাড়া নেবে?

    ছ’হাজার।

    আর আমি? আমিও কি ট্রাকে করে ফিরে যাব গাড়ির সঙ্গে?

    সত্যিই! তোমরা এই আর্টিস্ট-টাস্টিটরা রিয়্যাল কাছাখোলা। তোমার জন্যে এবারে জঙ্গলে আসা আর তোমাকেই ফেলে রেখে আমরা চলে যাব? ভাবলে কী করে এমন!

    ঝাঁঝি, জারুল ওরা সব কোথায়?

    জারুলদের ফরেস্ট অফিসের পথে একটা গেস্টহাউসে তুলে দিয়ে এসেছি। নবেন্দুরা এলে হারিত নবেন্দুর সঙ্গে আসবে চাহালাতে। আমরা, মানে, তুমি আর মেয়েরা, যতখানি মাল নেওয়া সম্ভব সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে যাব।

    চাহালা? সেটা কোথায়?

    গেলেই দেখতে পাবে। রাতটা চাহালাতে থেকে কাল ভোরে জোরান্ডাতে যাব।

    জোরান্ডা মানে কি জোড়া আন্ডা?

    মানে-ফানে নেই। থাকলেও, আমি জানি না।

    অধৈর্য গলাতে বলল চিকু।

    গামহার আবার বলল, কেস হবে না? মেডিক্যাল এগজামিনেশন? কিসসু হবে না।

    ছোটবাবু ততক্ষণে মোটর সাইকেল স্টার্ট করে ফেলে চিকুকে ‘প্রণাম স্যর’ বলে, মোটর সাইকেল ভটভটিয়ে এগিয়ে গেলেন।

    ম্যাজিকটা কি করলে?

    ম্যাজিকটা কি করব? আমি কি পি সি সরকার? ম্যাজিক করে, অশোকচক্র ছাপ মারা কাগজ। এক গচ্চা গেল, আর কী!

    এক হাজার?

    ইয়েস দাদা। তুমি ওড়িয়া জেনেও কিছু করতে পারলে না। টাকার চেয়ে বড় উকিল, টাকার চেয়ে সর্বমান্য ভাষা এমন আর কিছুই নেই গামহারদা। ব্যাপারটা তোমার পছন্দ হোক কী নাই হোক।

    বলো কি?

    হতাশ গলাতে বলল, গামহার।

    ভাবল, এই নব্য পৃথিবীতে ও একেবারেই অচল হয়ে গেছে।

    আমাদের পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ তো হাইলি এডুকেটেড। ওঁরা নিশ্চয়ই এইরকম আননোন ট্রাক-এর বিরুদ্ধে কেস করতেন না?

    দ্যাখো দাদা, পুলিশের কোনো রাজ্যভেদ নেই। রক্ষকরা সর্বত্রই ভক্ষক। তারাও একশোবার করতেন। আননোন কেন আনসীন ট্রাক-এর বিরুদ্ধেও করতেন। আর টাকাটা নেওয়ার পরেও সম্ভবত কাজটা ঠিকমতো করতেন না। পশ্চিমবঙ্গ, থুড়ি বাংলার হ্যাংলাদের সঙ্গে অন্য সব জায়গার ক্যাংলাদের এইটুকুই তফাৎ। এই হচ্ছে বাঙালিদের বিশেষ ঐতিহ্য।

    বল কী তুমি। বুদ্ধদেববাবু তো হান্ড্রেড পার্সেন্ট সৎ।

    মন্ত্রী সৎ হলেই যে শান্ত্রীদেরও সৎ হতে হবে এ কথা কোন শাস্ত্রে লিখেছে? তোমার বয়স হয়েছে খোকাবাবু, বিদ্যে হয়নি কিসসু। দাও, সিগারেটের প্যাকেটটা দাও। দেখি, কটা খেলে?

    একটা।

    দু’ঘণ্টাতে একটা! তুমি একটি রিয়্যাল খোকাবাবু। সত্যি।

    তারপর বলল, তোমার জন্যে ঝাঁঝি খুবই উদ্বিগ্ন। বারবার তোমার কথাই জিজ্ঞেস করছে। তুমি চা খেলে না, আমরা খেলাম স্বার্থপরের মতো, এই সব আর কী!

    তাই?

    হ্যাঁ। তবে অ্যাকসিলারেটরে আস্তে চাপ দিও।

    মানে?

