Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ৬. হেসেই অস্থির

    আশাপূর্ণা দেবী এক পাতা গল্প28 Mins Read0

    ৬. হেসেই অস্থির

    বাইরে এসে প্রিয়মাধব হেসেই অস্থির। উঃ আচ্ছা বিপদে ফেলেছিলে বুড়োকে! তবু ভাগ্যিস নাম দুটো মনে রেখেছিল!

    বললাম, সেটাই তো আসল। নামই তো সব! নাম জপই তো সব। নাম জপেই দেবতার প্রাণ প্রতিষ্ঠা।

    হল শুরু কবিত্ব! তোমার কি বিশ্বাস বুড়ো সেই পুরনো কালের দুর্বলতা মনে করে বসে আছে?

    হেসে বললাম, মনে করে কি আর বসে থাকতে হয়? যে থাকবার সে নিজেই মনের মধ্যে চেপে বসে থাকে। আমি ঠিক বুঝতে পেরেছি, এ যদি আমি না হয়ে সত্যিকার সুমিতা হত, ও ঠিক অনুভব করতে পারত!

    প্রিয়মাধব বিশ্বাস করেনি।

    প্রিয়মাধব হেসেছিল।

    তারপর প্রিয়মাধব গাড়িতে আসতে আসতে একটা কথা বলেছিল।

    হ্যাঁ, গাড়িতে শুধু ও আর আমিই আসছিলাম। ও বলল, সুমিতা

    হেসে বললাম, দেখ হাতে হাতে প্রমাণ। নামের মহিমা! বুঝতে পারছ নামই জপের বস্তু।

    ও আস্তে বলল, সে তো বুঝি! কিন্তু একটা কথা–এতদিন সংসারে কোনও চোখ ছিল না, আমাদের মধ্যেকার ফাঁকি ধরা পড়ত না, এখন বাড়িতে বউ আসবে, যত ছেলেমানুষই হোক, তবু মেয়ের চোখ, যে যদি ধরে ফেলে?

    ওর কথার উদ্দেশ্য বুঝতে পারছিলাম না। বলেছিলাম, মেয়ের চোখ যে ভয়ংকর বস্তু আমিও সে সত্য অস্বীকার করি না। তা হলে কী করা? চলে যাব? তা বলো তো কোনও তীর্থে-টির্থে চলে যাই

    আঃ নমিতা!

    ও রেগে উঠল।

    রাগের গলায় বলল, আঃ নমিতা, আমি বলতে চাইছি, বাইরেটা আমাদের খুব মজবুত রাখতে হবে বুঝলে? দেখাতে হবে আমাদের মধ্যে কোনও ফাঁক নেই, কোনও ফাঁকি নেই। আমরা খুব সুখী!

    আমি গম্ভীর গলায় বললাম, তার মানে ভেজালের উপর আরও ভেজাল? কিন্তু তাতে লাভ?

    লাভ?

    প্রিয়মাধব গাঢ় গলায় বলল, লাভ হচ্ছে প্রেস্টিজ বজায়। শ্বশুর শাশুড়ির মধ্যে যদি ইয়ে না দেখতে পায়, পরের মেয়ে জো পেয়ে যাবে, মানবে না, অবজ্ঞা করবে!

    বিস্মিত হয়েছিলাম।

    ও এমন ভাবে তলিয়ে ভাবতে পারে, কখনও টের পাইনি। আস্তে বললাম, তা হলে কী করতে হবে বলো?

    ওই তো। বলছি যে নতুন চোখকে দেখাতে হবে আমরা খুব সুখী–

    বুঝেছি! হেসে উঠলাম আমি, বোঝাতে হবে আমরা খুব সুখী, আমাদের মধ্যে প্রেমের বন্যা বইছে, আমরা দুজনে একদণ্ড না দেখলে অধীর হয়ে উঠি

    প্রিয়মাধব বলল, জানতাম তুমি বুঝতে পারবে! শুধু সমস্ত জীবনটাই তুমি ব্যঙ্গের ছলনায় নিজেকে ঢেকে রেখে এলে!

    তা একটা কিছু দিয়ে তো ঢাকতেই হবে–গম্ভীর গলায় বললাম, মানুষ তো পশু পক্ষী নয় যে কাপড়-চোপড় না হলেও চলবে তার!

    ও বলল, সেই তো। চলে না বলেই তো এ কথা বলা! মোটা পোশাকে নিজেদের ঢাকতে হবে। পরের মেয়ের সামনে নিরাবরণ হলে চলবে না।

    দেখা যাক! চেষ্টা করব সুখীর ভূমিকা অভিনয় করতে।

    ও একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল।

    বলল, অথচ এমন দিনও ছিল, যখন অভিনয় না করেও চলত! সত্যিই সুখী ছিলাম আমরা।

    আমি লীলাভরে বলে উঠলাম, তাই নাকি? সেটা কবে গো? খ্যাপার মতো কবে সেই পরশ পাথর পেয়ে হারিয়েছি?

    ও বলল, তুমি ঠাট্টা করছ। কিন্তু সেই প্রথম প্রথম, সুমিতাকে হারিয়েও! তখন কি সুখী ছিলাম না আমরা?

    .

    হয়তো ওর কথা ভুল নয়।

    হয়তো তবুও আমরা সুখী ছিলাম।

    আমাদের সেই যন্ত্রণাময় যৌবনের রাত্রির মার খেয়ে খেয়েও সুখীই ছিলাম।

    কারণ আমাদের মধ্যে আকর্ষণের তীব্রতা ছিল তখন! পরস্পরকে আঘাত হানার মধ্যেও তাই উগ্র একটা সুখের স্বাদ ছিল।

    আর অরুণ বড় হয়ে ওঠার পর সম্পর্কটাও কেমন সহজের সুরে গেঁথে গিয়েছিল।

    অরুণের কাছে ফাঁকি ধরা পড়ার ভয়েই হয়তো সেই সুখের অভিনয়ের মধ্যে সহজের স্বাদ পাওয়া।

    প্রিয়মাধব বলত, অরুণ। তোর মাকে বল তো গোটা তিরিশ টাকা বার করে রাখতে।…খোকা, তোর মার সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক কর সামনের ছুটিতে কোথায় আমরা বেড়াতে যাব।…বলল তো, সুমিতা তুমি আর তোমার ছেলেতে মিলে দেখছি এক দল হয়ে আমায় কোণঠাসা করে জব্দ করে ফেলছ। সুমিতা, এবার বোর্ডিঙে যাবার আগে তোমার ছেলের কী কী লাগবে লিস্ট করে রেখো!

    .

    খোকা, তোর মা!

    সুমিতা, তোমার ছেলে!

    বারবার এই মন্ত্র জপ করতে করতে সিদ্ধ হয়ে উঠছিল যেন ও।

    আমিও সেই সিদ্ধির সুরে সুর লাগাতাম বইকী! বলতাম, দেখ থোকা, তোর বাবার প্রত্যাশায় বসে থাকলে আমাদের আর বেড়াতে যাওয়া হয়েছে!… দেখিস খোকা লিস্ট দেখে তোর বাবা প্রথমে তর্ক করবে, বাড়াবাড়ি বলবে, তারপর নিজেই ডবল জিনিস কিনে আনবে।

    এমনি আরও কত কথার চাষই করতাম আমরা খোকাকে ঘিরে ঘিরে।

    মায়ের মতো শান্ত মিতভাষী অরুণ আমাদের এই লীলার দর্শক হয়ে শুধু লাজুক মুখে হাসত।

    বোর্ডিং থৈকে যখন আসত অরুণ, আমরা ঠিক মা বাপের মতোই শহরের স্টেশনে যেতাম ওকে আনতে। ছুটিতে বাড়ি আসার সেই প্রথম আবেগে অরুণ হয়তো একটু বেশি কথা কয়ে ফেলত, আমি বলতাম, খোকা তুই বাবার সঙ্গে বেশি কথা বলছিস।

    অরুণ লজ্জা পেয়ে তার গল্পের শ্রোতা হিসেবে আমাকেই লক্ষ্য করত। প্রিয়মাধব তখন বলত, খোকা ভারসাম্য রক্ষা হচ্ছে না, ওদিকটা বড় ঝুঁকি হয়ে যাচ্ছে!