    মানে, হারিতের কাছে পিস্তল আছে। আর ও আর্ট-কেলচার বিশেষ বোঝে না। আফটার অল, ঝাঁঝি ওর বিয়ে-করা বউ তো! ছেলের বিয়েতে দেড় হাজার লোক খাইয়েছিলেন ওর বাবা।

    ওর বাবা কি করতেন? তিনিও চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট?

    না। তিনি হাওড়ার নামকরা ঢালাইওয়ালা ছিলেন। বড় এক্সপোর্টার।

    বিরাট প্যান্ডেল হয়েছিল সিংহী প্যালেস-এ।

    কীসের জন্যে?

    আরে হারিতের বিয়ের সময়ে, থুরি বৌভাতের সময়ে।

    বলেই বলল, তবে আমার একটা নিজস্ব থিওরী আছে। সেটার জন্যেই আমি ও পথে হাঁটিনি।

    সেটা কি?

    যার বিয়ের প্যান্ডেলে যত বাঁশ লাগে সেই সব বাঁশের টোটাল বাঁশ-লেন্থ যে পুরুষের সব্বোবাঁশ হলো, তারই পেছনে সারা জীবন ধরে একটু একটু করে যায়।

    তুমি একটা যাচ্ছেতাই।

    গামহার বলল। রীতিমতো শীৎকার তুলে।

    চিকু বলল, হায় কুমুদিনী। তুমি আমার হাজার টাকা গচ্চাটা বাঁচাতে পারলে না। যাই বল আর তাই বল গামহারদা, তোমার ওই প্রেমটা টোটালি আনপ্রডাকটিভ। না করতে পারলে প্রেগন্যান্ট, না বাঁচাতে পারলে আমাদের আননোন-ট্রাকের এগেইনস্টে কেস-এর হাত থেকে। দেখি, তোমার নতুন প্রেমে কতদূর এগোতে পার।

    গামহার মনে মনে বলল, ক্ষমা করে দাও, ক্ষমা করে দাও এই সব ক্রুড, ম্যাটার-অফ ফ্যাক্ট আজকালকার ছোঁড়াদের। এরা কী বুঝবে তোমার মতো একজন আর্টিস্টের মানসিকতা! ক্ষমা করে দাও গামহার।

    চিকু, গামহার, জারুল এবং ঝাঁঝিরা রাস্তাতে একটা ধাবাতে খাওয়ার পাট চুকিয়ে যখন যোশীপুর থেকে বেরোল তার একটু পরই বড় রাস্তার উপরেই ঝড়ের গতিতে একটি বেগুনি মেটালিক রঙের ফিয়াট “উনো” উল্টোদিক থেকে এসে জোরে ব্রেক করে পথের ডানদিকে দাঁড়াল। একটি একগাদা– ফর্সা যুবক, লম্বা, চোখে র‍্যেবান-এর সানগ্লাস, ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে ডান হাতের ভঙ্গি দিয়ে কথা বলল, মুখে কিছু না বলে। ভঙ্গি বলল, ঠিকঠাক সব?

    চিকু ড্রাইভিং সিট-এর কাঁচ নামিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ভাল আছে। বেঁচে গেছে।

    নবাগন্তুকের বডি-ল্যাঙ্গোয়েজ তবু উদ্বেগের সঙ্গে বলল, তাই কি?

    চিকু আবারও চেঁচিয়ে বলল হারিত থানাতে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে। ট্রাকওয়ালাও ট্রাক নিয়ে। তোমার ড্রাইভার আর তোমরা দুজনে ধাবায় খেয়ে নিয়ে গাড়িটাকে ক্রেন দিয়ে ট্রাকে তুলে সেই ট্রাকে ড্রাইভারকে বসিয়ে, কলকাতায় পাঠিয়ে দিও ট্রাককে। তারপর তোমরা দু’জন চাহালা চলে এসো। বৃন্দাবন গেটে আমি বলে যাব।

    আগন্তুকের উর্ধ্বাঙ্গে একটি ‘মড’ জামা। হয়ত ‘উইকএন্ডার’ থেকে কেনা। তবে জামার হাতাটা মেয়েদের মেগিয়া-স্লিপ ব্লাউজের মতো। বিশেষত্ব এই যে, হাতাটা এতই ঢোলা যে, হাত তুললে বগল দেখা যায়। মেয়েদের ওই দৃশ্য কেমন লাগে তা বলতে পারবে না, কিন্তু গামহারের অন্য কোনো পুরুষের লোমওয়ালা বগল দেখতে আদৌ ইচ্ছা করে না।

    নবাগন্তুকের শরীরের ভাষা দেখে মনে হল যে, সে একবার এই গাড়ির কাছে আসতে খুবই ইচ্ছুক। খুবই উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল তাকে। সে যেন চিকুর মুখের কথাতে ভরসা করতে পারছিল না। ঝাঁঝি যে সত্যিই অক্ষত আছে এই সত্য সে নিজের চোখেই দেখতে চায়।

    চিকু তার উৎসাহে জল ঢেলে দিয়ে আর কথা না বাড়িয়ে বলল, আমি এগোলাম। তোমরা এসো।

    গাড়ির রঙিন কাঁচের ভিতর থেকে বাইরেটা দেখা যায় কিন্তু বাইরে থেকে ভিতরে কিছুই দেখা যায় না। ওরা পেছনের কাঁচ নামাতে পারত। নামালেই নবাগন্তুক ঝাঁঝিকে দেখে তার তৃষা নিবারণ করতে পারত। কিন্তু ডানদিকে বসা ঝাঁঝি কাঁচটা একটুও নামালো না। কেন? কে জানে! হয়ত গাড়ি গরম হয়ে যাবে বলে।

    অথবা নবাগন্তুক গরম হয়ে যাবে বলে।

    প্রথম দর্শনেই গামহার-এর মনে হলো যে, নবাগন্তুক ঝাঁঝিকে ভালবাসে। হয়ত ঝাঁঝিও তাকে ভালবাসে। মেয়েরা যাদের ভালবাসে তাদের সঙ্গে বেশি দুর্ব্যবহার করে। সেই দুর্ব্যবহারে পুরুষদের ভালবাসা আরও তীব্র হয়। এসবই বিধাতার চক্‌কান্ত।

    গামহার মনে মনে নিজেকে বলল, ছবিটা নির্বিঘ্নে আঁকা যাবে না। ঝাঁঝির স্বপ্নে বিভোর হয়েছিল ও। মাঝে মাঝেই গাড়ির রিয়ার-ভিউ মিরারে এক এক ঝলক দেখছিল। একা হারিতই যথেষ্ট ছিল পথের কাঁটা হিসেবে, এ আবার কোন উটকো আপদ এসে জুটল! ওর কপালটাই এরকম। গামহারের পাশের বাড়ির ন্যাপাদা জ্যোতিষচর্চা করেন। তিনি বলেছিলেন, একটা গাঢ় নীল-রঙা রুমাল সবসময়ে পকেটে রাখতে যখনই বাইরে বেরোবে। তাড়াতাড়িতে গাঢ় নীল-রঙা রুমাল যোগাড় করতে পারেনি। আগে জানত থোড়াই যে ভাগ্যর সাহায্য এমন দরকার পড়বে। কিছুদিন হলো গামহার-এর একটা ইনটিউশন হচ্ছে। ও নিজের ভাগ্য গুণতে না পারলেও জ্যোতিষীরই মতো মুখ দেখে বা শরীরের ভাষা দেখেই অনেক কিছু বলে দিতে পারে, যার নিরানব্বই ভাগই সত্যর সঙ্গে মিলে যায়।

    কখনও কখনও আজকাল ও ভাবে ছবি আঁকা ছেড়ে দিয়ে ফেস-রিডিংকেই পেশা করবে। ঝাঁঝিকে স্টাডি করে মনে হচ্ছিল কেসটা পাকলেও পাকতে পারে। চিকু গাড়িটা এগোতেই গামহার চিকুকে বলল, এই তোমার নবেন্দু!

    হ্যাঁ।

    কী করে?

    ওদের মস্ত কোম্পানি।

    কিসের ব্যবসা?

    স্টিভেডরিং অ্যান্ড শিপ-চ্যান্ডলারিং। শিপ-রিপেয়ারিং। এন সি বোস অ্যান্ড কোম্পানি। খুব নাম করা কোম্পানি। তিন পুরুষের ব্যবসা। কোটি কোটি টাকার মালিক ওরা।

    চিকু বলল।

    গামহার-এর মনে হলো যে, সেটা বোঝা গেছিল। কারণ পিতৃপুরুষের পয়সাতে যারা বড়লোক হয় তাদের মধ্যে একটা বোকা-বোকা ছাপ থাকে।

    বাঙালির ব্যবসা তো তিন পুরুষেই উঠে যায়। এই শেষ পুরুষ।

    জারুল বলল।

    কাজ দেখলে তো ব্যবসা থাকবে। কর্মচারীরা লুটে-পুটে খাচ্ছে।

    ঝাঁঝি বলল, পেছন থেকে।

    তো, ও করে কি?