    হেসে উঠতাম তিনজনেই।

    তখন তো আমরা খুব অসুখে ছিলাম না।

    পাছে লোকে আমাদের ভিতরের সম্পর্কের গলদ বুঝতে পারে, সেই ভেবে লোকের সামনে পরম সুখী দম্পতি সেজে সেই অভিনয়, তারপর প্রিয়মাধবের সেই বিষণ্ণ কাতর আক্ষেপ, এটা যদি সত্যিই হত নমিতা! যদি কোনও মন্ত্রবলে আমরা ভুলে যেতে পারতাম তুমি সুমিতা নও!

    আর তারপর আমার কৌতুক হাস্যচ্ছটা, ব্যঙ্গ উপহাস, পরিহাস! ওর বিষণ্ণতা কেটে যেত। হয়তো রাগত, হয়তো হাসত।

    মাঝে মাঝে আবার তবুও বিপদ আসত।

    যেমন সেবার নতুন চা বাগানের ঝিটার কাছে ধরা পড়তে পড়তে রয়ে যাওয়া।

    ঝিটা ভাল বাংলা বলত।

    সে প্রথম দিন ঘর ঝাড়তে এসে গালে হাত দিয়ে বলেছিল, এ কী মেমসাহেব আপনার বিছানা আলাদা ঘরে কেন?

    আমি তাড়াতাড়ি বলেছিলাম, সাহেব অনেক রাত অবধি বই পড়েন, চোখে আলো লাগলে ঘুম হয় না আমার!

    ঝিটা প্রবল প্রতিবাদ জানিয়েছিল, আমার এই স্বার্থপরতার বিরুদ্ধে।

    এ গল্প করেছিলাম প্রিয়মাধবের কাছে হেসে হেসে।

    প্রিয়মাধব বলেছিল, তা এ প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া স্বাভাবিক। একটা বাড়তি বিছানা এ ঘরে সাজিয়ে রাখলেও হয়।

    চমৎকার!

    ও গভীর চোখে তাকিয়ে বলেছিল, আর সত্যি বলতে একটা ঘরে দুটো খাট রাখলেও এখন বোধহয় আর কোনও অসুবিধে ছিল না।

    অসুবিধে ছিল না? বলেছিলাম নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে।

    ও বলল, মনে হয় না।

    খোলা তলোয়ারের উপর তো বাস করছি, সেটার ধার পরীক্ষা করতে চাও বুঝি?

    চাইলেও ক্ষতি নেই। পাথরে তলোয়ার অকেজো।

    নিজেকে খুব মহাপুরুষ ভাবো বুঝি এখন?

    মোটেই না, চিরকালই নিজেকে কাপুরুষ বলে জানি। আর তোমাকে পাথরের প্রতিমা বলে জানি।

    আমি চুপ করে গেলাম।

    কিন্তু আমি প্রতিবাদ করলাম না।

    এই জানাটাই তো ওকে জানিয়ে এসেছি আমি। আমার সেই বোকা অহংকার ওকেও নষ্ট করল, আমাকেও ক্ষয় করল।

    তবু চা বাগানে ওর সঙ্গে বেড়াতে গেছি আমি মেমসাহেব সেজে, মেমসাহেবের মান্য আর সেলাম কুড়িয়েছি। অরুণের ছুটির সময় নতুন নতুন দেশে বেড়াতে গিয়ে ভিতরের শূন্যতা ভুলে যেন ভরাট হয়ে উঠেছি, সেই স্মৃতিই সুখস্মৃতি।

    স্মৃতি বড় মমতাময়ী।

    সে সযত্নে সমস্ত জ্বালা যন্ত্রণায় তিক্ত স্বাদগুলি ধুয়ে মুছে তুলে রেখে দেয় মধুরটুকু সুন্দরটুকু।

    তাই দুর্গম দুরূহ পথের দুর্গতি ভুলে গিয়ে মানুষ আবার নতুন তীর্থযাত্রায় মাতে, প্রসব যন্ত্রণার ভয়াবহ স্মৃতি বিস্মৃত হয়ে মা আবার দ্বিতীয় সন্তানের জননী হতে চলে।

    তাই আমাদের সেই চা-বাগানের মাথাকোটা দিনগুলোর মধ্যেও সুখের স্মৃতিটুকুই স্মৃতি হয়ে ছিল প্রিয়মাধবের মধ্যে!

    তাই প্রশ্ন করেছিল, তখন কি আমরা সুখে ছিলাম না?

    .

    এখানে এসে সে জীবন হারিয়েছি আমরা।

    তা ছাড়া বিয়ে হয়ে অরুণও তো কেমন বদলে গেল।

    অথবা হয়তো বদলায়নি।

    আমাদেরই অরুণকে তার বউ উত্তরার পৃষ্ঠপটে দেখতে অভ্যস্ত হচ্ছিলাম! যে পৃষ্ঠপটটা বিবর্ণ অনুজ্জ্বল ধোঁয়াটে।

    উত্তরা যদি সোজাসুজি পাজি মেয়ে হত, হত মুখরা কি কুঁদুলে, অবাধ্য কি উদ্ধত, হয়তো স্বাভাবিকতা থাকত, আমাদেরও অসুবিধেটা কম হত।

    কিন্তু উত্তরা তা নয়।

    উত্তরা সভ্য মার্জিত, স্বল্পভাষিণী, আর সত্যের খাতিরে বলতেই হয়, নম্র বিনীত।

    কিন্তু ওর ওই বিনয়ের পিছনে যে অবজ্ঞা ছিল, ওর ওই নম্রতার পিছনে যে অনমনীয়তা, আর ওই ভিজে বেড়াল মার্কা সভ্যতার অন্তরালে যে অসভ্যতা, তা যেন লঙ্কাবাটার জ্বালা ধরায়।

    আগুনের জ্বালা ধরায় আমাকে, ওর ঈর্ষার বহর দেখে।

    বিয়ের কনে থেকেই দেখছি আমাদের ভালবাসা উত্তরার চক্ষুশূল।

    লক্ষ করে বুঝতে হত না, ওর প্রতিটি কথায়, প্রতিটি অভিব্যক্তিতে ধরা পড়ত সেই ঈর্ষা! প্রিয়মাধবকে বলেছিলাম, তোমার প্রেমাভিনয়টা একটু কমাও, পরের মেয়ের বিষ লাগছে।

    প্রিয়মাধব উত্তর দিয়েছিল, খুব ভাল, এটাই তো চেয়েছি।

    আচ্ছা কেন বলো তো?

    বুঝবে না তুমি। আর বুঝবে নাই বা কেন? একটা মেয়ের চোখের সামনে, আমরা নিঃস্ব আমরা শূন্য, এটা ধরা পড়া কি গৌরবের? তা ছাড়া

    হেসে উঠে বললাম, তুমি আজকাল লুকিয়ে বাংলা নাটক নভেল পড়ছ নাকি গো? নইলে এত ভাল ভাল কথা শিখলে কোথা থেকে?

    ও বলল, আমার জীবনটাই তো একটা নভেল। শিখি তো তার থেকেই শিখেছি।

    আগে বড় একটা ওর মধ্যে এই চিন্তার গভীরতা দেখিনি। হয়তো সত্যিই তাই, ওর জীবনটাই ওর মাস্টার। ওর এই সুরের সঙ্গে অন্তরঙ্গতার সুর মিশিয়ে যে কথা বলা উচিত ছিল, তা কি বলেছি? বলিনি। সেই চির অভ্যাসে হেসে হেসে বলেছি, ওরে বাস! শুনে ভয় করছে। কিন্তু তা ছাড়া-টা কী?

    তা ছাড়া? তা ছাড়াও অন্য দিকে তাকিয়ে বলে, নিজের কাছেই নিজে একটা হেঁয়ালি! বুঝতে পারি না সবটাই অভিনয় কিনা।

    কষ্টে বলি, তবে ভাবো বসে বসে হেঁয়ালির অর্থ!

    নাঃ ভাবাভাবি ছেড়ে দিয়েছিও হঠাৎ সোজা হয়ে উঠে বসে বলে, কিন্তু উনিই বা কেমন অভদ্র ঘরের মেয়ে যে শ্বশুর শাশুড়ির ভাব দেখলে ওঁর রাগ হয়? কারণটা কী?