    গামহার জিজ্ঞেস করল।

    চিকুর কথার তোড় থামলে আবার ও বলল, নবেন্দু তাহলে করে কি? কাজ দেখে না তো!

    তারপর বলল, আচ্ছা তোমাদের পরিমণ্ডলে কোটিপতি নয়, এমন কেউই কি নেই? তবে আমাকে বেঁধে আনলে কেন? তোমাদের পেছনে গাধা-বোট এর মতন। আমি কি মানাই এখানে?

    ওরা হেসে উঠল জোরে।

    চিকু বলল, তোমার কপাল এখন খুলতে শুরু করেছে। এখন তো আর্টিস্টদেরই দিন। তুমি যে মার্টিজ, ভ্যান গঁ, বা গঁগা হয়ে যাবে না, তা কে বলতে পারে।

    ভ্যান গঁর জীবদ্দশাতে তার তো একটি মাত্র ছবি বিক্রি হয়েছিল।

    তোমার অনেক হবে। তুমিও কোটিপতি হলে বলে।

    ও বুদ্ধিজীবী।

    কে?

    কে আবার? নবেন্দু।

    মানে?

    ও কবি। বলে, বুদ্ধিজীবী, আসলে দুর্বুদ্ধিজীবী।

    তাই? নিজের নামেই লেখে, না কোনও ছদ্মনাম আছে?

    না, না নিজের নামেই লেখে।

    নবেন্দু রায়ের কবিতা পড়েননি আপনি? নানা পত্রপত্রিকাতেও বেরোয়।

    জারুল বলল।

    ঝাঁঝি বলল, নিজের নামেই বেরোয় তবে নিজেই লেখে কি না তা বলতে পারব না।

    মানে?

    মানে, পয়সার তো অভাব নেই। কোনও উপোসী-কবিকে মাইনে করে রেখেছে হয়তো। সে লিখে দেয় আর ওর নামে ছাপা হয়।

    এমনও হয় নাকি?

    এমনই তো বেশি হচ্ছে আজকাল।

    ঝাঁঝি বলল।

    ওর তো চার-পাঁচটা বইও আছে।

    চিকু বলল।

    হ্যাঁ। নিজের পয়সাতে ছাপালে বই বের করতে আর কী লাগে?

    কী কী নাম বইয়ের?

    জারুল জিজ্ঞেস করল।

    সব বইয়ের নাম বলতে পারব না। শেষেরটা জানি।

    ঝাঁঝি ঝঝের সঙ্গে বলল।

    তারপর বলল, সেটা আমাকেই উৎসর্গ করাতে, তাই জানি।

    গামহার না-বলেই নিজেকে বলল, ধরেছি ঠিকই!

    তাই? বাঃ সত্যি ঝাঁঝি! তুমি কী ভাগ্যবতী। তার মানে, কবির প্রেরণা তুমি। হাউ ফরচুনেট। ভাবা যায় না। আমাকে যদি কোনও কবি-সাহিত্যিক একটি বই উৎসর্গ করতেন তাহলে কী না করতে পারতাম আমি তার জন্যে।

    জারুল বলল। অগ্রিম কিছু করো না কেন, তাহলে এই কবিই পরের বই তোমাকেই উৎসর্গ করতেন।

    তুমিও কী অগ্রিম কিছু করেছিলে কি?

    বাজে কথা বোলো না তো।

    বিরক্তির সঙ্গে বলল ঝাঁঝি।

    তারপর বলল, কবির প্রেরণা না কপির প্রেরণা তা বলতে পারব না। তাছাড়া, প্রেরণা আদৌ নই, কিছু যদি আদৌ হই তো আমি তার যন্ত্রণা।

    যন্ত্রণা। ওমা! কেন?

    কেন-টেন জানি না, যন্ত্রণা ছাড়া অমন মাখনবাবুকে আর কীই বা দেওয়ার আছে।

    ছিঃ। ছিঃ। এমন করে কি কেউ ভালবাসার পুরস্কার দেয়।

    চিকু বলল।

    বইটির নাম কি?

    গামহার জিজ্ঞেস করল।

    ‘তুমি বড় দাগা দিলে।‘

    সকলে একসঙ্গে হেসে উঠল ওরা। একমাত্র গামহার ছাড়া।

    ও দাগা পাওয়ার জন্যে মনে মনে তৈরি হচ্ছিল।

    ঈসস্‌। বেচারী। কষ্ট হচ্ছে। কী নিষ্ঠুর গো তুমি ঝাঁঝি। এতো কষ্টও কি কেউ দেয় কাউকে?

    জারুল বলল।

    তাতেও যদি জ্ঞানচক্ষু না খোলে তো আমি কী করতে পারি!

    একবার ভেবে দেখো। আমি যখন ফোন করি নবেন্দুকে ও তখন ঘুমিয়েছিল। তোমাদের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে শুনে পড়ি-কী-মরি করে নেক-ব্রেক স্পিডে নিজে গাড়ি চালিয়ে একটার মধ্যে যোশীপুর পৌঁছে গেল। সকালে এক কাপ চাও খেয়েছে কি না সন্দেহ। ভালবাসার টান না থাকলে কেউ এমন করে ছুটে আসতে পারে। একটু ভালবাসা তো ফিরিয়েও দিতে পারো! একটুখানি!

    চিকু বলল।

    তা পারি। কিন্তু বাড়িতে তার খাণ্ডার বউ। সেও কম বড়লোকের মেয়ে নয়। পাছাল না কী গাছাল পরিবারের। হাওড়ার বিরাট বড়লোক তারা। আর এদিকে আমার ঘরের চাড্ডাকান্টেন্ট–শিপ-রিপেয়ারারকে ভালবাসা ফেরত দিতে গেলে, তারা দুজনে যখন আমাকে ধরেই রিপেয়ার করে দেবে তখন আমাকে দেখতে আসবে কে!

    আহা! ভালবাসলে একটু দুঃখ সইতেই হয়।

    কী বিপদ রে বাবা! ভাল তো আমি বাসিনি। যে বেসেছে, সেই দুঃখটা সহ্য করুক।

    ঝাঁঝি বলল।

    এসব বড় কমপ্লিকেডেট ব্যাপার-স্যাপার। যার ফোঁড়া সেই বোঝে।

    চিকু বলল।

    ইয়েস স্যার। যার ফোঁড়া সেই বোঝে।

    ঝাঁঝি বলল।

    ঝাঁঝি যে এত কথা বলে, কাল তা বোঝেনি গামহার। কথা না বললেও ওর একরকম আকর্ষণ, কথা বললেও অন্যরকম আকর্ষণ।

    এমন সময়ে ধ্বপ করে একটা পাথরে গাড়ির আন্ডারক্যারেজটা ধাক্কা খেল।

    জারুল বলল, পরের ফোঁড়ার চিন্তা রেখে এখন ভাল করে গাড়িটা চালাও। গাড়ির ফোঁড়া হলে এখানে সেঁক দেওয়ার লোক পাবে না।

    সেই যে গতকাল বিকেল তিনটেতে বেরিয়েছিল কলকাতা থেকে তারপরে একটুও বিশ্রাম পায়নি শরীর। চাহালাতে পৌঁছেই বাথরুমে গেছিল গামহার এবং চানও করেছিল। তারপর এসে, তার জন্যে যে আলাদা ঘোট ঘরটি বরাদ্দ করেছিল চিকু, সেই ঘরে এসে শুয়ে পড়েছিল। সারা রাতই তো ঘুম নেই। ঝাঁঝিদের অ্যাকসিডেন্ট। তার উপরে ‘আননোন-ট্রাক’-এর বিরুদ্ধে পুলিশ কেস হয় হয় তার ধকল! কখন যে গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন হয়েছিল, জানেও না।

    ঘুম যখন ভাঙল, তখন রাত নেমে গেছে বেশ কিছুক্ষণ। চাঁদ উঠেছে। বেশ একটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। বাইরের ইউক্যালিপটাস গাছগুলোর সুগোল মসৃণ সাদা কাণ্ডগুলিকে মেমসাহেবদের ওয়াক্সিংকরা উরুর মতো দেখাচ্ছে আর হাওয়ার দোলায় হাতছানি-দেওয়া শাখা-প্রশাখাগুলিকে তাদের বারই মতো। অগণিত, আন্দোলিত, মসৃণ, রূপোলি বাহুর বাহুমূল থেকে গন্ধ ছুটছে হাওয়ায় ভেসে চাঁদের দিকে। মিশ্র বনগন্ধ মুখে করে হাওয়াটা ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে, বনময় শুকনো পাতা উড়িয়ে-তাড়িয়ে রিট্রিভার কুকুরের মতন।