    হেসে বললাম, দেবা ন জানন্তি।

    কিন্তু এ ক্ষেত্রে উত্তরার ওই কারণটা জানা মোটেই শক্ত ছিল না। কারণ হচ্ছে অরুণমাধবের প্রকৃতির মৃদুতা! অরুণ আস্তে চলে ফেরে, আস্তে কথা বলে, আস্তে হাসে, আস্তে খায়। অরুণ দাড়ি কামায় এক ঘণ্টা ধরে, স্নান করে ঘণ্টা ছাড়িয়ে, সারা সকালই অফিস যাবার প্রস্তুতি ওর। স্ত্রীর কোনও দাবি মেটাবার সময়ই নেই ওর। এমন স্বামী কোন মেয়ের পছন্দ? কে না জানে উগ্র কড়া স্বামী অনেক পছন্দ মেয়েদের, নিরীহ শান্ত স্বামীর চেয়ে। উত্তরার কাছেও অরুণমাধব তাই অনেক নম্বরে ফেল।

    উত্তরার স্বামী স্ত্রীকে নিয়ে মাতামাতি করতে জানে না, অথচ মা বাপের প্রাপ্য সম্মানের পাওনা দিতে জানে, এটাও কম বিরক্তিকর নয়।

    তবু হয়তো এত বিরক্তি আসত না, যদি উত্তরা ওর প্রৌঢ় শ্বশুরের প্রকৃতিতে যুবকোচিত উত্তাপ আর উৎসাহ না দেখত! উত্তরার শ্বশুর হাঁটে টগবগিয়ে, কথা কয় জোরে জোরে, হাসে প্রচুর, খায় প্রচুর। সব কাজে চটপটে সে।

    আর স্ত্রীকে নিয়ে মাতামাতিটা তো প্রায় দৃষ্টিকটু।

    সারাদিন তার হাঁক পাড়াপাড়ি, বউমা, তোমার শাশুড়ি কোথায় গেল? বউমা তোমার শাশুড়ি ঠাকরুন করছেন কী?…সুমিতা, তুমি যে বলেছিলে তোমার চশমাটার পাওয়ার বদলানো দরকার, কই যাবে তো চলো।… সুমিতা, কই নতুন বউকে নিয়ে আমোদ-আহ্লাদ করছ না? বলো তো থিয়েটারের টিকিট কেটে আসি।…

    ওর প্রকৃতির এই প্রাচুর্য তো সবটাই কৃত্রিম নয়। এটাই ওর প্রকৃতি। ওর বিধাতার দান। এই প্রাচুর্যের ফাঁদেই আটকা পড়েছিল একদিন নমিতা নামের একটা মেয়ে। শুধু এই অগাধ প্রাচুর্যের মুখে প্রকাণ্ড এক পাথর পড়ে গিয়ে সহজ প্রবাহের পথটা গিয়েছিল চেপে। তাই সে কখনও বিকৃতির পথে, কখনও ঘূর্ণি পথে, আর কখনও পথ হারিয়ে পাক খেয়ে মরেছে।

    এখন

    পরের মেয়ের কাছে মান সম্মান বজায় রাখবার জন্যে সেই পাথরটাকে জোর করে সরাচ্ছে ও, তাই কখনও বা কৃত্রিম লাগছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারি এই অভিনয়টাই ওর আসল। এই জীবনটা পেলেই ও বর্তে যেত।

    কিন্তু ওর বিধাতা কিছুতেই যে বর্তাতে দেবেন না ওকে। এই পণ করে রেখেছেন। কী দোষ আমার, কী বা দোষ ওর ছেলের বউয়ের?

    শুধু উত্তরার হিংসের চোখ অতবড় দেহটাকে ভেঙে-চুরে হুড়মুড়িয়ে ফেলে দিল, এ কথা বলব। কোন মুখে?

    ওর জীবনের অমিতাচারের ইতিহাস তো আমার অজানা নয়!

    তবু ভাবি উত্তরা যদি অতটুকু বয়েসের খোলসে অতখানি পাকা মনটা ভরে নিয়ে না আসত!

    হয়তো চারখানা থিয়েটারের টিকিট কেটে আনত প্রিয়মাধব, হাঁক পাড়ত খোকা নাম! বউমা তোমার শাশুড়ি ঠাকরুনকে নামাও মা!

    খোকাও নামত না, বউমাও নামত না।

    নামতাম আমি।

    চাপা গলায় বলতাম, ওরা যাবে না। চলো আমরাই যাই।

    প্রিয়মাধব আমার চাপা গলার মর্যাদা রাখত না। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলত, কেন, ওঁরা যাবেন না কেন শুনি? কী রাজকার্য পড়ল ওঁদের?

    আমি ওকে নিবৃত্ত করতে পারতাম না।

    তখন অরুণমাধব নেমে আসত, ভারী মুখে বলত, ওর মাথা ধরেছে নাকি, চলো আমরাই যাই।

    প্রিয়মাধব বলত, ঠিক আছে। তাই যাব! আশ্চর্য, মাথাটাও খুব হাতধরা আমার বউমার। দরকার মাফিক ঠিক সময়ে ধরে ওঠে।

    আমি হাঁ হাঁ করে বলতাম, কী যে বলো! মাথাধরার একটা ধাত থাকে বুঝলে? খোকা, তুই যাবি মানে? বউমা একা থাকবে?

    খোকা চাপা ভারী গলায় বলত, থাকলেই বা, ভূতে তো আর খেয়ে ফেলবে না। চলো চলো। বুঝতে পারতাম না, এই বিরক্তিটা কার উপর! আমাদের নির্লজ্জতা, না বউমার অবাধ্যতা, কোনটা ওকে এমন প্রকৃতিছাড়া অসহিষ্ণু করে তুলছে।

    তবু নির্লজ্জ আমাদের হতেই হচ্ছে।

    ভালবাসার আধিক্য দেখানো ছাড়া উপায় কোথায় আমাদের? পায়ের নীচে মাটি কই?

    ভালবাসা না দেখালে কীসের.জোরে খাড়া হয়ে থাকব ওদের সামনে? প্রিয়মাধবের সিদ্ধান্ত ভুল নয়।

    .

    আমার সঙ্গে ওর সতীনের সম্পর্ক নয়, এটা যেন মাঝে মাঝে ভুলে যায় উত্তরা। ওর চোখে সেই দৃষ্টি। অথচ বউকে নিয়েও তো কম মাতামাতি করতে চেষ্টা করেনি প্রিয়মাধব। বউমা, কী শাড়ি তোমার পছন্দ? বউমা, কোন মাছ খাবে বলো? বউমা, কোন ফুলে তোমার রুচি? বউমা, মুখখানি কেন পেঁচা করে বসে আছ মা! মায়ের জন্যে মন কেমন করছে বুঝি? বলো তো পৌঁছে দিয়ে আসি

    এ তো হরদম চালিয়ে যেতে চেষ্টা করেছে।

    কিন্তু চালাতে পারেনি।

    পাথরে ঠেক খেয়ে ফিরে এসেছে।

    মাঝে মাঝে বলেছে প্রিয়মাধব, আচ্ছা, ও কি আমাদের সন্দেহ করে?

    আমি উড়িয়ে দিয়েছি। বলেছি, পাগল? সন্দেহের কারণ কী?

    তবে অমন করে কেন ও?

    কত মেয়ের কত রকম প্রকৃতি!

    আমি বলতাম, কারও জীবনকে মহানিশা করার ক্ষমতা কি মানুষের? যার যা বিধিলিপি।

    ও মাথা হেঁট করত।

    বলত, তা বটে!

    এমনি চলতে চলতে আমরা কি ক্রমশ পরস্পরের কাছাকাছি এসে যাচ্ছিলাম?

    জানি না।

    এর মধ্যেই তো এল সেই ভয়ংকর দিন!

    প্রিয়মাধবের স্ট্রোক হল।

    চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেল ও।

    যেন ছুটন্ত ঘোড়া দুর্বার বেগে ছুটতে ছুটতে খাদে গড়িয়ে পড়ে গেল।

    সেই ভয়ংকর মুহূর্তে আমি নাকি ওর নাম ধরে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম!

    জানি না, আমার জ্ঞান ছিল না।

    পরে উত্তরা মুচকি হেসে বলেছিল, আপনারা বুঝি দুজনেই দুজনকে নাম ধরে ডাকেন মা?

    ওর সামনে বেশিক্ষণ ভুরু সোজা রাখতে পারি না আমি, সেদিনও পারিনি। বলেছিলাম, তার মানে?