    ওরা বাইরে চেয়ার পেতে বসে গল্প করছিল। নবেন্দুরা এসে গেছে। অনেকক্ষণই এসেছে মনে হয়। কারণ, ওদের কথাবার্তাতে মনে হলো ওদের চানও হয়ে গেছে। দু’কাপ চাও খাওয়া হয়ে গেছে।

    ঝাঁঝি বলল, গামহারদা উঠলে চা করে দিতে হবে।

    জারুল বলল, বাসনপত্র তো সব এখানেই আছে। চৌকিদারকে শুধু বলতে হবে গরম জলটা নিয়ে আসতে। গামহারদা হাফ-অ্যান্ড-হাফ বিস্কুট খান তো? চিকু?

    কে জানে রে বাবা! হাফ-অ্যান্ড-হাফ খায়? না, ফুল-অ্যান্ড-ফুল খায়। এই জঙ্গলে যা দেবে, তাই খাবে। গামহারদা কি অবুঝ? কিছু অবান্তর চিন্তা করাটা তোমাদের স্বভাব।

    আমাদের মানে?

    মানে, মেয়েদের।

    বলতে পারতে ‘তোমার’। জাত তুলে কথা বলবে না। জেনারালাইজ করবে না।

    বগল-কাট্টি জামা পরা নবেন্দু বলল, সেটা ঠিকই?

    গলার স্বরটা কিন্তু ভালই ছেলেটির। এই প্রথমবার শুনল গামহার। এতক্ষণে সেই বগল-কাট্টি জামাটা ছেড়েছে নিশ্চয়ই।

    শুয়ে শুয়ে ভাবল, গামহার।

    রাত্রি জাগরণের পরে বাথরুম এবং চান এবং তারপরে ঘুম এবং পরে বিছানাতে শায়ীন থেকেই এই সিমলিপালের জঙ্গলের চাঁদনি রাতের অভিঘাতে একটা ঘোরের মত লাগছে গামহার-এর। ওর ঘুম যে ভেঙেছে তা ও জানাতে চায় না ওদের কারোকেই এখুনি। শুয়ে শুয়ে এই বাসন্তী বনের রাতে ওদের কথা শুনতে ভাল লাগছে। যেন, চুরি করেই শুনছে কথা। ইভস-ডুপার ও ভয়্যারদের মধ্যে তফাত নেই বিশেষ। দু’জনের চুরি করা আনন্দই সমান। একজন শ্রবণে আনন্দিত অন্যজন নয়নে। এবং তারা হয়ত এই সমাজ-অস্বীকৃত অপরাধের জন্যে সমান ধিকৃতও। যা কিছুই চুরি করে করা যায়, চুরি করে কারো চান দেখা, চুরি করে কারো গান শোনা, চুরি করে কারোকে চুমু খাওয়া এসবেরই মধ্যে এক সমাজ অস্বীকৃত আনন্দ থাকে। সেই অস্বীকারই, সেই চোখরাঙানিই, সেই আনন্দকে এক অন্য মাত্রা দেয়। অপরাধী মাত্রই সেই কথা জানে।

    কে কী পারম মেখেছে জানে না গামহার। মেয়েরা সাবান দিয়ে গা ধুয়ে পাট-ভাঙা শাড়ি পরে, সামান্য প্রসাধন আর সুগন্ধি মেখে এলেই কীরকম এক গা-শিরশির ভাল লাগাতে ভরে যায় পরিবেশ, আর এইরকম জায়গাতে তো যায়ই! সেই সুগন্ধর সঙ্গে প্রকৃতির গায়ের সব সুগও বুঝি মাখামাখি হয়ে যায়। পায়ের কারে জানালা দিয়ে যতটুকু দেখা যায়, তাই অনেক। এখন জানালার নিচেই চেয়ার পেতে বসে-থাকা ওদের কথা শুনবে গামহার আর দু’নাক ভরে গন্ধ নেবে শুধু।

    জারুল বলল, হরিমতি কেমন আছে নবেন্দুদা?

    সে আছে।

    গামহার ভাবল, হরিমতিটা কে? বাড়ির ঝি না কি? নবেন্দু কি তাহলে ঝৈন? স্ত্রীতে প্রবল আসক্ত যে সে স্ত্রৈণ হলে, ঝিতে প্রবল আসক্ত যে, সে ঝৈন কেন হবে না?

    গামহার নিজের সঙ্গে নিঃশব্দে কথা বলল।

    আছে মানে?

    আছে, মানে আছে। তার অরুণ-বরুণ-কিরণমালা নিয়ে এবং চন্দনা পাখি এবং রান্নাঘরের তদারকি, তামা-পেতল পালিশ নিয়ে বেশ আছে।

    একটু চুপ করে থেকে নবেন্দু বলল, তার কোলে আরেকটি আসছে।

    এমন নিরাসক্ত ‘কুড নট কেয়ারলেস’ গলাতে কথাটা বলল নবেন্দু যে, শ্রোতাদের মনে হতেই পারে যে, হরিমতি অর্থাৎ তার বউকে অন্য কোনও পুরুষেই গর্ভবতী করেছে।

    ঘাবড়ে গেল গামহার। এ তো সাংঘাতিক জিনিস। তার ছবিটা আর শেষ হবে না। ঝাঁঝির ছবিটা ওই উপদ্রুত পটভূমিতে সম্ভবত আর আঁকা হয়ে উঠবে না। ‘আননোন ট্রাক ড্রাইভারটার উপরে তার অত্যন্তই রাগ হচ্ছে এখন। ব্যাটা তোবার আর সময় পেলে না যেন।

    তাই?

    জারুল বলল, উচ্ছ্বসিত গলায় নবেন্দুকে।

    চিকু আর হারিত বলল, কনগ্রাচুলেশানস।

    কবে আসছে সে?

    কে?

    চমকে উঠে বলল, নবেন্দু।

    আঃ। কী ন্যাকামিই যে করতে পারো। আরে, নবাগন্তুক।

    আবারও ঘাবড়ে গেল গামহার। বগল-কাট্টি নবাগন্তুককে নিয়েই সে এতক্ষণ মনে মনে ব্যতিব্যস্থ ছিল তার মধ্যে আবার অন্য নবাগন্তুক। কী কেলো!

    ও।

    বলল, নবেন্দু। অনেক অঙ্ক কষতে হবে।

    তারপর বলল, কিরণমালার বয়স এখন যদি দেড় মাস হয়। তাহলে দেড় মাস প্লাস এক মাস প্লাস দশ মাস দশ দিন। হিসেব করে নাও কবে আসতে পারে। পাঁচ দশ দিন আগেও আসতে পারে। সিজারিয়ান হবে তো!

    যা বাব্বা! তুমি তো জাব্বারের ক্লাব-এ নাম লেখালে দেখছি।

    হারিত বলল।

    মানে?

    কোন জাব্বার?

    আরে আমাদের গ্রেট আঁতেল আবদুল জাব্বার।

    জাব্বারের সঙ্গে আমার কি?

    মানে?

    বাঃ। ওঁর স্ত্রীর পেটও কখনই খালি থাকে না। শ্বশুরের অগাধ সম্পত্তি তো! ওর শালা ইমতিয়াজের সঙ্গে কমপিটিশনে নেমেছে জাব্বার, কে বেশি ছেলেমেয়ের বাবা হতে পারে। শ্বশুর প্রত্যেক পোতা-পুতিকে নাকি দশ লাখ করে দিয়ে যাবেন।

    হায়! হায়! গুগনে গুরজে মেগ ঘন বুরষা, কূলে একা বইস্যা আছি, নাহি ভুরসা। তুমিও কি এই ক্লাবের মেম্বার হতে চাও নাকি?

    চিকু বলল।

    ঝাঁঝি বলল, পার সন্তানে দশ লাখ পেলে কারো সন্তানের জননী হতাম। মন্দ কী!

    তুমি কি বাঙাল না কি?

    নবেন্দু জিজ্ঞেস করল।

    এখন তো বাঙাল-ঘটি সর্বত্রই হরে-দরে একই হয়ে গেছে। বাঙালি, বাংলাদেশী আর বঙ্গস। আমার আদিবাড়ি ফরিদপুরে। বাড়িতে জ্যাঠা আর বাবা এখনও ওই ভাষাতে কথা বলেন। আমার মামাবাড়িও ঢাকার বিক্রমপুরে। মা ও দিদিমাও ওই ভাষায় কথা বলেন। লোকে বলে না, মাদার-টাঙ। তাই বলতে পারি। তবে, না-বলাই উচিত।

    কেন? না বলাই উচিত কেন?