    ও নিরীহ মুখ নিয়ে বলেছিল, মানে কিছু না। যেদিন বাবা সিঁড়িতে গড়িয়ে পড়ে গেলেন, সেদিন দেখলাম কিনা আপনি বাবার নাম করে চেঁচিয়ে ডেকে উঠে ঝাঁপিয়ে গিয়ে পড়লেন।

    আমি এই ধৃষ্টতার দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম, বিয়ে দেবার আগে মেয়েকে সহবত শিক্ষা দিতে হয়, এটা বোধহয় তোমার মা জানেন না বউমা!

    ও মুখ কালো করে উঠে গিয়েছিল।

    এই মুখ কালো করে উঠে যাওয়ার ভঙ্গিটাই ওর সব সময়ের ভঙ্গি!

    ভাবি, বলব না কিছু।

    তবু বলা হয়ে যায়। হয়তো ও বলিয়ে ছাড়বে পণ করেই আসে।

    আমি যদি দৈবাৎ কোনও দিন সময় পেয়ে অরুণের কোনও প্রিয় খাদ্য তৈরি করে রাখি, উত্তরা। আত্মস্থ গলায় বলে, কেন বৃথা কষ্ট করছেন, ওসব ও খেতেই পারে না।

    আমি যদি বামুন ঠাকুরের কাছে গাওয়া ঘিয়ের বোতল রেখে বলে রাখি দাদাবাবুর খাবার সময় মনে করে দিও ঠাকুর! উত্তরা আমার কানে পৌঁছনো সুরে আদেশ দেয়, দাদাবাবুকে কাঁচা ঘি দিও না ঠাকুর, সহ্য হয় না ওর!

    আমি যদি দৈবাৎ কোনও দিন বলি, তোমার শ্বশুর ডাকাডাকি করছেন বউমা, চললাম, তুমি তোমার শ্বশুরের এই হালুয়াটুকু করে আনো তো৷

    ও অম্লান বদনে বলে, আমার হাতের হালুয়া তো বাবার পছন্দ হবে না মা, ও আপনি পরে এসে করে নেবেন।

    এতেও কি ভুরু সোজা রাখা সহজ?

    চুপ করে থাকা সম্ভব?

    বলব না বলেও মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়, পছন্দ হবেই, এমন ইচ্ছে নিয়ে করলেই পছন্দ হয় বউমা?

    বলা হয়ে যায়, অরুণের কী সহ্য হয় না হয়, সেটা আমার থেকে তুমি বেশি জেনে ফেললে কী করে বলো তো বউমা?

    ও মুখ কালো করে উঠে যায়।

    আর তারপর অরুণ মুখ ম্লান করে ঘুরে বেড়ায়।

    .

    দিদি যদি থাকত, দিদির সংসার কি দিদিকে সসম্মানে জায়গা দিত?

    পঙ্গু হয়ে পড়ে থেকেও নিষ্ঠুর হত না প্রিয়মাধব?

    হয়তো তাই হত।

    দিদি সহজ অধিকারের দাবিতে ঠিক জায়গায় প্রতিষ্ঠিত থাকত, আমি সেই প্রতিষ্ঠার জায়গাটা ঢিলে হয়ে যাবার ভয়ে বারবার স্কু আঁটতে যাই, তাই হয়তো সবটাই কড়া কঠিন হয়ে ওঠে।

    বহু জন্মের শত্রু সেই আমার দিদিকে যদি সামনে পেতাম একবার!

    মনে মনে বৃন্দাবনের পথে পথে কত ঘুরেছি, দিদিকে ধরে ফেলেছি, হাতে ধরে বলেছি, দিদি সাধ মিটেছে। তোর জিনিস তুই নে। ফিরিয়ে দে আমার সেই থান কাপড়খানা। যেটা চুরি করে নিয়ে যাবার

    সঙ্গে সঙ্গে তুই আমার সারা জীবনের শান্তি চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলি।

    কিন্তু গেলাম কই সেই বৃন্দাবনে?

    যেখানে দিদি মায়া হয়ে ছায়া হয়ে কল্পনা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে?

    না, কোথাও গেলাম না আমি।

    পালালাম না, আত্মহত্যা করলাম না। কলকাতার এই ছোট্ট বাড়িখানার একখানা ঘরে আস্তে আস্তে ক্ষয় হচ্ছি আমি।

    ক্রমশই বাকি সব ধূসর হয়ে যাচ্ছে।

    এখন শুধু জানি সকালে উঠেই প্রিয়মাধবের মুখ ধোওয়ার জল গরম করতে হবে, তারপর তার বেডপ্যান আনতে হবে, তারপর তাকে স্পঞ্জ করাতে হবে, তারপর তাকে ফলের রস আর দুধ খাইয়ে তার উপযুক্ত রান্নাটুকু করে নিতে হবে, তারপর তাকে খাইয়ে দিতে হবে, তারপর তাকে খবরের কাগজ পড়ে শোনাতে হবে–এই তারপরের মালার সুতো কোথাও ছিঁড়ে ঝুলে পড়ে না, জপের মালার মতো ঘুরে ঘুরে আসে শুধু!

    প্রিয়মাধবের এই অবস্থার জন্যে নিজেকে দায়ী মনে করেই কি ওর এত সেবা করছি আমি? না ওর সেবা না করে আমার উপায় নেই বলে?

    জানি না।

    বোধ করি উপায় নেই বলেই।

    ও আমাকে অপমান করে, আমি ওর এই অধঃপতনের মায়ায় মরে যাই, লজ্জায় মরে যাই।…

    অরুণমাধব বলে, মা, এমন করে শরীরকে অযত্ন করছ, ওটা তোমার স্বার্থপরতা। বাবার জন্যেও অন্তত খাড়া থাকতে হবে তোমায়।

    আমি বলি, তাই তো থেকে এলাম এতদিন।

    ও মানে বুঝতে পারে না, তাকিয়ে থাকে।

    কিন্তু আর কতকাল খাড়া থাকব আমি?

    আমার এই দীর্ঘদিনের যন্ত্রণার ইতিহাস কেউ জানে? কেউ শুনবে কান দিয়ে?

    কতবার ভেবেছি অরুণকে এ কথা বলে যাব আমি।

    কোথাও একটা স্বীকারোক্তির দরকার আমার।

    কিন্তু মায়াই আমার সর্বনাশ করেছে। বলতে দেয় না।

    অরুণ যখন মা বলে কাছে আসে, তখন কী করে বলব, অরুণ, আমি তো তোর মা নই, আমি তোকে এতদিন শুধু ঠকিয়ে এসেছি।

    কিন্তু মানুষ যে নিজেই নিজেকে অবিরত ঠকিয়ে চলে, বুঝতে পারে সেটা? নিজেকে চেনে না মানুষ! কলকাতায় আসার আগে কি ভাবতে পারতাম আমি, একদিন লুকিয়ে রিকশাগাড়ি চড়ে হেমন্ত উকিলের ভাইদের বাড়ির সামনে বেড়াতে যাব?

    .

    তবু গিয়েছিলাম একদিন। মনকে চোখ ঠেরে বলেছিলাম, দেখি গিয়ে সেই বুড়িটা আছে কিনা?

    কিন্তু থাকা কি সম্ভব? আবার অসম্ভবও নয়। বাড়ির মালিকরা যদি আমায় দেখতে পেত? তারা কি চিনতে পারত? চিনে ফেলে বলে উঠত, এ কী, পেতনিটা আবার কোথা থেকে এল! এটা না মরে গিয়েছিল?

    না কি ওরা ভাবত ইনি বউদির বোন সুমিতা দেবী। প্রিয়মাধবের স্ত্রী!

    ওরা কী বলে, জানতে ইচ্ছে হয়েছিল আমার, কিন্তু ওদের কাউকে দেখতে পাইনি। ওরা ও বাড়ি ভাড়া দিয়ে কোথায় চলে গিয়েছিল।

    আমি যদি এই বাড়িটাতেই থেকে যেতাম, ওদের সঙ্গে ঝগড়া কোঁদল করে, বার ব্রত আর উপোস করে, হেমন্ত উকিলের মার মতন একটা শুকনো বিধবা বুড়ি হয়ে যেতাম, তা হলেই কি উচিত হত আমার?

    জীবনের সব কিছুই ভুল আমার?

    না, সে কথা ভাবতে পারি না।

    সে- জীবনে আমি প্রিয়মাধবকে পেতাম কোথায়?

    তার ভালবাসা আর না-ভালবাসা, তার আদর সম্মান আর ঘৃণা অপমান, সব কিছুই তো অজানা থেকে যেত আমার?

    সেই অর্থহীন জীবনের মূল্য কী?

    তবু উকিলদের বাড়িটা দেখতে ইচ্ছে হল আমার।

    .

    রিকশা করে গেলাম।

    আমাদের সিকদার বাগানের এই বাড়িটা থেকে খুব বেশি দুর ছিল না ও বাড়িটা।

    বাড়িটার সামনে গিয়ে রিকশা থেকে নামলাম।

    পয়সা দিলাম না।

    বললাম, দাঁড়া, এক্ষুনি ফিরব!

    তারপর ওকেই বললাম, কড়া নাড়া দে।

    ভয়ানক একটা উত্তেজনা অনুভব করছিলাম। আবার কেমন যেন একটা ভয় ভয়। পালাতে পারলেই ভাল হয় যেন, কেনই বা এলাম? কী বলব?

    কী বলব সেটা অবশ্য ঠিক করে রেখেছিলাম।

    বলব, যমজ বোনের স্মৃতির জায়গাটা দেখতে এলাম একবার। এতদিন লোকালয়ের বাইরে চা বাগানে পড়ে ছিলাম।

    ওরা নিশ্চয়ই সৌজন্য করে বসাবে।

    নমিতার দেওর দুটোর নিশ্চয় বিয়ে হয়ে গিয়েছে, ছেলেমেয়ে হয়েছে, কাউকেই চিনতে পারা যাবে না। জিজ্ঞেস করে করে জেনে নিতে হবে।

    কী লাভ হবে জেনে?

    কী জানি!

    হয়তো মনের একেবারে ভিতরের খাঁজে একটা অস্ফুট আকাঙ্ক্ষা ছিল, ওরা ওদের বাড়ির বিধবা বড় বউয়ের সেই আকস্মিক মৃত্যুর সংবাদ বিশ্বাস করেছিল কিনা, সে মৃত্যুতে দুঃখবোধ করেছিল কিনা।

    যদিই দুঃখবোধ করে থাকে, লাভ কী হবে শুনে?

    ভেবেছি সে কথা।

    ভেবে ভেবে শেষ পর্যন্ত মনে হয়েছে, বোধ করি নিজের মূল্য যাচাই হওয়াই লাভ।

    হেমন্ত উকিলের বিধবা স্ত্রীর কোথাও কোনও মূল্য আছে কিনা জানা।

    অথচ ওই পরিচয়টার খোলসটার মধ্যে নমিতাকে তো কোনও দিনই ভরতে পারিনি।

    কড়া নাড়ার পরে দোর খুলেছিল।

    একটা বিরক্ত কণ্ঠ খবর দিয়েছিল, ও সব নামে এখানে কেউ থাকে না। হতে পারে বাড়িওয়ালার নাম, তারা ভাড়াটে।

    কণ্ঠটা একটা বালিকার, কিন্তু ঝাঁজটা বালিকার মতো নয়। অকারণ জ্বালাতনে বিরক্ত সে।

    বিরক্ত হবার অধিকার তার আছে।

    আছে, সকলেরই বিরক্ত হবার অধিকার আছে। একদা হেমন্ত উকিলের বিধবা স্ত্রীরও ছিল, এখন আর নেই।

    এখন শুধু পাথর হবার সাধনা তার।

    এখন তার ছেলের শাশুড়ি যদি এসে বলে, সাবিত্রীর মতন মরা স্বামী নিয়ে যমের সঙ্গে যুদ্ধ বেয়ানের, তবু যুগটা তো সত্যযুগ নয় ভাই, তাই ভয় হয় সবই বুঝি বৃথা হয়।তা হলেও নরম মুখে বলতে হয় তাকে, বৃথা জেনেই তো করে চলেছি বেয়ান। যুদ্ধ নয়, ঋণ শোধ!

    যদি বেয়ানের মেয়েও নরম গলায় বলে, কিন্তু আশ্চর্যের কথা এই, এত ইয়ে ছিল বাবার, অথচ এখন রাতদিন আপনাকে খিচোচ্ছেন!

    ইয়ে বলেই সারে বেয়ানের মেয়ে।

    তবু এখন আর ভুরু কোঁচকানো চলে না, মসৃণ রাখতে হয়। হেসে বলতে হয়, তবু রক্ষে বউমা যে, রোগে মতিভ্রংশ হয়ে রাতদিন আমাকেই খিচোচ্ছেন। অন্য কারও উপর কোপ পড়লে বিপদ আরও বাড়ত! কী বলেন বেয়ান?

    ভাঙব তো মচকাব না, মরব তো মর্যাদায় হারব না, এই প্রতিজ্ঞার উপর জীবন কাটিয়ে এলাম, এখন কে জানে শেষরক্ষে হয় কিনা!

    কিন্তু আমার এই লড়াইয়ের ইতিহাস কেউ জানবে না? আমার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সব শেষ হয়ে যাবে?

    কিন্তু কাকে জানাতে চাই?

    প্রিয়মাধবকে?

    সে তো রথের পাদানিতে পা রেখেছে! আমার কথা জানবার জন্যে কি আমার মরণের পরে বসে থাকবে?

    অরুণমাধব?

    তাই কি ইচ্ছে হয়?

    ও মানেই তো উত্তরা। যার ভয়ে রাত্রে ভিন্ন লিখি না। তবে কাকে?

    চুপি চুপি তবে বলি, দিদি, তোর জন্যে লিখে মরছি এই কথার বোঝা!

    হাঁ তোর জন্যে।

    এখনও যে আমার আশা হয়, তুই আসবি।

    হয়তো আমি মরে গেছি শুনলে নিশ্চিন্ত হয়ে এসে তোর ছেলেকে নিবি! দিদি তুই আর তোর সংসার তুই নে, পায়ে পড়ি তোর! শুধু তোর ওই চোখ জোড়াটা সরিয়ে নে আমার সর্বত্র থেকে।

    .

    এরপর ভারী খাপছাড়া খাপছাড়া লেখা।

    কোনও পাতায় দু লাইন, কোনও পাতায় হয়তো দশ লাইন।

    ভুল ভুল।

    সারাটা জীবন আমি একটা ভুলের নৈবেদ্য জুগিয়ে এলাম।

    দিদি আসবে না।

    দিদি মরে গেছে।

    দিদি সেই রাত্রেই খাদে পড়ে আত্মহত্যা করেছে।

    আর আমাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে গেছে আরও এক নিঃসীম অন্ধকার খাদের মধ্যে।

    .

    আচ্ছা, পরলোক বলে কি সত্যিই কিছু আছে? সেখানে কি সত্যিই আবার চেনা মানুষের সঙ্গে দেখা হয়?

    দিদির কাছে গিয়ে কি বলতে পারব, দিদি চিরকাল তো শত্রুতা সাধলি, মরেও শত্রুতা সেধে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল?

    আত্মহত্যায় নাকি স্বর্গ নেই, পরলোক নেই, আছে শুধু প্রেতলোক! তা দিদির জন্যেই বা সেই প্রেতলোক নয় কেন? ও কি আত্মহত্যা করে মরেও স্বর্গে যাবার ছাড়পত্র পাবে? কেন? কেন? বেশ, আমিও তো সেখানে যাচ্ছি। নমিতাকে কি হত্যা করিনি আমি? অথবা এই সুমিতাকে?

    প্রিয়মাধব আমায় বলে, যখন তখন কী অত লেখো?

    আমি বলি, জবানবন্দি।

    ও বুঝতে পেরেছিল, চেঁচিয়ে উঠে বলেছিল, পুড়িয়ে ফেলো বলছি, পুড়িয়ে ফেলল। ভেবেছ কি তুমি? তোমার ওই জবানবন্দি কে চায়?

    আমি হেসে তুলে রেখেছি ওর সামনে আলমারিতে। জানি ও খাট থেকে নেমে এসে খুলে বার করতে পারবে না।

    প্রতিদিন ও আমায় মিনতি করে, পুড়িয়ে ফেলো সুমিতা, পুড়িয়ে ফেলল।আমি হেসেছি। বলেছি, থাক না। যখন তুমিও থাকবে না–আমিও থাকব না। তখন কেউ দেখলেই বা কি?