    বাংলাদেশীরাই তো আর তাদের লিখ্য ভাষাতে ওই ভাষা ব্যবহার করেন না। কথ্য ভাষাতেও পশ্চিমবঙ্গীয় ভাষা, এমনকি কল্লুম-খেলুম পর্যন্ত ব্যবহার করেন। জানি না, ভাষার জন্যে যাঁরা এতো করলেন, তাঁদের এব্যাপারে এমন হীনমন্যতা কেন? তা তারাই যদি ওই মিষ্টি ভাষাকে ফেলে দ্যান, আমাদের দরকার কি বিজাতীয় ভাষা ব্যবহার করে! আমার পিতৃকুল মাতৃকুল সকলেই তো উদ্বাস্তু। কোনও মধুর স্মৃতি নিয়ে তো তারা ভিটে-মাটি, জমি-জিরেত, মাঠ-পুকুর, হরিসভা, লেখার টেবল, পিয়ানো, সবোদ, কুলদেবতা সব একবস্ত্রে ছেড়ে আসেননি! যারা পরম অসম্মানে একদিন আমাদের উৎখাত করেছিল তাদের প্রতি ভালবাসা রাজনীতিকদের নিজ স্বার্থর কারণে থাকতে পারে নানা কারণে আমাদের তো থাকার কথা নয়। তবু থেকে গেছে কিছু ভালবাসা, নস্টালজিয়া। যত তাড়াতাড়ি তা মুছে ফেলা যায়, ততই ভাল।

    বাবাঃ! হচ্ছিল গুগনে গুরজে মেগ ঘন বরষা’র কথা আর তুমি তো ছোটখাট বক্তৃতাই দিয়ে দিলে।

    চিকু বলল।

    জারুল বলল, তুমি বুঝবে কি মিস্টার চিকু চ্যাটার্জি। উদ্বাস্তু হলে জানতে। হঠাৎই সব শিকড় কেটে দিয়ে, নাভিমূল-এর সঙ্গে নাড়ি থেকে বিযুক্ত হতে কেমন যে লাগে তা যারা নাড়ি ছিঁড়েছে অসহায় নিরুপায়তায় শুধুমাত্র তারাই জানে। আমরা অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে জানিনি। কিন্তু মা দিদিমা, জ্যাঠা-দাদুরা জানেন। শরীরের ক্ষত হয়ত শুকিয়েছে, এখনও শুকোয়নি তাদের হৃদয়ের ক্ষত। শুকোবেও না, যতদিন বাঁচেন। সে কথা আমরাই বা ভুলি কী করে বল?

    সকলে চুপ করে রইল অনেকক্ষণ।

    এবারে কিন্তু গামহারদাকে ওঠাও। রাতের রান্নাবান্নার কিছু একটা করতে হবে তো। গামহারদা কি খাবেন?

    জারুল বলল।

    গামহারদার খাওয়ার ব্যাপারে কোনও ঝামেলা নেই। মানে, নেড়িকুত্তার মতো আর কী! গামহারদাকে একবার চাকদাতে নিয়ে গেছিলাম। তাই জানি। যা দেবে তাই চেটেপুটে তৃপ্তিভরে খাবে। বাইরে তো এমন সঙ্গীই দরকার।

    নেড়িকুত্তার সঙ্গে একজন নির্বিরোধী অন্তর্মুখী ভদ্রলোকের তুলনাটা কি ভাল হলো!

    কেন? নেড়িকুত্তা খারাপ না কি? কোন দিক দিয়ে খারাপ। তোমাদের এইসব ইডিয়টিক ইডিওসিনক্র্যাসি যত তাড়াতাড়ি ত্যাগ করবে, ততই মঙ্গল।

    তারপর বলল, এ যাত্রা জঙ্গল দেখার শখ মিটিয়ে দিতে হবে গামহারদার। বুঝেছ জারুল।

    হুঁ।

    জারুল বলল।

    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Article৩-৪. ন্যাশনাল হাইওয়ে
    Next Article ৭-৮. মুরগীর পাতলা ঝোল

    Related Articles

    বুদ্ধদেব গুহ

    বাবলি – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্ৰ ১ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ২ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৩ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৪ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    অবেলায় – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.