    ও রেগে বলেছে, যখন তুমিও থাকবে না–আমিও থাকব না, তখনকার জন্যে আমাদের কলঙ্ক কাহিনীটা পাকা খাতায় তোলা থাকুক, এই ইচ্ছে তোমার?

    আমি হেসে বলেছি, কাহিনীটা কলঙ্কের? আমার তো তা মনে হয় না। আমি তো ভাবি প্রেমের।

    হাসি দেখলেই জ্বলে যায় প্রিয়মাধব!

    শুধু আমার নয়, সকলেরই।

    পাশের বাড়ি থেকেও যদি কোনও সময় একটু হইহই হাসির আওয়াজ পাওয়া যায় তো চেঁচিয়ে ওঠে ও, হাসে কে? হাসে কে অমন অসভ্যের মতো? ঘুসি মেরে দাঁতগুলো ভেঙে দিতে পারে না কেউ?

    আমি হাসলে তো কথাই নেই।

    জ্বলে ওঠে, হাত বাড়িয়ে কাছের টেবিল থেকে ওষুধের শিশি নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে ভাঙে। আর বলে, লজ্জা করে না? লজ্জা করে না? হাসতে তোমার লজ্জা করে না? অন্য মেয়েমানুষ হলে কোনকালে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলত। বুঝলে? নয়তো বিষ খেত। অথচ তুমি বেহায়া মেয়েমানুষ, দাঁত বার করে হাসছ!

    আমি কষ্টে ঠোঁটে দাঁত চেপে বলি, দাঁত পড়ে গেলে তো আর বার করে হাসবার উপায় থাকবে না? যতদিন আছে হেসে নিই!

    ও বলত, ওঃ বটে! এখনও এত বাসনা? তবে যাও এ ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে হাসো গে! যাও যাও।

    আসতেই হত একটুক্ষণের জন্যে।

    খুবই একটুক্ষণের জন্যে।

    কারণ পরক্ষণেই তো ডাক ছাড়বে ও, অরুণ অরুণ, তোমার মা-টি কোথায় গেলেন? এই হতভাগার এ সময় একটা ওষুধ খাবার কথা ছিল না?

    আমি ঘরে আসি। বলি, এই তো ওষুধ খেলে, আবার ওষুধ খাবার বাসনা কেন?

    ও চেঁচিয়ে ওঠে, ঘাট হয়েছে, অন্যায় হয়েছে। রোগের জ্বালায় সময়ের জ্ঞান ভুলে গিয়ে মহারানির বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটিয়ে ফেলেছি।

    .

    অরুণ আমায় একা পেলে বলে, মা আর কত খাটবে তুমি? একটা নার্স রাখা হোক।

    আমি হেসে বলি, কূলে এসে তরী ডোবাব? এতদিনই যখন খেটে এলাম, তখন বাকি দিন কটাও–

    .

    ও অন্যদিকে তাকিয়ে অপ্রতিভ গলায় বলে, ডাক্তারবাবু তো বলেন, তার কোনও ঠিক নেই। হয়তো এই রকম অবস্থাতেই আরও দশ বছর

    আমি ওর দিকে স্পষ্ট চোখ তুলে তাকাই।

    বলি, তেমন হলে অবিশ্যিই নার্স রাখতে হবে তোকে।

    ও হয়তো আমার এ কথার মানে বুঝতে পারে না। দুঃখিত গলায় বলে, তোমাকে একেবারে শেষ করে তবে নার্স রাখা হবে, এই তবে তুমি চাও?

    আমি তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে দেখতে চেষ্টা করি এ আক্ষেপ ওর সত্যি, না শুধু ভদ্রতা? এ দুঃখ মায়ের জন্যে, না শুধু একটা মানুষের জন্যে?…ভালবাসা পেলেও তো বিশ্বাস করতে পারি না আমি এটা সত্যি। মনে হয় দয়া করছে, করুণা করছে। যাতে আমার আজীবনের বিতৃষ্ণা। অথচ কত লোককে দেখেছি শুধু দয়া কাড়বার জন্যেই বানিয়ে বানিয়ে দুঃখের গাথা গাইতে। বিশেষ করে মেয়েমানুষকে। অথচ আমার ওতেই

    হ্যাঁ, তাই আমি অরুণের ভালবাসার চোখকেও সন্দেহের চোখে দেখেছি। ভাবছি দয়া নয় তো? ভাবছি রক্তমাংসের যোগ যেখানে নেই সেখানে সত্যি ভালবাসা আসবে কোথা থেকে?

    ও যখন ছোট ছিল, ভাবতাম আমার উপর নির্ভর করতে হয়, তাই আমার উপর আকর্ষণ! মা ছেলের ভালবাসা যাচাই করতে হলে করতে হয় ছেলের বিয়ের পর। যখন ছেলেকে আর নির্ভর করতে হয় না।

    কিন্তু আমি ওকে যাচাই করব কোন দাবিতে? আমায় যাচাই করবে কে?

    আমি কি সত্যি মার মতো ভালবেসেছি ওকে? আমি তো ওকে আমার বলে ভাবতে পারিনি কোনওদিন। পরের জিনিস কেড়ে নিয়ে কাছে রেখেছি, সেই পাপে চিরদিন তার ভার বইছি, এই তো৷

    .

    দিদি, তুই স্বর্গে নরকে যেখানেই থাকিস, আমার এই দুঃসহ বঞ্চনার জীবনের যন্ত্রণা দেখতে পাচ্ছিস কি না?..যদি পাস তো একফোঁটা দয়া আমার জন্যে রাখিস।

    হ্যাঁ দয়া।

    যে দয়ায় আমার আজীবনের বিতৃষ্ণা।

    শুধু তোর কাছে সেই জিনিসটা চাই দিদি।

    আর যদি তুই এই পৃথিবীতেই থাকিস, আর আমার এই জবানবন্দির খাতা তোর চোখে পড়ে তো চোখের জল একফোঁটা ফেলিস আমার জন্যে।

    অরুণকে আমি বলেছি, আমাকে শেষ করা তো তোদের হাতে নয় বাপু!

    অরুণ ম্লান গলায় বলে, নয় কী করে বলি? বাবা তো সে ভার নিয়েইছেন দেখছি।

    আমি হেসে উঠে বলি, যাক এতদিনে তোর বাবাকে চিনলি তুই। আহা মানুষটার কি আর মাথার ঠিক আছে?

    অরুণ কিছু বলে না, হঠাৎ কোথা থেকে যেন ওর বউ এসে পড়ে নরম গলায় বলে, মাথার তো কোনও বেঠিক দেখি না। মাথা ঠিকই আছে। আপনার উপরই কেমন যেন একটা আক্রোশ–

    আমি কি চেঁচিয়ে উঠব?

    আমি কি ধমকে উঠব?…

    না দেয়ালে মাথা ঠুকব আমি?

    না কি আমার সেই চিরদিনের যত্নে লালিত বস্তুটিকে ভোগ করব এবার?

    প্রিয়মাধবের ছেলে কৃতী হয়েছে, সে তার বাপের জন্যে নার্স রাখতে পারবে।

    .

    আশ্চর্য! এত পরিশ্রম এত অনিয়ম, তবু তো একদিনের জন্যে একটু অসুখ করছে না?

    আমার মা-বাপের কোনও ফটো নেই, ফটো নেই পিসির। থাকলে এ বাড়িরই কোনও ধূলিধূসরিত দেয়ালে রং জ্বলে ঝাপসা হয়ে ঝুলত।

    কারণ সিকদার বাগানের এই জরাজীর্ণ খাঁচাটা থেকে তো মুক্তি হয়নি আমাদের বাড়ি করব বাড়ি করব করতে করতেই তো প্রিয়মাধব পড়ে গেল।

    ছবি নেই, তবু দেয়ালের ইটগুলো তো আছে। তাদের মধ্যে কি লুকোনো থাকে না আত্মা?

    আছে ভেবেই বলি, তোমাদের এই যমজের আধখানা মেয়েটাকে কি লোহা দিয়ে গড়েছিলে?…তাই এত দুর্গতিতেও মরে না, অসুখ করে না।

    কিন্তু একবার একটু অসুখ না করলে ওদের চোখে ধুলো দেব কী করে আমি? যাবার সময় কি হেয় হয়ে যাব আমি? হার মেনে চলে যাচ্ছি বলে দলিল রেখে যাব?

    না না, কিছুতেই না।

    আমি মানুষের মতন অসুখ করে মরে গেলাম, এ প্রমাণ রাখতে হবে।

    দিদির চেয়ে বোকা হব নাকি আমি?

    দিদি চালাকি করে আমার থান কাপড় চুরি করে নিয়ে পালিয়েছিল, নিজের সমস্ত বোকামি আর দুর্বলতা ওই থানখানার আড়ালে লুকোতে চেয়েছিল।

    আমিই বা কেন সারাজীবনের জীবনান্তকর ফসল নিজের হাতে আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে যাব?…

    সামান্য একটু অসুখও আমার কাছে এত দুর্লভ?

    আশ্চর্য!

    আশ্চর্য!

    আমি মরে যাচ্ছি। আমি চলে যাচ্ছি।

    প্রিয়মাধবকে শেষ পর্যন্ত সেবা করা আর হল না আমার। চাবিটা ওকে দিয়ে যাব। খাতাটা ও পোড়াতে বলে, পোড়াতে পারব না। ওই খাতার মধ্যে নমিতা নামের সেই মেয়েটা আছে বেঁচে।

    হেমন্ত উকিলের ভাইয়েরা তো তিরিশ বছর আগে তার শ্রাদ্ধ করে সেরে রেখেছে। আর নিশ্চয় লোকের কাছে বলে বেড়িয়েছে, ঢের বারণ করেছিলাম, জোর করে চলে গেলেন। বোন-ভগ্নিপতির নতুন শখের জীবন, ওঁকে কে বা দেখেছে, কে বা যত্ন করেছে? এখন মরলেন তো? কিনা একটা বিষপোকার কামড়ে। অপঘাত আর কাকে বলে!

    তবে?

    নমিতা মুছে যাবে?

    নমিতা রইল এই খাতার পাতায়।

    .

    খাতাটা মুড়ে রাখল নীহার।

    দেখল, রাত তিনটে!

    সময়ের জ্ঞান হারিয়ে এতক্ষণ ধরে এই কাঁচা হাতের উপন্যাসখানা পড়ছিল সে?

    অরুণমাধবের মায়ের নাম সুমিতা, সে কথা শুনেছিল সে। ওঁর একজন যমজ বোন ছিল, যার নাম নমিতা, তাও শুনেছিল। কিন্তু কে ভেবেছিল তাঁরা অদ্ভুত এক উপন্যাসের নায়িকা।

    কিন্তু এই নায়িকাদের বধ করতে হবে নীহারকে।

    নীহার যাঁর মাইনে খেয়েছিল, সেই প্রিয়মাধবের আদেশ পালন করতে হবে তাকে। নমিতা নামের ওই নায়িকাটি পৃথিবী থেকে মুছে যাবে? যাক না!

    ক্ষতি কী?

    গিয়েই তো ছিল।

    নতুন করে আবার উদঘাটন করে লাভ কী? সত্যি খবর জেনে অরুণমাধব তার সত্যি মাকে খুঁজে বেড়াবে?

    তিরিশ বছর ধরে কি সত্যিই টিকে আছেন তিনি এই পৃথিবীতে? যদি থাকেন, ছমাসের যে ছেলেটাকে ফেলে রেখে গিয়েছিলেন তিনি, তাকে কি আবিষ্কার করতে পারবেন ওই তিরিশ বছরের বিবাহিত পুরুষটির মধ্যে?

    নমিতা, সুমিতা এবং প্রিয়মাধবের মধ্যেকার এই উপন্যাস অতএব খতম।

    আমি খতম করার কে?

    আমি নিমিত্ত মাত্র।

    .

    সকালবেলা

    অরুণমাধব শুকনো মুখে এসে প্রশ্ন করল, মিস ঘোষ, কিছু যদি মনে না করেন তো একটা কথা বলছিলাম–

    বলুন।

    আচ্ছা, বাবার ঘরের ওই আলমারিটা সেদিন যখন খুলেছিলাম, দেখেছিলেন আপনি?

    খুলেছিলেন তো। আমার সামনেই তো খুললেন।

    আচ্ছা, একটা জিনিস ছিল দেখেছিলেন?

    মিস ঘোষ নিজ পদমর্যাদায় ফিরলেন।

    মিস ঘোষ বললেন, এই প্রশ্নটা কি বেশ শোভন মনে হচ্ছে আপনার অরুণবাবু?

    অরুণমাধব অপ্রতিভ হল।

    অরুণমাধব কুণ্ঠিত গলায় বলল, আমি অন্য কিছু মনে করে বলিনি মিস ঘোষ, মানে দেখেছিলেন কিনা?

    দেখেছিলাম। আলমারিটা খুলেছিলেন, দেখেছিলাম।

    একটা মোটামতো খাতা ছিল দেখেছিলেন।

    খাতা! তবু ভাল।

    নীহার হেসে উঠল, আমি ভাবলাম টাকাকড়ি গয়নাপত্তর। কীসের খাতা? ব্যাঙ্কের পাশবই নয় তো?

    না না, মনে হল যেন একটা অর্ডিনারি খাতা

    সাংসারিক আয়-ব্যয়ের?

    কীসের তাই তো জানি না ছাই! অথচ বেশ মনে রয়েছে, দেখেছি।

    নীহার এবার তীক্ষ্ণ হবে, আপনার কি ধারণা, আপনার বাবার কোনও একখানি অমূল্য খাতা আপনার বাবার নার্স সরিয়ে ফেলেছে?

    ছি ছি, এ আপনি কী বলছেন মিস ঘোষ?

    কিন্তু আপনি তো তা ছাড়া আর কিছু বলছেন না। খাতাটা ছিল, খাতাটা নেই। আলমারি খোলার সময় আমি ছিলাম, আর কেউ ছিল না। অতএব

    আমার অন্যায় হয়ে গেছে মিস ঘোষ, আমায় মাপকরবেন। আপনাকে পরিবারের আত্মীয়ের মতো মনে করি বলেই বলছি, বাবার মৃত্যুকালের প্রলাপের সঙ্গে ওই খাতার কোনও যোগ আছে মনে হচ্ছিল আমার।

    আপনার ভুলটা কোথায় জানেন অরুণবাবু? রোগীর প্রলাপকে গুরুত্ব দেওয়া। ব্রেন যখন অকেজো হয়ে যায়, কত অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বেরোয় তা থেকে, ধারণা নেই আপনার, তাই অত ভাবছেন। আজীবন ব্রহ্মচারী সাধু-মহাত্মার প্রলাপোক্তি শুনে অনেক সময় কানে আঙুল দিতে হয়, চিরদিনের শান্ত সভ্য নম্র ব্যক্তির প্রলাপোক্তি অনেক সময় ভাবিয়ে অবাক করে দেয়, এ সব গালমন্দ ভদ্রলোক শিখলেন কখন? প্রলাপ নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।

    কিন্তু খাতাটা–

    আমার সুটকেস খুলে দেখুন!

    নীহার জানে, খুলবে না সুটকেস।

    তাই নীহার স্বচ্ছন্দে বলে, খুলুন সুটকেস!

    হয়তো অরুণমাধব আর তার স্ত্রী, ওই মুহূর্তের দেখা খাতাখানা নিয়ে নীহারকেই সন্দেহ করবে। হয়তো চিরদিনই নিজেরা বলাবলি করবে, আর কারও নয়, ওই মিস ঘোষেরই কাজ। ভূতে তো উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে না? তবু ভদ্রতা বজায় রাখবে।

    সে সন্দেহ ঘাড়ে নিয়েই বিদায় নেবে নীহার।

    অরুণমাধব বলেছে, আপনি আমাদের পরিবারের বন্ধুর মতো।

    বন্ধুর কাজই করবে নীহার।

    অকারণ লোকটার মনটা কালিমাখা হতে দেবে না।

    কী এসে যাবে যদি অরুণমাধবের জীবনে সুমিতা এবং নমিতার রহস্য অনুদঘাটিতই থাকে?

    নীহার এই রহস্য কাহিনী ভুলে যাবে।

    নীহার খাতাটা পুড়িয়ে ফেলে ভাববে, আমি যাঁর মাইনে খেয়েছি তাঁর আদেশ পালন করেছি।

    অরুণমাধবও ভুলে যাবে।

    অরুণমাধব ভাববে, প্রলাপ প্রলাপই। ভাববে খাতাখানা বোধহয় চোখের ভ্রম।

    নমিতার আত্মা কি প্রেত হয়ে নীহারের ঘাড়ে চাপবে? নিজের মনে হেসে ওঠে নীহার।…

    এই পৃথিবীতে কত জীবন কত ভাবে অপচয় হচ্ছে, কত ধ্বংস হচ্ছে, কত দীর্ঘনিশ্বাস ঘুরে মরছে। পৃথিবীর বাতাসে। প্রিয়মাধব নামের একটা লোককে ঘিরে দুটো মেয়ের দীর্ঘশ্বাস যদি উদ্বেল হয়েই থাকে কখনও, সে নিশ্বাস বাতাসে বিলীন হয়ে গেছে। ওদের গাড়ি এসেছে, ওরা চলে গেছে।

    যারা আছে, তারা সুখে থাক, স্বস্তিতে থাক।

    নীহার ওদের পরিবারের বন্ধু।

    আগুন জ্বালো, আগুন জ্বালো…
    জীর্ণ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে দিয়ে আগুন জ্বালো।

    গুনগুন করে গান গাইছিল নীহার। খাতাখানা পুড়ছিল।

    এই কাগজ পোড়া গন্ধ আর ধোঁয়া অরুণমাধবের কাছ পর্যন্ত পৌঁছবে না, কারণ এটা নীহারের বাসা।

    কিন্তু তবু ধোঁয়া থেকে কি রক্ষা পাবে অরুণমাধব?

    প্রিয়মাধবের সেই শেষ কথা কি ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে রাখবেনা তার বাকি জীবনটা? প্রিয়মাধব ওকে কখন ঠকালেন সে কথা ভাববে না ও বাকি জীবন?

    আর ভাবতে ভাবতে মনে পড়বে না অরুণমাধবের, তার মা আর বাবার দাম্পত্য জীবনের অস্বাভাবিকতা?

    উত্তরা তার শ্বশুর শাশুড়ির এই বুড়ো বয়েসের প্রেমের গভীরতা দেখে ঠোঁট উলটেছে, কিন্তু সত্যিই কি ছিল সেই গভীরতা?

    এখন ভাববে অরুণমাধব।

    তার ছেলেবেলার স্মৃতি থেকে প্রত্যেকটি দিনের কথা আর ঘটনা মনে আনবে।

    ভাবতে ভাবতে অবাক হয়ে যাবে, আর মনে করবে, কী আশ্চর্য, আমার কেন সন্দেহ হয়নি?

    ভাববে, অথচ সন্দেহ করবার তো ছিল।

    বরাবর তো মাকে আমি আলাদা ঘরে শুতে দেখেছি। যখন অসুখে পড়লেন বাবা, তখন থেকেই শুধু–দিন দুই পরে প্রিয়মাধবের যখন জ্ঞান হয়েছিল, প্রিয়মাধব যে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, এ ঘরে কার বিছানা? কে শোবে এখানে? সে কথাও মনে পড়বে অরুণমাধবের। মনে পড়বে অরুণমাধব যখন বলেছিল, উত্তেজিত হচ্ছ কেন বাবা? ডাক্তার উত্তেজিত হতে বারণ করেছে। রাত্রে তোমায় দেখতে হচ্ছে বলে মা এখানে

    তখন প্রিয়মাধব বলে উঠেছিল, ওঃ সেবার জন্যে! রোগীর সেবার জন্যে। দয়াবতী নার্স! এখন আর ভয় নেই বলে?

    তন্নতন্ন করে প্রতিদিনকার কথা ভাবলে অনেক কথা মনে পড়বে অরুণমাধবের, আর বুঝতে পারবে প্রলাপেরও অর্থ থাকে।

    বুঝতে পারবে, সুমিতা তার মা নয়। কিন্তু কে তবে মা অরুণমাধবের?

    না, সে রহস্য কোনওদিন ভেদ করতে পারবে না অরুণমাধব।

    নার্স নীহার ঘোষ তার বন্ধুর কাজ করেছে।

    পুড়িয়ে ফেলেছে তার মার জীর্ণ প্রাণের আবর্জনা।

    খাতাটা যে নীহার ঘোষ সরিয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই অরুণমাধবের।

    কিন্তু কেন? সেইটাই বোঝবার উপায় নেই।

    বলেছিল, রাত থেকে প্রলাপ শুরু হয়েছিল, অনেক গোপন কথাই উনি বলেছেন আমায়।

    কে জানে কী সেই গোপন কথা?

    নীহার ঘোষের মুখ থেকে বার করা যাবে না সে কথা।

    যখন দূরের গাড়ির ঘণ্টা নিকটবর্তী হয়ে এসেছিল, যখন প্রিয়মাধব নামের মানুষটা তার অহংকার আর আভিজাত্য নিয়ে পৃথিবীকে গুডবাই করে চলে যাবার জন্যে পা বাড়িয়েছিল, তখন এমন অদ্ভুত ইচ্ছে হল কেন তার?

    কেন মনে করল সেই অদ্ভুত ইচ্ছের মানুষটা, আদরের ছেলেটাকে সারাজীবন ধরে কী ঠকানো ঠকিয়ে এসেছি তার হিসেব দিয়ে যাই।

    কেন মনে হল ওই হিসেব দেওয়াটার অভাবেই তাঁর গাড়ি আসছে না।

    কিন্তু গাড়ি তো একদিন আসবেই।

    কোনও ক্ষতিই কি হত প্রিয়মাধবের, যদি ওই হিসেবটা তাঁর ছেলের কাছে দাখিল না করতেন?

    না, বাইরে থেকে এখনও কোথাও কোনও ক্ষতি দেখা যাচ্ছে না।

    অনেকদিন পড়ে ছিলেন প্রিয়মাধব, তাই অনেক ঘটা করে শ্রাদ্ধ হল তাঁর।

    উত্তরার মা এলেন। শ্রাদ্ধের গোছ করতে।

    জামাইয়ের প্রাণ মুচড়োনো ভাষায় বলতে লাগলেন, তোমার মায়ের কাজ উদ্ধার করে দিয়ে গিয়েছিলাম বাবা, আবার তোমার বাপের কাজ উদ্ধার করতে এলাম। আহা, সে তো তবু সতীরানি ভাগ্যিমানী, চলে গেলেন। এ যে তোমার বড় কষ্ট, যার নাম উপতৃশোক।

    মেয়েকে বললেন, ওরে তোর শাশুড়ির ছবিখানা নামিয়ে এনে শ্বশুরের ছবির পাশে বসিয়ে দে। দুগাছি মালা পরিয়ে দে দুখানি ছবিতে। বেঁচে থাকতে যেমন জোড়ের পায়রাটি ছিলেন, মরলেও তেমনি দেখাক।

    মায়ের বাধ্য মেয়ে উত্তরা তার শাশুড়ির শ্রাদ্ধের সময় যে বড় ফটোটা করানো হয়েছিল, সেইখানা নামিয়ে এনে শ্বশুরের সম্প্রতিকার ছবির পাশে বসিয়ে দিল।

    মালা পরিয়ে দিল দুগাছা।

    বড় একটা সিঁদুরের টিপ পরিয়ে দিল শাশুড়ির ছবির কপালে।

    শ্রাদ্ধে অনেকের সঙ্গে নার্স নীহার ঘোষকেও নেমন্তন্ন করা হয়েছিল। সে তাকিয়ে দেখল এইসব সাজ আর সমারোহ। ভাবল, এই নার্সের জীবনে কত মৃত্যুই দেখলাম! কত ফুলের মালাও দেখলাম। তার মূল্যও জানলাম।তারপর উত্তরার কাছে গিয়ে আমুদে গলায় বলল, দেখলেনতো? বলেছিলাম–আপনার শ্বশুরের শ্রাদ্ধের ভোজ খেয়ে তবে যাব। কথা রাখলাম কিনা?

    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Article৫. অন্য সুর
    Next Article প্রবন্ধ সংগ্রহ – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    আশাপূর্ণা দেবী

    বিবাগী পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    কুমিরের হাঁ – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ঠিকানা – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ততোধিক – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ১. খবরটা এনেছিল মাধব

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }